
১) শ্রীলঙ্কা – প্রথম দর্শন
আমরা কুয়েতের বন্ধুরা শ্রীলঙ্কা বেড়াতে এসেছি। কুয়েত থেকে রাতের ফ্লাইট ধরে ভোর চারটে তে আমরা কলম্বো তে land করলাম। কলম্বো এয়ারপোর্ট টা বেশ ভালই লাগল, অত ভোরে ভীড় ও কম, ভিসা আগে থেকেই করা ছিল, তাই ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসতে বেশী সময় লাগলোনা আমাদের কারুর। সবাই এক এক করে বেরিয়ে এসে একটা বিরাট হলঘরে জড়ো হলাম, সেখানে আমাদের জন্যে একটা বোর্ড হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট Jet Wing Travel থেকে আসা একটি যুবক। বোর্ডে লেখা “Mr. Prodosh Mitra and Party”!
ছেলেটির নাম সুভাষ। বেশ চেনা বাঙালী নাম। তবে সে অবশ্য তামিল। এই ট্রিপে সে আমাদের গাইড। সুভাষ কে আমাদের বেশ ভাল লেগে গেল, সে বেশ প্রিয়দর্শন এবং আলাপী , তার কথাবার্ত্তা বেশ ভদ্র। অত সকালেও এয়ারপোর্টে দোকানপাট সব খোলা, ওখানকার স্থানীয় টাকা তোলা, টেলিফোনের সিম কার্ড কেনা ইত্যাদি নানা কাজে প্রথম থেকেই সুভাষ এই সব নানা কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো।
তারপর বাইরে গিয়ে বাসে ওঠা। বেশ বড় বাস। আমরা যে যার মতো যে যেখানে পারি সীট নিয়ে বসে পড়লাম।
আজ আমরা ক্যান্ডি যাবো। সারা রাত প্লেনে ঘুম হয়নি, চোখ জ্বালা করছে, সুভাষ বললো তোমাদের কাছেই নিগম্বো নামে একটা শহরে আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে তোমরা স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। তারপর আমরা ক্যান্ডি রওনা হব।
বাসের জানলা দিয়ে ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম, কলম্বো শহর ছাড়িয়ে এসেছি, জায়গাটা বেশ লাগছে, পরিস্কার রাস্তা, পাশে সুন্দর ছিমছাম বাড়ি, প্রায় সব বাড়ীর সামনে গেটের পাশে বুগনভিলিয়ার ঝাড় লালে লাল হয়ে ফুটে আছে। দক্ষিণ ভারতের (কেরালা, তামিলনাডু) সাথে মিল আছে আমার মনে হলো, যেন আমরা মাদুরাই বা কোয়েমবাটোরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে সুভাষ একটা মাইক হাতে নিয়ে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা, তার দুই মেয়ে, তাদের মধ্যে একজনের আবার আজই জন্মদিন! মেয়ের জন্মদিনে সে থাকতে পারছেনা, আমরা সমবেদনা জানালাম।
তার পরে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস। সেই বুদ্ধদেবের সময় থেকে শুরু।
শুনতে শুনতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে রামায়ণের যুগের কথা ভাবছিলাম। ছোটবেলায় আমার রামায়ণের বইতে দুটো ছবির কথা আমার খুব মনে পড়ে। এক হলো হনুমান তার ল্যাজে আগুণ লাগিয়ে লঙ্কা শহরে এক বাড়ির ছাদ থেকে আর এক বাড়ির ছাদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর অন্য ছবিটা অশোকবনে সীতা, একটা গাছের তলায় বেদীতে বসে। তার চারিপাশে অনেক মহিলা, তারা সবাই মানুষের মতোই দেখতে, তাদের রাক্ষুসী বলে মনেই হয়না। একজন তো বেশ সুন্দরী, তিনি নিশ্চয় বিভীষণের বৌ সরমা।
এই অশোকবনটা কোথায়? সেখানে একবার গেলে হয় না?
