Tag Archives: বন্ধু

সেন্ট লরেন্স ১৯৬৩ ব্যাচ  –  স্বর্ণজয়ন্তী সভা – শনিবার ১১ই জানুয়ারী, ২০১৪

 ১ দীপঙ্করের ফোন

১৯৬৩ সালে হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার পরে স্কুল ছেড়েছিলাম।  তার পর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল! স্কুল ছাড়ার স্বর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করতে আমরা স্কুলের বন্ধুরা জড়ো হচ্ছি দীপঙ্করের বাড়ী। শনিবার ১১ই জানুয়ারী, ২০১৪।

প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে যাওয়ায় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই ক্রমশঃ যোগাযোগ বেড়েছে। বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিয়মিত ইমেল চালাচালি হয়, যারা কলকাতায় থাকে তারা মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে বা ক্লাবে একটা সন্ধ্যা একসাথে কাটায়।  যারা বিদেশে থাকে তারা ছুটিতে দেশে এলে দেখা করে।

কিন্তু আমাদের স্কুলের বন্ধুদের আনুষ্ঠানিক রি-ইউনিয়ন এই প্রথম।    

প্রথম প্রস্তাবটা আসে প্রবীরের (ঘোষ) কাছ থেকে। তারপর প্রবীর, দীপঙ্কর (চ্যাটার্জ্জী), উৎপল (সোম), বিপ্লব (রায়) এবং আরো কয়েকজন একসাথে বসে দিনটা ঠিক করে আমাদের বাকিদের ইমেলে জানায়।  শেষ পর্য্যন্ত প্রবীরদের উদ্যোগে  আমাদের সহপাঠী দের একটা প্রাথমিক লিস্ট তৈরী হয়, সবার নাম ঠিকানা, ইমেল, টেলিফোন নম্বর একটা স্প্রেডশীটে ফেলে সবাইকে পাঠানো হয়।  

আমাদের মধ্যে অনেক বন্ধুই এখন দেশের বাইরে থাকে – এদের মধ্যে যারা আসতে পারবেনা, তারা সবাই মেলে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

এরা ছাড়াও আরও অনেক স্কুলের বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। এরা সব কোথায়? আজকের এই ইন্টারনেট আর ফেসবুকের যুগে তার লুকিয়ে আছে কি করে? এদের সাথে একদিন না একদিন ভবিষ্যতে যোগাযোগ হবেই, প্রবীরের ধারণা।

আমি ২০১৩ র ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কুয়েত থেকে কলকাতা পৌঁছে গেছি। পুরনো বন্ধুদের সাথে এত বছর পরে দেখা হবে ভাবতে বেশ ভালো লাগছে। 

ঠিক এক সপ্তাহ আগে শনিবার ৪ঠা জানুয়ারী সকালে বাড়ীতে হঠাৎ এক ফোন। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মে আই স্পিক্‌ টু মিস্টার ভৌমিক?”

অবাক হলাম না, এই মেয়েটির ফোন আমি আগেও পেয়েছি। মেয়েটি হলো দীপঙ্করের সেক্রেটারী, এবং আমি বাঙ্গালী জেনেও কেন জানিনা সে ইংরেজীতেই আমার সাথে কথা বলে।

আমিও ইংরেজিতেই জবাব দিলাম। “ইয়েস, স্পিকিং”। মেয়েটি বললো “প্লিজ হোল্ড অন, মিস্টার দীপঙ্কর চ্যাটার্জ্জী উইল স্পিক টু ইউ।”

দীপঙ্কর হলো ওর অফিসের বিগ বস্‌, তাই ও নিজে কখনো ফোন করেনা।

কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর ফোনের ওপার থেকে দীপঙ্করের মন্দ্র কন্ঠ ভেসে এলো।

“ইন্দ্রজিৎ!”

আর একটু হলেই বলতে যাচ্ছিলাম “ইয়েস স্যার”, কিন্তু শেষ মূহুর্ত্তে সামলে নিয়ে বললাম, “দীপঙ্কর! বলো কি খবর?”

দীপঙ্কর বেশী সময় নষ্ট করেনা, সোজা পয়েন্টে চলে আসে। সে বললো, “আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়ীতে কে কে আসছে জানো?”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “কে কে আসছে?”

দীপঙ্কর বললো, “প্রবীর ঘোষ, বিপ্লব রায়, উৎপল সোম, প্রদীপ ব্যানার্জ্জী আর অমিতাভ মল্লিক।”

আমি বললাম, “বাঃ, এ তো চাঁদের হাট~”

দীপঙ্কর বললো, “তুমিও চলে এসো।”

আমি একটু মিন মিন করে বলতে গেলাম আমি তো এগারো তারিখ আসছি, আজ বাড়ীতে মেয়ে জামাই আর দুই নাতনী আছে, আজ একটু অসুবিধে…কিন্তু দীপঙ্কর কোন কথাই শুনবেনা।

শেষ পর্য্যন্ত ঠিক হলো আমি এক ঘন্টার জন্যে যাবো।

তো চলে গেলাম।

 ২ প্রস্তুতি 

জানুয়ারীর চার তারিখে সন্ধ্যায় দীপঙ্করের বাড়ী গিয়ে দেখি সবাই এসে গেছে, অনুষ্ঠান কোথায় হবে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রবীর দেখি খুব চিন্তিত মুখে হাতে একটা ফোন নিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। প্রবীরের চেহারাটা আগের মতোই আছে, ব্যাকব্রাশ চুল, ছিপছিপে, মাথার সামনেটা একটু ফাঁকা হতে শুরু করেছে।

প্রবীর, উৎপল আর অমিতাভর সাথে কলকাতায় এলে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, কিন্তু বিপ্লব আর প্রদীপের সাথে সেই স্কুল ছাড়ার পরে এই প্রথম দেখা। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান, তবু আমাদের পরস্পর কে চিনতে কোন অসুবিধে হলোনা। সবাই সবাই কে জড়িয়ে ধরলাম। আগের মতোই তুই বলে সম্বোধন করলাম নিজেদের, খবরাখবর নিলাম, কে কোথায় আছে, কি করছে, ইত্যাদি। প্রদীপের মাথার চুল আমার মতোই সাদা, বিপ্লবের মাথায় বেশ বড় টাক। অমিতাভ আর উৎপল এর চেহারা তেমন পাল্টায়নি, অবশ্য ওদের সাথে তো মাঝে মাঝে দেখা হয়, তাই পাল্টালেও তেমন চোখে পড়েনা।

প্রবীরের হাতে একটা লম্বা লিস্ট, সে হিসেব করে বলে দিল ১১ তারিখ কতো জন আসবে।  দীপঙ্করের বাড়ীর বাইরের ঘরটা বেশ বড় আর সাজানো, সেখানে আমাদের বসার জন্যে অনেক সোফা আর চেয়ার সাজানো আছে।  তা ছাড়া তার ডাইনিং রুম টাও বেশ বড়, আর খাবার গরম করার জন্যে তার কিচেনেও যথেষ্ট জায়গা আছে।    

কে কে আসছে আর কে কে আসতে পারবেনা সেই নিয়েও আলোচনা হলো। অনেকেই আসবে –  যেমন অরুণাভ ঘোষ  থাকে ইংল্যান্ডে – এখন ছুটিতে কলকাতায়, অজয়নাথ রায়, প্রদীপ ভট্টাচার্য্য, প্রদীপ সোম, সুবীর ঘোষ। বোধহয় ক্লাস নাইন বা টেনে ভাস্কর চ্যাটার্জ্জী আমাদের স্কুল থেকে ট্র্যান্সফার নিয়ে চলে যায়, শুনলাম ভাস্করও আসবে। এদের সাথে সেই স্কুল ছাড়ার পর আর আমার দেখা হয়নি। ওদের সাথে আবার দেখা হবে ভাবতেই বেশ ভাল লাগছিল। সেই সব পুরোনো মুখ আর হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা স্মৃতিতে ভেসে আসছিল।

আলোচনার মধ্যে দীপঙ্করের লোকেরা চা আর খাবার দাবার নিয়ে এলো। নানা ধরনের পদ, দীপঙ্কর সব বেঙ্গল ক্লাব থেকে আনিয়েছে। 

গল্পে গল্পে কখন এক ঘন্টার জায়গায় দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে, ইচ্ছে না থাকলেও তাই উঠতেই হলো।

সামনের শনিবার ১১ই জানুয়ারী আবার দেখা হবে বলে উঠলাম।

রবীন নাগ অজয়নাথ রায়

১১ই জানুয়ারী, ২০১৪

দীপঙ্করের বাড়িতে সুভদ্রা আর আমি যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে সাতটা। বেশী দেরী হয়নি ভেবেছিলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি হাউসফুল, পার্টি শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। প্রবীর আমায় দেখে বললো, “একি হেরি, এত দেরী? আমি তো ভাবলাম তুই আর আসবিনা।”

দীপঙ্করের বিরাট হলঘর, বেশ গমগম করছে দেখলাম, পার্র্টি জমে উঠেছে, মেয়েরা সবাই সোফায় বসে গল্পে মশগুল, ছেলেরা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আলাপে ব্যস্ত। গ্লাসের গায়ে বরফের ঠোকাঠুকির টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।  দীপঙ্কর গৃহস্বামী, গোলগাল, মাথায় টাক, গালে আধপাকা দাড়ি, ট্রাউজার্স সার্ট আর ব্রেসে তাকে দেখতে বেশ সম্ভ্রান্ত লাগছে। অনেকটা Solzhenitsyn এর মত। সে দেখি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার স্টাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর কারুর প্লেট বা গ্লাস ফাঁকা দেখলেই তাদের নাও নাও বলে যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত করছে।

সেদিন আমার শরীর টা ভাল ছিলনা, সর্দ্দি জ্বর, ক্রোসিন খাচ্ছি সকাল থেকে,  কিন্তু দীপঙ্কর কিছুতেই ছাড়বেনা, আরে খাও খাও বলে সে আমায় একটা সিঙ্গল্‌ মল্টের এর গ্লাস ধরিয়ে দিল।

চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, অনেক অচেনা অল্পচেনা প্রৌঢ় মুখ। এরা কি তারাই, যাদের সাথে শৈশব আর কৈশোরের কমবেশী দশ বছর একসাথে কাটিয়েছি আমি? ভাল করে তাকিয়ে সেই কিশোর মুখগুলো চিনে নেবার চেষ্টা করলাম। কঠিন কাজ। সেই কিশোরেরা তো আজ আর কেউ নেই, সবাই হারিয়ে গেছে, জীবনের সেই দিনগুলোর মতোই। আর তাদের সাথে হারিয়ে গেছি সেই ছোটবেলার আমিও।

এখন যাদের আমার চারিপাশে দেখছি তার সবাই প্রাজ্ঞ, প্রবীণ, কারুর মাথায় টাক, কারুর ভুঁড়ি, কারুর মাথাভর্ত্তি পাকা চুল। স্কুলজীবনের সেই হাফপ্যাণ্ট পরা হাসিখুসী উচ্ছল ছেলেগুলো কোথায় গেল? তারা আজ কেউ  হাইকোর্টের  বিচারক বা উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা, কেউ লব্ধপ্রতিষ্ঠ ইঞ্জিনীয়ার, আবার কেউ সফল ব্যবসায়ী।

এদের আমি চিনিনা।

জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত, ওঠা পড়া, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। এখন আমাদের জীবন ঘিরে আছে নতুন আপনজনেরা, স্ত্রী, পুত্র কন্যা, নাতি, নাতনী, নতুন বন্ধু, সহযোগী, সতীর্থ।  পুরনো বন্ধুদের কাছ থেকে আমরা অনেকটা দূরে সরে গেছি এই পঞ্চাশ বছরে।

তা হোক, তবু কবির ভাষায় “পুরানো সেই দিনের কথা, সেই কি ভোলা যায়?”

