Category Archives: নানা চরিত্র

অন্নপূর্ণা বাবু

তোমরা নিশ্চয় ভাবছো, অন্নপূর্ণা তো মেয়েদের নাম, তাহলে অন্নপূর্ণা বাবু আবার হয় কি করে? পরশুরামের চিকিৎসা সঙ্কটের সেই ডাক্তার বাবুর মতো তাহলে বলবো, “অয় অয়,  zaaন্‌তি পারোনা!”

মনোহরপুকুর রোড আর সতীশ মুখার্জ্জী রোডের মোড়ে একটা বাড়ির একতলায় পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে অন্নপূর্ণা স্টোর্স নামে একটা স্টেশনারীর দোকান খুলে বসেছিলেন এক ভদ্রলোক। এমন কিছু বড় বা আহামরি নয়, ছোট আর সাধারণ দোকান, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই দোকানটা আমাদের পাড়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

কাছাকাছির মধ্যে আর কোন ভালো স্টেশনারীর দোকান ছিলনা বলেই কিছুটা হয়তো, আর তাছাড়া সেই ভদ্রলোক এর মধ্যে ব্যবসা বুদ্ধি ও বেশ ভাল ছিল মনে হয়, কেননা প্রসাধনের জিনিষ যেমন সাবান, পাউডার, মাথায় মাখার তেল, খাবার  জিনিষ যেমন বিস্কুট, চা, পাঁউরুটি, স্টেশনারী items  যেমন খাতা, পেন্সিল, writing pad,  হার্ডওয়ার  items যেমন পেরেক, হাতুড়ি, টর্চ, ইত্যাদি, মোটমাট আমাদের দৈনিক জীবন যাপনের জন্যে সংসারে যা যা দরকার সবই ওনার দোকানে গেলেই আমরা চট করে পেয়ে যেতাম। কোন কিছু দরকার পড়লেই জ্যেঠিমা মা কাকীমারা বলতেন “অন্নপূর্ণা থেকে অমুক জিনিষ টা নিয়ে আয় তো?” 

ভদ্রলোকের নাম টা আমরা কেউ জানতাম না, পাড়ার সবার কাছে তিনি ছিলেন অন্নপূর্ণা বাবু। বেশ লম্বা ছিলেন, গায়ের রং ফর্সা, নাকের নীচে একটা হিটলারী গোঁফ, সবসময় একটা হাফ হাতা গেঞ্জী পরে থাকতেন। তাঁর figure টা ছিল কিছুটা পাশবালিশের খোলের মতো, বুক, পেট, কোমর, সব এক সাইজ। বেশ একটা নেয়াপাতি ভুঁড়িও ছিল তাঁর। আর প্রায় সব সময় তাঁর মুখে পান আর সুপুরী, তাই চিবোতে চিবোতে খদ্দের দের সাথে বেশ ভারিক্কী চালে কথা বলতেন অন্নপূর্ণা বাবু।

একাই দোকান আর খদ্দের সামলাতেন, যার যা দরকার ক্ষিপ্র হাতে তা বের করে দিয়ে পয়সা কড়ি বুঝে নিতেন। তাঁর কাজে খুব efficient   ছিলেন অন্নপূর্ণা বাবু। তাঁর একটা জিনিষ কেবল আমার ভালো লাগতো না, সেটা হলো ওই সর্ব্বক্ষণ গেঞ্জী পরে থাকা।  

 এ আবার কি অসভ্যতা?

তাঁর দোকানে পাড়ার অনেক সুন্দরী আর সম্ভ্রান্ত মহিলারা কেনাকাটা করতে আসতেন, তাদের সামনে এই গেঞ্জী পরে থাকাটা কি উচিত? কিন্তু এ ব্যাপারে  অন্নপূর্ণা বাবুর কোন হেলদোল ছিলনা।

আজকের এই  Online retail এর যুগে  Amazon Flipcart ইত্যাদি বড় বড় Retail chain আর Supermarket কোম্পানীরা তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্যে  নানা Web service আর Software tools ব্যবহার করছে।

খদ্দেরদের সাথে  পরিচয় বাড়াবার জন্যে তাদের আছে Customer relationship management (CRM) software..  আগের বার তুমি এটা কিনেছিলে, তার সাথে এবার এই জিনিষটা নিতে পারো। ভাল ডিসকাউন্ট পাওয়া যাচ্ছে।

তার ওপর তাদের আছে Demand forecasting আর  Supply Chain management এর জন্যে দরকারী software, যাতে যখন যা দরকার তা সবসময় হাতের কাছে মজুদ থাকে, খদ্দের যেন খালি হাতে কখনো ফিরে না যায়। .  

