নতুন পোস্ট

  • কুয়েতের বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক সমিতির (বি সি এসের) লোগো 

    ১৯৯৭ সালে আমি কুয়েতে বি সি এসের সভাপতি হয়েছিলাম। তার আগে আমি কোনদিন বি সি এসের কোন কমিটি তে আসিনি, গায়ে ফুঁ লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। একেবারে প্রথমেই এক লাফে সভাপতি! মানে আনকোরা নতুন, এবং আনাড়ী – ইংরেজীতে যাকে বলে rookie । অবশ্য আমার কমিটিতে সহ সভাপতি রঞ্জন গুহ রায়,  সেক্রেটারী তপন ঘোষ এবং অন্যান্য সবাই বেশ অভিজ্ঞ, এবং কাজে পোক্ত। আমার পক্ষে সেটা একটা বাঁচোয়া ছিল।

    আর হবি তো হ’, সেই বছরটা (১৯৯৭) ছিল দারুণ ঘটনাবহুল  – আমাদের দেশের স্বাধীনতার স্বর্ণজয়ন্তী র উদযাপন উৎসবের বছর, তাছাড়া  সে বছর নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জন্মশতবার্ষিকী। কুয়েতে বিসি এসের নাম উজ্জ্বল করতে গেলে এ বছর দারুণ কিছু তো একটা কিছু করতে হবে?

    কিন্তু কি করা যায়?

    কুয়েতে বি সি এসের সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের উৎকর্ষতা নিয়ে খুব সুনাম। আমাদের member দের মধ্যে অনেক talent, কিন্তু আমাদের আর্থিক সামর্থ্য কম, তাই বছরে আমরা একটা স্যুভেনির ছাপাই, এবং তাতে যে বিজ্ঞাপন পাই তার টাকা এবং সদস্যদের চাঁদা  এই নিয়ে বছরে আমাদের ৪০০০ দিনার মত আয় হয়। টাকাটা খুব একটা কম নয়, তা দিয়ে বছরে আমরা কিছু  বাঁধাধরা অনুষ্ঠান করি। তার মধ্যে একটা পূর্ণাঙ্গ নাটক, একটা রবীন্দ্রনাথের গান বা নৃত্যনাট্য, একটা ছোটদের  অনুষ্ঠান। তাছাড়া পিকনিক, আর বিজয়া সন্মিলনী। এতেই আমাদের সব টাকা খরচ হয়ে যায়, যার মধ্যে খাওয়া দাওয়া হলো একটা বড় খরচ, অন্ততঃ ৬০%। পরের কমিটি কে দিয়ে যাবার মত খুব অল্প টাকাই অবশিষ্ট থাকে।

    সভাপতি হবার পর এই সব দেখে শুনে আমি প্রথমেই অনুভব করেছিলাম যে কলকাতার সাংষ্কৃতিক জগতের সাথে আমাদের যোগাযোগ তৈরী করতে গেলে অর্থাৎ দেশ থেকে নামী শিল্পীদের কুয়েতে এনে তাদের দিয়ে জমকালো কিছু অনুষ্ঠান করার জন্যে যে পরিমাণ অর্থ আমাদের দরকার, তা যোগাড় করতে গেলে Sponsored program করা ছাড়া গতি নেই।

    প্রধানতঃ সেই উদ্দেশ্য নিয়েই বোর্ণ ভিটা ইন্টার স্কুল Quiz ১৯৯৭ থেকেই আমরা শুরু করি।

    বোর্ণ ভিটা ইন্টার স্কুল Quiz ১৯৯৭ অনুষ্ঠান করে আমাদের তহবিলে যে উ্দবৃত্ত অর্থ জমেছিল, তাই দিয়ে আমরা সে বছর প্রমিতা মল্লিক আর সুগত বসুকে কুয়েতে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম।

    প্রমিতা “দেশমাতৃকা” নামে একটি চমৎকার দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। সুগত (নেতাজী সুভাষের ভ্রাতুস্পুত্র শিশির কুমার বসুর ছেলে) প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ও স্কলার, তিনি আমাদের নেতাজীর জীবন এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান নিয়ে একটি অনবদ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ লেকচার দিয়েছিলেন, পরে তাঁর সাথে আমাদের একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব্ব ও আলোচনাও হয়। সেই অনুষ্ঠানের নাম আমরা দিয়েছিলাম “লহ প্রণাম!”      

    সুখের এবং গর্ব্বের কথা যে সেই sponsored অনুষ্ঠানের ট্র্যাডিশন বি সি এসে এখনও চলেছে। তার পর থেকে কুয়েতে প্রায় প্রতি বছর দেশ থেকে আমরা নিয়ে এসেছি নানা নামী দামী শিল্পী, সঙ্গীত এবং নাটকের দলকে। সেই সাথে কুয়েতে উচ্চমানের সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের  জন্যে বি সি এসের সুনাম ক্রমশঃ বেড়েছে।

    Sponsored program না করলে এসব সম্ভব হতোনা।

    কিন্তু নতুন কিছু করতে গেলে কিছু প্রশ্ন, কিছু অভিযোগ তো আসবেই।

    আমাদের অনেক সদস্যদের কাছ থেকে তখন শুনতে হয়েছিল আমরা নাকি বি সি এস কে “commercialise” করছি। ভাবটা যেন কি দরকার আমাদের অতো টাকার? আমরা হলাম একটি Non-Profit association আমাদের তো যা পাচ্ছি তাই নিয়েই দিব্বি চলে যাচ্ছে! বেশী লাভের লোভ কি ভালো? ইত্যাদি। আবার এমন কি এ কথাও আমার কানে এলো যে লাভের বদলে সেই অনুষ্ঠান করলে যদি আর্থিক ক্ষতি হয়, কেউ কেউ বলছে তাহলে তার ভার কে নেবে?     

    বলা বাহুল্য এই সব অভিযোগ যারা করছিল তারা সংখ্যায় খুবই কম।   

    আমি তখন একটা GBM ডেকে সবাইকে বোর্ণ ভিটা ইন্টার স্কুল Quiz নিয়ে খুব উৎসাহব্যঞ্জক একটা  presentation দিয়েছিলাম মনে আছে। তাতে উল্লেখ করেছিলাম ওই অনুষ্ঠান করলে কুয়েতের বৃহত্তর সমাজে আমাদের recognition – সুনাম এবং সন্মান – কতোটা বাড়বে।  এও বলেছিলাম যে ওই অনুষ্ঠান করতে আর্থিক ক্ষতি হবার যদিও কোন সম্ভাবনাই নেই, তবু যদি তা হয়, তাহলে আমি এবং আমার কমিটির সব সদস্য সেই ক্ষতি মিটিয়ে দেবো।

    সবার সন্মতি পাবার পর আমরা হৈ হৈ করে স্পনসরের খোঁজে নেমে পড়েছিলাম।

    সেবার Pepsi আমাদের main sponsor হয়েছিল, আর তার সাথে  co-sponsor হতে এগিয়ে এসেছিলেন অনেক ভারতীয় উদ্যোগপতিরা। তাদের মধ্যে ছিলেন Caesars এর মিস্টার লরে্নস, Mailem এর মিস্টার লাম্বা, Toyotar মিস্টার সানি ম্যাথিউস, KITCO র ধীরাজ ওবেরয়। এ ছাড়াও আমাদের সাহায্য করতে হাত বাড়িয়েছিল অনেকে ভারতীয় কোম্পানী- Book sellers, Travel agents, Jewellers, Restaurants এবং আরও অনেকে। আমাদের মেম্বাররা সবাই এগিয়ে এসে সাহায্য করেছিল এই সব স্পনসর যোগাড় করতে।

    শ’খানেক কিংবা আরো বেশী স্পনসর পেয়েছিলাম আমরা সেবার।

    কি যে আশাতীত সাড়া পেয়েছিলাম আমরা সবার কাছ থেকে সেই প্রথম  বোর্ণ ভিটা ইন্টার স্কুল Quiz অনুষ্ঠানে এখনো ভাবলে বেশ একটা গর্ব আর আনন্দের অনুভূতি হয়। ইংরেজীতে যাকে বলে pride and joy..

    যাই হোক, সেই বোর্ণ ভিটা Quiz এর অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যেই আমি বি সি এসের একটা লোগো design করার পরিকল্পনা করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে অনেক ভারতীয় এবং বিদেশীরা আমাদের অতিথি হয়ে আসবেন, তাঁদের মনে আমাদের সম্বন্ধে একটা ভাল impression তৈরী করার জন্যে বি সি এসের নিজস্ব একটা Brand Identity দরকার বলে আমার মনে হয়েছিল।

    তাই সেবার গরমের ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে একটা Design Consultant কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করি। তারা আমায় তিনটে লোগো ডিজাইন করে দেয়। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। পঞ্চাশ দিনার মতো।

    কুয়েতে ফিরে এসে একটা GBM এ  আমরা মেম্বার দের কাছে সেই তিনটে লোগোর মধ্যে কোনটা সবাই চায় তাই নিয়ে একটা ভোট করালাম।  আশি শতাংশর বেশী ভোট পড়েছিল আমাদের এখনকার লোগো ডিজাইনে।

    যাকে বলে Hands down winner!

    বোর্ণ ভিটা Quiz এর অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে আমরা প্রত্যেক পোস্টার, প্রত্যেক বিজ্ঞাপন প্রত্যেক চিঠি এবং আমাদের অন্যান্য সব official কাগজপত্রে ওই লোগো ব্যবহার করা শুরু করি।

    সেই প্রথম Inter-school Quiz এর ফাইনালে প্রতিযোগী ছাত্র ছাত্রীদের জন্যে ছয়টা সাদা রং এর  কাঠের টেবিল তৈরী করা হয়েছিল। সাথে ছিল buzzer আর সেটা টিপলে জ্বলে ওঠা আলো। স্টেজে সেই সাদা টেবিলগুলোর প্রত্যেকটার সামনে বি সি এসের লোগো জ্বলজ্বল করতে দেখে কি যে ভাল লেগেছিল! সেদিন  অন্যান্য Community থেকে নানা স্কুলের ছাত্র ছাত্রী দের সাথে তাদের মা বাবারা এসেছিলেন, হল ভর্ত্তি লোক, তাদের মনের মধ্যে Quiz program এর quality র সাথে এই লোগোর মধ্যে দিয়ে বি সি এস সম্বন্ধে সবারএকটা ভাল impression হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

    সেই থেকে এই লোগো যেখানেই দেখি মনে বেশ একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করি। ভাবতে ভাল লাগে যে আমি যখন কুয়েতে থাকবোনা, তখন এই লোগো থাকবে আমার legacy হয়ে।

    লালুদার কবিতা থেকে ধার নিয়ে বলা যায় ~

    যতদিন বি সি এসে রহিবে এ লোগো/

    ততদিন মোরে কেউ ভুলিওনা ওগো/

    যে তিনটি লোগো থেকে আমরা একটা বেছে নিয়েছিলাম

  • হারানো সুর    

    মনোহরপুকুরের বাড়ীতে ছোটবেলার একটা সন্ধ্যার কথা খুব মনে পড়ে।

    বড় বারান্দায় সিঁড়ির কাছে আমাদের ধোপা এক বিরাট বান্ডিল কাপড় জামা নিয়ে এসে বসেছে, মা জ্যেঠিমা কাকীমারা তার সাথে কাপড়ের হিসেব করছেন, এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে ছোটকাকা উঠে এলেন।   বারান্দায় উঠে আসতেই চার বৌদি ঘিরে ধরলেন তাঁকে।   

    “অশোক, আজ নাইট শো তে আমাদের হারানো সুর দেখাতে নিয়ে চলো।”

    ছোটকাকার তখনো বিয়ে হয়নি, তিনি বৌদিদের একমাত্র অবিবাহিত দ্যাওর। আর খুব pampered..

    ছোটকাকার বরাবরই একটু মজা করার অভ্যেস, আর প্রতি কথার শেষে অ্যাঁ? বলা তার একটা মুদ্রাদোষ ছিল। হীরকের রাজা যেমন “ঠিক কি না?” বলতেন, অনেকটা সেরকম।

    ছোটকাকা সেদিন গম্ভীর আর উদাস মুখ করে বলেছিলেন, “যে সুর হারিয়ে গেছে তাকে আর দেখতে গিয়ে কি হবে, অ্যাঁ?”

    এখন জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে সেই জীবনের নানা হারানো সুর হঠাৎ আচমকা ফিরে আসে।

    যেমন গতকাল ছিল বিশ্বকর্ম্মা পূজো।

    ছোটবেলায় বিশ্বকর্ম্মা পূজো আমাদের জন্যে ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর season এর শেষ দিন। তার আগের দিন গুলো ঘুড়ি ওড়ালেও ওই দিনটা বলতে গেলে ছিল ঘুড়ি উৎসব এর দিন। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত “ভোকাট্টা”…

    বাবলু আর আমি আমাদের বাড়ীর ছাত থেকে খুব ঘুড়ি উড়িয়েছি একসময়।

    মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীর ছাদে আমরা বেশ কিছুদিন আগে থেকে ওই দিনটার জন্যে prepare করতাম। সুতো লাটাই ঘুড়ি কেনা হতো সতীশ মুখার্জ্জী রোডে “মাণিক লাল দত্তের” দোকান থেকে। সিকি তেল, আধ তেল, এক তেল। কত রকম ঘুড়ির design ছিল তখন, আর তাদের কতরকম নাম ছিল – ঘয়েলা, ময়ূরপঙ্খী, মোমবাতি, চৌরঙ্গী…তারপরে সেই ঘুড়িতে ব্যালান্স করে সুতোর কার্ণিক লাগানো ছিল একটা কঠিন কাজ।

    আর মাঞ্জা দেবার জন্যে কিনতাম এরারুট, কাঁচগুড়ো আর রং। এক ছুটির দিন দুপুরে আমি আর বাবলু ছাদে সুতোয় মাঞ্জা দিতাম। সাদা সুতো কিনে মাঞ্জা দেওয়া হতো ছাতে। অ্যারারুট, কাঁচগুড়ো আর রং জল মিশিয়ে মন্ড তৈরী করে সুতোর ওপরে কয়েকবার লাগাতে হতো, রোদ্দুরে শুকোবার পরে সুতোয় এমন ধার হত যে আঙুল কেটে যেতো অসাবধান হলেই। 

    বিশ্বকর্ম্মা পূজোর দিন সকাল থেকেই আকাশ ভরে উঠতো লাল নীল ঘুড়িতে। প্যাঁচ খেলে কোন ঘুড়ি কে কাটলে চারিদিক থেকে উল্লসিত আওয়াজ উঠতো – ভোকা…আ…আ…ট্টা…। সেই আওয়াজ এখনো আমার কানে ভাসে। আর কারুর ঘুড়ি কাটতে পারলে যে মনের মধ্যে একটা গর্ব্ব আর আনন্দের অনুভূতি হতো সেটাও এখনো ভুলিনি।

    বিশ্বকর্ম্মা পূজোর দিন বাবলুর স্কুল ছুটি কিন্তু আমার মিশনারী স্কুলে ছুটি নেই। ইচ্ছে না থাকলেও আমায় স্কুলে যেতেই হতো। মা’কে বলে লাভ হতোনা। She was too strict…

    বাবলু এদিকে সকাল থেকে ছাদে।

    সেদিন স্কুলে লাস্ট পিরিয়ডটা যেন কাটতেই চাইতোনা। বিকেলে ছুটির ঘন্টা বাজলেই উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতাম মনে পড়ে। বাড়ী পৌঁছেই দুড্ডাড় করে ছাতে চলে যেতাম, তারপর সন্ধ্যা নামা পর্য্যন্ত ঘুড়ি ওড়ানো।  

    ঘুন্টু সেলিমপুরের বাড়ীতে উঠে যাবার পর প্রায় প্রতি বছর বিকেলে মনোহরপুকুরে ঘুড়ি ওড়াতে চলে আসতো। হাজরা মোড়ে সাধনদাদুর কারখানায় বেশ বড় করে বিশ্বকর্ম্মা পূজো হতো। আমি ঘুন্টু আর বাবলু সন্ধ্যাবেলা সেখানে গিয়ে প্রসাদ খেয়ে আসতাম।

    ঘুড়ি ওড়ানো এখন অনেকদিন বন্ধ, তবে এখন লকডাউনের এই ঘরবন্দী জীবনে রোজ সন্ধ্যায় আমাদের পূর্ণ দাস রোডের বাড়ীর ছাতে হাঁটার সময় ইদানীং মাথার ওপরে খোলা আকাশে শনশন আওয়াজ পাই, দেখি ঘুড়ি উড়ছে চারিদিকে। গতকাল বিশ্বকর্ম্মা পূজোর দিন দেখলাম আকাশে অনেক ঘুড়ি, খুব প্যাঁচ লড়া চলছে, কয়েকটা ঘুড়ি কাটা পড়ে ভাসতে ভাসতে নীচে নেমে আসছে, একটা কাটা ঘুড়ি আমাদের ছাতে এসে পড়লো।   

    অলস ভঙ্গী তে বাতাসে দোল খেতে খেতে দুলকি চালে নেমে আসা কাটা ঘুড়ির নেমে আসা বড় সুন্দর দৃশ্য।      

    দেখলেই জীবনের সেই সব হারানো সুর মনের মধ্যে বেজে ওঠে।

  • টয়লেট টা কোনদিকে ভাই?

    ১) রাণীগঞ্জে আমার প্রথম চাকরী

    ১৯৬৮ সালে খড়্গপুর থেকে ইঞ্জীনিয়ারিং পাশ করার পরে আমি রাণীগঞ্জে বেঙ্গল পেপার মিলে বছর খানেক কাজ করেছিলাম। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম চাকরী। তখন আমার বাইশ বছর বয়েস।

    বাবা মারা গেছেন তিন বছর আগে ১৯৬৫ সালে, তখন আমার খড়গপুরে থার্ড ইয়ার। তাঁর দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে মা’র প্রায় সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষিত। জমি বিক্রী করে প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ধার করে তিনি সেই খরচের ধাক্কা সামলেছেন। তার ওপরে ছিল আমার কলেজে টিউশন আর হোস্টেলে থাকার খরচ।  মা আমায় এই খরচ নিয়ে কিছু বুঝতে না দিলেও আমাদের আর্থিক অবস্থা যে বেশ শোচনীয় তা বোঝার মত বয়েস আমার হয়েছিল।

    তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে একটা চাকরী পেয়ে উপার্জ্জন শুরু করে মা’র পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর ভার লাঘব করাই আমার তখন প্রধান কাজ। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতৃহীন, বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে – ভাল চাকরী পাবার জন্যে আমার কোন খুঁটির জোর ছিলনা। কেবল ছিল আমার আই আই টি খড়্গপুর থেকে পাওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা ডিগ্রী।

    তার ওপর চাকরী পাবার পক্ষে ১৯৬৮ সালটা খুব একটা অনুকূল ছিলনা। 

    ১৯৬৬ সাল থেকে দেশের অর্থনীতি ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি সামলাতে টাকার মূল্য কমানো u হলো। এর মধ্যে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা ভোটে জিতে বাংলা কংগ্রেস এর সাথে যুক্তফ্রণ্ট তৈরী করে ক্ষমতায় এসেছে। অজয় মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু উপ মুখ্যমন্ত্রী।

    বড় বড় সব কারখানা তে নানা দাবী দাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এক এক করে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার ওপরে নকশালবাড়ীতে কৃষক আন্দোলন নিয়ে মার্ক্সিস্ট কম্যুনিস্ট পার্টি দুই ভাগ হয়ে গেছে, মার্ক্সসিস্ট লেনিনিস্ট পার্টি নামে একটা নতুন রাজনৈতিক দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের পক্ষ নিয়ে চীনের মাও সে তুং এর   সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের আদর্শে কৃষিবিপ্লবের ডাক দিয়েছে। তার ওপর ভিয়েতনামের যুদ্ধ চলছে, আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে সবাই সোচ্চার।

    কলকাতার রাস্তায় তখন এই ধরণের দেয়াল লিখন দেখা যায়।

    “তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম”। “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”। “বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।” ইত্যাদি।  সারা দেশে একটা অশান্তি মারামারি খুনোখুনি আর নৈরাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমশঃ।  

    যাই হোক, এর মধ্যেই ইন্টারভিউ দিয়ে আমরা দুই ক্লাসমেট রমাপদ ত্রিপাঠী আর  আমি  চাকরী নিয়ে রাণীগঞ্জে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। মাইনে মাত্র তিনশো টাকা ছিল। তার মানে আমরা দুজনেই সেভাবে টাকার কথা ভাবিনি। ওই অশান্ত সময়ে একটা চাকরী পেয়ে কাজ শেখাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে কাজের অভিজ্ঞতাটা দরকার, মাইনে কম হতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা অমূল্য।     

    আমরা দু’জনেই কিছু দিনের মধ্যে চাকরী ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। সামান্য যা উপার্জ্জন করতাম সেটা বোধহয় নতুন কোন ভালো চাকরী খোঁজার পিছনেই খরচ হতো। তাছাড়া মাইনে থেকে কিছুটা হাত খরচ বাঁচতো, যেটা খড়গপুরে সেভাবে হাতে আসতোনা। 

    রাণীগঞ্জের সেই দিন গুলো বেশ ছিল। বয়েস্ও কম ছিল, যতদিন ছিলাম, খুব উপভোগ করেছি।

    বেশ ভাল একটা ফ্ল্যাট পেয়েছিলাম, চার বেলা মেসে খাবারের ব্যবস্থাও ছিল।  মিলের পাশেই দামোদর নদ, গরমে হাঁটু জল, নদীর ওপারে বাঁকুড়া জেলা, সেখান থেকে জলের মধ্যে দল বেঁধে হেঁটে শ্রমিকেরা কাজে আসে, বিকেলে বাড়ী যায়, সে এক সুন্দর দৃশ্য।

    বেশ কিছু সমবয়েসী বন্ধূও জুটে গেছে, স্থানীয় ক্লাবে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলি, ফুটবলও পেটাই মাঝে মাঝে। নদীর ধারে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে সেখানে ঘুরে ঘুরে বেলুন ফাটাই, জিলিপি খাই। ক্লাবের লনে টেনিস খেলি। অনেকে মিলে উইকেন্ডে রাণীগঞ্জ শহরে গিয়ে সিনেমা দেখি, আসানসোলে গিয়ে রেস্টুরেন্টে বিয়ার খাই। পূজোর পর দুর্গাপুরে জলসা শুনতে গিয়েছিলাম এক দিন বাসের মাথায় চড়ে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনবো বলে। তাছাড়া ছিল কাছের গ্রামে যাত্রাপালা, আমার সেই প্রথম যাত্রা দেখা।

    মামা মামীমা থাকতেন আসানসোলে, কোর্ট রোডে মামার বিশাল বাংলো। সেখানে  সুযোগ পেলেই চলে যেতাম। মামাতো মাসতুতো ভাই বোনদের সাথে খুব হুটোপাটি হতো। আম গাছে চড়তাম, তাছাড়া ছিল বারান্দায় বসে ক্যারম বা ব্যাডমিন্টন খেলা।

    সব মিলিয়ে বেশ ছিল সেই রাণীগঞ্জের দিনগুলো আমার জন্যে।    

    নোপুর গ্রাম

    বেঙ্গল পেপার মিলে আমি কাজ শুরু করলাম ওয়ার্কশপে, সেখানে মিলের নানা মেশিন যেমন পাম্প ইত্যাদি বিকল হইয়ে গেলে সারানোর জন্যে আসে। সেখানে লেদ মিলিং প্লেনিং ইত্যাদি নানা মেশিন,  এবং বেশ কিছু ফিটার আর মেশিনিস্ট কাজ করে, এরা সবাই কাছাকাছি গ্রামের ছেলে। রমাপদ কজ পেলো পাওয়ার প্ল্যাণ্টে, তার কাজ টার্ব্বাইন নিয়ে।

    আমাদের ওয়ার্কশপের ম্যানেজার চৌধুরী সাহেব বেশ মাইডিয়ার লোক। আর যারা সেখানে কাজ করে তাদের কাছ থেকে কত নতুন কিছু জানা যায়, যা আমি কলেজে শিখিনি।  তাদের অনেকের সাথেই কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বেশ ভাব হয়ে গেল।  চৌধুরী সাহেবের ভাই মহাদেব চৌধুরী একজন সিনিয়র ফিটার, বয়স্ক এবং কাজের লোক, স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ সুঠাম শরীর, ফর্সা এক মাথা কালো চুল, চুপচাপ, অমায়িক, সবসময় তাঁর মুখে হাসি। কিন্তু ইদানীং তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে, নিয়মিত কাজে আসেননা, ক্রমশঃ বেশ রোগাও হয়ে যাচ্ছেন, চেহারায় একটা ক্লান্তির ভাব, চোখের তলায় কালি। 

    ভাই কে নিয়ে চৌধুরী সাহেব বেশ চিন্তিত।  তিনি ভাইয়ের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করছেন।  মুস্কিল হলো চৌধুরী সাহেব থাকেন মিলের কলোনীতে তাঁর ম্যানেজারের বাংলোতে, আর তাঁর ভাই মহাদেব থাকেন কাছেই নোপুর নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে ভালো ডাক্তার বা হাসপাতাল নেই।

    বেঙ্গল পেপার মিলের  ওয়ার্কশপে  কার্ত্তিক বারিক নামে একটি ছেলে ছিল, তার কাজ ছিল নানা দরকারী জিনিষ পত্র জোগাড় করার। খুব কাজের ছেলে ছিল কার্ত্তিক, আর খুব ফুর্ত্তিবাজ। আমার আর রমার সাথে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

    তো একদিন কার্ত্তিক রমা আর আমায় নিয়ে একদিন সাইকেলে চেপে ওদের গ্রাম  (নোপুর) দেখাতে নিয়ে গেল। আমাদের মিল টা ছিল  রানীগঞ্জ থেকে কিছুটা দূরে বল্লভপুর নামে একটা জায়গায়, দামোদরের তীরে। সেখান থেকে নোপুর গ্রাম ক্রোশ খানেকের পথ, সাইকেলে যেতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে।  

    আমাদের সাই্কেল ছিলোনা, কার্ত্তিক কোথা থেকে দু’টো সাইকেল জোগাড় করে নিয়ে আসে।  

    পড়ন্ত বিকেলে আলপথে সাইকেলে চেপে  যেতে পাশে সবুজ ধানক্ষেত।  কার্ত্তিক আবার একটু কবিতাপ্রেমী, সে রবীন্দ্রনাথের “গগনে গরজে মেঘ” এর সাথে “রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা” এই লাইন দুটি নিয়ে তার আপত্তি ব্যক্ত করেছিল। ওর মতে আষাঢ় শ্রাবণে ধান কাটা হয়না। 

    রমার সাথে (সেও গ্রামের না হলেও শহরতলী হাওড়ার ছেলে) তার এই নিয়ে সেদিন  তর্ক বেঁধে যায়। সেই তর্কে আমন আর আউষ ধানের কথা উঠে এসেছিল। আমি তো শহরের ছেলে, এ সব ব্যাপারে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত, আমি কোন তর্কের ভিতরে না গিয়ে চারিদিকের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মন দিচ্ছিলাম।

    পরে শুনেছি কার্ত্তিকের কথাই ঠিক। আউষ ধান বর্ষাকালে ধানের চারা পোঁতা (রোপন)হয়, সেই ধান অগ্রহায়নে কাটা হয়। আর আমন ধান পোঁতা হয় শীতকালে, কাটা হয় চৈত্রে। বর্ষাকালে ধান কাটা নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল সোনার তরী কবিতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

    নোপুর গ্রাম থেকে মিলে অনেকে কাজ করতে আসে, তাদের অনেকের বাড়ীতে কার্ত্তিক আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। মাটির বাড়ী, ধুলোর রাস্তা,  পানাপুকুর, নারকেল গাছের সারি, বাংলার  গ্রামের  সেই ধূলিমলিন  চেহারা এখনো বেশ মনে পড়ে। 

    মহাদেবের বাড়ীতেও আমরা গিয়েছিলাম সেদিন। অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাদের পেয়ে মহাদেব খুব খুসী হয়েছিলেন মনে আছে। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মহাদেবকে দেখে সেদিন কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। কিন্তু মহাদেব নিজের শরীর খারাপ নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, “না না আমি তো ঠিক আছি, ও কিছু নয়”, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন “এরা আমার জন্যে অযথা চিন্তা করে।”

    বাইরে বেরিয়ে কার্ত্তিক বেশ চিন্তিত মুখে আমাদের বলেছিল, “বৌদি বলছিলেন মহাদেবদা’ কে একবার বর্দ্ধমান জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। চৌধুরীবাবুর সাথে এই নিয়ে কথা বলতে হবে। উনি নিজের ভাইয়ের চিকিৎসার বন্দোবস্তর ভার নেবেন আমায় বলেছেন।”

    তারপরে সেদিন কার্ত্তিক আমাদের তার বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। কার্ত্তিকের বাড়ীর সামনে বিশাল মাঠ, আর তাদের নিজেদের অনেক খেজুর গাছ। সেদিন কার্ত্তিক আমাদের জিরেন গাছের খেজুর রস খাইয়েছিল।

    “আপনাদের জন্যে তিন দিন জিরেন রেখেছি” বলেছিল কার্ত্তিক।

    আমার এখনো মনে আছে যে ঢকঢক করে সেই মিষ্টি রস বেশ কয়েক গেলাস খেয়ে ফেলে আমার বেশ একটু নেশা হয়েছিল, আমি কার্ত্তিক কে কিছুটা জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম “টয়লেট টা কোন দিকে ভাই?”

    কার্ত্তিক কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “টয়লেট ? আপনার সামনে দিব্বি ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে…যেখানে ইচ্ছে চলে যান…”

  • বার্দ্ধক্যে বারাণসী  – ফেব্রুয়ারী ৫-৭, ২০২৪

    ১)  পূর্ব্বকথা

    কথায় আছে বাবা বিশ্বনাথ না ডাকলে কাশী যাওয়া হয়না।

    ছোটবেলায় মা’র সাথে প্রতি বছর দিদার কাছে কাশী আসতাম। শেষ এসেছিলাম ১৯৬৫ সালে বাবার মৃত্যুর পরে, তখন খড়্গপুরে কলেজে পড়ি, গরমের ছুটিতে। তার পর অনেক বছর কেটে গেছে। বাবা বিশ্বনাথ আমায় ডাকেননি, আমারও আর কাশী আসা হয়নি।

    ২০১৯ সালে আমার শ্বাশুড়ী আর মা পর পর জানুয়ারী আর ফেব্রুয়ারী মাসে চলে গেলেন। তাঁদের দু’জনের বাৎসরিক কাজ করার কথা এক বছর পরে ২০২০ সালে, সেই কাজ ঠাকুরমশায়কে ডেকে বাড়ীতে করানো হলো। তখন কোভিড অতিমারী চলছে, লকডাউনের সময়ে তাঁদের আত্মাকে পিন্ডদান করতে গয়া বা কাশী যেতে পারিনি।

    এবার ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ পর্য্যন্ত বাবা বিশ্বনাথের ডাক এলো।

    আমরা আমার শ্বাশুড়ী আর মা’র পিন্ডদান করতে কাশী এসেছি। আমাদের সাথে  এসেছে আমাদের বড় মেয়ে পুপু। সে লন্ডনে ডাক্তার। ঠাম্মা আর দিদিভাইকে সে খুব ভালোবাসতো, তাই সে ছুটি নিয়ে আমাদের সাথে তাঁদের আত্মাকে পিন্ডদান করা দেখতে কাশী এসেছে, এই সুযোগে তার কাশী দেখা হয়ে যাবে। বাবা বিশ্বনাথ আমাদের সাথে তাকেও ডেকে নিয়েছেন।

    ভারত সেবাশ্রম সংঘে পিন্ডদান হবে, আগে থেকেই ফোন করে সব বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে। পুরোহিত মশাইয়ের নাম ছোটু মহারাজ, তিনি সব জিনিষ যোগাড় করে রাখবেন, আমাদের কেবল এসে পুজোর কাজটা করতে হবে। আমি মা’র কাজ করবো, সুভদ্রা করবে আমার শ্বাশুড়ীর কাজ।  

    ১৯৬৫ সালের পরে ২০২৪, অর্থাৎ প্রায় ষাট বছর I পরে আমি কাশী এলাম।

    এই ষাট বছরে কাশী অনেক পালটে গেছে, আর আমিও এখন সেই আগেকার শিশু বা কিশোর নই। আমার নতুন চোখে এই নতুন কাশীকে কেমন দেখবো, তাই নিয়ে মনে মনে প্রথম থেকেই আমি বেশ একটা আগ্রহ অনুভব করছিলাম।

    তখন তরুণ ছিল অরুণ আলো, পথটি ছিল কুসুমকীর্ণ/

    বসন্ত সে রঙ্গীন বেশে ধরায় তখন অবতীর্ণ।

    আর এখন আমার অবস্থা হলো  “বসন্ত সে কবেই গেছে, শরীর এখন  জরাজীর্ণ।”

    কাশী কিছুটা আমার সেই বাল্য কৈশোর আর আজকের বার্ধক্যের মধ্যে একটা সেতুর মতো।

    এটা হলো সেই সেতুবন্ধের গল্প।

    ২) ষাট বছর পর প্রথম কাশী দর্শন

    এই প্রথম প্লেনে কাশী এলাম। পুপু এলো দিল্লী থেকে। ওর ফ্লাইট কিছুক্ষন আগে এসেছে, আমাদের জন্যে সে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল।

    ছোটবেলায় তো প্লেনে ওঠার সামর্থ্য আমাদের ছিলনা, মা’র সাথে ট্রেণে কাশী আসতাম। ট্রেণে কাশী যাবার একটা প্রধান স্মৃতি ছিল বেনারস স্টেশনের ঠিক আগে গঙ্গার ওপরে লম্বা ব্রীজ। সেই ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেণ যাবার সময়, ট্রেণের ভিতর থেকে একটা সমবেত কন্ঠে “গঙ্গা মাইকি জয়” রব উঠতো। তাছাড়া প্রায় সবাই তাদের গঙ্গা মাই কে প্রণামী হিসেব নদীর জলে পয়সা ছুঁড়তেন, এবং সেগুলো ব্রীজের গার্ডারে লেগে ঝনঝন একটা শব্দ হতো, সেই শব্দ এখনো কানে বাজে।

    ট্রেণের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম বহু দূরে কাশীর গঙ্গার তীরের ইঁট রং এর উঁচু উঁচু বাড়ীগুলো, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, তাদের সামনে সিঁড়ি নেমে গেছে নদীতে। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে ভোলা প্রায় অসম্ভব। সত্যজিৎ রায় তাঁর “অপরাজিত” সিনেমার শুরুতেই  ব্রীজের ওপর ট্রেণ থেকে দেখা কাশীর ঘাটের ওই দৃশ্যটা ব্যবহার করেছেন। 

    স্টেশন থেকে নেমে আমরা সাইকেল রিক্সা অথবা ঘোড়ায় টানা গাড়ী (টাঙ্গা) চড়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে দিদার বাড়ীতে পৌঁছে যেতাম। পথে শহরের নানা দৃশ্য চোখে পড়তো।  সেই সব দৃশ্য এখন সাদা কালো ছবির মতো শুধু আমার মনে।

    ষাট বছর পরের এই শহর এখন কেমন লাগবে আমার চোখে? 