ভোলা যায়না।

মনের মধ্যে সেই স্কুলের ক্লাসরুম, বারান্দা, বিশাল সবুজ মাঠ, মাঠের দক্ষিণ দিকে তেঁতুল আর পলাশ  গাছ, সেই পুকুর আর বাঁধাকপির ক্ষেত, সেই চুড়োনওয়ালা, টিফিন পিরিয়ডের ছুটোছুটি, হাসাহাসি, কলরব, আর সেই সময়ের সহপাঠী আর শিক্ষকদের মুখ সব একসাথে ফিরে এল। অনেকটা যেন reverse osmosis process ব্যবহার করে পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান পেরিয়ে পিছিয়ে গেলাম সেই দিনগুলোতে।

নিবিড় সুখে, মধুর দুখে, জড়িত ছিল সেই দিন/

দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীণ/

২০১৮ সাল

নতুন করে সবার সাথে আলাপ

আমার প্রথম কাজ হল ঘুরে ঘুরে করে সবার সাথে দেখা করা এবং বিশেষ করে অচেনা বন্ধুপত্নী দের সাথে আলাপ করা। তাঁরা সবাই দেখলাম বেশ জমিয়ে গল্প করছেন সোফায় বসে, তাদের মধ্যে কারুর কারুর আজই হয়তো প্রথম দেখা, কিন্তু দেখে কে বলবে? মনে হয় যেন ওদের বহু দিনের বন্ধুত্ব! সুভদ্রার সাথে একমাত্র অমিতাভর বৌ সুজাতার আলাপ ছিল, আমি এক এক করে অন্য সবার সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলাম।

অরুণাভ ঘোষ কে দেখে চিনতে পারিনি, স্কুলে এক মাথা কোঁকড়া চুল আর বেশ কোমল তারুণ্যে ভরা মুখ ছিল ওর, সব সময় মজার মজার কথা বলে হাসাতো আমাদের। এখন তার মাথায় মোড়ানো চুল, মুখশ্রীতে সেই লাবণ্য আর নেই। তার জায়গায় বাসা বেঁধেছে একটা বয়সোচিত গাম্ভীর্য্য। ও এখন UK তে থাকে, এবার সাথে তার বৌ নেই, সে একাই এসেছে দেশে।

তার পাশে সুবীর ঘোষ, ছোটখাট চেহারা, আগের মতোই অবিকল, চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি। স্যুট টাই পরে সুবীর খুব ফর্মাল, যাকে বলে একেবারে টিপটপ, ফিটফাট। চুপচাপ, মুখে স্মিত হাসি। সেও একা এসেছে। স্যুট টাই কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সুবীর বলল, “আজকের অনুষ্ঠানের একটা মর্য্যাদা আছে তো, নাকি?”

আর রবীন নাগ, সে থাকে দিল্লীতে। এখন সে কিঞ্চিৎ অসুস্থ। সেও আজ একা এসেছে। একসময় দারুণ ফুটবল খেলতো রবীন, আমরা একসাথে প্রচুর বল পিটিয়েছি স্কুলে থাকতে এবং পরে আই আই টি খড়্গপুরে । নীল চোখ আর সোনালী চুল, স্কুলে থাকতে রবীন ছিল আমাদের পোস্টার বয়। আজকের রবীন কে দেখলে সেই ছোটবেলার রবীনকে একটু একটু মনে পড়ে।

উৎপল আর প্রদীপ সোম দুই ভাই, এদের স্ত্রীরা পাশাপাশি বসে আছে, তাদের নাম  চিত্রা আর ভারতী। তাদের সাথে গিয়ে আলাপ করলাম। উৎপল দেখি খুব ব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু প্রদীপ চুপ করে সোফায় বসে। স্কুলেও দুই ভাই এর স্বভাবে একটা পার্থক্য ছিল মনে আছে,  উৎপল হাসিখুসী, চঞ্চল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, ওদিকে প্রদীপ একটু ছোটখাটো, দুর্ব্বল, চুপচাপ। প্রদীপের বৌ ভারতী বলল, “দেখুন না খুব বড় একটা অসুখ থেকে উঠল, এত করে বললাম যেও না, কিন্তু কথা শুনলোনা, বললো পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করবোনা, কি যে বলো?” 

প্রবীরের বৌ সুপ্রিয়া আর পৃথ্বীরাজ এর বৌ অনিন্দিতা দেখি পাশাপাশি বসে খুব গল্প করছে, এদের দুজনের আগেই আলাপ ছিল বোধ হয়। সুপ্রিয়া খুব সপ্রতিভ, তাকে আমি বললাম “আপনাদের বিয়ে তে আমি মাধব লেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম”। সুপ্রিয়া বলল “বাড়িটার বয়স একশো বছর হয়ে গেল, জানেন? আমার এখন বম্বে থেকে কলকাতায় এলে ওখানেই থাকি, আসুন না একদিন?”

বহুদিন আগে, তখন আমাদের সবে বিয়ে হয়েছে, পৃথ্বীরাজরা থাকত যোধপুর পার্কে আর তাদের বাড়ীর ঠিকানা ছিল M Jodhpur Park। ঠিকানাটা অদ্ভুত, তাই এখনও মনে আছে। সেই বাড়ীতে একটা বিরাট ছাত ছিল।  পৃথ্বীরাজ ম্যানিলা তে AIM এ পড়তে যাবার আগে একদিন সুভদ্রা আর আমি আর অন্য কয়েকজন বন্ধু সেই বাড়িতে ওদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতিচারণ করলাম ওদের সাথে। পৃথ্বীরাজ অবিকল আগের মত আছে, বুড়িয়ে যায়নি, বেশ সুন্দর স্বাস্থ্য, চুল কালো, আগের মতোই চুপচাপ। মুখে হাসি। 

এবার দেখা হলো এক অচেনা ভদ্রলোকের সাথে, ইনি আবার কে? চেনা যাচ্ছেনা তো? বেশ অভিজাত বনেদী চেহারা, একটা নীল পুলোভার আর ট্রাউজার্স এ বেশ মানিয়েছে, মাথাজোড়া  টাক, চোখে একটা বাহারী চশমা, প্রফেসর প্রফেসর লাগছে। পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন আমার নাম প্রদীপ ভট্টাচার্য্য, আমি ছিলাম বি সেকশনে। অর্থাৎ যাদের বাংলার জায়গায় হিন্দী ছিল ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ।

ও হরি, প্রদীপ, তুমি?

আমাদের ক্লাসের তিন জন প্রদীপ সেদিন উপস্থিত। সোম, ব্যানার্জ্জী, ভট্টাচার্য্য। প্রদীপ মিত্র প্রদীপ রাও, প্রদীপ চক্রবর্ত্তী আর প্রদীপ সেন আসেনি, ওদের নিয়ে আমাদের ক্লাসে সাতজন প্রদীপ ছিল।

আমরা ছিলাম যাকে বলে প্রদীপের আলোয় আলোকিত।

প্রদীপ ভট্টাচার্য্য বি সেকশনে (হিন্দী) পড়লেও আমাদের অনেক কমন ক্লাস থাকত, আর টিফিন আর লাঞ্চ এর ব্রেকে তো একসাথেই মিলে মিশে থাকতাম আমরা । সুতরাং প্রদীপকে ভোলার প্রশ্নই ওঠেনা। একটু গাবদু ছিল, আর খুব হাসিখুসী। শুনলাম ও IAS এ ছিল, এখন রিটায়ার করে মহাভারত  নিয়ে রিসার্চ করে এবং বম্বে ইউনিভার্সিটি তে পার্ট টাইম পড়ায়।

সেদিন প্রদীপ ভট্টাচার্য্য বেশ একটা ভারিক্কী ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমাদের মধ্যে সেই একমাত্র IAS, আর সেই একমাত্র বি সেকশন। সুতরাং একটু পাঙ্গা নেবার অধিকার তার আছে।

স্মৃতি একটু ক্ষীণ বলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি হায়ার সেকেন্ডারী  পর্য্যন্ত স্কুলে ছিলে না আগেই ট্র্যান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিলে?” তাই শুনে প্রদীপ আমার ওপর বেশ চটে গেল। পাশেই বসে ছিল ওর বৌ, তার কাছে আমায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করে দিয়েই বললো ইন্দ্রজিৎ কি বলছে শোন। আমি নাকি…

আমি একটু  অপ্রস্তুতের হাসি হাসলাম।

অজয় একটা ওয়াইন এর গ্লাস হাতে নানা মজার কথা বলছে আর খুব জোরে জোরে হাসছে। তার গালে বিরাট জুলফি, তাকে বেশ মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো দেখতে লাগছে। স্কুলে থাকতে অজয় বেশ লাজুক ছিল, আর কম কথা বলতো, কিন্তু এই বয়েসে এসে সে বেশ প্রগলভ, তার ওপরে সে এখন হাইকোর্টে বিচারক।  নির্দ্বিধায় সে আমাদের একটার পর একটা আদিরসাত্মক জোক শুনিয়ে গেল। তার স্টক বেশ ভাল দেখলাম।

ভাস্কর কে দেখলাম বহু বছর পর, তার মাথা ভর্ত্তি সাদা চুল, বেশ রাশভারী চেহারা। সেই ক্লাস এইট বা নাইনের পরে আর দেখা নেই, যোগাযোগ ও নেই, কিন্তু দেখেই চিনলাম। এখনো ভাস্কর আগের মতোই হাসিখুসী, প্রাণবন্ত। ওর স্ত্রীর সাথেও আলাপ হলো।  ওরা থাকে গুরগাঁও তে। প্রদীপ ব্যানার্জ্জী (বাঁড়ু) আর তার বৌ এসেছে USA থেকে। ভাস্করের সাথে সে যাদবপুরে পড়েছে, প্রতি বছর ওদেরও (মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং ক্লাসের) জানুয়ারী মাসে কলকাতায় রিউনিয়ন হয়, সেখানে সুভাষ মাধব, প্রদ্যোত, অরুনাভ সবাই আসে, তাই ওদের মধ্যে ভাল যোগাযোগ আছে দেখলাম।

বিপ্লব আর তার বৌ ডালিয়ার সাথে গল্প করছিলাম, এমন সময় পাশে প্রদীপ ভট্টাচার্য্য গ্লাস হাতে এসে দাঁড়ালো। আমি ডালিয়া কে বললাম, “আপনার স্বামীর স্কুলে পড়ার সময় মাথা ভর্ত্তি কালো চুল ছিল জানেন, আর ছিল বড় বড় নিষ্পাপ দুটি চোখ। ”

প্রদীপ পাশ থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আঃ, নিষ্পাপ!”

আমি বললাম, “চোখ দুটো এখনো আগের মতোই আছে, কিন্তু মাথার চুল…”

বিপ্লব নীচু ক্লাস থেকেই পড়াশোনায় ভাল। ক্লাস থ্রি তে এন্টনী  স্যার প্রতি সপ্তাহের শেষে আমাদের নানা রং এর কার্ড দিতেন, গোলাপী পেতো সবচেয়ে ভাল ছেলেরা, তারপর সবুজ, হলদে ইত্যাদি। আমি ডালিয়া কে বললাম, “বিপ্লব প্রত্যেক সপ্তাহে গোলাপী কার্ড পেতো, জানেন তো? আর আমরা ছিলাম  হলদে সবুজ ওরাং ওটাং!”

বিপ্লব বললো “বল্‌ তো, একদম আমায় পাত্তা দেয়না।”

পাশ থেকে প্রদীপ আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “ঘর ঘর কি কাহানী!”

সবাই গল্পে মত্ত। প্রচুর ছবি তোলা হচ্ছে। আজকাল সেলফোনের ক্যামেরা দিয়ে বেশ ভাল ছবি তোলা যায়, আলাদা ক্যামেরার দরকার পড়েনা। আমি আমার ফোন দিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললাম।  প্রবীর আজকের সন্ধ্যার প্রধান ব্যবস্থাপক, স্বভাবতঃই তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। সারাক্ষণই তাকে খুব ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে, একবার এদিকে আর একবার ওদিকে। মাঝে মাঝে ছবি তোলার জন্যে কোন গ্রুপে বন্ধুদের  কাঁধে হাত রেখে হাসিনুখে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

অজয় বললো, “প্রবীর আর দীপঙ্কর আজকের অনুষ্ঠানের  অর্গানাইজার আর হোস্ট – ওদের দু’জনের সাথে সব মেয়েদের একটা ছবি তোলা হোক~”!

আমরা সবাই বললাম, খুব ভালো আইডিয়া! আমাদের বৌদের সবাই কে ডেকে ওদের দু’জন  কে মাঝখানে রেখে ছবি তোলা হলো।

মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়/

আবার দেখা যদি হলো সখা, প্রাণের মাঝে আয়/

২০২০ সাল

 মানুষ গড়ার কারিগর  

আমাদের সময়ে ভাল স্কুল হিসেবে আমাদের স্কুলের বেশ সুনাম ছিল।  হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় আমাদের স্কুলের রেজাল্ট খুব ভাল হতো। প্রায় প্রতি বছরই আমাদের স্কুল থেকে সারা বাংলায় প্রথম দশজনের মধ্যে একজন বা দু’জন থাকতোই। একদিকে যেমন স্কুলে একটা অনুশাসন আর শৃঙ্খলার পরিবেশ ছিল, অন্যদিকে তেমন আমাদের শিক্ষকেরা সবাই আমাদের সুশিক্ষার ব্যাপারে মনোযোগ দিতেন। অ্যানুয়াল আর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা ছাড়াও বছরের প্রায় পুরোটাই প্রতি শুক্রবার আমাদের সাপ্তাহিক পরীক্ষা দিতে হতো। ফলে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া সম্ভব ছিলনা।

পড়াশোনা ছাড়াও, খেলাধূলাতেও আমাদের স্কুলের নাম ছিল। প্রথমেই বলতে হয় আমাদের স্কুলের সেই বিশাল সবুজ মাঠের কথা। কলকাতা শহরের বুকে ওই রকম বড় মাঠ আর কোন স্কুলে ছিল বলে আমার জানা নেই। ওই মাঠ ছিল আমাদের স্কুলের একটা বড় গর্ব্বের জায়গা। সেই মাঠে কত যে ফুটবল হকি ক্রিকেট খেলেছি আমরা! কলকাতার অন্য ক্রিশ্চিয়ান স্কুল যেমন সেন্ট পল্‌স্‌, সেন্ট জেভিয়ার্স্‌ ইত্যাদি তাদের ফুটবল টীম নিয়ে এসে আমাদের সাথে টূর্ণামেন্ট খেলতো।

পড়াশোনা ও খেলাধূলায় আমাদের স্কুলের এই সাফল্যের পিছনে আমাদের শিক্ষকদের অবদান একটা প্রধান কারণ ছিল, আমাদের আলাপে পুরনো দিনের কথার মধ্যে তাই অনেকটাই আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের কথা চলে আসে।   

কম বয়েসে নীচু ক্লাসে ছিলেন পুলিন স্যার, পাঞ্জা স্যার, খান স্যার, চৌধুরী স্যার, মন্ডল স্যার।

পুলিন স্যারের ব্যায়াম পুষ্ট চেহারাটা বেশ মনে পড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের ড্রিল (Physical Education) টিচার। সপ্তাহে একদিন শেষ পিরিয়ডে মাঠে আমাদের ড্রিল হত, তাতে স্যার আমাদের নানা রকম ব্যায়াম আর কসরত শেখাতেন। আর কেউ কিছু না পারলে তার মাথায় হাল্কা করে একটা গাঁট্টা মারতেন।  “পুলিন স্যারের গাঁট্টা, পয়সায় আটটা” নামে একটা ছড়া বেশ প্রচলিত ছিল তখন।

বছরে একদিন স্কুলের বিশাল সবুজ মাঠে Sports day হতো, আমাদের পরিবারের অনেকে আমাদের দৌড় ঝাঁপ এবং অন্যান্য কসরত দেখতে আসতেন। সেদিন দর্শকদের  সামনে  আমরা অনেক জিমন্যাস্টিক খেলা দেখাতাম। তার মধ্যে একটা আগুনের রিং এর মধ্যে দিয়ে ডিগবাজী দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যাওয়া খেলাও ছিল, পুলিন স্যার সেটা আমাদের দিয়ে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রচুর প্র্যাকটিস করাতেন।    

ড্রয়িং শেখাতেন পাঞ্জা স্যার। ধুতি পাঞ্জাবী পরা রোগা পাতলা চেহারা, দুটো চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি, সব সময় খুব মজার মজার কথা বলতেন। খাইবার পাস আর বেলুচিস্থান নিয়ে তাঁর বিখ্যাত একটা গল্প ছিল।  এক বিয়েবাড়ীতে এক নিমন্ত্রিত বরযাত্রী ভদ্রলোক খাবার ডাক পড়ায় তাড়াহুড়ো তে ভুল করে বাথরুমের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। একটি ফাজিল ছেলে তাকে ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে খাবার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে বলে “এদিকে নয় স্যার, ওদিকে যান। এদিকটা হলো বেলুচিস্থান। ওদিকটা খাইবার পাস।”

ক্লাস ফাইভে ভূগোল পড়ানোর সময় মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পাঞ্জা স্যার আমাদের বলেছিলেন “তোমরা বাড়িতে গিয়ে যখন মা’কে বলো, ‘মা, ভাত দাও’, তখন আর কিছু দিতে বলোনা কেননা ডাল তরকারী মাছ ওই সব খাবার ভাতের সাথেই আসে তোমরা জানো। ওদেশের ছেলেরা তাদের মা’দের কি বলে জানো?” আমরা কৌতূহলী হয়ে বলতাম, “কি বলে স্যার?” উনি হেসে বলতেন ওরা বলে “মা, খেজুর দাও!”

ঘটনাচক্রে আমি এখন এই মরুভূমির দেশেই থাকি। পাঞ্জা স্যারের ওই কথাটা এখনো ভুলিনি। খেজুর খাবার সময় ওঁর ওই কথাটা মনে পড়বেই। হাসি আর মজা করে বলা কথা এরকম মনে গেঁথে যায়।

খান স্যার আমাদের ইতিহাস পড়াতেন।  সাধারণ দোহারা চেহারা, পরনে সাদা সার্ট আর ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুটো চোখ। ইতিহাস ছিল তাঁর passion । খান স্যার বড় ভালো পড়াতেন, আকবর, বীরবল, শিবাজী, আফজল খাঁ রা সবাই তাঁর পড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠতেন। তিনি হলদিবাড়ী বা পানিপতের যুদ্ধের কথা পড়াবার সময় আমরা তলোয়ারের ঝনঝন আওয়াজ, আহত সৈনিকদের আর্তনাদ, ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক যেন কানে শুনতে পেতাম। নিজেকে আমি মাঝে মাঝে নিজেকে সেই যুদ্ধের মধ্যে এক অনামী সৈনিক বলেও ভেবেছি। 
খান স্যারের সবই ভালো ছিল, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ আমরা পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছি কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দুমদাম প্রশ্ন করে বসতেন। একটু অমনোযোগী হলেই আমরা ঠিক ওনার কাছে ধরা পড়ে যেতাম।
তো একবার মনে পড়ে ক্লাসে বারো ভুইঁয়া দের সম্বন্ধে পড়াচ্ছেন খান স্যার। আমি সেদিন তৈরী হয়ে আসিনি, তাই খান স্যারের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না, পাছে আমায় কোন প্রশ্ন করে বসেন। খান স্যার বুঝতে পেরে আমায় বললেন, “ইন্দ্রজিৎ, তুমি তো ভৌমিক, তাই না? তার মানে তুমি নিশ্চয় কোন বারো ভুঁইয়ার বংশধর। আচ্ছা, তুমি বলো তো…”

সব্বোনাশ!

যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই! 

ভৌমিক হয়ে জন্মাবার জন্যে বেশ দুঃখ হয়েছিল সেদিন। ঘোষ বোস মিত্র বা মুখুজ্যে বাঁড়ূজ্যে হলেও এই বিপদে পড়তে হতোনা আমায়।

উঁচু ক্লাসে ওঠার পরে নতুন বিষয় নিয়ে পড়াতে এলেন নতুন শিক্ষকেরা।  মিত্র স্যার পড়াতেন ফিজিক্স, সুহাস স্যার কেমিস্ট্রী আর ভট্টাচার্য্য স্যার অঙ্ক।  বাংলা পড়াতেন অমল সান্যাল স্যার, ইংরেজী ফাদার ভেটিকাড। আমরা খুব ভাগ্যবান ছিলাম শিক্ষক হিসেবে এঁদের পেয়ে।

নিউটনের Laws of motion পড়ানো হচ্ছে, তৃতীয় Law – “Every action has an equal and opposite reaction” শিখে সবাই সবার পিঠে আচমকা কিল বসিয়ে দিচ্ছি। “কি রে আমায় মারলি কেন?” বললে উত্তর আসছে “আরে তোর পিঠও তো আমার হাতে সমান ভাবে মেরেছে!”

আর ছিল ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি ল্যাব।    

ফিজিক্স ল্যাবে পেন্ডূলাম ব্যবহার করে acceleration due to gravity (g) বের করতে হতো, উত্তরটা তো জানা 981cm/square second তাই কিছুটা কারিকুরি করে ৯৮১ তে পৌঁছে যাওয়া কঠিন ছিলোনা।  তবে লেন্সের focal length কিংবা কেমিসট্রী ল্যাবে সল্ট বের করা অত সহজ ছিলনা। কপার সালফেটের রং সবুজ, তাই সেটাই সব চেয়ে সহজে ধরে ফেলতাম।  

অন্যান্য বিষয়ের সাথে Moral Science নামে একটা সাবজেক্ট পড়ানো হতো আমাদের তাতে খ্রীশ্চান (রোমান ক্যাথলিক) ধর্মের নানা বাণী আর বাইবেল (Old and new Testaments, Gospels) থেকে নানা গল্প পড়াতেন আমাদের বিদেশী সাহেব শিক্ষকেরা, যাদের Father নামে ডাকা হতো। এঁদের  বেশীর ভাগই আসতেন ইউরোপ থেকে, এবং স্কুলের একটা বাড়ীতেই তাঁদের থাকার আর খাওয়ার বন্দোবস্ত হতো।  এঁদের মধ্যে কিছু ভারতীয় ফাদারও ছিলেন, যেমন ফাদার পিন্টো, ফাদার ডি’সুজা, ফাদার ডি সিলভা, ইত্যাদি। এঁদের সবার পোষাক ছিল সাদা আলখাল্লা।

যীশু খ্রীষ্টের জীবন গুলে খেতে হয়েছে সেই সময়। Old Testament এর অনেক গল্প মনে আছে এখনো।  Return of the Prodigal son, The Good Samaritan ইত্যাদি এই সব  গল্প এখনো মনে পড়ে।

আর মনে পড়ে আমাদের কিছু সহপাঠীদের কথা যারা আবাসিক (বোর্ডার)  ছিল। তাদের জন্যে স্কুলে আলাদা থাকা খাওয়ার জায়গা ছিল। প্রধানতঃ গ্রামের দু;স্থ প্রান্তিক পরিবারের ছেলেদের ক্রীশ্চান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে তাদের স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেওয়াই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এদের বেশীর ভাগ ছেলের ক্রীশ্চান নাম ছিল, আর পদবী ছিল গোম্‌স্‌।

আমাদের এই আবাসিক সহপাঠীরা পড়াশোনায় তেমন ভাল না হলেও অনেকেই খেলা ধূলায় খুব ভাল ছিল।  ক্লাস শেষ হলে বিকেলে তারা অনেকেই আমাদের সাথে ফুটবল খেলতো। তার পর সন্ধ্যার ঘ্ন্টা বাজলেই তারা তাদের হোস্টেলে ফিরে যেত। ক্রীশ্চান ধর্মের কঠোর অনুশাসনের মধ্যে তাদের রাখা হতো বলেই এখন মনে হয়। অল্প বয়েসে মা বাবা আর পরিবারের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া আর অন্য ধর্ম্মে ধর্মান্তরিত হওয়া তাদের মনে কি প্রভাব ফেলেছিল তা জানিনা, তবে তারা কমবেশী সবাই চুপচাপ মাথা নীচু করেই থাকতো। খেলার মাঠে অবশ্য তাদের অন্য রূপ।

একবার অঘোর শীল্ডের ফাইনাল খেলা হচ্ছে ঢাকুরিয়া লেকে, ন্যাশনাল হাই স্কুলের বিরুদ্ধে ৩-০ গোলে আমরা জিতেছিলাম, সেন্টার ফরোয়ার্ড  সাইমন গোম্‌স্‌ একাই তিন গোল করে হ্যাটট্রিক করেছিল। আমি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে খেলা দেখেছিলাম।  কি যে আনন্দ হয়েছিল! আর রাইট আউটে দারুণ খেলেছিল ক্ল্যারেন্স রডরিগ্‌স্‌ (ডাক নাম বাচ্চা), ক্ষিপ্র গতিতে বল নিয়ে ডান দিক থেকে তার উঠে আসা এখনও পরিস্কার চোখে ভাসে।

আমাদের ক্লাসে বোর্ডার সহপাঠীদের মধ্যে গ্যাব্রিয়েল গোম্‌স্‌, সুনীল গোম্‌স্‌ আর ক্লিফোর্ড রডরিগ্‌স্‌ এর চেহারা গুলো এখনো ভুলিনি।  কোথায়  কেমন আছে আমাদের এই সহপাঠীরা এখন, তা কেই বা জানে?

তাছাড়া মনে পড়ে আমাদের বেশ কিছু সহপাঠীদের, যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের জন্যে।  তারাও ফিরে এলো আমাদের সেদিনের স্মৃতিচারণে। তাদের মধ্যে আছে হিতেন চক্রবর্ত্তী, বিনোদ কোহলী, নারায়ণ কৃষ্ণান, আর ললিত মোহন নন্দা। 

২০২৩ সাল

পঞ্চাশ আর ষাটের  দশক

সেদিন স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সাথে স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে,  পঞ্চাশের দশক যেন হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া যেন একটা অদৃশ্য জানলা খুলে মনের ভেতরে ঢুকে এলো।

আজকাল মাঝে মাঝে বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় স্কুল বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে দেখি, বড় বড় জানলা, বিরাট বাড়ী, ভিতরে ক্লাস হচ্ছে, বাইরে সেই অর্জুন গাছগুলো পাতা ছড়িয়ে এখনো দাঁড়িয়ে। বহুদিন আগে আমি আর আমার এই সহপাঠীরা ওই ক্লাসরুমে বেঞ্চিতে বসতাম, বাইরে জানলা দিয়ে তাকালে অর্জুন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যেত Army Camp এর স্কাইলাইন, স্যাররা পড়াতেন, ক্লাসে কোন আওয়াজ নেই, শুধু ফ্যান চলার শব্দ। আর টিফিনের ঘন্টা বাজলেই শুরু হতো ছুটোছুটি আর হুটোপাটি, কান ঝালাপালা করা আওয়াজ।

ক্লাস টু থেকে শুরু করে থ্রী ফোর, ফাইভ…। একটা করে বছর যায়, আমরা বড় হতে থাকি।  প্রমোশন পেয়ে নতুন ক্লাসে উঠি, বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসের বুক লিস্ট নিয়ে দোকান থেকে বই কিনে নিয়ে আসি।  নতুন বইয়ের একটা আলাদা গন্ধ আছে, সেই সব নতুন বই পেয়ে সে কি উত্তেজনা আমাদের। কত নতুন কিছু শিখবো আমরা সামনের বছরে।

আমরা ভাল করে সেই বইদের মলাট দিয়ে ঢাকি।  ভিতরে প্রথম পাতায় নিজেদের নাম লিখি। কেউ কেউ আবার ঠিকানাও লেখে।  সেই ঠিকানা শুধু কলকাতা বা ভারতবর্ষের নয়। আমাদের কল্পনায় আমরা হলাম বিশ্বনাগরিক, মহাবিশ্বে আমাদের বাসস্থান।

Indrajit Bhowmick, Class 5, St Lawrence High School, 27,Ballygunje Circular Road, Kolkata 19, West Bengal, India, Asia, World, Solar System, Milky way, Universe – অনেকটা এই রকম।

বারোটা থেকে একটা এক ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেকের কিছুটা আগে থেকেই চিলরা আকাশে ভীড় করতো। ওদের sense of timing দেখে বেশ অবাক হতাম। আমার হাত থেকে বেশ কয়েকবার টিফিন কিছু বোঝার আগেই সোঁ করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চিল। কলকাতার আকাশ থেকে চিল এখন উধাও। তারা আর বোধ হয় আর টিফিন টাইমে স্কুলের আকাশে ভীড় করেনা।

আর এক ঘন্টা লাঞ্চ ব্রেকে প্রখর গ্রীষ্মেও মাঠে নেমে ফুটবল পেটাতাম আমরা, তার পর ঘেমে চুপচুপে হয়ে ভিজে ক্লাসে গিয়ে ক্লাসে বসতাম, ফ্যানের হাওয়ায় জামা শুকিয়ে যেত, এখন ভাবলে বেশ আশ্চর্য্য লাগে।

আর মনে পড়ে সকালে একা একা স্কুলে আসা আর বিকেলে স্কুল ছুটি হলে বন্ধুদের সাথে বাড়ী ফেরার কথা। তখন রিচি রোডের গেটটাই ব্যবহার করতাম আমরা। আমাদের স্কুল শুরু হতো সকাল দশটা চল্লিশে, তখন একা একাই হেঁটে আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ী থেকে ল্যান্সডাউন  রোডে শিশুমঙ্গল হাসপাতাল ছাড়িয়ে হাজরা রোড ধরে ম্যাডক্স স্কোয়ার এর পাশ দিয়ে রিচি রোড ধরতাম। বিকেলে স্কুল ছুটি হতো বিকেল তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিটে – বাড়ী ফেরার পথে সাথে কোন না কোন বন্ধু থাকতো।

কেমন ছিল আমাদের সেই  পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের কলকাতা?  

বিকেলে হোসপাইপ দিয়ে জল দিয়ে রাস্তা ধুতো কর্পোরেশনের লোকেরা। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে আর দেয়ালে হোর্ডিং এ উত্তম সুচিত্রা রাজ কাপুর নার্গিস দিলীপ কুমার বৈজয়ন্তীমালা, দেব আনন্দ্‌ মধুবালাদের ছবি দিয়ে পোস্টার লাগানো থাকতো। মাইকে ভেসে আসতো তখনকার সময়ের জনপ্রিয় ফিল্মী হিন্দী আর বাংলা গান। রাস্তা দিয়ে  রাজহাঁসের মত রাজকীয় চালে চলে যেতো ডাউস ঢাউস ঢাউস বিদেশী গাড়ী – শেভ্রোলে স্টুডিবেকার, প্লাইমাউথ, ডজ্‌, ইমপালা, অস্টিন, হিলম্যান, আর সাথে আমাদের দেশী গাড়ী – ল্যান্ডমাস্টার, ফিয়াট, স্ট্যান্ডার্ড হেরল্ড।  আর ছিল লাল রং এর 2, 2B 8B আর দশ নম্বর দোতলা বাস।  টুং টুং করে ঘন্টা বাজিয়ে পাশ দিয়ে যেতো হাতে টানা রিক্সা।

স্কুল ছুটির পরে বাড়ী ফেরার সময় বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কত কথাই না হতো আমাদের। ফিল্ম, সাহিত্য, সিনেমা খেলাধূলা নিয়ে। ষাটের দশকে আমাদের বয়ঃসন্ধির বয়েস, রাস্তা ঘাটে সুন্দরী মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকাই, দেশ পত্রিকায় বড়দের উপন্যাস পড়ার অভ্যাস শুরু হয়েছে।  দেশে ধারাবাহিক বেরোচ্ছে অচিন্ত্য সেনগুপ্তর প্রথম কদম ফুল কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সূর্য্যসাক্ষী। সেই সব প্রেমের উপন্যাস নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের উত্তেজিত আলোচনা চলে।

তাছাড়া আছে ময়দানে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের  লীগ আর আই এফ এ শীল্ডের খেলা, আর ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হল গিলক্রিষ্টের ফাস্ট বোলিং। রেডিওতে কমলদা’ অজয় বসু পিয়ারসন সুরিটার কমেন্টারী, শনি রবিবার দুপুরে অনুরোধের আসর, আর শুক্রবার রাত ন’টায় নাটক।

প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার আমাদের সাপ্তাহিক পরীক্ষা থাকতো, এবং সেই পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে আগের দিন অর্থাৎ বৃহষ্পতিবার থাকতো আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি।  রবিবার নিয়ে আমাদের সপ্তাহে দুই দিন ছুটি ছিল। আর শুক্রবার পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে রাত্রে  রেডিওর সামনে বসে রাত ন’টার নাটক শুনতে কি যে ভাল লাগতো।       

স্কুল থেকে বছরের প্রথমে আমাদের সবাইকে একটা বাৎসরিক ক্যালেন্ডার দেওয়া হতো, তাতে থাকতো বারো মাসের নানা ছুটি্র দিন এবং অন্যান্য নানা খবর। জেসুইট সাহেবরা স্কুল চালাতেন, তাই অনেক ক্রীশ্চান উৎসবের ছুটিও থাকতো – Good Friday, Easter  ছাড়াও  Ignatious Loyola’s birthday, St Patrick’s day ইত্যাদি।  এছাড়া গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি,  বড়দিনের ছুটি। 

কি অনবদ্য ছিল আমাদের সেই শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো, যা আমরা বন্ধুদের সাথে কাটিয়েছি একসাথে, গভীর অন্তরঙ্গতায় কাটানো সেই দিনগুলোর নানা স্মৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে আমাদের।

এই বন্ধুত্ব চিরদিনের।

 

২০২৪ সাল

   যখন ভাঙ্গলো মিলনমেলা

আড্ডা হাসি ঠাট্টা স্মৃতি চারণে দীপঙ্করের বড় হলঘর গমগম করছে। প্রচুর ছবিও তোলা হচ্ছে এদিক ওদিক।

দেরী হয়ে যাচ্ছে, এবার ডিনার শুরু করা যাক, বলল প্রবীর। ততক্ষণে বেশ কয়েক বার আমার গ্লাস ভরে দিয়ে গেছে দীপঙ্কর, মাথাটা বেশ টলমল করছে, পুরনো বন্ধুদের সাথে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চারিপাশ টা বেশ রঙ্গীন লাগছে, মন বেশ হাল্কা, যাকে বলে উড়ুউড়ু।

ডিনার এর আয়োজন খুব পরিপাটি, নিখুঁত মেনু।  প্রবীরের কেটারার (গুঁই কেটারার্স) এর লোকেরা (তারা সবাই আবার ইউনিফর্ম পরা) দীপঙ্করের ডাইনিং টেবিলে তাদের খাবারদাবার সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে, পাশের ঘরে মেয়েদের বসার বন্দোবস্ত। সব পদই খুব সুস্বাদু, মুখরোচক। শেষপাতে মিস্টি। রাবড়ী আর সন্দেশ। বেশ জমে গেল। 

খাবার পালা শেষ হতেই যাবার পালা শুরু। প্রায় এগারোটা বাজে, বেশ রাত হয়েছে, এক এক করে সবাই উঠতে শুরু করলো। আমরা কয়েকজন যারা রইলাম তারা দীপঙ্করের বারান্দায় গিয়ে আবার কিছু গ্রুপ ফটো তুললাম, সবাই সবার কাঁধে হাত রেখে। কেউ সামনে বসে কেউ পিছনে দাঁড়িয়ে।

বাইরে রাত গভীর হচ্ছে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো গল্প করে নিলাম আমরা ক’জন। আবার কবে দেখা হবে, আদৌ হবে কিনা, তা না জেনে।

আবার সামনের বছর দেখা হবে কি? কে জানে? বন্ধুদের সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় সেই প্রশ্নটা মনে এলো। নাকি আমরা আবার যে যার নিজের বৃত্তে ফিরে যাবো, আমাদের মধ্যে আবার ফিরে আসবে সেই আগেকার দূরত্ব?

