Tag Archives: ভুলোমন

ভুলভুলাইয়া

ধাবার সামনে দীপা, সুভদ্রা আর সুব্রত

২০১৬ সালের মে মাসে আমরা কুয়েত থেকে পাকাপাকি দেশে ফিরে এসেছি। কোন কাজ নেই, এই সময় দু’তিন দিনের জন্যে কলকাতার কাছে কোথাও বেড়াতে গেলে বেশ হয়।

হুগলি জেলায় ইটাচুণার রাজবাড়ী কথা বেশ কিছুদিন শুনছি। চেনাশোনা অনেকেই সেখানে গিয়ে থেকে এসেছে, তাদের কাছ থেকে খবর পেয়েই আমরা দুজনে এক উইকেন্ডে সেখানে গাড়ী ভাড়া এক রাতের জন্যে ঘুরে আসবো ভেবেছিলাম। দীপা গরমের ছুটিতে ছেলের সাথে কলকাতায় আছে, সে একদিন এসেছিল দেখা করতে, আমরা ইটাচূনা রাজবাড়ী যেতে চাই শুনে সে নেচে উঠলো, “চলো সুভদ্রা দি’, আমরা একসাথে যাই।”  

সুব্রত ঈদের ছুটিতে কুয়েত থেকে কলকাতায় আসছে, ওরা ইটাচূনা যায়নি, ঠিক হল আমরা চারজন একসাথে যাবো।  

ইটাচূণা আবার কি নাম?

অবশ্য গ্রামের নামের কোন মানে থাকতে হবে তার কি মানে আছে?

জলপাইগুড়ি তে ডুয়ার্সের একটা চা বাগানে একবার কাজে গিয়েছিলাম, অপূর্ব্ব সুন্দর জায়গা, চা বাগানের মধ্যে সারি সারি  লম্বা লম্বা shade tree,  দূরে নীল পাহাড়, কিন্তু জায়গাটার নাম ঘাটিয়া…

আমার ভালকাকীমার বাপের বাড়ী ছিল পুর্ব্ব বাংলার রংপুরের কাছে একটা গ্রামে, তার নাম গাইবান্ধা। কেন? ওখানে কি গরুদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় নাকি?

গ্রামের নামের কোন মাথামুন্ডু হয় না, যা ইচ্ছে একটা হলেই হলো।

ইটাচূণা নামটা অবশ্য বেশ ভাল, তার ওপরে আবার রাজবাড়ী। গ্রামে আবার রাজা কোথা থেকে এল? জমিদার বা খুব বড়লোক হলে সবাই রাজামশায় বলে ডাকে।  সেরকমই কিছু হবে। ওই গ্রামের এক ভদ্রলোক শোনা যায় সাহেবদের আমলে ইট আর চূনের ব্যবসা করে লালে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। সাহেবরা তাঁকে ভালবেসে অনেক জমি আর রাজা উপাধি দিয়ে থাকবেন, সেই থেকেই ইটাচূণা রাজবাড়ী। 

সুভদ্রা ইন্টারনেট থেকে ফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোন করে দুটো ঘর বুক করে ফেলেছে। ঘরের নাম ঠাকুমার ঘর আর  বড়বৌদির ঘর।  বেশ নাম তো ? বনেদী রাজবাড়ীর অন্তঃপুরের একটা গন্ধ পাওয়া যায় ওই নামগুলোতে। ওই ঘরে আমরা থাকবো ভাবতে বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছিল।

সুভদ্রা যদি ঠাকুমা হয়, আমি কি তাহলে ঠাকুর্দ্দা? কিংবা সুভদ্রা বড়বৌদি, আমি বড়দা’?

মন্দ কি?