প্রযুক্তির ব্যবহার করে তারা তাদের Business volume,  scale আর  service এমন একটা উচ্চতায় ক্রমশঃ নিয়ে যাচ্ছে যে তাদের সাথে পাড়ার ছোট ছোট দোকানদারদের  মোকাবিলা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ।  এমন কি মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে তাদের পাড়ার দোকান এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

আমাদের ছোটবেলায় প্রযুক্তির এই উৎপাত শুরু হয়নি।  আমাদের অন্নপূর্ণাবাবুরও কখনো কোন SCM কিংবা CRM software এর দরকার পড়েনি, তিনি একাই দু’ হাতে সব সামলে নিতেন।  চমৎকার ব্যবসা চালাতেন তিনি,  খদ্দেররা সবাই খুসী, যে যা চায় সব হাতে হাতে পেয়ে যায়।  দামও গলাকাটা নয়।    

রমরম করে চলতো অন্নপূর্ণা স্টোর্স।

একবার বড়বাজারে কি একটা কাজে গেছি, সেখানে ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক, মুটের মাথায় অনেক মাল চাপিয়ে হাতে একটা ছাতা নিয়ে মুটের পিছন পিছন চলেছেন।  যাকে বলে Supply Chain Management at work in real time..

কিন্তু এনাকে তো ভীষণ চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি?

তারপর বুঝলাম, আরে ইনি তো আমাদের অন্নপূর্ণা বাবু!

বরাবর গেঞ্জী পরা অবস্থায় কাউন্টারের পিছনে তাঁর উপরের অর্দ্ধেক চেহারা টা দেখেছি। হঠাৎ সার্ট গায়ে ধুতি পরিহিত পুরো মানুষটা কে দেখলে চিনব কি করে?

চোখাচোখি হতে অন্নপূর্ণা বাবু আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর হিটলারী গোঁফের ফাঁক দিয়ে একটা চেনা হাসি হাসলেন। অর্থাৎ আমায় চিনেছেন ঠিক। যাকে বলে perfect Customer relationship management ।

বছর ত্রিশ দোকান টা বেশ ভালই চলেছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎ অন্নপূর্ণা বাবু দোকান তুলে দিয়ে কোথায় চলে গেলেন। জানিনা কেন, কি হয়েছিল। অন্নপূর্ণা বাবুর সাথে তারপর আর কোনদিন আমার দেখা হয়নি।

এখনও ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বাড়ীটা চোখে পড়লেই অন্নপূর্ণা বাবুর দোকান আর তার সাথে আমাদের ফেলে আসা হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

ফুটুবাবু

আমাদের ছোটবেলায় কর্পোরেশন থেকে আমাদের বাড়িতে রবিবার বা কোন ছুটির দিন সকালে এক ভদ্রলোক এসে হাজির হতেন বছরে দু’বার। একবার আমাদের বসন্তের টীকা আর একবার আমাদের TABC ইঞ্জেকশন দিতে। তাঁকে বেশ মনে পড়ে। মাথায় অল্প টাক, পরনে ধুতি পাঞ্জাবী, চোখে চশমা, হাতে একটা ব্যাগ, তার মধ্যে ইঞ্জেকশন এর এম্পুল, সিরিঞ্জ, টীকা দেবার নানা সরঞ্জাম। মুখে হাসি নেই, বেশ গম্ভীর, দেখলেই ভয় পাবার মতো চেহারা।

তিনি এলেই সারা বাড়ীতে বেশ একটা হুলুস্থূল পড়ে যেত। উনি বড় বারান্দার গোল টেবিলে ব্যাগ থেকে তাঁর জিনিষপত্র সব বের করে রাখতেন, আর আমরা সবাই এক এক করে লাইন দিয়ে টীকা বা ইঞ্জেকশন নিতাম।

টীকা টা একটা যন্ত্র দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাঁ হাতের মাঝখানে দেওয়া হতো। মাঝে মাঝে সেটা পেকে গিয়ে বেশ যন্ত্রণা হতো। আর TABC ইঞ্জেকশন এর পর হাতে যা প্রচন্ড ব্যথা হতো, অন্ততঃ দু দিন তার পর হাত তুলতে পারতামনা।

TABC র নাম আমরা দিয়েছিলাম “টাইফয়েড, আমাশা, বসন্ত, কলেরা।”

