
১) মুখবন্ধ
ডিসেম্বর ৭, ২০০৭।
সেই দিন কুয়েতে সালমিয়ার ভারতীয় স্কুলের অডিটোরিয়ামে বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক সমিতি (বি সি এস) এর উদ্যোগে আমরা বাদল সরকারের বিখ্যাত নাটক “এবং ইন্দ্রজিৎ” সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ করেছিলাম।
সেই বছর সমিতির সভাপতি তাপস (বসু) যখন আমায় নাটক পরিচালনার ভার দিলে্ন, তখন আমি এই নাটকটিকেই বেছে নিয়েছিলাম। তার প্রধান কারণ অবশ্যই এই যে প্রায় চল্লিশ বছর আগে (১৯৬৫) লেখা এই নাটকটি কে এখনো বাংলায় লেখা সর্ব্বকালের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক নাটকের প্রথম পাঁচটি মধ্যে একটি বলে ধরা হয়।
বাদল সরকারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি তিনি লেখেন প্রবাস জীবনে, নাইজেরিয়ায় থাকতে ১৯৬৩ সালে। আর নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৫ সালে কলকাতায়।
বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক – দুই দিক থেকেই নাটকটি নিঃসন্দেহে বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি দিকচিহ্ন হিসেবে নিজের পরিচিতি আদায় করে নিয়েছে। এই নাটকটি ইংরেজী এবং নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং সারা দেশে এটি এখনো নিয়মিত অভিনীত হয়ে থাকে। নাটকটি নিয়ে অনেক্ লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে, এবং শুনেছি কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের এম এ ক্লাসের পাঠ্যতালিকায়তেও এই নাটক টি স্থান পেয়েছে।
নাটকটি পছন্দ করার আর একটি কারণ ছিল এই যে ১৯৬৬ সালে – তখন কলেজে পড়ি এবং নাটক দেখায় তখন দারুন নেশা – কলকাতায় রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্ত অঙ্গন প্রেক্ষাগৃহে এক সন্ধ্যায় শৌভনিক গোষ্ঠীর প্রযোজনায় ওই নাটকটি দেখে আমি মুগ্ধ আর অভিভূত হয়েছিলাম, সেই ভাল লাগা আর মুগ্ধতা কুয়েতের বাঙালী বন্ধুদের মনে পৌঁছে দিতে আমার গভীর আগ্রহ ছিল।
অবশ্য মনে একটু দুশ্চিন্তাও যে ছিলনা তা বলবোনা। নাটকটি বেশ কঠিন এবং দুর্ব্বোধ্য, তাই আগে থেকে একটু তৈরী হয়ে না এলে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে নাটকটি সাধারণ দর্শকদের ভাল না লাগারই সম্ভাবনাই বেশী। সাধারণত; কুয়েতে আমরা প্রতি বছর আমাদের দর্শকদের বিনোদন হিসেবে একটি হালকা হাসির নাটকই পরিবেশন করতাম।
এই নাটকে সেরকম কোন গল্প নেই, কোন হাসি গান বা মজার দৃশ্য বা সংলাপ নেই। এখানে নেই কোন নাটকীয় সংঘাত, অথবা কোন নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স। এই নাটক হলো মধ্যবিত্ত মানুষের সাধারণ জীবনের কথা, নীরবে বয়ে চলা নিস্তরঙ্গ নদীর মত সেই জীবন, এবং তারই টুকরো টুকরো ছবি।
তবু কেন জানিনা আমাদের দর্শকদের শিল্পবোধের ওপর আমার আস্থা ছিল। আমার মনে হয়েছিল, যে নাটকটি তে নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের যে যান্ত্রিক এবং নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা গতানুগতিক দিকটা ফুটে উঠেছে, তার সাথে গড়পড়তা কুয়েতের সব বাঙালী দর্শকই কমবেশী পরিচিত। এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটিতে আমাদের সকলের জীবনের কথাই বলা হয়েছে। তাই এই নাটকের সাথে আমরা আমাদের জীবনের মিল খুঁজে পাবো।
আমি জানতাম এবং ইন্দ্রজিৎ কুয়েতের দর্শকের ভাল লাগবে, এবং শেষ পর্য্যন্ত তাই হয়েওছিল।
নাটকটি যে আমাদের দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলবে তা আমি বুঝি নাটকের মহড়ার সময়ে। একমাত্র নুপূর (রায়চৌধুরী – মাসীমা) ছাড়া এই নাটকে যারা অভিনয় করেছিল তারা সকলেই বয়সে তরুণ। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই নাটকটি যখন লেখা হয় তখন এদের কারুর জন্ম হয়নি। প্রথম দিকে চল্লিশ বছর আগে লেখা নাটকটির আজকের যুগে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমার মনে কিছুটা সংশয় ছিল তা ঠিক। কিন্তু চার মাস মহড়া দেবার সময় লক্ষ্য করলাম বয়সে তরুণ এই ছেলেমেয়েদের নাটকটির প্রতি আকর্ষন ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ওদের উৎসাহ একটা সময়ে এসে আমার উৎসাহ কেও অতিক্রম করে গেছে।
তবু সাবধানের মার নেই ভেবে আমি নাটকটি মঞ্চস্থ হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বি সি এসের website এ নাটকটির বিষয় বস্তু নিয়ে অনেক লেখালেখি ও আলোচনা করেছিলাম। যাতে সেই সব লেখা পড়ে আমাদের সমিতির সভ্যরা নাটক দেখতে আসার আগে কিছুটা মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে আসে।
ইংরেজীতে একটা কথা আছে – “Fools dare where angels fear to tread” – আমিও সেরকম কিছুটা দুঃসাহসী হয়ে কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল, কেননা আমাদের দর্শকরা নাটকটি মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেছিলেন, এবং নাটকের শেষে তাঁরা আমাদের প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

