
আমাদের ছোটবেলায় সেই পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে যখন মনোহরপুকুরের বাড়ীতে আমাদের মধ্যবিত্ত যৌথপরিবারে আমরা ভাইবোনেরা বড় হচ্ছি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা সংঘাত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে – সেই সময়ের কথা ভাবলে দেশের মানুষের জীবনে শান্তির একটা বাতাবরণ নেমে আসার কথা মনে পড়ে। সেই শান্তির আবহ আমাদের পারিবারিক জীবনেও তার ছায়া ফেলেছিল।
মধ্যবিত্ত পরিবার বড় হলেও আমাদের ভাইবোনদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার জন্যে আমাদের সুশিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে মা বাবাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলনা। আর বাড়ীর বৌরা – আমাদের মা জ্যেঠীমা কাকীমারা – সর্ব্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন আমাদের পরিবারের এবং বিশেষ করে আমাদের ছোটদের কল্যাণ কামনায়।
সেই কল্যাণ কামনা থেকেই আমাদের জন্যে তাঁদের নানা ব্রত, নানা উপোস, নানা পূজো। নীল ষষ্ঠী, শিবরাত্রি, অক্ষয় তৃতীয়া…
মনোহরপকুরের বাড়ীতে সরস্বতী পূজো আর লক্ষ্মী পূজো দু’টোই হতো বেশ ধূমধাম করে। মা জ্যেঠিমা কাকীমারা সবাই খুব ভক্তি আর নিষ্ঠার সাথে পূজোর আয়োজন করতেন, আমাদের বাড়ীর সামনে টিনের চালের একতলা বাসায় থাকতেন হারু আর কানাই, দুই ভাই। ওঁদের মধ্যে একজন এসে পূজো করতেন।
যেহেতু সরস্বতী হলেন বিদ্যার দেবী, তাই তাঁর পূজো আমাদের ছোটদের – যারা স্কুলে পড়ি এবং যাদের মা সরস্বতীর আশীর্ব্বাদ একান্ত প্রয়োজন – তাদেরও পূজো ছিল , পূজোয় খুব মজা করতাম আমরা ভাইবোনেরা।
আমাদের স্কুলের পাঠ্য বই আর কলম দেবীর সামনে রাখা হতো, “জয় জয় দেবী চরাচর সারে” বলে হাত জোড় করে আমরা সবাই অঞ্জলি দিতাম, বেলপাতায় খাগের কলম দিয়ে “ওঁ সরস্বতৈ নমো নিত্যং” লিখতাম।
সরস্বতী পূজোর আগে কুল খাওয়া মানা ছিল, খেলে দেবী পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবেন এরকম একটা ধারণা আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা অনেকেই অবশ্য সেটা মানতাম না, মা সরস্বতী তাঁকে আগে না খাইয়ে নিজেরা কুল খেয়ে নিয়েছে বলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শাস্তি দিয়ে ফেল করিয়ে দেবেন, এত নিষ্ঠুর তিনি নন্।
গুরুজনদের না জানিয়ে মাঝে মাঝে পূজোর আগেই কুল খেয়েছি এ কথা এতদিন পরে এখন স্বীকার করতে বাধা নেই। মা’রা বাড়ীতে নানা মিষ্টি – তিলের নাড়ু নারকোলের নাড়ু, গজা মালপোয়া ইত্যাদি তৈরী করতেন, কিন্তু যে মিষ্টির কথা সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে তা হলো কদমা। আদ্যোপান্ত চিনি দিয়ে তৈরী ওই গোল মিষ্টিটা আর কোন পূজোতে খেয়েছি বলে মনে পড়েনা।
কদমা হলো সরস্বতী পূজোর মিষ্টি।
আর যেটা মনে পড়ে তা হলো আমরা ভাইবোনেরা নানা রং এর কাগজ কেটে গদের আঠা দিয়ে অনেক লম্বা লম্বা শিকল বানিয়ে সেগুলো বারান্দার দেয়ালে আটকে দিতাম। সারা বারান্দা ঝলমলে সুন্দর হয়ে সেজে উঠতো, বেশ একটা উৎসবের মেজাজ নেমে আসতো আমাদের সকলের মনে।
এতগুলো বছর কেটে গেছে, তবু এখনো প্রতি বছর সরস্বতী পূজো এলেই সেই শিকল বানানোর কাজে আমাদের ভাইবোনদের উৎসাহ আর উত্তেজনার কথা মনে পড়ে।


আর মনে পড়ে ঠাকুর কিনতে যাবার কথা।
একবার ১৯৬০ সালে, আমার তখন ক্লাস নাইন, সরস্বতী পূজোর দুই দিন আগে মেসোমশায় (রঞ্জুর বাবা, ভগবতী মাসীর -স্বামী) রাত প্রায় দশটা নাগাদ সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। উনি অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ছিলনা। কিন্তু অত রাতে মারা যাওয়াতে একটু logistical অসুবিধে হয়েছিল।
মাসী ছিলেন মা’র ঠিক ওপরের বোন, ভগবতী নাম থেকে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ভাগু। সবার কাছে তিনি ছিলেন ভাগুদি। আর ওই দুই বোন ছিলেন ভীষন কাছের মানুষ, বিয়ের পর থেকেই দু’জনে কলকাতায় থাকার জন্যে অন্য দুই ছোট বোনদের তুলনায় তাঁদের দু’জনের মধ্যে একটা একটা অদ্ভুত bonding তৈরী হয়েছিল। আর আমি আর রঞ্জু দু’জনে ছিলাম দুই বোনের এক মাত্র সন্তান। ছোটবেলায় মা আমায় নিয়ে মাঝে মাঝেই রবিবার বা কোন ছুটির দিন সকালে মাসীর বাড়ী (এন্টালী ক্রিস্টোফার রোডে সি আই টি বিলডিংএ সরকারী আবাসন) চলে যেতেন। ৩৩ নম্বর বাসে মাসীর বাড়ী যাওয়া হতো। হাজরা মোড়ে উঠতাম। আর পার্ক সার্কাস ছাড়িয়ে পদ্মপুকুর স্টপে নেমে কিছুটা হাঁটতে হতো।
