Category Archives: ভ্রমণ

বার্দ্ধক্যে বারাণসী  – ফেব্রুয়ারী ৫-৭, ২০২৪

১)  পূর্ব্বকথা

কথায় আছে বাবা বিশ্বনাথ না ডাকলে কাশী যাওয়া হয়না।

ছোটবেলায় মা’র সাথে প্রতি বছর দিদার কাছে কাশী আসতাম। শেষ এসেছিলাম ১৯৬৫ সালে বাবার মৃত্যুর পরে, তখন খড়্গপুরে কলেজে পড়ি, গরমের ছুটিতে। তার পর অনেক বছর কেটে গেছে। বাবা বিশ্বনাথ আমায় ডাকেননি, আমারও আর কাশী আসা হয়নি।

২০১৯ সালে আমার শ্বাশুড়ী আর মা পর পর জানুয়ারী আর ফেব্রুয়ারী মাসে চলে গেলেন। তাঁদের দু’জনের বাৎসরিক কাজ করার কথা এক বছর পরে ২০২০ সালে, সেই কাজ ঠাকুরমশায়কে ডেকে বাড়ীতে করানো হলো। তখন কোভিড অতিমারী চলছে, লকডাউনের সময়ে তাঁদের আত্মাকে পিন্ডদান করতে গয়া বা কাশী যেতে পারিনি।

এবার ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ পর্য্যন্ত বাবা বিশ্বনাথের ডাক এলো।

আমরা আমার শ্বাশুড়ী আর মা’র পিন্ডদান করতে কাশী এসেছি। আমাদের সাথে  এসেছে আমাদের বড় মেয়ে পুপু। সে লন্ডনে ডাক্তার। ঠাম্মা আর দিদিভাইকে সে খুব ভালোবাসতো, তাই সে ছুটি নিয়ে আমাদের সাথে তাঁদের আত্মাকে পিন্ডদান করা দেখতে কাশী এসেছে, এই সুযোগে তার কাশী দেখা হয়ে যাবে। বাবা বিশ্বনাথ আমাদের সাথে তাকেও ডেকে নিয়েছেন।

ভারত সেবাশ্রম সংঘে পিন্ডদান হবে, আগে থেকেই ফোন করে সব বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে। পুরোহিত মশাইয়ের নাম ছোটু মহারাজ, তিনি সব জিনিষ যোগাড় করে রাখবেন, আমাদের কেবল এসে পুজোর কাজটা করতে হবে। আমি মা’র কাজ করবো, সুভদ্রা করবে আমার শ্বাশুড়ীর কাজ।  

১৯৬৫ সালের পরে ২০২৪, অর্থাৎ প্রায় ষাট বছর I পরে আমি কাশী এলাম।

এই ষাট বছরে কাশী অনেক পালটে গেছে, আর আমিও এখন সেই আগেকার শিশু বা কিশোর নই। আমার নতুন চোখে এই নতুন কাশীকে কেমন দেখবো, তাই নিয়ে মনে মনে প্রথম থেকেই আমি বেশ একটা আগ্রহ অনুভব করছিলাম।

তখন তরুণ ছিল অরুণ আলো, পথটি ছিল কুসুমকীর্ণ/

বসন্ত সে রঙ্গীন বেশে ধরায় তখন অবতীর্ণ।

আর এখন আমার অবস্থা হলো  “বসন্ত সে কবেই গেছে, শরীর এখন  জরাজীর্ণ।”

কাশী কিছুটা আমার সেই বাল্য কৈশোর আর আজকের বার্ধক্যের মধ্যে একটা সেতুর মতো।

এটা হলো সেই সেতুবন্ধের গল্প।

২) ষাট বছর পর প্রথম কাশী দর্শন

এই প্রথম প্লেনে কাশী এলাম। পুপু এলো দিল্লী থেকে। ওর ফ্লাইট কিছুক্ষন আগে এসেছে, আমাদের জন্যে সে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল।

ছোটবেলায় তো প্লেনে ওঠার সামর্থ্য আমাদের ছিলনা, মা’র সাথে ট্রেণে কাশী আসতাম। ট্রেণে কাশী যাবার একটা প্রধান স্মৃতি ছিল বেনারস স্টেশনের ঠিক আগে গঙ্গার ওপরে লম্বা ব্রীজ। সেই ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেণ যাবার সময়, ট্রেণের ভিতর থেকে একটা সমবেত কন্ঠে “গঙ্গা মাইকি জয়” রব উঠতো। তাছাড়া প্রায় সবাই তাদের গঙ্গা মাই কে প্রণামী হিসেব নদীর জলে পয়সা ছুঁড়তেন, এবং সেগুলো ব্রীজের গার্ডারে লেগে ঝনঝন একটা শব্দ হতো, সেই শব্দ এখনো কানে বাজে।

ট্রেণের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম বহু দূরে কাশীর গঙ্গার তীরের ইঁট রং এর উঁচু উঁচু বাড়ীগুলো, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, তাদের সামনে সিঁড়ি নেমে গেছে নদীতে। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে ভোলা প্রায় অসম্ভব। সত্যজিৎ রায় তাঁর “অপরাজিত” সিনেমার শুরুতেই  ব্রীজের ওপর ট্রেণ থেকে দেখা কাশীর ঘাটের ওই দৃশ্যটা ব্যবহার করেছেন। 

স্টেশন থেকে নেমে আমরা সাইকেল রিক্সা অথবা ঘোড়ায় টানা গাড়ী (টাঙ্গা) চড়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে দিদার বাড়ীতে পৌঁছে যেতাম। পথে শহরের নানা দৃশ্য চোখে পড়তো।  সেই সব দৃশ্য এখন সাদা কালো ছবির মতো শুধু আমার মনে।

ষাট বছর পরের এই শহর এখন কেমন লাগবে আমার চোখে? 

বেনারস এয়ারপোর্টটা বেশ বড় আর সাজানো গোছানো। সিঁড়ি দিয়ে হলে নেমে আসতেই দেখি সামনে পুপু আমাদের জন্যে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।  আমাদের মালপত্র নিয়ে আমরা বেরোলাম। বাইরে তখন বিকেলের উজ্জ্বল আলো। 

হোটেলের ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে এসেছে, বেশ আরামাদায়ক বড় গাড়ী (SUV), আমরা সেই গাড়ীতে উঠে হোটেলের দিকে চললাম।

আমাদের ড্রাইভার এর নাম ভোলা। কাশীতে সবার নামই মহাদেব এর নামে হবে তাতে আর অবাক হবার কি আছে? ভোলা ফোনে কার সাথে কথা বলছে,  ভোজপুরী ভাষায় নাকি?  জিজ্ঞাসা করাতে সে বললো কাশী শহর বিহার এর বর্ডার এর খুব কাছে। আর বর্ডারের ওপারেই ভোজপুর জেলা, তাই কাশীতে ভোজপুরী ভাষা খুব প্রচলিত, এই ভাষায় এখানে অনেকেই কথা বলে। 

কাশী শহর এয়ারপোর্ট থেকে অনেকটা  দূর, যেতে সময় লাগলো ঘন্টা খানেক। যেতে যেতে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম – তখন বিকেলের রোদ এসে পড়েছে দু’দিকের ছোট ছোট বাড়ীতে, চারিদিকে খোলামেলা সবুজ,  দেখে মনে হয় বেশ বর্দ্ধিষ্ণু জায়গা।  কিন্তু ক্রমশঃ যত শহর কাছে আসতে লাগলো ততো ঘড়বাড়ী দোকানপাট আর সাইকেল অটো আর মানুষের ভীড় বাড়তে লাগল।  

সেই পড়ন্ত বিকেলে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দিকে যেতে যেতে বেনারস শহরের ব্যস্ত রাস্তা দেখছিলাম, নানা দৃশ্য চোখে পড়ছিল, রাস্তার দুই পাশে বেনারসী শাড়ীর দোকান, চারিদিকে হিন্দী সাইনবোর্ড, অটো রিকশা আর পথচারীদের ভীড়। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে কাশীর বিখ্যাত সরু সরু গলি। কালো বোরখা পরা কিছু কিশোরী দলবেঁধে হেসে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, হয়তো তারা স্কুল থেকে ফিরছে।

দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কত প্রাচীন এই বারাণসী শহর, হিন্দুদের পরম পবিত্র তীর্থ। স্বয়ং শিব এখানে এসে ভিক্ষা নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণার কাছ থেকে।  এই শহর মুসলমানদের অধীনেও থেকেছে, মন্দিরের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে মসজিদ। ফলে এখানে হিন্দু ও মুসলমান নারী পুরুষ যত্রতত্র দেখা যায়।

সারা বিশ্বে আমাদের হিন্দুদের মোট সাতটি পবিত্র ভূমি রয়েছে, যেখানে গেলে মানুষ মোক্ষ লাভ করতে পারে। অযোধ্যা, মথুরা, গয়া, কাশী, কাঞ্চী, অবন্তিকা ও দ্বারবতী – এই সাতটি শহরকে  একত্রে বলা হয় সপ্তপুরী। কাশী এই সপ্তপুরীর অন্যতম পবিত্র ভূমি। পাশাপাশি এই শহরটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এবং গঙ্গা নদীতে স্নান করা হিন্দু ধর্মমতে বিশেষ পুণ্যের কাজ।  

কাশীর গঙ্গায় স্নান করে বিশ্বনাথ দর্শন করলে পার্থিব জীবনের যত জ্বালা আর  যন্ত্রণা থেকে চিরকালের জন্যে নিশ্চিত মুক্তি এই বিশ্বাস থেকে দলে দলে হিন্দুরা যুগে যুগে সারা দেশ থেকে মন্দিরে শিবের দর্শন করতে ও পূজো দিতে আসেন।  

এই বিশ্বাস থেকে আমার দিদিমা ও তাঁর শেষ জীবনে বেশ কয়েক বছর কাশীতে একা একা থেকেছেন। মা মামা মাসীরা অবশ্য তাঁকে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে শারীরিক অসুস্থতা জনিত কারণে নিজেদের কাছে নিয়ে এসে রাখেন।

আমার বার্ধক্যে আমি অবশ্য নিজের জন্যে কোন পুণ্য অর্জ্জন করার জন্যে কাশী আসিনি। আমি এসেছি আমার মা’র পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যে। আমার মা রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে বড় হয়েছেন, সারা জীবন নিষ্ঠার সাথে পুজো আর্চা এবং  শিবরাত্রি বা কালীপূজোতে নির্জলা উপোস এই সব করেছেন।  আমার বাবার মৃত্যুর পরে তিনি আমায় নিয়ে গয়া  গিয়েছিলেন, সেখানে আমরা তাঁর পারলৌকিক আত্মার শান্তির জন্যে তাঁকে পিন্ডদান করেছিলাম।

সুতরাং তিনি নিশ্চয় চেয়েছিলেন যে তাঁর একমাত্র সন্তান তাঁর মৃত্যুর পরে  পিন্ডদান করে তাঁর আত্মাকে মুক্তি দেবে। সেই কাজ করতেই আমার কাশী আসা।    মা’র প্রতি সন্তানের কর্ত্তব্য পালন করাও অবশ্যই একটা পুণ্যের কাজ।  তাছাড়া  গঙ্গায় স্নান না করলেও বিশ্বনাথের দর্শন তো অন্ততঃ হবে।

প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল মা পরলোকে যাত্রা করেছেন, ঠিক এক বছর পরে ২০২০ সালে কোভিড অতিমারীর মধ্যে বাড়ীতে পূজো করে তাঁকে পিন্ডদান করা হয়েছে, কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী গয়া কাশী হরিদ্বার এর মত তীর্থক্ষেত্র থেকে  পিন্ডদান না করলে প্রেতাত্মা বৈতরণী নদীর ঘাটে অপেক্ষায় থাকেন, যতক্ষন না সন্তান পিন্ডদান করে ততদিন সেই নদী পেরিয়ে তাঁর প্রেতাত্মার স্বর্গে প্রবেশ করার অনুমতি নেই।  

এই সব ভাবতে ভাবতে আমাদের গাড়ী এক জায়গায় এসে একটা সরু গলির মুখে এসে দাঁড়ালো।   

আমাদের হোটেলটা একটু ভেতরে নদীর ধারে, সেখানে গাড়ী যাবেনা , তাই হোটেলের  দুই জন ইউনিফর্ম পরা লোক এসেছে তারা আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেবে। হেঁটে মাত্র দুই বা তিন মিনিটের রাস্তা, একটু এগোতেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। পাশেই শিবালা ঘাট, নদীর দর্শন পেলাম। নিজের মনে বয়ে চলেছে পুণ্যসলিলা গঙ্গা। এখানে জলের রং নীল, কলকাতার মত পলিমাটিতে ভরা হলুদ রং নয়। দেখে মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল।

আমাদের  হোটেলের নাম সূর্যোদয় হাভেলি, এই হোটেলটি আগে রাজস্থানের কোন মহারাজের বাড়ী ছিল শুনলাম। বেশ দামী হোটেল, শাকাহারী, অর্থাৎ এখানে সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়।

শুনেছি আধুনিক বারাণসীর বেশির ভাগটাই রাজপুত ও মারাঠা রাজাদের হাতে তৈরি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে তৈরী এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাড়ীর বেশিরভাগই তাই।  সেই সব রাজা রাজড়ারা বলা বাহুল্য শিবের ভক্ত ছিলেন। এবং তাঁদের তৈরী এই সব হাভেলিতে তাঁরা সপরিবারে এসে থাকতেন। কাশীতে গঙ্গার ধারে প্রাসাদোপম হাভেলি থাকা একরকমের আভিজাত্যের প্রকাশ, তাছাড়া পুণ্যও হয়।

এখন এই সব হাভেলির অনেকগুলোই হোটেল হিসেবে চালানো হয়।  ছোটবেলায় যখন আসতাম, তখন কাশীতে এত হোটেল ছিলনা।  

৩) কাশী আর বেনারস 

কাশী আর বেনারস দুটো আলাদা রেলস্টেশন হলেও আসলে কিন্তু ওরা একই শহরের দুই নাম। পরে শুনেছি ওখানে দুই উপনদী বরুণা আর অসি গঙ্গায় মিশেছে তাই সেখান থেকেই সন্ধি করে শহরের নাম হয়েছে বারাণসী। সেখান থেকে বেনারস।  

অনেকে বলে কাশী হলো বাঙালীর, আর বেনারস হলো সারা ভারতের।

একই শহরের ভিতর দুই আলাদা শহর, তাদের আলাদা রূপ, আলাদা পরিচয়।  আমার এক বন্ধু সিদ্ধার্থ পাঁচ বছর কাশীতে থেকে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। তার মতে কাশী ও বেনারস দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ।

কাশীতে বাঙালীর প্রতিপত্তি বেশী, বিধবাশ্রম, ভাতের হোটেল, আনন্দময়ী মা,   গঙ্গার ঘাট আর সিঁড়ি, হরিহর সর্ব্বজয়া আর ছোট্ট অপু।  বাংলা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী উপন্যাসের নায়িকারা নির্বাসিত হয়ে কাশীবাসিনী হয়েছেন। সেই সব উপন্যাসের মধ্যে আছে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতক, বিভূতিভুষনের দ্রবময়ীর কাশীবাস, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ।  এমনকি রবীন্দ্রনাথও চোখের বালির বিনোদিনী কে কাশী পাঠিয়েছিলেন।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর উনবিংশ শতাব্দী নিয়ে লেখা “সেই সময়” উপন্যাসে বালবিধবা  বিন্দুবাসিনীকে তখনকার সমাজের রীতি অনুযায়ী কাশী পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কাশীর একটা গোটা এলাকাই বাঙালির। যার নাম বাঙালিটোলা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দিব্যি বাংলা বলে চলেছেন প্রবাসীরা। এখানে তিন হাজারের বেশি দুর্গাপুজো হয়। এককালে সংস্কৃত শেখার জন্য বহু বাঙালি পাড়ি দিতেন কাশী। একটা সময় ছিল যখন কাশীতে রীতিমতো শাসন করতেন বাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিতরা।  

অন্যদিকে বেনারস হলো ভারতীয় সংষ্কৃতি আর আধ্যাত্মিকতার এক বিশেষ পীঠস্থান। বেনারসী শাড়ী, রাবড়ী,  জর্দ্দা পান, কচুরী,  মুজরা, বাইজী দের নাচ গান, কবি সন্মেলন, বিসমিল্লা খাঁর অষ্টপ্রহর সানাই, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বেনারেস ঘরানা। অপরাধ জগতের  মগনলাল মেঘরাজেরাও বেনারসের অতি ঘোর বাস্তব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় উপন্যাসে গঙ্গানারায়ন তার ছেলেবেলার বান্ধবী এবং বালবিধবা কাশীতে নির্বাসিতা বিন্দুবাসিনী কে কাশীতে এসে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল। শেষ পর্য্যন্ত সে বিন্দুকে যখন সে খুঁজে পায়, সে তখন এইরকম একজন অপরাধ জগতের মানুষের রক্ষিতা। সে গঙ্গার কাছে ফিরে যেতে রাজী হয়না, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।

বারাণসীকে ভারতের প্রাচীনতম শহর বলে মনে করা হয়।   

এই শহর হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র শহর হলেও বারাণসী বৌদ্ধ, জৈন আর শিখ ধর্মেরও অন্যতম পীঠস্থান।

৫২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বারাণসীর কাছে সারনাথে বুদ্ধ প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেন।    বুদ্ধগয়ায় বোধিসত্ত্ব লাভ করার পর গৌতম বুদ্ধ তা প্রচার করার জন্য পঞ্চভার্গব ভিক্ষুর সন্ধানে প্রথম এসে পৌঁছেছিলেন সারনাথে। পরে সম্রাট অশোক সারনাথের একটি মৃগদাবে একটি বুদ্ধমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কাশী এলে সারনাথে সেই মন্দির দর্শন করতে পর্য্যটকরা দল বেঁধে যান্‌।  মা মাসীদের সাথে ছোটবেলায় আমিও বেশ কয়েকবার গেছি।

৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে চীনা পর্যটক  ফাহিয়েন এবং পরে হিউয়েন সাং  বারাণসীতে এসেছিলেন।  তাঁদের রচনা থেকে এই শহরের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের পরিচয় পাওয়া যায়।  

 ভক্তিবাদী আন্দোলনের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবীর। কবীরকে “পঞ্চদশ শতাব্দীর ভারতের শ্রেষ্ঠ ভক্তিবাদী সন্ত কবি ও অতিন্দ্রীয়বাদী” বলা হয়।  ১৫০৭ সালের শিবরাত্রি উৎসবের সময় গুরু নানক এই শহরে আসেন। তার এই বারাণসী সফর শিখধর্ম্ম প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

কিন্তু শুধু ধর্ম দিয়ে বারাণসী কে চেনা যাবেনা।

এই শহর শত শত বছর ধরে ভারতীয় সংস্কৃতি, শিল্প ও শিক্ষার উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান হিসেবে তার পরিচয় বজায় রেখেছে।

তুলসীদাস তাঁর জীবনের সিংহভাগ এই শহরে কাটিয়েছেন। রামায়ণের  ওপর লেখা তাঁর বিখ্যাত কাব্য রামচরিতমানস তিনি এখানেই রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুও হয় এই শহরে।    

কিছুদিন আগে গৌতম চক্রবর্ত্তী আনন্দবাজারে বারাণসীর ছেলে মুনসী প্রেমচন্দের ১৯১৮ সালে প্রকাশিত  সাড়া জাগানো উপন্যাস “সেবাসদন” নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেই আলোচনায় উঠে এসেছে বিংশ শতাব্দীর (প্রাক স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার পর) কাশীর সাংষ্কৃতিক পরিবেশ।  সেবাসদন উপন্যাসের নায়িকা ব্রাম্ভনের মেয়ে সুমন। বিয়ের আগে পিতৃগৃহে সে নাচ আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছে। 

বৃদ্ধ স্বামী কে ছেড়ে সে কাশীর মন্দিরে সাধু সন্তদের সামনে গান গায়, নাচে।

গৌতম লিখেছেন~

——————

নাচনেওয়ালী? মন্দিরের চাতালে সাধুসন্ত ও দর্শনার্থী দের ভীড়ে শিবলিঙ্গের সামনে নাচছে গল্পের নায়িকা সুমন। সে যদি খারাপ মেয়ে হয়, তাহলে সে মন্দিরে কি ভাবে নাচে? সাধু সন্তরা তার নাচ দেখে এত ধন্য ধন্য করে কেন?

————–

ঊর্দ্দু থেকে ইংরেজীতে সম্প্রতি অনূদিত হবার আগে কেউ জানতোনা সাধুদের আশ্রমে মন্দিরে উচ্চাঙ্গ নাচ গানের এই সংষ্কৃতির কথা। নানা অনুষ্ঠানে সরস্বতী পূজোর দিন, বাইজী, মুজরো গায়িকা এমন কি বহুবল্লভারা (ঊর্দ্দুতে “তওয়াইফ”রা) বিনা পারিশ্রমিকে দশাশ্বমেধ ঘাটে নাচ গান করতে আসতেন।

বারাণসীর ইমামবাদী বাইজীর কাছ থেকে গান শিখে প্রথম বাংলা টপ্পা গানের প্রচলন করেন নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য। অঘোর চক্রবর্ত্তীর ধ্রুপদ বা মহেশচন্দ্র সরকারের মত বীণা বাদকের শিক্ষাও এই শহরে। কথক নাচ ও ছয় মাত্রার দাদরা তালের ও বিকাশ ঘটেছিল এই শহরে। আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সঙ্গীতকার তানসেনের বংশধরেরা অনেকেই বারাণসীকে তাদের বাসভূমি বলে বেছে নেন। তৈরী হয় বেনারস ঘরানা।

এঁদের কারুর মধ্যে ছিলনা ধর্ম বা জাত পাতের বিভেদ। কোন নোংরামীও ছিলনা, তবু স্বাধীনতার পরে সরকারের উদ্যোগে কাশীর ডালমন্ডির বাইজী মহল্লা তুলে দেওয়া হয়। যেহেতু এই তওয়াইফেরা অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান, তাই এই নিয়ে তখন খুব হৈ চৈ এবং সাম্প্রদায়িক অশান্তি শুরু হয়,  কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত জয় হয় পুরুষতন্ত্রেরই।  

ডালমন্ডীর বাইজী প্রেমচন্দের উপন্যাসের নায়িকা সুমন বাইজী বা তওয়াইফ হলেও সে তার শরীরী সতীত্ব হারায়নি। উপন্যাসের শেষে তার স্বামীর সাথেও তার দেখা হয়।

৪) প্রথম সন্ধ্যা  – দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গারতি

আমাদের ঘরটা বেশ বড়, পুপুর জন্যে একটা  আলাদা বিছানার বন্দোবস্ত করতে অসুবিধে হইয়নি।  বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের জন্যে একটা নৌকা বুক করা আছে, চেক ইন করে ঘরে মালপত্র রেখে আমরা সোজা ঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠে বসলাম।

হোটেলটি তিনতলা। আমাদের ঘর এক তলায় হলেও নদী আরো অনেকটাই নীচে। ঘাটে যেতে সিঁড়ি বেয়ে তাই অনেকটা নামতে হলো। পাঁচটা বাজে কিন্তু তখনও বেশ আলো। দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গারতি দেখবো, সেখানে নৌকায় করে যেতে যেতে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিলা। একের পর এক ঘাট পেরিয়ে যেতে থাকলাম, আর অনেকদিন পরে চোখে পড়লো কাশীর সেই পরিচিত দৃশ্য।  সারি সারি উঁচু ইট রঙ এর বাড়ী আর জলে নেমে আসা সিঁড়ি। 

ছোটবেলায় বাবা যখন কাশী আসতেন, তখন সবাই মিলে বিকেলে গঙ্গায় নৌকায় চড়ে অনেক দূরে চলে যেতাম। মাথার ওপরে নীল আকাশ, চারিদিকে নদীর নীল জল, মাঝির দাঁড়ের আওয়াজে জলে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আসছে, আমি চলন্ত নৌকা থেকে জলে হাত নামিয়ে দিয়ে দেখতাম কেমন ঠাণ্ডা। মণিকর্ণিকা ঘাট এলে মা বলতেন এখানে চিতার আগুণ কখনো নেবেনা। কাশীতে অনেক মরণোন্মুখ মানুষ মারা যেতে আসেন, এই ঘাটে দাহ করলে মোক্ষলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয়না।  

এখন অবশ্য সবই ডিজেলে চালানো মটরবোট।  চারিদিকে নদীতে মটরবোটের ছড়াছড়ি। এখানে আসার আগে আমাদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল, কাশীর মশাদের কামড়ে নাকি ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া হয়। আমরা প্রতিষেধক ক্রীম গায়ে আর জামায় মেখে নিলাম। সাবধানের মার নেই।

গঙ্গারতি নদী থেকেই দেখা হলো। দশাশ্বমেধ ঘাট তো লোকে লোকারণ্য, সামনে নদীতেও সারি সারি নৌকা, বড় বড় স্টীমার। তাতে ভর্ত্তি দর্শনার্থী ভক্তের দল। ক্রমশঃ অন্ধকার নেমে এলো, তার মধ্যে চারিদিকে জ্বলজ্বল করছে আলোর মালা। তার সাথে মাইকে শোনা যাচ্ছে ভজন আর স্তোত্রপাঠ। বেশ জমজমাট ব্যাপার।

গঙ্গারতি এখন গঙ্গার তীরে নানা শহরে হয়। এমন কি কলকাতায়ও। এক বছর আগে সুভদ্রা আর আমি হরিদ্বারে দেখেছি।

৪) দ্বিতীয় দিন

গতকাল আসা আর আগামীকাল ফেরার মাঝখানে আজ আমাদের কাশীতে একমাত্র দিন। সুতরাং এই দিনটিতে আমাদের প্রধান দুটি কাজ সারতে হবে, এক হলো মা’দের দু’জনের বাৎসরিক কাজ করা আর দুই হলো বিশ্বনাথ দর্শন।  তারপরে বাকি সময়টা আমরা যতটা পারি কাশী শহরের অন্যান্য নানা দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়াবো।  

ভোরে  ব্যালকনি থেকে সূর্য্যোদয়

আমাদের ঘরের পাশে বাইরে একটা ছোট ব্যালকনি আছে, পরের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সেখানে তিন জনে চা খেতে খেতে সূর্য্যোদয় দেখা হলো। মন ভাল করা দৃশ্য। সেই ভোরেই ঘাটে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। 

ব্যালকনি তে তিন জনে চা খেতে খেতে নদী দেখতে দেখতে আমার মন চলে যাচ্ছিলো সেই ছোটবেলার কাশীতে। রাণা মহলের বাড়ীর ছাতে গেলেই  নীচে নদী দেখা যেতো, এখনকার মত তখনো পাশে চরে গাছগাছালি গজিয়ে উঠেছে। একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে দুলতে দুলতে ভেসে জলে গিয়ে পড়ছে। দূরে ব্রীজের ওপর দিয়ে গুম গুম আওয়াজ করে ট্রেণ চলে যাচ্ছে। এই সব নানা স্মৃতি।

আজও সেই একই দৃশ্য। কিছুই যেন বদলায়নি।  দূরে চর, কাছে ঘাটে লোকে স্নান করছে, নদীর জলে এদিক থেকে ওদিক বোট আর নৌকারা ভেসে চলেছে, তাদের পিছনে পিছনে মাছের লোভে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য পাখীর ঝাঁক।

স্নান সেরে তৈরী হয়ে সকাল সকাল হোটেলেই ব্রেকফাস্ট। এখানে নিরামিষ খাবার খুবই সুস্বাদু। গতকাল কাল ডিনার ও এখানে করেছি।  কাশীর কচুরী নাকি খুব বিখ্যাত, কিন্তু তা’ নাকি সকাল দশটার পরে আর কোন দোকানে পাওয়া যায়না।  অদ্ভুত নিয়ম। আমাদের তাই আর কচুরী খাওয়া হলোনা।

কাশীতে ঘুরে বেড়াবার জন্যে গাড়ীর বদলে অটোই ভাল, কেননা  সরু গলির মধ্যে গাড়ী ঢোকেনা অনেক দূরে পার্ক করে হাঁটতে হয়। হোটেল থেকেই একটি গাইড ছেলে কে কাল বলে রেখেছি, সে আজ সারাদিনের জন্যে একটা অটো ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।  ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দির – ভাঙা আর গড়ার ইতিহাস

আমাদের প্রথম কাজ হলো বিশ্বনাথ দর্শন।

হিন্দুদের জন্যে কাশীর একটি প্রধান আকর্ষন হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির।  মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে।

যাই হোক, এই মন্দিরটি কবে প্রথম তৈরী হয়েছিল, তা নিয়ে নানা মতামত আছে। বারাণসীতে যে সবচেয়ে পুরনো পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তার থেকে অনুমিত হয় গাঙ্গেয় উপত্যকায় এই শহরে জনবসতি শুরু হয়েছিল খৃস্টপূর্ব একাদশ কিংবা দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই জন্য বারাণসীকে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির একটি মনে করা হয়।

এই মন্দিরের নাম ছিল আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির।

সেই মধ্যযূগ থেকে আমাদের দেশে পশ্চিম আর উত্তর থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বহিরাগত মুসলমান আক্রমণ হয়েছে। সেই সব আক্রমণকারীরা কেউ এসেছে সোনা দানা লুট করতে,  আবার কেউ এসেছে আমাদের দেশে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে। আমাদের ইতিহাস বইয়ের পাতায় খুললেই পড়া যায়  শুধুসেই সব যুদ্ধের কাহিনী – সেখানে শুধু তলোয়ারের ঝনঝনানি, ঘোড়াদের হ্রেষা ধ্বনি, আর যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা হাজার হাজার রক্তাক্ত মৃতদেহ। এক দিকে আল্লা হু আকবর আর অন্যদিকে হর হর মহাদেব চিৎকার!

এই সব আক্রমণকারীদের নামের লম্বা লিস্ট। মহম্মদ ঘোরী থেকে শুরু করে  ইলতুৎমিস, ফিরোজ শা তুঘলক, কুতুবউদ্দিন আইবক্‌ …

হিন্দু রাজাদের যুদ্ধে পরাজিত করার পর তাদের সৈন্যরা সারা দেশ জুড়ে একের পর এক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার জায়গায় মসজিদ স্থাপন করে গেছে। কিন্তু তার মধ্যেও সেই সব মন্দিরের পুনর্নিমাণ হয়েছে, ধনী এবং ধর্ম্মভীরু হিন্দু রাজা বা বণিক বা জমিদাররা সু্যোগ পেলেই সেই কাজ করেছেন।     

এই ভাবেই যুগে যুগে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরেরও ভাঙা গড়া চলে এসেছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট  আকবরের সময়কাল ছিল বারাণসীর সাংস্কৃতিক নবজাগরণের যুগ।   আকবর শহরটিকে সাজিয়ে তোলেন।  ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন এবং শিব ও বিষ্ণুর দুটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। পুণের রাজা সেই সময় অন্নপূর্ণা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় শের শাহ কলকাতা থেকে পেশোয়ার  গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করার পরে এই অঞ্চলের পরিবহন পরিকাঠামোরও উন্নতি ঘটেছিল।  ষোড়শ শতাব্দী থেকে পর্যটকেরা আবার এই শহরে আসা শুরু করেন।

আবার ১৬৬৯ সালে আওরংজেব সম্রাট হবার পরেই পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে সেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করান। এই মসজিদটি আজও মন্দিরের পাশে অবস্থিত।  ১৭০১ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ক্রমশঃ ভেঙে পড়ে, এবং ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলের শাসনভার হিন্দু সামন্ত রাজাদের হাতে চলে যায়। আধুনিক বারাণসীর বেশিরভাগটাই  অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজপুত ও মারাঠা রাজাদের হাতে তৈরি।  

১৭৩৭ সালে মুঘল সম্রাট কাশী রাজ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরে ব্রিটিশ যুগে কাশীর রাজাই এখানকার মুখ্য শাসক হয়ে ওঠেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাশীর রাজবংশ বারাণসী শাসন করেছিল।  

এর পরে আসে মারাঠা ও ব্রিটিশ আমল।

বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে মালহার রাও হোলকার এর পুত্রবধূ তথা হোলকার (আজকের ইন্দোর) রাজ্যের মহারানি অহল্যাবাই নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।  ভক্তিমতী ও সুশাসক হিসেবে রাণী অহল্যাবাই এর খুব সুনাম ছিল, তাঁর আমলে যুদ্ধ বিগ্রহ হয়নি, প্রজারা শান্তিতে বসবাস করতো। তিনি বহু জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।

 ১৮৩৫  সালে পাঞ্জাবের শিখ সম্রাট  রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের চূড়াটি ১০০০ কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।

আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে  দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ভিতর কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির একটি বহু আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।

পশ্চিম এশিয়াতে জেরুসালেম এও মধ্যযুগে ধর্ম্মযুদ্ধে (crusade) ক্রীশ্চান আর মুসলমানদের এই গীর্জ্জা আর মসজিদ ভাঙা গড়া হয়েছে।  ২০১৩ সালে যখন আমি জেরুসালেমে গিয়েছিলাম, তখন সেই ভাঙা গড়ার নিদর্শন আমি দেখেছি।  সেখানে উনবিংশ শতাব্দীতে অটোমানদের রাজত্বের সময় (১৮৫০) একটা “ফিরমান” জারী করা হয়, তাতে দুই পক্ষই রাজী হয় যে এর পর থেকে আর কোন ভাঙা গড়া নয়,  জেরুসালেম ও বেথেলহেমের সব গীর্জ্জা আর মসজিদই এখন যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতেই থাকবে। এই ফিরমানের নাম ছিল “Status Quo”~

আমাদের দেশে অবশ্য এরকম কোন ফিরমান জারীর কোন প্রশ্ন ছিলনা, কেননা এখানে মুসলমান শাসকেরা এক তরফা হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করে গেছে। শোনা যায় যে কাশী শহরেই প্রায় ৩০,০০০ মন্দির ধ্বংস করা হয়,  তার মধ্যে আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির চত্বরে চল্লিশটি মন্দির ছিল।

মূল মন্দিরের উত্তর দিকে একটি পবিত্র কূপ আছে । প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে আক্রমণকারীদের হাত থেকে জ্যোতির্লিঙ্গ কে বাঁচাবার জন্যে এক পুরোহিত নাকি মূর্ত্তি নিয়ে এই কূপটিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

তবে ফিরমান না থাকলেও ব্রিটিশ আমল থেকেই আইন করে মন্দির মসজিদ ধ্বংস করার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরে আমাদের নিজেদের সংবিধান তৈরী হয়, যেখানে পরিস্কার লেখা আছে যে আমরা একটি ধর্ম্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক (secular, democratic) দেশ – সুতরাং এখন আর কারুর মন্দির বা মসজিদ ধ্বংস করার কোন  অধিকার নেই।

২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির (বি জে পি) হিন্দুত্ববাদী সরকার। তাদের উদ্যোগে যে সব হিন্দু মন্দির বহিরাগত মুসলমান শাসকেরা বিশেষ করে আওরঙ্গজেব – ভেঙে বা নিষ্ক্রিয় করে তার জায়গায় মসজিদ তৈরী করেছিলেন, সেই সব মসজিদ গুলো  সব এক এক করে ভেঙে বা সরিয়ে তাদের জায়গায় ধ্বংস হওয়া মন্দিরগুলো আবার নতুন সাজে গড়ে উঠছে। প্রথমে অযোধ্যায় রামজন্মভূমি তে বাবরী মসজিদ ভেঙে রামলালা (শিশু রামের)  সরযু নদীর তীরে বিশাল বর্ণাঢ্য মন্দির তৈরী হলো, আর তার পরে সম্প্রতি কাশীতে জ্ঞানব্যাপী মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে নতুন বিশ্বনাথ এর মন্দির চালু হয়েছে। এর জন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বি জে পি কে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে অনুমতিও পেতে হয়েছে। বিশ্বনাথ মন্দিরের আশেপাশে চল্লিশটিরও বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত, শতাব্দী প্রাচীন মন্দির পাওয়া গেছে এবং তার প্রত্যেকটিই পুনর্নির্মিত হয়েছে।

জ্ঞানবাপী মসজিদ কে দূরে কোথাও সরিয়ে দেওয়া হবে  আদালত থেকে এই নির্দ্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এর পরে মথুরায় বিষ্ণু মন্দির নতুন করে তৈরী করবার জন্যে আদালতের নির্দেশের অপেক্ষা করা হচ্ছে।

বিশ্বনাথ দর্শন। 

আজ সকাল দশটায় কাশী বিশ্বনাথ  মন্দিরে আমাদের টিকিট কাটা আছে। তাই বিশ্বনাথ দর্শন আজকে আমাদের প্রথম কাজ।  

আমার ছোটবেলায় কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে যাবার জন্যে একটা সরু গলি ছিল, তার নাম ছিল বিশ্বনাথের গলি।  তার দুই পাশে দোকান আর নানা ছোট মন্দির ছিল, আর ছিল গিজগিজে ভীড়। নদী থেকে মন্দিরে প্রবেশ করার কোন ঘাট বা রাস্তা  ছিলনা।

জায়গাটা ২০২২ সালের পরে আমূল পাল্টে গেছে।

আগের সেই বিশ্বনাথের সরু গলি আর নেই।  ঠাসাঠাসি ভীড় ও নেই। সেখানে এখন বেশ চওড়া একটি রাস্তা। এখন মন্দিরের চত্বরটি বিশাল করা হয়েছে, সেই চত্বর এখন পরিস্কার ঝকঝকে সেখানে মার্বেলের সাদা মেঝে। ভীড় কমানোর জন্যে ইন্টারনেটে আগে থেকে টিকিট কেনার বন্দোবস্ত হয়েছে।

এখন Internet এ আগে থেকে পাস নিতে হয়, আমাদের তিন জনের পাস আজ সকাল দশটায়। এখন গলি দিয়ে না গিয়ে নদীর ঘাট থেকেও মন্দিরে ঢোকার বন্দোবস্ত হয়েছে। আমরা আগে বড় রাস্তার ধারে একটা দোকানে প্রসাদ আর পূজোর জিনিষ পত্র কিনে সেখানে চটি রেখে মন্দিরে ঢুকলাম।

বিশ্বনাথ মন্দিরের ভেতরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়।   মার্বেল পাথরে বাঁধানো ঝকঝকে পরিস্কার  বিশাল  প্রাঙ্গন।  সেই চত্বরে দেখা যায় অনেক ছোট ছোট মন্দির। মাঝখানে বিশ্বনাথের মন্দির, মাথার ওপরে সোনার চূড়া। সামনে ঢোকার জন্যে ছোট সুশৃঙ্খল লাইন। সময় অনুযায়ী ব্যাচে ভাগ করাতে কোনরকম বিশৃঙ্খলা নেই, আমাদের লাইনে মাত্র কুড়ি ত্রিশ জন পুরুষ  নারী ও শিশু, প্রতেকের হাতে টিকিট। সেই টিকিট দেখার জন্যে একজন গার্ড মন্দিরের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছে।   

সব মিলিয়ে অতি সুন্দর বন্দোবস্ত। ভাল ভাবে দর্শন আর পূজো হলো। তার পরে গেলাম অন্নপূর্ণার মন্দির, এবং এক এক করে আরো অনেক মন্দির যা ওই বিশাল পাথরে বাঁধানো পরিস্কার চত্বরে ছড়িয়ে আছে।

মা’র কথা ভাবছিলাম। ভীড়ের মধ্যে কত কষ্ট করে দর্শন করতেন মা। খুব শিবে ভক্তি ছিল তাঁর।

শুধু মন্দির নয়। চত্বরের ভিতরে চারিপাশে লাইব্রেরী,  ভি আই পি লাউঞ্জ, মিউজিয়াম, কনফারেন্স রুম, আরও কত কি! এলাহী ব্যাপার।

বেরোবার সময় দেখি আগাপাস্তলা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা জ্ঞানব্যাপী মসজিদ। কোন লোক নেই সেখানে, এখানে এখন আর কোন নমাজ পড়া হয়না। কিছু সিকিউরিটির লোক পাহারা দিচ্ছে যাতে কোন গোলমাল না হয়। হয়তো কিছুদিন পরে এই মসজিদ ভেঙে ফেলা হবে।

কালভৈরবের মন্দির

বিশ্বনাথ দর্শনের পর কিছুটা দূরে গিয়ে কালভৈরবের মন্দির।  সরু গলির ভিতরে ঢুকতে হবে, তাই আমাদের অটো দূরে পার্ক করে রেখে আমরা কিছুটা হেঁটে দর্শন করে এলাম। তখন বেলা বারোটা হবে, গলিতে বেশ ভীড়, সবাই মন্দিরেই যাচ্ছে, গলির দুই পাশে অনেক দোকান, সেখানে কালভৈরবের ছবি সহ নানা পূজোর সামগ্রী বিক্রী হচ্ছে।

আমি কালভৈরবের মন্দিরে আগে আসিনি, এই প্রথম।

তবে বহু দিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রথম আলো” উপন্যাস পড়ার সময়  তাঁর নাম জেনেছিলাম। সেই উপন্যাসে এক জায়গায়  ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্রমানিক্য তাঁর সঙ্গী শশীভূষনের সাথে জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে এক জায়গায় গিয়ে একটি ভাঙ্গা মন্দির এবং তার পিছনে পাহাড়ের গায়ে একটি ছবি দেখতে পান্‌,  তিনটি  চোখ, আর পাশে একটি ত্রিশুল!

