Tag Archives: নাটক

কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ

১) মুখবন্ধ

ডিসেম্বর ৭, ২০০৭।

সেই দিন কুয়েতে সালমিয়ার ভারতীয় স্কুলের অডিটোরিয়ামে বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক সমিতি (বি সি এস) এর উদ্যোগে আমরা বাদল সরকারের বিখ্যাত নাটক “এবং ইন্দ্রজিৎ” সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ করেছিলাম।

সেই বছর সমিতির সভাপতি তাপস (বসু) যখন আমায় নাটক পরিচালনার ভার দিলে্ন, তখন আমি এই নাটকটিকেই বেছে নিয়েছিলাম। তার প্রধান কারণ অবশ্যই এই যে প্রায় চল্লিশ বছর আগে (১৯৬৫) লেখা এই নাটকটি কে এখনো বাংলায় লেখা সর্ব্বকালের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক নাটকের প্রথম পাঁচটি মধ্যে একটি বলে ধরা হয়।

বাদল সরকারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি তিনি লেখেন প্রবাস জীবনে, নাইজেরিয়ায় থাকতে ১৯৬৩ সালে। আর নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৫ সালে কলকাতায়।  

বিষয়বস্তু  এবং আঙ্গিক – দুই দিক থেকেই নাটকটি নিঃসন্দেহে বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি দিকচিহ্ন হিসেবে নিজের পরিচিতি আদায় করে নিয়েছে। এই নাটকটি ইংরেজী এবং নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত  হয়েছে, এবং সারা দেশে এটি এখনো নিয়মিত অভিনীত হয়ে থাকে।  নাটকটি নিয়ে অনেক্ লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে, এবং শুনেছি কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের এম এ ক্লাসের পাঠ্যতালিকায়তেও এই নাটক টি স্থান পেয়েছে।

নাটকটি পছন্দ করার  আর একটি কারণ ছিল এই যে ১৯৬৬ সালে – তখন কলেজে পড়ি এবং নাটক দেখায় তখন দারুন নেশা – কলকাতায় রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্ত অঙ্গন প্রেক্ষাগৃহে এক সন্ধ্যায় শৌভনিক গোষ্ঠীর প্রযোজনায় ওই নাটকটি দেখে আমি মুগ্ধ আর অভিভূত হয়েছিলাম, সেই ভাল লাগা আর মুগ্ধতা কুয়েতের বাঙালী বন্ধুদের মনে পৌঁছে দিতে আমার গভীর আগ্রহ ছিল।

অবশ্য মনে একটু দুশ্চিন্তাও যে ছিলনা তা বলবোনা। নাটকটি বেশ কঠিন এবং দুর্ব্বোধ্য, তাই  আগে থেকে একটু তৈরী হয়ে না এলে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে নাটকটি সাধারণ দর্শকদের ভাল না লাগারই সম্ভাবনাই বেশী। সাধারণত; কুয়েতে আমরা প্রতি বছর আমাদের দর্শকদের  বিনোদন হিসেবে একটি হালকা হাসির নাটকই পরিবেশন করতাম।

এই নাটকে সেরকম কোন গল্প নেই, কোন হাসি গান বা মজার দৃশ্য বা সংলাপ নেই। এখানে নেই কোন নাটকীয় সংঘাত, অথবা কোন নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স। এই নাটক হলো মধ্যবিত্ত মানুষের সাধারণ জীবনের কথা, নীরবে বয়ে চলা নিস্তরঙ্গ নদীর মত সেই জীবন, এবং তারই  টুকরো টুকরো ছবি।   

তবু কেন জানিনা আমাদের দর্শকদের শিল্পবোধের ওপর আমার আস্থা ছিল। আমার মনে হয়েছিল, যে নাটকটি তে নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের যে যান্ত্রিক এবং নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা গতানুগতিক দিকটা ফুটে উঠেছে, তার সাথে গড়পড়তা কুয়েতের সব বাঙালী দর্শকই কমবেশী পরিচিত।  এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটিতে আমাদের সকলের জীবনের কথাই বলা হয়েছে।  তাই এই নাটকের সাথে আমরা আমাদের জীবনের মিল খুঁজে পাবো।

আমি জানতাম এবং ইন্দ্রজিৎ কুয়েতের দর্শকের ভাল লাগবে, এবং শেষ পর্য্যন্ত তাই হয়েওছিল।

নাটকটি যে আমাদের দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলবে তা আমি বুঝি নাটকের মহড়ার সময়ে।  একমাত্র নুপূর (রায়চৌধুরী – মাসীমা) ছাড়া এই নাটকে যারা অভিনয় করেছিল তারা সকলেই বয়সে তরুণ। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই নাটকটি যখন লেখা হয় তখন এদের কারুর জন্ম হয়নি।  প্রথম দিকে চল্লিশ বছর আগে লেখা নাটকটির আজকের যুগে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমার মনে কিছুটা সংশয় ছিল তা  ঠিক। কিন্তু চার মাস মহড়া দেবার সময় লক্ষ্য করলাম বয়সে তরুণ এই ছেলেমেয়েদের নাটকটির প্রতি আকর্ষন ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ওদের উৎসাহ একটা সময়ে এসে আমার উৎসাহ কেও অতিক্রম করে  গেছে।  

তবু সাবধানের মার নেই ভেবে আমি নাটকটি মঞ্চস্থ হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বি সি এসের website এ নাটকটির বিষয় বস্তু নিয়ে অনেক লেখালেখি ও আলোচনা করেছিলাম। যাতে সেই সব লেখা পড়ে আমাদের সমিতির সভ্যরা নাটক দেখতে আসার আগে কিছুটা মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে আসে।  

ইংরেজীতে একটা কথা আছে – “Fools dare where angels fear to tread” – আমিও সেরকম কিছুটা দুঃসাহসী হয়ে  কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল, কেননা আমাদের দর্শকরা নাটকটি মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেছিলেন, এবং নাটকের শেষে তাঁরা আমাদের প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

২) অমল, বিমল, কমল, ইন্দ্রজিৎ আর মানসী    

নাটকটিতে মূল চরিত্র সাতটি। তাদের মধ্যে দু’জন – লেখক আর মাসীমা – হলেন রক্তমাংসের মানুষ, অর্থাৎ জীবন্ত চরিত্র। বাকি পাঁচ জন – অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ আর মানসী –  এরা সবাই বাস করে লেখকের কল্পনায়।  এই পাঁচ জন কাল্পনিক চরিত্র কে নিয়ে লেখক একটি নাটক লিখতে চান।  এই ব্যাপারটা না জানা থাকলে নাটকের মধ্যে অনেক জায়গাতেই এই চার জনের সাথে  লেখকের ব্যবহার আর সংলাপ দর্শকের কাছে দুর্ব্বোধ্য মনে হতে পারে।  নাটকটি শুরু হবার আগে তাই পরিচালক হিসেবে মাইক হাতে আমি মিনিট পাঁচেক ধরে দর্শকদের নাটকটি র মূল আখ্যান আর আঙ্গিক নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলাম।  

BCS Website এ বিশদে নাটক টি নিয়ে লেখা আর নাটকের আগে এই বক্তৃতাটা বেশ কাজে দিয়েছিল বলেই আমার ধারণা।   

এই নাটকের প্রধান চরিত্র একজন উদীয়মান তরুণ লেখক, যিনি আধুনিক বাঙালী মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের জীবন কে উপজীব্য করে নিয়ে একটি নাটক লিখতে চান্‌। সেই নাটকে উঠে আসবে তাদের জীবনচক্রের নানা দিক।

এই আধুনিক নাগরিক সমাজ নিয়ে নাটকের শুরুতে লেখক দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছেন~

“ ১৯৬১ সালের আদমশুমারির হিসাবে কলকাতার বর্তমান লোকসংখ্যা ২৯,২৭,২৮৯। এর শতকরা প্রায় আড়াই ভাগ গ্র্যাজুয়েট বা আরো উচ্চশিক্ষিত। বিভিন্ন নামে এঁদের পরিচিতি। এঁরা মধ্যবিত্ত, যদিও এঁদের মধ্যে বিত্তের তারতম্য যথেষ্ট। এঁরা বুদ্ধিজীবী যদিও বুদ্ধি জীবিকা হলে অনেকেই অনাহারে মরতো। এঁরা শিক্ষিত, যদি ডিগ্রিকে শিক্ষা বলে ধরে নেওয়া চলে। এঁরা ভদ্রলোক, ছোটলোকদের থেকে নিজেদের পার্থক্যটা বোঝেন বলে। এঁরা অমল বিমল কমল। এবং ইন্দ্রজিৎ।” 

অমল, বিমল, কমল, এবং ইন্দ্রজিৎ, নাটকের এই চার জন চরিত্রের সাথে দর্শকদের আলাপ হবে যখন এরা কলেজে পড়ে। এদের সাথে আছে মানসী, সে ইন্দ্রজিৎ এর প্রেমিকা।

কলেজের ক্লাসের কিছু দৃশ্যতে এরা চারজন ছাত্র, তারা স্টেজে যন্ত্রের মত চলাফেরা করে যন্ত্রের মত   শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। ক্লাসের পরে বসে নানা বিষয় নিয়ে তাদের প্রাণখোলা আড্ডা।

কলেজে শিক্ষক ও ছাত্র

কলেজের পর প্রাণখোলা আড্ডা

লেখক দেখিয়েছেন যে আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ, হয়তো চেষ্টা করলে আমরাও উল্লেখযোগ্য হতে পারতাম, কিন্তু আমরা চেষ্টা করিনি, মিশে গেছি জনারণ্যে। আমাদের মতই সাধারণ হলো অমল, বিমল আর কমল। এই সাধারণ মানুষেরা সমাজের নানা নিয়ম মেনে নিয়ে একটা যান্ত্রিক জীবনে বাঁধা পড়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।  এদের নিয়ে নাটক লেখা যায়না।

কিন্তু এদের থেকে আলাদা একজন আছে, সে ‘ইন্দ্রজিৎ’। সে আমাদের মত সাধারণ অমল-কমল-বিমল বা নির্মল নয়, সে ইন্দ্রজিৎ। আর আলাদা বলেই ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে নাটক লেখা হয়।  

দর্শক-পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে কেন এই নাটক। কেন ইন্দ্রজিৎ নাটকের নামভূমিকায়? কি ভাবে ইন্দ্রজিৎ তার বন্ধুদের থেকে আলাদা?   

এই প্রশ্নের উত্তর হলো ইন্দ্রজিৎ আলাদা তার চিন্তাভাবনায়। সে অন্য তিনজনের মত অবলীলায় সব কিছু মেনে নিতে পারে না।  এই যেমন সে তার প্রেমিকা মানসীকে বলে, “যে নিয়মে সাত বছরের ছেলেকে জুতো পালিশ করতে হয়, সে নিয়মটাকে আমি মানতে পারি না”।

কলেজের সেই প্রাণখোলা আড্ডার পরে একদিন সবাই চলে গেলে ইন্দ্রজিৎ একা বসে থাকে। বন্ধুদের সাথে রোজ সেই একই বিষয় নিয়ে  একই কথা বলতে তার ভাল লাগেনা। এমন সময় লেখক তার কাছে আসে। 

লেখকঃ কি রে এখানে একা বসে কি ভাবছিস? তোর স্যাঙাৎরা সবাই কোথায়? অমল বিমল কমল?

