দিসুম রেস্তোঁরা, লন্ডন

গত উইকেন্ডে আমরা এখানে দিসুম (Dishoom) নামে একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম।

এই রেস্টুরেন্টটা লন্ডনে বেশ নাম করেছে, গত তিন চার বছরে অনেকগুলো ব্রাঞ্চ খুলেছে Covent Garden Kings Cross এবং আরো নানা জনপ্রিয় upmarket জায়গায়, শুনলাম শিগগিরি Edinburgh এও নাকি খুলবে। আমরা বাড়ির কাছে East London এ Shoreditch Dishoom এ গেলাম। 

দিসুম আবার কি নাম? শুনলেই হিন্দী সিনেমার সেই নায়ক আর ভিলেন এর ঢিসুম ঢিসুম ঘুঁসোঘুঁসির কথা মনে পড়েনা ? গাড়ীতে যেতে যেতে আমি আমার নাতনীদের বললাম, “Be careful, the waiters may greet you with a punch on the nose~”

বড় নাতনীকে আজকাল ঠকানো যায়না, সে বললো, “You are joking, Dabhai!” 

রেস্টুরেন্টে দেখলাম বেশ ভীড়, গমগম করছে লোক, waiter রা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। আগে সীট বুক করে যাইনি তাই জায়গা পেতে একটু সময় লাগলো। নিজেদের টেবিলে বসে মেনু কার্ড টা পড়তে গিয়ে দেখি এরা  পুরনো বোম্বাইয়ের হারিয়ে যাওয়া ইরানী কাফে কে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়।

ইরানী কাফে?

নিমেষের মধ্যে ফিরে গেলাম ১৯৬৯ সালের বোম্বাইয়ে, Indian Oil Marketing Division এর Management trainee হয়ে  সেখানে আমি আর সুমন্ত্র (ঘোষাল) তখন দু’জনে Santa Cruz East এর একটা ছোট হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি।

ইরানী কাফের কথায় ছবির মত সেই দিনগুলো আবার ফিরে এলো আমার মনে।

কি সুন্দর শহর মনে হতো বোম্বাই কে তখন, কলকাতা দেখে অভ্যস্ত আমার চোখে মনে হত এ যেন এক বিদেশী শহর, পরিস্কার রাস্তাঘাট, শহরের মধ্যে দিয়ে রেললাইন চলে গেছে, স্টেশনে গেলে মনে হয় আমি পৌঁছলেই আমার জন্যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে একটা ট্রেণ, বাস স্টপে লম্বা কিন্তু খুব disciplined queue, দাপুটে কন্ডাক্টর দের শাসনে বাসে গাদাগাদি ভীড় নেই, বাসের দোতলায় বসে আমরা বিনা পয়সায় দেখে নিই নীল সমুদ্র। অফিস ছুটির পরে কোনদিন ফ্লোরা ফাউন্টেন, কোন দিন চার্চ গেট। পেডার রোড কিংবা নেপিয়ান সী রোডে Zacaranda গাছগুলো ভরে থাকে নীল ফুলে। আর কি আশ্চর্য্য সুন্দর রাত্রে মেরিন ড্রাইভে আলোর মালা।

সম্প্রতি আমরা চাঁদে পা দিয়েছি, সারা পৃথিবীময় তাই নিয়ে দারুণ উত্তেজনা, বোম্বাইয়ের রাস্তায় নানা জায়গায় বিশাল বিলবোর্ডে চাঁদের মাটিতে Air India র মহারাজা আর নীল আর্মস্ট্রং এর সেই iconic বিজ্ঞাপন। রাজকীয় পোষাকে মহারাজা, মাথায় পাগড়ী, পায়ে শুঁড় তোলা নাগরা জুতো, চাঁদে স্পেসস্যুট পরা নীল – কে মাথা ঝুঁকিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা – Mr. Armstrong, I presume…

জুলাই মাসে বোম্বাই তে সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি। আমরা দু’জন ছাতা মাথায় রোজ সকালে কাছেই একটা ইরানী কাফে তে গিয়ে মাসকা বান আর চা খেয়ে 84 Ltd বাস ধরে Worli তে Indian Oil এর অফিস যাই। সুমন্ত্রর আবার একটু স্বাস্থ্য বাতিক, তাই সে মাসকা বানের সাথে একটা মর্ত্তমান কলাও খায়।

