
হাজারদুয়ারী প্রাসাদ
প্রথম দিন ১২/১২/২০২৩
১) ট্রেণ যাত্রা
ছোটবেলার স্কুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আজকাল KP mপ্রায়ই কোথাও একসাথে বেড়াতে যাবার কথা ওঠে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে দীপঙ্কর অমিতাভ সুজাতা সুভদ্রা আর আমি একসাথে গোপালপুর বেড়িয়ে আসার পর আমাদের এই যৌথ বেড়ানোর প্রতি আগ্রহ বেশ বেড়ে গেছে। এবার আমরা যাচ্ছি মুর্শিদাবাদ, আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে প্রবীর আর সুপ্রিয়া।
মুর্শিদাবাদে আমাদের কাশিমবাজারের রাজবাড়ীতে দুই রাতের থাকার বন্দোবস্ত করছে অমিতাভ। কাশিমবাজারের আজকের রাজা প্রশান্ত রায়ের ছেলে পল্লব রায় এখন এই রাজবাড়ীটার দেখাশোনা করে। সে অমিতাভর বন্ধু, তারা দু’জনেই Calcutta Club এর সদস্য, এবং আমাদের এই ট্রিপের সব বন্দোবস্তই পল্লব করে দিয়েছে।
মঙ্গলবার ১২ই ডিসেম্বর সকাল ন’টায় আমাদের ট্রেণ হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়বে।
কলকাতা স্টেশন আবার কোথায়?
আমরা কেউ ওই স্টেশন চিনিনা। যাই হোক, আমাদের সকলের ড্রাইভাররা জায়গাটা চেনে। তাই অসুবিধে হয়নি। জায়গাটা হলো উত্তর কলকাতায়, আর জি কর মেডিকাল কলেজ আর হাসপাতালের কাছে। আমাদের বেরোতে একটু দেরী হয়েছে, তবে এই সাত সকালে কলকাতার রাস্তা ফাঁকা। তবু আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন ট্রেণ ছাড়বার বেশী দেরী নেই। দীপঙ্কর, প্রবীর, আর অমিতাভ ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে, আমাদের দেরী দেখে ওরা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল কয়েকবার।
ট্রেণ দাঁড়িয়ে আছে লাইনের ওপারের প্ল্যাটফর্মে, ওভারব্রীজ দিয়ে লাইন ক্রস করার সময় হাতে নেই, আমাদের বুড়ো কুলী আমাদের মাল মাথায় নিয়ে হেঁটে লাইন ক্রস করে আমাদের ট্রেণে উঠিয়ে দিলো। সেই কুলীটির অভিজ্ঞতা আর উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে সেদিন ট্রেণ মিস করিনি।
ট্রেণের চেয়ার কারের টিকিট কেটে রেখেছিলো প্রবীর।
একটু পরেই ট্রেণ ছেড়ে দিলো। মন্থর গতিতে আমরা কলকাতা শহর আর শহরতলীর মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম, কারুর হেঁসেল, কারুর রান্নাঘর, কারুর উঠোন দুই পাশে দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কিছু কোঠাবাড়ী, তার বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে, ছাতে শাড়ি শুকোচ্ছে। দুই একটা পুকুর চোখে পড়ছে সেখানে সকালবেলায় দাঁতন করছে কিছু লোক, তাদের পরণে গামছা, হয়তো এর পরে পুকুরে নেমে স্নান সেরে নিয়ে তারা অফিস যাবার জন্যে তৈরী হবে।
একটা নতুন দিন শুরু হচ্ছে, ঘুম ভাঙ্গছে কলকাতা শহরের।
একটু পরেই অবশ্য শিয়ালদা লাইনে এসে পড়ার পরে চেনা স্টেশন এক এক করে আসতে লাগলো। দমদম জংশন, বরানগর, বেলঘরিয়া, আগরপাড়া। বহুদিন আগে, ১৯৬৬ সালে, আমি তখন খড়্গপুরে থার্ড ইয়ার, গরমের ছুটিতে আমার ট্রেনিং ছিল বেলঘরিয়াতে Texmaco কোম্পানীতে। আগরপাড়াতেও Texmaco র একটা ফ্যাক্টরী ছিল, তাই কাজ থাকলে বেলঘরিয়া থেকে আগরপাড়া ও অনেক বার লাইন ধরে হেঁটে গেছি। ওই স্টেশনগুলো পেরিয়ে যাবার সময় সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি মনে ভেসে আসছিল।
ট্রেণ বেশ ভাল স্পীড নেবার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল কামরায় হকারদের আনাগোনা। তাদের মধ্যে বেশ কিছু ভিখারী, একটি বিকলাঙ্গ শিশু দেখলাম ঘষ্টে ঘষ্টে কামরার এক দিক থেকে অন্য দিকে দুই পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথের লোকটি করুণ চোখে হাত পেতে আছে। জীবিকা অর্জ্জনের জন্যে এই শিশুটিকে ব্যবহার করছে তার পরিবার। এই ধরণের দৃশ্য আমাদের সবার মোটামুটি পরিচিত। আমরা কেউ কেউ ব্যাগ থেকে কিছু খুচরো পয়সা বের করে ওই বাড়িয়ে দেওয়া হাতে গুঁজে দিই। আবার কেউ কেউ উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। জগতের সব দুঃখ কষ্ট অনাচার অবিচার অসাম্য দূর করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
এছাড়া আছে খাবার দাবার, ব্রেকফাস্টের জন্যে চা আর স্যান্ডুইচ বিক্রেতারা। বেশ কয়েকবার আমরা লেবু চা কিনে খেলাম। লেবু চার কাগজের কাপ গুলো এত ছোট যে বার বার না খেলে ঠিক চা খেয়েছি বলে মনেই হয়না।
এটা কি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চায়ের কাপ?
আর হকারদের কথা তো বলে শেষ করাই যাবেনা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ নেই, যা এখানে পাওয়া যাবেনা। অফিস স্টেশনারীর পসরা সাজিয়ে একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার হাতে আছে A4 কাগজ, পেন্সিল, বল পয়েন্ট পেন, ফাইল, স্টেপলার, হোলপাঞ্চ, টর্চ, ব্যাটারী এবং আরো অনেক এরকম অত্যন্ত দরকারী জিনিষ। লোকে পটাপট কিনছে দেখলাম। একজন রংচঙে গামছা বিক্রী করছিল, সুভদ্রা তার কাছ থেকে দুটো লাল নীল বেগুণি রঙের চেক আর স্ট্রাইপ করা গামছা কিনে নিল। ওই গামছা দিয়ে সুন্দর কামিজ কিংবা টপ্ বানানো যাবে।
এরপরে একটি লোক এলো যে পিঠ চুলকানোর সুবিধের জন্যে লম্বা প্লাস্টিকের লাঠি বিক্রী করছে। লাঠিটার শেষটা আঙুলের নখের মত ছুঁচলো, চুলকানোর সুবিধের জন্যে।
বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর মেয়েদের এই নিয়ে কোন অসুবিধে থাকেনা। তখন তাদের বাধ্য বরেরা বললেই তারা বৌদের মাথা পা বা কোমর টেপার জন্যে প্রস্তুত। “শুনছো, পিঠের এই জায়গাটায় একটু চুলকে দাওনা গো”, বললেই তারা হাসিমুখে এসে বৌদের হুকুম তামিল করতো।
কিন্তু বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরে এখন সেই বরেদের আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন হয়ে গেছে। এখন তাদের দেখলে আর চেনাই যায়না।
একজন তো সারাদিন ভুরু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে শেয়ার মার্কেটের ওঠা পড়া দেখে। আর একজন রাত দুটো থেকে রাত চারটে টি ভি চালিয়ে ফুটবল খেলা দেখে যায়। আর তৃতীয় জনের অবস্থা আরো খারাপ, সারাদিন তার ফোন আসে, কে বা কারা যে তাকে এত ফোন করে কে জানে, তার ওপরে সে আবার রাত্রে ল্যাপটপ খুলে কি যে হাবিজাবি লেখা লেখে, তার কোন মাথামুন্ডু নেই।
বৌদের সাথে কথা বলার সময় এখন এদের কারুর নেই।
সখীর হৃদয় কুসুম কোমল/কার অনাদরে আজি ঝরে যায়/
কেন কাছে আসো, কেন মিছে হাসো/ কাছে যে আসিত, সে তো আসিতে না চায়/
সুতরাং, এখন হলো নিজের পিঠ নিজে চুলকোবার দিন। কিন্তু মুস্কিল হলো নিজের পিঠ নিজে চুলকোনো অত সোজা কাজ নয়। ভগবান আমাদের শরীরের ডিজাইন করার সময় পিঠ আর হাতের ভারসাম্যের কথাটা চিন্তা করেননি। ফলে পিঠের অনেক জায়গাই আমাদের হাত পৌঁছয়না। আর পিঠের যে সব জায়গা্য আমাদের হাত পৌঁছয়না সেই সব জায়গাই অবধারিত বেশি চুলকোয়।
সে এক মহা যন্ত্রণা।
সুজাতা সুপ্রিয়া আর সুভদ্রা তিনজনেই প্লাস্টিকের পিঠ চুলকোনোর লাঠি কিনে নিলো।
এই সব যখন চলছে তখন আমাদের ট্রেণ একটার পর একটা স্টেশন ক্রস করে যাচ্ছে। অমিতাভ মাথা নীচু করে চোখ কুঁচকে তার ফোনে স্টেশন এর নাম দেখে যাচ্ছে, বেথুয়াডহরী, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর…
খুব কম স্টেশনেই আমাদের ট্রেণ থামছে। বেলঘরিয়ার পরে রাণাঘাট আর তার পরে কৃষ্ণনগর। প্রত্যেক স্টেশনে মাত্র এক মিনিটের জন্যে ট্রেণ দাঁড়ায়। সামনে বহরমপুর আর তারপর আমাদের স্টেশন মুর্শিদাবাদ। এক মিনিটের মধ্যে নামতে হবে, তাই আমরা আগে থেকেই ওপরের র্যাক থেকে আমাদের ব্যাগ নামিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিয়েছি।
অমিতাভ দুটো Toyota Innova SUV বলে রেখেছিল, সেই দুটো গাড়িতে চড়ে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য কাশিমবাজারের রাজবাড়ী।

২) কাশিমবাজার রাজবাড়ী
স্টেশন থেকে কাশিমবাজারের রাজবাড়ী বেশী দূর নয়। পথে আসতে আসতে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রধান এবং জনবহুল, ব্যস্ত এবং ব্যবসায়িক অঞ্চল লালবাগের রাস্তাঘাটে প্রচুর ভীড় আর রাস্তায় অনেক ঘোড়ায় টানা গাড়ী চোখে পড়ল। বিয়ের পরে সুভদ্রা আর আমি একবার ১৯৭৫ সালে মুর্শিদাবাদে এসেছিলাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে মুর্শিদাবাদে এসে রাস্তার ভীড় আর ঘোড়ায় টানা গাড়ী দেখে সেই পুরনো দিনগুলো আবার মনের মধ্যে ফিরে এলো।