ইন্দ্রজিৎঃ ওরা একটু আগে চলে গেল।

লেখকঃ কি নিয়ে গ্যাঁজালি?

ইন্দ্রজিৎঃ (কিছুটা বিরক্ত) ওই তো সেই একই বিষয় – ক্রিকেট, রাজনীতি, সিনেমা, ফিসিক্স আর সাহিত্য। আর ভাল লাগেনা এই সব। ইচ্ছে হয় কোথাও বেরিয়ে পড়ি! কোন নাম না জানা জায়গায়…

লেখকঃ বাঃ, চল্‌ তাহলে, আমিও যাবো তোর সাথে। তোর পকেটে কত টাকা আছে?

ইন্দ্রজিৎঃ (মানিব্যাগে টাকা গুণে) – আড়াই টাকা।

লেখকঃ আমারও ওই রকম। চল্‌ একটা বাস ধরে হাওড়া স্টেশন চলে যাই, তারপরে যে ট্রেণটা প্রথমে পাবো, সেটা ধরে এই টাকায় যত দূর যাওয়া যায়, চলে যাই।

যাওয়া অবশ্য শেষ পর্য্যন্ত হয়না। 

লেখক ইন্দ্রজিৎ কে বাদামের ঠোঙা এগিয়ে দিয়ে বলে, “নে, বাদাম খা!”

নে, বাদাম খা

৩) নাটকের বিষয়বস্তু

এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু হলো অমল বিমল কমলের মত আজকের সাধারণ নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষ এক অসার অর্থহীন যান্ত্রিক এবং নানা সামাজিক নিয়মের নাগপাশে বাঁধা জীবনে আটকে পড়ে আছে।  ইন্দ্রজিৎ এর মত কিছু মানুষ এই নিয়মের গন্ডী থেকে বেরিয়ে পড়তে চায়। তারা হল বিদ্রোহী। ইংরেজীতে যাকে বলে non- compliant, uncompromising… নাটকের এই বিদ্রোহী চরিত্র ইন্দ্রজিৎ আসলে লেখক নিজেই, নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ইন্দ্রজিৎ এর সংলাপে তাঁর নিজের ভাবনা চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে।  ইন্দ্রজিৎ লেখকেরই দ্বৈত সত্তা, তার অল্টার ইগো।  

লেখক ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে যে নাটক লেখার চেষ্টা করছেন সেখানে তিনি আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের চক্র বোঝাতে গিয়ে বলছেন “স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ আর পরীক্ষা। পরীক্ষা আর পাস। তারপর দুনিয়া”। লেখক চরিত্রের ভেতর দিয়ে বাদল সরকার খুব সহজে জীবনের একটা ছক এঁকেছেন, যেই ছকে আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষেরা সবাই কম-বেশি ঘুরপাক খাচ্ছি।

ঘুরছি, ঘুরছি আর ঘুরছি…

লেখকের সংলাপে বার বার ওই কথা টা ঘুরে ফিরে আসে।

সেই ঘোরা বোঝাবার জন্যে আমরা স্টেজের পিছনের কালো ব্যাকড্রপে একটা মোটিফ এঁকে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম, তাতে আঁকা ছিল একটা চাকার ছবি আর সেই চাকার মধ্যে বাঁধা পড়ে আছে কিছু মানুষ।

ঘুরছি, ঘুরছি আর ঘুরছি

৪)   অভিনব আঙ্গিক

বাদল সরকার এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকে এমন কিছু নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন, যা আর কোন মৌলিক বাংলা নাটকে এর আগে দেখা যায়নি।

প্রথমতঃ, এই নাটকে স্টেজ বলতে কেবল লেখকের চেয়ার, টেবিল, আর একটা টেবিল ল্যাম্প, এ ছাড়া  অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎ এর বসার জন্যে চারটে কাঠের cube, সেগুলো দরকার মত তারাই এখান থেকে ওখানে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আর বাগানে ইন্দ্রজিৎ আর মানসীর  পাশাপাশি বসে  কথা বলার জন্যে একটা বেঞ্চ।

ব্যাস বাকি যত কিছু প্রপ্‌ দরকার সব অদৃশ্য, দর্শক কে কল্পনা করে নিতে হবে। 

চাকরীর ইন্টারভিউ দেবার সীনে এক এক করে অমল বিমল কমল ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে, বাকিরা বাইরে বসে। ইন্টারভিউ যারা নিচ্ছেন তাঁরা অদৃশ্য, যে ইন্টারভিউ দিচ্ছে সে কেবল হাত পা নেড়ে মূকাভিনয় করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। শেষে অদৃশ্য তিনজন প্রশ্নকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে হেসে সে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে পরের জন ঢুকছে। বাইরে অপেক্ষমান অন্যরা তাদের নিজেদের সংলাপ বলে যাচ্ছে।  

লেখক এর একটা সংলাপ আছে সেখানে সে বলছে আসলে ওদের বেশী প্রশ্ন নেই তো, একই প্রশ্ন সবাইকে করছে, তাই ওরা চায়না যে বাইরে বেরিয়ে এসে কেউ তার প্রশ্নগুলো তার বন্ধুদের বলে দিক।

চাকরীর ইন্টারভিউ

চাকরী পাবার পরে অফিসের সীনে, সেখানে অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎ কাজ করে। চার জন পাশাপাশি বসে। তাদের সামনে অদৃশ্য টেবিলে রাখা অদৃশ্য ফাইল ,কাগজ, টাইপরাইটার। তারা কথা বলতে বলতে হাত চালিয়ে ফাইলে চোখ বোলাচ্ছে, অদৃশ্য পাতা ওল্টাচ্ছে, অদৃশ্য টাইপরাইটারে অদৃশ্য কাগজ লাগিয়ে দুই আঙুল ব্যবহার করে বাতাসে টাইপ করছে।

এছাড়া আছে একই অভিনেতার বিভিন্ন রোলের মধ্যে অনায়াস বিচরণ।

যেমন অফিসের দৃশ্যে  লেখক হয়ে যান্‌ অফিসের বেয়ারা “হরিশ”! সেখানে তার কাজ হলো বাবুদের ফাই ফরমাস খাটা, দরকার মতো চা, সিগারে্ট,‌  ফাইল এই সব এনে দেওয়া। অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎরা তাকে নানা সুরে “হরিশ ! হরিশ!!” বলে ডাকলেই সে তাদের কাছে “বলুন স্যার” বলে গিয়ে হাজির হয়।  হরিশের জন্যে কোন আলাদা অভিনেতা নেই, লেখক দর্শকদের সামনেই  কাঁধে একটা কাপড় নিয়ে হরিশ হয়ে যায়।    

মাঝে মাঝে সেই হরিশ আবার অফিসের ম্যানেজার হয়ে গিয়ে সেক্রেটারী মিস মালহোত্রা কে ডেকে চিঠি dictate করে। তখন তার কাঁধে আর টেবিল পরিস্কার করার কাপড় নেই, তার চালচলনে তখন রাশভারী ব্যক্তিত্ব। অমল বিমল কমলরা তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে “গুড মর্ণিং স্যার” বলে।

এদিকে মানসী দিব্বি মিস মালহোত্রা হয়ে গিয়ে অদৃশ্য খাতায় অদৃশ্য পেন দিয়ে ডিক্টেশন লেখে।

এই সব অভিনব নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করার জন্যেও এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে সমানভাবে আদৃত হয়।   

অফিসের দৃশ্য – কখনো হরিশ, কখনো ম্যানেজার

৫) নাটকের শুরু

এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের শুরুটা বেশ মজার।

রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্ত অঙ্গন মঞ্চে এই নাটকটা প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালে। প্রথম সীনে পর্দ্দা খোলার পরে যখন লেখক স্টেজে দর্শকদের সাথে কথা বলছে তখন হঠাৎ সামনের  সারির দর্শক আসন থেকে একটা গুঞ্জন শুরু হলো। দু’জন দর্শকের মধ্যে সীট নিয়ে বাদানুবাদ।  একদিকে স্টেজে লেখক তার সংলাপ বলছে, অন্যদিকে হলে সেই জায়গাটাতে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে, একটা জটলার মত, আর গুঞ্জন  ক্রমশঃ  কোলাহলের দিকে এগোচ্ছে।

ব্যাপার টা কি?

এমন সময়ে  ওই জটলার দিকে লেখকের চোখ পড়বে, এবং সে তার সংলাপ বন্ধ করে ওই কোলাহলরত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলবে, “এই যে শুনছেন, ও মশাই! আপনারা একবার একটু ওপরে উঠে আসবেন?”

তারপর “আমাদের বলছেন?” বলে চার মূর্ত্তি অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ এক এক করে স্টেজে উঠে তাদের নাম বলবে।

কি নাম আপনার? অমল কুমার বোস।

আপনার? বিমল কুমার ঘোষ। ইত্যাদি।

আমার ভাই খোকন গল্প করে যে তার এক বন্ধু সব্যসাচী নাকি একবার নাটক দেখতে গিয়ে ওই ঝগড়ার সময়ে অমল বিমলদের পিছনেই বসেছিল। ওদের ঝগড়া দেখে সে বুঝতে পারেনি যে ওই ঝগড়াটা আসলে নাটকেরই একটা অংশ, সে ওদের কাছে গিয়ে ঝগড়া থামাতে যায়। তার পরে লেখক যখন ওদের  স্টেজে ডাকছে, তখন  লেখক তাকেও ডাকছে এই ভেবে সে ওদের সাথে আর একটু হলেই স্টেজে উঠে “আমার নাম সব্যসাচী সেন” বলে  একটা কেলো করতে যাচ্ছিল, নাটকের কিছু লোক তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে আনে।

এই সীট নিয়ে ঝগড়ার কথা  অবশ্য নাটকে লেখা নেই। এটা কিছুটা ইম্প্রোভাইস করা। আমরাও এই ভাবে আমাদের নাটক শুরু করি।  

এই দৃশ্য টা  রোজ রীতিমতো রিহার্সাল হতো।  অবশ্য আমাদের নাটকের ভিডিও তে ঝগড়াটা ওঠেনি। আমি আমাদের ভিডিওগ্রাফার ভিক্টর কে বলেছিলাম ঝগড়াটা তুলতে কিন্তু ওই জায়গাটা অন্ধকার ছিল, তাই বোধহয় তোলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওই সময়ে হলে একটা অস্পস্ট চ্যাঁচামেচির আওয়াজ ভিডিওতে উঠেছে, এবং দেখা যাচ্ছে সামনের সারিতে বসে আমাদের সত্য (চক্রবর্ত্তী) বেশ বিরক্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কি যেন বলছে।  ঝগড়া থামাতে বলছে ধরে নেওয়া যায়।

তার মানে আমাদের অভিনয় বেশ বিশ্বাস্য হয়েছিল!

নাটকের শুরু

৬) মাসীমা

মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারে স্নেহময়ী মাসীমা জ্যেঠিমা কাকীমা পিসীমা কেউ না কেউ একজন থাকবেনই।  এই নাটকেও একটি মাসীমার চরিত্র আছে, যিনি মাঝে মাঝেই লেখকের কাছে এসে “ওরে ভাত যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কখন থেকে ডাকছি, খেতে আয় বাবা!” বলে অনুরোধ উপরোধ করেন।

কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়না। 

লেখকের মনে নানা চিন্তা। আমি কে? আমি কি? আমি কেন? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?

মাসীমা এসব কি কেন কোথায় প্রশ্নের মানে বোঝেন না। তিনি বলেন “কি যে ছাই হাবি জাবি ভাবিস তুই, বুঝিনা বাবা!”

