
পূর্ব্বকথা
আমরা স্কুলের তিন বন্ধু অমিতাভ, দীপঙ্কর আর আমি গোপালপুর বেড়াতে যাচ্ছি।
অনেক আলোচনার পরে গোপালপুর যাওয়া ঠিক হয়েছে।। কাছেই পুরী আর দীঘা আছে, কিন্তু দুটোই চেনা এবং বড্ড ভীড়। গোপালপুরে ওবেরয় দের পাম বীচ রিসর্ট হোটেলটা বেশ upmarket, এখন অবশ্য মেফেয়ার নামে একটা চেন সেটা কিনে নিয়ে renovate করে অনেক বাড়িয়েছে, সেখানে সমুদ্রতট ও শুনেছি খুব চওড়া আর পরিস্কার আর ভীড়ও কম।
আমি কখনো সেখানে যাইনি, কিন্তু ছোটবেলায় সুভদ্রা মা বাবার সাথে গেছে একবার। আমরা দু’জনেই গোপালপুরে যেতে রাজী। অমিতাভ সুজাতারা বিয়ের পরে ১৯৭২ সালে সেখানে হানিমুন করতে গিয়েছিল। সেখানে অনেক বছর পরে গিয়ে আর একবার সেই পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরে পাবার জন্যে তারাও যেতে রাজী। আর দীপঙ্কর সেখানে একসময় Institute of Chartered Accountant (East India Chapter) এর সেক্রেটারী পোস্টের ইলেকশনে জেতার জন্যে উড়িষ্যা চষে খেয়েছে, জায়গাটা তাই এখনো তার হাতের পাতার মত চেনা। সেও রাজী।
ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে নির্জ্জন এক সমুদ্রের বেলাতটে কিছুদিন একসাথে কাটানোটাই আসল উদ্দেশ্য। আমাদের তিনজনের অনেকদিনের বন্ধুত্ব, আমরা তিন জনেই সারা পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু একসাথে আমাদের বেড়ানো এই প্রথম।
গোপালপুরে হাওড়া থেকে ট্রেণে করে বেরহমপুর স্টেশনে ভোরবেলা নেমে গাড়ী করে হোটেলে যাওয়া যায়। সেখান থেকে গোপালপুর বেশী দূর নয়। কম বয়েসে দীপঙ্কর আর অমিতাভ ট্রেণেই গোপালপুর গেছে, হোটেল থেকে স্টেশনে গাড়ীও পাঠিয়ে দেবে বললে। তবে এই বয়সে ট্রেণের থেকে প্লেনে যাওয়া টাই আমাদের কাছে বেশী সুবিধের মনে হলো। আজকাল প্লেনের টিকিট আর ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস স্লীপারের ভাড়া প্রায় একই। তাই খরচও তেমন কিছু বেশী নয়। দমদম থেকে সকালের প্লেনে ভুবনেশ্বর পৌঁছে সেখান থেকে বড় একটা গাড়ী ভাড়া করে গোপালপুরে হোটেলে পৌঁছনোটাই শেষ পর্য্যন্ত ঠিক হলো।
ভুবনেশ্বর থেকে গোপালপুর ১৭০ কিলোমিটার, গাড়ীতে যেতে প্রায় চার ঘন্টা লাগবে, সেটাই একমাত্র downside। রাস্তা (ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৬) অবশ্য খুব ভাল, দীপঙ্কর জানালো।
ঠিক হলো আমরা বেরোব ২২শে আগস্ট, ফিরবো ২৬শে আগস্ট, ২০২২। হোটেলে চার রাতের রিসার্ভেশন করলো অমিতাভ। দীপঙ্কর কাটলো প্লেনের টিকিট। সুভদ্রা ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট থেকে গোপালপুর মেফেয়ার পাম বীচ হোটেল পর্য্যন্ত যাবার গাড়ীর বন্দোবস্ত করে ফেললো।
আজকাল এসব কাজ করা যায় বাড়ীতে বসে একটা মোবাইল ফোন থেকে। টেকনোলজী কা কেয়া খেল্ হ্যায়!




প্রথম দিন ২২শে আগস্ট, ২০২২
১) আমাদের যাত্রা হলো শুরু
২২/৮/২২ সকালে দমদম এয়ারপোর্টে চেক ইন করে পাঁচজনে গিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসে গল্প করছি। দীপঙ্কর খোঁজ নিয়ে এসে জানালো যে আমাদের প্লেন এখনো এসে পৌঁছয়নি। তাই প্লেন ছাড়ার এখনো বেশ দেরী। আমি আর অমিতাভ এর মধ্যে একটু কফি খেয়ে এলাম। কোথাও বেড়াতে যাবার আগে এই সময়টা আমার বেশ লাগে, সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে একটা অষ্পষ্ট ভাল লাগা, উত্তেজনা।
ইতিমধ্যে দীপঙ্করের বাড়ী থেকে একটা ফোন এলো। দীপঙ্কর দেখলাম ফোনটা পেয়ে বেশ একটু রেগে গিয়ে বলছে, “কি? কেক আর ফুল রেখে গেছে? কে? কি নাম?” তার একটু পরে শুনলাম বলছে, “ঠিক আছে কেকটা তোমরা খেয়ে নাও আর ফুলগুলো সব ফেলে দাও~”
বাড়ীর কাজের লোকের ফোন, যা বোঝা গেল। কেউ একজন দীপঙ্করকে কেক আর ফুল পাঠিয়েছে। কিন্তু এতে রেগে যাবার কি আছে? সুজাতা বললো “বুঝলেনা, এক নাছোড়বান্দা মহিলা…”
আমি বললাম “তা তো বুঝলাম, কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে আজ দীপঙ্করের জন্মদিন নাকি? তাহলে তো হোটেলে গিয়ে সেলিব্রেট করতে হবে!”
দীপঙ্কর সজোরে প্রতিবাদ করে বললো “আরে ভাই, না না, আজ আমার জন্মদিন নয়।” দীপঙ্করের প্রায় সব কথাই “আরে ভাই” দিয়ে শুরু হয়।
অমিতাভ বললো “কাল দীপঙ্করের জন্মদিন, আমরা হোটেলে কাল সেলিব্রেট করবো!”
