পাকিস্তান আর ভারত

আজকাল সুভদ্রা আর আমি মাঝে মাঝে দিল্লী যাই।  সেখানে আমাদের ছোট মেয়ে বুড়ী থাকে, আমরা মেয়ে জামাই আর নাতি নাতনীদের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে আসি। দিল্লী গেলেই মুকুর সাথে দেখা হয়, আর আমরা নিয়ম করে একদিন কিছুক্ষণ একসাথে কাটাই।

মুকু আমাকে ওর গাড়ীতে তাদের Army Officers Golf Club এ নিয়ে যায়। সেখানে আমরা দুই ভাই গলফ কোর্সের পাশে একটা খোলা রেস্টুরেন্টে বসে নানা গল্প করে সময় কাটাই।

আর্মিতে অনেক বছর অফিসার হয়ে কাজ করেছে মুকু, দেশের নানা জায়গায় তার পোস্টিং ছিল। সে হলো যাকে বলে একজন পোড় খাওয়া আর্মি  অফিসার।    

সাধারণ ভারতীয় আর পাকিস্তানী লোকেদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এই গল্পটা তার কাছ থেকে সম্প্রতি শুনলাম।

ভারত আর পাকিস্তান শুনলেই মনে হয় সাবজেক্টটা খুব সংবেদনশীল, এই নিয়ে অনেক তর্কাতর্কির অবকাশ আছে। সেই তর্কের মধ্যে চলে আসে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ১৯৬৫ আর ১৯৭১ এর যুদ্ধ, কাশ্মীর, কারগিল, মুম্বাই এর তাজমহল হোটেল। নানা তিক্ততা ও অসূয়া।

কিন্তু মুকুর এই গল্পটি শুনলে এই দুই দেশের মানুষের সম্পর্কের সম্বন্ধে একটা অন্যরকম ধারণা হয়।  Ground level এ দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক শত্রুতার নয়, সেই সম্পর্ক অনেক সময়ই বরং বন্ধুত্বের।   

মহম্মদ ইকবাল রহমান (M I Rehman) নামে মুকুর এক সহকর্ম্মী অফিসারের এক আত্মীয়ের বিয়ে হচ্ছে পাকিস্তানের করাচীতে।  অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে Ministry of Foreign Affairs আর  Indian Military Intelligence থেকে সে সেই বিয়েতে যোগ দেবার অনুমতি যোগাড় করেছে।

সেখান থেকে ফিরে এসে সে মুকু কে করাচীতে তার অভিজ্ঞতার র এই আশ্চর্য্য গল্পটা বলেছিল।    

সে বললো করাচীতে যতদিন সে ছিল, নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সব জায়গায় তাকে shadow করতো plainclothes এ পাকিস্তানী Security agency ISI এর একজন লোক। যেখানেই সে যায়, সেখানেই কাছাকাছি বসে থাকে অথবা তাকে নজর রেখে ঘুরে বেড়ায় সেই লোকটি।

ইকবাল এবং সে কেউ কারুর সাথে কথা বলেনা, কিন্তু দুজনেই জানে পরস্পরের উপস্থিতি। ইকবাল জানে ঐ ISI এর লোকটি তার নিজের কাজ করছে, তার ওপরে নজরদারী রাখাই হলো তার কাজ।

এর মধ্যে বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ, পরের দিন ইকবালের দেশে ফেরার কথা, সে যাবার আগে তার আত্মীয় বন্ধুদের এক রেস্টুরেন্টে খেতে ডেকেছে। সেখানেও ইকবাল দেখলো যথারীতি সেই লোকটি পাশের এক টেবিলে চুপচাপ এক কাপ চা নিয়ে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

পার্টি শেষ, ইকবাল বিল pay করতে গেল, গিয়ে শোনে তার বিল কেউ একজন already pay করে দিয়েছে। ইকবাল তো অবাক।  এই বিদেশে কে তার বিল অযাচিত ভাবে pay করে দিলো?

কাউন্টারের  ভদ্রলোক তখন ওই ISI এর স্পাই টির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।  ওই লোকটাই তার বিল pay করেছে!

তাই শুনে ইকবালের বেশ রাগ হয়ে গেল।

এতদিন সে এই লোকটাকে সহ্য করে এসেছে, কিন্তু আজ এই শেষ রাতে তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল।  সে সেই লোকটার কাছে গিয়ে বললো, “সেই প্রথম দিন থেকে আপনি আমায় ফলো করছেন, আমি কিছু বলিনি, আজ এখানে আমার শেষ রাত, আমি আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় দের এখানে খাওয়াতে নিয়ে এসেছি, সেখানেও আপনি এসে আমার সামনে বসে আছেন, তাও আমি আপত্তি জানাইনি। কিন্তু আপনি আমার রেস্টুরেন্টের বিল ও মিটিয়ে দেবেন, এটা কি হচ্ছেটা কি?”

তাই শুনে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ইকবালের দুটো হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খুব বিনীত আন্তরিক ভাবে বললো, “স্যার,  please আমার ওপর রাগ করবেন না। এ ক’দিন আমি আপনাদের কাছে থেকে আপনাদের কথাবার্ত্তা শুনে জেনেছি যে আপনারা সবাই originally হায়দ্রাবাদের । জানেন আমিও হায়দ্রাবাদের ছেলে, ওখানেই আমার জন্ম, ওখানেই আমি বড় হয়েছি। আমার যখন দশ বছর বয়েস, তখন আমার আব্বা আর আম্মা আমায় নিয়ে করাচীতে চলে আসেন। কিন্তু এখনো আমি হায়দ্রাবাদে আমার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা ভুলতে পারিনা। আপনি হায়দ্রাবাদ থেকে এসেছেন, তাই আপনাকে এবং আপনার এখানকার আত্মীয় বন্ধুদের সবাইকে ক’দিন থেকেই আমি খুব আপন ভাবছি। আপনারা হলেন আমার মেহমান, এই দেশে আমার অতিথি। সুতরাং আপনাকে অনুরোধ, আজ আপনাদের আতিথেয়তা আমায় করতে দিন্‌।”

1 thought on “পাকিস্তান আর ভারত

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।