আমাদের ছোটবেলায় Ceylon Radio খুব জনপ্রিয় ছিল, শ্রীলংকার নাম ছিল সিংহল।
আমাদের মধ্যে অমিতাভর ইতিহাস এর জ্ঞান সবচেয়ে বেশী, সে বলল সিংহল নামটা এসেছে বাংলার রাজা বিজয় সিংহের নাম থেকে। এই নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা আছে।
অমিতাভর প্রায় পুরো কবিতা টা মুখস্থ, সে গড়গড় করে আবৃত্তি শুরু করে দিলঃ
আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়/
সিংহল নামে রেখে গেল নিজ শৌর্য্যের পরিচয়/ ইত্যাদি।
এই সব হতে হতে আমরা নিগম্বো পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রের তীরে Jet Wing Group এর বিরাট হোটেল।
আমি তুতু কে বললাম বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে তার সাথে নিগম্বোর খুব মিল, বলো তো কি? আমাদের সকলের শরীরে ওই জিনিষটা আছে।
তুতু ঝঙ্কার দিয়ে উঠে আমায় এক ধমক দিয়ে বলে উঠলো জানি জানি, তোমাকে আর বলতে হবেনা।
এ কি রে? দিল্লীর মেয়ে হয়ে তুতু বাংলা এত ভাল জানলো কি করে?


২) মানবিক আর পাশবিক
নিগম্বোর হোটেল টা বেশ লাগলো আমাদের, স্নান টান সেরে রাতজাগার ক্লান্তি ধুয়ে ফেলে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে এলাম সবাই রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের বিরাট কাঁচের জানলা দিয়ে দেখা যায় পাশেই বিরাট সমুদ্রসৈকত, ধূ ধূ বালি, তার মধ্যে জেলেরা তাদের জাল শুকোচ্ছে, কিছু নৌকা ও সেই বালির মধ্যে দেখা গেল।
আজকে আমরা ক্যান্ডি যাবো । রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শহর।
ক্যান্ডি যাবার পথে অনেক গুলো স্টপ্ যার মধ্যে প্রথম হল পিনাওয়ালা হস্তী অনাথ আশ্রম (Elephant Orphanage), United Nations এর হেরিটেজ সাইট্, পৃথিবীর বৃহত্তম Elephant reserve, এবং পর্য্যটকদের জন্যে শ্রীলঙ্কার একটি অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান।
নিগম্বো থেকে পিনাওয়ালা খুব বেশী দূর নয়, ঘণ্টা দেড়েকের পথ। এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে, দু’দিকে সবুজ পাহাড়, মাঝে মাঝে পথের পাশে চালাঘর আর দোকান, কিছু হোর্ডিং ও চোখে পড়লো, তাতে শাড়ি আর গয়নার বিজ্ঞাপন, শ্রীলঙ্কার সুন্দরী মেয়েরা সেজেগুজে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের চোখে তাদের আহামরি কিছু সুন্দর লাগছেনা যদিও। মাহিলা জয়বর্ধন আর কুমার সঙ্গকারার কিছু ছবি ভেবেছিলাম দেখবো, কিন্তু না, আমাদের দেশের মত এখানে ক্রিকেটাররা মডেলিং এ আসেনি, তারা মন দিয়ে তাদের খেলাটাই খেলছে।
হাতি দের নিয়ে মানুষের মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে, তার প্রধান কারণ বোধহয় তাদের ওদের বিরাট শারীরিক আয়তন। পৃথিবীর অন্যান্য জীবজন্তুর সাথে তুলনা করলে হাতিদের কেমন যেন আলাদা বলে মনে হয়, অতবড় শরীর, লম্বা শুঁড়, তারা যেন সেই আদিম ডাইনোসরদের বংশধর, মানুষের বহু আগে থেকে তারা এই পৃথিবীতে বাস করছে। ফলে মানুষদের থেকে আরো লম্বা সময় ধরে তাদের বিবর্তন (evolution) হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।