বেশ বেশ, বেড়ানো এবং জন্মদিন – একসাথে দুই মজা।
মাত্র দেড় ঘন্টার প্লেন জার্নি ভালোই হলো, কিছু বোঝার আগেই নির্ঝঞ্ঝাটে সময় মত ভুবনেশ্বর পৌঁছে গেলাম। দীপঙ্করের সেক্রেটারী খাবারের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, স্যান্ডুইচ আর Mango juice, তা ছাড়াও আমাদের সাথে কিছু কেক বিস্কুট ইত্যাদি ছিল। সেগুলোর ও সদব্যবহার হলো।
গাড়ী এসে গেল ফোন করতেই। মালপত্র তুলে বেরিয়ে পড়লাম।
ভুবনেশ্বর শহরটা বেশ লাগছিল গাড়ীর জানলার বাইরে, ছিমছাম সবুজ, low skyline, পরিস্কার চওড়া রাস্তা ঘাট, আর একবার শহরের বাইরে আসার পরে রাস্তার দুই পাশে একের পর এক স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়, বেশীর ভাগই বেসরকারী মনে হলো। দীপঙ্কর বললো উড়িষ্যা হলো দেশের মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে। দেশের নানা প্রদেশ থেকে ছেলে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে।
গাড়ীর ভেতরে যেতে যেতে নানা গল্প হচ্ছে, বেশীর ভাগ গল্প দীপঙ্করের। সে কম বয়সে এখানে এসে Institute of Chartered Accountants এর সেক্রেটারী হবার ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পেন করতে এসে প্রায় সব নামকরা Chartered Accountancy firm এর পার্টনার দের সাথে দেখা করেছিল, পরে সে নির্ব্বাচনে জিতে ICA Eastern Chapter এর সেক্রেটারী হবার পরে সেই যোগাযোগ আরো গাঢ় হয়, এবং এদের অনেকের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়। তার নিজের ব্যবসার জন্যেও এই যোগাযোগ এবং বন্ধুত্ব খুব জরুরী।
এই সব কারণে উড়িষ্যার এই দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের সাথে তার পরিচয় খুব গভীর।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অডিটর যিনি কিনা উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের ব্যক্তিগত কাজ দেখেন, তিনি হলেন দীপঙ্করের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি নাকি প্রতি বছর তাকে নিজের বাগানের প্রচুর আম পাঠান। গাড়ীতে যেতে যেতে দীপঙ্কর সেই ভদ্রলোককে ফোন করে জানিয়ে রাখলো সে গোপালপুর যাচ্ছে এবং রাত্রে হোটেল থেকে ফোন করে কথা বলবে।
এরকম জনসংযোগ না থাকলে ব্যবসা বাড়ানো যায়না। দীপঙ্করের চার্টার্ড একাউন্টেসী ফার্মের ব্যবসা হু হু করে বেড়ে চলেছে।
কিছুদূর পরে একটা ছোট জনপদ পড়লো রাস্তার দুই পাশে অনেক ভীড় জটলা, কিছু দোকান। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা “কুনা কাফে।”
সুভদ্রা বললো কি অদ্ভুত নাম, কুনা কাফে।
দীপঙ্কর খুব গম্ভীর মুখ করে বলল “কুনা কাফে মানে কি জানো তো? এই কাফে টা হলো ঘরকুনো লোকেদের বাড়ীর বাইরে একমাত্র কফি খাবার জায়গা।”
সুজাতা একটু হেসে প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতে বললো, “দীপঙ্করের যত সব বাজে কথা!”
এই রকম ভাবে দীপঙ্করের গল্প আর অনর্গল ফাজলামি ভরা কথা শুনতে শুনতে আমরা যখন গোপালপুর পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে।
মেফেয়ার পাম বীচ হোটেলটা বেশ ঝাঁ চকচকে। ঢুকেই বিশাল লাউঞ্জ। এই পাঁচতারা হোটেলটা প্রথমে ওবেরয়দের ছিল। দেশের মধ্যে Premier Deluxe luxury resort হিসেবে গোপালপুরের ওবেরয় পাম বীচ হোটেলের খুব সুনাম ছিল। মেফেয়ার গ্রুপ তাদের কাছ থেকে প্রপার্টিটা কিনে নিয়ে এখন অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে শুনেছি। তাছাড়া আগে একতলা ছিল, এখন দোতলা হয়েছে।
যাই হোক, হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে আমাদের ঘরের চাবি আর মালপত্র ঘরে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করে ঘরে যাবার পথে দীপঙ্কর রিসেপশনের ছেলেটাকে একটু হেসে বলে গেল, “আমাদের ভালো ভাবে দেখাশোনা কোরো কিন্তু, নাহলে দিলীপের কাছে খবর চলে যাবে!”
দিলীপ রায় হলো মেফেয়ারের মালিক, আর দীপঙ্করের বন্ধু।




২ আড্ডা আর ডিনার
হোটেলটা 5 Star Deluxe, তাই বেশ সাজানো গোছানো ঝকঝকে। দামী কার্পেটে ঢাকা মেঝে। আমাদের তিনটে ঘর দোতলায়। আমাদের আর অমিতাভদের ঘর পাশাপাশি, দীপঙ্করের ঘর সামান্য একটু দূরে। বেশ বড় ঘর, উঁচু সিলিং। ঘরের পাশে একটা লম্বা ব্যালকনি, সেখানে চেয়ার টেবিল সাজানো, বড় কাঁচের জানলা দিয়ে দূরে সমুদ্র দেখা যায়, কিন্তু এখন অন্ধকার, কাল সকালে সেখানে চা নিয়ে বসে গল্প করা যাবে। দীপঙ্করের ঘরে ব্যালকনি নেই। ওর বুকিং একজনের জন্যে, তাই বোধ হ্য় ব্যালকনি ছাড়া ঘর।
মালপত্র রেখে হাত পা মুখ ধুয়ে আমরা দীপঙ্করের ঘরে গিয়ে বসলাম। ডিনারে যাবার আগে দীপঙ্করের আনা দামী হুইস্কির সাথে একটু আড্ডা হোক। সাথে অনেক চানাচুর আর বাদাম ও আনা হয়েছে।
দীপঙ্কর তিনটে খুব নামী দামী, স্কচ হুইস্কির বোতল এনেছে, যদিও আমি কোনটারই নাম শুনিনি, কিন্তু গলায় ঢেলেই বুঝতে পারছি এর জাত আলাদা, এই তরলে গলা জ্বলেনা, একটা ঝিমঝিমে নেশা হয়। অভ্যাস মত সাথে কচর মচর করে হুইস্কির সাথে চানাচুর আর বাদাম খাচ্ছি হঠাৎ দীপঙ্কর বললো, “ইন্দ্রজিৎ, এই মালের সাথে কোন কিছু খাওয়ার নিয়ম নেই ভাই, শুধু না গলায় ঢাললে এর স্বাদ বুঝবেনা।”
সুভদ্রা বলল “দ্যাখোনা ইন্দ্রজিৎ তো সাথে বিস্কুট না থাকলে চা খায়না। যেন বিস্কুট খাবার জন্যেই ও চা খায় মনে হয়। আর যে কোন ড্রিঙ্কের সাথে ওকে বাদাম চিপস বা মাছের চপ দিতেই হবে।” আমার নামে কিছু বলার সুযোগ পেলে সুভদ্রা ছাড়েনা।
চানাচুর আর বাদাম বাদ দিয়ে শুধু দীপঙ্করের দামী হুইস্কি খেতে কিন্তু বেশ ভাল লাগলো, অস্বীকার করবোনা।
আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। এর মধ্যে দীপঙ্করের সেই বন্ধু ফোন করে খবরাখবর নিলেন। আমাদের বেড়াবার কি প্ল্যান ওনাকে জানালে উনি সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। বালুগাঁও এর মাছের বাজার অথবা চিল্কা হ্রদে নৌকাবিহার, কাছাকাছি সব দর্শনীয় স্থানেই তাঁর অনেক চেনশোনা। চিল্কায় পান্থনিবাস হোটেলে আমাদের লাঞ্চের ব্যাপারটাও উনি দেখে দেবেন বললেন। দীপঙ্কর ওনাকে কাল ফোন করে আমাদের বেড়াবার প্ল্যান জানাবে ঠিক হলো।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে দীপঙ্করের গভীর জ্ঞান, তাই আমাদের আলোচনায় রাগ রাগিনী খেয়াল ধ্রুপদ কিংবদন্তী শিল্পী আর তাঁদের ঘরানা এসে গেল। বিসমিল্লা খান কিরকম অল্প বয়সে বেনারসে কাকা অসুস্থ হলে অষ্টপ্রহর বাঁশী বাজিয়েছিলেন, আল্লারাখা রবিশঙ্কর কে এক ফাংশনে কানে কানে বলেছিলেন “বেটা আউর শাদী মত্ কর্”, কোন এক দুঃস্থ কিশোর খুঁজে খুঁজে অনেক দূরের কোন শহরে গিয়ে শেষ পর্য্যন্ত তার গুরুকে খুঁজে পেয়ে পরে এক বিখ্যাত শিল্পী হয়েছিলেন, এই সব অনেক গল্প আমরা শুনলাম দীপঙ্করের কাছে।
রাগ রাগিনী নিয়েও দীপঙ্করের পান্ডিত্য অসাধারণ, তার কাছে কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিশাল কালেকশন তার বাড়ীতে প্রায়ই সঙ্গীতের আসর বসে, সেই আসরে কলকাতার অনেক সঙ্গীত রসিক ও বোদ্ধারা এসে মাঝে মাঝে যোগ দেন।
দীপঙ্করের কাছ থেকে জানলাম ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুণ), মরুৎ (বাতাস) আর ব্যোম (আকাশ) এই পাঁচ টি প্রাকৃতিক element নিয়ে মহাদেব পাঁচটি রাগ তৈরী করার পরে পার্ব্বতী চেয়েছিলেন পাঁচটি একসাথে মিশিয়ে একটি রাগ যেন মহাদেব তৈরী করেন। মহাদেব নাকি পার্ব্বতীকে বলেছিলেন এই কাজটা তুমি করো পারু।
আমি দীপঙ্কর কে বললাম মহাদেব পার্ব্বতী কে পারু বলে ডাকতেন নাকি? দীপঙ্কর বলল “হ্যাঁ, সেজন্যেই তো শরৎচন্দ্র দেবদাস কে দিয়ে পার্ব্বতীকে ওই নামে ডাকিয়েছেন।”
অমিতাভ বললো, “তো পারু কি রাগ কোন তৈরী করেছিলেন?”