সেবার একদিন একটা সাইকেল রিক্সায় চেপে আমরা অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম, হাজারদুয়ারী, মোতিঝিল এই সব জায়গার নাম এখন আবছা মনে পড়ে, কিন্তু এখন এতদিন পরে স্মৃতি একেবারেই ঝাপসা। আমার ক্যামেরায় অনেক ছবিও তুলেছিলাম সেবার, তার মধ্যে আমার সুন্দরী নতুন বিয়ে করা বৌয়ের নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবিই বেশী ছিল।
এই প্রাচীন শহর অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এই শহরে ছড়িয়ে আছে বহু দর্শনীয় স্থান, যেখানে বাংলার ইতিহাস জানার জন্যে যেতেই হবে। দুঃখের বিষয় বিয়ের পরের সেই দিনগুলোতে অতীতের ইতিহাস আমার জীবনে ততোটা গুরুত্ব পেতোনা, তখন বর্ত্তমানেই মজে ছিলাম। এখন এই বয়েসে এসে ইতিহাস জানার ইচ্ছেটা বেশী।
একসময় সমস্ত বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবী মসনদ থেকে। শুধু মাত্র নবাবরাই নন, বর্ধিষ্ণু এই অঞ্চলে ছিল বহু জমিদার বংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি। পরে সেই ধনী জমিদারদের মধ্যে অনেকে ইংরেজ শাসকদের কাছে রাজা উপাধি পান্। কাশিমবাজার রাজবাড়ি সেই ইতিহাসেরই মূর্ত প্রতীক।
আমরা কাশিমবাজারের রাজবাড়ী পৌঁছে গেলাম মিনিট পনেরোর মধ্যে।
প্রথম দর্শনে সামনে থেকে দেখে ধবধবে সাদা বাড়ীটির ইউরোপীয় (Romanesque) স্থাপত্য আমার চোখে খুব সুন্দর লাগলো। সামনে ত্রিভুজাকার façade, এবং তার তলায় বেশ কিছু স্তম্ভ, আর বাড়ীটির সামনে ঘন সবুজ রং এর ঘাসের গালিচা বাড়ীর সাদা রং এর সাথে একটা অদ্ভুত সুন্দর contrast তৈরী করে বাড়ীটার একটা বনেদী চেহারা দিয়েছে।
১৯৭৪ সালে সুভদ্রার আর আমার বিয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতায় কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে। এলগিন রোড আর হরিশ মুখার্জ্জী রোডের মোড়ে অবস্থিত ওই রাজবাড়ীটি তেও যতদূর মনে পড়ছে ধবধবে সাদা প্রাসাদোপম বাড়ীর সামনে বিশাল সবুজ লন্ ছিল। আমার মাস্তুতো দাদা রতনদা’ বোধহয় ওই রাজবাড়ীতে কাউকে চিনতেন, তিনিই বৌভাতের জন্যে বাড়ীটির বন্দোবস্ত করে দেন্।
যাই হোক্, ভিতরে ঢুকে রিসেপশনে চেক ইন করে দোতলায় যার যার নিজের ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নীচে একতলায় নেমে এলাম আমরা। সেখানে একটা বিশাল ডাইনিং রুম, এক দিকে একটা লম্বা টেবিলে আমাদের জায়গা করা হয়েছে। শেফ ভদ্রলোক আমরা পল্লবের চেনা বলে এসে খুব খাতির করে এসে আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন।
লাঞ্চের মেনু পুরো বাড়ীর খাবার, সুক্তো, ডাল, ভাত, পাঁচমিশেলী তরকারী, মাছের ঝোল, মাংস, চাটনি – সব সুস্বাদু বাঙালী রান্না। শেষ পাতে মিষ্টি ছিল লাল দই, আর বহরমপুরের বিখ্যাত মিষ্টি, ছানাবড়া। কাশিমবাজারের রায় পরিবারের এখন একটা মিষ্টির দোকান কলকাতায় খুব নাম করেছে, তার নাম “Sugarr and Spice”,মুর্শিদাবাদের রাজবাড়ীতেও তাদের একটা দোকান আছে সেখান থেকেই আবাসিক দের জন্যে মিষ্টি সরবরাহ করা হয়।
জমিয়ে খেলাম সবাই, বেশ ক্ষিদেও পেয়েছিল। দুই দিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ শহরে যত দেখার জায়গা আছে, সব তো চাক্ষুস করা সম্ভব নয়, এই বয়সে এসে বেশী ছোটাছুটিও আমরা করতে চাইনা। হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে আমরা আজ আর সামনের দুই দিন কোথায় কোথায় যাওয়া যায় আর কি কি দেখা যায়, তার একটা ছক করে ফেললাম।

৩) কাটরা মসজিদ
প্রথমে কাটরা মসজিদ। এখানে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর সমাধি। ঢোকবার মুখেই বেশ কিছু গাইড দাঁড়িয়ে।
সেই গাইড দের মধ্যে একজনের সাথে আমাদের রফা হলো। তার নাম মনোজ তরফদার। তার কাছে শুনলাম যে কাটরা মসজিদ এবং মুর্শিদাবাদের অন্যান্য যত প্রাচীন প্রাসাদ আছে সব সরকারী পুরাতত্ত্ব বিভাগ ASI (Archeological Society of India) দেখাশোনা করে। এই গাইড রাও সবাই ASI দ্বারা লাইসেন্স প্রাপ্ত।
এক হিন্দু পরিবারে ১৬৭০ সালে এক হিন্দু ব্রাম্ভন পরিবারে মুর্শিদকুলী খাঁর জন্ম, তাঁর নাম ছিল সূর্য্য নারায়ণ মিশ্র। ন’বছর বয়েসে, মাথা মুন্ডন করে পৈতে নেওয়া হয়ে গেছে, সংস্কৃত মন্ত্র ছাড়াও রামায়ণ মহাভারত পুরান পড়েন। গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ। সেই সময় পারস্যের এক ধনী ব্যক্তি সফিউদ্দীন ইসলাম তাঁকে দত্তক নেন্, এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। তখন তাঁর নাম হয় কারতলব খান।
সফিউদ্দীন সম্রাট আওরংজেবের কাছের মানুষ ছিলেন। সফির পালিত পুত্র কারতলবের জমি জমা আর কর খাজনা ইত্যাদির হিসেব করার কাজ দেখে খুসী হয়ে সম্রাট আওরংজেব ১৭০০ সালে তাঁকে মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি দিয়ে বাংলার দিওয়ান করে ঢাকায় (তখন জাহাঙ্গীরাবাদ) পাঠান।
ঢাকায় তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবেদার ছিলেন সম্রাটের নাতি আজিম উস শান, যিনি কারতলবের প্রতি আওরংজেবের স্নেহ ভাল চোখে দেখেননি। তাঁদের শত্রুতা চরমে ওঠায়, মুর্শিদকুলী আওরংজেবের অনুমতি নিয়ে ঢাকা থেকে কিছুটা পশ্চিমে মুকসুদাবাদ নামে একটি ছোট শহরে তাঁর দপ্তর সরিয়ে আনেন। ১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি আনুগত্য ও দক্ষতার সাথে দিওয়ান হিসেবে তাঁর কাজ করে গেছেন, নিয়মিত মোগল সম্রাটের কাছে খাজনা পাঠিয়েছেন, এবং নিজের প্রদেশে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন এবং জায়গীরদার প্রথা সংক্রান্ত নানা উদ্ভাবনী কাজ করেছেন।
দিল্লীতে আজিম উস শানের ছেলে ফারুকশিয়ার মোগল সম্রাট হবার পরে তিনি ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলী খান কে বাংলা প্রদেশের সুবেদার করেন, কিন্তু চার বছর পরে মুর্শিদকুলী খাঁ মোগলদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে খাজনা পাঠানো বন্ধ করে ১৭১৭ সালে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হন্। এবং এই মুকসুদাবাদই পরে স্বাধীন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ হয়ে ওঠে।
কাটরা কথাটার মানে হলো সরাই খানা, সেই মধ্যযুগে বিদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এই সরাইখানা তে বিশ্রাম নিতো, সাথে খানা পিনা নাচ গান ও হতো নিশ্চয়।
কাটরা মসজিদ একটা চৌকো জায়গা নিয়ে তৈরী, যার চার কোণে বসানো চারটে উঁচু মিনার। ইঁটের তৈরী লাল রং এর মসজিদ, তার চারিপাশে সবুজ বাগান আর সামনে একটা লম্বা দোতলা বাড়ী, সেটাও লাল ইঁটের তৈরী, তাতে সারি সারি ঘর আর জানলা। এই ঘরগুলো নাকি ছিল ৭০০ জন মাদ্রাসার ছাত্রদের কোরান পড়ার জন্যে। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই মসজিদ ছিল ইসলামী শিক্ষার একটি বড় কেন্দ্র।
চারিদিকে লাল রং আর মাঝখানে সাজানো সবুজ বাগান পরিবেশকে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে সেরকম ভীড় নেই, শুধু আমরা ক’জন, সেই নির্জনতাও খুব উপভোগ করেছিলাম সেদিন। ১৭২৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর তৈরী এই কাটরা মসজিদ আজ দেশের হেরিটেজ প্রপার্টি।
মনোজ আমাদের গল্প করলো যে দিওয়ান হবার পরে মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাট আওরংজেব কে খুসী করার জন্যে নিয়মিত খাজনা পাঠিয়ে দিতেন। একবার তিনি নাকি তাঁর ছেলের হাতে ১০০০ স্বর্ণ মুদ্রা (মোহর) পাঠিয়েছিলেন, সে নাকি তার মধ্যে থেকে একটি মোহর এক গরীব দুঃখী লোক কে দান করে। ভেবেছিল কেউ গুণে দেখবেনা তাই ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
কিছুদিন পরে মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাটের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। তাতে লেখা এক হাজারের জায়গায় একটা মোহর কম পাঠিয়েছো দেখছি, কি ব্যাপার?
ছেলে কে জিজ্ঞেস করে যখন জানলেন সে একটা মোহর একজন গরীব লোককে দয়াপরবশ হয়ে দান করেছে, তিনি নাকি ছেলেকে মেরে তার মৃত ছেলের শিরচ্ছেদ করে তার মাথা ও একটি মোহর সম্রাট কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
যখন আমরা মনোজের এই গল্প অবাক হয়ে শুনছি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দীপঙ্কর, খেলোয়াড়ী হাফ প্যান্ট (বার্মুডা) পরে তাকে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে, নীচু গলায় সে আমায় বললো “এর একটা কথাও বিশ্বাস কোরোনা ইন্দ্রজিৎ, সব ডাহা গুল!”
