
উর্ম্মি আর উদয়ন অনেক বছর পরে কলকাতায় এসেছে। পাটুলীতে ঝুনকুর ঝকঝকে নতুন বাড়ীতে আমরা ভাইবোনেরা সবাই একটা সন্ধ্যা ওদের সাথে কাটালাম।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এক সূত্রে বাঁধা আছে সহস্র জীবন। আমরা ভাইবোনেরা যে সুতোয় বাঁধা আছি তা হলো আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীতে একসাথে কাটানো বাল্য আর কৈশোরের প্রায় পনেরো কুড়ি বছরের দিনগুলোর স্মৃতি।
এই বাঁধন এতগুলো বছরেও আলগা হয়নি।
উর্ম্মিরা বলেছিল বিকেল পাঁচটার মধ্যে চলে আসতে, তো আমরা চলে এলাম। সুভদ্রা আর আমি। মিঠু, খোক্ন, টুপসি, ওর ছেলে, আর বুবান। ভান্টুলি আর শ্রেয়া। কৌশিকী, ঝুন্টু, আর ঋদ্ধি। তা ছাড়া উর্ম্মি, উদয়ন আর ঝুনকু। সব মিলিয়ে টুপসির বাচ্চাটাকে নিয়ে আমরা পনেরো জন।
তারপর শুধু হাসি আর আড্ডা, যাকে বলে নরক গুলজার।
মনোহরপুকুরের দিন গুলো নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ হলো। সেই সবাই মিলে ছাতের বারান্দায় মাদুরে বসে কাঁসার থালায় খাওয়ার কথা কি ভোলা যায়? সেই অন্নপূর্ণা বাবু, মাখনবাবু, সুন্দর স্টূডিওর পাঞ্জাবী ভদ্রলোক যার নাম খোকন দিয়েছে সুন্দরবাবু, পাশের পাঁচুবাবুর বাড়ীর তলায় মুচি, বসন্ত নাপিত। কত সব চেনা মানুষ। তাদের নিয়ে কত কথা। কত গল্প। শেষ আর হয়না।
হরিকুমার বাবু থাকতেন মঞ্জুশ্রীর গলির পরে মোহন বিশুদের বাড়ীর তলায়। উর্ম্মি বললো মোহনের বৌর ওপরে মাঝে মাঝে কোন দেবী এসে ভর করতেন, আর ভর হলেই নাকি সেই বৌ ঠাস ঠাস করে তার শ্বাশুড়ীকে গালে চড় মারতো। এমন কি মোহনকেও সে এমন চড় মেরেছে যে সে নাকি বৌয়ের ভর হলেই নীচে রকে গিয়ে বসে থাকতো। বাপ্পা বলেছে ভরটর সব বাজে, আসলে শ্বাশুড়ী আর বরের ওপর রাগ মেটানোর ওটা একটা উপলক্ষ্য।
আমরা একবার সবাই মিলে ট্রেণে ডায়মন্ড হারবার গিয়েছিলাম, উদয়নও ছিল আমাদের সাথে, মনে আছে? বৃষ্টিভেজা দিন ছিল, উদয়ন উদাত্ত গলায় অনেক কবিতা আবৃত্তি করেছিল নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। মনে আছে? আর একবার আমরা উর্ম্মির দুই যমজ মেয়েকে দেখে ফেরার সময় দেশপ্রিয় পার্কের সামনে ফুটপাথে একটা গ্রুপ ফটো তুলেছিলাম, মনে আছে? দিদিভাই ও ছিল সেবার আমাদের সাথে।
সবার সব পরিস্কার মনে আছে।






ট্রেণের কথা উঠতে খোকন বলল মাঝে মাঝে আমি কাজ থেকে বাড়ী ফেরার সময় শিয়লাদা থেকে ট্রেণ ধরে গড়িয়া আসতাম। সে কি ভীড়। কে যে কাকে ধরে ঝুলছে বোঝার উপায় নেই। এক ভদ্রলোক হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন আরে আরে আমার ধুতি! কিন্তু কিছু বোঝার আগেই তাঁর ধুতি অন্য কারুর হাতে চলে গেছে।
খোকনের এই সব মজার মজার কথা শুনে সব চেয়ে বেশী হাসছে উর্ম্মি আর ঝুনকু।
“হি হি হা হা, আমার ধুতি… হো হো হা হা”!
ঝুন্টুর কৌতূহল একটু বেশী । সে বললো, “তলায় কিছু ছিল তো?”
ভান্টুলি বললো “না থাকলেও কিছু দেখা যেতোনা। ওপরে পাঞ্জাবী ছিল নিশ্চয়, তাতে সব ঢাকা পড়ে যাবে…”
ঝুনকু বললো, “যাঃ, কি সব অসভ্যতা হচ্ছে…”
ভান্টুলির স্টকেও ট্রেণের গল্প। এটা ফুলকাকাকে নিয়ে।
একবার ফুলকাকা ট্রেণে করে কোথাও যাচ্ছেন, রাত হয়েছে। কামরায় তিন জন তাস খেলছে, তারা ফুলকাকাকে বললো “তিন পাত্তি খেলবেন?” ফুলকাকা তাস খেলেন না তিনি তাঁর ব্যাগ মাথার নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন সেই খেলোয়াড়রা কেউ নেই, তাঁর ব্যাগটাও উধাও।
খোকন বললো, “ভাগ্যিস মাথাটাও নিয়ে যায়নি…”
ঝুনকু আর উর্ম্মি যথারীতি হেসে লুটিয়ে পড়লো।
“হি হি হা হা, মাথাটাও নিয়ে যায়নি হো হো হা হা”!