না,না তা কি করে হয়? আজকের এই ইন্টারনেট, ইমেল আর ফেসবুকের যুগে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ এত সহজ হয়ে উঠেছে, এখন একবার পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে আর কি হারানো সম্ভব? আশা করব আমরা এবার থেকে প্রতি বছর একসাথে জড়ো হব, আমাদের সেই বাৎসরিক মিলন উৎসবে এবার যারা আসতে পারেনি, তারাও যোগ দেবে। ক্রমশঃ সেই সব হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের এক এক করে আমরা আমাদের মধ্যে ফিরে পাবো। 

সেই আশা নিয়ে আমাদের আজকের এই প্রথম সভা শেষ হলো।

২০২৫ সাল

 ) পুনশ্চ

২০২৫ সালে এই লেখা যখন লিখছি, তখন সেই ২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সাল বারো বছর জানুয়ারীর প্রথমে দীপঙ্করের বাড়ীতে আমাদের বন্ধুদের এই বার্ষিক রিইউনিয়ন প্রতি বছর নিয়মিত হয়ে এসেছে।

২০১৪ সালের পর থেকে নতুন অনেকে পরের বছর গুলোতে আমাদের অনেক প্রবাসী সহপাঠী তাদের সুবিধা মতো এই পুনর্মিলন সভায় যোগ দিয়েছে।  তাদের মধ্যে আছে হায়দ্রাবাদ থেকে চৈতন্যময় (গাঙ্গুলী), সিঙ্গাপুর থেকে দেবব্রত (ব্যানার্জ্জী), USA থেকে  সুভাষ (চন্দ্র বোস) আর কিশোর (আচার্য্য), কুয়েত থেকে সিদ্ধার্থ (ভট্টাচার্য্য), কলকাতা থেকে জয়ন্ত দে।   

কিন্তু এই বারো বছরে আমরা হারিয়েছি আরো বেশ কিছু সহপাঠীকে। ২০১৪ সালেই চলে গেছে অজয় নাথ রায় আর রবীন নাগ। তার পরে এক এক করে চলে গেছে সুভাষ মাধব বোস, প্রদীপ সোম, প্রদীপ মিত্র আর বিপ্লব রায়।

ভগবানের কাছে তাদের সবার আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।

২০২৫ সাল

ছোটবেলার খেলার মাঠের বন্ধুরা

সকালবেলার কেয়াতলা রোড

১) স্বরাজ

 ২০২০ সালের আগস্ট মাস।

কোভিডের প্রকোপ কিছুটা কমেছে।  আমরা দু’টো ভ্যাক্সিন নিয়েছি, মুখে মাস্ক পরে মাঝে মাঝে বাড়ীর বাইরে বেরোই।  বিদেশ ভ্রমণের বাধানিষেধ কমেছে, লন্ডন থেকে পুপু এসেছে আমাদের দেখতে।

আমি  আর পুপু রোজ সকালে বাড়ীর কাছে ঢাকুরিয়া লেকে একটু হেঁটে আসি।

একদিন পুপুর সাথে লেকে হাঁটার পর  কেয়াতলা রোড দিয়ে  বাড়ী ফিরছি।  দক্ষিণ কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালী পাড়া, একদিকে নানা রং এর একতলা দো’তলা বাড়ী, তাদের সামনে এক চিলতে বারান্দা, আর মাঝে মাঝে  বস্তীতে টালির চালের বাড়ী । ওই সকালে রাস্তার ধারে জলের কলের সামনে কিছু মেয়েরা বাসন মাজছে।  কিছু  লোক গামছা পরে ঘটির জল দিয়ে স্নান করছে।  কেউ কেউ নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছে,  এই সবের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম  সামনে উল্টো দিক থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের দিকে হেঁটে আসছেন,  এবং মনে হলো তিনি যেন আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।  

ইনি কি আমার পরিচিত কেউ?   আমার মতোই হাইট, ভারী চেহারা।  দু’জনেরই মুখে মাস্ক বলে চিনতে পারছিনা।  

আমাদের কাছে এসে ভদ্রলোক একটু হেসে  বললেন “মাস্ক টা একটু খুলবেন প্লীজ?”

এই কোভিডের সময় অপরিচিত কারুর কাছ থেকে এই ধরণের অনুরোধ আসলে একটু অস্বস্তি হয়। আমি অবশ্য ভদ্রতা করে মুখ থেকে মাস্ক টা খুলতেই যাচ্ছিলাম, কেননা মনে  হচ্ছিল ভদ্রলোক আমায় চেনেন।

কিন্তু  পুপু ডাক্তার, সে সোজা বলে দিলো “না বাবা”। ওর মা’র মতোই ও ও বেশ যাকে ইংরেজীতে বলে aggressive…

ভদ্রলোক এবং আমি দুজনেই একটু অপ্রস্তুত।

উনি বললেন,  “মান্টু না?”   

আমি ভাবলাম এই রে, ঠিক যা ভেবেছি। ইনি আমায় চেনেন। একটু বিব্রত হয়ে আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে মানে আমি তো ঠিক…

ভদ্রলোক বললেন ছোটবেলায় আমরা একসাথে কত খেলাধুলা করেছি। আমার সব মনে আছে, শ্যামল দা’,বাবলু, বাপ্পা, মনা, শঙ্কর, বাবু,  অলক, বিকাশ …

আমি খুব লজ্জা পেয়ে বললাম আপনার নামটা কি?

উনি বললেন, “আবার আপনি কেন? আমি হলাম স্বরাজ।  তুমি আমায় চিনতে পারছোনা? কালীঘাট পার্কে আমরা  কত ফুটবল খেলেছি একসাথে. আমার চেহারাটা পালটে গেছে, তাই তুমি চিনতে পারছোনা, কিন্তু তোমায়  দ্যাখো আমি চিনতে পেরে গেলাম, আমার বেশ গর্ব্ববোধ হচ্ছে,…  ”

স্বরাজ কে আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম, ষাট বছর পরে দেখা,সময়টা তো কম নয়।  আর তার ওপরে স্বরাজের চেহারা একেবারেই পালটে গেছে। আগে ছিল ছিপছিপে লম্বা, এখন চেহারাটা বেশ মুশকো হয়েছে।  কিন্তু যেই বললো কালীঘাট পার্কে ফুটবল খেলেছি এক সাথে, অমনি  এক মূহুর্ত্তের মধ্যে ছবির মত ওকে মনে পড়ে গেল। ওরা থাকতো হাজরা রোডে অন্য পাড়ায়। ওদের ক্লাব ছিল উদয়ন সঙ্ঘ, আর আমাদের ক্লাব ছিল মনোহরপুকুর বৈশাখী সঙ্ঘ। আমাদের দুই ক্লাবের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হতো কালীঘাট পার্কে।

অসাধারণ বল কন্ট্রোল ছিল স্বরাজের।  তাছাড়া ছিল স্পীড আর দুর্দ্ধর্ষ ড্রিবলিং স্কিল।  এখনো মনে আছে একবার আমার মাথার ওপর দিয়ে বল ট্যাপ করে পাশ কাটিয়ে তীরবেগে আমাদের গোলের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে।

আমিও ফুটবলটা ভালোই খেলতাম। তাই হয়তো স্বরাজের ও আমার কথা এতদিন পরেও মনে আছে।  ছোটবেলার খেলার মাঠের সেই বন্ধুত্ব কি কোন দিনই ভোলা যায়?  

সেই বন্ধুত্ব চিরকালীন।

তারপরে কিছু মামুলী কথাবার্ত্তার পর আমরা বিদায় নিলাম।  কেউই কাউকে ঠিকানা বা ফোন নাম্বার দিলামনা। 

২) কিরণ

কিরণকে কি কারুর মনে আছে? কিরণ সিনহা।

ফুটবলটা বেশ ভাল খেলত। উঁচু ক্লাসে উঠে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল বোধহয়। থাকতো বালীগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। কোয়ালিটির পাশে একটা ছোট পার্কে ওকে পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে দেখেছি মাঝে মাঝে।

আমাদের সেন্ট লরেন্স স্কুলে ছিল বিশাল খেলার মাঠ,  সেই মাঠ ছোট ছোট ভাগ করে লাঞ্চ ব্রেকে আমরা চুটিয়ে ফুটবল খেলতাম। এখনো মনে পড়ে  স্কুলের পিছন দিকে বাঁধাকপির ক্ষেত আর পুকুরের দিকে এক চিলতে মাঠে ক্লাস ফোর ফাইভে খেলতাম আমরা। আর সেই সময় কিরণ ছিল আমাদের স্টার প্লেয়ার। এমনিতে পড়াশোনায় কিরণ তেমন ভাল ছিলনা,  ক্লাসে  মাথা নীচু করে চুপ করেই থাকতো বেশীর ভাগ সময়, খুব লাজুক ছিল কিরণ।

কিন্তু খেলার মাঠে বল পায়ে তার অন্য রূপ।  ফুটবল মাঠে সে একচ্ছত্র সম্রাট।  

বেশ কয়েক বছর আগে একবার বালীগঞ্জ ফাঁড়ির উল্টো দিকে পেট্রোল পাম্পের পাশে The Wardrobe নামে একটা লন্ড্রীতে কাপড় কাচাতে নিয়ে গেছি। ঢুকেই দেখি কাউন্টারে আমাদের কিরণ বসে।

অনেকদিন পর দেখা, কিন্তু আমি চিনলাম সহজেই, চেহারাটা অনেকটা আগের মতোই আছে, বেশ শক্তপোক্ত খেলোয়াড় সুলভ। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা, কপালের সামনে একটু পাতলা হয়েছে, বেশ ভারিক্কী হয়েছে কিরণ, দোকান টা ওরই  franchise  নেওয়া বুঝলাম, কেননা চারপাশের কর্ন্মচারীদের সাথে সে বেশ হুকুমের ভঙ্গী তে কথা বলছিল।

কিরণ ও আমায় চিনেছে ঠিক। ছোটবেলার ফুটবল মাঠের বন্ধুদের  সহজে ভোলা যায়না।

“এখনও খেলো নাকি?” কিছুটা লাজুক গলায় কিরণ জিজ্ঞেস করলো আমায়।

“কোথায় আর?” বললাম আমি।

তারপর বেশ কিছু খুচরো কথা হলো।

আমার বিলটা সই করার আগে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে পুরনো বন্ধুকে ২০% ডিসকাউন্ট লিখে দিল কিরণ।

কি মুস্কিল, এসব আবার কেন, বললাম আমি।

তার পরে আর কোনদিন কিরণের দোকানে কাপড় কাচাতে নিয়ে যাইনি।

বন্ধুদের এইরকম ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে ডিসকাউন্ট দিতে গিয়ে ওর দোকানটা শেষে উঠে যাক আর কি?

কি দরকার?

৩) পৃথ্বীশ

পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে যখন স্কুলে পড়ি, তখন কলকাতার দুই ফুটবল ক্লাব  মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল ছিল দুই  প্রবল পরান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী, আর তাদের সমর্ত্থক দের মধ্যেও ছিল দারুণ রেষারেষি।

স্কুলে আমাদের নিজেদের মধ্যে খেলার জন্যে দুই ফুটবল টীম করার সময় প্রায়ই মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার দের নিয়ে টীম তৈরি  হতো।  আমি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান কোন দলের সমর্থক ছিলামনা,  কিন্তু আমায় সবসময় ইস্টবেঙ্গলের টীমে খেলতে হতো।  আসলে আমাদের সহপাঠী খেলোয়াড়দের মধ্যে মোহনবাগানের সমর্থক অনেক বেশী থাকতো, তুলনায় ইস্টবেঙ্গলে অনেক কম।  তাই ইস্টবেঙ্গলের টীমে যথেষ্ট প্লেয়ার পাওয়া যেতোনা।  তাই আমায় ইস্টবেঙ্গলের টীমে খেলতে হতো।  সেই সব খেলা অবশ্য এলেবেলে খেলা, তাই কোন একটা দল হলেই হলো।

কিন্তু  ইস্টবেঙ্গলের দলে বাঁধা খেলোয়াড় ছিল পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশ  চ্যাটার্জ্জী।

সে ছিল ইস্টবেঙ্গলের পাঁড় সমর্থক। তাকে ইস্টবেঙ্গল কেমন খেলেছে এই প্রশ্ন করা হলে তার তিনটে সম্ভাব্য উত্তর ছিলঃ

১) দারুণ খেলেছে

২) দুর্দ্দান্ত খেলেছে

৩) দুর্দ্ধর্ষ খেলেছে

ইস্টবেঙ্গল কখনো খারাপ খেলেছে, এ কথা সে ভাবতেই পারতোনা।

তো একবার কলকাতা লীগের খেলায় (বোধ হয় ১৯৫৭ কি ১৯৫৮ সালে) এরিয়ান ক্লাবের কাছে ইস্টবেঙ্গল ০-৪ হেরে যায়। পরের দিন স্কুলে আমি পৃথ্বীশ কে বললাম “কী রে, কাল তোদের কী হল?”