তারপরে মনোজ বললো নবাবের বড় মেয়ে আজিমুন্নিসা বেগমকে তাঁর কোন একটি ব্যাধি নিরাময়ের জন্যে ১০০ টি শিশুর কলিজা খাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁর ব্যাধি নিরাময় হলেও শিশুদের কলিজা খাওয়া নাকি তাঁর নেশা হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে তাকে কলিজা খেকো বেগম ও বলা হয়। মুর্শিদকুলি খাঁ না কি সে জন্যে রেগে গিয়ে নিজের মেয়েকে জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলেন।
আমার পাশ থেকে অবিশ্বাসী দীপঙ্কর আবার বলে উঠলো “ইন্দ্রজিৎ এসব পুরো গ্যাঁজা, বুঝেছো তো?”
মনোজ বলল “না স্যার, সত্যি স্যার, কলিজা খাকী বেগমের সমাধি আর বাচ্চা মসজিদ এখান থেকে কাছে, বলেন তো আমি আপনাদের দেখিয়ে আনতে পারি ওখানে সব লেখা আছে!”
মুর্শিদকুলী খাঁ যতদূর জানা যায়, দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, ১৭২৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্য্যন্ত তাঁর রাজত্বে শান্তি এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় ছিল। কাটরা মসজিদের প্রাঙ্গনে বাগানের এক পাশে একটি ছোট শিবমন্দির দেখলাম। ব্যক্তিগত জীবনেও মুর্শিদকুলী খাঁ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেননা, তাঁর হারেম ছিলনা, এক স্ত্রীর সাথে সারা জীবন কাটিয়েছেন।
জমিজমা সংক্রান্ত আইনের সংস্কারকে মুর্শিদকুলী খাঁর অন্যতম অবদান হিসেবে ধরা হয়। মোগলদের জায়গীর প্রথাকে পালটে তিনি যে জমি আইনের প্রবর্ত্তন করেছিলেন, তাই শেষে জমিদারী প্রথা হিসেবে চালু হয়।
কাটরা মসজিদ থেকে বেরোবার দরজার পাশে নীচে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে, মনোজ দেখালো মাটির তলায় নবাবের সমাধি। ধর্ম্মপ্রাণ নবাবের নাকি ইচ্ছে ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পরে মানুষের যাতায়াতের পায়ের তলায় তাঁর সমাধি থাকবে, যাতে জীবনে যত পাপ তিনি করেছেন, মানুষের পায়ের তলায় কবরে শুয়ে থাকলে সেই পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে।


৪) জাহানকোষা কামান
কাটরা মসজিদের পরে জাহানকোষা কামান। জায়গাটা খুব কাছে । দুই মিনিটে পৌঁছে গেলাম।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে শুধু যুদ্ধ। ক্ষমতা আর আধিপত্যের, লোভ আর হিংসার কাহিনী। আর সেই যুদ্ধে ব্যবহার হয় গুলি বারুদ আর কামান।
কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর বিখ্যাত “পলাশীর যুদ্ধ” কাব্যে লিখেছিলেন,
“আবার, আবার সেই কামান গর্জন!
কাঁপাইয়া ধরাতল, বিদারিয়া রণস্থল,
উঠিল যে ভীম রব, ফাটিল গগন”
আজ কবি কথিত সেই সব কামান অব্যবহার্য হয়ে পড়লেও তাদের আকর্ষণ বিন্দুমাত্রও কমেনি। পশ্চিমবঙ্গের যে দু’টি বিখ্যাত কামানের নাম সর্বজনবিদিত, সেগুলি হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের দলমাদল এবং মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা। প্রথমটি প্রচারের আলোয় অনেকটা বেশি আলোকিত হলেও জাহানকোষার মাহাত্ম্যও কম নয়।
জাহানকোষা কামানটি রাখা আছে কাটরা মসজিদ থেকে কাছেই একটি গ্রামে যার নাম তোপখানা। আমাদের গাড়ী দুটো সেই গ্রামের ভিতরে ঢুকে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। গাছপালার মধ্যে ধুলোমাখা সরু রাস্তা, সেই পড়ন্ত বিকেলে কিছু লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে, বাচ্চারা খেলা করছে। কিছুটা দূরে একটা ঘেরা জায়গায় দেখা যাচ্ছে একটি কামান, কিছুটা যেন অনাদৃত, অবহেলিত আর একলা, আশে পাশে তাকে দেখার বা তাকে দেখে মুগ্ধ বা আশ্চর্য্য হবার কেউ নেই। পর্য্যটক বা গাইড ও কেউ নেই। শুধু আমরা ক’জন।
অষ্টধাতু দিয়ে তৈরী বলে কামানে এখনো কোন জং পড়েনি। কামানটির গায়ে খুব সুক্ষ্ম কাজে লেখা আছে ফারসী ভাষায় কোন লিপি। পাশে একটা ASI এর নোটিস বোর্ড সেখানে কামান সংক্রান্ত অনেক তথ্য। যে লোহার চাকাযুক্ত গাড়িতে কামানটি স্থাপিত ছিল তা বহু বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।


৫) মোতিঝিল
ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামছে, আমরা মোতিঝিল প্রাসাদের দিকে রওনা দিলাম।
মোতিঝিল মুর্শিদাবাদ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। একটা বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে, সেই গেটে বড় বড় করে “মোতিঝিল” লেখা। গেটের সামনে অনেক দোকান পাট, ভীড়। ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় সাজানো বাগান, আর এক দিকে একটা বেশ বড় ঝিল।
মুর্শিদাবাদে মোতিঝিলে ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ হল পর্য্যটকদের জন্য একটা বড় আকর্ষন।
কে এই ঘসেটি বেগম?
১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁর মৃত্যুর পরে নানা ঘটনাবলীর পরে ১৭৪০ সালে বাংলার নবাব হন্ আলীবর্দ্দী খাঁ। দীর্ঘ ষোল বছর (১৭৬০ সাল পর্য্যন্ত) তিনি বাংলার নবাব ছিলেন।
আলিবর্দ্দীর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের স্বামী আলীবর্দ্দির ভ্রাতুষ্পুত্র নওয়াজেস মহম্মদ ধনী ছিলেন এবং তিনি দানধ্যানে বহু অর্থ অকাতরে বিলোতেন। তাঁরা থাকতেন মুর্শিদাবাদে মোতিঝিল প্রাসাদে। নওয়াজেস তাঁর দান ধ্যান এবং ধার্মিক ব্যবহারের জন্যে ক্রমশ; সাধারণ এবং অভিজাত সবার মধ্যেই অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠছিলেন। নওয়াজেস আলিবর্দ্দীর জীবনদশাতেই অল্প বয়েসে মারা না গেলে হয়তো সিরাজের জায়গায় তিনিই নবাব হতেন। তাহলে বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হতো কিনা কে জানে?
তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে ঘসেটি বেগম উত্তরাধিকার সূত্রে তার স্বামীর কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ধন সম্পদ পান। মোতিঝিল প্রাসাদে গেলে সেই সব ধন রত্ন বিলাস সামগ্রী আজও যত্ন করে সাজানো আছে দেখা যায়।
নবাব আলীবর্দ্দী খানের মৃত্যুর পরে, ঘসেটি বেগম চেষ্টা করছিলেন দ্বিতীয় বোন শাহ বেগমের পুত্র শওকত জঙ্গ কে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত আলিবর্দ্দী খাঁ মৃত্যুর আগে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের ছেলে সিরাজউদ্দৌলা কে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব হিসেবে অভিষিক্ত করেন।
ঘসেটি বেগম তাই নবাব আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীরজাফর, ধনী ব্যবসায় জগৎ শেঠ, এবং উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ দের কাছে পরাজিত হন এবং ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানান।
বিয়ের পরে যখন আমরা এসেছিলাম, মনে আছে এই প্রাসাদের ভিতরে আমরা অনেকটা সময় কাটাই। সেখানে অনেক দর্শনীয় এবং মূল্যবান জিনিষ ছিল, তার মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ে লাল নীল কাঁচের জানলা, যা কিনা বিদেশ থেকে কেনা। তা ছাড়া ঝাড়লন্ঠন ঘর সাজানোর জিনিষ, নানা কারুকার্য্য, চারিদিকে বৈভবের ছড়াছড়ি।
এবার আর হাতে বেশী সময় না থাকায় ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ পর্য্যন্ত আর হাঁটা গেলনা। গেট থেকে প্রাসাদ পর্য্যন্ত একটা ছোট ট্রেনে করে যাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল, কিন্তু সন্ধ্যা নামায় সেটাও বন্ধ। আমরা তাই ঝিলের ধারে একটু হেঁটে বেড়ালাম।

৬) সন্ধ্যার আড্ডা
কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে একটু বিশ্রাম করে আমরা বসলাম আড্ডায়। দোতলায় আমাদের ঘর গুলো পাশাপাশি, এই সময়ে হোটেল খালি, আমরা ছাড়া এখানে আর কোন অতিথি নেই।
দীপঙ্কর আর অমিতাভর ঘরের পাশে একটা বসবার ঘর আছে লাউঞ্জের মত, সেখানে অনেক চেয়ার পাতা। দীপঙ্করের আনা মহার্ঘ্য হুইস্কি আর জিন যে যার মতো নিয়ে জমিয়ে বসলাম আমরা।
আমাদের মধ্যে দীপঙ্কর সেই কলেজ জীবন থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভক্ত। খুব কম বয়েস থেকেই নানা সঙ্গীত সন্মেলন এর টিকিট কেটে রাত জেগে সে বিখ্যাত নানা শিল্পীর অনুষ্ঠান শুনতো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে তার একটা স্বাভাবিক আর সহজাত ভাল লাগা ছিল। তার ওপরে সে বেশ কিছু বছর ধরে নানা জায়গা থেকে অনেক দুষ্প্রাপ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরনো রেকর্ড আর সি ডির collection করে আসছে। এই সব দুষ্প্রাপ্য গান শুনতে তার বাড়ীতে নানা গুনীজনের আগমন হয়।
হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রাগ রাগিনী ও নানা ঘরানার শিল্পীদের নিয়ে তার অপরিমিত পড়াশোনা আর জ্ঞান। আমাদের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় তার উত্তেজনা দেখে আমরা যারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তেমন বুঝিনা, তারাও বুঝি যে ব্যাপারটা তার কাছে একটা গভীর প্রেমের মত, একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু মুস্কিল হলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে একটা নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে, তার বাইরে যাওয়া নিয়ে দীপঙ্করের প্রবল আপত্তি। এ ব্যাপারে সে কঠোর ভাবে রক্ষণশীল। তাই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তার নানা অভিযোগ, এমন কি সে রবীন্দ্রনাথকেও পছন্দ করেনা, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাবার কথা উঠলে সে অবজ্ঞা করে বলে তোমরা যাও, আমার ওখানে যাবার কোন ইচ্ছে নেই।
এদিকে সুপ্রিয়া আবার রবীন্দ্রনাথের গানে একেবার যাকে বলে নিমজ্জিত। মুম্বাই তে তার বাড়ীতে সে রবীন্দ্রনাথের গান শেখানোর স্কুল খুলেছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও তার যথেষ্ট তালিম আছে। গানের ভাব প্রকাশের জন্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শৃঙ্খলার সামন্য একটু এদিক ওদিক হলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়, এই নিয়ে দীপঙ্করের সাথে তার তর্ক শুরু হয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন রাগাশ্রিত গানে কঠোর রাগের আধার কে মুখ্য করে তোলেননি। গানের কথার চারিপাশে তিনি উন্মুক্ত রেখেছেন সুরের প্রবাহ, রাগের মূল মেজাজ ও লয় বজায় রেখে তিনি কাঠামোগত বন্ধন থেকে তাঁর গানগুলিকে মুক্তি দিয়েছেন।
আমরা বাকিরা এই তর্কে যোগ দিইনা, তবে সাধারণ ভাবে যেহেতু আমরাও সুপ্রিয়ার মত রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালবাসি এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আমাদের তেমন জ্ঞান বা উৎসাহ নেই, তাই আমরা এই তর্কে মনে মনে সুপ্রিয়ার পক্ষেই থাকি।
বেশ কিছুক্ষণ তর্ক চলার পরে শেষে আমরা সুপ্রিয়া কে গান গাইতে অনুরোধ করলাম। সে আমাদের অনুরোধে দুটি গান গাইলো~
“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা”, আর “বাজিল কাহার বীণা”।
বড় ভাল গায় সুপ্রিয়া। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম।
আমার জীবনে “আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা” গানটার একটা বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৪ সালে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সুভদ্রার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্ত্তা চলছে। তো একদিন আমরা বেশ কয়েকজন জানুয়ারী মাসের এক বিকেলে গেছি ওদের সাঁতরাগাছির বাড়ীতে, কনে দেখা আর জামাই দেখা দুটোই একসাথে হবে।
আমার মা’র অনুরোধে সেদিন সুভদ্রা আমাদের ওই গানটা খুব সপ্রতিভ ভাবে গেয়ে শুনিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্য্যায়ের ওই ছোট গানটিতে প্রতিটি ছত্রে ভালবাসার কথা।
আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয়/
বড় উতলা আজ পরাণ আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও?/
অনাত্মীয় অল্পবয়েসী একটি সুন্দরী মেয়ে আমার মত একজন অচেনা ছেলে কে একঘর লোকের সামনে প্রেম নিবেদন করবে তা তো হতে পারেনা। আমি অত নির্বোধ ও ছিলাম না যে তা ভাববো। কিন্তু আমি নিজেকেই কিছুটা অবাক করে দিয়ে সুভদ্রার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে একটি ছোট প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলাম।
গোপন কথাটি রবে না গোপনে/ উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে/
হয়তো আমি সেই অচেনা সুন্দরী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম “হ্যাঁ, আমি খেলায় হার মানতে রাজী, যদি তুমি আমার সাথে খেলতে রাজী থাকো।”
আমরা দু’জনেই রবীন্দ্রনাথের গান ভালবেসে শুনতাম। কবি তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই আমাদের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন।
সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কিন্তু সেই বিকেলটার স্মৃতি আমার মনে এখনো অমলিন। বিশেষ করে এই গানটা যখন যেখানেই শুনি, মনে মনে চলে যাই সেই পঞ্চাশ বছর আগের এক শীতের বিকেলে একটি অচেনা সুন্দরী মেয়ের গান শুনে তাকে ভাল লাগার দিনে।
সুপ্রিয়াকে পরে সেই কথা জানিয়ে ঐ গানটি সেদিন গাইবার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।


মোতিঝিল
দ্বিতীয় দিন – ১৩/১২/২০২৩
১) কাঠগোলা
আজকে সকালে সবাই তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে এলাম। আজ প্রাতরাশে প্রথমে ফলের রস, তার পরে লুচি হালুয়া তরকারী। সাথে টোস্ট ডিম, চা কফি।
শেফ ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির করছেন, লাঞ্চে কি খাবেন, ডিনারে কি খাবেন সব জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন আগে থেকেই। আমরা যখন খেতে বসি তিনি নিজে এসে তত্ত্বাবধান করে যান। রাজবাড়ীতে এই ক’দিন বেশ রাজার হালেই থাকা যাবে মনে হচ্ছে।
আজ আমাদের প্রথম স্টপ হলো কাঠগোলা। এটা এক পুরনো দিনের রাজস্থানী ব্যবসায়ী পরিবারের বাগানবাড়ী। গেট দিয়ে ঢুকে একটি অল্পবয়েসী ছেলেকে আমাদের গাইড হিসেবে পেলাম। তার বিশেষত্ব হলো সে একজন স্বভাব কবি, অধিকাংশ সময়ে সে আমাদের সাথে কবিতায় কথা বলছিল।
মোগল আমলে রাজস্থান থেকে আসা জৈন ব্যবসায়ীদের আনাগোনা এখানে বাড়তে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিচিত নাম অবশ্যই জগৎ শেঠ। নবাব এবং ইংরেজদের দু’ দিকের সাথেই এদের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল, তাদের তাঁরা চড়া শুদে টাকা ধার দিতেন। ব্যবসা করে এদের এত বাড়বাড়ন্ত হয়েছিলে, যে শোনা যায় এঁদের ধন সম্পত্তি নাকি আজকের আদানী আম্বানীর থেকেও অনেক গুণ বেশী ছিল।
কাঠগোলা বাগান বা কাঠগোলা প্রাসাদ তার কালো গোলাপ এর বাগান আর আদিনাথের (জৈনধর্মের আদিপুরুষ) মন্দিরের জন্যে বিখ্যাত। পঞ্চাশ বিঘা জুড়ে এক বিশাল জমির ওপর এই বাগান বিস্তৃত। কালো গোলাপ অবশ্য এখন আর নেই, কিন্তু সেখানে আজ এক বিশাল আমবাগান। কথিত আছে এই কাঠগোলা বাগান আর প্রাসাদ তৈরী করেন লক্ষীপত সিং দুগার। আজ কাঠগোলার এই বাগানটি মুর্শিদাবাদের পর্য্যটকদের জন্যে একটি অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনস্থল। বাগানের চার কোণে চারটি অশ্বারোহীর সাদা মার্বেলের স্ট্যাচু। শোনা গেল তারা হলেন সেই দুগার পরিবারের চার ভাই।
কাঠগোলা নাম কেন? আমাদের গাইডের কাছে শুনলাম দুগার দের নাকি বিশাল কাঠের ব্যবসা ছিল, সেখান থেকেই ওই নাম।
গেট দিয়ে ঢুকে সামনেই একটা বিশাল টলটলে জলের বিশাল পুকুর, কিছু লোক ঘাটে দাঁড়িয়ে জলে খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর জলের মধ্যে অনেক রঙ্গীন মাছ খলবল করে জলে ঢেউ তুলছে। পুকুরের চার দিকে ঘাটের সিঁড়ি জলে নেমে গেছে, বেশ কিছু রাজহাঁস সেখানে ব্যস্ত ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কাঠগোলার দুগার দের সাথে জগৎ শেঠের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। আমাদের গাইড রাস্তার পাশে একটি সুড়ঙ্গ দেখালো, সেখানে সিঁড়ি নেমে গেছে এবং নীচে জল দেখা যায়। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি এই বাড়ীর সাথে জগৎ শেঠের বাড়ীতে মাটির তলা দিয়ে জলপথে যোগাযোগ ছিল। গোপন নথিপত্র সরকারী নজর এড়িয়ে নাকি এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নৌকা করে বা অন্য কোন উপায়ে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হত।
পথচারীদের সেই সুড়ঙ্গের কাছে না আসার জন্যে বলা হত এখানে মেয়েরা স্নান করছে, একটু দূরত্ব রেখে হাঁটুন। আমাদের গাইড কবিতায় বুঝিয়ে বললো – “মেয়েরা হেথায় করিতেছে স্নান, আপনারা দয়া করে দূর দিয়ে যান্!”
আর একটু এগিয়ে গেলে দুগার পরিবারের একটা বিরাট প্রাসাদ, আর পাশে ফুলের বাগান। এখানে নাকি রঙ্গীন মাছগুলো মারা গেলে তাদের যত্ন করে মাটির তলায় কবর দেওয়া হত। আমাদের গাইড বললো – “দ্যাখো মাছেদের কি কদর, মাটির নীচে তাদের কবর!”
প্রাসাদ ছেড়ে এগিয়ে গেলে একটা চাঁপা গাছ, তার গুঁড়ির একটা দিক বেশ কিছুটা ভেঙ্গে ফাঁক হয়ে গেছে, আমাদের কবি গাইড এর ভাষায় “গাছটি চাঁপা, পিছনটা ফাঁপা”।
বাগানের পাশে একটু দূরে দেখলাম একটা ধবধবে সাদা মার্বেলের তৈরী মন্দির। এই হলো সেই কাঠগোলার বিখ্যাত পরশনাথের মন্দির। তার সামনে ফুলের বাগান। গাইডের কাজ শেষ, সে এবার ফিরে যাবে।
সে আমাদের বিদায় জানিয়ে বললো – “সামনে বাগান, আমি যাই, আপনারা আগান!”
