তুমি, আমি ও গাঁদালপাতা

আমাদের জ্যেঠু বাবা কাকাদের সব ভাইদের নামের শেষে একটা বন্ধু জোড়া ছিল।  বিশ্ববন্ধু  প্রিয়বন্ধু,  নিখিল বন্ধু, প্রাণবন্ধু এই রকম।  এই চার ভাইয়ের স্কুলের সহপাঠী রা তাদের এই নাম নিয়ে মজা করে বলতো,  “এই নিখিল বিশ্বে প্রাণটা বড়ই প্রিয়। ”

আমার বিয়ে ঠিক হবার পরে আমার শ্বশুরমশায় সুভদ্রাকে বলেছিলেন, “তোমার শ্বশুররা সবাই friends, মা!”

নামের শেষে বন্ধু জোড়া থাকলেও একমাত্র ছোটকাকা (অশোকবন্ধু ) আর সোনাকাকা  (সুনীলবন্ধু) – এই দুজনই আমাদের ছোটদের সাথে বন্ধুর মত মিশতেন, সব সময়ে আমাদের সাথে হাসি খুসী মজা ঠাট্টা করতেন।

সোনাকাকা পাটনায় থাকতেন তাই তাঁকে আমরা খুব কাছে পাইনি। কিন্তু মনোহরপুকুরে ছোটকাকা ছিলেন আমাদের খুব কাছের মানুষ।

এই গল্পটা তাঁকে নিয়ে।

একদিন সন্ধ্যায় আমাদের বড় বারান্দায় খোদেচাটা পুরনো গোল টেবিলে কয়েকজন বসে চা খাচ্ছি। ছোটকাকা বললেন, “বুঝলি মান্টু, আমি এবার একটা ফিল্ম তৈরী করবো ঠিক করেছি।”

ফিল্ম? আমরা সবাই তো লাফিয়ে উঠলাম।

ছোটকাকা বললেন “ফিল্মের গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ, সঙ্গীত, পরিচালনা সবটাই আমার। কেবল অভিনয়ের জন্যে একজন নায়ক আর একজন নায়িকা আমার দরকার। বাকি সবটাই আমি দেখবো।”

কিছুদিন আগেই আমাদের সবাই কে নিয়ে ছোটকাকা সত্যজিত রায়ের “কাঞ্চনজঙ্ঘা” দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কিনা কে জানে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম “গল্পটা লিখে ফেলেছো?”

ছোটকাকা বললেন, “না শুরু করিনি এখনো, তবে ছবির নাম ঠিক করে ফেলেছি!”

আমরা সবাই তো উত্তেজিত। কি নাম হবে ছবির?

ছোটকাকা বললেন “তুমি, আমি ও গাঁদাল পাতা।”

এ আবার কি নাম?

জিজ্ঞেস করলে ছোটকাকা আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “এটা হলো আমাদের মত সাধারণ মানুষের জীবনের কথা, বুঝলিনা?”

স্বপ্নময় চক্রবর্ত্তী আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় সংখ্যায় “সাদা কাক” নামে একটি কলাম লিখতেন, তাতে নানা ধরণের চরিত্রের কথা থাকতো। তাতে একটা লেখায় দুই প্রেমিক প্রেমিকার কথা ছিল, তাদের নাম চানু আর মিনু।

স্বপ্নময় লিখছেন কমবয়েসে স্কুলে থাকতেই চানু একজন প্রেমিকা যোগাড় করার ক্যালি দেখিয়েছিল। ওরা দুজন যখন নদীর ধারে গিয়ে বসতো তখন তারা কি বলছে শোনার জন্যে বন্ধুরা পিছনে গিয়ে দাঁড়াতো। ওদের কথাবার্ত্তা শুনে তারা বুঝেছিল যে প্রেম করার জন্যে “জীবন” কথাটা খুব দরকারী।

যেমন নদীর ওপারে একটা আলো জ্বলছে আর নিবছে, চানু বললো, “আলোটা কিন্তু জ্বলেই আছে, নিবছেনা আসলে। আমাদের জীবনটাই ওরম। মনে হয় নিবে গেছে, কিন্তু আসলে নেবেনি!”

কিংবা “ওই দ্যাখো মাঝে মাঝে নদীর জল সরে গেলে কেমন কাদা ভেসে আসছে। আমাদের জীবনটাই ওরম। কখনো জল আর কখনো কাদা!”

অথবা, “ইস এই আমগুলোর মধ্যে বেশ কিছু আম পচা বেরোল, আমাদের জীবনটাই ওরম। কিছু ভালো কিছু পচা।”

চানুর এই সব কথা মিনু মুগ্ধ হয়ে শুনতো, আর এই ভাবেই ওদের মধ্যে প্রেমটা বেশ জমে ওঠে।

হাই থট কথাটাও লোককে ইম্প্রেস করতে বেশ কাজে লাগে।

চারুলতা ছবির শেষ দৃশ্যে মিনু জিজ্ঞেস করেছিল “ওরা দু’জন ফ্রিজ করে গেল কেন গো?” চানু বলেছিল “ওটা হাই থট, বোঝাতে সময় লাগবে, নিরিবিলি পেলে বুঝিয়ে দেবো!”

অশনি সংকেত ছবিতে একটা দুর্ভিক্ষের দৃশ্য ছিল। গ্রামের মানুষ খেতে পাচ্ছেনা। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রজাপতির উড়ে যাওয়া দেখানো হয়েছিল। মিনু জিজ্ঞেস করেছিল,”প্রজাপতি গুলো উড়ছে কেন গো?”

চানু বলেছিল “বুঝলেনা, হাই থট, আমাদের জীবনও ওই প্রজাপতির মতই কেবল উড়তে চায়!”

গোল টেবিলে চা খেতে খেতে ছোটকাকা বললেন, “শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে নায়ক নায়িকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, আর দূর থেকে গাঁদাল পাতার গন্ধ ভেসে আসছে!”

আমি বললাম, “ছবিতে গাঁদাল পাতার গন্ধ বোঝাবে কি করে?”

ছোটকাকা বললেন, “অসুবিধা কি আছে? একটা সংলাপ দিয়ে দেবো নায়কের মুখে। নায়ক উদাস আর করুণ মুখ করে গন্ধ শোঁকার ভান করবে আর বলবে, আঃ গাঁদাল পাতা! উঃ গাঁদাল পাতা! ব্যাস দর্শক বুঝে যাবে।”

আমি বললাম, “তা না হয় হলো, কিন্তু এত জিনিষ থাকতে গাঁদাল পাতা কেন?”

ছোটকাকা অল্প হেসে বললেন, “হাই থট, বুঝলিনা?”