Tag Archives: দিল্লী

মুকু আর সোনুর সাথে দিল্লীতে কিছুক্ষণ

সোমবার, ৩০/৯/২০২৪

সুভদ্রা আর আমি দিল্লীতে এসেছি বুড়ীর কাছে দিন দশেকের জন্যে।

দিল্লীতে এলে মুকুর সাথে একবার দেখা হবেই।  সাধারণতঃ ও আমায় ওদের Army Officers Club এ নিয়ে যায়, সেখানে খানাপিনা আর আড্ডা হয়। এবার আমরা সোনুকেও ডেকে নিলাম।

কথামতো সকালে সোনু চলে এলো আমায় তুলতে। দিল্লীর সব রাস্তাঘাট ওর মোটামুটি চেনা। যদিও এখন অনেকদিন গুরগাঁও তে থাকার জন্যে দিল্লী তার কাছে কিছুটা অপরিচিত, তার একটা প্রধান কারণ হলো দিল্লী শহরটাও এতগুলো বছরে অনেকটাই পালটে গেছে।

আমিও এক সময় দিল্লীতে প্রায়ই আসতাম। ন’কাকা দেরাদুন থেকে দিল্লীতে এসে প্রথমে রামকৃষ্ণপুরম ও পরে নৌরজী নগরে থাকতেন। জ্যেঠুর  U18 গ্রীন পার্ক এক্সটেন্সনের বাড়ীতে ও কতবার গেছি। তখন বাসে স্কুটারে বা ভটভটিয়াতে সফদরজং হাসপাতালের পাশে  ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে  নেমে ইউসুফসরাই এর গলি দিয়ে সোজা চলে যেতাম। এখন ওই সব জায়গা একেবারেই অচেনা মনে হয়। দিল্লী আর আমার চেনা সেই আগের দিল্লী নেই।

বুড়ীরা আগে থাকতো নিজামুদ্দীন ইস্টে, এখন তারা পঞ্চশীল পার্কে চলে এসেছে। S Block এ ওদের বাড়ী। সোনুকে ঠিকানা দিয়ে রেখেছিলাম। পঞ্চশীল পার্কের ওই জায়গাটা অনেকটা খাঁচার মত,সেখানে ঢোকার আর বেরোবার জন্যে আবার তিনটে গেট। এক নম্বর গেট মাসের ১-১০ তারিখ খোলা, দুই নম্বর গেট খোলা মাসের ১১-২০ তারিখ, আর ২১ থেকে ৩০ তারিখ তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢোকা বেরোনো। সেদিন ছিল ৩০ তারিখ, তাই তিন নম্বর গেটের এই মাসে সেটাই শেষ দিন।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কমনে আসে যায়…

সোনুর আসতে একটু দেরী হলো। সে বললো আমি তো পঞ্চশীল পার্কের বি ব্লক দিয়ে ঢুকলাম, জানি সোজা রাস্তা। ওমা, কিছুদূর গিয়ে দেখি গেট বন্ধ তালা ঝুলছে। কি আর করি আবার বেরিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হলো।

খাঁচা থেকে বেরোতে গিয়ে আবার এক ঝামেলা। গেটে তালা লাগানো।

যারা বাইরে থাকে তারা এসব জানবে কি করে?সোনু বেচারা কে দোষ দেওয়া যায়না।

এই তারিখ নিয়ে একটা মজার গল্প আছে।

——————–

এক ভদ্রলোক বর্দ্ধমান থেকে ট্রেণে ব্যান্ডেল যাচ্ছেন, সেখন থেকে তিনি কর্ড লাইনের লোকাল ধরবেন, সেটা ছাড়ে বেলা দুটোয়। তাঁর হাতে ঘড়ি নেই, সহযাত্রী এক ভদ্রলোকের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি দেখছেন দুটো প্রায় বাজে, তার মানে ব্যাণ্ডেল এর ওই ট্রেণ তাঁর মিস হয়ে যাবে। মরিয়া হয়ে তিনি সেই সহযাত্রীকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার ঘড়িতে ক’টা বাজে দাদা? আমার একটা দুটোর ট্রেণ ধরতে হবে ব্যান্ডেল থেকে…”

তিনি উত্তরে জিজ্ঞেস করলেন আজ কত তারিখ?

তারিখ? ভদ্রলোক তো অবাক! সময়ের সাথে তারিখের কি সম্পর্ক?

“আজ তো কুড়ি তারিখ” তিনি বললেন।

“আমার ঘড়িটা দিনে দুই মিনিট করে ফাস্ট হয়ে যায় বুঝলেন, আমি মাসে একবার করে ঠিক করে নিই। আজ যদি কুড়ি তারিখ হয়, তার মানে আমার ঘড়ি এখন চল্লিশ মিনিট ফাস্ট, তার মানে দু’টো বাজতে এখনো অনেক দেরী। ব্যাণ্ডেলে ট্রেণ আপনি পেয়ে যাবেন চিন্তা নেই।“

তাই শুনে ভদ্রলোক একটা স্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।

—————–

যাই হোক অনেক দিন পরে সোনুর সাথে দেখা, আমরা গাড়ীতেই যেতে যেতে গল্প শুরু করে দিলাম। সম্প্রতি তনুজ আর সুদীপ্তার ছেলে হয়েছে, পাটনার দিকে আমাদের বংশের পঞ্চম প্রজন্মের প্রথম সন্তান। পাটনার দাদু  জগদবন্ধুকে প্রথম প্রজন্ম ধরলে সোনাকাকা দ্বিতীয়, সোনু তৃতীয়, অনুজ হলো চতুর্থ প্রজন্ম।

আমাদের বাবা কাকারা যৌথ পরিবারে এক সাথে বড় হয়েছিলেন, আমাদের ভাই বোনেরাও মোটামুটি তাই। সেই জন্যে আমাদের মধ্যে এখনো যথেষ্ট আলাপ পরিচয় বন্ধুত্ব আর যোগাযোগ আছে, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেটা আশা করা যায়না।  এই নবজাতক সোনুর নাতি যখন বড় হবে তখন আমাদের প্রজন্মের কেউ থাকবোনা, এবং আমাদের এখনকার পারিবারিক সম্পর্কগুলোও অনেকটা আলগা হয়ে আসবে। আবার নানা নতুন সম্পর্কের সূচনা হবে।

সেটাই স্বাভাবিক।

সোনু বললো সুদীপ্তার মা এখন কিছুদিন ওদের কাছে আছেন, বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্যে। বাচ্চার এখন এক মাস বয়েস। সোনু ফোনে ছবি দেখালো, খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে তাকে।

এই সব গল্প করতে করতে সোনু বেশ কয়েকবার ভুল রাস্তা ধরেছে।  আর বার বার কপাল চাপড়ে বলছে, “আরে আমি কি করছি? এর পরের ডান দিকের এক্সিট টা নিতে হতো। আবার কিছুটা ঘুরতে হবে।“