২) অমল, বিমল, কমল, ইন্দ্রজিৎ আর মানসী
নাটকটিতে মূল চরিত্র সাতটি। তাদের মধ্যে দু’জন – লেখক আর মাসীমা – হলেন রক্তমাংসের মানুষ, অর্থাৎ জীবন্ত চরিত্র। বাকি পাঁচ জন – অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ আর মানসী – এরা সবাই বাস করে লেখকের কল্পনায়। এই পাঁচ জন কাল্পনিক চরিত্র কে নিয়ে লেখক একটি নাটক লিখতে চান। এই ব্যাপারটা না জানা থাকলে নাটকের মধ্যে অনেক জায়গাতেই এই চার জনের সাথে লেখকের ব্যবহার আর সংলাপ দর্শকের কাছে দুর্ব্বোধ্য মনে হতে পারে। নাটকটি শুরু হবার আগে তাই পরিচালক হিসেবে মাইক হাতে আমি মিনিট পাঁচেক ধরে দর্শকদের নাটকটি র মূল আখ্যান আর আঙ্গিক নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলাম।
BCS Website এ বিশদে নাটক টি নিয়ে লেখা আর নাটকের আগে এই বক্তৃতাটা বেশ কাজে দিয়েছিল বলেই আমার ধারণা।
এই নাটকের প্রধান চরিত্র একজন উদীয়মান তরুণ লেখক, যিনি আধুনিক বাঙালী মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের জীবন কে উপজীব্য করে নিয়ে একটি নাটক লিখতে চান্। সেই নাটকে উঠে আসবে তাদের জীবনচক্রের নানা দিক।
এই আধুনিক নাগরিক সমাজ নিয়ে নাটকের শুরুতে লেখক দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছেন~
“ ১৯৬১ সালের আদমশুমারির হিসাবে কলকাতার বর্তমান লোকসংখ্যা ২৯,২৭,২৮৯। এর শতকরা প্রায় আড়াই ভাগ গ্র্যাজুয়েট বা আরো উচ্চশিক্ষিত। বিভিন্ন নামে এঁদের পরিচিতি। এঁরা মধ্যবিত্ত, যদিও এঁদের মধ্যে বিত্তের তারতম্য যথেষ্ট। এঁরা বুদ্ধিজীবী যদিও বুদ্ধি জীবিকা হলে অনেকেই অনাহারে মরতো। এঁরা শিক্ষিত, যদি ডিগ্রিকে শিক্ষা বলে ধরে নেওয়া চলে। এঁরা ভদ্রলোক, ছোটলোকদের থেকে নিজেদের পার্থক্যটা বোঝেন বলে। এঁরা অমল বিমল কমল। এবং ইন্দ্রজিৎ।”
অমল, বিমল, কমল, এবং ইন্দ্রজিৎ, নাটকের এই চার জন চরিত্রের সাথে দর্শকদের আলাপ হবে যখন এরা কলেজে পড়ে। এদের সাথে আছে মানসী, সে ইন্দ্রজিৎ এর প্রেমিকা।
কলেজের ক্লাসের কিছু দৃশ্যতে এরা চারজন ছাত্র, তারা স্টেজে যন্ত্রের মত চলাফেরা করে যন্ত্রের মত শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। ক্লাসের পরে বসে নানা বিষয় নিয়ে তাদের প্রাণখোলা আড্ডা।