আমাদের এই পৃথিবীতে মানুষের সাথে বসবাস করছে অসংখ্য জীব জন্তু, পতঙ্গ, পাখী, জলচর প্রাণী, মানুষের মতই তারাও লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পেরিয়ে এসেছে বিবর্তনের নানা ধাপ। আমরা সাধারণ মানুষেরা তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিনা, চিড়িয়াখানায় তাদের খাঁচায় বন্দী অবস্থায় অথবা জঙ্গল সাফারীতে জীপে চড়ে অভয়ারণ্যে প্রকৃতির কোলে তাদের নিজেদের স্বাধীন পরিবেশে দেখি। একই পৃথিবীতে মানুষের সাথে এদের বাস, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তাদের কোন ভূমিকা নেই।
আমরা সভ্য মানুষেরা আমাদের মন অনূভূতি আর মস্তিষ্ক আছে বলে গর্ব্ব করি, পৃথিবীর জীবজগত কে আমাদের সমকক্ষ বলে মনে করিনা। আমাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল যে আমরা হলাম বুদ্ধিমান আর মানবিক, আর ওরা হলো বুদ্ধিহীন, পাশবিক, হিংস্র। প্রকৃতি এবং বিবর্ত্তন ওদের আমাদের সমতুল্য করে তৈরী করেনি।
প্রানীবিজ্ঞানীরা কিন্তু আমাদের চারিপাশের জীবজগতের নানাবিধ কান্ডকারখানা দেখে একান্তভাবেই বিস্মিত এবং অভিভূত।
পরিযায়ী পাখিরা অথবা কিছু জাতের প্রজাপতি কি আশ্চর্য্য দক্ষতায় লক্ষ লক্ষ মাইল আকাশে পরিক্রমা করে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যায়। অলিভ রিডলি কচ্ছপেরা বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ডিম পেড়ে সমুদ্রে ফিরে যায়। ফুলেরা ঠিক এক সময়ে সকালে অথবা বিকেলে নিয়ম করে ফুটে ওঠে প্রজাপতিদের আকর্ষন করার জন্যে।
এসব কি করে হচ্ছে? এর থেকে কি প্রমাণ হয়না যে প্রাণীদের মধ্যেও মানুষের মতই সময় আর দিক নির্নয় করার ক্ষমতা আছে, নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব প্রকাশ ও বিনিময়ের একটা ভাষাও তাদের মত করে আছে?
বন্য প্রাণীদের নিয়ে জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানে এখন অনেক গবেষনা হচ্ছে, এবং নানা জায়গায় বিজ্ঞানীরা এই তথাকথিত “মনুষ্যেতর” প্রাণীদের মধ্যে এক অদ্ভুত ও সূক্ষ্ম “মানবিক” ব্যবহার দেখতে পাচ্ছেন। অনেক জীবের মধ্যেই তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন ভালবাসা, মাতৃপ্রেম, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা, পরোপকার এমনকি আত্মদান, যা আমরা আমাদের নিজেদের একচেটিয়া বলেই এতদিন ভেবে এসেছি।
পাশবিক কথাটা এসেছে পশু থেকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাশবিকতা ক্রুরতা হিংসা ইত্যাদি নানা বিশ্রী দোষ পশুদের তুলনায় মানুষের মধ্যে অনেক বেশী।


হাতিদের নিয়ে ও অনেক গবেষনা হয়ে চলেছে।
বিজ্ঞানীদের মতে হাতি একটি অতি মহান, বুদ্ধিমান এবং সামাজিক প্রাণী। অতবড় শরীর সত্ত্বেও তারা প্রচন্ড agile, উঁচু পাহাড়ে তারা দরকার পড়লে তরতর করে উঠে যেতে পারে। তাদের ওই দুলকি চালে হাঁটা দেখে মনে হয় তারা বেশ নিরীহ প্রাণী। সহজেই তাদের পোষ মানানো যায়। আমাদের ছোটবেলায় কলকাতা চিড়িয়াখানায় হাতির পিঠে চড়া হতো। একটা কনক্রীটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে একটা প্ল্যাটফর্মে উঠে আমরা ছোটরা হাতির পিঠে উঠে সারা চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াতাম। এখন বোধ হয় হাতির পিঠে চড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