বীরচন্দ্র অবাক বিষ্ময়ে বলে ওঠেন – “কালভৈরব!”

জায়গাটার নাম উনকোটি অর্থাৎ এক কোটি থেকে এক কম। সেখানে নির্জন জঙ্গলে পাহাড়ের গায়ে নাকি শত সহস্র হিন্দু দেবদেবীর ছবি আর মূর্ত্তি রাখা আছে।  

শুনলাম যেএই কাল ভৈরবের মন্দির কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আর কাশী এলে কালভৈরবকে একবার সব ভক্তই দর্শন করে পূজো দিয়ে যান্‌। আমরাও তাই করলাম।   

এই কালভৈরব  কিসের দেবতা? 

হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, কাল ভৈরবের মন্দিরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন শিবের রুদ্র রূপের এক মূর্তি। এই মন্দিরের প্রধান দেবতা, ভগবান কাল ভৈরব, ভগবান শিবের ভয়ঙ্কর প্রকাশ বলে বিশ্বাস করা হয়।  কাল ভৈরব হলেন শক্তির আধার। শিবের জ্বলন্ত প্রচণ্ড রূপকেই কাল ভৈরব হিসেবে ধরা হয়।  তাঁকে বলা হয় কাশীর কোতওয়াল বা কাশীর রক্ষাকর্তা।   হিন্দুদের বিশ্বাস, কালভৈরব প্রাচীন শহর বারাণসী ও শহরবাসীদেরও রক্ষা করেন।

হিন্দু পুরাণে বাবা কাল ভৈরবকে ঘিরে নানা কাহিনির উল্লেখ আছে। মনে করা হয়, তিনি হলেন মহাদেবেরই আর এক রূপ। কাল ভৈরবের মন্দিরে দর্শন করলে জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

আমার মনে পড়ে ১৯৬২ সালে, তখন আমি স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি, চীনের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবার পরে জনসাধারণ কে  অনুপ্রাণিত করার জন্যে রেডিওতে রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রায়ই বাজানো হতো – “হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত পানে চাহো…”

ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে পিন্ডদান

কালভৈরব মন্দির থেকে বেরিয়ে আমাদের আসল কাজ।  ভারত সেবাশ্রমের মন্দিরে মা আর আমার শ্বাশুড়ীর পিণ্ডদান। বেলা বারোটায় সময় দেওয়া আছে, তার একটু আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম। 

শহরের অপেক্ষাকৃত পরিস্কার জায়গায় বেশ চওড়া বড় রাস্তার ওপরেই ভারত সেবাশ্রমের মন্দির, আর থাকার জন্যে ধর্মশালা। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে একটি বড় মন্দির, এবং ডান দিকে একটি তিনতলা বাড়ী, সেখানে মনে হলো একটি হোটেল বা ধর্ম্মশালা আছে, বেশ কিছু পরিবারকে সেখানে দেখলাম, কাশীতে এলে অনেকেই এখানে এসে ওঠেন। বিশেষ করে বাঙালীদের জন্যে এই ধর্ম্মশালা খুব জনপ্রিয়, বোধহয় শুদ্ধ নিরামিষ বাঙালী খাবার, পরিস্কার থাকার জায়গা, আর সস্তা বলেই।  

আমাদের পুরোহিত ছোটু মহারাজ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।  দুজনে একসাথে পিন্ডদানের পুজো করলাম। পুরোহিত ভদ্রলোক সব কেনাকাটা এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন।

বেশ নিষ্ঠার সাথে তিনি পূজো করলেন, মনে হলো এই কাজে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের কাজ হয়ে গেল।

আমার মা আর আমার শ্বাশুড়ীর আত্মার শান্তি হোক। ওঁদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হলো পিন্ড পেতে। এক বছরের মধ্যে পিন্ড দেবার কথা, কিন্তু অবশ্য বাৎসরিক কাজ বাড়িতে করেছি এক বছর পরে। কিন্তু এখন তাঁদের আত্মার সদগতি হল, তাঁরা এখন নিশ্চিন্তে বৈতরনী পার করে স্বর্গে  চলে গেছেন। সেখানে তাঁদের এখন অপার শান্তি।

মনে মনে একটা দৃশ্য কল্পনা করছিলাম, মা’র অশরীরী প্রেতাত্মা  বৈতরণী পার হতেই দেখছেন, দিদা মামা মাসী বাবা এবং তাঁর অন্যান্য প্রিয়জনেদের প্রেতাত্মারা  তার জন্যে নদীর ওপারে অপেক্ষা করছেন। কত দিন পরে আবার তাঁদের সাথে মা মিলিত হলেন।  

ছোটু মহারাজ কে বিদায় জানাবার আগে তাঁর সাথে একটা ছবি তোলা হলো।

 বাটি চোখা

এর পরে ছেলেটি আমাদের নিয়ে গেল “বাটি চোখা” নামে একটি দামী রেস্তোরাঁয়। কাশীতে এই রেস্তোঁরাটি নাকি খুব বিখ্যাত।

ডাইনিং রুম টা দোতলায়। ঢোকার পথে  নীচে দেখি বেশ কিছু মহিলা ঘোমটা পরে ময়দা বেলছেন আর তরকারী কাটছেন। বেশ বড় রেস্তোরাঁ, আর বেশ ভীড় । মেনু হলো মোটা মোটা রুটির সাথে ডাল আর পাঁচমিশেলী তরকারী। গাইড ছেলেটিও খেলো আমাদের সাথে।  

এই খাবারটা নাকি এখানে প্রচন্ড জনপ্রিয়। আমার অবশ্য খাবারটা তেমন কিছু ভাল লাগলোনা।  বেশ অখাদ্যই বলা যায়। এত মোটা রুটি আর ডাল তার সাথে কিছুটা বিস্বাদ তরকারী – অন্ততঃ আমার কাছে – কে আর ভালবেসে খায়?

শেষ পাতে অবশ্য উত্তর ভারতের মিষ্টি  – বরফি, লাড্ডু, কালাকাঁদ, ইত্যাদি ছিল, সাথে  মিষ্টি  লস্যি।

বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি

লাঞ্চের পরে  আমরা গেলাম  BHU ক্যাম্পাস দেখতে। তখন বেলা প্রায় তিনটে।

একটা তো মাত্র দিন তার মধ্যে যতোটা পারি ঘুরে দেখা।

বেশ বড় আর সুন্দর সবুজ গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা সুন্দর BHU ক্যাম্পাস, এখন তার একটা ভাগ IIT হয়েছে।  কিন্তু যেহেতু একবারে শহরের মাঝখানে, তাই ক্যাম্পাসের ভিতর যেন শান্তি ও নীরবতার কিছুটা অভাব।  সাইকেল রিক্সা আর বাস চলছে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে কিছু লোক।

ছাত্রাবাসগুলো রাস্তার ধারে। 

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশ বাহিনী এখানে একদল বিদ্রোহী ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে। থিওসফির প্রচারে অ্যানি বেসান্ত এখানে এসেছিলেন। “সকল ধর্মের মানুষকে একই ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করতে এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধের প্রচার ভারতবাসীর মন থেকে সকল কুপ্রথা দূর করতে” তিনি এখানে সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। ১৯১৬ সালে এই কলেজটি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

আমাদের দেশের এটি একটি প্রধান এবং স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়, এখান থেকে আমার মামা স্বর্গীয় ধ্রুবনারায়াণ বাগচী ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করেছিলেন। পরে আমার মামাতো ভাই ভাস্বর ও তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখান থেকেই ইঞ্জিনীয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করে। আমার বন্ধুদের মধ্যেও অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে।   

সঙ্কটমোচন মন্দির

ক্যাম্পাসে ঘুরে আমরা গেলাম সঙ্কটমোচন – হনুমানের মন্দিরে। 

ভারত ও ভারতের বাইরে হনুমান মন্দির আছে অসংখ্য, তবে কাশীধামের এই সংকটমোচন মন্দিরটি সবচেয়ে জাগ্রত বলে পরিচিত।  হনুমানজী কাশীর এই মন্দিরে অবস্থান করে ভক্তদের জীবনের নানা সঙ্কট থেকে মুক্ত করেন।   

অনেকটা জায়গা নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ।  প্রাঙ্গনের ভিতরে অনেক বড় বড় গাছ,  ঢুকতেই বাঁ পাশে সংকটমোচন, আর ডানদিকে শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির। মন্দির দু’টি মুখোমুখি। ভাবটা এমন, রাম ছাড়া হনুমান চলবে না। হনুমান ছাড়া রামের এক পা যাওয়ার জো নেই।  

হনুমানজীর মন্দিরে হনুমান থাকবেনা তা তো আর হয়না। দেখি প্রকান্ড ল্যাজ ঝুলিয়ে  ডালে ডালে বসে আছে অনেক মুখপোড়া হনুমান। কাউকে প্রসাদ দিতে দেখলই তারা দল বেঁধে গাছ থেকে নেমে আসে। তাদের বেশ আগ্রাসী মনোভাব।

সংকটমোচন মন্দিরে সিঁদুর রাঙানো হনুমানজি ছাড়াও আছে বিশ্বনাথ মহাদেবের একটি লিঙ্গ বিগ্রহ। বিপরীতে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সীতা ও লক্ষ্মীজির সুসজ্জিত বিগ্রহ।

মন্দিরের সামনে ভীড় আর লম্বা লাইন। মাঝে মাঝেই ভক্তদের জোর গলায় আওয়াজ ভেসে আসছে “ভারত মাতা কি জয়!”  

বেনারসী শাড়ী

এর পরে বেনারসী শাড়ী কেনা।

গাইড ছেলেটি আমাদের নিয়ে গেল একটি গলির মধ্যে এক বিরাট শাড়ীর আড়তে। সেখানে দোতলায় মাটিতে বসে চারিদিকে শাড়ী বিছিয়ে আমাদের শাড়ী দেখালেন এক মধ্যবয়েসী  ভদ্রলোক – তাঁর চোখে মুখে কথা।  চমৎকার ব্যক্তিত্ব, রসিক মানুষ, খদ্দের কে বাগে আনার অসীম ক্ষমতা। তিনি দোকানের ম্যানেজার না মালিক ঠিক বোঝা গেলনা। কিন্তু সেলসম্যান হিসেবে দুর্দ্দান্ত। এঁর কাছে এসে কিছু না কিনে ফেরা প্রায় অসম্ভব। 

তিন খানা দামী শাড়ী তিনি অবলীলায় গছিয়ে দিলেন আমাদের।

অবশ্য আমাদের তো তিনটেই দরকার ছিল। দুই মেয়ে আর সুভদ্রা। ভালোই হলো ওরা পছন্দ করে কিনলো।  সামনে আমাদের বিয়ের সুবর্ণবার্ষিকী, সেই অনুষ্ঠানে মেয়েরা দু’জন এই বেনারসী শাড়ী পরবে।

আমার ছোটবেলায় বিশ্বনাথের গলির মোড়ে অনেক বেনারসী শাড়ীর দোকান ছিল, আমার মনে পড়ে একবার ছোড়দাদুর (দিদার ছোট ভাই দূর্গাপ্রসন্ন আচার্য্য, মা’র ছোটমামা) বড় মেয়ে রমা মাসীর বিয়ের বেনারসী কেনার ভার পড়েছিল মা’র ওপর। অনেক দোকান ঘুরে অনেক বাছাবাছি করে মা একটা বেশ দামী লাল বেনারসী পছন্দ করেছিলেন।

আমার ছোটবেলার কাশীর স্মৃতির মধ্যে বিশ্বনাথের গলিতে বেনারসী শাড়ীর দোকানে এক গাদা শাড়ীর পাহাড়, তার মধ্যে মা শাড়ী বেছে যাচ্ছেন, আমি পাশে বসে, আমার বয়েসী খুব মিষ্টি দেখতে একটি ছোট্ট মেয়ে – সম্ভবতঃ দোকানদারের মেয়ে – বিনুনী করে পরিপাটি চুল বাঁধা, একটা লাল ডুরে শাড়ি পরে এক পাশে বসে চুপ করে মা’র শাড়ী বাছা দেখতো, তাকেও ভুলিনি।

রাবড়ী, পান, আর সান্ধ্য নৌকাভ্রমণ

শাড়ী কিনে হোটেল ফেরার পথে বেনারসের বিখ্যাত রাবড়ী আর পান না খেলে কি করে হয়?

শেষে হোটেলে যখন পৌছলাম, তখনও বাইরে দিনের আলো। ঘরের পাশে বারান্দায় সামনে নদী দেখতে দেখতে চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজও একটা নৌকা ভ্রমণ হলো। প্রায় রেল ব্রীজ পর্য্যন্ত চলে গেলাম আজ।  তার পর মণিকর্ণিকা আর হরিশচন্দ্র ঘাটের শ্মশান দেখে অসি ঘাট পর্য্যন্ত গিয়ে ফিরলাম।

আজও রাত্রে দশাশ্বমেধ ঘাটে আর অসি ঘাটে গঙ্গারতি হচ্ছে দেখলাম, নদীর জলে আর ঢেউতে সেই আরতির আলোর ছায়া কাঁপছে।  

দেখতে বেশ লাগছিল। 

এবার মাত্র এক দিনের জন্যে কাশী এসেছিলাম আমরা। বড্ডই কম সময়। আর একটা দিন বেশী থাকলে আমরা সারনাথ আর রামনগরে কাশীর রাজার (নরেশ) প্রাসাদ আর দূর্গ দেখে আসতে পারতাম। কিন্তু এই ভাবেই এই ট্রিপ টা প্ল্যান করেছিলাম, তাই এখন আর কিছু করার নেই। পুপুকেও লন্ডনে ফিরতে হবে, তার ছুটি কম, ফেরার টিকিট ও কাটা হয়ে গেছে। কালকে দুপুরে আমাদের কলকাতার ফ্লাইট, পুপু আর আমি ঠিক করলাম যে ভোরবেলা দু’জনে মিলে নদীর ধার ধরে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্য্যন্ত হাঁটবো।

৫) তৃতীয় এবং শেষ দিন

আজ আমাদের ফেরা।  ব্রেকফাস্টের পরে হোটেল থেকে চেক আউট করে এয়ারপোর্ট।

তার আগে কথামতো ভোরবেলা আমি আর পুপু ঘুম থেকে উঠে একটু নীচে নদীর ধারে হেঁটে এলাম। একটার পর একটা ঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি, নদীর ধারে লোকের ভীড় বাড়ছে, কিছু কিছু জায়গায় পূজোয় বসেছে পুরোহিতেরা, তাদের যজমানেরা তাদের ঘিরে গোল হয়ে বসেছে। অনেকের খালি গায়ে পৈতে, অনেকের মাথা ন্যাড়া। সবাই ধর্ম্মপ্রাণ হিন্দু। নদীর পাড়ে প্রায়ই চোখে পড়ছে লাল রং এর শিব মন্দির, আর মন্দিরের পাশে বট বা অশ্বথ গাছ, তাদের ডালে বাঁদরের দল।

“নৌকা চড়বেন বাবু?” বলে অনেক বোটের চালকরা এসে আমাদের ধরছে। নদীতে অনেক মাছধরা নৌকা। মাছের লোভে তাদের পিছন পিছন উড়ে যাচ্ছে সাদা সারস পাখীরা। 

অনেকটা দূর হেঁটেছিলাম আমরা দু’জন সেদিন।

হরিশ্চন্দ্র আর মণিকর্ণিকা ঘাটে চিতাকাঠের স্তুপ রাখা। জ্বলন্ত চিতার ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস কিছুটা বন্ধ হয়ে আসে। মৃতের আত্মীয়রা এবং প্রিয়জনেরা মুখ ম্লান করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

ঘাটের পাশে উঁচু উঁচু লাল রং এর সব বড় বড় বাড়ী।  অনেক দূরে কিছুটা ছায়ায় ঢাকা রেল ব্রীজ। নদীর ওপারে চর, সেখানে গাছপালার মাঝে কিছু ঘরও চোখে পড়ে। ওই চরেও মানুষ বাস করে? কি জানি, হবেও বা।

সেদিন সকালে পুপুর সাথে কাশীর ঘাটে অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময়    মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলায় আমি আর আমার সমবয়েসী মাসতুতো ভাই রঞ্জু এরকম সারাদিন কাশীর ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম।

একবার ছিলাম শুধু আমি আর মা। সেদিন বোধহয় মাসীরা সবাই  ফিরে গেছেন, বাড়ীতে শুধু আমি আর মা। আমরাও পরের দিন ট্রেণ ধরে ফিরে যাবো। তাই আমাদের মন খারাপ।

মা বললেন চল্‌ মান্টু আমরা দু’জন নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি। সাধারণতঃ কাশীতে গেলে আমি মা’কে কখনো একা পেতামনা। আশে পাশে অনেকে থাকতো, দিদা, মাসীরা। তাছাড়া মা’র মধ্যে ভালবাসার প্রকাশ তেমন ছিলনা। জড়িয়ে ধরা বা মাথায় হাত বোলানো, বা আদর করা, এই সব মা’র স্বভাবে ছিলনা। বরং কারণে অকারণে  তাঁর শাসনেই আমি বেশী অভ্যস্ত ছিলাম।    

এখনো মা’র সঙ্গে কাটানো সেই পড়ন্ত সন্ধ্যয় কাশীর গঙ্গার ঘাটে হাঁটার  কথা মনে পড়ে।  বোধ হয় চৌষট্টি ঘাট থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্য্যন্ত হেঁটেছিলাম আমরা দু’জন। কিছু কি কথা হচ্ছিল আমাদের মা আর ছেলের মধ্যে? দুজনের পৃথিবী আলাদা, দুজনেই হয়তো নিজের নিজের চিন্তায় মগ্ন ছিলাম।

সেদিন আমার জন্যে একটা অপ্রত্যাশিত আনন্দ অপেক্ষা করে ছিল।

ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটি লোক গুড় আর বাদামের মিষ্টি চাকতি বিক্রী করছিল। আমার বোধ হয় একটু লোভ হয়ে থাকবে, কিন্তু আমি না চাইতেও  মা আমায় একটা চাকতি কিনে দিয়েছিলেন।  কি জানি হয়তো লোভী চোখে তাকিয়েছিলাম, মা লক্ষ্য করে থাকবেন। বেশী দাম ছিলনা, এক আনা বা দুই আনা হবে, কিন্তু সেই যুগে হয়তো অনেক। ছোটবেলায় ওই সব খাবার খুব প্রিয় হয়, নিজে কিনে খাবার তো সুযোগ ছিলনা, সেই জন্যেই হয়তো। 

খুব ভাল লেগেছিল মনে পড়ে। আবার একটু হালকা অস্বস্তিও হয়েছিল, কেননা ওই বয়সেও আমি জানতাম আমরা গরীব, জীবিকার জন্যে মা’কে চাকরী করতে হয়, মা’র কাছে হয়তো এটা একটা বাজে খরচ, তাছাড়া রাস্তার জিনিষ কিনে খাওয়াও তো মা পছন্দ করেননা।

কিন্তু আজ নিজে থেকেই …

মা’র কাছ থেকে তাঁর এরকম অপ্রকাশ্য অন্তঃসলিলা ভালবাসা পাবার আরও অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, কিন্তু কাশীর ঘাটে সেই সন্ধ্যায় আমায় বাদামের চাকতি কিনে দেবার ঘটনাটা  এই জন্যে এখানে লিখলাম যে এতদিন পরে বার্দ্ধক্যে পৌঁছে কাশীর ঘাটে এখন আমি আর আমার মেয়ে পুপু। সে এখন আমার জীবনে আমার মা’র জায়গাটা নিয়ে ফেলেছে। আমার মা’র মতোই আমার প্রতি তার অকৃত্রিম আর শর্ত্তহীন ভালবাসা।  তবে সেই  ভালবাসা আর তার দুশ্চিন্তা অবশ্য অনেক বেশী প্রকাশ্য।

যাই হোক, দু’জনে মিলে অনেকটা হাঁটলাম সেদিন ভোরে। হোটেলে ফিরে এসে স্নান সেরে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়লাম।

হোটেলের লোকেরা আমাদের মাল  পৌঁছে দিল বড় রাস্তায়, সেখানে তার গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিল ভোলা। সে আমাদের পোঁছে দিল কাশী এয়ারপোর্টে।

হোটেলের দুই কর্মচারী আর ড্রাইভার ভোলার সাথে ফেরার দিন

হস্তীদর্শন, পিনাওয়ালা,  শ্রীলঙ্কা, ফেব্রুয়ারী, ২০১২

১) শ্রীলঙ্কা – প্রথম দর্শন

আমরা কুয়েতের বন্ধুরা শ্রীলঙ্কা বেড়াতে এসেছি। কুয়েত থেকে রাতের ফ্লাইট ধরে ভোর চারটে তে আমরা কলম্বো তে land করলাম। কলম্বো এয়ারপোর্ট টা বেশ ভালই লাগল, অত ভোরে ভীড় ও কম, ভিসা আগে থেকেই করা ছিল, তাই ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসতে বেশী সময় লাগলোনা আমাদের কারুর। সবাই এক এক করে বেরিয়ে এসে একটা বিরাট হলঘরে জড়ো হলাম, সেখানে আমাদের জন্যে একটা বোর্ড হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট  Jet Wing Travel থেকে আসা একটি যুবক। বোর্ডে লেখা “Mr. Prodosh Mitra and Party”!

ছেলেটির নাম সুভাষ। বেশ চেনা বাঙালী নাম। তবে সে অবশ্য তামিল। এই ট্রিপে সে আমাদের গাইড। সুভাষ কে আমাদের বেশ ভাল লেগে গেল, সে বেশ প্রিয়দর্শন এবং আলাপী , তার কথাবার্ত্তা বেশ ভদ্র। অত সকালেও এয়ারপোর্টে দোকানপাট সব খোলা, ওখানকার স্থানীয় টাকা তোলা, টেলিফোনের সিম কার্ড কেনা ইত্যাদি নানা কাজে   প্রথম থেকেই সুভাষ এই সব নানা কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো।

তারপর বাইরে গিয়ে বাসে ওঠা। বেশ বড় বাস। আমরা যে যার মতো যে যেখানে পারি  সীট নিয়ে বসে পড়লাম।

আজ আমরা ক্যান্ডি যাবো। সারা রাত প্লেনে ঘুম হয়নি, চোখ জ্বালা করছে, সুভাষ বললো তোমাদের কাছেই নিগম্বো নামে একটা শহরে আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে তোমরা স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। তারপর আমরা ক্যান্ডি রওনা হব।

বাসের জানলা দিয়ে ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম, কলম্বো শহর ছাড়িয়ে এসেছি, জায়গাটা বেশ লাগছে, পরিস্কার রাস্তা, পাশে সুন্দর ছিমছাম বাড়ি, প্রায় সব বাড়ীর সামনে গেটের পাশে বুগনভিলিয়ার ঝাড় লালে লাল হয়ে ফুটে আছে। দক্ষিণ ভারতের (কেরালা, তামিলনাডু) সাথে মিল আছে আমার মনে হলো, যেন আমরা মাদুরাই বা কোয়েমবাটোরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে সুভাষ একটা মাইক হাতে নিয়ে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা, তার দুই মেয়ে, তাদের মধ্যে একজনের আবার আজই জন্মদিন! মেয়ের জন্মদিনে সে থাকতে পারছেনা, আমরা সমবেদনা জানালাম।

তার পরে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস। সেই বুদ্ধদেবের সময় থেকে শুরু।  

শুনতে শুনতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে রামায়ণের যুগের কথা ভাবছিলাম। ছোটবেলায় আমার রামায়ণের বইতে দুটো ছবির কথা আমার খুব মনে পড়ে। এক হলো হনুমান তার ল্যাজে আগুণ লাগিয়ে লঙ্কা শহরে এক বাড়ির ছাদ থেকে আর এক বাড়ির ছাদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর অন্য ছবিটা অশোকবনে সীতা, একটা গাছের তলায় বেদীতে বসে। তার চারিপাশে অনেক মহিলা, তারা সবাই মানুষের মতোই দেখতে, তাদের রাক্ষুসী বলে মনেই হয়না। একজন তো বেশ সুন্দরী, তিনি নিশ্চয় বিভীষণের বৌ সরমা।

এই অশোকবনটা কোথায়? সেখানে একবার গেলে হয় না?

আমাদের ছোটবেলায় Ceylon Radio খুব জনপ্রিয় ছিল, শ্রীলংকার নাম ছিল সিংহল।

আমাদের মধ্যে অমিতাভর ইতিহাস এর জ্ঞান সবচেয়ে বেশী, সে বলল সিংহল নামটা এসেছে বাংলার রাজা বিজয় সিংহের নাম থেকে। এই নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা আছে।

 অমিতাভর প্রায় পুরো কবিতা টা মুখস্থ, সে গড়গড় করে আবৃত্তি শুরু করে দিলঃ

আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়/

সিংহল নামে রেখে গেল নিজ শৌর্য্যের পরিচয়/ ইত্যাদি।

এই সব হতে হতে আমরা নিগম্বো পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রের তীরে Jet Wing Group এর বিরাট হোটেল।

আমি তুতু কে বললাম বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে তার সাথে নিগম্বোর খুব মিল, বলো তো কি? আমাদের সকলের শরীরে ওই জিনিষটা আছে।

তুতু ঝঙ্কার দিয়ে উঠে আমায় এক ধমক দিয়ে বলে উঠলো জানি জানি, তোমাকে আর বলতে হবেনা।

এ কি রে? দিল্লীর মেয়ে হয়ে তুতু বাংলা এত ভাল জানলো কি করে?

২) মানবিক আর পাশবিক

নিগম্বোর  হোটেল টা বেশ লাগলো আমাদের, স্নান টান সেরে রাতজাগার ক্লান্তি ধুয়ে ফেলে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে এলাম সবাই রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের বিরাট কাঁচের জানলা দিয়ে দেখা যায় পাশেই বিরাট সমুদ্রসৈকত, ধূ ধূ বালি, তার মধ্যে জেলেরা তাদের জাল শুকোচ্ছে, কিছু নৌকা ও সেই বালির মধ্যে দেখা গেল।

আজকে আমরা ক্যান্ডি যাবো । রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শহর।

ক্যান্ডি যাবার পথে অনেক গুলো স্টপ্‌ যার মধ্যে প্রথম হল  পিনাওয়ালা হস্তী অনাথ আশ্রম   (Elephant Orphanage), United Nations এর হেরিটেজ সাইট্‌, পৃথিবীর বৃহত্তম Elephant reserve,  এবং পর্য্যটকদের জন্যে শ্রীলঙ্কার একটি অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। 

নিগম্বো থেকে পিনাওয়ালা খুব বেশী দূর নয়, ঘণ্টা দেড়েকের পথ। এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে, দু’দিকে সবুজ পাহাড়, মাঝে মাঝে পথের পাশে চালাঘর আর দোকান, কিছু হোর্ডিং ও চোখে পড়লো, তাতে শাড়ি আর গয়নার বিজ্ঞাপন, শ্রীলঙ্কার সুন্দরী মেয়েরা সেজেগুজে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের চোখে তাদের আহামরি কিছু সুন্দর লাগছেনা যদিও। মাহিলা জয়বর্ধন আর কুমার সঙ্গকারার কিছু ছবি ভেবেছিলাম দেখবো, কিন্তু না, আমাদের দেশের মত এখানে ক্রিকেটাররা মডেলিং এ আসেনি, তারা মন দিয়ে তাদের খেলাটাই খেলছে।

হাতি দের নিয়ে মানুষের মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে, তার প্রধান কারণ বোধহয় তাদের ওদের বিরাট শারীরিক আয়তন। পৃথিবীর অন্যান্য জীবজন্তুর সাথে তুলনা করলে হাতিদের কেমন যেন আলাদা বলে মনে হয়, অতবড় শরীর, লম্বা শুঁড়, তারা যেন সেই আদিম ডাইনোসরদের বংশধর, মানুষের বহু আগে থেকে তারা এই পৃথিবীতে বাস করছে। ফলে মানুষদের থেকে আরো লম্বা সময় ধরে তাদের বিবর্তন (evolution) হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।

আমাদের এই পৃথিবীতে মানুষের সাথে বসবাস করছে অসংখ্য জীব জন্তু, পতঙ্গ, পাখী, জলচর প্রাণী, মানুষের মতই তারাও লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পেরিয়ে এসেছে  বিবর্তনের নানা ধাপ। আমরা সাধারণ মানুষেরা তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিনা, চিড়িয়াখানায় তাদের খাঁচায় বন্দী অবস্থায় অথবা জঙ্গল সাফারীতে জীপে চড়ে অভয়ারণ্যে প্রকৃতির কোলে তাদের নিজেদের স্বাধীন পরিবেশে দেখি। একই পৃথিবীতে মানুষের সাথে এদের বাস, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তাদের কোন ভূমিকা নেই।

আমরা সভ্য মানুষেরা আমাদের মন অনূভূতি আর মস্তিষ্ক আছে বলে গর্ব্ব করি, পৃথিবীর জীবজগত কে আমাদের সমকক্ষ বলে মনে করিনা। আমাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল যে আমরা হলাম বুদ্ধিমান আর মানবিক, আর ওরা হলো বুদ্ধিহীন, পাশবিক, হিংস্র। প্রকৃতি এবং বিবর্ত্তন ওদের আমাদের সমতুল্য করে তৈরী করেনি।  

প্রানীবিজ্ঞানীরা কিন্তু আমাদের চারিপাশের জীবজগতের নানাবিধ কান্ডকারখানা দেখে একান্তভাবেই  বিস্মিত এবং অভিভূত।

পরিযায়ী পাখিরা অথবা কিছু জাতের প্রজাপতি কি আশ্চর্য্য দক্ষতায় লক্ষ লক্ষ মাইল আকাশে পরিক্রমা করে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যায়। অলিভ রিডলি কচ্ছপেরা বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ডিম পেড়ে সমুদ্রে ফিরে যায়।  ফুলেরা ঠিক এক সময়ে সকালে অথবা বিকেলে নিয়ম করে ফুটে ওঠে প্রজাপতিদের আকর্ষন করার জন্যে।

এসব কি করে হচ্ছে?  এর থেকে কি প্রমাণ হয়না যে প্রাণীদের মধ্যেও মানুষের মতই সময় আর দিক নির্নয় করার ক্ষমতা আছে, নিজেদের মধ্যে  পারস্পরিক ভাব প্রকাশ ও বিনিময়ের একটা ভাষাও তাদের মত করে আছে?

বন্য প্রাণীদের নিয়ে জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানে এখন অনেক গবেষনা হচ্ছে, এবং নানা জায়গায় বিজ্ঞানীরা এই তথাকথিত  “মনুষ্যেতর” প্রাণীদের মধ্যে এক অদ্ভুত ও সূক্ষ্ম “মানবিক” ব্যবহার দেখতে পাচ্ছেন। অনেক জীবের মধ্যেই তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন ভালবাসা, মাতৃপ্রেম, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা, পরোপকার এমনকি আত্মদান, যা আমরা আমাদের নিজেদের একচেটিয়া বলেই এতদিন ভেবে এসেছি।  

পাশবিক কথাটা এসেছে পশু থেকে।  কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাশবিকতা ক্রুরতা হিংসা ইত্যাদি নানা বিশ্রী দোষ পশুদের তুলনায় মানুষের মধ্যে অনেক বেশী।  

হাতিদের নিয়ে ও অনেক গবেষনা হয়ে চলেছে।  

বিজ্ঞানীদের মতে হাতি একটি অতি মহান, বুদ্ধিমান এবং সামাজিক প্রাণী। অতবড় শরীর সত্ত্বেও তারা প্রচন্ড agile, উঁচু পাহাড়ে তারা দরকার পড়লে তরতর করে উঠে যেতে পারে। তাদের ওই দুলকি চালে হাঁটা দেখে মনে হয় তারা বেশ নিরীহ প্রাণী। সহজেই তাদের পোষ মানানো যায়। আমাদের ছোটবেলায় কলকাতা চিড়িয়াখানায় হাতির পিঠে চড়া হতো। একটা কনক্রীটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে একটা প্ল্যাটফর্মে উঠে আমরা ছোটরা হাতির পিঠে উঠে সারা চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াতাম। এখন বোধ হয় হাতির পিঠে চড়া বন্ধ হয়ে গেছে। 

জয়পুরে অম্বর প্যালেসেও হাতির পিঠে চড়ে ওপরে ওঠার আর নীচে নামার বন্দোবস্ত আছে। সেখানেও ভয় করেনি, বরং দুলুনী টা বেশ ভাল ই লেগেছে। দক্ষিণ ভারতে  – কেরালা বা তামিলনাডূতে তো মন্দিরে, পথে ঘাটে অনেক পোষমানা হাতি চোখে পড়ে। আমাদের দেশে সার্কাসে ও অনেক  হাতির খেলা দেখেছি। ব্যাঙ্ককে একবার হাতিদের ফুটবল খেলতে দেখেছিলাম।   

কিন্তু বন্য হাতি দের একটু ভয় পেতেই হয়, এমনিতে শান্ত হলে কি হবে তারা হঠাৎ কোন কারণে একবার রেগে গেলে খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন তারা মানুষকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলে, শুঁড় দিয়ে তুলে মাটিতে আছাড় মারে। “মদমত্ত হস্তী” কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। মদ ঠিক রাগ নয় যদিও, মদ হলো ক্ষমতার অহঙ্কার, তবু একটা রিপুই তো। সব প্রাণীদের মত হাতিরাও রিপুর শিকার। বাংলার পুরুলিয়া বাঁকুড়া জেলা আর ঝাড়খণ্ড ওডিশার বর্ডারে দলমা বলে একটা জায়গায় জঙ্গল থেকে অনেক হাতি মাঝে মাঝে লোকালয়ে চলে আসে। তখন মানুষের  সাথে তাদের নানা ভাবে সংঘাত শুরু হয়, শস্যের ক্ষেত লন্ডভন্ড করে তারা চলে যায়, রেল লাইনে কাটা পড়ে মারা যায় কিছু হাতি। খবরের কাগজে সেই ছবি দেখি।   

আমাদের বাংলার হাতি বিশারদ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী আমাদের দেশের হাতিদের নিয়ে বিশদে গবেষনা করেছেন। তাঁঢ় লেখা গবেষনা পত্র ও বইতে তিনি হাতিদের স্বভাব, জীবনযাত্রা, এবং ব্যবহার সম্পর্কে এমন সব অনেক অজানা তথ্য জানিয়েছেন, যা অবাক করার মত।

তাঁর লেখা পড়ে জানা যায় যে হাতিদের মনে এমন একটা সহানুভূতি আর কোমল দিক আছে, যা কেবল মাত্র মানুষদের সাথে তুলনীয় বলে অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সম্প্রতি একটি লেখা পড়ে জানলাম যে প্লেনে করে হাতিদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাবার সময় তাদের মাঝখানে নাকি অনেক মুরগীর ছানা রেখে দেওয়া হয়।

কেন?