২) জগৎ শেঠের বাড়ী – নসীপুর
কাঠগোলার পরে আমাদের গন্তব্য জগৎ শেঠের বাড়ী।
স্কুলে থাকতে ইতিহাস পড়ে আমার ধারণা ছিল যে জগৎ শেঠ একজন ধনী ব্যবসায়ীর নাম। আমি মনে মনে তাঁর চেহারা ও কল্পনা করতাম বিশাল বপু, বিশাল গোঁফ, কিছুটা আমাদের বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের মত।
পরে জানলাম জগৎ শেঠ আসলে একজন বিশেষ কারুর নাম নয়, ওটা একটা পারিবারিক উপাধি। এই উপাধির মানে তারা হল জগতের অর্থাৎ সারা পৃথিবীর মালিক।
এই পরিবারের আদিপুরুষের নাম মাণিক চাঁদ। তিনি ব্যবসার সুত্রে ১৭০০ সালে প্রথম পাটনা থেকে ঢাকা আসেন। মাণিকচাঁদের নিজের সন্তান ছিলনা, ১৭১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পালিত পুত্র ফতেচাঁদ শেঠ পরিবারের ব্যবসার উত্তরাধিকারী হন্ এবং তাঁর সময়ে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। ১৭২৩ সালে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ার ফতেচাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি দেন। এরপর থেকে ফতেচাঁদের পুরো পরিবার জগৎ শেঠ পরিবার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তার সময়েই শেঠ পরিবারের যশ-প্রতিপত্তি চূড়ায় পৌঁছয়।
জগৎ শেঠের বিলাসবহুল বাড়ী এখন একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। বাড়ীর পাশে একটি বড় সাদা রং এর জৈন মন্দির। টিকিট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।
বাড়ীর ভিতরে ঢুকে মিউজিয়াম, শেঠদের নানা ব্যক্তিগত সংগ্রহ সেখানে রাখা। টাকশালে তৈরী সোনা আর রূপোর মুদ্রা। মুর্শিদাবাদের সিল্ক আর ঢাকাই মসলিন শাড়ী। এছাড়া কিছু প্রাকৃতিক সৃষ্টি, যেমন ফসিল ও উল্কা পাথর। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য অয়েল পেন্টিং দেয়ালে টাঙানো। মূল্যবান আসবাব পত্র, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছাপ মারা লোহার চেয়ার। অস্ত্র শস্ত্র রাখার গুপ্ত ঘর মাটির ২০ ফিট তলায়।
আর মাটির তলায় সেই গুপ্ত সুড়ঙ্গ – যার অন্য দিকটা আমরা একটু আগে দেখে এসেছি কাঠগোলায়।
সব মিলিয়ে জগৎ শেঠের বাড়ীর ভিতরে ঢুকে খুব একটা আহামরি কিছু লাগলোনা আমাদের কাছে। বেশ এলোমেলো ভাবে জিনিষপত্র রাখা, কিছু মরচে পড়া কোম্পানীর আমলের কিছু মরচে পড়া লোহার চেয়ার রাখা আছে ঘরের এক কোণে। দেয়ালে রং ও করা হয়নি বহুদিন। যত বৈভব আশা করেছিলাম, তত কিছু চোখে পড়লোনা।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনকুবের, যার কাছে আজকের আদানী, আমবানী, বিল গেটস, এয়ন মাস্ক, জেফ বেজোস সবাই শিশু, তার বাড়ী দেখে বেশ আশাভঙ্গই হয়েছিল সেদিন আমাদের।
প্রবীর অমিতাভকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, জগুদা’ দের এত টাকা কি করে হলো রে?”
আসলে আমি আর প্রবীর হলাম ইঞ্জিনীয়ার, লোহা লক্কড় যন্ত্রপাতি নিয়ে আমাদের কাজ, ওদিকে অমিতাভ আর দীপঙ্কর হলো ফাইন্যান্সের লোক, টাকা জমানোর ব্যাপারটা ওরা ভাল জানবে।
দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, টাকা রোজগার করার অনেক ফন্দী ফিকির আছে, সে সব জানতে গেলে আগে টাকা ভালবাসতে হবে, টাকা অন্ত প্রাণ হতে হবে। ক্ষমতাশালী রাজাদের (আজকের দিনে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের) সাথে যোগাযোগ আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী করা হলো সবচেয়ে জরুরী। রাজনৈতিক ক্ষমতা আর ব্যবসা – power and business – এই দুইয়ের সম্পর্কের নাম হলো Crony capitalism, ব্যাপারটা আগেও ছিল, এখনো আছে। জগু দা’রা এই ব্যাপারটা খুব ভাল জানতেন। ”
অমিতাভ তার সাথে যোগ করে বললো, “অবশ্য টাকা থাকলেই জীবনটা সুখের হবে তার কোন মানে নেই। না হলে এই জগৎ শেঠের পরিবারে এত সৈন্য সামন্ত, এত অস্ত্রশস্ত্র কেন দরকার হতো?”
আমি বললাম “ওরা হলো গিয়ে ভাগ্যলক্ষীর বরপুত্র। সেই Abba র গানটা মনে আছে তো? It’s a rich man’s world?”
Money, money, money, must be funny, in the rich man’s world/
Money, money, money, always sunny, in the rich man’s world/






৩) হাজারদুয়ারী
হাজারদুয়ারী মুর্শিদাবাদের অন্যতম দর্শনীয় জায়গা। বাস্তবিক হাজারদুয়ারী আর মুর্শিদাবাদ দুটো কথা প্রায় সমার্থক। আমরা যে ট্রেনে এসেছি তার নাম ও ছিল হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস। সুতরাং মুর্শিদাবাদ এলে হাজারদুয়ারী তো দেখতেই হবে।
জগৎ শেঠের বাড়ীর পরে আমরা গেলাম হাজারদুয়ারী দেখতে। কাছেই, গাড়ীতে মিনিট দশেক লাগলো। যখন পৌঁছলাম তখন বেলা হয়েছে, মাথার ওপরে সূর্য্য, বেশ গরম।
গঙ্গার ধারে একটা বিশাল জায়গা নিয়ে হাজারদুয়ারী প্রাসাদ আর ইমামবাড়া।
গেটের সামনে সরু রাস্তায় ময়লা ছড়ানো, বিক্ষিপ্ত ভীড়, ঘোড়ার গাড়ী। পুরো পরিবেশেই কেমন যেন একটা অবক্ষয় আর অযত্নের মলিন ছাপ। যাই হোক, গেট দিয়ে ঢুকে টিকিট কাটার পরে আমরা একজন গাইডকে নিলাম। সুজাতা আমাদের খরচের হিসাব রাখছে। পরে হিসেব করে ভাগাভাগি করে নেবো আমরা।
একটা গাছের ছায়ায় বসে আমাদের গাইড তার লেকচার শুরু করলো।
১৭৫৬ সালে আলীবর্দ্দী খাঁর মৃত্যুর পরে বাংলার নবাব হন্ তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা।
মাত্র তেইশ বছর বয়েসে সিরাজ যখন বাংলার নবাব হন্ তখন উড়িষ্যা আর বিহারের অনেকটাই আলীবর্দ্দী হারিয়েছেন মারাঠাদের সাথে চুক্তির জন্যে । সিরাজ মুর্শিদকুলী খাঁ বা আলীবর্দ্দী খাঁর মত বিচক্ষণ ছিলেননা, নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতাও তাঁর ছিলনা। কম বয়েস হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, এবং তাঁর অত্যাচারে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর চারিদিকে বহু শত্রু এবং অনেক মসনদ দখল করার দাবীদার জড়ো হয়ে যায়। তার ওপরে ঐতিহাসিকেরা সিরাজকে একজন নির্বোধ, এবং লম্পট মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দীর্ঘদিন রাজত্ব শাসন করার সুযোগ সিরাজ পান্নি। শেষে মাত্র এক বছর রাজত্বের পরে ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে পলাশীর যুদ্ধে প্রধানতঃ তাঁর নিজের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যু হয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নাটকে গানে গল্পে কবিতায় বার বার কিন্তু একজন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে উঠে এসেছে সিরাজের নাম। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সিরাজ ব্রিটিশ বিরোধী এই ভাগ্য বিড়ম্বিত নায়কের প্রতি একটা বড় অংশের বাঙালীর সহানুভূতি রয়েছে।
এই ভাল আর মন্দ দুই দিকের মধ্যে কোনটা ঠিক? সিরাজ কি নায়ক ছিলেন, না খলনায়ক?
গাইড ছেলেটির কাছ থেকে হাজারদুয়ারী এবং তার উলটো দিকে ইমামবাড়া নিয়ে কিছু তথ্য জানা গেল।
এই প্রাসাদে কি সত্যিই এক হাজারটি দরজা আছে? গাইড ছেলেটি বললো প্রাসাদটিতে মাত্র ১০০ টি বাস্তব দরজা রয়েছে আর বাকি ৯০০ টি নাকি নকল। ভাগীরথী নদীর তীরে কিলা নিজামত বা নিজামত কিলা ছিল মুর্শিদাবাদের পুরনো দুর্গের স্থান। এই প্রাসাদের নির্মানের জন্য দুর্গটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। জায়গাটি এখনো কিলা নিজামত নামে পরিচিত।
হাজারদুয়ারী প্রধানতঃ একটি জাদুঘর, সেখানে এ সযত্নে ধরে রাখা আছে স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ের অজস্র নিদর্শন। সেখানে কি কি দর্শনীয় জিনিষ আছে তা গাইড ছেলেটি আমাদের জানিয়ে দিল। একটা ছবি আছে, সামনে খাবারের থালা নিয়ে বসে একটি বিশাল মোটা লোক খাচ্ছে। সেই ছবিটা দেখতে ভুলবেন না, বললো সে।
গাইডের বক্তব্য শেষ হলে তার পাওনা মিটিয়ে আমরা টিকিট কেটে হাজারদুয়ারীর ভেতরে প্রবেশ করলাম।
এই প্রাসাদের মোট তিনটি তলা রয়েছে। আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। তৎকালীন নবাব দের ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র – আলীবর্দ্দী খাঁ এবং সিরাজের তরবারী এমন কি যে ছুরি দিয়ে মহম্মদী বেগ সিরাজ কে খুন করেছিলেন তা পর্য্যন্ত রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। এছাড়া আছে মার্বেল মূর্তি, চীনামাটির বাসন, ধাতব সামগ্রী, দুর্লভ বই, পাণ্ডুলিপি, পুরনো মানচিত্র, ভূমি রাজস্ব রেকর্ড। আছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার রূপোর সিংহাসন আর বিশাল ঝাড়বাতি। আর তিনতলায় আছে নবাব আমলের নানা নিদর্শন। সোনা দিয়ে মোড়া কোরাণ শরীফ, নানা অমূল্য পুঁথিপত্র, অসংখ্য বই, আবুল ফজলের আইনী আকবরীর পান্ডুলিপি, তাছাড়া নানা পুরাকীর্তি এবং আসবাবপত্রের বিশাল সংগ্রহ। দেশ বিদেশ থেকে সংগৃহীত নানা ধরণের ঘড়ি, রাফায়েল, ভ্যান ডাইক এবং অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের অয়েল পেন্টিং, শ্বেত পাথরের মূর্ত্তি, এবং আরও অনেক দর্শনীয় জিনিষ।
এ ছাড়া ৯০ ডিগ্রীতে একটি জোড়া আয়নার রাখা আছে । এই আয়নায় মানুষ তার নিজের মুখ দেখতে পারে না যদিও অন্যরা একই দেখতে পারে। এটি নবাব আক্রমণকারীদের দূরে রাখার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
একটা ফেলে আসা সময়কে ধরে রেখেছে হাজারদুয়ারী।




৪) ইমামবাড়া
হাজারদুয়ারীর ঠিক উল্টো দিকে এক বিশাল লম্বা প্রাসাদ। শুনলাম এটি হল শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ইমামবাড়া তার কাছেই আছে মদিনা মসজিদ। এটি শুধুমাত্র মহরমের সময় দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
ইমামবাড়ার সামনে একটি কামান, যার নাম বাচাওয়ালি টোপ, এটি তৈরি করেছিলেন মুর্শিদকুলী খান। কামানটি মুখ উঁচু করে একটি উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত। এই কামানটি নাকি ভাগীরথীর জলের তলায় ছিল, নদী সরে যাবার পরে এক উদ্ধার করে এখানে রাখা হয়।
ইমামবাড়ার স্থাপত্যও চোখে পড়ার মত, সামনে অসংখ্য স্তম্ভ, আর প্রবেশদ্বার হিসাবে একটি বিশাল গেট, যার নাম দক্ষিণ দরওয়াজা অন্য প্রান্তে যেখানে সিঁড়ি শুরু হয়, সেখানে দুটি ভিক্টোরিয়ান সিংহের মূর্তি রয়েছে। গাইডের মুখে শুনলাম মহরম উৎসবের সময় এখানে মেলা বসে, অনেক লোকজনের ভীড়ে জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে।
হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়ার চারিপাশে একটু ঘুরে বেড়ালাম আমরা। কাছেই দুটো বড় মসজিদ। চারিদিকে পর্য্যটকদের ভীড়, বেশ একটা উৎসবের বা মেলার মত পরিবেশ।
বেশ কিছু ছবি তোলা হলো।



৫) একটি আশ্চর্য্য স্বপ্ন
হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়া দেখার পরে আজ বিকেলে আর কোথাও যাবার নেই, হোটেলে ফিরে আমরা সোজা ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে গেলাম। আবার উপাদেয় সব পদ, শেষ পাতে মিষ্টি দই আর রাজভোগ। শেফ ভদ্রলোক আবার কাছে এসে রাত্রে কি খাবো জিজ্ঞেস করে গেলেন। এদের আতিথেয়তার কোন ত্রুটি নেই। আমরা রায় পরিবারের ছোটবাবু পল্লবের অতিথি। সুতরাং আমাদের দিকে তো নজর একটু বেশী হবেই।
দুপুরে একটু বিশ্রাম নেবার পরে সন্ধ্যায় আবার আড্ডা দেবো এই হলো আমাদের প্ল্যান। তো বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা রাখতেই গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলাম। আসলে রোদের মধ্যে অত হাঁটা, তারপরে জমিয়ে একটা লাঞ্চ। ঘুমের আর দোষ কি?
