খান স্যার

স্কুলের ইতিহাস পাঠক্রম নিয়ে আমাদের দেশে এখন অনেক তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা। তাদের মত হলো স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে স্কুল আর কলেজের ছাত্ররা ইতিহাসের বইতে শুধু মুঘল আর অন্যান্য মুসলমান রাজাদের কাহিনী পড়ে।  হিন্দু সাম্রাজ্য এবং হিন্দু রাজাদের কথা দেশের ছাত্রদের  সেরকম ভাবে কিছুই পড়ানো হয়না। উত্তর ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য, দক্ষিণের চোলা বা বিজয়নগর, বাংলার সেন বা পাল বংশ এমন কি শিবাজীর মাড়াঠাদের নিয়ে আমাদের স্কুলের বা কলেজের ইতিহাসের বইতে সেরকম উল্লেখ নেই। সেখানে শুধু মুঘলদের এবং পরে ইংরেজদের ইতিহাস।

হিন্দুত্ববাদী বিক্রম সম্পথ ইতিহাসের এই বিকৃতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি অনেক ইতিহাসবিদ – যেমন রমেশচন্দ্র দত্ত, যদুনাথ সরকার ইত্যাদি – তাঁদের লেখা ইতিহাসের পাঠে হিন্দু রাজত্বের কথা লিখলেও প্রথম দিকের অসাম্প্রদায়িক (Left/Secular)ভারত সরকার ইতিহাসের পাঠ থেকে হিন্দু রাজাদের মোটামুটি বাইরে রেখেছেন। বিক্রম বলছেন তার ফলে প্রাচীন ভারতের অনেক হিন্দু রাজত্বের উজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের ছাত্রদের গোচরে আসছেনা।

তর্কের অন্যদিকে Left secular ইতিহাসবিদ রা – যেমন রোমিলা থাপার, রামচন্দ্র গুহ – প্রতিবাদ করে বলছেন মুসলমান invader দের আসার আগে ভারত নানা ছোটখাটো রাজাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে ছিল। মুঘলরা এবং পরে ইংরেজদের  শাসনের ফলে ভারত এক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, ভারতের হিন্দুদের সাথে তাদের মুসলমান বা ইংরেজ শাসকদের কোন বিবাদ ছিলনা ইত্যাদি।

এর মধ্যে আমি মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদের স্কুলজীবনে ইতিহাসে কি পড়েছিলাম তা মনে করার চেষ্টা করি।                 

আমাদের স্কুলে (সেন্ট লরেন্স, বালীগঞ্জ, কলকাতা) ইতিহাস পড়াতেন খান স্যার । সাধারণ দোহারা চেহারা, পরনে সাদা সার্ট আর ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুটো চোখ। ইতিহাস ছিল তাঁর passion ।

যতদূর মনে পড়ে আমাদের ইতিহাসের বইতে বহিরাগত মুসলমান শাসকদেরই প্রাধান্য ছিল বেশী। তবে রাণা প্রতাপ, শিবাজী, চন্দ্রগুপ্ত, অশোক দের কথাও পড়েছি। তবে তাদের মোটামুটি সকলকেই minor player হিসেবে ই দেখানো হতো। চোলা বা বিজয়নগর সাম্রাজ্য সম্বন্ধে তো আমাদের কিছুই পড়ানো হয়েছে বলে মনে পড়েনা।

আর প্রায় প্রত্যেক যুদ্ধেই হিন্দু রাজাদের হার হতো – এখনকার হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের ছাত্র – বিক্রম সম্পথ আর স্বপন দাশগুপ্তদের –  এই আপত্তি খুব একটা ভুল বোধ হয় নয়।  আমাদের বাংলার ইতিহাসেও সেন আর পাল বংশ এবং পরে বারো ভুঁইয়া দেরও দেখানো হয়েছে মুঘল বা ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরাজিত হিসেবে।

হিন্দু রাজাদের পরাক্রম, সাহস আর বিদ্রোহের কথা আমাদের স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে খুব বেশী নেই, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মারাঠাদের কথা, বাঙলায় সশস্ত্র আন্দোলন, সিপাহী বা নৌবিদ্রোহ কেও খুব একটা মাহাত্ম্য দেখানো হয়নি। গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের জন্যেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এই কথাই আমরা জানি।

এখন এই হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সশস্ত্র আন্দোলন এবং প্রাণ বিসর্জ্জন কে আমাদের ইতিহাসে যথাযোগ্য সন্মান জানানো হয়নি। স্বাধীনতার জন্যে ভগত সিং, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মত নেতাদের অবদানের নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে।

আমাদের ছোটবেলায় এই সব বিতর্ক আর বিবাদ ছিলনা।         

খান স্যার বড় ভালো পড়াতেন, আকবর, বীরবল, শিবাজী, আফজল খাঁ রা সবাই তাঁর পড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠতেন। তিনি হলদিবাড়ী বা পানিপতের যুদ্ধের কথা পড়াবার সময় আমরা তলোয়ারের ঝনঝন আওয়াজ, আহত সৈনিকদের আর্তনাদ, ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক যেন কানে শুনতে পেতাম। নিজেকে আমি মাঝে মাঝে নিজেকে সেই যুদ্ধের মধ্যে এক অনামী সৈনিক বলেও ভেবেছি।  


খান স্যারের সবই ভালো ছিল, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ আমরা পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছি কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দুমদাম প্রশ্ন করে বসতেন। একটু অমনোযোগী হলেই আমরা ঠিক ওনার কাছে ধরা পড়ে যেতাম।

তো একবার মনে পড়ে ক্লাসে বারো ভুইঁয়া দের সম্বন্ধে পড়াচ্ছেন খান স্যার। আমি সেদিন তৈরী হয়ে আসিনি, তাই খান স্যারের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না, পাছে আমায় কোন প্রশ্ন করে বসেন। খান স্যার বুঝতে পেরে আমায় বল্লেন “ইন্দ্রজিৎ, তুমি তো ভৌমিক, তাই না? তার মানে তুমি নিশ্চয় কোন বারো ভুঁইয়ার বংশধর। আচ্ছা, তুমি বলো তো…

সব্বোনাশ!

যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই!  

ভৌমিক হয়ে জন্মাবার জন্যে বেশ দুঃখ হয়েছিল সেদিন। ঘোষ বোস মিত্র বা মুখুজ্যে বাঁড়ূজ্যে হলেও এই বিপদে পড়তে হতোনা আমায়।