যাও এবারের মত তোমায় ছেড়ে দিলাম ~

২৮শে মার্চ, ২০১৮।

আজ আমাদের ভিয়েতনামে শেষ দিন।  এখান থেকে আমরা যাচ্ছি কাম্বোডিয়ার সীম রীপে  আঙ্কোর ওয়াট মন্দির দেখতে।

সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে হানয় এয়ারপোর্টে যাবার পথে দুই জায়গায় আমাদের গাইড টুয়ান আমাদের নিয়ে যাবে, প্রথমে  হো চি মিনের mausoleum, যেখানে  তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত, তার পরে সেখান থেকে কাছেই Single pillar pagoda, এই দুটো জায়গা দেখার পরে আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে কাম্বোডিয়ার সীম রীপের ফ্লাইট ধরবো।

হো চি মিনের Mausolem শহরের একটা কেন্দ্রস্থলে, সেখানে চারিদিকে নানা সরকারী অফিস বিল্ডিং, পার্লামেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের বাড়ী ইত্যাদি।মিলিটারীর ছড়াছড়ি চারিদিকে। বিশাল প্রাঙ্গন সামনে, অনেকটা হেঁটে ভেতরে ঢুকতে হলো, বেশ ভীড়, লম্বা লাইন। রাইফেল হাতে মিলিটারী গার্ড রা দরজায় দাঁড়িয়ে, sunglass পরা চলবেনা, মাথায় টুপি পরা থাকলে মৃত নেতা কে সন্মান জানানোর জন্যে তা খুলে ঢুকতে হবে। এই সব নিয়ম মেনে সবাই লাইন দিয়ে ঢুকছে, সারা জায়গাটা অত লোক থাকতেও বেশ নিস্তব্ধ।

ছোট একটা ঘরে কাঁচের বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছেন হো চি মিন। ওইটুকু দেশের ওরকম একজন দুর্দ্ধর্ষ নেতা, USA র মত এক প্রবল প্রতিপক্ষ কে যুদ্ধে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। জানি তিনি মৃত তবু তাঁর এই ঘুমন্ত মুখের মধ্যেও একটা কঠিন ভাব,  মনে হচ্ছে বেশ জীবন্ত তিনি, এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন, একটু আওয়াজ হলেই হয়তো  ঘুম ভেঙে উঠে বসবেন। তাঁকে এত কাছ থেকে দেখে গায়ে বেশ কাঁটা দিচ্ছিল।

আমরা লাইন করে কাঁচের বাক্স প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে এলাম।

সেখান থেকে কাছেই One pillar pagoda সেখানে টুয়ানের সাথে আমরা হেঁটে পৌঁছে গেলাম।  এখানে চারিদিকে জলের moat এর মধ্যে থেকে উঠে এসেছে একটি column এর ওপরে তৈরী নারী বুদ্ধের (female Buddha) মন্দির, আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দর্শন করে এলাম।

হানয় এয়ারপোর্টে দেবযানীর পাসপোর্ট দেখে চেক ইন কাউন্টারের লোকটি বলল আপনার পাসপোর্টে তো দেখছি দুটো ফাঁকা পাতা নেই। নিয়ম হলো দুটো ফাঁকা পাতা না থাকলে তো আপনাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া যাবেনা।

এ আবার কি নিয়ম?

প্রদোষ আর দেবযানী  হলো কানাডার নাগরিক, তাদের মেয়েরা থাকে আমেরিকায়, কাজে এবং বেড়াতে  তারা সারা পৃথিবীতে অনবরত ঘুরে বেড়াচ্ছে।  তাদের ভূপর্য্যটক আখ্যা দেওয়া যায়।  তাদের পাসপোর্টের পাতা খুব তাড়াতাড়ি স্ট্যাম্পে র ছাপে ভরে ওঠে,  সুতরাং দেবযানীর পাসপোর্টে  দুটো ফাঁকা পাতা না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

দেবযানী বেশ বলিয়ে কইয়ে মেয়ে, তার ওপরে সে আবার খুব সুন্দরী , হানয় এয়ারপোর্টের কাউন্টারের লোকটিকে সে সহজেই বশ করে প্লেনে উঠে পড়লো।

কিন্তু তার পরে কাম্বোডিয়ার সীম রীপ এয়ারপোর্টে পৌঁছে তো এক বিরাট ঝামেলা।   আমাদের সবার visa on arrival stamped হয়ে গেল , এদিকে প্রদোষ বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু দেবযানীর পাসপোর্টে পাশাপাশি দুটো ফাঁকা পাতা না থাকায় তাকে কিছুতেই এয়ারপোর্টের Immigration officer রা বাইরে বেরোতে দিচ্ছেনা। আমরা দেখছি ম্লান মুখে দেবযানী দু’জন অফিসারের সাথে একবার এদিক আর একবার ওদিকে যাচ্ছে, বুঝলাম ওকে জেরা করা হচ্ছে কেন সে এই পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে? কি তার উদ্দেশ্য? সে কি নিয়ম জানেনা?  