জয়পুরে অম্বর প্যালেসেও হাতির পিঠে চড়ে ওপরে ওঠার আর নীচে নামার বন্দোবস্ত আছে। সেখানেও ভয় করেনি, বরং দুলুনী টা বেশ ভাল ই লেগেছে। দক্ষিণ ভারতে – কেরালা বা তামিলনাডূতে তো মন্দিরে, পথে ঘাটে অনেক পোষমানা হাতি চোখে পড়ে। আমাদের দেশে সার্কাসে ও অনেক হাতির খেলা দেখেছি। ব্যাঙ্ককে একবার হাতিদের ফুটবল খেলতে দেখেছিলাম।
কিন্তু বন্য হাতি দের একটু ভয় পেতেই হয়, এমনিতে শান্ত হলে কি হবে তারা হঠাৎ কোন কারণে একবার রেগে গেলে খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন তারা মানুষকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলে, শুঁড় দিয়ে তুলে মাটিতে আছাড় মারে। “মদমত্ত হস্তী” কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। মদ ঠিক রাগ নয় যদিও, মদ হলো ক্ষমতার অহঙ্কার, তবু একটা রিপুই তো। সব প্রাণীদের মত হাতিরাও রিপুর শিকার। বাংলার পুরুলিয়া বাঁকুড়া জেলা আর ঝাড়খণ্ড ওডিশার বর্ডারে দলমা বলে একটা জায়গায় জঙ্গল থেকে অনেক হাতি মাঝে মাঝে লোকালয়ে চলে আসে। তখন মানুষের সাথে তাদের নানা ভাবে সংঘাত শুরু হয়, শস্যের ক্ষেত লন্ডভন্ড করে তারা চলে যায়, রেল লাইনে কাটা পড়ে মারা যায় কিছু হাতি। খবরের কাগজে সেই ছবি দেখি।
আমাদের বাংলার হাতি বিশারদ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী আমাদের দেশের হাতিদের নিয়ে বিশদে গবেষনা করেছেন। তাঁঢ় লেখা গবেষনা পত্র ও বইতে তিনি হাতিদের স্বভাব, জীবনযাত্রা, এবং ব্যবহার সম্পর্কে এমন সব অনেক অজানা তথ্য জানিয়েছেন, যা অবাক করার মত।
তাঁর লেখা পড়ে জানা যায় যে হাতিদের মনে এমন একটা সহানুভূতি আর কোমল দিক আছে, যা কেবল মাত্র মানুষদের সাথে তুলনীয় বলে অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সম্প্রতি একটি লেখা পড়ে জানলাম যে প্লেনে করে হাতিদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাবার সময় তাদের মাঝখানে নাকি অনেক মুরগীর ছানা রেখে দেওয়া হয়।
কেন?
কারণ হাতিরা নাকি যাতে তাদের ভারী পায়ের চাপে সেই সব মুরগীর ছানারা চাপা পড়ে মারা না যায়, সেই ভয়ে সারাটা সময় তারা নাকি একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ও নড়াচড়া করেনা। যার ফলে প্লেন আকাশে উঠলেও কোন কাঁপন বা ঝাঁকুনী অনুভূত হয়না।
ছোট ছোট মুরগী ছানাদের প্রতি হাতিদের এই আচরণ মানবিক ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?
বিজ্ঞানীরা হাতির ব্রেণে এমন সব নিউরন পেয়েছেন, যা কিনা মানূষের ব্রেণের নিউরণের সমতুল্য।
Fascinated by their noble nature, scientists have studied the elephant’s brain and discovered spindle cells—rare neurons also found in humans. These are associated with self-awareness, empathy, and complex social perception.
In other words, an elephant is not only physically huge; it’s an emotional giant, too। It feels, understands, and acts with a silent wisdom.
