
১ – ওরা থাকে ওধারে
জয়পদ আর বিজয়পদ এই দু’জন যমজ ভাই ছিল identical twins – দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিং এর কাছে কোন এক অখ্যাত প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আমাদের পরিবারে কাজের লোক হিসেবে যখন তারা আসে তখন তাদের অল্প বয়েস। দু’জনে একেবারে এক রকম দেখতে, দু’জনেরি গায়ের রং কুচকুচে কালো, কথাবার্ত্তাও দু’জনে গ্রামের ভাষায় একই ভাবে বলে। দু’জনেই স্বাস্থ্যবান আর কর্মঠ, বাড়ীর কাজে তারা দু’জন – প্রথমে বিজয় ও সে কাজ ছেড়ে দেবার পরে জয় – বহাল হয়ে গেল সহজেই। ওরা আমারই বয়সী ছিল, হয়তো আমার থেকে সামান্য বড়োও হতে পারে।
আমাদের বাড়ীতে ছোটবেলা থেকেই সংসারে ঠিকে এবং দিন রাতের লোকেদের কাজ করতে দেখেছি। আমরা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করে কত কিছু জানবো শিখবো, আর জয় বিজয় আমাদের সমবয়সী হলেও ওরা বাড়ীতে ফাইফরমাস খাটবে, আমাদের সাথে ওদের এই পার্থক্য, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আমাদের চোখে পড়েনি।
গ্রাম আর শহর, শিক্ষিত আর অশিক্ষিত, ভদ্রলোক আর অন্ত্যজ – আমাদের সমাজের মধ্যে এই যে একটা পরিস্কার শ্রেণীবিভাজনরেখা রয়েছে, সমাজের নিয়ম হিসেবেই আমরা তা মেনে নিয়েছি। হয়তো ওই প্রান্তিক খেটে খাওয়া সমাজের নীচের তলার মানুষেরাও সেই নিয়ম মেনে নিয়েছিল।
এটা এখন ভাবলে বেশ খারাপ লাগে।
তবে এটাও ঠিক যে ছোটবেলায় আমাদের ভাই বোনদের মনে ওই কাজের লোকদের প্রতি কোন নাক উঁচু মনোভাব ছিলনা। আমাদের বাড়ীর পরিবেশে কাজের লোকেরা থাকতো বাড়ীর লোকের মতোই। আর যেহেতু ওই দুই ভাইয়ের চমৎকার হাসিখুসী স্বভাব ছিল তাই অল্পদিনের মধ্যেই ওরা আমাদের বাড়ীর লোকের মত হয়ে যায়।
ইদানীং আমাদের দেশে খুব ধীরে হলেও ক্রমশঃ সমাজের নীচের স্তরের প্রান্তিক মানুষদের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর প্রযুক্তি পৌঁছে যাচ্ছে। এখন দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে পাকা বাড়ী, শৌচালয়, জল বিদ্যুৎ ইন্টারনেট মোবাইল ফোন ইত্যাদি সবই সহজলভ্য। একদা পিছিয়ে পড়া গ্রামের দলিত আদিবাসী লোকেরাও তাদের জীবনকে একটু একটু করে নতুন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাবার সু্যোগ পাচ্ছে।
সম্প্রতি বিজয়ের গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে তার পরিবারের সাথে একটা দিন কাটাবার সুযোগ হয়েছিল। সেইদিন বিজয় কে দেখে দেশের সেই সামাজিক পরিবর্ত্তনের একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। যা ছিল একসাথে কৌতূহলোদ্দীপক এবং আনন্দদায়ক।
এই লেখাটা সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে।


২ মান্টুদা, মুখ থেইকে মাক্সোটা খুইলে ফেলো
