
ছোটবেলায় রঞ্জু
১) সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজ রোপন
রঞ্জু আর আমি ছিলাম পিঠোপিঠি ভাই। আপন ভাই না, আমরা ছিলাম মাসতুতো ভাই, কিন্তু আপন এর থেকেও বেশী আপন। যাকে বলে অভিন্নহৃদয়, মাণিকজোড়, হরিহরাত্মা।
মা’রা ছিলেন পাঁচ বোন। এদের মধ্যে মা (সরস্বতী) আর মাসী (ভগবতী) কলকাতায় থাকতেন। গায়ত্রী মাসী থাকতেন পাটনায় আর ছোটমাসী (পার্ব্বতী) থাকতেন মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে, পরে ভোপালে।
কলকাতায় থাকার দরুণ মা আর মাসীর মধ্যে একটা গভীর ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাসী যেহেতু মা’র থেকে প্রায় আট বছরের বড়, মা’র প্রতি তাঁর একটা স্নেহের ভাব ও ছিল। মা’ও তাঁর ভাগু দি’কে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন।
দুই বোন ই তাদের প্রথম সন্তান কে হারিয়ে পরের সন্তান কে আঁকড়ে ধরেছিলেন। মাসী রঞ্জুকে, মা আমাকে। আমরা দু’জনেই আমাদের মা’দের একমাত্র সন্তান। তাছাড়া তাঁরা দুজনেই তাঁদের স্বামীদের (মেসোমশায় ১৯৬১, বাবা ১৯৬৫) কয়েক বছরের মধ্যে বিধবা হন্। দুই বোনের ভিতরে bonding এটাও একটা বড় কারণ ছিল।
মাসীরা থাকতেন এন্টালীতে ক্রীস্টোফার রোডে CIT Buildings এ। একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতি রবিবার মা আর আমি ৩৩ নম্বর বাসে চেপে হাজরা মোড় থেকে পদ্মপুকুর স্টপে নেমে কাছেই হাঁটাপথে মাসীর বাড়ীতে এসে সারাদিন কাটাতাম। ওখানেই খাওয়া হতো। তারপর সারা দুপুর আর বিকেল মা’রা দুই বোন বিছানায় বসে গল্প করতেন,আমি আর রঞ্জু বাইরে ওর বন্ধুদের সাথে খেলতাম, অথবা দু’জনে বাড়ীতে বসে একসাথে কোন বই পড়তাম, অথবা ক্যারম খেলতাম।
এই ভাবেই আমাদের ছোটবেলায় দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা তৈরী হয়। মা আর মাসীর মধ্যে যে ভালবাসা ছিল সেটাই মনে হয় আমাদের দু’জনের এক অপর কে ভাল লাগা এবং ভালাবাসার কারণ।
স্কুলের পালা শেষ করে আমরা কলেজে ভর্ত্তি হলাম ১৯৬৩ সালে। আমি গেলাম খড়্গপুরে। রঞ্জু ভর্ত্তি হলো কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের কাছে ওয়েলেসলি স্ট্রীটে মৌলানা আবদুল কালাম কলেজে।
কলেজে যাবার পর থেকে আমাদের পথ ক্রমশঃ আলাদা হতে শুরু করলো। দু’জনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা না কমলেও জীবনের নানা বাধ্যবাধকতা কে মেনে নিয়ে আমরা ক্রমশঃ এক অপরের থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগলাম।
এই সময় থেকে রঞ্জু বাম রাজনীতির দিকে ক্রমশঃ আকৃষ্ট হতে থাকে। বাড়ী ছেড়ে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে গিয়ে থাকার পর থেকেই তার মার্ক্সিস্ট আদর্শে হাতে খড়ি। অনেক পোড় খাওয়া বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত radical ছাত্র তখন প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াশোনা করে, এবং তাদের সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে মেশার ফলে রঞ্জু ক্রমশঃ বাম আদর্শের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।
