অন্ধ ধোপা

মনোহরপুকুরে আমাদের ছোটবেলায় একজন ধোপা বাড়ী তে কাপড় নিয়ে আসত, তার একটা চোখ অন্ধ, সব সময় বোঁজা থাকতো – তাকে কি কারুর মনে আছে?

ছোটখাটো মানুষটি, কাঁধে একটা বিশাল ভারী কাপড়ের বস্তা নিয়ে সে সামান্য কুঁজো হয়ে আমাদের পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত।

আমাদের বাড়ীতে কাপড় দিতে আর নিতে সে আসতো সন্ধ্যাবেলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে   আলোর নীচে বারান্দায় এসে কাঁধ থেকে কাপড়জামার স্তূপ নামিয়ে সে উবু হয়ে বসতো। মা জ্যেঠিমা কাকীমা রা সবাই এসে নিজের নিজের কাপড় জামার হিসেব মিলিয়ে নিতেন।

ভালোকাকীমা র কাজ ছিল একটা মোটা ধোপার খাতায় সব হিসেব লিখে রাখা।

মাঝে মাঝেই হিসেব মিলতোনা।

তখন ওই ধোপা বেচারা  মা কাকীমাদের কাছে solid বকুনি খেতো। কাপড় কম হলে তো বটেই, এমন কি কাপড় কয়েকটা বেশী এসে গেলেও মা রা মনের সুখে তাকে বকতেন আর সে মুখ বুঁজে বকুনী খেয়ে যেত। “হাঁ মাইজী, নেহী মাইজী” ছাড়া তার মুখে কোন কথাও শুনিনি কোনদিন।

বাবুরাম সাপুড়ের সেই বিখ্যাত সাপের মতোই নিরীহ নির্ব্বিবাদী লোক ছিল আমাদের সেই অন্ধ ধোপা।

 ২

একবার ছোটকাকীমা দুই দিন পরে দানাপুর যাবেন, তাঁর একটা শাড়ী ধোপার কাছে পড়ে আছে, সেই শাড়ি টা তার এতদিনে দিয়ে যাবার কথা, কিন্তু সে আসেনি, আমার ওপর ভার পড়ল ধোপার বাড়ী গিয়ে সেই শাড়ী নিয়ে আসার।

খুঁজে খুঁজে এক পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে পৌঁছলাম ধোপার আস্তানায়। জায়গাটা হলো দেওদার স্ট্রীট। হাজরা রোড আর বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের মাঝামাঝি,  ডোভার রোড দিয়ে  ঢুকতে হয়।  

একটা অন্ধকার সরু গলি র দুই পাশে ঘন বস্তী, অন্ধকার হয়ে আসছে, রাস্তায় ম্লান আলো।  বাচ্চারা খেলছে, তাদের কলরব, সব মিলিয়ে একটা নোংরা, ময়লা পরিবেশ, এখানে আমাদের কাপড় কাচা হয়?

বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের ওই upmarket locality র একদম পাশে ধোপাদের ওই বস্তী দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম মনে পড়ে।

শেষ পর্য্যন্ত সেই অন্ধ ধোপার ঘর খুঁজে পেয়েছিলাম। সে আমায় দেখে খুব লজ্জিত হয়েছিল, যতদূর মনে পড়ছে শরীর খারাপ বলে সে আসতে পারেনি আমাদের বাড়ি। ছোটকাকীমার শাড়ীটা আমায় সেদিন দিয়েছিল কিনা, অথবা পরের দিন দিয়ে এসেছিল কিনা তা আর এখন মনে পড়েনা।

কিন্তু সেই অন্ধ ধোপা কে ভুলিনি। তার নিজের থেকেও ভারী কাপড়ের বিশাল বস্তা নিয়ে ছোটখাটো মানুষটার অল্প কুঁজো হয়ে পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আমাদের বাড়ীর বারান্দায় মা কাকিমাদের সামনে উবু হয়ে বসে তার চুপ করে বকুনি খাওয়া, নোংরা বস্তীর মধ্যে তার অন্ধকার ছোট ঘরে হঠাৎ আমায় দেখে অপ্রস্তুত হওয়া, এই সব এখনো ছবির মতো মনের মধ্যে রয়ে গেছে।