আর এই দু’দিন গাইডদের মুখে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের নানা আজব আজগুবি উদ্ভট গল্প মাথার মধ্যে গজগজ করছে, ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে আমি ফিরে গেলাম সোজা অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সেই স্বপ্নে আমি মোগল আমলের দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁ, সম্রাট আওরংজেব আমায় ডেকেছেন, আমি তার কাছে খাজনা নিয়ে দেখা করতে গেছি।
স্বপ্নে আমি সম্রাটের সাথে বেশ সুন্দর উর্দ্দু ভাষায় কথা বলে যাচ্ছি, কোন অসুবিধেই হচ্ছেনা, আওরংজেব আমার ওপর মোটের ওপর বেশ সদয় মনে হচ্ছে, বেটা বেটা বলে তিনি আমায় অনেক উপদেশ দিচ্ছেন।
তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পালঙ্কে বসে আছেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব, শণের মত সাদা চুল দাড়ি, শ্যেন দৃষ্টি, সারা মুখে অসংখ্য বলিরেখা। পরণে সাদা ঢোলা আলখাল্লা, পাজামা। গলায় মুক্তোর মালা, হাতের মুঠোয় তসবি। সামনে মেঝেতে জাজিম বিছানো, তার ওপর হাঁটু মুড়ে বসে আছি আমি, কারতলব খান।
আওরংজেব আমায় বললেন তোমায় দেখলে আমার সফির কথা মনে পড়ে। সে আমার আত্মীয় ছিল। সফি তোমায় আমার কাছে নিয়ে এসেছিল । সে যখন আমায় বলল তোমার আগের পরিচয়, তখন প্রথমে আমি একটু নারাজ ছিলাম। কারণ আমি হিন্দুদের তত বিশ্বাস করতামনা।
তুমি জন্মেছো এদেশের আদি ধর্ম্মের পরিবারে, সেই ধর্ম্ম জেনেছো, পড়েছো, এতে কোন কসুর নেই। ঘটনাক্রমে তার পরে দীক্ষিত হয়েছো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ন্ম ইসলামে। পড়েছো কোরান, হাদিস। এটা তোমার জীবনের পরম সৌভাগ্য। তুমি হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষের মন পড়তে পারো। ভাল মন্দ বুঝতে পারো, সবার প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারো।
তুমি হিন্দু ঘরের আউলাদ, এটা তোমার অতিরিক্ত সুবিধা, হিন্দুদের কাছে টানো। তারা সচরাচর বেইমানী করেনা, তাদের লালচ আর সাহস দুইই কম। কিন্তু তোমার মধ্যে আমি কূটনীতির অভাব লক্ষ্য করি।
পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজনীতির চাল দেওয়া, দরকারে দুশমনের গালে চুমু খাওয়া ধূর্ততা, শঠতা, লোক চেনার মত পরিপক্কতা এই সব তোমাকে আয়ত্ত্ব করতে হবে।
বেটা, আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি সবার ওপরে ইনসানিয়াত, মনুষ্যত্ব। সর্ব্বশক্তিমান আল্লা তাদেরই পাশে থাকেন যারা মানুষের পাশে থাকে। আল্লার কাছে দোয়া করি যেন তুমি শেষ দিন পর্য্যন্ত যে ধর্ম্মেরই মানুষ হোক, সাচ্চা ইনসানের পাশে যেন দাঁড়াতে পারো।
আমায় এই সব উপদেশ দিতে দিতে নৃশংস নিষ্ঠুর হিন্দু বিদ্বেষী সম্রাট আওরংজেব হঠাৎ যেন একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে গেলেন, তাঁর গলায় আমি পেলাম অনুতাপের আর আত্মধিক্কারের সুর। এ যেন এক অন্য আওরংজেব!
বেটা,আমি জীবনে যত অপরাধ করেছি, তার শেষ নেই, আমি জানি খোদাতালার কাছে তার ক্ষমা নেই। সেই পাপ এই মুলুক আমার তখত্ সব ধ্বংস করে দেবে। এ থেকে আমার রেহাই নেই বেটা।
কুর্সির লালচে আমি আব্বাজানকে বন্দী করেছি,অত্যাচার করেছি, নিজের ভাইদের একে একে নৃশংস ভাবে খতম করেছি। আমার হাত খুনে লাল হয়ে আছে। তখন আমার একটাই লক্ষ্য, সকলকে সরিয়ে আমিই হবো হিন্দুস্তানের মালিক। আলমগীর আওরংজেব। বাকি সবাই থাকবে আমার পায়ের তলায়। যে যখন আমার বিরোধিতা করেছে, তাকে আমি সরিয়ে দিয়েছি। আল্লার দরবারে এর কোন ক্ষমা নেই।
এদিকে আমি মনে মনে ভাবছি ব্যাপারটা কি, বাদশা একবার বলছেন ধূর্ত্ত হও, শঠ হও, নির্মম হও, আবার অন্যদিকে মানবতার বাণী শোনাচ্ছেন, আবার নিজের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা করছেন। এতো মরণকালে হরিনামের মত শোনাচ্ছে! দেরীতে বোধোদয়?
এই সব ভাবছি, এমন সময় সুভদ্রার ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলাম সন্ধ্যা হয়েছে, হোটেল থেকে ঘরে চা দিতে এসেছে, সাথে বিস্কুট। স্বপ্নের রেশটা কিন্তু রয়েই গেল মনের ভিতরে। ভাবছিলাম কে যে আমাদের মনের নানা চিন্তা আর কল্পনা মিশিয়ে এই সব আশ্চর্য্য বাস্তব স্বপ্ন তৈরী করে্ !
আমি সেই লোকটার নাম দিয়েছি স্বপ্নের জাদুকর।


৬) রাত্রের আড্ডা
আজকের আড্ডার বিষয় হলো কর্পোরেট জগতে প্রেম। দীপঙ্করের কর্পোরেট জগতের হোমরা চোমরা লোক – কানোরিয়া, বাজোরিয়া, গোয়েঙ্কা, বাঙ্গুর, আগরওয়াল দের সাথে খুব মেলামেশা, দহরম মহরম। তার স্টকে তাই তাদের নিয়ে অনেক গল্প। সেই সব গল্প আমাদের সে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে।
দীপঙ্করের সেদিন বলা দুটো গল্প এখনো মনে পড়ে।
প্রথম গল্প – দজ্জাল বৌ
একটা বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তাঁর সেক্রেটারী একটি কমবয়েসী মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছেন। অফিসে অনেক সিনিয়র ম্যানেজার দের দু’জনের এই পারস্পরিক ভাল লাগার ব্যাপারে কিছুটা আন্দাজ আছে, কিন্তু এই নিয়ে কেউ কিছু বলেনা, প্রাপ্তবয়স্ক দুই নারী ও পুরুষ তাদের সম্পর্ক কি ভাবে তৈরী করবে তাতে কার কি বলার আছে? তার ওপর চেয়ারম্যান বলে কথা।
তো একদিন সকালে চেয়রাম্যান ট্যুরে কলকাতার বাইরে গেছেন, তাই তাঁর অফিস প্রায় খালি। সেই সেক্রেটারী মহিলা আর কিছু অন্য মহিলা টাইপিস্ট নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছেন। বস্ নেই তাই কাজ ও নেই, বেশ একটা খুসীর আমেজ অফিসে।
এমন সময় রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ চেয়ারম্যানের স্ত্রীর প্রবেশ। তাঁকে ওই মেয়েরা সবাই চেনে, সবাই সন্মান জানিয়ে তাঁকে গুড মর্ণিং ম্যাডাম বলার আগেই মহিলা গিয়ে সেই সেক্রেটারী মেয়েটির কাছে গিয়ে তার চুল ধরে এক টান। আর এলোপাথাড়ি চড় চাপড় এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি।
তোর এত বড় আস্পর্দ্ধা, আমার বরের সাথে লুকিয়ে প্রেম করছিস, জানিস তোর কি ব্যবস্থা করবো আমি? আমায় তুই চিনিস না্…ইত্যাদি।
সেই সেক্রেটারী মেয়েটি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে সেও সহকর্ম্মীদের সামনে এই অপমান সহ্য করবে কেন, সেও সমান তালে মহিলার ওপরে চড়াও হলো। চেয়ারম্যানের দামী কার্পেটে ঢাকা অফিসে দুই বয়স্ক ভদ্রমহিলার মধ্যে শুরু হয়ে গেল চুলোচুলি।
সৌভাগ্য বশতঃ সেদিন ব্যাঙ্কের আরও দুই একজন উচ্চপদস্থ অফিসার সেদিন সেই অফিসে নিজেদের ঘরে ছিলেন, তাঁরা বাইরে বেরিয়ে এসে কোনমতে দুই মহিলাকে থামান।
দীপঙ্কর ওই ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টর ছিল, সে এই ঘটনার কথা শোনে কোম্পানীর সেক্রেটারীর কাছ থেকে। তিনি নাকি দীপঙ্কর কে বলেছিলেন মিস্টার চ্যাটার্জ্জি, আপনি একটু চেয়ারম্যান সাহেব কে বুঝিয়ে বলুন না।
আমি বললাম তুমি কি বুঝিয়ে বললে?
