Tag Archives: টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলে জ্যাঠামশায়ের সাথে কিছুক্ষণ (১৯৮১ )

আমার প্রপিতামহ স্বর্গীয় দীনবন্ধু ভৌমিকের এক মেয়ের (বাবাদের পিসীর) ময়মনসিংহে বিয়ে হয়। তিনি, এবং তাঁদের দুই ছেলে দেশভাগের পরে ভারতে আসেন নি, দু’জনেই ভিটে মাটির টানে পূর্ব্ব বাংলায় রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের বড় ছেলে (পূর্ণ রায়) ছিলেন ডাক্তার, তিনি ও তাঁর স্ত্রী ষোড়শী নিঃসন্তান ছিলেন।
আর তাঁদের ছোট ছেলে (সুশীল রায়) ছিলেন উকিল, তিনি টাঙ্গাইল কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। তাঁর দুই ছেলে তারাপদ (কবি তারাপদ রায়) আর বিজন দুজনেই কর্ম্মসূত্রে কলকাতায় চলে এলেও তিনি আসেন নি, স্ত্রী মারা যাবার পরে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি টাঙ্গাইলেই নিজের ভিটেয় থেকে যান।
তারাপদ দা’র বাবা সম্পর্কে ছিলেন আমার বাবা কাকাদের পিসতুতো দাদা, আমার সুশীল জ্যাঠামশায়।
ভাদরা যেতে না পারলেও ১৯৮১ সালে আমি একবার টাঙ্গাইলে গিয়ে সুশীল জ্যাঠামশায়ের সাথে দেখা করে এসেছিলাম। সেই ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে বেশ hostile পরিবেশে তিনি শুধুমাত্র ভিটে মাটির টানে জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ একা একজন প্রৌঢ়া বিধবা কাজের মহিলার উপর নির্ভর করে থেকে গিয়েছিলেন। জ্যাঠামশায়ের বাংলাদশে থেকে যাবার অভিজ্ঞতা অবশ্য বিয়োগান্ত হয়নি। টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ীতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।

তাঁর সাথে টাঙ্গাইল শহরে গিয়ে দেখা করা নিয়ে নীচের এই লেখাটি।

———-

আমার বাবার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে  প্রাক স্বাধীনতা যুগের পূর্ব্ববঙ্গের নানা শহরে, তাঁর মুখে সেই সব জায়গার নানা গল্প শুনেছি, পূর্ব্বাচল নামে তাঁর স্মৃতিকথায় ও সেইসব জায়গার সুন্দর বর্ণনা আছে।
ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, রাজসাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম… 
বাবার লেখা পড়তাম আর ভাবতাম এই সব জায়গায় কি কোনদিন আমার যাওয়া হবে? 
১৯৮১ সালে বাংলাদেশে যাবার সেই সু্যোগ এসে গেল। বাঙাল পরিবারে জন্ম, তাই বাংলাদেশ আসার সু্যোগ পেয়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম মনে পড়ে। ওই দেশটার সাথে আমার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন রক্তের মধ্যে মিশে আছে। 
International Centre for Diarrhoeal Disease Research (ICDDR) বাংলাদেশে কলেরা আর আমাশা এই দুই রোগ আর মহামারী নিয়ে রিসার্চ করছে, তারা  IBM system ব্যবহার  করে  বাংলাদেশে র নানা গ্রামে আর শহরে জন্ম মৃত্যু সংক্রান্ত sample demographic database তৈরী করবে।  সেই কাজে সাহায্য করার জন্যে IBM India থেকে একটা assignment পেয়ে আমি তাদের সাথে বছর খানেক বাংলাদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।

কাজের সূত্রে সেই এক বছর বাংলাদেশের নানা শহর দেখা হয়েছিল, অনেক লোকের সাথে আলাপ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। ঢাকায় যখন বেশ কয়েকবার যাতায়াত  এবং বেশ কিছু দিন থাকা হয়ে গেছে,  তখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের গ্রাম ভাদরা গ্রাম টা ঢাকা থেকে খুব একটা দূর নয়, একবার সেখানে ঘুরে এলে বেশ হয়।

কিন্তু আমি তো জায়গাটা কোথায় জানিনা, কেই বা আমায় সেখানে নিয়ে যাবে, আর সেখানে গেলেই বা নিজের পরিচয় কি দেবো, সেখানে আমার অভ্যর্থনা কেমন হবে এই সব ভেবে সেখানে যাবার আশা পরিত্যাগ করেছি।  

তার পরে এক দিন মনে হলো ভাদরা না হোক, অন্ততঃ টাঙ্গাইল গিয়ে জ্যাঠামশায়ের সাথে একবার দেখা করে আসি, উনি একা একা কেমন আছেন দেখে আসি, আর তিনি হয়তো আমায় ভাদরা যাবার ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারেন। ভাদরা গ্রাম শুনেছি টাঙ্গাইল থেকে খুব একটা দূরেও নয়।