    বেনারস এয়ারপোর্টটা বেশ বড় আর সাজানো গোছানো। সিঁড়ি দিয়ে হলে নেমে আসতেই দেখি সামনে পুপু আমাদের জন্যে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।  আমাদের মালপত্র নিয়ে আমরা বেরোলাম। বাইরে তখন বিকেলের উজ্জ্বল আলো। 

    হোটেলের ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে এসেছে, বেশ আরামাদায়ক বড় গাড়ী (SUV), আমরা সেই গাড়ীতে উঠে হোটেলের দিকে চললাম।

    আমাদের ড্রাইভার এর নাম ভোলা। কাশীতে সবার নামই মহাদেব এর নামে হবে তাতে আর অবাক হবার কি আছে? ভোলা ফোনে কার সাথে কথা বলছে,  ভোজপুরী ভাষায় নাকি?  জিজ্ঞাসা করাতে সে বললো কাশী শহর বিহার এর বর্ডার এর খুব কাছে। আর বর্ডারের ওপারেই ভোজপুর জেলা, তাই কাশীতে ভোজপুরী ভাষা খুব প্রচলিত, এই ভাষায় এখানে অনেকেই কথা বলে। 

    কাশী শহর এয়ারপোর্ট থেকে অনেকটা  দূর, যেতে সময় লাগলো ঘন্টা খানেক। যেতে যেতে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম – তখন বিকেলের রোদ এসে পড়েছে দু’দিকের ছোট ছোট বাড়ীতে, চারিদিকে খোলামেলা সবুজ,  দেখে মনে হয় বেশ বর্দ্ধিষ্ণু জায়গা।  কিন্তু ক্রমশঃ যত শহর কাছে আসতে লাগলো ততো ঘড়বাড়ী দোকানপাট আর সাইকেল অটো আর মানুষের ভীড় বাড়তে লাগল।  

    সেই পড়ন্ত বিকেলে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দিকে যেতে যেতে বেনারস শহরের ব্যস্ত রাস্তা দেখছিলাম, নানা দৃশ্য চোখে পড়ছিল, রাস্তার দুই পাশে বেনারসী শাড়ীর দোকান, চারিদিকে হিন্দী সাইনবোর্ড, অটো রিকশা আর পথচারীদের ভীড়। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে কাশীর বিখ্যাত সরু সরু গলি। কালো বোরখা পরা কিছু কিশোরী দলবেঁধে হেসে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, হয়তো তারা স্কুল থেকে ফিরছে।

    দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কত প্রাচীন এই বারাণসী শহর, হিন্দুদের পরম পবিত্র তীর্থ। স্বয়ং শিব এখানে এসে ভিক্ষা নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণার কাছ থেকে।  এই শহর মুসলমানদের অধীনেও থেকেছে, মন্দিরের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে মসজিদ। ফলে এখানে হিন্দু ও মুসলমান নারী পুরুষ যত্রতত্র দেখা যায়।

    সারা বিশ্বে আমাদের হিন্দুদের মোট সাতটি পবিত্র ভূমি রয়েছে, যেখানে গেলে মানুষ মোক্ষ লাভ করতে পারে। অযোধ্যা, মথুরা, গয়া, কাশী, কাঞ্চী, অবন্তিকা ও দ্বারবতী – এই সাতটি শহরকে  একত্রে বলা হয় সপ্তপুরী। কাশী এই সপ্তপুরীর অন্যতম পবিত্র ভূমি। পাশাপাশি এই শহরটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এবং গঙ্গা নদীতে স্নান করা হিন্দু ধর্মমতে বিশেষ পুণ্যের কাজ।  

    কাশীর গঙ্গায় স্নান করে বিশ্বনাথ দর্শন করলে পার্থিব জীবনের যত জ্বালা আর  যন্ত্রণা থেকে চিরকালের জন্যে নিশ্চিত মুক্তি এই বিশ্বাস থেকে দলে দলে হিন্দুরা যুগে যুগে সারা দেশ থেকে মন্দিরে শিবের দর্শন করতে ও পূজো দিতে আসেন।  

    এই বিশ্বাস থেকে আমার দিদিমা ও তাঁর শেষ জীবনে বেশ কয়েক বছর কাশীতে একা একা থেকেছেন। মা মামা মাসীরা অবশ্য তাঁকে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে শারীরিক অসুস্থতা জনিত কারণে নিজেদের কাছে নিয়ে এসে রাখেন।

    আমার বার্ধক্যে আমি অবশ্য নিজের জন্যে কোন পুণ্য অর্জ্জন করার জন্যে কাশী আসিনি। আমি এসেছি আমার মা’র পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যে। আমার মা রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে বড় হয়েছেন, সারা জীবন নিষ্ঠার সাথে পুজো আর্চা এবং  শিবরাত্রি বা কালীপূজোতে নির্জলা উপোস এই সব করেছেন।  আমার বাবার মৃত্যুর পরে তিনি আমায় নিয়ে গয়া  গিয়েছিলেন, সেখানে আমরা তাঁর পারলৌকিক আত্মার শান্তির জন্যে তাঁকে পিন্ডদান করেছিলাম।

    সুতরাং তিনি নিশ্চয় চেয়েছিলেন যে তাঁর একমাত্র সন্তান তাঁর মৃত্যুর পরে  পিন্ডদান করে তাঁর আত্মাকে মুক্তি দেবে। সেই কাজ করতেই আমার কাশী আসা।    মা’র প্রতি সন্তানের কর্ত্তব্য পালন করাও অবশ্যই একটা পুণ্যের কাজ।  তাছাড়া  গঙ্গায় স্নান না করলেও বিশ্বনাথের দর্শন তো অন্ততঃ হবে।

    প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল মা পরলোকে যাত্রা করেছেন, ঠিক এক বছর পরে ২০২০ সালে কোভিড অতিমারীর মধ্যে বাড়ীতে পূজো করে তাঁকে পিন্ডদান করা হয়েছে, কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী গয়া কাশী হরিদ্বার এর মত তীর্থক্ষেত্র থেকে  পিন্ডদান না করলে প্রেতাত্মা বৈতরণী নদীর ঘাটে অপেক্ষায় থাকেন, যতক্ষন না সন্তান পিন্ডদান করে ততদিন সেই নদী পেরিয়ে তাঁর প্রেতাত্মার স্বর্গে প্রবেশ করার অনুমতি নেই।  

    এই সব ভাবতে ভাবতে আমাদের গাড়ী এক জায়গায় এসে একটা সরু গলির মুখে এসে দাঁড়ালো।   

    আমাদের হোটেলটা একটু ভেতরে নদীর ধারে, সেখানে গাড়ী যাবেনা , তাই হোটেলের  দুই জন ইউনিফর্ম পরা লোক এসেছে তারা আমাদের মালপত্র নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেবে। হেঁটে মাত্র দুই বা তিন মিনিটের রাস্তা, একটু এগোতেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। পাশেই শিবালা ঘাট, নদীর দর্শন পেলাম। নিজের মনে বয়ে চলেছে পুণ্যসলিলা গঙ্গা। এখানে জলের রং নীল, কলকাতার মত পলিমাটিতে ভরা হলুদ রং নয়। দেখে মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল।

    আমাদের  হোটেলের নাম সূর্যোদয় হাভেলি, এই হোটেলটি আগে রাজস্থানের কোন মহারাজের বাড়ী ছিল শুনলাম। বেশ দামী হোটেল, শাকাহারী, অর্থাৎ এখানে সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়।

    শুনেছি আধুনিক বারাণসীর বেশির ভাগটাই রাজপুত ও মারাঠা রাজাদের হাতে তৈরি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে তৈরী এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাড়ীর বেশিরভাগই তাই।  সেই সব রাজা রাজড়ারা বলা বাহুল্য শিবের ভক্ত ছিলেন। এবং তাঁদের তৈরী এই সব হাভেলিতে তাঁরা সপরিবারে এসে থাকতেন। কাশীতে গঙ্গার ধারে প্রাসাদোপম হাভেলি থাকা একরকমের আভিজাত্যের প্রকাশ, তাছাড়া পুণ্যও হয়।

    এখন এই সব হাভেলির অনেকগুলোই হোটেল হিসেবে চালানো হয়।  ছোটবেলায় যখন আসতাম, তখন কাশীতে এত হোটেল ছিলনা।  

    ৩) কাশী আর বেনারস 

    কাশী আর বেনারস দুটো আলাদা রেলস্টেশন হলেও আসলে কিন্তু ওরা একই শহরের দুই নাম। পরে শুনেছি ওখানে দুই উপনদী বরুণা আর অসি গঙ্গায় মিশেছে তাই সেখান থেকেই সন্ধি করে শহরের নাম হয়েছে বারাণসী। সেখান থেকে বেনারস।  

    অনেকে বলে কাশী হলো বাঙালীর, আর বেনারস হলো সারা ভারতের।

    একই শহরের ভিতর দুই আলাদা শহর, তাদের আলাদা রূপ, আলাদা পরিচয়।  আমার এক বন্ধু সিদ্ধার্থ পাঁচ বছর কাশীতে থেকে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। তার মতে কাশী ও বেনারস দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ।

    কাশীতে বাঙালীর প্রতিপত্তি বেশী, বিধবাশ্রম, ভাতের হোটেল, আনন্দময়ী মা,   গঙ্গার ঘাট আর সিঁড়ি, হরিহর সর্ব্বজয়া আর ছোট্ট অপু।  বাংলা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী উপন্যাসের নায়িকারা নির্বাসিত হয়ে কাশীবাসিনী হয়েছেন। সেই সব উপন্যাসের মধ্যে আছে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতক, বিভূতিভুষনের দ্রবময়ীর কাশীবাস, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ।  এমনকি রবীন্দ্রনাথও চোখের বালির বিনোদিনী কে কাশী পাঠিয়েছিলেন।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর উনবিংশ শতাব্দী নিয়ে লেখা “সেই সময়” উপন্যাসে বালবিধবা  বিন্দুবাসিনীকে তখনকার সমাজের রীতি অনুযায়ী কাশী পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

    কাশীর একটা গোটা এলাকাই বাঙালির। যার নাম বাঙালিটোলা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দিব্যি বাংলা বলে চলেছেন প্রবাসীরা। এখানে তিন হাজারের বেশি দুর্গাপুজো হয়। এককালে সংস্কৃত শেখার জন্য বহু বাঙালি পাড়ি দিতেন কাশী। একটা সময় ছিল যখন কাশীতে রীতিমতো শাসন করতেন বাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিতরা।  

    অন্যদিকে বেনারস হলো ভারতীয় সংষ্কৃতি আর আধ্যাত্মিকতার এক বিশেষ পীঠস্থান। বেনারসী শাড়ী, রাবড়ী,  জর্দ্দা পান, কচুরী,  মুজরা, বাইজী দের নাচ গান, কবি সন্মেলন, বিসমিল্লা খাঁর অষ্টপ্রহর সানাই, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বেনারেস ঘরানা। অপরাধ জগতের  মগনলাল মেঘরাজেরাও বেনারসের অতি ঘোর বাস্তব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় উপন্যাসে গঙ্গানারায়ন তার ছেলেবেলার বান্ধবী এবং বালবিধবা কাশীতে নির্বাসিতা বিন্দুবাসিনী কে কাশীতে এসে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল। শেষ পর্য্যন্ত সে বিন্দুকে যখন সে খুঁজে পায়, সে তখন এইরকম একজন অপরাধ জগতের মানুষের রক্ষিতা। সে গঙ্গার কাছে ফিরে যেতে রাজী হয়না, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।

    বারাণসীকে ভারতের প্রাচীনতম শহর বলে মনে করা হয়।   

    এই শহর হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র শহর হলেও বারাণসী বৌদ্ধ, জৈন আর শিখ ধর্মেরও অন্যতম পীঠস্থান।

    ৫২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বারাণসীর কাছে সারনাথে বুদ্ধ প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেন।    বুদ্ধগয়ায় বোধিসত্ত্ব লাভ করার পর গৌতম বুদ্ধ তা প্রচার করার জন্য পঞ্চভার্গব ভিক্ষুর সন্ধানে প্রথম এসে পৌঁছেছিলেন সারনাথে। পরে সম্রাট অশোক সারনাথের একটি মৃগদাবে একটি বুদ্ধমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কাশী এলে সারনাথে সেই মন্দির দর্শন করতে পর্য্যটকরা দল বেঁধে যান্‌।  মা মাসীদের সাথে ছোটবেলায় আমিও বেশ কয়েকবার গেছি।

    ৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে চীনা পর্যটক  ফাহিয়েন এবং পরে হিউয়েন সাং  বারাণসীতে এসেছিলেন।  তাঁদের রচনা থেকে এই শহরের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের পরিচয় পাওয়া যায়।  

     ভক্তিবাদী আন্দোলনের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবীর। কবীরকে “পঞ্চদশ শতাব্দীর ভারতের শ্রেষ্ঠ ভক্তিবাদী সন্ত কবি ও অতিন্দ্রীয়বাদী” বলা হয়।  ১৫০৭ সালের শিবরাত্রি উৎসবের সময় গুরু নানক এই শহরে আসেন। তার এই বারাণসী সফর শিখধর্ম্ম প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

    কিন্তু শুধু ধর্ম দিয়ে বারাণসী কে চেনা যাবেনা।

    এই শহর শত শত বছর ধরে ভারতীয় সংস্কৃতি, শিল্প ও শিক্ষার উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান হিসেবে তার পরিচয় বজায় রেখেছে।

    তুলসীদাস তাঁর জীবনের সিংহভাগ এই শহরে কাটিয়েছেন। রামায়ণের  ওপর লেখা তাঁর বিখ্যাত কাব্য রামচরিতমানস তিনি এখানেই রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুও হয় এই শহরে।    

    কিছুদিন আগে গৌতম চক্রবর্ত্তী আনন্দবাজারে বারাণসীর ছেলে মুনসী প্রেমচন্দের ১৯১৮ সালে প্রকাশিত  সাড়া জাগানো উপন্যাস “সেবাসদন” নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেই আলোচনায় উঠে এসেছে বিংশ শতাব্দীর (প্রাক স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার পর) কাশীর সাংষ্কৃতিক পরিবেশ।  সেবাসদন উপন্যাসের নায়িকা ব্রাম্ভনের মেয়ে সুমন। বিয়ের আগে পিতৃগৃহে সে নাচ আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছে। 

    বৃদ্ধ স্বামী কে ছেড়ে সে কাশীর মন্দিরে সাধু সন্তদের সামনে গান গায়, নাচে।

    গৌতম লিখেছেন~

    ——————

    নাচনেওয়ালী? মন্দিরের চাতালে সাধুসন্ত ও দর্শনার্থী দের ভীড়ে শিবলিঙ্গের সামনে নাচছে গল্পের নায়িকা সুমন। সে যদি খারাপ মেয়ে হয়, তাহলে সে মন্দিরে কি ভাবে নাচে? সাধু সন্তরা তার নাচ দেখে এত ধন্য ধন্য করে কেন?

    ————–

    ঊর্দ্দু থেকে ইংরেজীতে সম্প্রতি অনূদিত হবার আগে কেউ জানতোনা সাধুদের আশ্রমে মন্দিরে উচ্চাঙ্গ নাচ গানের এই সংষ্কৃতির কথা। নানা অনুষ্ঠানে সরস্বতী পূজোর দিন, বাইজী, মুজরো গায়িকা এমন কি বহুবল্লভারা (ঊর্দ্দুতে “তওয়াইফ”রা) বিনা পারিশ্রমিকে দশাশ্বমেধ ঘাটে নাচ গান করতে আসতেন।

    বারাণসীর ইমামবাদী বাইজীর কাছ থেকে গান শিখে প্রথম বাংলা টপ্পা গানের প্রচলন করেন নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য। অঘোর চক্রবর্ত্তীর ধ্রুপদ বা মহেশচন্দ্র সরকারের মত বীণা বাদকের শিক্ষাও এই শহরে। কথক নাচ ও ছয় মাত্রার দাদরা তালের ও বিকাশ ঘটেছিল এই শহরে। আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সঙ্গীতকার তানসেনের বংশধরেরা অনেকেই বারাণসীকে তাদের বাসভূমি বলে বেছে নেন। তৈরী হয় বেনারস ঘরানা।

    এঁদের কারুর মধ্যে ছিলনা ধর্ম বা জাত পাতের বিভেদ। কোন নোংরামীও ছিলনা, তবু স্বাধীনতার পরে সরকারের উদ্যোগে কাশীর ডালমন্ডির বাইজী মহল্লা তুলে দেওয়া হয়। যেহেতু এই তওয়াইফেরা অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান, তাই এই নিয়ে তখন খুব হৈ চৈ এবং সাম্প্রদায়িক অশান্তি শুরু হয়,  কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত জয় হয় পুরুষতন্ত্রেরই।  

    ডালমন্ডীর বাইজী প্রেমচন্দের উপন্যাসের নায়িকা সুমন বাইজী বা তওয়াইফ হলেও সে তার শরীরী সতীত্ব হারায়নি। উপন্যাসের শেষে তার স্বামীর সাথেও তার দেখা হয়।

    ৪) প্রথম সন্ধ্যা  – দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গারতি

    আমাদের ঘরটা বেশ বড়, পুপুর জন্যে একটা  আলাদা বিছানার বন্দোবস্ত করতে অসুবিধে হইয়নি।  বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের জন্যে একটা নৌকা বুক করা আছে, চেক ইন করে ঘরে মালপত্র রেখে আমরা সোজা ঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠে বসলাম।