কারণ হাতিরা নাকি যাতে তাদের ভারী পায়ের চাপে সেই সব মুরগীর ছানারা চাপা পড়ে মারা না যায়, সেই ভয়ে  সারাটা সময় তারা নাকি একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ও নড়াচড়া করেনা। যার ফলে প্লেন আকাশে উঠলেও কোন কাঁপন বা ঝাঁকুনী অনুভূত হয়না।

ছোট ছোট মুরগী ছানাদের প্রতি হাতিদের এই আচরণ মানবিক ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?

বিজ্ঞানীরা হাতির ব্রেণে এমন সব নিউরন পেয়েছেন, যা কিনা মানূষের ব্রেণের নিউরণের সমতুল্য।

Fascinated by their noble nature, scientists have studied the elephant’s brain and discovered spindle cells—rare neurons also found in humans. These are associated with self-awareness, empathy, and complex social perception.

In other words, an elephant is not only physically huge; it’s an emotional giant, tooIt feels, understands, and acts with a silent wisdom.

কিন্তু হাতিদের নিয়ে যে কথাটা আমাদের সবাইকে বিস্নিত করে, তা হলো এই যে যখন হাতিরা বুঝতে পারে যে তাদের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তখন তারা দল ছেড়ে বিজন কোন জায়গায় চলে যায়, যেখানে তারা একাকী মৃত্যুবরণ করে।

কেন? 

বিজ্ঞানীরা বলেন যাতে ছোটরা তাদের মৃত্যু দেখে কষ্ট না পায়।

তাদের মনে এত সমবেদনা, এত সহমর্ম্মিতা? এ তো আমাদের মানুষদের মতোই, কিংবা হয়তো আরো বেশী।  

মানুষ এবং জীবজগতে অন্যান্য অনেক প্রাণীর মত হাতিরাও সমাজবদ্ধ জীব, তারা দলবদ্ধ হয়ে থাকে,  এবং যেখানেই যায় দলপতিকে অনুসরণ করে যায়।  আমি কেনিয়ার তৃণভূমি (সাভানা) আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে দলবদ্ধ হাতির গজেন্দ্রগমন প্রত্যক্ষ করেছি। সে এক অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য।

 ৩) পিনাওয়ালা হস্তী অনাথাশ্রম – হাতিদের স্নান

আমাদের বাস পিনাওয়ালা তে এসে দাঁড়ালো।

 ১৯৭৮ সালে পাঁচটি অনাথ (orphan)  বাচ্চা হাতি কে নিয়ে পিনাওয়ালার এই অনাথ আশ্রমের কাহিনীর শুরু, এখন হাতিদের সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আশি।  প্রতি বছর এখান থেকে কিছু  হাতি মন্দির বা চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় পঞ্চাশ জন মাহুত ওই হাতিদের দেখাশোনা করে।

শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে এক সময়  তিন হাজারের ও বেশী হাতি ছিল, প্রধানতঃ Poaching এর জন্যে তা ক্রমশঃ কমতে থাকে।  অনাথ শিশু হাতিদের দেখভাল করা তো বটেই, তা ছাড়াও এই Orphanage তৈরী করার পিছনে একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাতিদের বংশরক্ষা, প্রতিপালন আর বংশবৃদ্ধি (conservation আর breeding), সেই উদ্দেশ্য এখন স্পষ্টতই সফল।

ধৃতিকান্ত লাহিড়ী মশায় লিখেছেন একটি বাচ্চা হাতি নাকি  কোনভাবে একবার দলছুট হয়ে লোকালয়ে এসে গিয়েছিল,    তাকে গ্রামবাসীরা বিপন্ন অবস্থায় দেখে দুধ টুধ খাইয়ে আবার তাকে দলের কাছে ফিরিয়ে দিতে গিয়েছিল, কিন্তু সেই দলে তাকে আর ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। তার গায়ে নাকি মানুষের গন্ধ লেগে গিয়েছিল!

এই খবরটা পড়ে সেই শিশু হাতিটির জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল মনে আছে, আর তার মা’র জন্যেও। হাতিদের যূতবদ্ধ দলীয় বা পারিবারিক জীবনে নানা অলিখিত নিয়ম আছে, যা পরিবারের বা দলের সবাই কে মেনে চলতে হয়। ওই মা’কেও তাই সেই নিয়ম মেনে তার শিশুটিকে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।আহা রে!

বেচারা!

পিনাওয়ালার শুরুটাই অনাথ শিশু  হাতিদের নিয়ে, তাদের সবার গায়েই মানুষের গন্ধ লেগে গেছে, তারা আর কোন দিন বনে ফিরে যেতে পারবেনা।

চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা   ছোট গ্রাম পিনাওয়ালা, সেই গ্রামে দশ hectare মত জায়গা নিয়ে একটা নারকেলের plantation,  তার ভেতরে গড়ে উঠেছে এই বিখ্যাত হস্তী অনাথআলয়। 

মেন বাস রাস্তা থেকে দেখলাম একটা গলি ঢুকে গেছে ভেতরে, সেখানে সারি সারি দোকান,  টুরিস্ট দের ভীড়, ফেরিওয়ালা রা “এটা নেবেন স্যার, ওটা নেবেন স্যার” বলে চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে। সুভাষ বলল ওই গলি দিয়ে একশো মিটার মত এগোলেই Maha Oya, ওয়া নদী, সেখানে রোজ সকালে বিকেলে হাতির দল কে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাস্তা ক্রস করে দল বেঁধে আমরা গলিতে ঢুকে পড়লাম। দু’পাশে দোকান, তাতে প্রায় সব জিনিষেই হাতির মোটিফ আঁকা। সে শাড়ি হোক কি গয়না, কি ঘর সাজাবার জিনিষ। হস্তীশিল্প যাকে বলে।

হাতির dropping (বাংলায় হাগু) শুকিয়ে chemically treat করে তাই দিয়েও নানা জিনিষ তৈরী করে বিক্রী করছে লোকে। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি একটা বাচ্চা হাতির ছবি, সে একটা কমোডের ওপর বসে পটি করছে। নন্দাকে সেই সাইনবোর্ড টা দেখাতেই সে “উঁ হুঁ! ইন্দ্রজিৎ!”, বলে নাকে শাড়ির আঁচল দিয়ে Vibration mode এ চলে গেল। নন্দার একটু শুচিবাই আছে, নোংরা কিছু দেখলে বা শুনলে গা ঘিনঘিন করে, সে তখন Vibration mode এ চলে যায়, সেটা দেখার জন্যে আমরা প্রায়ই মজা করে তার সামনে নানা গা ঘিনঘিন  করা কথা বলি।

গলির শেষে এসে দেখি বেশ খোলা একটা জায়গা, পাথরের টিলার মধ্যে দিয়ে ওয়া নদী বয়ে যাচ্ছে, জল বেশী গভীর নয়,  এক পাল হাতি সেই ওয়া নদীর জলে গা ডুবিয়ে স্নান করছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

হাতিদের সম্বন্ধে ইউরোপের রেনেসাঁস যুগের বিখ্যাত শিল্পী বিজ্ঞানী ও দার্শনিক লিওনার্ডো দা ভিঞ্চি এর স্মরনীয় উক্তি ছিলঃ

The elephant embodies righteousness, reason, and temperance. The elephant enters the river and bathes with a certain dignity, as if wishing to purify itself from all evil.

লিওনার্ডো বর্ণিত হাতিদের সেই পুণ্য স্নান আমরা দু’চোখ ভরে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে। বিশেষ করে ভাল লাগলো বেশ কিছু শিশু হাতিকে দেখে। তারা তাদের মা’দের পিছনে কিছুটা মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছোট শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে আরাম করে স্নান করছে।

চারিদিকে বিদেশী ট্যুরিস্টদের দের ভীড়, ক্যামেরার অবিশ্রান্ত ক্লিক ক্লিক আওয়াজ!

আধঘণ্টা মত থাকার পরে হঠাৎ মাইকে ঘোষনা করে সবাইকে জানানো হলো, এবার স্নান শেষ , রাস্তা দিয়ে হাতিদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তাই রাস্তা খালি করুন। ওদের পথ ছেড়ে দিন।

সরু গলি, দু’পাশে দোকান আর মানুষজন, তার মধ্যে দিয়ে লাইন বেঁধে ওই বিশাল হাতিরা হেলতে দুলতে মাহুত দের পিছনে বাধ্য ছেলের মত  ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে,  কোন বিশৃঙ্খলা নেই, কোন হুড়োহুড়ি নেই, কেমন যেন একটা অবিশ্বাস্য surreal দৃশ্য বলে আমার মনে হলো।  

স্বপ্নের মত অনেকটা।

মেন রাস্তা ক্রস করে হাতির দল রাস্তার ওপাশে নারকেল গাছের বনে  ঢুকে গেল, সেখানেই ওদের আস্তানা বোধ হয়, আমরা তাদের পিছন পিছন বেরিয়ে এসে আমাদের বাসে ওঠার আগে পাশে একটা দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটা করে শেষে জমিয়ে ডাবের জল খেলাম ঢকঢক করে।

 আশ্চর্য্য ভ্রমণ – গোপালপুর (২২ – ২৬ আগস্ট, ২০২২)

পূর্ব্বকথা

আমরা স্কুলের তিন বন্ধু অমিতাভ, দীপঙ্কর আর আমি গোপালপুর বেড়াতে যাচ্ছি। 

অনেক আলোচনার পরে গোপালপুর যাওয়া ঠিক হয়েছে।। কাছেই পুরী আর দীঘা আছে, কিন্তু দুটোই চেনা এবং বড্ড ভীড়। গোপালপুরে ওবেরয় দের পাম বীচ রিসর্ট হোটেলটা বেশ upmarket, এখন অবশ্য মেফেয়ার নামে একটা চেন সেটা কিনে নিয়ে renovate করে অনেক বাড়িয়েছে, সেখানে সমুদ্রতট ও শুনেছি খুব চওড়া আর পরিস্কার আর ভীড়ও কম।

আমি কখনো সেখানে যাইনি, কিন্তু ছোটবেলায় সুভদ্রা মা বাবার সাথে গেছে একবার। আমরা দু’জনেই গোপালপুরে যেতে রাজী। অমিতাভ সুজাতারা বিয়ের পরে ১৯৭২ সালে সেখানে হানিমুন করতে গিয়েছিল। সেখানে অনেক বছর পরে গিয়ে আর একবার সেই পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরে পাবার জন্যে তারাও যেতে রাজী। আর দীপঙ্কর সেখানে একসময় Institute of Chartered Accountant (East India Chapter) এর সেক্রেটারী পোস্টের ইলেকশনে জেতার জন্যে উড়িষ্যা চষে খেয়েছে, জায়গাটা তাই এখনো তার হাতের পাতার মত চেনা। সেও রাজী।

ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে নির্জ্জন এক সমুদ্রের বেলাতটে কিছুদিন একসাথে কাটানোটাই আসল উদ্দেশ্য। আমাদের তিনজনের অনেকদিনের বন্ধুত্ব, আমরা তিন জনেই সারা পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু একসাথে আমাদের বেড়ানো এই প্রথম।   

গোপালপুরে হাওড়া থেকে ট্রেণে করে বেরহমপুর স্টেশনে ভোরবেলা নেমে গাড়ী করে হোটেলে যাওয়া যায়। সেখান থেকে গোপালপুর বেশী দূর নয়। কম বয়েসে দীপঙ্কর আর অমিতাভ ট্রেণেই গোপালপুর গেছে, হোটেল থেকে স্টেশনে গাড়ীও পাঠিয়ে দেবে বললে। তবে এই বয়সে ট্রেণের থেকে প্লেনে যাওয়া টাই আমাদের কাছে বেশী সুবিধের মনে হলো। আজকাল প্লেনের টিকিট আর ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস স্লীপারের ভাড়া প্রায় একই। তাই খরচও তেমন কিছু বেশী নয়। দমদম থেকে সকালের প্লেনে ভুবনেশ্বর পৌঁছে সেখান থেকে বড় একটা গাড়ী ভাড়া করে গোপালপুরে হোটেলে পৌঁছনোটাই শেষ পর্য্যন্ত ঠিক হলো।

ভুবনেশ্বর থেকে গোপালপুর ১৭০ কিলোমিটার, গাড়ীতে যেতে প্রায় চার ঘন্টা লাগবে, সেটাই একমাত্র downside। রাস্তা (ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৬) অবশ্য খুব ভাল, দীপঙ্কর জানালো।

ঠিক হলো আমরা বেরোব ২২শে আগস্ট, ফিরবো ২৬শে আগস্ট, ২০২২। হোটেলে চার রাতের রিসার্ভেশন করলো অমিতাভ। দীপঙ্কর কাটলো প্লেনের টিকিট। সুভদ্রা ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট থেকে গোপালপুর মেফেয়ার পাম বীচ হোটেল পর্য্যন্ত যাবার গাড়ীর বন্দোবস্ত করে ফেললো।

আজকাল এসব কাজ করা যায় বাড়ীতে বসে একটা মোবাইল ফোন থেকে। টেকনোলজী কা কেয়া খেল্‌ হ্যায়!    

প্রথম দিন ২২শে আগস্ট, ২০২২

১) আমাদের যাত্রা হলো শুরু  

২২/৮/২২ সকালে দমদম এয়ারপোর্টে চেক ইন করে পাঁচজনে গিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসে গল্প করছি। দীপঙ্কর খোঁজ নিয়ে এসে জানালো যে আমাদের প্লেন এখনো এসে পৌঁছয়নি। তাই প্লেন ছাড়ার এখনো বেশ দেরী। আমি আর অমিতাভ এর মধ্যে একটু কফি খেয়ে এলাম। কোথাও বেড়াতে যাবার আগে এই সময়টা আমার বেশ লাগে, সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে একটা অষ্পষ্ট ভাল লাগা, উত্তেজনা।

ইতিমধ্যে দীপঙ্করের বাড়ী থেকে একটা ফোন এলো। দীপঙ্কর দেখলাম ফোনটা পেয়ে বেশ একটু রেগে গিয়ে বলছে, “কি? কেক আর ফুল রেখে গেছে? কে? কি নাম?” তার একটু পরে শুনলাম বলছে, “ঠিক আছে কেকটা তোমরা খেয়ে নাও আর ফুলগুলো সব ফেলে দাও~”

বাড়ীর কাজের লোকের ফোন, যা বোঝা গেল। কেউ একজন দীপঙ্করকে কেক আর ফুল পাঠিয়েছে। কিন্তু এতে রেগে যাবার কি আছে? সুজাতা বললো “বুঝলেনা, এক নাছোড়বান্দা মহিলা…”

আমি বললাম “তা তো বুঝলাম, কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে আজ দীপঙ্করের জন্মদিন নাকি? তাহলে তো হোটেলে গিয়ে সেলিব্রেট করতে হবে!”

দীপঙ্কর সজোরে প্রতিবাদ করে বললো “আরে ভাই, না না, আজ আমার জন্মদিন নয়।” দীপঙ্করের প্রায় সব কথাই “আরে ভাই” দিয়ে শুরু হয়। 

অমিতাভ বললো “কাল দীপঙ্করের জন্মদিন, আমরা হোটেলে কাল সেলিব্রেট করবো!”

বেশ বেশ, বেড়ানো এবং জন্মদিন – একসাথে দুই মজা।

মাত্র দেড় ঘন্টার প্লেন জার্নি ভালোই হলো, কিছু বোঝার আগেই নির্ঝঞ্ঝাটে সময় মত ভুবনেশ্বর পৌঁছে গেলাম। দীপঙ্করের সেক্রেটারী খাবারের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, স্যান্ডুইচ আর Mango juice, তা ছাড়াও আমাদের সাথে কিছু কেক বিস্কুট ইত্যাদি ছিল। সেগুলোর ও সদব্যবহার হলো।

গাড়ী এসে গেল ফোন করতেই। মালপত্র তুলে বেরিয়ে পড়লাম।

ভুবনেশ্বর শহরটা বেশ লাগছিল গাড়ীর জানলার বাইরে, ছিমছাম সবুজ, low skyline, পরিস্কার চওড়া রাস্তা ঘাট, আর একবার শহরের বাইরে আসার পরে রাস্তার দুই পাশে একের পর এক স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়, বেশীর ভাগই বেসরকারী মনে হলো। দীপঙ্কর বললো উড়িষ্যা হলো দেশের মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে। দেশের নানা প্রদেশ থেকে ছেলে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে।

গাড়ীর ভেতরে যেতে যেতে নানা গল্প হচ্ছে, বেশীর ভাগ গল্প দীপঙ্করের। সে কম বয়সে এখানে এসে Institute of Chartered Accountants এর সেক্রেটারী হবার ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পেন করতে এসে প্রায় সব নামকরা Chartered Accountancy firm এর পার্টনার দের সাথে দেখা করেছিল, পরে সে নির্ব্বাচনে জিতে ICA Eastern Chapter এর সেক্রেটারী হবার পরে সেই যোগাযোগ আরো গাঢ় হয়, এবং এদের অনেকের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়। তার নিজের ব্যবসার জন্যেও এই যোগাযোগ এবং বন্ধুত্ব খুব জরুরী।

এই সব কারণে উড়িষ্যার এই দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের সাথে তার পরিচয় খুব গভীর।          

এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অডিটর যিনি কিনা উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের ব্যক্তিগত কাজ দেখেন, তিনি হলেন দীপঙ্করের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি নাকি প্রতি বছর তাকে নিজের বাগানের প্রচুর আম পাঠান। গাড়ীতে যেতে যেতে দীপঙ্কর সেই ভদ্রলোককে ফোন করে জানিয়ে রাখলো সে গোপালপুর যাচ্ছে এবং রাত্রে হোটেল থেকে ফোন করে কথা বলবে।

এরকম জনসংযোগ না থাকলে ব্যবসা বাড়ানো যায়না। দীপঙ্করের চার্টার্ড একাউন্টেসী ফার্মের ব্যবসা হু হু করে বেড়ে চলেছে।   

কিছুদূর পরে একটা ছোট জনপদ পড়লো রাস্তার দুই পাশে অনেক ভীড় জটলা, কিছু দোকান। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা “কুনা কাফে।” 

সুভদ্রা বললো কি অদ্ভুত নাম, কুনা কাফে।

দীপঙ্কর খুব গম্ভীর মুখ করে বলল “কুনা কাফে মানে কি জানো তো? এই কাফে টা হলো ঘরকুনো লোকেদের বাড়ীর বাইরে একমাত্র কফি খাবার জায়গা।”

সুজাতা একটু হেসে প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতে বললো, “দীপঙ্করের যত সব বাজে কথা!”

এই রকম ভাবে দীপঙ্করের গল্প আর অনর্গল ফাজলামি ভরা কথা শুনতে শুনতে আমরা যখন গোপালপুর পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে।

মেফেয়ার পাম বীচ হোটেলটা বেশ ঝাঁ চকচকে। ঢুকেই বিশাল লাউঞ্জ। এই পাঁচতারা হোটেলটা প্রথমে ওবেরয়দের ছিল। দেশের মধ্যে Premier Deluxe luxury resort হিসেবে গোপালপুরের ওবেরয় পাম বীচ হোটেলের খুব সুনাম ছিল। মেফেয়ার গ্রুপ তাদের কাছ থেকে প্রপার্টিটা কিনে নিয়ে এখন অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে শুনেছি। তাছাড়া আগে একতলা ছিল, এখন দোতলা হয়েছে। 

যাই হোক, হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে আমাদের ঘরের চাবি আর মালপত্র ঘরে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করে ঘরে যাবার পথে দীপঙ্কর রিসেপশনের ছেলেটাকে একটু হেসে বলে গেল, “আমাদের ভালো ভাবে দেখাশোনা কোরো কিন্তু, নাহলে দিলীপের কাছে খবর চলে যাবে!”

দিলীপ রায় হলো মেফেয়ারের মালিক, আর দীপঙ্করের বন্ধু।

২ আড্ডা আর ডিনার   

হোটেলটা 5 Star Deluxe, তাই বেশ সাজানো গোছানো ঝকঝকে। দামী কার্পেটে ঢাকা মেঝে। আমাদের তিনটে ঘর দোতলায়। আমাদের আর অমিতাভদের ঘর পাশাপাশি, দীপঙ্করের ঘর সামান্য একটু দূরে। বেশ বড় ঘর, উঁচু সিলিং। ঘরের পাশে একটা লম্বা ব্যালকনি, সেখানে চেয়ার টেবিল সাজানো, বড় কাঁচের জানলা দিয়ে দূরে সমুদ্র দেখা যায়, কিন্তু এখন অন্ধকার, কাল সকালে সেখানে চা নিয়ে বসে গল্প করা যাবে। দীপঙ্করের ঘরে ব্যালকনি নেই। ওর বুকিং একজনের জন্যে, তাই বোধ হ্য় ব্যালকনি ছাড়া ঘর। 

মালপত্র রেখে হাত পা মুখ ধুয়ে আমরা দীপঙ্করের ঘরে গিয়ে বসলাম। ডিনারে যাবার আগে দীপঙ্করের আনা দামী হুইস্কির সাথে একটু আড্ডা হোক। সাথে অনেক চানাচুর আর বাদাম ও আনা হয়েছে।

দীপঙ্কর তিনটে খুব নামী দামী, স্কচ হুইস্কির বোতল এনেছে, যদিও আমি কোনটারই নাম শুনিনি, কিন্তু গলায় ঢেলেই বুঝতে পারছি এর জাত আলাদা, এই তরলে গলা জ্বলেনা, একটা ঝিমঝিমে নেশা হয়। অভ্যাস মত সাথে কচর মচর করে হুইস্কির সাথে চানাচুর আর বাদাম খাচ্ছি হঠাৎ দীপঙ্কর বললো, “ইন্দ্রজিৎ, এই মালের সাথে কোন কিছু খাওয়ার নিয়ম নেই ভাই, শুধু না গলায় ঢাললে এর স্বাদ বুঝবেনা।”

সুভদ্রা বলল “দ্যাখোনা ইন্দ্রজিৎ তো সাথে বিস্কুট না থাকলে চা খায়না। যেন বিস্কুট খাবার জন্যেই ও চা খায় মনে হয়। আর যে কোন ড্রিঙ্কের সাথে ওকে বাদাম চিপস বা মাছের চপ দিতেই হবে।” আমার নামে কিছু বলার সুযোগ পেলে সুভদ্রা ছাড়েনা।

চানাচুর আর বাদাম বাদ দিয়ে শুধু দীপঙ্করের দামী হুইস্কি খেতে কিন্তু বেশ ভাল লাগলো, অস্বীকার করবোনা।

আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। এর মধ্যে দীপঙ্করের সেই বন্ধু ফোন করে খবরাখবর নিলেন। আমাদের বেড়াবার কি প্ল্যান ওনাকে জানালে উনি সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। বালুগাঁও এর মাছের বাজার অথবা চিল্কা হ্রদে নৌকাবিহার, কাছাকাছি সব দর্শনীয় স্থানেই তাঁর অনেক চেনশোনা। চিল্কায় পান্থনিবাস হোটেলে আমাদের লাঞ্চের ব্যাপারটাও উনি দেখে দেবেন বললেন। দীপঙ্কর ওনাকে কাল ফোন করে আমাদের বেড়াবার প্ল্যান জানাবে ঠিক হলো।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে দীপঙ্করের গভীর জ্ঞান, তাই আমাদের আলোচনায় রাগ রাগিনী খেয়াল ধ্রুপদ কিংবদন্তী শিল্পী আর তাঁদের ঘরানা এসে গেল। বিসমিল্লা খান কিরকম অল্প বয়সে বেনারসে কাকা অসুস্থ হলে অষ্টপ্রহর বাঁশী বাজিয়েছিলেন, আল্লারাখা রবিশঙ্কর কে এক ফাংশনে কানে কানে বলেছিলেন “বেটা আউর শাদী মত্‌ কর্‌”, কোন এক দুঃস্থ কিশোর খুঁজে খুঁজে অনেক দূরের কোন শহরে গিয়ে শেষ পর্য্যন্ত তার গুরুকে খুঁজে পেয়ে পরে এক বিখ্যাত শিল্পী হয়েছিলেন, এই সব অনেক গল্প আমরা শুনলাম দীপঙ্করের কাছে।

রাগ রাগিনী নিয়েও দীপঙ্করের পান্ডিত্য অসাধারণ, তার কাছে কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিশাল কালেকশন তার বাড়ীতে প্রায়ই সঙ্গীতের আসর বসে, সেই আসরে কলকাতার অনেক সঙ্গীত রসিক ও বোদ্ধারা এসে মাঝে মাঝে যোগ দেন।

দীপঙ্করের কাছ থেকে জানলাম ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুণ), মরুৎ (বাতাস) আর ব্যোম (আকাশ) এই পাঁচ টি প্রাকৃতিক element নিয়ে মহাদেব পাঁচটি রাগ তৈরী করার পরে পার্ব্বতী চেয়েছিলেন পাঁচটি একসাথে মিশিয়ে একটি রাগ যেন মহাদেব তৈরী করেন। মহাদেব নাকি পার্ব্বতীকে বলেছিলেন এই কাজটা তুমি করো পারু।

আমি দীপঙ্কর কে বললাম মহাদেব পার্ব্বতী কে পারু বলে ডাকতেন নাকি? দীপঙ্কর বলল “হ্যাঁ, সেজন্যেই তো শরৎচন্দ্র দেবদাস কে দিয়ে পার্ব্বতীকে ওই নামে ডাকিয়েছেন।” 

অমিতাভ বললো, “তো পারু কি রাগ কোন তৈরী করেছিলেন?”

দীপঙ্কর বলল “মালকোষ!”

সুভদ্রা্র ও রাগ রাগিণী নিয়ে কিছু ফান্ডা আছে, সে বললো পন্ডিত যশরাজ একবার দূর্গা পূজোয় কুয়েতে এসে রাগ দূর্গা শুনিয়েছিলেন, এত ভাল লেগেছিল, এখনো ভুলিনি।

দীপঙ্কর সুভদ্রাকে উড়িয়ে দিয়ে বললো “যশরাজ? দূর, ওই লোকটার তো পোটাটো ডিফেক্ট~”

সুজাতা সুভদ্রার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বললো “গান গাইবার সাথে পোটাটো ডিফেক্ট এর কি সম্পর্ক?”

সুভদ্রা আমার নামে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে বললো “ইন্দ্রজিৎ এর ও খুব পোটাটো ডিফেক্ট জানো তো, ওর পিছনে মেয়েদের লম্বা লাইন…”

সুজাতা বললো, “তাই নাকি ইন্দ্রজিৎ? এটা তো জানতামনা।”

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “সব গুণী লোকেদেরই পোটাটো ডিফেক্ট থাকে, যেমন রবীন্দ্রনাথ, পন্ডিত যশরাজ, আমি…”

এই সব কথা হচ্ছে এমন সময় রেস্টুরেন্ট থেকে ফোন এলো, স্যার আপনাদের ডিনার রেডি, চলে আসুন।

বিশাল বড় আলো ঝলমলে সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্ট। দরজার বাইরে সাদা দেয়ালে টাঙানো ইন্দিরা গান্ধী, জে আর ডি টাটা, এবং আরও নানা রথী মহারথীর ছবি, তাঁরা সবাই এই হোটেলে অতিথি হয়ে এসে থেকে গেছেন। উঁচু সিলিং, ঝকঝকে মার্বেলের মেঝে, ভারী দরজা, চারিদিকে বৈভবের ছাপ। ওবেরয় সাহেবের উত্তরাধিকার, বোঝা যায়। আমাদের দেশের হোটেলের ব্যবসায় তিনি এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ ছিলেন।

একটি মেয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে একটা বড় টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালো। তার নাম লোপামুদ্রা। মেয়েটি হাসিখুসী, ছোটখাটো গোলগাল চেহারা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা তার কাজ হলো সবার দেখাশোনা করা, সে হলো হোস্টেস। আমাদের সাথে তার বেশ আলাপ হয়ে গেল।

আমরা লোপামুদ্রা কে বললাম কাল আমাদের বন্ধুর জন্মদিন, আমরা একটা স্পেশাল কেক চাই, আর তাছাড়া তোমাদের এখানে একটা ছানাপোড়া বলে একটা মিষ্টি আছে, সেটা কাল আমাদের খাওয়াতে পারবে?

লোপামুদ্রা তখন ওদের শেফ কে নিয়ে সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। কাল দীপঙ্করের জন্মদিন পালন করা হবে একটা স্পেশাল ডিনার দিয়ে, তার মেনুও আমরা ঠিক করে দিলাম, সাথে কেক, ছানাপোড়া সব ওরা বন্দোবস্ত করবে। শেফ আমাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন তিনি নিজে কেক আর ছানাপোড়া তৈরীর দায়িত্ব নেবেন।  

কেক এ দীপঙ্করের নাম লেখা হবে, আমি সেই নামের বানান লোপামুদ্রাকে একটা কাগজে লিখে দিলাম।           

৩ ) দ্বিতীয় দিন – ২৩/৮/২২

দীপঙ্করের জন্মদিন আজ, সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাকে সবাই অভিনন্দন জানালাম। ব্রেকফাস্টের পর সেরে সবাই মিলে সমুদ্রের ধারে   হোটেলের পিছনে একটা বড় বাগান, চারদিকে দেয়ালে ঘেরা, এক কোণে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট, পাশে কিছু টেবিল চেয়ার পাতা। শুনলাম প্রতিদিন বিকেলে সেখানে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া যায়, সাথে সিঙাড়া, ঝালমুড়ি। On the house..তা ছাড়া সাথে একটা গানের অনুষ্ঠান ও নাকি রোজ বিকেলে

হোটেলের বাইরে সমুদ্র, সেখানে যেতে গেলে একটা গেট দিয়ে যেতে হবে, সেখানে একজন লোক একটা খাতা খুলে বসে আছে, নাম ধাম রুম নম্বর ইত্যাদি লিখতে হবে, হোটেলের অতিথিরা বাইরে গেলে তাদের একটা রেকর্ড রাখা, হোটেলে ফেরার সময় আবার সেই খাতায় সই করতে হবে। কেউ যাতে হারিয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা। মানে হয়তো সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আর ফিরলোনা, হতেও তো পারে?

এই হোটেলের নিজের কোন সৈকত আছে বলে kiমনে হলোনা। নিজের নুলিয়াও নেই। তবে কয়েকজন নুলিয়া এসে আলাপ করলো। তারা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। অনেক করে বলা সত্ত্বেও আমরা টায়ার নিয়ে সমুদ্রে নামবোনা, তাই তারা বেশ আশাহত। নিজের মনেই তারা সমুদ্রের জলে নেমে কাঁকড়া ধরতে চলে গেল।

আমরা তিন জনেই আজ হাফ প্যান্ট পরে এসেছি। কমবয়েসে সমুদ্র অনেকবার দেখা, নুলিয়ার হাত ধরে সমুদ্রে ঢেউয়ের মোকাবিলাও করেছি অনেক। এই বয়সে এখন আর জলে নামার ইচ্ছে নেই। এখন শুধু সমুদ্রের শোভা দেখা আর নরম ভেজা বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটা।    

একটা বিশাল ছাতা হোটেল থেকে দিয়ে গেছে, তার তলায় অনেক গুলো চেয়ার। আমরা সেখানে বসে বালিতে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম। তারপরে খালি পায়ে বালির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেলাম। হোটেল ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে একটা খুব পুরনো লাইটহাউস। লাল সাদা রং এর এই লাইটহাউসটি গোপালপুরের একটি দর্শনীয় স্থাপত্য, নানা জায়গায় এর ছবি দেখেছি। 

তবে এক সময় এই লাইটহাউসটি জাহাজের নাবিকদের কাজে লাগলেও, আজ তার চারিদিকে ভাঙ্গাচোরা কিছু বাড়ী, অবক্ষয়ের চিহ্ন চারিদিকে। এত দামী একটা 5 star luxury resort এর ঠিক পাশে এই রকম একটা বিশ্রী পরিবেশ দেখে বেশ অবাকই লাগে। ওবেরয় রা অনায়াসে এখানে একটা চমৎকার বাগান বানিয়ে দিতে পারতেন। তার বদলে এখানে ভাঙাচোরা আর পোড়ো বাড়ী, ধুলো ময়লা ভরা রাস্তাঘাট, এত দামী একটা হোটেলের পাশে মোটেই মানানসই নয়। 

অনেকটা হেঁটে ফিরে এসে দীপঙ্কর আর আমি গিয়ে সমুদ্রের ধারে বসলাম। ঢেউ এসে পায়ের কাছে ভেঙে আবার ফিরে যাচ্ছে, আমরা গল্প করে যাচ্ছি। দূরে পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ উঠছে একের পর এক, কিন্তু আমরা নিরাপদ দূরত্বে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। কূলে ঢেউ এসে ভেঙে আমাদের পা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু বড় ঢেউ বুক পর্য্যন্ত এসে ফিরে যাচ্ছে। 

আমাদের দু’জনের বাড়ী কাছাকাছি ছিল বলে  স্কুলে পড়তে দীপঙ্কর আর আমি একসাথে নানা গল্প  করতে করতে হেঁটে বাড়ী ফিরতাম, তখন থেকেই দীপঙ্করের  খুব সাহিত্যে নেশা।  আমিও বইয়ের পোকা ছিলা, কিন্তু আমি পড়তাম বাংলা গল্প উপন্যাস, দীপঙ্করের নেশা ছিল ইংরেজী ভাষায় নানা দেশের লেখকদের লেখা non-fiction – নানা বিষয় নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। আমাদের দু’জনেরি বই পড়ার ব্যাপারে  সেই অভ্যেস এখনো আছে। দীপঙ্কর আমায় আমাকে তার প্রিয় লেখক এবং তাদের কিছু অসাধারণ বই সম্বন্ধে বলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কিছু বই সে আমায় পড়াবেই।  পরে সে একটা কাগজে তার প্রিয় কিছু লেখক ও তাদের কয়েকটা বইয়ের নাম ও লিখে দিয়েছিল।  ওর ধারণা শুধু fiction পড়া, তাও আবার বাংলায়, মোটেই কাজের কথা নয়।   

গল্প করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ গর্জ্জন করে এসে আমাদের মাথায় নাকে মুখে একরাশ নোনা জল ঢেলে দিয়ে গেল।

ভাবটা যেন, “কি রে, কিরকম দিলাম?”

সমুদ্রে এসে জলে একটু না ভিজলে কি করে হবে? কিন্তু মুস্কিল হলো সারা গায়ে মাথায় চুলে একরাশ বালি। ঘরে ফিরে স্নান করার সময় অনেকক্ষন লাগলো শরীর থেকে সব বালি সরাতে। প্যান্টের পকেটও ভারী, কেননা বালিতে ভর্ত্তি। 

দুপুরে সুভদ্রা আর আমি হোটেলের বাইরে একটু হেঁটে একটা বাজারের মধ্যে স্বস্তি নামে একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম। উড়িষ্যায় দুটো হোটেলের বেশ নাম। এক হলো এই স্বস্তি আর একটা হলো পান্থনিবাস। স্বস্তি হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোক খুব আলাপী আর মিশুকে, তিনি আমাদের বললেন কাল আপনাদের বন্ধুদের নিয়ে আসুন না, আমি আপনাদের খয়রা মাছ খাওয়াবো।

খয়রা? সেটা আবার কি মাছ?   

এদিকে আজ দীপঙ্কর অমিতাভ আর সুজাতা খেয়েছে পান্থনিবাসে। সেটাও হোটেলের বাইরে বাজারের মধ্যে। হাঁটাপথের দূরত্বে। কাল আমরা সবাই স্বস্তিতে যাবো ঠিক হলো খয়রা মাছ খেতে। লাঞ্চের পর একটু রেস্ট নিয়ে সূর্য্যাস্ত দেখতে বাইরে গিয়ে হোটেলের বাইরে ওই চায়ের দোকানে চা আর ঝালমুড়ি নিয়ে বসে আড্ডা হলো। কাল ঠিক হলো একটা গাড়ী নিয়ে আমরা একটু চিল্কা ঘুরে আসবো।

আজ রাত্রে আবার কালকের মত দীপঙ্করের ঘরে বিশুদ্ধ বিলিতি মাল সহকারে আড্ডা। আজ রাগ রাগিনী নয়, আজ ছেলেবেলার স্কুলের গল্প। দীপঙ্কর আর অমিতাভ দুজনেই হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিল।   দীপঙ্কর চ্যাটার্জ্জি নামে আর একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছিল, আমাদের সাথে একই সালে সে বেচারা হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দেয়, কিন্তু আমাদের দীপঙ্করের মত অত ভালো রেজাল্ট তার হয়নি।

অনেক পরে দুই দীপঙ্করের দেখা এবং আলাপ হয়, এখন দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব। আলাপ হবার পর একদিন দ্বিতীয় দীপঙ্কর হেসে আমাদের দীপঙ্কর কে নাকি বলেছিলেন, “আপনার জন্যে মশাই ছোটবেলায় আমায় বাবার কাছে খুব মার খেতে হয়েছে!”

“আমার জন্যে?” দীপঙ্কর তো অবাক, “আমি আবার কি করলাম?”

দ্বিতীয় দীপঙ্কর বললেন, “আরে মশাই আপনি তো হায়ার সেকেন্ডারীতে সেকেন্ড হলেন, তার পর আপনার নাম খবরের কাগজে দেখে আমাদের যত আত্মীয়স্বজন, বাবার বন্ধুরা সবাই বাবাকে ফোন করে আর বলে “কি খুসী হয়েছি, আমাদের দীপু সেকেন্ড হয়েছে, কি গর্ব্ব হচ্ছে, কি আনন্দ…”

“আর প্রত্যেক বার ফোন নামিয়ে রেখে আমায় বাবার এক চড়। সেদিন অন্ততঃপক্ষে চল্লিশ পঞ্চাশটা চড় খেতে হয়েছিল মশাই আপনার জন্যে।”

হায়ার সেকেন্ডারী তে ভাল রেজাল্ট না হলে কি হবে, এই দ্বিতীয় দীপঙ্কর খুব সফল ব্যবসায়ী। তাঁর বাবার একটা চা বাগান ছিল আসামে, বাবার সেই ব্যবসা বাড়িয়ে আসামে ও ডুয়ার্সে তিনি এখন অন্ততঃ কুড়িটা চা বাগানের মালিক। দীপঙ্কর মাঝে মাঝেই গিয়ে বন্ধুর চা বাগানের গেস্ট হাউসে কিছুদিন কাটিয়ে আসে।ব্যবসার কাজে দুজনে এক সাথে পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরেও এসেছে বেশ কয়েক বার।

কাল চিল্কা যাবার জন্যে হোটেল থেকে একটা গাড়ীর বন্দোবস্ত করা হলো। আর দীপঙ্কর তার বন্ধু কে ফোন করে বলতেই তিনি সেখানকার পান্থনিবাসের ম্যানেজার কে আমাদের ওখানে দুপুরের খাওয়ার কথা বলে দেবেন বললেন। 

আড্ডার মধ্যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার ডাক এলো। আজ দীপঙ্করের জন্মদিন বলে সে একটা লাল জামা পরে বেশ সাজগোজ করে এসেছে। আমাদের টেবিলটা এক কোনে সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। শেফ এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বিশাল কেক নিয়ে এলো।

এদিকে হয়েছে কি, রেস্টুরেন্টের অন্য কোণে আর একটা টেবিলে একটা বেশ বড় গ্রুপ বসে আছে, সেখানেও একজনের আজ জন্মদিন। দূর থেকে আমরা দেখলাম হোটেল এর ওয়েটাররা একটা বড় কেক নিয়ে এসে সেই টেবিলের সামনে খুব হ্যাপি বার্থডে বলে গান গাইছে। যে মেয়েটির আজ জন্মদিন, সে হাসিমুখে অনেকগুলো মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভালো। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী আর হাসিখুসী, রঙ্গীন টপ আর স্কার্টে তাকে বেশ মানিয়েছে, তার দুই ছোট ছেলে মেয়েও তাদের মা’কে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করছে দেখলাম। তাছাড়া টেবিলের অন্য পুরুষ ও মহিলারা সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

ইতিমধ্যে আমাদের টেবিলেও গান গাইতে গাইতে চলে এলো ওয়েটাররা, তাদের মধ্যে আছে হোটেলের শেফ আর জমকালো শাড়ী পরে চোখে গোল চশমা আমাদের লোপামুদ্রা।

দীপঙ্করের কেক কাটা হয়ে গেছে এমন সময় ওই টেবিল থেকে জন্মদিনের মহিলা এবং তার বর আমাদের টেবিলে এসে দীপঙ্কর কে শুভেচ্ছা জানাতে এলো। দীপঙ্করকেও পালটা শুভেচ্ছা জানাতে হবে, সে মেয়েটিকে হেসে বলল- “Two birthdays today, 75 and 25!”

মহিলার বর পাশ থেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে তার বর কে হাত তুলে থামিয়ে দীপঙ্করকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে গেল। তার মুখে জ্বলজ্বল করছিল একগাল হাসি। কোন পুরুষ, তা সে যতই বুড়ো হোক, তাকে দেখে পঁচিশ বছর বয়েস বললে তার তো খুসী হবারই কথা!

তারপরে তো আমাদের খাওয়া দাওয়া বেশ জমে গেল। পোলাও, মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারী, আর সবশেষে শেফের নিজের তৈরী ছানাপোড়া। 

ঘরে ফেরার পথে আমি দীপঙ্কর কে বললাম “ওই ভদ্রমহিলার বয়েস তোমার পঁচিশ মনে হলো?” দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, সুন্দরী মেয়েদের বয়েস কখনো পঁচিশের থেকে বেশী হয় নাকি?”

তৃতীয় দিন – ২৪/৮/২২

৪)  অলিভ রিডলি কচ্ছপ

আজ আমাদের চিল্কা হ্রদ যাবার দিন।

এখানে আসার আগে আমি গোপালপুর আর চিল্কা সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করে এসেছিলাম, এখানে কি কি দেখার জায়গা আছে ইত্যাদি। পর্য্যটক দের জন্যে চিল্কা হ্রদ অবশ্যই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। তার নানা কারণ আছে। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম কূলে ১১০০ স্কোয়ার কিমি বিস্তৃত এই চিল্কা হলো আমাদের দেশের সব চেয়ে বড় হ্রদ। সমুদ্রের সাথে এই হ্রদের যোগ থাকায় জোয়ারের সময় এই হ্রদে লোনা জল এসে যায়। কিন্তু বেশ কিছু নদী চিল্কায় এসে মেশায় একে fresh water লেকও বলা হয়। এই হ্রদে ইরাবতী শুশুক ছাড়া নানা জলচর প্রাণী বাস করে।

চিল্কার তীরে অনেক মাছের বাজার তাই, প্রধানতঃ এই তীর চিংড়ি আর কাঁকড়া কেনাবেচার জন্যে বিখ্যাত। শীতকালে এই হ্রদে অনেক পরিযায়ী পাখী চলে আসে। গুগল এ গিয়ে অনেক গোলাপী ফ্লামিঙ্গোর ছবি দেখলাম। এরা আসে উত্তরে সাইবেরিয়া বৈকাল হ্রদ এবং অন্যান্য নানা পাহাড়ী জায়গা থেকে।

আর একটা বিশেষ ব্যাপারের জন্যে চিল্কা বিখ্যাত। অলিভ রিডলি নামে এক জাতীয় সামুদ্রিক কাছিমরা দলে দলে ওড়িশার সমুদ্রকূলে এসে ডিম পাড়ে –এদের জল্পাই রং এর খোলসের সূত্রেই তাদের এই নাম। আকারে তারা ছোট, এবং তাদের ফ্লিপারের মত পা থাকে যা ডাঙায় বসবাসকারী কাছিম দের থেকে আলাদা। উড়িষ্যা ও ভারতের অন্য কিছু রাজ্যের উপকূলে তারা দলে দলে প্রজননের জন্যে আসে। এর নাম হলো মাস নেস্টিং যার প্রধান ঠিকানা হলো ওড়িশার কেন্দ্রপাড়া জেলার অন্তর্গত গহিরমাথা অঞ্চল।কিন্তু সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ, কেননা সেটি ভারত সরকারের সুরক্ষিত এলাকা।

কিন্তু গঞ্জাম ডিস্ট্রিক্টে রম্ভার কাছে রুশিকুল্য নদীর মোহনাও মাস নেস্টিং এর আর এক ঠিকানা, এবং পর্য্যটকদের কাছে তা এক প্রধান আকর্ষণ। জায়গাটা গোপালপুর থেকে খুব কাছে, কিন্তু আমরা আগস্টে এসেছি, মাস নেস্টিং এর সময়টা মোটামুটি হলো ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চের মাঝামাঝি। সুতরাং আমাদের দেখা কপালে নেই।

ডিসেম্বর মাসে ওড়িশা উপকূলে সমুদ্রের পরিস্কার জলে পুরুষ ও স্ত্রী কাছিমরা একত্রিত হয় মেটিং এর জন্যে। এর পর পুরুষ কাছিমরা ফিরে যায় তাদের বিচরণ স্থানে। স্ত্রী কাছিমরা অপেক্ষা করে, সঠিক আবহাওয়া আর উপযুক্ত পটভূমি পেলে তবেই এরা দলে দলে ডিম পাড়ার জন্যে পারে উঠে আসে। সে এক অদ্ভুত, অভিন্‌ব, অভাবনীয় দৃশ্য। প্রতিটি ঢেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসে একরাশ প্রাণ!

সাধারণতঃ এই সমারোহ চলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। আসে কয়েক লক্ষ অলিভ রিডলি। যারা এখানে জন্মগ্রহণ করে তারাই নাকি ফিরে আসে আবার জননী হয়ে। শোনা গেল সে এক আশ্চর্য্য অভিনব প্রাকৃতিক লীলা। প্রতিটি কাছিম সেই বিস্তীর্ণ বালুতটে ঢেউয়ের নাগালের বাইরে জায়গা খুঁজে নিয়ে গর্ত্ত খুঁড়তে শুরু করে দেয়। তারপরে তাদের ডিম সেই গর্ত্তে রেখে প্রাণপন শক্তি দিয়ে সেই গর্ত্ত বালি দিয়ে ঢেকে ধরিত্রী মায়ের সুরক্ষায় তাদের জমা করে তারা আবার ফিরে যায় জলে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে জলে ফিরতে প্রায় এক ঘন্টা বা তারও বেশী লেগে যায়।

এই কাহিনীর দ্বিতীয় ভাগ এখন থেকে দেড় মাস পরে রচিত হবে, মে মাসে। তখন বালির গরমে ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরোবে, এবং নিজেরাই শুধুমাত্র প্রকৃতির দুর্বোধ সঙ্কেত চিনে নিয়ে নির্ভুল পথে পাড়ি দেবে দূর সাগরে নিজেদের ডেরায়। ততদিন পর্য্যন্ত সরকারের বন দফতর আর নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকেরা অক্লান্ত ভাবে সামলে ডিমগুলো সামলে রাখবে পশুপাখী আর মানুষের হাত থেকে। 

গোপালপুরে এসে রম্ভায় গিয়ে সেখানে মাস নেস্টিং দেখা না হওয়ায় আমাদের মন একটু খারাপ।

দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই ইউটিউবে ভিডিও তে দেখে নিও। কষ্ট করে রাত জেগে সমুদ্রের তীরে গিয়ে বসে থাকার বয়েস কি আমাদের আর আছে?”

৫)   চিল্কায় নৌকাবিহার    

গঞ্জাম জেলার বারকুল আর খোরদা জেলার রম্ভা নামে চিল্কার তীরে দুটি জায়গা থেকে পর্য্যটকরা হ্রদে বোটিং করে। দীপঙ্করের বন্ধু আমাদের বলেছেন বারকুলে যেতে, সেটা রম্ভার তুলনায় গোপালপুর থেকে কাছে এবং সেখানকার পান্থনিবাসে তিনি আমাদের লাঞ্চের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ম্যানেজারের নাম মিস্টার কর্‌। কর্‌ পদবীটা বাঙালীদেরও হয়, কিন্তু ইনি উড়িষ্যার লোক।

তাই আমরা বারকুলেই যাচ্ছি।               

চিল্কায় অনেক দ্বীপ। এই সব দ্বীপে নৌকা নিয়ে পর্য্যটকরা যায়, আমরা তো ঠিক সে অর্থে পর্য্যটক নই। তবু দীপঙ্করের বন্ধু বলে দিয়েছেন, বারকুলে লাঞ্চ সেরে আমরা যেন একটা নৌকা ভাড়া করে কালিজায়ি নামে একটা দ্বীপে গিয়ে সেখানে এক কালীমন্দিরে পূজো দিয়ে আসি। কালিজায়ির মা কালী খুব জাগ্রত।

এ ছাড়া তিনি বলে দিয়েছেন যে বারকুল পৌঁছবার আগে টামপারা নামে একটা লেক পড়বে, সেই জায়গাটাও দেখার মত। আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ কাটাতে পারি।

তো আমরা ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম। আজও বড় গাড়ী। রাস্তাও বেশ ভাল, কোন ঝাঁকানি নেই। গোপালপুর থেকে টামপারা এক ঘণ্টার মত পথ। পথে ছত্রপুর নামে একটা শহর পড়লো।

টামপারা (fresh water) লেকটা দেখলাম বেশ বড় (৭৫০ acre – অর্থাৎ প্রায় পাঁচ স্কোয়ার কিমি এর বিস্তার)। রুশিকুল্য নদীর মোহনাও এখান থেকে বেশী দূরে নয়। সেই হ্রদের ধারে একটা চমৎকার বাগানের সামনে এসে আমাদের গাড়ী থামলো। আকাশে সেদিন মেঘ, পাশের হ্রদ থেকে ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে, এই আগস্ট মাসেও তেমন গরম নেই, বাগানের গাছগাছালির মধ্যে একটি বাঁধানো রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। বেশ কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটা কফি শপে গিয়ে বসলাম।

কফি শপের ঠিক উল্টো দিকে হ্রদের ধারে একটা ছোট্ট হোটেল, বাইরে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা টাম্পারা গেস্ট হাউস, ছত্রপুর। 

দীপঙ্কর বললো, “আমার গার্লফ্রেন্ডরা যখন আমার সাথে এখানে আসে তখন আমরা এই গেস্ট হাউসে এসে উঠি, আর একটা ঘর নিই যাতে জানলা খুললেই সামনে হ্রদ দেখা যায়!”

সুজাতা বললো “এই আবার দীপঙ্করের ঢপ্‌ শুরু হলো!”

সুভদ্রা বললো “যাও যাও তোমার ক্যালি আমাদের খুব জানা আছে! গার্লফ্রেন্ড না ছাই!”

দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, তোমরা বিশ্বাস না করলে আমি কি করতে পারি, পূর্ণিমার রাতে লেকের জল চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করে, আমার বান্ধবীরা কেউ ওই Lake facing room ছাড়া থাকবেনা! ”

টামপারা থেকে বারকুল কাছেই। সেখানে পান্থনিবাস হোটেলে গিয়ে দেখি সেখানকার ম্যানেজার কর্‌ সাহেব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। হোটেলে অনেক গেস্ট, বেশ ভীড়, তাই তিনি তাদের নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত। আমাদের জন্যে তিনি একটা হোটেলের ঘর খুলে দিলেন, আমরা সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিতে নিতে তিনি আমাদের জন্যে রেস্টুরেন্টে টেবিলের আর খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন।

লাঞ্চ ভালোই হলো। কর্‌ সাহেব ভালোই বন্দোবস্ত করেছেন। চিংড়ী মাছ আর কাঁকড়ার ঝোল খেলাম ভাত দিয়ে। তা ছাড়া ভাত ডাল আর তরকারী। শেষ পাতে মিষ্টি দই।

লাঞ্চের পর কাছেই হ্রদের ধারে সারি সারি নৌকা বাঁধা আছে সেখানে একটা কাউন্টারে এক ঘণ্টা বোটিং এর টিকিট কিনে আমরা একটা নৌকায় উঠে পড়লাম। ওঠার আগে আমাদের প্রত্যেককে একটা লাইফ জ্যাকেট পরতে হলো।  

আমাদের নৌকাটা একটা মটরবোট, ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। মাঝি একটা স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বোটটা চালাচ্ছে, আমরা বোটের দুই পাশে বসে জলের ঢেউএর দোলায় অল্প অল্প দুলছি, অভিজ্ঞতাটা মন্দ নয়। তীরের কাছাকাছি দিয়ে আমাদের বোট চলছে, সেদিকে তাকালে তীরের গাছপালা ঘরবাড়ী পাহাড় সব চোখে পড়ছে, আর অন্যদিকে অকূল জল। ঠিক সমুদ্রের মতোই। যতদূর তাকাই শুধু জল আর জল। কোন ডলফিন চোখে না পড়লেও অনেক পাখী আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর জলের মধ্যে কিছু কচ্ছপ চোখে পড়লো, তারা চার পা চালিয়ে বেশ আরাম করে হাই স্পীডে জলের মধ্যে সাঁতার কেটে ভেসে যাচ্ছে। মাটিতে তারা আস্তে আস্তে এগোয়, কিন্তু জলের মধ্যে তারা বেশ স্বচ্ছন্দ।  মিনিট পনেরোর মধ্যে কালিজায়ী দ্বীপে পৌঁছে গেলাম আমরা। সুজাতা আর সুভদ্রা মন্দিরে গেল পূজো দিতে, আমাদের ছেলেদের মনে অত ভক্তি নেই, সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য এই প্রিন্সিপল ফলো করে আমরা তিন জন একটা জলের মধ্যে রাবারের তৈরী একটা ভাসমান র‍্যাম্পের ওপর দিয়ে উঠে কিছুদূর গিয়ে চিল্কার সীমাহীন জলের শোভা দেখলাম।   

এদিকে আকাশে তখন কালো মেঘ জড়ো হচ্ছে, ঝড় উঠবে নাকি? এখন ভালোয় ভালোয় ফিরে গেলে হয়।

আবার সবাই বোটে এসে বসলাম, মিনিট পাঁচেক যাবার পরে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া শুরু হলো। আকাশের মেঘ আর বাষ্প নেমে এসেছে অনেক নীচে, তীরের পাহাড় বাড়ী গাছপালা সবই ঝাপসা দেখাচ্ছে আর তীব্র হাওয়ায় জলে বেশ ধেউ উঠছে। আমি সেই ঝাপসা পাহাড় আর জলের ঢেউয়ের কিছু ছবি তুলে নিলাম।

আমাদের ছোটবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি জনপ্রিয় গানের (শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি) শেষের দিকে এই লাইন গুলো ছিল।

জমছে কালো মেঘ, অন্ধকার ঘনায়/

তাই দেখে মাঝি আকাশে তাকায়/

রুদ্র ঝড়ে উঠবে নড়ে স্তব্ধ প্রকৃতি/

আমাদের মাঝি লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছেনা তার কোন ভাবান্তর হচ্ছে, এই ধরণের ঝড় বৃষ্টি তার অনেক দেখা আছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমরা সবাই চুপ, কার মনে কি চলছে বলা মুস্কিল, তবে আমি ভাবছি ঝড় আর বৃষ্টি যেন আমাদের নিরাপদে কূলে পৌঁছে যাওয়া পর্য্যন্ত একটু অপেক্ষা করে।

শেষ পর্য্যন্ত তাই হলো অবশ্য। এর প্রধান কারণ আমার মনে হয় মা কালীর আশীর্ব্বাদ। সুজাতা আর সুভদ্রা ভাগ্যিস তাঁর মন্দিরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এসেছে। তা না করলে কি হতো বলা মুস্কিল।

যাই হোক, পারে পৌঁছবার পরে মাঝি বোট নোঙ্গর করে ছুটলো আমাদের জন্যে ছাতা আনতে। আমরা সেই ছাতার তলায় মাথা বাঁচিয়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ছুটে গিয়ে কাছেই একটি ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের ড্রাইভার সেখানে গাড়ী নিয়ে চলে এলো, আমরা গাড়িতে উঠে স্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম।

বারকুল থেকে বৃষ্টির মধ্যে হোটেলে ফেরার কথাটা অনেকদিন মনে থাকবে। সামনের সীটে বসে আমি দেখছিলাম বৃষ্টি তে ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, চারিদিক ঝাপসা, উইন্ডশীল্ডে ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টিকে সামলাতে ঝপাঝপ শব্দ করে দুটো ওয়াইপার উঠছে আর নামছে। যে রাস্তায় সকালে এসেছিলাম, এখন সে রাস্তা আর চেনার উপায় নেই। জীবনে এরকম বেশ কিছু মূহুর্ত্ত আর অভিজ্ঞতা আসে যা চট করে ভোলা যায়না। আমাদের চিল্কা যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সেই রকম।

ড্রাইভার ছেলেটি বলতেই হবে ওই দুর্য্যোগের মধ্যে খুব সুন্দর গাড়ী চালিয়েছিল সেদিন। 

৬) চতুর্থ দিন – ২৫/৮/২২      

আজ গোপালপুরে আমাদের শেষদিন। আজকের সকালটা আরাম করে সমুদ্র তীরে রোদ বাঁচিয়ে ছাতার তলায় বসে গল্প করে কেটে গেল। নরম ভেজা বালিতে জলে পা ডুবিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে।

সুভদ্রা আর আমি একটু হোটেলের সুইমিং পুলে নামলাম। পুলে আর কেউ নেই শুধু আমরা দু’জন। ট্রাঙ্ক এর বদলে একটা শর্ট পরে এসেছি আমি, যেটা পরে সমুদ্রর তীরেও হাঁটা যায় আবার পুলেও নামা যায়।        

ঘর থেকে বেরোবার আগে যে মানিব্যাগটা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছি, পুলে নামার আগে তা খেয়ালই ছিলনা। জলে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে দু’তিনটে ল্যাপ নেবার পরে সুভদ্রার সাথে জলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গল্প করছি, হঠাৎ মনে হলো পকেটটা এত ভারী লাগছে কেন?

পিছু কেন ভারী ঠেকে ভাবে কোচোয়ান…

চকিতে বুঝলাম কেন। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ব্যাগটা বের করে বুঝলাম যা কেলো হবার তা হয়ে গেছে। টাকার নোট সব ভিজে। ডেবিট ক্রেডিট কার্ডের কিছু হবেনা। কিন্তু নোট গুলো শুকোনো একটা বড় কাজ এখন।

ঘরে ফিরে নোট গুলো ব্যাগ থেকে বের করে বিছানায় শুকোতে দিলাম। ব্যাগটাও সপসপে ভিজে। 

রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্তবুড়ীর দিদিশ্বাশুড়ীর তিন বোনের কথা লিখেছিলেন, আমার অবস্থা অনেকটা তাঁদের মত।

কোন দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে, নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে/

টাকাকড়ি গুলো হাওয়া খাবে বলে রেখে দেয় খোলা জানলায়/

আমি অবশ্য টাকার নোট গুলো জানলায় রাখিনি, বিছানায় রেখে ফুল স্পীডে ফান চালিয়ে তাদের হাওয়া খাইয়েছিলাম।

দুপুরে আজ সবাই মিলে স্বস্তি হোটেলে লাঞ্চে গেলাম। কালকের সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির করে বড় একটা গোল টেবিলে বসালেন। খয়রা মাছটা দেখলাম অনেকটা তেলাপিয়ার মত। খুব সুস্বাদু রান্না, বেশ ভাল লাগলো খেতে। শেষ পাতে ছানাপোড়া। 

কাল আমরা কলকাতা ফিরছি, সাথে বাড়ীর জন্যে কিছু ছানাপোড়া নিয়ে গেলে কেমন হয়?

ম্যানেজার ভদ্রলোক কে আমাদের জন্যে কিছু ছানাপোড়া প্যাক করে দিতে বললাম। তিনি বললেন, “কাল ভুবনেশ্বর যাবার পথে ল্যাংলেশ্বর নামে একটা ছোট শহর পড়বে। ওই শহরে কোন এক ভালো দোকান থেকে আপনারা ছানাপোড়া কিনে নেবেন, কেননা ওখানকার ছানাপোড়াই হল বিখ্যাত, কাছাকাছির মধ্যে সব চেয়ে নাম করা।” 

লাঞ্চের পরে আবার একটু বিশ্রাম সেরে আমরা সমুদ্রের ধারে চা আর ঝালমুড়ি নিয়ে বসে গেলাম। নানা আলোচনার মধ্যে ফেনার মুকুট পরা সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্লান্তিহীন আসা যাওয়া দেখতে দেখতে পশ্চিমের আকাশ কমলা আর লাল রং এ ভরিয়ে সুর্য্যাস্ত হল, তারপর নেমে এলো অন্ধকার।

৭) পঞ্চম দিন – ২৬/৮/২৩ – ফেরা

কাল ফ্লাইটের চেক ইন আর বোর্ডিং পাস হোটেল থেকে লোপামুদ্রা করিয়ে রেখেছে।

আজ ব্রেকফাস্ট এর পর সকাল সকাল হোটেল থেকে চেক আউট করে মালপত্র গাড়ীতে তুলে বেরিয়ে পড়লাম। ভুবনেশ্বর পর্য্যন্ত চার ঘন্টার লম্বা রাস্তা।

পথে ল্যাংলেশ্বর জায়গাটা পড়ল। ড্রাইভার আমাদের একটা মশহুর ছানাপোড়া দোকানের সামনে এসে গাড়ী থামালো। আমরা যে যার দরকার মত কেউ এক কেজি কেউ দুই কেজি ছানাপোড়া কিনে নিলাম।

সুজাতা বলল, ল্যাংলেশ্বর! কি নাম বাবা…

দীপঙ্কর বলল “আরে ভাই, এই নামটা কি করে হলো জানো? এর একটা হিস্ট্রি আছে। একবার বহু বছর আগে ঈশ্বর নামে একটি লোক এই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, সে ছিল ছানাপোড়া তৈরী করার একজন বিখ্যাত কারিগর। দেশজুড়ে তার সুনাম। এখানকার কিছু লোক তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, তার ফলে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়, সে আর কোথাও যেতে পারেনা। এখানেই সে ছানাপোড়া তৈরীর কারখানা খোলে এবং ক্রমে ক্রমে এই জায়গাটা ছানাপোড়ার জন্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হয়েছে ল্যাংলেশ্বর।”

সুভদ্রা বলল ভ্যাট্‌, দীপঙ্করের যত হাবিজাবি গল্প।

আমাদের প্লেন ছাড়ছে বেলা দুটো। দমদম পৌঁছবো বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। আমি ফোনে আমাদের ড্রাইভার কে বাড়ী থেকে গাড়ীটা নিয়ে দমদমে আসতে বলছি।

“একটু আগে এসে গাড়ীতে তেল আছে কিনা দেখে নিও, টায়ার গুলোতে হাওয়া ভরতে হতে পারে, তিনটের একটু আগে দমদম পৌঁছে যেও”, ইত্যাদি বলে যাচ্ছি আর ভাবছি মোবাইল ফোন যখন ছিলনা, তখন আমরা কি করে বেঁচে ছিলাম!

দীপঙ্কর বসে ছিল পিছনে, সে বললো ইন্দ্রজিৎ এর ড্রাইভার কে এই পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।

কি গল্প?

এক কোম্পানীর মালিক তাঁর এক কর্ম্মচারীকে পাঠাবেন আসানসোলে তাঁর এক খদ্দেরের কাছ থেকে একটা চেক নিয়ে আসতে। ইয়ার এন্ড এসে যাচ্ছে, তাই চেক টা পাওয়া খুব দরকারী।

কর্ম্মচারী ছেলেটি খুব বিশ্বাসী আর বশংবদ।

মালিক তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিচ্ছেন এই ভাবে।

শোনো তুমি সামনের সোমবার ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবে, বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

ব্ল্যাক ডায়মন্ড প্ল্যাটফর্ম আট থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় ছাড়বে, তার মানে তোমায় হাওড়া স্টেশনে পৌনে ছটার আগে পৌঁছে যেতে হবে, বুঝতে পেরেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

তুমি সেদিন ভোর চারটে তে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠবে, উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়বে। তুমি তো ফার্ণ রোডে আলেয়া সিনেমার কাছে থাকো, ওখান থেকে গড়িয়াহাটে হেঁটে যেতে তোমার দুই তিন মিনিট লাগবে, সেখানে গিয়ে তুমি পাঁচ নম্বর বাস ধরবে, ফার্স্ট বাস আসে ভোর পাঁচটায় তাই তার আগেই তোমায় বাস স্টপে পৌঁছে যেতে হবে, দেরী করবেনা, বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

আচ্ছা ওই সকালে বাসে তুমি হাওড়া স্টেশনে ছ’টার আগেই পৌঁছে যাবে, সেখানে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে টিকিট রিসার্ভেশন কাউন্টারে লাইন দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড চেয়ার কারে তোমার সীট রিসার্ভ করে টিকিট কিনবে। ঠিক আছে?

হ্যাঁ, স্যার! এবার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে ট্রেণে উঠে নিজের সীটে গিয়ে বসবে। আসানসোল স্টেশনে ট্রেণ পৌছবে সকাল ন’টায়। কিন্তু তুমি যে অফিসে যাবে তারা খোলে বেলা দশটায়। তাই তুমি ট্রেণ থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে মিনিট পনেরো চা খেয়ে নিয়ে নিও। ক্লীয়ার?

হ্যাঁ, স্যার!

তারপরে বাইরে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ওদের অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটা ওদের দেখিও। ওরা তোমায় এক টা চেক দেবে, সেটা নিয়ে তুমি আবার স্টেশনে ফিরে বিকেল চারটে তে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে এসো।

সোমবার ন’টা নাগাদ মালিকের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। সেই বশংবদ কর্ম্মচারীর ফোন।

এবার তাদের দু’জনের কথাবার্ত্তা এরকম হলো।

কি হলো? কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? ভোরবেলা গড়িয়াহাট থেকে ফার্স্ট বাস পাঁচ নম্বর ধরেছিলে?

হ্যাঁ, স্যার!

বেশ! তারপর? ট্রেণের টিকিট কাটলে? সীট রিসার্ভ করতে পারলে?

হ্যাঁ স্যার!

বেশ বেশ! আসানসোল পৌছে গেছো?

হ্যাঁ স্যার!

তাহলে তো সবই ঠিকঠাকই করেছো। ফোন করছো কেন? কোন প্রবলেম?

হ্যাঁ স্যার একটা প্রবলেম হয়েছে।

মালিক একটু অবাক। কি আবার প্রবলেম হলো।

স্যার এই দোকানে চা পাওয়া যায়না, কেবল কফি। আমি কি কফি খেতে পারি, স্যার?

এ আবার কি অসভ্যতা

মার্চ ৩১, ২০১৮। কাল আমরা বন্ধুরা মাদ্রিদ থেকে লিসবনে এসে পৌঁছে হলিডে ইন হোটেলে উঠেছি।

আজ সকালে আমাদের half day লিসবন সিটি ট্যূর।   

হোটেলে সকাল ন’টায় বাস আসবে। আমরা সবাই রেডি হয়ে লাউঞ্জে এসে সোফায় বসে আছি।        

এমন সময় হোটেলের বাইরে একটা বড় বাস এসে দাঁড়ালো, এবং একটু পরে একটি সুদর্শন যুবক আমাদের সামনে এসে বললো You are the group of Prodosh Mitra? My name is Nunu and I shall be your guide today…

নুনু?

এ আবার কি অসভ্য নাম?

অবশ্য পর্তুগীজ ভাষায় অসভ্য নয় নিশ্চয়, নাহলে ওরকম গর্ব্ব আর আনন্দের সাথে কেউ বলে আমার নাম নুনু? পরে জেনেছিলাম কথাটার মানে হলো petite ছোটখাটো, আদরের।

অসভ্য কথা শুনলেই মেয়েদের খুব হাসি পায়, আমাদের বৌদের মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবেই একটা চাপা হাসির  গুঞ্জন উঠলো। আমরা ছেলেরা অবশ্য অসভ্য কথাকে হাসির ভাবিনা, তবু আমরাও একটু চোখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। ছেলেটির জন্যে একটু সহানুভূতিও অনুভব করলাম, বেচারা জানেওনা কি বিশ্রী একটা নাম তার গায়ে আটকে আছে চিরজীবনের মতো।   

নুনু ছেলেটি কিন্তু খুব স্মার্ট, সুন্দর কথা বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে তার বেশ ভাল আলাপ হয়ে গেল।

কিন্তু মুস্কিল হলো বাসে সে বসে আছে একেবারে সামনে, তার সাথে কথা বলতে গেলে বা তাকে কোন প্রশ্ন করতে গেলে তাকে নাম ধরে ডাকতে হবে।

সুমিতা সিদ্ধার্থ কে বলল তুমি ওকে নাম ধরে ডাকেবেনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে বলবে Excuse me?

নাম ধরে ডাকতে হবে তাই আমরা কেউ ই নুনুকে কোন প্রশ্ন করছিনা। কিছুক্ষণ বকবক করে নুনু ড্রাইভারের পাশের সীটে সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে।

এদিকে বাসে একদম পিছনে বসে আছি আমি আর প্রদোষ। বাসে এ সি চলছেনা, বেশ গরম। তুতু বসে আছে একদম সামনে, প্রদোষ তুতু কে বললো এই নুনু কে বলো তো এ সি টা চালাতে।

তুতু পিছন দিকে প্রদোষ কে একটা বিশ্রী দৃষ্টি দিয়ে বললো, না আমি বলতে পারবোনা, তুমি বলো।

প্রদোষ আর কি করে, সে কয়েকবার মিন মিন করে খুব নীচু গলায় মিস্টার নুনু, মিস্টার নুনু বলে ডাকলো, কিন্তু অত আস্তে বললে নুনু শুনবে কি করে? তখন মরিয়া হয়ে লজ্জা শরম বিসর্জ্জন দিয়ে প্রদোষ বেশ জোরে ডেকে উঠলো – মিস্টার নুনু !

এবার কথাটা নুনুর কানে গেছে, সে মুখ ফিরিয়ে বললো, ইয়েস?

প্রদোষ বলল Please will you turn the air conditioning on?

Sure, বললো নুনু।

কিছুক্ষন পরে আবার এক মুস্কিল। মাইক্রোফোন থেকে একটা খসখস আওয়াজ হচ্ছে, কানে লাগছে।

প্রদোষ এবার তার সংকোচ ছাড়িয়ে উঠেছে। তার গলায় এখন বেশ জোর।

আমি ওর পাশে বসে ছিলাম, আমি বললাম মিস্টার বলার কি দরকার, বাচ্চা ছেলে, ওকে নাম ধরেই ডাকোনা।

বজ্রগম্ভীর স্বরে প্রদোষ ডেকে উঠলো এই নুনু, নুনু!

সামনে বসে ছিল তুতু, সে পিছন ফিরে প্রদোষ কে বলল “এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে?” 

