
১) এ আবার কি অসভ্যতা
মার্চ ৩১, ২০১৮ – শনিবার
আমাদের আজকের ট্যুর প্যাকেজে সকালে half day লিসবন সিটি ট্যূর।
হোটেলে সকাল ন’টায় বাস আসবে। আমরা সবাই রেডি হয়ে লাউঞ্জে এসে সোফায় বসে আছি।
এমন সময় হোটেলের বাইরে একটা বড় বাস এসে দাঁড়ালো, এবং একটু পরে একটি সুদর্শন যুবক আমাদের সামনে এসে বললো You are the group of Prodosh Mitra? My name is Nunu and I shall be your guide today…
নুনু?
এ আবার কি অসভ্য নাম?
অবশ্য পর্তুগীজ ভাষায় অসভ্য নয় নিশ্চয়, নাহলে ওরকম গর্ব্ব আর আনন্দের সাথে কেউ বলে আমার নাম নুনু? পরে জেনেছিলাম কথাটার মানে হলো petite ছোটখাটো, আদরের।
অসভ্য কথা শুনলেই মেয়েদের খুব হাসি পায়, আমাদের বৌদের মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবেই একটা চাপা হাসির গুঞ্জন উঠলো। আমরা ছেলেরা অবশ্য অসভ্য কথাকে হাসির ভাবিনা, তবু আমরাও একটু চোখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। ছেলেটির জন্যে একটু সহানুভূতিও অনুভব করলাম, বেচারা জানেওনা কি বিশ্রী একটা নাম তার গায়ে আটকে আছে চিরজীবনের মতো।
নুনু ছেলেটি কিন্তু খুব স্মার্ট, সুন্দর কথা বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে তার বেশ ভাল আলাপ হয়ে গেল।
কিন্তু মুস্কিল হলো বাসে সে বসে আছে একেবারে সামনে, তার সাথে কথা বলতে গেলে বা তাকে কোন প্রশ্ন করতে গেলে তাকে নাম ধরে ডাকতে হবে।
সুমিতা সিদ্ধার্থ কে বলল তুমি ওকে নাম ধরে ডাকেবেনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে বলবে Excuse me?
নাম ধরে ডাকতে হবে তাই আমরা কেউ ই নুনুকে কোন প্রশ্ন করছিনা। কিছুক্ষণ বকবক করে নুনু ড্রাইভারের পাশের সীটে সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে।
এদিকে বাসে একদম পিছনে বসে আছি আমি আর প্রদোষ। বাসে এ সি চলছেনা, বেশ গরম। তুতু বসে আছে একদম সামনে, প্রদোষ তুতু কে বললো এই নুনু কে বলো তো এ সি টা চালাতে।
তুতু পিছন দিকে প্রদোষ কে একটা বিশ্রী দৃষ্টি দিয়ে বললো, না আমি বলতে পারবোনা, তুমি বলো।
প্রদোষ আর কি করে, সে কয়েকবার মিন মিন করে খুব নীচু গলায় মিস্টার নুনু, মিস্টার নুনু বলে ডাকলো, কিন্তু অত আস্তে বললে নুনু শুনবে কি করে? তখন মরিয়া হয়ে লজ্জা শরম বিসর্জ্জন দিয়ে প্রদোষ বেশ জোরে ডেকে উঠলো – মিস্টার নুনু !
এবার কথাটা নুনুর কানে গেছে, সে মুখ ফিরিয়ে বললো, ইয়েস?
প্রদোষ বলল Please will you turn the air conditioning on?
Sure, বললো নুনু।
কিছুক্ষন পরে আবার এক মুস্কিল। মাইক্রোফোন থেকে একটা খসখস আওয়াজ হচ্ছে, কানে লাগছে।
প্রদোষ এবার তার সংকোচ ছাড়িয়ে উঠেছে। তার গলায় এখন বেশ জোর।
আমি ওর পাশে বসে ছিলাম, আমি বললাম মিস্টার বলার কি দরকার, বাচ্চা ছেলে, ওকে নাম ধরেই ডাকোনা।
বজ্রগম্ভীর স্বরে প্রদোষ ডেকে উঠলো এই নুনু, নুনু!