ইন্টারনেটের কল্যাণে আজকাল সব কিছুই ঘরে বসেই করা যায়, ইটাচূণা রাজবাড়ীর ওয়েবসাইটে গিয়ে আমি পরের দিন এক রাতের জন্যে পেমেন্ট ও করে দিলাম। দীপারা একটা বড় গাড়ীর বন্দোবস্ত করেছে।

বুধবার ৬ই জুলাই সকালে বেরোব, আগের দিন রাজবাড়ীর marketing office থেকে ফোন এলো। hiসকালে আর রাত্রে কি খাবেন? মেনু হল মাছ, মাংস, চিকেন আর ডিম।

বেশ ভাল ব্যবস্থা তো? Very well organized…

আমি আর সুভদ্রা মাছ, দীপা আর সুব্রত ডিম অর্ডার করলাম।

ছয় তারিখ কথামতো ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় গাড়ী নিয়ে দীপা আর সুব্রত আমাদের আইরনসাইড রোডের বাড়ীতে হাজির। আমরাও তৈরী হয়ে ছিলাম।

বড় গাড়ী। টয়োটা ইনোভা,  পিছনে বুটে আমাদের মালপত্র রেখে আমরা যে যার মত বসে গেলাম। আমি ক্যামেরা হাতে সামনে, ড্রাইভারের পাশে। ড্রাইভারের নাম বাপী। বাপীর ছোটখাটো চেহারা, সে অল্প কথার মানুষ, আমায় একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল দরকার পড়লে ডাকবেন, আমি এই দেশের সব জায়গায় গাড়ী চালিয়েছি। সব রাস্তা আমার চেনা।

কাল ইন্টারনেট থেকে আমি ম্যাপ ডাউনলোড করেছি, কিন্তু তার আর দরকার হবেনা, ইটাচূণা রাজবাড়ির রাস্তা বাপীর চেনা, সে এখানে আগে এসেছে।

রাস্তায় খাবার জন্যে আমরা গতকাল হলদিরাম থেকে কিছু নোনতা স্ন্যাক কিনেছি, আজ দীপা আর সুব্রত বেকবাগানে মিঠাই থেকে সিঙাড়া আর কড়াপাকের সন্দেশ কিনে নিলো গাড়ী থামিয়ে।

পার্ক সার্কাস ব্রীজ ছাড়িয়ে সেকেন্ড হুগলী ব্রীজ, সেটা ছাড়াতেই দেখা গেল নীল রং দিয়ে সাজানো নবান্ন বিল্ডিং। তারপরে কোনা রোড চলে এলো, ক্রমশঃ লোকালয় ছাড়িয়ে যাচ্ছি আমরা, দু’পাশের দৃশ্যপট landscape দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সুভদ্রাদের রামরাজাতলার বাড়ীর রাস্তা পেরিয়ে গেলাম, শহর থেকে শহরতলী, রাস্তার পাশে বাড়ী আর দোকান বাজারের চেহারা পালটে যাচ্ছে।

শহরতলী ছাড়িয়ে ক্রমশঃ চওড়া দূর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে আমাদের গাড়ী যাচ্ছে।  

অনেকক্ষণ গাড়ীতে আছি, এবার একটা rest room break নিলে হয়না?

বাপীকে বলতেই সে পথে একটা Rest area তে নিয়ে এসে গাড়ী থামালো। এই সব জায়গা সব তার হাতের পাতার মত চেনা।

বিরাট একটা খোলা জায়গা, মাঝখানে HP petrol station, দূরে HP নামে একটা ধাবা।    

ধাবার দরজায় এক বিশাল চেহারার ভদ্রলোক হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন।

এই এক শুরু হয়েছে দেখছি আজকাল এই দুই হাত জোড় করে নমস্কার। কোন মলে গেলে সিকিউরিটি গার্ডরা আমাদের body check করার আগে নমস্কার করবেই। কেন রে বাপু? আমরা তো টেররিস্ট হতে পারি। আমাদের পেটে বোমা গোঁজা কিংবা পকেটে ছুরি কিংবা রিভলভার থাকতে পারেনা? ভাল করে আমাদের চেক কর্‌ তা না যেন আমরা রামচন্দ্র আর তারা ভক্ত হনুমান।

“অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ” কথাটা পালটে এখন বলা উচিত “অতি ভক্তি গার্ডের লক্ষণ।”   

দোকান ফাঁকা, কিছু চেয়ার আর সোফা এদিক ওদিক বসানো। কাউন্টারে আর এক হুমদো মত ভদ্রলোক বসে আছেন।

প্রথম হুমদো হাত জোড় করে নমস্কার করে আমাদের বললেন “আসুন, আসুন!”

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কফি পাওয়া যাবে?”