পৃথ্বীশ গোমড়া মুখ করে বললো, “অস্বীকার করছি, কাল ইস্টবেঙ্গল ভালো খেলেছে!”

ঢাকুরিয়া লেক

চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা

মন্দারমণি সমুদ্র সৈকতে সুর্য্যাস্ত

এপ্রিল, ২০১৭

১ মন্দারমণি

কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সাথে মন্দারমণি গিয়েছিলাম। 

একটা সময় ছিল যখন কলকাতার কাছে সমুদ্র সৈকত হিসেবে সবচেয়ে বেশী নামডাক ছিল দীঘার। কিন্তু আজ দীঘা আর আগের মত নেই, এখন সেখানে বড্ড ভীড় আর নোংরা ঘিঞ্জি পরিবেশ। সেই তুলনায়  মন্দারমণি বেশ নিরিবিলি, pristine, চমৎকার চওড়া বীচ্‌, বেশী ভীড় নেই।

আমরা উঠেছিলাম সমুদ্রের ধারে Sun City Hotel এ। 

মন্দারমণি যাবার আগে শুনেছিলাম যে ওখানে High tide এর জন্যে যথেষ্ট জায়গা না রেখে হোটেল গুলো তৈরী হওয়ায় জোয়ারের সময়ে সমুদ্রের জল প্রায় হোটেলের মধ্যে ঢুকে আসে। 

তো আমরা প্রথম দিন পৌঁছে যখন বিকেলে বীচে গিয়ে পোঁছলাম, তখন ভাঁটা। সমুদ্র অনেকটাই দূরে। বিশাল বীচ, শক্ত বালি, সেই বালির ওপরে অনায়াসে গাড়ী চালানো যায়। দেখলাম হোটেলের গা ঘেঁসে পাথরের বাঁধ, বুঝলাম জল যাতে হোটেলের ভিতরে না ঢোকে তাই ওই ব্যবস্থা। 


আমরা হোটেলের বাইরে একটা দোকানে ডাব অর্ডার করতে তারা খাতির করে আমাদের প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসতে দিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, সমুদ্রের তীরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আড্ডা মারার মজাই আলাদা। নানা রকম মজা হাসি আর পি এন পি সি হচ্ছে। এদিকে আড্ডা মারতে মারতে কখন যে নিঃশব্দে সমুদ্রের ঢেউ আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। দোকানের বাচ্চা ছেলেটা হঠাৎ বলে উঠলো উঠুন উঠুন… 


চেয়ারগুলো সব সরাবার আগেই ঢেউ এসে আমাদের প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়ে গেল।

২ ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রজিৎ!! চটি চটি!!

দ্বিতীয় দিন বিকেলে আবার সমুদ্রের তীরে গেছি। একটু পরে সূর্য্যাস্ত হবে, সময়টা বড় মায়াবী। আমরা আমাদের চটি গুলো জল থেকে বেশ কিছুটা দূরে যাকে বলে নিরাপদ দূরত্বে রেখে খালি পায়ে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে হাঁটছি। আর জলের মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবে যাওয়া সূর্য্য কে ধরবার জন্যে ক্যামেরা তাক করে আছি।

সামনে পূর্ণিমা, জোয়ারের জল যে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে তা খেয়াল নেই। ক্যামেরার aperture, light metering আর shutter speed এই সব নিয়ে আমি মগ্ন। 


হঠাৎ ধ্রুবর গলায় আর্ত চিৎকার কানে এলো। 


ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রজিৎ!! চটি চটি!!


তাকিয়ে দেখি আমাদের চটি জলে ভেসে যাচ্ছে। 


সব্বোনাশ! 


সূর্য্যাস্তের ছবি তোলা চুলোয় গেল, চটি বাঁচাতে পাঁই পাঁই করে ছুটলাম।

৩ চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। 

আমাদের হোটেলের বাইরে বীচের ওপরে বেশ কিছু makeshift ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট, বাঁশের খুঁটির  ওপরে তেরপল দিয়ে ঢাকা ছাউনী। তলায় বেশ কিছু টেবিল চেয়ার পাতা, সেখানে লোকেরা বসে খাচ্ছে। বাঁশের খুঁটিতে A4 সাইজের মেনুকার্ড ঝুলছে, তাতে নানা ধরণের খাবার এর লিস্ট। ইলিশ মাছ আর চিংড়ীমাছ ভাজা, কাঁকড়া, চিকেন। তাছাড়া তড়কা ডাল, রুটি, ভাত, তরকারী, যা চাই। হোটেলের তুলনায় বেশ সস্তাও।

আমরা ঠিক করলাম সন্ধ্যায় এখানে এসে খাবো।

কিন্তু বিকেল থেকে জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করলো। সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে আমাদের চক্ষুস্থির। কোথায় দোকান?

চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। 

৪ দীঘা

মন্দারমণি তে সারাদিন তেমন কিছু করার নেই, একদিন আমরা দীঘা আর শঙ্করপুর ঘুরে এলাম।

১৯৬৩-৬৮ খড়্গপুরে থাকার সময় অনেকবার দীঘা গেছি বন্ধুদের সাথে। ষোলো সতেরো বছর বয়েস তখন, বাড়ীর গন্ডী থেকে বের হয়ে হোস্টেলে স্বাধীন জীবন, নতুন পাওয়া বন্ধুরা, আর ক্লাসে যাওয়া আর ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে প্রত্যেকের একটা করে সাইকেল।

জীবনে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?

বাঙালীর প্রিয় পুরী কে ছাড়িয়ে সমুদ্র সৈকত হিসেবে দীঘা তখন ক্রমশঃ তার জনপ্রিয়তা  অর্জ্জন করতে শুরু করেছে। বাংলা ছোটগল্পে উপন্যাসে আধুনিক গানে দীঘা তার জায়গা করে নিয়েছে। পিন্টূ ভটাচার্য্যের “চলোনা দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়া ছায়ায়” গান তখন সুপারহিট। 

আমাদের ফার্স্ট আর সেকেন্ড ইয়ারে বছরে অন্ততঃ দুই তিন বার লং উইকেন্ড পেলেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে দীঘা তে গিয়ে দুই দিন কাটিয়ে আসতাম। খড়্গপুর থেকে দীঘা বেশ দূর (আশি মাইল), তখন সেই লাইনে সোজা বাস বা ট্রেণ রুট ছিলনা। আমরা খড়্গপুর স্টেশন থেকে বাসের মাথায় সাইকেল চাপিয়ে কাঁথি চলে যেতাম। কাঁথি থেকে দীঘা ত্রিশ মাইল মত। সাইকেলে চার ঘন্টা মত লাগতো।

রাত দুটো নাগাদ কাঁথি পৌঁছে আমরা দশ বারোজন বন্ধু পাশাপাশি অন্ধকার রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলা দীঘা পৌঁছতাম। মাথার ওপর রাতের তারাভরা আকাশ, দুইপাশে অন্ধকার চরাচর, মাঝে মাঝে দুই একটি ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ গ্রাম চলে যায়, এসবের মধ্যে গল্প করতে করতে গান গাইতে গাইতে সাইকেলে চেপে আমরা চলেছি। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে, একটু পরেই সূর্য্যোদয় হবে। তার আগেই আমরা সোজা সমুদ্রের তীরে পৌঁছে যেতাম।

প্রথম যৌবনের অনন্য অপূর্ব্ব অভিজ্ঞতার সাথে দীঘার স্মৃতি আমার মনে অবধারিত জড়িয়ে আছে।

তখন কি নির্জ্জন আর পরিস্কার ছিল দীঘা! সমুদ্রের ধারে বে কাফে নামে একটা রেস্তোরাঁ ছিল, তার দোতলার বারান্দায় চা খেতে খেতে সামনে অকূল সমুদ্রে সূর্য্যাস্ত দেখে মোহিত হবার স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনি। ঝাউবনের ছায়ায়  চাদর পেতে বন্ধুদের সাথে হাসি গান আর আড্ডাও ভোলার নয়। সৈকতাবাস নামে একটা সস্তা কিন্তু পরিস্কার সরকারী হোটেল ছিল  সেখানে এক বা দুই রাত কাটিয়ে আবার সাইকেলে চেপে খড়্গপুরে হোস্টেলে ফিরে যেতাম।

সেই দীঘা আর নেই। ষাট বছরে অনেক পরিবর্ত্তন হয়েছে। এখন রাস্তাঘাট দোকান পাট অনেক বাড়ী চারিদিকে। অনেক পর্য্যটকের ভীড়। সমুদ্র সৈকতে থিকথিক করছে ভীড়, গাড়ী পার্ক করার জায়গা পেতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ফেরার পথে শঙ্করপুর সমুদ্রসৈকত অবশ্য জনবহুল নয়।  

পথে অনেক চিংড়ী মাছ আর কাঁকড়ার আড়ত চোখে পড়লো। কলকাতা ফেরার পথে একটা এইরকম একটা আড়তে নেমে সবাই বাড়ীর জন্যে কেজি দুই মাছ কিনে নিলাম।      

পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ ও বশংবদ কর্ম্মচারী

আমরা তিন বন্ধু – দীপঙ্কর, অমিতাভ আর আমি – আমাদের বৌদের নিয়ে সম্প্রতি উড়িষ্যায় গোপালপুরে সমুদ্রের ধারে তিন দিন ছুটি কাটিয়ে এলাম। আমরা তিনজন হলাম বাল্যবন্ধু, বালীগঞ্জের সেন্ট লরেন্স হাইস্কুলে সেই পঞ্চাশের দশকে নীচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকে আমাদের বন্ধুত্ব।

তিনদিন সমুদ্রের তীরে জলে ভেজা বালিতে পা ডুবিয়ে হেঁটে, ফেনা মাখা ঢেউএর সাথে catch me if you can খেলে, আর জমিয়ে কাঁকড়া আর চিংড়ী মাছ খেয়ে দিনগুলো বেশ হৈ হৈ করে কেটে গেল। এক দিন চিল্কা হ্রদে গিয়ে বোটিং ও হলো।

এবার ফেরার পালা। হোটেল থেকে গাড়ী নিয়ে ভুবনেশ্বর যাচ্ছি। সেখান থেকে আমাদের প্লেন ছাড়ছে বেলা দুটো। দমদম পৌঁছবো বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। আমি ফোনে আমাদের ড্রাইভার কে বাড়ী থেকে গাড়ীটা নিয়ে দমদমে আসতে বলছি।

“একটু আগে এসে গাড়ীতে তেল আছে কিনা দেখে নিও, টায়ার গুলোতে হাওয়া ভরতে হতে পারে, তিনটের একটু আগে দমদম পৌঁছে যেও”, ইত্যাদি বলে যাচ্ছি আর ভাবছি মোবাইল ফোন যখন ছিলনা, তখন আমরা কি করে বেঁচে ছিলাম!

দীপঙ্কর বসে ছিল পিছনে, সে বললো ইন্দ্রজিৎ এর ড্রাইভার কে এই পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।

কি গল্প?

