একাকী গায়কের নহে তো গান    

অক্টোবর, ২০১৩

মান্না দে সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।  এখন চারিদিকে তাঁকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ  এবং আলোচনা হচ্ছে, এবং সেই আলোচনায়  তাঁর সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তুলনা চলে আসছে। 

আনন্দবাজারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর স্মৃতিচারণে এই দুজনের তুলনা টেনে এনেছেন দেখলাম।  তিনি পারেন, কেননা প্রতিভা ও সাধনার জোরে তিনি ওনাদের সমকক্ষ, এবং আরো বড়ো কথা, ওই দুজনের সাথেই তিনি গান গেয়েছেন। তাঁর মতে “হেমন্ত দা ছিলেন ‘রোমান্টিক সম্রাট’ আর মান্না দা হলেন ‘সুরের সাগর’~”

দুজনেই নিজের নিজের জায়গায় গৌরবের সাথে অধিষ্টিত।  তাঁদের মধ্যে তুলনা করা চলেনা।

কিন্তু ব্যাপার টা হচ্ছে আমরা সাধারণ লোকেরা যারা গানের ব্যকরণ বুঝিনা কিন্তু গান শুনতে ভালবাসি, তারা নিজের নিজের মত করে তাদের ব্যক্তিগত ভাল লাগা তৈরী করে নিই।  আমাদের মধ্যে কেউ রফি, কেউ কিশোর, কেউ  মুকেশ বা তালাতের ভক্ত।

আমি যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এ নিবেদিত প্রাণ। ওনার গান শুনলে আমি এখনো কেমন যেন সন্মোহিত হয়ে পড়ি। ওরকম ভরাট, মিষ্টি, রোমান্টিক গলা ভগবান কি আর কাউকে কোন দিন দেবেন? মনে হয়না। ওই গলা আর হবেনা। ওনার গান শুনলেই প্রাণ টা যেন জুড়িয়ে যায়! শরীরে ক্লান্তি বোধ করলে অথবা মন নিরাশায় ভরে উঠলে আমি ওনার গান চালিয়ে শুনি। অব্যর্থ ওষুধ! কিছুক্ষণ ওনার গলা শোনার পরেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

সেই ছোটবেলা থেকে নিয়ে আজ পর্য্যন্ত আমার জীবনের ফেলে আসা দিনের কথা যখন মনে পড়ে, সেই সব দিনের স্মৃতির সাথে  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান  নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে। 

হয়তো মনোহরপুকুরের বাড়ীর বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে নীচে রাস্তায় লোক চলাচল দেখছি, পাড়ার পূজো প্যান্ডেলের মাইকে বেজে উঠছে তাঁর মায়াবী গলায় গান।  হয়তো খড়গপুরে হোস্টেলে এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে নিজের ঘরে পড়ার টেবিলে বসে আছি, এরকম মেঘলা দিনে একা ঘরে বসে মনের মধ্যেও একটা নিঃসঙ্গতার মেঘ জমছে,  তখন  দূর থেকে সজল বাতাসে  ভেসে আসছে হেমন্তর  তখনকার সময়ের কোন মন মাতানো গান,  শুনতে শুনতে  আমার মন ক্রমশঃ ভাল হয়ে উঠছে।  অথবা বম্বে তে সারাদিন অফিসের কাজ সেরে সান্টা ক্রুজ স্টেশনের ভীড় কাটিয়ে মাথা নীচু করে নিজের ঘরে ফিরছি, হঠাৎ কাছেই কোথাও রেডিও তে বেজে উঠলো হেমন্তের fluid গলা।  “আঃ হেমন্ত”, বলে আমি একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলাম।

আমাদের এই ব্যক্তিগত ভালো লাগা দিয়েই কিন্তু শিল্পীদের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি তৈরী হয়। গ্রামোফোন কোম্পানীর sales record থেকে সেই জনপ্রিয়তার হিসেব মেলে। যেমন শুনেছি এখনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড (CD) সব চেয়ে বেশী বিক্রি হয় দেবব্রত বিশ্বাস এর গান।  

প্রতিভা  মাপা যায়না, talent এর কোন measure নেই, কিন্তু sale এর বিশ্বস্ত record আছে,  তাই দিয়ে কে প্রথম, কে দ্বিতীয় সেই বিচার করা যেতেই পারে।

তবে  রেকর্ড বিক্রী ছাড়াও শিল্পীদের জনপ্রিয়তার  আর একটা সূক্ষ্ম  বিচার ছিল।   

আমাদের ছোটবেলায় রেডিওতে বাংলা আধুনিক গানের অনুরোধের আসর শুনতাম রোজ শনিবার আর রবিবার দুপুরে। সেই পঞ্চাশ আর ষাটের দশক কে বলা হতো আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। অনেক গুণী গীতিকার সুরকার আর শিল্পীর উজ্জ্বল সমাবেশ ঘটেছিল এক সাথে, আমরা তাঁদের কাছ থেকে বছরের পর বছর উপহার পেতাম একের পর এক কালজয়ী গান। আজকের দিনেও সেই সব গান তাদের জনপ্রিয়তা হারায়ানি।

