
১ – একাল সেকাল
ত্রিশ বছর পর কাজ থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে দূর্গা পূজোর দিনগুলো এখন কলকাতায় কাটাচ্ছি। চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ শুনছি আর মন চলে যাচ্ছে সেই পঞ্চাশ ষাট আর সত্তরের দশকের আমার কম বয়েসের পূজোর দিনগুলোতে।
পবিত্র সরকারের লেখা সনৎ সিংহের গাওয়া একটা জনপ্রিয় গান মনে পড়ে। সেই গানে পাঠশালায় ছেলেমেয়েরা নামতা মুখস্থ করছে, কিন্তু তাদের মন পড়ে আছে চন্ডীতলায়, সেখানে কুমোর ঠাকুর গড়ার কাজে ব্যস্ত, পূজোর আর বেশী দেরী নেই, তাদের খুব ইচ্ছে করছে এক ছুটে চলে যায় সেখানে। হয়তো মায়ের চোখ আঁকা হচ্ছে এখন, কিংবা মোষের পেট ফেটে অসুর হয়তো বেরিয়ে এসেছে এতক্ষণে। পবিত্র সেই গানে চমৎকার ধরেছেন ছোটদের মনের ওই অস্থিরতা, পূজো আসার আগে থেকেই মনের মধ্যে আমিও কমবয়সে ঠিক ওইরকম একটা উত্তেজনার ভাব টের পেতাম।
কাছে এলো পূজোর ছুটি, রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপাফুলের রং। কবি বলেছেন।
একটা বয়স ছিল যখন সেই রং লাগতো আমার মনেও।
নিয়ম করে প্রতি বছর মহালয়ার দিন রাত থাকতে উঠে সব ভাইবোনদের সাথে অন্ধকারে রেডিওর সামনে বসে কত আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে মহিষাসুর মর্দ্দিনী অনুষ্ঠান শুনতাম তখন। পূজোর আগে কোথাও বাঁশ দিয়ে প্যান্ডেলের কাঠামো তৈরী হচ্ছে দেখলে মন কেমন একটা অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠত। দেব সাহিত্য কুটীরের শারদীয়া পত্রিকা বাড়ীতে এলে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। টেনিদা’ আর তার দলবল, কিংবা হর্ষবর্ধন গোবর্ধন দুই ভাইয়ের মজার যত সব কান্ডকারখানা! পূজোর জলসায় পূজোর গান গাইতে আসতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। “পূজোয় চাই নতুন জুতো” নামে বাটা একটা ক্যাম্পেন করতো পূজোর সময়। আমরা পূজোয় পেতাম নতুন জুতো আর জামাকাপড়…
এখন আর মহালয়ার ভোরে ঘুম ভাঙেনা। এখন সি ডি চালিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুনি। পূজোর আগে এক গাদা বাঁশ রাস্তায় স্তূপ হয়ে পড়ে আছে কিংবা রাস্তা বন্ধ করে প্যান্ডেল হচ্ছে দেখলে আজকাল বেশ বিরক্তই লাগে। টেনিদা’ আর হর্ষবর্ধন গোবর্ধন নিরুদ্দেশে চলে গেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্ররা আর নেই। এখনো রমরম করে চলে পূজোর বাজার, কেনাকাটা। ফুটপাথে অসংখ্য হকারের স্টল, ভীড় ঠেলে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, ভাল লাগেনা।