দীপঙ্কর বলল “মালকোষ!”
সুভদ্রা্র ও রাগ রাগিণী নিয়ে কিছু ফান্ডা আছে, সে বললো পন্ডিত যশরাজ একবার দূর্গা পূজোয় কুয়েতে এসে রাগ দূর্গা শুনিয়েছিলেন, এত ভাল লেগেছিল, এখনো ভুলিনি।
দীপঙ্কর সুভদ্রাকে উড়িয়ে দিয়ে বললো “যশরাজ? দূর, ওই লোকটার তো পোটাটো ডিফেক্ট~”
সুজাতা সুভদ্রার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বললো “গান গাইবার সাথে পোটাটো ডিফেক্ট এর কি সম্পর্ক?”
সুভদ্রা আমার নামে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে বললো “ইন্দ্রজিৎ এর ও খুব পোটাটো ডিফেক্ট জানো তো, ওর পিছনে মেয়েদের লম্বা লাইন…”
সুজাতা বললো, “তাই নাকি ইন্দ্রজিৎ? এটা তো জানতামনা।”
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “সব গুণী লোকেদেরই পোটাটো ডিফেক্ট থাকে, যেমন রবীন্দ্রনাথ, পন্ডিত যশরাজ, আমি…”
এই সব কথা হচ্ছে এমন সময় রেস্টুরেন্ট থেকে ফোন এলো, স্যার আপনাদের ডিনার রেডি, চলে আসুন।
বিশাল বড় আলো ঝলমলে সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্ট। দরজার বাইরে সাদা দেয়ালে টাঙানো ইন্দিরা গান্ধী, জে আর ডি টাটা, এবং আরও নানা রথী মহারথীর ছবি, তাঁরা সবাই এই হোটেলে অতিথি হয়ে এসে থেকে গেছেন। উঁচু সিলিং, ঝকঝকে মার্বেলের মেঝে, ভারী দরজা, চারিদিকে বৈভবের ছাপ। ওবেরয় সাহেবের উত্তরাধিকার, বোঝা যায়। আমাদের দেশের হোটেলের ব্যবসায় তিনি এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ ছিলেন।
একটি মেয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে একটা বড় টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালো। তার নাম লোপামুদ্রা। মেয়েটি হাসিখুসী, ছোটখাটো গোলগাল চেহারা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা তার কাজ হলো সবার দেখাশোনা করা, সে হলো হোস্টেস। আমাদের সাথে তার বেশ আলাপ হয়ে গেল।
আমরা লোপামুদ্রা কে বললাম কাল আমাদের বন্ধুর জন্মদিন, আমরা একটা স্পেশাল কেক চাই, আর তাছাড়া তোমাদের এখানে একটা ছানাপোড়া বলে একটা মিষ্টি আছে, সেটা কাল আমাদের খাওয়াতে পারবে?
লোপামুদ্রা তখন ওদের শেফ কে নিয়ে সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। কাল দীপঙ্করের জন্মদিন পালন করা হবে একটা স্পেশাল ডিনার দিয়ে, তার মেনুও আমরা ঠিক করে দিলাম, সাথে কেক, ছানাপোড়া সব ওরা বন্দোবস্ত করবে। শেফ আমাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন তিনি নিজে কেক আর ছানাপোড়া তৈরীর দায়িত্ব নেবেন।
কেক এ দীপঙ্করের নাম লেখা হবে, আমি সেই নামের বানান লোপামুদ্রাকে একটা কাগজে লিখে দিলাম।
৩ ) দ্বিতীয় দিন – ২৩/৮/২২
দীপঙ্করের জন্মদিন আজ, সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাকে সবাই অভিনন্দন জানালাম। ব্রেকফাস্টের পর সেরে সবাই মিলে সমুদ্রের ধারে হোটেলের পিছনে একটা বড় বাগান, চারদিকে দেয়ালে ঘেরা, এক কোণে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট, পাশে কিছু টেবিল চেয়ার পাতা। শুনলাম প্রতিদিন বিকেলে সেখানে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া যায়, সাথে সিঙাড়া, ঝালমুড়ি। On the house..তা ছাড়া সাথে একটা গানের অনুষ্ঠান ও নাকি রোজ বিকেলে
হোটেলের বাইরে সমুদ্র, সেখানে যেতে গেলে একটা গেট দিয়ে যেতে হবে, সেখানে একজন লোক একটা খাতা খুলে বসে আছে, নাম ধাম রুম নম্বর ইত্যাদি লিখতে হবে, হোটেলের অতিথিরা বাইরে গেলে তাদের একটা রেকর্ড রাখা, হোটেলে ফেরার সময় আবার সেই খাতায় সই করতে হবে। কেউ যাতে হারিয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা। মানে হয়তো সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আর ফিরলোনা, হতেও তো পারে?