জয়পদ আর বিজয়পদ দুই ভাই আমাদের বাড়ীর কাজ ছেড়ে দেবার পর ওদের সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিলনা। তবে ছোটমা অনেক চেষ্টা করে নানা জায়গায় তদবির করে বিজয় কে স্টেট ব্যাঙ্ক আর জয় কে FCI তে চাকরী করে দিয়েছিলেন। সরকারী চাকরী পেয়ে তাদের দুজনের জীবনেই অনেক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল, অনেক দিন কাজ করার পরে ভাল পেনশন ইত্যাদি পেয়ে তাদের গ্রামের জীবনযাত্রা আমূল পালটে যায়।
সেই জন্যে ছোটমা’র প্রতি দুই ভাইয়ের মনে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল, তাই আমাদের বাড়ীতে কাজের লোক না হলেও আমাদের পরিবারের সাথে এই দুই ভাইয়ের একটা যোগাযোগ থেকেই যায়। আমাদের নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে ওরা আসতো, না বলতেই নিজে থেকে নানা কাজ করে দিত। তাদের গ্রামের বাড়ী থেকে তরীতরকারী ফলমূল ইত্যাদি এনে দিতো।
তারপরে তো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে প্রধানতঃ খোকনের কাছ থেকে শুনতাম বিজয় এখন একজন সম্পন্ন গৃহস্থ, স্ত্রী ছেলে পুত্রবধূ নিয়ে বারুইপুরের কাছে এক গ্রামে তার বিরাট সংসার। তার আমন্ত্রণে ওদের গ্রামের বাড়ীতে ওরা মাঝে মাঝে যায়, আর গেলে বিজয় আর তার পরিবার তাদের নিয়ে কি করবে ভেবে পায়না, তাদের আদর যত্ন আর আতিথেয়তা পেয়ে খোকনরা আপ্লুত। ছোটমা বেশ কয়েক বার ওদের বাড়ীতে অতিথি হিসেবেও থেকে এসেছেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে লকডাউন এর প্রভাব যখন একটু কমেছে, শীত তখনো বিদায় নেয়নি, আমরা ভাই বোনেরা ভাবছি কোথাও সবাই মিলে একসাথে বেড়িয়ে আসবো, তখন খোকন একদিন বললো বিজয় বার বার বলছে ওদের বাড়ী আসতে, ওদের গ্রামটা দেখে আসবি নাকি?
আসবো তো বটেই, এরকম লোভনীয় প্রস্তাব কেউ ছাড়ে নাকি? আমরা এক কথায় রাজী। টুবলি কলকাতা এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে, সেও আমাদের সাথে যোগ দিতে চায়।
বুধবার ফেব্রুয়ারীর ষোল তারিখ যাওয়া ঠিক হলো।
কথামতো সেদিন সকাল দশটা নাগাদ একটা বড় Mahindra Scorpio SUV গাড়ী নিয়ে আমরা রওনা হলাম। পথে গড়িয়া থেকে খোকন মিঠু আর টুবলিকে তুলে নেওয়া হলো। টুবলি সল্ট লেকে ওদের বাড়ী থেকে Uber নিয়ে গড়িয়া চলে এসেছে।
গড়িয়া থেকে বাইপাস ধরে নরেন্দ্রপুর সোনারপুর ছাড়িয়ে আমরা বারুইপুরের দিকে এগোলাম। কলকাতা শহরের এই দক্ষিণ প্রান্তে বাইপাসের ধারে কত উঁচু উঁচু বাড়ী আর Housing complex ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে, দেখে অবাক হতে হয়।
বারুইপুর শহরটা বেশ বড়, শহরের প্রধান রাস্তার দুই দিকে দোকান, জমজমাট ভীড়। ছোটকাকা কাজ থেকে অবসর নেবার পরে এখানে একটা জমি কিনে বাড়ী করে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। টুবলির তাই জায়গাটা চেনা। “বিয়ের পরে কলকাতা থেকে মা বাবার কাছে আসলে ট্রেণ থেকে নেমে এই স্টেশন রোড থেকে রিক্সা নিয়ে আমি বাড়ী যেতাম”, কিছুটা স্মৃতিমেদুর হয়ে বললো সে।