কলেজে শিক্ষক ও ছাত্র

কলেজের পর প্রাণখোলা আড্ডা
লেখক দেখিয়েছেন যে আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ, হয়তো চেষ্টা করলে আমরাও উল্লেখযোগ্য হতে পারতাম, কিন্তু আমরা চেষ্টা করিনি, মিশে গেছি জনারণ্যে। আমাদের মতই সাধারণ হলো অমল, বিমল আর কমল। এই সাধারণ মানুষেরা সমাজের নানা নিয়ম মেনে নিয়ে একটা যান্ত্রিক জীবনে বাঁধা পড়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এদের নিয়ে নাটক লেখা যায়না।
কিন্তু এদের থেকে আলাদা একজন আছে, সে ‘ইন্দ্রজিৎ’। সে আমাদের মত সাধারণ অমল-কমল-বিমল বা নির্মল নয়, সে ইন্দ্রজিৎ। আর আলাদা বলেই ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে নাটক লেখা হয়।
দর্শক-পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে কেন এই নাটক। কেন ইন্দ্রজিৎ নাটকের নামভূমিকায়? কি ভাবে ইন্দ্রজিৎ তার বন্ধুদের থেকে আলাদা?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো ইন্দ্রজিৎ আলাদা তার চিন্তাভাবনায়। সে অন্য তিনজনের মত অবলীলায় সব কিছু মেনে নিতে পারে না। এই যেমন সে তার প্রেমিকা মানসীকে বলে, “যে নিয়মে সাত বছরের ছেলেকে জুতো পালিশ করতে হয়, সে নিয়মটাকে আমি মানতে পারি না”।
কলেজের সেই প্রাণখোলা আড্ডার পরে একদিন সবাই চলে গেলে ইন্দ্রজিৎ একা বসে থাকে। বন্ধুদের সাথে রোজ সেই একই বিষয় নিয়ে একই কথা বলতে তার ভাল লাগেনা। এমন সময় লেখক তার কাছে আসে।
লেখকঃ কি রে এখানে একা বসে কি ভাবছিস? তোর স্যাঙাৎরা সবাই কোথায়? অমল বিমল কমল?
ইন্দ্রজিৎঃ ওরা একটু আগে চলে গেল।
লেখকঃ কি নিয়ে গ্যাঁজালি?
ইন্দ্রজিৎঃ (কিছুটা বিরক্ত) ওই তো সেই একই বিষয় – ক্রিকেট, রাজনীতি, সিনেমা, ফিসিক্স আর সাহিত্য। আর ভাল লাগেনা এই সব। ইচ্ছে হয় কোথাও বেরিয়ে পড়ি! কোন নাম না জানা জায়গায়…
লেখকঃ বাঃ, চল্ তাহলে, আমিও যাবো তোর সাথে। তোর পকেটে কত টাকা আছে?
ইন্দ্রজিৎঃ (মানিব্যাগে টাকা গুণে) – আড়াই টাকা।
লেখকঃ আমারও ওই রকম। চল্ একটা বাস ধরে হাওড়া স্টেশন চলে যাই, তারপরে যে ট্রেণটা প্রথমে পাবো, সেটা ধরে এই টাকায় যত দূর যাওয়া যায়, চলে যাই।
যাওয়া অবশ্য শেষ পর্য্যন্ত হয়না।
লেখক ইন্দ্রজিৎ কে বাদামের ঠোঙা এগিয়ে দিয়ে বলে, “নে, বাদাম খা!”

নে, বাদাম খা
৩) নাটকের বিষয়বস্তু
এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু হলো অমল বিমল কমলের মত আজকের সাধারণ নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষ এক অসার অর্থহীন যান্ত্রিক এবং নানা সামাজিক নিয়মের নাগপাশে বাঁধা জীবনে আটকে পড়ে আছে। ইন্দ্রজিৎ এর মত কিছু মানুষ এই নিয়মের গন্ডী থেকে বেরিয়ে পড়তে চায়। তারা হল বিদ্রোহী। ইংরেজীতে যাকে বলে non- compliant, uncompromising… নাটকের এই বিদ্রোহী চরিত্র ইন্দ্রজিৎ আসলে লেখক নিজেই, নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ইন্দ্রজিৎ এর সংলাপে তাঁর নিজের ভাবনা চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ইন্দ্রজিৎ লেখকেরই দ্বৈত সত্তা, তার অল্টার ইগো।
লেখক ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে যে নাটক লেখার চেষ্টা করছেন সেখানে তিনি আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের চক্র বোঝাতে গিয়ে বলছেন “স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ আর পরীক্ষা। পরীক্ষা আর পাস। তারপর দুনিয়া”। লেখক চরিত্রের ভেতর দিয়ে বাদল সরকার খুব সহজে জীবনের একটা ছক এঁকেছেন, যেই ছকে আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষেরা সবাই কম-বেশি ঘুরপাক খাচ্ছি।
ঘুরছি, ঘুরছি আর ঘুরছি…
লেখকের সংলাপে বার বার ওই কথা টা ঘুরে ফিরে আসে।
সেই ঘোরা বোঝাবার জন্যে আমরা স্টেজের পিছনের কালো ব্যাকড্রপে একটা মোটিফ এঁকে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম, তাতে আঁকা ছিল একটা চাকার ছবি আর সেই চাকার মধ্যে বাঁধা পড়ে আছে কিছু মানুষ।

ঘুরছি, ঘুরছি আর ঘুরছি
৪) অভিনব আঙ্গিক
বাদল সরকার এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকে এমন কিছু নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন, যা আর কোন মৌলিক বাংলা নাটকে এর আগে দেখা যায়নি।
প্রথমতঃ, এই নাটকে স্টেজ বলতে কেবল লেখকের চেয়ার, টেবিল, আর একটা টেবিল ল্যাম্প, এ ছাড়া অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎ এর বসার জন্যে চারটে কাঠের cube, সেগুলো দরকার মত তারাই এখান থেকে ওখানে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আর বাগানে ইন্দ্রজিৎ আর মানসীর পাশাপাশি বসে কথা বলার জন্যে একটা বেঞ্চ।
ব্যাস বাকি যত কিছু প্রপ্ দরকার সব অদৃশ্য, দর্শক কে কল্পনা করে নিতে হবে।
চাকরীর ইন্টারভিউ দেবার সীনে এক এক করে অমল বিমল কমল ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে, বাকিরা বাইরে বসে। ইন্টারভিউ যারা নিচ্ছেন তাঁরা অদৃশ্য, যে ইন্টারভিউ দিচ্ছে সে কেবল হাত পা নেড়ে মূকাভিনয় করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। শেষে অদৃশ্য তিনজন প্রশ্নকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে হেসে সে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে পরের জন ঢুকছে। বাইরে অপেক্ষমান অন্যরা তাদের নিজেদের সংলাপ বলে যাচ্ছে।
লেখক এর একটা সংলাপ আছে সেখানে সে বলছে আসলে ওদের বেশী প্রশ্ন নেই তো, একই প্রশ্ন সবাইকে করছে, তাই ওরা চায়না যে বাইরে বেরিয়ে এসে কেউ তার প্রশ্নগুলো তার বন্ধুদের বলে দিক।


