
আমাদের ছোটবেলায় পঞ্চাশের দশকে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ছোটদের গোয়েন্দা উপন্যাস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। জন্মদিনে আমরা এই সব বই (“যখের ধন”, “আবার যখের ধন”, “নীল পত্রের রক্ত লেখা”) উপহার পেতাম, আর গোগ্রাসে গিলতাম।
সেই সব উপাদেয় গল্পে মোটাসোটা পুলিশ অফিসার সুন্দরবাবুকে তোমাদের মধ্যে যারা আমার সমবয়েসী তাদের মনে আছে নিশ্চয়। সেই পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু কে হেমেন্দ্রকুমার বেশ একটা কমিক (হাসির) চরিত্র করেই উপস্থিত করেছেন তাঁর গল্পে। তিনি জয়ন্ত আর মাণিকের বাড়ী তে এসে ডিমের “মামলেট” খেতেন আর কথায় কথায় “হুম” বলতেন।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি আর এই সব বই পড়ে? বোধহয় না।
আমার এই লেখাটি অবশ্য অন্য একজন সুন্দরবাবুকে নিয়ে।
কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছিলাম JEE Entrance Application form এর সাথে ছবি তে অনেকে নানা ভঙ্গী তে তোলা নিজের সেলফি পাঠিয়েছে, সবাই নানা ড্রেসে। চকরা বকরা সার্ট , মাথায় টুপি, চোখে সান গ্লাস। কেউ হাসছে কেউ নাচছে, কারুর মুখে সিগারেট…
তাদের এই সব ছবি দেখে কর্তাব্যক্তিরা যাকে বলে থ।
এসব কি হচ্ছে টা কি?
আমরা তো college application এর পাসপোর্ট সাইজের ছবি স্টুডিও থেকে তুলিয়ে পাঠাতাম। সেই ছবি তে সাধারণতঃ আমাদের শুধু গম্ভীর গোমড়া মুখ। কদাচিৎ এক চিলতে হাসি।
দিন কাল কত পালটে গেল, ভাবা যায়না।
আমাদের ছোটবেলায় বাড়ীর কাছে হাজরা রোড আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোডের মোড়ের দক্ষিণ পূর্ব্ব কোণে একটা বিরাট বাড়ির দোতলায় একটা স্টুডিও ছিল, তার নাম সুন্দর স্টুডিও। সেই স্টুডিও তে আমরা ছোটবেলায় এবং বড় হয়ে ফটোও তুলতে গেছি অনেকবার। ছোটবেলায় পারিবারিক অনেক ফটো সেই স্টুডিও তে তোলা হয়েছে, তার পরে কলেজ ভর্তি বা চাকরীর application এর জন্যে পাসপোর্ট ফটো দরকার হলে ওখানেই গিয়েছি।
হাজরা মোড়ে মানুষের ভীড় ট্রাম বাস গাড়ীর ব্যস্ততার মধ্যে ওই বিশাল বাড়ীটার কথা বেশ মনে পড়ে। বাড়ীর তলায় ফুটপাথে জুতো পালিশওয়ালারা সারি সারি বসে থাকতো। আর টাইপরাইটার মেশিন নিয়ে বসে খুব মন দিয়ে বেশ কিছু মাঝবয়েসী চশমা পরা লোক ভুরু কুঁচকে কাগজ দেখে দেখে ঠকাঠক শব্দ করে টাইপ করতো। আর ছিল অনেক খবরের কাগজ আর পত্রপত্রিকার স্টল, সেখান থেকে প্রায়ই সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা কিনেছি। তাছাড়া ছিল একটা সরবতের দোকান। গরমকালে সেখানে ঠান্ডা বরফ মেশানো লেবু সরবত স্ট্র দিয়ে চোঁ চোঁ করে খেয়ে তেষ্টা মিটিয়েছি অনেক।
বাড়ীটার ওপরে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজীতে SUNDAR STUDIO লেখা বিশাল হোর্ডিং, অনেক দূর থেকে চোখে পড়ত।
ষাটের দশকে যখন প্রথম নিজের ক্যামেরা দিয়ে ফটো তোলা শুরু করি, তখন ফিল্ম ডেভেলপ আর প্রিন্ট করাতেও আমি সেখানে প্রায়ই যেতাম। কাছাকাছি সেই সময় আর কোন স্টুডিও ছিলনা।
সরু অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে দোতলায় উঠে স্টুডিওর দরজা। ঢুকেই একটা ঘর, সেখানে স্টুডিওর মালিক এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের অফিস। ঘরটা বেশ সুন্দর সাজানো, customer দের বসবার জন্যে সোফা, দেয়ালে এক সুন্দরী লাস্যময়ী যুবতীর অনেক হাস্যমুখী ছবি টাঙানো।