বারুইপুর থেকে বিজয়দের গ্রাম আরো প্রায় মিনিট পনেরোর রাস্তা, বিজয় বলে দিয়েছিল বন্ধন ব্যাঙ্ক এর পরে একটা রাস্তা ডান দিকে গ্রামের ভিতরে চলে গেছে, সেখানে পৌঁছে ওকে একটা ফোন করতে।
শহর কলকাতা ক্রমশঃ তার থাবা বাড়াচ্ছে কলকাতার উপকণ্ঠে।
বন্ধন ব্যাঙ্ক চোখে পড়তেই বিজয়ের নির্দ্দেশ অনুযায়ী আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে তার গ্রামের সরু রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। আর ঢুকেই পল্লীগ্রামের পরিবেশ চোখে পড়লো। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, চারিদিকে প্রচুর গাছ পালা, তার মাঝে কিছু মাটির আর পাকা বাড়ী। সরু কিন্তু পাকা সিমেন্টের রাস্তা, আমাদের গাড়ীটা পুরো রাস্তা জুড়ে যাচ্ছে, উল্টো দিক থেকে কোন গাড়ী এলে কি হবে কে জানে, তার ওপরে মাঝে মাঝে রাস্তার একেবারে পাশে পুকুর, একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ীশুদ্ধ জলে।
ঝুনকু আর খোকন এখানে বেশ কয়েকবার এসেছে, তাই জায়গাটার সাথে তারা পরিচিত। তাছাড়া বিজয় তার বাড়ী থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্যে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক দিন পরে তাকে দেখলাম। বেশ রোগা হয়ে গেছে বিজয়, একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দেখলাম, খোকনের প্রশ্নের উত্তরে বলল কোমরে ব্যথা, ডাক্তার দেখিয়েছে। আমায় অনেকদিন পরে দেখছে বিজয় কিন্তু তার ব্যবহারে তা বোঝার জো নেই। আন্তরিক ভাবে সে আমার হাত ধরে আমায় তার বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেল।
“এখেনে কেউ মাক্স পরেনা মান্টুদা, মুখ থেইকে মাক্স টা খুইলে ফেলো”, বেশ ভারিক্কী চালেই আমায় বললো বিজয়।
তার কথায় একটা অধিকারবোধ আর শাসনের ভাব ছিল যেটা খুব উপভোগ করেছিলাম সেদিন। এত বছর পরে দেখা, আমি তো তার কাছে বলতে গেলে একজন অজানা অচেনা লোক। কিন্তু কত সহজে সে আমায় আত্মীয়ের মতো আপন করে নিলো একেবারে প্রথম থেকেই, তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি তার ব্যবহারে কোন জড়তা ছিলনা।


৩ – বিজয়ের গ্রাম, বাড়ী আর সংসার
আগে মাটির বাড়ীতে থাকতো বিজয়রা, এখন বিজয় তার নিজের পাকা বাড়ী বানিয়েছে, উঠোনের দেয়ালে তার বাবা আর তার নাম বেশ স্টাইল করে সিমেন্ট দিয়ে লেখা।
স্বর্গীয় ঋতুরাম সর্দ্দার – বিজয়পদ সর্দ্দার
উঠোনের এক দিকে রান্নাঘর, সেখানে একটি অল্পবয়েসী মেয়ে আমাদের দেখে লাজুক হাসলো। বিজয় আলাপ করিয়ে দিয়ে বললো, “সকাল থেকে বৌমা তোমাদের জন্যে রান্না করতি লেগেছে”। বৌটির গায়ে গায়ে ঘুরছে তার দুই ছেলেমেয়ে, বিজয়ের নাতি অঙ্কিত আর নাতনী অদ্বিতীয়া। তারাও তাদের মা’র মত বেশ চুপচাপ। বিজয়ের বৌ প্রভা বাড়ী নেই, শুনলাম সে গেছে তাদের পুকুর ঘাটে, বাড়ীর পাশেই রাস্তার ওপারে বিজয়দের নিজের পুকুর।
