টয়লেট টা কোনদিকে ভাই?

১) রাণীগঞ্জে আমার প্রথম চাকরী

১৯৬৮ সালে খড়্গপুর থেকে ইঞ্জীনিয়ারিং পাশ করার পরে আমি রাণীগঞ্জে বেঙ্গল পেপার মিলে বছর খানেক কাজ করেছিলাম। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম চাকরী। তখন আমার বাইশ বছর বয়েস।

বাবা মারা গেছেন তিন বছর আগে ১৯৬৫ সালে, তখন আমার খড়গপুরে থার্ড ইয়ার। তাঁর দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে মা’র প্রায় সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষিত। জমি বিক্রী করে প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ধার করে তিনি সেই খরচের ধাক্কা সামলেছেন। তার ওপরে ছিল আমার কলেজে টিউশন আর হোস্টেলে থাকার খরচ।  মা আমায় এই খরচ নিয়ে কিছু বুঝতে না দিলেও আমাদের আর্থিক অবস্থা যে বেশ শোচনীয় তা বোঝার মত বয়েস আমার হয়েছিল।

তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে একটা চাকরী পেয়ে উপার্জ্জন শুরু করে মা’র পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর ভার লাঘব করাই আমার তখন প্রধান কাজ। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতৃহীন, বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে – ভাল চাকরী পাবার জন্যে আমার কোন খুঁটির জোর ছিলনা। কেবল ছিল আমার আই আই টি খড়্গপুর থেকে পাওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা ডিগ্রী।

তার ওপর চাকরী পাবার পক্ষে ১৯৬৮ সালটা খুব একটা অনুকূল ছিলনা। 

১৯৬৬ সাল থেকে দেশের অর্থনীতি ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি সামলাতে টাকার মূল্য কমানো u হলো। এর মধ্যে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা ভোটে জিতে বাংলা কংগ্রেস এর সাথে যুক্তফ্রণ্ট তৈরী করে ক্ষমতায় এসেছে। অজয় মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু উপ মুখ্যমন্ত্রী।

বড় বড় সব কারখানা তে নানা দাবী দাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এক এক করে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার ওপরে নকশালবাড়ীতে কৃষক আন্দোলন নিয়ে মার্ক্সিস্ট কম্যুনিস্ট পার্টি দুই ভাগ হয়ে গেছে, মার্ক্সসিস্ট লেনিনিস্ট পার্টি নামে একটা নতুন রাজনৈতিক দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের পক্ষ নিয়ে চীনের মাও সে তুং এর   সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের আদর্শে কৃষিবিপ্লবের ডাক দিয়েছে। তার ওপর ভিয়েতনামের যুদ্ধ চলছে, আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে সবাই সোচ্চার।

কলকাতার রাস্তায় তখন এই ধরণের দেয়াল লিখন দেখা যায়।

“তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম”। “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”। “বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।” ইত্যাদি।  সারা দেশে একটা অশান্তি মারামারি খুনোখুনি আর নৈরাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমশঃ।  

যাই হোক, এর মধ্যেই ইন্টারভিউ দিয়ে আমরা দুই ক্লাসমেট রমাপদ ত্রিপাঠী আর  আমি  চাকরী নিয়ে রাণীগঞ্জে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। মাইনে মাত্র তিনশো টাকা ছিল। তার মানে আমরা দুজনেই সেভাবে টাকার কথা ভাবিনি। ওই অশান্ত সময়ে একটা চাকরী পেয়ে কাজ শেখাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে কাজের অভিজ্ঞতাটা দরকার, মাইনে কম হতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা অমূল্য।     

আমরা দু’জনেই কিছু দিনের মধ্যে চাকরী ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। সামান্য যা উপার্জ্জন করতাম সেটা বোধহয় নতুন কোন ভালো চাকরী খোঁজার পিছনেই খরচ হতো। তাছাড়া মাইনে থেকে কিছুটা হাত খরচ বাঁচতো, যেটা খড়গপুরে সেভাবে হাতে আসতোনা। 

