রঞ্জু আর অলিম্পিক    

অলিম্পিক এলেই আমার রঞ্জুর কথা মনে পড়ে।

রঞ্জু আমার মেজমাসীর ছেলে, ছোটবেলা থেকেই আমরা ছিলাম যাকে বলে অভিন্নহৃদয়, হরিহরাত্মা। মা আর আমার মেজমাসী পিঠোপিঠি বোন ছিলেন, মাসী মা’র থেকে প্রায় আট বছরের বড় হলেও তাঁদের দুই বোনের মধ্যে দুর্দ্দান্ত bonding ছিল, মা আমায় নিয়ে ছুটির দিনে প্রায়ই হাজরা মোড় থেকে তেত্রিশ নম্বর বাসে চেপে এন্টালী তে মাসীর বাড়ীতে চলে যেতেন। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে মা আর মাসী দু’জনে বিছানায় মুখোমুখি বসে গল্প করতেন, আমি আর রঞ্জু বাড়ীতে কিংবা বাড়ীর বাইরে সারা দুপুর বিকেল খেলা করে বেড়াতাম। রঞ্জু ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত, সেই তুলনায় আমি শান্ত আর চুপচাপ ছিলাম, আমাদের দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব হবার সেটাও একটা কারণ হতে পারে।

এই ২০২৪ সালে এখন প্যারিসে অলিম্পিক চলছে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে চৌষট্টি বছর আগে ১৯৬০ সালের টোকিও  অলিম্পিকের কথা। তখনই আমাদের প্রথম অলিম্পিক নিয়ে উৎসাহ শুরু হয়। আমরা সব পুরনো এবং সমসাময়িক  অলিম্পিক hero দের সম্পর্কে পড়াশোনা করে নানা তথ্য আহরণ করতে শুরু করে দিলাম। এমিল জ্যাটোপেক, পাভো নুরমি, জেসি ওয়েন্স, বব্‌ বিমন, আবেবে বিকিলা, কিপজোগ কিনো, সারজি বুবকা, এদের সবার কীর্ত্তিকলাপ জানার জন্যে আমরা মাঝে মাঝে থিয়েটার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে চলে যেতাম। সেখানে World Sports পত্রিকার পাতায় পাতায় এইসব কিংবদন্তীদের নিয়ে অনেক খবর।

আসলে আমাদের ওই বয়সে মনের জানলা গুলো ক্রমশঃ খুলছে, তাই অলিম্পিকের আদর্শ, সারা পৃথিবীর দেশের athlete আর sportsman মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা সেই ১৯৬০ সালে আমাদের মনকে খুব উদ্বুদ্ধ আর অনুপ্রাণিত করেছিল মনে পড়ে। আমরা নিজেদের মধ্যে প্রায় “অলিম্পিক অলিম্পিক” খেলেছি, কখনো আমি জাপান, রঞ্জু চীন, কিংবা আমি East Germany, রঞ্জু Russia , অথবা আমি USA, রঞ্জু England !  রঞ্জুদের বাড়ীর একতলার সিঁড়িতে রবারের বল kick করে  ওপরে পাঠিয়ে বলটা ক’বার drop করে নীচে নামলো, কিংবা দৌড়ে ওপরের তিন নম্বর ফ্ল্যাটের দরজা ছুঁয়ে কে আগে নেমে আসতে পারে এই সব হিসেব করে পয়েন্ট count করে আমরা নিজেদের সোনা রূপো ব্রোঞ্জ মেডেল দিতাম। ওই দেশগুলোর হয়ে আমরা অনেক মেডেল জিতেছি সেই সময়!

খেলাধূলার ব্যাপারে ক্রমশঃ রঞ্জুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা বাড়তে থাকে, খেলাধূলা সংক্রান্ত যাবতীয় খবর – Sports statistics –   সমস্ত অলিম্পিক আর world রেকর্ড, বিশেষ করে track and field event এর, তাছাড়া দেশের এবং বিদেশের  ক্রিকেট টেনিস আর ফুটবল এর  কত খবর যে সে রাখতো ভাবলে বেশ অবাক লাগে। তখন তো আর এখনকার মত Google search বা Wikipedia ছিলনা, যে কোন Sports related information পেতে গেলে রঞ্জুই ছিল আমাদের প্রধান source…