আমি যখন খড়্গপুর থেকে ছুটিছাটাতে কলকাতায় আসতাম তখন থেকেই আমি তার এই পরিবর্ত্তনটা লক্ষ্য করি। তার মুখে তখন শুধু দ্বন্দ্বমূলক সমাজবাদের (Dialectical Materialism) কথা, আমায় বেশ কিছু Marx আর Engels বইও সে তখন দিয়েছিল পড়তে। খুব উৎসাহ নিয়ে সে আমায় মার্ক্সীয় তত্ত্ব বোঝাতো। সেই সব কঠিন তত্ত্ব আমার মাথায় না ঢুকলেও আমি হুঁ হাঁ করে শুনে যেতাম। ওর উৎসাহে জল ঢালতে ইচ্ছে করতোনা।
ব্যাপারটা যে কোন দিকে গড়াবে তখন আমি আন্দাজ করতে পারিনি।
তবে এটা বুঝেছিলাম যে রঞ্জুর মনের মধ্যে সমাজের অসাম্য একটা বিপুল এবং গভীর প্রভাব ফেলছে। তার ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বন্ধুরাই তার মাথায় এই সব চিন্তা রোপন করছে কিনা তা তখন জানতামনা।
তবে আমাদের আলোচনার মধ্যে প্রায়ই এই সামাজিক বৈষম্য নিয়ে তার রাগ আর অসহিষ্ণুতা আমি দেখতে পেতাম। এই যে একজন গরীব লোক রিক্সা টানছে, আর একজন দামী গাড়ী চড়ছে, এই যে একজন শীতের রাত রাস্তায় শুয়ে কাটায় আর একজন শোয় দুগ্ধফেননিভ শয্যায় তার বিলাসবহুল প্রাসাদে, কেন এরকম হবে? ফুটপাতে শীতের রাতে ঠান্ডায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকে, পথের শিশু রা খেতে না পেয়ে কাঁদে, এই সব দৃশ্য রঞ্জুর মনে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করতো।
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে তার সহানুভূতি আর তার এই প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী স্বভাবটি রঞ্জু পেয়েছিল তাঁর বাবা – আমার মেসোমশায়ের কাছ থেকে। মেসোমশায় তাঁর যৌবনে ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, এমন কি তিনি অনুশীলন সমিতির ও সভ্য ছিলেন শুনেছি। বেশ কয়েক বছর ব্রিটিশ আমলে তিনি জেলেও ছিলেন, এবং জেল থেকেই তিনি ইংরেজি আর ফিলসফিতে কৃতিত্বের সাথে MA পরীক্ষায় পাশ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে মানুষের ওপরে মানুষের অন্যায় এবং অত্যাচার হয়ে এসেছে, এবং একই সাথে সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ করে এসেছে আরও একদল প্রতিবাদী মানুষ।
সবাই প্রতিবাদ করেনা, অনেকে এই সব অত্যাচার মাথা নীচু করে মেনে নেয়। কিন্তু রঞ্জু সেই দলে ছিলনা।
কবি বলেছেন~ “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা দোঁহে যেন তৃণ সম দহে।”
রঞ্জু অন্যায় সহ্য করেনি। সে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছিল।


যৌবনে রঞ্জু
২) বাংলায় ভূমি সংস্কার আন্দোলন
আমাদের দেশে কৃষকদের ওপর অত্যাচারের দীর্ঘ ইতিহাস। সেই মোগল দের সময় থেকেই জমিদার এবং মুসলমান শাসকদের কাছে খাজনা দিতে গিয়ে গরীব চাষীদের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে। এর ওপরে ছিল ভূমিহীন চাষী দের করুণ অবস্থা। তারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে অন্যের জমিতে ফসল ফলাতো। এক ভূমিহীন bonded labour কে নিয়ে প্রেমচন্দের সেই বিখ্যাত গল্প সদগতি নিয়ে সত্যজিৎ রায় একটা সিনেমা তৈরী করেছিলেন।
মোগলদের পরে এলো ব্রিটিশরা। তাদের শাসন ছিল আরও ভয়ঙ্কর। উনবিংশ শতাব্দীতে নীলচাষীদের ওপর তাদের অত্যাচার এবং নীলবিদ্রোহ নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ উপন্যাস সমাজে খুব সাড়া ফেলেছিল।