রাণীগঞ্জের সেই দিন গুলো বেশ ছিল। বয়েস্ও কম ছিল, যতদিন ছিলাম, খুব উপভোগ করেছি।

বেশ ভাল একটা ফ্ল্যাট পেয়েছিলাম, চার বেলা মেসে খাবারের ব্যবস্থাও ছিল।  মিলের পাশেই দামোদর নদ, গরমে হাঁটু জল, নদীর ওপারে বাঁকুড়া জেলা, সেখান থেকে জলের মধ্যে দল বেঁধে হেঁটে শ্রমিকেরা কাজে আসে, বিকেলে বাড়ী যায়, সে এক সুন্দর দৃশ্য।

বেশ কিছু সমবয়েসী বন্ধূও জুটে গেছে, স্থানীয় ক্লাবে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলি, ফুটবলও পেটাই মাঝে মাঝে। নদীর ধারে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে সেখানে ঘুরে ঘুরে বেলুন ফাটাই, জিলিপি খাই। ক্লাবের লনে টেনিস খেলি। অনেকে মিলে উইকেন্ডে রাণীগঞ্জ শহরে গিয়ে সিনেমা দেখি, আসানসোলে গিয়ে রেস্টুরেন্টে বিয়ার খাই। পূজোর পর দুর্গাপুরে জলসা শুনতে গিয়েছিলাম এক দিন বাসের মাথায় চড়ে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনবো বলে। তাছাড়া ছিল কাছের গ্রামে যাত্রাপালা, আমার সেই প্রথম যাত্রা দেখা।

মামা মামীমা থাকতেন আসানসোলে, কোর্ট রোডে মামার বিশাল বাংলো। সেখানে  সুযোগ পেলেই চলে যেতাম। মামাতো মাসতুতো ভাই বোনদের সাথে খুব হুটোপাটি হতো। আম গাছে চড়তাম, তাছাড়া ছিল বারান্দায় বসে ক্যারম বা ব্যাডমিন্টন খেলা।

সব মিলিয়ে বেশ ছিল সেই রাণীগঞ্জের দিনগুলো আমার জন্যে।    

নোপুর গ্রাম

বেঙ্গল পেপার মিলে আমি কাজ শুরু করলাম ওয়ার্কশপে, সেখানে মিলের নানা মেশিন যেমন পাম্প ইত্যাদি বিকল হইয়ে গেলে সারানোর জন্যে আসে। সেখানে লেদ মিলিং প্লেনিং ইত্যাদি নানা মেশিন,  এবং বেশ কিছু ফিটার আর মেশিনিস্ট কাজ করে, এরা সবাই কাছাকাছি গ্রামের ছেলে। রমাপদ কজ পেলো পাওয়ার প্ল্যাণ্টে, তার কাজ টার্ব্বাইন নিয়ে।

আমাদের ওয়ার্কশপের ম্যানেজার চৌধুরী সাহেব বেশ মাইডিয়ার লোক। আর যারা সেখানে কাজ করে তাদের কাছ থেকে কত নতুন কিছু জানা যায়, যা আমি কলেজে শিখিনি।  তাদের অনেকের সাথেই কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বেশ ভাব হয়ে গেল।  চৌধুরী সাহেবের ভাই মহাদেব চৌধুরী একজন সিনিয়র ফিটার, বয়স্ক এবং কাজের লোক, স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ সুঠাম শরীর, ফর্সা এক মাথা কালো চুল, চুপচাপ, অমায়িক, সবসময় তাঁর মুখে হাসি। কিন্তু ইদানীং তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে, নিয়মিত কাজে আসেননা, ক্রমশঃ বেশ রোগাও হয়ে যাচ্ছেন, চেহারায় একটা ক্লান্তির ভাব, চোখের তলায় কালি। 

ভাই কে নিয়ে চৌধুরী সাহেব বেশ চিন্তিত।  তিনি ভাইয়ের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করছেন।  মুস্কিল হলো চৌধুরী সাহেব থাকেন মিলের কলোনীতে তাঁর ম্যানেজারের বাংলোতে, আর তাঁর ভাই মহাদেব থাকেন কাছেই নোপুর নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে ভালো ডাক্তার বা হাসপাতাল নেই।

বেঙ্গল পেপার মিলের  ওয়ার্কশপে  কার্ত্তিক বারিক নামে একটি ছেলে ছিল, তার কাজ ছিল নানা দরকারী জিনিষ পত্র জোগাড় করার। খুব কাজের ছেলে ছিল কার্ত্তিক, আর খুব ফুর্ত্তিবাজ। আমার আর রমার সাথে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