দেশভাগের সময় টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ছিল।  এই ১৯৮১ সালে এখন টাঙ্গাইল একটি জেলা।    

তারাপদ দা’র কাছ থেকে direction নিয়ে এসেছিলাম। এক রবিবার দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম।

ঢাকার বাইদুল মুকারাম মসজিদের কাছে বাস স্ট্যান্ড, সেখানে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে, সেই সব বাসের গায়ে বড় বড় করে বাংলায় লেখা আরবী ভাষায় কোরানের বাণী, “বিসমিল্লা রাহমানুর রাহিম”, “লা ইলা ইল্লাল্লাহ” ইত্যাদি।

রবিবার দুপুরে মাগরেব এর নমাজ সবে শেষ হয়েছে, রাস্তায় চারিদিকে লুঙ্গী পরা মাথায় টুপি দাড়িওয়ালা ধর্ম্মপ্রাণ  মুসলমান লোকেদের  ভীড়।  সেই ভীড়ের মধ্যে আমি  বিধর্ম্মী হিসেবে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত, সবাই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছে, এদের ধর্ম্মে নাকি বলে বিধর্ম্মী কে মারলে বেহেস্তে যাবার রাস্তা সুগম হয়। আমায় দেখে এই সব ধর্ম্মপ্রাণ লোকেদের মনে নিজেদের বেহেস্তে যাবার পথ সুগম করার ইচ্ছে জাগছে কিনা কে জানে?

গা টা বেশ ছমছম করছে, মনের ভেতরে বেশ একটা শিরশিরানি ভয় টের পাচ্ছিলাম। 

কাজটা কি ঠিক করছি?

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল খুব দূর নয়, বাসে দুই ঘন্টার পথ।  

টাঙ্গাইলের বাস খুঁজে উঠে বসে পড়লাম। ছুটির দিন দুপুর, বাস ফাঁকাই পেলাম। পিচের রাস্তা তেমন চওড়া না হলেও বেশ মসৃণ, শহর ছাড়িয়ে একটু পরেই দু’দিকে চোখে পড়ল অবারিত প্রান্তর, দিকচক্রবাল পর্য্যন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে কিছু I গ্রাম আর জনপদ আসে, সেখানে বাড়ীর দেয়ালে নানা ধরণের লিখন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী”, কিংবা “কাদের সিদ্দিকির হুলিয়া, নিতে হবে তুলিয়া” ইত্যাদি।

বট, অশ্বথ, ছাতিম, তেঁতুল, আম জাম, কাঁঠাল, আরও কত নাম না জানা গাছের ডাল পালা দুই পাশ থেকে এসে রাস্তার ওপরে ঝুঁকে পড়ে ছায়া ফেলে। মাঝে  মাঝেই চোখে পড়ে পথের ধারে কলাবাগান, কিছু ছোট পুকুর, ছোট বাড়ী, অসংখ্য নারকেল গাছ।

বেলা তিনটে নাগাদ টাঙ্গাইল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে রিক্সা নিলাম। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম। রিক্সাওয়ালা একেবারে অবিকল তারাপদ দা’র মত করে কথা বলছে, এক সুর, এক উচ্চারণ, এক কথা বলার ভঙ্গী। একেই বোধ হয় বলে স্থানমাহাত্ম্য।

টাঙ্গাইল শহরে সবাই ওই ভাবেই কথা বলে নাকি?

তারাপদ দা’র  direction থাকায় জ্যাঠামশায়ের বাড়ী বাস স্ট্যান্ড থেকে কাছেই, খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলোনা। রাস্তার ওপরেই একতলা ছোট বাড়ী। রাস্তার উল্টো দিকে একটা বিরাট পুকুর।  বাড়ীর সামনে বারান্দায় আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে  (বোধ হয় মার্চ্চ মাস, তখনও অল্প শীত) জ্যাঠামশায় আরামকেদারায় বসে রোদ পোয়াচ্ছেন, এই দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। আমায় দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলেন। বাবা আর দাদুর নাম বলতেই চিনতে পেরে উঠে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। 

ছোটখাটো চেহারা, চোখে ঘষা কাঁচের চশমা, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, তবু মনের জোর আর সাহস সাঙ্ঘাতিক, দুই ছেলে পাশে নেই, স্ত্রীও গত হয়েছেন, বয়স হয়েছে,  তবু একা একা এক বয়স্কা কাজের মহিলার ওপরে নির্ভর করে তিনি টাঙ্গাইলে থেকে গেছেন।

বান্ধবহীন স্বজনহীন জীবনে অপ্রত্যাশিত ভাবে জ্যাঠামশায়  আমায় পেয়ে খুব খুসী হয়েছিলেন বুঝেছিলাম, অচেনা হলেও আমি তো ঘরের লোক, হাজার হলেও রক্তের সম্পর্ক। আমার কাছ থেকে পরিবারের কে কোথায় আছেন সব খবরাখবর নিলেন।  মামা রা দুজনেই  (ব্রজবন্ধু, জগদবন্ধু) চলে গেছেন সে কথা জানেন, আমার বাবাও যে অল্পবয়েসে গত হয়েছেন সে খবরও পেয়েছেন জানালেন।