সোনু আবার ওদের বাঙালী পূজোর কমিটির এক চাঁই। এবছর পূজো তে ওরা পরশুরামের “ভূষন্ডির মাঠে” নাটক করবে। বিখ্যাত মজার নাটক। তাতে সোনুর একটা ছোট রোল আছে। পুরোদমে নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে।

এ ছাড়া পূজোর নানা কাজ। বেশ কিছু ফোন এলো গাড়ীতেই। কেউ জানতে চাইছে দাদা পুলিশের ক্লিয়ারেনসটা কবে পাওয়া যাবে, কেউ বলছে দাদা নাটকের প্রপ গুলো কে দেখছে,? সোনু গাড়ী চালাতে চালাতে এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আবার ভুল করে এক জায়গায় বাঁ দিকে না গিয়ে সোজা চলে গেল। “ও হো, এটা আমি কি করলাম”, কপাল চাপড়ে বললো সোনু, “দ্যাখো বাঁ দিকে না ঢুকে সোজা ইউসুফসরাই চলে এসেছি।“

আমি জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম এটা ইয়ুসুফসরাই নাকি? সেই পুরনো দিনের ইয়ুসুফসরাই বলে চেনাই যাচ্ছেনা। ওই গলির ভিতের একটা হনুমানের মন্দির ছিল না?

যাই হোক, আবার ইউ টার্ণ।

এর মধ্যে দুই বার মুকুর ফোন এসেছে। কি রে তোদের কি হলো?

শেষ পর্য্যন্ত ইউ ১৮এ তো পৌঁছলাম। বাড়ীর পাশে অনেক নতুন বাড়ী উঠেছে, জায়গাটা আর চেনা যায়না। পাশে একটা বড় মাঠ ছিল আগে, সেখানে একটা কবরস্থান ছিল, সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে ন’কাকা দের নওরোজী নগরের বাড়ীতে যাবার একটা সর্টকাট ছিল। হাতে সময় থাকলে আমরা হেঁটে চলে যেতাম। “কমল” নামে একটা সিনেমা হল ও ছিল কাছেই। সোনু বলল সেটা আর নেই। ভেঙে শপিং মল করা হয়েছে নাকি।

মুকু বাড়ীর বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। ওর গাড়ীতেই বেরোলাম আমরা।

মুকু আমাদের নিয়ে গেল ওদের Dhaulakia Officers’ club এ – রাস্তাটা ওর ভালোই চেনা, কেননা সেখানে সে অরুণা বৌদি আর মনিকাকে নিয়ে প্রায়ই যায়। সাধারণতঃ ওখানে ওরা বিকেলে পুলে সাঁতার কেটে সন্ধ্যায় কিছু খেয়ে বাড়ী ফিরে আসে।

সোনুর তুলনায় দেখলাম মুকু দিল্লীর রাস্তাঘাট অনেক ভাল চেনে। বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখালো তাকে, দুই এক বার আমাদের “দ্যাখ্‌, একটা অন্য রাস্তা দিয়ে তোদের নিয়ে যাচ্ছি” বলে সে দুম্‌ করে একটা no entry দিয়ে একটা মিলিটারী টাউনশিপে ঢুকে পড়লো।

সোনু মুকুকে মাঝে মাঝে “কর্ণেল সাহাব” বলে ডাকে, সে বললো পুলিস আমাদের কর্ণেল সাহাব কে কিছু বলবেনা।

যাই হোক ওই টাউনশিপের মধ্যে দিয়ে আমরা মুকুদের ক্লাবে পিছন দিক দিয়ে একটা এন্ট্রি নিলাম। গেটে যারা পাহারা দিচ্ছিল, তারা সবাই দেখলাম মুকুকে ভালই চেনে। জায়গাটা বেশ সুন্দর, প্রচুর গাছপালা। সোমবার সকাল, ভীড় ও তেমন নেই।

আমরা একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসলাম। মুকু আমাদের দু’জনের জন্যে বীয়ার অর্ডার দিল, সোনু চাইলো জিন আর সোডা। সাথে আলু ভাজা আর ফ্রাইড চিকেন।

আমাদের গল্প শুরু হলো। নানা ধরনের গল্প। তবে প্রধানতঃ পুরনো দিনের পারিবারিক স্মৃতি। 

এদিকে রেস্তোঁরার  টিভি তে ক্রিকেট দেখাচ্ছে, বাংলাদেশের সাথে আমাদের টেস্ট ম্যাচ। আমি আজকাল ক্রিকেটের কোন খবর রাখিনা, কিন্তু সোনুর খুব উৎসাহ। সে নিজে কমবয়সে ভাল ক্রিকেট খেলতো – পেস বোলার ছিল। কিন্তু জোরে বল করতে গিয়ে তার মাস্‌ল্‌ এ স্ট্রেন হওয়ায় পরে সে স্পিনে চলে যায়।

“তখন তো আমাদের ভাল Physio আর কোচ ছিলনা”, দুঃখ করে বললো সে।

বাংলাদেশের সাথে এই টেস্ট ম্যাচে প্রথম তিন দিন বৃষ্টি হওয়াতে আজ চতুর্থ দিন প্রথম খেলা। মীমাংসা হবার কোন চান্স নেই, ড্র হবেই। যাই হোক, বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হবার পরে আমাদের রবীন্দ্র জাডেজা ৩০০০ রান আর তিনশোটা উইকেট পেয়েছে জানা গেল। এই সব দেখতে দেখতে মুকু তার এক CO (Commanding Officer) র কথা বললো, তিনি নাকি সব কথার মধ্যে ক্রিকেটের ভাষায় কথা বলতেন। যেমন – “That was a googly”, “I played him with a straight bat” কিংবা, “I sent him to the boundary” – এইরকম আর কি।

তো একদিন মুকু সেই CO ভদ্রলোকের সামনে বসে আছে, একজন আর্দ্দালী এসে বললো “স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন, নাম বলছেন না, কিন্তু দেখা করা খুব নাকি আর্জেন্ট।“ CO ভদ্রলোক তাকে বললেন “LBW”!

মুকু তো অবাক! তার মানে কি?

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “বুঝলেনা তো?” ওর মানে হচ্ছে “Let the bugger wait!”

আমাদের ছোটবেলায় জহর রায়ের একটা হাসির গল্প ছিল – ইডেন গার্ডেনে ম্যাচ দেখতে গিয়ে একজন দর্শক নাকি গ্যালারীতে মাল খেয়ে out হয়ে গিয়ে টলমল করে হাঁটছিলেন, জহর রায় তাঁকে LBW out বলেছিলেন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য তার মানে ছিল “Loaded belly with wine!”