লেখক মাসীমাকে একটু খ্যাপাবার জন্যে কবিতা করে বলে~

“কেন তুমি তরকারী বঁটি দিয়ে কুটবে, কেন তুমি ডালে দেবে আটখানা লংকাই?

সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই।

কেন তুমি ঘড়ি ধরে অফিসেতে ছুটবে, তেল দিতে কেন বাছো অন্যের  চরকাই?  

সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই। ”

নিয়মের গন্ডীতে বাঁধা আমাদের নাগরিক জীবন কে বোঝাতে বাদলবাবু এই “সব্বাই করে বলে” লাইনটি ব্যবহার করেছিলেন, যা এক সময় লোকের মুখে মুখে ঘুরতো।  

সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই – লেখক ও মাসীমা

৭)  প্রেম

স্কুলের পরে কলেজ, এবং কলেজে পড়ার সময় প্রেম।

আমাদের প্রায় প্রত্যেকের জীবনচক্রে এ এক অনিবার্য্য ঘটনা, নাটকে জীবনের ওই সময়টা ছুঁয়ে গেছেন নাট্যকার।

অমল বিমল কমল আর লেখক চার জন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে,  তাদের সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় নানা বয়সের নানা ধরণের মেয়েরা, তারা সতৃষ্ণ নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।      প্রথমে দেখা যায় সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ে হাতে বই খাতা নিয়ে কলেজে হেঁটে যাচ্ছে। তার একটু পরে দেখা গেল এক আধুনিকাকে, তার হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস, চলার ভঙ্গীতে লাস্য।

এবং আরও একটু পরে তার আশ্চর্য্য হয়ে দেখলো একটি মেয়ের সাথে কথা হেসে হেসে অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে কথা বলতে বলতে তাদের দিকে একবার ও  না তাকিয়ে চলে গেল তাদের বন্ধু ইন্দ্রজিৎ~

“ডুবে ডুবে কিরকম জল খাচ্ছে দেখেছিস – আমাদের সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিলোনা।” দু;খ করে বললো অমল বিমল কমল। 

কিন্তু ইন্দ্রজিৎ এর সাথে এই মেয়েটি কে? 

জানা গেল এই মেয়েটির নাম মানসী, এবং সে ইন্দ্রজিৎ এর এক দূর সম্পর্কের বোন হয়। তারা পার্কের বেঞ্চে গিয়ে পাশাপাশি বসে, কথা বলে, আর দর্শকদের কল্পনা করে নিতে হয়, তাদের মাথার ওপরে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ধরেছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে আকাশে চাঁদ ওঠে, ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলো জ্বলে ওঠে। 

ইন্দ্রজিৎ ও মানসীর প্রেম শেষ পর্য্যন্ত নাটকে পরিণতি লাভ করেনি। ইন্দ্রজিৎ চেয়েছিল মানসীকে বিয়ে করতে।  কিন্তু মানসী রাজী হয়নি। এখানেও সেই সমাজের নিয়মের প্রশ্ন উঠে এসেছে। মানসীর মনে সংশয় ছিল যে দূর সম্পর্কের বোন কে বিয়ে করলে তাদের বিয়ে পরিবারের মান্যতা হয়তো পাবেনা।

অনেকদিন মানসী বা ইন্দ্রজিৎ কেউই বিয়ে করেনি। দেখা করেছে, কথা বলেছে। ইন্দ্রজিৎ বারবার বলেছে বিয়ের কথা কিন্তু মানসী রাজি নয়।

ইন্দ্রজিৎ ও মানসী

৮) বিবাহ   

লেখক যে জীবন চক্রের ছক এঁকেছেন তাতে কলেজ পাসের পর দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় টিকতে হলে একটা চাকরি দরকার, রুটি-রুজির নিশ্চিত ব্যবস্থা দরকার। ইন্দ্রজিৎ ও তাঁর বন্ধুরা সেজন্য চাকরির খোঁজ করে, ইন্টারভিউ দেয়। তারপরে এক সময় তারা চাকরীও পায়। এবং স্বাবলম্বী হবার পরে তারা জগতের নিয়ম মেনে বিয়েও করে।

এই ভাবেই নাটকে জীবনের একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যায় তারা। 

বিয়ের প্রথমে বর আর বৌ, মধ্যবয়েসে স্বামী আর স্ত্রী আর শেষ বয়েসে গিয়ে কর্ত্তা আর গিন্নী… নাটকে জীবনের তিন বয়সের দাম্পত্যের দৃশ্য দেখিয়েছেন নাট্যকার। 

সদ্য বিয়ে হয়েছে অমলের, সদ্যবিবাহিত বলে তারা এখন বর আর বৌ। বৌকে একা পেয়ে অমল তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে লজ্জা পেয়ে বৌ  “কি করছো? কেউ দেখে ফেলবে!” বলে একটু দূরে সরে যায়।

বিমলের বিয়ে কয়েক বছর হলো হয়েছে, তারা এখন স্বামী আর স্ত্রী। এক দৃশ্যে সকালে বিমল খবরের কাগজ পড়ছে, তার স্ত্রী তার সামনে চায়ের কাপ রেখে বলে “আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরো, দিদি জামাইবাবুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে!”

কমলের এখন বেশ বয়েস, সে আর তার স্ত্রী এখন কর্ত্তা আর গিন্নী।  তাদের ছেলের অসুখ,  অফিস ফেরত তার ওষুধ কিনে আনার কথা ছিল, কিন্তু সে ভুলে গেছে, তাই তাকে গিন্নীর গঞ্জনা শুনতে হয়।

আমাদের সকলের দাম্পত্য জীবনের এই সব অতি পরিচিত দৃশ্য!

বিয়ের পরে বর বৌ, স্বামী স্ত্রী, ও কর্ত্তা গিন্নী

৯) দুনিয়া    

এই ভাবেই  দিন কাটে।  অমল বিমল কমল যুবক থেকে মধ্যবয়েসী  এবং তারপর প্রৌঢ় হতে থাকে।

জীবনচক্রে ধীরে ধীরে আটকে যায় সবাই।

ঘুরে ফিরে অমল-কমল-বিমলের সাথে দেখা হয় লেখকের। এরা সবাই চাকরি-বাকরি, ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। যদিও কেউই তেমন সুখী নয়।

অমল লেখককে বলে, “এই এ-বি-সি-ডি কোম্পানিতে ঢুকে ভবিষ্যৎটা ঝরঝরে হয়ে গেল। সিনিয়র অ্যাসিসটেন্টের পোস্টে ছ’বছরের এক্সপেরিয়েন্স, জানো? আর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার করে নিয়ে এল, বাইরে থেকে এক মাদ্রাজিকে!”

বিমল জমি কেনা বেচা আর বাড়ী তৈরী করার প্রোমোটার হয়েছে। তার হাতে অনেক বাড়ী আর জমি।  লেখক কিনতে চাইলে খুব কম দামে সে  ভাল জমি বা বাড়ীর সন্ধান দিতে পারে। তাছাড়া তার মনে অনেক নতুন লাভজনক ব্যবসার স্কীম আছে, লেখকের যদি উৎসাহ থাকে…

ওদিকে কমল তার চাকরীর বাঁধা মাইনের বাইরেও কিছু উপার্জ্জনের আশায় ইন্সিওরেন্স বিক্রী করে।  সে লেখক কে বলে “একটা ইন্সিওরেন্স পলিসি করিয়ে নিতে ভুলোনা কিন্তু!”

এই ভাবেই আমাদের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তদের বর্ণহীন, স্বাদহীন, যান্ত্রিক, গতানুগতিক নাগরিক জীবন এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে এগিয়ে যায়। অমল রিটায়ার করে, অমলের ছেলে  অমল চাকরী পায়। বিমল অসুখে পড়ে, বিমলের ছেলে বিমল চাকরী পায়। কমল মারা যায়, কমলের ছেলে কমল…

১০) ইন্দ্রজিৎ কি নির্মল ?

কিন্তু নাটকের মুখ্য চরিত্র ইন্দ্রজিৎ কোথায়? ওদের মতই সেও কি চাকরি করছে? বিয়ে করেছে?  

জানা গেল ইন্দ্রজিৎ একটা কোর্স করতে লন্ডন চলে যায়। সেখান থেকে সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে। ত।রপর এক সময় দেশে ফিরে আসে ইন্দ্রজিৎ। বিয়ে করে অন্য এক মানসী কে। লেখকের সাথে একদিন দেখা হয় তার।  অনেকদিন পর দেখা তাই লেখক অনেক কথাই জানতে চাইছে ইন্দ্রজিতের কাছে, কেমন আছে? কি করছে? কিন্তু লেখক যতোটা শুনতে চায় ইন্দ্রজিতের বলার মতো ততোটা নেই।

আমাদের জীবনের দৈনন্দিনতা আর প্রাত্যহিকতার গ্লানি, রোজ রোজ একই বিষয়ের ফিরে ফিরে আসা, একই রুটিনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, অস্তিত্বের ভার,  প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মধ্যে  মধ্যে নিহিত থাকে এক ধরণের অবসাদ আর ক্লান্তি। তার সাথে থাকে আমাদের হাজারো না পাওয়া, বাধাবিপত্তি, অসুখবিসুখ, ব্যর্থতা, বিপর্য্যয়।

ইন্দ্রজিৎ বলে, “দুনিয়াতে বলবার মত ঘটনা প্রায়ই ঘটে না”।

আমি সকালে বাজার করি। আমার বৌ রান্না করে।

আমি খেয়ে দেয়ে অফিসে যাই। আমার বৌ বাড়ীর কাজ করে।

আমি অফিস থেকে ফিরি। আমার বৌ আমার জন্যে চা নিয়ে আসে।

সুমন গুণের সাম্প্রতিক এই কবিতাটিতে এক সাধারণ নারীর জীবনের এইরকম বর্ণহীন, স্বাদহীন, গন্ধহীন একটি দিনের কথা লেখা আছে।

—————

লালন – সুমন গুণ

বাড়ীতে দুপুরে তুমি একা থাকো, একমাত্র ছেলে সকাল দশটায় যায় কাজে/

তারপর তোমার আর খুব কিছু করার থাকেনা, ভোরে উঠে চা করে ঘর মুছে/

ভাতের সাথে একটা দুটো তরকারী বানিয়ে নাও/

ছেলে যাবার পরে দিন খুব বড় হয়ে যায়/

গ্রিল টেনে দিয়ে তুমি ঘরে আসো, চেয়ার এলিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকো/

বেশীক্ষন দাঁড়াতে পারোনা, বিছানায় শুয়ে নাও, ঘুম পায়, দরজা খোলা থাকে/

এক সময় ঘুম ভেঙে উঠে, স্নান সেরে, ছাদে যাও/

দুপুরের স্তব্ধ রোদে মেলে দাও শাড়ি, গামছা, ছেলের পাজামা/

আস্তে আস্তে নেমে এসে বারান্দায় সামান্য দাঁড়াও/

দুপুরে কখনো অল্প ঘুম আসে, বিকেলের আগে ঘুম ভাঙে/

তবু কিছুক্ষন বিছানায় চোখ বুজে থাকো/

নৈহাটি লোকাল এসে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়/

গ্রিলের আওয়াজে তুমি বারান্দায় এলে গ্রিল খুলে/

ক্লান্ত, জীর্ণ, অপত্যকালীন সন্ধ্যা ঘরে উঠে আসে/

——————

ইন্দ্রজিৎ তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, কারণ সে ভেবেছিল সে বাকিদের থেকে আলাদা। কিন্তু আজ তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে সে ইন্দ্রজিৎ নয়, সে অমল-কমল-বিমলের মতই সাধারণ আরেকজন। সে নির্মল। এখন বাকি জীবনটা ঘর-সংসার, চাকরি-বাকরি করে কাটিয়ে দিতে চায় সে।

কিন্তু ইন্দ্রজিৎ তো নির্মল হতে পারবেনা, সে তো সাধারণ হতে পারবে না। কারণ হিসেবে লেখক বলেন, “কিন্তু তোমার যে কিছু নেই। প্রমোশন নেই, বাড়ি করা নেই, ব্যবসার স্কিম নেই, কী করে নির্মল হবে তুমি?”