২   

শঙ্করীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ক্রিকেট নিয়ে দুটি বই লিখেছিলেন, “ইডেনে শীতের দুপুর” আর “বল পড়ে ব্যাট নড়ে”। এই দুটো বই  ক্রিকেট এর ইতিহাস নিয়ে নানা ঘটনা আর তথ্যে সমৃদ্ধ ছিল, বিশেষ করে আদি যুগের ক্রিকেট, W G Grace থেকে Don Bradman পর্য্যন্ত ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বিশেষ করে বডিলাইন সিরিজ নিয়ে সেখানে অনেক লেখা ছিল। রঞ্জুর কাছে  ওই বই দুটো ছিল, মাসীর বাড়ীতে খেয়ে দেয়ে উঠে সারা দুপুর প্রায়ই রঞ্জু ওই বই থেকে আমায় পড়ে শোনাতো। পড়তে পড়তে রঞ্জু উত্তেজিত হয়ে উঠতো, মনে হত ও যেন সেই সব দিনে গিয়ে ফিরে গেছে, তার চোখের সামনে খেলা হচ্ছে আর সে তার live ধারা বিবরণী দিচ্ছে। শঙ্করীপ্রসাদের লেখার গুণে আর রঞ্জুর সেই উত্তেজিত ভঙ্গী তে পড়া দুই এ মিলিয়ে সেই দুপুর গুলো দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠতো আমার কাছে।

সব চেয়ে বেশী মনে পড়ে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টাই টেস্টের কথা। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর রিচি বেনোর  অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ব্রিসবেন এ খেলাটা হয়েছিল ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে। শঙ্করীপ্রসাদ তাঁর বই তে সেই টেস্ট ম্যাচ নিয়ে পুরো একটা chapter  লিখেছিলেন, যার মধ্যে টানটান রোমাঞ্চে ভরা বিখ্যাত শেষ ওভার নিয়েই বেশ কয়েক পাতা লেখা হয়েছিল। সেই chapter টা রঞ্জু যে কতবার পড়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। পড়তে পড়তে তার ওই শেষ ওভারটা পুরোটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, পরের দিকে বই দরকার হত না, রঞ্জু গড় গড় করে তার ওই উত্তেজিত গলায় verbatim বলে যেত, আর আমরা যারা শুনতাম তারা রঞ্জুর সাথে সাথে উত্তেজিত আর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতাম।

রঞ্জু পড়ছে, তার গলা কাঁপছে উত্তেজনায়, চার নম্বর বল, মেকিফ যা থাকে কপালে বলে ধুমধাড়াক্কা ব্যাট চালালো। যাকে বলে তাড়ু। দুই রান হয়ে গেছে, দুই দলের এখন সমান সমান রান, এখন জেতার জন্যে আর এক রান দরকার। কিন্তু তৃতীয় রান নিতে গিয়ে কনরাড হান্টের অব্যর্থ থ্রো সোজা আলেক্সান্ডার এর হাতে। মেকিফ রান আউট।

রান সমান সমান। জিততে এক রান, হাতে দুই বল, এক উইকেট। সারা মাঠে তুমুল উত্তেজনা। কি হয়, কি হয়!

লাস্ট ব্যাটসম্যান লিন্ডসে ক্লাইন। এসেই সে সাত নম্বর বলে রান নেবার জন্যে ব্যাট হাঁকড়ালো। ব্যাটে বলে হলেও রান নেওয়া যায়না, বল গেছে সলোমনের হাতে। তা সত্ত্বেও রান নেবার জন্যে মরিয়া হয়ে আম্পায়ারের দিক থেকে মেকিফ ছুটলো উইকেট ছেড়ে, আর প্রায় বারো মিটার দূর থেকে সলোমনের থ্রো মেকিফের উইকেট ছিটকে দিল।

ম্যাচ টাই।

সারা বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাসে সেই প্রথম টাই ম্যাচ!