কিন্তু হাতিদের নিয়ে যে কথাটা আমাদের সবাইকে বিস্নিত করে, তা হলো এই যে যখন হাতিরা বুঝতে পারে যে তাদের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তখন তারা দল ছেড়ে বিজন কোন জায়গায় চলে যায়, যেখানে তারা একাকী মৃত্যুবরণ করে।
কেন?
বিজ্ঞানীরা বলেন যাতে ছোটরা তাদের মৃত্যু দেখে কষ্ট না পায়।
তাদের মনে এত সমবেদনা, এত সহমর্ম্মিতা? এ তো আমাদের মানুষদের মতোই, কিংবা হয়তো আরো বেশী।
মানুষ এবং জীবজগতে অন্যান্য অনেক প্রাণীর মত হাতিরাও সমাজবদ্ধ জীব, তারা দলবদ্ধ হয়ে থাকে, এবং যেখানেই যায় দলপতিকে অনুসরণ করে যায়। আমি কেনিয়ার তৃণভূমি (সাভানা) আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে দলবদ্ধ হাতির গজেন্দ্রগমন প্রত্যক্ষ করেছি। সে এক অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য।


৩) পিনাওয়ালা হস্তী অনাথাশ্রম – হাতিদের স্নান
আমাদের বাস পিনাওয়ালা তে এসে দাঁড়ালো।
১৯৭৮ সালে পাঁচটি অনাথ (orphan) বাচ্চা হাতি কে নিয়ে পিনাওয়ালার এই অনাথ আশ্রমের কাহিনীর শুরু, এখন হাতিদের সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আশি। প্রতি বছর এখান থেকে কিছু হাতি মন্দির বা চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় পঞ্চাশ জন মাহুত ওই হাতিদের দেখাশোনা করে।
শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে এক সময় তিন হাজারের ও বেশী হাতি ছিল, প্রধানতঃ Poaching এর জন্যে তা ক্রমশঃ কমতে থাকে। অনাথ শিশু হাতিদের দেখভাল করা তো বটেই, তা ছাড়াও এই Orphanage তৈরী করার পিছনে একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাতিদের বংশরক্ষা, প্রতিপালন আর বংশবৃদ্ধি (conservation আর breeding), সেই উদ্দেশ্য এখন স্পষ্টতই সফল।
ধৃতিকান্ত লাহিড়ী মশায় লিখেছেন একটি বাচ্চা হাতি নাকি কোনভাবে একবার দলছুট হয়ে লোকালয়ে এসে গিয়েছিল, তাকে গ্রামবাসীরা বিপন্ন অবস্থায় দেখে দুধ টুধ খাইয়ে আবার তাকে দলের কাছে ফিরিয়ে দিতে গিয়েছিল, কিন্তু সেই দলে তাকে আর ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। তার গায়ে নাকি মানুষের গন্ধ লেগে গিয়েছিল!
এই খবরটা পড়ে সেই শিশু হাতিটির জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল মনে আছে, আর তার মা’র জন্যেও। হাতিদের যূতবদ্ধ দলীয় বা পারিবারিক জীবনে নানা অলিখিত নিয়ম আছে, যা পরিবারের বা দলের সবাই কে মেনে চলতে হয়। ওই মা’কেও তাই সেই নিয়ম মেনে তার শিশুটিকে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।আহা রে!
বেচারা!
