Tag Archives: মুম্বাই

বিয়ের আগে – মা vs বৌ

১ – কার রান্না?

১৯৭০ সাল, আমি ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানী (মার্কেটিং ডিভিসন) তে Management Trainee  হিসেবে জয়েন করে মুম্বাইতে গেছি।  আমাদের আট জনের ব্যাচে আমরা দুই জন বাঙ্গালী, সুমন্ত্র ঘোষাল, আর আমি। আমরা দু’জন সান্তা ক্রুজ ইস্ট (রেল লাইন এর পূব দিকে) একটা গেস্ট হাউসে একটা বড় ঘর নিয়ে থাকি।

মুম্বাইতে হেড অফিসে আমাদের তিন মাস ক্লাস রুম ট্রেনিং, তাই রোজ সকাল আটটা নাগাদ স্নান টান সেরে বেরিয়ে আমরা কাছেই একটা ইরাণী রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট (মাসকা বান আর কলা) সেরে লাল রং এর দোতলা বাস (84 Limited) ধরে Worli তে আমাদের অফিসে চলে যাই। তারপরে সারা দিন ক্লাসে নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করে বিকেলে দোতলা বাসে চড়ে মুম্বাই শহর টা ঘুরে ঘুরে  দেখি।  সুমন্ত্র দিল্লীর ছেলে, আমি এসেছি কলকাতা থেকে। মুম্বাই শহরটা আমাদের দু’জনের চোখেই নতুন।

সারা বিকেল শহরটা ঘুরে বেড়িয়ে দেখে সন্ধ্যায় আবার ট্রেণে বা বাসে চেপে বাড়ী।

আমাদের ঘরে রান্নার বন্দোবস্ত ছিলনা, থাকলেও আমরা রান্না করতাম কিনা সন্দেহ। রাত্রের খাবারের জন্যে আমরা বোস বাবু বলে এক বাঙালী ভদ্রলোক কে ঠিক করেছিলাম, তিনি রোজ সন্ধ্যাবেলা টিফিন ক্যারিয়ারে করে আমাদের ডিনার দিয়ে যেতেন। মুম্বাইতে ওই ভাবে খাবার সাপ্লাই করার ট্র্যাডিশন বহুদিনের।

বোসবাবু বাঙালী খাবার পাঠাতেন। ডাল, তরকারী, মাছের ঝোল। আমরা খেতাম আর অনুমান করতাম এই সব ওনার বাড়ীর রান্না। হয়তো ওনার মা বা বৌ এইসব রান্না করেন, এটা হলো ওঁদের family business…

হয়তো একদিন একটা নিরামিষ তরকারী দারুন খেতে হয়েছে, সুমন্ত্র খেয়ে বলতো, বাঃ এই তরকারীটা দুর্দ্দান্ত লাগছে খেতে, এটা নিশ্চয় বোসবাবুর মা রান্না করেছেন।

আবার কোন একদিন মাছের ঝোল মুখে বিস্বাদ লাগলে আমি বলতাম কি বিশ্রী হয়েছে খেতে, এই রান্নাটা বোস বাবুর বৌ রেঁধেছে নির্ঘাৎ!

মা আর বৌ – ২ – কার জন্যে ফিরে যাবো?

মাস দুয়েক ক্লাসরুম ট্রেনিং এর পরে আমাদের একটা ফিল্ড ট্রিপ হলো আমেদাবাদ আর বরোদা তে।

সেখানে আমরা আঙ্কলেশ্বর Oil field আর বরোদার কয়ালী refinery দেখে অনেক কিছু জানবো শিখবো। আমাদের ট্রেণ মুম্বাই থেকে সন্ধ্যাবেলা ছাড়লো। আমরা আট জন Management Trainee, আমাদের সাথে আমাদের মেন্টর এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক তিনি বেশ মাই ডিয়ার লোক, ফর্সা, এক মাথা টাক, ছোটখাটো, হাসিখুসী মানুষ, তাঁর মুখ দেখেই তাঁকে বাঙ্গালী বলে চেনা যায়। আমি আর সুমন্ত্র তাঁকে মুকুল দা’ বলে ডাকি।  

তো এক কম্পার্টমেন্ট এ সকলে মিলে বসে খুব আড্ডা চলছে। আড্ডার সাবজেক্ট হলো Love Marriage না Arranged marriage ? মুকুলদা’ আমাদের মডারেটর। বিয়ে নিয়ে এই অবিবাহিত যুবকদের তর্ক আর কথাবার্ত্তা শুনে তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন মনে হয়।

কিছুক্ষণ আলোচনা চলার পরে হঠাৎ মুকুল দা’ বললেন আচ্ছা ধরো বিয়ের পরে তোমরা সবাই upward mobile corporate executive হয়েছো, অফিসের কাজে তোমরা খুব ব্যস্ত থাকো, তোমাদের সবার লক্ষ্য কোম্পানীতে তরতর করে ওপরে ওঠা, বাড়ীতে বৌকে বেশী সময় দিতে পারোনা। অফিসের একটা খুব important মিটিং এ তোমাদের ধরো কলকাতা বা দিল্লী থেকে হেড অফিস মুম্বাই তে ডাকা হয়েছে, এই মিটিং টা তোমাদের জন্যে attend করা খু্বই জরুরী, না attend করলে প্রোমোশন আটকে যেতে পারে। ট্রেণে করে মুম্বাই যাচ্ছো এমন সময় মাঝরাস্তায় একটা টেলিগ্রাম পেলে। তাতে লেখা “তোমার বৌ খুব অসুস্থ, হাসপাতালে, এখুনি ফিরে এসো!”

তোমরা কি করবে? মিটিং ক্যানসেল করে বৌ এর কাছে ফিরে যাবে, না বৌ চুলোয় যাক, চাকরীতে উন্নতি অনেক বেশী দরকারী ভেবে মুম্বাই চলে যাবে?

যতদূর মনে পড়ছে আমরা প্রায় সবাই বলেছিলাম মুম্বাই চলে যাবো। মুকুলদা’ আমাদের উত্তর শুনে মুচকি হেসেছিলেন।

সুমন্ত্র পরে একটু ভেবে বলেছিল, “মুকুল দা’ আপনি যদি বৌয়ের বদলে মায়ের অসুখ বলতেন, তাহলে কিন্তু আমরা সকলে ফিরেই যেতাম! আমাদের তো বৌ নেই, তাই আমরা কেবল মা কেই চিনি!”