আর সেই শহরের নানা কোনায় রাস্তার মোড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এই সব ইরানী কাফে। ইরান থেকে আসা Zoroastrian immigrant দের তৈরী করা এই সব দোকানের একটা  আলাদা look and feel ছিল, ঢুকলেই সেই বৈশিষ্ট্য আমার নজরে পড়ত, elegant distinguished and unique!  Bentwood chairs, দেয়ালে লাগানো sepia family portraits, stained mirrors, মাথার ওপরে ঘটাংঘট করে আস্তে আস্তে ঘুরতো চার পাখার সিলিং ফ্যান। কত রকমের লোক এসে ভীড় জমাতো সেই সব কাফেতে, বড়লোক ব্যবসাদার, গরীব ট্যাক্সি ড্রাইভার, courting couples, budding writers, কলেজ যাবার পথে ছাত্র ছাত্রীরা। Smart brisk waiter রা সবাই ব্যস্ত ভাবে চারিদিকে ঘোরাঘুরি করত, পরিবেশ টা বেশ লাগতো আমার।

সেই বিগত বিস্মৃত বোম্বাই এর ইরানী কাফের পরিবেশ আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চায় দিশুম।

সুভদ্রা আর পুপু মেনু কার্ড দেখছে, এই সু্যোগে আমি আমাদের Waiter এর সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। এই আমার এক দোষ। রাস্তা ঘাটে অচেনা কোন মানুষ কে ভাল লেগে গেলে তার সাথে আলাপ করতে আমার বেশ লাগে। আমাদের Waiter ছেলেটি বেশ স্বাস্থ্যবান যুবক, সুঠাম চেহারা, চমৎকার ইংরেজী বললেও তার চেহারা দেখে বোঝা যায় যে সে British নয়। জিজ্ঞেস করে জানলাম তার দেশ হলো ব্রাজিল, রিওর কাছে এক শহরে তার বাড়ী। ব্যাস আমিও শুরু করে দিলাম, রিও কি সুন্দর জায়গা, তোমরা কি সুন্দর অলিম্পিক games organize করলে, আমার খুব ইচ্ছে একদিন তোমাদের দেশটা ঘুরে আসবো ইত্যাদি। ছেলেটি দেখলাম অলিম্পিক নিয়ে তেমন উৎসাহী নয়, তাকে বেশ bitter শোনালো, সে বলল জানো তো আমাদের দেশটা গরীব, অলিম্পিক করতে গিয়ে এত টাকা বাজে খরচ করা হল~

ইতিমধ্যে সুভদ্রা’র মেনু দেখা শেষ, সে অর্ডার দেবে, কিন্তু আমি Waiter এর  সাথে কথা বলেই যাচ্ছি। খেয়ালই নেই। সুভদ্রা আমার দিকে দেখি কঠিন দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে দেখে আমি থামলাম।

বেশ ভাল খাবার, service ও বেশ prompt, খেতে খেতে খেয়াল করছিলাম এক বেশ ভারী চেহারার দাড়িওয়ালা সাহেব এই টেবিলে ওই টেবিলে ঘুরে ঘুরে patron দের সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। মনে হলো তিনি বোধ হয় এই রেস্টুরেন্টের  ম্যানেজার, কার কি রকম লাগছে তার খোঁজখবর করছেন।  

খাওয়া হয়ে গেলে বিল মিটিয়ে বেরোচ্ছি, হঠাৎ সেই ম্যানেজার ভদ্রলোকের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। 

“Did you have a good meal sir?”  বেশ amiable cheerful গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বেশ ভাল লাগলো, আপনি এখানকার ম্যানেজার বুঝি? বলে আমিও আলাপ জুড়ে দিলাম। তারপরে যেই বলেছি আমি পুরনো বোম্বাই তে ইরানী কাফে তে একসময় যেতাম, তাঁর উৎসাহ আর দেখে কে, তাঁকে আর থামানোই গেলনা। এই দ্যাখো আমরা  কি রকম সেই পুরনো পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, দ্যাখো আমাদের মেঝে,  আমাদের দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি, দ্যাখো মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে, আমাদের ওয়েবসাইটে একবার যেও, সেখানে পুরনো দিনের ইরানী কাফের অনেক গল্প পাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে আটকে গেলাম বেশ কিছুক্ষণ।

ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে দেখি ওরা সবাই বাইরে গাড়ীতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। 

সুভদ্রা ঠান্ডা থমথমে গলায় আমায় জিজ্ঞেস করলো, “কি গল্প শেষ হলো?”

2 thoughts on “দিসুম রেস্তোঁরা, লন্ডন

  1. ঝরঝরে বৈঠকী মেজাজের লেখা। পাঠকের একই সঙ্গে লন্ডনের দিসুম আর বোম্বাইয়ের ইরানী রেস্তোরাঁ দেখা হয়ে যায়। পরিণত বয়সে তৃতীয় প্রজন্মের উপস্থিতিতে যৌবনের স্মৃতিচারণ খুবই উপভোগ্য। লেখার মধ্যে নাট্যকার ইন্দ্রের ছায়া দেখতে পাওয়া গেল পরিবেশ ও বিভিন্ন চরিত্রের ডিটেলস এর বিবরণ পড়ে।

    Like

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।