খোকনের মোবাইল চুরি

কিছুদিন আগে একটা কাজে কালীঘাট থানায় যেতে হয়েছিল।

সেখানে ডিউটি অফিসারের টেবিল এর কাঁচের তলায় মুক্তোর মত সুন্দর হাতের লেখায় দেখি একটা মোবাইল চুরির দরখাস্ত।

মহাশয়, অমুক তারিখে অমুক জায়গায় আমার মোবাইল ফোন (নং অমুক) চুরি হইয়াছে।

লিখেছেন কোন এক কাজল মুখার্জ্জী।

নীচে ইংরেজিতেও লেখা।

ওটা যে একটা sample চিঠি সেটা প্রথমে বুঝিনি।

বুঝলাম একটু পরেই যখন তিন জন ছেলে এসে বলল তাদের একজনের মোবাইল ফোন চুরি করে নিয়ে গেছে একজন লোক।  কে সে, কেমন করে চুরি করলো, তারা অসাবধান হয়েছিল কিনা, ইত্যাদি অনেক প্রশ্নোত্তর চলল বেশ কিছুক্ষণ।

ডিউটি অফিসারের যুক্তি হল অসাবধান হয়ে থাকলে দোষটা তাদের। তারাও সেটা দেখলাম স্বীকার করে নিল।

তাতে খুসী হয়ে ডিউটি অফিসার ওদের কাজল মুখার্জ্জীর লেখা sample application দেখিয়ে বললেন,  “ঠিক এই ভাবে লিখে নিয়ে এসো তারপরে দেখবো। ”

ওদের কাছে কাগজ পেন নেই, চাইলে তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন।

“চিঠির draft করে দিচ্ছি এই না কত। তার ওপরে আবার বাবুদের কাগজ আর পেন দিতে হবে! হুঁ! আবদার! এটা কি থানা না মামাবাড়ী? যাও যাও নিয়ে এসো, আমার এখানে কাগজ পেন কিছু নেই। ”

মোবাইল ফোন চুরি, যা বুঝলাম খুব common এখন।

আজকাল একটা মোবাইল ফোন চুরি মানে হলো প্রায় সর্বস্ব চুরি যাওয়া।  সেখানে জীবনের বহু ব্যক্তিগত এবং মহামূল্যবান তথ্য এবং ছবি রাখা থাকে।  অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সব তথ্য ছবি ইত্যাদির কোন back up থাকেনা।  অতএব একবার ফোন হারিয়ে গেলে সেই মূল্যবান তথ্য আবার খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব , এবং যদিও বা সেই সব  যোগাড় করা সম্ভব হয় তার জন্যে ব্যাপক কাঠখড় পোড়াতে হবে এবং অনেক সময়  লাগবে।  এমন কি বছর খানেক বা তার বেশীও লেগে যেতে পারে।

এখন আমরা আছি Information age এ, এখন তথ্যই হলো সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু (Asset)।

এই নিয়ে একটা গল্প নীচে।

খোকন আমার ভাই।

———–

কাস্টমস ক্লাব থেকে একদিন সন্ধ্যায় খোকন বাড়ি ফিরছে, হাওড়া ইউনিয়ন মহামেডান ক্লাবের ঘেরা মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তা পেরিয়ে মনুমেন্টের পাশে গিয়ে ট্রাম ধরবে, আর না পেলে আর একটু এগিয়ে বাস বা মিনিবাস।

ক্রমশঃ অন্ধকার নামছে, ময়দানের ওই জায়গাটা বেশ নির্জন। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন কিছুটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল ~ আপনার কাছে কি একটা মোবাইল ফোন আছে, দাদা?

কে রে বাবা?

খোকন তাকিয়ে দেখে পাশে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে, বেশভূষা দেখে গ্রামের ছেলে বলে মনে হয়, গায়ের রং কুচকুচে কালো, কথাবার্ত্তায় আর উচ্চারণে একটা টান আছে যা ক্যানিং বা লক্ষীকান্তপুরের লোকেদের গলায় শোনা যায়। 

ফোন আছে শুনে ছেলেটি প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, আমার বাবার বড় অসুখ দাদা, আজ তেনাকে হাসপাতালে ভর্ত্তি কইরেছে, দয়া কইরে একটু ফোন টা দ্যান,আমি একটু বাবার সাথে কথা কই?”

এতো বড় বিপদ হল! খোকন ভাবলো এ এখন বাবার সাথে কতক্ষণ কথা বলবে কে জানে?

ছেলেটা বাজে কথা বলছেনা তো? একটু বাজিয়ে দেখবার জন্যে খোকন বলল “কি নাম্বার তোমার বাবার, আমি ফোন করে দেখছি, লাইন পাওয়া যায় কিনা।”

ছেলেটা যে নাম্বার বলল তাতে রিং হতে খোকন ছেলেটাকে ওর ফোন টা দিয়ে বললো, “নাও কথা বলো।”

ছেলেটা কান্নায় ভেঙে পড়ে বেশ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তার বাবার সাথে কথা একতরফা কথা বলতে লাগলো। তার কথাগুলো অনেকটা এরকম (খোকন বেশ ভাল নকল করে, আমি অতটা পারবোনা)~

“বাবা গো, তুমি কেমন আছো গো, তুমি হাসপাতালে কেন গেলে গো, তোমার কি হইয়েছে গো, আমি এখুনি তোমার কাছে আসতেছি গো…”

তার এই আকুলি বিকুলি কান্না দেখে খোকন বেশ একটু অপ্রস্তুত হল, ছেলেটিকে সন্দেহ করেছিল বলে তার মনে একটু দুঃখ আর লজ্জাও হল, কিন্তু তার পরে যা ঘটল তার জন্যে সে একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা।

“আমি  এখুনি তোমার কাছে আসতেছি গো…আমি দৌড়ি দৌড়ি আসতেছি গো” বলতে বলতে ছেলেটি পাঁই পাঁই করে ছুট!

খোকন “আরে আরে কোথায় যাচ্ছো আমার ফোন দিয়ে যাও” বলতে বলতে ওর পিছনে ধাওয়া করেও কোন লাভ হলনা, এই বয়সে একটা অল্পবয়েসী ছেলের সাথে দৌড়ে কেউ পারে নাকি? তার ওপরে আবার গ্রামের ছেলে!

ইউসিন বোল্টের মত তীরবেগে ছুটে ছেলেটা ময়দানের অন্ধকারে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।  খোকনের ফোন কানে ধরে তার বাবার সাথে কেঁদে কেঁদে কথা বলতে বলতে সে উধাও হয়ে গেল।