আজও পূজোর বেশ কিছু দিন আগে থেকে শহরের প্রায় সব রাস্তার দুই পাশ বড় বড় হোর্ডিং এ ঢাকা থাকে। তবে সেই সব হোর্ডিং গুলোতে খেয়াল করলে দেখা যায় অর্ধেকের ওপর বিজ্ঞাপন পান পরাগ আর পানমসালার।
এই সব কোম্পানী মৃত্যু বেচে এত লাভ করছে ? ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
কমবয়েসে আমরা ভীড়ের মধ্যে গা ভাসিয়ে ঘুরে ঘুরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিমা দেখে বেড়াতাম। পা ব্যথা কি বস্তু জানাই ছিলনা। এখন আগের মত ভীড়ের মধ্যে গা ভাসিয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার সামর্থ্য এবং উৎসাহ কোনটাই নেই। এখন বাড়ীতে আরাম করে বসে ইন্টারনেট কিংবা টিভি তেই সব ঠাকুর বেশ ভাল ভাবেই দেখা যায়। তা ছাড়া আছে ফেসবুক, এবং নানাবিধ Mobile App…
আগে বারোয়ারী পূজোর খরচ উঠতো বাড়ী বাড়ী চাঁদা তুলে। এখন কর্পোরেট স্পনসরশীপ আর তোলাবাজীর টাকা থেকে কোটি কোটি টাকা খাটে এক একটা পূজোয়। এখন পূজো হলো big business…
এ বছর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে থীম ছিল মহাভারত, সেখানে দেখলাম অর্জ্জুন আর শ্রীকৃষ্ণের এক বিশাল রূপোর রথ, যার দাম নাকি কুড়ি কোটি টাকা। এত টাকা এরা কোথায় পায় কে জানে? এদিকে দেশে লোকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। ওই রথ আর অনাবশ্যক, অবিশ্বাস্য অপচয় দেখে শামশুর রহমানের কবিতার সেই লাইনটা মনে পড়ে যায়।
“এক অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে চলেছে স্বদেশ~”
সময় বদলেছে, আমি নিজেও বয়সের সাথে সাথে অনেক পালটে গেছি, আমার সেই সবুজ চশমাটা হারিয়ে গেছে। এখন আর আমার মনে চাঁপাফুলের রং লাগেনা।
But, wait….
একটা জিনিষ আছে যা এখনও আনন্দে মন মাতায়, তা হলো ওই ঢাকের আওয়াজ। সনৎ সিংহের সেই গানের কথায় সেটা এখনও আগের মতোই “মিষ্টি মধুর”‘~
“তা ধিনা তাকতা ধিনা, তাক গুড় গুড়, কুরুড় কুরুড় তাক… ”



সমাজসেবী সঙ্ঘ হিন্দুস্তান পার্ক সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার
২ – পূজো না উৎসব?
সাবেকী না থীম? পূজো না উৎসব? এই নিয়ে এখন কলকাতায় serious তরজা চলছে।
এখন হলো থীম পূজোর যুগ। সার্ব্বজনীন পূজো মানে এখন শুধু প্রতিমা নয়, প্যান্ডেলসজ্জা, আলো এই সব নিয়ে একটা সর্ব্বাঙ্গীন প্যাকেজ। অবশ্য কিছু পুজো যেমন একডালিয়া, বাগবাজার, কলেজ স্কোয়ার এখনও তাদের সাবেকী পূজোর পরিবেশ বজায় রেখেছে। তাদের বক্তব্য হলো পূজো তে ভক্তিভরে মায়ের আরাধনাই হলো আসল, বাকি যা তা হলো বর্জ্জনীয় আড়ম্বর।