    হোটেলটি তিনতলা। আমাদের ঘর এক তলায় হলেও নদী আরো অনেকটাই নীচে। ঘাটে যেতে সিঁড়ি বেয়ে তাই অনেকটা নামতে হলো। পাঁচটা বাজে কিন্তু তখনও বেশ আলো। দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গারতি দেখবো, সেখানে নৌকায় করে যেতে যেতে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিলা। একের পর এক ঘাট পেরিয়ে যেতে থাকলাম, আর অনেকদিন পরে চোখে পড়লো কাশীর সেই পরিচিত দৃশ্য।  সারি সারি উঁচু ইট রঙ এর বাড়ী আর জলে নেমে আসা সিঁড়ি। 

    ছোটবেলায় বাবা যখন কাশী আসতেন, তখন সবাই মিলে বিকেলে গঙ্গায় নৌকায় চড়ে অনেক দূরে চলে যেতাম। মাথার ওপরে নীল আকাশ, চারিদিকে নদীর নীল জল, মাঝির দাঁড়ের আওয়াজে জলে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আসছে, আমি চলন্ত নৌকা থেকে জলে হাত নামিয়ে দিয়ে দেখতাম কেমন ঠাণ্ডা। মণিকর্ণিকা ঘাট এলে মা বলতেন এখানে চিতার আগুণ কখনো নেবেনা। কাশীতে অনেক মরণোন্মুখ মানুষ মারা যেতে আসেন, এই ঘাটে দাহ করলে মোক্ষলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয়না।  

    এখন অবশ্য সবই ডিজেলে চালানো মটরবোট।  চারিদিকে নদীতে মটরবোটের ছড়াছড়ি। এখানে আসার আগে আমাদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল, কাশীর মশাদের কামড়ে নাকি ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া হয়। আমরা প্রতিষেধক ক্রীম গায়ে আর জামায় মেখে নিলাম। সাবধানের মার নেই।

    গঙ্গারতি নদী থেকেই দেখা হলো। দশাশ্বমেধ ঘাট তো লোকে লোকারণ্য, সামনে নদীতেও সারি সারি নৌকা, বড় বড় স্টীমার। তাতে ভর্ত্তি দর্শনার্থী ভক্তের দল। ক্রমশঃ অন্ধকার নেমে এলো, তার মধ্যে চারিদিকে জ্বলজ্বল করছে আলোর মালা। তার সাথে মাইকে শোনা যাচ্ছে ভজন আর স্তোত্রপাঠ। বেশ জমজমাট ব্যাপার।

    গঙ্গারতি এখন গঙ্গার তীরে নানা শহরে হয়। এমন কি কলকাতায়ও। এক বছর আগে সুভদ্রা আর আমি হরিদ্বারে দেখেছি।

    ৪) দ্বিতীয় দিন

    গতকাল আসা আর আগামীকাল ফেরার মাঝখানে আজ আমাদের কাশীতে একমাত্র দিন। সুতরাং এই দিনটিতে আমাদের প্রধান দুটি কাজ সারতে হবে, এক হলো মা’দের দু’জনের বাৎসরিক কাজ করা আর দুই হলো বিশ্বনাথ দর্শন।  তারপরে বাকি সময়টা আমরা যতটা পারি কাশী শহরের অন্যান্য নানা দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়াবো।  

    ভোরে  ব্যালকনি থেকে সূর্য্যোদয়

    আমাদের ঘরের পাশে বাইরে একটা ছোট ব্যালকনি আছে, পরের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সেখানে তিন জনে চা খেতে খেতে সূর্য্যোদয় দেখা হলো। মন ভাল করা দৃশ্য। সেই ভোরেই ঘাটে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। 

    ব্যালকনি তে তিন জনে চা খেতে খেতে নদী দেখতে দেখতে আমার মন চলে যাচ্ছিলো সেই ছোটবেলার কাশীতে। রাণা মহলের বাড়ীর ছাতে গেলেই  নীচে নদী দেখা যেতো, এখনকার মত তখনো পাশে চরে গাছগাছালি গজিয়ে উঠেছে। একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে দুলতে দুলতে ভেসে জলে গিয়ে পড়ছে। দূরে ব্রীজের ওপর দিয়ে গুম গুম আওয়াজ করে ট্রেণ চলে যাচ্ছে। এই সব নানা স্মৃতি।

    আজও সেই একই দৃশ্য। কিছুই যেন বদলায়নি।  দূরে চর, কাছে ঘাটে লোকে স্নান করছে, নদীর জলে এদিক থেকে ওদিক বোট আর নৌকারা ভেসে চলেছে, তাদের পিছনে পিছনে মাছের লোভে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য পাখীর ঝাঁক।

    স্নান সেরে তৈরী হয়ে সকাল সকাল হোটেলেই ব্রেকফাস্ট। এখানে নিরামিষ খাবার খুবই সুস্বাদু। গতকাল কাল ডিনার ও এখানে করেছি।  কাশীর কচুরী নাকি খুব বিখ্যাত, কিন্তু তা’ নাকি সকাল দশটার পরে আর কোন দোকানে পাওয়া যায়না।  অদ্ভুত নিয়ম। আমাদের তাই আর কচুরী খাওয়া হলোনা।

    কাশীতে ঘুরে বেড়াবার জন্যে গাড়ীর বদলে অটোই ভাল, কেননা  সরু গলির মধ্যে গাড়ী ঢোকেনা অনেক দূরে পার্ক করে হাঁটতে হয়। হোটেল থেকেই একটি গাইড ছেলে কে কাল বলে রেখেছি, সে আজ সারাদিনের জন্যে একটা অটো ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।  ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

    কাশী বিশ্বনাথ মন্দির – ভাঙা আর গড়ার ইতিহাস

    আমাদের প্রথম কাজ হলো বিশ্বনাথ দর্শন।

    হিন্দুদের জন্যে কাশীর একটি প্রধান আকর্ষন হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির।  মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। তাই মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে।

    যাই হোক, এই মন্দিরটি কবে প্রথম তৈরী হয়েছিল, তা নিয়ে নানা মতামত আছে। বারাণসীতে যে সবচেয়ে পুরনো পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তার থেকে অনুমিত হয় গাঙ্গেয় উপত্যকায় এই শহরে জনবসতি শুরু হয়েছিল খৃস্টপূর্ব একাদশ কিংবা দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই জন্য বারাণসীকে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির একটি মনে করা হয়।

    এই মন্দিরের নাম ছিল আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির।

    সেই মধ্যযূগ থেকে আমাদের দেশে পশ্চিম আর উত্তর থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বহিরাগত মুসলমান আক্রমণ হয়েছে। সেই সব আক্রমণকারীরা কেউ এসেছে সোনা দানা লুট করতে,  আবার কেউ এসেছে আমাদের দেশে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে। আমাদের ইতিহাস বইয়ের পাতায় খুললেই পড়া যায়  শুধুসেই সব যুদ্ধের কাহিনী – সেখানে শুধু তলোয়ারের ঝনঝনানি, ঘোড়াদের হ্রেষা ধ্বনি, আর যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা হাজার হাজার রক্তাক্ত মৃতদেহ। এক দিকে আল্লা হু আকবর আর অন্যদিকে হর হর মহাদেব চিৎকার!

    এই সব আক্রমণকারীদের নামের লম্বা লিস্ট। মহম্মদ ঘোরী থেকে শুরু করে  ইলতুৎমিস, ফিরোজ শা তুঘলক, কুতুবউদ্দিন আইবক্‌ …

    হিন্দু রাজাদের যুদ্ধে পরাজিত করার পর তাদের সৈন্যরা সারা দেশ জুড়ে একের পর এক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার জায়গায় মসজিদ স্থাপন করে গেছে। কিন্তু তার মধ্যেও সেই সব মন্দিরের পুনর্নিমাণ হয়েছে, ধনী এবং ধর্ম্মভীরু হিন্দু রাজা বা বণিক বা জমিদাররা সু্যোগ পেলেই সেই কাজ করেছেন।     

    এই ভাবেই যুগে যুগে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরেরও ভাঙা গড়া চলে এসেছে।

    ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট  আকবরের সময়কাল ছিল বারাণসীর সাংস্কৃতিক নবজাগরণের যুগ।   আকবর শহরটিকে সাজিয়ে তোলেন।  ১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন এবং শিব ও বিষ্ণুর দুটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। পুণের রাজা সেই সময় অন্নপূর্ণা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় শের শাহ কলকাতা থেকে পেশোয়ার  গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করার পরে এই অঞ্চলের পরিবহন পরিকাঠামোরও উন্নতি ঘটেছিল।  ষোড়শ শতাব্দী থেকে পর্যটকেরা আবার এই শহরে আসা শুরু করেন।

    আবার ১৬৬৯ সালে আওরংজেব সম্রাট হবার পরেই পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে সেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করান। এই মসজিদটি আজও মন্দিরের পাশে অবস্থিত।  ১৭০১ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ক্রমশঃ ভেঙে পড়ে, এবং ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলের শাসনভার হিন্দু সামন্ত রাজাদের হাতে চলে যায়। আধুনিক বারাণসীর বেশিরভাগটাই  অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজপুত ও মারাঠা রাজাদের হাতে তৈরি।  

    ১৭৩৭ সালে মুঘল সম্রাট কাশী রাজ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরে ব্রিটিশ যুগে কাশীর রাজাই এখানকার মুখ্য শাসক হয়ে ওঠেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাশীর রাজবংশ বারাণসী শাসন করেছিল।  

    এর পরে আসে মারাঠা ও ব্রিটিশ আমল।

    বর্তমান মন্দিরটি ১৭৮০ সালে মালহার রাও হোলকার এর পুত্রবধূ তথা হোলকার (আজকের ইন্দোর) রাজ্যের মহারানি অহল্যাবাই নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।  ভক্তিমতী ও সুশাসক হিসেবে রাণী অহল্যাবাই এর খুব সুনাম ছিল, তাঁর আমলে যুদ্ধ বিগ্রহ হয়নি, প্রজারা শান্তিতে বসবাস করতো। তিনি বহু জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।

     ১৮৩৫  সালে পাঞ্জাবের শিখ সম্রাট  রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের চূড়াটি ১০০০ কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে মুড়ে দেন।

    আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে  দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ভিতর কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির একটি বহু আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।

    পশ্চিম এশিয়াতে জেরুসালেম এও মধ্যযুগে ধর্ম্মযুদ্ধে (crusade) ক্রীশ্চান আর মুসলমানদের এই গীর্জ্জা আর মসজিদ ভাঙা গড়া হয়েছে।  ২০১৩ সালে যখন আমি জেরুসালেমে গিয়েছিলাম, তখন সেই ভাঙা গড়ার নিদর্শন আমি দেখেছি।  সেখানে উনবিংশ শতাব্দীতে অটোমানদের রাজত্বের সময় (১৮৫০) একটা “ফিরমান” জারী করা হয়, তাতে দুই পক্ষই রাজী হয় যে এর পর থেকে আর কোন ভাঙা গড়া নয়,  জেরুসালেম ও বেথেলহেমের সব গীর্জ্জা আর মসজিদই এখন যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতেই থাকবে। এই ফিরমানের নাম ছিল “Status Quo”~

    আমাদের দেশে অবশ্য এরকম কোন ফিরমান জারীর কোন প্রশ্ন ছিলনা, কেননা এখানে মুসলমান শাসকেরা এক তরফা হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করে গেছে। শোনা যায় যে কাশী শহরেই প্রায় ৩০,০০০ মন্দির ধ্বংস করা হয়,  তার মধ্যে আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির চত্বরে চল্লিশটি মন্দির ছিল।

    মূল মন্দিরের উত্তর দিকে একটি পবিত্র কূপ আছে । প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে আক্রমণকারীদের হাত থেকে জ্যোতির্লিঙ্গ কে বাঁচাবার জন্যে এক পুরোহিত নাকি মূর্ত্তি নিয়ে এই কূপটিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

    তবে ফিরমান না থাকলেও ব্রিটিশ আমল থেকেই আইন করে মন্দির মসজিদ ধ্বংস করার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরে আমাদের নিজেদের সংবিধান তৈরী হয়, যেখানে পরিস্কার লেখা আছে যে আমরা একটি ধর্ম্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক (secular, democratic) দেশ – সুতরাং এখন আর কারুর মন্দির বা মসজিদ ধ্বংস করার কোন  অধিকার নেই।

    ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির (বি জে পি) হিন্দুত্ববাদী সরকার। তাদের উদ্যোগে যে সব হিন্দু মন্দির বহিরাগত মুসলমান শাসকেরা বিশেষ করে আওরঙ্গজেব – ভেঙে বা নিষ্ক্রিয় করে তার জায়গায় মসজিদ তৈরী করেছিলেন, সেই সব মসজিদ গুলো  সব এক এক করে ভেঙে বা সরিয়ে তাদের জায়গায় ধ্বংস হওয়া মন্দিরগুলো আবার নতুন সাজে গড়ে উঠছে। প্রথমে অযোধ্যায় রামজন্মভূমি তে বাবরী মসজিদ ভেঙে রামলালা (শিশু রামের)  সরযু নদীর তীরে বিশাল বর্ণাঢ্য মন্দির তৈরী হলো, আর তার পরে সম্প্রতি কাশীতে জ্ঞানব্যাপী মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে নতুন বিশ্বনাথ এর মন্দির চালু হয়েছে। এর জন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বি জে পি কে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে অনুমতিও পেতে হয়েছে। বিশ্বনাথ মন্দিরের আশেপাশে চল্লিশটিরও বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত, শতাব্দী প্রাচীন মন্দির পাওয়া গেছে এবং তার প্রত্যেকটিই পুনর্নির্মিত হয়েছে।

    জ্ঞানবাপী মসজিদ কে দূরে কোথাও সরিয়ে দেওয়া হবে  আদালত থেকে এই নির্দ্দেশ দেওয়া হয়েছে।

    এর পরে মথুরায় বিষ্ণু মন্দির নতুন করে তৈরী করবার জন্যে আদালতের নির্দেশের অপেক্ষা করা হচ্ছে।

    বিশ্বনাথ দর্শন। 

    আজ সকাল দশটায় কাশী বিশ্বনাথ  মন্দিরে আমাদের টিকিট কাটা আছে। তাই বিশ্বনাথ দর্শন আজকে আমাদের প্রথম কাজ।  

    আমার ছোটবেলায় কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে যাবার জন্যে একটা সরু গলি ছিল, তার নাম ছিল বিশ্বনাথের গলি।  তার দুই পাশে দোকান আর নানা ছোট মন্দির ছিল, আর ছিল গিজগিজে ভীড়। নদী থেকে মন্দিরে প্রবেশ করার কোন ঘাট বা রাস্তা  ছিলনা।

    জায়গাটা ২০২২ সালের পরে আমূল পাল্টে গেছে।

    আগের সেই বিশ্বনাথের সরু গলি আর নেই।  ঠাসাঠাসি ভীড় ও নেই। সেখানে এখন বেশ চওড়া একটি রাস্তা। এখন মন্দিরের চত্বরটি বিশাল করা হয়েছে, সেই চত্বর এখন পরিস্কার ঝকঝকে সেখানে মার্বেলের সাদা মেঝে। ভীড় কমানোর জন্যে ইন্টারনেটে আগে থেকে টিকিট কেনার বন্দোবস্ত হয়েছে।

    এখন Internet এ আগে থেকে পাস নিতে হয়, আমাদের তিন জনের পাস আজ সকাল দশটায়। এখন গলি দিয়ে না গিয়ে নদীর ঘাট থেকেও মন্দিরে ঢোকার বন্দোবস্ত হয়েছে। আমরা আগে বড় রাস্তার ধারে একটা দোকানে প্রসাদ আর পূজোর জিনিষ পত্র কিনে সেখানে চটি রেখে মন্দিরে ঢুকলাম।

    বিশ্বনাথ মন্দিরের ভেতরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়।   মার্বেল পাথরে বাঁধানো ঝকঝকে পরিস্কার  বিশাল  প্রাঙ্গন।  সেই চত্বরে দেখা যায় অনেক ছোট ছোট মন্দির। মাঝখানে বিশ্বনাথের মন্দির, মাথার ওপরে সোনার চূড়া। সামনে ঢোকার জন্যে ছোট সুশৃঙ্খল লাইন। সময় অনুযায়ী ব্যাচে ভাগ করাতে কোনরকম বিশৃঙ্খলা নেই, আমাদের লাইনে মাত্র কুড়ি ত্রিশ জন পুরুষ  নারী ও শিশু, প্রতেকের হাতে টিকিট। সেই টিকিট দেখার জন্যে একজন গার্ড মন্দিরের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছে।   

    সব মিলিয়ে অতি সুন্দর বন্দোবস্ত। ভাল ভাবে দর্শন আর পূজো হলো। তার পরে গেলাম অন্নপূর্ণার মন্দির, এবং এক এক করে আরো অনেক মন্দির যা ওই বিশাল পাথরে বাঁধানো পরিস্কার চত্বরে ছড়িয়ে আছে।

    মা’র কথা ভাবছিলাম। ভীড়ের মধ্যে কত কষ্ট করে দর্শন করতেন মা। খুব শিবে ভক্তি ছিল তাঁর।

    শুধু মন্দির নয়। চত্বরের ভিতরে চারিপাশে লাইব্রেরী,  ভি আই পি লাউঞ্জ, মিউজিয়াম, কনফারেন্স রুম, আরও কত কি! এলাহী ব্যাপার।

    বেরোবার সময় দেখি আগাপাস্তলা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা জ্ঞানব্যাপী মসজিদ। কোন লোক নেই সেখানে, এখানে এখন আর কোন নমাজ পড়া হয়না। কিছু সিকিউরিটির লোক পাহারা দিচ্ছে যাতে কোন গোলমাল না হয়। হয়তো কিছুদিন পরে এই মসজিদ ভেঙে ফেলা হবে।

    কালভৈরবের মন্দির

    বিশ্বনাথ দর্শনের পর কিছুটা দূরে গিয়ে কালভৈরবের মন্দির।  সরু গলির ভিতরে ঢুকতে হবে, তাই আমাদের অটো দূরে পার্ক করে রেখে আমরা কিছুটা হেঁটে দর্শন করে এলাম। তখন বেলা বারোটা হবে, গলিতে বেশ ভীড়, সবাই মন্দিরেই যাচ্ছে, গলির দুই পাশে অনেক দোকান, সেখানে কালভৈরবের ছবি সহ নানা পূজোর সামগ্রী বিক্রী হচ্ছে।

    আমি কালভৈরবের মন্দিরে আগে আসিনি, এই প্রথম।

    তবে বহু দিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রথম আলো” উপন্যাস পড়ার সময়  তাঁর নাম জেনেছিলাম। সেই উপন্যাসে এক জায়গায়  ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্রমানিক্য তাঁর সঙ্গী শশীভূষনের সাথে জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে এক জায়গায় গিয়ে একটি ভাঙ্গা মন্দির এবং তার পিছনে পাহাড়ের গায়ে একটি ছবি দেখতে পান্‌,  তিনটি  চোখ, আর পাশে একটি ত্রিশুল!

