
ষাটের দশকে আমাদের ছোটবেলায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেট খেলার বর্ণময় ইতিহাস নিয়ে “ইডেনে শীতের দুপুর” নামে একটা বই লিখেছিলেন। তোমাদের মধ্যে যারা আমার সমবয়সী এবং ক্রিকেট নিয়ে তখন যাদের উৎসাহ ছিল তাদের সেই বইটির কথা মনে আছে নিশ্চয়। এই লেখাটির নাম সেই বই থেকে ধার করা।
কুয়েতের বন্ধুদের সাথে সেই আশির দশক থেকে বন্ধত্ব। সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত এর ভেতর দিয়ে আমদের একসাথে পথচলা। এখন সবাই কাজ থেকে অবসর নিয়ে কুয়েত থেকে ফিরে এসেছি। আমাদের মধ্যে যারা কলকাতায় এসে থিতু হয়েছি তারা মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে আড্ডা জমাই। বা একসাথে কলকাতার কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে চলে যাই।
এই লেখাটা আমাদের বন্ধুদের কোলাঘাট বেড়ানো নিয়ে।
——————————————–


কাজ থেকে অবসর নেবার পরে এখন আমাদের জীবন বেশ আনন্দের, রোজই ছুটি, যখন যেখানে খুসী চলে যাই, উইকএন্ডের সন্ধ্যায় আবার কাল সকালে কাজে যেতে হবে বলে মন খারাপ হয়না। এখন সপ্তাহের প্রতিদিনই উইকএন্ড। কিন্তু কোভিডের অতিমারীতে ২০২০ সালটা প্রায় পুরোটাই বাড়ীতে বন্দী হয়ে কেটেছে।
২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে – তখন কোভিডের প্রকোপ কিছুটা কমেছে, ভ্যাক্সিন আসার কথা শোনা যাচ্ছে – আমরা কুয়েতের বন্ধুরা দুচ্ছাই আর পারা যাচ্ছেনা বলে দু’দিনের জন্যে কলকাতা থেকে বাস ভাড়া করে কোলাঘাট ঘুরে এলাম।
কলকাতা থেকে কোলাঘাট ঘন্টা দুয়েকের পথ, বেশ চওড়া পরিস্কার রাস্তা। সকাল সকাল বেরিয়ে বেলা বারোটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের হোটেলের নাম সোনার বাংলা। রূপনারায়ণ নদীর ধারে। সুন্দর বাগান, সেখানে এই জানুয়ারীর শীতে ফুলের মেলা। আর সোনালী রোদ। আমাদের সবার গায়ে গরম জামা, মনের ভিতরে উষ্ণতা ।


বেলা একটা নাগাদ পোঁছে ইলিশ মাছের নানা পদ দিয়ে তৈরী উপাদেয় লাঞ্চ সেরে বাগানে চেয়ার টেনে গোল হয়ে বসে আমাদের আড্ডা শুরু হলো।
সারা দুপুর আর সন্ধ্যা পর্য্যন্ত চললো আমাদের অন্তহীন আড্ডা। অনেক দিন পরে একসাথে হয়েছি আমরা – তাই আমাদের গল্প আর ফুরোতে চায়না। এক এক জন এক একটা গল্প বলে আর বাকি আমরা সবাই হো হো করে হাসিতে লুটিয়ে পড়ি।
গল্পে গল্পে কি করে যে সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারলামনা। রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের টেবিলে চা দিয়ে গেল। ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামলো। নদীর ওপারে সুর্য্যাস্ত হলো, কুয়াশার স্তর নেমে এলো নদীর জলের ওপর। বেশ মায়াবী দৃশ্য।
আমাদের আড্ডায় অনেক মজার মজার গল্প বললো সবাই। সব গল্পই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা।
সেদিনের কিছু গল্প এই সাথে।


১ – সুভদ্রার গল্প – পুলি পিঠে
কুয়েতে সুভদ্রা ALICO তে লাইফ ইন্সুরেন্স বিক্রী করতো আর তার খদ্দেরদের কাছে যাবার জন্যে সে তার সাধের বিশাল Mitsubishi Pajero (SUV) গাড়ী চড়ে সারা কুয়েত শহর চষে বেড়াতো।
তার গাড়ীর গ্যারেজ ছিলো Sharq এ Fisheries বিল্ডিং এর উল্টোদিকে। গাড়ীতে কোন গন্ডগোল হলে সে নিজেই সেখানে গাড়ী নিয়ে চলে যেতো। সেই গ্যারেজের মেকানিকরা সবাই ভারতীয়। তাদের যে লীডার তার নাম মওলা, সে অন্ধ্রের লোক। ভাঙা ভাঙা হিন্দী তে কথা বলে।
তো একবার সুভদ্রার গাড়ীর ফ্যান বেল্ট ছিঁড়ে খুলে গেছে। আমি সুভদ্রা কে বললাম পুলি থেকে বেল্টটা খুলে গেছে, মওলা কে বললেই ও বুঝে যাবে।
সুভদ্রা ফ্যান বেল্ট কথাটা ভুলে গেছে, তার শুধু মনে আছে পুলি।
সে গ্যারেজে গিয়ে মওলা কে বললো “দেখো তো পিঠে মে কুছ হুয়া…”
পিঠে?
মওলা তো অবাক!
“পিঠে কেয়া হ্যায় ম্যাডাম?”
তারপর গাড়ীর বনেট খুলে অবশ্য মওলা বুঝে যায় প্রবলেমটা কি।
গল্পটা শুনে সিদ্ধার্থ বললো তুমি ওকে বললেনা কেন “পাটিসাপটা কো জরা দেখনা, উসমে কুছ গড়বড় হুয়া হোগা…”