দেশ স্বাধীন হবার ঠিক আগে ১৯৪৬-৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলনের কথাও আমরা ভুলিনি। না ভোলার প্রধান কারণ ছিল গ্রামে ও শহরে সেই আন্দোলনের পক্ষে জনসাধারণের অসাধারণ সমর্থন পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে ও গণসঙ্গীতে তার প্রভাব পড়ে। কিছুদিন আগে আমরা তেভাগা আন্দোলনের ওপর মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প অবলম্বনে “হারানের নাতজামাই” নাটকটি দেখলাম। তেভাগাও কৃষকদের জমির অধিকার ও উৎপন্ন ফসলের দুই তৃতীয়াংশ অধিকার পাবার আন্দোলন ছিল।
তেভাগা আন্দোলন নিয়ে রচিত সলিল চৌধুরীর কালজয়ী গান এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে।
হেই সামালো হেই সামালো/
হেই সামালো ধান হো, কাস্তে টা দাও শান হো/
ধান কবুল আর মান কবুল/
আর দেবোনা আর দেবোনা/ রক্তে রাঙা ধান মোদের প্রাণ হো/
তারপরে তো ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো। পরাধীনতার হাত থেকে উদ্ধার পাবার পরে কুড়ি বছর পর তখন কেটে গেছে। পাঞ্জাব আর হরিয়ানায় সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছে, সেখানে সবাই ধনী কৃষক, তাদের বিশাল বিশাল জমি, তাছাড়া সরকারের প্রচুর অনুদান, ক্যানালে সেচের জল, বিদ্যুৎ এর পয়সা আর ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়না, ভালো বীজ দেওয়া হয়, তাদের ফসল সরকার ন্যায্য দামে (MSP – Minimum Sales price) কিনে নেয়। প্রত্যেকের দামী গাড়ী, ট্র্যাক্টর।
আমাদের বাংলায় অবশ্য এসব কিছুই হয়নি। আমাদের অসুবিধে ছিল অনেক কৃষক এবং সবার ছোট ছোট জমি। অনেক ভূমিহীন চাষী আর তার ওপরে আছে জমিদার আর জোতদার (যারা ধনী আর ক্ষমতাশালী কৃষক) দের অত্যাচার।
ষাটের দশকের শেষে (১৯৬৭) যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সেই সরকার এর দুই নেতা মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোনার ও বিনয় চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের কাজ শুরু করেন।
তাঁরা বড় জমির মালিকদের হাতে থাকা ভূমি সিলিং আইনের অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত জমি এবং বেনামি জমি রাষ্ট্রের কাছে অর্পণ করেছিলেন। এইভাবে অর্পিত ভাল কৃষি জমি পরবর্তীকালে ২৪ লক্ষ ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকের মধ্যে জমি বিতরণ করা হয়।
এ ছাড়াও তাঁরা অপারেশন বর্গা শুরু করেছিলেন, যার মধ্যে দিয়ে ধনী কৃষক রা তাদের জমির কিছু অংশ বর্গাদার দের নিজের খরচে চাষ করার জন্যে দেন এবং বিনিময়ে উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ বর্গাদারের কাছ থেকে পান্। যুক্তফ্রন্ট সরকারের এই উদ্বৃত্ত ভূমি বন্টন আর অপারেশন বর্গা বাংলায় অসাধারণ সাফল্য লাভ করে।
কিন্তু ইতিমধ্যে ষাটের দশকের শেষের দিকে (১৯৬৯ সালে) চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয় নকশাল আন্দোলন এবং এক ঝাঁক মেধাবী এবং বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত যুবক সেই নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ী থেকে প্রধানতঃ এই কৃষি আন্দোলন এর উৎপত্তি। গ্রামের গরীব কৃষক দের ওপর ধনী জোতদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদ থেকেই সেই আন্দোলনের শুরু।