আমি সুভদ্রা আর টুবলি এই প্রথম বিজয়ের বাড়ী এসেছি, সে আমাদের বাড়ীটা ঘুরিয়ে দেখালো। প্রচ্ছন্ন গর্ব মেশানো বিনয়ের সাথে সে আমাদের জানালো যে তার বাড়ীতে টি ভি, এ সি, ওয়াই ফাই, ব্রড ব্যান্ড ইন্টারনেট, বেশ কিছু মোবাইল ফোন – এ সমস্ত কিছুই আছে। আর আছে আধুনিক বাথরুম সেখানে কমোডের ও ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ আমাদের শহুরে বাড়ীতে যা কিছু আছে সবই আছে তার এই গ্রামের বাড়ীতেও। দিদি আর বৌদিদের তাই কোন অসুবিধেই হবেনা এখানে।
দোতলা বাড়ী, তিনতলায় ছাত। দোতলায় দুটো শোবার ঘর, আর আছে একটা খোলা ছাদ, সেখানে পরে ঘর উঠবে হয়তো। বিজয় আর অঙ্কিত দু’জনে মিলে সেই ছাতে আমাদের বসার জন্যে কিছু চেয়ার এনে দিলো।
তিন তলার ছাতে ওঠার পথে পূজোর ঘর। সেটা ছাড়িয়ে ওপরের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রথমেই দেখলাম সারা ছাতে শুকোনোর জন্যে ছড়ানো আছে প্রচুর ধান। সন্তর্পনে সেই ধান কাটিয়ে পাঁচিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। নীচে তাকিয়ে দেখি চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে পল্লীগ্রাম তার যাবতীয় সৌন্দর্য্য নিয়ে। যতদূর চোখ যায় শুধু অবারিত সবুজ ধানক্ষেত। কচি ধানের চারার তলায় জমে আছে জল, আর রোদ পড়ে সেই জল চিকচিক করছে।
আমার শহুরে চোখে এই দৃশ্য খুব মায়াবী লাগলো, আর অবধারিত ভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে পড়ে গেল।
ওপারেতে দেখি আঁকা/ তরুছায়া মসী মাখা/ গ্রামখানি মেঘে ঢাকা/প্রভাতবেলা/
বিজয় বললো “ওই যে ক্ষেতটা দেখতিছো, ওটা সবটাই আমার। প্রায় কুড়ি বিঘা জমি।”
“কে চাষ করে, তুমি লোক রেখেছো?”
বিজয় বলল, “চাষ করার জন্যি লোক আছে, আমি নিজেও কাজে লাগি।” এই বয়সেও বিজয় খুব কর্মঠ।
আমরা ভাইবোনেরা কিছুক্ষন দোতলার ছাতে চেয়ারে বসে গল্প করলাম, বিজয় আমাদের জন্যে ডাবের জল নিয়ে এলো। তারপর খোকন আর আমি বিজয়ের সাথে গেলাম গ্রামটা একটু ঘুরে দেখতে। গ্রামের নাম চয়নী মাঝেরহাট। ঘুরে ঘুরে এঁকে বেঁকে সরু সিমেন্টের রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে পুকুর, সেখানে ঘাটে বেশ কিছু লোক গা ডুবিয়ে স্নান করছে, আর কোথাও ঘাটের সিঁড়িতে বসে কাজে ব্যস্ত কিছু মেয়ে। আমাদের মত অচেনা শহুরে মানুষদের দেখে তারা মাথায় ঘোমটা দিলো।
সত্যেন দত্তের সেই পালকীর গানের লাইনগুলো মনে এলো তাদের দেখে।
কার বহুড়ী বাসন মাজে, পুকুর ঘাটে ব্যস্ত কাজে/ হুন হুনা/
এঁটো হাতে হাতের পোঁছায়, গায়ে মাথার কাপড় গোছায়/হুন হুনা, হুনহুনা/
পথে জয়পদর বাড়ী পড়লো। জয় হলো বিজয়ের যমজ ভাই। ওরা Identical twins, কম বয়েসে ওদের অবিকল এক চেহারা ছিল। পাশাপাশি রাখলে কে যে কে চেনা প্রায় অসম্ভব ছিল। এখন অবশ্য চেহারা অনেক আলাদা হয়ে গেছে দু’জনের। বিজয় কাজ ছেড়ে দেবার পরে তার দুই ভাই জয়পদ আর চিন্তামণি আমাদের বাড়ীতে কাজ করেছে কিছুদিন।
