
নভেম্বর, ২০১৭
মা’র ৯৪ বছর বয়েস হল, ক্রমশঃ আরো ক্ষীন আর দুর্ব্বল হচ্ছেন। সারাদিন বাড়ীতে বন্দী, লাঠি ধরে আস্তে আস্তে হাঁটেন। ভাই বোন সমবয়েসী খেলার সাথী এক এক করে সবাই চলে গেছেন, এখন তাঁরও ওপারে যাবার অপেক্ষা।
আমি মা’র একমাত্র সন্তান তাই তাঁর স্নেহের সিংহভাগ আমিই পেয়ে এসেছি। অবশ্য সেই স্নেহের উল্টোদিকে ছিল কঠোর শাসন আর পরের দিকে গভীর দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ, যার ভারও আমায় সারা জীবন একাই বইতে হয়েছে।
১৯৬৩ সালে খড়গপুরে হোস্টেলে যাবার সময়ে (আমার সেই প্রথম বাড়ী ছেড়ে একা থাকা)হাওড়া স্টেশনে আমায় তুলে দিতে এসেছিলেন মা আর বাবা। ট্রেণ ছেড়ে দেবার পরে অনেকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়েছিলাম। দু’দিন পরে বাবার লেখা পোস্টকার্ড পেলাম। হাওড়া স্টেশনের পোস্ট অফিস থেকে সে দিন আমায় ট্রেণে তুলে দিয়েই লিখে পোস্ট করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন তোমাকে ছেড়ে তোমার মা খুব কাঁদছেন, তুমি ঠিকঠাক পৌঁছলে কিনা জানার জন্যে আমরা খুব উদ্বিগ্ন থাকবো, তাই এই চিঠি পেয়েই উত্তর দিও।
এবছর পূজা সংখ্যা দেশে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস “ঘটনাক্রমে” র এক জায়গায় বৃদ্ধা মা মোহিনী এবং তাঁর প্রৌঢ় এবং অসুস্থ ছেলে সুকুমার কে নিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
—————–
মোহিনী আর আগের মত চটপটে নন্, নানা ব্যথা বেদনা অস্থি সন্ধিতে বিকলতা, লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। তাই তাঁর ছেলে সুকুমার যখন শেষ দুপুরে নার্সিং হোম থেকে ফিরলেন, তখন তিনি তেমন উদ্বেলিত হতে পারলেন না। তবে তাঁর মুখে এক অপরূপ হাসি ছিল। সুকুমার যখন তাঁর বিছানার পাশে পা ঝুলিয়ে বসলেন তখন মোহিনীর রোগা হাত সুকুমারের পিঠে বিচরণ করছে। কি খুঁজছে সেখানে কে জানে? কে জানে মায়ের হাত সন্তানের শরীরে বার বার নিজেকেই খুঁজে পায় কিনা। হয়তো হাত ও বিড়বিড় করে। এ আমার এ আমার এ আমার।
——————–
গল্পের মোহিনীর মত আমার মা ও এক কালে খুব চটপটে ছিলেন, সারা জীবন এ জি বেঙ্গলে চাকরী করেছেন, রোজ সকালে নিয়ম করে ভীড় বাসে চড়ে ডালহাউসী স্কোয়ারে অফিস গিয়েছেন, সন্ধ্যাবেলা রোজ ফিরেছেন ট্রামে। তাছাড়া বিশাল যৌথ পরিবারের অনেক দায়িত্ব সামলেছেন, নিকট এবং দূর সম্পর্কের দুঃস্থ আত্মীয়দের যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। দেশের প্রায় সব তীর্থস্থানে গিয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি এক আশ্চর্য্য সফল, ব্যস্ত এবং কর্ম্মবহুল জীবন কাটিয়েছেন।
ছোটবেলায় আমি মা’র সাথে দূরপাল্লার ট্রেণে করে অনেক ঘুরেছি। কখনও দিল্লী, কখনও পাটনা, কখনও কাশী। সেই সব ভীড় ট্রেণে unreserved কামরায় হুড়োহুড়ি করে আমার হাত ধরে মা কি করে যে ঢুকে জায়গা করে নিতেন, ভাবলে বেশ অবাক লাগে।
কিন্তু সেই মা এখন সারাদিন আমাদের পূর্ণ দাস রোডের বাড়ীর বারান্দায় জানলার সামনে একটা চেয়ারে একা চুপ করে বসে থাকেন। কথা বলার লোক নেই, বলার মত কোন কথাও নেই। কিছুদিন আগেও খবরের কাগজ আর দেশ পত্রিকা খুঁটিয়ে পড়তেন, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে কেবল গীতা নিয়ে পাতা উল্টোন্।
এখন আমি রোজ একবার মা’র কাছে বিকেলে যাই, মা’র পাশে বসে একসাথে চা খাই। পুরনো দিনের নানা কথা হয়। গল্পের মোহিনী র মতো মা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোন।
কোন কাজে আটকে গেলে আজ যেতে পারছিনা বলার জন্যে মা’কে ফোন করি, কিন্তু আমার ফোন পেয়ে কিছু বলার আগে মা নিজেই জিজ্ঞেস করেন, “কি রে আজ আসতে পারবিনা? আজ কি হলো, শরীর ঠিক আছে তো?”