ওদিকে যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লী, সমাজসেবী, নাকতলা, বেহালা সুরুচি সঙ্ঘ, ত্রিধারা অকালবোধন, মুদিয়ালী, কসবা বোসপুকুর, এবং অন্য অনেক নামী দামী পুজোতেই এখন থীম। সেখানে কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের সাবেকী সনাতন প্রতিমার জায়গা এখন অধিকার করে নিয়েছেন আর্ট কলেজের স্বনামধন্য শিল্পীরা – ভবতোষ সুতার, সনাতন দিন্দা এবং অন্যান্যরা। তাঁদের তৈরী মায়ের প্রতিমার নান্দনিক সৌন্দর্য্য দর্শক কে মুগ্ধ করে ঠিকই, কিন্তু সাবেকীদের মতে সেই মুগ্ধতার মধ্যে কোথায় যেন মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসা ও ভক্তিবোধের কিছুটা অভাব থেকেই যায়। কিন্তু থীমের প্রবক্তাদের মত হলো থীম হচ্ছে উৎসবের অঙ্গ। থীমই হাজার হাজার মানুষ কে পূজোর দিকে টানে, থীমের মধ্যেই আছে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার প্রধান উপাদান।
এবছর আমি আর সুভদ্রা চতুর্থী আর পঞ্চমীর দিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এক দিন দক্ষিণ আর এক দিন উত্তর কলকাতা। পূজো শুরু হতে তখনও দুই দিন বাকী, তবু চতুর্থী থেকেই রাস্তায় মানুষের ঢল।
সমাজসেবী সঙ্ঘের এবারের পূজোর থীম অন্ধদের নিয়ে, সেখানে প্যান্ডেলে সব কিছু ব্রেলে লেখা। রামরাজাতলায় সুভদ্রাদের দূর্গাবাড়ীর পিছনে ইছাপুর জগাছার বিখ্যাত শিবাজী সঙ্ঘের পুজো। সেখানে এবছর থীম হলো আমাদের জীবনে টেকনোলজীর অভিশাপ। প্যান্ডেল জুড়ে মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপের ছবি। ছেলেমেয়েরা সবাই মাথা নীচু করে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। বিবেকানন্দ রোডের লোহাপট্টি চালতাবাগানে থীম এবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিশাল ছবি, তাঁর কবিতা লেখা চারিদিকে, মাইকে তাঁর গান বাজছে। কত পরিকল্পনা, যত্ন আর কত লোকের পরিশ্রম লুকিয়ে আছে এই সব থীম তৈরীর পিছনে তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
আগে কলেজ স্কোয়ারে ঠাকুর দেখে পাশেই প্যারামাউন্টে মালাই সরবৎ খাওয়া আমাদের নিয়ম ছিল। কিন্তু এবার চতুর্থীর বিকেলেই দোকানের দরজায় ভীড় উপছে পড়ছে। প্যারামাউন্টে সরবৎ না খেতে পাওয়ার দুঃখ কিছুটা অন্ততঃ ভোলা গেল বিবেকানন্দ রোডের চালতাবাগানে। সেখানে রাস্তার পাশে দোকানে গরম গরম সিঙ্গাড়া আর অমৃতি বিক্রী হচ্ছে… খেতে একেবারে অমৃত!
সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে ফেরার সময় মহম্মদ আলি পার্কের বিরাট পূজো। দেখি বাঁশ দিয়ে তৈরী বেড়ার মধ্যে দিয়ে পিলপিল করে হাজার হাজার লোক ঢুকছে, প্রায় মাইল খানেক লম্বা লাইন। আমি সুভদ্রাকে বললাম, “কি যাবে নাকি?”
সুভদ্রার প্রশ্নসূচক উত্তর খুব সংক্ষিপ্ত। সে ভুরু কুঁচকে বললো, “পাগল?”