এই হোটেলের নিজের কোন সৈকত আছে বলে kiমনে হলোনা। নিজের নুলিয়াও নেই। তবে কয়েকজন নুলিয়া এসে আলাপ করলো। তারা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। অনেক করে বলা সত্ত্বেও আমরা টায়ার নিয়ে সমুদ্রে নামবোনা, তাই তারা বেশ আশাহত। নিজের মনেই তারা সমুদ্রের জলে নেমে কাঁকড়া ধরতে চলে গেল।
আমরা তিন জনেই আজ হাফ প্যান্ট পরে এসেছি। কমবয়েসে সমুদ্র অনেকবার দেখা, নুলিয়ার হাত ধরে সমুদ্রে ঢেউয়ের মোকাবিলাও করেছি অনেক। এই বয়সে এখন আর জলে নামার ইচ্ছে নেই। এখন শুধু সমুদ্রের শোভা দেখা আর নরম ভেজা বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটা।
একটা বিশাল ছাতা হোটেল থেকে দিয়ে গেছে, তার তলায় অনেক গুলো চেয়ার। আমরা সেখানে বসে বালিতে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম। তারপরে খালি পায়ে বালির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেলাম। হোটেল ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে একটা খুব পুরনো লাইটহাউস। লাল সাদা রং এর এই লাইটহাউসটি গোপালপুরের একটি দর্শনীয় স্থাপত্য, নানা জায়গায় এর ছবি দেখেছি।


তবে এক সময় এই লাইটহাউসটি জাহাজের নাবিকদের কাজে লাগলেও, আজ তার চারিদিকে ভাঙ্গাচোরা কিছু বাড়ী, অবক্ষয়ের চিহ্ন চারিদিকে। এত দামী একটা 5 star luxury resort এর ঠিক পাশে এই রকম একটা বিশ্রী পরিবেশ দেখে বেশ অবাকই লাগে। ওবেরয় রা অনায়াসে এখানে একটা চমৎকার বাগান বানিয়ে দিতে পারতেন। তার বদলে এখানে ভাঙাচোরা আর পোড়ো বাড়ী, ধুলো ময়লা ভরা রাস্তাঘাট, এত দামী একটা হোটেলের পাশে মোটেই মানানসই নয়।
অনেকটা হেঁটে ফিরে এসে দীপঙ্কর আর আমি গিয়ে সমুদ্রের ধারে বসলাম। ঢেউ এসে পায়ের কাছে ভেঙে আবার ফিরে যাচ্ছে, আমরা গল্প করে যাচ্ছি। দূরে পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ উঠছে একের পর এক, কিন্তু আমরা নিরাপদ দূরত্বে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। কূলে ঢেউ এসে ভেঙে আমাদের পা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু বড় ঢেউ বুক পর্য্যন্ত এসে ফিরে যাচ্ছে।
আমাদের দু’জনের বাড়ী কাছাকাছি ছিল বলে স্কুলে পড়তে দীপঙ্কর আর আমি একসাথে নানা গল্প করতে করতে হেঁটে বাড়ী ফিরতাম, তখন থেকেই দীপঙ্করের খুব সাহিত্যে নেশা। আমিও বইয়ের পোকা ছিলা, কিন্তু আমি পড়তাম বাংলা গল্প উপন্যাস, দীপঙ্করের নেশা ছিল ইংরেজী ভাষায় নানা দেশের লেখকদের লেখা non-fiction – নানা বিষয় নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। আমাদের দু’জনেরি বই পড়ার ব্যাপারে সেই অভ্যেস এখনো আছে। দীপঙ্কর আমায় আমাকে তার প্রিয় লেখক এবং তাদের কিছু অসাধারণ বই সম্বন্ধে বলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কিছু বই সে আমায় পড়াবেই। পরে সে একটা কাগজে তার প্রিয় কিছু লেখক ও তাদের কয়েকটা বইয়ের নাম ও লিখে দিয়েছিল। ওর ধারণা শুধু fiction পড়া, তাও আবার বাংলায়, মোটেই কাজের কথা নয়।


গল্প করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ গর্জ্জন করে এসে আমাদের মাথায় নাকে মুখে একরাশ নোনা জল ঢেলে দিয়ে গেল।
ভাবটা যেন, “কি রে, কিরকম দিলাম?”
সমুদ্রে এসে জলে একটু না ভিজলে কি করে হবে? কিন্তু মুস্কিল হলো সারা গায়ে মাথায় চুলে একরাশ বালি। ঘরে ফিরে স্নান করার সময় অনেকক্ষন লাগলো শরীর থেকে সব বালি সরাতে। প্যান্টের পকেটও ভারী, কেননা বালিতে ভর্ত্তি।
দুপুরে সুভদ্রা আর আমি হোটেলের বাইরে একটু হেঁটে একটা বাজারের মধ্যে স্বস্তি নামে একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম। উড়িষ্যায় দুটো হোটেলের বেশ নাম। এক হলো এই স্বস্তি আর একটা হলো পান্থনিবাস। স্বস্তি হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোক খুব আলাপী আর মিশুকে, তিনি আমাদের বললেন কাল আপনাদের বন্ধুদের নিয়ে আসুন না, আমি আপনাদের খয়রা মাছ খাওয়াবো।
খয়রা? সেটা আবার কি মাছ?
এদিকে আজ দীপঙ্কর অমিতাভ আর সুজাতা খেয়েছে পান্থনিবাসে। সেটাও হোটেলের বাইরে বাজারের মধ্যে। হাঁটাপথের দূরত্বে। কাল আমরা সবাই স্বস্তিতে যাবো ঠিক হলো খয়রা মাছ খেতে। লাঞ্চের পর একটু রেস্ট নিয়ে সূর্য্যাস্ত দেখতে বাইরে গিয়ে হোটেলের বাইরে ওই চায়ের দোকানে চা আর ঝালমুড়ি নিয়ে বসে আড্ডা হলো। কাল ঠিক হলো একটা গাড়ী নিয়ে আমরা একটু চিল্কা ঘুরে আসবো।
আজ রাত্রে আবার কালকের মত দীপঙ্করের ঘরে বিশুদ্ধ বিলিতি মাল সহকারে আড্ডা। আজ রাগ রাগিনী নয়, আজ ছেলেবেলার স্কুলের গল্প। দীপঙ্কর আর অমিতাভ দুজনেই হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিল। দীপঙ্কর চ্যাটার্জ্জি নামে আর একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছিল, আমাদের সাথে একই সালে সে বেচারা হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দেয়, কিন্তু আমাদের দীপঙ্করের মত অত ভালো রেজাল্ট তার হয়নি।
অনেক পরে দুই দীপঙ্করের দেখা এবং আলাপ হয়, এখন দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব। আলাপ হবার পর একদিন দ্বিতীয় দীপঙ্কর হেসে আমাদের দীপঙ্কর কে নাকি বলেছিলেন, “আপনার জন্যে মশাই ছোটবেলায় আমায় বাবার কাছে খুব মার খেতে হয়েছে!”
“আমার জন্যে?” দীপঙ্কর তো অবাক, “আমি আবার কি করলাম?”