দেখা গেল জয়পদ বাড়ী নেই, পুকুরে স্নান করতে গেছে। তো বিজয় আমাদের নিয়ে চলে গেল সেই পুকুরঘাটে। জয় আর চিন্তামণি দুজনেই আমাদের দেখে খুব খুসী। পুকুর ধারে রাস্তার ওপরেই অনেক কথা হলো তিন ভাইয়ের সাথে। মনোহরপুকুরের বাড়ীর সেই পুরনো দিনগুলো নিয়েই স্মৃতিরোমন্থন হলো। বিশেষ করে তাদের মনে আছে মেজমা আর সেজমার (জ্যেঠিমা আর আমার মা) কথা। জ্যেঠিমা সম্বন্ধে বিজয়ের সহাস্য মন্তব্য – “বড়মা খুব ভালবাসতো আমাদের, কিন্তু মাঝে মাঝে বড় গরম হই যেতো” শুনে বাকি দুই ভাইও হেসে তাদের সোৎসাহী সমর্থন জানালো।
তিন ভাই এর সাথে আমি আর খোকন ওই পুকুর পাড়ে গ্রুপ ফটো তুললাম।
তার পরে বাড়ী ফেরার পথে তার নিজের পুকুর দেখাতে নিয়ে গেল বিজয়, সেখানে বিজয়ের বৌ প্রভা তখন তার কাজ সেরে বেশ কিছু বাসন হাতে বাড়ী ফিরছে। আমাদের দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তার বৌমার মতোই শান্ত স্মিত হেসে সে নীরবে অভ্যর্থনা জানালো আমাদের।
গ্রাম দেখা শেষ করে আমরা বাড়ী ফিরলাম। ইতিমধ্যে বিজয়ের ছেলে বিশ্বজিৎ তার কাজ থেকে ফিরে এসেছে, বাড়ীর কাছেই বড় রাস্তার ওপর সে একটা বাড়ী কিনে সেটা বন্ধন ব্যাঙ্ক কে একটা দিক ভাড়া দিয়েছে, তা ছাড়াও তার একটা বিয়েবাড়ী ভাড়া আর কেটারিং এর ব্যবসা আছে, আর সেই বাড়ীর একতলায় বিল্ডিং মেটিরিয়াল এর দোকান। বেশ করিতকর্ম্মা আর উদ্যমী ছেলে বিশ্বজিৎ। এত অল্প বয়সে এতগুলো ব্যবসা করার মত মূলধন সে পেলো কোথায় এই প্রশ্ন অবশ্য করিনি। ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে সেই টাকা খাটিয়ে বাড়িয়েছে ধরে নিতে হবে, তাছাড়া বিজয়ও তার পেনশনের টাকা থেকে ছেলে কে সাহায্য করেছে নিশ্চয়।
বড় কথা হলো সে টাকাটা নষ্ট করেনি, ঠিকঠাক কাজে লাগিয়েছে।
“বড় রাস্তার পাশে জমিটা কত দিয়ে কিনলে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“কত আর? পঞ্চাশ লাখ মতো হবে! জলা জমি বলে একটু সস্তায় পেলাম!” বিশ্বজিৎএর কথায় তার বাবার মত কোন গ্রামীন টান নেই।
“আর বাড়ীটা তৈরী করতে কত পড়লো?”
খানিকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বিশ্বজিৎ বললো, “এখনো পর্য্যন্ত তো দুই কোটি টাকা মতো লেগেছে, কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি।”
বলে কি?
আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীটা তো মনে হচ্ছে বিজয়ই কিনে নিতে পারতো~
বিজয় বললো “মান্টুদা’, তোমরা এবার এসে খেতি বোসো, আর দেরী কইরোনা, খাবার ঠান্ডা হই যাবে। ”
তাকিয়ে দেখি উঠোনের মাঝখানে বেশ কিছু টেবিল চেয়ার পাতা। বিয়ের নেমন্তন্নের পার্টির মতো ধবধবে পরিস্কার সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিশ্বজিৎএর কেটারিং এর ব্যবসা আছে, ওই বন্দোবস্ত করেছে।
আমরা গিয়ে যে যার মত বসে পড়লাম, বেশ ক্ষিদেও পেয়েছিলো। আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার শিউমঙ্গলও এসে বসলো আমাদের সাথে।



৪ – বিজয় আর মার্লন ব্র্যান্ডো