সেই পঞ্চাশের দশকে বসন্ত রোগ নির্মূল হয়নি, আর টাইফয়েডও বেশ কঠিন রোগ ছিল, সুতরাং খারাপ লাগলেও বা ভয় পেলেও আমাদের টীকা আর ইঞ্জেকশন নিতেই হতো, আপত্তি করার সুযোগ ছিলনা। জ্যেঠিমা, মা কাকীমারা ও নিতেন। বাবা কাকাদের নিতে দেখিনি, ওনারা ছুটির দিনে কেউ বাড়িতে থাকতেন না সকালে, সেই জন্যেই হয়তো।

তখন তো আজকের মতো AIDS এর প্রাদুর্ভাব হয়নি, ইঞ্জেকশনের ছুঁচ থেকে রোগের সংক্রমণ এর কথা তখন বোধ হয় কেউ ভাবতোনা, disposable syringe ও তখন চালু হয়নি। একটা কাপের মধ্যে গরম জল আর disinfectant spirit এ ছুঁচ ডুবিয়ে তুলো দিয়ে মুছে আবার পরের জনের ওপর ব্যবহার করা হতো।

এই ব্যবস্থা এখনো কলকাতায় চালু আছে কিনা জানিনা। হয়তো নেই। এখন বোধহয় ছেলেমেয়েরা immunization এর ইঞ্জেকশন নিতে  হাসপাতালে যায়।

পরে মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ির পাশে ডক্টর মৃণাল দত্ত তাঁর চেম্বার খোলেন। মৃণাল বাবুর কম্পাউন্ডার ছিল একটি বেঁটে খাটো লোক। সেই লোকটি দারুণ ভালো ইঞ্জেকশন দিতো, ইঞ্জেকশন দিয়ে সে পাড়ায়  এমন নাম করে ফেলেছিল যে পাড়ায় কারুর ইঞ্জেকশন দেবার দরকার পড়লেই তার ডাক পড়তো। আমাদের বাড়িতেও একে ওকে ইঞ্জেকশন দেবার জন্যে সে লোক টি প্রায়ই আসতো। 

তার আসল নাম টা আমরা কেউ জানতাম না, ভালোকাকীমা তার নাম দিয়েছিলেন “ফুটুবাবু”। শেষ পর্য্যন্ত আমাদের কাছে সে ফুটুবাবুই থেকে যায়।

একবার কাকে একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে, তাই আমাদের কাজের লোক সীতা কে পাঠানো হলো ডক্টর দত্তের চেম্বারে ফুটুবাবুকে ডেকে আনতে। সীতা সেখানে গিয়ে “ফুটুবাবুকে একবার আমাদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিও” বলাতে তাকে সবাই বলেছিল “এখানে ফুটুবাবু বলে কেউ নেই।” 

আজ এই অতিমারীর যুগে ফুটুবাবু থাকলে তাঁর যে খুব কদর হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। White Tiger উপন্যাসের সেই ড্রাইভার ছেলেটি যেরকম ড্রাইভারদের নিয়ে একটা বিশাল ব্যবসা শুরু করেছিল, সেরকম ফুটুবাবুও অনেক ছেলেমেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে তাঁর অফিসে নিয়ে ভ্যাক্সিনেশনের একটা বড় ব্যবসা শুরু করে দিতে পারতেন।

অতিমারীর কল্যাণে তাঁর ও জীবনের ভোল পালটে যেত।

জানিনা সেটা শেষ পর্য্যন্ত ঘটেছে কিনা।

মাখনবাবু 

আমাদের ছোট বেলায় মনোহরপুকুরের বাড়ী তে মাঝে মাঝে মাখনবাবু নামে এক ভদ্রলোক আসতেন। তাঁর ছিল গয়নার ব্যবসা, লেক মার্কেটের কাছে রাসবিহারী এভিনিউ এর ওপরে লক্ষ্মী জুয়েলার্স নামে তার একটা ছোট দোকান ও ছিল। 

মাখনবাবু মনোহরপুকুরের বড় বারান্দার গোল টেবিলে বসে তাঁর গয়নার বাক্স খুলে মা জ্যেঠিমা কাকিমাদের নানা গয়নার sample দেখাতেন। তাছাড়া তাঁর কাছে গয়নার design এর  catalogue থাকতো, সেই বই খুলে তিনি মা’দের নানা রকম গয়নার design দেখাতেন। তাঁকে ভীড় করে ঘিরে মা জ্যেঠিমা কাকীমাদের সেই উৎসাহ, আর তাঁদের  উৎসুক দৃষ্টি মেলে গয়না দেখা বেশ মনে পড়ে।

মাখনবাবু সার্থকনামা লোক ছিলেন। ধুতি পাঞ্জাবী পরে আসতেন, পাতা করে চুল আঁচড়ানো, পায়ে পাম শু, সবসময়  মুখে হাসি, অতি বিনয়ী, মিষ্টি মিষ্টি কথা, যাকে বলে perfect salesman! Smooth operator, মানে যাকে বাংলায় বলে “পুরো মাখন!”

আর ওনার business model ও বেশ effective, গৃহিণী রা দোকানে আসার  অপেক্ষায় না থেকে সোজা তাদের বাড়ীতে চলে যাওয়া। Competition এর যেখানে কোন সম্ভাবনাই নেই।     

আমার তখন দশ এগারো বছর বয়স, তার মানে আমার মা’র তখন তেত্রিশ বছর, কাকীমাদের ত্রিশ বছরের নীচে। ওই বয়সে গয়নার প্রতি মেয়েদের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো তেমন স্বচ্ছল ছিলামনা, আমাদের ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার, প্রাচুর্য্যের মধ্যে আমরা মানুষ হইনি। তাই বেশী গয়না কেনার সামর্থ্য মা দের ছিল না ধরে নেওয়া যায়।

মা কে জিজ্ঞেস করলাম তখন সোনার ভরি কত টাকা ছিল? মা’র মনে নেই। তবু এখনকার তুলনায় তখন সোনার দাম অনেক কম হলেও মাদের নাগালের বেশ কিছুটা বাইরেই ছিল নিশ্চয়। পরিবারের উপার্জন যা ছিল তার বেশীর ভাগটাই চলে যেত সংসারের খরচে।    

তবু সামাজিক কারণেও তো গয়নার দরকার পড়ে। কারুর বিয়ে, কারুর মুখে ভাতে উপহার দিতে হয়,  তখন নতুন গয়না কেনার টাকা না থাকলে পুরনো গয়না ভাঙিয়ে কাজ সারতে হয়। মা কাকীমা রাও তাই করতেন। দরদাম হতো। মাখনবাবু কিন্তু বেশী দরাদরি তে যেতেন না, তাঁর মুখে শুধু হাসি। মা’রা মাখনবাবুর সাথে দরাদরি তে খুব একটা পেরে উঠতেন বলে মনে হয়না।

খুব এলেমদার salesman ছিলেন মাখন বাবু, ব্যবসা টা ভালো ই বুঝতেন। মাদের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রতিবার এসেই বেশ কিছু অর্ডার নিয়ে যেতেন।

মাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম মাখনবাবু র সাথে তোমাদের যোগাযোগ হলো কি করে? শুনলাম উনি নাকি বাংলাদেশের (তখন East Bengal) গাইবান্ধার কাছের শহর কুড়িগ্রামের লোক, মা মাসী দের ছোটমামীমা র বাপের বাড়ী সেখানে। সেই সূত্রেই চেনাশোনা এবং যাতায়াত। মাসীদের বাড়িতেও মাখনবাবুকে মাঝে মাঝে দেখেছি। আমার মাসতুতো ভাই রঞ্জু ও তাঁকে বেশ ভালোই চিনতো।

বাঙ্গালদের এই লতায় পাতায় আত্মীয়তা আর সম্পর্কের ব্যাপারটা আমার বেশ লাগে। চেনাশোনা সবাই কে কাছে টেনে নেওয়া আর সাহায্য করা বাঙ্গালদের সহজাত। আজকের পৃথিবী তে যৌথ পরিবারের অবলুপ্তির সাথে সাথে এই দুঃস্থ বিপন্ন আত্মীয় অনাত্মীয় কে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার অভ্যেস ক্রমশঃ যেন কমে আসছে। এখন হল  Take your  বস্তা,  see your রাস্তা র যুগ।

রাসবিহারী রোডের দোকান টা ছেড়ে দিয়ে মাখনবাবু গড়িয়াহাটের বাজারের কাছে আলেয়া সিনেমার পাশে বড়ো একটা দোকান করেছিলেন, সেখানে পরে কয়েকবার গেছি। ক্রমশঃ মাখনবাবুর বয়স বেড়েছে, তাঁর ছেলের বিয়ে দেবার সময় আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন, বিয়ের পর ওনার দোকানে একবার সেই বিয়ের এলবামও দেখিয়েছিলেন আমাকে আর মাকে।