দ্বিতীয় দীপঙ্কর বললেন, “আরে মশাই আপনি তো হায়ার সেকেন্ডারীতে সেকেন্ড হলেন, তার পর আপনার নাম খবরের কাগজে দেখে আমাদের যত আত্মীয়স্বজন, বাবার বন্ধুরা সবাই বাবাকে ফোন করে আর বলে “কি খুসী হয়েছি, আমাদের দীপু সেকেন্ড হয়েছে, কি গর্ব্ব হচ্ছে, কি আনন্দ…”
“আর প্রত্যেক বার ফোন নামিয়ে রেখে আমায় বাবার এক চড়। সেদিন অন্ততঃপক্ষে চল্লিশ পঞ্চাশটা চড় খেতে হয়েছিল মশাই আপনার জন্যে।”
হায়ার সেকেন্ডারী তে ভাল রেজাল্ট না হলে কি হবে, এই দ্বিতীয় দীপঙ্কর খুব সফল ব্যবসায়ী। তাঁর বাবার একটা চা বাগান ছিল আসামে, বাবার সেই ব্যবসা বাড়িয়ে আসামে ও ডুয়ার্সে তিনি এখন অন্ততঃ কুড়িটা চা বাগানের মালিক। দীপঙ্কর মাঝে মাঝেই গিয়ে বন্ধুর চা বাগানের গেস্ট হাউসে কিছুদিন কাটিয়ে আসে।ব্যবসার কাজে দুজনে এক সাথে পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরেও এসেছে বেশ কয়েক বার।
কাল চিল্কা যাবার জন্যে হোটেল থেকে একটা গাড়ীর বন্দোবস্ত করা হলো। আর দীপঙ্কর তার বন্ধু কে ফোন করে বলতেই তিনি সেখানকার পান্থনিবাসের ম্যানেজার কে আমাদের ওখানে দুপুরের খাওয়ার কথা বলে দেবেন বললেন।
আড্ডার মধ্যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার ডাক এলো। আজ দীপঙ্করের জন্মদিন বলে সে একটা লাল জামা পরে বেশ সাজগোজ করে এসেছে। আমাদের টেবিলটা এক কোনে সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। শেফ এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বিশাল কেক নিয়ে এলো।
এদিকে হয়েছে কি, রেস্টুরেন্টের অন্য কোণে আর একটা টেবিলে একটা বেশ বড় গ্রুপ বসে আছে, সেখানেও একজনের আজ জন্মদিন। দূর থেকে আমরা দেখলাম হোটেল এর ওয়েটাররা একটা বড় কেক নিয়ে এসে সেই টেবিলের সামনে খুব হ্যাপি বার্থডে বলে গান গাইছে। যে মেয়েটির আজ জন্মদিন, সে হাসিমুখে অনেকগুলো মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভালো। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী আর হাসিখুসী, রঙ্গীন টপ আর স্কার্টে তাকে বেশ মানিয়েছে, তার দুই ছোট ছেলে মেয়েও তাদের মা’কে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করছে দেখলাম। তাছাড়া টেবিলের অন্য পুরুষ ও মহিলারা সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
ইতিমধ্যে আমাদের টেবিলেও গান গাইতে গাইতে চলে এলো ওয়েটাররা, তাদের মধ্যে আছে হোটেলের শেফ আর জমকালো শাড়ী পরে চোখে গোল চশমা আমাদের লোপামুদ্রা।
দীপঙ্করের কেক কাটা হয়ে গেছে এমন সময় ওই টেবিল থেকে জন্মদিনের মহিলা এবং তার বর আমাদের টেবিলে এসে দীপঙ্কর কে শুভেচ্ছা জানাতে এলো। দীপঙ্করকেও পালটা শুভেচ্ছা জানাতে হবে, সে মেয়েটিকে হেসে বলল- “Two birthdays today, 75 and 25!”
মহিলার বর পাশ থেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে তার বর কে হাত তুলে থামিয়ে দীপঙ্করকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে গেল। তার মুখে জ্বলজ্বল করছিল একগাল হাসি। কোন পুরুষ, তা সে যতই বুড়ো হোক, তাকে দেখে পঁচিশ বছর বয়েস বললে তার তো খুসী হবারই কথা!
তারপরে তো আমাদের খাওয়া দাওয়া বেশ জমে গেল। পোলাও, মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারী, আর সবশেষে শেফের নিজের তৈরী ছানাপোড়া।
ঘরে ফেরার পথে আমি দীপঙ্কর কে বললাম “ওই ভদ্রমহিলার বয়েস তোমার পঁচিশ মনে হলো?” দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, সুন্দরী মেয়েদের বয়েস কখনো পঁচিশের থেকে বেশী হয় নাকি?”


তৃতীয় দিন – ২৪/৮/২২
৪) অলিভ রিডলি কচ্ছপ
আজ আমাদের চিল্কা হ্রদ যাবার দিন।
এখানে আসার আগে আমি গোপালপুর আর চিল্কা সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করে এসেছিলাম, এখানে কি কি দেখার জায়গা আছে ইত্যাদি। পর্য্যটক দের জন্যে চিল্কা হ্রদ অবশ্যই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। তার নানা কারণ আছে। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম কূলে ১১০০ স্কোয়ার কিমি বিস্তৃত এই চিল্কা হলো আমাদের দেশের সব চেয়ে বড় হ্রদ। সমুদ্রের সাথে এই হ্রদের যোগ থাকায় জোয়ারের সময় এই হ্রদে লোনা জল এসে যায়। কিন্তু বেশ কিছু নদী চিল্কায় এসে মেশায় একে fresh water লেকও বলা হয়। এই হ্রদে ইরাবতী শুশুক ছাড়া নানা জলচর প্রাণী বাস করে।
চিল্কার তীরে অনেক মাছের বাজার তাই, প্রধানতঃ এই তীর চিংড়ি আর কাঁকড়া কেনাবেচার জন্যে বিখ্যাত। শীতকালে এই হ্রদে অনেক পরিযায়ী পাখী চলে আসে। গুগল এ গিয়ে অনেক গোলাপী ফ্লামিঙ্গোর ছবি দেখলাম। এরা আসে উত্তরে সাইবেরিয়া বৈকাল হ্রদ এবং অন্যান্য নানা পাহাড়ী জায়গা থেকে।
আর একটা বিশেষ ব্যাপারের জন্যে চিল্কা বিখ্যাত। অলিভ রিডলি নামে এক জাতীয় সামুদ্রিক কাছিমরা দলে দলে ওড়িশার সমুদ্রকূলে এসে ডিম পাড়ে –এদের জল্পাই রং এর খোলসের সূত্রেই তাদের এই নাম। আকারে তারা ছোট, এবং তাদের ফ্লিপারের মত পা থাকে যা ডাঙায় বসবাসকারী কাছিম দের থেকে আলাদা। উড়িষ্যা ও ভারতের অন্য কিছু রাজ্যের উপকূলে তারা দলে দলে প্রজননের জন্যে আসে। এর নাম হলো মাস নেস্টিং যার প্রধান ঠিকানা হলো ওড়িশার কেন্দ্রপাড়া জেলার অন্তর্গত গহিরমাথা অঞ্চল।কিন্তু সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ, কেননা সেটি ভারত সরকারের সুরক্ষিত এলাকা।
কিন্তু গঞ্জাম ডিস্ট্রিক্টে রম্ভার কাছে রুশিকুল্য নদীর মোহনাও মাস নেস্টিং এর আর এক ঠিকানা, এবং পর্য্যটকদের কাছে তা এক প্রধান আকর্ষণ। জায়গাটা গোপালপুর থেকে খুব কাছে, কিন্তু আমরা আগস্টে এসেছি, মাস নেস্টিং এর সময়টা মোটামুটি হলো ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চের মাঝামাঝি। সুতরাং আমাদের দেখা কপালে নেই।
ডিসেম্বর মাসে ওড়িশা উপকূলে সমুদ্রের পরিস্কার জলে পুরুষ ও স্ত্রী কাছিমরা একত্রিত হয় মেটিং এর জন্যে। এর পর পুরুষ কাছিমরা ফিরে যায় তাদের বিচরণ স্থানে। স্ত্রী কাছিমরা অপেক্ষা করে, সঠিক আবহাওয়া আর উপযুক্ত পটভূমি পেলে তবেই এরা দলে দলে ডিম পাড়ার জন্যে পারে উঠে আসে। সে এক অদ্ভুত, অভিন্ব, অভাবনীয় দৃশ্য। প্রতিটি ঢেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসে একরাশ প্রাণ!