সেই ভোরবেলা থেকে বিজয়ের বৌমা আমাদের জন্যে রান্না করেছে শুনেছিলাম, এবার সে নিজেই আমাদের পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বড় নম্র আর শান্ত মেয়েটি, একা একা এত কাজ সে হাসিমুখে করছে, তার মাথায় ঘোমটা, মুখে কোন কথা নেই, তাকে দেখে আমাদের খুব ভাল লাগলো। বিজয়ের কাছে শুনেছি সে বড় ঘরের মেয়ে। তার তিন ভাই এর কাছ থেকে সে তার বাবার সম্পত্তির কোন ভাগ চায়নি, তাই ভাইয়েরা ভালবেসে তাকে প্রায়ই এটা সেটা উপহার দিয়ে যায়। বিজয় তার ছেলের বিয়েতে তার বড়লোক বেয়াই এর কাছ থেকে কোন যৌতুক ও নেয়নি, তাই দুই পরিবারের মধ্যে খুব সুসম্পর্ক।
আমাদের সাথে বিজয় আর তার নাতি নাতনীও খেতে বসেছে, তারাও তাদের মা’র মতোই খুব চুপচাপ আর শান্ত। বিজয়ের বৌ প্রভা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখাশোনা করতে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে তাদের আতিথেয়তা বড় আন্তরিক।
এলাহী মেনু।
সেদ্ধ চালের ভাত, শুনলাম সেই চাল বিজয়ের নিজের ক্ষেতের। বিশ্বজিৎ এর ব্যবসায় যারা কাজ করে, সেখানে তাদের দুপুরের খাবারের চালও যায় এখান থেকে। তার পরে মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, সাথে বেগুণী, আর বাটা মাছ ভাজা। চাল এসেছে বিজয়ের ক্ষেত থেকে, বাটা মাছ বিজয়ের পুকুরের। তার পর এক এক করে গলদা চিংড়ীর মালাইকারী, রুই মাছের কালিয়া আর পাঁঠার মাংস। শেষ পাতে টোম্যাটো আর আমসত্ত্বের চাটনি আর মিষ্টি।
বিজয় কিছু বাকি রাখেনি।
প্রত্যেকটি পদ অত্যন্ত সুস্বাদু লাগলো আমাদের । আমরা প্রত্যেকেই সাধারণ ভাবে আমাদের খাবারে একটি বিশেষ স্বাদে অভ্যস্ত থাকি, আমাদের জিভে সেই স্বাদের একটা ভাল লাগা আগে থেকেই তৈরী হয়ে থাকে। সেই তৈরী স্বাদের থেকে খাবারের রসায়নে একটু এদিক ওদিক হলেই আমরা টের পাই। হয়তো ভাত ভাল সেদ্ধ হয়নি, কিংবা নুন মশলা আমাদের মনোমত নয়, আমরা টের পাবোই।
কিন্তু বিজয়ের বউমার প্রত্যেকটি রান্না একেবারে আমাদের palette এর সাথে যাকে বলে perfect fit…
সে যে একজন পাকা রাঁধুনী তা বুঝতে দেরী হলোনা, হুস হাস করে চেটে পুটে খেলাম সবাই।
খাবার পরে লম্বা গেলাসে করে ডাবের জল নিয়ে এলো বিজয়। তার নিজের জমিরই গাছ, সম্ভবতঃ। ডাব নিজেই কেটে গেলাসে ভরেছে সে।
সারা দুপুর বিজয়দের চাতালে বসে নানা গল্প হলো আমাদের।
মাসে ইলেক্ট্রিক বিল কত হয়? হাজার চারেক টাকা।
লোড শেডিং হয় কিনা। না, আজকাল আর হয়না।
মশারী ব্যবহার করতে হয় রাতে? হ্যাঁ।
চুরি চামারী ডাকাতি? গরু নাকি অনেক চুরি হয়ে গেছে এই গ্রাম থেকে। বাংলা দেশে পাচার হয়ে যায় তারা। এখন তাই সবার শুধু ছোট ছোট “হেলে” গরু। গ্রামে হিন্দুদের বাস, তাই গরুর মাংস এখানে খাওয়ার চল নেই।
রাজনীতির লোকেদের টাকা পয়সা খাওয়াতে হয়? তা তো হয় অবশ্যই। তবে টাকা দিলে তাদের দিয়ে কাজও হয়। এই তো গ্রামে পাকা রাস্তা হয়েছে।
এই সব নানা প্রসঙ্গ চলে এলো আমাদের আলোচনায়।
