
এপ্রিল, ২০১৭
১ মন্দারমণি
কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সাথে মন্দারমণি গিয়েছিলাম।
একটা সময় ছিল যখন কলকাতার কাছে সমুদ্র সৈকত হিসেবে সবচেয়ে বেশী নামডাক ছিল দীঘার। কিন্তু আজ দীঘা আর আগের মত নেই, এখন সেখানে বড্ড ভীড় আর নোংরা ঘিঞ্জি পরিবেশ। সেই তুলনায় মন্দারমণি বেশ নিরিবিলি, pristine, চমৎকার চওড়া বীচ্, বেশী ভীড় নেই।
আমরা উঠেছিলাম সমুদ্রের ধারে Sun City Hotel এ।
মন্দারমণি যাবার আগে শুনেছিলাম যে ওখানে High tide এর জন্যে যথেষ্ট জায়গা না রেখে হোটেল গুলো তৈরী হওয়ায় জোয়ারের সময়ে সমুদ্রের জল প্রায় হোটেলের মধ্যে ঢুকে আসে।
তো আমরা প্রথম দিন পৌঁছে যখন বিকেলে বীচে গিয়ে পোঁছলাম, তখন ভাঁটা। সমুদ্র অনেকটাই দূরে। বিশাল বীচ, শক্ত বালি, সেই বালির ওপরে অনায়াসে গাড়ী চালানো যায়। দেখলাম হোটেলের গা ঘেঁসে পাথরের বাঁধ, বুঝলাম জল যাতে হোটেলের ভিতরে না ঢোকে তাই ওই ব্যবস্থা।
আমরা হোটেলের বাইরে একটা দোকানে ডাব অর্ডার করতে তারা খাতির করে আমাদের প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসতে দিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, সমুদ্রের তীরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আড্ডা মারার মজাই আলাদা। নানা রকম মজা হাসি আর পি এন পি সি হচ্ছে। এদিকে আড্ডা মারতে মারতে কখন যে নিঃশব্দে সমুদ্রের ঢেউ আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। দোকানের বাচ্চা ছেলেটা হঠাৎ বলে উঠলো উঠুন উঠুন…
চেয়ারগুলো সব সরাবার আগেই ঢেউ এসে আমাদের প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়ে গেল।


২ ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রজিৎ!! চটি চটি!!
দ্বিতীয় দিন বিকেলে আবার সমুদ্রের তীরে গেছি। একটু পরে সূর্য্যাস্ত হবে, সময়টা বড় মায়াবী। আমরা আমাদের চটি গুলো জল থেকে বেশ কিছুটা দূরে যাকে বলে নিরাপদ দূরত্বে রেখে খালি পায়ে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে হাঁটছি। আর জলের মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবে যাওয়া সূর্য্য কে ধরবার জন্যে ক্যামেরা তাক করে আছি।
সামনে পূর্ণিমা, জোয়ারের জল যে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে তা খেয়াল নেই। ক্যামেরার aperture, light metering আর shutter speed এই সব নিয়ে আমি মগ্ন।
হঠাৎ ধ্রুবর গলায় আর্ত চিৎকার কানে এলো।
ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রজিৎ!! চটি চটি!!
তাকিয়ে দেখি আমাদের চটি জলে ভেসে যাচ্ছে।
সব্বোনাশ!
সূর্য্যাস্তের ছবি তোলা চুলোয় গেল, চটি বাঁচাতে পাঁই পাঁই করে ছুটলাম।


৩ চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
আমাদের হোটেলের বাইরে বীচের ওপরে বেশ কিছু makeshift ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট, বাঁশের খুঁটির ওপরে তেরপল দিয়ে ঢাকা ছাউনী। তলায় বেশ কিছু টেবিল চেয়ার পাতা, সেখানে লোকেরা বসে খাচ্ছে। বাঁশের খুঁটিতে A4 সাইজের মেনুকার্ড ঝুলছে, তাতে নানা ধরণের খাবার এর লিস্ট। ইলিশ মাছ আর চিংড়ীমাছ ভাজা, কাঁকড়া, চিকেন। তাছাড়া তড়কা ডাল, রুটি, ভাত, তরকারী, যা চাই। হোটেলের তুলনায় বেশ সস্তাও।
আমরা ঠিক করলাম সন্ধ্যায় এখানে এসে খাবো।
কিন্তু বিকেল থেকে জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করলো। সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে আমাদের চক্ষুস্থির। কোথায় দোকান?
চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।