অবশ্যই  পাওয়া যাবে জানালেন তিনি। কফির অর্ডার দিয়ে দিলাম আমরা। সুভদ্রা আর দীপা বাথরুমে যাবে। কিন্তু ধাবায় বাথরুম নেই। দোকানের একটি ছেলে ওদের দূরে বাথরুম দেখাতে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে সুব্রত কাউন্টারের দ্বিতীয় হুমদো ভদ্রলোক কে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে শুরু করেছে।

এই দোকানটা কি HPর ? না, ওঁরা ফ্রাঞ্চাইজ নিয়েছেন।

মালিক কে? ওই যিনি দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন।

তাহলে আপনি? আমি কর্ম্মচারী।

আজ তো ঈদের ছুটি, দোকানে ভীড় নেই কেন? কি করে বলবো? পরে বিকেলের দিকে ভীড় হবে আশা করছি।

আপনাদের এখানে কি ঘর পাওয়া যায়? না।

ক’জন লোক কাজ করে? দশজন।

আমি বুঝতে পারছিলাম সুব্রত র এই  grilling ভদ্রলোকের পছন্দ হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পরে ওনার একটা ফোন এল, তিনি সুব্রতর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেন। 

কফি আর আসেনা, ওদিকে সুভদ্রা আর দীপাও ফিরছেনা। আমি আর সুব্রত দু’জনে বসে আড্ডা মারছি। আমাদের আজকের সাবজেক্ট পৃথিবীতে তেলের দাম কেন কমে যাচ্ছে? সুব্রত তেল কোম্পানীতে কাজ করে, আমিও একসময় Indian Oil এ কাজ করেছি। তাই ভারতের তেল নিয়ে কথা উঠলো, আমরা কত তেল import করি, ইত্যাদি। সেখান থেকে কথায় কথায় ভারতবর্ষের Refinery র কথা উঠলো। আমি সুব্রত কে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা আম্বানীদের গুজরাটে একটা Refinery আছে না? কোথায় যেন?

এই রে!

সুব্রতর কিছুতেই মনে পড়ছেনা জায়গাটার নাম। আমারও না। কিছু জানা জিনিষের নাম ভুলে গেলে বড্ড অস্বস্তি হয়, না মনে পড়া পর্য্যন্ত অস্থির লাগে।

ওই কাউন্টারের ভদ্রলোক কি জানেন ? ওনাকে সুব্রত জিজ্ঞেস করবে নাকি? কিন্তু ভদ্রলোক সেই যে ফোন কানে নিয়ে বসে আছেন, কার সাথে এত লম্বা কথা বলছেন কে জানে। কিংবা হয়তো কারুর সাথে কথা বলছেন না আদৌ, সুব্রতর প্রশ্নবাণ আবার শুরু হবে এই ভয়ে ফোনে কথা বলার অভিনয় করছেন।

ভুলে যাওয়া নিয়ে এই রকম একটা গল্প আছে। এক ভুলো লোকের বাড়ীতে তার বন্ধু এসেছে, সে তার বন্ধুকে বলছে জানিস,  কাল আমরা একটা রেস্টুরেন্টে খেলাম। সে যে কি অপূর্ব্ব খাবার~

বন্ধু জিজ্ঞেস করল কোন রেস্টুরেন্ট? কি নাম?

এই রে, নাম তো মনে পড়ছেনা। একটা ফুলের নাম কর্‌, যা প্রেমিকরা প্রেমিকাদের দেয়।

বন্ধু বললো, কার্নেশন?

আরে না না।

তাহলে কি প্যানসি?

না না, যে ফুলের গাছে কাঁটা থাকে।

ও Rose?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলে ভুলো লোকটি তার বৌ কে ডেকে বললো, এই Rose, কাল আমরা যে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম তার নামটা যেন কি?

তার মানে রেস্টুরেন্টের নাম তো ভুলেছেই, তার ওপর নিজের বৌয়ের নামও মনে নেই!

সুব্রতর অবশ্য অত খারাপ অবস্থা নয়, সে বৌয়ের নাম ভোলেনি।

একটু পরে দীপা আর সুভদ্রা ফিরতেই সুব্রতর দীপাকে প্রথম প্রশ্ন – অমুক দা কোথায় থাকেন যেন?

দীপা একটুও সময় না নিয়ে promptly বললো জামনগরে!

সুব্রতর মুখটা তাই শুনে  উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।  আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে সে বললো ~

ইন্দ্রজিৎ দা’, জামনগর!