রঞ্জু এই নকশাল আন্দোলনে সামিল হয়।
এর পরেই শুরু হয়ে যায় যুক্তফ্রন্টের কম্যুনিস্ট শাসকদের সাথে নকশালদের বিরোধ। দুই দলই কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী, এবং দুই দলেরই লক্ষ্য জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কৃষকদের ওপর জোতদার আর ধনী কৃষক দের অন্যায় অত্যাচার দূরীকরণ, জমিহীন দের জমি বন্টন, ফসলের সুসংহত ভাগ ইত্যাদি। যুক্তফ্রন্টের প্রধান দল সি পি এম – কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট) যারা তখন সরকারে। আর নকশাল দের নেতা চারু মজুমদার আর কানু সান্যালরা তাদের পার্টির নাম দিলেন কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) – সি পি এম এল। অর্থাৎ তাঁরা হলেন সি পি এম এর থেকেও বেশী জনদরদী। এবং তাঁদের আন্দোলন হলো চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর অনুগামী। আর সেই আন্দোলন হলো সশস্ত্র, হিংসাত্মক।
একজন বাম, আর একজন অতি বাম।
এই দুই দলে অনেক আলোচনা হলো কিন্তু একসাথে এগোবার কোন সূত্র পাওয়া গেলনা।

আসানসোলে মামাবাড়ীর বাগানে রঞ্জু আর ভাস্বর – সাথে বোনেরা
৩) নকশালবাড়ী আন্দোলন
নকশাল আন্দোলনের নেতাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজের দুই শ্রেণীর অর্থাৎ এক দিকে ধনী কৃষক ও জোতদার এবং অন্যদিকে দরিদ্র এবং ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে একটা সাম্যের পরিবেশ তৈরী করা যেখানে কোন শ্রেণী বৈষম্য থাকবেনা।
কিন্তু প্রথম থেকেই নকশাল আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। গ্রামে গ্রামে জোতদারদের ঘর বাড়ী তে আগুণ লাগিয়ে দেওয়া, তাদের ক্ষেতের ফসল কেটে নেওয়া, এবং শেষে ধনী জমিদার এবং বড় কৃষকদের নৃশংস ভাবে খুন করা শুরু হয়। তারপরে ক্রমশঃ সেই অনিয়ন্ত্রিত অরাজকতা গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
চারু মজুমদার নকশালদের এই হত্যালীলার নাম দিয়েছিলেন “শ্রেণী শত্রু খতম।”
কলকাতার রাস্তা ঘাটে দেয়ালে তখন লেনিন আর মাও সে তুং এর ছবি তে ছয়লাপ। আর হাজার হাজার পোস্টারে লেখা “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান!” “সত্তরের দশক মুক্তির দশক” ইত্যাদি। কে বা কারা তাদের এই সব কাজের জন্যে টাকা জোগাতো জানিনা।
কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের পথে গিয়ে নকশালবাড়ী আন্দোলন রাষ্ট্রের রোষের মুখে পড়ল। নকশালদের এই আইনের শাসন কে তোয়াক্কা না করা আন্দোলন কে তারা মানবে কেন? তারা সেই আন্দোলন কে রাষ্ট্রবিরোধী ঘোষণা করে পুলিশ দিয়ে তাদের দমন করতে শুরু করলো। এর ফলে নকশালরা রাস্তা ঘাটে পুলিশ দেখলেই তাদের নির্ব্বিচারে মারতে শুরু করে। এর ফল হয় আরো মারাত্মক।
এবার পুলিশও নির্ম্মম হতে শুরু করে, তারা একতরফা মার খাবে কেন? ধরপাকড় শুরু হলো, জেলে নিয়ে গিয়ে বহু তরুণ বিদ্রোহীর ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলো। Encounter এর নাম দিয়ে অনেক বন্দী যুবক কে ছেড়ে দিয়ে তাদের পিছন থেকে পুলিশ গুলি করে মারে।