মুকুর আর একটা গল্প আমার বাবা (তার সেজকাকা) কে  নিয়ে। একবার,মুকু তখন খুব ছোট, ব্যাঙ্গালোরের কাছে জালাহালি নামে একটা জায়গায় জ্যেঠু পোস্টেড।

“গাড়ী করে সবাই মিলে কোথাও যাওয়া হচ্ছে, গাড়ীর সামনে সেজকাকা, পাশে বাবা গাড়ী চালাচ্ছেন। পিছনে মা আর আমরা তিন ভাই বোন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, একটা গাছে দেখলাম একটা বোর্ড টাঙানো, তাতে লেখা আছে “Block Development Officer”।আমি সেজকাকাকে জিজ্ঞেস করলাম “What does a Block Development officer do?” এক মূহুর্ত্ত দেরী না করে সেজকাকা হেসে বললেন “কি আবার? He blocks development!”

আমি হেসে বললাম “এটা তো বাবা একটা ওভারবাউন্ডারী হাঁকালেন!”

মুকু খবর দিলো ঝর্ণা দি মারা গেছেন কয়েক দিন আগে। তোমরা যারা ঝর্ণা দি’কে চেনোনা, তাদের জানাই যে তিনি মুকুদের বদুমামার স্ত্রী ছিলেন। মুকুর মামাদের মধ্যে বদুমামা আর নিতুমামা দুই ভাই সব চেয়ে ছোট ছিলেন, নিতু মামা বিয়ে করেননি, বদু মামার বিয়ে হয়েছিল আমাদের উষাপিসীর মেয়ে ঝর্ণাদি’র সাথে,ওঁদের দু’জনের কোন সন্তান ছিলনা।  বামুনপাড়ায় শেষের দিকে যখন ওঁদের সাথে দেখা করতে যেতাম, তখন বদু মামা আর নিতু মামা চলে গেছেন, সেই বিশাল বাড়ীতে শুধু থাকতেন ঝর্ণা দি আর রাদুমামার স্ত্রী। দুজনেই শয্যাশায়ী। তাদের দেখা শোনা করতো বড়মামার মেয়ে কেয়া – সেও বিয়ে করেনি।

রাদুমামীমা আর ঝর্ণাদি দু’জনেই  চলে যাবার ফলে এখন কেয়া একা হয়ে গেল।  বড়মামার ছেলে ঢুন্ডি কাছেই থাকে। তার ছেলের বিয়েতে মুকুরা সামনের নভেম্বরে কলকাতায় আসবে, তখন ওরা সবাই মিলে বাড়ীটা নিয়ে কি করবে তার সিদ্ধান্ত নেবে।

মনোহরপুকুরের বাড়ীটার মত বামুনপাড়ার বাড়ীটাও হয়তো হাতবদল হবে, সেখানে নতুন একটা বিশাল বাড়ী তৈরী হবে। ওই বাড়ীটার সাথে আমার ও অনেক স্মৃতি জড়িত, বাড়ীর সামনে একটা গলি, তার শেষে একটা গেট আর গেট দিয়ে ঢুকে এক চিলতে জমি। সেই জমিতে আমার কম বয়সে নিতু মামা বদুমামারা কালীপূজোয় বাড়ীতে তৈরী বসন তুবড়ী জ্বালাতো, তার ফুলকি উঠে যেতো তিন তলার ছাদ ছাড়িয়ে অনেক ওপরে। 

মনোহরপকুরের বাড়ীর মত ওই বাড়ীতেও এক সময় খুব হৈ হুল্লোড় হয়েছে।

সোনুদের গুরগাঁওতে সম্প্রতি হরিয়ানার Assembly election হয়ে গেল। এবং জম্মু কাশ্মীরেও পরে পরেই। সোনু রাজনীতির অনেক খবর রাখে, সে বললো হরিয়ানায় এবার কংগ্রেস জিতবে।  কাশ্মীরেও NC কংগ্রেস জোটের জেতার সম্ভাবনা। বি জে পির সময়টা গত লোকসভার পর থেকে ভাল যাচ্ছেনা। মোদী ম্যাজিক ভ্যানিশ। ভালোই, মাঝে মাঝে সরকার পালটানো দরকার। কেউই অপরিহার্য্য নয়।

এর মধ্যে দ্বিতীয় রাউন্ড বিয়ার আর জিন এসে গেছে। আমাদের ছোটবেলায় বাবা কাকারা বাড়িতে কোনদিন ড্রিঙ্ক করেননি। ব্যাপার টা সেই যুগে ভদ্রসমাজে ভাল চোখে দেখা হতোনা।

সোনু গল্প করলো, একবার অনেক দিন আগে, সোনা কাকা তখন সিমলার কাছে চেল নামে একটা জায়গায় পোস্টেড। শীতকাল, প্রচন্ড ঠান্ডা, চারিদিকে বরফ পড়ছে, বাড়ীর ভিতরে সোনাকাকার কিছু সহকর্ম্মী Army officer এসেছেন, সবাই মিলে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে গা গরম করার জন্যে ব্র্যান্ডি আর হুইস্কী পান চলছে, এমন সময় হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে কাঁপা কাঁপা মেয়েলী গলায় কে যেন”সোঁনাকাঁকু,সোঁনাকাঁকু” বলে ডেকে উঠলো। ডাকটা সোনু বেশ সুন্দর নকল করে শোনালো আমাদের সেদিন, সে অভিনয়টা বেশ ভালই করে বুঝলাম।

এই ভর সন্ধ্যে বেলা যাদের নাম করতে নেই, সেই সব অশরীরী আত্মারা কেউ নাকি? “বাবার একটু ভূতের ভয় ছিল  বেশ কয়েকবার ওই খনখনে কাঁপা কাঁপা গলায় ”সোঁনাকাঁকু,সোঁনাকাঁকু”ডাক শোনার পরে বাবা আমায় বললো, “সোনু যা তো দরজা টা একটু ফাঁক করে দ্যাখ্‌ তো কে আমায় ডাকছে?”

যাই হোক, দরজা খুলে দেখা গেল, শিখা আর শঙ্কর। কিছুদিন আগে ওদের বিয়ে হয়েছে, বোধহয় হানিমুন করতেই ওদের সিমলায় আসা। কিন্তু এই বরফ পড়ায় ওরা কিছুটা বিপদে পড়ে গেছে।

ওরা দুজন সোনাকাকীমার দেওয়া শুকনো জামাকাপড় পরে নেবার পরে সবাই মিলে গল্প করছে, সোনাকাকা সোনু কে বললেন “নতুন জামাই কে তো আমি হুইস্কি অফার করতে পারিনা, তুই বরং ওদের দু’জনকে এই Glenfiddich এর নতুন বোতলটা দিয়ে আয়। আমাদের বুড়োদের সাথে তোরা ছোটরাও একটু গা গরম করে নে।“

সোনাকাকা এরকমই দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন।

শঙ্কর নাকি কিছুতেই নতুন শ্বশুরের সামনে হুইস্কি খাবেনা, তার নাকি ভীষন লজ্জা করবে…সোনু এবার শঙ্করের সেই লজ্জিত ভঙ্গীর পার্ট টাও নিখুঁত অভিনয় করে দেখালো আমাদের।

শেষ পর্য্যন্ত সেদিন ওরা নাকি বোতলটা প্রায় শেষ করে দিয়েছিল।

বেলা প্রায় দু’টো বাজে, আমাদের ড্রিঙ্ক শেষ, মুকু আমাদের পাশে একটা সাজানো গোছানো রেস্তোঁরা তে লাঞ্চে নিয়ে গেল। সেখানে তিন জনে বসে খেতে খেতে মুকু বললো “কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় আমরা সাঁতার কেটে এখানে খেতে বসেছি, এমন সময় হঠাৎ চৈতীর ছেলে সুমন – ও অন্য একটা টেবিলে কারুর সাথে খাচ্ছিল – আমাদের কাছে এসে বলল “মুকুমামা আমায় চিনতে পারছো?”