কিন্তু প্রদোষ কে থামানো যাচ্ছেনা, সে ওই খসখস আওয়াজ আর সহ্য করতে পারছেনা।

সে আবার পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “নুনু, এই নুনু! আওয়াজ টা বন্ধ কর্‌ মাইরী…”

আরশোলা ভাজা, টিকটিকির চাটনী

মার্চ, ২০১৭। আমরা কুয়েতের বন্ধুরা ভিয়েতনাম আর কাম্বোডিয়া বেড়াতে এসেছি।

আমাদের ট্রিপ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গত সাত দিন ভিয়েতনামে হানয় আর হ্যালং বে তে ঘুরে আর কাম্বোডিয়াতে সীম রীপ (আঙ্কোর ভাট মন্দির) দেখে এখন আমরা বাসে চেপে চলেছি কাম্বোডিয়ার রাজধানী Phnom Penh এর দিকে। সেখানে আমাদের প্ল্যান হলো Khmer Rouge এর বন্দীদের  যেখানে রেখে অত্যাচার করা হতো, সেই বিখ্যাত Tuol Sleng prison দেখা। তারপরে মেকং নদীতে নৌকাভ্রমণ।  

পরের দিন দেশে ফেরা।

সীম রীপ থেকে Phnom Penh  ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা। বিকেলের আলো থাকতে পৌঁছতে হবে তাই আমরা সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট খেয়ে মালপত্র বাসে তুলে নিয়ে  বেরিয়ে পড়েছি। পথে কোথাও একটা ব্রেক নিয়ে কিছু খেয়ে নেবো।

মার্চ মাসে তেমন গরম পড়েনি তখনো, আমরা বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি কাম্বোডিয়ার গ্রামের দৃশ্যপট। আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের সাথে মতোই অনেকটা। আজ দিনটা বেশ সুন্দর, নীল আকাশ, নরম রোদ, চারিদিকে সবুজের মেলা। বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত, চারিদিকে তাল আর নারকেল গাছের সারি। মাঝে মাঝে কিছু জনপদ পেরিয়ে যাচ্ছি। কিছু কৃষক কে মাঠে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে, তাদের মাথায় সাদা ত্রিভুজ টোকা। গ্রামের বাড়ীগুলোর  ডিজাইন একটু অন্যরকম, আমাদের চোখে বেশ নতুন লাগলো। আর তাদের মধ্যে পাকাবাড়ীর বদলে বাঁশের তৈরী বাড়ীই বেশী।

মাঝপথে আমাদের ড্রাইভার একটা জায়গায় এসে বাস থামালো। দেখলাম এখানে একটা বেশ বড় বাজার বসেছে। তরী তরকারী ফলমূল এই সব সাজিয়ে নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দরদাম করে কেনাকাটা করছে বহু লোক। আজ রবিবার, ছুটির দিন, তাই বোধ হয় ভীড় এক্টূ বেশী।  আমরা একটা চায়ের দোকান খুঁজে চা খাচ্ছি, এমন হঠাৎ সমবেত মেয়েলী গলায় একটা আর্ত আওয়াজ পেলাম।

“ও মাগো! দেখে যাও শিগগিরি!”

আমাদের বৌরা যথারীতি দোকান গুলোতে ঘুরে দেখতে গেছে কেনার মত কিছু স্যুভেনির সেখানেপাওয়া যায় কিনা দেখতে। সেখানে গিয়ে  ঢালাও করে যা বিক্রী হচ্ছে তা’ দেখে তাদের এই সমবেত আর্ত্তনাদ।

আমরা ছেলেরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে আমরাও তাজ্জব।

এক এক টা দোকানে পর্য্যাপ্ত পরিমাণে পাহাড়ের মত উঁচু ঢিপ করে রাখা আছে কালো কালো নানা ধরণের পতঙ্গ ভাজা। তাদের মধ্যে আরশোলা আছে, আরো কি কি আছে কে জানে, উচ্চিংড়ে, ফড়িং, locust ইত্যাদি  জাতীয় সব  প্রাণী। কাঁচের শিশিতে তেলের মধ্যে চার পা ছড়িয়ে উল্টো হয়ে ভাসছে  টিকটিকি। আচার নাকি? হতেও পারে।

আমার মনে আছে রাজগীর থেকে পাটনা ফেরার পথে একটা দোকানে মৌরলা মাছ ভাজা পাওয়া যেত। আমরা প্লেট ভর্ত্তি করে নিয়ে মনের সুখে খেয়েছি।  আর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে  Carniviore নামে একটা বেশ নামী রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে মেনু তে বীফ, পর্ক, চিকেন, হরিণ ইত্যাদি ছাড়াও  অন্যান্য নানা বন্য জন্তুর মাংস – তার মধ্যে আছে জলহস্তী, গণ্ডার, হাতি, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়েনা ইত্যাদি। আমাদের বন্ধুদের  মধ্যে কেউ কেউ উৎসাহ নিয়ে সে সব অর্ডার করেছিল, আমি অবশ্য risk নিইনি।

কিন্তু এখানে এই সব কেঁচো সুঁওপোকা ব্যাং টিকটিকি এমন কি সাপ দেখে এই সব কেউ ভালবেসে খায় ভেবে বেশ বমি পাচ্ছিল আমাদের সবার।  

আরও অবাক করার মত ব্যাপার হলো সেই সব অখাদ্য ভালবেসে কিনছে যে খদ্দেররা, তাদের মধ্যে আছে বেশ কিছু সুন্দরী কমবয়েসী মেয়েরাও। তাদের বেশভূষা দেখলে মনে হয় তারা বেশ সম্পন্ন পরিবারের উচ্চশিক্ষিত মহিলা, তাদের অনেকের হাতে ফ্যাশানী হ্যান্ডব্যাগ, চোখে রোদচশমা।

আজ রবিবার, সন্ধ্যায় বন্ধুবান্ধব এর সাথে বসে পার্টিতে হুইস্কির সাথে জমিয়ে আরশোলা আর উচ্চিংড়ে ভাজা, পরে ডিনারে ডালভাতের সাথে ব্যাঙএর চপ, সাপের ডালনা, আর টিকটিকির আচার?

ওয়াক!  

মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস এই সব দেশে আমি জন্মাইনি।

আশ্চর্য্য ভ্রমণ – মুর্শিদাবাদ (১২-১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩)

হাজারদুয়ারী প্রাসাদ

প্রথম দিন ১২/১২/২০২৩

১) ট্রেণ যাত্রা 

ছোটবেলার স্কুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আজকাল KP mপ্রায়ই কোথাও একসাথে বেড়াতে যাবার কথা ওঠে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে দীপঙ্কর অমিতাভ সুজাতা সুভদ্রা আর আমি একসাথে গোপালপুর বেড়িয়ে আসার পর আমাদের এই যৌথ বেড়ানোর প্রতি আগ্রহ বেশ বেড়ে গেছে। এবার আমরা যাচ্ছি মুর্শিদাবাদ, আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে প্রবীর আর সুপ্রিয়া।

মুর্শিদাবাদে আমাদের কাশিমবাজারের রাজবাড়ীতে দুই রাতের থাকার বন্দোবস্ত করছে অমিতাভ। কাশিমবাজারের আজকের রাজা প্রশান্ত রায়ের ছেলে পল্লব রায় এখন এই রাজবাড়ীটার দেখাশোনা করে।  সে অমিতাভর বন্ধু, তারা দু’জনেই Calcutta Club এর সদস্য, এবং আমাদের এই ট্রিপের সব বন্দোবস্তই পল্লব করে দিয়েছে।

মঙ্গলবার ১২ই ডিসেম্বর সকাল ন’টায় আমাদের ট্রেণ হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়বে।  

কলকাতা স্টেশন আবার কোথায়?

আমরা কেউ ওই স্টেশন চিনিনা।  যাই হোক, আমাদের সকলের ড্রাইভাররা জায়গাটা চেনে। তাই অসুবিধে হয়নি।   জায়গাটা হলো  উত্তর কলকাতায়, আর জি কর মেডিকাল কলেজ আর হাসপাতালের কাছে।  আমাদের বেরোতে একটু দেরী হয়েছে, তবে এই সাত সকালে কলকাতার রাস্তা ফাঁকা।  তবু আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন ট্রেণ ছাড়বার বেশী দেরী নেই।  দীপঙ্কর, প্রবীর, আর অমিতাভ ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে, আমাদের দেরী দেখে ওরা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল কয়েকবার। 

ট্রেণ দাঁড়িয়ে আছে লাইনের ওপারের প্ল্যাটফর্মে, ওভারব্রীজ দিয়ে  লাইন ক্রস করার সময় হাতে নেই, আমাদের বুড়ো কুলী আমাদের মাল মাথায় নিয়ে হেঁটে লাইন ক্রস করে আমাদের ট্রেণে উঠিয়ে দিলো।  সেই কুলীটির অভিজ্ঞতা আর উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে সেদিন ট্রেণ মিস করিনি।

ট্রেণের চেয়ার কারের টিকিট কেটে রেখেছিলো প্রবীর।

একটু পরেই ট্রেণ ছেড়ে দিলো।  মন্থর গতিতে আমরা কলকাতা শহর আর শহরতলীর মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম, কারুর হেঁসেল, কারুর রান্নাঘর, কারুর উঠোন দুই পাশে দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কিছু কোঠাবাড়ী, তার বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে, ছাতে শাড়ি শুকোচ্ছে।  দুই একটা পুকুর চোখে পড়ছে সেখানে সকালবেলায় দাঁতন করছে কিছু লোক, তাদের পরণে গামছা, হয়তো এর পরে পুকুরে নেমে স্নান সেরে নিয়ে তারা অফিস যাবার জন্যে তৈরী হবে।

একটা নতুন দিন শুরু হচ্ছে, ঘুম ভাঙ্গছে কলকাতা শহরের।  

একটু পরেই অবশ্য শিয়ালদা লাইনে এসে পড়ার পরে  চেনা স্টেশন এক এক করে আসতে লাগলো।  দমদম জংশন, বরানগর, বেলঘরিয়া, আগরপাড়া।  বহুদিন আগে, ১৯৬৬ সালে, আমি তখন খড়্গপুরে থার্ড ইয়ার, গরমের ছুটিতে  আমার ট্রেনিং  ছিল বেলঘরিয়াতে Texmaco কোম্পানীতে। আগরপাড়াতেও Texmaco র একটা ফ্যাক্টরী ছিল, তাই কাজ থাকলে বেলঘরিয়া থেকে আগরপাড়া ও অনেক বার লাইন ধরে হেঁটে গেছি। ওই স্টেশনগুলো পেরিয়ে যাবার সময় সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি মনে ভেসে আসছিল।

ট্রেণ বেশ ভাল স্পীড নেবার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল কামরায় হকারদের আনাগোনা। তাদের মধ্যে বেশ কিছু ভিখারী, একটি বিকলাঙ্গ শিশু দেখলাম ঘষ্টে ঘষ্টে কামরার এক দিক থেকে অন্য দিকে দুই পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথের লোকটি করুণ চোখে হাত পেতে আছে। জীবিকা অর্জ্জনের জন্যে এই শিশুটিকে ব্যবহার করছে তার পরিবার। এই ধরণের দৃশ্য আমাদের সবার মোটামুটি পরিচিত।  আমরা কেউ কেউ ব্যাগ থেকে কিছু খুচরো পয়সা বের করে ওই বাড়িয়ে দেওয়া হাতে গুঁজে দিই। আবার কেউ কেউ উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি।  জগতের সব দুঃখ কষ্ট অনাচার অবিচার অসাম্য দূর করার ক্ষমতা আমাদের নেই। 

এছাড়া আছে খাবার দাবার, ব্রেকফাস্টের জন্যে চা আর স্যান্ডুইচ বিক্রেতারা। বেশ কয়েকবার আমরা লেবু চা কিনে খেলাম।  লেবু চার কাগজের কাপ গুলো এত ছোট যে বার বার না খেলে ঠিক চা খেয়েছি বলে মনেই হয়না।  

এটা কি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চায়ের কাপ?

আর হকারদের কথা তো বলে শেষ করাই যাবেনা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ নেই, যা এখানে পাওয়া যাবেনা।  অফিস স্টেশনারীর পসরা সাজিয়ে একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার হাতে আছে A4 কাগজ, পেন্সিল, বল পয়েন্ট পেন, ফাইল, স্টেপলার, হোলপাঞ্চ, টর্চ, ব্যাটারী এবং আরো অনেক এরকম অত্যন্ত দরকারী জিনিষ।  লোকে পটাপট কিনছে দেখলাম। একজন রংচঙে গামছা বিক্রী করছিল, সুভদ্রা তার কাছ থেকে দুটো লাল নীল বেগুণি রঙের চেক আর স্ট্রাইপ করা গামছা কিনে নিল।  ওই গামছা দিয়ে  সুন্দর কামিজ কিংবা টপ্‌ বানানো যাবে।

এরপরে একটি লোক এলো যে  পিঠ চুলকানোর সুবিধের জন্যে লম্বা প্লাস্টিকের লাঠি বিক্রী করছে। লাঠিটার শেষটা আঙুলের নখের মত ছুঁচলো, চুলকানোর সুবিধের জন্যে।

বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর মেয়েদের এই নিয়ে কোন অসুবিধে থাকেনা। তখন তাদের বাধ্য বরেরা বললেই তারা বৌদের মাথা পা বা কোমর টেপার জন্যে প্রস্তুত। “শুনছো, পিঠের এই জায়গাটায় একটু চুলকে দাওনা গো”, বললেই তারা হাসিমুখে এসে বৌদের হুকুম তামিল করতো।

কিন্তু বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরে এখন সেই বরেদের আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন হয়ে গেছে। এখন তাদের দেখলে আর চেনাই যায়না।

একজন তো সারাদিন ভুরু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে শেয়ার মার্কেটের ওঠা পড়া দেখে।  আর একজন রাত দুটো থেকে রাত চারটে টি ভি  চালিয়ে ফুটবল খেলা দেখে যায়।   আর তৃতীয় জনের অবস্থা আরো খারাপ, সারাদিন তার ফোন আসে, কে বা কারা যে তাকে এত ফোন করে কে জানে, তার ওপরে সে আবার রাত্রে ল্যাপটপ খুলে কি যে হাবিজাবি লেখা লেখে, তার কোন মাথামুন্ডু নেই।

বৌদের সাথে কথা বলার সময় এখন এদের কারুর নেই।

সখীর হৃদয় কুসুম কোমল/কার অনাদরে আজি ঝরে যায়/

কেন কাছে আসো, কেন মিছে হাসো/ কাছে যে আসিত, সে তো আসিতে না চায়/

সুতরাং, এখন হলো নিজের পিঠ নিজে চুলকোবার দিন।  কিন্তু মুস্কিল হলো নিজের পিঠ নিজে চুলকোনো অত সোজা কাজ নয়। ভগবান আমাদের শরীরের ডিজাইন করার সময় পিঠ আর হাতের ভারসাম্যের কথাটা চিন্তা করেননি।  ফলে পিঠের অনেক জায়গাই আমাদের হাত পৌঁছয়না। আর পিঠের যে সব  জায়গা্য আমাদের হাত পৌঁছয়না সেই সব জায়গাই অবধারিত বেশি চুলকোয়। 

সে এক মহা যন্ত্রণা।

সুজাতা সুপ্রিয়া আর সুভদ্রা তিনজনেই প্লাস্টিকের পিঠ চুলকোনোর  লাঠি কিনে নিলো।

এই সব যখন চলছে তখন আমাদের ট্রেণ  একটার পর একটা স্টেশন ক্রস করে যাচ্ছে।  অমিতাভ মাথা নীচু করে চোখ কুঁচকে তার ফোনে স্টেশন এর নাম দেখে যাচ্ছে, বেথুয়াডহরী, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর…

খুব কম স্টেশনেই আমাদের ট্রেণ থামছে। বেলঘরিয়ার পরে রাণাঘাট আর তার পরে কৃষ্ণনগর। প্রত্যেক স্টেশনে মাত্র এক মিনিটের জন্যে ট্রেণ দাঁড়ায়।  সামনে বহরমপুর আর তারপর আমাদের স্টেশন মুর্শিদাবাদ। এক মিনিটের মধ্যে নামতে হবে, তাই আমরা আগে থেকেই ওপরের র‍্যাক থেকে আমাদের ব্যাগ নামিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিয়েছি।

অমিতাভ দুটো Toyota Innova SUV বলে রেখেছিল, সেই দুটো গাড়িতে চড়ে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য কাশিমবাজারের রাজবাড়ী।

২) কাশিমবাজার রাজবাড়ী

স্টেশন থেকে কাশিমবাজারের রাজবাড়ী বেশী দূর নয়। পথে আসতে আসতে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রধান এবং জনবহুল, ব্যস্ত এবং ব্যবসায়িক অঞ্চল লালবাগের রাস্তাঘাটে প্রচুর ভীড় আর রাস্তায় অনেক ঘোড়ায় টানা গাড়ী চোখে পড়ল।  বিয়ের পরে সুভদ্রা আর আমি একবার ১৯৭৫ সালে মুর্শিদাবাদে এসেছিলাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে  মুর্শিদাবাদে এসে রাস্তার ভীড় আর ঘোড়ায় টানা গাড়ী দেখে সেই পুরনো দিনগুলো আবার মনের মধ্যে ফিরে এলো।

সেবার একদিন একটা সাইকেল রিক্সায় চেপে আমরা অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম, হাজারদুয়ারী, মোতিঝিল এই সব জায়গার নাম এখন আবছা মনে পড়ে, কিন্তু এখন এতদিন পরে স্মৃতি একেবারেই ঝাপসা।  আমার ক্যামেরায় অনেক ছবিও তুলেছিলাম সেবার, তার মধ্যে আমার সুন্দরী নতুন বিয়ে করা বৌয়ের নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবিই বেশী ছিল।  

এই প্রাচীন শহর অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এই শহরে ছড়িয়ে আছে বহু দর্শনীয় স্থান, যেখানে বাংলার ইতিহাস জানার জন্যে যেতেই হবে। দুঃখের বিষয় বিয়ের পরের সেই দিনগুলোতে অতীতের ইতিহাস আমার জীবনে ততোটা গুরুত্ব পেতোনা, তখন বর্ত্তমানেই মজে ছিলাম। এখন এই বয়েসে এসে ইতিহাস জানার ইচ্ছেটা বেশী।

একসময় সমস্ত বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবী মসনদ থেকে। শুধু মাত্র নবাবরাই নন, বর্ধিষ্ণু এই অঞ্চলে ছিল বহু জমিদার বংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি।  পরে সেই ধনী জমিদারদের মধ্যে অনেকে ইংরেজ শাসকদের কাছে রাজা উপাধি পান্‌। কাশিমবাজার রাজবাড়ি সেই ইতিহাসেরই মূর্ত প্রতীক।

আমরা কাশিমবাজারের রাজবাড়ী পৌঁছে গেলাম মিনিট পনেরোর মধ্যে।

প্রথম দর্শনে সামনে থেকে দেখে ধবধবে সাদা বাড়ীটির ইউরোপীয় (Romanesque) স্থাপত্য আমার চোখে খুব সুন্দর লাগলো। সামনে ত্রিভুজাকার façade, এবং তার তলায় বেশ কিছু স্তম্ভ, আর বাড়ীটির সামনে ঘন সবুজ রং এর ঘাসের গালিচা বাড়ীর সাদা রং এর সাথে একটা অদ্ভুত সুন্দর contrast তৈরী করে বাড়ীটার একটা বনেদী চেহারা দিয়েছে।

১৯৭৪ সালে সুভদ্রার আর আমার বিয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতায় কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে। এলগিন রোড আর হরিশ মুখার্জ্জী রোডের মোড়ে অবস্থিত ওই রাজবাড়ীটি তেও যতদূর মনে পড়ছে ধবধবে সাদা প্রাসাদোপম বাড়ীর সামনে বিশাল সবুজ লন্‌ ছিল। আমার মাস্তুতো দাদা রতনদা’ বোধহয় ওই রাজবাড়ীতে কাউকে চিনতেন, তিনিই বৌভাতের জন্যে বাড়ীটির বন্দোবস্ত করে দেন্‌।

যাই হোক্‌, ভিতরে ঢুকে রিসেপশনে চেক ইন করে দোতলায় যার যার নিজের ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নীচে একতলায় নেমে এলাম আমরা। সেখানে একটা বিশাল ডাইনিং রুম, এক দিকে একটা লম্বা টেবিলে আমাদের জায়গা করা হয়েছে। শেফ ভদ্রলোক আমরা পল্লবের চেনা বলে এসে খুব খাতির করে এসে আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন।

লাঞ্চের মেনু পুরো বাড়ীর খাবার, সুক্তো, ডাল, ভাত, পাঁচমিশেলী তরকারী, মাছের ঝোল, মাংস, চাটনি – সব সুস্বাদু বাঙালী রান্না। শেষ পাতে মিষ্টি ছিল লাল দই, আর বহরমপুরের বিখ্যাত মিষ্টি, ছানাবড়া। কাশিমবাজারের রায় পরিবারের এখন একটা মিষ্টির দোকান কলকাতায়  খুব নাম করেছে, তার নাম “Sugarr and Spice”,মুর্শিদাবাদের রাজবাড়ীতেও তাদের একটা দোকান আছে সেখান থেকেই আবাসিক দের জন্যে মিষ্টি সরবরাহ করা হয়। 

জমিয়ে খেলাম সবাই, বেশ ক্ষিদেও পেয়েছিল। দুই দিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ শহরে যত দেখার জায়গা আছে, সব তো চাক্ষুস করা সম্ভব নয়, এই বয়সে এসে বেশী ছোটাছুটিও আমরা করতে চাইনা।  হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে আমরা আজ আর সামনের দুই দিন কোথায় কোথায় যাওয়া যায় আর কি কি দেখা যায়, তার একটা ছক করে ফেললাম।

) কাটরা মসজিদ

প্রথমে কাটরা মসজিদ। এখানে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর সমাধি। ঢোকবার মুখেই বেশ কিছু গাইড দাঁড়িয়ে।

সেই গাইড দের মধ্যে একজনের সাথে আমাদের রফা হলো। তার নাম মনোজ তরফদার। তার কাছে শুনলাম যে কাটরা মসজিদ এবং মুর্শিদাবাদের অন্যান্য যত প্রাচীন প্রাসাদ আছে সব সরকারী পুরাতত্ত্ব বিভাগ  ASI (Archeological Society of India) দেখাশোনা করে। এই গাইড রাও সবাই ASI দ্বারা লাইসেন্স প্রাপ্ত।

এক হিন্দু পরিবারে ১৬৭০ সালে এক হিন্দু ব্রাম্ভন পরিবারে মুর্শিদকুলী খাঁর জন্ম, তাঁর নাম ছিল সূর্য্য নারায়ণ মিশ্র।  ন’বছর বয়েসে, মাথা মুন্ডন করে পৈতে নেওয়া হয়ে গেছে, সংস্কৃত মন্ত্র ছাড়াও রামায়ণ মহাভারত পুরান পড়েন। গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ। সেই সময় পারস্যের এক ধনী ব্যক্তি সফিউদ্দীন ইসলাম তাঁকে দত্তক নেন্‌, এবং ইসলাম ধর্মে  ধর্মান্তরিত করেন। তখন তাঁর নাম হয় কারতলব খান।

সফিউদ্দীন সম্রাট আওরংজেবের কাছের মানুষ ছিলেন। সফির পালিত পুত্র কারতলবের জমি জমা আর কর খাজনা ইত্যাদির হিসেব করার কাজ দেখে খুসী হয়ে  সম্রাট আওরংজেব ১৭০০ সালে তাঁকে মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি দিয়ে বাংলার দিওয়ান করে ঢাকায় (তখন জাহাঙ্গীরাবাদ) পাঠান। 

ঢাকায় তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবেদার ছিলেন সম্রাটের নাতি আজিম উস শান, যিনি কারতলবের প্রতি আওরংজেবের স্নেহ ভাল চোখে দেখেননি। তাঁদের শত্রুতা চরমে ওঠায়, মুর্শিদকুলী  আওরংজেবের অনুমতি নিয়ে ঢাকা থেকে কিছুটা পশ্চিমে মুকসুদাবাদ নামে একটি ছোট শহরে তাঁর দপ্তর সরিয়ে আনেন।   ১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি আনুগত্য ও দক্ষতার সাথে দিওয়ান হিসেবে তাঁর কাজ করে গেছেন, নিয়মিত মোগল সম্রাটের কাছে খাজনা পাঠিয়েছেন, এবং নিজের প্রদেশে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন এবং জায়গীরদার প্রথা সংক্রান্ত নানা উদ্ভাবনী কাজ করেছেন।

দিল্লীতে আজিম উস শানের ছেলে ফারুকশিয়ার মোগল সম্রাট হবার পরে তিনি ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলী খান কে বাংলা প্রদেশের সুবেদার করেন, কিন্তু চার বছর পরে মুর্শিদকুলী খাঁ মোগলদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে খাজনা পাঠানো বন্ধ করে  ১৭১৭ সালে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হন্‌। এবং এই মুকসুদাবাদই পরে  স্বাধীন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ হয়ে ওঠে।

কাটরা কথাটার মানে হলো সরাই খানা, সেই মধ্যযুগে বিদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা  এই সরাইখানা তে বিশ্রাম নিতো, সাথে খানা পিনা নাচ গান ও হতো নিশ্চয়। 

কাটরা মসজিদ একটা চৌকো জায়গা নিয়ে তৈরী, যার চার কোণে বসানো চারটে উঁচু মিনার। ইঁটের তৈরী লাল রং এর মসজিদ, তার চারিপাশে  সবুজ বাগান আর সামনে একটা লম্বা দোতলা বাড়ী, সেটাও লাল ইঁটের তৈরী, তাতে সারি সারি ঘর আর জানলা। এই ঘরগুলো নাকি ছিল ৭০০ জন মাদ্রাসার ছাত্রদের কোরান পড়ার জন্যে। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই মসজিদ ছিল ইসলামী শিক্ষার একটি বড় কেন্দ্র। 

চারিদিকে লাল রং আর মাঝখানে সাজানো সবুজ বাগান পরিবেশকে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে সেরকম ভীড় নেই, শুধু আমরা ক’জন, সেই নির্জনতাও খুব উপভোগ করেছিলাম সেদিন।  ১৭২৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর তৈরী এই কাটরা মসজিদ আজ দেশের হেরিটেজ প্রপার্টি।

মনোজ আমাদের গল্প করলো যে দিওয়ান হবার পরে মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাট আওরংজেব কে খুসী করার জন্যে নিয়মিত খাজনা পাঠিয়ে দিতেন।  একবার তিনি নাকি তাঁর ছেলের হাতে ১০০০ স্বর্ণ মুদ্রা (মোহর) পাঠিয়েছিলেন, সে নাকি তার মধ্যে থেকে একটি মোহর এক গরীব দুঃখী লোক কে দান করে। ভেবেছিল কেউ গুণে দেখবেনা তাই ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

কিছুদিন পরে মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাটের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। তাতে লেখা এক হাজারের জায়গায় একটা মোহর কম পাঠিয়েছো দেখছি, কি ব্যাপার?

ছেলে কে জিজ্ঞেস করে যখন জানলেন সে একটা মোহর একজন গরীব লোককে দয়াপরবশ হয়ে দান করেছে, তিনি নাকি ছেলেকে মেরে তার মৃত ছেলের শিরচ্ছেদ করে তার মাথা  ও একটি মোহর সম্রাট কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। 

যখন আমরা মনোজের  এই গল্প অবাক হয়ে শুনছি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দীপঙ্কর, খেলোয়াড়ী হাফ প্যান্ট (বার্মুডা) পরে তাকে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে, নীচু গলায় সে আমায় বললো “এর একটা কথাও বিশ্বাস কোরোনা ইন্দ্রজিৎ, সব ডাহা গুল!”

তারপরে মনোজ বললো নবাবের বড় মেয়ে আজিমুন্নিসা বেগমকে তাঁর কোন একটি ব্যাধি নিরাময়ের জন্যে ১০০ টি শিশুর কলিজা খাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁর ব্যাধি নিরাময় হলেও শিশুদের কলিজা খাওয়া নাকি তাঁর নেশা হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে তাকে কলিজা খেকো বেগম ও বলা হয়।   মুর্শিদকুলি খাঁ না কি সে জন্যে রেগে গিয়ে নিজের মেয়েকে জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলেন।  

আমার পাশ থেকে অবিশ্বাসী দীপঙ্কর আবার বলে উঠলো “ইন্দ্রজিৎ এসব পুরো গ্যাঁজা, বুঝেছো তো?”

মনোজ বলল “না স্যার, সত্যি স্যার, কলিজা খাকী বেগমের সমাধি আর বাচ্চা মসজিদ এখান থেকে কাছে, বলেন তো আমি আপনাদের দেখিয়ে আনতে পারি ওখানে সব লেখা আছে!”

মুর্শিদকুলী খাঁ  যতদূর জানা যায়, দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, ১৭২৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্য্যন্ত তাঁর রাজত্বে শান্তি এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় ছিল। কাটরা মসজিদের প্রাঙ্গনে বাগানের এক পাশে একটি ছোট শিবমন্দির দেখলাম। ব্যক্তিগত জীবনেও মুর্শিদকুলী খাঁ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেননা, তাঁর হারেম ছিলনা, এক স্ত্রীর সাথে সারা জীবন কাটিয়েছেন। 

জমিজমা সংক্রান্ত আইনের সংস্কারকে মুর্শিদকুলী খাঁর অন্যতম অবদান হিসেবে ধরা হয়।  মোগলদের জায়গীর প্রথাকে পালটে তিনি যে জমি আইনের প্রবর্ত্তন করেছিলেন, তাই শেষে জমিদারী প্রথা হিসেবে চালু হয়।  

কাটরা মসজিদ থেকে বেরোবার দরজার পাশে নীচে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে, মনোজ দেখালো মাটির তলায় নবাবের সমাধি। ধর্ম্মপ্রাণ নবাবের নাকি ইচ্ছে ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পরে মানুষের যাতায়াতের পায়ের তলায় তাঁর সমাধি থাকবে, যাতে জীবনে যত পাপ তিনি করেছেন, মানুষের পায়ের তলায় কবরে শুয়ে থাকলে সেই পাপের কিছুটা  প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে।

৪) জাহানকোষা কামান

কাটরা মসজিদের পরে জাহানকোষা কামান।  জায়গাটা খুব কাছে । দুই মিনিটে পৌঁছে গেলাম।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে শুধু যুদ্ধ।  ক্ষমতা আর আধিপত্যের, লোভ আর হিংসার কাহিনী।  আর সেই যুদ্ধে ব্যবহার হয় গুলি বারুদ আর কামান।

কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর বিখ্যাত “পলাশীর যুদ্ধ” কাব্যে লিখেছিলেন,
“আবার, আবার সেই কামান গর্জন!
কাঁপাইয়া ধরাতল, বিদারিয়া রণস্থল,
উঠিল যে ভীম রব, ফাটিল গগন”
আজ কবি কথিত সেই সব কামান অব্যবহার্য হয়ে পড়লেও তাদের আকর্ষণ বিন্দুমাত্রও কমেনি। পশ্চিমবঙ্গের যে দু’টি বিখ্যাত কামানের নাম সর্বজনবিদিত, সেগুলি হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের দলমাদল এবং মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা। প্রথমটি প্রচারের আলোয় অনেকটা বেশি আলোকিত হলেও জাহানকোষার মাহাত্ম্যও কম নয়।

জাহানকোষা কামানটি রাখা আছে কাটরা মসজিদ থেকে কাছেই একটি গ্রামে যার নাম তোপখানা। আমাদের গাড়ী দুটো সেই গ্রামের ভিতরে ঢুকে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। গাছপালার মধ্যে ধুলোমাখা সরু রাস্তা, সেই পড়ন্ত বিকেলে কিছু লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে, বাচ্চারা খেলা করছে। কিছুটা দূরে একটা ঘেরা জায়গায় দেখা যাচ্ছে একটি কামান, কিছুটা যেন অনাদৃত, অবহেলিত আর একলা, আশে পাশে তাকে দেখার বা তাকে দেখে মুগ্ধ বা আশ্চর্য্য হবার কেউ নেই। পর্য্যটক বা গাইড ও কেউ নেই। শুধু আমরা ক’জন।

অষ্টধাতু দিয়ে তৈরী বলে কামানে এখনো কোন জং পড়েনি। কামানটির গায়ে খুব সুক্ষ্ম কাজে লেখা আছে ফারসী ভাষায় কোন লিপি। পাশে একটা ASI এর নোটিস বোর্ড সেখানে কামান সংক্রান্ত অনেক তথ্য।  যে লোহার চাকাযুক্ত গাড়িতে কামানটি স্থাপিত ছিল তা বহু বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।  

৫) মোতিঝিল

ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামছে, আমরা মোতিঝিল প্রাসাদের দিকে রওনা দিলাম।

মোতিঝিল মুর্শিদাবাদ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। একটা বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে, সেই গেটে বড় বড় করে “মোতিঝিল” লেখা। গেটের সামনে অনেক দোকান পাট, ভীড়। ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় সাজানো বাগান, আর এক দিকে একটা বেশ বড় ঝিল।

মুর্শিদাবাদে মোতিঝিলে ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ হল পর্য্যটকদের জন্য একটা বড় আকর্ষন।

কে এই ঘসেটি বেগম?

১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁর মৃত্যুর পরে নানা ঘটনাবলীর পরে ১৭৪০ সালে বাংলার নবাব হন্‌ আলীবর্দ্দী খাঁ। দীর্ঘ ষোল বছর (১৭৬০ সাল পর্য্যন্ত) তিনি বাংলার নবাব ছিলেন।  

আলিবর্দ্দীর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের স্বামী আলীবর্দ্দির ভ্রাতুষ্পুত্র নওয়াজেস মহম্মদ ধনী ছিলেন এবং তিনি দানধ্যানে বহু অর্থ অকাতরে বিলোতেন।  তাঁরা থাকতেন মুর্শিদাবাদে মোতিঝিল প্রাসাদে।  নওয়াজেস  তাঁর দান ধ্যান এবং ধার্মিক ব্যবহারের জন্যে ক্রমশ; সাধারণ এবং অভিজাত সবার মধ্যেই অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠছিলেন।  নওয়াজেস আলিবর্দ্দীর জীবনদশাতেই অল্প বয়েসে মারা না গেলে হয়তো সিরাজের জায়গায় তিনিই নবাব হতেন। তাহলে বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হতো কিনা কে জানে?

তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে ঘসেটি বেগম উত্তরাধিকার সূত্রে তার স্বামীর কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ধন সম্পদ পান। মোতিঝিল প্রাসাদে গেলে সেই সব ধন রত্ন বিলাস সামগ্রী আজও যত্ন করে সাজানো আছে দেখা যায়।  

নবাব আলীবর্দ্দী খানের  মৃত্যুর পরে, ঘসেটি বেগম চেষ্টা করছিলেন দ্বিতীয় বোন শাহ বেগমের পুত্র  শওকত জঙ্গ কে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত আলিবর্দ্দী খাঁ  মৃত্যুর আগে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের ছেলে সিরাজউদ্দৌলা কে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব হিসেবে অভিষিক্ত করেন।  

ঘসেটি বেগম তাই নবাব আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীরজাফর, ধনী ব্যবসায় জগৎ শেঠ, এবং উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ দের কাছে পরাজিত হন এবং ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানান।

বিয়ের পরে যখন আমরা এসেছিলাম, মনে আছে এই প্রাসাদের ভিতরে আমরা অনেকটা সময় কাটাই। সেখানে অনেক দর্শনীয় এবং মূল্যবান জিনিষ ছিল, তার মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ে লাল নীল কাঁচের জানলা, যা কিনা বিদেশ থেকে কেনা।  তা ছাড়া ঝাড়লন্ঠন ঘর সাজানোর জিনিষ, নানা কারুকার্য্য, চারিদিকে বৈভবের ছড়াছড়ি।

এবার আর হাতে বেশী সময় না থাকায় ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ পর্য্যন্ত আর হাঁটা গেলনা।  গেট থেকে প্রাসাদ পর্য্যন্ত একটা ছোট ট্রেনে করে যাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল, কিন্তু সন্ধ্যা নামায় সেটাও বন্ধ।  আমরা তাই ঝিলের ধারে একটু হেঁটে বেড়ালাম।

৬) সন্ধ্যার আড্ডা    

কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে একটু বিশ্রাম করে আমরা বসলাম আড্ডায়। দোতলায় আমাদের ঘর গুলো পাশাপাশি, এই সময়ে  হোটেল খালি, আমরা ছাড়া এখানে আর কোন অতিথি নেই।

দীপঙ্কর আর অমিতাভর ঘরের পাশে একটা বসবার ঘর আছে লাউঞ্জের মত, সেখানে অনেক চেয়ার পাতা। দীপঙ্করের আনা মহার্ঘ্য হুইস্কি আর জিন যে যার মতো নিয়ে জমিয়ে বসলাম আমরা। 

আমাদের মধ্যে দীপঙ্কর সেই কলেজ জীবন থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভক্ত।  খুব কম বয়েস থেকেই নানা সঙ্গীত সন্মেলন এর টিকিট কেটে রাত জেগে সে বিখ্যাত নানা শিল্পীর অনুষ্ঠান শুনতো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে তার একটা স্বাভাবিক আর সহজাত ভাল লাগা ছিল। তার ওপরে সে বেশ কিছু বছর ধরে নানা জায়গা থেকে অনেক দুষ্প্রাপ্য  শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরনো রেকর্ড আর সি ডির collection  করে আসছে। এই সব দুষ্প্রাপ্য গান শুনতে তার বাড়ীতে নানা গুনীজনের আগমন হয়।

হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রাগ রাগিনী ও নানা ঘরানার শিল্পীদের নিয়ে তার অপরিমিত পড়াশোনা আর জ্ঞান।  আমাদের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় তার উত্তেজনা দেখে আমরা যারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তেমন বুঝিনা, তারাও বুঝি যে ব্যাপারটা তার কাছে একটা গভীর প্রেমের মত, একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

কিন্তু মুস্কিল হলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে একটা নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে, তার বাইরে যাওয়া নিয়ে দীপঙ্করের প্রবল আপত্তি।  এ ব্যাপারে সে কঠোর ভাবে রক্ষণশীল। তাই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তার নানা অভিযোগ, এমন কি সে রবীন্দ্রনাথকেও পছন্দ করেনা, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাবার কথা উঠলে সে অবজ্ঞা করে বলে তোমরা যাও, আমার ওখানে যাবার কোন ইচ্ছে নেই।

এদিকে সুপ্রিয়া আবার রবীন্দ্রনাথের গানে একেবার যাকে বলে নিমজ্জিত। মুম্বাই তে তার বাড়ীতে সে রবীন্দ্রনাথের  গান শেখানোর স্কুল খুলেছিল।  শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও তার যথেষ্ট তালিম আছে।  গানের ভাব প্রকাশের জন্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শৃঙ্খলার সামন্য একটু এদিক ওদিক হলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়, এই নিয়ে দীপঙ্করের সাথে তার তর্ক শুরু হয়ে গেল।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন রাগাশ্রিত গানে কঠোর রাগের আধার কে মুখ্য করে তোলেননি। গানের কথার চারিপাশে তিনি  উন্মুক্ত রেখেছেন সুরের প্রবাহ, রাগের মূল মেজাজ ও লয় বজায়  রেখে তিনি কাঠামোগত বন্ধন থেকে তাঁর  গানগুলিকে মুক্তি দিয়েছেন।  

আমরা বাকিরা এই তর্কে যোগ দিইনা, তবে সাধারণ ভাবে যেহেতু আমরাও সুপ্রিয়ার মত রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালবাসি এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আমাদের তেমন জ্ঞান বা উৎসাহ নেই, তাই আমরা এই তর্কে মনে মনে সুপ্রিয়ার পক্ষেই থাকি।

বেশ কিছুক্ষণ তর্ক চলার পরে শেষে আমরা সুপ্রিয়া কে গান গাইতে অনুরোধ করলাম। সে আমাদের অনুরোধে দুটি গান গাইলো~

“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা”, আর “বাজিল কাহার বীণা”।

বড় ভাল গায় সুপ্রিয়া। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম।  

আমার জীবনে “আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা” গানটার একটা বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৪ সালে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সুভদ্রার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্ত্তা চলছে। তো একদিন আমরা বেশ কয়েকজন জানুয়ারী মাসের এক বিকেলে গেছি ওদের সাঁতরাগাছির বাড়ীতে, কনে দেখা আর জামাই দেখা দুটোই একসাথে হবে।

আমার মা’র অনুরোধে সেদিন সুভদ্রা আমাদের ওই গানটা খুব সপ্রতিভ ভাবে গেয়ে শুনিয়েছিল।  রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্য্যায়ের ওই ছোট গানটিতে প্রতিটি ছত্রে ভালবাসার কথা।        

আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয়/

বড় উতলা আজ পরাণ আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও?/

অনাত্মীয় অল্পবয়েসী একটি সুন্দরী মেয়ে আমার মত একজন অচেনা ছেলে কে একঘর লোকের সামনে প্রেম নিবেদন করবে তা তো হতে পারেনা। আমি অত নির্বোধ ও ছিলাম না যে তা ভাববো।  কিন্তু আমি নিজেকেই কিছুটা অবাক করে দিয়ে সুভদ্রার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে একটি ছোট প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলাম।

গোপন কথাটি রবে না গোপনে/ উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে/ 

হয়তো আমি  সেই অচেনা সুন্দরী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম “হ্যাঁ, আমি খেলায় হার মানতে রাজী, যদি তুমি আমার সাথে খেলতে রাজী থাকো।”

আমরা দু’জনেই রবীন্দ্রনাথের গান ভালবেসে শুনতাম। কবি তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই আমাদের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন।   

সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কিন্তু সেই বিকেলটার স্মৃতি আমার মনে এখনো অমলিন।  বিশেষ করে এই গানটা যখন যেখানেই শুনি, মনে মনে চলে যাই সেই পঞ্চাশ বছর আগের এক শীতের বিকেলে একটি অচেনা সুন্দরী মেয়ের গান শুনে তাকে ভাল লাগার  দিনে।

সুপ্রিয়াকে পরে সেই কথা জানিয়ে ঐ গানটি সেদিন গাইবার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। 

মোতিঝিল

 দ্বিতীয় দিন – ১৩/১২/২০২৩

) কাঠগোলা 

আজকে সকালে সবাই তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে এলাম। আজ প্রাতরাশে প্রথমে ফলের  রস, তার পরে লুচি হালুয়া তরকারী। সাথে টোস্ট ডিম, চা কফি।

শেফ ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির করছেন, লাঞ্চে কি খাবেন, ডিনারে কি খাবেন সব জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন আগে থেকেই। আমরা যখন খেতে বসি তিনি নিজে এসে তত্ত্বাবধান করে যান।  রাজবাড়ীতে এই ক’দিন বেশ রাজার হালেই থাকা যাবে মনে হচ্ছে। 

আজ আমাদের প্রথম স্টপ হলো কাঠগোলা। এটা এক পুরনো দিনের রাজস্থানী ব্যবসায়ী পরিবারের বাগানবাড়ী। গেট দিয়ে ঢুকে একটি অল্পবয়েসী ছেলেকে আমাদের গাইড হিসেবে পেলাম। তার বিশেষত্ব হলো সে একজন স্বভাব কবি, অধিকাংশ সময়ে সে আমাদের সাথে কবিতায় কথা বলছিল। 

মোগল আমলে রাজস্থান থেকে আসা জৈন ব্যবসায়ীদের আনাগোনা এখানে বাড়তে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিচিত নাম অবশ্যই জগৎ শেঠ। নবাব এবং ইংরেজদের দু’ দিকের সাথেই এদের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল, তাদের তাঁরা  চড়া শুদে টাকা ধার দিতেন।  ব্যবসা করে এদের এত বাড়বাড়ন্ত হয়েছিলে, যে শোনা যায় এঁদের ধন সম্পত্তি নাকি আজকের আদানী আম্বানীর থেকেও অনেক গুণ বেশী ছিল।

কাঠগোলা বাগান বা কাঠগোলা প্রাসাদ তার কালো গোলাপ এর বাগান আর আদিনাথের (জৈনধর্মের আদিপুরুষ) মন্দিরের জন্যে বিখ্যাত। পঞ্চাশ বিঘা জুড়ে এক বিশাল জমির ওপর এই বাগান বিস্তৃত। কালো গোলাপ অবশ্য এখন আর নেই, কিন্তু সেখানে আজ এক বিশাল আমবাগান। কথিত আছে এই কাঠগোলা বাগান আর প্রাসাদ তৈরী করেন লক্ষীপত সিং দুগার। আজ কাঠগোলার এই বাগানটি মুর্শিদাবাদের পর্য্যটকদের জন্যে একটি অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনস্থল। বাগানের চার কোণে চারটি অশ্বারোহীর সাদা মার্বেলের স্ট্যাচু। শোনা গেল তারা হলেন সেই দুগার পরিবারের চার ভাই।

কাঠগোলা নাম কেন? আমাদের গাইডের কাছে শুনলাম দুগার দের নাকি বিশাল কাঠের ব্যবসা ছিল, সেখান থেকেই ওই নাম।

গেট দিয়ে ঢুকে সামনেই একটা বিশাল টলটলে জলের বিশাল পুকুর, কিছু লোক ঘাটে দাঁড়িয়ে জলে খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর জলের মধ্যে অনেক রঙ্গীন মাছ খলবল করে জলে ঢেউ তুলছে। পুকুরের চার দিকে ঘাটের সিঁড়ি জলে নেমে গেছে, বেশ কিছু রাজহাঁস সেখানে ব্যস্ত ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

কাঠগোলার দুগার দের সাথে জগৎ শেঠের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল।  আমাদের গাইড রাস্তার পাশে একটি সুড়ঙ্গ দেখালো, সেখানে সিঁড়ি নেমে গেছে এবং নীচে জল দেখা যায়। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি এই বাড়ীর সাথে জগৎ শেঠের বাড়ীতে মাটির তলা দিয়ে জলপথে যোগাযোগ ছিল। গোপন নথিপত্র সরকারী নজর এড়িয়ে নাকি এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নৌকা করে বা অন্য কোন উপায়ে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হত।

পথচারীদের সেই সুড়ঙ্গের কাছে না আসার জন্যে বলা হত এখানে মেয়েরা স্নান করছে, একটু দূরত্ব রেখে হাঁটুন। আমাদের গাইড কবিতায় বুঝিয়ে  বললো – “মেয়েরা হেথায় করিতেছে স্নান, আপনারা দয়া করে দূর দিয়ে যান্‌!”

আর একটু এগিয়ে গেলে দুগার পরিবারের একটা বিরাট প্রাসাদ, আর পাশে ফুলের বাগান। এখানে নাকি রঙ্গীন মাছগুলো মারা গেলে তাদের যত্ন করে মাটির তলায় কবর দেওয়া হত। আমাদের গাইড বললো – “দ্যাখো মাছেদের কি কদর, মাটির নীচে তাদের কবর!”

প্রাসাদ ছেড়ে এগিয়ে গেলে একটা চাঁপা গাছ, তার গুঁড়ির একটা দিক বেশ কিছুটা ভেঙ্গে ফাঁক হয়ে গেছে,  আমাদের কবি গাইড এর ভাষায় “গাছটি চাঁপা, পিছনটা ফাঁপা”।

বাগানের পাশে একটু দূরে দেখলাম একটা ধবধবে সাদা মার্বেলের তৈরী মন্দির।  এই হলো সেই কাঠগোলার বিখ্যাত পরশনাথের মন্দির। তার সামনে ফুলের বাগান। গাইডের কাজ শেষ, সে এবার ফিরে যাবে।

সে আমাদের বিদায় জানিয়ে বললো – “সামনে বাগান, আমি যাই, আপনারা আগান!”

২) জগৎ শেঠের বাড়ীনসীপুর

কাঠগোলার পরে আমাদের গন্তব্য জগৎ শেঠের বাড়ী।

স্কুলে থাকতে ইতিহাস পড়ে আমার ধারণা ছিল যে জগৎ শেঠ একজন ধনী ব্যবসায়ীর নাম। আমি মনে মনে তাঁর চেহারা ও কল্পনা করতাম বিশাল বপু, বিশাল গোঁফ, কিছুটা আমাদের বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের মত।

পরে জানলাম জগৎ শেঠ আসলে একজন বিশেষ কারুর নাম নয়, ওটা একটা পারিবারিক উপাধি। এই উপাধির মানে তারা হল জগতের অর্থাৎ সারা পৃথিবীর মালিক। 

এই পরিবারের আদিপুরুষের নাম মাণিক চাঁদ। তিনি ব্যবসার সুত্রে ১৭০০ সালে প্রথম পাটনা থেকে ঢাকা আসেন। মাণিকচাঁদের নিজের সন্তান ছিলনা, ১৭১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পালিত পুত্র ফতেচাঁদ শেঠ পরিবারের ব্যবসার উত্তরাধিকারী হন্‌ এবং তাঁর সময়ে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে।  ১৭২৩ সালে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ার ফতেচাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি দেন। এরপর থেকে ফতেচাঁদের পুরো পরিবার জগৎ শেঠ পরিবার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তার সময়েই শেঠ পরিবারের যশ-প্রতিপত্তি চূড়ায় পৌঁছয়। 

জগৎ শেঠের বিলাসবহুল বাড়ী এখন একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। বাড়ীর পাশে একটি বড় সাদা রং এর  জৈন মন্দির। টিকিট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।

বাড়ীর ভিতরে ঢুকে মিউজিয়াম,  শেঠদের নানা ব্যক্তিগত সংগ্রহ সেখানে রাখা। টাকশালে তৈরী সোনা আর রূপোর মুদ্রা।  মুর্শিদাবাদের সিল্ক আর  ঢাকাই মসলিন শাড়ী। এছাড়া কিছু প্রাকৃতিক সৃষ্টি, যেমন ফসিল ও উল্কা পাথর।  বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য অয়েল পেন্টিং দেয়ালে টাঙানো। মূল্যবান আসবাব পত্র, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছাপ মারা লোহার চেয়ার। অস্ত্র শস্ত্র রাখার গুপ্ত ঘর মাটির ২০ ফিট তলায়।

আর মাটির তলায় সেই গুপ্ত সুড়ঙ্গ – যার অন্য দিকটা আমরা একটু আগে দেখে এসেছি কাঠগোলায়।

সব মিলিয়ে জগৎ শেঠের বাড়ীর ভিতরে ঢুকে খুব একটা আহামরি কিছু লাগলোনা আমাদের কাছে।  বেশ এলোমেলো ভাবে জিনিষপত্র রাখা, কিছু মরচে পড়া কোম্পানীর আমলের কিছু মরচে পড়া লোহার চেয়ার রাখা আছে ঘরের এক কোণে। দেয়ালে রং ও করা হয়নি বহুদিন। যত বৈভব আশা করেছিলাম, তত কিছু চোখে পড়লোনা।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনকুবের, যার কাছে আজকের আদানী, আমবানী, বিল গেটস, এয়ন মাস্ক, জেফ বেজোস সবাই শিশু, তার বাড়ী দেখে বেশ আশাভঙ্গই হয়েছিল সেদিন আমাদের।

প্রবীর অমিতাভকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, জগুদা’ দের এত টাকা কি করে হলো রে?”

আসলে আমি আর প্রবীর হলাম ইঞ্জিনীয়ার,  লোহা লক্কড় যন্ত্রপাতি নিয়ে আমাদের কাজ, ওদিকে অমিতাভ আর দীপঙ্কর হলো ফাইন্যান্সের লোক, টাকা জমানোর ব্যাপারটা ওরা ভাল জানবে।

দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, টাকা রোজগার করার অনেক ফন্দী ফিকির আছে, সে সব জানতে গেলে আগে টাকা ভালবাসতে হবে, টাকা অন্ত প্রাণ হতে হবে। ক্ষমতাশালী রাজাদের (আজকের দিনে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের) সাথে যোগাযোগ আর বন্ধুত্বের  সম্পর্ক  তৈরী করা হলো সবচেয়ে জরুরী।  রাজনৈতিক ক্ষমতা আর ব্যবসা – power and business –  এই দুইয়ের সম্পর্কের নাম হলো Crony capitalism, ব্যাপারটা আগেও ছিল, এখনো আছে। জগু দা’রা এই ব্যাপারটা খুব ভাল জানতেন। ”

অমিতাভ তার সাথে যোগ করে বললো, “অবশ্য টাকা থাকলেই জীবনটা সুখের হবে তার কোন মানে নেই। না হলে এই জগৎ শেঠের পরিবারে এত সৈন্য সামন্ত, এত অস্ত্রশস্ত্র কেন দরকার হতো?” 

আমি বললাম “ওরা হলো গিয়ে ভাগ্যলক্ষীর বরপুত্র। সেই Abba র গানটা মনে আছে তো? It’s a rich man’s world?” 

Money, money, money, must be funny, in the rich man’s world/
Money, money, money, always sunny, in the rich man’s world/

৩) হাজারদুয়ারী

হাজারদুয়ারী মুর্শিদাবাদের অন্যতম দর্শনীয় জায়গা। বাস্তবিক হাজারদুয়ারী আর মুর্শিদাবাদ দুটো কথা প্রায় সমার্থক। আমরা যে ট্রেনে এসেছি তার নাম ও ছিল হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস। সুতরাং মুর্শিদাবাদ এলে হাজারদুয়ারী তো দেখতেই হবে।

জগৎ শেঠের বাড়ীর পরে আমরা গেলাম হাজারদুয়ারী দেখতে।  কাছেই, গাড়ীতে মিনিট দশেক লাগলো। যখন পৌঁছলাম তখন বেলা হয়েছে, মাথার ওপরে সূর্য্য, বেশ গরম।

গঙ্গার ধারে একটা বিশাল জায়গা নিয়ে হাজারদুয়ারী প্রাসাদ আর ইমামবাড়া।

গেটের সামনে সরু রাস্তায় ময়লা ছড়ানো, বিক্ষিপ্ত ভীড়, ঘোড়ার গাড়ী। পুরো পরিবেশেই কেমন যেন একটা অবক্ষয় আর অযত্নের মলিন ছাপ। যাই হোক, গেট দিয়ে ঢুকে টিকিট কাটার পরে আমরা একজন গাইডকে নিলাম।  সুজাতা  আমাদের খরচের হিসাব রাখছে।  পরে হিসেব করে ভাগাভাগি করে নেবো আমরা।

একটা গাছের ছায়ায় বসে আমাদের গাইড তার লেকচার শুরু করলো।

১৭৫৬ সালে আলীবর্দ্দী খাঁর  মৃত্যুর পরে বাংলার নবাব হন্‌ তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা।

মাত্র তেইশ বছর বয়েসে সিরাজ যখন বাংলার নবাব হন্‌ তখন উড়িষ্যা আর বিহারের অনেকটাই আলীবর্দ্দী হারিয়েছেন মারাঠাদের সাথে চুক্তির জন্যে । সিরাজ মুর্শিদকুলী খাঁ বা আলীবর্দ্দী খাঁর মত বিচক্ষণ ছিলেননা, নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতাও তাঁর ছিলনা। কম বয়েস হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, এবং তাঁর অত্যাচারে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর চারিদিকে বহু শত্রু এবং অনেক মসনদ দখল করার দাবীদার জড়ো হয়ে যায়।  তার ওপরে ঐতিহাসিকেরা সিরাজকে একজন নির্বোধ, এবং লম্পট মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

দীর্ঘদিন রাজত্ব শাসন করার সুযোগ সিরাজ পান্‌নি। শেষে মাত্র এক বছর রাজত্বের পরে  ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে পলাশীর যুদ্ধে প্রধানতঃ তাঁর নিজের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যু হয়। 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নাটকে গানে গল্পে কবিতায় বার বার কিন্তু একজন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে উঠে এসেছে সিরাজের নাম। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সিরাজ ব্রিটিশ বিরোধী এই ভাগ্য বিড়ম্বিত নায়কের প্রতি একটা বড় অংশের বাঙালীর সহানুভূতি রয়েছে।  

এই ভাল আর মন্দ দুই দিকের মধ্যে কোনটা ঠিক? সিরাজ কি নায়ক ছিলেন, না খলনায়ক? 

গাইড ছেলেটির কাছ থেকে হাজারদুয়ারী এবং তার উলটো দিকে ইমামবাড়া নিয়ে কিছু তথ্য জানা গেল। 

এই প্রাসাদে কি সত্যিই এক হাজারটি দরজা আছে? গাইড ছেলেটি বললো প্রাসাদটিতে মাত্র ১০০ টি বাস্তব দরজা রয়েছে আর বাকি ৯০০ টি নাকি নকল। ভাগীরথী নদীর তীরে কিলা নিজামত বা নিজামত কিলা ছিল মুর্শিদাবাদের পুরনো দুর্গের স্থান। এই প্রাসাদের নির্মানের জন্য দুর্গটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। জায়গাটি  এখনো কিলা নিজামত নামে পরিচিত।

হাজারদুয়ারী প্রধানতঃ একটি জাদুঘর, সেখানে এ সযত্নে ধরে রাখা আছে স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের একটি  বিশেষ অধ্যায়ের অজস্র নিদর্শন। সেখানে কি কি দর্শনীয় জিনিষ আছে তা গাইড ছেলেটি আমাদের জানিয়ে দিল। একটা ছবি আছে, সামনে খাবারের থালা নিয়ে বসে একটি বিশাল মোটা লোক খাচ্ছে।  সেই ছবিটা দেখতে ভুলবেন না, বললো সে।  

গাইডের বক্তব্য শেষ হলে তার পাওনা মিটিয়ে আমরা টিকিট কেটে হাজারদুয়ারীর ভেতরে প্রবেশ করলাম।

এই প্রাসাদের মোট তিনটি তলা রয়েছে। আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম।  তৎকালীন নবাব দের ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র – আলীবর্দ্দী খাঁ এবং সিরাজের তরবারী এমন কি যে ছুরি দিয়ে মহম্মদী বেগ সিরাজ কে খুন করেছিলেন তা পর্য্যন্ত রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়।  এছাড়া আছে মার্বেল মূর্তি, চীনামাটির বাসন,   ধাতব সামগ্রী, দুর্লভ বই, পাণ্ডুলিপি, পুরনো মানচিত্র, ভূমি রাজস্ব রেকর্ড।  আছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার রূপোর সিংহাসন আর বিশাল ঝাড়বাতি।  আর তিনতলায় আছে নবাব আমলের নানা নিদর্শন। সোনা দিয়ে মোড়া কোরাণ শরীফ, নানা অমূল্য পুঁথিপত্র, অসংখ্য বই, আবুল ফজলের আইনী   আকবরীর পান্ডুলিপি, তাছাড়া নানা পুরাকীর্তি এবং আসবাবপত্রের বিশাল সংগ্রহ। দেশ বিদেশ থেকে সংগৃহীত নানা ধরণের ঘড়ি, রাফায়েল, ভ্যান ডাইক এবং অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের অয়েল পেন্টিং, শ্বেত পাথরের মূর্ত্তি, এবং আরও অনেক দর্শনীয় জিনিষ।

এ ছাড়া ৯০ ডিগ্রীতে একটি জোড়া আয়নার রাখা আছে । এই আয়নায় মানুষ তার নিজের মুখ দেখতে পারে না যদিও অন্যরা একই দেখতে পারে। এটি নবাব আক্রমণকারীদের দূরে রাখার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।

একটা ফেলে আসা সময়কে ধরে রেখেছে হাজারদুয়ারী।

) ইমামবাড়া

 

হাজারদুয়ারীর ঠিক উল্টো দিকে এক বিশাল লম্বা প্রাসাদ। শুনলাম এটি হল শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ইমামবাড়া  তার কাছেই আছে মদিনা মসজিদ। এটি শুধুমাত্র মহরমের সময় দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।

ইমামবাড়ার সামনে একটি কামান, যার নাম বাচাওয়ালি টোপ, এটি তৈরি করেছিলেন মুর্শিদকুলী খান। কামানটি মুখ উঁচু করে একটি উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত। এই কামানটি নাকি ভাগীরথীর জলের তলায় ছিল, নদী সরে যাবার পরে এক উদ্ধার করে এখানে রাখা হয়।

ইমামবাড়ার স্থাপত্যও চোখে পড়ার মত, সামনে অসংখ্য স্তম্ভ, আর প্রবেশদ্বার হিসাবে একটি বিশাল গেট, যার নাম দক্ষিণ দরওয়াজা অন্য প্রান্তে যেখানে সিঁড়ি শুরু হয়, সেখানে দুটি ভিক্টোরিয়ান সিংহের মূর্তি রয়েছে। গাইডের মুখে শুনলাম মহরম উৎসবের সময় এখানে মেলা বসে, অনেক লোকজনের ভীড়ে জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে।

হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়ার চারিপাশে একটু ঘুরে বেড়ালাম আমরা।  কাছেই দুটো বড় মসজিদ। চারিদিকে পর্য্যটকদের ভীড়, বেশ একটা উৎসবের বা মেলার মত পরিবেশ। 

 বেশ কিছু ছবি তোলা হলো।

) একটি আশ্চর্য্য স্বপ্ন

হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়া দেখার পরে আজ বিকেলে আর কোথাও যাবার নেই, হোটেলে ফিরে আমরা সোজা ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে গেলাম। আবার উপাদেয় সব পদ, শেষ পাতে মিষ্টি দই আর রাজভোগ। শেফ ভদ্রলোক আবার কাছে এসে রাত্রে কি খাবো জিজ্ঞেস করে গেলেন। এদের আতিথেয়তার কোন ত্রুটি নেই। আমরা রায় পরিবারের ছোটবাবু পল্লবের অতিথি। সুতরাং আমাদের দিকে তো নজর একটু বেশী হবেই।

দুপুরে একটু বিশ্রাম নেবার পরে সন্ধ্যায় আবার আড্ডা দেবো এই হলো আমাদের প্ল্যান। তো বিছানায় শুয়ে  বালিশে মাথা রাখতেই গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলাম। আসলে রোদের মধ্যে অত হাঁটা, তারপরে জমিয়ে একটা লাঞ্চ। ঘুমের আর দোষ কি?

আর এই দু’দিন গাইডদের মুখে  মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের নানা  আজব আজগুবি উদ্ভট গল্প মাথার মধ্যে গজগজ করছে, ঘুমের মধ্যেই  স্বপ্নে আমি ফিরে গেলাম সোজা অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সেই স্বপ্নে আমি মোগল আমলের দেওয়ান  মুর্শিদকুলী খাঁ, সম্রাট আওরংজেব আমায় ডেকেছেন, আমি তার কাছে  খাজনা নিয়ে দেখা করতে গেছি।

স্বপ্নে আমি সম্রাটের সাথে বেশ সুন্দর উর্দ্দু ভাষায় কথা বলে যাচ্ছি, কোন অসুবিধেই হচ্ছেনা, আওরংজেব আমার ওপর মোটের ওপর বেশ সদয় মনে হচ্ছে, বেটা বেটা বলে তিনি আমায় অনেক উপদেশ দিচ্ছেন।

তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পালঙ্কে বসে আছেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব, শণের মত সাদা চুল দাড়ি, শ্যেন দৃষ্টি, সারা মুখে অসংখ্য বলিরেখা। পরণে সাদা ঢোলা আলখাল্লা, পাজামা। গলায় মুক্তোর মালা, হাতের মুঠোয় তসবি। সামনে মেঝেতে জাজিম বিছানো, তার ওপর হাঁটু মুড়ে বসে আছি আমি, কারতলব খান।

আওরংজেব আমায় বললেন তোমায় দেখলে আমার সফির কথা মনে পড়ে। সে আমার আত্মীয় ছিল। সফি তোমায় আমার কাছে নিয়ে এসেছিল । সে যখন আমায় বলল তোমার আগের পরিচয়, তখন প্রথমে আমি একটু নারাজ ছিলাম। কারণ আমি হিন্দুদের তত বিশ্বাস করতামনা।  

তুমি জন্মেছো এদেশের আদি ধর্ম্মের পরিবারে, সেই ধর্ম্ম জেনেছো, পড়েছো, এতে কোন কসুর নেই।  ঘটনাক্রমে তার পরে দীক্ষিত হয়েছো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ন্ম ইসলামে। পড়েছো কোরান, হাদিস। এটা তোমার জীবনের পরম সৌভাগ্য। তুমি হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষের মন পড়তে পারো। ভাল মন্দ বুঝতে পারো, সবার প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারো।

তুমি হিন্দু ঘরের আউলাদ, এটা তোমার অতিরিক্ত সুবিধা, হিন্দুদের কাছে টানো। তারা সচরাচর বেইমানী করেনা, তাদের লালচ আর সাহস দুইই কম।  কিন্তু তোমার মধ্যে আমি কূটনীতির অভাব লক্ষ্য করি।

পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজনীতির চাল দেওয়া,  দরকারে দুশমনের গালে চুমু খাওয়া  ধূর্ততা, শঠতা,  লোক চেনার মত পরিপক্কতা এই সব তোমাকে আয়ত্ত্ব করতে হবে।        

বেটা, আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি সবার ওপরে ইনসানিয়াত, মনুষ্যত্ব। সর্ব্বশক্তিমান আল্লা তাদেরই পাশে থাকেন যারা মানুষের পাশে থাকে। আল্লার কাছে দোয়া করি যেন তুমি শেষ দিন পর্য্যন্ত যে ধর্ম্মেরই মানুষ হোক, সাচ্চা ইনসানের পাশে যেন দাঁড়াতে পারো।

আমায় এই সব উপদেশ দিতে দিতে নৃশংস নিষ্ঠুর হিন্দু বিদ্বেষী সম্রাট আওরংজেব হঠাৎ যেন একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে গেলেন, তাঁর গলায় আমি পেলাম অনুতাপের আর আত্মধিক্কারের সুর। এ যেন এক অন্য আওরংজেব!   

বেটা,আমি জীবনে যত অপরাধ করেছি, তার শেষ নেই, আমি জানি খোদাতালার কাছে তার ক্ষমা নেই। সেই পাপ এই মুলুক আমার তখত্‌ সব ধ্বংস করে দেবে। এ থেকে আমার রেহাই নেই বেটা। 

কুর্সির লালচে আমি আব্বাজানকে বন্দী করেছি,অত্যাচার করেছি, নিজের ভাইদের একে একে নৃশংস ভাবে খতম করেছি। আমার হাত খুনে লাল হয়ে আছে। তখন আমার একটাই  লক্ষ্য, সকলকে সরিয়ে আমিই হবো হিন্দুস্তানের মালিক। আলমগীর আওরংজেব। বাকি সবাই থাকবে আমার পায়ের তলায়। যে যখন আমার বিরোধিতা করেছে, তাকে আমি সরিয়ে দিয়েছি। আল্লার দরবারে এর কোন ক্ষমা নেই।

এদিকে আমি মনে মনে ভাবছি ব্যাপারটা কি, বাদশা একবার বলছেন ধূর্ত্ত হও, শঠ হও, নির্মম হও, আবার অন্যদিকে মানবতার বাণী শোনাচ্ছেন, আবার নিজের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা করছেন। এতো মরণকালে হরিনামের মত শোনাচ্ছে! দেরীতে বোধোদয়?

এই সব ভাবছি, এমন সময় সুভদ্রার ডাকে  ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলাম সন্ধ্যা হয়েছে, হোটেল থেকে ঘরে চা দিতে এসেছে, সাথে বিস্কুট। স্বপ্নের রেশটা কিন্তু রয়েই গেল মনের ভিতরে।  ভাবছিলাম কে যে আমাদের মনের নানা  চিন্তা আর কল্পনা মিশিয়ে  এই সব আশ্চর্য্য বাস্তব স্বপ্ন তৈরী করে্‌ !  

আমি সেই লোকটার নাম দিয়েছি স্বপ্নের জাদুকর।

) রাত্রের আড্ডা    

আজকের আড্ডার বিষয় হলো কর্পোরেট জগতে প্রেম। দীপঙ্করের কর্পোরেট জগতের হোমরা চোমরা লোক – কানোরিয়া, বাজোরিয়া, গোয়েঙ্কা, বাঙ্গুর, আগরওয়াল দের সাথে খুব মেলামেশা, দহরম মহরম। তার স্টকে তাই তাদের নিয়ে অনেক গল্প। সেই সব গল্প আমাদের সে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে।

দীপঙ্করের সেদিন বলা দুটো গল্প এখনো মনে পড়ে। 

প্রথম গল্প – দজ্জাল বৌ

একটা বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তাঁর সেক্রেটারী একটি কমবয়েসী মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছেন। অফিসে অনেক সিনিয়র ম্যানেজার দের দু’জনের এই পারস্পরিক ভাল লাগার ব্যাপারে কিছুটা আন্দাজ আছে, কিন্তু এই নিয়ে কেউ কিছু বলেনা, প্রাপ্তবয়স্ক দুই নারী ও পুরুষ  তাদের সম্পর্ক কি ভাবে তৈরী করবে তাতে কার কি বলার আছে? তার ওপর চেয়ারম্যান বলে কথা।

তো একদিন সকালে চেয়রাম্যান ট্যুরে কলকাতার বাইরে গেছেন, তাই তাঁর অফিস প্রায় খালি। সেই সেক্রেটারী মহিলা আর কিছু অন্য মহিলা টাইপিস্ট নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছেন। বস্‌ নেই তাই কাজ ও নেই, বেশ একটা খুসীর আমেজ অফিসে।

এমন সময় রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ চেয়ারম্যানের স্ত্রীর প্রবেশ। তাঁকে ওই মেয়েরা সবাই চেনে, সবাই সন্মান জানিয়ে তাঁকে গুড মর্ণিং ম্যাডাম বলার আগেই মহিলা গিয়ে সেই সেক্রেটারী মেয়েটির কাছে গিয়ে তার চুল ধরে এক টান।  আর এলোপাথাড়ি চড় চাপড় এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি।

তোর এত বড় আস্পর্দ্ধা, আমার বরের সাথে লুকিয়ে প্রেম করছিস, জানিস তোর কি ব্যবস্থা করবো আমি?  আমায় তুই চিনিস না্…ইত্যাদি।

সেই সেক্রেটারী মেয়েটি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে সেও সহকর্ম্মীদের সামনে এই  অপমান সহ্য করবে কেন, সেও সমান তালে মহিলার ওপরে চড়াও হলো। চেয়ারম্যানের দামী কার্পেটে ঢাকা অফিসে দুই বয়স্ক ভদ্রমহিলার মধ্যে শুরু হয়ে গেল চুলোচুলি।

সৌভাগ্য বশতঃ সেদিন ব্যাঙ্কের আরও দুই একজন উচ্চপদস্থ অফিসার সেদিন সেই অফিসে নিজেদের ঘরে ছিলেন, তাঁরা বাইরে বেরিয়ে এসে কোনমতে দুই মহিলাকে থামান।

দীপঙ্কর ওই ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টর ছিল, সে এই ঘটনার কথা শোনে কোম্পানীর সেক্রেটারীর কাছ থেকে। তিনি নাকি দীপঙ্কর কে বলেছিলেন মিস্টার চ্যাটার্জ্জি, আপনি একটু চেয়ারম্যান সাহেব কে বুঝিয়ে বলুন না।

আমি বললাম তুমি কি বুঝিয়ে বললে?

দীপঙ্কর বলল দূর, আমি কি বোঝাবো? শেষ পর্য্যন্ত ওই দজ্জাল বৌয়ের ভয়ে তিনি নিজে থেকেই সরে এসেছেন

দ্বিতীয় গল্পকে কোথা ধরা পড়ে কে জানে

একটি নামকরা এয়ার কন্ডিশনার কোম্পানীর মালিক এক মাড়োয়ারী, শিক্ষিত, সুদর্শন ভদ্রলোক,   স্ত্রী আর দুই প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর সুখী পরিবার। এই কোম্পানীটা তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন।

তো এক দিন একটি অল্প বয়েসী মেয়ে তাঁকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিক্রী করতে আসে। কি যে ছিল সেই মেয়েটির মধ্যে কে জানে, ভদ্রলোক তার প্রেমে পড়ে গেলেন।   তারপরে এই দু’জনের মধ্যে যে একটা অদ্ভুত,অবিশ্বাস্য, অসমবয়েসী  সম্পর্ক তৈরী হল তা কেবল গল্প উপন্যাসেই সম্ভব। 

শেষ পর্য্যন্ত ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স করে তাঁর পরিবার কে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির সাথে ঘর বাঁধলেন। তিনি তাঁর সম্পত্তির সিংহভাগ, তাঁর বাড়ী ঘর, এমনকি কোম্পানীর সব শেয়ার  তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে উইল করেছিলেন, নিজেও কোম্পানী থেকে সরে এসেছিলেন। 

দীপঙ্কর ছিল সেই কোম্পানীর অডিটর। ভদ্রলোকের অনুরোধে দীপঙ্কর তাঁর উইল এবং ডিভোর্সের কাজ কর্ম, সম্পত্তির ভাগ ইত্যাদি সব দেখা শোনা করেছিল।  

কর্পোরেট জগতের পুরুষ ও নারীর নিষিদ্ধ সম্পর্কের এই দু’টি গল্প নিয়ে আমাদের অনেক তর্কের অবকাশ ছিল। প্রথম গল্পটি তো অনায়াসে “Me too” আন্দোলনের পর্য্যায়ে পড়বে। সেক্রেটারী মেয়েটির সাথে চেয়ারম্যানের এই সম্পর্ক কোন ভাবেই প্রেম বলে ধরা যায়না। এটা অবশ্যই পুরুষের ক্ষমতার অপব্যবহার।  কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটি ঠিক সেই জাতের নয়। এই গল্পেও নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে, কিন্তু   নারী পুরুষের গভীর প্রেমই হলো এই গল্পের প্রধান উপজীব্য। একজন পুরুষ একজন নারীকে ভালবেসে তাঁর সামাজিক সন্মান, প্রতিপত্তি, ধন, মান এমন কি নিজের স্ত্রী আর পরিবারকেও ছেড়ে যেতে পারেন?

এসেছো প্রেম,  এসেছো আজ, কি মহা সমারোহে…        

কিন্তু এর মধ্যেও মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার দেখবে আমার সন্দেহ নেই। তাদের সহানুভূতি থাকবে স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি। তাদের এই ভাবে ছেড়ে চলে যাবার কোন অজুহাতই তারা মেনে নেবেনা। দাম্পত্যে বিষ জমলেও দু’জন কে একসাথে থেকে যেতে হবে?  আর ছাড়াছাড়ি হলেই ছেলেদের দোষ!     

