হরিকুমার বাবু  

মনোহরপুকুর রোডে আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাড়ী থেকে কিছুদূরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হরিকুমার বাবু।তখন হরিকুমার বাবু পাড়ায় মোটামুটি চেনা মুখ। এদিকে ওদিকে পূজো বা পাড়ার অন্য নানা বারোয়ারী অনুষ্ঠানে মাতব্বরি করতে দেখা যেত তাঁকে, যদিও কারুর কাছ থেকেই তেমন পাত্তা পেতেন না।

একটু অসংলগ্ন কথাবার্ত্তা বলতেন, মাঝে মাঝে টলতে টলতে হাঁটতেন, চোখ দুটো প্রায়ই লাল হয়ে থাকতো। নেশা করতেন হয়তো। রাইটার্সে বোধহয় একটা পিয়ন বা বেয়ারার কাজ করতেন।    

পাড়ায় পাগলাটে বলে তাঁর দুর্নাম ছিল। তবে নিজের মত থাকতেন, কারুর সাথে কোন দুর্ভাব বা ঝগড়াঝাঁটি ছিলনা। সবাই যতটা পারে তাঁকে এড়িয়েই চলতো।

এই হরিকুমার বাবু আমাদের বাড়ীতে মাঝে মাঝেই আসতেন।

মার মুখে শুনেছি ওনার পরিবার ছিল পাটনায়, আমাদের পরিবারের  পাটনার শাখার সাথে ওনার পরিবারের সেখানে এক জ্ঞাতি সম্পর্ক তৈরী হয়। যেখান থেকে ভাগ্যের ফেরে যুদ্ধের সময় কলকাতায় এসে তিনি মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীতে উঠেছিলেন। পরে পাশেই একটা ছোট ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করেন।

আমাদের ছোটবেলায় ওনাকে একটু দুঃখী একলা মানুষ বলে মনে হতো আমার। পরে বড় হয়ে বুঝেছি, উনি ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বহীন, হেরে যাওয়া মানুষ। সবার উপহাস, অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র।  

চালচুলো হীন, আপাতদৃষ্টিতে এই একাকী অসহায় মানুষটির জন্যে আমার মনে কোথাও একটা সমবেদনা আর সহানুভূতি অনুভব করতাম মনে পড়ে। কারুর ভালবাসা পেলে হয়তো তাঁর জীবনটা পালটে যেতো। কিন্তু তাঁর জীবনে ভালবাসা নিয়ে কেউ আসেনি।     

এই পৃথিবীতে এই ধরণের হতভাগ্য লোক অনেক আছে, আমাদের হরিকুমার বাবু ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।   

সারা জীবন একলা কাটিয়ে গিয়েছিলেন হরিকুমার বাবু, তাঁর মৃত্যুও হয় সকলের অজান্তে, নিভৃতে। অনেক দিন থেকে তাঁর ঘর বন্ধ ছিল। ভেতর থেকে মৃতদেহের দুর্গন্ধ পেয়ে পাড়ার লোকেরা পুলিশ ডেকে তাঁর দরজা ভেঙে ঢুকে তাঁর মৃতদেহ  উদ্ধার করে তাঁর সৎকার করে।

গোড়ালী পর্য্যন্ত নেমে আসা ঢলঢলে প্যান্ট, ময়লা বুশসার্ট আর ছেঁড়া চটি পরে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা আসতেন হরিকুমার বাবু। চোখ দুটো অল্প লাল, কথা একটু জড়ানো, হাঁটার ভঙ্গি টাও কেমন যেন একটু টলমলে।

তিনি যে এসেছেন তা কেউ গ্রাহ্যই করতোনা, কেউ বসতে বলতনা তাঁকে, কেউ কথাও বলতোনা তাঁর সাথে। তিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে কি বলতেন কেউ শুনতো না

জ্যেঠিমা কে কিছুটা কুণ্ঠিত ভঙ্গী তে বলতেন “বৌদি, একটু চা হবে?”

তার পর বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা একা চা খেয়ে কাপ টা টেবিলে রেখে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যেতেন, দেখে ওনার জন্যে বেশ মায়াই হতো।

বাংলা দেশের কোন গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে হরিকুমার বাবুর নামে পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত সুধা নামে একটি মেয়ে। সেই চিঠি ওনার জন্যে রেখে দেওয়া হতো বারান্দায় Book case এর ওপর। খোলা পড়ে থাকা গোটা গোটা মেয়েলী অক্ষরে লেখা সেই পোস্টকার্ডের চিঠিতে কৌতূহলবশতঃ আমরা অনেকেই চোখ বোলাতাম, অস্বীকার করবোনা। 

“শ্রীচরণেষু  হরিকাকা” দিয়ে শুরু, আর “ইতি প্রণতা সুধা” দিয়ে শেষ, সেই চিঠি গুলো জুড়ে থাকতো অনেক দুঃখের কথা। হয়তো কাকার কাছে নিজেদের অবস্থার কথা জানানো র মধ্যে কিছু সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল সুধার। চিঠির মধ্যে কিছুটা হলেও একটা আর্তি আর প্রার্থনার সুর ধরা পড়তো, আমার মনে পড়ে।       

হরিকুমার বাবু আমাদের বাড়ী এলে তাঁকে সেই চিঠি দেওয়া হতো। তিনি মন দিয়ে সেই চিঠি পড়তেন। তার পর কেমন যেন উদাস হয়ে যেতেন। চুপ করে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন বেশ কিছুক্ষণ। কি ভাবতেন কে জানে? 

মনোহরপুকুরের বাড়িতে কাটানো সেই সব ছেলেবেলার দিনগুলোর স্মৃতির মধ্যে হরিকুমার বাবু তাঁর জায়গা করে নিয়েছেন।

2 thoughts on “হরিকুমার বাবু  

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।