আমাদের মাসতুতো দাদা রতন দা’ তখন লালবাজারে পুলিশের সার্জেন্ট। তাঁকে কাজে রাস্তা ঘাটে ডিউটি করতে হয়। বেচারা রতন দা’র অবস্থা তখন বেশ খারাপ। রাস্তায় বেরোলে তিনি সব সময় পকেটে পিস্তলে হাত রেখে ঘোরেন। কিন্তু কেউ পিছন থেকে এসে ছুরি মারলে পিস্তলে কোন কাজ হবেনা। তাই রতনদা’ বাইরে বেরোলে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকেন।
রতনদা’ আমাদের বড়মাসীর ছেলে, তিনি আমাদের ছোটমাসী পার্ব্বতীর বয়সী। সুতরাং আমার আর রঞ্জুর থেকে তিনি বয়সে অনেকটাই বড়। আমাকে আর রঞ্জুকে তিনি খুবই স্নেহ করেন, সুতরাং তাঁর পক্ষে রঞ্জুকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার তো কোন প্রশ্নই নেই।
সেই দিনগুলোতে রতন দা’ পড়ে গিয়েছিলেন এক উভয়সঙ্কটে।
এই সময় ১৯৬৯ সালে আমি Indian Oil Corporation এ কাজে join করে প্রথমে মুম্বাই ও পরে উত্তর প্রদেশের নানা শহরে কাজ নিয়ে চলে যাই। শুনেছি সেই সময় রঞ্জু পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো, পালা করে করে চেনা শোনাদের বাড়ীতে রাত কাটাতো। মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীতেও সে বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছে।
একবার নাকি মাঝ রাতে আমাদের বাড়ীতেও রঞ্জুকে খুঁজতে এসেছিল পুলিশ।
রঞ্জু ধরা পড়লে পুলিশের হাতে তার কি অবস্থা হবে সেই ভেবে রঞ্জুর জন্যে মাসী আর মা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন।
নকশাল আন্দোলন এর উদ্দেশ্য যে ঠিক কি ছিল, তা বোঝা মুস্কিল। বিশাল দেশের একটা ছোট প্রদেশে কিছু লোক মেরে আর ক্ষেতে বাড়ীতে আগুণ লাগিয়ে কি বিপ্লব তারা আনবে ভেবেছিল আমি জানিনা। রঞ্জুর মত অনেক শিক্ষিত বুদ্ধিমান এবং আদর্শবাদী যুবক কোন বিপ্লবের আশায় চারু মজুমদারের এই মারণ যজ্ঞে যোগ দিয়েছিল তাই বা কে জানে। ওরা কি ভারতবর্ষে ফরাসী বা রুশ বিপ্লবের মত কিছু করবে আশা করেছিল?
রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সাফল্য লাভ করার জন্যে যে বিশাল জন আন্দোলন দরকার, নকশাল আন্দোলন ততটা জনসমর্থন পায়নি। শেষের দিকে বরং গ্রামে কিছুটা সমর্থন থাকলেও শহরে তারা অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬/৪৭ সালের তেভাগা কৃষক আন্দোলনের সময় বাংলা সাহিত্য নাটক সঙ্গীতে যেরকম সাড়া জেগেছিল, নকশাল আন্দোলনে সেরকম কোন উন্মাদনা চোখে পড়েনি। ওই আন্দোলন নিয়ে যে লেখালেখি হয়েছে, সবই তাত্ত্বিক মতাদর্শের কচকচি। পন্ডিতি ফলানো ছাড়া যার আর কোন উদ্দেশ্য ছিলনা। মাও সে তুং এর পথই নাকি তাদের পথ। সেই পথেই নাকি মুক্তি। মাও তাঁর দেশের অধ্যাপক, ডাক্তার, শিক্ষক, শিল্পী সবাই কে গ্রামে ক্ষেতের কাজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কি লাভ হয়েছিলো তাতে ?
মাওয়ের সময় থেকেই চীনে এক (কম্যুনিস্ট) পার্টির শাসন, অর্থাৎ সেখানে গণতন্ত্র কোনদিনই ছিলনা,আজও নেই। আজ সেখানে পুঁজিবাদ রমরম করে চলছে সেখানে অনেক ধনী বিলিওনেয়ার। কিন্তু সেখানে আজও গণতন্ত্র নেই।
আমাদের ভারতবর্ষ হলো গণতান্ত্রিক দেশ এবং আমাদের সংবিধানে তা পরিস্কার বলা আছে। নকশালরা কি আশা করেছিল যে তারা ভারতবর্ষে গণতন্ত্র মুছে দিয়ে এক পার্টির স্বৈরতন্ত্র আনবে?