“চিনতে পারবোনা কেন? কবে দিল্লী এসেছিস? বাড়ীতে আয় একদিন!” ওকে বলেছিল মুকু। আমাদের বারেন্দ্র দের যৌথ পরিবারের লতায় পাতায় এই সব কিছুটা দূরের সম্পর্কের মধ্যেও কিরকম গভীর আত্মীয়তার টান থেকে যায়!

সুমন কাজে মাঝে মাঝে অল্প দিনের জন্যে দিল্লী আসে, এবার হঠাৎ মুকুমামার সাথে দেখা হয়ে যাওয়াতে সে খুব খুসী।

সোনু বললো “সুমনের মত ভাল ছেলে চট করে দেখা যায়না, he is a gem…”

বেশ কয়েকবছর আগে মঙ্গল আর রুণার বড় ছেলে মটরবাইক কিনে একাই সেই নতুন বাইকে চেপে ব্যাঙ্গালোর থেকে তিরুপতি যাচ্ছিল। পথে একটা ট্রাকের ধাক্কায় সে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে শেষ পর্য্যন্ত মারা যায়। মঙ্গল আর রুমা খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানিপত্‌ থেকে দিল্লী আসে। সোনুর ছেলে তনুজ তখন ব্যাঙ্গালোরে, তার কাছ থেকে খবর পেয়ে সুমন – তখন সে কোন এক এয়ারলাইনে কাজ করতো – Spicejet কিংবা Go Air ঠিক মনে নেই – তাদের সাথে কথা বলে দু’জন  passenger কে offload করে ওদের ব্যাঙ্গালোর নিয়ে আসে, এবং শুধু তাই নয়, সেই এয়ারলাইনের গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট থেকে মঙ্গল আর রুণা কে প্রথমে accident site ও পরে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্তও করে।

প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন সম্ভাবনাময় তরুণ সন্তানের এরকম অকাল্মৃত্যু মঙ্গল আর রুণার মনে কতটা আঘাত হেনেছিল তা সহজেই কল্পনা করা যায়। পাঞ্জাবের পানিপত্‌ শহরে চলে যাবার পরে ওরা এমনিতেই পরিবারের বাকি সবার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল,এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পরে এখন তারা আরও অনেক বেশী চুপচাপ হয়ে গেছে।

তবে মুকু আর সোনু দু’জনেই বললো মঙ্গল আর রুণা পানিপতে এখন তাদের নিজেদের হার্ট এর হাসপাতাল খুলেছে, এবং সেই হাসপাতাল নাকি খুব ভাল চলছে সেখানে। মুকু ওকে পাটনায় নিজেদের বাড়ীতে ক্লিনিক খোলার কথা বলেছিল, কিন্তু কোন কারণে সে আর পাটনায় আসতে চায়না।

ছোটবেলায় যখন পাটনায় যেতাম, ভাইদের মধ্যে রাঙাকাকাই তখন একমাত্র পাটনায় থাকতেন, তাই কৃষ্ণা শুক্লা বন্টু মঙ্গল এদের সাথেই বাগানে খুব হুটোপাটি করেছি তখন। রাঙাকাকার তিন মেয়ের পরে এক ছেলে হওয়াতে মঙ্গল দাদু আর দিদার খুব ফেভারিট নাতি ছিল মনে পড়ে। তার আদরের শেষ ছিলনা।  ভোজপুরী ভাষায় তাকে সবাই ডাকতো “মঙ্গলওয়া”।

এখন সে সবার কাছ থেকে দূরে থাকে স্বেচ্ছা নির্ব্বাসনে।  

পাটনার অন্যান্য ভাই বোনেদেরও খবরাখবর নিলাম, বিশেষ করে যাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বহুদিন। বড় জ্যেঠুর ছেলে মেয়েরা – দীপা গুণু খোকন যেমন। সবাই নিজের নিজের  মত ভাল আছে জেনে ভাল লাগলো। বড়জ্যেঠুর ছোট ছেলে আমাদের সব চেয়ে ছোট ভাই  লাল্টুর সাথে অবশ্য সম্প্রতি আমার দেখা হয়েছে, মাঝে মাঝে সে আমায় ফোন ও করে আজকাল। লাল্টুর সাথে মনোহরপকুরের ঝুন্টু ভান্টুলী আর টুবলির বেশ ভাল যোগাযোগ আছে, এবং সে দূরে ব্যাঙ্গালোরে থাকলেও আমাদের অনেকেরই বেশ ভাল খোঁজ রাখে।

আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ তো কাউকে চিনবেনা। সম্পর্কে ভাই বোন হলেও তারা পরস্পরের কাছে অচেনা অজানাই থেকে যাবে। সেটাই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে ভাবনার কোন কারণ নেই।

খাওয়া শেষ, এবার বাড়ী ফেরার পালা।

সোনুর তুলনায় মুকু দেখলাম দিল্লীর রাস্তাঘাট অনেক ভাল চেনে। সে নানা রাস্তা আর ওভারব্রীজের ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে গেল। তার homing instinct এর প্রশংসা করতেই হয়। বহুদিন ধরে দিল্লীতে গাড়ী চালাচ্ছে সে।

প্রানী জগতে নানা জীব জন্তুর এরকম অসাধারণ homing instinct দেখা যায়। Monarch butterfly রা মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে বহুদূর গন্তব্যে পৌঁছে যায়। Olive Ridley কচ্ছপেরা প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা নির্দিষ্ট সমুদ্র উপকূলে এসে ডিম পেড়ে বালি দিয়ে ঢেকে সমুদ্রে ফিরে চলে যায়। আর সেই ডিম ফেটে যে বাচ্চারা জন্মায় তারা সমুদ্রে ফিরে যায়, কিন্তু এক বছর পরে ঠিক সময়ে নিজেদের ডিম পাড়তে আবার তারা তাদের জন্মস্থানে ফিরে আসে।