চাকরীর ইন্টারভিউ
চাকরী পাবার পরে অফিসের সীনে, সেখানে অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎ কাজ করে। চার জন পাশাপাশি বসে। তাদের সামনে অদৃশ্য টেবিলে রাখা অদৃশ্য ফাইল ,কাগজ, টাইপরাইটার। তারা কথা বলতে বলতে হাত চালিয়ে ফাইলে চোখ বোলাচ্ছে, অদৃশ্য পাতা ওল্টাচ্ছে, অদৃশ্য টাইপরাইটারে অদৃশ্য কাগজ লাগিয়ে দুই আঙুল ব্যবহার করে বাতাসে টাইপ করছে।

এছাড়া আছে একই অভিনেতার বিভিন্ন রোলের মধ্যে অনায়াস বিচরণ।
যেমন অফিসের দৃশ্যে লেখক হয়ে যান্ অফিসের বেয়ারা “হরিশ”! সেখানে তার কাজ হলো বাবুদের ফাই ফরমাস খাটা, দরকার মতো চা, সিগারে্ট, ফাইল এই সব এনে দেওয়া। অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎরা তাকে নানা সুরে “হরিশ ! হরিশ!!” বলে ডাকলেই সে তাদের কাছে “বলুন স্যার” বলে গিয়ে হাজির হয়। হরিশের জন্যে কোন আলাদা অভিনেতা নেই, লেখক দর্শকদের সামনেই কাঁধে একটা কাপড় নিয়ে হরিশ হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে সেই হরিশ আবার অফিসের ম্যানেজার হয়ে গিয়ে সেক্রেটারী মিস মালহোত্রা কে ডেকে চিঠি dictate করে। তখন তার কাঁধে আর টেবিল পরিস্কার করার কাপড় নেই, তার চালচলনে তখন রাশভারী ব্যক্তিত্ব। অমল বিমল কমলরা তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে “গুড মর্ণিং স্যার” বলে।
এদিকে মানসী দিব্বি মিস মালহোত্রা হয়ে গিয়ে অদৃশ্য খাতায় অদৃশ্য পেন দিয়ে ডিক্টেশন লেখে।
এই সব অভিনব নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করার জন্যেও এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে সমানভাবে আদৃত হয়।


অফিসের দৃশ্য – কখনো হরিশ, কখনো ম্যানেজার
৫) নাটকের শুরু
এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের শুরুটা বেশ মজার।
রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্ত অঙ্গন মঞ্চে এই নাটকটা প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালে। প্রথম সীনে পর্দ্দা খোলার পরে যখন লেখক স্টেজে দর্শকদের সাথে কথা বলছে তখন হঠাৎ সামনের সারির দর্শক আসন থেকে একটা গুঞ্জন শুরু হলো। দু’জন দর্শকের মধ্যে সীট নিয়ে বাদানুবাদ। একদিকে স্টেজে লেখক তার সংলাপ বলছে, অন্যদিকে হলে সেই জায়গাটাতে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে, একটা জটলার মত, আর গুঞ্জন ক্রমশঃ কোলাহলের দিকে এগোচ্ছে।
ব্যাপার টা কি?
এমন সময়ে ওই জটলার দিকে লেখকের চোখ পড়বে, এবং সে তার সংলাপ বন্ধ করে ওই কোলাহলরত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলবে, “এই যে শুনছেন, ও মশাই! আপনারা একবার একটু ওপরে উঠে আসবেন?”
তারপর “আমাদের বলছেন?” বলে চার মূর্ত্তি অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ এক এক করে স্টেজে উঠে তাদের নাম বলবে।
কি নাম আপনার? অমল কুমার বোস।
আপনার? বিমল কুমার ঘোষ। ইত্যাদি।
আমার ভাই খোকন গল্প করে যে তার এক বন্ধু সব্যসাচী নাকি একবার নাটক দেখতে গিয়ে ওই ঝগড়ার সময়ে অমল বিমলদের পিছনেই বসেছিল। ওদের ঝগড়া দেখে সে বুঝতে পারেনি যে ওই ঝগড়াটা আসলে নাটকেরই একটা অংশ, সে ওদের কাছে গিয়ে ঝগড়া থামাতে যায়। তার পরে লেখক যখন ওদের স্টেজে ডাকছে, তখন লেখক তাকেও ডাকছে এই ভেবে সে ওদের সাথে আর একটু হলেই স্টেজে উঠে “আমার নাম সব্যসাচী সেন” বলে একটা কেলো করতে যাচ্ছিল, নাটকের কিছু লোক তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে আনে।
এই সীট নিয়ে ঝগড়ার কথা অবশ্য নাটকে লেখা নেই। এটা কিছুটা ইম্প্রোভাইস করা। আমরাও এই ভাবে আমাদের নাটক শুরু করি।
এই দৃশ্য টা রোজ রীতিমতো রিহার্সাল হতো। অবশ্য আমাদের নাটকের ভিডিও তে ঝগড়াটা ওঠেনি। আমি আমাদের ভিডিওগ্রাফার ভিক্টর কে বলেছিলাম ঝগড়াটা তুলতে কিন্তু ওই জায়গাটা অন্ধকার ছিল, তাই বোধহয় তোলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওই সময়ে হলে একটা অস্পস্ট চ্যাঁচামেচির আওয়াজ ভিডিওতে উঠেছে, এবং দেখা যাচ্ছে সামনের সারিতে বসে আমাদের সত্য (চক্রবর্ত্তী) বেশ বিরক্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কি যেন বলছে। ঝগড়া থামাতে বলছে ধরে নেওয়া যায়।
তার মানে আমাদের অভিনয় বেশ বিশ্বাস্য হয়েছিল!



