Tag Archives: রেস্তোঁরা

আরশোলা ভাজা, টিকটিকির চাটনী

মার্চ, ২০১৭। আমরা কুয়েতের বন্ধুরা ভিয়েতনাম আর কাম্বোডিয়া বেড়াতে এসেছি।

আমাদের ট্রিপ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গত সাত দিন ভিয়েতনামে হানয় আর হ্যালং বে তে ঘুরে আর কাম্বোডিয়াতে সীম রীপ (আঙ্কোর ভাট মন্দির) দেখে এখন আমরা বাসে চেপে চলেছি কাম্বোডিয়ার রাজধানী Phnom Penh এর দিকে। সেখানে আমাদের প্ল্যান হলো Khmer Rouge এর বন্দীদের  যেখানে রেখে অত্যাচার করা হতো, সেই বিখ্যাত Tuol Sleng prison দেখা। তারপরে মেকং নদীতে নৌকাভ্রমণ।  

পরের দিন দেশে ফেরা।

সীম রীপ থেকে Phnom Penh  ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা। বিকেলের আলো থাকতে পৌঁছতে হবে তাই আমরা সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট খেয়ে মালপত্র বাসে তুলে নিয়ে  বেরিয়ে পড়েছি। পথে কোথাও একটা ব্রেক নিয়ে কিছু খেয়ে নেবো।

মার্চ মাসে তেমন গরম পড়েনি তখনো, আমরা বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি কাম্বোডিয়ার গ্রামের দৃশ্যপট। আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের সাথে মতোই অনেকটা। আজ দিনটা বেশ সুন্দর, নীল আকাশ, নরম রোদ, চারিদিকে সবুজের মেলা। বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত, চারিদিকে তাল আর নারকেল গাছের সারি। মাঝে মাঝে কিছু জনপদ পেরিয়ে যাচ্ছি। কিছু কৃষক কে মাঠে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে, তাদের মাথায় সাদা ত্রিভুজ টোকা। গ্রামের বাড়ীগুলোর  ডিজাইন একটু অন্যরকম, আমাদের চোখে বেশ নতুন লাগলো। আর তাদের মধ্যে পাকাবাড়ীর বদলে বাঁশের তৈরী বাড়ীই বেশী।

মাঝপথে আমাদের ড্রাইভার একটা জায়গায় এসে বাস থামালো। দেখলাম এখানে একটা বেশ বড় বাজার বসেছে। তরী তরকারী ফলমূল এই সব সাজিয়ে নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দরদাম করে কেনাকাটা করছে বহু লোক। আজ রবিবার, ছুটির দিন, তাই বোধ হয় ভীড় এক্টূ বেশী।  আমরা একটা চায়ের দোকান খুঁজে চা খাচ্ছি, এমন হঠাৎ সমবেত মেয়েলী গলায় একটা আর্ত আওয়াজ পেলাম।

“ও মাগো! দেখে যাও শিগগিরি!”

আমাদের বৌরা যথারীতি দোকান গুলোতে ঘুরে দেখতে গেছে কেনার মত কিছু স্যুভেনির সেখানেপাওয়া যায় কিনা দেখতে। সেখানে গিয়ে  ঢালাও করে যা বিক্রী হচ্ছে তা’ দেখে তাদের এই সমবেত আর্ত্তনাদ।

আমরা ছেলেরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে আমরাও তাজ্জব।

এক এক টা দোকানে পর্য্যাপ্ত পরিমাণে পাহাড়ের মত উঁচু ঢিপ করে রাখা আছে কালো কালো নানা ধরণের পতঙ্গ ভাজা। তাদের মধ্যে আরশোলা আছে, আরো কি কি আছে কে জানে, উচ্চিংড়ে, ফড়িং, locust ইত্যাদি  জাতীয় সব  প্রাণী। কাঁচের শিশিতে তেলের মধ্যে চার পা ছড়িয়ে উল্টো হয়ে ভাসছে  টিকটিকি। আচার নাকি? হতেও পারে।