জানিনা।
তবে এটা জানা যে বহু তত্ত্বের কচকচি দিয়েও এই আশা পূরণ করা প্রথম থেকেই অসম্ভব ছিল।
এই আন্দোলনে সামিল হয়ে রঞ্জু তার ব্যক্তিগত জীবনে তার আদর্শের জন্যে অনেক আত্মত্যাগ করেছে। নিজের কথা ভাবেনি। দেশের কথা ভেবেছে, গরীব মানুষদের জীবনে পরিবর্ত্তন আনার কথা ভেবেছে। নিজের চাকরী যায় যাক, নিয়মিত কাজে কামাই করে গেছে রঞ্জু। মাসীর কথাও ভাবেনি সে। পালিয়ে পালিয়ে লুকিয়ে কোথায় না থেকেছে সে তখন। কখনো কলকাতায় কোন বস্তীতে কখনো কোন গ্রামে কোন চাষীর বাড়ীতে।
তার তখন পাখীর চোখ বিপ্লব। কিন্তু সে যে একটা বিরাট মগজধোলাই এর চক্রান্তের শিকার হয়েছে, সেটা সে শেষ পর্য্যন্ত বুঝতে পেরেছিল কিনা আমি জানিনা।

রতনদা’, মাসী, মাসীমণি আর মা
৪ ) রঞ্জুর পুলিশের হাতে ধরা পড়া
শেষ পর্য্যন্ত ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার ধরা পড়েন। কাছাকাছি সময়ে রঞ্জু কেও পুলিশ ধরে হাজতে নিয়ে যায়। আমি তখন IBM এ কাজ নিয়ে দিল্লীতে ট্রেণিং এ।
মা আর মাসী খবর পেয়ে পাগলের মত লালবাজারে রঞ্জুকে দেখতে বার বার ছুটে যান্। রতনদা’ মা আর মাসীকে লালবাজারে পুলিশ কমিশনার এর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যান্। তা ছাড়া রতনদা’ হাজতে রঞ্জুর জন্যে মা আর মাসীর আনা খাবার ও পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করেছিলেন বলে শুনেছি।
অচিস্মান ঘটক নামে একজন পুলিশের বড়কর্ত্তা – বোধ হয় ডি এস পি ছিলেন – মা’দের যমশেরপুরের এক জ্যাঠতুতো দিদির (রাঙাজ্যাঠা – শ্রী দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচীর মেয়ে ঊষারাণী দি’) ছেলে ছিলেন। মা আর মাসী তাঁর হাজরা রোডের বাড়ীতে গিয়ে তাঁকে রঞ্জুর ওপর হাজতে যেন কোন শারীরিক অত্যাচার না করা হয় তা’র জন্যে অনুরোধ করেছিলেন।
এ ছাড়া যিনি রঞ্জুর সবচেয়ে বড় পরিত্রাতা হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আমাদের মনোহরপুকুরের বড় জামাই, শ্রী রমাবিলাস গোস্বামী – আমাদের সকলের জামাইবাবু। রঞ্জু কে তিনি খুব ভাল চিনতেন, কেননা রঞ্জু প্রায় মনোহরপুকুরের বাড়ীর ছেলের মতোই হয়ে গিয়েছিল।
জামাইবাবু তখন ছিলেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের জজসাহেব। পুলিশের অনেক বড় ছোট কর্ত্তার সাথে তাঁর দহরম মহরম ছিল। বিশেষ করে পুলিশের এক কুখ্যাত অফিসার – রণদেব (রুণু) গুহ নিয়োগী – কয়েদীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করার জন্যে যাঁর দুর্নাম ছিল – তাঁর সাথে জামাইবাবুর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল।
জামাইবাবুর জন্যেই রঞ্জুর ওপরে পুলিশ কোন অত্যাচার করেনি।
তার আরো একটা কারণ ছিল এই যে পুলিশ জেনেছিল যে রঞ্জু নিজে ওদের দলের কোন উঁচু নেতা ছিলনা, এবং কোন খুনোখুনির ঘটনায় ও সে জড়িত ছিলনা।
সে ছিল শুধুমাত্র একজন আদর্শবাদী যুবক, নকশাল আন্দোলনের প্রতি যার মতাদর্শের মিল ছিল, এবং সে ছিল পার্টির এক নীচুতলার কর্ম্মী, সে তার পার্টির জন্যে ছোটখাটো কাজ করতো, কোন নৃশংস হত্যাকান্ড বা অন্য কোন সেই জাতীয় অপরাধের সাথে তার কোন যোগ ছিলনা।
যাই হোক, এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। পুলিশের হাত থেকে অল্পদিনের মধ্যেই রঞ্জু ছাড়া পেয়ে আবার তার পুরনো জীবনে ফিরে আসে।

বিয়ের পরে দেবযানী আর রঞ্জু

সুভদ্রা আর আমি আইরনসাইড রোডের বাড়ীতে রঞ্জু গার্গী আর দেবযানীর সাথে

আইরনসাইড রোডের বাড়ীতে মা আর মাসীর সাথে আমি আর রঞ্জু
৫ ) আবার সে এসেছে ফিরিয়া