আমাদের গৃহপালিত বেড়ালদের ও নাকি নিজের জায়গায় চিনে ফিরে আসার একটা আশ্চর্য্য ক্ষমতা আছে। এই নিয়ে শিবরাম চক্রবর্ত্তির একটা বিখ্যাত গল্প আছে, যারা পড়োনি তাদের জন্যে এখানে লিখে রাখি।

————-

শিবরাম এর বাড়ীতে একটা বেড়াল আছে, তিনি সেটাকে মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে ফেলে রেখে আসেন, কিন্তু সে দুই তিন দিনের মধ্যেই আবার তার কাছে ফিরে আসে।

একবার তিনি বেড়ালটাকে একটা বস্তার মধ্যে বন্দী করে ট্রেণে করে অনেক দূরে গিয়ে একটা জায়গায় ফেলে দিয়ে আসেন। কিন্তু মুস্কিল হলো এবার তিনি নিজেই রাস্তা গুলিয়ে ফেলে আর নিজের বাড়ী ফিরতে পারছেন না। অগত্যা শেষ পর্য্যন্ত সেই বেড়াল টাকে follow করেই তিনি নিজের বাড়ী ফিরেছিলেন।

কিন্তু বেড়াল তো আর সোজা পথে বাড়ী ফেরেনা। তারা গেরস্থের বাড়ীর দেয়াল টপকায়, বাড়ীর দেয়ালে জলের পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠে, এক বাড়ীর ছাদ থেকে পাশের বাড়ীর ছাদে লাফ দিয়ে চলে যায়।  

শিবরাম যখন বাড়ী ফিরলেন, তখন তাঁর জামাকাপড়ে ধুলো ময়লার কালো দাগ, হাতে কালশিরে পড়েছে, পাঞ্জাবীর হাতা ছিঁড়ে গেছে, হাঁটু ছড়ে রক্ত বেরোচ্ছে, চুল এলোমেলো, তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর মাথার ওপর দিয়ে একটা ঝড় চলে গেছে।

তাঁর প্রতিবেশীরা তো তাঁকে দেখে অবাক। এ কি চেহারা হয়েছে আপনার?

শিবরাম একটু কাষ্ঠহাসি হেসে তাদের বলেছিলেন, “আর বলবেননা, বেড়াল কে অনুসরণ করে বাড়ী ফেরা যে কি কঠিন কাজ, কি বলবো?”  

—————-

মুকু সেই বেড়ালটার মতোই বেশ সাবলীল ভঙ্গী তে পঞ্চশীল পার্কে আমাদের নিয়ে এলো। আমি বললাম, “আজ কিন্তু ৩০ তারিখ, মনে রাখিস তিন নম্বর গেট।“ কুছ পরোয়া নেই ভঙ্গীতে মুকু ঠিক তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে পড়লো।

আমায় নামিয়ে ওরা দু’জন ওপরে উঠে সুভদ্রা আর বুড়ী সৌগত আর ওদের বাচ্চা দের  সাথে দেখা করে এলো। সুভদ্রা বললো “তোমরা আমাদের বৌদের না নিয়ে নিজেরা গিয়ে গল্প করে আসো কেন?কি এত গল্প তোমাদের যা আমাদের বলা যায়না?”

সোনু বললো,”বৌদি, আজ আমরা যে সময়ের কথা বললাম, সেই সময়ে তো তোমরা কেউ ছিলেনা, তাই ওইসব গল্প শুনে তোমাদের ভীষণ বোরিং লাগতো।“

ভেবে দেখলে কথাটা কিন্তু ঠিকই বলেছে সোনু। সারাদিন তিন জনে মিলে কত বোরিং কথা বলে হাসাহাসি করলাম আমরা। আমাদের সাথে মঙ্গলটা থাকলে আরো ভাল হতো, ওর কাছ থেকে আরও এইরকম বেশ কিছু বোরিং গল্প শোনা যেতো।

কিন্তু তা আর হবার নয়। মঙ্গলের সাথে দেখা করতে গেলে আমাদের পানিপত্‌ যেতে হবে।

নালন্দা ট্রিপ, ১৯৮৯, সামনে মঙ্গল বসে , পাশে বুড়ী

অপত্য স্নেহ

মুকুদের Army Officers Golf Club এ চারিদিকে অবারিত আদিগন্ত সবুজ  গলফ কোর্স । খোলা আকাশের নীচে ক্লাবের outdoor restaurant, চারিপাশে অনেক গাছপালা, তাদের পাতার মাঝখান দিয়ে ঝিলিমিলি রোদ্দুর, মরশুমী ফুলের বাগান। সেই রেস্টুরেন্টের  নিরিবিলি কোণ বেছে নিয়ে একটা টেবিলে আমরা দুজনে বীয়ার নিয়ে মুখোমুখি বসে আড্ডা মারি। শীতের সকাল, নরম সোনালী রোদ, পরিবেশটা খুব সুন্দর, আমি আমার মনের মধ্যে বেশ একটা ফুরফুরে আনন্দের ভাব টের পাই। 

মুকুদের ক্লাবের চারিদিকে সাদা উর্দ্দি পরা মাথায় পাগড়ী পরা অধস্তন কর্ম্মচারীরা কাজ করছে, কেউ রিসেপশন কাউন্টারে, কেউ রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, কেউ আবার মালী। Army তে rank ব্যাপারটা খুব important, তাই Army officer দের তুলনায় এই সব কর্ম্মচারীরা একটু নীচের তলার লোক।

উত্তর ভারতে হিন্দী belt এর প্রদেশ গুলোতে “বেটা” কথাটা নিজের ছেলেমেয়েদের অথবা ছোটদের ভালবেসে বলা হয়।

হাঁ বেটা, নেহী বেটা, উধর যাও বেটা, ইধর আও বেটা ইত্যাদি।

আমি দেখলাম মুকু অক্লেশে এই সব উর্দ্দী পরা মাঝবয়েসী এমন কি বেশ বুড়ো ওয়েটারদেরও  আদর করে “বেটা” বলে সম্বোধন করছে, এবং তার কাছ থেকে এই  পুত্রসদৃশ স্নেহের ব্যবহার পেয়ে তাদেরও কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। অফিসারদের কাছ থেকে এই অপত্যস্নেহ পাওয়া তাদের কাছে নতুন কিছু নয়, এতে তারা বেশ অভ্যস্ত বলেই মনে হয়।

এই নিয়ে মুকুর একটা গল্প আছে।

—————-

মুকুর মেয়ে মণিকা Institute of Mass Communication এ admission পেয়েছে, এখানে admission পাওয়া সোজা নয়, খুব কম লোকেই পায়।  মুকু তার সাথে ব্যাঙ্কে গেছে admission fee pay করতে। সেখানে গিয়ে দেখে বিশাল লম্বা লাইন। অন্ততঃ ঘন্টা দুয়েক লেগে যাবে লাইনের সামনে পৌঁছতে।

মুকু মণিকা কে বলল, “থাক্‌ তোর আর এখানে ভর্ত্তি হতে হবেনা, তুই বরং বরোদাতে গিয়ে Art History নিয়ে MA পড়তে যা, সেখানে এরকম লাইন দেবার ব্যাপার নেই, আমি টাকাটা ব্যাঙ্ক ট্র্যান্সফার করে দেবো।”

এই সব কথা হচ্ছে, এমন সময় একটি উর্দ্দি পরা ব্যাঙ্কের দারোয়ান এসে মুকু কে বললো “সাব্‌, আমায় চেক লিখে দিন্‌, আমি আপনার টাকা জমা দিয়ে রিসিট এনে দিচ্ছি”।

আমি মুকু কে বললাম, “কে লোকটা?”