আমাদের চেনা জানা অনেক গুণী মানুষ  বিবাহিত হয়েও নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য নারীর সাথে জীবন কাটিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন রবিশঙ্কর, সমরেশ বসু, সলিল চৌধুরীর মত সর্ব্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষেরা। 

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই তথাকথিত hegemonic toxic masculinity  নিয়ে আমাদের বৌরা একটা আক্রমনাত্মক আলোচনা শুরু করার জন্যে মুখিয়ে ছিল, কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভাল যে তার আগেই নীচ থেকে একজন এসে বললো স্যার খেতে আসুন, ডিনার রেডি।

তৃতীয় এবং শেষ দিন  – ১৪/১২/২০২৩ 

) রাজবাড়ী ট্যুর

আজ আমাদের এখানে শেষ দিন।

পল্লব আজ সকালে আমাদের জন্যে কাশিমবাজারের রাজবাড়ীর একটা ট্যুরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ব্রেকফাস্টের পরে এক মহিলা আমাদের নিয়ে পুরো রাজবাড়ী ঘুরিয়ে দেখালেন, তার সাথে তিনি কাশিমপুরের রাজপরিবারের এবং রাজবাড়ীর ইতিহাস নিয়ে ও অনেক তথ্য জানালেন আমাদের।  

আমরা জানলাম ১৭৪০ খৃস্টাব্দে পেশায় ব্যবসায়ী দীনবন্ধু রায় এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করেন।  পরে ব্রিটিশ সরকার এই জমিদার পরিবারকে তাদের প্রজাকল্যাণ, ধর্ম্মনিরপেক্ষতা আর সুশাসনের পুরস্কার হিসেবে রাজা উপাধি দেন।  ১৯৯০ এর দশকে পরিবারের উত্তরাধিকারীরা বাড়ির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বাড়ির কিছুটা অংশ নিয়ে অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে পরিবারেরই উদ্যোগে ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য চালু হয়েছে কাশিমবাজার রাজবাড়ী গেস্ট হাউস।

বিশাল জায়গা জুড়ে রাজবাড়ী।  প্রথমে আমরা গেলাম বাড়ীর বাইরে চারিদিক টা দেখতে। প্রাসাদের সামনে সুন্দর সবুজ লন আছে, কিন্তু বাড়ীর পিছনে সেই তুলনায় বেশ অযত্নের ছাপ। একটা পুকুর পাশে  বাঁধানো ঘাট, কিন্তু জল ময়লা, ব্যবহার করা হয় বলে মনে হলোনা। চারিদিকে ছাতিম, চাঁপা, এবং আরও অনেক বড় বড় গাছ।  একটা সিমেন্টের টেনিস কোর্ট ও দেখলাম হইয়তো বহুদিন আগে সাহেবসুবোরা সেখানে খেলতেন, কিন্তু এখন আর কেউ খেলেনা, কোর্টময় ধূলো আর চারিদিকে শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। রাজবাড়ীকে ফাইভ স্টার ডি লুক্স হোটেল করতে গেলে পল্লবদের এখনো অনেক টাকা ঢালতে হবে।

বাড়ীর  অন্দরমহলটা কিন্তু সুন্দর, পরিস্কার, সাজানো গোছানো। বৈভবের চিহ্ন চারিদিকে। এক তলার সুদৃশ্য হলঘরে ঝকঝকে পরিস্কার মার্বেলের  মেঝে।  চারিপাশের দেয়ালে সাজানো নানা মূল্যবান কাঁচের, রুপোর, হাতির দাঁতের তৈরী ঘর সাজাবার সামগ্রী, আর ফ্রেমে বাঁধানো অনেক পুরনো পারিবারিক ছবি। হলঘরে বসার জন্যে দামী এবং আরামদায়ক সোফা, আর মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়লন্ঠন।  একটা  প্রাচীন পাল্কীও রাখা আছে দেখলাম এক জায়গায়, কবে সেটা শেষ ব্যবহার করা হয়েছিল, এবং কি উপলক্ষ্যে, কে জানে? 

রাধা গোবিন্দ মন্দির, নাটমন্দির, ভোগের ঘর, দালান ও গর্ভগৃহ দেখে আমরা এগোলাম চন্ডীমণ্ডপের দিকে। এই চন্ডীমণ্ডপেই খুব ধূমধাম করে দূর্গা পূজো হয়, কলকাতা থেকে রায় পরিবারের সবাই আসেন। দূর্গা দালানে অনেক গান বাজনা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।     

আমাদের রাজবাড়ীর ট্যুর শেষ হলো বেলা দশটা নাগাদ।

সন্ধ্যায় আমাদের ফেরার ট্রেণ, দিনের অনেকটাই বাকি আছে, দুটো গাড়ীও আছে, সাথে, তাই কোথাও ঘুরে এলে কেমন হয়?

মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি দেখার মত অনেক ঐতিহাসিক জায়গা আছে, রয়েছে প্রচুর মন্দির, যার অধিকাংশই বেশ কয়েক শতাব্দী পুরনো। কাশিমবাজারে মোগলদের আমলে  ব্রিটিশ আর ডাচরা এখানে নদীর ধারে কুঠি  (warehouse) বানিয়ে  থাকতো, এখানে তাদের কবরখানা দেখতে অনেকে আসে। । বহু প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্রিটিশ এবং ডাচ ব্যক্তিত্বের শেষ শয়নভূমি এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই।

তাছাড়া আছে ১৭৫০ ক্রিস্টাব্দ নাগাদ স্থাপিত নাটোরের রানী ভবানীর টেরাকোটার মন্দিরগুলি। কিরিটেশ্বড়ী কালী মন্দির, যা কালী পিঠগুলির মধ্যে অন্যতম। খোশবাগে আছে সিরাজউদ্দৌলা এবং তার পরিবারের কবরগুলি।

সময় থাকলে পলাশীতেও হয়তো যাওয়া যেতো্‌ কিন্তু শুনলাম সেখানে ধূ ধূ করছে ফাঁকা মাঠ, তার মধ্যে একটা জায়গায় লাঠির ওপরে একটা বোর্ড টাঙানো আছে, তাতে লেখা “এই স্থানে ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর যুদ্ধ হইয়াছিল।”

সেই বোর্ড দেখার জন্যে দেড় ঘণ্টা গাড়ী চালিয়ে যাবার কোন মানে হয়না।  

আমাদের হাতে সময় নেই তাই এত সব জায়গা দেখে আসা সম্ভব হবেনা। এই বয়সে এত ছোটাছুটিও করা মুস্কিল।    

অমিতাভ বললো গাড়ী নিয়ে গঙ্গার ব্রীজ পেরিয়ে আজিমগঞ্জ যাওয়া যেতে পারে, লাঞ্চের মধ্যে ফিরে আসা যাবে।  সেখানে নাকি বড়াকোঠি বলে ভাগীরথীর তীরে একটা বড় নিরামিষ হোটেল আছে, খুব দামী, প্রতি রাতে এক ঘরের ভাড়া প্রায় ৩০,০০০ টাকা, সেখানে শুধু খুব বড়লোক মাড়োয়ারীরাই গিয়ে থাকে।

তারপরে আজিমগঞ্জ থেকে ফিরে দুপুরে লাঞ্চের পরে একটু হোটেলে বসে প্যাকিং সেরে বিল মিটিয়ে বিকেলের দিকে স্টেশন চলে যাবো।

) আজিমগঞ্জ

দু’টো গাড়ী নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আজিমগঞ্জের দিকে। সামনের গাড়ীতে ড্রাইভারের পাশে সামনে আমি, পিছনে দীপঙ্কর প্রবীর আর অমিতাভ, পিছনের গাড়ীতে মেয়েরা।

মুর্শিদাবাদ আর বহরমপুর পাশাপাশি শহর। বহরমপুর এখন মুর্শিদাবাদ জেলার প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার, প্রধানতঃ কাঁসা আর পেতলের বাসনের জন্যে জায়গাটা বিখ্যাত, তা ছাড়া শোলা, সিল্ক, হাতির দাঁত ইত্যাদি নিয়েও এখানে অনেক কুটির শিল্পের দোকান দেখা যায়, রাস্তায় বেশ ভীড়, দুই পাশে প্রচুর দোকানপাট। তাছাড়া অবশ্যই আছে এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি ছানাবড়ার দোকান। 

একটু পরেই এসে গেল ভাগীরথীর ওপরে ব্রীজ। এবং তার পরেই দীপঙ্করের ফোন বেজে উঠলো, ক্রিং ক্রিং!

বাইরে বেড়াতে এলেও দীপঙ্কর তার অফিসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, মাঝে মাঝেই তার কাছে নানা কাজের ফোন আসে, এবং সে তার কর্ম্মচারীদের নানা রকম নির্দেশ দিয়ে আবার আমাদের আড্ডায় ফিরে আসে।

আজ তাকে ফোন করছে তার সেক্রেটারী। আমরা শুনেছি মেয়েটি খুব কাজের, দীপঙ্কর তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।  অফিসের বাইরে থাকলে তার সাথে ফোনে কথা বলতে দীপঙ্করের বেশ ভালোই লাগে।

যাই হোক, ওদিক থেকে মেয়েটি কি বলছে শোনা না গেলেও দীপঙ্করের কথা শুনে বুঝলাম যে হায়দ্রাবাদে কিছুদিন পরে তাকে একটা কোম্পানীর বোর্ড মিটিং এ যেতে হবে, তাঁর সাথে কলকাতা থেকে যাবেন আর এক ভদ্রলোক। মিটিংটা বিকেলে হবার কথা কিন্তু দীপঙ্করের অন্য একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় সে মিটিংটা পরের দিন সকালে করতে চায়। কিন্তু এই বদল করাটা সোজা কাজ নয়।

প্রথমতঃ সেই কোম্পানী কে রাজী করাতে হবে, তারপর তারা রাজী হলে ওই অন্য ভদ্রলোক কে জানাতে হবে, তিনি রাজী হলে দু’জনের এয়ার টিকিট আর একটা রাত থাকার জন্যে হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে। ইত্যাদি। 

এক বার ভাল করে বুঝিয়ে বললে এই সেক্রেটারী মেয়েটি এক এক করে গুছিয়ে এই সমস্ত কাজ করে ফেলতে পারে। কিন্তু দীপঙ্কর ফোনে তাকে কাজগুলো দিচ্ছে এক এক করে, মেয়েটি একটা কাজ শেষ করে ফোনে জানাচ্ছে, দীপঙ্কর তখন তাকে ফোনে পরের কাজটা বিশদ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

ক্রিং ক্রিং…  “কি কোম্পানী রাজী হলো? তাহলে  এবার মিস্টার ভটচাজ্জি কে ফোন করে জানাও”।

ক্রিং ক্রিং…“মিস্টার ভটচাজ্জি রাজী? বেশ! এবার তুমি আমাদের বিজনেস ক্লাসে দুটো রিটার্ণ এয়ার টিকিটের বন্দোবস্ত করে ফেলো! পরের দিন সন্ধ্যায় ফিরবো! ”

ক্রিং ক্রিং…

এই ভাবে পাঁচ দশ মিনিট অন্তর অন্তর দীপঙ্করের ফোন আসতেই লাগলো। এক দিকের বাক্যালাপ শুনে বেশ সময়টা কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমরা আজিমগঞ্জ রেল স্টেশন পৌঁছে গেছি। স্টেশনের পরে একটা সরু রাস্তা তাতে বিস্তর যানবাহন চলাচল করছে। আমাদের বড় Innova SUV কোনমতে সেই রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে।

কিন্তু কোথায় বড়াকোঠি?

অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জায়গাটা পাওয়া গেল। বাইরে থেকে দেখে বড়াকোঠির মাহাত্ম্য টের পাওয়া মুস্কিল। সাধারণ একাট বাড়ী, সামনে কোন বড় গেট নেই, বাগান নেই, শুধু একটা ছোট খোলা দরজা। গাড়ী পার্ক করার জন্যে একটা খোলা মাঠ সামনে, সেখানে গাড়ি রেখে আমরা সেই বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

 হোটেলে কোন ঘর  খালি নেই,  আমাদের ভিতরে ঢুকে দেখার আবেদন মঞ্জুর হলোনা। বড়াকোঠি আসা আমাদের বিফল ই হলো।

অবশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবেনা। বড়াকোঠি একেবারে নদীর ধারে, সেখানে অতিথিদের  সকালের ব্রেকফাস্ট আর বিকেলের চা খাবার জন্যে অনেক টেবিল আর চেয়ার  সাজানো আছে, সেখানে এই দুপুরে কেউ নেই, আমরা গিয়ে সেখান থেকে নদীর শোভা দেখলাম বসে বসে।

সেই গভীর স্রোতহীন শান্ত নদীর নীরবে বয়ে যাওয়া বড় সুন্দর দৃশ্য।  নদীর জলে আকাশের ছায়া পড়েছে, দুই পারের ঘাটে অনেক মানুষ জনের জটলা, কিছু দোকান পাট, আর নদী পারাপার করছে অনেক নৌকা। কেউ মাল বোঝাই, কিছু নৌকায় অনেক মানুষ এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে।

যেন আবহমান কাল থেকে বয়ে যাচ্ছে এই নদী। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সে। আজিমগঞ্জে বড়াকোঠির পাশে ভাগীরথীর পারে বসে নদীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শহরের দিকে তাকিয়ে আমার মন চলে গেল সেই সব পুরনো দিনে।

আমি মনে মনে চলে গেলাম সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদাবাদে। মোগল সাম্রাজ্য ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে, মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার স্বাধীন নবাব,  ইংরেজরা ক্রমশঃ মোগলদের সরিয়ে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করছে। ইংরেজদের কাছে বেঙ্গল প্রভিন্স হলো সোনার দেশ। মুর্শিদাবাদ ও তার নিকটবর্ত্তী শহর ও গঞ্জ থেকে তারা কিনে আনে আফিম, তামাক, নীল, সোরা, পাট, তুলো, রেশম থেকে খাদ্যশস্য মশলা ও নানাবিধ জিনিষ। সেই মালপত্র রাখা হয় নদীতীরবর্ত্তী কাশিমবাজার কুঠির গুদামঘরে।

ওদিকে হুগলী নদীর কাছে তিনটি গ্রাম ইজারা নিয়ে ইংরেজরা গড়ে তুলেছে এক নতুন শহর, তার নাম ক্যালকাটা। উদীয়মান সেই শহরে এসে বসতি স্থাপন করছে নানা জাতির ভাগ্যান্বেষী মানুষজন।

কাশিমবাজার এবং দেশের অন্যান্য শহর থেকে এই সব মজুত মাল যথেষ্ট পরিমাণ হলে তাদের ছোট বড় নানা নৌকায় নিয়ে যাওয়া হয় সেই নতুন শহর ক্যালকাটায়। তারপরে সেই সব মাল বোঝাই করা হয় জাহাজঘাটায় নোঙ্গর করে থাকা বিশাল বিশাল বাণিজ্যপোতে। তারা পাল তুলে রওনা হয়ে যায় সাত সমুদ্র পেরিয়ে ইংল্যান্ডের দিকে।

একসময় যিনি ছিলেন স্রেফ দেওয়ান কারতলব খান, সেই তিনিই এখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা সুবার দন্ড মুন্ডের কর্তা নবাব মুর্শিদকুলী খান। তাঁর কর্ম্মক্ষেত্র ছিল ছোট এক জনপদ মুকসুদাবাদ, এক পীরের নামে। সেই শহর এখন সুবা বাংলার রাজধানী – মুর্শিদাবাদ, তাঁর নামাঙ্কিত।

মুর্শিদকুলী খানের স্বপ্ন দিয়ে সাজানো এই শহর।  নদীর পাড় দিয়ে পরের পর কেয়ারী করা ফুলের বাগিচা। ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলে আছে নানা জাতের জলযা্‌ন, ডিঙ্গি নৌকা থেকে বড় বড় বর্ণময় ময়ূরপঙ্খী, মকরমুখী সাগরদাঁড়ি বজরা । শহর জুড়ে অসংখ্য অট্টালিকা, মসজিদ, সুউচ্চ মিনার,  গম্বুজ, আছে ত্রিশূল চিহ্নিত শিব মন্দিরও। আলোয় আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে।  

গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা, কাবেরী যমুনা ওই/

বহিয়া চলেছে আগের মত, কইরে আগের মানুষ কই?/

আগের মানুষ নেই, সেই আগের বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী  আলো ঝলমল মুর্শিদাবাদও কি আর আছে?

আজ সে ধূলিধূসরিত এক মলিন শহর, তার সারা গায়ে আজ অবক্ষয় আর দারিদ্র্যের চিহ্ন।

) ফেরা

আজমগঞ্জ থেকে কাশিমবাজারে ফিরে লাঞ্চ সেরে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে স্টেশনের দিকে এগোলাম।  লালবাগের ব্যস্ত রাস্তায় তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে।

বিদায়, মুর্শিদাবাদ!

 সামতাবেড় – শরৎকুঠি

সামতাবেড়ে শরৎচন্দ্রের বাসভবনের সামনে বাগানে তাঁর আবক্ষ মর্ম্মর মূর্ত্তি

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বন্ধুদের সাথে এক রাত্রের জন্যে কোলাঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলাম।  ছিলাম রূপনারায়ণ নদীর ধারে সোনার বাংলা হোটেলে।

মনে আছে ১৯৬৩ সালে কলেজে ভর্ত্তি হবার ইন্টার byভিউ দিতে বাবার সাথে ট্রেণে খড়্গপুর গিয়েছিলাম। বম্বে এক্সপ্রেস, কোন স্টেশনে থামছিলনা, ট্রেণে বেশ ভীড় ছিল, আমাদের 2nd class unreserved কম্পার্টমেন্ট, সেখানে কোনমতে আমরা বসার জায়গা পেয়েছিলাম। হঠাৎ ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেণ চলার একটা গুমগুম আওয়াজ পেয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক ঘোলাটে মাটির রং এর নদীর ওপর দিয়ে আমাদের ট্রেণ চলেছে।

বাবা বললেন এ হলো রূপনারায়ণ নদী।  

তখন ভরা বর্ষা, দুই কূল ছাপানো রূপনারায়ণ, সেই আমার প্রথম দেখা।

তারপরে তো পাঁচ বছরে এই ব্রীজের ওপর দিয়ে কতবার গেছি এসেছি। আমাদের খড়্গপুরে থাকতে থাকতেই সেখানে একটি  দ্বিতীয় রেল আর রোড ব্রিজ তৈরী হয়েছে। কোলাঘাটের ঈলিশ আর পরের স্টেশন মেচেদা সিঙ্গাড়ার জন্যে বিখ্যাত ছিল। কলেজ জীবনে ঈলিশ কিনতে না পারলেও মেচেদায় চায়ের সাথে সিঙ্গাড়া খেয়েছি প্রচুর।

কোলাঘাটে আমাদের হোটেলটা ওই ব্রীজের পাশেই, নদীর ধারে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে মন চলে যাচ্ছিল সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোতে।

কোলাঘাটে রূপনারায়ণের তীরে ও হোটেলের বাগানে

শুনেছিলাম কোলাঘাটের আগের স্টেশন দেউলটির কাছে সামতাবেড় নামে একটা গ্রামে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা বাড়ী আছে। সেখানে এক সময় উনি থাকতেন। হোটেলে খোঁজখবর করে শুনলাম সামতাবেড় গ্রামটা আমাদের কলকাতা ফেরার পথেই পড়বে, দেউলটি পোঁছে মেন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে যেতে হবে, পথে সাইনবোর্ড আছে, আর কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তারা বলে দেবে।

সবাই মিলে ঠিক করলাম পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে চেক আউট করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কলকাতা ফেরার পথে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখে নেবো। শরৎবাবুর লেখার সাথে আমরা সকলেই কমবেশী পরিচিত। স্কুলে থাকতে ওনার অভাগীর স্বর্গ আর মহেশ এই দুটো গল্প তো আমাদের পাঠ্যই ছিল। তাছাড়াও শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম খন্ড পড়ার ফলে ইন্দ্রনাথ, ছিনাথ বহুরূপী, নতুনদা’, শাহজী আর অন্নদা দিদির  সাথে আমাদের বেহ ভাল পরিচয় ছিল।  বিন্দুর ছেলে রামের সুমতি নিষ্কৃতি ইত্যাদিও আমরা স্কুলে থাকতেই পড়েছি।

পরে বয়স বাড়লে শরৎচন্দ্রের লেখা আর তেমন পড়া হয়নি। সাম্প্রতিক লেখকেরা – যেমন স্কুলের উঁচু ক্লাসে তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণরা – আমায় গ্রাস করে নিয়েছিলেন। তারপর আমার কলেজ জীবনে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন জোয়ার এলো। রমাপদ চৌধুরী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘো্ষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল কর, আশাপূর্ণা দেবীরা এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। তার পরে এলেন সুনীল শীর্ষেন্দুরা।

এর মধ্যে আমি চলে গেলাম কুয়েতে।

সুতরাং একটা লম্বা সময় আমার শরৎচন্দ্রের কোন বই পড়ার সুযোগ হয়নি।

কুয়েত থেকে ২০১৬ সালে পাকাপাকি ফেরার পরে দেখলাম বাড়ীর আলমারীতে বেশ কিছু বই মা কিনে রেখেছেন। তার মধ্যে আছে শরৎ সমগ্র, বঙ্কিম সমগ্র, শরদিন্দু ওমনিবাস, রাজশেখর সমগ্র, সত্যজিৎ ১০০, ইত্যাদি। দেখে খুব খুসী হলাম, অবসরের পরে কোন কাজ নেই, এখন সারাদিনই বলতে গেলে বাড়ীতে, আর হাতের কাছে এত ভালো ভালো বই ! সময় কাটাতে আর কোন অসুবিধেই হবেনা।  

প্রথমেই ধরলাম শরৎচন্দ্র সমগ্র।

এক এক করে সেই বই থেকে তাঁর সব উপন্যাস পড়ে ফেললাম। দেনা পাওনা, পন্ডিত মশায়, দত্তা, চরিত্রহীন, পুরো শ্রীকান্ত (চার খন্ড), বিরাজ বৌ, কত কি যে আগে পড়া হয়নি।  শরৎচন্দ্রে প্রায় ডুবে রইলাম মাস দুয়েক।

পড়ে একটা জিনিষ বুঝতে পারলাম যে কেন সারা ভারতবর্ষে তাঁর সময়ে জনপ্রিয়তাতে শরৎচন্দ্রের  কাছাকাছি কোন সাহিত্যিক ছিলেন না।  তাঁর সব লেখা ভারতের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, এবং এখনও বাংলায় তো বটেই, শোনা যায় সারা ভারতে তাঁর লেখার কাটতি সব চেয়ে বেশী।

তাঁর সব উপন্যাসই নারীকেন্দ্রিক। পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তাঁর দরদ বেশী ছিল।  আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তাঁর করুণা ছিল আরও বেশী। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন।

রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে এক জায়গায় নিখিলেশ তার স্ত্রী বিমলা কে জিজ্ঞেস করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা তার কেমন লাগে। উত্তরে বিমলা বলেছিলেন বঙ্কিম তাঁর অত্যন্ত প্রিয় লেখক, কেবল তাঁর নায়িকারা এত বেশী সুন্দরী বলে তাঁর খুব ঈর্ষা হয়।

সত্যিই তাই। বঙ্কিমের নায়িকারা সবাই দারুণ সুন্দরী। এবং তাঁর প্রায় সব  উপন্যাসই (কিছু বাদ দিলে) মিলনাত্মক। এমন কি জন্মান্ধ ফুলওয়ালী রজনী ও শেষ পর্য্যন্ত দৃষ্টি ফিরে পায় এবং স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকে।  

শরৎচন্দ্রের নায়িকারাও অনেকেই বেশ সুন্দরী ঠিকই, কিন্তু তাদের ভাল লাগে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা আর ব্যক্তিত্বর জন্যে। তাদের নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ ভালবাসা, অকুন্ঠ স্নেহ এবং সাংসারিক কাজে তাদের কর্ত্তব্যপরায়ণতার কোন তুলনাই চলেনা।  

আর একটা ব্যাপার হল যে  তাঁর অনেক উপন্যাসই বিয়োগান্ত।  উপন্যাসের শেষে পন্ডিত মশায়ের কুসুম, চরিত্রহীন এর কিরণময়ী , বিরাজ বৌ এর বিরাজের করুণ পরিণতি দেখে পাঠকের মন খারাপ হবেই।

শ্রীকান্ত চতুর্থ পর্বে দেখি সে কোন কাজই করেনা, সারাদিন বাড়ীতে নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছে, কিন্তু তাও রাজলক্ষী তার সেবায় সব সময় ব্যস্ত। এই লুচি ভেজে আনছে, এই শরীর খারাপ বলে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে , কিংবা মাথায় জলপট্টি লাগাচ্ছে, এমন কি টাকা পয়সাও তুলে দিচ্ছে তার হাত খরচের জন্যে। অথচ শ্রীকান্ত নির্লিপ্ত, উদাসীন।

কি রে বাবা?

ওদিকে দেবদাস কে দ্যাখো। সে সারাদিন মাল খেয়ে চূর হয়ে থাকে, কি যে তার সমস্যা ভগবান জানেন। কিন্তু দুই সুন্দরী নায়িকা তার মন পাবার জন্যে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে।

এ আবার কি?

কিন্তু কি করা যাবে? শরৎচন্দ্রের নায়িকারা সবাই ওই রকমই। তারা দুঃখ পাবে, কষ্ট পাবে, শেষে ভিখিরি হয়ে পথে বসবে, তবু তারা শেষ পর্য্যন্ত তাদের সেবা আর ভালবাসার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবেনা। তারা হলো যাকে বলে আদর্শ নারী, সংকল্প থেকে তাদের টলানো অসম্ভব, সে যতোই না কেন বিপদ তাদের সামনে আসুকে।I

এই সব বাদ দিলে তাঁর সব বইতে সহজ করে বলা সাধারণ মানুষের গল্প আছে, বিশেষ করে গ্রামীন সমাজের নানা কথা উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর চরিত্ররা সবাই আমাদের চারিপাশের চেনা মানুষ – কেউ শঠ, কুটিল, স্বার্থান্বেষী আবার কেউ উদারমনস্ক, দয়ালূ, আদর্শবাদী।  তাদের আমরা সহজেই চিনে নিতে পারি। 

সামতাবেড়ের রাস্তায় সাইনবোর্ড আর শরৎ কুঠির গেটে মার্ব্বেল ফলকে ওনার লেখা

যাই হোক্‌, আমরা তো বেরিয়ে পড়লাম।

দেউলটি কোলাঘাট থেকে খুব বেশী দূরে নয়। সেখানে পৌঁছে রাস্তার পাশে একটা দোকানে খোঁজ করতেই তারা আমাদের রাস্তা বাতলে দিলো। বড় রাস্তা ছেড়ে আমরা গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। কিছুটা দূর এগোনোর পরে কিছু সাইনবোর্ড চোখে পড়লো।

একটা জায়গায় এসে রাস্তা খুবই সরু হয়ে গেছে, তাই আমাদের বাস আর এগোতে পারলোনা। আমরা বাস থেকে নেমে সাইনবোর্ড দেখে দেখে বাড়ীর গেটে পোঁছে গেলাম। গেটের পাশে বাইরে দেয়ালে বাঁধানো বোর্ড তাতে লেখা “বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বসত বাড়ী।” আর তার পাশে মার্ব্বেল ফলকে “মহেশ” থেকে একটি ছোট উদ্ধৃতি।

গেট দিয়ে ঢুকে সোজা পথ সামনে একটি লাল রং এর টালি দিয়ে ঢাকা একটি দোতলা বাড়ীর দিকে চলে গেছে। বাড়ীটি সুন্দর। গ্রাম্য পরিবেশ , চারিদিকে গাছগাছালি, সবুজে ঢাকা।   বাড়ীর সামনে একটা পুকুর আর পুকুরঘাট ও চোখে পড়ল। সামনে কিছু কার্ত্তিক ঠাকুরের মাটির মূর্ত্তি।

বাড়ীর গেটের সামনে পুকুর, আর গেট থেকে তোলা বাড়ীর সামনে আমাদের গ্রুপ ফটো

এক বয়স্ক ভদ্রলোক নীচে দাওয়ায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন, আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।  জানা গেল ওনার নাম দুলাল চন্দ্র লালা। সবাই এখানে ওনাকে লালাবাবু নামেই চেনে। উনি অনেকদিন থেকে এই বাড়ীতে আছেন, এখন তিনি এই বাড়ীর  কেয়ারটেকার। শরৎচন্দ্রের পরিবারের অনুমতি নিয়ে তিনি এই বাড়ীর দেখভাল করেন, এবং আমাদের মত যাঁরা এখানে আসেন তাঁদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান।

শরৎ স্মৃতিরক্ষা কমিটি নামে একটি সরকারী সংস্থা এই বাড়ীটির  রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে।

লালাবাবু আমাদের জানালেন যে এই বাড়ীটির নাম “শরৎ কুটির।”

শরৎচন্দ্র সামতাবেড় গ্রামে নদীর কাছে ১৯১৯ সালে জমি কিনে বাড়ী তৈরী করতে শুরু করেন।  ১৯২৩ সালে বাড়ী তৈরী হবার পরে তিনি এখানে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী  হিরন্ময়ী দেবীর সাথে ১৯৩৪ সাল পর্য্যন্ত  অর্থাৎ বারো বছর ছিলেন। 

শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় শেষ দিকে কলকাতার বালীগঞ্জে অশ্বিনী দত্ত রোডে ১৯৩৪ সালে একটি বাড়ি তৈরি করিয়ে সেখানে গিয়ে থাকতে শুরু করেন।   

আরও চার বছর পরে ১৯৩৮ সালে শরৎচন্দ্রের জীবনাবসান হয়।

শরৎচন্দ্রের জন্ম হয় হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে, সেখানে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে। পরে তাঁর কৈশোর কেটেছে বিহারের ভাগলপুরে তাঁর মামাবাড়ীতে। সেখানেও গ্রাম্য পরিবেশই ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। পরিণত বয়সে তিনি কয়েক বছর কাজ নিয়ে বর্ম্মার (এখন মিয়ানমার) রেঙ্গুন শহরে কাটিয়েছেন। তাঁর নানা লেখায় (শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব্ব – অভয়ার সাথে, পথের দাবী)  সেই শহরের বর্ণনা আমরা পাই। বর্মাতে তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানের মৃত্যুর পরে তিনি দেশে ফিরে হাওড়ায় বাজেশিবপুরে দশ এগারো বছর কাটিয়ে তারপরে সামতাবেড়ে এসে থাকতে শুরু করেন।

কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিমি  দূরে এই গ্রামে তিনি কেন বাড়ী তৈরী করে থাকতে এসেছিলেন তা পরিস্কার জানা নেই। তবে বাল্য আর কৈশোরে গ্রামে থাকার জন্যে গ্রাম্য জীবনের প্রতি তাঁর একটা টান হয়তো ছিল। তা ছাড়া সামতাবেড়ে লেখার জন্যে একটা শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ ও হয়তো তিনি চেয়েছিলেন। আর ছিল কাছেই রূপনারায়ণ নদীর আকর্ষণ।  

লালা বাবু আমাদের বললেন শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় অল্প কয়েকটি মাত্র গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন। তাদের  মধ্যে তিনি কেবল পথের দাবী আর বিপ্রদাস বই দুটির কথা বলেন। পথের দাবী ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হবার পরে সেই উপন্যাসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নায়ক সব্যসাচীর বিদ্রোহ কে শরৎচন্দ্র যে ভাষায়  প্রশংসা করেছিলেন (“মুক্তিপথের অগ্রদূত”) তা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকের কাছে রাজদ্রোহ বলে মনে করা হয়েছিল।  ১৯২৭ সালে বইটি বাজেয়াপ্ত হয়।  

   

বাড়ীর একতলার দেয়ালে ফলক

লালাবাবু আমাদের এক তলার ঘর গুলো সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। ভিতরে ঢোকা যাবেনা, বাইরে জানলার গরাদের  ভিতর থেকে আমরা দেখলাম তাঁর লেখার টেবিল, তার শোবার ঘর, সেখানে খাটে পরিস্কার সাদা চাদর পাতা, সাথে মাথার বালিশ আর পাশবালিশ।আরও একটা ঘর দেখলাম, লালা বাবু বললেন এই ঘর ছিল তাঁর হোমিওপ্যাথীর রোগীদের দেখার চেম্বার, সেখানে শরৎবাবু গ্রামের লোকেদের হোমিওপ্যাথীর চিকিৎসা করতেন। 

শরৎচন্দ্র হাওড়া শহর ছেড়ে সামতাবেড়ে যখন থেকে বাস করতে থাকেন, তখন থেকে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র লোকদের অসুখে চিকিৎসা করা তাঁর একটা কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগী দেখে তিনি শুধু ওষুধই দাতব্য করতেন না, অনেকের পথ্যও কিনে দিতেন। হাওড়া শহরে থাকার সময় সেখানেও তিনি এই-রকম করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড় অঞ্চলের বহু দুঃস্থ পরিবারকে বিশেষ করে অনাথ বিধবাদের মাসিক অর্থসাহায্য করতেন।

এছাড়া তিনি আরো একটা ঘর দেখিয়ে বললেন যে সেই সময় শরৎচন্দ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সাথে অনুশীলন সমিতির গোপনে যোগাযোগ ছিল, এ বাড়ীর একটি ঘরে মাঝে মাঝে তাঁদের মিটিং আর আলোচনা হত।

লালাবাবু জানালেন  সামতাবেড়ের এই শরৎকুঠি তৈরী করতে সে যুগে খরচ হয়েছিল মোট ১৭,০০০ টাকা। Burmese design এ তৈরী এই বাড়ীটি তাঁর বর্ম্মায় বাস করার স্মৃতির প্রেরণা হিসেবে ধরা হয়। এই বাড়ীর আসবাবপত্র সব বার্মা টিকের তৈরী।  

এই বাড়ীতে শরৎচন্দ্রের নানা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিষ এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে।  তাঁর হুকা, তাঁর লেখার টেবিল, তাঁর বইয়ের আলমারী আর একটা ছোট লাইব্রেরী, জাপানী দেয়াল ঘড়ি সব কিছুই লালা বাবু আমাদের দেখালেন।  

শুনলাম এই শরৎ কুঠি এখন একটি সরকার ঘোষিত ঐতিহ্যের (heritage site) স্মৃতিসৌধ।  

শরৎচন্দ্রের ঘরে রক্ষিত তাঁর নিত্য ব্যবহৃত লেখার টেবিল, ঘড়ি, বিছানা ও আসবাবপত্র

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দোতলায় ও উঠলাম আমরা। সেখানে চারিপাশে  টানা বারান্দা, লাল পাথরের মেঝে। বারান্দার পাশে বেশ কিছু শোবার ঘর। বারান্দা থেকে নীচে শ্যামল সবুজ প্রকৃতির ছবি তোলা হল, আর নিজেদের কিছু গ্রুপ ফটো।

নীচে ফুলের বাগানে শরৎচন্দ্রের একটা মার্বেলের Bust রাখা আছে, আমরা সকলে তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ ফটো তুললাম।   

বিদায় নেবার আগে লালাবাবুকে সন্মানী হিসেবে কিছু টাকা দিয়ে এবং আমাদের সব কিছু ভাল ভাবে দেখাবার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।  

ফেরার পথে বাসে যেতে যেতে শরৎচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ীটি দেখার সুযোগ পেয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়েছিল।

লিসবনের খাস্তা গজা  

Jeronimos Monastery, Lisbon

১) এ আবার কি অসভ্যতা

মার্চ ৩১, ২০১৮ – শনিবার

আমাদের আজকের ট্যুর প্যাকেজে সকালে half day লিসবন সিটি ট্যূর।    

হোটেলে সকাল ন’টায় বাস আসবে। আমরা সবাই রেডি হয়ে লাউঞ্জে এসে সোফায় বসে আছি।        

এমন সময় হোটেলের বাইরে একটা বড় বাস এসে দাঁড়ালো, এবং একটু পরে একটি সুদর্শন যুবক আমাদের সামনে এসে বললো You are the group of Prodosh Mitra? My name is Nunu and I shall be your guide today…

নুনু?

এ আবার কি অসভ্য নাম?

অবশ্য পর্তুগীজ ভাষায় অসভ্য নয় নিশ্চয়, নাহলে ওরকম গর্ব্ব আর আনন্দের সাথে কেউ বলে আমার নাম নুনু? পরে জেনেছিলাম কথাটার মানে হলো petite ছোটখাটো, আদরের।

অসভ্য কথা শুনলেই মেয়েদের খুব হাসি পায়, আমাদের বৌদের মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবেই একটা চাপা হাসির  গুঞ্জন উঠলো। আমরা ছেলেরা অবশ্য অসভ্য কথাকে হাসির ভাবিনা, তবু আমরাও একটু চোখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। ছেলেটির জন্যে একটু সহানুভূতিও অনুভব করলাম, বেচারা জানেওনা কি বিশ্রী একটা নাম তার গায়ে আটকে আছে চিরজীবনের মতো।   

নুনু ছেলেটি কিন্তু খুব স্মার্ট, সুন্দর কথা বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে তার বেশ ভাল আলাপ হয়ে গেল।

কিন্তু মুস্কিল হলো বাসে সে বসে আছে একেবারে সামনে, তার সাথে কথা বলতে গেলে বা তাকে কোন প্রশ্ন করতে গেলে তাকে নাম ধরে ডাকতে হবে।

সুমিতা সিদ্ধার্থ কে বলল তুমি ওকে নাম ধরে ডাকেবেনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে বলবে Excuse me?