    বীরচন্দ্র অবাক বিষ্ময়ে বলে ওঠেন – “কালভৈরব!”

    জায়গাটার নাম উনকোটি অর্থাৎ এক কোটি থেকে এক কম। সেখানে নির্জন জঙ্গলে পাহাড়ের গায়ে নাকি শত সহস্র হিন্দু দেবদেবীর ছবি আর মূর্ত্তি রাখা আছে।  

    শুনলাম যেএই কাল ভৈরবের মন্দির কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আর কাশী এলে কালভৈরবকে একবার সব ভক্তই দর্শন করে পূজো দিয়ে যান্‌। আমরাও তাই করলাম।   

    এই কালভৈরব  কিসের দেবতা? 

    হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, কাল ভৈরবের মন্দিরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন শিবের রুদ্র রূপের এক মূর্তি। এই মন্দিরের প্রধান দেবতা, ভগবান কাল ভৈরব, ভগবান শিবের ভয়ঙ্কর প্রকাশ বলে বিশ্বাস করা হয়।  কাল ভৈরব হলেন শক্তির আধার। শিবের জ্বলন্ত প্রচণ্ড রূপকেই কাল ভৈরব হিসেবে ধরা হয়।  তাঁকে বলা হয় কাশীর কোতওয়াল বা কাশীর রক্ষাকর্তা।   হিন্দুদের বিশ্বাস, কালভৈরব প্রাচীন শহর বারাণসী ও শহরবাসীদেরও রক্ষা করেন।

    হিন্দু পুরাণে বাবা কাল ভৈরবকে ঘিরে নানা কাহিনির উল্লেখ আছে। মনে করা হয়, তিনি হলেন মহাদেবেরই আর এক রূপ। কাল ভৈরবের মন্দিরে দর্শন করলে জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

    আমার মনে পড়ে ১৯৬২ সালে, তখন আমি স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি, চীনের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবার পরে জনসাধারণ কে  অনুপ্রাণিত করার জন্যে রেডিওতে রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রায়ই বাজানো হতো – “হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত পানে চাহো…”

    ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে পিন্ডদান

    কালভৈরব মন্দির থেকে বেরিয়ে আমাদের আসল কাজ।  ভারত সেবাশ্রমের মন্দিরে মা আর আমার শ্বাশুড়ীর পিণ্ডদান। বেলা বারোটায় সময় দেওয়া আছে, তার একটু আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম। 

    শহরের অপেক্ষাকৃত পরিস্কার জায়গায় বেশ চওড়া বড় রাস্তার ওপরেই ভারত সেবাশ্রমের মন্দির, আর থাকার জন্যে ধর্মশালা। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে একটি বড় মন্দির, এবং ডান দিকে একটি তিনতলা বাড়ী, সেখানে মনে হলো একটি হোটেল বা ধর্ম্মশালা আছে, বেশ কিছু পরিবারকে সেখানে দেখলাম, কাশীতে এলে অনেকেই এখানে এসে ওঠেন। বিশেষ করে বাঙালীদের জন্যে এই ধর্ম্মশালা খুব জনপ্রিয়, বোধহয় শুদ্ধ নিরামিষ বাঙালী খাবার, পরিস্কার থাকার জায়গা, আর সস্তা বলেই।  

    আমাদের পুরোহিত ছোটু মহারাজ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।  দুজনে একসাথে পিন্ডদানের পুজো করলাম। পুরোহিত ভদ্রলোক সব কেনাকাটা এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন।

    বেশ নিষ্ঠার সাথে তিনি পূজো করলেন, মনে হলো এই কাজে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের কাজ হয়ে গেল।

    আমার মা আর আমার শ্বাশুড়ীর আত্মার শান্তি হোক। ওঁদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হলো পিন্ড পেতে। এক বছরের মধ্যে পিন্ড দেবার কথা, কিন্তু অবশ্য বাৎসরিক কাজ বাড়িতে করেছি এক বছর পরে। কিন্তু এখন তাঁদের আত্মার সদগতি হল, তাঁরা এখন নিশ্চিন্তে বৈতরনী পার করে স্বর্গে  চলে গেছেন। সেখানে তাঁদের এখন অপার শান্তি।

    মনে মনে একটা দৃশ্য কল্পনা করছিলাম, মা’র অশরীরী প্রেতাত্মা  বৈতরণী পার হতেই দেখছেন, দিদা মামা মাসী বাবা এবং তাঁর অন্যান্য প্রিয়জনেদের প্রেতাত্মারা  তার জন্যে নদীর ওপারে অপেক্ষা করছেন। কত দিন পরে আবার তাঁদের সাথে মা মিলিত হলেন।  

    ছোটু মহারাজ কে বিদায় জানাবার আগে তাঁর সাথে একটা ছবি তোলা হলো।

     বাটি চোখা

    এর পরে ছেলেটি আমাদের নিয়ে গেল “বাটি চোখা” নামে একটি দামী রেস্তোরাঁয়। কাশীতে এই রেস্তোঁরাটি নাকি খুব বিখ্যাত।

    ডাইনিং রুম টা দোতলায়। ঢোকার পথে  নীচে দেখি বেশ কিছু মহিলা ঘোমটা পরে ময়দা বেলছেন আর তরকারী কাটছেন। বেশ বড় রেস্তোরাঁ, আর বেশ ভীড় । মেনু হলো মোটা মোটা রুটির সাথে ডাল আর পাঁচমিশেলী তরকারী। গাইড ছেলেটিও খেলো আমাদের সাথে।  

    এই খাবারটা নাকি এখানে প্রচন্ড জনপ্রিয়। আমার অবশ্য খাবারটা তেমন কিছু ভাল লাগলোনা।  বেশ অখাদ্যই বলা যায়। এত মোটা রুটি আর ডাল তার সাথে কিছুটা বিস্বাদ তরকারী – অন্ততঃ আমার কাছে – কে আর ভালবেসে খায়?

    শেষ পাতে অবশ্য উত্তর ভারতের মিষ্টি  – বরফি, লাড্ডু, কালাকাঁদ, ইত্যাদি ছিল, সাথে  মিষ্টি  লস্যি।

    বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি

    লাঞ্চের পরে  আমরা গেলাম  BHU ক্যাম্পাস দেখতে। তখন বেলা প্রায় তিনটে।

    একটা তো মাত্র দিন তার মধ্যে যতোটা পারি ঘুরে দেখা।

    বেশ বড় আর সুন্দর সবুজ গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা সুন্দর BHU ক্যাম্পাস, এখন তার একটা ভাগ IIT হয়েছে।  কিন্তু যেহেতু একবারে শহরের মাঝখানে, তাই ক্যাম্পাসের ভিতর যেন শান্তি ও নীরবতার কিছুটা অভাব।  সাইকেল রিক্সা আর বাস চলছে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে কিছু লোক।

    ছাত্রাবাসগুলো রাস্তার ধারে। 

    ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশ বাহিনী এখানে একদল বিদ্রোহী ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে। থিওসফির প্রচারে অ্যানি বেসান্ত এখানে এসেছিলেন। “সকল ধর্মের মানুষকে একই ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করতে এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধের প্রচার ভারতবাসীর মন থেকে সকল কুপ্রথা দূর করতে” তিনি এখানে সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। ১৯১৬ সালে এই কলেজটি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

    আমাদের দেশের এটি একটি প্রধান এবং স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়, এখান থেকে আমার মামা স্বর্গীয় ধ্রুবনারায়াণ বাগচী ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করেছিলেন। পরে আমার মামাতো ভাই ভাস্বর ও তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখান থেকেই ইঞ্জিনীয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করে। আমার বন্ধুদের মধ্যেও অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে।   

    সঙ্কটমোচন মন্দির

    ক্যাম্পাসে ঘুরে আমরা গেলাম সঙ্কটমোচন – হনুমানের মন্দিরে। 

    ভারত ও ভারতের বাইরে হনুমান মন্দির আছে অসংখ্য, তবে কাশীধামের এই সংকটমোচন মন্দিরটি সবচেয়ে জাগ্রত বলে পরিচিত।  হনুমানজী কাশীর এই মন্দিরে অবস্থান করে ভক্তদের জীবনের নানা সঙ্কট থেকে মুক্ত করেন।   

    অনেকটা জায়গা নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ।  প্রাঙ্গনের ভিতরে অনেক বড় বড় গাছ,  ঢুকতেই বাঁ পাশে সংকটমোচন, আর ডানদিকে শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির। মন্দির দু’টি মুখোমুখি। ভাবটা এমন, রাম ছাড়া হনুমান চলবে না। হনুমান ছাড়া রামের এক পা যাওয়ার জো নেই।  

    হনুমানজীর মন্দিরে হনুমান থাকবেনা তা তো আর হয়না। দেখি প্রকান্ড ল্যাজ ঝুলিয়ে  ডালে ডালে বসে আছে অনেক মুখপোড়া হনুমান। কাউকে প্রসাদ দিতে দেখলই তারা দল বেঁধে গাছ থেকে নেমে আসে। তাদের বেশ আগ্রাসী মনোভাব।

    সংকটমোচন মন্দিরে সিঁদুর রাঙানো হনুমানজি ছাড়াও আছে বিশ্বনাথ মহাদেবের একটি লিঙ্গ বিগ্রহ। বিপরীতে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সীতা ও লক্ষ্মীজির সুসজ্জিত বিগ্রহ।

    মন্দিরের সামনে ভীড় আর লম্বা লাইন। মাঝে মাঝেই ভক্তদের জোর গলায় আওয়াজ ভেসে আসছে “ভারত মাতা কি জয়!”  

    বেনারসী শাড়ী

    এর পরে বেনারসী শাড়ী কেনা।

    গাইড ছেলেটি আমাদের নিয়ে গেল একটি গলির মধ্যে এক বিরাট শাড়ীর আড়তে। সেখানে দোতলায় মাটিতে বসে চারিদিকে শাড়ী বিছিয়ে আমাদের শাড়ী দেখালেন এক মধ্যবয়েসী  ভদ্রলোক – তাঁর চোখে মুখে কথা।  চমৎকার ব্যক্তিত্ব, রসিক মানুষ, খদ্দের কে বাগে আনার অসীম ক্ষমতা। তিনি দোকানের ম্যানেজার না মালিক ঠিক বোঝা গেলনা। কিন্তু সেলসম্যান হিসেবে দুর্দ্দান্ত। এঁর কাছে এসে কিছু না কিনে ফেরা প্রায় অসম্ভব। 

    তিন খানা দামী শাড়ী তিনি অবলীলায় গছিয়ে দিলেন আমাদের।

    অবশ্য আমাদের তো তিনটেই দরকার ছিল। দুই মেয়ে আর সুভদ্রা। ভালোই হলো ওরা পছন্দ করে কিনলো।  সামনে আমাদের বিয়ের সুবর্ণবার্ষিকী, সেই অনুষ্ঠানে মেয়েরা দু’জন এই বেনারসী শাড়ী পরবে।

    আমার ছোটবেলায় বিশ্বনাথের গলির মোড়ে অনেক বেনারসী শাড়ীর দোকান ছিল, আমার মনে পড়ে একবার ছোড়দাদুর (দিদার ছোট ভাই দূর্গাপ্রসন্ন আচার্য্য, মা’র ছোটমামা) বড় মেয়ে রমা মাসীর বিয়ের বেনারসী কেনার ভার পড়েছিল মা’র ওপর। অনেক দোকান ঘুরে অনেক বাছাবাছি করে মা একটা বেশ দামী লাল বেনারসী পছন্দ করেছিলেন।

    আমার ছোটবেলার কাশীর স্মৃতির মধ্যে বিশ্বনাথের গলিতে বেনারসী শাড়ীর দোকানে এক গাদা শাড়ীর পাহাড়, তার মধ্যে মা শাড়ী বেছে যাচ্ছেন, আমি পাশে বসে, আমার বয়েসী খুব মিষ্টি দেখতে একটি ছোট্ট মেয়ে – সম্ভবতঃ দোকানদারের মেয়ে – বিনুনী করে পরিপাটি চুল বাঁধা, একটা লাল ডুরে শাড়ি পরে এক পাশে বসে চুপ করে মা’র শাড়ী বাছা দেখতো, তাকেও ভুলিনি।

    রাবড়ী, পান, আর সান্ধ্য নৌকাভ্রমণ

    শাড়ী কিনে হোটেল ফেরার পথে বেনারসের বিখ্যাত রাবড়ী আর পান না খেলে কি করে হয়?

    শেষে হোটেলে যখন পৌছলাম, তখনও বাইরে দিনের আলো। ঘরের পাশে বারান্দায় সামনে নদী দেখতে দেখতে চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজও একটা নৌকা ভ্রমণ হলো। প্রায় রেল ব্রীজ পর্য্যন্ত চলে গেলাম আজ।  তার পর মণিকর্ণিকা আর হরিশচন্দ্র ঘাটের শ্মশান দেখে অসি ঘাট পর্য্যন্ত গিয়ে ফিরলাম।

    আজও রাত্রে দশাশ্বমেধ ঘাটে আর অসি ঘাটে গঙ্গারতি হচ্ছে দেখলাম, নদীর জলে আর ঢেউতে সেই আরতির আলোর ছায়া কাঁপছে।  

    দেখতে বেশ লাগছিল। 

    এবার মাত্র এক দিনের জন্যে কাশী এসেছিলাম আমরা। বড্ডই কম সময়। আর একটা দিন বেশী থাকলে আমরা সারনাথ আর রামনগরে কাশীর রাজার (নরেশ) প্রাসাদ আর দূর্গ দেখে আসতে পারতাম। কিন্তু এই ভাবেই এই ট্রিপ টা প্ল্যান করেছিলাম, তাই এখন আর কিছু করার নেই। পুপুকেও লন্ডনে ফিরতে হবে, তার ছুটি কম, ফেরার টিকিট ও কাটা হয়ে গেছে। কালকে দুপুরে আমাদের কলকাতার ফ্লাইট, পুপু আর আমি ঠিক করলাম যে ভোরবেলা দু’জনে মিলে নদীর ধার ধরে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্য্যন্ত হাঁটবো।

    ৫) তৃতীয় এবং শেষ দিন

    আজ আমাদের ফেরা।  ব্রেকফাস্টের পরে হোটেল থেকে চেক আউট করে এয়ারপোর্ট।

    তার আগে কথামতো ভোরবেলা আমি আর পুপু ঘুম থেকে উঠে একটু নীচে নদীর ধারে হেঁটে এলাম। একটার পর একটা ঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি, নদীর ধারে লোকের ভীড় বাড়ছে, কিছু কিছু জায়গায় পূজোয় বসেছে পুরোহিতেরা, তাদের যজমানেরা তাদের ঘিরে গোল হয়ে বসেছে। অনেকের খালি গায়ে পৈতে, অনেকের মাথা ন্যাড়া। সবাই ধর্ম্মপ্রাণ হিন্দু। নদীর পাড়ে প্রায়ই চোখে পড়ছে লাল রং এর শিব মন্দির, আর মন্দিরের পাশে বট বা অশ্বথ গাছ, তাদের ডালে বাঁদরের দল।

    “নৌকা চড়বেন বাবু?” বলে অনেক বোটের চালকরা এসে আমাদের ধরছে। নদীতে অনেক মাছধরা নৌকা। মাছের লোভে তাদের পিছন পিছন উড়ে যাচ্ছে সাদা সারস পাখীরা। 

    অনেকটা দূর হেঁটেছিলাম আমরা দু’জন সেদিন।

    হরিশ্চন্দ্র আর মণিকর্ণিকা ঘাটে চিতাকাঠের স্তুপ রাখা। জ্বলন্ত চিতার ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস কিছুটা বন্ধ হয়ে আসে। মৃতের আত্মীয়রা এবং প্রিয়জনেরা মুখ ম্লান করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

    ঘাটের পাশে উঁচু উঁচু লাল রং এর সব বড় বড় বাড়ী।  অনেক দূরে কিছুটা ছায়ায় ঢাকা রেল ব্রীজ। নদীর ওপারে চর, সেখানে গাছপালার মাঝে কিছু ঘরও চোখে পড়ে। ওই চরেও মানুষ বাস করে? কি জানি, হবেও বা।

    সেদিন সকালে পুপুর সাথে কাশীর ঘাটে অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময়    মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলায় আমি আর আমার সমবয়েসী মাসতুতো ভাই রঞ্জু এরকম সারাদিন কাশীর ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম।

    একবার ছিলাম শুধু আমি আর মা। সেদিন বোধহয় মাসীরা সবাই  ফিরে গেছেন, বাড়ীতে শুধু আমি আর মা। আমরাও পরের দিন ট্রেণ ধরে ফিরে যাবো। তাই আমাদের মন খারাপ।