এক কোম্পানীর মালিক তাঁর এক কর্ম্মচারীকে পাঠাবেন আসানসোলে তাঁর এক খদ্দেরের কাছ থেকে একটা চেক নিয়ে আসতে। ইয়ার এন্ড এসে যাচ্ছে, তাই চেক টা পাওয়া খুব দরকারী।

কর্ম্মচারী ছেলেটি খুব বিশ্বাসী আর বশংবদ।

মালিক তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিচ্ছেন এই ভাবে।

শোনো তুমি সামনের সোমবার ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবে, বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

ব্ল্যাক ডায়মন্ড প্ল্যাটফর্ম আট থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় ছাড়বে, তার মানে তোমায় হাওড়া স্টেশনে পৌনে ছটার আগে পৌঁছে যেতে হবে, বুঝতে পেরেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

তুমি সেদিন ভোর চারটে তে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠবে, উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়বে। তুমি তো ফার্ণ রোডে আলেয়া সিনেমার কাছে থাকো, ওখান থেকে গড়িয়াহাটে হেঁটে যেতে তোমার দুই তিন মিনিট লাগবে, সেখানে গিয়ে তুমি পাঁচ নম্বর বাস ধরবে, ফার্স্ট বাস আসে ভোর পাঁচটায় তাই তার আগেই তোমায় বাস স্টপে পৌঁছে যেতে হবে, দেরী করবেনা, বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

আচ্ছা ওই সকালে বাসে তুমি হাওড়া স্টেশনে ছ’টার আগেই পৌঁছে যাবে, সেখানে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে টিকিট রিসার্ভেশন কাউন্টারে লাইন দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড চেয়ার কারে তোমার সীট রিসার্ভ করে টিকিট কিনবে। ঠিক আছে?

হ্যাঁ, স্যার!

এবার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে ট্রেণে উঠে নিজের সীটে গিয়ে বসবে। আসানসোল স্টেশনে ট্রেণ পৌছবে সকাল ন’টায়। কিন্তু তুমি যে অফিসে যাবে তারা খোলে বেলা দশটায়। তাই তুমি ট্রেণ থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে মিনিট পনেরো চা খেয়ে নিয়ে নিও। ক্লীয়ার?

হ্যাঁ, স্যার!

তারপরে বাইরে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ওদের অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটা ওদের দেখিও। ওরা তোমায় একটা চেক দেবে, সেটা নিয়ে তুমি আবার স্টেশনে ফিরে বিকেল চারটে তে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে এসো।

সোমবার ন’টা নাগাদ মালিকের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। সেই বশংবদ কর্ম্মচারীর ফোন।

এবার তাদের দু’জনের কথাবার্ত্তা এরকম হলো।

কি হলো? কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? ভোরবেলা গড়িয়াহাট থেকে ফার্স্ট বাস পাঁচ নম্বর ধরেছিলে?

হ্যাঁ, স্যার!

বেশ! তারপর? ট্রেণের টিকিট কাটলে? সীট রিসার্ভ করতে পারলে?

হ্যাঁ স্যার!

বেশ বেশ! আসানসোল পৌছে গেছো?

হ্যাঁ স্যার!

তাহলে তো সবই ঠিকঠাকই করেছো। ফোন করছো কেন? কোন প্রবলেম?

হ্যাঁ স্যার একটা প্রবলেম হয়েছে।

মালিক একটু অবাক। কি আবার প্রবলেম হলো।

স্যার এই দোকানে চা পাওয়া যায়না, কেবল কফি। আমি কি কফি খেতে পারি, স্যার?

স্মোকিং কিলস্‌

আমাদের বন্ধু দের কিছু মুদ্রাদোষ আছে, যেমন প্রদোষ অবাক হলে বলে  “গুড গড্‌” আর ধ্রুব কোন কারণে অস্বস্তিতে পড়লে বলেন “কি বলবো মাইরী”!

তো একবার প্রদোষ আর তুতু কলকাতায় এসেছে, ওদের সাউথ সিটি র বাড়ীতে আমরা কয়েকজন ড্রইং রুমে বসে আড্ডা মারছি। সাথে প্রদোষের সিঙ্গল মল্ট্‌। সামনে টি ভি খোলা, তাতে একটা ইংরেজী ছবি চলছে, সাইলেন্ট মোডে। বেশ ঝিংচ্যাক ছবি মনে হয়, গল্পের মধ্যে মাঝে মাঝে টি ভি তে চোখ চলে যাচ্ছে, দেখছি হ্যারিসন ফোর্ড খুব গুলি গোলা চালাচ্ছেন, তাছাড়া বেশ কিছু car chase এর দৃশ্য।

কয়েক রাউন্ড মাল খাবার পর সকলের চোখ বেশ ঢুলুঢুলু। হঠাৎ সুভদ্রা বললো, “এই, টি ভিতে কি সিনেমা চলছে?”

স্ক্রীনের বাঁ দিকে ওপরে খুব ছোট অক্ষরে বোধ হয় সিনেমার নাম লেখা আছে, দূর থেকে পড়া যাচ্ছেনা। সুভদ্রার কথা শুনে ধ্রুব টলমলে পায়ে উঠে টি ভির কাছে চলে গেলেন। তারপরে আবার টলমলে পায়ে ফিরে এসে যুদ্ধজয়ের খবর জানানোর ভঙ্গীতে বললেন ছবির নাম হলো “স্মোকিং কিলস্‌”।

 “স্মোকিং কিলস্‌”?

আমরা সবাই ধ্রুবর কথা শুনে হো হো করে হাসলাম। কিছুটা আউট হয়ে যাওয়ায় হাসিটা বোধ হয় একটু বেশীই হলো।

প্রদোষ বললো গুড গড ধ্রুব, আপনি কি  আউট  হয়ে গেছেন?

ধ্রুব ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটু অপ্রস্তুত। তিনি একটু হেসে বললেন “কি বলবো মাইরী…”

পার্থর জ্যাকেট

পার্থর বাড়ীতে নেমন্তন্ন থাকলে সেখানে আমাদের দু’টো প্রধান আকর্ষন।

এক হলো সিঙ্গল মল্ট্‌। আর দুই মণিকার দুর্দ্দান্ত রান্না আর elaborate menu…তার সাথে অবশ্যই ওদের দুজনের আন্তরিক আতিথেয়তা।

তো একবার এইরকম একটা নেমন্তন্নে গিয়ে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে আমরা ক’জন আরাম করে পার্থদের বাড়ীর সুদৃশ্য ড্রয়িং রুমে নরম সোফায় গা ডুবিয়ে বসে আছি।

KOC র  চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পার্থ সম্প্রতি  একটি মহামূল্য Apple I Phone উপহার পাবার গল্প করছে।  সে এক অদ্ভুত ফোন, কত কি যে তার ফিচার, পার্থ আমাদের সেই সব  বুঝিয়ে বলছে, কি দারুণ ক্যামেরা, কত মেগা পিক্সেল, কতগুলো সিমকার্ড।  ইত্যাদি ইত্যাদি।  এবং সেই ফোনের ভেতরে রাখা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তার উপহার পাবার ছবিও সে আমাদের দেখাচ্ছে, যাতে আমরা তার কথা বিশ্বাস করি।  

পার্থর মুখ গর্ব্বে জ্বলজ্বল করছে, তার সাফল্যে আমরা বন্ধুরাও খুব খুসী।  চেয়ারম্যানের হাত থেকে উপহার পাওয়া খুব কম লোকের ভাগ্যেই থাকে।  বন্ধুর ভাগ্যে আর সাফল্যে আমরাও গর্বিত।

কিন্তু এর মধ্যে পার্থর একটা নতুন জ্যাকেট হারিয়ে গেছে বলে তার মন খুব খারাপ। কি করে হারালো, আমরা জানতে চাইলাম।

আর বোলোনা, পার্থ বললো, মণিকা আর আমি নিউ ইয়র্কে সেন্ট্রাল পার্কে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি জ্যাকেটটা নেই। কোথায় গেল? চারিদিকে আশে পাশে অনেক খুঁজলাম। কোথাও নেই।

তুতু বললো নতুন জ্যাকেট?

পার্থ বলল আরে ভাই, of course – brand new! হুম্‌!

সব কথার প্রথমে “আরে ভাই”, আর শেষে  “হুম্‌” বলা পার্থর একটা অভ্যেস।

হুম্‌ কথাটা মাঝে মাঝে সন্মতিসূচকও হতে পারে আবার চিন্তাসূচক ও হতে পারে।

আমি বললাম লেদার জ্যাকেট ছিল নাকি?

পার্থ বললো আরে ভাই, of course – shining leather! হুম্‌!

আমি বললাম সত্যি শীতকালে জ্যাকেট হারালে বড় মুস্কিল হয়।  গায়ে  অন্য গরম জামা ছিল।?

পার্থ বললো আরে ভাই, of course, আমার তো গায়ে ভারী কোট থাকে সব সময়। হুম্‌!

আমরা সবাই পার্থর জ্যাকেট হারানোর শোকে বেশ মুহ্যমান হয়ে পার্থের গল্প শুনছি আর ভাবছি এই বুঝি পার্থ জ্যাকেটটা খুঁজে পাবে। কিন্তু না, খুঁজে আর পাওয়া গেলনা।

মিনি  বললো সত্যি নিউ ইয়র্ক শহরটা চোরে ভর্ত্তি।  আর সেন্ট্রাল পার্কে তো চারিদিকে চোর গিজগিজ করছে।

প্রসূণ আমাদের মধ্যে বেশ প্র্যাকটিকাল, আর ডাক্তার বলে চোরদের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তার  বেশ ভাল ধারণা। সে বললো যে চুরি করেছে তার সাইজ যদি তোমার মত হয়, মানে তোমার জ্যাকেট যদি তার গায়ে ফিট করে যায় , তাহলে সে তো জ্যাকেটটা পরে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, কেউ জানবেই না যে ওটা তার নয়।

তুতু বলল হয়তো বাড়ীতে ফেলে রেখে এসেছিলেন, ফিরে গিয়ে পেলেন?

পার্ত্থ বললো আরে ভাই, না না জ্যাকেট টা তো নতুন ফোনের বাক্সের মধ্যেই ছিল, তখনো খুলে ফোনে পরানো হয়নি।  কোথায় যে ফেললাম! হুম্‌!

ও হরি, ফোনের জ্যাকেট!

আমরা সকলেই সেদিন বেশ আশাহত হয়েছিলাম, কেননা সবাই ভাবছিলাম ওটা একটা গায়ে পরবার জ্যাকেট।

পার্থের গল্প বলার ভঙ্গীটাই ওইরকম।   শ্রোতাদের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নেবার ক্ষমতা আছে ওর।

আমরা কেউই বুঝতে পারিনি যে ফোনের জ্যাকেটের কথা হচ্ছে। 

তাপস পাল

তোমরা যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়েছো, তারা নিশ্চয় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনে থাকবে। অসিতবাবু হাওড়ার রামরাজাতলায় থাকতেন, সুভদ্রাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। অসিতবাবুদের সাথে সুভদ্রাদের পারিবারিক পরিচয় ছিল। ওনার স্ত্রী বিনতা হাওড়া গার্লসে শিক্ষিকা ছিলেন।

বিনতাদির কাছে সুভদ্রা শুনেছে যে অসিতবাবু নাকি হিন্দী সিনেমার মারামারির দৃশ্য দেখতে খুব ভালবাসতেন। শনি আর রবিবারে দূরদর্শনে হিন্দী সিনেমা দেখানো হতো, ওনাদের বাড়ীর চাকরের নাকি কাজ ছিল শনি আর রবিবার টিভির সামনে বসে থাকা। আর সিনেমায় কোন মারামারির দৃশ্য হলেই “বাবু শিগগিরি আসুন” বলে ওনাকে ডাকা। অসিত বাবুও নাকি চাকরের ডাক শুনে লেখা টেখা সব ছেড়ে দৌড়ে টিভির সামনে চলে আসতেন।