সামনে বসে ছিল তুতু, সে পিছন ফিরে প্রদোষ কে বলল “এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে?”
কিন্তু প্রদোষ কে থামানো যাচ্ছেনা, সে ওই খসখস আওয়াজ আর সহ্য করতে পারছেনা।
সে আবার পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “নুনু, এই নুনু! আওয়াজ টা বন্ধ কর্ মাইরী…”




২ ভাস্কো ডা গামা
বাসে করে সারা শহর ঘুরতে ঘুরতে নুনু আমাদের লিসবনের ইতিহাস বর্ণনা করতে লাগলো। পাহাড় দিয়ে ঘেরা টাগোস নদীর মোহনার কাছে গড়ে ওঠা লিসবন হলো ইউরোপে এথেন্সের পরে প্রাচীনতম রাজধানী শহর এবং তার অনুপম সৌন্দর্য্যের জন্যে তার পৃথিবীজোড়া খ্যাতি।
বাসে যেতে যেতে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম এই মার্চ্চ মাসের সকালে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় ঢাকা বুলেভার্ড, বেশ কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে, কিছু লোক পথের পাশে বেঞ্চিতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। রং বেরং এর ফুলের সমারোহ চারিদিকে, পরিস্কার চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তার ফুটপাথে নানারকম সুন্দর ডিজাইন দিয়ে আঁকা টাইল দিয়ে ঢাকা, রাস্তার পাশে অনেক বাড়ীর দেয়ালে ছবি আর ফ্রেস্কো আঁকা। অনেক গোলচক্কর চারিদিকে, প্রায় প্রত্যেক গোলচক্করেই বিশাল বিশাল সুদৃশ্য স্ট্যাচু। যেন কোন এক মহান শিল্পীর সৃষ্টি এই শহর।
বড় বড় ছাদখোলা লাল দোতলা বাস ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় সরু neighbourhood এর ভেতর দিয়ে ট্রাম চলে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় আমরা মধ্যযুগে ঢুকে পড়েছি।
ইউরোপের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে Iberian peninsula তে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে এই ছোট্ট রাজ্য পর্ত্তুগাল প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সুদূর ১১৪০ সালে, তারপরে সেখানকার রাজা রাজড়ারা নানা যুদ্ধ বিগ্রহ করে তাদের রাজ্য দক্ষিণে আরো বাড়িয়ে নেয়, যার মধ্যে ছিল বন্দর শহর লিসবন। ১৩৮৫ সালে লিসবন পর্তুগালের রাজধানী হয়। কিন্তু পর্ত্তুগাল বিখ্যাত হয় পনেরো আর ষোল শতাব্দীতে, যখন তাদের নৌসেনা এবং আবিস্কারকরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তাদের উপনিবেশ তৈরী করতে শুরু করে।
ওই সময়টা ছিল পর্ত্তুগালের স্বর্ণযুগ, এখন যাকে বলা হয় Age of Discovery – তখন পর্তুগাল হয়ে ওঠে পৃথিবীর এক দুর্দ্ধর্ষ ঔপনিবেশিক শক্তি। লিসবনের টাগোস নদীর মোহনার তীরে Belem District এর সব iconic ঐতিহাসিক landmark ওই সময়ই তৈরী হয়। তাদের মধ্যে আছে World Heritage site Belem Tower, Discovery Monument আর Jeronimos Monastery, যা আজ আমরা দেখবো।
নুনু আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল একটা Viewing point এ – যার নাম স্থানীয় ভাষায় Meraduro – সেখানে অনেক ওপর থেকে নীচে দেখা যায় ছবির মত সুন্দর ছড়ানো শহর, বাগান, ঘরবাড়ী, রাস্তা।