নাটকের শুরু
৬) মাসীমা
মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারে স্নেহময়ী মাসীমা জ্যেঠিমা কাকীমা পিসীমা কেউ না কেউ একজন থাকবেনই। এই নাটকেও একটি মাসীমার চরিত্র আছে, যিনি মাঝে মাঝেই লেখকের কাছে এসে “ওরে ভাত যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কখন থেকে ডাকছি, খেতে আয় বাবা!” বলে অনুরোধ উপরোধ করেন।
কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়না।
লেখকের মনে নানা চিন্তা। আমি কে? আমি কি? আমি কেন? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
মাসীমা এসব কি কেন কোথায় প্রশ্নের মানে বোঝেন না। তিনি বলেন “কি যে ছাই হাবি জাবি ভাবিস তুই, বুঝিনা বাবা!”
লেখক মাসীমাকে একটু খ্যাপাবার জন্যে কবিতা করে বলে~
“কেন তুমি তরকারী বঁটি দিয়ে কুটবে, কেন তুমি ডালে দেবে আটখানা লংকাই?
সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই।
কেন তুমি ঘড়ি ধরে অফিসেতে ছুটবে, তেল দিতে কেন বাছো অন্যের চরকাই?
সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই। ”
নিয়মের গন্ডীতে বাঁধা আমাদের নাগরিক জীবন কে বোঝাতে বাদলবাবু এই “সব্বাই করে বলে” লাইনটি ব্যবহার করেছিলেন, যা এক সময় লোকের মুখে মুখে ঘুরতো।

সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই – লেখক ও মাসীমা
৭) প্রেম
স্কুলের পরে কলেজ, এবং কলেজে পড়ার সময় প্রেম।
আমাদের প্রায় প্রত্যেকের জীবনচক্রে এ এক অনিবার্য্য ঘটনা, নাটকে জীবনের ওই সময়টা ছুঁয়ে গেছেন নাট্যকার।
অমল বিমল কমল আর লেখক চার জন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় নানা বয়সের নানা ধরণের মেয়েরা, তারা সতৃষ্ণ নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথমে দেখা যায় সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ে হাতে বই খাতা নিয়ে কলেজে হেঁটে যাচ্ছে। তার একটু পরে দেখা গেল এক আধুনিকাকে, তার হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস, চলার ভঙ্গীতে লাস্য।
এবং আরও একটু পরে তার আশ্চর্য্য হয়ে দেখলো একটি মেয়ের সাথে কথা হেসে হেসে অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে কথা বলতে বলতে তাদের দিকে একবার ও না তাকিয়ে চলে গেল তাদের বন্ধু ইন্দ্রজিৎ~
“ডুবে ডুবে কিরকম জল খাচ্ছে দেখেছিস – আমাদের সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিলোনা।” দু;খ করে বললো অমল বিমল কমল।


কিন্তু ইন্দ্রজিৎ এর সাথে এই মেয়েটি কে?
জানা গেল এই মেয়েটির নাম মানসী, এবং সে ইন্দ্রজিৎ এর এক দূর সম্পর্কের বোন হয়। তারা পার্কের বেঞ্চে গিয়ে পাশাপাশি বসে, কথা বলে, আর দর্শকদের কল্পনা করে নিতে হয়, তাদের মাথার ওপরে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ধরেছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে আকাশে চাঁদ ওঠে, ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলো জ্বলে ওঠে।
ইন্দ্রজিৎ ও মানসীর প্রেম শেষ পর্য্যন্ত নাটকে পরিণতি লাভ করেনি। ইন্দ্রজিৎ চেয়েছিল মানসীকে বিয়ে করতে। কিন্তু মানসী রাজী হয়নি। এখানেও সেই সমাজের নিয়মের প্রশ্ন উঠে এসেছে। মানসীর মনে সংশয় ছিল যে দূর সম্পর্কের বোন কে বিয়ে করলে তাদের বিয়ে পরিবারের মান্যতা হয়তো পাবেনা।
অনেকদিন মানসী বা ইন্দ্রজিৎ কেউই বিয়ে করেনি। দেখা করেছে, কথা বলেছে। ইন্দ্রজিৎ বারবার বলেছে বিয়ের কথা কিন্তু মানসী রাজি নয়।