আমার মনে আছে রাজগীর থেকে পাটনা ফেরার পথে একটা দোকানে মৌরলা মাছ ভাজা পাওয়া যেত। আমরা প্লেট ভর্ত্তি করে নিয়ে মনের সুখে খেয়েছি।  আর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে  Carniviore নামে একটা বেশ নামী রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে মেনু তে বীফ, পর্ক, চিকেন, হরিণ ইত্যাদি ছাড়াও  অন্যান্য নানা বন্য জন্তুর মাংস – তার মধ্যে আছে জলহস্তী, গণ্ডার, হাতি, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়েনা ইত্যাদি। আমাদের বন্ধুদের  মধ্যে কেউ কেউ উৎসাহ নিয়ে সে সব অর্ডার করেছিল, আমি অবশ্য risk নিইনি।

কিন্তু এখানে এই সব কেঁচো সুঁওপোকা ব্যাং টিকটিকি এমন কি সাপ দেখে এই সব কেউ ভালবেসে খায় ভেবে বেশ বমি পাচ্ছিল আমাদের সবার।  

আরও অবাক করার মত ব্যাপার হলো সেই সব অখাদ্য ভালবেসে কিনছে যে খদ্দেররা, তাদের মধ্যে আছে বেশ কিছু সুন্দরী কমবয়েসী মেয়েরাও। তাদের বেশভূষা দেখলে মনে হয় তারা বেশ সম্পন্ন পরিবারের উচ্চশিক্ষিত মহিলা, তাদের অনেকের হাতে ফ্যাশানী হ্যান্ডব্যাগ, চোখে রোদচশমা।

আজ রবিবার, সন্ধ্যায় বন্ধুবান্ধব এর সাথে বসে পার্টিতে হুইস্কির সাথে জমিয়ে আরশোলা আর উচ্চিংড়ে ভাজা, পরে ডিনারে ডালভাতের সাথে ব্যাঙএর চপ, সাপের ডালনা, আর টিকটিকির আচার?

ওয়াক!  

মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস এই সব দেশে আমি জন্মাইনি।

গ্রীনিচের O2 Mall এর এক রেস্টুরেন্টে

লন্ডনে আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে গ্রীনিচ (Greenwich) জায়গাটা খুব বেশী দূরে নয়।  লন্ডনে এলে এখনো দুই একবার গ্রীনিচে যাই, কেননা  জায়গাটা বড় সুন্দর, খোলা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, প্রচুর বড় বড় গাছ সেখানে ছড়িয়ে আছে।  আর আছে ফুলের বাগান সেখানে ছোট লেকে সাদা হাঁসেরা ভেসে বেড়ায়। তাছাড়া আছে কফি শপ, রেস্টুরেন্ট। 

গ্রীনিচ অবশ্যই গ্রীনিচ মীন টাইম এর জন্যে বিখ্যাত, এখান দিয়েই চলে গেছে  মেরিডিয়ান লাইন (zero ডিগ্রী longitude )। কিন্তু সেখানে Time keeping  আর Astronomy সম্পর্কিত  আরও অনেক প্রাচীন এবং বৈজ্ঞানিক আকর্ষণ  আছে  বিশেষ করে Royal Astronomical Observatory , Naval Museum,  Planetarium,  Cutty Sark, ইত্যাদি। সেগুলো আছে একটা টিলার ওপরে অনেকটা জায়গা নিয়ে।  তার মধ্যে একটা বিশাল চত্বর, সেখানে মেরিডিয়ান লাইন আঁকা আর সেই লাইনের দুই পাশে নানা শহরের নাম (আর তাদের longitude ডিগ্রী – কতটা পূবে আর কতটা পশ্চিমে)।

গ্রীনিচে একটা   hilltop viewing point আছে, যেখানে দাঁড়ালে দূরে নীচে  দেখা যায় লন্ডন শহরের স্কাইলাইন,  এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া টেম্‌স্‌ নদী আর তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া Emirates রোপওয়ে আর তার পাশে O2 Mall এর বিশাল তাঁবুর মত সাদা hemispheric ছাউনী।