WBCS পরীক্ষা দিয়ে সে Sales Tax এর অফিসার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বহুদিন কাজে না যাওয়ায় তার মাইনে আটকে তাকে শো কজ করা হয়েছিল, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই কাজ সে ফিরে পায়, এবং অফিসার হিসেবে তার কাজে সুনাম হয়। পরে সে Sales Tax Officers’ Association এর সেক্রেটারীও হয়েছিল। একবার কোন কারণে ওর সাথে দেখা করতে বেলেঘাটাতে ওদের অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানে তার প্রতিপত্তি দেখে খুব ভাল লেগেছিল। বহু লোক ওর সাথে দেখা করে ওর কাছ থেকে নানা আদেশ ও পরামর্শ নিচ্ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল যে ওখানে তার যথেষ্ট সন্মান, খোদ কমিশনার সাহেবও ওর কাজে খুব সন্তুষ্ট।
আবার সে আমাদের সাথে হেসে খেলে দিন কাটায়। আমরা ভাইবোনেরা একসাথে কলকাতার কাছে বেড়াতে যাই, রঞ্জু আমাদের মধ্যে থাকে মধ্যমণি হয়ে। কখনো ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, কখনো ব্যান্ডেল কখনো মায়াপুর, কখনো বোটানিকাল গার্ডেন্স।
মনোহরপকুরে সবাই মিলে তাস আর ক্যারম খেলা জমে ওঠে।
কিছু পরে আমাদের দু’জনেরই বিয়ে আর সন্তান হয়, আমরা নিজের নিজের সংসারে প্রবেশ করি। নিজেদের আলাদা বৃত্ত তৈরী করে নিই। নানা ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরী হতে থাকে।
তারপর ঘটনাচক্রে জীবিকার তাগিদে আমি বিদেশ চলে যাই।

মায়াপুরে রঞ্জু আর দেবযানীর সাথে সুভদ্রা আমি আর খোকন

পিকনিকে প্যাডল বোটে রঞ্জু
রঞ্জু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু আমাদের মনে নানা স্মৃতির মধ্যে সে এখনো উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে। তার দুষ্টুমি ভরা হাসি আর সব সময় সবার পিছনে লাগার কথা এখনো মনে পড়ে।
সুভদ্রা গল্প করে যে একবার অনেকে মিলে দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হয়েছে। মন্দিরে দর্শন সেরে ফেরার সময় সুভদ্রা দেখে তার একটা চটি নেই। কোথায় গেল? অনেক খোঁজা খুঁজি করে যখন কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছেনা, হঠাৎ সুভদ্রার খেয়াল হলো এটা নিশ্চয় রঞ্জুর কাজ।
“এই রঞ্জু, কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার চটি?”
রঞ্জু “আমি কি জানি” বলে তার দুষ্টু হাসিটা হেসে শেষ পর্য্যন্ত বের করে দিয়েছিল সুভদ্রার চটি।
এই বার্ধক্যে পৌঁছে রঞ্জু কে খুব মনে পড়ে। আর তাকে মনে পড়লে অবধারিত মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের “হতভাগ্যের গান” কবিতার এই লাইন গুলো।
আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি/
আমরা দুখের বক্র মুখের চক্র দেখে ভয় না করি/
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য, বাজিয়ে যাবো জয়বাদ্য/
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীল আকাশ/
হাস্যমুখে অদৃষ্টের করবো মোরা পরিহাস/
ভগবানের কাছে রঞ্জুর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।
I remember Ranjuda well from the time we all played cards on the round table on the balcony. I was also in school in Kolkata when he went underground. I vaguely remember a discussion Sajoma had with Baba on how to get Ranjuda out of police custody. Many years later I met him and Boudi at some place and Gargi was also there. I always liked his humour even though I was much younger than him. Rest In Peace, Ranjuda.
LikeLiked by 1 person
Thanks Sonu for your comments. Yes Sonakaka with his army contacts may have helped too. It was a difficult time for us
LikeLike