দীপঙ্কর বলল দূর, আমি কি বোঝাবো? শেষ পর্য্যন্ত ওই দজ্জাল বৌয়ের ভয়ে তিনি নিজে থেকেই সরে এসেছেন
দ্বিতীয় গল্প – কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে
একটি নামকরা এয়ার কন্ডিশনার কোম্পানীর মালিক এক মাড়োয়ারী, শিক্ষিত, সুদর্শন ভদ্রলোক, স্ত্রী আর দুই প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর সুখী পরিবার। এই কোম্পানীটা তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন।
তো এক দিন একটি অল্প বয়েসী মেয়ে তাঁকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিক্রী করতে আসে। কি যে ছিল সেই মেয়েটির মধ্যে কে জানে, ভদ্রলোক তার প্রেমে পড়ে গেলেন। তারপরে এই দু’জনের মধ্যে যে একটা অদ্ভুত,অবিশ্বাস্য, অসমবয়েসী সম্পর্ক তৈরী হল তা কেবল গল্প উপন্যাসেই সম্ভব।
শেষ পর্য্যন্ত ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স করে তাঁর পরিবার কে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির সাথে ঘর বাঁধলেন। তিনি তাঁর সম্পত্তির সিংহভাগ, তাঁর বাড়ী ঘর, এমনকি কোম্পানীর সব শেয়ার তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে উইল করেছিলেন, নিজেও কোম্পানী থেকে সরে এসেছিলেন।
দীপঙ্কর ছিল সেই কোম্পানীর অডিটর। ভদ্রলোকের অনুরোধে দীপঙ্কর তাঁর উইল এবং ডিভোর্সের কাজ কর্ম, সম্পত্তির ভাগ ইত্যাদি সব দেখা শোনা করেছিল।
কর্পোরেট জগতের পুরুষ ও নারীর নিষিদ্ধ সম্পর্কের এই দু’টি গল্প নিয়ে আমাদের অনেক তর্কের অবকাশ ছিল। প্রথম গল্পটি তো অনায়াসে “Me too” আন্দোলনের পর্য্যায়ে পড়বে। সেক্রেটারী মেয়েটির সাথে চেয়ারম্যানের এই সম্পর্ক কোন ভাবেই প্রেম বলে ধরা যায়না। এটা অবশ্যই পুরুষের ক্ষমতার অপব্যবহার। কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটি ঠিক সেই জাতের নয়। এই গল্পেও নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে, কিন্তু নারী পুরুষের গভীর প্রেমই হলো এই গল্পের প্রধান উপজীব্য। একজন পুরুষ একজন নারীকে ভালবেসে তাঁর সামাজিক সন্মান, প্রতিপত্তি, ধন, মান এমন কি নিজের স্ত্রী আর পরিবারকেও ছেড়ে যেতে পারেন?
এসেছো প্রেম, এসেছো আজ, কি মহা সমারোহে…
কিন্তু এর মধ্যেও মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার দেখবে আমার সন্দেহ নেই। তাদের সহানুভূতি থাকবে স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি। তাদের এই ভাবে ছেড়ে চলে যাবার কোন অজুহাতই তারা মেনে নেবেনা। দাম্পত্যে বিষ জমলেও দু’জন কে একসাথে থেকে যেতে হবে? আর ছাড়াছাড়ি হলেই ছেলেদের দোষ!
আমাদের চেনা জানা অনেক গুণী মানুষ বিবাহিত হয়েও নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য নারীর সাথে জীবন কাটিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন রবিশঙ্কর, সমরেশ বসু, সলিল চৌধুরীর মত সর্ব্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষেরা।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই তথাকথিত hegemonic toxic masculinity নিয়ে আমাদের বৌরা একটা আক্রমনাত্মক আলোচনা শুরু করার জন্যে মুখিয়ে ছিল, কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভাল যে তার আগেই নীচ থেকে একজন এসে বললো স্যার খেতে আসুন, ডিনার রেডি।



তৃতীয় এবং শেষ দিন – ১৪/১২/২০২৩
১) রাজবাড়ী ট্যুর
আজ আমাদের এখানে শেষ দিন।
পল্লব আজ সকালে আমাদের জন্যে কাশিমবাজারের রাজবাড়ীর একটা ট্যুরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ব্রেকফাস্টের পরে এক মহিলা আমাদের নিয়ে পুরো রাজবাড়ী ঘুরিয়ে দেখালেন, তার সাথে তিনি কাশিমপুরের রাজপরিবারের এবং রাজবাড়ীর ইতিহাস নিয়ে ও অনেক তথ্য জানালেন আমাদের।
আমরা জানলাম ১৭৪০ খৃস্টাব্দে পেশায় ব্যবসায়ী দীনবন্ধু রায় এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করেন। পরে ব্রিটিশ সরকার এই জমিদার পরিবারকে তাদের প্রজাকল্যাণ, ধর্ম্মনিরপেক্ষতা আর সুশাসনের পুরস্কার হিসেবে রাজা উপাধি দেন। ১৯৯০ এর দশকে পরিবারের উত্তরাধিকারীরা বাড়ির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বাড়ির কিছুটা অংশ নিয়ে অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে পরিবারেরই উদ্যোগে ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য চালু হয়েছে কাশিমবাজার রাজবাড়ী গেস্ট হাউস।
বিশাল জায়গা জুড়ে রাজবাড়ী। প্রথমে আমরা গেলাম বাড়ীর বাইরে চারিদিক টা দেখতে। প্রাসাদের সামনে সুন্দর সবুজ লন আছে, কিন্তু বাড়ীর পিছনে সেই তুলনায় বেশ অযত্নের ছাপ। একটা পুকুর পাশে বাঁধানো ঘাট, কিন্তু জল ময়লা, ব্যবহার করা হয় বলে মনে হলোনা। চারিদিকে ছাতিম, চাঁপা, এবং আরও অনেক বড় বড় গাছ। একটা সিমেন্টের টেনিস কোর্ট ও দেখলাম হইয়তো বহুদিন আগে সাহেবসুবোরা সেখানে খেলতেন, কিন্তু এখন আর কেউ খেলেনা, কোর্টময় ধূলো আর চারিদিকে শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। রাজবাড়ীকে ফাইভ স্টার ডি লুক্স হোটেল করতে গেলে পল্লবদের এখনো অনেক টাকা ঢালতে হবে।
বাড়ীর অন্দরমহলটা কিন্তু সুন্দর, পরিস্কার, সাজানো গোছানো। বৈভবের চিহ্ন চারিদিকে। এক তলার সুদৃশ্য হলঘরে ঝকঝকে পরিস্কার মার্বেলের মেঝে। চারিপাশের দেয়ালে সাজানো নানা মূল্যবান কাঁচের, রুপোর, হাতির দাঁতের তৈরী ঘর সাজাবার সামগ্রী, আর ফ্রেমে বাঁধানো অনেক পুরনো পারিবারিক ছবি। হলঘরে বসার জন্যে দামী এবং আরামদায়ক সোফা, আর মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়লন্ঠন। একটা প্রাচীন পাল্কীও রাখা আছে দেখলাম এক জায়গায়, কবে সেটা শেষ ব্যবহার করা হয়েছিল, এবং কি উপলক্ষ্যে, কে জানে?
রাধা গোবিন্দ মন্দির, নাটমন্দির, ভোগের ঘর, দালান ও গর্ভগৃহ দেখে আমরা এগোলাম চন্ডীমণ্ডপের দিকে। এই চন্ডীমণ্ডপেই খুব ধূমধাম করে দূর্গা পূজো হয়, কলকাতা থেকে রায় পরিবারের সবাই আসেন। দূর্গা দালানে অনেক গান বাজনা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
আমাদের রাজবাড়ীর ট্যুর শেষ হলো বেলা দশটা নাগাদ।
সন্ধ্যায় আমাদের ফেরার ট্রেণ, দিনের অনেকটাই বাকি আছে, দুটো গাড়ীও আছে, সাথে, তাই কোথাও ঘুরে এলে কেমন হয়?
মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি দেখার মত অনেক ঐতিহাসিক জায়গা আছে, রয়েছে প্রচুর মন্দির, যার অধিকাংশই বেশ কয়েক শতাব্দী পুরনো। কাশিমবাজারে মোগলদের আমলে ব্রিটিশ আর ডাচরা এখানে নদীর ধারে কুঠি (warehouse) বানিয়ে থাকতো, এখানে তাদের কবরখানা দেখতে অনেকে আসে। । বহু প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্রিটিশ এবং ডাচ ব্যক্তিত্বের শেষ শয়নভূমি এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই।
তাছাড়া আছে ১৭৫০ ক্রিস্টাব্দ নাগাদ স্থাপিত নাটোরের রানী ভবানীর টেরাকোটার মন্দিরগুলি। কিরিটেশ্বড়ী কালী মন্দির, যা কালী পিঠগুলির মধ্যে অন্যতম। খোশবাগে আছে সিরাজউদ্দৌলা এবং তার পরিবারের কবরগুলি।
সময় থাকলে পলাশীতেও হয়তো যাওয়া যেতো্ কিন্তু শুনলাম সেখানে ধূ ধূ করছে ফাঁকা মাঠ, তার মধ্যে একটা জায়গায় লাঠির ওপরে একটা বোর্ড টাঙানো আছে, তাতে লেখা “এই স্থানে ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর যুদ্ধ হইয়াছিল।”
সেই বোর্ড দেখার জন্যে দেড় ঘণ্টা গাড়ী চালিয়ে যাবার কোন মানে হয়না।
আমাদের হাতে সময় নেই তাই এত সব জায়গা দেখে আসা সম্ভব হবেনা। এই বয়সে এত ছোটাছুটিও করা মুস্কিল।
অমিতাভ বললো গাড়ী নিয়ে গঙ্গার ব্রীজ পেরিয়ে আজিমগঞ্জ যাওয়া যেতে পারে, লাঞ্চের মধ্যে ফিরে আসা যাবে। সেখানে নাকি বড়াকোঠি বলে ভাগীরথীর তীরে একটা বড় নিরামিষ হোটেল আছে, খুব দামী, প্রতি রাতে এক ঘরের ভাড়া প্রায় ৩০,০০০ টাকা, সেখানে শুধু খুব বড়লোক মাড়োয়ারীরাই গিয়ে থাকে।
তারপরে আজিমগঞ্জ থেকে ফিরে দুপুরে লাঞ্চের পরে একটু হোটেলে বসে প্যাকিং সেরে বিল মিটিয়ে বিকেলের দিকে স্টেশন চলে যাবো।




২) আজিমগঞ্জ
দু’টো গাড়ী নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আজিমগঞ্জের দিকে। সামনের গাড়ীতে ড্রাইভারের পাশে সামনে আমি, পিছনে দীপঙ্কর প্রবীর আর অমিতাভ, পিছনের গাড়ীতে মেয়েরা।
মুর্শিদাবাদ আর বহরমপুর পাশাপাশি শহর। বহরমপুর এখন মুর্শিদাবাদ জেলার প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার, প্রধানতঃ কাঁসা আর পেতলের বাসনের জন্যে জায়গাটা বিখ্যাত, তা ছাড়া শোলা, সিল্ক, হাতির দাঁত ইত্যাদি নিয়েও এখানে অনেক কুটির শিল্পের দোকান দেখা যায়, রাস্তায় বেশ ভীড়, দুই পাশে প্রচুর দোকানপাট। তাছাড়া অবশ্যই আছে এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি ছানাবড়ার দোকান।
একটু পরেই এসে গেল ভাগীরথীর ওপরে ব্রীজ। এবং তার পরেই দীপঙ্করের ফোন বেজে উঠলো, ক্রিং ক্রিং!