টিলার ওপর থেকে নীচে গ্রীনিচ শহরে যাবার রাস্তা আর সিঁড়ি নেমে গেছে।  নীচে একটা বড় flea market বসে,  তাছাড়া শহর টা বেশ ছবির মত নিরিবিলি আর সুন্দর। সেখানেও মাঝে মাঝে যাওয়া হয়।  

গ্রীনিচ একদিনের ফ্যামিলি পিকনিকের পক্ষে আদর্শ জায়গা।

এই গল্পটা অবশ্য গ্রীনিচ বরোতে O2 মল নিয়ে।  সেটা Observatory আর Museum  থেকে কিছুটা দূরে।

O2 নামে এই দেশে একটা মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্ক কোম্পানী আছে, এই মলটা তাদের নামে তৈরী।   সেই মলের তাঁবুর মত hemispheric ছাউনীতে সিঁড়ি বেয়ে অনেক লোক ওপরে চলে যায়, নীচ থেকে তাদের দেখতে বেশ পিঁপড়ের মত লাগে। কম বয়েস হলে আমিও অনায়াসে ওপরে দৌড়ে উঠে যেতাম,  কিন্তু এখন বয়েসটা বাদ সাধে।

O2 Mall এ অনেক কোম্পানীর ফ্যাকটরী আউটলেট আছে, যেখানে জামাকাপড় জুতো ইত্যাদি অনেক জিনিষপত্রের দাম অবিশ্বাস্য কম, এবার একদিন আমরা সস্তায় কেনাকাটা করার জন্যে সেখানে গিয়েছিলাম।

O2 mall এ গাড়ীতে গেলে নদী পার হবার জন্যে Blackwell Tunnel আছে, আর টিউবে গেলে জুবিলী লাইনে North Greenwich স্টেশনে নেমে  নদীর ওপরে Emirates রোপওয়ে ধরে  চলে যাওয়া যায়। রোপওয়ে তে আগে চড়া হয়েছে, এবার তাই নদীর নীচে টানেল পেরিয়ে গাড়ীতেই যাওয়া হলো।

কেনাকাটা সারা হলে মলের ভিতরে একটা ইটালিয়ায়ন রেস্টুরেন্ট – Frankie and Benny’s- এ খেতে ঢুকলাম আমরা। কোভিড এর জন্যে দোকান সব খোলা হলেও মল বেশ ফাঁকা, রেস্টুরেন্টও খালি।

আমাদের ওয়েটার ছেলেটি খুব প্রিয়দর্শন।  ফর্সা, একমাথা  কালো চুল,  একটু গাবদু চেহারা হলেও তার চলাফেরায় বেশ একটা ক্ষিপ্র, চটপটে ভাব আছে।  পরনে সাদা সার্টের ওপরে লাল রং এর একটা apron,  কোম্পানীর ইউনিফর্ম হবে, ফর্সা রং এর সাথে তা দিব্বি মানিয়েছে।  ছেলেটি বেশ হাসিখুসী, কথাবার্ত্তা বেশ ভদ্র, আর  ইংরেজী ভাল বললেও  তার কথাবার্তায় সেরকম কোন ব্রিটিশ accent নেই,  চেহারা দেখে ইউরোপের কোন দেশের বলে মনে হয়।  স্পেন বা ইটালী?

যাই হোক, খাবার অর্ডার দিয়ে আমরা নানা গল্প করে যাচ্ছি, ছেলেটি সব খাবার এক এক করে নিয়ে এসে নিখুঁত ভাবে আমাদের টেবিলে পরিবেশন করে গেলো।

তারপর হঠাৎ আমাদের অবাক করে সে বললো, “Please don’t mind my asking, but are you  speaking in  Bengali?”

 অ্যাঁ , বলে কি?

একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে সে ইংরেজীতে  বললো, “তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলে তো তাই শুনে মনে হলো~”

তুমি বাংলা জানো? ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করলাম আমি।

এবার সে একগাল হেসে বললো “একটু একটু!”    

তারপরে তো অনেক গল্প হলো তার সাথে।  ইংরেজীতেই।

সে নাকি কলকাতায় ও গিয়েছে বেশ কয়েকবার তার মামার কাছে। মামা ছিলেন তার মা’র আপন দাদা, বোন আর ভাগ্নে কে তিনি খুব ভালবাসতেন। তিনি ভাল বেহালা বাজাতেন, মুম্বাই থেকে কলকাতায় বেহালা বাজাতে কয়েকবার গিয়ে কলকাতা তাঁর এত ভাল লেগে যায় যে তিনি শেষ পর্য্যন্ত সেখানে থেকে যান। তোমরা হয়তো তাঁর নাম শুনেও থাকতে পারো।

কি নাম ? জিজ্ঞেস করলাম আমরা।

ছেলেটি একটু কুন্ঠিত ভঙ্গী তে বলল, “আমার মামার নাম ভি জি জোগ্‌! ”

ভি জি জোগের নাম জানবোনা? আমি তো হৈ হৈ করে উঠলাম।  ওনার মত এত বড় শিল্পী, পদ্মভূষণ সঙ্গীত নাটক আকাদেমী ইত্যাদি কত খেতাব আর পুরস্কার পেয়েছেন, তার ওপরে কলকাতার সাথে তাঁর গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক তো সবাই জানে। কলকাতা আর বাঙালী কে ভালবাসার সূত্রে তিনি তো আমাদেরও আত্মীয়।

ছেলেটির সাথে তারপর বেশ কিছুক্ষণ আলাপ জমে গেল আমাদের। ওর মা থাকেন পুণাতে।  মারা যাবার আগে পর্য্যন্ত বোনের কাছে মামা আসতেন মাঝে মাঝে, মুম্বাই তে কাজে এলেই। ও নিজে কোন গান বাজনা জানেনা, তবে লতা মাসী আর আশা মাসীর গান ওর খুব ভালো লাগে, ওঁরা ওদের পুণার বাড়ীতে প্রায়ই আসতেন ওর ছোটবেলায়।

নদীর ধারে কাছেই গ্রীনিচের এক এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সে একাই থাকে। তবে একা হলেও লন্ডনে তার থাকতে ভালোই লাগছে, কয়েক বছর হলো তার মা আর বাবাও গত হয়েছেন, তাই দেশে ফেরার টান তার আর নেই।  

বিল মিটিয়ে ছেলেটিকে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে রেস্টুরেন্ট  থেকে বেরিয়ে এলাম।।

লন্ডনের সাথে কলকাতার এই আশ্চর্য্য যোগাযোগের জন্যে গ্রীনিচের সেই দুপুরটার কথা অনেকদিন মনে থাকবে।

দিসুম রেস্তোঁরা, লন্ডন

গত উইকেন্ডে আমরা এখানে দিসুম (Dishoom) নামে একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম।

এই রেস্টুরেন্টটা লন্ডনে বেশ নাম করেছে, গত তিন চার বছরে অনেকগুলো ব্রাঞ্চ খুলেছে Covent Garden Kings Cross এবং আরো নানা জনপ্রিয় upmarket জায়গায়, শুনলাম শিগগিরি Edinburgh এও নাকি খুলবে। আমরা বাড়ির কাছে East London এ Shoreditch Dishoom এ গেলাম। 

দিসুম আবার কি নাম? শুনলেই হিন্দী সিনেমার সেই নায়ক আর ভিলেন এর ঢিসুম ঢিসুম ঘুঁসোঘুঁসির কথা মনে পড়েনা ? গাড়ীতে যেতে যেতে আমি আমার নাতনীদের বললাম, “Be careful, the waiters may greet you with a punch on the nose~”

বড় নাতনীকে আজকাল ঠকানো যায়না, সে বললো, “You are joking, Dabhai!” 