তারাপদ দা’র সাথে আমার যোগাযোগ আছে জেনে খুসী হলেন।

সেই বিধবা কাজের মহিলাও আমায় দেখে খুব খুসী। হাসিমুখে ঝকঝকে কাঁসার রেকাবী আর গেলাসে  যত্ন করে আমায় বাড়ীর তৈরী নাড়ু, নিমকি সন্দেশ আর ঠান্ডা জল এনে দিলেন, ভেতরে শোবার ঘরে  খাটের ওপর বসে নানা গল্প করতে করতে খেলাম। 

ঘন্টা দুয়েক ওঁদের সাথে বেশ কেটে গেল।

ভাদরা যাবার কথা তুললাম। কিন্তু বুঝলাম জ্যাঠামশায় এর ইচ্ছে নয় আমি ভাদরা যাই।   ভাদরা যাবার ব্যাপারে উনি খুব একটা উৎসাহ দিলেন না। প্রথমতঃ গ্রামটা নাকি অগম্য, রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। আলপথ ধরে হেঁটে বা সাইকেলে চেপে যেতে হয়। আর বর্ষা কালে নৌকায়। তাছাড়া সেখানে আমাদের আর কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, আমায় দেখে ওখানকার স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে unfavourable (adverse, hostile) reaction হবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।   

বাংলাদেশে এখন গ্রাম অত অগম্য এই যুক্তি আমি ঠিক মেনে নিতে না পারলেও তাঁর সাথে তর্ক করিনি। নিশ্চয় অন্য কোন কারণ ছিল, যা তিনি আমায় বলতে চান নি, যার জন্যে তিনি আমায় ভাদরা যেতে উৎসাহ দেন্‌নি, হয়তো ওখানে গেলে সত্যিই আমার কোন বিপদ হবার সম্ভাবনা ছিল।    

অন্ধকার হবার আগেই উঠলাম। তারপরে রিক্সা নিয়ে আবার বাসস্ট্যাণ্ড।

বারণ করা  সত্ত্বেও জ্যাঠামশায় আমার সাথে বাস স্ট্যাণ্ড পর্য্যন্ত এসে পৌঁছে দিলেন। এখনও তিনি ওকালতি করেন বুঝলাম, কালো একটা কোট চাপিয়ে নিলেন বেরোবার আগে। বাস স্ট্যান্ডে অনেক পরিচিত লোক তাঁকে “চাচা কেমন আসেন?” বলে হেসে সালাম জানাচ্ছিলেন। তিনি তাদের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন, বললেন আমার ভাইপো। কলকাতা থেকে দেখা করতে এসেছে। বাসস্ট্যাণ্ড এর কাছে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল, আমায় আঙুল তুলে দেখালেন, ছোটবেলায় তারাপদ দা’ ওই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ওনার কবিতায় ওই স্কুলের উল্লেখ আছে, মনে পড়ে গেল।

তারপরে বাসে উঠে পড়লাম, জানলা দিয়ে দেখলাম জ্যাঠামশায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন, ঝলঝলে ট্রাউজার্স, গায়ে কালো কোট, তাঁকে দেখে বেশ দুঃখী, অসহায় আর একলা মনে হচ্ছিল,  ইংরেজীতে যাকে বলে sad lonely and lost~

জ্যাঠামশায়ের ওই বাস স্ট্যান্ডে আমায় বিদায় জানানোর দৃশ্য টা আমার এখনও পরিস্কার মনে পড়ে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমায় আপন করে নিয়েছিলেন।

তার দুই এক বছরের মধ্যে টাঙ্গাইলেই তাঁর জীবনাবসান হয়।

বাসে আসতে আসতে ভাবছিলাম কি হতো যদি শ্যামাপ্রসাদ না পারতেন, যদি কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গ পাকিস্তানে চলে যেতো? 

১৯৪২ সালে ব্রজবন্ধু মারা গেছেন, আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীতে তখন তাঁর ছেলেরা অর্থাৎ আমাদের বাবা কাকারা থাকেন। তাঁরা কি পাকিস্তানে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কলকাতার বাড়ী বিক্রী করে বিহারে পাটনা বা রাঁচীতে বাস তুলে নিয়ে যেতেন?

বলা মুস্কিল।

পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশের) নাগরিক হলে আজ আমাদের কি অবস্থা হতো?  আমরা কি  “নিজভূমে পরবাসী” হয়ে মাথা নীচু করে থাকতাম?

বাসের ঝাঁকানীর মধ্যে এই সব ভাবতে ভাবতে চলেছি।

জানলার বাইরে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।