তাহলে কি ইন্দ্রজিৎ আলাদা হতে পারলো? ইন্দ্রজিৎ কে নিয়ে নাটক লেখা কি সার্থক হলো?

লেখক নাটকের শেষ টানেন, “আমাদের অতীত-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে গেছে। আমরা জেনে গেছি পেছনে যা ছিল, সামনেও তাই।”

মোটিফের কাগজে তাই ওই চাকার পাশে একটা দূরান্তে চলে যাওয়া এক জোড়া রেল লাইন ও এঁকে দিই আমরা।

পিছনেও যা, সামনেও তাই।  মনে হয় দুই লাইন হয়তো কোথাও এক জায়গায় গিয়ে মিশেছে, কিন্তু তা নয়। কোনদিনই ওরা এক হবেনা।  

গ্রীক পুরাণের হতভাগ্য  সিসিফাস সারা জীবন একাট ভারী লোহার বল ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের ওপরে তুলতেই সেটা আবার গড়িয়ে নীচে নেমে যেতো।  বাদল সরকার নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষদের সেই সিসিফাসের সাথে তুলনা করেছেন।

That’s all ladies and gentlemen

১১) আমাদের দল

কুয়েতের বি সি এসে নাটকে উৎসাহী যুবকের কোন অভাব নেই। বরং তারা সংখ্যায় এত বেশী যে সবাইকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়াই মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে। এবং ইন্দ্রজিৎ এর ক্ষেত্রে যেহেতু মাত্র সাতটি চরিত্র তাই অনেককেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাদ দিতে হয়েছিল।

লেখক করেছিল শুকদেব (চট্টোপাধ্যায়), ইন্দ্রজিৎ – শুভঙ্কর (রায়), অমল – অজিত (চ্যাটার্জ্জী), বিমল – দেবাঞ্জন (ভট্টাচার্য্য), কমল – তাপস (ভট্টাচার্য্য), মাসীমা – নুপূর (রায় চৌধুরী) আর মানসী – দীপা (গুপ্ত)।

মহড়া হয়েছিল প্রায় তিন মাস ধরে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার বাড়ীতেই হতো। মনে আছে আমাদের সবার মাসীমা নুপূর রোজ রিহার্সালে বাড়ীতে তৈরী নারকেলের নাড়ু বানিয়ে নিয়ে আসতো। নিমেষে তা উধাও হয়ে যেতো অবশ্যই।

প্রবাসী জীবনে নাটকের থেকেও বেশী উপভোগ্য হত মহড়া উপলক্ষ্যে সবার একজোট হওয়া।  হৈ হৈ আড্ডা এর ওর পিছনে লাগা এসব তো ছিলই। কিন্তু সব চেয়ে ভাল লাগতো নাটকটির পিছনে এই দলের সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে।

পার্থসারথী (বর্দ্ধন) স্টেজ আর আবহের দায়িত্বে ছিল। স্টেজে অবশ্য বিশেষ কাজ কিছু ছিলনা। কেবল ওই পিছনে কালো কাগজের ওপর একটা চাকা আর রেল লাইনের মোটিফ এঁকে সাঁটিয়ে দিতে বলেছিলাম ওকে। আবহে সে ব্যবহার করেছিল পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত। Bach, Beethoven এবং অন্যান্য দিকপালদের Cello Violin ইত্যাদি।  অভিনেতাদের সংলাপ ধরার জন্যে মেঝেতে রাখা ফ্লোর মাইক ব্যবহার করেছিলাম।   

অমিতেন্দ্র (বাগচী) ছিল আলোর দায়িত্বে। এই নাটকে আলোর কোন কেরামতি ছিলনা। দু’ তিনতে ফ্লাড লাইটেই কাজ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তার তেমন কোন অসুবিধে হয়নি।

মনে পড়ে যে নাটক শুরু হবার এক ঘন্টা তখনো বাকি, আমি হলে পৌঁছে দেখি সেই মোটিফের কাগজটা পিছনের ব্যাকড্রপে সাঁটানো হয়নি, পার্থকেও দেখা যাচ্ছেনা।  কোথায় গেল? এদিকে একটু পর থেকে দর্শকরা আসতে শুরু করবে।

পার্থ অবশ্য খুবই দায়িত্ববান ছেলে। বি সি এসের অনেক নাটকের কাজ সে একাই সামলেছে। তো একটু পরেই সে তার কাগজটা নিয়ে এসে পিছনে সাঁটিয়ে দিলো।

দিয়ে আমায় বললো, “কি ইন্দ্রজিৎ দা’, ঠিক আছে তো?”

দেখলাম তার  আঁকার size আর proportion আমি যেরকম চেয়েছিলাম, একদম তাই হয়েছে। হলের একদম পিছন থেকেও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।

আমি পার্থকে বললাম, “পারফেক্ট!”

কুয়েতের তিনটে ইংরেজী কাগজেই আমাদের নাটকের রিভিউ ছাপা হয়েছিলা। তার সব গুলোতেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।

আমাদের দলের অভিনেতা দের সাথে সুভদ্রা আর আমি (নাটকের আগে)

কাস্ট পার্টি তে উপহার পেয়ে উৎফুল্ল পরিচালক

১২) পরিশিষ্ট – বাদলবাবু

কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ মঞ্চস্থ করার আগে নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক হিসেবে বি সি এসের হয়ে আমি নাট্যকার বাদলবাবুকে নাটকটি কুয়েতে করার অনুমতি চাইবার জন্যে কলকাতায় ফোন করেছিলাম। তিনি আমার ফোন পেয়ে খুসী হয়েছিলেন, এবং অবশ্যই আমাদের কুয়েতে তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করার অনুমতি ও দিয়েছিলেন।

সাফল্যের সাথে নাটকটি কুয়েতে মঞ্চস্থ হবার পরে আমরা তাঁকে বি সি এসের পক্ষ থেকে সন্মানী হিসেবে একটি চেক পাঠাই। লেখকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল শুকদেব (চট্টোপাধ্যায়) , সে নিজে হাতে গিয়ে বাদলবাবুকে সেই চেক দিয়ে আসে। সেই চেকের সাথে একটা ইংরজীতে লেখা প্রাপ্তির (Receipt) চিঠিও ছিল, তাতে সই করে আমাদের পাঠাবার জন্যে।  

সেই ইংরেজী প্রাপ্তির চিঠি সই করার সাথে সাথে বাদলবাবু বাংলায় নিজে হাতে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লিখে আমাদের পাঠিয়েছিলেন।

বাদলবাবু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, আমরা তাঁর পরলোকগত আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি

কুয়েতে রক্তকরবী – প্রস্তুতি পর্ব্ব

ফাগুলাল আর চন্দ্রা

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের  ১২ তারিখে কুয়েতের বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক সমিতির প্রযোজনায় আমরা ভারতীয় দূতাবাসের অডিটোরিয়াম এ রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটি মঞ্চস্থ  করেছিলাম। 

১) রক্তকরবী কেন?

রক্তকরবী নিঃসন্দেহে একটি কঠিন নাটক এবং কুয়েতের দর্শকদের কাছে এই নাটক ভাল লাগবে কিনা এটি একটি বড় প্রশ্ন ছিল আমাদের মনে। এই নাটকটি একটি রূপক, এই নাটকের বিষয়বস্তুর ভিতরে অন্তর্নিহিত আছে সমাজে শ্রেণীবিভাগ, প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দর্শন, গভীর চিন্তা এবং সুস্পষ্ট মতামত। নাটক দেখতে এসে এই সব সিরিয়াস  ব্যাপার নিয়ে কেই বা ভাবতে চায়?

কিন্ত অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে এটাও ঠিক যে রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজেই অনেকবার বলেছেন রক্তকরবী কোন রূপক নয়, তা হল নন্দিনী নামের একটি মানবীর কাহিনী। নাটকটিতে ভাল লাগার উপাদানও কম নেই। সুন্দর গল্প আছে, নাচ আছে, গান আছে, আছে নারী আর পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ, বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালবাসা, সন্দেহ, শোষন, অত্যাচার, বিদ্রোহ। সবার ওপরে আছে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল ভাষায় লেখা শাণিত সব সংলাপ।

রক্তকরবী নিঃসন্দেহে একটি উচ্চস্তরের বাংলা নাটক। তাই অনেক ভেবেচিন্তে আমরা রক্তকরবী নাটকটিকে বেছে নিলাম।

২) প্রস্তুতি     

রক্তকরবী নাটকে অনেক চরিত্র, কুয়েতে চট করে অত অভিনেতা পাওয়া মুস্কিল। দল তৈরী করতে তাই প্রথমে কিছু অসুবিধে হয়েছিল।  এমনিতে কুয়েতে বাঙালিদের মধ্যে ভাল অভিনেতা অভিনেত্রী র অভাব নেই, নাটকে অংশ নিতে তারা সবসময়ই উৎসাহী। তাই প্রধান চরিত্র মোটামুটি সব পাওয়া গেলেও, কিছু চরিত্র বাদ দিতে হলো।  তাছাড়া বেশ কিছু  লম্বা আর কাব্যিক ভাষার সংলাপ – যা কিনা  অনেকাংশেই দর্শকের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে – আর তার সাথে কিছু গানও  বাদ দিলাম। এর ফলে নাটকটার সময় দুই ঘন্টা থেকে দেড় ঘণ্টায় না মিয়ে আনা গেল।   

এ দিকে আর এক মুস্কিল, রঞ্জন আর দু’জন প্রহরীর তো কোন সংলাপই নেই।  বিশেষ করে রঞ্জন এর রোলটা কে করতে চাইবে? রাজা দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসার  পরে তার মৃতদেহ হয়ে শুধু শুয়ে থাকা কাজ। এই রোলে কাউকে পাওয়া কঠিন। শেষ পর্য্যন্ত শৈবাল রঞ্জন আর প্রথম প্রহরী করতে রাজী হয়েছিল। অনুপম হয়েছিল দ্বিতীয় প্রহরী, তার সুন্দর ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যবান চেহারা, শুকদেব বললো “অনুপমকে প্রহরী হিসেবে যা মানাবে না!” সংলাপহীন ওই দুটো রোলে ওই দু’ জন কিন্তু নিয়ম করে রোজ রিহার্সালে এসেছে।  “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে” গানের সাথে গ্রামবাসীদের নাচের সীনে কিছু বাচ্চা ছেলে মেয়েদের  দীপা যোগাড় করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল।