কথাবার্ত্তা বেশী বলেনা বিজয়, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বে আর ব্যবহারে পরিবারের ওপরে তার যে একটা অনায়াস আধিপত্য আছে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়না। এমন নয় যে তাকে সবাই ভয় পায়, বা তাকে দেখে তঠস্থ হয়ে থাকে। বরং তার মুখে সবসময়ই লেগে থাকে এক চিলতে হাসি যার থেকে তার আত্মবিশ্বাসের একটা সুস্পষ্ট আন্দাজ পাওয়া যায়।
নাতি নাতনীরা এত চুপচাপ কেন? তোমরা ওদের বেশী বকঝকা করোনা তো – সুভদ্রার এই প্রশ্নের ঊত্তরে বিজয়পদ তার সহজ হাসি হেসে বলেছিল “একটু আধটু শাসন না করলি চলবি কি করে?” এক এক জন মানুষ থাকে যাদের ব্যক্তিত্ব আশেপাশের লোকেদের কাছ থেকে ভয় আর সমীহ আদায় করে নেয়। বিজয় ডন নয়, তবু তার গ্রামের লোকজন আর সংসারের কাছের মানুষদের কাছে তার প্রভাব আর প্রতিপত্তি আমার নজর এড়ায়নি। আজকের স্বল্পবাক আত্মবিশ্বাসী বিজয় কে দেখে আমার গডফাদার ছবিতে ডন কর্লিয়নের ভূমিকায় মার্লন ব্র্যান্ডোর দুর্দ্দান্ত অভিনয়ের কথা মনে পড়ছিল। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ঘটনাবহুল জীবনের শেষে পৌঁছে এক শান্ত সৌম্য পরিতৃপ্ত ডন বসে আছেন তাঁর বাগানে, তাকিয়ে দেখছেন তাঁর নাতি নাতনীরা বাগানে ছুটোছুটি করে খেলা করছে। সে এমন এক মায়াবী দৃশ্য, অভিনয়ের গুণে যা মনে থেকে যায় অনেকদিন।


৫) বিদায়ের পালা
আলো কমে আসছে, আমাদের ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো।
বাড়ী থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে ওঠার পথে দেখি বিজয়ের বাড়ীর বাগানে শিম গাছে রাশি রাশি শিম ঝুলছে। বিজয় আমাদের জন্যে তার বাগানের গাছ থেকে বেশ কিছু শিম আর শীষ পালং তুলে আমাদের জন্যে থলিতে ভরে দিলো।
বড় রাস্তা পর্য্যন্ত আমাদের গাড়ীতে করে এলো বিজয়। তার ছেলের দোকান আর অফিস রাস্তার ওপরে, বন্ধন ব্যাঙ্কের বিরাট সাইনবোর্ড। দোতলায় বন্ধন ব্যাঙ্ক, একতলায় বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাড়া দেবার জন্যে একটা আলাদা জায়গা করা হয়েছে, আর পাশে একটা বিল্ডিং মেটিরিয়ালের শোরুম।
ব্যবসার দুটো সাইনবোর্ড টাঙানো আছে চোখে পড়লো। প্রভা বিল্ডার্স আর অদ্বিতীয়া কেটারিং। মা আর মেয়ের নামে তার কোম্পানীর নাম রেখেছে বিশ্বজিৎ।
বিশ্বজিৎ আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখালো। তার আর বিজয়ের মুখে একটা সাফল্য আর তৃপ্তির হাসি লক্ষ্য করে বেশ ভাল লাগলো।
গাড়ীতে ফিরতে ফিরতে বিজয়ের একটা কথা বার বার মনে পড়ছিল।
“মান্টুদা, আমার যা কিছু হয়েছে, সব তোমাদের আশীর্ব্বাদে”, বার বার বলেছিল সে। তার সেই কথার মধ্যে ছিল বিশুদ্ধ আন্তরিকতা। আর তার সেই কথা শুনে আমার বেশ লজ্জাই করেছিল সেদিন। সেই আশীর্ব্বাদ তো সে পেয়েছে তার ভাগ্যদেবতার কাছ থেকে।
বাকিটা তার একান্ত নিজের সুকৃতি, তার সততা, নিষ্ঠা আর কর্ম্মক্ষমতা।
বিজয়দের সাথে তাদের গ্রামে কাটানো সেই দিনটির কথা আর তাদের আতিথেয়তার কথা অনেকদিন মনে থাকবে।
ভগবান তাদের মঙ্গল করুন।