আমাদের পরবর্ত্তী গন্তব্য হলো বিখ্যাত Jeronimos Monastery, যার ভিতরে আছে বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ নাবিক আবিস্কারক (explorer) ভাস্কো ডা গামার কবর। ছোটবেলায় ইতিহাসের বইতে ১৪৯২ সালে ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে Cape of good hope পেরিয়ে তাঁর ভারতবর্ষের গোয়া তে পৌঁছবার কাহিনী পড়েছি।
Jeronimos Monastery র বিশাল imposing স্থাপত্য চোখে পড়ার মত। ভাস্কো ডা গামা ভারত থেকে Spice trade শুরু করেন, এবং সেই ব্যবসা থেকে যে বিশাল অর্থ উপার্জ্জন হয়, তা অনেকটাই খরচ করে Jeronimos Monastery তৈরী হয় – ভাস্কো ডা গামার সফল ভারত অভিযান এর memorial হিসেবে। এই বিশাল উপাসনা গৃহতে পর্তুগালের রাজা রাজড়াদের সাথে ভাস্কো ডা গামাকেও সন্মানের সাথে সমাধিত করা হয়।
ভাস্কো ডা গামা গোয়াতে পর্তুগীজ সরকারের ভাইসরয় হয়েছিলেন, শোনা যায় ভারতেই তাঁর মৃত্যু হয়, এবং কোচিতে প্রথমে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। পরে পর্তুগীজ সরকার তাঁর দেহ লিসবনে স্থানান্তরিত করেন, যদিও কোচিতে St Francis Church এও তাঁর একটা সমাধিস্থল (Memorial) এখনো আছে।
Jeronimos Monastery র সামনে দর্শনার্থীদের বিশাল লম্বা লাইন। নুনু আমাদের বলল, “তোমরা লাইনে দাঁড়িওনা, কেননা Monastery র হলে ঢোকার জন্যে কোন টিকিট লাগেনা, ওই হলো দোতলায় মিউজিয়ামে যাবার লাইন। তোমরা হলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে পাশে এখানকার একটা বিখ্যাত Pasties এর দোকান আছে, সেখানে গিয়ে কফি নিয়ে একটু বসতে পারো। ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে বাসে ফিরে এসো কিন্তু।”
Monastery র হলঘরে ঢুকে দেখি সেখানে অনেক লোক, একটা মৃদু গুঞ্জন চারিদিকে। দেয়ালে বড় বড় Oil Painting টাঙানো, রঙীন কাঁচের ওপর ছবি আঁকা জানলা। খুঁজে খুঁজে ভাস্কো ডা গামার শায়িত মর্মর মূর্ত্তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পনেরো শো খ্রীষ্টাব্দের শেষে Age of discovery র সময় তিনি ছিলেন পর্তুগালের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, এক অন্যতম নায়ক। এখানে ভাস্কো ডা গামার মর্মর মূর্ত্তি দেখে ধারণা হয় তিনি ছোটখাটো লোক ছিলেন, মুখ চোখ তীক্ষ্ণ, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। দুই হাত ওপরে নমস্কারের ভঙ্গীতে তুলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন।
সেদিন Jeronimos Monastery তে ওই হলঘরে ভাস্কো ডা গামার শায়িত মর্মর মূর্ত্তির সামনে চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই স্কুল জীবনের দিন গুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম। মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল অন্ধকার রাত্রে ঝড়ের উত্তাল সমুদ্র, জাহাজ ডুবির ভয়, নাবিকদের কোলাহল, আর এই সব ছাপিয়ে ভাস্কো ডা গামার সাহস, আত্মবিশ্বাস আর নেতৃত্ব দেবার অপরিসীম ক্ষমতা।
মূর্ত্তির তলায় দুর্বোধ্য পর্তুগীজ ভাষায় কি সব লেখা আছে দেখলাম।
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব পর্তুগালে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল… বা ওই ধরণের কিছু নাকি?