১৯৬০ সালের সেই ঐতিহাসিক প্রথম টাই টেস্টের পরে টেস্ট, লিমিটেড ওভার‌ আর টি টোয়েন্টি ম্যাচে নেকবার টাই  হয়েছে,  কিন্তু  প্রথম বারের মত সেই উর্ধশ্বাস উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ বোধ হয় আর কোন ম্যাচে হয়নি।  

এখন তো ইউটিউব গুগল এই সব থেকে সেই ম্যাচটা চাইলেই দেখা যায়, সেই ম্যাচ নিয়ে বহু আলোচনা analysis ইত্যাদি সব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় তো সেসব ছিলনা, আমাদের ছিলেন শঙ্করীপ্রসাদ, আর ছিল রঞ্জু।

শঙ্করীপ্রসাদের লেখনীর গুণে আর রঞ্জুর  অননুকরণীয় পড়ার সুবাদে মাসীর বাড়ীতে কাটানো সেই দুপুরগুলো আমার কাছে এখনও স্মরনীয় হয়ে আছে।      

৩   

রঞ্জু আর আমি খুব একসাথে কলকাতার রাস্তায় হেঁটেছি এক সময়। গল্প করতে করতে কতবার আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ী থেকে পার্ক সার্কাস হয়ে এন্টালীর সুন্দরীমোহন এভিনিউর কাছে ক্রিস্টোফার রোডে সি আই টি বিল্ডিং এ মাসীর বাড়ী (দুই নম্বর ব্রীজের পাশে) হেঁটে গেছি, উত্তর কলকাতা ভাল চিনিনা বলে দু’জনে শিয়ালদা’ থেকে শ্যামবাজার চষে বেড়িয়েছি।

দু’জনে পাশাপাশি হাঁটার সময়ে আমাদের অনেক গল্প হত।  রঞ্জু তার জীবনের নানা গল্প করতো, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ার সময় হোস্টেলের বন্ধুদের গল্প, মিশনের মহারাজদের গল্প, আর সবচেয়ে বেশী করতো খেলাধূলার জগতে তার নিজের ব্যক্তিগত নানা উজ্জ্বল সাফল্যের গল্প। আমি শুনতাম।

একবার ময়দানে ঘেরামাঠে ফুটবল ম্যাচ দেখে দু’জনে ফিরছি। ইস্টবেঙ্গল পুলিশ কে ২-০ হারিয়েছে, তাই রঞ্জু খুব খুসী। এস এন ব্যানার্জ্জী রোডে অনাদির দোকানে মোগলাই পরোটা খেয়ে আমরা ধর্ম্মতলা স্ট্রীট  ধরে মৌলালীর দিকে হাঁটছি। অফিস পাড়ায়,  ডালহাউসী এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে সন্ধ্যা নামছে, কর্ম্মক্লান্ত দিনের শেষে সবাই ঘরে ফিরছে, বাসে বাদুড়ঝোলা লোক, রাস্তায় জনস্রোত।

সেই ক্রমশঃ নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারে ভীড়ের রাস্তায় আমরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটছি। রঞ্জু শুরু করলো নরেন্দ্রপুরে স্কুলের Sports এর গল্প। Middle Distance (৫০০০ মিটার) এর  final, রঞ্জুর প্রধান opponent যে ছেলেটি সে হলো স্কুলের চ্যাম্পিয়ন দৌড়বাজ, তাকে গত কয়েকবছর কেউ হারাতে পারেনি, তার যেমন দম, তেমনই স্পীড। রঞ্জু মনে মনে ঠিক করেছে তাকে এবার হারাতেই হবে।

প্রত্যেক খেলাতেই জেতার জন্যে একটা mental preparation দরকার, যাকে বলে game plan বা strategy, middle বা long distance run এর strategy হল কিভাবে প্রথম থেকে শেষ পর্য্যন্ত দম ধরে রেখে দৌড়বে, প্রথম থেকেই pace set করে এগিয়ে যাবে না Mo Farahর মত প্রথমে দম conserve করে পিছিয়ে থাকবে, শেষ রাউন্ডে গিয়ে accelerate করে এগিয়ে যাবে।

রঞ্জু ঠিক করেছে সে Mo Farah র strategy adopt করে প্রথমে পিছনে থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে স্পীড বাড়িয়ে এগোবে।  

রেস শুরু হয়ে গেছে, আমরা হাঁটছি। মাঠটা বারো পাক দিতে হবে। শুরুর দুই রাউন্ড পরে রঞ্জু একদম শেষে, প্রধান প্রতিপক্ষ ছেলেটি একদম আগে এগিয়ে গেছে, মাঝখানে এক ঝাঁক ছেলে। রঞ্জু হাঁটতে হাঁটতে তার স্বভাবোচিত উত্তেজিত গলায় রেসের minute to minute পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে যাচ্ছে।