অভিনয় ছাড়া স্টেজের পিছনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে, এই ব্যাকস্টেজের কাজ করার জন্যেও কুয়েতে বাঙালীদের মধ্যে গুণী এবং কাজের লোকের অভাব হয়নি কোনদিন। আমাদের মঞ্চের দায়িত্ব নিলো রাজীব আর শৈবাল, আলো অমিতেন্দ্র, আবহ বনানী আর রথীন, পোষাক সুভদ্রা, এবং প্রম্পটিং সুপর্ণা। 

দল তৈরী করার পরে  মহা উৎসাহে আমরা  মহড়া শুরু করে দিলাম। হাতে তিন মাস সময়।

প্রথম কয়েকদিন মহড়ার পরে দুটো জিনিষ পরিস্কার হয়ে গেল।

এক, এত বছর আগে লেখা এই নাটক, তার ওপর  রবীন্দ্রনাথের কঠিন সব সংলাপ, নাটকের মূল বক্তব্য ও কেমন যেন একটু অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে,  কিন্তু কয়েকটা মহড়া হবার পরে বুঝলাম এই নাটক নিয়ে আমার দলের তরুণ অভিনেতাদের উৎসাহ আমার থেকেও বেশী। তারা সকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজের নিজের চরিত্র আত্মস্থ করে নিলো ।

আর দ্বিতীয় যে জিনিষটা হল সেটা আরও চমৎকার।

প্রথম বার পড়ে সংলাপ গুলো যত কঠিন মনে হয়েছিল, মহড়া করতে করতে সেই সংলাপ গুলো আমাদের কাছে ক্রমশঃ সহজ হয়ে উঠতে লাগলো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে আমাদের মনের ওপর তাঁর সন্মোহনী প্রভাব ফেলতে শুরু করে দিলেন। যতো রিহার্স করছি, ততোই রবীন্দ্রনাথের সংলাপের মাধুর্য্য তার সমস্ত রূপ রস গন্ধ নিয়ে  অনিবার্য্য, অবধারিত ভাবে আমাদের মনের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো।

৩) রিহার্সালের মজা        

প্রবাসী বাঙালীর জীবনে নাটকের মূল আকর্ষণ আমার মতে এই রিহার্সাল। এই রিহার্সালকে কেন্দ্র করে মাস তিনেক সবাই মিলে জড়ো হওয়া আর এক সাথে আড্ডায় গল্পে হাসিতে কিছুটা সময় কাটানো। যেন নাটকটা হলো একটা উপলক্ষ্য মাত্র, আসল আনন্দ হলো রিহার্সালের সময়টা বাড়ী জুড়ে হৈ হৈ, উত্তেজনা, আড্ডা, আলোচনা,  কেউ চা সিঙাড়া খাচ্ছে, কেউ বা আবার হাসি ঠাট্টায় মগ্ন। সমস্বরে সবাই কথা বলছে, নানা আলোচনা, হাসি, গল্প, রসিকতা, কলরব, কলতান।          

আর একটা ব্যাপার হচ্ছে সবাই  নিজের নিজের অভিনীত চরিত্রদের সাথে মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে, যার জন্যে রিহার্সালের মধ্যে এমন কি বাইরেও মাঝে মাঝে দেখা হলে সবাই সবাই কে নাটকের নামেই ডাকে। ধরা যাক তাপস একদিন রিহার্সালে একটু দেরী করে এসেছে, সে ঘরে ঢুকলেই রব উঠলো, “ওরে, ফাগু এসে গেছে! ফাগুলাল, আজ এত দেরী হলো কেন ভাই?” নাটক হয়ে যাবার পরে একদিন অরুণাভর বাড়িতে সবাই মিলে মাটিতে শতরঞ্চি পেতে ভিডিও দেখা হবে , শর্ব্বরী সেদিন  আসতে পারছেনা, দেবাশীষ তাকে বলল “কেন,নাতনি? যে বাসা দিয়েছি সে তো খাসা, সরকারি খরচে সতরঞ্চি পর্যন্ত রাখা গেছে।” কল্যাণ একদিন আমাদের বললো যে ও মোড়ল শুনে পলি নাকি বলেছে ইন্দ্রজিৎ দা’ লোক চেনে বোঝা যাচ্ছে! কেউ কেউ আবার অরুণাভ কে “পাগলভাই” বলেও ডাকছে। রথীন অরুণাভ কে বলছে শুনলাম, “পাগলভাই, সিঙাড়াটা কোন দোকান থেকে এনেছো? দারুণ তো!”

অবশ্য উল্টোটাও হত মাঝে, নাটকের নামের বদলে ভুল করে আসল নাম চলে আসতো। হরেরাম কোলে গোঁসাই সেজে সব সময় দুই হাত তুলে হরি হরি করছে, তার গায়ে গেরুয়া নামাবলী, তার আসল নামের সাথে তার চরিত্রের নামের হুবহু মিল। একদিন দেবাশীষ ভুল করে শর্ব্বরী কে বলে ফেললো, “নাতনি, একটা সুখবর আছে। এদের ভালো কথা শোনাবার জন্যে হরেরাম কোলেকে আনিয়ে রেখেছি

রিহার্সালের কথা উঠলে খাওয়া দাওয়ার কথা বলবোনা, তা কি করে হয়? 

হরেরামের বাড়ীতে এক শুক্রবার রিহার্সাল। সেদিনের মূল আকর্ষণ ছিল স্বাতীর তৈরী কচুরী আর আলুর দম। পরে স্টেজ রিহার্সালেও একদিন স্বাতী শ’ খানেক মাছের চপ নিয়ে এসেছিল। কুয়েতে রক্তকরবীর নাটকের ইতিহাস যদি কোনদিন লেখা হয় তাহলে সেখানে সেই মাছের চপ এর কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে নিশ্চয়। পলকের মধ্যে শ’খানেক চপ হাওয়া। যাকে বলে Gone with the wind!

৪) মেগা রিহার্সাল

নাটকের দিন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে, আর দিন পনেরো বাকী।

এতদিন আমরা নাটকটা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে বার বার রিহার্স করেছি, তার অনেক কারণ ছিল।

প্রথমতঃ রোজ সবাই আসতোনা, বিশেষ করে নাচের বাচ্চারা। কারুর কারুর ছোট পার্ট, এরা মাঝে মাঝে না আসতে চাইলে আমি জোর করতাম না। কিছু চরিত্র যেমন প্রথম দ্বিতীয় আর তৃতীয় গ্রামবাসী তো প্রায় শেষ মুহূর্ত্তে পেলাম। ওই তিন জনের সাথে নন্দিনীর “ওগো তোমরা রঞ্জন কে দেখেছো?” সীনটা তো অভিনেতার অভাবে কোনদিন রিহার্স করাই হয়নি। তাছাড়া কোনদিন কারুর শরীর খারাপ, কারুর কাজ পড়ে গেছে, এসব তো থাকেই। তাই অনেক দৃশ্য বাদ দিয়ে নাটকটা ভাগ ভাগ করে আমাদের রিহার্সাল হতো। পার্ট মুখস্থ হাবার জন্যে কিছু কিছু দৃশ্য দরকার মতো বার বার করতাম, যাতে অভিনেতারা দৃশ্যগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।    

এখন আর আমাদের বেশী সময় হাতে নেই, তাই ঠিক হলো একদিন আমাদের বাড়িতে প্রথম থেকে শেষ পুরো নাটকটা রিহার্স করা হবে, ভাগ ভাগ করে নয়। আমরা এর নাম দিয়েছি মেগা রিহার্সাল। কি ভুলভাল হচ্ছে তাই পরে দেখার জন্যে আজ এই রিহার্সালের ভিডিও রেকর্ডিং হবে, রাজকুমার তার নতুন ভিডিও ক্যামেরা আর স্ট্যান্ড নিয়ে এসেছে। বনানী এসেছে তার হারমোনিয়াম নিয়ে। বাচ্চারা সবাই শাড়ি পরে এসেছে। ফাগুলালকে মাথায় পাগড়ী আর ধুতি সার্টে বেশ authentic লাগছে। ফাগু আর বিশুর পিঠে কাগজে বড় বড় অক্ষরে নাম্বার (৪৭ফ,৬৯ঙ) সাঁটানো। রথীন কোথা থেকে জোগাড় করে রাজার জন্যে তিনটে সবুজ রং এর ব্যাং নিয়ে এসেছে। শুকদেব তার মধ্যে থেকে একটা ব্যাং বেছে নিলো। নাটকে এই ব্যাং এর বয়স তিন হাজার বছর। নাটকে এক জায়গায় ধ্বজার দন্ড ভাঙতে হবে, শুকদেব আগে ভাগে আমাদের রান্নাঘরে গিয়ে একটা লাঠি দেখে এসেছে। ওই দৃশ্যের সময় সংলাপ বলতে বলতে সে চট করে ছুটে রান্নাঘর থেকে গিয়ে লাঠিটা নিয়ে আসবে।

বাড়ী জুড়ে হৈ হৈ, উত্তেজনা, আড্ডা, আলোচনা, কেউ চা সিঙাড়া খাচ্ছে, কেউ হাসি ঠাট্টায় মগ্ন, পরিবেশ বেশ জমে উঠেছে, রাজকুমার তার ভিডিও ক্যামেরা স্ট্যান্ডে বসিয়ে রেডী।

তারাপদ রায়ের একটা কবিতায় ছিল যে বাড়ির সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে, বাক্স প্যাঁটরা হোল্ডল বাঁধা হয়েছে, চারিদিকে খুব ব্যস্ততা, হাঁকাহাঁকি, একজন ট্যাক্সি ডাকতে গেছে, ট্যাক্সি এলেই বেরিয়ে পড়া হবে, তার পর হাওড়া স্টেশন, পুঁ ঝিক ঝিক রেলগাড়ী। ছেলেবেলার সেই উত্তেজনার দিন নিয়ে তাঁর সেই কবিতায় একটা লাইন ছিলঃ

“আমার খুব ভালো লাগে এই সব হাঙ্গামা।” 

৫) মেকআপ এর কারিগর

এই হাঙ্গামার মধ্যে যখন রিহার্সাল শুরু করবো ভাবছি, এমন সময়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলেন এক মালয়ালী ভদ্রলোক, তাঁর নাম পল (Paul)। শুকদেব আমার সাথে তাঁর আলাপ করিয়ে দিলো। তিনি সব অভিনেতাদের মেকআপ করাবেন। আজ তিনি এসেছেন মেকআপ নিয়ে আলোচনা করতে।

আগে আমাদের  নাটকে সমিতির সদস্যদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ মেকআপ করতেন, ইদানীং এই ব্যাপারটা বাইরের কাউকে দিয়ে করা হয়, তাতে খরচ সামান্য বেশী হলেও ঝামেলা অনেক কম।

পল ভদ্রলোকের গায়ের রং মিশমিশে কালো, লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা, কিন্তু তাঁর মুখে সবসময় একটা অমায়িক মিষ্টি হাসি, ইংরেজী হিন্দী এই দুটো ভাষাই ভাল না জানার জন্যে তাঁর মুখে বেশী কথা নেই, যাই বলা হয়, তিনি ঘাড় নেড়ে বলেন হয়ে যাবে,চিন্তা নেই। বোঝা গেল যে তিনি বেশ করিতকর্ম্মা লোক, মেকআপের ব্যাপারে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা।তিনি আগেও আমাদের নাটকে মেক আপ করিয়েছেন। তবে তাঁকে নিয়ে মুস্কিল হল বাংলা ভাষা না জানার জন্যে তিনি চরিত্রানুগ মেকআপ প্রায়শঃই করতে পারেননা। তাঁকে চরিত্রদের সম্বন্ধে আগে ভাল করে না বোঝালে তিনি যে কি মেকআপ করবেন তা আগে থেকে বলা খুব মুস্কিল।

গতবছর পূজোয় শুকদেব ছোটদের নিয়ে “ভাষণদাদু” নামে একটা নাটক করেছিল।তাতে তার রোল ছিল এক বুড়ো বাঙ্গালী ভদ্রলোকের। মানে একজন দাদু আর কি। শুকদেব বললো, “ইন্দ্রজিৎদা, পল আমার মেকআপ শেষ করার পরে আয়নায় নিজেকে দেখে আমি তো চমকে উঠলাম।এ কি? আমায় তো একজন দুর্দ্ধর্ষ পর্ত্তুগীজ জলদস্যু মনে হচ্ছে!”