ইন্দ্রজিৎ ও মানসী
৮) বিবাহ
লেখক যে জীবন চক্রের ছক এঁকেছেন তাতে কলেজ পাসের পর দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় টিকতে হলে একটা চাকরি দরকার, রুটি-রুজির নিশ্চিত ব্যবস্থা দরকার। ইন্দ্রজিৎ ও তাঁর বন্ধুরা সেজন্য চাকরির খোঁজ করে, ইন্টারভিউ দেয়। তারপরে এক সময় তারা চাকরীও পায়। এবং স্বাবলম্বী হবার পরে তারা জগতের নিয়ম মেনে বিয়েও করে।
এই ভাবেই নাটকে জীবনের একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যায় তারা।
বিয়ের প্রথমে বর আর বৌ, মধ্যবয়েসে স্বামী আর স্ত্রী আর শেষ বয়েসে গিয়ে কর্ত্তা আর গিন্নী… নাটকে জীবনের তিন বয়সের দাম্পত্যের দৃশ্য দেখিয়েছেন নাট্যকার।
সদ্য বিয়ে হয়েছে অমলের, সদ্যবিবাহিত বলে তারা এখন বর আর বৌ। বৌকে একা পেয়ে অমল তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে লজ্জা পেয়ে বৌ “কি করছো? কেউ দেখে ফেলবে!” বলে একটু দূরে সরে যায়।
বিমলের বিয়ে কয়েক বছর হলো হয়েছে, তারা এখন স্বামী আর স্ত্রী। এক দৃশ্যে সকালে বিমল খবরের কাগজ পড়ছে, তার স্ত্রী তার সামনে চায়ের কাপ রেখে বলে “আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরো, দিদি জামাইবাবুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে!”
কমলের এখন বেশ বয়েস, সে আর তার স্ত্রী এখন কর্ত্তা আর গিন্নী। তাদের ছেলের অসুখ, অফিস ফেরত তার ওষুধ কিনে আনার কথা ছিল, কিন্তু সে ভুলে গেছে, তাই তাকে গিন্নীর গঞ্জনা শুনতে হয়।
আমাদের সকলের দাম্পত্য জীবনের এই সব অতি পরিচিত দৃশ্য!