ওয়েলিংটন স্কোয়ার যখন পৌঁছলাম তখন বেশ অন্ধকার, রাস্তার আলো সব জ্বলে উঠেছে, ঢং ঢং করে ঘন্টি বাজিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রাম। বাদুড়ঝোলা প্রাইভেট বাসের কন্ডাকটর রা “মৌলালী, শিয়ালদা’, বৌবাজার” বলে ডাক দিচ্ছে।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নামে/ ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে নেয় চিল/

পৃথিবীর সব আলো নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন/তখন গল্পের তরে জ্বোনাকীর রঙে ঝিলমিল/

সব পাখী ঘরে ফেরে, সব নদী…

ধর্ম্মতলা থেকে তালতলা হয়ে আমরা এস এন ব্যানার্জ্জী রোডে পড়ে ভেতরের গলি দিয়ে মৌলালীর দিকে এগোচ্ছি। এইসব  রাস্তা অলি গলি রঞ্জুর সব চেনা।

এদিকে ছয় পাক ঘোরা হয়ে গেছে, রঞ্জু এখন স্পীড বাড়াতে শুরু করেছে, সে এখন মাঝামাঝি, লীডার ছেলেটি তবুও অনেকটা সামনে।

আমরা যখন মৌলালী পৌছলাম তখন দশ পাক ঘোরা হয়ে গেছে, আর দুটো পাক বাকী, রঞ্জু এই বার  accelerate করতে শুরু করলো। সার্কুলার রোড পেরিয়ে ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা, আনন্দ পালিতের পার্কে যখন পৌঁছলাম, তখন একেবারে শেষ রাউণ্ড।

রঞ্জুর গলায় উর্দ্ধশ্বাস উত্তেজনা ফুটে বেরোচ্ছে, লীডারের সাথে তার gap ক্রমশঃ কমে আসছে, তারা এখন প্রায় সমান সমান। কিন্তু আরো কয়েকজন রঞ্জুর পিছনে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, রঞ্জু মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখছে। এদের মধ্যে কেউ তাকে ছাড়িয়ে যাবে নাকি? তাহলে তো সর্ব্বনাশ। পক্ষীরাজের মত হাওয়ায় ভর দিয়ে ছুটে চলেছে রঞ্জু, সেই সত্যেন দত্তের রানারের মতঃ

রঞ্জু সবেগে হরিণের মত ধায়…  

আনন্দ পালিত  পার্কে পোঁছে আমি রঞ্জুকে বললাম চল্‌ পার্কে একটু বসে চীনেবাদাম খাই, পা ব্যথা করছে।

রেসে শেষ পর্য্যন্ত কি হয়েছিল তা আর মনে নেই, কিন্তু সেই পার্কে দু’জনে পাশাপাশি বসে চীনেবাদাম খাওয়াটা বেশ  মনে আছে।

৪   

আর একবার, তখন আমরা কলেজে পড়ি, আমি খড়গপুরে, রঞ্জু কলকাতায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজে। একদিন বিকেলে দু’জনে পার্ক সার্কাস ময়দানে হাঁটছি। রঞ্জু শুরু করল তার কলেজের ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার ফাইনাল এর গল্প। ফাইনালে রঞ্জুর প্রতিপক্ষ কলেজের ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন। সে state level এ খেলে, ব্যাডমিন্টনে তার দুর্দ্দান্ত stamina আর skill, তাকে হারানো প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু রঞ্জুর ডিকশনারী তে অসম্ভব বলে কোন শব্দ নেই। সে জানে যে কোন খেলায় জিততে গেলে যেটা সবচেয়ে বেশী দরকার তা হলো জেতার অদম্য ইচ্ছে, একটা লড়াকু মনোভাব, ইংরেজী তে যাকে বলে mental fortitude, আমি জিততে পারি এই আত্মবিশ্বাস। আর যেটা দরকার তা হলো court coverage, anticipation – opponent এর strategy বুঝে মনে মনে একটা game plan তৈরী করা এবং খেলার সময় সেই game plan কাজ না করলে Plan B কিংবা Plan C আগে থেকে তৈরী করে রাখা। যে কোন খেলাই ultimately একটা mind game, তাই ওই ছেলেটির মত stamina আর skill রঞ্জুর হয়তো নেই, কিন্তু mind game জেতার জন্যে তার আছে মগজাস্ত্র।     

