
সুভদ্রা, আমি, আমার ভাই খোকন আর তার ছেলে বুবান আমরা চার জনে দেরাদুন থেকে গাড়ী নিয়ে গঙ্গোত্রী যাচ্ছি।
আমাদের ড্রাইভার এর নাম রামেন্দ্র রাওয়াত, আমাদের গন্তব্য হলো গঙ্গোত্রীর কাছে ধারালী নামে একটা জায়গায়, সেখানে আমাদের হোটেলের নাম হলো Prakriti the Retreat – সেটাই দেখলাম সবচেয়ে ভাল হোটেল সেখানে।
কাছেই হারশিল নামে একটা শহর আছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে ভাল হোটেল নেই। রামেন্দ্র বললো হারশিল কথাটা এসেছে হরিশিলা থেকে।
দেরাদুন থেকে ধারালীর দূরত্ব প্রায় ২০০ কিমি। পথে উত্তরকাশীতে থেমে দুপুরের খাওয়া খেতে ঘন্টা খানেক নিয়ে সব মিলিয়ে ধারালীতে হোটেলে পৌঁছতে আমাদের আনুমানিক আট ঘন্টা লাগবে। অর্থাৎ বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছবো।
রামেন্দ্র বললো আপনাদের হোটেলটা একদম নদীর পাশে। পাহাড়ের ওপরে তখনো যথেষ্ট আলো থাকবে। আপনারা হোটেলে পৌঁছে নদীর ধারে চলে যেতে পারেন।
রামেন্দ্র উত্তরাখন্ডের লোক, সে হলো গাড়োয়ালী। হিন্দী অবশ্য সে ভালোই বলে। সে মধ্যবয়েসী, হাসিখুসী, বেশ কথা বলে, আমাদের সাথে তার আলাপ জমে গেল অল্পক্ষনের মধ্যেই। জানা গেল সে তার বৌ আর ছেলে মেয়েদের নিয়ে দেরাদুনে থাকে। তবে অনেক বছর ধরে সে নিয়মিত দেরাদুন থেকে চার ধামে গাড়ী চালিয়েছে বলে এই অঞ্চলের রাস্তাঘাটের সাথে সে খুব পরিচিত।
তার গাড়ী চালানো দেখে বুঝলাম সে বেশ দক্ষ ড্রাইভার। আমাদের গাড়ীটাও (Toyota RAV 4) বেশ বড়ো আর নতুন। বেশী ঝাঁকানী নেই। আমি সামনে রামেন্দ্রর পাশে ক্যামেরা হাতে বসলাম। ওরা তিনজন আরাম করে পা ছড়িয়ে পিছনে। লম্বা পাহাড়ী রাস্তায় এই বড় গাড়ীই ভালো। Comfortable and safe…
দেরাদুন শহরটা পেরোলেই পাহাড়ী রাস্তা শুরু। এই রাস্তায় আমরা মুসৌরী গেছি অনেকবার। কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে Road sign দেখে বুঝলাম আমরা মুসৌরী্র দিকে না গিয়ে অন্য দিকে বেঁকে গেলাম। রামেন্দ্র বললো ওই রাস্তাটা বাঁ দিকে মুসৌরী আর যমুনোত্রীর দিকে চলে গেছে। আমরা যাচ্ছি ডান দিকে উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রীর দিকে।
গাড়ী চলছে, জানলার বাইরে দেখছি পাহাড়ের রূপ। ছবি তুলে যাচ্ছি। কথাবার্ত্তাও চলছে টুকটাক।
রাস্তায় খুব কাজ হচ্ছে দেখছি। রামেন্দ্র বললো মোদীজী উত্তরাখন্ডে তিব্বত বর্ডারের চারিপাশে চওড়া all weather road তৈরী করছেন, যাতে army trucks আর artillery চট করে বর্ডারে পৌঁছে দেওয়া যায়। উত্তরাখন্ডে বি জে পি সম্প্রতি Assembly election এ জিতেছে। তাদের মুখ্যমন্ত্রীর বিশাল ছবি রাস্তার পাশে হোর্ডিং এ চোখে পড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ গাড়ী চালাবার পরে একটা জায়গায় এসে রামেন্দ্র গাড়ী থামালো। চা আর বাথরুম ব্রেক। দোকানের নাম কাজল রেস্টুরেন্ট এন্ড কাফে। রাস্তার ধারে বেশ ছিমছাম দোকান, সেখানে বসার জায়গা আছে, অনেক গুলো টেবিল চেয়ার। আমরা যখন গেলাম তখন দোকানে কোন লোক নেই। আমরা গরম কফি আর বিস্কুট অর্ডার করে বসলাম। ওদের টয়লেটটা খুব পরিস্কার, দেখে বেশ ভাল লাগলো। এই পাহাড়ের দেশের লোকেদের ওপর বেশ একটা শ্রদ্ধা আর সন্মানের ভাব জন্মাচ্ছে আমার মনে। দোকানের মালিক কাউন্টারে বসে আছেন তাঁর সাথে কিছুক্ষণ গল্প জুড়ে দিলাম।




উত্তরকাশী যাবার পথে এবার নদীর পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে আমাদের রাস্তা। দূরে পাহাড়, পাশে নদী নুড়ি পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে আমরা নদীর এদিকে মাঝে মাঝে ব্রীজ পার হয়ে ওদিকে। রামেন্দ্র আমাদের বলে দিয়েছে এখানে নদীর নাম গঙ্গা নয়। এখানে তার নাম হলো ভাগীরথী। আরও নীচে রুদ্রপ্রয়াগ আর দেবপ্রয়াগে মন্দাকিনী আর অলকনন্দারর সাথে মিশে যাওয়ার পরে তিন সখীর মিলিত নাম হলো গঙ্গা, যা তার পরে হৃষিকেশ আর হরিদ্বারে সমতলে নেমে এসেছে।