সাধারণতঃ এই সমারোহ চলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। আসে কয়েক লক্ষ অলিভ রিডলি। যারা এখানে জন্মগ্রহণ করে তারাই নাকি ফিরে আসে আবার জননী হয়ে। শোনা গেল সে এক আশ্চর্য্য অভিনব প্রাকৃতিক লীলা। প্রতিটি কাছিম সেই বিস্তীর্ণ বালুতটে ঢেউয়ের নাগালের বাইরে জায়গা খুঁজে নিয়ে গর্ত্ত খুঁড়তে শুরু করে দেয়। তারপরে তাদের ডিম সেই গর্ত্তে রেখে প্রাণপন শক্তি দিয়ে সেই গর্ত্ত বালি দিয়ে ঢেকে ধরিত্রী মায়ের সুরক্ষায় তাদের জমা করে তারা আবার ফিরে যায় জলে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে জলে ফিরতে প্রায় এক ঘন্টা বা তারও বেশী লেগে যায়।
এই কাহিনীর দ্বিতীয় ভাগ এখন থেকে দেড় মাস পরে রচিত হবে, মে মাসে। তখন বালির গরমে ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরোবে, এবং নিজেরাই শুধুমাত্র প্রকৃতির দুর্বোধ সঙ্কেত চিনে নিয়ে নির্ভুল পথে পাড়ি দেবে দূর সাগরে নিজেদের ডেরায়। ততদিন পর্য্যন্ত সরকারের বন দফতর আর নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকেরা অক্লান্ত ভাবে সামলে ডিমগুলো সামলে রাখবে পশুপাখী আর মানুষের হাত থেকে।
গোপালপুরে এসে রম্ভায় গিয়ে সেখানে মাস নেস্টিং দেখা না হওয়ায় আমাদের মন একটু খারাপ।
দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই ইউটিউবে ভিডিও তে দেখে নিও। কষ্ট করে রাত জেগে সমুদ্রের তীরে গিয়ে বসে থাকার বয়েস কি আমাদের আর আছে?”
৫) চিল্কায় নৌকাবিহার
গঞ্জাম জেলার বারকুল আর খোরদা জেলার রম্ভা নামে চিল্কার তীরে দুটি জায়গা থেকে পর্য্যটকরা হ্রদে বোটিং করে। দীপঙ্করের বন্ধু আমাদের বলেছেন বারকুলে যেতে, সেটা রম্ভার তুলনায় গোপালপুর থেকে কাছে এবং সেখানকার পান্থনিবাসে তিনি আমাদের লাঞ্চের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ম্যানেজারের নাম মিস্টার কর্। কর্ পদবীটা বাঙালীদেরও হয়, কিন্তু ইনি উড়িষ্যার লোক।
তাই আমরা বারকুলেই যাচ্ছি।
চিল্কায় অনেক দ্বীপ। এই সব দ্বীপে নৌকা নিয়ে পর্য্যটকরা যায়, আমরা তো ঠিক সে অর্থে পর্য্যটক নই। তবু দীপঙ্করের বন্ধু বলে দিয়েছেন, বারকুলে লাঞ্চ সেরে আমরা যেন একটা নৌকা ভাড়া করে কালিজায়ি নামে একটা দ্বীপে গিয়ে সেখানে এক কালীমন্দিরে পূজো দিয়ে আসি। কালিজায়ির মা কালী খুব জাগ্রত।
এ ছাড়া তিনি বলে দিয়েছেন যে বারকুল পৌঁছবার আগে টামপারা নামে একটা লেক পড়বে, সেই জায়গাটাও দেখার মত। আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ কাটাতে পারি।
তো আমরা ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম। আজও বড় গাড়ী। রাস্তাও বেশ ভাল, কোন ঝাঁকানি নেই। গোপালপুর থেকে টামপারা এক ঘণ্টার মত পথ। পথে ছত্রপুর নামে একটা শহর পড়লো।


টামপারা (fresh water) লেকটা দেখলাম বেশ বড় (৭৫০ acre – অর্থাৎ প্রায় পাঁচ স্কোয়ার কিমি এর বিস্তার)। রুশিকুল্য নদীর মোহনাও এখান থেকে বেশী দূরে নয়। সেই হ্রদের ধারে একটা চমৎকার বাগানের সামনে এসে আমাদের গাড়ী থামলো। আকাশে সেদিন মেঘ, পাশের হ্রদ থেকে ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে, এই আগস্ট মাসেও তেমন গরম নেই, বাগানের গাছগাছালির মধ্যে একটি বাঁধানো রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। বেশ কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটা কফি শপে গিয়ে বসলাম।
কফি শপের ঠিক উল্টো দিকে হ্রদের ধারে একটা ছোট্ট হোটেল, বাইরে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা টাম্পারা গেস্ট হাউস, ছত্রপুর।
দীপঙ্কর বললো, “আমার গার্লফ্রেন্ডরা যখন আমার সাথে এখানে আসে তখন আমরা এই গেস্ট হাউসে এসে উঠি, আর একটা ঘর নিই যাতে জানলা খুললেই সামনে হ্রদ দেখা যায়!”
সুজাতা বললো “এই আবার দীপঙ্করের ঢপ্ শুরু হলো!”
সুভদ্রা বললো “যাও যাও তোমার ক্যালি আমাদের খুব জানা আছে! গার্লফ্রেন্ড না ছাই!”
দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, তোমরা বিশ্বাস না করলে আমি কি করতে পারি, পূর্ণিমার রাতে লেকের জল চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করে, আমার বান্ধবীরা কেউ ওই Lake facing room ছাড়া থাকবেনা! ”




টামপারা থেকে বারকুল কাছেই। সেখানে পান্থনিবাস হোটেলে গিয়ে দেখি সেখানকার ম্যানেজার কর্ সাহেব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। হোটেলে অনেক গেস্ট, বেশ ভীড়, তাই তিনি তাদের নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত। আমাদের জন্যে তিনি একটা হোটেলের ঘর খুলে দিলেন, আমরা সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিতে নিতে তিনি আমাদের জন্যে রেস্টুরেন্টে টেবিলের আর খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন।
লাঞ্চ ভালোই হলো। কর্ সাহেব ভালোই বন্দোবস্ত করেছেন। চিংড়ী মাছ আর কাঁকড়ার ঝোল খেলাম ভাত দিয়ে। তা ছাড়া ভাত ডাল আর তরকারী। শেষ পাতে মিষ্টি দই।
লাঞ্চের পর কাছেই হ্রদের ধারে সারি সারি নৌকা বাঁধা আছে সেখানে একটা কাউন্টারে এক ঘণ্টা বোটিং এর টিকিট কিনে আমরা একটা নৌকায় উঠে পড়লাম। ওঠার আগে আমাদের প্রত্যেককে একটা লাইফ জ্যাকেট পরতে হলো।
আমাদের নৌকাটা একটা মটরবোট, ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। মাঝি একটা স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বোটটা চালাচ্ছে, আমরা বোটের দুই পাশে বসে জলের ঢেউএর দোলায় অল্প অল্প দুলছি, অভিজ্ঞতাটা মন্দ নয়। তীরের কাছাকাছি দিয়ে আমাদের বোট চলছে, সেদিকে তাকালে তীরের গাছপালা ঘরবাড়ী পাহাড় সব চোখে পড়ছে, আর অন্যদিকে অকূল জল। ঠিক সমুদ্রের মতোই। যতদূর তাকাই শুধু জল আর জল। কোন ডলফিন চোখে না পড়লেও অনেক পাখী আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর জলের মধ্যে কিছু কচ্ছপ চোখে পড়লো, তারা চার পা চালিয়ে বেশ আরাম করে হাই স্পীডে জলের মধ্যে সাঁতার কেটে ভেসে যাচ্ছে। মাটিতে তারা আস্তে আস্তে এগোয়, কিন্তু জলের মধ্যে তারা বেশ স্বচ্ছন্দ। মিনিট পনেরোর মধ্যে কালিজায়ী দ্বীপে পৌঁছে গেলাম আমরা। সুজাতা আর সুভদ্রা মন্দিরে গেল পূজো দিতে, আমাদের ছেলেদের মনে অত ভক্তি নেই, সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য এই প্রিন্সিপল ফলো করে আমরা তিন জন একটা জলের মধ্যে রাবারের তৈরী একটা ভাসমান র্যাম্পের ওপর দিয়ে উঠে কিছুদূর গিয়ে চিল্কার সীমাহীন জলের শোভা দেখলাম।
এদিকে আকাশে তখন কালো মেঘ জড়ো হচ্ছে, ঝড় উঠবে নাকি? এখন ভালোয় ভালোয় ফিরে গেলে হয়।
আবার সবাই বোটে এসে বসলাম, মিনিট পাঁচেক যাবার পরে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া শুরু হলো। আকাশের মেঘ আর বাষ্প নেমে এসেছে অনেক নীচে, তীরের পাহাড় বাড়ী গাছপালা সবই ঝাপসা দেখাচ্ছে আর তীব্র হাওয়ায় জলে বেশ ধেউ উঠছে। আমি সেই ঝাপসা পাহাড় আর জলের ঢেউয়ের কিছু ছবি তুলে নিলাম।
আমাদের ছোটবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি জনপ্রিয় গানের (শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি) শেষের দিকে এই লাইন গুলো ছিল।
জমছে কালো মেঘ, অন্ধকার ঘনায়/
তাই দেখে মাঝি আকাশে তাকায়/
রুদ্র ঝড়ে উঠবে নড়ে স্তব্ধ প্রকৃতি/
আমাদের মাঝি লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছেনা তার কোন ভাবান্তর হচ্ছে, এই ধরণের ঝড় বৃষ্টি তার অনেক দেখা আছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমরা সবাই চুপ, কার মনে কি চলছে বলা মুস্কিল, তবে আমি ভাবছি ঝড় আর বৃষ্টি যেন আমাদের নিরাপদে কূলে পৌঁছে যাওয়া পর্য্যন্ত একটু অপেক্ষা করে।
শেষ পর্য্যন্ত তাই হলো অবশ্য। এর প্রধান কারণ আমার মনে হয় মা কালীর আশীর্ব্বাদ। সুজাতা আর সুভদ্রা ভাগ্যিস তাঁর মন্দিরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এসেছে। তা না করলে কি হতো বলা মুস্কিল।





যাই হোক, পারে পৌঁছবার পরে মাঝি বোট নোঙ্গর করে ছুটলো আমাদের জন্যে ছাতা আনতে। আমরা সেই ছাতার তলায় মাথা বাঁচিয়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ছুটে গিয়ে কাছেই একটি ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের ড্রাইভার সেখানে গাড়ী নিয়ে চলে এলো, আমরা গাড়িতে উঠে স্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম।
বারকুল থেকে বৃষ্টির মধ্যে হোটেলে ফেরার কথাটা অনেকদিন মনে থাকবে। সামনের সীটে বসে আমি দেখছিলাম বৃষ্টি তে ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, চারিদিক ঝাপসা, উইন্ডশীল্ডে ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টিকে সামলাতে ঝপাঝপ শব্দ করে দুটো ওয়াইপার উঠছে আর নামছে। যে রাস্তায় সকালে এসেছিলাম, এখন সে রাস্তা আর চেনার উপায় নেই। জীবনে এরকম বেশ কিছু মূহুর্ত্ত আর অভিজ্ঞতা আসে যা চট করে ভোলা যায়না। আমাদের চিল্কা যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সেই রকম।
ড্রাইভার ছেলেটি বলতেই হবে ওই দুর্য্যোগের মধ্যে খুব সুন্দর গাড়ী চালিয়েছিল সেদিন।


৬) চতুর্থ দিন – ২৫/৮/২২
আজ গোপালপুরে আমাদের শেষদিন। আজকের সকালটা আরাম করে সমুদ্র তীরে রোদ বাঁচিয়ে ছাতার তলায় বসে গল্প করে কেটে গেল। নরম ভেজা বালিতে জলে পা ডুবিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে।
সুভদ্রা আর আমি একটু হোটেলের সুইমিং পুলে নামলাম। পুলে আর কেউ নেই শুধু আমরা দু’জন। ট্রাঙ্ক এর বদলে একটা শর্ট পরে এসেছি আমি, যেটা পরে সমুদ্রর তীরেও হাঁটা যায় আবার পুলেও নামা যায়।
ঘর থেকে বেরোবার আগে যে মানিব্যাগটা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছি, পুলে নামার আগে তা খেয়ালই ছিলনা। জলে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে দু’তিনটে ল্যাপ নেবার পরে সুভদ্রার সাথে জলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গল্প করছি, হঠাৎ মনে হলো পকেটটা এত ভারী লাগছে কেন?
পিছু কেন ভারী ঠেকে ভাবে কোচোয়ান…
চকিতে বুঝলাম কেন। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ব্যাগটা বের করে বুঝলাম যা কেলো হবার তা হয়ে গেছে। টাকার নোট সব ভিজে। ডেবিট ক্রেডিট কার্ডের কিছু হবেনা। কিন্তু নোট গুলো শুকোনো একটা বড় কাজ এখন।
ঘরে ফিরে নোট গুলো ব্যাগ থেকে বের করে বিছানায় শুকোতে দিলাম। ব্যাগটাও সপসপে ভিজে।
রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্তবুড়ীর দিদিশ্বাশুড়ীর তিন বোনের কথা লিখেছিলেন, আমার অবস্থা অনেকটা তাঁদের মত।
কোন দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে, নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে/
টাকাকড়ি গুলো হাওয়া খাবে বলে রেখে দেয় খোলা জানলায়/
আমি অবশ্য টাকার নোট গুলো জানলায় রাখিনি, বিছানায় রেখে ফুল স্পীডে ফান চালিয়ে তাদের হাওয়া খাইয়েছিলাম।
দুপুরে আজ সবাই মিলে স্বস্তি হোটেলে লাঞ্চে গেলাম। কালকের সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির করে বড় একটা গোল টেবিলে বসালেন। খয়রা মাছটা দেখলাম অনেকটা তেলাপিয়ার মত। খুব সুস্বাদু রান্না, বেশ ভাল লাগলো খেতে। শেষ পাতে ছানাপোড়া।
কাল আমরা কলকাতা ফিরছি, সাথে বাড়ীর জন্যে কিছু ছানাপোড়া নিয়ে গেলে কেমন হয়?