এই উদ্বেগ অবশ্য আমার বেশ ভালোই লাগে। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি।
একবার মনে আছে মা’কে নিয়ে এক ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বাইরে হলে ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। পাশাপাশি বসার জায়গা নেই, তাই মা’র থেকে J একটু দূরে বসেছি। আমার পাশের লোকটি উঠে গেলে একটু জায়গা হতেই মা, ছোটখাটো মানুষটি, ক্ষিপ্র ভঙ্গীতে তীর বেগে কেউ আসার আগেই চলে এসে আমার পাশে বসে পড়লেন।
ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু এখনো ভুলতে পারিনা।


মাঝে মাঝে আমি আমার গাড়ীতে মা’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কোনদিন মাসতুতো বোন গার্গীর বাড়ী বাঁশদ্রোণী। কোনদিন মামাতো বোন মিনির বাড়ী কসবায়। এরকম আরো অনেক আত্মীয়স্বজন আর কাছের লোকের কাছে চলে যাই, খানিকক্ষন সময় কাটিয়ে আসি। মা বেশী কথা না বললেও তাঁর ভাল লাগে বুঝতে পারি। যাদের বাড়ীতে যাই তারাও খুব খুসী হয় মা’কে পেলে।
আমাদের যৌথ পরিবারে মা লতায় পাতায় সবার সাথে গভীর সম্পর্ক রাখতেন। এ ব্যাপারে তাঁর একটা স্বাভাবিক তৎপরতা ছিল।
কিছুদিন আগে মা’কে বললাম চলো তোমাকে তোমার অফিস দেখিয়ে আনি। এক সময়ে যেখানে তুমি রোজ যেতে।
মা রাজী।
প্রথম স্টপ মনোহরপুকুর। আমাদের বাড়ি আর নেই, বিক্রী হয়ে গেছে, সেখানে এখন নতুন বাড়ি, তার তলায় গিয়ে গাড়ীটা পার্ক করে কিছুক্ষণ থাকলাম। মা চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন বাড়ীটার দিকে। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি এখানে কাটিয়েছেন।
সেখান থেকে কালীঘাটে মায়ের মন্দির। মহিম হালদার স্ট্রীট দিয়ে কালীমন্দির যাবার পথে একটা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির পড়তো সেখানে মা আর জ্যেঠিমা শিবের মাথায় জল দিতেন।বছরে অন্ততঃ তিন দিন আমি আর মা এক সাথে কালীবাড়ী যেতাম। আমার জন্মদিনে ভোরবেলা, শিবরাত্রির দিন বিকেলে আর কালীপূজোর দিন রাত্রে।
কালীঘাট থানার পরে মন্দিরের রাস্তায় ঢুকে ডান দিক বন্ধ, পুলিশ গাড়ী ঢুকতে দেবেনা, দূর থেকেই মা দুই হাত জুড়ে প্রণাম করে নিলেন। মা খুব শিবের ভক্ত ছিলেন, প্রায় সব সময় তাঁর গলায় “প্রণমামি শিবং শিব কল্পতরুং” গানের সুর শুনে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম।
তার পরে সেখান থেকে আশুতোষ মুখার্জ্জী রোড, হাজরা মোড়, পুর্ণ সিনেমা, জগুবাবুর বাজার, এলগিন রোড, লছমী বাবু কা সোনা চাঁদী কি দুকান। মা’কে বললাম কি, এই সব জায়গা চিনতে পারছো? তোমার তো চেনা রাস্তা, রোজ দু’বেলা বাসে করে এই রুটে যাতায়াত করতে।
মা ঘোলাটে চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে বললেন “কতো গাড়ী, কি ভীড়!”
সবই মা’র চোখে নতুন লাগছে মনে হলো।
তারপর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হয়ে রেড রোড দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন মা দেখলাম বাইরের সবুজ দেখে খুব খুসী। তার পরে ইডেন গার্ডেন আকাশবাণী ভবন হয়ে রাজভবনের সামনে মা’র পুরনো অফিস। সেখান থেকে আউটরাম ঘাটে গঙ্গা। মা আবার হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।
এই সব জায়গা এক সময় কত পরিচিত ছিল তাঁর!