নাম ধরে ডাকতে হবে তাই আমরা কেউ ই নুনুকে কোন প্রশ্ন করছিনা। কিছুক্ষণ বকবক করে নুনু ড্রাইভারের পাশের সীটে সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে।

এদিকে বাসে একদম পিছনে বসে আছি আমি আর প্রদোষ। বাসে এ সি চলছেনা, বেশ গরম। তুতু বসে আছে একদম সামনে, প্রদোষ তুতু কে বললো এই নুনু কে বলো তো এ সি টা চালাতে।

তুতু পিছন দিকে প্রদোষ কে একটা বিশ্রী দৃষ্টি দিয়ে বললো, না আমি বলতে পারবোনা, তুমি বলো।

প্রদোষ আর কি করে, সে কয়েকবার মিন মিন করে খুব নীচু গলায় মিস্টার নুনু, মিস্টার নুনু বলে ডাকলো, কিন্তু অত আস্তে বললে নুনু শুনবে কি করে? তখন মরিয়া হয়ে লজ্জা শরম বিসর্জ্জন দিয়ে প্রদোষ বেশ জোরে ডেকে উঠলো – মিস্টার নুনু !

এবার কথাটা নুনুর কানে গেছে, সে মুখ ফিরিয়ে বললো, ইয়েস?

প্রদোষ বলল Please will you turn the air conditioning on?

Sure, বললো নুনু।

কিছুক্ষন পরে আবার এক মুস্কিল। মাইক্রোফোন থেকে একটা খসখস আওয়াজ হচ্ছে, কানে লাগছে।

প্রদোষ এবার তার সংকোচ ছাড়িয়ে উঠেছে। তার গলায় এখন বেশ জোর।

আমি ওর পাশে বসে ছিলাম, আমি বললাম মিস্টার বলার কি দরকার, বাচ্চা ছেলে, ওকে নাম ধরেই ডাকোনা।

বজ্রগম্ভীর স্বরে প্রদোষ ডেকে উঠলো এই নুনু, নুনু!

সামনে বসে ছিল তুতু, সে পিছন ফিরে প্রদোষ কে বলল “এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে?” 

কিন্তু প্রদোষ কে থামানো যাচ্ছেনা, সে ওই খসখস আওয়াজ আর সহ্য করতে পারছেনা।

সে আবার পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “নুনু, এই নুনু! আওয়াজ টা বন্ধ কর্‌ মাইরী…”

২  ভাস্কো ডা গামা          

বাসে করে সারা শহর ঘুরতে ঘুরতে নুনু আমাদের লিসবনের ইতিহাস বর্ণনা করতে লাগলো। পাহাড় দিয়ে ঘেরা টাগোস নদীর মোহনার কাছে গড়ে ওঠা লিসবন হলো ইউরোপে এথেন্সের পরে প্রাচীনতম রাজধানী শহর এবং তার অনুপম সৌন্দর্য্যের জন্যে তার পৃথিবীজোড়া খ্যাতি।    

বাসে যেতে যেতে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম এই মার্চ্চ মাসের সকালে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় ঢাকা বুলেভার্ড, বেশ কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে, কিছু লোক পথের পাশে বেঞ্চিতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। রং বেরং এর ফুলের সমারোহ চারিদিকে, পরিস্কার চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তার ফুটপাথে নানারকম সুন্দর ডিজাইন দিয়ে আঁকা টাইল দিয়ে ঢাকা, রাস্তার পাশে অনেক বাড়ীর দেয়ালে ছবি আর ফ্রেস্কো আঁকা। অনেক গোলচক্কর চারিদিকে, প্রায় প্রত্যেক গোলচক্করেই বিশাল বিশাল সুদৃশ্য স্ট্যাচু। যেন কোন এক মহান শিল্পীর সৃষ্টি এই শহর।  

বড় বড় ছাদখোলা লাল দোতলা বাস ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় সরু neighbourhood এর ভেতর দিয়ে ট্রাম চলে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় আমরা মধ্যযুগে ঢুকে পড়েছি। 

ইউরোপের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে Iberian peninsula তে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে এই ছোট্ট রাজ্য পর্ত্তুগাল প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সুদূর ১১৪০ সালে, তারপরে সেখানকার রাজা রাজড়ারা নানা যুদ্ধ বিগ্রহ করে তাদের রাজ্য দক্ষিণে আরো বাড়িয়ে নেয়, যার মধ্যে ছিল বন্দর শহর লিসবন। ১৩৮৫ সালে লিসবন পর্তুগালের রাজধানী হয়। কিন্তু পর্ত্তুগাল বিখ্যাত হয় পনেরো আর ষোল শতাব্দীতে, যখন তাদের নৌসেনা এবং আবিস্কারকরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তাদের উপনিবেশ তৈরী করতে শুরু করে।

ওই সময়টা ছিল পর্ত্তুগালের স্বর্ণযুগ, এখন যাকে বলা হয় Age of Discovery – তখন পর্তুগাল হয়ে ওঠে পৃথিবীর এক দুর্দ্ধর্ষ ঔপনিবেশিক শক্তি। লিসবনের টাগোস নদীর মোহনার তীরে Belem District এর  সব iconic ঐতিহাসিক landmark ওই সময়ই তৈরী হয়। তাদের মধ্যে আছে World Heritage site Belem Tower, Discovery Monument আর Jeronimos Monastery, যা আজ আমরা দেখবো।              

নুনু আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল একটা Viewing point এ – যার নাম স্থানীয় ভাষায় Meraduro – সেখানে অনেক ওপর থেকে নীচে দেখা যায় ছবির মত সুন্দর ছড়ানো শহর, বাগান, ঘরবাড়ী, রাস্তা।  

আমাদের পরবর্ত্তী গন্তব্য হলো বিখ্যাত Jeronimos Monastery,  যার ভিতরে আছে বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ নাবিক আবিস্কারক (explorer) ভাস্কো ডা গামার কবর। ছোটবেলায় ইতিহাসের বইতে ১৪৯২ সালে ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে Cape of good hope পেরিয়ে তাঁর ভারতবর্ষের গোয়া তে পৌঁছবার কাহিনী পড়েছি।

Jeronimos Monastery র বিশাল imposing স্থাপত্য চোখে পড়ার মত। ভাস্কো ডা গামা ভারত থেকে Spice trade শুরু করেন, এবং সেই ব্যবসা থেকে যে বিশাল অর্থ উপার্জ্জন হয়, তা অনেকটাই খরচ করে Jeronimos Monastery  তৈরী হয় – ভাস্কো ডা গামার সফল ভারত অভিযান এর memorial হিসেবে। এই বিশাল উপাসনা গৃহতে পর্তুগালের রাজা রাজড়াদের সাথে ভাস্কো ডা গামাকেও সন্মানের সাথে সমাধিত করা হয়।

ভাস্কো ডা গামা গোয়াতে পর্তুগীজ সরকারের ভাইসরয় হয়েছিলেন, শোনা যায় ভারতেই তাঁর মৃত্যু হয়, এবং কোচিতে প্রথমে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। পরে পর্তুগীজ সরকার তাঁর দেহ লিসবনে স্থানান্তরিত করেন, যদিও কোচিতে St Francis Church এও তাঁর একটা সমাধিস্থল (Memorial) এখনো আছে।

Jeronimos Monastery র সামনে দর্শনার্থীদের বিশাল লম্বা লাইন। নুনু আমাদের বলল, “তোমরা লাইনে দাঁড়িওনা, কেননা Monastery র হলে ঢোকার জন্যে কোন টিকিট লাগেনা, ওই হলো দোতলায় মিউজিয়ামে যাবার লাইন। তোমরা হলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে পাশে এখানকার একটা বিখ্যাত Pasties এর দোকান আছে, সেখানে গিয়ে কফি নিয়ে একটু বসতে পারো। ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে বাসে ফিরে এসো কিন্তু।”  

Monastery র হলঘরে ঢুকে দেখি সেখানে অনেক লোক, একটা মৃদু গুঞ্জন চারিদিকে। দেয়ালে বড় বড় Oil Painting টাঙানো, রঙীন কাঁচের ওপর ছবি আঁকা জানলা। খুঁজে খুঁজে ভাস্কো ডা গামার শায়িত মর্মর মূর্ত্তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পনেরো শো খ্রীষ্টাব্দের শেষে Age of discovery র সময় তিনি ছিলেন পর্তুগালের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, এক অন্যতম নায়ক। এখানে ভাস্কো ডা গামার মর্মর মূর্ত্তি দেখে ধারণা হয় তিনি ছোটখাটো লোক ছিলেন, মুখ চোখ তীক্ষ্ণ, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। দুই হাত ওপরে নমস্কারের ভঙ্গীতে তুলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন।  

সেদিন Jeronimos Monastery তে ওই হলঘরে ভাস্কো ডা গামার শায়িত মর্মর মূর্ত্তির সামনে চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই স্কুল জীবনের দিন গুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম। মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল অন্ধকার রাত্রে ঝড়ের উত্তাল সমুদ্র, জাহাজ ডুবির ভয়, নাবিকদের কোলাহল, আর এই সব ছাপিয়ে ভাস্কো ডা গামার সাহস, আত্মবিশ্বাস আর নেতৃত্ব দেবার অপরিসীম ক্ষমতা।    

মূর্ত্তির তলায় দুর্বোধ্য পর্তুগীজ ভাষায় কি সব লেখা আছে দেখলাম।

দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব পর্তুগালে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল… বা ওই ধরণের কিছু নাকি?

কি জানি, হবেও বা।

Vasco Da Gama – in Jerominos Monastery

 ৩ –  লিসবনের গজা       

Jeronimos Monastery থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে সারি সারি দোকান, একটু হেঁটেই পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত গজার দোকান, নুনু আমাদের যার কথা বলেছিল। বাইরে বিশাল সাইনবোর্ড Belem Pasties, আর রেস্টুরেন্টের ভেতরে বিশাল ভীড়। ঢুকে কোনমতে একটা টেবিল পাওয়া গেল। ইউনিফর্ম পরা ওয়েটাররা ট্রে হাতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে রেস্টুরেন্টটা বেশ নামী।

যাই হোক কফি আর গজা অর্ডার দিয়ে বসে আছি তো আছিই। এদিকে নুনু বলে দিয়েছে দুই ঘন্টার মধ্যে ফিরতে, তাই বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি আমরা। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের ওয়েটারের নাম ফার্নান্ডো। আমি বার দুয়েক গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছি আর কত দেরী ভাই, সে আমাদের কোন পাত্তা না দিয়ে ট্রে হাতে ব্যস্ত ভাবে দূরে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।

মহা মুস্কিল তো? এই লিসবনের গজা খাওয়া আমাদের কপালে নেই মনে হচ্ছে।

যাই হোক একটু পরে আবার ব্যস্তসমস্ত ভাবে ঘুরে বেড়ানো ফার্নান্ডো কে গিয়ে যেই “এত দেরী হচ্ছে কেন ভাই” জিজ্ঞেস করেছি, মনে হলো আগুণে যেন ঘি পড়লো। ছোটখাটো বেশ সুঠাম চেহারার ছেলেটি হঠাৎ হেড অফিসের বড়বাবুর মত তেলেবেগুণে জ্বলে উঠে তার হাতের ট্রে টা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো~

Will you take my place?   

ফার্ণান্ডো কে হঠাৎ ওই ভাবে ফেটে পড়তে দেখে আমার সেদিন খুব দুঃখ হয়েছিল। নানা কারণে আমাদের অনেকের মনেই জমতে থাকে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ। কাজের চাপ, নানাবিধ অসন্মান, গ্লাণি, সম্পর্কের টানাপোড়েন। হয়তো তার ভিতরে নিশ্চয় ক্রমশঃ জমে উঠছিল অনেক অস্থিরতা, অসহায়তা, তা আমার সামান্য একটা কথায় মুহুর্ত্তের মধ্যে ফুঁসে বেরিয়ে আসে।

পরক্ষনেই অবশ্য সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল, আমিও হেসে তার কাঁধে হাত রেখে দুঃখপ্রকাশ করেছিলাম।   

কিন্তু ঘটনাটা আমি আজও ভুলতে পারিনা। Abba র সেই বিখ্যাত Fernando গান টা শুনলে আমার এখনো লিসবনের সেই ফার্নান্ডো ছেলেটিকে মনে পড়ে। গানের সেই ফার্নান্ডো ছিল তার দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক যুবক সৈনিক, এখন তার বয়স হয়েছে, তার মাথায় এখন পাকা চুল। তবু এই পরিণত বয়সে এসেও সে তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ভোলেনি, সেই বারুদের গন্ধ, বোমার আওয়াজ সে এখনো ভুলতে পারেনা।

There was something in the air that night/

The stars were bright, Fernando/
They were shining there for you and me/

For liberty, Fernando

আমাদের এই ওয়েটার ফার্ণান্ডো ছেলেটিও সৈনিক। তবে সে হলো জীবনযুদ্ধের সৈনিক।

জানিনা সে কেমন আছে।

একটু পরেই আমাদের টেবিলে কফি আর রসে ভাজা খাস্তা গজা দিয়ে গেল সে।

তবে বলতে দ্বিধা নেই, সেই গজা খেয়ে আমার বেশ খারাপ লেগেছিল, খুবই আশাহত হয়েছিলাম আমি। ছোটবেলায় আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীতে মা আর জ্যেঠিমার তৈরী খাস্তা গজার সাথে এর কোন তুলনাই হয়না।

ছোটবেলার সেই গজার স্বাদ এখনো আমার জিভে লেগে আছে।

মা আর জ্যেঠিমা যদি লিসবনে এসে একটা গজার দোকান খুলতেন…

লিসবনে গজার দোকান

Subhadra and I at the Discovery monument, Belem, Lisbon

যাও এবারের মত তোমায় ছেড়ে দিলাম ~

২৮শে মার্চ, ২০১৮।

আজ আমাদের ভিয়েতনামে শেষ দিন।  এখান থেকে আমরা যাচ্ছি কাম্বোডিয়ার সীম রীপে  আঙ্কোর ওয়াট মন্দির দেখতে।

সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে হানয় এয়ারপোর্টে যাবার পথে দুই জায়গায় আমাদের গাইড টুয়ান আমাদের নিয়ে যাবে, প্রথমে  হো চি মিনের mausoleum, যেখানে  তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত, তার পরে সেখান থেকে কাছেই Single pillar pagoda, এই দুটো জায়গা দেখার পরে আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে কাম্বোডিয়ার সীম রীপের ফ্লাইট ধরবো।

হো চি মিনের Mausolem শহরের একটা কেন্দ্রস্থলে, সেখানে চারিদিকে নানা সরকারী অফিস বিল্ডিং, পার্লামেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের বাড়ী ইত্যাদি।মিলিটারীর ছড়াছড়ি চারিদিকে। বিশাল প্রাঙ্গন সামনে, অনেকটা হেঁটে ভেতরে ঢুকতে হলো, বেশ ভীড়, লম্বা লাইন। রাইফেল হাতে মিলিটারী গার্ড রা দরজায় দাঁড়িয়ে, sunglass পরা চলবেনা, মাথায় টুপি পরা থাকলে মৃত নেতা কে সন্মান জানানোর জন্যে তা খুলে ঢুকতে হবে। এই সব নিয়ম মেনে সবাই লাইন দিয়ে ঢুকছে, সারা জায়গাটা অত লোক থাকতেও বেশ নিস্তব্ধ।

ছোট একটা ঘরে কাঁচের বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছেন হো চি মিন। ওইটুকু দেশের ওরকম একজন দুর্দ্ধর্ষ নেতা, USA র মত এক প্রবল প্রতিপক্ষ কে যুদ্ধে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। জানি তিনি মৃত তবু তাঁর এই ঘুমন্ত মুখের মধ্যেও একটা কঠিন ভাব,  মনে হচ্ছে বেশ জীবন্ত তিনি, এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন, একটু আওয়াজ হলেই হয়তো  ঘুম ভেঙে উঠে বসবেন। তাঁকে এত কাছ থেকে দেখে গায়ে বেশ কাঁটা দিচ্ছিল।

আমরা লাইন করে কাঁচের বাক্স প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে এলাম।

সেখান থেকে কাছেই One pillar pagoda সেখানে টুয়ানের সাথে আমরা হেঁটে পৌঁছে গেলাম।  এখানে চারিদিকে জলের moat এর মধ্যে থেকে উঠে এসেছে একটি column এর ওপরে তৈরী নারী বুদ্ধের (female Buddha) মন্দির, আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দর্শন করে এলাম।

হানয় এয়ারপোর্টে দেবযানীর পাসপোর্ট দেখে চেক ইন কাউন্টারের লোকটি বলল আপনার পাসপোর্টে তো দেখছি দুটো ফাঁকা পাতা নেই। নিয়ম হলো দুটো ফাঁকা পাতা না থাকলে তো আপনাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া যাবেনা।

এ আবার কি নিয়ম?

প্রদোষ আর দেবযানী  হলো কানাডার নাগরিক, তাদের মেয়েরা থাকে আমেরিকায়, কাজে এবং বেড়াতে  তারা সারা পৃথিবীতে অনবরত ঘুরে বেড়াচ্ছে।  তাদের ভূপর্য্যটক আখ্যা দেওয়া যায়।  তাদের পাসপোর্টের পাতা খুব তাড়াতাড়ি স্ট্যাম্পে র ছাপে ভরে ওঠে,  সুতরাং দেবযানীর পাসপোর্টে  দুটো ফাঁকা পাতা না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

দেবযানী বেশ বলিয়ে কইয়ে মেয়ে, তার ওপরে সে আবার খুব সুন্দরী , হানয় এয়ারপোর্টের কাউন্টারের লোকটিকে সে সহজেই বশ করে প্লেনে উঠে পড়লো।

কিন্তু তার পরে কাম্বোডিয়ার সীম রীপ এয়ারপোর্টে পৌঁছে তো এক বিরাট ঝামেলা।   আমাদের সবার visa on arrival stamped হয়ে গেল , এদিকে প্রদোষ বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু দেবযানীর পাসপোর্টে পাশাপাশি দুটো ফাঁকা পাতা না থাকায় তাকে কিছুতেই এয়ারপোর্টের Immigration officer রা বাইরে বেরোতে দিচ্ছেনা। আমরা দেখছি ম্লান মুখে দেবযানী দু’জন অফিসারের সাথে একবার এদিক আর একবার ওদিকে যাচ্ছে, বুঝলাম ওকে জেরা করা হচ্ছে কেন সে এই পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে? কি তার উদ্দেশ্য? সে কি নিয়ম জানেনা?  

ওদিকে বাইরে আমরা সবাই অধীর অপেক্ষায়। প্রদোষের মুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ।

শেষ পর্য্যন্ত দেবযানীকে অবশ্য ছেড়ে দিলো একজন senior officer, কিন্তু পরে তার মুখে সেই harrowing অভিজ্ঞতার গল্প  শুনে মনে হয়েছে যে এক সময় সত্যিই তার মনে হয়েছিল যে তাকে  কাম্বোডিয়া ঢুকতে দেওয়া হবেনা, তাকে ফিরে যেতে হবে।

বেশ কিছু দিন পরে দেবযানী বেশ মজা করে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল আমাদের।

তার গল্পে দু’জন চরিত্র, একজন মিনমিনে রোগা পাতলা জুনিয়র assistant, আর একজন মোটাসোটা বেঁটেখাটো হাট্টা গাঁট্টা সিনিয়র অফিসার।

গল্পটা এই রকম –

———————

মিনমিনে বললো ম্যাঁও ফ্যাঁও ক্যাঁও চ্যাঁও…

আমি দেবযানীকে বললাম তার মানে কি?

দেবযানী বললো ও বললো, “দেখুন না স্যার এই মেয়েটি নিশ্চয় আমাদের দেশে স্পাই করতে এসেছে এ কে ঢুকতে দেওয়া যায়না স্যার…”

হাট্টা গাঁট্টা গম্ভীর হয়ে বললো  “হাঃ কাঃ ফাঃ মাঃ !”

আমি বললাম তার মানে?

দেবযানী এই সব কথার মানে সব বুঝতে পারছে, সে বললো লোকটা আমায় জিজ্ঞেস করছে আমি এই নিয়ম টা জানি কি না? আমি তো অনেক করে বুঝিয়ে বললাম না স্যার বিশ্বাস করুন আমি এই সব নিয়ম জানিনা, আমি স্পাই নই স্যার, আমি আর আমার বর আপনাদের এই সুন্দর দেশ ঘুরে দেখতে এসেছি, আমরা ট্যূরিস্ট…

মিনমিনে মিনমিন করে বললো কুঁচু মুঁচু ফুঁচু হুঁচু…

আমি বললাম তার মানে? সে বললো বুঝলেনা ও বললো, “স্যার এর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না , এই মেয়েটা কে ঢুকতে দিলে দেশের একটা বড় বিপদ হয়ে যাবে।”

এই রকম কিছুক্ষণ চলার পরে হাট্টা গাঁট্টার বোধ হয় একটু মায়া হলো। সে বললো “ফঃ হঃ ফঃ খঃ!

দেবযানী বললো তার মানে হচ্ছে “ঠিক আছে যাও এবারের মত তোমায় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু আর যেন কোনদিন এরকম ভুল না হয়!”

——————————–

দেবযানীর এই গল্পটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের  চন্দ্রগুপ্ত নাটকের একটা  প্যারোডি ছিল তাতে এক বাঙাল জমিদার  সব চেয়ে বেশী চাঁদা দিয়েছেন বলে পাড়ার নাটকে  আলেকজান্ডারের রোল টা তাঁকে দিতেই হয়েছে,  আর তিনিও তাঁর মত করে নাটকের সব সংলাপ বলে যাচ্ছেন সইত্য সেলুকস কি বিচিত্তির এই দ্যাশ ইত্যাদি…

তো এক সময়ে স্টেজে চন্দ্রগুপ্ত কে নিয়ে সেনাপতি  Antigones এর প্রবেশ।

জমিদার – অ্যা্ন্টি গনশা, এডা কেডা?

সেনাপতি – মহারাজ এই যুবক একজন গুপ্তচর, আমাদের শিবিরের বাইরে সন্দেহজনক ভাবে আনাগোনা করছিল, তাই তাকে আপনার সামনে ধরে নিয়ে এসেছি।

জমিদার – গুইপ্তচর? এ রে বন্দী কর্‌~

চন্দ্রগুপ্ত – আমায় বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না সম্রাট!

জমিদার – ও তুমি দ্যাখতেসি বীর! হঃ, ব্যাটাকে ছাইড়্যা দে…

দেবযানীর গল্পে ওই হাট্টা গাঁট্টা অফিসার হলেন আলেকজেন্ডার, আর দেবযানী হলো female বুদ্ধর মতো female চন্দ্রগুপ্ত !

টাঙ্গাইলে জ্যাঠামশায়ের সাথে কিছুক্ষণ (১৯৮১ )

আমার প্রপিতামহ স্বর্গীয় দীনবন্ধু ভৌমিকের এক মেয়ের (বাবাদের পিসীর) ময়মনসিংহে বিয়ে হয়। তিনি, এবং তাঁদের দুই ছেলে দেশভাগের পরে ভারতে আসেন নি, দু’জনেই ভিটে মাটির টানে পূর্ব্ব বাংলায় রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের বড় ছেলে (পূর্ণ রায়) ছিলেন ডাক্তার, তিনি ও তাঁর স্ত্রী ষোড়শী নিঃসন্তান ছিলেন।
আর তাঁদের ছোট ছেলে (সুশীল রায়) ছিলেন উকিল, তিনি টাঙ্গাইল কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। তাঁর দুই ছেলে তারাপদ (কবি তারাপদ রায়) আর বিজন দুজনেই কর্ম্মসূত্রে কলকাতায় চলে এলেও তিনি আসেন নি, স্ত্রী মারা যাবার পরে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি টাঙ্গাইলেই নিজের ভিটেয় থেকে যান।
তারাপদ দা’র বাবা সম্পর্কে ছিলেন আমার বাবা কাকাদের পিসতুতো দাদা, আমার সুশীল জ্যাঠামশায়।
ভাদরা যেতে না পারলেও ১৯৮১ সালে আমি একবার টাঙ্গাইলে গিয়ে সুশীল জ্যাঠামশায়ের সাথে দেখা করে এসেছিলাম। সেই ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে বেশ hostile পরিবেশে তিনি শুধুমাত্র ভিটে মাটির টানে জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ একা একজন প্রৌঢ়া বিধবা কাজের মহিলার উপর নির্ভর করে থেকে গিয়েছিলেন। জ্যাঠামশায়ের বাংলাদশে থেকে যাবার অভিজ্ঞতা অবশ্য বিয়োগান্ত হয়নি। টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ীতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।

তাঁর সাথে টাঙ্গাইল শহরে গিয়ে দেখা করা নিয়ে নীচের এই লেখাটি।

———-

আমার বাবার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে  প্রাক স্বাধীনতা যুগের পূর্ব্ববঙ্গের নানা শহরে, তাঁর মুখে সেই সব জায়গার নানা গল্প শুনেছি, পূর্ব্বাচল নামে তাঁর স্মৃতিকথায় ও সেইসব জায়গার সুন্দর বর্ণনা আছে।
ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, রাজসাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম… 
বাবার লেখা পড়তাম আর ভাবতাম এই সব জায়গায় কি কোনদিন আমার যাওয়া হবে? 
১৯৮১ সালে বাংলাদেশে যাবার সেই সু্যোগ এসে গেল। বাঙাল পরিবারে জন্ম, তাই বাংলাদেশ আসার সু্যোগ পেয়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম মনে পড়ে। ওই দেশটার সাথে আমার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন রক্তের মধ্যে মিশে আছে। 
International Centre for Diarrhoeal Disease Research (ICDDR) বাংলাদেশে কলেরা আর আমাশা এই দুই রোগ আর মহামারী নিয়ে রিসার্চ করছে, তারা  IBM system ব্যবহার  করে  বাংলাদেশে র নানা গ্রামে আর শহরে জন্ম মৃত্যু সংক্রান্ত sample demographic database তৈরী করবে।  সেই কাজে সাহায্য করার জন্যে IBM India থেকে একটা assignment পেয়ে আমি তাদের সাথে বছর খানেক বাংলাদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।

কাজের সূত্রে সেই এক বছর বাংলাদেশের নানা শহর দেখা হয়েছিল, অনেক লোকের সাথে আলাপ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। ঢাকায় যখন বেশ কয়েকবার যাতায়াত  এবং বেশ কিছু দিন থাকা হয়ে গেছে,  তখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের গ্রাম ভাদরা গ্রাম টা ঢাকা থেকে খুব একটা দূর নয়, একবার সেখানে ঘুরে এলে বেশ হয়।

কিন্তু আমি তো জায়গাটা কোথায় জানিনা, কেই বা আমায় সেখানে নিয়ে যাবে, আর সেখানে গেলেই বা নিজের পরিচয় কি দেবো, সেখানে আমার অভ্যর্থনা কেমন হবে এই সব ভেবে সেখানে যাবার আশা পরিত্যাগ করেছি।  

তার পরে এক দিন মনে হলো ভাদরা না হোক, অন্ততঃ টাঙ্গাইল গিয়ে জ্যাঠামশায়ের সাথে একবার দেখা করে আসি, উনি একা একা কেমন আছেন দেখে আসি, আর তিনি হয়তো আমায় ভাদরা যাবার ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারেন। ভাদরা গ্রাম শুনেছি টাঙ্গাইল থেকে খুব একটা দূরেও নয়।

দেশভাগের সময় টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ছিল।  এই ১৯৮১ সালে এখন টাঙ্গাইল একটি জেলা।    

তারাপদ দা’র কাছ থেকে direction নিয়ে এসেছিলাম। এক রবিবার দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম।

ঢাকার বাইদুল মুকারাম মসজিদের কাছে বাস স্ট্যান্ড, সেখানে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে, সেই সব বাসের গায়ে বড় বড় করে বাংলায় লেখা আরবী ভাষায় কোরানের বাণী, “বিসমিল্লা রাহমানুর রাহিম”, “লা ইলা ইল্লাল্লাহ” ইত্যাদি।

রবিবার দুপুরে মাগরেব এর নমাজ সবে শেষ হয়েছে, রাস্তায় চারিদিকে লুঙ্গী পরা মাথায় টুপি দাড়িওয়ালা ধর্ম্মপ্রাণ  মুসলমান লোকেদের  ভীড়।  সেই ভীড়ের মধ্যে আমি  বিধর্ম্মী হিসেবে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত, সবাই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছে, এদের ধর্ম্মে নাকি বলে বিধর্ম্মী কে মারলে বেহেস্তে যাবার রাস্তা সুগম হয়। আমায় দেখে এই সব ধর্ম্মপ্রাণ লোকেদের মনে নিজেদের বেহেস্তে যাবার পথ সুগম করার ইচ্ছে জাগছে কিনা কে জানে?

গা টা বেশ ছমছম করছে, মনের ভেতরে বেশ একটা শিরশিরানি ভয় টের পাচ্ছিলাম। 

কাজটা কি ঠিক করছি?

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল খুব দূর নয়, বাসে দুই ঘন্টার পথ।  

টাঙ্গাইলের বাস খুঁজে উঠে বসে পড়লাম। ছুটির দিন দুপুর, বাস ফাঁকাই পেলাম। পিচের রাস্তা তেমন চওড়া না হলেও বেশ মসৃণ, শহর ছাড়িয়ে একটু পরেই দু’দিকে চোখে পড়ল অবারিত প্রান্তর, দিকচক্রবাল পর্য্যন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে কিছু I গ্রাম আর জনপদ আসে, সেখানে বাড়ীর দেয়ালে নানা ধরণের লিখন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী”, কিংবা “কাদের সিদ্দিকির হুলিয়া, নিতে হবে তুলিয়া” ইত্যাদি।

বট, অশ্বথ, ছাতিম, তেঁতুল, আম জাম, কাঁঠাল, আরও কত নাম না জানা গাছের ডাল পালা দুই পাশ থেকে এসে রাস্তার ওপরে ঝুঁকে পড়ে ছায়া ফেলে। মাঝে  মাঝেই চোখে পড়ে পথের ধারে কলাবাগান, কিছু ছোট পুকুর, ছোট বাড়ী, অসংখ্য নারকেল গাছ।

বেলা তিনটে নাগাদ টাঙ্গাইল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে রিক্সা নিলাম। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম। রিক্সাওয়ালা একেবারে অবিকল তারাপদ দা’র মত করে কথা বলছে, এক সুর, এক উচ্চারণ, এক কথা বলার ভঙ্গী। একেই বোধ হয় বলে স্থানমাহাত্ম্য।

টাঙ্গাইল শহরে সবাই ওই ভাবেই কথা বলে নাকি?

তারাপদ দা’র  direction থাকায় জ্যাঠামশায়ের বাড়ী বাস স্ট্যান্ড থেকে কাছেই, খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলোনা। রাস্তার ওপরেই একতলা ছোট বাড়ী। রাস্তার উল্টো দিকে একটা বিরাট পুকুর।  বাড়ীর সামনে বারান্দায় আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে  (বোধ হয় মার্চ্চ মাস, তখনও অল্প শীত) জ্যাঠামশায় আরামকেদারায় বসে রোদ পোয়াচ্ছেন, এই দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। আমায় দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলেন। বাবা আর দাদুর নাম বলতেই চিনতে পেরে উঠে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। 

ছোটখাটো চেহারা, চোখে ঘষা কাঁচের চশমা, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, তবু মনের জোর আর সাহস সাঙ্ঘাতিক, দুই ছেলে পাশে নেই, স্ত্রীও গত হয়েছেন, বয়স হয়েছে,  তবু একা একা এক বয়স্কা কাজের মহিলার ওপরে নির্ভর করে তিনি টাঙ্গাইলে থেকে গেছেন।

বান্ধবহীন স্বজনহীন জীবনে অপ্রত্যাশিত ভাবে জ্যাঠামশায়  আমায় পেয়ে খুব খুসী হয়েছিলেন বুঝেছিলাম, অচেনা হলেও আমি তো ঘরের লোক, হাজার হলেও রক্তের সম্পর্ক। আমার কাছ থেকে পরিবারের কে কোথায় আছেন সব খবরাখবর নিলেন।  মামা রা দুজনেই  (ব্রজবন্ধু, জগদবন্ধু) চলে গেছেন সে কথা জানেন, আমার বাবাও যে অল্পবয়েসে গত হয়েছেন সে খবরও পেয়েছেন জানালেন।

তারাপদ দা’র সাথে আমার যোগাযোগ আছে জেনে খুসী হলেন।

সেই বিধবা কাজের মহিলাও আমায় দেখে খুব খুসী। হাসিমুখে ঝকঝকে কাঁসার রেকাবী আর গেলাসে  যত্ন করে আমায় বাড়ীর তৈরী নাড়ু, নিমকি সন্দেশ আর ঠান্ডা জল এনে দিলেন, ভেতরে শোবার ঘরে  খাটের ওপর বসে নানা গল্প করতে করতে খেলাম। 

ঘন্টা দুয়েক ওঁদের সাথে বেশ কেটে গেল।

ভাদরা যাবার কথা তুললাম। কিন্তু বুঝলাম জ্যাঠামশায় এর ইচ্ছে নয় আমি ভাদরা যাই।   ভাদরা যাবার ব্যাপারে উনি খুব একটা উৎসাহ দিলেন না। প্রথমতঃ গ্রামটা নাকি অগম্য, রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। আলপথ ধরে হেঁটে বা সাইকেলে চেপে যেতে হয়। আর বর্ষা কালে নৌকায়। তাছাড়া সেখানে আমাদের আর কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, আমায় দেখে ওখানকার স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে unfavourable (adverse, hostile) reaction হবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।   

বাংলাদেশে এখন গ্রাম অত অগম্য এই যুক্তি আমি ঠিক মেনে নিতে না পারলেও তাঁর সাথে তর্ক করিনি। নিশ্চয় অন্য কোন কারণ ছিল, যা তিনি আমায় বলতে চান নি, যার জন্যে তিনি আমায় ভাদরা যেতে উৎসাহ দেন্‌নি, হয়তো ওখানে গেলে সত্যিই আমার কোন বিপদ হবার সম্ভাবনা ছিল।    

অন্ধকার হবার আগেই উঠলাম। তারপরে রিক্সা নিয়ে আবার বাসস্ট্যাণ্ড।

বারণ করা  সত্ত্বেও জ্যাঠামশায় আমার সাথে বাস স্ট্যাণ্ড পর্য্যন্ত এসে পৌঁছে দিলেন। এখনও তিনি ওকালতি করেন বুঝলাম, কালো একটা কোট চাপিয়ে নিলেন বেরোবার আগে। বাস স্ট্যান্ডে অনেক পরিচিত লোক তাঁকে “চাচা কেমন আসেন?” বলে হেসে সালাম জানাচ্ছিলেন। তিনি তাদের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন, বললেন আমার ভাইপো। কলকাতা থেকে দেখা করতে এসেছে। বাসস্ট্যাণ্ড এর কাছে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল, আমায় আঙুল তুলে দেখালেন, ছোটবেলায় তারাপদ দা’ ওই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ওনার কবিতায় ওই স্কুলের উল্লেখ আছে, মনে পড়ে গেল।

তারপরে বাসে উঠে পড়লাম, জানলা দিয়ে দেখলাম জ্যাঠামশায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন, ঝলঝলে ট্রাউজার্স, গায়ে কালো কোট, তাঁকে দেখে বেশ দুঃখী, অসহায় আর একলা মনে হচ্ছিল,  ইংরেজীতে যাকে বলে sad lonely and lost~

জ্যাঠামশায়ের ওই বাস স্ট্যান্ডে আমায় বিদায় জানানোর দৃশ্য টা আমার এখনও পরিস্কার মনে পড়ে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমায় আপন করে নিয়েছিলেন।

তার দুই এক বছরের মধ্যে টাঙ্গাইলেই তাঁর জীবনাবসান হয়।

বাসে আসতে আসতে ভাবছিলাম কি হতো যদি শ্যামাপ্রসাদ না পারতেন, যদি কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গ পাকিস্তানে চলে যেতো? 

১৯৪২ সালে ব্রজবন্ধু মারা গেছেন, আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীতে তখন তাঁর ছেলেরা অর্থাৎ আমাদের বাবা কাকারা থাকেন। তাঁরা কি পাকিস্তানে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কলকাতার বাড়ী বিক্রী করে বিহারে পাটনা বা রাঁচীতে বাস তুলে নিয়ে যেতেন?

বলা মুস্কিল।

পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশের) নাগরিক হলে আজ আমাদের কি অবস্থা হতো?  আমরা কি  “নিজভূমে পরবাসী” হয়ে মাথা নীচু করে থাকতাম?

বাসের ঝাঁকানীর মধ্যে এই সব ভাবতে ভাবতে চলেছি।

জানলার বাইরে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।