ম্যানেজার ভদ্রলোক কে আমাদের জন্যে কিছু ছানাপোড়া প্যাক করে দিতে বললাম। তিনি বললেন, “কাল ভুবনেশ্বর যাবার পথে ল্যাংলেশ্বর নামে একটা ছোট শহর পড়বে। ওই শহরে কোন এক ভালো দোকান থেকে আপনারা ছানাপোড়া কিনে নেবেন, কেননা ওখানকার ছানাপোড়াই হল বিখ্যাত, কাছাকাছির মধ্যে সব চেয়ে নাম করা।”
লাঞ্চের পরে আবার একটু বিশ্রাম সেরে আমরা সমুদ্রের ধারে চা আর ঝালমুড়ি নিয়ে বসে গেলাম। নানা আলোচনার মধ্যে ফেনার মুকুট পরা সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্লান্তিহীন আসা যাওয়া দেখতে দেখতে পশ্চিমের আকাশ কমলা আর লাল রং এ ভরিয়ে সুর্য্যাস্ত হল, তারপর নেমে এলো অন্ধকার।





৭) পঞ্চম দিন – ২৬/৮/২৩ – ফেরা
কাল ফ্লাইটের চেক ইন আর বোর্ডিং পাস হোটেল থেকে লোপামুদ্রা করিয়ে রেখেছে।
আজ ব্রেকফাস্ট এর পর সকাল সকাল হোটেল থেকে চেক আউট করে মালপত্র গাড়ীতে তুলে বেরিয়ে পড়লাম। ভুবনেশ্বর পর্য্যন্ত চার ঘন্টার লম্বা রাস্তা।
পথে ল্যাংলেশ্বর জায়গাটা পড়ল। ড্রাইভার আমাদের একটা মশহুর ছানাপোড়া দোকানের সামনে এসে গাড়ী থামালো। আমরা যে যার দরকার মত কেউ এক কেজি কেউ দুই কেজি ছানাপোড়া কিনে নিলাম।
সুজাতা বলল, ল্যাংলেশ্বর! কি নাম বাবা…
দীপঙ্কর বলল “আরে ভাই, এই নামটা কি করে হলো জানো? এর একটা হিস্ট্রি আছে। একবার বহু বছর আগে ঈশ্বর নামে একটি লোক এই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, সে ছিল ছানাপোড়া তৈরী করার একজন বিখ্যাত কারিগর। দেশজুড়ে তার সুনাম। এখানকার কিছু লোক তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, তার ফলে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়, সে আর কোথাও যেতে পারেনা। এখানেই সে ছানাপোড়া তৈরীর কারখানা খোলে এবং ক্রমে ক্রমে এই জায়গাটা ছানাপোড়ার জন্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হয়েছে ল্যাংলেশ্বর।”
সুভদ্রা বলল ভ্যাট্, দীপঙ্করের যত হাবিজাবি গল্প।
আমাদের প্লেন ছাড়ছে বেলা দুটো। দমদম পৌঁছবো বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। আমি ফোনে আমাদের ড্রাইভার কে বাড়ী থেকে গাড়ীটা নিয়ে দমদমে আসতে বলছি।
“একটু আগে এসে গাড়ীতে তেল আছে কিনা দেখে নিও, টায়ার গুলোতে হাওয়া ভরতে হতে পারে, তিনটের একটু আগে দমদম পৌঁছে যেও”, ইত্যাদি বলে যাচ্ছি আর ভাবছি মোবাইল ফোন যখন ছিলনা, তখন আমরা কি করে বেঁচে ছিলাম!
দীপঙ্কর বসে ছিল পিছনে, সে বললো ইন্দ্রজিৎ এর ড্রাইভার কে এই পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।
কি গল্প?
এক কোম্পানীর মালিক তাঁর এক কর্ম্মচারীকে পাঠাবেন আসানসোলে তাঁর এক খদ্দেরের কাছ থেকে একটা চেক নিয়ে আসতে। ইয়ার এন্ড এসে যাচ্ছে, তাই চেক টা পাওয়া খুব দরকারী।
কর্ম্মচারী ছেলেটি খুব বিশ্বাসী আর বশংবদ।
মালিক তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিচ্ছেন এই ভাবে।
শোনো তুমি সামনের সোমবার ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবে, বুঝেছো?
হ্যাঁ, স্যার!
ব্ল্যাক ডায়মন্ড প্ল্যাটফর্ম আট থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় ছাড়বে, তার মানে তোমায় হাওড়া স্টেশনে পৌনে ছটার আগে পৌঁছে যেতে হবে, বুঝতে পেরেছো?
হ্যাঁ, স্যার!
তুমি সেদিন ভোর চারটে তে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠবে, উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়বে। তুমি তো ফার্ণ রোডে আলেয়া সিনেমার কাছে থাকো, ওখান থেকে গড়িয়াহাটে হেঁটে যেতে তোমার দুই তিন মিনিট লাগবে, সেখানে গিয়ে তুমি পাঁচ নম্বর বাস ধরবে, ফার্স্ট বাস আসে ভোর পাঁচটায় তাই তার আগেই তোমায় বাস স্টপে পৌঁছে যেতে হবে, দেরী করবেনা, বুঝেছো?
হ্যাঁ, স্যার!
আচ্ছা ওই সকালে বাসে তুমি হাওড়া স্টেশনে ছ’টার আগেই পৌঁছে যাবে, সেখানে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে টিকিট রিসার্ভেশন কাউন্টারে লাইন দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড চেয়ার কারে তোমার সীট রিসার্ভ করে টিকিট কিনবে। ঠিক আছে?
হ্যাঁ, স্যার! এবার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে ট্রেণে উঠে নিজের সীটে গিয়ে বসবে। আসানসোল স্টেশনে ট্রেণ পৌছবে সকাল ন’টায়। কিন্তু তুমি যে অফিসে যাবে তারা খোলে বেলা দশটায়। তাই তুমি ট্রেণ থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে মিনিট পনেরো চা খেয়ে নিয়ে নিও। ক্লীয়ার?
হ্যাঁ, স্যার!
তারপরে বাইরে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ওদের অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটা ওদের দেখিও। ওরা তোমায় এক টা চেক দেবে, সেটা নিয়ে তুমি আবার স্টেশনে ফিরে বিকেল চারটে তে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে এসো।
সোমবার ন’টা নাগাদ মালিকের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। সেই বশংবদ কর্ম্মচারীর ফোন।
এবার তাদের দু’জনের কথাবার্ত্তা এরকম হলো।
কি হলো? কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? ভোরবেলা গড়িয়াহাট থেকে ফার্স্ট বাস পাঁচ নম্বর ধরেছিলে?
হ্যাঁ, স্যার!
বেশ! তারপর? ট্রেণের টিকিট কাটলে? সীট রিসার্ভ করতে পারলে?
হ্যাঁ স্যার!
বেশ বেশ! আসানসোল পৌছে গেছো?
হ্যাঁ স্যার!
তাহলে তো সবই ঠিকঠাকই করেছো। ফোন করছো কেন? কোন প্রবলেম?
হ্যাঁ স্যার একটা প্রবলেম হয়েছে।
মালিক একটু অবাক। কি আবার প্রবলেম হলো।
স্যার এই দোকানে চা পাওয়া যায়না, কেবল কফি। আমি কি কফি খেতে পারি, স্যার?