মাসীর বাড়ীতেই লাঞ্চ খেতাম। আর সারা দিন আমি আর রঞ্জু এক সাথে । কখনো পাড়ায় ক্রিকেট, কখনো বাড়ীতে ক্যারম, কখনো রেডিও তে অনুরোধের আসর। আবার মাসী আর মা’র নানা কাজেও আমাদের দুই মাণিকজোড় ছুটোছুটি করতাম। ট্যাক্সি ডেকে দেওয়া, চিঠি পোস্ট করা, ট্রেণের টিকিট কাটা, বাজার করে নিয়ে আসা, এই সব নানা কাজ দু’জনে মিলে করতে বেশ লাগতো।
রঞ্জু আর আমি দুই ভাই ক্রমশঃ অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে যাই।
মেসোমশায় খুব চুপচাপ মানুষ ছিলেন, নিজের ঘর থেকে বেরোতেন না, শেষের দিকে অসুখে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন।
বাবার মৃত্যুর সময় রঞ্জু তখন নরেন্দ্রপুরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে, তার বয়স মাত্র তেরো বছর। মাসী অত রাতে মেসোমশায়ের সেক্রেটারী রামুয়াকে পাঠালেন মেসোমশায়ের গাড়ী নিয়ে রঞ্জুকে আনতে। মাসী রামুয়াকে বলে দিয়েছিলেন রঞ্জুকে তুলে ফেরার পথে আমাদের বাড়ী থেকে মা’কে তুলে নিতে। মাসীর আর আমাদের দুজনের বাড়ীতেই ফোন ছিলনা, তাই আগে খবর দেওয়া সম্ভব ছিলনা।
রামুয়া যখন আমাদের বাড়ীর দরজায় কড়া নাড়লো, তখন রাত প্রায় দু’টো।
কড়ার শব্দ শুনে বাড়ীর বড়রা সবাই ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছেন, আমারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মা খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
গাড়ীতে তখন ছোট্ট রঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরের দিন আমার স্কুলে সাইন্সের পরীক্ষা ছিল মনে আছে। Weekly test..আর তার পরের দিন বাড়ীতে সরস্বতী পূজো।
স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পরে ভালকাকা আমায় আর বাবলুকে নিয়ে গোপালনগরে সরস্বতী ঠাকুর কিনতে গিয়েছিলেন। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, আলো জ্বলে উঠেছিল চারিদিকে, বিশাল একটা প্রাঙ্গনে অনেক ঠাকুর সাজানো, কেনা বেচা চলছে, বেশ ভীড়, তার মধ্যেই ভালকাকার সাথে আমাদের কোন এক দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। মনে হলো মেসোমশায়কে তিনি চিনতেন।
ভালকাকা তাঁকে বলেছিলেন, “খবর টা শুনেছেন নাকি? ননীবাবু কাল রাত্রে মারা গেছেন। স্ট্রোক হয়েছিল। ”
তারপরে দু’জনের মধ্যে মেসোমশায় কে নিয়ে কিছু শোকপ্রকাশ এবং কিছু আলোচনা হয়েছিল। মৃত্যু যে আমাদের জীবনে একটি সামাজিক ঘটনা, লোকের মুখে মুখে যে এই ভাবে মানুষের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, সেদিন সরস্বতী ঠাকুর কিনতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি তা জানতে পারি।
পারিবারিক গন্ডীর মধ্যে ১৯৬০ সালে সেই ছিল আমার জীবনে পরিবারে্র এত কাছের একজন মানুষের মৃত্যুর প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। মনে আছে সরস্বতী পুজোর আনন্দ সেবছর অনেকটাই মুছে দিয়েছিল সেই মৃত্যু সংবাদ।
এখন এতদিন পরে জীবন সায়াহ্নে পোঁছে আমার কাছের কত লোক এক এক করে চলে গেলেন। মৃত্যু এখন আর আমার কাছে অপরিচিত নয়।
আমাদের আগের প্রজন্মের কেউই আর এখন আমাদের কাছে নেই। মৃত্যু এসে হানা দিয়েছে আমাদের প্রজন্মেও। শঙ্কর আর তাপার পরে সম্প্রতি মিঠুও চলে গেল আমাদের ছেড়ে।
এখন সরস্বতী পূজো এলেই আমাদের ছোটবেলার মনোহরপুকুরে সেই গমগমে সরস্বতী পুজোর পরিবেশের কথা মনে পড়লে মনটা এখন বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
বসন্তপঞ্চমী, জানুয়ারী, ২০২৩




Kadmar sathe birkhandi mone ache tor? Amader chotobelay jautho paribare dhum dham kore Saraswati pujo hoto. Sei pujor participant bolte ekhon amar ek jartuto didi ar ami out of may be 30. Kaler niyam.
LikeLike
Thik bolecchish. Amader madhyabitto Joutha paribarer chhele meyeder jibonjatra shei 50s aar 60s e akebare ak chhilo. Thanks for reading my posts and for commenting.
LikeLike