১
মনোহরপুকুর, বোধহয় ১৯৫৭ সাল।
দিদিভাই আমাদের ছোটদের নিয়ে বাড়ির বড়ো বারান্দায় একটা সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে। উপলক্ষ্যটা ঠিক মনে নেই। রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকী কিংবা বসন্ত উৎসব হবে হয়তো।
প্ল্যান হলো দিদিভাই ব্যাকস্টেজ থেকে রবীন্দ্রনাথের “পূজারিণী” কবিতাটা আবৃত্তি করবে আর তার সাথে আমরা স্টেজে কবিতাটার একটা নাট্যরূপ অভিনয় করব। এর সাথে থাকবে কিছু গান, আবৃত্তি, আর আবহসঙ্গীত।
আমাদের সকলের তো খুব উৎসাহ। রোজ বিকেলে ছাতে গান আর নাটকের রিহার্সাল চলে। “ওরে ভাই ফাগুণ লেগেছে বনে বনে” গানটা দিদিভাই এর কাছ থেকে আমরা শিখে নিয়েছি।
নাটকে চারজন চরিত্র।
আমি হলাম “নৃপতি বিম্বিসার”, প্রথম সীনে – “নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইল পদনখকণা তার”- আমি বুদ্ধের মূর্ত্তির সামনে গিয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে যাব।
বাবলু হলো বিম্বিসারের ছেলে অজাতশত্রু, সে আবার বুদ্ধকে দু চক্ষে দেখতে পারেনা। সে রাজা হয়ে বুদ্ধের পূজা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, তার রাজত্বে শুধু মারামারি, কাটাকাটি, হিংসা। বাবলুর প্রথম সীন হলো হাতে একটা রাংতার তৈরী তলোয়ার মাথার ওপর বাঁইবাঁই করে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ স্টেজে নাচবে। সাথে বাজনা।
এছাড়া দুজন মেয়ে। এক হলো রাজমহিষী, যার কাজ হলো শুধু সাজগোজ করা, ওই পার্টটা করেছিল সামনের বাড়ীর অপুমাসী র মেয়ে টুটু। আর একজন “শ্রীমতী নামে সে দাসী” সেটা করেছিল দিদিভাইয়ের বন্ধু গৌরীদির বোন বাসন্তী। ওরা আমাদের পাড়াতেই থাকতো। দাসী শ্রীমতী কে রাজমহিষী অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে বুদ্ধদেবের পূজো করবেই। শেষ সীনে সে যখন পূজো করছে তখন অজাতশত্রু এসে তার গলা কেটে তাকে মারবে।
মোটামুটি এই হলো নাটক।
বাবলু কে পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছে যে তলোয়ার দিয়ে গলা কাটার timing টা ভীষন important, ও শ্রীমতীর গলার কাছে তলোয়ার নামানোর সঙ্গে সঙ্গে ঝ্যাং করে একটা বাজনা বাজবে আর স্টেজ অন্ধকার হয়ে যাবে। বাবলু তাই ওই সীন টা নিয়ে বেশ চিন্তিত।
২
নাটকের দিন বারান্দায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসার জায়গাতে স্টেজ বানানো হয়েছে। জ্যেঠিমার ঘর হলো গ্রীনরুম। সেখানে আমাদের সব সাজগোজ করিয়ে দিয়েছে দিদিভাই। চায়ের ঘরটা হলো উইংস। সেখানে ভালোকাকীমার ভাই শ্যামলমামা দাঁড়িয়ে। তিনি হলেন ব্যাকস্টেজ ম্যানেজার।
স্টেজের সামনে বারান্দায় চাদর পাতা, একটু একটু করে সেখানে বেশ ভীড় জমে গেল। অনেকে এসেছে। তাদের মধ্যে আত্মীয়রা আছেন, আর পাড়ার ও অনেকে নিমন্ত্রিত।
প্রথম আর্টিস্ট পলা । সে হলো ভজা জ্যেঠুর ভাই পূজা জ্যেঠুর মেয়ে। তখন পলার কতোই বা বয়েস? বারো কি তেরো হবে। লাল রং এর ডুরে শাড়ি, আঁট করে চুল বাঁধা, চোখ নাচিয়ে হাত ঘুরিয়ে বেশ গিন্নীর মতো পলা “হাইস্যো না কো বাবুরা, বুড়া আমায় মারিসে” বলে একটা কবিতা সুন্দর ঝরঝর করে আবৃত্তি করল। She was a big hit, প্রচুর হাততালি পড়ল দর্শকদের কাছ থেকে।
তারপর আমাদের কোরাসে “ওরে ভাই ফাগুণ লেগেছে বনে বনে” গান। সেটাও মোটামুটি ভালোই উতরে গেল।
তারপর শুরু হলো নাটক। সেটাও ভালোই এগোচ্ছিল, কিন্তু বাবলুর লাস্ট সীনে গিয়ে একটু কেলো হয়ে গেল। দোষ অবশ্য বাবলু কে দেওয়া যায়না। আগেই বলেছি ওই গলা কাটার timing টা নিয়ে ওর বেশ চিন্তা ছিল। যদি তলোয়ার নামানোর সময় ঝ্যাং করে বাজনাটা না বাজে, যদি স্টেজ অন্ধকার না হয়?
বাবলু তাই রাংতার তরোয়াল মাথার ওপর ধরে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। ওদিকে শ্যামলমামাও (যার কাজ হলো ঝ্যাং বাজনা টা বাজানো আর স্টেজে আলো নেবানো), বসে আছেন বাবলুর তরোয়াল নামানোর অপেক্ষায়।
বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর বাবলু উইংসে দাঁড়ানো শ্যামলমামা কে জিজ্ঞেস করেছিল, “মামা, কাটবো?”
প্রশ্নটা বেশ উঁচু গলায় জোরেই করতে হয়েছিল বাবলুকে, কেননা উইংস টা ছিল স্টেজের মাঝখান থেকে বেশ দূরেই। ফলে ওর ওই কথাটা হল শুদ্ধ সবাই শুনে ফেলে।
তার পর থেকে বহুদিন বাবলুকে “মামা কাটবো?” বলে খ্যাপানো হয়েছে।
মনোহরপুকুরের বাড়ীর ইতিহাস যদি কোনদিন লেখা হয় তাহলে এই গল্পটা তার মধ্যে স্থান পাবে নিশ্চয়।