    মা বললেন চল্‌ মান্টু আমরা দু’জন নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি। সাধারণতঃ কাশীতে গেলে আমি মা’কে কখনো একা পেতামনা। আশে পাশে অনেকে থাকতো, দিদা, মাসীরা। তাছাড়া মা’র মধ্যে ভালবাসার প্রকাশ তেমন ছিলনা। জড়িয়ে ধরা বা মাথায় হাত বোলানো, বা আদর করা, এই সব মা’র স্বভাবে ছিলনা। বরং কারণে অকারণে  তাঁর শাসনেই আমি বেশী অভ্যস্ত ছিলাম।    

    এখনো মা’র সঙ্গে কাটানো সেই পড়ন্ত সন্ধ্যয় কাশীর গঙ্গার ঘাটে হাঁটার  কথা মনে পড়ে।  বোধ হয় চৌষট্টি ঘাট থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্য্যন্ত হেঁটেছিলাম আমরা দু’জন। কিছু কি কথা হচ্ছিল আমাদের মা আর ছেলের মধ্যে? দুজনের পৃথিবী আলাদা, দুজনেই হয়তো নিজের নিজের চিন্তায় মগ্ন ছিলাম।

    সেদিন আমার জন্যে একটা অপ্রত্যাশিত আনন্দ অপেক্ষা করে ছিল।

    ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটি লোক গুড় আর বাদামের মিষ্টি চাকতি বিক্রী করছিল। আমার বোধ হয় একটু লোভ হয়ে থাকবে, কিন্তু আমি না চাইতেও  মা আমায় একটা চাকতি কিনে দিয়েছিলেন।  কি জানি হয়তো লোভী চোখে তাকিয়েছিলাম, মা লক্ষ্য করে থাকবেন। বেশী দাম ছিলনা, এক আনা বা দুই আনা হবে, কিন্তু সেই যুগে হয়তো অনেক। ছোটবেলায় ওই সব খাবার খুব প্রিয় হয়, নিজে কিনে খাবার তো সুযোগ ছিলনা, সেই জন্যেই হয়তো। 

    খুব ভাল লেগেছিল মনে পড়ে। আবার একটু হালকা অস্বস্তিও হয়েছিল, কেননা ওই বয়সেও আমি জানতাম আমরা গরীব, জীবিকার জন্যে মা’কে চাকরী করতে হয়, মা’র কাছে হয়তো এটা একটা বাজে খরচ, তাছাড়া রাস্তার জিনিষ কিনে খাওয়াও তো মা পছন্দ করেননা।

    কিন্তু আজ নিজে থেকেই …

    মা’র কাছ থেকে তাঁর এরকম অপ্রকাশ্য অন্তঃসলিলা ভালবাসা পাবার আরও অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, কিন্তু কাশীর ঘাটে সেই সন্ধ্যায় আমায় বাদামের চাকতি কিনে দেবার ঘটনাটা  এই জন্যে এখানে লিখলাম যে এতদিন পরে বার্দ্ধক্যে পৌঁছে কাশীর ঘাটে এখন আমি আর আমার মেয়ে পুপু। সে এখন আমার জীবনে আমার মা’র জায়গাটা নিয়ে ফেলেছে। আমার মা’র মতোই আমার প্রতি তার অকৃত্রিম আর শর্ত্তহীন ভালবাসা।  তবে সেই  ভালবাসা আর তার দুশ্চিন্তা অবশ্য অনেক বেশী প্রকাশ্য।

    যাই হোক, দু’জনে মিলে অনেকটা হাঁটলাম সেদিন ভোরে। হোটেলে ফিরে এসে স্নান সেরে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়লাম।

    হোটেলের লোকেরা আমাদের মাল  পৌঁছে দিল বড় রাস্তায়, সেখানে তার গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিল ভোলা। সে আমাদের পোঁছে দিল কাশী এয়ারপোর্টে।

    হোটেলের দুই কর্মচারী আর ড্রাইভার ভোলার সাথে ফেরার দিন

  • হস্তীদর্শন, পিনাওয়ালা,  শ্রীলঙ্কা, ফেব্রুয়ারী, ২০১২

    ১) শ্রীলঙ্কা – প্রথম দর্শন

    আমরা কুয়েতের বন্ধুরা শ্রীলঙ্কা বেড়াতে এসেছি। কুয়েত থেকে রাতের ফ্লাইট ধরে ভোর চারটে তে আমরা কলম্বো তে land করলাম। কলম্বো এয়ারপোর্ট টা বেশ ভালই লাগল, অত ভোরে ভীড় ও কম, ভিসা আগে থেকেই করা ছিল, তাই ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসতে বেশী সময় লাগলোনা আমাদের কারুর। সবাই এক এক করে বেরিয়ে এসে একটা বিরাট হলঘরে জড়ো হলাম, সেখানে আমাদের জন্যে একটা বোর্ড হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট  Jet Wing Travel থেকে আসা একটি যুবক। বোর্ডে লেখা “Mr. Prodosh Mitra and Party”!

    ছেলেটির নাম সুভাষ। বেশ চেনা বাঙালী নাম। তবে সে অবশ্য তামিল। এই ট্রিপে সে আমাদের গাইড। সুভাষ কে আমাদের বেশ ভাল লেগে গেল, সে বেশ প্রিয়দর্শন এবং আলাপী , তার কথাবার্ত্তা বেশ ভদ্র। অত সকালেও এয়ারপোর্টে দোকানপাট সব খোলা, ওখানকার স্থানীয় টাকা তোলা, টেলিফোনের সিম কার্ড কেনা ইত্যাদি নানা কাজে   প্রথম থেকেই সুভাষ এই সব নানা কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো।

    তারপর বাইরে গিয়ে বাসে ওঠা। বেশ বড় বাস। আমরা যে যার মতো যে যেখানে পারি  সীট নিয়ে বসে পড়লাম।

    আজ আমরা ক্যান্ডি যাবো। সারা রাত প্লেনে ঘুম হয়নি, চোখ জ্বালা করছে, সুভাষ বললো তোমাদের কাছেই নিগম্বো নামে একটা শহরে আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে তোমরা স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। তারপর আমরা ক্যান্ডি রওনা হব।

    বাসের জানলা দিয়ে ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম, কলম্বো শহর ছাড়িয়ে এসেছি, জায়গাটা বেশ লাগছে, পরিস্কার রাস্তা, পাশে সুন্দর ছিমছাম বাড়ি, প্রায় সব বাড়ীর সামনে গেটের পাশে বুগনভিলিয়ার ঝাড় লালে লাল হয়ে ফুটে আছে। দক্ষিণ ভারতের (কেরালা, তামিলনাডু) সাথে মিল আছে আমার মনে হলো, যেন আমরা মাদুরাই বা কোয়েমবাটোরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।

    এদিকে সুভাষ একটা মাইক হাতে নিয়ে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা, তার দুই মেয়ে, তাদের মধ্যে একজনের আবার আজই জন্মদিন! মেয়ের জন্মদিনে সে থাকতে পারছেনা, আমরা সমবেদনা জানালাম।

    তার পরে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস। সেই বুদ্ধদেবের সময় থেকে শুরু।  

    শুনতে শুনতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে রামায়ণের যুগের কথা ভাবছিলাম। ছোটবেলায় আমার রামায়ণের বইতে দুটো ছবির কথা আমার খুব মনে পড়ে। এক হলো হনুমান তার ল্যাজে আগুণ লাগিয়ে লঙ্কা শহরে এক বাড়ির ছাদ থেকে আর এক বাড়ির ছাদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর অন্য ছবিটা অশোকবনে সীতা, একটা গাছের তলায় বেদীতে বসে। তার চারিপাশে অনেক মহিলা, তারা সবাই মানুষের মতোই দেখতে, তাদের রাক্ষুসী বলে মনেই হয়না। একজন তো বেশ সুন্দরী, তিনি নিশ্চয় বিভীষণের বৌ সরমা।

    এই অশোকবনটা কোথায়? সেখানে একবার গেলে হয় না?

    আমাদের ছোটবেলায় Ceylon Radio খুব জনপ্রিয় ছিল, শ্রীলংকার নাম ছিল সিংহল।

    আমাদের মধ্যে অমিতাভর ইতিহাস এর জ্ঞান সবচেয়ে বেশী, সে বলল সিংহল নামটা এসেছে বাংলার রাজা বিজয় সিংহের নাম থেকে। এই নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা আছে।

     অমিতাভর প্রায় পুরো কবিতা টা মুখস্থ, সে গড়গড় করে আবৃত্তি শুরু করে দিলঃ

    আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়/

    সিংহল নামে রেখে গেল নিজ শৌর্য্যের পরিচয়/ ইত্যাদি।

    এই সব হতে হতে আমরা নিগম্বো পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রের তীরে Jet Wing Group এর বিরাট হোটেল।

    আমি তুতু কে বললাম বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে তার সাথে নিগম্বোর খুব মিল, বলো তো কি? আমাদের সকলের শরীরে ওই জিনিষটা আছে।

    তুতু ঝঙ্কার দিয়ে উঠে আমায় এক ধমক দিয়ে বলে উঠলো জানি জানি, তোমাকে আর বলতে হবেনা।

    এ কি রে? দিল্লীর মেয়ে হয়ে তুতু বাংলা এত ভাল জানলো কি করে?

    ২) মানবিক আর পাশবিক

    নিগম্বোর  হোটেল টা বেশ লাগলো আমাদের, স্নান টান সেরে রাতজাগার ক্লান্তি ধুয়ে ফেলে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে এলাম সবাই রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের বিরাট কাঁচের জানলা দিয়ে দেখা যায় পাশেই বিরাট সমুদ্রসৈকত, ধূ ধূ বালি, তার মধ্যে জেলেরা তাদের জাল শুকোচ্ছে, কিছু নৌকা ও সেই বালির মধ্যে দেখা গেল।

    আজকে আমরা ক্যান্ডি যাবো । রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শহর।

    ক্যান্ডি যাবার পথে অনেক গুলো স্টপ্‌ যার মধ্যে প্রথম হল  পিনাওয়ালা হস্তী অনাথ আশ্রম   (Elephant Orphanage), United Nations এর হেরিটেজ সাইট্‌, পৃথিবীর বৃহত্তম Elephant reserve,  এবং পর্য্যটকদের জন্যে শ্রীলঙ্কার একটি অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। 

    নিগম্বো থেকে পিনাওয়ালা খুব বেশী দূর নয়, ঘণ্টা দেড়েকের পথ। এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে, দু’দিকে সবুজ পাহাড়, মাঝে মাঝে পথের পাশে চালাঘর আর দোকান, কিছু হোর্ডিং ও চোখে পড়লো, তাতে শাড়ি আর গয়নার বিজ্ঞাপন, শ্রীলঙ্কার সুন্দরী মেয়েরা সেজেগুজে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের চোখে তাদের আহামরি কিছু সুন্দর লাগছেনা যদিও। মাহিলা জয়বর্ধন আর কুমার সঙ্গকারার কিছু ছবি ভেবেছিলাম দেখবো, কিন্তু না, আমাদের দেশের মত এখানে ক্রিকেটাররা মডেলিং এ আসেনি, তারা মন দিয়ে তাদের খেলাটাই খেলছে।

    হাতি দের নিয়ে মানুষের মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে, তার প্রধান কারণ বোধহয় তাদের ওদের বিরাট শারীরিক আয়তন। পৃথিবীর অন্যান্য জীবজন্তুর সাথে তুলনা করলে হাতিদের কেমন যেন আলাদা বলে মনে হয়, অতবড় শরীর, লম্বা শুঁড়, তারা যেন সেই আদিম ডাইনোসরদের বংশধর, মানুষের বহু আগে থেকে তারা এই পৃথিবীতে বাস করছে। ফলে মানুষদের থেকে আরো লম্বা সময় ধরে তাদের বিবর্তন (evolution) হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।

    আমাদের এই পৃথিবীতে মানুষের সাথে বসবাস করছে অসংখ্য জীব জন্তু, পতঙ্গ, পাখী, জলচর প্রাণী, মানুষের মতই তারাও লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পেরিয়ে এসেছে  বিবর্তনের নানা ধাপ। আমরা সাধারণ মানুষেরা তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিনা, চিড়িয়াখানায় তাদের খাঁচায় বন্দী অবস্থায় অথবা জঙ্গল সাফারীতে জীপে চড়ে অভয়ারণ্যে প্রকৃতির কোলে তাদের নিজেদের স্বাধীন পরিবেশে দেখি। একই পৃথিবীতে মানুষের সাথে এদের বাস, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তাদের কোন ভূমিকা নেই।

    আমরা সভ্য মানুষেরা আমাদের মন অনূভূতি আর মস্তিষ্ক আছে বলে গর্ব্ব করি, পৃথিবীর জীবজগত কে আমাদের সমকক্ষ বলে মনে করিনা। আমাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল যে আমরা হলাম বুদ্ধিমান আর মানবিক, আর ওরা হলো বুদ্ধিহীন, পাশবিক, হিংস্র। প্রকৃতি এবং বিবর্ত্তন ওদের আমাদের সমতুল্য করে তৈরী করেনি।  

    প্রানীবিজ্ঞানীরা কিন্তু আমাদের চারিপাশের জীবজগতের নানাবিধ কান্ডকারখানা দেখে একান্তভাবেই  বিস্মিত এবং অভিভূত।

    পরিযায়ী পাখিরা অথবা কিছু জাতের প্রজাপতি কি আশ্চর্য্য দক্ষতায় লক্ষ লক্ষ মাইল আকাশে পরিক্রমা করে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যায়। অলিভ রিডলি কচ্ছপেরা বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ডিম পেড়ে সমুদ্রে ফিরে যায়।  ফুলেরা ঠিক এক সময়ে সকালে অথবা বিকেলে নিয়ম করে ফুটে ওঠে প্রজাপতিদের আকর্ষন করার জন্যে।

    এসব কি করে হচ্ছে?  এর থেকে কি প্রমাণ হয়না যে প্রাণীদের মধ্যেও মানুষের মতই সময় আর দিক নির্নয় করার ক্ষমতা আছে, নিজেদের মধ্যে  পারস্পরিক ভাব প্রকাশ ও বিনিময়ের একটা ভাষাও তাদের মত করে আছে?

    বন্য প্রাণীদের নিয়ে জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানে এখন অনেক গবেষনা হচ্ছে, এবং নানা জায়গায় বিজ্ঞানীরা এই তথাকথিত  “মনুষ্যেতর” প্রাণীদের মধ্যে এক অদ্ভুত ও সূক্ষ্ম “মানবিক” ব্যবহার দেখতে পাচ্ছেন। অনেক জীবের মধ্যেই তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন ভালবাসা, মাতৃপ্রেম, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা, পরোপকার এমনকি আত্মদান, যা আমরা আমাদের নিজেদের একচেটিয়া বলেই এতদিন ভেবে এসেছি।  

    পাশবিক কথাটা এসেছে পশু থেকে।  কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাশবিকতা ক্রুরতা হিংসা ইত্যাদি নানা বিশ্রী দোষ পশুদের তুলনায় মানুষের মধ্যে অনেক বেশী।  

    হাতিদের নিয়ে ও অনেক গবেষনা হয়ে চলেছে।  

    বিজ্ঞানীদের মতে হাতি একটি অতি মহান, বুদ্ধিমান এবং সামাজিক প্রাণী। অতবড় শরীর সত্ত্বেও তারা প্রচন্ড agile, উঁচু পাহাড়ে তারা দরকার পড়লে তরতর করে উঠে যেতে পারে। তাদের ওই দুলকি চালে হাঁটা দেখে মনে হয় তারা বেশ নিরীহ প্রাণী। সহজেই তাদের পোষ মানানো যায়। আমাদের ছোটবেলায় কলকাতা চিড়িয়াখানায় হাতির পিঠে চড়া হতো। একটা কনক্রীটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে একটা প্ল্যাটফর্মে উঠে আমরা ছোটরা হাতির পিঠে উঠে সারা চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াতাম। এখন বোধ হয় হাতির পিঠে চড়া বন্ধ হয়ে গেছে। 

    জয়পুরে অম্বর প্যালেসেও হাতির পিঠে চড়ে ওপরে ওঠার আর নীচে নামার বন্দোবস্ত আছে। সেখানেও ভয় করেনি, বরং দুলুনী টা বেশ ভাল ই লেগেছে। দক্ষিণ ভারতে  – কেরালা বা তামিলনাডূতে তো মন্দিরে, পথে ঘাটে অনেক পোষমানা হাতি চোখে পড়ে। আমাদের দেশে সার্কাসে ও অনেক  হাতির খেলা দেখেছি। ব্যাঙ্ককে একবার হাতিদের ফুটবল খেলতে দেখেছিলাম।   

    কিন্তু বন্য হাতি দের একটু ভয় পেতেই হয়, এমনিতে শান্ত হলে কি হবে তারা হঠাৎ কোন কারণে একবার রেগে গেলে খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন তারা মানুষকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলে, শুঁড় দিয়ে তুলে মাটিতে আছাড় মারে। “মদমত্ত হস্তী” কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। মদ ঠিক রাগ নয় যদিও, মদ হলো ক্ষমতার অহঙ্কার, তবু একটা রিপুই তো। সব প্রাণীদের মত হাতিরাও রিপুর শিকার। বাংলার পুরুলিয়া বাঁকুড়া জেলা আর ঝাড়খণ্ড ওডিশার বর্ডারে দলমা বলে একটা জায়গায় জঙ্গল থেকে অনেক হাতি মাঝে মাঝে লোকালয়ে চলে আসে। তখন মানুষের  সাথে তাদের নানা ভাবে সংঘাত শুরু হয়, শস্যের ক্ষেত লন্ডভন্ড করে তারা চলে যায়, রেল লাইনে কাটা পড়ে মারা যায় কিছু হাতি। খবরের কাগজে সেই ছবি দেখি।   

    আমাদের বাংলার হাতি বিশারদ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী আমাদের দেশের হাতিদের নিয়ে বিশদে গবেষনা করেছেন। তাঁঢ় লেখা গবেষনা পত্র ও বইতে তিনি হাতিদের স্বভাব, জীবনযাত্রা, এবং ব্যবহার সম্পর্কে এমন সব অনেক অজানা তথ্য জানিয়েছেন, যা অবাক করার মত।

    তাঁর লেখা পড়ে জানা যায় যে হাতিদের মনে এমন একটা সহানুভূতি আর কোমল দিক আছে, যা কেবল মাত্র মানুষদের সাথে তুলনীয় বলে অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সম্প্রতি একটি লেখা পড়ে জানলাম যে প্লেনে করে হাতিদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাবার সময় তাদের মাঝখানে নাকি অনেক মুরগীর ছানা রেখে দেওয়া হয়।

    কেন?