মুকু বললো, “শোন্‌ না! আমি তো চেক লিখে দিলাম, ভাবলাম  account payee cheque, কি আর করবে? দেখাই যাক না”।

মিনিট দশেক পরে লোকটা এসে মুকুকে টাকার রিসিট দিয়ে একটু দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললো, “আপ মেরেকো পহচানা নেহী, সাব্‌?”

মুকু অফিসার সুলভ পুত্রস্নেহে বিগলিত হয়ে লোকটাকে বললো “নেহী বেটা, ম্যায় পহচানা নেহি, কৌন হ্যায় তুম্‌?”

লোকটা বললো, “ম্যায় ভরতপুর মে আপকা আর্দালী থা”, তার পর মণিকাকে দেখিয়ে, “বেবী কো ম্যায় হী সাইকেল চালানা সিখায়া…”

————–

বীয়ার নিয়ে দুজনে আরাম করে বসে গল্প করছি, এই সময় এই সুন্দর বাগান কে ব্যাকগ্রাউন্ড করে আমাদের একটা ছবি তোলা যায়না?

আমি মুকু কে বললাম কাউকে একটু বল্‌ না আমাদের একটা ছবি তুলে দেবে।

দূর থেকে একজন বেশ প্রৌঢ় ওয়েটার আসছিল, তার মাথা ভরা পাকা চুল, সাথে আবার বেশ বাহারী সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

সব্বোনাশ, মুকু কি এই বুড়ো লোকটাকেও “বেটা” বলে ডাকবে নাকি?

যা ভেবেছি তাই।  

মুকু ওই ফ্রেঞ্চকাট লোকটাকে ডেকে বললো, “বেটা, ইধার আও!”

লোকটা কাছে এসে বশংবদের মত এসে দাঁড়িয়ে বললো, “জী সাব্‌!”

মুকু তাকে স্নেহমিশ্রিত স্বরে বললো, “হমারে এক ফোটো খিঁচ দো বেটা…”

কোয়েলিয়া গান থামা এবার

আজকাল সুভদ্রা আর আমি মাঝে মাঝে দিল্লী যাই।  সেখানে আমাদের ছোট মেয়ে বুড়ী থাকে, আমরা মেয়ে জামাই আর নাতি নাতনীদের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে আসি। দিল্লী গেলেই মুকুর সাথে দেখা হয়, আর আমরা নিয়ম করে একদিন কিছুক্ষণ একসাথে কাটাই।

মুকু আমাকে ওর গাড়ীতে তাদের Army Officers Golf Club এ নিয়ে যায়। রাস্তায় গাড়ী চালাতে চালাতে মুকু অনর্গল কথা বলে যায়। তার অনেক গল্প। আর সেই কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মুকু মাঝে মাঝে বেশ কিছু গানের দুই এক কলি নিজের মনেই গেয়ে ওঠে।

মুকু সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে সে একজন সঙ্গীতরসিক, এমন কি ভাল বাংলায় তাকে সঙ্গীতপিপাসু ও বলা যায়। একটু সুযোগ পেলেই সে কিছু গান গুণগুণ করে গাইবেই। আর একটা আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো যে জীবনটা প্রায় সবটাই বাংলার বাইরে কাটালেও তার প্রিয় গান গুলো সবই বাংলা গান। স্কুলের উঁচু ক্লাসে (ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেন ১৯৬০-৬৩) পড়ার সময়ে সে তিন বছর কলকাতায় ছিল। সেটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। সেই সময়ের বহু বাংলা গান মুকুর এখনো বেশ মনে আছে, গত বছর সে গাড়ী চালাতে চালাতে স্টিয়ারিং এ তবলা বাজাতে বাজাতে গাইছিল মান্না দে’র আমি যামিনী তুমি শশী হে…

এবার তার গলায় শুনলাম দুই ভাই সিনেমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত সুপারহিট গান “তারে বলে দিও সে যেন আসেনা আমার দ্বারে”…ওই গানের একটা interlude আছে গানের মাঝখানে বিশ্বজিৎ (রাধাকান্ত নন্দী) হঠাৎ তবলা বাজানো বন্ধ করবে আর উত্তমকুমার (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) বলবে “কি রে থামলি কেন, বাজা?”

ট্র্যাফিক জ্যামে গাড়ী আটকে গেলে বা ট্র্যাফিক লাইটে গাড়ী থামলেই মুকু আনমনে গান থামিয়ে বলে উঠছে, “কি রে থামলি কেন, বাজা?”

এই গান গাওয়া নিয়ে মুকুর একটি গল্প আছে, এর থেকে তার self mocking  আর self deprecating persona সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যাবে।

————-

একবার বহুদিন আগে পঞ্চাশের দশকে (মুকুর বয়েস তখন সাত কি আট বছর) জ্যেঠুরা তখন পান্ডারা রোডে থাকেন, সবাই মিলে টাঙ্গা চড়ে বিপু মামার বাড়ীতে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ীতে জ্যেঠিমা (মুকুর মেজমা) ও আছেন।

মুকুর সব গল্প শুনলেই সেগুলো মনের মধ্যে একটা ছবির মত ফুটে ওঠে। ওর গল্প বলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক দক্ষতা আছে।

আমি শুনছিলাম আর মনে মনে কল্পনা করে নিচ্ছিলাম সেই সময়কার পান্ডারা রোড, নির্জ্জন, গাছের ছায়ায় ঢাকা, তার মধ্যে টাঙ্গা চলছে, ঘোড়ার খুরের খট্‌খট্‌ আর গাড়োয়ানের জিভ দিয়ে তোলা টক্‌টক্‌ আওয়াজ শোনা যায়, তার সাথে মাঝে মাঝে স্পীড বাড়ানোর জন্যে ঘোড়ার পিঠে আলতো করে মারা চাবুকের সপ্‌সপ্‌ শব্দ।

ছোটবেলায় এক সময়ে কত টাঙ্গায় চড়েছি, দিল্লী পাটনা লক্ষ্ণৌ কাশী এই সব শহরে। এখন আর কোথাও টাঙ্গা চলেনা, তার জায়গায় এখন অটো আর রিক্সা।

যাই হোক, টাঙ্গায় যেতে যেতে মুকু – সে সেই অল্পবয়েস থেকেই সঙ্গীতপিপাসু –    জ্যেঠিমা কে বললো, “মেজমা তুমি একটা গান গাও না!”