চালতাবাগান হিন্দুস্তান পার্ক শিবাজী সঙ্ঘ, জগাছা, হাওড়া



কলেজ স্কোয়ার ত্রিধারা চালতাবাগান
৩ – বাড়ীর পূজো
আমার শ্বশুরবাড়ীতে, হাওড়ার রামরাজাতলায় ১৯৬০ সালে নিজেদের বাড়ীতে দূর্গা পূজো শুরু করেছিলেন সুভদ্রার জ্যাঠা কাকা বাবারা। সেই পূজোর প্রায় ষাট বছর হতে চললো। বাবা কাকারা এখন আর কেউ নেই, এখন পূজোর দায়িত্ব নিয়েছে পরের প্রজন্ম, বাড়ীর ছেলে মেয়ে বৌরা। দেশে ফিরে আসার পর থেকে সুভদ্রা এখন পূজোর অনেক দায়িত্ব সামলায়। পূজোর দিনগুলো আমাদের সেখানেই কাটে।
বাড়ীর পূজোতে ওই সাবেকী vs উৎসবের conflict টা নেই। এখানে নিষ্ঠা আর ভক্তির সাথে পূজো হয়, এবং একই সাথে পারিবারিক আনন্দ উৎসবেরও একটা চমৎকার জমজমাট পরিবেশ তৈরী হয়। ইংরেজীতে যাকে বলে best of both worlds…
রামরাজাতলায় সুভদ্রাদের লতায় পাতায় ছড়ানো ছিটোনো তিন চার পুরুষের বিশাল যৌথ পরিবার। এবং এই বিশাল পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্প্রীতি এখনও অটুট, মাঝেই মাঝেই নানা অনুষ্ঠানে অনেকে একসাথে জড়ো হয়। স্বাভাবিক ভাবেই তাই পূজোতেও রোজ এই extended family র অনেকে নিমন্ত্রিত হয়ে সুভদ্রাদের বাড়ীতে আসেন। পূজোতে অংশ নেবার পরে সবাই মিলে পূজোর দালানে বসে গল্প, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া হয়। সমবেত হাসি ঠাট্টার কলতানে ঠাকুরদালান মুখরিত হয়ে ওঠে।
বাড়ীর মেয়েরা সবাই মিলে পূজোর কাজের ভার নেয়। ভোরবেলা উঠে ভোগ রান্না করা, শাঁখ বাজানো, প্রদীপ হাতে ঘুরে ঘুরে সবাই কে হোমের শিখার তাপ দেওয়া, প্রসাদ বিতরণ এই সব কাজ ভাগাভাগি করাতে বেশ একটা মজা আছে। সুভদ্রাদের কুলদেবতা হলেন নারায়ণ, পূজোর দালানে যে হাড়িকাঠ আছে সেখানে পাঁঠার বদলে চালকুমড়ো বলি হয়, সেটাও বেশ একটা দেখার মত জিনিষ।
সকাল থেকেই পূজোর আয়োজন শুরু হয়ে যায়। প্রথমে পূজো, তারপরে এক এক করে হাড়িকাঠে চালকুমড়ো বলি, পুষ্পাঞ্জলি, হোম। শেষে শান্তির জল। অষ্টমী আর নবমীর মাঝে সময় মেনে হয় সন্ধিপূজো। সেই পূজোতে সবাই মিলে রামচন্দ্রের একশো আট গোলাপী পদ্মফুল মা’র পায়ে অর্পণ করে প্রদীপ জ্বালানো হয়। পদ্মফুল বাজার থেকে আসে আধফোটা অবস্থায়। সেই ফুল হাত দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে তারপর ধীরেসুস্থে সাবধানে একটা একটা করে পাপড়ি ফোটানোর কাজটা বেশ সময়সাপেক্ষ। বাড়ীর মেয়েদের ওপরেই থাকে সেই কাজের ভার।
আর রোজ সন্ধ্যায় হয় ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে আরতি। তখন বাড়ীশুদ্ধ সবাই পূজোর দালানে এসে জড়ো হয়। কাঁসরঘন্টার আওয়াজ আর ধুনোর ধোঁয়ায় আর গন্ধে কিছুক্ষনের জন্যে সেখানে একটা মোহময় অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মা’ যেন ধীরে ধীরে সবার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠেন।
দুপুরে রোজ জমিয়ে খাওয়া হয়। আজকাল তো আর মাটিতে বসে কলাপাতা শালপাতা মাটির ভাঁড় নেই। এখন চেয়ার টেবিলে বসে কাগজের প্লেট আর গ্লাস। তবু সেই “ওরে এদিকে একটু শুক্তো”, অথবা “জগন্নাথ, চিংড়ী মাছটা এদিকে আর এক রাউন্ড পাঠা”, কিংবা “ভাই, আমায় একটু দই এর মাথা প্লীজ্” এসব তো আর কোন দিন পুরনো হবেনা, এসব হলো চিরকালীন।
আর আমার কাছে যেটা সব চেয়ে লোভনীয় ছিল তা হলো বাড়ীর তৈরী নানারকম মিষ্টি – নারকোলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, গজা, মোয়া। কত বছর বাড়ীর তৈরী গজা খাইনি, এ জিনিষ কি ছাড়া যায়? প্রসাদের থালা নিয়ে অনেকেই আমার কাছে আসছে, আমি সেখান থেকে বেশ কয়েকবার গজা তুলে নিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর সুভদ্রার কাছে ধমক খেলাম। “সকাল থেকে কতবার গজা খেয়েছো আজ?”