কিছুক্ষণ পরে আমরা ভাগীরথী নদীর ওপরে Tehri dam এর কাছে এসে পৌঁছলাম। এখানে Hydroelectric power generation plant আছে। ২০০৬ সালে এই বাঁধের কাজ শেষ হবার পরে এখান থেকেই এখন উত্তরাখন্ডের প্রায় ৯০% বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। রামেন্দ্র আমাদের একটা Viewing point এর সামনে নিয়ে গেল। খুব দূর থেকে নীচে দেখা যায় বাঁধের reservoir – বিশাল এক নীল হ্রদ।
রক্তকরবীতে রাজা নিজের সাথে নন্দিনীর তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “সরোবর কি ফেনার নূপুর পরা ঝর্ণার মত নাচতে পারে?” টেহরী বাঁধের বিশাল নীল সরোবর দেখে আমার রাজার সেই কথাটা মনে পড়লো। ফেনার নূপুর পরা উচ্ছল বালিকা ভাগীরথী কে এখানে পায়ে শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।




উত্তরকাশী পৌঁছলাম প্রায় দেড়টা নাগাদ। উত্তরাখন্ডের এই শহরটিকে বেশ ধূলিধূসরিত আর নোংরা মনে হলো । বেশ চওড়া একটা রাস্তা, সেখান দিয়ে একের পর এক বাস আর গাড়ী চলে যাচ্ছে। বেশ কিছু বাসের পিছনে বদ্রীনাথ লেখা আছে দেখলাম। রাস্তার দু’পাশে দোকান, তার মধ্যে রামেন্দ্রর বাছা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করলাম। মেনু দেখে বুঝলাম এখানে প্রধান দু’টো খাবার – staple food – হলো মোমো আর ম্যাগীর স্যুপ। কিসের মাংস দেবে কে জানে এই ভেবে আমরা তিন জন নিরামিষ মোমো অর্ডার করলাম কিন্তু বুবান নিরামিষ ভালবাসেনা। আমরা অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে চিকেন মোমো অর্ডার করলো।
সেই ২০১৭ সালের পর থেকে কি একটা ওষুধ খাবার পরে তার পেট এখনো একদিনও খারাপ হয়নি জানালো সে। এখানে চিকেন মোমো খেয়েও তার কিছুই হবেনা সে নিশ্চিত।
বুবান বললো , “আমার পেটটা বীভৎস!”
বীভৎস?
বুবান একটু অপ্রস্তুত আর লজ্জিত ভঙ্গীতে বললো, এখানে বীভৎস মানে ব্যাপক, মানে ভাল, দারুণ, দুর্দ্দান্ত!”
কত বদলে যাচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষা!
খেয়ে দেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে রাস্তার এক ঠ্যালাওয়ালার কাছ থেকে কিছু ফল – কমলালেবু, আঙ্গুর ইত্যাদি কেনা হলো। তারপরে আর সময় নষ্ট না করে সোজা ধারালীর পথে।
এবার পাহাড়ী রাস্তায় ক্রমাগত সেকেন্ড গীয়ারে ওঠা। এঁকে বেঁকে আস্তে আস্তে এক পাহাড় থেকে পাশের পাহাড়ে চলে যাচ্ছি, যত ওপরে উঠছি তত যেন বেশ ঠান্ডা লাগছে, আমরা সকলেই গায়ে আর এক গরম জামা পরে নিলাম। কেউ জ্যাকেট, কেউ সোয়েটার, কেউ শাল।
রাস্তার এক একটা বাঁক ঘুরতেই আশ্চর্য্য সুন্দর সব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পাহাড়ের গায়ে বৃত্তাকারে নেমে গেছে ক্ষেত, দূরে ছোট ছোট গ্রাম দেখা যায়, সেই গ্রামের ছোট ছোট বাড়ীতে বিকেলের সূর্য্যের আলো এসে পড়েছে। মাঝে মাঝেই দূরের পাহাড়ের গা থেকে ধোঁয়া উঠছে দেখা যায়। রামেন্দ্র বললো – Forest fire – বনে আগুন লেগেছে, তাই ধোঁয়া।
ক্রমশঃ দূরের পাহাড়গুলো কাছে চলে আসতে শুরু করলো, তাদের চূড়ো সব বরফে ঢাকা। সেই বরফের ওপরে অস্তগামী সূর্য্যের লাল আলো এসে পড়েছে।
জীবনে অনেক হিল স্টেশনে গিয়েছি কিন্তু এত কাছ থেকে বিশাল বরফে ঢাকা পর্ব্বতচুড়ো দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম।
বুবান বললো, “জ্যেঠু আমরা আর একটু ওপরে উঠলে ওই ঝাউ গাছ গুলোর মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের চুড়োয় বরফের মধ্যে সূর্য্যের লাল আলো এসে পড়ছে, এরকম বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিও। বীভৎস উঠবে। ”

