মাধবকাকার সঙ্গে কিছুক্ষণ

মাধব কাকা, উত্তরপাড়ায় নিজের ঘরে, অক্টোবর ১৮, ২০১৬

 ১

গত মঙ্গলবার (১৮/১০/২০১৬) চৈতী, সুভদ্রা আর আমি উত্তরপাড়া তে গিয়ে মাধবকাকার সাথে দেখা করে এলাম।

মাধবকাকা এখন উত্তরপাড়ায় ছোট ছেলে রঞ্জু, বৌমা জয়া আর নাতি অরিজিৎ (দানু) কে নিয়ে থাকেন। ফোন করে তাঁর সাথে কথা বলা যায়না, কেননা তিনি এখন কানে একেবারেই শোনেন না। তার ছেলে রঞ্জুর সাথে কথা হল, বললাম বিজয়ার পরে দেখা করতে যাবো। চৈতীকে বলাতে সেও এক কথায় আমার আর সুভদ্রার সাথে যেতে রাজী।

চৈতী কে গোলপার্ক থেকে তুলে বেরোতে বেরোতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। আজকাল সাড়ে পাঁচটায় অন্ধকার হয়ে আসে, পার্ক সার্কাস ফ্লাই ওভার দিয়ে দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন নদীর ওপারে লাল টুকটুকে বলের মত সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে। কোনা রোড ধরে সোজা বালীখাল, সেখানে হাইওয়ে থেকে নেমে জি টি রোডে পড়লাম। রঞ্জু ফোনে direction দিয়ে দিয়েছিল।

জি টি রোড আছে আগের মতোই, নোংরা সরু রাস্তা, পথচারীদের ভীড়, দু’পাশে সারি সারি দোকান, গাড়ী বাস ঠ্যালাগাড়ী রিক্সা, নানা যানবাহন, হর্ণের বিকট আওয়াজ। সামনেই কালীপুজো, রাস্তার পাশে বেশ কিছু বাঁশের structure, পূজোর প্যান্ডেল বানানো শুরু হয়ে গেছে, একটা টেম্পো করে বেশ কিছু লোক একটি বেশ বড় কালীপ্রতিমা নিয়ে যাচ্ছে চোখে পড়লো। এখানে সেখানে মাইক থেকে হিন্দী ফিল্মের গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।

এই সবের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আহিরীটোলা খেয়াঘাট, রাস্তার একদম পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। দেখে মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে গেল। ওই নোংরা ঘিঞ্জি রাস্তার পাশেই এক বিশাল বিস্তীর্ণ নদী বয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য সত্যিই অবাক করার মত, সামঞ্জস্য হীন।

খেয়া ঘাট ছাড়িয়ে একটু আগে ভদ্রকালীর সখের বাজারের মোড়। সেখান থেকে রঞ্জু কে ফোন করতে সে বললো, “ওখানেই গাড়ীটা রাখুন, আমি দানুকে পাঠাচ্ছি।” মিনিট দশেক এর মধ্যে সাইকেলে চেপে দানু চলে এল, তাকে follow করে আমরা পৌঁছে গেলাম মাধবকাকার বাড়ীর গলিতে। রামলাল দত্ত লেন। রঞ্জু আমাদের অপেক্ষায় গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে আগে কোনদিন দেখিনি, ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু প্রথম দেখাতেই তাকে মাধবকাকার ছেলে বলে চিনতে পারলাম। দু’জনের মুখের বেশ সাদৃশ্য আছে।

যেতে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা লাগলো। পৌঁছলাম ছ’টার একটু পরে। তখন বেশ অন্ধকার।

একটা gated compound এর ভেতরে মাধবকাকার তিনতলা বাড়ী, ছোটর মধ্যে বেশ ছিমছাম সাজানো গোছানো। মাধবকাকা থাকেন দোতলায়, হাঁটুর ব্যথায় কষ্ট পান, তাই আজকাল আর বেশী চলাফেরা করতে পারেন না। ওপরেই থাকেন, নীচে নামেন না। বেশ সেজেগুজে স্মার্ট একটা টি শার্ট পরে খাটে বসেছিলেন, আমরা গিয়ে প্রণাম করলাম। চেহারাটা বয়সের তুলনায় এখনও বেশrobust আছে, কেবল মুখ আর ঠোঁটের কাছটা যেন একটু ফোলা লাগলো। এমনিতে কথা বেশী বলছিলেন না, সারাক্ষণ চুপ করেই বসে রইলেন। বোধ হয় কানে কিছ শুনতে না পারার জন্যেই।