সত্যি, এই বয়সে এত মিষ্টি খাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
কিন্তু কি করবো, এতগুলো বছর দেশের বাইরে ছিলাম, আমার জীবনের গজা খাওয়ার কোটা তো কমপ্লিট হতে এখনো অনেক দেরী?
আমি সুভদ্রা কে বললাম, “না না, মা’র নাম করে খেলে কিছু হয়না।”









৪ – কেন চেয়ে আছো গো মা
এ বছর আমাদের গোল পার্কের যে ফ্ল্যাটে আমার মা আর শ্বাশুড়ী থাকেন সেই building complex এর পূজোর ঠাকুর ভাসান দেখতে বিজয়া দশমীর দিন বিকেলে আমি কয়েকজন আবাসিকদের সাথে গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলাম। আমরা যখন ইডেন গার্ডেন এর পিছনে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় চারটে, জায়গাটা বেশ গমগম করছে লোকের ভীড়ে। এক একটা ট্রাকে করে প্রতিমা আসছে, আর আসতে না আসতেই এক দল ছেলে মাথায় গামছা আর ফেট্টি বেঁধে সেখানে চলে আসছে। তাদের রেট বাঁধা, সামান্য দরাদরি হচ্ছে ব্যাস্, তারপর তারা কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে হৈ হৈ করে চলে যাচ্ছে নদীতে।
আমাদের প্রতিমাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকজন ছেলে কাঁধে চাপিয়ে নদীতে নিয়ে গেল।
ঘাটের ওপরে বাঁধানো দেয়াল, সেখানে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। পড়ন্ত বিকেলে রোদের তেজ কমে আসছে, সামনে মন্থর ঘোলাটে নদী নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে, আর সেই নদীর জলে এক এক করে প্রতিমা বিসর্জ্জন হচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখছে সবাই। মন খারাপ করা দৃশ্য। মেয়েদের সবার পরণে লাল পাড় সাদা শাড়ী, সারা মুখে গালে কপালে সিঁদূর মাখামাখি। সবাই তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। ওদিকে একের পর এক ট্রাক আসছে, তাদের ঘিরে উন্মাদের মত নেচে চলেছে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। ঢাকীরা সাথে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। বেশ frenetic scene, বিশেষ করে কাঁধে প্রতিমা নিয়ে যখন হৈ হৈ করে হাই স্পীডে ছেলেগুলো ভীড়ের মধ্যে চলে আসছে, তখন একটু অন্যমনস্ক হয়ে তাদের সামনে পড়ে গেলে বিশ্রী দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
আমরা দেয়ালের পাশে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। দূরে দেখা যাচ্ছে এক দিকে হাওড়া ব্রীজ, আর অন্য দিকে বিদ্যাসাগর সেতু, শেষ বিকেলের মায়াবী কুয়াশায় তারা কিছুটা ঢাকা। নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক প্রতিমা, কিছু লোক জলে নেমে ঘড়া বা বোতলে গঙ্গাজল ভরে নিচ্ছে, ওই নোংরা polluted জল আমাদের অনেকের কাছেই খুব পবিত্র।
যতোটা বিশৃঙ্খলা আশঙ্কা করে গিয়েছিলাম, তার তুলনায় সব ব্যাপারটা বেশ সুসংবদ্ধ ভাবেই হলো।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কাজ মিটিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম।