রেস্টুরেন্টে দেখলাম বেশ ভীড়, গমগম করছে লোক, waiter রা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। আগে সীট বুক করে যাইনি তাই জায়গা পেতে একটু সময় লাগলো। নিজেদের টেবিলে বসে মেনু কার্ড টা পড়তে গিয়ে দেখি এরা  পুরনো বোম্বাইয়ের হারিয়ে যাওয়া ইরানী কাফে কে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়।

ইরানী কাফে?

নিমেষের মধ্যে ফিরে গেলাম ১৯৬৯ সালের বোম্বাইয়ে, Indian Oil Marketing Division এর Management trainee হয়ে  সেখানে আমি আর সুমন্ত্র (ঘোষাল) তখন দু’জনে Santa Cruz East এর একটা ছোট হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি।

ইরানী কাফের কথায় ছবির মত সেই দিনগুলো আবার ফিরে এলো আমার মনে।

কি সুন্দর শহর মনে হতো বোম্বাই কে তখন, কলকাতা দেখে অভ্যস্ত আমার চোখে মনে হত এ যেন এক বিদেশী শহর, পরিস্কার রাস্তাঘাট, শহরের মধ্যে দিয়ে রেললাইন চলে গেছে, স্টেশনে গেলে মনে হয় আমি পৌঁছলেই আমার জন্যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে একটা ট্রেণ, বাস স্টপে লম্বা কিন্তু খুব disciplined queue, দাপুটে কন্ডাক্টর দের শাসনে বাসে গাদাগাদি ভীড় নেই, বাসের দোতলায় বসে আমরা বিনা পয়সায় দেখে নিই নীল সমুদ্র। অফিস ছুটির পরে কোনদিন ফ্লোরা ফাউন্টেন, কোন দিন চার্চ গেট। পেডার রোড কিংবা নেপিয়ান সী রোডে Zacaranda গাছগুলো ভরে থাকে নীল ফুলে। আর কি আশ্চর্য্য সুন্দর রাত্রে মেরিন ড্রাইভে আলোর মালা।

সম্প্রতি আমরা চাঁদে পা দিয়েছি, সারা পৃথিবীময় তাই নিয়ে দারুণ উত্তেজনা, বোম্বাইয়ের রাস্তায় নানা জায়গায় বিশাল বিলবোর্ডে চাঁদের মাটিতে Air India র মহারাজা আর নীল আর্মস্ট্রং এর সেই iconic বিজ্ঞাপন। রাজকীয় পোষাকে মহারাজা, মাথায় পাগড়ী, পায়ে শুঁড় তোলা নাগরা জুতো, চাঁদে স্পেসস্যুট পরা নীল – কে মাথা ঝুঁকিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা – Mr. Armstrong, I presume…

জুলাই মাসে বোম্বাই তে সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি। আমরা দু’জন ছাতা মাথায় রোজ সকালে কাছেই একটা ইরানী কাফে তে গিয়ে মাসকা বান আর চা খেয়ে 84 Ltd বাস ধরে Worli তে Indian Oil এর অফিস যাই। সুমন্ত্রর আবার একটু স্বাস্থ্য বাতিক, তাই সে মাসকা বানের সাথে একটা মর্ত্তমান কলাও খায়।

আর সেই শহরের নানা কোনায় রাস্তার মোড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এই সব ইরানী কাফে। ইরান থেকে আসা Zoroastrian immigrant দের তৈরী করা এই সব দোকানের একটা  আলাদা look and feel ছিল, ঢুকলেই সেই বৈশিষ্ট্য আমার নজরে পড়ত, elegant distinguished and unique!  Bentwood chairs, দেয়ালে লাগানো sepia family portraits, stained mirrors, মাথার ওপরে ঘটাংঘট করে আস্তে আস্তে ঘুরতো চার পাখার সিলিং ফ্যান। কত রকমের লোক এসে ভীড় জমাতো সেই সব কাফেতে, বড়লোক ব্যবসাদার, গরীব ট্যাক্সি ড্রাইভার, courting couples, budding writers, কলেজ যাবার পথে ছাত্র ছাত্রীরা। Smart brisk waiter রা সবাই ব্যস্ত ভাবে চারিদিকে ঘোরাঘুরি করত, পরিবেশ টা বেশ লাগতো আমার।