ওদিকে বাইরে আমরা সবাই অধীর অপেক্ষায়। প্রদোষের মুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ।

শেষ পর্য্যন্ত দেবযানীকে অবশ্য ছেড়ে দিলো একজন senior officer, কিন্তু পরে তার মুখে সেই harrowing অভিজ্ঞতার গল্প  শুনে মনে হয়েছে যে এক সময় সত্যিই তার মনে হয়েছিল যে তাকে  কাম্বোডিয়া ঢুকতে দেওয়া হবেনা, তাকে ফিরে যেতে হবে।

বেশ কিছু দিন পরে দেবযানী বেশ মজা করে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল আমাদের।

তার গল্পে দু’জন চরিত্র, একজন মিনমিনে রোগা পাতলা জুনিয়র assistant, আর একজন মোটাসোটা বেঁটেখাটো হাট্টা গাঁট্টা সিনিয়র অফিসার।

গল্পটা এই রকম –

———————

মিনমিনে বললো ম্যাঁও ফ্যাঁও ক্যাঁও চ্যাঁও…

আমি দেবযানীকে বললাম তার মানে কি?

দেবযানী বললো ও বললো, “দেখুন না স্যার এই মেয়েটি নিশ্চয় আমাদের দেশে স্পাই করতে এসেছে এ কে ঢুকতে দেওয়া যায়না স্যার…”

হাট্টা গাঁট্টা গম্ভীর হয়ে বললো  “হাঃ কাঃ ফাঃ মাঃ !”

আমি বললাম তার মানে?

দেবযানী এই সব কথার মানে সব বুঝতে পারছে, সে বললো লোকটা আমায় জিজ্ঞেস করছে আমি এই নিয়ম টা জানি কি না? আমি তো অনেক করে বুঝিয়ে বললাম না স্যার বিশ্বাস করুন আমি এই সব নিয়ম জানিনা, আমি স্পাই নই স্যার, আমি আর আমার বর আপনাদের এই সুন্দর দেশ ঘুরে দেখতে এসেছি, আমরা ট্যূরিস্ট…

মিনমিনে মিনমিন করে বললো কুঁচু মুঁচু ফুঁচু হুঁচু…

আমি বললাম তার মানে? সে বললো বুঝলেনা ও বললো, “স্যার এর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না , এই মেয়েটা কে ঢুকতে দিলে দেশের একটা বড় বিপদ হয়ে যাবে।”

এই রকম কিছুক্ষণ চলার পরে হাট্টা গাঁট্টার বোধ হয় একটু মায়া হলো। সে বললো “ফঃ হঃ ফঃ খঃ!

দেবযানী বললো তার মানে হচ্ছে “ঠিক আছে যাও এবারের মত তোমায় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু আর যেন কোনদিন এরকম ভুল না হয়!”

——————————–

দেবযানীর এই গল্পটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের  চন্দ্রগুপ্ত নাটকের একটা  প্যারোডি ছিল তাতে এক বাঙাল জমিদার  সব চেয়ে বেশী চাঁদা দিয়েছেন বলে পাড়ার নাটকে  আলেকজান্ডারের রোল টা তাঁকে দিতেই হয়েছে,  আর তিনিও তাঁর মত করে নাটকের সব সংলাপ বলে যাচ্ছেন সইত্য সেলুকস কি বিচিত্তির এই দ্যাশ ইত্যাদি…

তো এক সময়ে স্টেজে চন্দ্রগুপ্ত কে নিয়ে সেনাপতি  Antigones এর প্রবেশ।

জমিদার – অ্যা্ন্টি গনশা, এডা কেডা?

সেনাপতি – মহারাজ এই যুবক একজন গুপ্তচর, আমাদের শিবিরের বাইরে সন্দেহজনক ভাবে আনাগোনা করছিল, তাই তাকে আপনার সামনে ধরে নিয়ে এসেছি।

জমিদার – গুইপ্তচর? এ রে বন্দী কর্‌~

চন্দ্রগুপ্ত – আমায় বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না সম্রাট!

জমিদার – ও তুমি দ্যাখতেসি বীর! হঃ, ব্যাটাকে ছাইড়্যা দে…

দেবযানীর গল্পে ওই হাট্টা গাঁট্টা অফিসার হলেন আলেকজেন্ডার, আর দেবযানী হলো female বুদ্ধর মতো female চন্দ্রগুপ্ত !