দোতলায় দুটো ঘর, তার মধ্যে বড় ঘরটিতে মাধবকাকা বিছানায় বসেছিলেন, আমি তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম।

বাড়ীটা ছোট হলেও ঝকঝকে পরিস্কার, মোজেইক এর মেঝে, দেয়ালে নানা পারিবারিক ছবি সাজানো। বোঝাই যায় যে জয়া সুগৃহিণী। মাধবকাকার ঘরে বিছানার ওপর পরিপাটি করে চাদর বিছোনো। খাটের পিছনে দেয়ালে মাধবকাকা আর কাকীমার একটা বড় করে বাঁধানো ছবি টাঙানো আছে। বোধ হয় বিয়ের পরে তোলা। কাকীমার লাল শাড়ী, মাথায় ঘোমটা। সেই ছবিতে মাধবকাকাকে চেনাই যাচ্ছেনা, রোগা, ল্যাংপ্যাঙ্গে এক অচেনা যুবক। অবশ্য একটু খেয়াল করে দেখলে মুখের মিলটা টের পাওয়া যায়।

চৈতী জিজ্ঞেস করলো এটা কি মাধবকাকার ছবি?

জয়ার সাথে আগে আমাদের কোন পরিচয় ছিলনা, কিন্তু সে দেখলাম আমাদের পরিবারের সব খবরই রাখে, মা জ্যেঠিমা কাকীমাদের সবাইকে চেনে। মনোহরপুকুরে গেছেও বলল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জয়া আর রঞ্জু আমাদের আপন করে নিল। যে ঘরে আমরা বসেছিলাম সেই ঘরের সাথে লাগানো কিচেন। “চা খাবেন তো?” বলে জয়া সেখানে গিয়ে খুটখাট শুরু করে দিল। রঞ্জু হঠাৎ কোথায় বেরিয়ে গেল, নিশ্চয় আমাদের জন্যে কিছু কিনতে।

আমরা দানুর সাথে কথা বলে জানলাম সে Globsyn নামে কলকাতার একটা Management Institute থেকে MBA করেTimes of India তে Digital marketing এর কাজ নিয়েছে, কিন্তু সে এই কাজে খুব একটা happy নয়। তার future career নিয়ে অনেক আলোচনা হল, বুঝলাম সে মা আর বাবা কে ছেড়ে কলকাতার বাইরে যেতে প্রস্তুত নয়। বাইরে গেলে বেশী টাকা জমাতে পারবেনা, সে বলল মা আর বাবা তাকে তাঁদের কষ্টার্জ্জিত টাকা খরচ করে MBA পড়িয়েছেন, এখন সেই টাকা তাঁদের ফেরত দেওয়া তার আশু কর্ত্তব্য। কলকাতার বেশ কিছু জায়গায় সে চাকরীর চেষ্টা চালাচ্ছে, তার মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা লেগে যাবে তার আশা। আমরা তাকে আমাদের শুভেচ্ছা জানালাম।

আমরা আসবো বলে অনেক খাবারের আয়োজন করেছে জয়া। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সে আমাদের আলোচনাতে যোগ দিচ্ছে, আর তার কাছ থেকে আমরা অনেক খবর পাচ্ছি। মাধবকাকার ভাইরা আর কেউ বেঁচে নেই, তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেউ আর উত্তরপাড়ায় থাকেনা, তাদের বাড়ী সব ফাঁকা পড়ে আছে। একমাত্র বোন ভক্তি পিসী এখন মেয়ের কাছে নবদ্বীপে থাকেন ইত্যাদি। রঞ্জু কাছেই কো অপেরাটিভ ব্যাঙ্কে কাজ করতো, কিন্তু রাজনৈতিক গুন্ডা দের চাপ অসহ্য হওয়ায় তার blood sugar অত্যধিক বেড়ে যায়। ফলে সে কাজ থেকে voluntary retirement নিয়ে নিয়েছে। এখন দানু দাঁড়িয়ে গেলে তারা দু’জনে নিশ্চিন্ত।

ইতিমধ্যে রঞ্জু দোকান থেকে খাবার কিনে ফিরে এসেছে, জয়া চায়ের সাথে বাড়ীতে বানানো বিস্কুট, গজা প্লেটে করে এগিয়ে দিলো আমাদের। তার পরে একে একে আসতে লাগলো বাড়ীতে বানানো নারকেলের নাড়ু, দোকান থেকে আনা ভেজিটেবল প্যাটিস, নানা রকমের মিষ্টি – সন্দেশ, রসগোল্লা।

সর্ব্বনাশ, এত কে খাবে?