খেলা শুরু হয়ে গেছে, আমরা হাঁটছি, রঞ্জু শট বাই শট ধারাবিবরণী শুরু করে দিয়েছে। “ও একটা দারুণ overhead smash করলো, আমি কোনমতে তুলে দিলাম, আমি একটা ব্যাকহ্যান্ড ড্রপ শট মারলাম একেবারে নেট ঘেঁষে”, ইত্যাদি।

তিন রাউন্ড হাঁটার পর প্রথম গেমটা শেষ হলো। রঞ্জু হেরে গেল ১৫-২১। কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুরা খুব উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে, রঞ্জু যে ওই চ্যাম্পিয়ন ছেলেটিকে এরকম fight দেবে তারা আশাই করেনি।

দ্বিতীয় গেম শুরু হলো।

প্রথম থেকেই এই গেমে রঞ্জু দুর্দ্ধর্ষ খেলছে, অপোনেন্টের smash আর drop shot সে দুর্দ্দান্ত anticipate করে ঠিক জায়গায় পোঁছে গিয়ে return করে দিচ্ছে, রঞ্জু নিজেই জানেনা কি করে সে এত ভাল খেলছে, প্রমথ চৌধুরীর মন্ত্রশক্তি গল্পের মত তাকে মনে হয় কোন অদৃশ্য শক্তি ঘাড় ধরে খেলাচ্ছে। তার প্রতিপক্ষ কিছুটা ব্যাকফুটে, তার আত্মবিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও কমছে, এদিকে রঞ্জু একটা করে পয়েন্ট পাচ্ছে আর দর্শকদের মধ্যে রঞ্জুর বন্ধুরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে।

দ্বিতীয় গেমটা রঞ্জু শেষ পর্য্যন্ত যখন জিতলো তখন আমাদের পার্ক সার্কাস ময়দানের বিশাল মাঠে আরো তিন রাউন্ড হাঁটা হয়ে গেছে। আমি রঞ্জুকে বললাম চল্‌ এবার বাড়ী ফেরা যাক, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বাকিটা বাড়ী যেতে যেতে যেতে শুনবো।

বাড়ী ফিরতে ফিরতে তৃতীয় গেম শুরু হল। সে এক হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ, লম্বা লম্বা rally, কেউ কাউকে ছাড়বেনা। ১০-১০, ১২-১২, ১৫-১৫, ১৮-১৮… কোর্টে যেন আগুণ লেগে গেছে~ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা সবাই রঞ্জুর জন্যে গলা ফাটাচ্ছে।  

Dangerous smashes, delectable flicks, deadly drop shots…

বাড়ী পর্য্যন্ত যখন এসেছি, তখন ২০-২০। একেবারে চূড়ান্ত সাসপেন্স।

রঞ্জু বলল মান্টুদা, চলো আর একটু এগিয়ে যাই।

সেদিন ম্যাচ এর রেজাল্ট কি হয়েছিল আমার আর মনে নেই, কেবল এটুকু মনে আছে যে মৌলালীতে গিয়ে ম্যাচ শেষ হয়েছিল।

আজ রঞ্জু আর নেই। আমি কাজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতা ফিরে এসেছি।

মনে হয় রঞ্জূটা আজ থাকলে বেশ হত, দু’জনে মিলে আবার আগের মত কলকাতার রাস্তায়, ঢাকুরিয়া লেকে কিংবা পার্ক সার্কাস ময়দানে গল্প করতে করতে হাঁটতাম।

ছোটবেলার মত এখন আবার হাতে অফুরন্ত সময়।

খেলার জগতে ওর সাথে আলোচনা করার মত আরও কত ঘটনা ঘটে গেছে ও চলে যাবার পর। ২০১০ সালের Soccer World Cup এ Ghanar বিরুদ্ধে Uruguyar Suarez এর হাত দিয়ে অবধারিত গোল বাঁচানো, শ্রীলঙ্কার মুরলী কে New Zealand এর Wicket keeper captain ব্রেন্ডন ম্যাকালাম এর unsporting রান আউট, ২০০৯ সালের Andy Roddick আর Roger Federer এর অবিশ্বাস্য লম্বা Wimbledon Final… 

তাছাড়া ইউসেন বোল্ট কিংবা মাইকেল ফেল্পস কে নিয়ে আলোচনা করেই রঞ্জুর সাথে পুরো একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় তা আর সম্ভব নয়। 

অলিম্পিক এলেই খুব রঞ্জুর কথা মনে পড়ে।

4 thoughts on “রঞ্জু আর অলিম্পিক    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।