সম্প্রতি এ বি পি আনন্দ চ্যানেলে তাপস পালের  জ্বালাময়ী বক্তৃতা বার বার দেখাচ্ছিল, তা দেখতে দেখতে আমার অসিতবাবুর কথা মনে পড়ছিল। একথা অস্বীকার করবোনা যে বার বার টেলিভিশনে ওই দৃশ্য দেখতে আমার মন্দ লাগতোনা, বেশ গা গরম হয়ে উঠতো। মনে হতো কোন সিনেমাই দেখছি, যেখানে নায়ক তার শত্রুদের বেশ এক হাত নিচ্ছে।

আর তাপস পাল তো অভিনেতাই, তাঁকে ঠিক রাজনৈতিক নেতা বলে কি মনে হয়? সুতরাং ওই দৃশ্য দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তিনি অন্যের তৈরী করা স্ক্রিপ্ট বলে যাচ্ছেন এবং তাঁর ওই আগুণে বক্তৃতা আদতে অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

দাদার কীর্ত্তি সিনেমার সেই বোকা ভালোমানুষ ছেলেটার কি হলো? মা সরস্বতী কে সে যে সারা রাত ঠান্ডা জলে গা ডুবিয়ে বলেছিল “মা, আমায় বোধ দাও মা, আমায় বুদ্ধি দাও”, সেই প্রার্থনায় কোন কাজ হয়নি দেখা যাচ্ছে।

এদিকে অফিস থেকে ফিরে রোজ এ বি পি আনন্দ খুলে ওই এক দৃশ্য দেখছি বলে সুভদ্রার “সারেগামা” কিংবা “তুমি যে আমার” দেখা হচ্ছেনা, সে একদিন বন্ধুদের কাছে আমার নামে complain  করে বলছিল “দ্যাখো না, এই এক হয়েছে তাপস পাল। এর জ্বালায় আমার কোন সিরিয়াল দেখা হচ্ছেনা।”সেদিন প্রসূণের বাড়িতে বন্ধুরা সবাই মিলে বসে World Cup এর  France Germany ম্যাচ টা দেখছি, হাফ টাইমে আমি প্রসূণ কে বললাম “একটু তাপস পাল টা চালিয়ে দাও তো, দেখি কি হচ্ছে।”

আমি আসলে বলতে চাইছিলাম এ বি পি আনন্দটা চালিয়ে দাও, কিন্তু মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল তাপস পাল। তার পর থেকে বন্ধুদের মধ্যে ওই কথাটাই চালু হয়ে গেছে।

বেশ কিছুদিন পরে একদিন শুনি প্রসূণ দেবাশীষ কে বলছে “এই দ্যাখো তো আমার বাড়িতে তাপস পাল আসছেনা কেন?” তার উত্তরে দেবাশীষ বললো, “আমি কি করে জানবো কেন আসছেনা? আমার বাড়িতে তো তাপস পাল রোজ আসে।”

কোন বাইরের লোক এই সব সাংকেতিক কথাবার্ত্তা শুনলে কি ভাববে কে জানে?

Shuzaa zaike ডাইন দিক মে

বাঙালীদের হিন্দী তে কথা বলা নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। 

১৯৭০ এর দশকে হেমন্ত বসু নামে  একজন  ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতাকে  মাঝে মাঝে  বড়বাজারের দিকে অবাঙালী শ্রোতাদের  তাঁর বক্তৃতায় অবলীলাক্রমে  কেন্দ্রের  বিরুদ্ধে  হিন্দীতে “কেন্দ্র  নিত্যনৈমিত্তিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করকে প্রাণ ওষ্ঠাগত কর্‌ দেতা হ্যায়” বলে বিষোদ্গার করতেন।  

শুনেছিলাম একবার পঙ্কজ মল্লিক নিজের সুর দেওয়া রবীন্দ্রনাথের একটি গান রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন কুন্দনলাল সায়গল। গান শেষ হবার পরে দুজনে যখন ফিরছেন তখন কুন্দনলাল পঙ্কজদা কে বললেন “কেয়া বড়িয়া গানা সুনায়া আপ নে উনকো মল্লিকসাহাব,  দিল ভর গিয়া!”

এদিকে পঙ্কজবাবুর তো রবীন্দ্রনাথের সামনে গাইতে হবে ভেবে সকাল থেকে বুক দুরদুর করছে ভয়ে। গান গাওয়া হয়ে গেছে, তাই এখন তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত।

তিনি বন্ধু কুন্দনলাল কে তাঁর ভাঙা ভাঙা হিন্দী তে নাকি বলেছিলেন, “কেয়া বোলতে হো? সুন্দর গায়া? হামারা তো প্রথম সেহী হৃদকম্প হো রহা থা, গাইতে যে পারা হ্যায়, ইয়ে হী যথেষ্ট হ্যায়!”

কুয়েতে বহুদিন আগে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি কুয়েত অয়েল কোম্পানীতে উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তাঁর হিন্দীও ছিল অসাধারণ! শোনা যায় তিনি নাকি একবার তাঁর একজন colleague কে বলেছিলেন, “আজ মিটিং মে ইতনা হট্টগোল হুয়া কি হাম তো বেগতিক দেখকে সুযোগ বুঝকে উঁহা সে চম্পট দিয়া!”

কুয়েতে অনেক বাংলাদেশী আছে, তাদের সাথে দেখা হলে আমরা বাংলায় কথা বললেও তারা আমাদের ভারতীয় ভেবে হিন্দীতে উত্তর দেবেই।

এই নিয়ে দুটো গল্প।

আশির দশকে সিদ্ধার্থ আর সুমিতা একবার ফাহাহীলে একটা ভিডিওর দোকানে গেছে, সেখানে একটি বাংলাদেশী ছেলে তাদের নানারকম ভিডিও দেখাচ্ছে। সে ধরেই নিয়েছে যে ভাবী শাড়ী পরে আছেন, তিনি হলেন বাঙালী, আর দাদা কোট প্যান্ট অতএব তিনি নিশ্চয় ভারতীয়। কোন ভিডিওতে কি সিনেমা তা বোঝাতে সে প্রথমে সুমিতাকে বাংলায় বোঝায় আর পরে দাদা বুঝতে পারেননি এই ভেবে সিদ্ধার্থকে হিন্দীতে অনুবাদ করে জানায়।    

হামলোগ নামে একটা ভিডিও এসেছে বাজারে, ছেলেটি সুমিতাকে বললো “এই ভিডিও টা লয়ে zaan ভাবী, ছাত্র ছাত্রীদের সমস্যা লয়া সুন্দর বানাইসে।”

তারপর সিদ্ধার্থ  হয়তো তার কথা বুঝতে পারেনি এই ভেবে তার দিকে তাকিয়ে হিন্দীতে, “ছাত্র ছাত্রী লোগোকা  সমস্যা লয়া বহুত সুন্দর বানায়া হ্যায়!”

এক বন্ধুর ছেলের পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ছিল বলে শ্যামল আর নুপূর তাকে  একদিন Al Razi হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল, সেখানে অনেক বাংলাদেশী ward boy,  তাদের একজন কে নুপূর জিজ্ঞেস করে, “Children’s ward টা কোথায় ভাই?”  

তার উত্তরে সেই ছেলেটি যে অবিস্মরণীয় Classic উত্তর দিয়েছিল তা হলোঃ

Shuza zaike ডাইন দিক মে!

নুইসেন্স

আমার বন্ধু সিদ্ধার্থর ছোটবেলা কেটেছে আসামের ডিগবয় শহরে। সে যখন খুব ছোট, ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ে, তার স্কুলের ইংরেজীর মাস্টারমশায়  ঠিক করলেন যে ছেলেদের ইংরেজীটা  ভালভাবে শিখতে গেলে তাদের ইংরেজীতে কথা বলাটা খুব দরকার।

তিনি নিয়ম করে দিলেন যে এবার থেকে সবাইকে ইংরেজীতে কথা বলতে হবে, অসমীয়া, বাংলা কিংবা হিন্দী তে কথা বলা চলবেনা।

সিদ্ধার্থ আর তার বন্ধুদের তো প্রথম প্রথম খুব অসুবিধে হতে লাগলো। ইংরেজীতে কথা বলার অভ্যেস না থাকলে যা হয় আর কি,  সোজা সোজা কথাও মনে মনে বাংলা থেকে ইংরেজীতে translate করে বলতে হচ্ছে, এবং তাও প্রচুর ভুলভাল হচ্ছে।

মাস্টারমশায় বললেন চোখ কান খোলা রাখো, চারিপাশে ইংরেজী তে কেউ কিছু বললে বোঝার চেষ্টা করো, কোথাও ইংরেজীতে কিছু লেখা থাকলে সেটা পড়ে তার মানে জেনে নাও।

ডিগবয় খুব সুন্দর শহর, সেখানে  অনেক বাগান, পরিস্কার রাস্তাঘাট,  নানা জায়গায় ইংরেজীতে লেখা  “Keep your city beautiful”, “ Do not walk on grass”, “Do not touch the flowers”, “Do not commit nuisance”,  ইত্যাদি।

সিদ্ধার্থর সহপাঠী বন্ধু সুকান্ত একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলো  “Do not commit nuisance মানে কি রে?”

সিদ্ধার্থও কথাটার মানে ঠিক জানেনা।

বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করে ওরা জানলো যে কথাটার মানে হলো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া। অর্থাৎ হিসি করা।

এর কিছুদিন পরে ওদের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে, সিদ্ধার্থরা সবাই একমনে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখে যাচ্ছে, সারা হলঘর শান্ত, নীরব, নিশ্চুপ, কোন আওয়াজ নেই।

এমন সময় সুকান্ত হঠাৎ হাত তুললো। সে কিছু বলবে।

Invigilator ছিলেন ওদের ইংরেজীর মাস্টারমশায় । তিনি সুকান্ত কে ইংরেজীতে বললেন, “What do you want?”

সুকান্ত কে ইংরেজীতেই উত্তর দিতে হবে।

সে বললো, “I want to commit nuisance sir!”

ডিস্ম্যান্টেলেবল্‌

কুয়েতে প্রথম দিকে একদিন সিদ্ধার্থ আর নীহার (সেন) দা’ গেছেন ফার্নিচার কিনতে। দুজনেই কুয়েতে নতুন, তাই দুজনেরি নতুন বাড়ীতে খাট চেয়ার টেবিল এই সব দরকার।

হাওয়ালীর বেইরুট স্ট্রীট আর টিউনিস স্ট্রীট অঞ্চলে সারি সারি ফার্ণিচারের দোকান। সেখানে দোকানদাররা সবাই আরব, তাদের মধ্যে প্যালেস্টিনিয়ানই বেশী।

আলমারী টেবিল সোফা সব বেশ ভারী, এই সব বাড়ী নিয়ে যেতে গেলে একটা বড় ভ্যান ভাড়া করতে হবে, গাড়ীতে করে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এগুলো খুলে নিয়ে বাড়ীতে assemble করা যায়না?

নীহার দা’ দোকানদার কে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলেন Are these dismantalable?

Dismantalable?

নীহারদার এই শক্ত ইংরেজী শুনে প্যালিস্টিনিয়ান দোকানদারের তো প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা। তার চোখ গোল গোল হয়ে গেল, কিছুক্ষণ সে কোন কথাই বলতে পারেনি।

আমাদের বাংলায় অবিশ্বাস বিপন্নতা বা বিস্ময় বোঝাবার জন্যে যেমন অনেক expression আছে যেমন যাঃ সে কি, তার মানে? কি যে বলেন, না না হতেই পারেনা, ইত্যাদি, আরবদের ওই একটাই কথা ওয়াল্লা – যা কিনা তারা universally ব্যবহার করে।   

কয়েক মূহুর্ত পরে সংবিত ফিরে পেয়ে দোকানদারটি বললো, “ওয়াল্লা, হোয়াত ইস দ্যাত্‌?”

নীহার দা’ বুঝলেন ইংরেজীটা একটু বেশী কঠিন হয়ে গেছে, একটু সোজা করে বোঝানোর জন্যে তিনি বললেন, “Can we break them and take them home?”

ব্রেক কথাটা শুনে লোকটি হাঁ হাঁ করে উঠে কিছুটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ করে বলেছিল, “ওয়াল্লা, নো নো, নো ব্রেক, দিস ভেরী স্ত্রং…”