বাড়ী যখন ফিরছি তখন অন্ধকার নেমে আসছে।

———————-
নভেম্বর, ২০২৩
এখন এই ২০২৩ সালে যখন মা আর আমাদের মধ্যে নেই, আমি মাঝে মাঝে বাড়ীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি। নীচে পূর্ণ দাস রোডে আর কেয়াতলা রোডে লোকজন, ব্যস্ততা, গাছে পাখী এসে বসছে, কাঠবিড়ালী তরতর করে গাছের ডাল দিয়ে চলে যাচ্ছে, চারিদিকে প্রাণের খেলা।
মনে হয় সবই আছে আগের মত, শুধু মা ই আর নেই।
কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানে এক ভদ্রমহিলা বলছিলেন, এখন থেকে একশো বছর পরে, ধরো ২১২৩ সালে, যখন আমরা কেউ বেঁচে থাকবোনা, তখন আমাদের এই যে এখন এত বাড়ী গাড়ী টাকা পয়সা, এই সব কোথায় থাকবে? আমাদের কষ্টার্জ্জিত টাকায় তৈরী বাড়ীতে থাকবে অচেনা লোকেরা, আমাদের এত সাধের দামী গাড়ী স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে পড়ে থাকবে। আমাদের মৃত্যুর পর বড় জোর কয়েক দশক আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের মনে রাখবে, আমাদের ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবে, কিন্তু তারপর? আমরা কি আমাদের ঠাকুর্দ্দার ঠাকুর্দ্দার নাম কেউ জানি, বা জানতে চাই?
তাহলে মোদ্দা কথাটা কি দাঁড়ালো?
ভিডিওর মহিলা বলছেন, সবসময় ভাবো কত ক্ষণস্থায়ী আমাদের জীবন, তাই “এ আমার এ আমার এ আমার” বলে কোন কিছুকেই একান্ত নিজের বলে আঁকড়ে থেকে মনকে ভারাক্রান্ত কোরোনা।
গীতায় ও ভগবান শ্রী কৃষ্ণ আমাদের সেই নিরাসক্তি আর নির্লিপ্তি সাধনা করার উপদেশ দিয়ে গেছেন।
মা’র মৃত্যু এখন অন্য আর একটি কারণে আমার জন্যে অনেক সহনীয় হয়ে এসেছে।
২০১৯ সালে মা চলে যাবার পরের বছরেই (২০২০ সালে) আমাদের জীবনে কোভিডের অতিমারীর আবির্ভাব হয়।
কোভিডের আগে অনেক বছর ধরে আমাদের মনে সার্থক জীবন আর ভাল মৃত্যু সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী হয়েছে। আগে সেই চলে যাওয়া ছিল এক সার্থক জীবনের সুখী পরিণতি। দীর্ঘ জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে সব দায়িত্ব পালন করে পরিণত বয়সে আত্মীয় পরিজনদের সবাইকে পাশে রেখে সেই চলে যাওয়ার সার্থকতা এতদিন ছিল সামাজিক পরিপূর্ণতায়।
আমার মা যখন পরিণত বয়সে মারা যান, তখন শ্মশান ঘাটে গিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আমার সব ভাই বোনেরা গিয়েছিল। তাঁর শ্রাদ্ধবাসরেও অনেকে এসেছিলেন, স্মৃতিচারণ করেছিলেন। আমাদের ধারণায় এই ছিল গ্রহণযোগ্য মৃত্যু।
কিন্তু ২০২০ সালের এই করোনা ভাইরাস এসে ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু নিয়ে আমাদের ধারণা যেন আমূল পালটে দিয়ে গেল।
মৃত্যুর কি নতুন রূপ দেখলাম আমরা?
আনন্দবাজারে সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত লিখেছেন – “আমরা দেখলাম করোনা আক্রান্ত কে বাড়ী ফিরতে দেওয়া হচ্ছেনা, চিকিৎসক কে পাড়া ছাড়া করা হচ্ছে, মুমূর্ষূ কে এম্বুল্যান্স থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আক্রান্ত কে তো বটেই, তার পরিবার কেও একঘরে করা হচ্ছে, ফুটপাথে পড়া রোগীর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেনা। সেই সঙ্গে আতঙ্ক, গুজব, কুসংস্কার। সংক্রমণের আশঙ্কায় আত্মীয় স্বজন কে মৃতদেহের কাছে যেতে দেওয়া হয়না। হাসপাতাল থেকেই সোজা কোভিড আক্রান্ত দের জন্যে আলাদা শ্মশানে দাহ করার জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ”
যাঁরা দেখাশোনা করেন, সেই নার্স ও ডাক্তাররা স্পেসস্যুটের মত পোষাক পরে থাকেন, যাতে তাঁরা আক্রান্ত না হন্। তাঁদের হাতে দস্তানা, চোখে ভারী গগলস্, যাতে বীজানু না ঢোকে। ফলে মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে রোগীর সাথে কোন মানুষের শারীরিক যোগাযোগ নেই। এমন কি ডাক্তার বা নার্সের চোখে কোন সহানুভূতির ছায়া অথবা তাঁরা যে কোন মানুষের সঙ্গের স্বাদ পাবেন, তারও উপায় নেই।
আপনজনের মৃত্যু এমনিতেই অসহনীয় দুঃখের, কিন্তু করোনার আবহে করোনাভাইরাস এমন একটা অসামাজিক চেহারা দিল মৃত্যুকে, যার জন্যে আমরা মানসিক ভাবে এখনো তৈরী নই। হয়তো কোন দিন হবোনা।
আমার মা এই কোভিড অতিমারীর আগে চলে গেছেন এই কথা ভেবে মনের মধ্যে একটা স্বস্তি অনুভব করি।