তো একদিন কার্ত্তিক রমা আর আমায় নিয়ে একদিন সাইকেলে চেপে ওদের গ্রাম  (নোপুর) দেখাতে নিয়ে গেল। আমাদের মিল টা ছিল  রানীগঞ্জ থেকে কিছুটা দূরে বল্লভপুর নামে একটা জায়গায়, দামোদরের তীরে। সেখান থেকে নোপুর গ্রাম ক্রোশ খানেকের পথ, সাইকেলে যেতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে।  

আমাদের সাই্কেল ছিলোনা, কার্ত্তিক কোথা থেকে দু’টো সাইকেল জোগাড় করে নিয়ে আসে।  

পড়ন্ত বিকেলে আলপথে সাইকেলে চেপে  যেতে পাশে সবুজ ধানক্ষেত।  কার্ত্তিক আবার একটু কবিতাপ্রেমী, সে রবীন্দ্রনাথের “গগনে গরজে মেঘ” এর সাথে “রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা” এই লাইন দুটি নিয়ে তার আপত্তি ব্যক্ত করেছিল। ওর মতে আষাঢ় শ্রাবণে ধান কাটা হয়না। 

রমার সাথে (সেও গ্রামের না হলেও শহরতলী হাওড়ার ছেলে) তার এই নিয়ে সেদিন  তর্ক বেঁধে যায়। সেই তর্কে আমন আর আউষ ধানের কথা উঠে এসেছিল। আমি তো শহরের ছেলে, এ সব ব্যাপারে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত, আমি কোন তর্কের ভিতরে না গিয়ে চারিদিকের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মন দিচ্ছিলাম।

পরে শুনেছি কার্ত্তিকের কথাই ঠিক। আউষ ধান বর্ষাকালে ধানের চারা পোঁতা (রোপন)হয়, সেই ধান অগ্রহায়নে কাটা হয়। আর আমন ধান পোঁতা হয় শীতকালে, কাটা হয় চৈত্রে। বর্ষাকালে ধান কাটা নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল সোনার তরী কবিতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

নোপুর গ্রাম থেকে মিলে অনেকে কাজ করতে আসে, তাদের অনেকের বাড়ীতে কার্ত্তিক আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। মাটির বাড়ী, ধুলোর রাস্তা,  পানাপুকুর, নারকেল গাছের সারি, বাংলার  গ্রামের  সেই ধূলিমলিন  চেহারা এখনো বেশ মনে পড়ে। 

মহাদেবের বাড়ীতেও আমরা গিয়েছিলাম সেদিন। অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাদের পেয়ে মহাদেব খুব খুসী হয়েছিলেন মনে আছে। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মহাদেবকে দেখে সেদিন কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। কিন্তু মহাদেব নিজের শরীর খারাপ নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, “না না আমি তো ঠিক আছি, ও কিছু নয়”, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন “এরা আমার জন্যে অযথা চিন্তা করে।”

বাইরে বেরিয়ে কার্ত্তিক বেশ চিন্তিত মুখে আমাদের বলেছিল, “বৌদি বলছিলেন মহাদেবদা’ কে একবার বর্দ্ধমান জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। চৌধুরীবাবুর সাথে এই নিয়ে কথা বলতে হবে। উনি নিজের ভাইয়ের চিকিৎসার বন্দোবস্তর ভার নেবেন আমায় বলেছেন।”

তারপরে সেদিন কার্ত্তিক আমাদের তার বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। কার্ত্তিকের বাড়ীর সামনে বিশাল মাঠ, আর তাদের নিজেদের অনেক খেজুর গাছ। সেদিন কার্ত্তিক আমাদের জিরেন গাছের খেজুর রস খাইয়েছিল।

“আপনাদের জন্যে তিন দিন জিরেন রেখেছি” বলেছিল কার্ত্তিক।

আমার এখনো মনে আছে যে ঢকঢক করে সেই মিষ্টি রস বেশ কয়েক গেলাস খেয়ে ফেলে আমার বেশ একটু নেশা হয়েছিল, আমি কার্ত্তিক কে কিছুটা জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম “টয়লেট টা কোন দিকে ভাই?”

কার্ত্তিক কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “টয়লেট ? আপনার সামনে দিব্বি ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে…যেখানে ইচ্ছে চলে যান…”