    কারণ হাতিরা নাকি যাতে তাদের ভারী পায়ের চাপে সেই সব মুরগীর ছানারা চাপা পড়ে মারা না যায়, সেই ভয়ে  সারাটা সময় তারা নাকি একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ও নড়াচড়া করেনা। যার ফলে প্লেন আকাশে উঠলেও কোন কাঁপন বা ঝাঁকুনী অনুভূত হয়না।

    ছোট ছোট মুরগী ছানাদের প্রতি হাতিদের এই আচরণ মানবিক ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?

    বিজ্ঞানীরা হাতির ব্রেণে এমন সব নিউরন পেয়েছেন, যা কিনা মানূষের ব্রেণের নিউরণের সমতুল্য।

    Fascinated by their noble nature, scientists have studied the elephant’s brain and discovered spindle cells—rare neurons also found in humans. These are associated with self-awareness, empathy, and complex social perception.

    In other words, an elephant is not only physically huge; it’s an emotional giant, tooIt feels, understands, and acts with a silent wisdom.

    কিন্তু হাতিদের নিয়ে যে কথাটা আমাদের সবাইকে বিস্নিত করে, তা হলো এই যে যখন হাতিরা বুঝতে পারে যে তাদের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তখন তারা দল ছেড়ে বিজন কোন জায়গায় চলে যায়, যেখানে তারা একাকী মৃত্যুবরণ করে।

    কেন? 

    বিজ্ঞানীরা বলেন যাতে ছোটরা তাদের মৃত্যু দেখে কষ্ট না পায়।

    তাদের মনে এত সমবেদনা, এত সহমর্ম্মিতা? এ তো আমাদের মানুষদের মতোই, কিংবা হয়তো আরো বেশী।  

    মানুষ এবং জীবজগতে অন্যান্য অনেক প্রাণীর মত হাতিরাও সমাজবদ্ধ জীব, তারা দলবদ্ধ হয়ে থাকে,  এবং যেখানেই যায় দলপতিকে অনুসরণ করে যায়।  আমি কেনিয়ার তৃণভূমি (সাভানা) আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে দলবদ্ধ হাতির গজেন্দ্রগমন প্রত্যক্ষ করেছি। সে এক অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য।

     ৩) পিনাওয়ালা হস্তী অনাথাশ্রম – হাতিদের স্নান

    আমাদের বাস পিনাওয়ালা তে এসে দাঁড়ালো।

     ১৯৭৮ সালে পাঁচটি অনাথ (orphan)  বাচ্চা হাতি কে নিয়ে পিনাওয়ালার এই অনাথ আশ্রমের কাহিনীর শুরু, এখন হাতিদের সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আশি।  প্রতি বছর এখান থেকে কিছু  হাতি মন্দির বা চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় পঞ্চাশ জন মাহুত ওই হাতিদের দেখাশোনা করে।

    শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে এক সময়  তিন হাজারের ও বেশী হাতি ছিল, প্রধানতঃ Poaching এর জন্যে তা ক্রমশঃ কমতে থাকে।  অনাথ শিশু হাতিদের দেখভাল করা তো বটেই, তা ছাড়াও এই Orphanage তৈরী করার পিছনে একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাতিদের বংশরক্ষা, প্রতিপালন আর বংশবৃদ্ধি (conservation আর breeding), সেই উদ্দেশ্য এখন স্পষ্টতই সফল।

    ধৃতিকান্ত লাহিড়ী মশায় লিখেছেন একটি বাচ্চা হাতি নাকি  কোনভাবে একবার দলছুট হয়ে লোকালয়ে এসে গিয়েছিল,    তাকে গ্রামবাসীরা বিপন্ন অবস্থায় দেখে দুধ টুধ খাইয়ে আবার তাকে দলের কাছে ফিরিয়ে দিতে গিয়েছিল, কিন্তু সেই দলে তাকে আর ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। তার গায়ে নাকি মানুষের গন্ধ লেগে গিয়েছিল!

    এই খবরটা পড়ে সেই শিশু হাতিটির জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল মনে আছে, আর তার মা’র জন্যেও। হাতিদের যূতবদ্ধ দলীয় বা পারিবারিক জীবনে নানা অলিখিত নিয়ম আছে, যা পরিবারের বা দলের সবাই কে মেনে চলতে হয়। ওই মা’কেও তাই সেই নিয়ম মেনে তার শিশুটিকে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।আহা রে!

    বেচারা!

    পিনাওয়ালার শুরুটাই অনাথ শিশু  হাতিদের নিয়ে, তাদের সবার গায়েই মানুষের গন্ধ লেগে গেছে, তারা আর কোন দিন বনে ফিরে যেতে পারবেনা।

    চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা   ছোট গ্রাম পিনাওয়ালা, সেই গ্রামে দশ hectare মত জায়গা নিয়ে একটা নারকেলের plantation,  তার ভেতরে গড়ে উঠেছে এই বিখ্যাত হস্তী অনাথআলয়। 

    মেন বাস রাস্তা থেকে দেখলাম একটা গলি ঢুকে গেছে ভেতরে, সেখানে সারি সারি দোকান,  টুরিস্ট দের ভীড়, ফেরিওয়ালা রা “এটা নেবেন স্যার, ওটা নেবেন স্যার” বলে চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে। সুভাষ বলল ওই গলি দিয়ে একশো মিটার মত এগোলেই Maha Oya, ওয়া নদী, সেখানে রোজ সকালে বিকেলে হাতির দল কে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়।

    রাস্তা ক্রস করে দল বেঁধে আমরা গলিতে ঢুকে পড়লাম। দু’পাশে দোকান, তাতে প্রায় সব জিনিষেই হাতির মোটিফ আঁকা। সে শাড়ি হোক কি গয়না, কি ঘর সাজাবার জিনিষ। হস্তীশিল্প যাকে বলে।

    হাতির dropping (বাংলায় হাগু) শুকিয়ে chemically treat করে তাই দিয়েও নানা জিনিষ তৈরী করে বিক্রী করছে লোকে। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি একটা বাচ্চা হাতির ছবি, সে একটা কমোডের ওপর বসে পটি করছে। নন্দাকে সেই সাইনবোর্ড টা দেখাতেই সে “উঁ হুঁ! ইন্দ্রজিৎ!”, বলে নাকে শাড়ির আঁচল দিয়ে Vibration mode এ চলে গেল। নন্দার একটু শুচিবাই আছে, নোংরা কিছু দেখলে বা শুনলে গা ঘিনঘিন করে, সে তখন Vibration mode এ চলে যায়, সেটা দেখার জন্যে আমরা প্রায়ই মজা করে তার সামনে নানা গা ঘিনঘিন  করা কথা বলি।

    গলির শেষে এসে দেখি বেশ খোলা একটা জায়গা, পাথরের টিলার মধ্যে দিয়ে ওয়া নদী বয়ে যাচ্ছে, জল বেশী গভীর নয়,  এক পাল হাতি সেই ওয়া নদীর জলে গা ডুবিয়ে স্নান করছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

    হাতিদের সম্বন্ধে ইউরোপের রেনেসাঁস যুগের বিখ্যাত শিল্পী বিজ্ঞানী ও দার্শনিক লিওনার্ডো দা ভিঞ্চি এর স্মরনীয় উক্তি ছিলঃ

    The elephant embodies righteousness, reason, and temperance. The elephant enters the river and bathes with a certain dignity, as if wishing to purify itself from all evil.

    লিওনার্ডো বর্ণিত হাতিদের সেই পুণ্য স্নান আমরা দু’চোখ ভরে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে। বিশেষ করে ভাল লাগলো বেশ কিছু শিশু হাতিকে দেখে। তারা তাদের মা’দের পিছনে কিছুটা মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছোট শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে আরাম করে স্নান করছে।

    চারিদিকে বিদেশী ট্যুরিস্টদের দের ভীড়, ক্যামেরার অবিশ্রান্ত ক্লিক ক্লিক আওয়াজ!

    আধঘণ্টা মত থাকার পরে হঠাৎ মাইকে ঘোষনা করে সবাইকে জানানো হলো, এবার স্নান শেষ , রাস্তা দিয়ে হাতিদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তাই রাস্তা খালি করুন। ওদের পথ ছেড়ে দিন।

    সরু গলি, দু’পাশে দোকান আর মানুষজন, তার মধ্যে দিয়ে লাইন বেঁধে ওই বিশাল হাতিরা হেলতে দুলতে মাহুত দের পিছনে বাধ্য ছেলের মত  ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে,  কোন বিশৃঙ্খলা নেই, কোন হুড়োহুড়ি নেই, কেমন যেন একটা অবিশ্বাস্য surreal দৃশ্য বলে আমার মনে হলো।  

    স্বপ্নের মত অনেকটা।

    মেন রাস্তা ক্রস করে হাতির দল রাস্তার ওপাশে নারকেল গাছের বনে  ঢুকে গেল, সেখানেই ওদের আস্তানা বোধ হয়, আমরা তাদের পিছন পিছন বেরিয়ে এসে আমাদের বাসে ওঠার আগে পাশে একটা দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটা করে শেষে জমিয়ে ডাবের জল খেলাম ঢকঢক করে।

  • সেন্ট লরেন্স ১৯৬৩ ব্যাচ  –  স্বর্ণজয়ন্তী সভা – শনিবার ১১ই জানুয়ারী, ২০১৪

     ১ দীপঙ্করের ফোন

    ১৯৬৩ সালে হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার পরে স্কুল ছেড়েছিলাম।  তার পর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল! স্কুল ছাড়ার স্বর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করতে আমরা স্কুলের বন্ধুরা জড়ো হচ্ছি দীপঙ্করের বাড়ী। শনিবার ১১ই জানুয়ারী, ২০১৪।

    প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে যাওয়ায় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই ক্রমশঃ যোগাযোগ বেড়েছে। বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিয়মিত ইমেল চালাচালি হয়, যারা কলকাতায় থাকে তারা মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে বা ক্লাবে একটা সন্ধ্যা একসাথে কাটায়।  যারা বিদেশে থাকে তারা ছুটিতে দেশে এলে দেখা করে।

    কিন্তু আমাদের স্কুলের বন্ধুদের আনুষ্ঠানিক রি-ইউনিয়ন এই প্রথম।    

    প্রথম প্রস্তাবটা আসে প্রবীরের (ঘোষ) কাছ থেকে। তারপর প্রবীর, দীপঙ্কর (চ্যাটার্জ্জী), উৎপল (সোম), বিপ্লব (রায়) এবং আরো কয়েকজন একসাথে বসে দিনটা ঠিক করে আমাদের বাকিদের ইমেলে জানায়।  শেষ পর্য্যন্ত প্রবীরদের উদ্যোগে  আমাদের সহপাঠী দের একটা প্রাথমিক লিস্ট তৈরী হয়, সবার নাম ঠিকানা, ইমেল, টেলিফোন নম্বর একটা স্প্রেডশীটে ফেলে সবাইকে পাঠানো হয়।  

    আমাদের মধ্যে অনেক বন্ধুই এখন দেশের বাইরে থাকে – এদের মধ্যে যারা আসতে পারবেনা, তারা সবাই মেলে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

    এরা ছাড়াও আরও অনেক স্কুলের বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। এরা সব কোথায়? আজকের এই ইন্টারনেট আর ফেসবুকের যুগে তার লুকিয়ে আছে কি করে? এদের সাথে একদিন না একদিন ভবিষ্যতে যোগাযোগ হবেই, প্রবীরের ধারণা।

    আমি ২০১৩ র ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কুয়েত থেকে কলকাতা পৌঁছে গেছি। পুরনো বন্ধুদের সাথে এত বছর পরে দেখা হবে ভাবতে বেশ ভালো লাগছে। 

    ঠিক এক সপ্তাহ আগে শনিবার ৪ঠা জানুয়ারী সকালে বাড়ীতে হঠাৎ এক ফোন। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মে আই স্পিক্‌ টু মিস্টার ভৌমিক?”

    অবাক হলাম না, এই মেয়েটির ফোন আমি আগেও পেয়েছি। মেয়েটি হলো দীপঙ্করের সেক্রেটারী, এবং আমি বাঙ্গালী জেনেও কেন জানিনা সে ইংরেজীতেই আমার সাথে কথা বলে।

    আমিও ইংরেজিতেই জবাব দিলাম। “ইয়েস, স্পিকিং”। মেয়েটি বললো “প্লিজ হোল্ড অন, মিস্টার দীপঙ্কর চ্যাটার্জ্জী উইল স্পিক টু ইউ।”

    দীপঙ্কর হলো ওর অফিসের বিগ বস্‌, তাই ও নিজে কখনো ফোন করেনা।

    কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর ফোনের ওপার থেকে দীপঙ্করের মন্দ্র কন্ঠ ভেসে এলো।

    “ইন্দ্রজিৎ!”

    আর একটু হলেই বলতে যাচ্ছিলাম “ইয়েস স্যার”, কিন্তু শেষ মূহুর্ত্তে সামলে নিয়ে বললাম, “দীপঙ্কর! বলো কি খবর?”

    দীপঙ্কর বেশী সময় নষ্ট করেনা, সোজা পয়েন্টে চলে আসে। সে বললো, “আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়ীতে কে কে আসছে জানো?”

    আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “কে কে আসছে?”

    দীপঙ্কর বললো, “প্রবীর ঘোষ, বিপ্লব রায়, উৎপল সোম, প্রদীপ ব্যানার্জ্জী আর অমিতাভ মল্লিক।”

    আমি বললাম, “বাঃ, এ তো চাঁদের হাট~”

    দীপঙ্কর বললো, “তুমিও চলে এসো।”

    আমি একটু মিন মিন করে বলতে গেলাম আমি তো এগারো তারিখ আসছি, আজ বাড়ীতে মেয়ে জামাই আর দুই নাতনী আছে, আজ একটু অসুবিধে…কিন্তু দীপঙ্কর কোন কথাই শুনবেনা।

    শেষ পর্য্যন্ত ঠিক হলো আমি এক ঘন্টার জন্যে যাবো।

    তো চলে গেলাম।

     ২ প্রস্তুতি 

    জানুয়ারীর চার তারিখে সন্ধ্যায় দীপঙ্করের বাড়ী গিয়ে দেখি সবাই এসে গেছে, অনুষ্ঠান কোথায় হবে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রবীর দেখি খুব চিন্তিত মুখে হাতে একটা ফোন নিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। প্রবীরের চেহারাটা আগের মতোই আছে, ব্যাকব্রাশ চুল, ছিপছিপে, মাথার সামনেটা একটু ফাঁকা হতে শুরু করেছে।

    প্রবীর, উৎপল আর অমিতাভর সাথে কলকাতায় এলে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, কিন্তু বিপ্লব আর প্রদীপের সাথে সেই স্কুল ছাড়ার পরে এই প্রথম দেখা। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান, তবু আমাদের পরস্পর কে চিনতে কোন অসুবিধে হলোনা। সবাই সবাই কে জড়িয়ে ধরলাম। আগের মতোই তুই বলে সম্বোধন করলাম নিজেদের, খবরাখবর নিলাম, কে কোথায় আছে, কি করছে, ইত্যাদি। প্রদীপের মাথার চুল আমার মতোই সাদা, বিপ্লবের মাথায় বেশ বড় টাক। অমিতাভ আর উৎপল এর চেহারা তেমন পাল্টায়নি, অবশ্য ওদের সাথে তো মাঝে মাঝে দেখা হয়, তাই পাল্টালেও তেমন চোখে পড়েনা।

    প্রবীরের হাতে একটা লম্বা লিস্ট, সে হিসেব করে বলে দিল ১১ তারিখ কতো জন আসবে।  দীপঙ্করের বাড়ীর বাইরের ঘরটা বেশ বড় আর সাজানো, সেখানে আমাদের বসার জন্যে অনেক সোফা আর চেয়ার সাজানো আছে।  তা ছাড়া তার ডাইনিং রুম টাও বেশ বড়, আর খাবার গরম করার জন্যে তার কিচেনেও যথেষ্ট জায়গা আছে।    

    কে কে আসছে আর কে কে আসতে পারবেনা সেই নিয়েও আলোচনা হলো। অনেকেই আসবে –  যেমন অরুণাভ ঘোষ  থাকে ইংল্যান্ডে – এখন ছুটিতে কলকাতায়, অজয়নাথ রায়, প্রদীপ ভট্টাচার্য্য, প্রদীপ সোম, সুবীর ঘোষ। বোধহয় ক্লাস নাইন বা টেনে ভাস্কর চ্যাটার্জ্জী আমাদের স্কুল থেকে ট্র্যান্সফার নিয়ে চলে যায়, শুনলাম ভাস্করও আসবে। এদের সাথে সেই স্কুল ছাড়ার পর আর আমার দেখা হয়নি। ওদের সাথে আবার দেখা হবে ভাবতেই বেশ ভাল লাগছিল। সেই সব পুরোনো মুখ আর হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা স্মৃতিতে ভেসে আসছিল।