প্রায় পরিবারের একজনই হয়ে গিয়েছিলেন মাখনবাবু।

শেষ গড়িয়াহাটের লক্ষ্মী জুয়েলার্স এ যাই আমার মাসতুতো ভাই রঞ্জুর সাথে। নব্বই এর দশকের শেষে। গিয়ে দেখি Counter এ বসে একটি অল্পবয়েসী ছেলে, মাখনবাবুর কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বললো “বাবা আর নেই~”

তাকিয়ে দেখি তার পিছনে দেয়ালে মাখনবাবুর ছবি। ফ্রেমের ভেতর থেকে মাখনবাবু হাসি হাসি মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

জমাদার

কে বলে মেথর তুমি অস্পৃশ্য অশুচি/

তুমি আছো গৃহবাসে তাই আছে রুচি/ ~ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

ছোটবেলায় আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীতে কর্পোরেশন থেকে প্রতিদিন সকালে বাথরুম ধুতে একটি ছেলে আসতো, তাকে সবাই জমাদার বলে ডাকতাম।

ছেলেটি বিহার থেকে এসেছে এই কাজ নিয়ে, খুবই অল্প বয়েস, কুড়ি ও হবে কিনা সন্দেহ। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতো, কুচকুচে কালো গায়ের রং, কিন্তু দাঁত গুলো ধবধবে সাদা, আর হাসিটা খুব মিষ্টি।হাঁটু পর্য্যন্ত গোটানো মালকোচা মারা ধুতি, গায়ে একটা ফতুয়া, আর হাতে একটা ঝাঁটা, তার ওই চেহারাটা এখনো স্পষ্ট চোখে ভাসে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে বড়ো বারান্দায় ঢুকে সে “মেজমা” বলে একটা হাঁক দিয়ে নিজের উপস্থিতি সকলকে জানান দিতো। সঙ্গে সঙ্গে মা জ্যেঠিমা কাকীমা রা বলে উঠতেন “ওরে, বাথরুম থেকে জামাকাপড় বালতি ঘটি সব সরিয়ে রাখ্‌, জমাদারএসেছে।”,

মাঝে মাঝে কেউ না থাকলে সে আমাকেও বলতো,“বাথরুম থেকে কাপড় জামা আর বালতি টা সরিয়ে লিবেন দাদাবাবু!”

আমরা বাথরুম থেকে কাপড়জামা ঘটি সব না সরানো পর্য্যন্ত সে হাসিমুখে চুপ করে ঝাঁটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাকে ছুঁলে বা তার ছায়া মাড়ালে আমাদের জাত যাবে এ কথা ভাবতে তার কোন অপমানবোধ হতো না?

কি জানি!

তার হাসিমুখ দেখে আমার মনে হতো আমাদের অসুবিধের মধ্যে ফেলে সে বেশ মজাই পাচ্ছে। আমাদের এই অপমান সে গায়ে মাখছেনা, এই ব্যবস্থাযেন সে মেনেই নিয়েছে মনে মনে, যেন আমাদের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার ই তার প্রাপ্য, তার বেশী কিছু সে চায়ও না।

অনেক দিন হয়ে গেছে, সেই জমাদার আর আসেনা, তার জায়গায় এখন অন্য লোক আসে, সেই original জমাদার কে আমরা সবাই ভুলেই গেছি।

সে কিন্তু আমাদের ভোলেনি!

শুনেছি অনেক বছর পর (আমি তখন বোধহয় খড়্গপুরে কলেজে পড়ি) একদিনহঠাৎ কোট প্যান্ট টুপি পরা একটি লোক সিঁড়ি দিয়ে বড়ো বারান্দায়উঠে এসে “বড়মা” বলে হাঁক দিয়েছিল।

এ আবার কে রে বাবা?

কে আবার? আমাদের সেই জমাদার।সে নাকি কর্পোরেশনের কাজ ছেড়ে দুবাই চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে কিছুদিনের জন্যে দেশে ফিরেছে। মেজমা আর সেজমা (আমার মা) কে সে অনেক দিন দেখেনি, তাই সে দেখা করতে চলে এসেছে।

যাকে বলে প্রাণের টান!

আমি মা কে বললাম “তোমরা কি করলে তখন?”

মা বললেন,“কি আর করবো? চেয়ারে বসতে দিলাম। অনেক বাবা বাছা করলাম, এমন কি এক কাপ চা আর বিস্কুটও খেতে দিলাম। এত দূর থেকে দেখা করতে এসেছে!”

আমি বললাম, “তার পর ওই কাপ আর প্লেট এর কি হলো?”

মা বললেন “কি আবার হবে? মেজদি ফেলে দিল। ওই কাপে আর কাউকে চা দেওয়া যায় নাকি?”