মোহাম্মেদ  ইমলাক হুসেন সাহেবের আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন

কুয়েতে  আমরা  মুরগাবে কর্ণফুলী স্টোর্সে নিয়মিত বাজার করি। তরীতরকারী ছাড়াও সেখানে বাংলাদেশের মাছ পাওয়া যায়। বরফের মাছ ঠিকই, তবু  কুয়েতের সমুদ্রের   fresh মাছের সাথে মাঝে মাঝে দেশের কাতলা মৃগেল আর পাপ্তা পার্শে ও খেতে ইচ্ছে করে। এর মধ্যে মুরগাবে অনেক বাংলাদেশী দোকান ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠলেও আমাদের কাছে কর্ণফুলী স্টোর্সের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।

এর প্রধান কারণ তাদের Customer relationship management (CRM) অন্য দোকানগুলোর থেকে অনেক ভালো, এবং তার জন্যে  স্বীকৃতি দিতে হবে তাদের মালিক মোহাম্মেদ ইমলাক হুসেন সাহেবকে। ভদ্রলোক দেখতে ছোটখাটো, কথা খুব কম বলেন, কিন্তু তাঁর ভেতরে একটা রাশভারী ব্যক্তিত্ব আছে, যেদিন তিনি কাউন্টারে থাকেন, সেদিন সব কর্ম্মচারী দের বেশ তঠস্থ দেখা যায়, ইমলাক সাহেব  তাদের কাজে কোন গাফিলতি দেখলে কোন চ্যাঁচামেচি করেননা, তাদের দিকে কেবল ঠাণ্ডা চোখে তাকান, ব্যাস তাতেই কাজ হয়…

কিছু ম্যানেজার আছেন যাঁরা চোখ রাঙান, আবার কিছু আছেন যাঁরা শুধু ঠান্ডা চোখে তাকান। ইমলাক সাহেব এই দ্বিতীয় দলের।  কর্ণফুলী স্টোর্সের এত বাড়বাড়ন্ত তাঁর কর্মকুশলতা আর নেতৃত্বেই হচ্ছে ধরে নেওয়া যায়, ইতিমধ্যে আবু হালিফার দিকেও তাদের একটা দোকান খোলা হয়েছে।

দোকানের বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ডে দোকানের নামের তলায় বেশ বড় বড় করে তাঁর নাম লেখা –  “প্রোঃ – মোঃ ইমলাক হুসেন।”

কুয়েতের মত বিদেশে বসে এত বড় একটা দোকান চালানো সোজা কাজ নয়।  বাংলাদেশ থেকে তরীতরকারী মাছ আমদানী করা (Supply chain management, Storage), এখানকার কাস্টমস্‌, পুলিশ, মিউনিসিপ্যালিটি র লোকেদের তোয়াজ করা, কর্ম্মচারীদের কাজ দেখা, competition সত্ত্বেও sales  আর customer   বাড়ানো, এত সব দায়িত্ব প্রায় একা নিজের কাঁধে বইছেন তিনি, তাঁর এই    উদ্যোগী স্বভাবের  তারিফ করতেই হয়।

আমরা তাঁর দোকানে গেলে বিশেষ করে সুভদ্রাকে দেখলে আমি লক্ষ্য করি ইমলাক সাহেব কেমন যেন  বিহবল  হয়ে যান্‌। যেন কি করবেন ভেবে পান্‌না। নিজে আমাদের জন্যে ডাবের জলের can নিয়ে এসে খাবার জন্যে সাধাসাধি করেন। সুভদ্রা যা চায়, সে মাছই হোক, বা মুড়ি বা জর্দ্দা, তাঁর দোকানে না থাকলে তিনি নিজে ছুটে বাইরে কোন দোকান থেকে   নিয়ে আসেন।

আর আপত্তি জানালে তাঁর মুখে একটাই কথা, “অসুবিধা নাই”…

একদিকে কর্ম্মচারীদের সাথে কঠিন আর ঠান্ডা  ব্যবহার, অন্যদিকে  বিনয় বিগলিত, মাথা নীচু, মুখে হাসি, সুভদ্রাকে দেখলেই  ইমলাক সাহেবের ওই পরিবর্ত্তনটা আমি খুব উপভোগ করতাম।  

শেষের দিকে তাঁর সাথে বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল, নানা রকম ব্যক্তিগত কথা বলতেন। স্ত্রী ও ছেলে কে USA পাঠিয়ে দিয়েছেন,  শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে, এই সব।  ক্রমশঃ তাঁকে বেশ ক্লান্ত, বিপর্য্যস্ত, চিন্তিত মনে হতো।  মাথায় বেশ কিছু পাকা চুল। দেখা হলে আমায় প্রায়ই বলতেন চট্টগ্রাম আসবেন একবার বৌদি কে নিয়ে, আমি সব বন্দোবস্ত করে দেবো, হোটেল, গাড়ী, গাইড। আপনাদের কোন চিন্তা নাই। পতেঙ্গা কক্সবাজার রাঙামাটি সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবো।

আমার সাথে কথা বলার সময় ইমলাক সাহেব আমাদের দিকের বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, ভুলেও বাঙাল ভাষায় বলতেন না। ভাবী নয়, বৌদি। দিমু নয়, দেবো।

তো একদিন বাজার করতে গিয়ে সাইন বোর্ডে চোখ পড়লো, দেখলাম সেখানে ইমলাক সাহেবের নাম আর নেই।

কি হলো? 

শুনলাম তিনি  আর নেই, কর্ণফুলী স্টোর্স এর মালিকানা এখন নতুন কারুর হাতে। পুরনো কর্ম্মচারীরা সবাই আগের বলেই মনে হলো। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল ইমলাক সাহেব নাকি ব্যবসার বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

কর্ম্মচারীদের কথা মতো ইমলাক সাহেব  ভালো লোক ছিলেন, কিন্তু ওনার বৌ আর ছেলে নাকি তাঁর কাছ থেকে  টাকা চেয়ে চেয়ে তাঁকে “এক্কেরে শ্যাষ কইরা দিসিলো।” টাকা নিয়ে পালানো ছাড়া নাকি তাঁর আর কোন উপায় ছিলোনা।

এক উদ্যোগী সফল ব্যবসাদার ভদ্রলোক থেকে একজন চুরির আসামী  …ইমলাক সাহেবের এও এক আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন!    

3 thoughts on “মোহাম্মেদ  ইমলাক হুসেন সাহেবের আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন

  1. “তাঁর মুখে একটাই কথা, “অসুবিধা নাই”…”

    চট্টগ্রামে গিয়ে লোকেদের মুখে ওরকম আরেকটি কথা শুনেছি “কোন সমস্যা নাই’।
    কানে লাগত, কারণ আমার সময়ে তা কখনো শুনিনি।

    ভাষা সময়ের সাথে বদলে যায়।

    Liked by 1 person

  2. মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।
    ইন্দ্র কলম দিয়ে পাঠকদের ওর সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। এটাই ওর বৈশিষ্ট্য।

    Like

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।