আমি বললাম কি হচ্ছে কি? কারুর ধুতি, কারুর ব্যাগ হারিয়ে যাচ্ছে, এ তো দুঃখের গল্প! এত হাসছিস কেন তোরা?
জ্যেঠিমার বোন শেফালী মাসীর বর মেসোমশায়ের ডাকনাম ছিল খোকা। মাঝে মাঝে শেফালী মাসীর কোন কাজে – কিছু দিতে বা নিতে – উনি কাজ থেকে পুলিশের ড্রেস পরে মনোহরপুকুরে আসতেন, আর এলেই জ্যেঠিমা “ওরে খোকা বাবু এসেছে” বলে একটা হাঁক পাড়তেন।
মেসোমশায় ছিলেন কলকাতার কোন এক থানার ওসি। লম্বা চওড়া চেহারা, পরণে পুলিশের ইউনিফর্ম, তার ওপরে গমগমে গলা। রসিক লোক ছিলেন, নিজের রসিকতাতে নিজেই যখন হাসতেন তখন আমাদের বাড়ীর কড়িবরগা সব কেঁপে উঠতো।
এদিকে আমাদের বাড়ীর সামনে এক মুদীর দোকান ছিল, সেখানে আমরা চাল ডাল তেল ইত্যাদি কিনতে যেতাম। যে লোকটা সেই দোকান চালাতো তাকে সবাই খোকা নামে চিনতো। মুদীর দোকানের নাম হয়ে গিয়েছিল খোকার দোকান। মা কাকীমারা মাঝে মাঝে আমাদের বলতো, “খোকার দোকান থেকে আড়াইশো গ্রাম মুড়ি নিয়ে আয় তো~ ”
ঝুন্টূ বললো “একদিন মেজমা শুনি পিছনের গলিতে কে পেচ্ছাপ করছিল তাকে ধমক দিয়ে বলছে খোকাকে বলবো একদিন পুলিশের ড্রেস পরে এসে তোমায় ধরতে। মজাটা বুঝবে সেদিন। আমি ভাবলাম My God, মুদীর দোকানের ওই মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা ছেঁড়া গেঞ্জী পরা লোকটার এত ক্ষমতা?”
আসলে দুজনের নামই খোকা, তাই ঝুন্টুর গুলিয়ে গেছে। খোকন গম্ভীর ভাবে বলল “A case of mistaken identity”..
ঝুন্টু বললো “তার পর থেকে আমি খোকার দোকানে গেলে লোকটাকে খুব সন্মান করে কথা বলতাম…”
তাই শুনে ঝুনকু আর উর্ম্মি আবার হেসে গড়াগড়ি।
“হি হি হা হা, সন্মান করে কথা বলতাম, হো হো হা হা”!



আমাদের বাড়ীর পাশে ডক্টর মৃণাল দত্তের চেম্বার, সেখানে এক কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক ইঞ্জেকশন দিতে আসতেন, তার নাম ভালোকাকীমা দিয়েছিলেন ফুটুবাবু। উর্ম্মি বলল একবার নাকি রাস্তায় ভালোকাকার সাথে আচমকা ফুটূবাবুর দেখা হয়। এখন ভালকাকা ছিলেন পাড়ার একজন সন্মানীয় লোক, সবাই দেখা হলেই খুব খাতির করে তাঁকে শ্যামলদা’ বলে ডাকে, তিনি নাকি ফুটুবাবুকে দেখে কিছুটা patronizing ভঙ্গীতে হাসি মুখে যেন অনেক দিনে চেনা এই ভাবে “ভাল আছো ফুটু?” বলেছিলেন।
খোকন বললো “ওনার নাম যে ফুটু উনি কি সেটা জানতেন নাকি?”
আমি বললাম “মনে হচ্ছে উনি ভেবেছিলেন কে না কে ফুটু, আমায় শ্যামলদা’ ফুটু ভাবছে – a case of mistaken identity”..
উর্ম্মি আর ঝুনকুর হাসি আর থামেই না।
“হি হি হা হা, ভাল আছো ফুটু, হো হো হা হা”!
