জন্মদিন

ছোটবেলায় জন্মদিন গুলো ছিল নিখাদ আনন্দের দিন।

খুব ভোরে উঠতে হত, মা আর জ্যেঠিমা র সাথে প্রতি বছর জন্মদিনে নিয়ম করে কালীঘাটে মায়ের মন্দির যেতাম।  পথে মহিম হালদার স্ট্রীটে নকুলেশ্বর শিবের মন্দির পড়ত। মা আর জ্যেঠিমার সাথে আমিও শিবলিঙ্গের  মাথায় জল ঢালতাম।

আমার জন্মদিনের সাথে ভোরবেলার কালীঘাটের মন্দির আর সিঁদুর লাগানো প্যাঁড়ার ঠোঙ্গার তাই অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক।

সারাদিন কাটতো গভীর আনন্দে, ওই দিনটা যেন শুধু আমার।

বিকেলে মনোহরপুকুরের বাড়ীতে  অনেকে আত্মীয় স্বজন আসতেন, আমরা ছোটরা সারা বিকেল আর সন্ধ্যা হৈ হৈ করে হুটোপাটি করতাম। এখনকার মত কেক কাটা আর গান গাওয়া অবশ্য তখন হতোনা, বেলুন দিয়ে বাড়ী  সাজানোর প্রথাও তখন বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারে শুরু হয়নি।  কিন্তু খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হত বেশ বড় করে। আর পায়েস তো হতোই।  সাথে লুচি বা পোলাও আর মাংস।

একটু রাত হলে সবাই চলে যাবার পর আমি বসতাম উপহার পাওয়া বই নিয়ে। সে যুগে বই উপহার দেবারই চল ছিল। ছোট বেলা থেকেই আমি ছিলাম বইয়ের পোকা, নতুন বইয়ের মলাট খুলে যে গন্ধ টা পেতাম তার মজাই আলাদা।

জয়ন্ত মাণিক আর বিমল কুমার দের নিয়ে হেমেন্দ্র কুমার রায়ের গোয়েন্দা কাহিনী তো ছিলই, তা ছাড়া কত বিদেশী বই য়ের বাংলা  সংস্করণ, Hunchback of Notre Dame, Count of Monti Christo, Three Musketeers, Last days of Pompei, এবং এই রকম আর ও কত বই তখন জন্মদিনে উপহার পেয়ে গোগ্রাসে গিলেছি। আর একটু বড় হবার পরে  পেতাম শরৎচন্দ্র বঙ্কিম চন্দ্র…

আমার দশ বছরের জন্মদিন আমার মা মনোহরপুকুরের বাড়ীতে খুব বড় করে celebrate করেছিলেন মনে আছে, এই সাথে সেই দিনের দু’টো ছবি। সেদিন আমায় মা ধুতি পাঞ্জাবী পরিয়েছিলেন, আমার একেবারেই ভাল লাগেনি, ধুতি পরে কি সারা ছাতময় ভাই বোন দের সাথে দৌড়াদৌড়ি করা যায়? কিন্তু সেই বয়সে মা’র কথাই শেষ কথা। কি আর করা যাবে? ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমার পাঞ্জাবীটা বেশ stylish, মাঝখানে নয়, ডান দিকে বোতাম।

কত দিন হয়ে গেল, তবু সেই দিনটার কিছু স্মৃতি এখনো আমার বেশ মনে থেকে গেছে।

দুপুরে তিন তলায় রান্নাঘরের পাশে মেঝেতে আসন পেতে আমি খেতে বসেছি, আমার থালার চারিদিকে বাটি সাজানো , আর আমার মাস্তুতো দাদা রতন দা আমার সামনে ক্যামেরা নিয়ে  সমানে বলে যাচ্ছে মুখ তোল্‌,  একটু হাস্‌…

কিংবা বিকেলেবেলা ছাদে প্রচুর ভীড়, তার মধ্যে মা আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন রতন আমাদের দু’জনের একটা ছবি তুলে দে তো। ছবিতে দেখছি আমার ভুরু কোঁচকানো, বেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমায় ছবি তুলতে হচ্ছে, তোলা হয়ে গেলেই মা’র হাত ছাড়িয়ে আমি ছুট মারবো ভাই বোনদের সাথে খেলতে।

সেদিন আমায় কে যেন একটা গ্যাস বেলুন দিয়েছিলো, সেটা আকাশে উড়িয়ে আমি শক্ত করে সুতোটা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় কেউ একজন, বোধহয় ছোটকাকা, আমায় এসে “ মান্টু, একটা মজা দেখবি” বলে আমার হাত থেকে সুতো টা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি অসহায় হয়ে দেখলাম বেলুনটা  ভাসতে ভাসতে আকাশে হারিয়ে গেল।

সেই হারানো বেলুনটার জন্যে সেদিন খুব দুঃখ হয়েছিল।

আমার ছোটবেলার জন্মদিন গুলোও সেই বেলুনটার মতই বহুদিন হারিয়ে গেছে।

2 thoughts on “জন্মদিন

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে।