আমাদের ছোটবেলায় কর্পোরেশন থেকে আমাদের বাড়িতে রবিবার বা কোন ছুটির দিন সকালে এক ভদ্রলোক এসে হাজির হতেন বছরে দু’বার। একবার আমাদের বসন্তের টীকা আর একবার আমাদের TABC ইঞ্জেকশন দিতে। তাঁকে বেশ মনে পড়ে। মাথায় অল্প টাক, পরনে ধুতি পাঞ্জাবী, চোখে চশমা, হাতে একটা ব্যাগ, তার মধ্যে ইঞ্জেকশন এর এম্পুল, সিরিঞ্জ, টীকা দেবার নানা সরঞ্জাম। মুখে হাসি নেই, বেশ গম্ভীর, দেখলেই ভয় পাবার মতো চেহারা।
তিনি এলেই সারা বাড়ীতে বেশ একটা হুলুস্থূল পড়ে যেত। উনি বড় বারান্দার গোল টেবিলে ব্যাগ থেকে তাঁর জিনিষপত্র সব বের করে রাখতেন, আর আমরা সবাই এক এক করে লাইন দিয়ে টীকা বা ইঞ্জেকশন নিতাম।
টীকা টা একটা যন্ত্র দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাঁ হাতের মাঝখানে দেওয়া হতো। মাঝে মাঝে সেটা পেকে গিয়ে বেশ যন্ত্রণা হতো। আর TABC ইঞ্জেকশন এর পর হাতে যা প্রচন্ড ব্যথা হতো, অন্ততঃ দু দিন তার পর হাত তুলতে পারতামনা।
TABC র নাম আমরা দিয়েছিলাম “টাইফয়েড, আমাশা, বসন্ত, কলেরা।”
সেই পঞ্চাশের দশকে বসন্ত রোগ নির্মূল হয়নি, আর টাইফয়েডও বেশ কঠিন রোগ ছিল, সুতরাং খারাপ লাগলেও বা ভয় পেলেও আমাদের টীকা আর ইঞ্জেকশন নিতেই হতো, আপত্তি করার সুযোগ ছিলনা। জ্যেঠিমা, মা কাকীমারা ও নিতেন। বাবা কাকাদের নিতে দেখিনি, ওনারা ছুটির দিনে কেউ বাড়িতে থাকতেন না সকালে, সেই জন্যেই হয়তো।
তখন তো আজকের মতো AIDS এর প্রাদুর্ভাব হয়নি, ইঞ্জেকশনের ছুঁচ থেকে রোগের সংক্রমণ এর কথা তখন বোধ হয় কেউ ভাবতোনা, disposable syringe ও তখন চালু হয়নি। একটা কাপের মধ্যে গরম জল আর disinfectant spirit এ ছুঁচ ডুবিয়ে তুলো দিয়ে মুছে আবার পরের জনের ওপর ব্যবহার করা হতো।
এই ব্যবস্থা এখনো কলকাতায় চালু আছে কিনা জানিনা। হয়তো নেই। এখন বোধহয় ছেলেমেয়েরা immunization এর ইঞ্জেকশন নিতে হাসপাতালে যায়।
পরে মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ির পাশে ডক্টর মৃণাল দত্ত তাঁর চেম্বার খোলেন। মৃণাল বাবুর কম্পাউন্ডার ছিল একটি বেঁটে খাটো লোক। সেই লোকটি দারুণ ভালো ইঞ্জেকশন দিতো, ইঞ্জেকশন দিয়ে সে পাড়ায় এমন নাম করে ফেলেছিল যে পাড়ায় কারুর ইঞ্জেকশন দেবার দরকার পড়লেই তার ডাক পড়তো। আমাদের বাড়িতেও একে ওকে ইঞ্জেকশন দেবার জন্যে সে লোক টি প্রায়ই আসতো।
তার আসল নাম টা আমরা কেউ জানতাম না, ভালোকাকীমা তার নাম দিয়েছিলেন “ফুটুবাবু”। শেষ পর্য্যন্ত আমাদের কাছে সে ফুটুবাবুই থেকে যায়।
একবার কাকে একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে, তাই আমাদের কাজের লোক সীতা কে পাঠানো হলো ডক্টর দত্তের চেম্বারে ফুটুবাবুকে ডেকে আনতে। সীতা সেখানে গিয়ে “ফুটুবাবুকে একবার আমাদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিও” বলাতে তাকে সবাই বলেছিল “এখানে ফুটুবাবু বলে কেউ নেই।”
আজ এই অতিমারীর যুগে ফুটুবাবু থাকলে তাঁর যে খুব কদর হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। White Tiger উপন্যাসের সেই ড্রাইভার ছেলেটি যেরকম ড্রাইভারদের নিয়ে একটা বিশাল ব্যবসা শুরু করেছিল, সেরকম ফুটুবাবুও অনেক ছেলেমেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে তাঁর অফিসে নিয়ে ভ্যাক্সিনেশনের একটা বড় ব্যবসা শুরু করে দিতে পারতেন।
অতিমারীর কল্যাণে তাঁর ও জীবনের ভোল পালটে যেত।
জানিনা সেটা শেষ পর্য্যন্ত ঘটেছে কিনা।
লেখার গুণে ফুটুবাবু যেন জীবন্ত রূপ ধারণ করে পাঠকের সামনে হাজির হন। তার সঙ্গে ফুটে ওঠে অর্ধশতাব্দী আগের মধ্যবিত্ত বাঙালীর সামাজিক চালচিত্র।
LikeLike
Thanks Tope. Always appreciate your comments.
LikeLiked by 1 person
Amader barite eta hoto Good Friday o Christmas. Thanks for bringing back memories.
LikeLike
😀
LikeLike