২ – সিদ্ধার্থর গল্প
আমার বন্ধু সিদ্ধার্থর মেজমাসীর একটা অদ্ভুত প্রবণতা ছিল, luck ও বলা যায়, তাঁর সাথে celebrity দের পথে ঘাটে দেখা হয়ে যেত। এবং তাদের সাথে দেখা হলেই চেনা নেই শোনা নেই তবু মেজমাসী খুব smartly তাদের সাথে গিয়ে আলাপ জুড়ে দিতে পারতেন। এবং আলাপ করে বাড়ি এসেই তিনি তাঁর বোনদের সবাই কে ফোন করে বলতেন কার সাথে দেখা হল, তিনি কাকে কি বললেন, তারা কি বললো ইত্যাদি।
একবার নিউ মার্কেটে মাধবী মুখার্জ্জীর সাথে মেজমাসীর দেখা। মেজমাসী বললেন এ কী মাধবী, তোমার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ নাকি? মাধবী একটু সংকোচের সাথে বললেন আমি তো মাসীমা আপনাকে ঠিক…
মেজমাসী বললেন আমায় চিনতে পারছোনা তো? কি করে চিনবে? তুমি তো আমায় কোনদিন দ্যাখোইনি।
এই নিয়ে মাসীমা মানে সিদ্ধার্থর মা’র একটা inferiority complex ছিল, কেননা তাঁর সাথে কোনদিন কোন celebrity র দেখা হয়না।
তো একবার মাসীমা ছেলের কাছে কুয়েতে বেড়াতে এসেছেন। মাস তিনেক থাকার পরে সিদ্ধার্থ তাঁকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। দুবাই তে Stop over, সেখানে সিদ্ধার্থ দ্যাখে মৃণাল সেন লাউঞ্জে একটু দূরে বসে আছেন। মাসীমাও দেখেছেন।
সিদ্ধার্থ মাসীমাকে বলল মা আমি একটু বাথরুমে যাচ্ছি, তুমি কিন্তু একদম ওনার সাথে গিয়ে কথা বলবেনা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে সিদ্ধার্থ দ্যাখে যা ভয় পেয়েছিল তাই, মাসীমা মৃণাল বাবুর পাশে বসে দিব্বি আলাপ করে যাচ্ছেন। সিদ্ধার্থ কাছে আসতে মাসীমা বললেন এই হল আমার ছেলে, কুয়েতে থাকে। মৃণাল বাবু বেশ গপ্পে লোক, তিনি বললেন আমিও কুয়েতে গিয়েছিলাম একবার বেশ কিছুদিন আগে…
দমদম থেকে যাদবপুরে বাড়িতে ঢুকেই মাসীমার ফোন মেজমাসীকে।
মেজদি, জানিস আজ কার সাথে দেখা হলো?
ঋত্বিক ঘটক!

৩ – টিঙ্কুর গল্প
টিঙ্কু আর দেবাশীষ কলকাতায় ফিরে আসার পর, তাদের ড্রাইভার সুভাষ ওদের প্রায় বাড়ীর লোক হয়ে গেছে। গাড়ী চালানো ছাড়া সে ওদের বাজার দোকান ইত্যাদি অনেক কাজ হাসিমুখে করে দেয়। সে একাধারে বিশ্বাসী আর করিতকর্ম্মা ছেলে।
তো একদিন টিঙ্কু সুভাষ কে বললো, “আমার জন্যে বারোটা বারোটা করে দুই গোছা চব্বিশটা রজনীগন্ধা নিয়ে আসিস তো। কাটতে হবেনা, আমি কেটে নেবো।”
কিছুক্ষণ পরে সুভাষ রজনীগন্ধা নিয়ে এসে হাজির। টিঙ্কু বলল, “নিয়ে এসেছিস, ঠিক আছে ফ্রিজে রেখে দে।”
বিকেলে টিঙ্কু ফ্রিজ খুলে কোথাও ফুল না দেখে সুভাষ কে বললো, “কি রে রজনীগন্ধা কোথায় রাখলি? ফ্রিজে তো দেখছিনা?”
“কেন, ওখানেই তো আছে”, বলে সুভাষ দুই তাড়া রজনীগন্ধা পান মসালার প্যাকেট নিয়ে এসে টিঙ্কু কে দিলো!
টিঙ্কুর তো তাই দেখে চক্ষু চড়কগাছ!
টিঙ্কুর বকুনী খেয়ে সুভাষ বলেছিল, “তাই দোকানের লোকটা বলছিল এগুলো তো এক প্যাকেটে দশটা করে থাকে, বারোটা তো হবেনা, দুটো আলাদা নিয়ে যান!”
সত্যি পান মসালার নাম রজনীগন্ধা হলে সুভাষ কি করবে?
কিন্তু টিঙ্কুরই বা কি দোষ?

৪) কোলাঘাট থেকে ফেরার পথে কোভিডের টেস্ট
পরের দিন কোলাঘাট থেকে কলকাতা ফেরার পথে এক জায়গায় গাড়ী দাঁড় করিয়ে রাস্তার পাশে একটা হোটেলে আমরা লাঞ্চ খেতে ঢুকলাম। প্রসূণ বললো, “তোমরা যাও আমি একটু টয়লেট হয়ে আসছি।”
একটু পরে ফিরে প্রসূণ ফিরে এলো, তার মুখের ওপর একটা রুমাল। সে বললো “আমার কোভিড হয়নি। ”
আমরা বললাম, “কি করে জানলে?”
প্রসূণ বললো “বাথরুমে একটা কোভিড টেস্ট দিয়ে এলাম। সব গন্ধই নাকে পেয়েছি। নিশ্চিন্ত।“


