লন্ডনে এক লবযুবক

Sptalfields Fleamarket, London

 কাজ থেকে অবসর নিয়ে লন্ডনে এসে ভেবেছিলাম এখন আমার স্বাধীন জীবন, লম্বা ছুটি, যা ইচ্ছে করে বেড়াবো, যেখানে ইচ্ছে যাবো, কি মজা!

লন্ডনে কত কি করার আছে, দেখার আছে…

কিন্তু ব্যাপারটা আদপেই তা হচ্ছেনা।

বিভূতিভুষণ মুখোপাধ্যায় এর বরযাত্রী তে একটা গল্প ছিল যেখানে গনশার দল নদীর ধারে একটা মেলায় ব্যাজ পরে ভলন্টিয়ারের কাজ করছে, কিন্তু কোন সেরকম বিপদ আপদ ঘটছেনা তাই তাদের কাজও নেই। হঠাৎ তারা দেখলো একটি ছোট মেয়ে নদীর ধারে চুপ করে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তারা গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে খুকী? কথায় কথায় জানা গেল, তার দিদিমা নদীতে স্নান করতে গেছে, অনেকক্ষণ হয়ে গেল, এখনো ফিরছেনা।

সর্ব্বনাশ, গনশা বললো এ তো জলে ডোবা কেস। তারা মেয়েটির কাছে রাজেন কে রেখে গেল পুলিশে খবর দিতে, এতক্ষণে একটা ভাল কাজ পাওয়া গেছে। ওদিকে রাজেন মেয়েটিকে মন ভোলাবার জন্যে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।

“দিদিমার তো অনেক বয়েস হয়েছিল খুকী, আর দিদিমারা তো কারো চিরকাল থাকেনা!”

তার এই সান্ত্বনা শুনে মেয়েটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। এদিকে ওদের ঘিরে আস্তে আস্তে একটা ভীড় জড়ো হচ্ছে।

বিভূতিভুষণ লিখছেন, “ভীড়ের ভিতর হইতে একটি গ্রাম্য লোক মন্তব্য করিলো, দিদিমা আর কার লবযুবতী থাকে বাবু?”

—-

গল্পের সেই দিদিমার মত আমিও আর লবযুবক নই, এই কথাটা মাঝে মাঝেই খেয়াল হয় আজকাল।

লন্ডনের রাস্তায় বেরিয়ে লাল রং এর ফাঁকা দোতলা বাস গুলো দেখে বড্ড ইচ্ছে করে London Transport এর  একটা All day card কিনে এক লাফ দিয়ে পাদানী তে উঠে পড়ি, তারপরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আরাম করে বসে চলন্ত বাস থেকে শহরের রাস্তাঘাট ঘরবাড়ী বাগান দোকানপাট দেখতে দেখতে যেদিকে দু’ চোখ যায় চলে যাই।

অথবা ওয়েম্বলী কিংবা এমিরেটস স্টেডিয়াম এ গিয়ে প্রিমিয়ার লীগে আর্সেনাল বা এভার্টন এর ফুটবল খেলা দেখে আসি। লর্ডস বা ওভাল এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর সাথে ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, এক রবিবার সারাদিন কাটিয়ে আসতে খুব ইচ্ছে করে।

Garrick  Theatre  এ John Osborne এর  The Entertainers এ Sir Kenneth Branagh অভিনয় করছেন, তাঁর অভিনয় দেখার জন্যে সব টিকিট এক মাস আগে থেকে বিক্রী হয়ে যায়, এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে ইচ্ছে করে ছাতা মাথায় গিয়ে টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। কিংবা South Bank এ Globe এ Theatre Repertory র King Lear হচ্ছে, Shakespeare এর শহরে এসে এই সু্যোগ কি ছাড়া উচিত?

কিন্তু সে সব আর কিছুই হবার নয়। এই সব ইচ্ছে শেষ পর্য্যন্ত অপূর্ণই থেকে যায়।

কম বয়সের সেই বেপরোয়া লাগামহীন স্বাধীন জীবন আমি হারিয়েছি।

লন্ডন Underground ট্রেণে উঠে ভীড়ের মধ্যে আমায় দেখে তরুণ যুবক যুবতীরা আমায় তাদের সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, আমার বেশ অস্বস্তি হয়। বলতে ইচ্ছে করে আরে না না আমি তত কিছু বুড়ো হইনি, তোমরা বোসো, আমি ঠিক আছি। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত বসতেই হয়। বহু Tourist attraction spot এ ভেতরে ঢোকার জন্যে টিকিট কাটার সময়ে আমায় দেখে কাউন্টার এর লোকেরা জিজ্ঞেস করে তুমি কি OAP?

প্রথম দিন আমি আমার মেয়ে (পুপু) কে জিজ্ঞেস করলাম, OAP মানে কি রে?

OAP মানে হল Old age pensioner, তার মানে আমার টিকিট লাগবেনা, অথবা half price…

মনে মনে এখনো  লবযুবক হলে কি হবে, এখন বাইরের সবার চোখে আমি বেশ বুড়োই।   

বিশেষ করে আমার দুই মেয়ের চোখে আমি এখন খুব fragile, এবার লন্ডনে এসে দেখছি পুপু আমার শরীর আর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভীষণ চিন্তিত আর সাবধানী। প্রতি সপ্তাহে আমার প্রেশার চেক করছে, প্রেশার আর কোলেস্টরলের ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছি কিনা খোঁজ নিচ্ছে। ভিটামিন ডি আর ক্যালসিয়াম এর ওষুধ কিনে দিচ্ছে। ওগুলো নাকি আমার এখন খাওয়া উচিত।

আর সবসময় উপদেশ। এটা করো। সেটা কোরোনা। কোথাও বেড়াতে গেলে স্যুটকেস তুলবেনা। পিঠে লেগে যাবে, আমি তুলছি।  সিঁড়ি বা escalator দিয়ে ওঠানামা করার সময় হাতল ধরে থাকো। বাথরুমে পিছলে পড়ে যেওনা, সাবধান! 