জয়া বললো এর পরে আইসক্রীম আছে !

গল্পে গল্পে ঘন্টা খানেক কেটে গেল। এবার উঠতে হবে।

জয়া আমাদের তিনতলায় তার পূজোর ঘর দেখাতে নিয়ে গেল। পাশেই এক চিলতে ছাত। অন্ধকার, মাথার ওপরে তারাভরা আকাশ, চারিপাশে ঘনবসতি, গায়ে গায়ে লাগানো বাড়ীর ঘন ঠাসবুনোট। কিছু বাড়ী অন্ধকার। কিছু বাড়ীর জানলায় আলো জ্বলছে। জয়া বললো জানেন, আমি রোজ সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ ছাতে এসে বসে থাকি, আমার খুব ভাল লাগে।

ছাত থেকে রাতের শহরের ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ল, মাধবকাকার বিয়েতে মনোহরপুকুর থেকে মা জ্যেঠিমা কাকীমারা সবাই আমাদের ছোটদের নিয়ে বিকেলে এসেছিলেন, রাত্রের ট্রেণ ধরে আমরা ফিরে যাই। তখন এই জায়গাটা কি ফাঁকা ছিল, চারিদিকে খোলা মাঠ, মিঠু, আমি বাবলু আর সমবয়েসী অনেক ছেলে মেয়েরা সেই মাঠে সারা বিকেল খুব ছোটাছুটি করেছিলাম। ওই মাঠেই বিয়ের অনুষ্ঠান আর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল।

এখন আর কোন ফাঁকা জায়গা নেই, চারিদিকে শুধু বাড়ী।

ছাত থেকে নামার সময় সিঁড়ির পাশে দেখলাম দেয়ালে বুক কেস, তার ভেতরে যত্ন করে সাজানো অনেক বই। জয়া বললো আপনার বাবার লেখা পূর্ব্বাচল বইটা আমাদের কাছে আছে। জেনে আমি অবাক হলাম, আর খুসীও।

ফেরার সময় রঞ্জু আর জয়া অনেক করে বললো আবার আসবেন, এবার বেশীক্ষণ থাকলেন না, এর পরের বার সারা দিনের জন্যে আসুন, আমরা সকলে মিলে বেলুড়ের মন্দির দেখে আসবো। তাদের দু’জনের এই আন্তরিক ব্যবহারের মধ্যে কোথাও যেন মাধবকাকার স্বভাব আর ব্যবহারের ছায়া দেখতে পেলাম আমি।

রঞ্জু এসে গলির মোড় পর্য্যন্ত এগিয়ে দিল আমাদের।

ফেরার পথে আমরা বালী (বিবেকানন্দ) ব্রীজ ধরে দক্ষিণেশ্বর হয়ে ফিরলাম। বিবেকানন্দ ব্রীজে রাস্তার কাজ হবার জন্যে অনেকদিন দু’দিকই বন্ধ ছিল, সম্প্রতি ফেরার দিকটা খুলে দেওয়া হয়েছে। ব্রীজের ওপর দিয়ে আসার সময় নীচে কালো নদী, আর নদীর ওপারে দূরে মা ভবতারিণীর সাদা রং এর মন্দির আলোয় ঝলমল করছে, দেখে মনটা অকস্মাৎ খুব প্রশান্ত হয়ে উঠলো।

দক্ষিণেশ্বর থেকে দমদম এয়ারপোর্ট পর্য্যন্ত নতুন রাস্তা হয়েছে, তার পরে রাজারহাট হয়ে বাইপাস, পরমা ফ্লাইওভার। ভেবেছিলাম ফেরাটা তাড়াতাড়ি হবে, কিন্তু পশ্চিম দিক দিয়ে হাওড়া হয়ে যাবার তুলনায় এই উত্তর আর পূব দিক দিয়ে ফেরার দূরত্বটা বোধ হয় একটু বেশী। তাই ভাল রাস্তা হওয়া সত্ত্বেও ফিরতেও দেড় ঘন্টা লেগে গেল। উত্তরপাড়া থেকে রাত সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে গোলপার্ক পৌঁছলাম রাত ন’টার একটু পরে।

সব মিলিয়ে বিকেল সাড়ে চারটে থেকে রাত ন’টা, সাড়ে চার ঘন্টা, দেড় ঘন্টা যেতে, দেড়্ ঘন্টা ফিরতে আর দেড়ঘণ্টা ওদের সাথে। বেশ ভালোই হলো আমাদের trip সব মিলিয়ে।

মাধবকাকা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আর দুই বছর পরে।