কি জানি, হবেও বা।

৩ – লিসবনের গজা
Jeronimos Monastery থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে সারি সারি দোকান, একটু হেঁটেই পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত গজার দোকান, নুনু আমাদের যার কথা বলেছিল। বাইরে বিশাল সাইনবোর্ড Belem Pasties, আর রেস্টুরেন্টের ভেতরে বিশাল ভীড়। ঢুকে কোনমতে একটা টেবিল পাওয়া গেল। ইউনিফর্ম পরা ওয়েটাররা ট্রে হাতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে রেস্টুরেন্টটা বেশ নামী।
যাই হোক কফি আর গজা অর্ডার দিয়ে বসে আছি তো আছিই। এদিকে নুনু বলে দিয়েছে দুই ঘন্টার মধ্যে ফিরতে, তাই বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি আমরা। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের ওয়েটারের নাম ফার্নান্ডো। আমি বার দুয়েক গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছি আর কত দেরী ভাই, সে আমাদের কোন পাত্তা না দিয়ে ট্রে হাতে ব্যস্ত ভাবে দূরে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।
মহা মুস্কিল তো? এই লিসবনের গজা খাওয়া আমাদের কপালে নেই মনে হচ্ছে।
যাই হোক একটু পরে আবার ব্যস্তসমস্ত ভাবে ঘুরে বেড়ানো ফার্নান্ডো কে গিয়ে যেই “এত দেরী হচ্ছে কেন ভাই” জিজ্ঞেস করেছি, মনে হলো আগুণে যেন ঘি পড়লো। ছোটখাটো বেশ সুঠাম চেহারার ছেলেটি হঠাৎ হেড অফিসের বড়বাবুর মত তেলেবেগুণে জ্বলে উঠে তার হাতের ট্রে টা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো~
Will you take my place?
ফার্ণান্ডো কে হঠাৎ ওই ভাবে ফেটে পড়তে দেখে আমার সেদিন খুব দুঃখ হয়েছিল। নানা কারণে আমাদের অনেকের মনেই জমতে থাকে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ। কাজের চাপ, নানাবিধ অসন্মান, গ্লাণি, সম্পর্কের টানাপোড়েন। হয়তো তার ভিতরে নিশ্চয় ক্রমশঃ জমে উঠছিল অনেক অস্থিরতা, অসহায়তা, তা আমার সামান্য একটা কথায় মুহুর্ত্তের মধ্যে ফুঁসে বেরিয়ে আসে।
পরক্ষনেই অবশ্য সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল, আমিও হেসে তার কাঁধে হাত রেখে দুঃখপ্রকাশ করেছিলাম।
কিন্তু ঘটনাটা আমি আজও ভুলতে পারিনা। Abba র সেই বিখ্যাত Fernando গান টা শুনলে আমার এখনো লিসবনের সেই ফার্নান্ডো ছেলেটিকে মনে পড়ে। গানের সেই ফার্নান্ডো ছিল তার দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক যুবক সৈনিক, এখন তার বয়স হয়েছে, তার মাথায় এখন পাকা চুল। তবু এই পরিণত বয়সে এসেও সে তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ভোলেনি, সেই বারুদের গন্ধ, বোমার আওয়াজ সে এখনো ভুলতে পারেনা।
There was something in the air that night/
The stars were bright, Fernando/
They were shining there for you and me/
For liberty, Fernando
আমাদের এই ওয়েটার ফার্ণান্ডো ছেলেটিও সৈনিক। তবে সে হলো জীবনযুদ্ধের সৈনিক।
জানিনা সে কেমন আছে।
একটু পরেই আমাদের টেবিলে কফি আর রসে ভাজা খাস্তা গজা দিয়ে গেল সে।
তবে বলতে দ্বিধা নেই, সেই গজা খেয়ে আমার বেশ খারাপ লেগেছিল, খুবই আশাহত হয়েছিলাম আমি। ছোটবেলায় আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীতে মা আর জ্যেঠিমার তৈরী খাস্তা গজার সাথে এর কোন তুলনাই হয়না।
ছোটবেলার সেই গজার স্বাদ এখনো আমার জিভে লেগে আছে।
মা আর জ্যেঠিমা যদি লিসবনে এসে একটা গজার দোকান খুলতেন…



Subhadra and I at the Discovery monument, Belem, Lisbon