তখন আর বেশী সময় নেই নাটক শুরু হবার, সেই অল্প সময়ে অনেক বলে কয়ে বুঝিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে শুকদেবের মেকআপ পুরো বদলে শেষ পর্য্যন্ত সে যখন স্টেজে নামলো তখন তাকে ঠিক সান্তা ক্লজের মত দেখাচ্ছিল। এক মুখ সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে লাল জামা…

তো এই হল পল!

মেগা রিহার্সালের জন্যে সবাই তৈরী, কিন্তু তার আগে পল কে নিয়ে বসানো হলো আমাদের টিভির ঘরে। সেখানে তাকে আমাদের নাটকের চরিত্রগুলোসব এক এক করে বোঝাতে হবে। কার কি রোল, কার কি রকম dress আর মেকআপ হবে এই সব। শুকদেব আর সুভদ্রা কে এই কাজের ভার দিয়ে আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

ওরা পলকে এক এক করে নাটকের চরিত্র বোঝাতে লাগলো। মাঝে মাঝে ওদের কথা কানে আসছিল~

শুকদেব বলছে ম্যায় হুঁ রাজা, সমঝে না, মতলব King, emperor…

তারপরে দেবাশীষ কে দেখিয়ে ইয়ে হ্যায় সর্দ্দার,মতলব কিং কা আর্মি কা জেনেরাল, কমান্ডার ইন চীফ…

তাপস আর শর্ব্বরী কে ডাকা হলো। ইনকা নাম হ্যায় ফাগুলাল, ইয়ে এক গ্রামবাসী, মতলব ভিলেজার হ্যায়, আউর ইয়ে হ্যায় উনকি বিবি, চন্দ্রা…ইয়ে দোনো সিধাসাধা গাঁও কা আদমী…সিম্পল, সমঝে না?

তারপর এলো অরুণাভ। ইয়ে হ্যায় বিশু পাগল,মতলব পাগলা সা আদমী হ্যায়, ইধর উধর গানা গা কে ঘুমতা, তারপরে শুকদেব ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “কি ইন্দ্রজিৎ দা, বিশুকে ঠিক বুঝিয়েছি তো?”

আমি সন্মতি জানালাম। কি আর করবো? বিশুপাগলের চরিত্র বোঝানো কি সহজ কাজ? ওর থেকে ভাল তো আমিও বোঝাতে পারতামনা।

কিন্তু কল্যাণ কে ডেকে নিয়ে এসে মোড়ল বোঝাতে গিয়ে শুকদেবের হিন্দীতে কুলোলনা, সে হাল ছেড়ে দিয়ে সুভদ্রাকে বললো, “মোড়ল হিন্দীতে কি হবে বৌদি?”

সুভদ্রা বললো আপ মুখিয়া সমঝতে হ্যায়? মুখিয়া? সরপঞ্চ?  

পল তো যথারীতি সবেতেই মাথা নাড়ছে, যেন সব সে পরিস্কার বুঝছে, আর একটা ছোট নোটবুকে কি সব হিজিবিজি লিখে রাখছে, আমাদের impress করার জন্যেই বোধ হয়।

আমি তো পলের ভাবগতিক দেখে ভাবলাম,সব্বোনাশ, শুকদেব এ কাকে ধরে নিয়ে এলো? শেষ পর্য্যন্ত হয়তো দেখবো শো এর দিন রক্তকরবী নাটকে বেশ কিছু পর্ত্তুগীজ জলদস্যু, রঘু ডাকাত আর সান্টা ক্লস মাথায় ফেট্টি বেঁধে স্টেজময় দাপাদাপি করছে।

উঠোনে দাপুটি করে নেচেছিল কাল/

তার পরে কি হইলো জানে শ্যামলাল/

পল চলে যাবার পরে মেগা রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল।

৬)  মহড়া

সুভদ্রা আর সুপর্ণা দুই দিকে বসে প্রম্পট করার জন্যে তৈরী, বনানী হারমোনিয়াম নিয়ে এক দিকে বসে, রথীন তার যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তুত। প্রত্যেকের সামনে খোলা বই। রাজকুমারের চোখ তার ভিডিও ক্যামেরা্র ভিউফাইন্ডারে।   

প্রথম থেকে শেষ কোন interruption ছাড়া রিহার্স করার অনেকগুলো সুবিধে আছে। নাটকটা করতে কতক্ষণ সময় লাগছে তার একটা ভাল ধারণা পাওয়া যায়। তারপরে নাটকটি এক দৃশ্য থেকে পরের দৃশ্যে কত  seamlessly এগিয়ে যাচ্ছে  সেটা জানা যায়, প্রত্যেক অভিনেতা তার পরের entry নিয়ে আগে থেকেই তৈরী হয়ে থাকতে পারে।

পুরো নাটকটা কেমন gel করছে, সেটা ভাগ ভাগ করে করলে ঠিক বোঝা যায়না। Sum of parts make more than a whole বলে ইংরেজীতে একটা কথা আছে। আমাদের ক্ষেত্রে সব পার্ট জোড়া লাগিয়ে নাটকের একটা চমৎকার সামগ্রিক রূপ আমার চোখে ফুটে উঠলো। বুঝতে পারলাম সবাই নাটকটা এবং নিজের নিজের রোল নিয়ে কতোটা সিরিয়াস এবং তৈরী।    

বেশ তরতর করে এগিয়ে চলেছে আমাদের নাটকের নৌকা।এখন আমরা স্টেজ রিহার্সালের জন্যে তৈরী।

মেগা রিহার্সাল শেষ হলে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডার পালা। সমস্বরে সবাই কথা বলছে, নানা আলোচনা, হাসি, গল্প, রসিকতা, ক্যালব্যাল, আমাদের বাড়ীর হলঘর গমগম করতে লাগলো।

আমার খুব ভাল লাগে এই সব হাঙ্গামা!

এইচ টু ও

ইন্টারভিউ – হ্যান্ডশেক

এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকে একটা চাকরীর ইন্টারভিউ এর সীন ছিল। তাতে এক এক করে  অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ রা  একটা ঘরে ইন্টারভিউ দিতে ঢুকছে। কিন্তু ওদের বের করে দেওয়া হচ্ছে অন্য দরজা দিয়ে।

কেন?

লেখক এর একটা সংলাপ আছে সেখানে সে বলছে  আসলে ওদের বেশী প্রশ্ন নেই তো, একই প্রশ্ন সবাইকে করছে, তাই ওরা চায়না যে বাইরে বেরিয়ে এসে কেউ তার প্রশ্নগুলো তার বন্ধুদের বলে দিক।

এই নিয়ে নীচের গল্প টা~

বেঙ্গল কেমিকাল কোম্পানী চীফ কেমিস্ট চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তার উত্তরে হাজার হাজার  প্রার্থীর দরখাস্ত এসেছে।  যদিও  চাকরীর জন্যে কেমিস্ট্রী  তে মাস্টার্স ডিগ্রী যথেষ্ট বলা হয়েছে , কিন্তু প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই  ডক্টরেট আর অনেকের আবার পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রী!   

ইন্টারভিউ এর দিন প্রচন্ড ভীড়, যাকে বলে লোকে লোকারণ্য, অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের “প্রতিদ্বন্দ্বী” ছবির সেই ইন্টারভিউ এর সীনটার মত।

দুই বন্ধু এসেছে ইন্টারভিউ দিতে। তাদের মধ্যে একজন খুব সাজগোজ করে এসেছে, স্যুট টাই, পায়ে চকচকে পালিশ করা জুতো। সে ভেবেছে এখানে যারা এসেছে সবারই তো দরকারী শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, সে ব্যাপারে কেউ কাউকে বেশী টেক্কা দিতে পারবেনা, যদি ভাল সেজেগুজে এলে একটু চোখে পড়া যায়!

বেঙ্গল কেমিকাল কোম্পানীর চীফ কেমিস্ট বলে কথা, সে তো কোম্পানীর একজন বড়সাহেব,   তাকে স্যুট টাই না পরলে মানাবে কেন?

একটু সকাল সকালই তার ডাক পড়লো। যাঁরা ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, তাঁরা তার ফিটফাট চেহারা আর সাজগোজ দেখে  বেশ চমৎকৃত, তাঁদের মধ্যে  একজন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার জুতোটা তো খুব ভাল পালিশ করেছো, আয়নার মত চকচক করছে!”

যদিও সে একটু আগে রাস্তার মোড়ে জুতো পালিশওয়ালার কাছে জুতো পালিশ করিয়ে এসেছে, তবু তার মনে হল সে কথা বললে তার কিছু নম্বর কাটা যেতে পারে। এঁরা ভাববেন যে নিজের জুতো নিজে পালিশ করেনা সে কি করে চীফ কেমিস্টের  এর দায়িত্ব সামলাবে?

সে একটু রেলা নিয়ে বললো “আমি নিজেই পালিশ করেছি স্যার~”

“কি দিয়ে পালিশ করলে?” জিজ্ঞেস করলেন আর একজন, একটু মজা করেই। এত প্রার্থী কে রুটিন একঘেয়ে প্রশ্ন করতে করতে মাঝে মাঝে একটু অন্যরকম প্রশ্ন করতে ভালই লাগে।

কি দিয়ে?

প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে পরে সামলে নিয়ে ছেলেটি বললো, “চেরী ব্লসম বুটপালিশ দিয়ে স্যার!”

“চেরী ব্লসম, হুম!” বললেন পরীক্ষক, “আচ্ছা, তুমি বুট পালিশের কেমিকাল ফর্মূলা জানো?”

সব্বোনাশ! এটা তো জানা নেই! বেচারা চুপ করে রইলো। সে যে এই ফ্যাসাদে পড়বে কে জানতো?

“বেঙ্গল কেমিকাল কোম্পানী এখন বুট পালিশ তৈরী করেনা ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে তো করতেই পারি আমরা। তাই না? তাহলে আমাদের  ভবিষ্যৎ চীফ কেমিস্ট হিসেবে আমরা তো আশা করতে পারি যে তুমি অন্ততঃ আমাদের  ভবিষ্যৎ কার্য্যকলাপ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবে। ”

ইন্টারভিউ এর শেষে সে বাইরে বেরিয়ে আসতেই তাকে ছেঁকে ধরলো সবাই। “কি জিজ্ঞেস করছে একটু বলুন না প্লীজ?”  

ইন্টারভিউ

কাউকে নিজের বেইজ্জতের কথা না বললেও তার বন্ধু তার মুখ দেখেই বুঝেছে যে কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। সব শুনে বন্ধুটি বলল “আমায় তোর জুতোটা দে তো, আমি তোর জুতো পরে ইন্টারভিউ দেবো।”

“তুই আমার জুতো পরবি? তোর তো দু সাইজ ছোট হবে~”

“দে না, আমি ঠিক পরে নেবো, ভাবিস না!”

তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে, দিন প্রায় শেষ, বন্ধুটির যখন ডাক পড়ল, তখন বাইরে আর মাত্র কয়েকজন প্রার্থী বাকি। ভেতরে পরীক্ষকরাও ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।

দুই সাইজ ছোট জুতো পরে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরে ঢুকে ছেলেটি পরীক্ষক দের সামনে  “গুড আফটারনুন স্যার!” বলে দাঁড়িয়ে রইলো, চেয়ারে আর বসেনা।

“কি হলো, বসুন!” পরীক্ষকরা বেশ বিরক্ত।

“আমার জুতো স্যার!”, বিগলিত হেসে নিজের পায়ের জুতোর দিকে ইঙ্গিত করে দেখালো সে।

“কি হয়েছে তোমার জুতোর?” পরীক্ষকরা কিছুটা হতভম্ব, তাঁদের সহ্যের সীমা ক্রমশঃ ছাড়াচ্ছে।

“আমি আমার জুতো নিজেই পালিশ করেছি স্যার!”

“So what?” এবার চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলেন এক পরীক্ষক।

“আমি আমার জুতো জল দিয়ে পালিশ করেছি স্যার!” বললো ছেলেটি।

তার পরে একগাল হেসে, “আর জলের কেমিকাল ফর্মূলা হলো  এইচ টু ও স্যার!”

———

বন্ধুটির সেই চাকরীটা শেষ পর্য্যন্ত হয়েছিল কিনা তা জানা নেই।

বাইরে বসে বাকি প্রার্থীদের সম্ভাব্য প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা

কুয়েতে পাগলা ঘোড়া

১ –  নাটক 

২০০৯ সালের ২৭ শে নভেম্বর (শুক্রবার) সন্ধ্যায় কুয়েতের সালমিয়ার  ইন্ডিয়ান স্কুলের স্টেজে আমরা  বাদল সরকারের “পাগলা ঘোড়া” নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম। ষাট সত্তরের দশকে কলকাতায় এই নাটকটি সাফল্যের সাথে প্রথম মঞ্চস্থ করেন বহুরূপী। তারপর এতগুলো বছরে নাটকটি বহু ভাষায় অনুদিত হয়ে পৃথিবীর বহু জায়গায় আজও অভিনীত হয়ে চলেছে।  

পাগলা ঘোড়া নাটকের ভিতরে চারটে গল্প।  প্রত্যেকটি গল্পের মূল বিষয়  হলো পুরুষ আর নারীর সম্পর্ক নিয়ে।  প্রতি গল্পেই মেয়েদের ভালবাসা  হলো নিঃস্বর্ত্ব আত্মসমর্পন, আর পুরুষদের প্রেম মানেই হলো একতরফা অধিকারবোধ আর প্রত্যাখ্যান। 

যদিও বাদল বাবু এই নাটক কে ভালবাসার নাটক বলেছেন, কিন্তু মনে করা হয় নাটকটি আমাদের দেশে একদিকে  patriarchal সমাজ, আর অন্যদিকে মেয়েদের lack of empowerment নিয়ে লেখা।  

এই নাটকের পটভূমিকা হল গ্রামের প্রান্তে একটি শ্মশান।  সেখানে এক রাতে চারজন পুরুষ এসেছে একটি মেয়ের মৃতদেহ দাহ করতে। সেই শ্মশানবন্ধুরা হলো  কার্ত্তিক কম্পাউন্ডার, পোস্টমাস্টার শশী,  কন্ট্রাকটর সাতকড়ি (সাতু) আর এদের থেকে অপেক্ষাকৃত  অল্পবয়েসী  তরুণ স্কুলশিক্ষক হিমাদ্রি। বাইরে চিতা জ্বলছে, আর ঘরের ভিতরে  সময় কাটাবার জন্যে একটা তক্তাপোষে বসে তাস খেলছে ওই চার জন, সাথে সাতুর আনা বিলায়েতী হুইস্কি। 

হঠাৎই ওই চারজনের মধ্যে এসে হাজির হয় আর একজন।  যে মেয়েটির দেহ পুড়ছে বাইরের চিতায়, এ হলো সেই মেয়েটির অশরীরী আত্মা। ওই চার জন তাকে দেখতে পায়না,  কিন্তু সে তাদের আশেপাশে ঘোরে, তাদের সাথে কথা বলে। রাত বাড়ে, চার জনের নেশা ক্রমশঃ জমে ওঠে। আর অদৃশ্য সেই মেয়েটি কেমন করে যেন একটা অদ্ভুত প্রভাব ফেলতে শুরু করে তাদের মনের ওপরে।  মেয়েটি বার বার তাদের জীবনের ভালোবাসার গল্প বলতে উৎসাহিত আর অনুপ্রাণিত করতে থাকে।

“বলো না তোমার গল্পটা?  খুব মিষ্টি গল্প! আমার খুব ভালো লাগে।”

তারপরে গ্রামের শ্মশানের সেই গা ছমছম করা অন্ধকার রাতে, এক এক করে বেরিয়ে আসে তাদের চার জনের জীবনের চারটি ভালোবাসার গল্প। প্রেম আর অপ্রেম, নিবেদন আর প্রত্যাখ্যান, আকুলতা আর যন্ত্রণা, পাওয়া আর পেয়ে হারানোর সেই চারটে গল্প নাটকের মধ্যে  ফ্ল্যাশ ব্যাক এর মধ্যে দিয়ে দর্শকদের সামনে ফুটে ওঠে। 

২) মঞ্চ, আলো, আবহ আর পোষাক

পাগলা ঘোড়া নাটকের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মঞ্চ।    

প্রথমতঃ সেখানে শ্মশানের পরিবেশ ফোটাতে হবে। তারপর  আরও নানা ঝামেলা। অশরীরি আত্মা, চার চারটে আলাদা গল্প। শশীর সাথে মালতী, হিমাদ্রির সাথে মিলি, সাতুর সাথে লক্ষ্মী,  আর কার্ত্তিকের সাথে ওই মেয়েটা যে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গুগল করে দেখা গেল বহুরূপীর পাগলা ঘোড়া নাটকে খালেদ চৌধুরীর স্টেজ একেবারে authentic শ্মশান ! বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরী একচালা ঘর, দেয়ালে চাটাই আর মাদুর, টিমটিম করে লন্ঠনের আলো জ্বলছে। বাইরে একটা  ফাঁকা জায়গা, এক পাশে গাছের তলায় একটা বেদী আর অন্য দিকে জ্বলন্ত চিতা।    

আবার USA র New Jersey তে অমল পালেকারের সাম্প্রতিক নাটকে স্টেজ   হলো  modern আর abstract, তাকে শ্মশান বলে বোঝার জো নেই।  একটা ভাঙা চোরা লাল ইঁট বের করা দেয়াল, আর ঝকঝকে বিশাল স্টেজ জুড়ে  চারটে নানা লেভেলের rectangular platform, এক একটা লেভেলে এক  জনের flash back সীন, আর প্রত্যেক সীন আলাদা করে বোঝাবার জন্যে আলাদা রং এর আলো।

বাস্তব না বিমূর্ত? আমরা বাস্তবের দিকেই ঝুঁকলাম।

নাটকে নয়টা ফ্ল্যাশব্যাক সীন, যেখানে ওই চারজনের অতীত জীবন ফুটে উঠবে। সুতরাং মঞ্চকে দুই ভাগে ভাগ করে একদিকে দেখাতে হবে একটা ঘরে চারজন তাস খেলছে, আর অন্য দিকে দেখাতে হবে ফ্ল্যাশ ব্যাক সীনগুলো। নাটক মাঝে মাঝেই দর্শকদের নিয়ে যাবে বর্ত্তমান থেকে অতীতে।  আর সেই time travel বোঝাতে আমাদের ব্যবহার করতে হবে আলো আর আবহ।  

মঞ্চ তৈরীর ভার যার ওপর তার নাম হলো পার্থসারথি বর্দ্ধন। সে আবহের ও দায়িত্বে। আর আলোর ভার নিয়েছে অমিতেন্দ্র বাগচী।   

বর্ত্তমান থেকে অতীতে যাবার মূহুর্ত্তে এবং অতীত থেকে বর্ত্তমানে ফিরে আসার মূহুর্ত্তে দর্শকদের বোঝানোর জন্যে  আমরা বিশেষ একটা ভূতুড়ে আবহসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলাম।  আর  স্টেজের যে দিকে অভিনয়  চলছে, সেদিকটা আলোকিত করে তখন অন্যদিকে কিছুটা অন্ধকার করে রাখতে হবে। ফ্ল্যাশব্যাক সীনে অভিনয় চলার সময় অন্যদিকে তক্তাপোষে বসা অল্প আলোয় দেখা যাবে তাস খেলোয়াড়রা freeze করে গেছে, তারা হাত পা নাড়াচ্ছেনা, কথা বলছেনা, তারা একেবারে স্ট্যাচুর মত নিশ্চুপ। 

বাদল সরকারের  অনেক নাটকে আঙ্গিকের এই ধরণের  অভিনবত্ব দেখা যায়।  ষাটের দশকে তাঁর নাটকগুলো জনপ্রিয় হবার পিছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল।   

নাটকে চারটি  মেয়ে।  আমাদের নাটকে দীপা একাই চারটে রোল করছে।  সুতরাং তাকে আলাদা করে দর্শকদের কাছে পৌছনোর জন্যে আমরা পোষাক আর অন্য প্রপ্‌ ব্যবহার করেছিলাম।  যে মেয়েটি র অশরীরি আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সাথে মালতীর তফাত বোঝাতে মালতীর গায়ে একটা শাল।  আর মিলি অল্পবয়েসী  বড়লোকের মেয়ে, তার পায়ে হিল তোলা জুতো, চলায় একটা ছন্দ, কথা বলার ভঙ্গীতে একটা মাদকতা।   লক্ষীকে করে দিলাম কাঠ বাঙাল। তার সংলাপ গুলো সব বাঙাল ভাষায় লেখা হলো।

বাদল বাবু তো আঙ্গিক তৈরী করেই খালাস, এদিকে সেই সব আঙ্গিক নাটকে প্রয়োগ করতে গেলে অনেক হ্যাপা পোয়াতে হয়।

৩ –  আমাদের  মঞ্চ  নির্মাণ

বহুরূপীর design follow করে পার্থ আমাদের স্টেজ কে দুই ভাগে ভাগ করেছে, এক দিকে ঘর যেখানে চৌকি আর তক্তাপোষের  ওপরে বসে চারজন তাস খেলবে, আর অন্যদিকে ফাঁকা একটু জায়গা আর একটা বেদী আর চাতাল যার মাঝখানে একটা গাছ, সেখানে flash back সীন গুলো হবে।  ঘরের তিন দিকে কোন দেয়াল নেই,    পিছনে একটা প্লাস্টার ওঠা স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আর দু’দিকে শুধু দুটো জানলা আর একটা দরজার ফ্রেম। একটা নীচু মত দেয়ালও  পিছনে  (half wall) রাখা হলো, সেখানে চার জন মাঝে মাঝে গিয়ে বসবে।