জ্যেঠিমা বললেন, “আমি তো গান গাইতে পারিনা মুকু, বরং তুই একটা গান গা’ না”।

এখন মুকু হচ্ছে এমন একজন ছেলে যাকে গান গাইতে বলার দরকার হয়না, সে এমনিতেই নিজের উৎসাহেই গান গেয়ে যায়। সুতরাং বলা বাহুল্য জ্যেঠিমা বলার সাথে সাথে সে একটা গান গাইতে শুরু করে দিলো।

“কি গান গাইলি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কিছু দিন আগে শুমার কাছ থেকে শুনে এই গানের সুরটা তার খুব ভালো লেগেছে। সে গাইতে শুরু করে দিলো “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো…”

মুকু আমায় বললো , “আমি বেশ ভালোই গান টা শুরু করেছিলাম, বুঝলি, কিন্তু দুই লাইন গাইবার পরেই আমার মাথায় এক বিরাট চাঁটি ”…

চাঁটি? আমি বললাম “সে কি রে, কে মারলো?”

মুকু বললো, “কে আবার? বাবা…”

মুকুর পাশে বসেছিলেন জ্যেঠু, তিনি নাকি মুকুর মাথায় এক চাঁটি মেরে বলেছিলেন, “এই ভর দুপুরে চাঁদের আলো! যত্ত সব ইয়ার্কি, হুঁঃ! তোকে আর গান গাইতে হবেনা, ঢের হয়েছে, থামা তোর গান। ”

———————

মুকু, আমি ও কুতব মিনার

১৯৫৩ সাল, আমার সাত বছর বয়েস, মা’র সাথে বাবার কাছে দিল্লীতে গিয়েছি। সেই প্রথম আমার দিল্লী যাওয়া।


নিখিল জ্যেঠু (আমরা বলতাম দিল্লীর জ্যেঠু) তখন দিল্লীতে পোস্টেড, সফদরজং এনক্লেভে ওঁর বিরাট বাগানওয়ালা বিশাল কোয়ার্টার, সেখানে গিয়ে প্রথম মুকুর সাথে আমার দেখা।


মুকু সেই ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত আর দামাল, সব সময় দুদ্দাড় করে ছুটে বেড়াচ্ছে, সেই তুলনায় আমি শান্ত, লাজুক আর ভীতু, বিশেষ করে নতুন জায়গায় নতুন লোকজনেদের সাথে একেবারেই মিশতে পারিনা, ফলে ওনাদের বাড়ী গেলে শুমা আর জ্যেঠু আমায় অনেক আদর করা সত্ত্বেও আমি মা’র আঁচলের পিছনে লুকিয়ে থাকি।


তার ওপরে মুকুদের বাড়িতে একটা বিরাট অ্যালশেসিয়ান কুকুর আছে, তার নাম তোজো, তাকে  আমি ভীষণ ভয় পাই। সব মিলিয়ে মুকুদের বাড়িতে যেতে আমার মোটেই ভাল লাগেনা।
যাই হোক, এক ছুটির দিন সবাই মিলে কুতব মিনার যাওয়া হবে, জ্যেঠুর গাড়ীতে পিছনের সীটে বসে আছি মুকু আর শিখার সাথে, শিখা তখন ছোট্ট মেয়ে, চার কি পাঁচ বছর বয়েস, পুটপুট করে দুই ভাই বোনে ইংরেজীতে কি যে কথা বলে যাচ্ছে, আমার মাথায় কিছুই ছাই ঢুকছেনা, আমি চুপ করে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি।


Feeling quite left out and ignored যাকে বলে!


কিছুক্ষণ পরে মুকু আর শিখা হঠাৎ “কুতব মিনার কুতব মিনার” বলে চ্যাঁচাতে শুরু করলো।
ব্যাপারটা কি ?


আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গাঢ় লাল রং এর বেশ উঁচু একটা টাওয়ার, তলাটা মোটা, খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা দেয়াল, লম্বা হয়ে ছোট হতে হতে ওপরে উঠে গেছে, মাঝে মাঝে কিছু গোল বারান্দা, তাতে বেশ কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে নীচ থেকে দেখা যায়।


এটাই কুতব মিনার নাকি ?


লোক গুলো ওই ওপরের বারান্দায় উঠল কেমন করে ? হাঁচোড় পাঁচোড় করে ওই খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা দেয়াল বেয়ে নাকি ?


সব্বোনাশ! আমার দ্বারা ও কাজ জীবনেও হবেনা।


জ্যেঠু বললেন, “কে কে কুতব মিনারে চড়বে, হাত তোলো।” মুকু তো সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে ready, ওদিকে ছোট্ট শিখাও দেখি হাসিমুখে হাত তুলে বসে আছে।


আমি তো অবাক, এ কি রে ? এইটুকু মেয়ে, সে কিনা ওই লম্বা টাওয়ারের গা বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠবে? সাহস তো কম নয় ? জ্যেঠু আর শুমার ও তো তাই নিয়ে কোন চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছেনা!
আমি মনে মনে কল্পনা করলাম দুরন্ত মুকু হাঁই পাঁই করে লাফিয়ে লাফিয়ে ওই দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে, আর তার পিছন পিছন হামাগুড়ি দিয়ে শিখা…


আমি আর হাত তুলছিনা, চুপ করে বসে আছি! তোমরা যত ইচ্ছে ওঠো বাবা, আমি ওতে নেই । শুমা বললেন “মান্টুবাবুর কি হলো ? তুমি কুতব মিনারে চড়বেনা ?”


আমি চুপ।


কিন্তু পরে সামনে গিয়ে দেখি ও হরি, ভেতরে তো দিব্বি ওপরে ওঠার সিঁড়ি!


তখন আর আমায় পায় কে ? মুকুর সাথে আমিও দুদ্দাড় করে ওপরে উঠে গেলাম। তখন ভেতরটা বেশ অন্ধকার, সরু, ঘুলঘুলি দিয়ে অল্প আলো আসছে, উত্তাল স্রোতের মত ওই একই সিঁড়ি দিয়ে লোক উঠছে আর নামছে তার মধ্যে দিয়েই আমরা দুজন প্রায় দৌড়ে উঠছি, এ যেন বেশ একটা মজার খেলা! তখন তো আর এখনকার মতো হাঁটু কনকন আর কোমর টনটন নেই, শরীরের কলকব্জা সব brand new, ফুসফুসে অফুরন্ত দম!


একেবারে ওপরের বারান্দায় উঠে গিয়েছিলাম আমরা দু’জনে। সেখান থেকে নীচটা খুব সুন্দর দেখায়, সাজানো বাগান, প্রচুর ফুল ফুটে আছে।

আর দূরে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় দিল্লী শহরের ঘরবাড়ী, আর দিকচক্রবালে সবুজ বনানী।


সেই বিকেল টা এখনো খুব মনে পড়ে।


মুকুর সাথে সেই দিন থেকে আমার ভাব।

সুতা হ্যায় সুতা?