উচ্চারণে একটু টান থাকলেও ভদ্রলোক বাংলাটা মোটামুটি ভালই বলতে পারতেন। তাঁর বেশভূষা দেখলে তাকে বেশ সৌখীন লোক বলেই মনে হতো। ছোটখাটো কিন্তু বেশ ফিটফাট চেহারা, ব্যাকব্রাশ করা চুল, পরিস্কার ইস্ত্রী করা জামাকাপড়, গলায় একটা রঙ্গীন স্কার্ফ, পালিশ করা চকচকে জুতো। ফটো তোলা থেকে শুরু করে ল্যাবের কাজ সব তিনি একাই করতেন মনে হয়, তাঁর কোন assistant কে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
স্টুডিওর ওই ঘরটার আর একটা দরজা ছিল বাড়ির ভেতরে যাওয়ার। সেখানে একটা পর্দা টাঙ্গানো থাকত। মাঝে মাঝে সেই পর্দা সরিয়ে এক মোটাসোটা মহিলা ভেতরে ঢুকে ভদ্রলোকের সাথে বেশ ঝগড়ার বা আদেশের ভঙ্গিতে কথা বলতেন মনে আছে। তাঁর সাথে পায়ে পায়ে একটা গোলগাল বাচ্চা ছেলেও আসত। সেও মার সাথে বাবার দিকে বেশ একটা বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকাতো, যেন মার সাথে সেও বাবা কে কিছুটা বকুনী দিতে পারলে খুসী হয়।
মা আর ছেলে কে দোকানে customer দের সামনে দেখলে ভদ্রলোক স্পষ্টতঃই বেশ অপ্রস্তুত হতেন। নীচু গলায় বার বার হিন্দী তে বলতেন, ঠিক আছে, ভেতরে যাও, আমি আসছি। কিন্তু ভদ্রমহিলা তাঁর কথা শেষ না করে যেতেন না।
একবার আমি আর আমার ভাই খোকন ওই দোকানে বসে আছি, এমন সময় সেই ভদ্রমহিলার প্রবেশ। খোকন আমায় ফিসফিস করে বললো সুন্দরবাবুর বৌ, বুঝলি?
সুন্দরবাবু? সে আবার কে? আমি একটু ব্যোমকেই গেলাম।
তার পর বুঝলাম ও হরি, খোকন স্টুডিওর নাম থেকে ওই পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের নাম দিয়েছে সুন্দরবাবু।
দেয়ালে টাঙানো ছবির ওই সুন্দরী লাস্যময়ী যুবতী ইনিই নাকি? মুখের মিল আছে সন্দেহ নেই। খোকনের observation যথারীতি অব্যর্থ এবং নির্ভুল!
এক সময় এই ছবির মেয়েটির প্রেমে পড়ে একে বিয়ে করেছিলেন সুন্দরবাবু, এখন এত বছর পরে সে মেয়েটি হারিয়ে গেছে, সে প্রেমও বোধ হয় আর নেই, এখন শুধু গঞ্জনা আর কথা কাটাকাটি।
তার পর বহুদিন কেটে গেছে।
যতদূর মনে পড়ে আশির দশকের প্রথম দিকে বাজারে Colour film আসার পর সুন্দরবাবুর ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। ততো দিনে তাঁর ছেলে বেশ বড়ো আর লায়েক হয়ে গেছে। শেষের দিকে গেলে মাঝে মাঝে সেই ছেলেকেই বাবার জায়গায় কাউন্টারে বসতে দেখতাম। তার পর কালের নিয়ম মেনেই সে দোকান উঠে গেছে।
এখন এই Digital Photography র যুগে এসে মাঝে মাঝে যখন album খুলে সেই পুরনো Black and white ফটো গুলো দেখি, তখন সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে, আর সুন্দরবাবুর গলায় রঙ্গীন স্কার্ফ ফিটফাট চেহারা আর বাইরের লোকের সামনে বৌয়ের গঞ্জনা খেয়ে অপ্রস্তুত মুখটাও ভুলতে পারিনা।
—————
সাথের দুটো ছবি সুন্দর স্টুডিও তে তোলা।
প্রথম টা মা’র সাথে আমি – ছেলেকে বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে মা নিয়ে গেছেন ছবি তোলাতে। তখনকার দিনে এই ধরণের ছবি তোলার চল ছিল। এখন তো আর স্টুডিওতে যাবার দরকার পড়েনা। বাড়ীতেই মা বাবারা তাঁদের শিশুদের ইচ্ছেমতো ছবি তুলে নিতে পারেন।
দ্বিতীয় ছবিতে দুই জ্যাঠতুতো দিদির সাথে আমি। লক্ষ্য করলে দেখবে তিনজনে তিন দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হয় আমাদের সামনে আমাদের তিন মা আমাদের direction দিচ্ছেন, সোজা হয়ে বসো, হাসো, সামনের দিকে তাকাও, ইত্যাদি।
সুন্দরবাবু বেশ ভালো ছবি তুলতেন, স্বীকার করতেই হবে।