তো শো এর  দিন (শুক্রবার) সকাল দশটা নাগাদ ইন্ডিয়ান স্কুলে গিয়ে দেখি পার্থ তার সাকরেদদের  নিয়ে কাজে লেগে গেছে। কাজের সরঞ্জাম সব পার্থ যোগাড় করে নিয়ে এসেছে। থার্ম্মোকোল, পেন্ট, ব্রাশ, কাঁচি, ছুরি, দড়ি, তার, সুতো, আঠা,  পেরেক, হাতুড়ি ইত্যাদি আরও যা যা  কিছু দরকার। এছাড়া নানা রকম  prop  যেমন মা কালীর ছবি, গামছা, লন্ঠন চিতা জ্বালাবার জন্যে Electronic fire এই সব।

স্টেজটা চোখের সামনে আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে লাগলো।

কুয়েতের রাস্তায় এখন অনেক ঝাঁকড়া গাছ, সেই গাছের বেশ কিছু ডাল কেটে এনেছে পার্থ। একটা গাছ বসবে স্টেজে চাতালের বেদীর মাঝখানে, আর বাকি ডালগুলো কেটে ছুলে চিতার কাঠ বানানো হবে।  পার্থ কাঠগুলো কে  একটার পর একটা  layer করে সাজিয়ে স্টেজের সামনে রেখে দিয়ে তার ওপরে Electronic fire জ্বালিয়ে দিলেই বেশ চিতা বলে মনে হবে।  

পার্থ বেদীতে একটা leafy গাছের ডাল দাঁড় করিয়ে ডালটা যাতে বেঁকে পড়ে না যায় সে জন্যে তিন দিকে তিনটে তার দিয়ে বেদীর নীচে কাঠের baton এর সাথে বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ডাল টাকে এবার বেশ গাছ গাছ মনে হচ্ছে।   

ঘরের পিছনে দেয়ালটা পার্থ থার্ম্মোকোল দিয়ে তৈরী করলো, তার মধ্যে কিছু জায়গায় প্লাস্টার খোলা লাল ইঁট আঁকা।  স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল বোঝাতে কিছু জায়গায় ভিজে বোঝাতে নীল রং বুলিয়ে দেওয়া হলো। জানলা দরজার ফ্রেম গুলো stable আর strong করার জন্যে পার্থ সেগুলো নীচে কাঠের platform এর সাথে শক্ত করে তার দিয়ে বেঁধে রেখেছে।

বিকেল পাঁচটার আগেই স্টেজ ready হয়ে গেল। বহুরূপীর মত authentic শ্মশান তৈরী করতে না পারলেও আমাদের শ্মশান মোটের ওপর বিশ্বাসযোগ্য।   

সব শেষে কিছু খুচরো কাজ ছিল, যেমন দেয়ালে কিছু পেরেক ঠুকে মা কালীর ছবি, বাংলা ক্যালেন্ডার এই সব লাগানো। গামছা আর এক ঘটা গঙ্গাজল লাগবে লাস্ট সীনে।  গামছা টাঙাবার জন্যে একটা দড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হলো পিছনে।  লন্ঠনটা দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো নিয়ে আমার মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল, আমার ইচ্ছে ছিল ওটাকে half wall এর ওপরে রাখতে। আমি পার্থ কে বললাম “দেখো,  লন্ঠন টা পেরেকে ঝোলালে, পড়ে যাবে না তো?”

পার্থ বললো, “আরে না না”…

 ৩  –  কি হতে পারতো, কিন্তু হয়নি         

বাদল সরকারের এই নাটক কে জনপ্রিয় করার পিছনে বহুরূপী আর শম্ভু মিত্রের অবদান অনস্বীকার্য্য, তাই নাটকের শুরুতেই আমরা বি সি এসের তরফে আমাদের এই নাটককে শম্ভু মিত্রের স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করলাম।

তারপর নাটক তো শুরু হয়ে গেল।  

অমিতেন্দ্র আলোর সরঞ্জাম নিয়ে দরকার মত আলো জ্বালাচ্ছে নেবাচ্ছে,  আর আমার অন্য পাশে পার্থ, তার কাজ হল  ঠিক সময়ে Audio clip গুলো play করা।  শ্মশানের রাত বোঝাতে ঝিঁঝিঁ পোকা আর শেয়াল কুকুরের ডাক, দূরে রেলগাড়ীর হুইসিল, এই সব ক্লিপ সে যোগাড় করে সি ডি তে রেকর্ড করে নিয়ে এসেছে।  আমি বসে আছি ওদের দুজনের মাঝখানে।   

সেদিন আমি খুব নার্ভাস ছিলাম, প্রথম থেকে tense হয়ে বসে ছিলাম সারাক্ষণ আর প্রতি মূহুর্ত্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কোন একটা ভুল হলো।  

কতরকম ভুল হতে পারে আমাদের amateur নাটকে!

সেদিন সকাল থেকে সারা দিন পার্থর সাথে থেকে চোখের সামনে একটু একটু করে স্টেজ তৈরী হতে দেখেছি।  বাইরে চাতালের গাছটা জানি পার্থ পাতলা তিনটে তার দিয়ে শক্ত করে বেদীর নীচে কাঠের ব্যাটন পুঁতে তার সাথে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু কি জানি সেই সুতো খুলে গাছটা দুম করে মেয়েটার মাথার ওপরে পড়বেনা তো? বলা যায়না।  

দুপুরে পার্থ  মাঝে মাঝে দেয়ালে পেরেক ঠোকার সময়ে লাল ইঁটের থার্মোকোল খুলে পড়ছিল। মাত্র কয়েক ঘন্টায়  এখন glue কি শুকিয়েছে, না সেগুলো এখনো আলগা আছে? হঠাৎ  দেয়ালে কারুর হাত লাগলে খুলে পড়লে তো হয়েছে আর কি! দর্শকরা কি ভাববে যে পুরনো বাড়ী, তাই দেয়াল ভেঙে পড়ছে?

তার ওপরে আরও কত চিন্তা!

প্রথম সীনে সেই অশরীরি মেয়েটির হাসির সীনে দেয়ালের পিছনে মেয়েটাকে উঁচুতে তোলার জন্যে একটা চেয়ার আর তার ওপরে দাঁড়াবার জন্যে একটা টুল রাখা আছে। সেখানে উঠতে বা নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে সে পা ভাঙলেই তো কেলেঙ্কারী।    

সাতু যখন খুব ভাবপ্রবণ হয়ে জানলার ফ্রেমে হাত দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় তার সংলাপ বলছে আমি দেখছি জানলার ফ্রেমটা ভূমিকম্পের মত দুলছে। এই রে, এখন জানলা শুদ্ধ সাতু উলটে পড়বে না কি? চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, ওরে সাতু সাবধান, জানলা তে হাত দিস্‌না, জানলা শুদ্ধ উলটে পড়বি!

কিন্তু  thankfully এসব কিছুই হলোনা। 

বরং কিছু কিছু জায়গায় দেখলাম ওরা বেশ নিজেরাই উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু মুস্কিল আসান করে দিলো। বিলায়েতী হুইস্কির বদলে আমরা বোতলে ভরে লাল চা নিয়ে এসেছিলাম। বোতল দেখে যাতে বোঝা না যায় জনি ওয়াকার বা অন্য কোন চেনা ব্র্যান্ড। খবরের কাগজে নাটকের ছবি বেরোবে, সেখানে জনি ওয়াকারের বোতল দেখলে তো নির্ঘাত জেল এবং দেশ থেকে বহিস্কার। সাদামাটা কাঁচের বোতল জোগাড় করা হয়েছিল  নাটকের জন্যে। তো যাই হোক, একটা সীনে কারুর হাতে লেগে কিছুটা চা গ্লাস থেকে চলকে তক্তপোষে পড়ে যায়।  হিমাদ্রী দেখলাম smartly উঠে গামছা দিয়ে জায়গাটা মুছে পরিস্কার করে দিলো।   

নাটকের মধ্যে মাঝে মাঝেই হুইস্কির গেলাস refill করতে হচ্ছে, কিন্তু মুস্কিল হল দু’ঘন্টা ধরে কত আর ঠান্ডা চা খাওয়া যায়? তাই গেলাস আর কারুর ফুরোচ্ছেনা। এক সীনে সাতু “দিন শশী বাবু, আপনার গেলাসটা ভরে দিই” বলতে গিয়ে দেখে গেলাসটা already ভরা। সে চমৎকার সংলাপটা বদলে বললো “শশীবাবু আপনার গেলাস তো ভরাই আছে মশাই, খান্‌, খান্‌…”

এদিকে আমি সামনে বসে চমকে উঠলাম। “ভরাই আছে?” ওরকম কোন সংলাপ তো ছিলোনা নাটকে?

তো যাই হোক, লন্ঠনটা শেষ পর্য্যন্ত পড়ে ভাঙেনি ঠিকই, কিন্তু পড়ে গেলেও আমার মনে হয় ওরা পাঁচ জন ঠিক সামলে নিতো।

ধরা যাক হঠাৎ লন্ঠনটা দুম করে পড়ে ঝনঝন শব্দ করে চৌচির হয়ে ভেঙে গেল আর সেই কাঁচ ভাঙার আওয়াজ Floor mike গুলো capture  আর amplify করে সারা হলে ছড়িয়ে  দিলো।

তখন? 

আমি জানি তাহলে নাটকের সংলাপগুলো একটু পালটে যেতো।

অনেকটা এই রকম~

———————————– 

শশী (কিছুটা দার্শনিক ভঙ্গী তে গম্ভীর গলায়)  – হুম্‌ম্‌ম্‌, লন্ঠনটা ভাঙলো তাহলে?

হিমাদ্রি (বিরক্ত হয়ে) –  তা আর ভাঙবেনা শশী দা’? এত করে বললাম ওটা হাফ ওয়ালের ওপরে রাখুন। আপনি কথা শুনলেন না। দেখি এখন কাঁচ গুলো কুড়াই গিয়ে…

 শশী (ওঠার নাম না করে, গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে) – না না, তুমি কেন ? আমি, আমি দেখছি…

সাতু (জড়িত কন্ঠে) – আপনারা তো বেশ মুস্কিলে ফেললেন দেখছি – এখন আমি একটা ঝাঁটা পাই কোথায়…

কার্ত্তিক (হাত দুটো বাড়িয়ে নাটকীয় সুরে) – আরে ঝাঁটা দিয়ে কি হবে? আমার গামছাটা নিয়ে নাও না, ওটা তো লাস্ট সীনে কাজে লাগছেনা। দেখো হিমাদ্রি সাবধানে কুড়িও, কাঁচ যেন পায়ে না ফোটে…

মেয়েটা (কান্না কান্না গলায়) – এই তোমরা কি সারারাত শুধু ঝাঁট দিয়ে যাবে নাকি? তোমাদের গল্প গুলো বলবেনা? এদিকে আমি যে পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম…

সাতু (আরও জড়িত গলায়) – নাঃ আপনারা দেখছি আমাদের নাটকটার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিলেন মশাই।

নাঃ বারোটা কিছু বাজেনি, মোটের ওপরে নাটক টা ভালোয় ভালোয় উতরেই গেছে শেষ পর্য্যন্ত।

বি সি এসে র পক্ষ থেকে আমরা বাদল বাবু কে তাঁর সন্মানী চেক পাঠিয়েছি্লাম অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়  (কার্ত্তিক কম্পাউন্ডার) এর হাত দিয়ে, তিনি আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন অভিজিৎ এর হাতে। এই সাথে তার দুটো ছবি।

বাকি ছবি আমাদের কাস্ট পার্টির আর সবশেষে স্থানীয় খবরের কাগজ কুয়েত টাইমসে রিভিউ। সেখানে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, বলা বাহুল্য আমাদেরই লেখা।