ইদানীং আমাদের দেশে বাংলায় কথা বললে বাংলার বাইরে বাঙালীদের হেনস্থার কথা শোনা যাচ্ছে। নীচের এই গল্পটা তাই নিয়ে, যদিও এটা অনেক দিন আগের কথা, তখন দেশে বাঙালীদের এত হেনস্থা হতোনা।

মাধবকাকা ছিলেন আমাদের বাবা কাকাদের পিসতুতো ভাই।  তাঁর মা অর্থাৎ আমাদের বাবাদের পিসীমা ছিলেন  দাদুদের একমাত্র এবং সবচেয়ে ছোট বোন, এবং তাই তাঁর দাদাদের খুব আদরের। তাঁর বিয়ে হয় কলকাতার কাছে  উত্তরপাড়ার লাহিড়ী পরিবারে। তাঁর সন্তানদের মধ্যে মাধবকাকা – মেজ ছেলে – কোন কারণে আমাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।  তাঁর হাসিখুশী  সুন্দর স্বভাবের জন্যে বাবা কাকারা এবং মা কাকীমারা সবাই মাধবকাকাকে খুব স্নেহ করতেন।

 মাধবকাকা আমাদের পরিবারের  সকলের খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। এই গল্পটা তাঁকে নিয়ে। তবে এর কতটা সত্যি আর কতটা বানানো, আমি জানিনা।  

————————–

মাধব কাকা দিল্লী বেড়াতে এসে তাঁর মামাতো দাদা আমাদের নিখিল জ্যেঠুর Green Park Extension এর বাড়ীতে উঠেছেন।  নিখিল জ্যেঠুর স্ত্রীর নাম শুভা, আমরা ছোটরা তাঁকে শুমা বলে ডাকি।

দিল্লী শহরে কত কি দেখার আছে, কুতুব মিনার, লাল কেল্লা, জামা মসজিদ। এই সব জায়াগা গুলো ভাল করে দেখার জন্যে মাধবকাকা একাই রোজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েন, সন্ধ্যায় ফেরেন।

একদিন সকালে মাধবকাকা বাইরে বেরোবেন, এমন সময়  শুমা বল্লেন “মাধব ঠাকুরপো, আপনার জামার দু’টো বোতাম খুলে গেছে দেখছি, আপনি আজ ফেরার সময় দোকান থেকে একটু সুতো কিনে আনবেন তো, আপনার জামার ওই বোতাম দু’টো আমি সেলাই করে দেবো।”

এ দিকে হয়েছে কি, মাধবকাকা হিন্দী টা ভালো জানেন না। সুতোর হিন্দী কি? মাধবকাকা র কেবল মনে পড়ছে “রসসি”! কিন্তু রসসি মানে তো দড়ি? একটা দোকানে ঢুকে মাধবকাকা জিজ্ঞেস করলেন “রসসি  হ্যায়, রসসি?” তারপর আর একটু ভালো করে বোঝাবার জন্যে বল্লেন “পাতলা রসসি, সেলাই করনে কে লিয়ে!”

দোকানদার এর মাথায় কিছুই ঢুকলোনা।

তারপর আর একটা দোকান। মাধবকাকা ভাবলেন সংস্কৃত টা হিন্দীর কাছাকাছি, হয়তো “রজ্জু” বললে বোঝানো যাবে। দোকানদার যদি উপনিষদ পড়ে থাকে তাহলে “রজ্জুতে সর্পভ্রম” কথাটা জানে নিশ্চয়। মাধবকাকা সেখানেও অনেক কষ্ট করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। “সেলাই করনে কে লিয়ে পাতলা সরু রজ্জু হ্যায় ?” কিন্তু দোকানদার দের সংস্কৃত জানা নেই, উপনিষদ পড়া তো দূরের কথা।

দোকানে দোকানে ঘুরে ব্যর্থমনোরথ ক্লান্ত মাধবকাকা শেষে একটা দোকানে ঢুকে ভাবলেন নাঃ, বাংলাতেই চেষ্টা করা যাক। সুতো কথাটা যতোটা পারা যায় হিন্দী তে উচ্চারণ করে মাধবকাকা দোকানদার কে বললেন “সুতা হ্যায়,সুতা?”

দোকানদার ভদ্রলোক একটু হেসে পরিস্কার বাংলায় বললেন “দাদা, আপনি সুতো চান তো? বাংলা তে ই বলুন না,আমরা এখানে সবাই তো বাঙালী”।

গোবিন্দ

কয়েকমাস আগে দিল্লী গিয়েছিলাম।

শুনেছিলাম  East of Kailash এ ISKCON এর মন্দির, তার পাশে গোবিন্দ (Govinda) বলে একটা Vegetarian restaurant আছে, সেখানে খাবারটা নাকি বেশ ভাল।

তো ওইদিকে একটা কাজে গিয়েছিলাম, ভাবলাম মন্দিরটা দেখেই যাই, আর তাহলে গোবিন্দতে গিয়ে খেয়েও আসা যাবে।

নিরামিষ খাবারই আজকাল ভাল লাগে খেতে।

যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় দুটো বাজে, মন্দির বন্ধ, চারটে তে খুলবে, কিন্তু restaurant খোলা। আমরা ভেতরে গিয়ে বসলাম। বেশ বড় Air-conditioned হল, অনেক চেয়ার টেবিল, ওই সময়ে মোটামুটি খালি।

একপাশে বিরাট Buffet এর আয়োজন, আর হলের ভেতরে কিছু সাত্ত্বিক ধরণের লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সবার পরণে সাদা ধুতি কামিজ, কপালে বড় সাদা তিলক, দেখে মনে হয় সবাই পূজারী ব্রাম্ভণ, পূজো করতে করতে উঠে এসেছে কিংবা একটু পরেই পূজো করতে যাবে!

তাদের মধ্যে থেকে একজন ভক্ত হনুমানের মত হাত জোড় করে সামনে এসে দাঁড়ালো।

এই কি waiter নাকি?

সত্যিই তাই, দেখা গেল এখানে waiter দের ওটাই uniform!

যাই হোক খাওয়া দাওয়া ভালই হলো। শেষ করে বিল মিটিয়ে উঠবো ভাবছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক, দেখেই বোঝা যায় বাঙ্গালী, গলায় একটা মস্ত বড় ভিক্ষার ঝুলি, কপালে বিরাট তিলক, মনে হলো ইনি বোধহয় Restaurant এর Manager, আমাদের দেখে কাছে এসে একগাল হেসে হাত জোড় করে অত্যন্ত বিনয়ী অমায়িক ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করলেন, “খানা ক্যায়সা লাগা?”

সুভদ্রা বললো, “খুব ভাল লাগা, আপনি বাঙ্গালী?”