সেদিন পরে দুই মা’র সাথে বিজয়ার সন্ধ্যেটা কাটিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে রাত ন’টা নাগাদ গাড়ীতে করে বালীগঞ্জ পোস্ট অফিসের কাছে আমাদের আয়রনসাইড রোডের ফ্ল্যাটে ফিরছি। গড়িয়াহাট মোড়ে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। গাড়ীর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ফুটপাথে বহুলোক দাঁড়িয়ে, আর রাস্তার ওপর কাগজ পেতে হাজার হাজার লোক বসে আছে। তারা প্রতিমা বিসর্জ্জন দেখবে, তাই আগে থেকে জায়গা নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে না ঘুরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক প্রতিমা দেখার এই একমাত্র সুযোগ। একের পর এক ট্রাকে প্রতিমা আসছে, তাদের ভিতরে আলোর মালায় সাজানো ঝলমলে প্রতিমা। সামনে প্যাঁ পোঁ করে ব্যান্ড পার্টি কুচকাওয়াজ করে হাঁটছে, আর তাদের পিছনে নাচানাচি করছে বহু ছেলেমেয়ে। ট্রাকের পিছনে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়া গাড়ী বাস আর নানা যানবাহনের বিশাল লাইন।
গাড়ীতে বসে পূজোর গত কয়েকদিনের নানা স্মৃতি নানা ছবি মনে ভেসে আসছিল। বিশেষ করে মনে পড়ছিল একটু আগে পড়ন্ত বিকেলে গঙ্গার ঘাটে ছেলেদের কাঁধে বিসর্জ্জন যাবার পথে মায়ের প্রতিমার আয়ত চোখ দুটো। যেন আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আছেন।
কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখপানে…
এই গান রবীন্দ্রনাথ পঁচিশ বছর বয়েসে লিখেছিলেন, উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালীদের সম্বন্ধে। সেই সময় শোনা যায় বাংলায় নবজাগরণ এসেছিল, তবু তাঁর এই গানে বাঙ্গালীদের সম্বন্ধে তাঁর দুঃখ আর লজ্জা বেশ পরিস্কার বোঝা যায়।
এরা চাহেনা তোমারে, চাহেনা যে, আপন মায়েরে নাহি জানে/
এরা তোমায় কিছু দেবেনা, দেবেনা, মিথ্যা কহে শুধু কত কি ভাণে/
আজ যদি কবি বেঁচে থাকতেন, তাহলে উৎসবকে উপলক্ষ্য করে আজ যে মাতামাতি আর উচ্ছৃঙ্খলতা চলছে আমাদের দেশে, এই অর্থের অপচয় (unproductive expenditure) , হুজুগ আর হুল্লোড়, রাস্তায় অবিশ্রান্ত জনস্রোত, ট্র্যাফিক আটকে দিয়ে রাস্তায় উদ্দাম নাচানাচি, এই সব দেখে উনি আজকের আমাদের বাঙালীদের সম্বন্ধে কি ভাবতেন?
তবে কবির গানে মা অবশ্য দেশমাতৃকা, মা দূর্গা নন্। তবু মা’ই তো?
বিজয়া দশমীর রাতে রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে আটকে গিয়ে গাড়ীতে বসে এই সব ভাবছিলাম।
আজকের দিনটা হলো মন খারাপের দিন।







সুন্দর লিখেছ|
আসল বদল হয়েছে, সেই সবুজ বয়েস আমাদের আর নেই|
যারা এখন কাঁচা, তারা নিশ্চই সেই আনন্দ খুঁজে পায়, অন্য ভাবে হলেও|
Sent from my iPhone
LikeLike
That’s so true
LikeLike