বিয়ের পরে বর বৌ, স্বামী স্ত্রী, ও কর্ত্তা গিন্নী
৯) দুনিয়া
এই ভাবেই দিন কাটে। অমল বিমল কমল যুবক থেকে মধ্যবয়েসী এবং তারপর প্রৌঢ় হতে থাকে।
জীবনচক্রে ধীরে ধীরে আটকে যায় সবাই।
ঘুরে ফিরে অমল-কমল-বিমলের সাথে দেখা হয় লেখকের। এরা সবাই চাকরি-বাকরি, ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। যদিও কেউই তেমন সুখী নয়।
অমল লেখককে বলে, “এই এ-বি-সি-ডি কোম্পানিতে ঢুকে ভবিষ্যৎটা ঝরঝরে হয়ে গেল। সিনিয়র অ্যাসিসটেন্টের পোস্টে ছ’বছরের এক্সপেরিয়েন্স, জানো? আর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার করে নিয়ে এল, বাইরে থেকে এক মাদ্রাজিকে!”
বিমল জমি কেনা বেচা আর বাড়ী তৈরী করার প্রোমোটার হয়েছে। তার হাতে অনেক বাড়ী আর জমি। লেখক কিনতে চাইলে খুব কম দামে সে ভাল জমি বা বাড়ীর সন্ধান দিতে পারে। তাছাড়া তার মনে অনেক নতুন লাভজনক ব্যবসার স্কীম আছে, লেখকের যদি উৎসাহ থাকে…
ওদিকে কমল তার চাকরীর বাঁধা মাইনের বাইরেও কিছু উপার্জ্জনের আশায় ইন্সিওরেন্স বিক্রী করে। সে লেখক কে বলে “একটা ইন্সিওরেন্স পলিসি করিয়ে নিতে ভুলোনা কিন্তু!”
এই ভাবেই আমাদের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তদের বর্ণহীন, স্বাদহীন, যান্ত্রিক, গতানুগতিক নাগরিক জীবন এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে এগিয়ে যায়। অমল রিটায়ার করে, অমলের ছেলে অমল চাকরী পায়। বিমল অসুখে পড়ে, বিমলের ছেলে বিমল চাকরী পায়। কমল মারা যায়, কমলের ছেলে কমল…
১০) ইন্দ্রজিৎ কি নির্মল ?
কিন্তু নাটকের মুখ্য চরিত্র ইন্দ্রজিৎ কোথায়? ওদের মতই সেও কি চাকরি করছে? বিয়ে করেছে?
জানা গেল ইন্দ্রজিৎ একটা কোর্স করতে লন্ডন চলে যায়। সেখান থেকে সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে। ত।রপর এক সময় দেশে ফিরে আসে ইন্দ্রজিৎ। বিয়ে করে অন্য এক মানসী কে। লেখকের সাথে একদিন দেখা হয় তার। অনেকদিন পর দেখা তাই লেখক অনেক কথাই জানতে চাইছে ইন্দ্রজিতের কাছে, কেমন আছে? কি করছে? কিন্তু লেখক যতোটা শুনতে চায় ইন্দ্রজিতের বলার মতো ততোটা নেই।
আমাদের জীবনের দৈনন্দিনতা আর প্রাত্যহিকতার গ্লানি, রোজ রোজ একই বিষয়ের ফিরে ফিরে আসা, একই রুটিনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, অস্তিত্বের ভার, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মধ্যে মধ্যে নিহিত থাকে এক ধরণের অবসাদ আর ক্লান্তি। তার সাথে থাকে আমাদের হাজারো না পাওয়া, বাধাবিপত্তি, অসুখবিসুখ, ব্যর্থতা, বিপর্য্যয়।
ইন্দ্রজিৎ বলে, “দুনিয়াতে বলবার মত ঘটনা প্রায়ই ঘটে না”।
আমি সকালে বাজার করি। আমার বৌ রান্না করে।
আমি খেয়ে দেয়ে অফিসে যাই। আমার বৌ বাড়ীর কাজ করে।
আমি অফিস থেকে ফিরি। আমার বৌ আমার জন্যে চা নিয়ে আসে।
সুমন গুণের সাম্প্রতিক এই কবিতাটিতে এক সাধারণ নারীর জীবনের এইরকম বর্ণহীন, স্বাদহীন, গন্ধহীন একটি দিনের কথা লেখা আছে।
—————
লালন – সুমন গুণ
বাড়ীতে দুপুরে তুমি একা থাকো, একমাত্র ছেলে সকাল দশটায় যায় কাজে/
তারপর তোমার আর খুব কিছু করার থাকেনা, ভোরে উঠে চা করে ঘর মুছে/
ভাতের সাথে একটা দুটো তরকারী বানিয়ে নাও/
ছেলে যাবার পরে দিন খুব বড় হয়ে যায়/
গ্রিল টেনে দিয়ে তুমি ঘরে আসো, চেয়ার এলিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকো/
বেশীক্ষন দাঁড়াতে পারোনা, বিছানায় শুয়ে নাও, ঘুম পায়, দরজা খোলা থাকে/
এক সময় ঘুম ভেঙে উঠে, স্নান সেরে, ছাদে যাও/
দুপুরের স্তব্ধ রোদে মেলে দাও শাড়ি, গামছা, ছেলের পাজামা/
আস্তে আস্তে নেমে এসে বারান্দায় সামান্য দাঁড়াও/
দুপুরে কখনো অল্প ঘুম আসে, বিকেলের আগে ঘুম ভাঙে/
তবু কিছুক্ষন বিছানায় চোখ বুজে থাকো/
নৈহাটি লোকাল এসে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়/
গ্রিলের আওয়াজে তুমি বারান্দায় এলে গ্রিল খুলে/
ক্লান্ত, জীর্ণ, অপত্যকালীন সন্ধ্যা ঘরে উঠে আসে/
——————
ইন্দ্রজিৎ তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, কারণ সে ভেবেছিল সে বাকিদের থেকে আলাদা। কিন্তু আজ তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে সে ইন্দ্রজিৎ নয়, সে অমল-কমল-বিমলের মতই সাধারণ আরেকজন। সে নির্মল। এখন বাকি জীবনটা ঘর-সংসার, চাকরি-বাকরি করে কাটিয়ে দিতে চায় সে।
কিন্তু ইন্দ্রজিৎ তো নির্মল হতে পারবেনা, সে তো সাধারণ হতে পারবে না। কারণ হিসেবে লেখক বলেন, “কিন্তু তোমার যে কিছু নেই। প্রমোশন নেই, বাড়ি করা নেই, ব্যবসার স্কিম নেই, কী করে নির্মল হবে তুমি?”
তাহলে কি ইন্দ্রজিৎ আলাদা হতে পারলো? ইন্দ্রজিৎ কে নিয়ে নাটক লেখা কি সার্থক হলো?
লেখক নাটকের শেষ টানেন, “আমাদের অতীত-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে গেছে। আমরা জেনে গেছি পেছনে যা ছিল, সামনেও তাই।”
মোটিফের কাগজে তাই ওই চাকার পাশে একটা দূরান্তে চলে যাওয়া এক জোড়া রেল লাইন ও এঁকে দিই আমরা।
পিছনেও যা, সামনেও তাই। মনে হয় দুই লাইন হয়তো কোথাও এক জায়গায় গিয়ে মিশেছে, কিন্তু তা নয়। কোনদিনই ওরা এক হবেনা।
গ্রীক পুরাণের হতভাগ্য সিসিফাস সারা জীবন একাট ভারী লোহার বল ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের ওপরে তুলতেই সেটা আবার গড়িয়ে নীচে নেমে যেতো। বাদল সরকার নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষদের সেই সিসিফাসের সাথে তুলনা করেছেন।