পিনাওয়ালার শুরুটাই অনাথ শিশু হাতিদের নিয়ে, তাদের সবার গায়েই মানুষের গন্ধ লেগে গেছে, তারা আর কোন দিন বনে ফিরে যেতে পারবেনা।
চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট গ্রাম পিনাওয়ালা, সেই গ্রামে দশ hectare মত জায়গা নিয়ে একটা নারকেলের plantation, তার ভেতরে গড়ে উঠেছে এই বিখ্যাত হস্তী অনাথআলয়।
মেন বাস রাস্তা থেকে দেখলাম একটা গলি ঢুকে গেছে ভেতরে, সেখানে সারি সারি দোকান, টুরিস্ট দের ভীড়, ফেরিওয়ালা রা “এটা নেবেন স্যার, ওটা নেবেন স্যার” বলে চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে। সুভাষ বলল ওই গলি দিয়ে একশো মিটার মত এগোলেই Maha Oya, ওয়া নদী, সেখানে রোজ সকালে বিকেলে হাতির দল কে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাস্তা ক্রস করে দল বেঁধে আমরা গলিতে ঢুকে পড়লাম। দু’পাশে দোকান, তাতে প্রায় সব জিনিষেই হাতির মোটিফ আঁকা। সে শাড়ি হোক কি গয়না, কি ঘর সাজাবার জিনিষ। হস্তীশিল্প যাকে বলে।
হাতির dropping (বাংলায় হাগু) শুকিয়ে chemically treat করে তাই দিয়েও নানা জিনিষ তৈরী করে বিক্রী করছে লোকে। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি একটা বাচ্চা হাতির ছবি, সে একটা কমোডের ওপর বসে পটি করছে। নন্দাকে সেই সাইনবোর্ড টা দেখাতেই সে “উঁ হুঁ! ইন্দ্রজিৎ!”, বলে নাকে শাড়ির আঁচল দিয়ে Vibration mode এ চলে গেল। নন্দার একটু শুচিবাই আছে, নোংরা কিছু দেখলে বা শুনলে গা ঘিনঘিন করে, সে তখন Vibration mode এ চলে যায়, সেটা দেখার জন্যে আমরা প্রায়ই মজা করে তার সামনে নানা গা ঘিনঘিন করা কথা বলি।
গলির শেষে এসে দেখি বেশ খোলা একটা জায়গা, পাথরের টিলার মধ্যে দিয়ে ওয়া নদী বয়ে যাচ্ছে, জল বেশী গভীর নয়, এক পাল হাতি সেই ওয়া নদীর জলে গা ডুবিয়ে স্নান করছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
হাতিদের সম্বন্ধে ইউরোপের রেনেসাঁস যুগের বিখ্যাত শিল্পী বিজ্ঞানী ও দার্শনিক লিওনার্ডো দা ভিঞ্চি এর স্মরনীয় উক্তি ছিলঃ
The elephant embodies righteousness, reason, and temperance. The elephant enters the river and bathes with a certain dignity, as if wishing to purify itself from all evil.
লিওনার্ডো বর্ণিত হাতিদের সেই পুণ্য স্নান আমরা দু’চোখ ভরে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে। বিশেষ করে ভাল লাগলো বেশ কিছু শিশু হাতিকে দেখে। তারা তাদের মা’দের পিছনে কিছুটা মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছোট শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে আরাম করে স্নান করছে।
চারিদিকে বিদেশী ট্যুরিস্টদের দের ভীড়, ক্যামেরার অবিশ্রান্ত ক্লিক ক্লিক আওয়াজ!


আধঘণ্টা মত থাকার পরে হঠাৎ মাইকে ঘোষনা করে সবাইকে জানানো হলো, এবার স্নান শেষ , রাস্তা দিয়ে হাতিদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তাই রাস্তা খালি করুন। ওদের পথ ছেড়ে দিন।
সরু গলি, দু’পাশে দোকান আর মানুষজন, তার মধ্যে দিয়ে লাইন বেঁধে ওই বিশাল হাতিরা হেলতে দুলতে মাহুত দের পিছনে বাধ্য ছেলের মত ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, কোন বিশৃঙ্খলা নেই, কোন হুড়োহুড়ি নেই, কেমন যেন একটা অবিশ্বাস্য surreal দৃশ্য বলে আমার মনে হলো।
স্বপ্নের মত অনেকটা।
মেন রাস্তা ক্রস করে হাতির দল রাস্তার ওপাশে নারকেল গাছের বনে ঢুকে গেল, সেখানেই ওদের আস্তানা বোধ হয়, আমরা তাদের পিছন পিছন বেরিয়ে এসে আমাদের বাসে ওঠার আগে পাশে একটা দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটা করে শেষে জমিয়ে ডাবের জল খেলাম ঢকঢক করে।