সেই বিগত বিস্মৃত বোম্বাই এর ইরানী কাফের পরিবেশ আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চায় দিশুম।

সুভদ্রা আর পুপু মেনু কার্ড দেখছে, এই সু্যোগে আমি আমাদের Waiter এর সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। এই আমার এক দোষ। রাস্তা ঘাটে অচেনা কোন মানুষ কে ভাল লেগে গেলে তার সাথে আলাপ করতে আমার বেশ লাগে। আমাদের Waiter ছেলেটি বেশ স্বাস্থ্যবান যুবক, সুঠাম চেহারা, চমৎকার ইংরেজী বললেও তার চেহারা দেখে বোঝা যায় যে সে British নয়। জিজ্ঞেস করে জানলাম তার দেশ হলো ব্রাজিল, রিওর কাছে এক শহরে তার বাড়ী। ব্যাস আমিও শুরু করে দিলাম, রিও কি সুন্দর জায়গা, তোমরা কি সুন্দর অলিম্পিক games organize করলে, আমার খুব ইচ্ছে একদিন তোমাদের দেশটা ঘুরে আসবো ইত্যাদি। ছেলেটি দেখলাম অলিম্পিক নিয়ে তেমন উৎসাহী নয়, তাকে বেশ bitter শোনালো, সে বলল জানো তো আমাদের দেশটা গরীব, অলিম্পিক করতে গিয়ে এত টাকা বাজে খরচ করা হল~

ইতিমধ্যে সুভদ্রা’র মেনু দেখা শেষ, সে অর্ডার দেবে, কিন্তু আমি Waiter এর  সাথে কথা বলেই যাচ্ছি। খেয়ালই নেই। সুভদ্রা আমার দিকে দেখি কঠিন দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে দেখে আমি থামলাম।

বেশ ভাল খাবার, service ও বেশ prompt, খেতে খেতে খেয়াল করছিলাম এক বেশ ভারী চেহারার দাড়িওয়ালা সাহেব এই টেবিলে ওই টেবিলে ঘুরে ঘুরে patron দের সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। মনে হলো তিনি বোধ হয় এই রেস্টুরেন্টের  ম্যানেজার, কার কি রকম লাগছে তার খোঁজখবর করছেন।  

খাওয়া হয়ে গেলে বিল মিটিয়ে বেরোচ্ছি, হঠাৎ সেই ম্যানেজার ভদ্রলোকের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। 

“Did you have a good meal sir?”  বেশ amiable cheerful গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বেশ ভাল লাগলো, আপনি এখানকার ম্যানেজার বুঝি? বলে আমিও আলাপ জুড়ে দিলাম। তারপরে যেই বলেছি আমি পুরনো বোম্বাই তে ইরানী কাফে তে একসময় যেতাম, তাঁর উৎসাহ আর দেখে কে, তাঁকে আর থামানোই গেলনা। এই দ্যাখো আমরা  কি রকম সেই পুরনো পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, দ্যাখো আমাদের মেঝে,  আমাদের দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি, দ্যাখো মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে, আমাদের ওয়েবসাইটে একবার যেও, সেখানে পুরনো দিনের ইরানী কাফের অনেক গল্প পাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে আটকে গেলাম বেশ কিছুক্ষণ।

ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে দেখি ওরা সবাই বাইরে গাড়ীতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। 

সুভদ্রা ঠান্ডা থমথমে গলায় আমায় জিজ্ঞেস করলো, “কি গল্প শেষ হলো?”