That’s all ladies and gentlemen
১১) আমাদের দল
কুয়েতের বি সি এসে নাটকে উৎসাহী যুবকের কোন অভাব নেই। বরং তারা সংখ্যায় এত বেশী যে সবাইকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়াই মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে। এবং ইন্দ্রজিৎ এর ক্ষেত্রে যেহেতু মাত্র সাতটি চরিত্র তাই অনেককেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাদ দিতে হয়েছিল।
লেখক করেছিল শুকদেব (চট্টোপাধ্যায়), ইন্দ্রজিৎ – শুভঙ্কর (রায়), অমল – অজিত (চ্যাটার্জ্জী), বিমল – দেবাঞ্জন (ভট্টাচার্য্য), কমল – তাপস (ভট্টাচার্য্য), মাসীমা – নুপূর (রায় চৌধুরী) আর মানসী – দীপা (গুপ্ত)।
মহড়া হয়েছিল প্রায় তিন মাস ধরে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার বাড়ীতেই হতো। মনে আছে আমাদের সবার মাসীমা নুপূর রোজ রিহার্সালে বাড়ীতে তৈরী নারকেলের নাড়ু বানিয়ে নিয়ে আসতো। নিমেষে তা উধাও হয়ে যেতো অবশ্যই।
প্রবাসী জীবনে নাটকের থেকেও বেশী উপভোগ্য হত মহড়া উপলক্ষ্যে সবার একজোট হওয়া। হৈ হৈ আড্ডা এর ওর পিছনে লাগা এসব তো ছিলই। কিন্তু সব চেয়ে ভাল লাগতো নাটকটির পিছনে এই দলের সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে।
পার্থসারথী (বর্দ্ধন) স্টেজ আর আবহের দায়িত্বে ছিল। স্টেজে অবশ্য বিশেষ কাজ কিছু ছিলনা। কেবল ওই পিছনে কালো কাগজের ওপর একটা চাকা আর রেল লাইনের মোটিফ এঁকে সাঁটিয়ে দিতে বলেছিলাম ওকে। আবহে সে ব্যবহার করেছিল পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত। Bach, Beethoven এবং অন্যান্য দিকপালদের Cello Violin ইত্যাদি। অভিনেতাদের সংলাপ ধরার জন্যে মেঝেতে রাখা ফ্লোর মাইক ব্যবহার করেছিলাম।
অমিতেন্দ্র (বাগচী) ছিল আলোর দায়িত্বে। এই নাটকে আলোর কোন কেরামতি ছিলনা। দু’ তিনতে ফ্লাড লাইটেই কাজ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তার তেমন কোন অসুবিধে হয়নি।
মনে পড়ে যে নাটক শুরু হবার এক ঘন্টা তখনো বাকি, আমি হলে পৌঁছে দেখি সেই মোটিফের কাগজটা পিছনের ব্যাকড্রপে সাঁটানো হয়নি, পার্থকেও দেখা যাচ্ছেনা। কোথায় গেল? এদিকে একটু পর থেকে দর্শকরা আসতে শুরু করবে।
পার্থ অবশ্য খুবই দায়িত্ববান ছেলে। বি সি এসের অনেক নাটকের কাজ সে একাই সামলেছে। তো একটু পরেই সে তার কাগজটা নিয়ে এসে পিছনে সাঁটিয়ে দিলো।
দিয়ে আমায় বললো, “কি ইন্দ্রজিৎ দা’, ঠিক আছে তো?”
দেখলাম তার আঁকার size আর proportion আমি যেরকম চেয়েছিলাম, একদম তাই হয়েছে। হলের একদম পিছন থেকেও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
আমি পার্থকে বললাম, “পারফেক্ট!”
কুয়েতের তিনটে ইংরেজী কাগজেই আমাদের নাটকের রিভিউ ছাপা হয়েছিলা। তার সব গুলোতেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।

আমাদের দলের অভিনেতা দের সাথে সুভদ্রা আর আমি (নাটকের আগে)

কাস্ট পার্টি তে উপহার পেয়ে উৎফুল্ল পরিচালক
১২) পরিশিষ্ট – বাদলবাবু
কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ মঞ্চস্থ করার আগে নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক হিসেবে বি সি এসের হয়ে আমি নাট্যকার বাদলবাবুকে নাটকটি কুয়েতে করার অনুমতি চাইবার জন্যে কলকাতায় ফোন করেছিলাম। তিনি আমার ফোন পেয়ে খুসী হয়েছিলেন, এবং অবশ্যই আমাদের কুয়েতে তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করার অনুমতি ও দিয়েছিলেন।
সাফল্যের সাথে নাটকটি কুয়েতে মঞ্চস্থ হবার পরে আমরা তাঁকে বি সি এসের পক্ষ থেকে সন্মানী হিসেবে একটি চেক পাঠাই। লেখকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল শুকদেব (চট্টোপাধ্যায়) , সে নিজে হাতে গিয়ে বাদলবাবুকে সেই চেক দিয়ে আসে। সেই চেকের সাথে একটা ইংরজীতে লেখা প্রাপ্তির (Receipt) চিঠিও ছিল, তাতে সই করে আমাদের পাঠাবার জন্যে।
সেই ইংরেজী প্রাপ্তির চিঠি সই করার সাথে সাথে বাদলবাবু বাংলায় নিজে হাতে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লিখে আমাদের পাঠিয়েছিলেন।
বাদলবাবু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, আমরা তাঁর পরলোকগত আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি




































