তোমাদের মধ্যে যাদের আমার কাছাকাছি বয়েস, তাদের মনে থাকতে পারে আমাদের ছোটবেলায় বিজয়া দশমী এলে পূজো শেষ হয়ে গেল ভেবে মনটা বেশ খারাপ হত ঠিকই, কিন্তু একই সাথে বিজয়ায় অনেক আত্মীয়স্বজন বাড়ীতে দেখা করতে আসতেন এবং তাঁদের জন্যে মা জ্যেঠিমা কাকীমারা অনেক খাবার তৈরি করে রাখতেন। আর আমরা ছোটরা সেই সব খাবারের ভাগ পেতাম।
কিন্তু বিজয়ার প্রধান downside ছিল দু’টো।
এক হলো গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা। আজকাল এই নিয়মটা কি উঠে গেছে? বোধ হয় না।
এখন আমি নিজে একজন গুরুজন হয়ে গেছি, কেউ আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে আমার একটু অস্বস্তি হয়। কিছুদিন আগে গায়ত্রীমাসীর নাতি ঋদ্ধির (মুনিয়া আর দেবাশীষের ছেলে) বিয়েতে গিয়েছিলাম, সেখানে ছোটরা অনেকে ছিল। ঋদ্ধি আর তার নববধূ শীতল তো বটেই্, তা ছাড়া গার্গীর ছেলে শুভ আর তার বৌ সোহিনী, উদয়ের মেয়ে রমিতা, রঞ্জুর মেয়ে তু্তুন, আর তার স্বামী রোহন। এরকম আরো অনেকে সবাই আমায় আর সুভদ্রাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, আমি বাধা দিতে গেলে তারা আমার কথা শোনেনি।
বড়দের শ্রদ্ধা জানানোর এই পুরনো প্রথা আজকের তরুণ ছেলে মেয়েরাও চালু রেখেছে দেখে আমার ভাল লেগেছে।
মনোহরপুকুরে আমাদের ও তখন এই রকম পাইকারী হারে গুরুজন দের প্রণাম করার প্রথা ছিল। আমাদের বাড়ী তখন গুরুজনে একেবার টইটম্বুর ভর্ত্তি, তার ওপর আবার যাঁরা দেখা করতে আসতেন তাঁদেরও প্রণাম করা নিয়ম ছিল। নো ছাড়ান ছুড়ন…
——–
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তাঁর বরযাত্রী বই তে এক জায়গায় লিখছেন, গণশা বলিল, “পরশু মাসীর বাড়ী গেছলাম। মা মাসী ডেকে ডেকে তেইশজন কে পায়ে হাত দিয়ে পেরনাম করালে, তার মধ্যে তিন জন ফাউ। সেখানে অত গুরুজন আছে জানলে ওদিক মাড়াতামনা। কোমরের ফিক ব্যাথাটা এসা আউড়ে উঠেছে!”
ত্রিলোচন প্রশ্ন করিল, “ফাউ মানে?”
“তিনটে তাদের মধ্যে কাজের লোক ছিল, ঘাড় তুলে তাকাবার তো আর ফুরসত ছিলনা!”
————
বিজয়াতে ছেলেদের মধ্যে কোলাকুলির চল অবশ্য এখনো আছে। এখানে ছোট বড়র কোন প্রভেদ নেই, ছোটরাও গুরুজনদের সাথে কোলাকুলি করতে পারে্।
এই নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম।
———–
একবার বিজয়ার পর ভীড় বাসে দুই বন্ধুর দেখা, কিন্তু তাদের মাঝখানে অনেক সহযাত্রী, তাদের শরীরের মধ্যে কয়েক স্কোয়ার ইঞ্চি ফাঁক, সেই ফাঁক দিয়ে তারা পরস্পর কে হেসে শুভ বিজয়া জানাচ্ছে।
কিন্তু এই ভীড় বাসে দূর থেকে নমস্কার বা কোলাকুলি করা অসম্ভব। একে তো দূরত্ব, তার ওপরে দুই হাত দিয়ে ওপরে বাসের হ্যান্ডেল ধরা। নমস্কার যে করবেন তারও উপায় নেই, হ্যান্ডেল থেকে হাত ছাড়লেই উল্টে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা।
দু’জনে তাই যতটা সম্ভব তাদের হাত দুটো ওপরে রেখেই দুই কাঁধ সামনে পিছনে একটু আন্দোলিত করলেন, কোলাকুলি বোঝাতে।
বোঝো কান্ড।
————
দ্বিতীয় downside ছিল বিজয়ার চিঠি লেখা। উঃ, এখন ভাবলে মনে হয় সে ছিল এক বিভীষিকা।
আর যে সব গুরুজনরা বাইরে থাকতেন – তাঁদের সংখ্যাও কিছু কম নয় – তাঁদের নিয়ম করে চিঠিতে বিজয়ার প্রণাম জানাতে হতো। সে আর এক যন্ত্রণা। আজ যেরকম গ্রুপ মেলে বা Whatsapp এ একবার লিখেই সবাইকে একসাথে সবাই কে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তখন তো আর তা ছিলনা। তখন প্রতিটি চিঠি আলাদা আলাদা লিখতে হতো, আর তাও শুধু ন্য়, একটা পোস্টকার্ডে বা ইনল্যান্ডে বেশ কয়েকজন প্রণাম আশীর্ব্বাদ ইত্যাদি জানাচ্ছেন, লেখার জায়গা ক্রমশঃ কমে আসছে, কিন্তু তার মধ্যেই কোনমতে জায়গা করে নিয়ে কখনো মার্জিনে কিছুটা, শেষে কিছুটা, এই ভাবে ভেঙে ভেঙে লিখতে হতো, মাঝে মাঝে নাম ঠিকানার জায়গাতেও প্রণাম জানিয়েছি, প্রায়ই অক্ষর গুলো এত ছোট হয়ে যেত আর হাতের লেখা এত বিশ্রী, যে কেউ সেই লেখা পড়তে পারতো কিনা বলা মুস্কিল।
কেবল একটাই যা সান্ত্বনা ছিল, যে পড়তে না পারলেও কোন অসুবিধে ছিলানা, কেননা কি লেখা আছে তা তো সবারই জানা।
“তুমি আমার বিজয়ার প্রণাম নিও, ছোটদের ভালবাসা জানিও।” ব্যাস, এই তো?
এই একই বাক্য আমাদের সারা দিন ধরে শ’ খানেক চিঠিতে রোবোটের মত লিখে যেতে হতো।
এটা একটা শাস্তি নয়?
বিজয়া দশমী এলেই সেই মিষ্টি খাবার আনন্দের পাশাপাশি ওই শাস্তির কথাটাও এখনো মনে পড়ে।