৪ দীঘা
মন্দারমণি তে সারাদিন তেমন কিছু করার নেই, একদিন আমরা দীঘা আর শঙ্করপুর ঘুরে এলাম।
১৯৬৩-৬৮ খড়্গপুরে থাকার সময় অনেকবার দীঘা গেছি বন্ধুদের সাথে। ষোলো সতেরো বছর বয়েস তখন, বাড়ীর গন্ডী থেকে বের হয়ে হোস্টেলে স্বাধীন জীবন, নতুন পাওয়া বন্ধুরা, আর ক্লাসে যাওয়া আর ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে প্রত্যেকের একটা করে সাইকেল।
জীবনে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?
বাঙালীর প্রিয় পুরী কে ছাড়িয়ে সমুদ্র সৈকত হিসেবে দীঘা তখন ক্রমশঃ তার জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করতে শুরু করেছে। বাংলা ছোটগল্পে উপন্যাসে আধুনিক গানে দীঘা তার জায়গা করে নিয়েছে। পিন্টূ ভটাচার্য্যের “চলোনা দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়া ছায়ায়” গান তখন সুপারহিট।
আমাদের ফার্স্ট আর সেকেন্ড ইয়ারে বছরে অন্ততঃ দুই তিন বার লং উইকেন্ড পেলেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে দীঘা তে গিয়ে দুই দিন কাটিয়ে আসতাম। খড়্গপুর থেকে দীঘা বেশ দূর (আশি মাইল), তখন সেই লাইনে সোজা বাস বা ট্রেণ রুট ছিলনা। আমরা খড়্গপুর স্টেশন থেকে বাসের মাথায় সাইকেল চাপিয়ে কাঁথি চলে যেতাম। কাঁথি থেকে দীঘা ত্রিশ মাইল মত। সাইকেলে চার ঘন্টা মত লাগতো।
রাত দুটো নাগাদ কাঁথি পৌঁছে আমরা দশ বারোজন বন্ধু পাশাপাশি অন্ধকার রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলা দীঘা পৌঁছতাম। মাথার ওপর রাতের তারাভরা আকাশ, দুইপাশে অন্ধকার চরাচর, মাঝে মাঝে দুই একটি ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ গ্রাম চলে যায়, এসবের মধ্যে গল্প করতে করতে গান গাইতে গাইতে সাইকেলে চেপে আমরা চলেছি। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে, একটু পরেই সূর্য্যোদয় হবে। তার আগেই আমরা সোজা সমুদ্রের তীরে পৌঁছে যেতাম।
প্রথম যৌবনের অনন্য অপূর্ব্ব অভিজ্ঞতার সাথে দীঘার স্মৃতি আমার মনে অবধারিত জড়িয়ে আছে।
তখন কি নির্জ্জন আর পরিস্কার ছিল দীঘা! সমুদ্রের ধারে বে কাফে নামে একটা রেস্তোরাঁ ছিল, তার দোতলার বারান্দায় চা খেতে খেতে সামনে অকূল সমুদ্রে সূর্য্যাস্ত দেখে মোহিত হবার স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনি। ঝাউবনের ছায়ায় চাদর পেতে বন্ধুদের সাথে হাসি গান আর আড্ডাও ভোলার নয়। সৈকতাবাস নামে একটা সস্তা কিন্তু পরিস্কার সরকারী হোটেল ছিল সেখানে এক বা দুই রাত কাটিয়ে আবার সাইকেলে চেপে খড়্গপুরে হোস্টেলে ফিরে যেতাম।
সেই দীঘা আর নেই। ষাট বছরে অনেক পরিবর্ত্তন হয়েছে। এখন রাস্তাঘাট দোকান পাট অনেক বাড়ী চারিদিকে। অনেক পর্য্যটকের ভীড়। সমুদ্র সৈকতে থিকথিক করছে ভীড়, গাড়ী পার্ক করার জায়গা পেতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ফেরার পথে শঙ্করপুর সমুদ্রসৈকত অবশ্য জনবহুল নয়।
পথে অনেক চিংড়ী মাছ আর কাঁকড়ার আড়ত চোখে পড়লো। কলকাতা ফেরার পথে একটা এইরকম একটা আড়তে নেমে সবাই বাড়ীর জন্যে কেজি দুই মাছ কিনে নিলাম।