সেই অনুরোধের আসরে সব শেষে বাজানো হতো হেমন্ত মুখোপাধায়ের গান,  বাংলা আধুনিক গানের জগতে  শ্রোতাদের  মনে তাঁর জন্যে শ্রেষ্ঠ আসনটি  অবিসংবাদিত ভাবে বাঁধা ছিল। 

মান্না দে সেই সময় বম্বেতে  হিন্দী ফিল্মের গান গেয়ে সুনাম অর্জ্জন করে বাংলা গানের জগতে সবে পা রেখেছেন।  অনুরোধের আসরে তাঁর সেই সময়ের গানগুলি বাজানো হতো প্রথম দিকে।  কিন্তু ক্রমশঃ কয়েক বছরের মধ্যেই  ষাটের দশক থেকেই তাঁর বাংলা গানের  জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে শুরু করে।

বাংলা সিনেমা তেও উত্তমকুমারের গলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানই প্রচলিত ছিল, দুইজনের গলায় বেশ ভাল মিলও ছিল। কিন্তু ক্রমশঃ মান্না দে বাংলা ফিল্মের গানেও জনপ্রিয়তায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে ছাড়িয়ে যান।   উত্তমকুমারের সাথে তাঁর গলার মিল তেমন না থাকলেও  ক্রম্নশঃ বাংলা সিনেমায়  তাঁর লিপেই মান্না দের বহু গান বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করে।   

পরের দিকে অনুরোধের  আসরে  তাঁর আধুনিক গানও সবার শেষে বাজানো হতো।     

আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীর কাছে বসুশ্রী I Iসিনেমায় প্রতি বাংলা নববর্ষে এক বিশাল সঙ্গীতানুষ্ঠান হতো। বাংলা গানের জগতের সব মহারথীরা সেখানে এসে গান গাইতেন। সেই গান মাইকে বাজতো, আর আমরা অনেকে, যাদের ভিতরে ঢোকার পাস বা টিকিট ছিলনা, বাইরে দাঁড়িয়ে সেই গান শুনতাম।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রতি বছর সব শেষে গান গাইতেন।  তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী।  

কিন্তু কবে থেকে ঠিক মনে নেই, একদিন দেখলাম বসুশ্রী সিনেমার অনুষ্ঠানে মান্না দে গান গাইতে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরে, সবার শেষে।

অস্বীকার করবোনা, সেদিন আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল।

তবে আমার মত হেমন্ত ভক্তদের একটা ব্যাপারে একটু সান্ত্বনা ছিল, তা হলো জনপ্রিয়তার দিক থেকে বম্বের ফিল্মি গানের জগতে এবং বিশেষ করে রাগপ্রধান গানে মান্না দে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও, বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে প্রথম সারির শিল্পী ছিলেন।  ১৯৬১ সালে কবির জন্মশতবার্ষিকীর বছরে  বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গানের প্রভূত প্রসার শুরু হয়। শান্তিনিকেতনের পরিধি অতিক্রম করে  রবীন্দ্রসঙ্গীত সে বছর থেকে যে সব বরেণ্য গুণী শিল্পীর হাত ধরে  সাধারণ বাঙালীর কাছে পৌছে যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম পথিকৃৎ।

তাঁর গাওয়া সেই প্রথম যুগের রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডের গান কি অসম্ভব শ্রুতিমধুর ও জনপ্রিয় হয়েছিলা তা আমার এখনো মনে  পড়ে।   রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বাঙালীর কাছে এত জনপ্রিয় করার পিছনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মূল্যবান অবদান ছিল একথা অস্বীকার করা যাবেনা।  সেই শতবার্ষিকীর বছরে  HMV শ্যামা গীতিনাট্যের রেকর্ডে বজ্রসেনের গান গেয়েছিলেন তিনি, কণিকা বন্দ্যোপাধায় গেয়েছিলেন শ্যামার গান।  আজও শ্যামার সেই রেকর্ডটি আমাদের বয়সী অনেকের কাছেই বার বার শোনা একটি অতি যত্নের সঞ্চয়।

যাই হোক আগেই বলেছি মান্না দে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দু’জনেই ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান এবং গুণী শিল্পী, এঁদের দুজনের মধ্যে কোন তুলনা করা যায়না।  তাঁরা দুজনেই নিজের নিজের মত করে অতুলনীয়।

কিন্তু আমাদের মত সাধারণ শ্রোতাদের কাছে এঁদের মধ্যে একজনের প্রতি একটু বিশেষ ব্যক্তিগত ভালবাসা আর পক্ষপাতিত্ব থাকলেও সেটা বোধহয় খুব একটা অন্যায় নয়।