বাইরে বেড়াতে এলেও দীপঙ্কর তার অফিসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, মাঝে মাঝেই তার কাছে নানা কাজের ফোন আসে, এবং সে তার কর্ম্মচারীদের নানা রকম নির্দেশ দিয়ে আবার আমাদের আড্ডায় ফিরে আসে।
আজ তাকে ফোন করছে তার সেক্রেটারী। আমরা শুনেছি মেয়েটি খুব কাজের, দীপঙ্কর তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অফিসের বাইরে থাকলে তার সাথে ফোনে কথা বলতে দীপঙ্করের বেশ ভালোই লাগে।
যাই হোক, ওদিক থেকে মেয়েটি কি বলছে শোনা না গেলেও দীপঙ্করের কথা শুনে বুঝলাম যে হায়দ্রাবাদে কিছুদিন পরে তাকে একটা কোম্পানীর বোর্ড মিটিং এ যেতে হবে, তাঁর সাথে কলকাতা থেকে যাবেন আর এক ভদ্রলোক। মিটিংটা বিকেলে হবার কথা কিন্তু দীপঙ্করের অন্য একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় সে মিটিংটা পরের দিন সকালে করতে চায়। কিন্তু এই বদল করাটা সোজা কাজ নয়।
প্রথমতঃ সেই কোম্পানী কে রাজী করাতে হবে, তারপর তারা রাজী হলে ওই অন্য ভদ্রলোক কে জানাতে হবে, তিনি রাজী হলে দু’জনের এয়ার টিকিট আর একটা রাত থাকার জন্যে হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে। ইত্যাদি।
এক বার ভাল করে বুঝিয়ে বললে এই সেক্রেটারী মেয়েটি এক এক করে গুছিয়ে এই সমস্ত কাজ করে ফেলতে পারে। কিন্তু দীপঙ্কর ফোনে তাকে কাজগুলো দিচ্ছে এক এক করে, মেয়েটি একটা কাজ শেষ করে ফোনে জানাচ্ছে, দীপঙ্কর তখন তাকে ফোনে পরের কাজটা বিশদ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ক্রিং ক্রিং… “কি কোম্পানী রাজী হলো? তাহলে এবার মিস্টার ভটচাজ্জি কে ফোন করে জানাও”।
ক্রিং ক্রিং…“মিস্টার ভটচাজ্জি রাজী? বেশ! এবার তুমি আমাদের বিজনেস ক্লাসে দুটো রিটার্ণ এয়ার টিকিটের বন্দোবস্ত করে ফেলো! পরের দিন সন্ধ্যায় ফিরবো! ”
ক্রিং ক্রিং…
এই ভাবে পাঁচ দশ মিনিট অন্তর অন্তর দীপঙ্করের ফোন আসতেই লাগলো। এক দিকের বাক্যালাপ শুনে বেশ সময়টা কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমরা আজিমগঞ্জ রেল স্টেশন পৌঁছে গেছি। স্টেশনের পরে একটা সরু রাস্তা তাতে বিস্তর যানবাহন চলাচল করছে। আমাদের বড় Innova SUV কোনমতে সেই রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে।
কিন্তু কোথায় বড়াকোঠি?
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জায়গাটা পাওয়া গেল। বাইরে থেকে দেখে বড়াকোঠির মাহাত্ম্য টের পাওয়া মুস্কিল। সাধারণ একাট বাড়ী, সামনে কোন বড় গেট নেই, বাগান নেই, শুধু একটা ছোট খোলা দরজা। গাড়ী পার্ক করার জন্যে একটা খোলা মাঠ সামনে, সেখানে গাড়ি রেখে আমরা সেই বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হোটেলে কোন ঘর খালি নেই, আমাদের ভিতরে ঢুকে দেখার আবেদন মঞ্জুর হলোনা। বড়াকোঠি আসা আমাদের বিফল ই হলো।
অবশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবেনা। বড়াকোঠি একেবারে নদীর ধারে, সেখানে অতিথিদের সকালের ব্রেকফাস্ট আর বিকেলের চা খাবার জন্যে অনেক টেবিল আর চেয়ার সাজানো আছে, সেখানে এই দুপুরে কেউ নেই, আমরা গিয়ে সেখান থেকে নদীর শোভা দেখলাম বসে বসে।
সেই গভীর স্রোতহীন শান্ত নদীর নীরবে বয়ে যাওয়া বড় সুন্দর দৃশ্য। নদীর জলে আকাশের ছায়া পড়েছে, দুই পারের ঘাটে অনেক মানুষ জনের জটলা, কিছু দোকান পাট, আর নদী পারাপার করছে অনেক নৌকা। কেউ মাল বোঝাই, কিছু নৌকায় অনেক মানুষ এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে।
যেন আবহমান কাল থেকে বয়ে যাচ্ছে এই নদী। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সে। আজিমগঞ্জে বড়াকোঠির পাশে ভাগীরথীর পারে বসে নদীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শহরের দিকে তাকিয়ে আমার মন চলে গেল সেই সব পুরনো দিনে।
আমি মনে মনে চলে গেলাম সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদাবাদে। মোগল সাম্রাজ্য ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে, মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার স্বাধীন নবাব, ইংরেজরা ক্রমশঃ মোগলদের সরিয়ে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করছে। ইংরেজদের কাছে বেঙ্গল প্রভিন্স হলো সোনার দেশ। মুর্শিদাবাদ ও তার নিকটবর্ত্তী শহর ও গঞ্জ থেকে তারা কিনে আনে আফিম, তামাক, নীল, সোরা, পাট, তুলো, রেশম থেকে খাদ্যশস্য মশলা ও নানাবিধ জিনিষ। সেই মালপত্র রাখা হয় নদীতীরবর্ত্তী কাশিমবাজার কুঠির গুদামঘরে।
ওদিকে হুগলী নদীর কাছে তিনটি গ্রাম ইজারা নিয়ে ইংরেজরা গড়ে তুলেছে এক নতুন শহর, তার নাম ক্যালকাটা। উদীয়মান সেই শহরে এসে বসতি স্থাপন করছে নানা জাতির ভাগ্যান্বেষী মানুষজন।
কাশিমবাজার এবং দেশের অন্যান্য শহর থেকে এই সব মজুত মাল যথেষ্ট পরিমাণ হলে তাদের ছোট বড় নানা নৌকায় নিয়ে যাওয়া হয় সেই নতুন শহর ক্যালকাটায়। তারপরে সেই সব মাল বোঝাই করা হয় জাহাজঘাটায় নোঙ্গর করে থাকা বিশাল বিশাল বাণিজ্যপোতে। তারা পাল তুলে রওনা হয়ে যায় সাত সমুদ্র পেরিয়ে ইংল্যান্ডের দিকে।
একসময় যিনি ছিলেন স্রেফ দেওয়ান কারতলব খান, সেই তিনিই এখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা সুবার দন্ড মুন্ডের কর্তা নবাব মুর্শিদকুলী খান। তাঁর কর্ম্মক্ষেত্র ছিল ছোট এক জনপদ মুকসুদাবাদ, এক পীরের নামে। সেই শহর এখন সুবা বাংলার রাজধানী – মুর্শিদাবাদ, তাঁর নামাঙ্কিত।
মুর্শিদকুলী খানের স্বপ্ন দিয়ে সাজানো এই শহর। নদীর পাড় দিয়ে পরের পর কেয়ারী করা ফুলের বাগিচা। ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলে আছে নানা জাতের জলযা্ন, ডিঙ্গি নৌকা থেকে বড় বড় বর্ণময় ময়ূরপঙ্খী, মকরমুখী সাগরদাঁড়ি বজরা । শহর জুড়ে অসংখ্য অট্টালিকা, মসজিদ, সুউচ্চ মিনার, গম্বুজ, আছে ত্রিশূল চিহ্নিত শিব মন্দিরও। আলোয় আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে।
গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা, কাবেরী যমুনা ওই/
বহিয়া চলেছে আগের মত, কইরে আগের মানুষ কই?/
আগের মানুষ নেই, সেই আগের বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী আলো ঝলমল মুর্শিদাবাদও কি আর আছে?
আজ সে ধূলিধূসরিত এক মলিন শহর, তার সারা গায়ে আজ অবক্ষয় আর দারিদ্র্যের চিহ্ন।




৩) ফেরা
আজমগঞ্জ থেকে কাশিমবাজারে ফিরে লাঞ্চ সেরে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে স্টেশনের দিকে এগোলাম। লালবাগের ব্যস্ত রাস্তায় তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে।
বিদায়, মুর্শিদাবাদ!

The last comment posted by me is now not seen anywhere. So, posting a comment afresh as below.
A good one as usual.
Enjoyed reading . We were in the same places last February. So many placer are fresh in our minds.
your descriptions are in much details. Clear that you have studied a lot on the subjects.
The imaginary dream scene was interesting.
a coincidence.
About 2/3 days before I read your blog, I suddenly remembered the company called TEXMACO. I was wondering if I am able to remember the name correctly. Then read in your blog on Texmaco.
LikeLike
Thanks Bappa. Yes I did read up a bit on the history. But I did prep up the blog with many personal anecdotes. The Tagore songs for instance and the corporate love affairs – they had nothing to do with history of Murshidabad.
LikeLike
Indra, I forgot to recognize, this again is a wonderful narrative, enriched by much history of the place.
Tomar hate jadu aachhe.
Sent from my iPhone
LikeLike
Thanks Subhash
LikeLike