রোজ সকাল বেলা বাড়ীর কাছে একটা দোকানে খবরের কাগজ কিনতে যাই, আর বিকেলে বাড়ীর কাছে রাস্তায় একটু হেঁটে আসি, কিন্তু পুপু পারতপক্ষে আমায় একা ছাড়তে চায়না। আর আমার সাথে বেরোলে সবসময় তার শাসন শুনতে হবেই। ফাঁকা সরু রাস্তা, আমি অনায়াসে এক লাফে ক্রস করে যেতে পারি।  হয়তো বহু দূরে একটা  গাড়ী দেখা যাচ্ছে, যেই রাস্তায় পা রেখেছি, অমনি শুনতে হবে, আঃ বাবা, ফুটপাথ দিয়ে হাঁটো, গাড়ী আসছে, দেখছোনা?

এখন ছুটির দিনে আমি পার্কে গিয়ে বসে থাকি। মেয়ে আর নাতনীরা জগ্‌ করে, সাইকেল চালায়, সুভদ্রা হাঁটে, আর আমি চুপ করে একটা বই নিয়ে বেঞ্চে বসে থাকি। গা জোড়ানো ঠান্ডা বাতাস বয়, পিঠে অল্প রোদ এসে পড়ে, চারিদিকে বহু গাছ, সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ, শান্ত পরিবেশ, বেশ লাগে।

স্নেহ নিম্নগামী বলে একটা কথা আছে না? আমার মেয়েরা দু’জনেই এখন মা হয়েছে, আমিও কি এখন তাদের কাছে সন্তানের মতোই?

কি জানি।

কিন্তু সত্যি বলতে কি আমায় নিয়ে আমার মেয়েদের এই fussing আমার বেশ লাগে।

ওরা আমার লবযুবক না হবার দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

এর মধ্যে আমরা একদিন Whitechapel এ Spitalfields নামে একটা Street Market এ গিয়েছিলাম। লন্ডনের নানা জায়গায় এরকম অনেক Street Market আছে, Covent Garden, Greenwich, Notting Hill, এই সব মার্কেটে অনেক খাবার স্টল, লোকেরা বাইরে টেবিল চেয়ারে বসে খাচ্ছে, নানা দোকানের স্টল, সেখানে কেনাকাটা চলছে, সারা জায়গাটা গমগম করছে, যেন একটা উৎসবের পরিবেশ। 

তো আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, দোকানে দোকানে। কোথাও জামাকাপড়, কোথাও গয়নাগাঁটি। কোথাও পুরনো রেকর্ড, এক কি দুই পাউণ্ডে সেকেণ্ড হ্যান্ড বই। না কিনলে শুধু দেখেই চোখের বেশ সুখ হয়। একটা দোকানে দেখলাম অনেক মজার মজার poster টাঙানো। একটা তে লেখা “I do not need Google. My wife knows everything”, অন্য আর একটা তে বেড়াল কোলে একটা মেয়ের ছবি, তলায় লেখা “My husband said it is either the cat or me. I miss him sometimes…”

সুভদ্রা আর পুপু দরদাম করে কিছু কেনাকাটাও করছে, নাতনীদের জন্যে টপ, দীপের (জামাই) জন্যে টি শার্ট।

হঠাৎ একটা দোকানে দেখলাম সুন্দর ডিজাইনের Cosmetic jewellery – চেন আর লকেট – সাজিয়ে রাখা আছে, তা দেখে পুপুর খুব পছন্দ হয়ে গেল।  দামও বেশী নয়, মাত্র পনেরো পাউন্ড। আমাদের সাধ্যের মধ্যে।

কিন্তু পুপু নিজের জন্যে কিনতে ইতস্ততঃ করছে দেখে আমি বললাম এটা আমি তোকে কিনে দেবো। বোধহয় আমি পুপুকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম, কিংবা কাঁধে হাত রেখেছিলাম, ঠিক মনে নেই, এই ধরণের public show of affection এ দেশে খুব normal…

দোকানের অল্পবয়েসী  মেয়েটি (তাকে দেখে আর তার উচ্চারণ শুনে তাকে East European বলে মনে হয়)  আমাদের হাসিমুখে লক্ষ্য করছিল, পুপু তাকে বলল আমার বাবা আমায় এই লকেটটা present করবে বলছে।

মেয়েটির হাসিমুখ অল্পের জন্যে যেন কিছুটা মেঘলা হয়ে গেল, আর তার চোখ দুটো যেন একটু  ছলোছলো ! খুব ধরা গলায় সে বলল জানি, তোমার বাবা কে দেখে আমার নিজের বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে ! তোমায় আমি পাঁচ পাউন্ড কমিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমায় দশ পাউন্ড দিও।

এ কি রে?

“না না, তা কি করে হয়” বলে আমরা খুব অপ্রস্তুত হয়ে আপত্তি জানালাম। কিন্তু মেয়েটি আমাদের কথায় কান দিলোনা, সে অবিচলিত।

শেষ পর্য্যন্ত তাকে দশ পাউন্ড দিয়ে পুপু বলল “Thank you, you are very kind…”

না, আমি আর লবযুবক হতে চাইনা। এই বেশ আছি ~