উদয়ন ও বেশ ভাল গল্প বলতে পারে। সে শুরু করলো হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার পরে তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে জম্বুদ্বীপে বেড়াতে যাবার লোমহর্ষক গল্প। রামায়ণের জম্বু দ্বীপ নয়, এ হলো সুন্দরবনের জম্বুদ্বীপ, সাগর দ্বীপের কাছে। শীতের দিন ফ্রেজারগঞ্জ থেকে নৌকায় সাত বন্ধু – তারা আবার সবাই হিন্দু স্কুলের মেধাবী ছাত্র – বিকেলে গিয়ে পৌছল সেই দ্বীপে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, সারাদিন খাওয়া হয়নি, এদিকে নির্জন জনমানবশুন্য দ্বীপ, থাকা খাওয়ার জায়গা নেই, ওদিকে নৌকা নিয়ে মাঝিও কেটে পড়েছে, এখন উপায়?
হঠাৎ তারা শোনে অন্ধকারে কোথাও রেডিও তে লতা মঙ্গেশকারের গান বাজছে। কেউ কোথাও নেই, গানটা বাজাচ্ছে কে? ভূতুড়ে ব্যাপার। তারপর তো সেই রেডিওর খোঁজে গিয়ে কিছু জেলের দেখা পাওয়া গেল, তারা তাদের ভালবেসে অনেক রাতে রান্না সেরে মাছের ঝোল ভাত খাওয়ালো আর পরের দিন ছোট নৌকায় করে ওদের আবার ফ্রেজারগঞ্জে পৌঁছে দিল।
এই নৌকা মাছ ধরার নয়। ছোট এবং নীচু, মাছ নিয়ে যাবার নৌকা, সেখানে সাত জন বসাতে নৌকার অর্ধেক জলের তলায়। জায়গাটা নদীর মোহনা, চারিদিকে অকূল সমুদ্র, ছোট নৌকায় করে জল ছেঁচে ছেঁচে ফ্রেজারগঞ্জে পৌঁছবার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা উদয়ন এতগুলো বছর পরেও এখনো ভোলেনি। তার সাথে সাথে সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের ঢেউ এ অস্তগামী সূর্য্যের লাল আলো পড়ার দৃশ্যটা এখনো উদয়নের মনে পড়ে। সে এক অদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য।
উদয়ন বেশ ভাল গল্প বলে, কিন্তু সব চেয়ে জমিয়ে গল্প বলে আমাদের খোকন। খোকনের গল্প বলার একটা অননুকরণীয় ভঙ্গী আছে, সেটা হলো কোন গল্প বলার সাথে সাথে তার দুটি হাত কে সে নানা ভাবে ঘুরিয়ে ব্যবহার করে।
শম্ভু মিত্র ম্যাগসেসে পুরস্কার নিতে ম্যানিলা যাচ্ছেন, তাঁকে এয়ারপোর্টে দেখাশোনা করার ভার পড়েছে খোকনের ওপর। সে তখন দমদমে পোস্টেড। খোকন কিছুদিন আগে রাজা অয়দিপাউস নাটকে শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখে মুগ্ধ। সেই মানুষটাকে অভাবিত ভাবে এত কাছে পেয়ে তাই স্বভাবতঃই সে দারুণ অভিভূত।
খোকন হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বালে যাচ্ছে “আমি তো ওনাকে অনেক কিছু বলে যাচ্ছি, আপনি আমাদের বাঙালীদের গর্ব, আপনি এত বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন আপনার এই সন্মান আমাদেরও সন্মান, ইত্যাদি প্রভৃতি। আর উনি শুধু গম্ভীর মুখে হুঁ হুঁ করে যাচ্ছেন।”
তারপর যেই না বলেছি “আমি একাডেমীতে গত সপ্তাহে আপনাদের বহুরূপীর রাজা অয়দিপাউস নাটকটা দেখেছি, আমার খুব ভাল লেগেছে”, ওমনি ভদ্রলোক যেন হঠাৎ জেগে উঠলেন, আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “তুমি দেখেছ? হলে কোথায় বসেছিলে বলো তো?”
যেই আমি বলেছি সামনের পাঁচ নম্বর রো তে বাঁদিকে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমায় বললেন “আচ্ছা অমুক সীনে আমি যখন হাতটা ঘুরিয়ে (খোকন এই জায়গাটা হাত ঘুরিয়ে দেখালো উনি কেমন করে দেখাচ্ছেন)কপালের কাছে নিয়ে আসছি, তখন তোমাদের সীট থেকে আমার মুখটা কি দেখা যাচ্ছিলো?”
খোকন বললো “আমি ভাবলাম এই রে সেরেছে, এর পরে আমায় নাটকের সমঝদার ভেবে আবার কি প্রশ্ন করবেন কে জানে, তাড়াতাড়ি এক জন কে ডেকে বললাম ভাই এনাকে লাউঞ্জে পৌঁছে দিয়ে এসো।”
এই রকম নানা গল্প করতে করতে রাত প্রায় ন’টা বেজে গেল।
ইতিমধ্যে কেটারার এসে বড় বড় কড়ায় করে খাবার দিয়ে গেছে। মেনু হলো মিষ্টি পোলাও, ফুলকপির রোস্ট, মাংস, চাটনি আর ক্ষীরকদম্ব।
শেষ পর্য্যন্ত যখন বেরোলাম তখন রাত দশটা বেজে গেছে।
প্রায় পাঁচ ঘন্টা কি করে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।