    আলোচনার মধ্যে দীপঙ্করের লোকেরা চা আর খাবার দাবার নিয়ে এলো। নানা ধরনের পদ, দীপঙ্কর সব বেঙ্গল ক্লাব থেকে আনিয়েছে। 

    গল্পে গল্পে কখন এক ঘন্টার জায়গায় দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে, ইচ্ছে না থাকলেও তাই উঠতেই হলো।

    সামনের শনিবার ১১ই জানুয়ারী আবার দেখা হবে বলে উঠলাম।

    রবীন নাগ অজয়নাথ রায়

    ১১ই জানুয়ারী, ২০১৪

    দীপঙ্করের বাড়িতে সুভদ্রা আর আমি যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে সাতটা। বেশী দেরী হয়নি ভেবেছিলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি হাউসফুল, পার্টি শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। প্রবীর আমায় দেখে বললো, “একি হেরি, এত দেরী? আমি তো ভাবলাম তুই আর আসবিনা।”

    দীপঙ্করের বিরাট হলঘর, বেশ গমগম করছে দেখলাম, পার্র্টি জমে উঠেছে, মেয়েরা সবাই সোফায় বসে গল্পে মশগুল, ছেলেরা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আলাপে ব্যস্ত। গ্লাসের গায়ে বরফের ঠোকাঠুকির টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।  দীপঙ্কর গৃহস্বামী, গোলগাল, মাথায় টাক, গালে আধপাকা দাড়ি, ট্রাউজার্স সার্ট আর ব্রেসে তাকে দেখতে বেশ সম্ভ্রান্ত লাগছে। অনেকটা Solzhenitsyn এর মত। সে দেখি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার স্টাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর কারুর প্লেট বা গ্লাস ফাঁকা দেখলেই তাদের নাও নাও বলে যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত করছে।

    সেদিন আমার শরীর টা ভাল ছিলনা, সর্দ্দি জ্বর, ক্রোসিন খাচ্ছি সকাল থেকে,  কিন্তু দীপঙ্কর কিছুতেই ছাড়বেনা, আরে খাও খাও বলে সে আমায় একটা সিঙ্গল্‌ মল্টের এর গ্লাস ধরিয়ে দিল।

    চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, অনেক অচেনা অল্পচেনা প্রৌঢ় মুখ। এরা কি তারাই, যাদের সাথে শৈশব আর কৈশোরের কমবেশী দশ বছর একসাথে কাটিয়েছি আমি? ভাল করে তাকিয়ে সেই কিশোর মুখগুলো চিনে নেবার চেষ্টা করলাম। কঠিন কাজ। সেই কিশোরেরা তো আজ আর কেউ নেই, সবাই হারিয়ে গেছে, জীবনের সেই দিনগুলোর মতোই। আর তাদের সাথে হারিয়ে গেছি সেই ছোটবেলার আমিও।

    এখন যাদের আমার চারিপাশে দেখছি তার সবাই প্রাজ্ঞ, প্রবীণ, কারুর মাথায় টাক, কারুর ভুঁড়ি, কারুর মাথাভর্ত্তি পাকা চুল। স্কুলজীবনের সেই হাফপ্যাণ্ট পরা হাসিখুসী উচ্ছল ছেলেগুলো কোথায় গেল? তারা আজ কেউ  হাইকোর্টের  বিচারক বা উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা, কেউ লব্ধপ্রতিষ্ঠ ইঞ্জিনীয়ার, আবার কেউ সফল ব্যবসায়ী।

    এদের আমি চিনিনা।

    জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত, ওঠা পড়া, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। এখন আমাদের জীবন ঘিরে আছে নতুন আপনজনেরা, স্ত্রী, পুত্র কন্যা, নাতি, নাতনী, নতুন বন্ধু, সহযোগী, সতীর্থ।  পুরনো বন্ধুদের কাছ থেকে আমরা অনেকটা দূরে সরে গেছি এই পঞ্চাশ বছরে।

    তা হোক, তবু কবির ভাষায় “পুরানো সেই দিনের কথা, সেই কি ভোলা যায়?”

    ভোলা যায়না।

    মনের মধ্যে সেই স্কুলের ক্লাসরুম, বারান্দা, বিশাল সবুজ মাঠ, মাঠের দক্ষিণ দিকে তেঁতুল আর পলাশ  গাছ, সেই পুকুর আর বাঁধাকপির ক্ষেত, সেই চুড়োনওয়ালা, টিফিন পিরিয়ডের ছুটোছুটি, হাসাহাসি, কলরব, আর সেই সময়ের সহপাঠী আর শিক্ষকদের মুখ সব একসাথে ফিরে এল। অনেকটা যেন reverse osmosis process ব্যবহার করে পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান পেরিয়ে পিছিয়ে গেলাম সেই দিনগুলোতে।

    নিবিড় সুখে, মধুর দুখে, জড়িত ছিল সেই দিন/

    দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীণ/

    ২০১৮ সাল

    নতুন করে সবার সাথে আলাপ

    আমার প্রথম কাজ হল ঘুরে ঘুরে করে সবার সাথে দেখা করা এবং বিশেষ করে অচেনা বন্ধুপত্নী দের সাথে আলাপ করা। তাঁরা সবাই দেখলাম বেশ জমিয়ে গল্প করছেন সোফায় বসে, তাদের মধ্যে কারুর কারুর আজই হয়তো প্রথম দেখা, কিন্তু দেখে কে বলবে? মনে হয় যেন ওদের বহু দিনের বন্ধুত্ব! সুভদ্রার সাথে একমাত্র অমিতাভর বৌ সুজাতার আলাপ ছিল, আমি এক এক করে অন্য সবার সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলাম।

    অরুণাভ ঘোষ কে দেখে চিনতে পারিনি, স্কুলে এক মাথা কোঁকড়া চুল আর বেশ কোমল তারুণ্যে ভরা মুখ ছিল ওর, সব সময় মজার মজার কথা বলে হাসাতো আমাদের। এখন তার মাথায় মোড়ানো চুল, মুখশ্রীতে সেই লাবণ্য আর নেই। তার জায়গায় বাসা বেঁধেছে একটা বয়সোচিত গাম্ভীর্য্য। ও এখন UK তে থাকে, এবার সাথে তার বৌ নেই, সে একাই এসেছে দেশে।

    তার পাশে সুবীর ঘোষ, ছোটখাট চেহারা, আগের মতোই অবিকল, চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি। স্যুট টাই পরে সুবীর খুব ফর্মাল, যাকে বলে একেবারে টিপটপ, ফিটফাট। চুপচাপ, মুখে স্মিত হাসি। সেও একা এসেছে। স্যুট টাই কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সুবীর বলল, “আজকের অনুষ্ঠানের একটা মর্য্যাদা আছে তো, নাকি?”

    আর রবীন নাগ, সে থাকে দিল্লীতে। এখন সে কিঞ্চিৎ অসুস্থ। সেও আজ একা এসেছে। একসময় দারুণ ফুটবল খেলতো রবীন, আমরা একসাথে প্রচুর বল পিটিয়েছি স্কুলে থাকতে এবং পরে আই আই টি খড়্গপুরে । নীল চোখ আর সোনালী চুল, স্কুলে থাকতে রবীন ছিল আমাদের পোস্টার বয়। আজকের রবীন কে দেখলে সেই ছোটবেলার রবীনকে একটু একটু মনে পড়ে।

    উৎপল আর প্রদীপ সোম দুই ভাই, এদের স্ত্রীরা পাশাপাশি বসে আছে, তাদের নাম  চিত্রা আর ভারতী। তাদের সাথে গিয়ে আলাপ করলাম। উৎপল দেখি খুব ব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু প্রদীপ চুপ করে সোফায় বসে। স্কুলেও দুই ভাই এর স্বভাবে একটা পার্থক্য ছিল মনে আছে,  উৎপল হাসিখুসী, চঞ্চল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, ওদিকে প্রদীপ একটু ছোটখাটো, দুর্ব্বল, চুপচাপ। প্রদীপের বৌ ভারতী বলল, “দেখুন না খুব বড় একটা অসুখ থেকে উঠল, এত করে বললাম যেও না, কিন্তু কথা শুনলোনা, বললো পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করবোনা, কি যে বলো?” 

    প্রবীরের বৌ সুপ্রিয়া আর পৃথ্বীরাজ এর বৌ অনিন্দিতা দেখি পাশাপাশি বসে খুব গল্প করছে, এদের দুজনের আগেই আলাপ ছিল বোধ হয়। সুপ্রিয়া খুব সপ্রতিভ, তাকে আমি বললাম “আপনাদের বিয়ে তে আমি মাধব লেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম”। সুপ্রিয়া বলল “বাড়িটার বয়স একশো বছর হয়ে গেল, জানেন? আমার এখন বম্বে থেকে কলকাতায় এলে ওখানেই থাকি, আসুন না একদিন?”

    বহুদিন আগে, তখন আমাদের সবে বিয়ে হয়েছে, পৃথ্বীরাজরা থাকত যোধপুর পার্কে আর তাদের বাড়ীর ঠিকানা ছিল M Jodhpur Park। ঠিকানাটা অদ্ভুত, তাই এখনও মনে আছে। সেই বাড়ীতে একটা বিরাট ছাত ছিল।  পৃথ্বীরাজ ম্যানিলা তে AIM এ পড়তে যাবার আগে একদিন সুভদ্রা আর আমি আর অন্য কয়েকজন বন্ধু সেই বাড়িতে ওদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতিচারণ করলাম ওদের সাথে। পৃথ্বীরাজ অবিকল আগের মত আছে, বুড়িয়ে যায়নি, বেশ সুন্দর স্বাস্থ্য, চুল কালো, আগের মতোই চুপচাপ। মুখে হাসি। 

    এবার দেখা হলো এক অচেনা ভদ্রলোকের সাথে, ইনি আবার কে? চেনা যাচ্ছেনা তো? বেশ অভিজাত বনেদী চেহারা, একটা নীল পুলোভার আর ট্রাউজার্স এ বেশ মানিয়েছে, মাথাজোড়া  টাক, চোখে একটা বাহারী চশমা, প্রফেসর প্রফেসর লাগছে। পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন আমার নাম প্রদীপ ভট্টাচার্য্য, আমি ছিলাম বি সেকশনে। অর্থাৎ যাদের বাংলার জায়গায় হিন্দী ছিল ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ।

    ও হরি, প্রদীপ, তুমি?

    আমাদের ক্লাসের তিন জন প্রদীপ সেদিন উপস্থিত। সোম, ব্যানার্জ্জী, ভট্টাচার্য্য। প্রদীপ মিত্র প্রদীপ রাও, প্রদীপ চক্রবর্ত্তী আর প্রদীপ সেন আসেনি, ওদের নিয়ে আমাদের ক্লাসে সাতজন প্রদীপ ছিল।

    আমরা ছিলাম যাকে বলে প্রদীপের আলোয় আলোকিত।

    প্রদীপ ভট্টাচার্য্য বি সেকশনে (হিন্দী) পড়লেও আমাদের অনেক কমন ক্লাস থাকত, আর টিফিন আর লাঞ্চ এর ব্রেকে তো একসাথেই মিলে মিশে থাকতাম আমরা । সুতরাং প্রদীপকে ভোলার প্রশ্নই ওঠেনা। একটু গাবদু ছিল, আর খুব হাসিখুসী। শুনলাম ও IAS এ ছিল, এখন রিটায়ার করে মহাভারত  নিয়ে রিসার্চ করে এবং বম্বে ইউনিভার্সিটি তে পার্ট টাইম পড়ায়।

    সেদিন প্রদীপ ভট্টাচার্য্য বেশ একটা ভারিক্কী ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমাদের মধ্যে সেই একমাত্র IAS, আর সেই একমাত্র বি সেকশন। সুতরাং একটু পাঙ্গা নেবার অধিকার তার আছে।

    স্মৃতি একটু ক্ষীণ বলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি হায়ার সেকেন্ডারী  পর্য্যন্ত স্কুলে ছিলে না আগেই ট্র্যান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিলে?” তাই শুনে প্রদীপ আমার ওপর বেশ চটে গেল। পাশেই বসে ছিল ওর বৌ, তার কাছে আমায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করে দিয়েই বললো ইন্দ্রজিৎ কি বলছে শোন। আমি নাকি…

    আমি একটু  অপ্রস্তুতের হাসি হাসলাম।

    অজয় একটা ওয়াইন এর গ্লাস হাতে নানা মজার কথা বলছে আর খুব জোরে জোরে হাসছে। তার গালে বিরাট জুলফি, তাকে বেশ মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো দেখতে লাগছে। স্কুলে থাকতে অজয় বেশ লাজুক ছিল, আর কম কথা বলতো, কিন্তু এই বয়েসে এসে সে বেশ প্রগলভ, তার ওপরে সে এখন হাইকোর্টে বিচারক।  নির্দ্বিধায় সে আমাদের একটার পর একটা আদিরসাত্মক জোক শুনিয়ে গেল। তার স্টক বেশ ভাল দেখলাম।

    ভাস্কর কে দেখলাম বহু বছর পর, তার মাথা ভর্ত্তি সাদা চুল, বেশ রাশভারী চেহারা। সেই ক্লাস এইট বা নাইনের পরে আর দেখা নেই, যোগাযোগ ও নেই, কিন্তু দেখেই চিনলাম। এখনো ভাস্কর আগের মতোই হাসিখুসী, প্রাণবন্ত। ওর স্ত্রীর সাথেও আলাপ হলো।  ওরা থাকে গুরগাঁও তে। প্রদীপ ব্যানার্জ্জী (বাঁড়ু) আর তার বৌ এসেছে USA থেকে। ভাস্করের সাথে সে যাদবপুরে পড়েছে, প্রতি বছর ওদেরও (মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং ক্লাসের) জানুয়ারী মাসে কলকাতায় রিউনিয়ন হয়, সেখানে সুভাষ মাধব, প্রদ্যোত, অরুনাভ সবাই আসে, তাই ওদের মধ্যে ভাল যোগাযোগ আছে দেখলাম।

    বিপ্লব আর তার বৌ ডালিয়ার সাথে গল্প করছিলাম, এমন সময় পাশে প্রদীপ ভট্টাচার্য্য গ্লাস হাতে এসে দাঁড়ালো। আমি ডালিয়া কে বললাম, “আপনার স্বামীর স্কুলে পড়ার সময় মাথা ভর্ত্তি কালো চুল ছিল জানেন, আর ছিল বড় বড় নিষ্পাপ দুটি চোখ। ”

    প্রদীপ পাশ থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আঃ, নিষ্পাপ!”

    আমি বললাম, “চোখ দুটো এখনো আগের মতোই আছে, কিন্তু মাথার চুল…”

    বিপ্লব নীচু ক্লাস থেকেই পড়াশোনায় ভাল। ক্লাস থ্রি তে এন্টনী  স্যার প্রতি সপ্তাহের শেষে আমাদের নানা রং এর কার্ড দিতেন, গোলাপী পেতো সবচেয়ে ভাল ছেলেরা, তারপর সবুজ, হলদে ইত্যাদি। আমি ডালিয়া কে বললাম, “বিপ্লব প্রত্যেক সপ্তাহে গোলাপী কার্ড পেতো, জানেন তো? আর আমরা ছিলাম  হলদে সবুজ ওরাং ওটাং!”

    বিপ্লব বললো “বল্‌ তো, একদম আমায় পাত্তা দেয়না।”

    পাশ থেকে প্রদীপ আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “ঘর ঘর কি কাহানী!”

    সবাই গল্পে মত্ত। প্রচুর ছবি তোলা হচ্ছে। আজকাল সেলফোনের ক্যামেরা দিয়ে বেশ ভাল ছবি তোলা যায়, আলাদা ক্যামেরার দরকার পড়েনা। আমি আমার ফোন দিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললাম।  প্রবীর আজকের সন্ধ্যার প্রধান ব্যবস্থাপক, স্বভাবতঃই তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। সারাক্ষণই তাকে খুব ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে, একবার এদিকে আর একবার ওদিকে। মাঝে মাঝে ছবি তোলার জন্যে কোন গ্রুপে বন্ধুদের  কাঁধে হাত রেখে হাসিনুখে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

    অজয় বললো, “প্রবীর আর দীপঙ্কর আজকের অনুষ্ঠানের  অর্গানাইজার আর হোস্ট – ওদের দু’জনের সাথে সব মেয়েদের একটা ছবি তোলা হোক~”!

    আমরা সবাই বললাম, খুব ভালো আইডিয়া! আমাদের বৌদের সবাই কে ডেকে ওদের দু’জন  কে মাঝখানে রেখে ছবি তোলা হলো।

    মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়/

    আবার দেখা যদি হলো সখা, প্রাণের মাঝে আয়/

    ২০২০ সাল

     মানুষ গড়ার কারিগর  

    আমাদের সময়ে ভাল স্কুল হিসেবে আমাদের স্কুলের বেশ সুনাম ছিল।  হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় আমাদের স্কুলের রেজাল্ট খুব ভাল হতো। প্রায় প্রতি বছরই আমাদের স্কুল থেকে সারা বাংলায় প্রথম দশজনের মধ্যে একজন বা দু’জন থাকতোই। একদিকে যেমন স্কুলে একটা অনুশাসন আর শৃঙ্খলার পরিবেশ ছিল, অন্যদিকে তেমন আমাদের শিক্ষকেরা সবাই আমাদের সুশিক্ষার ব্যাপারে মনোযোগ দিতেন। অ্যানুয়াল আর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা ছাড়াও বছরের প্রায় পুরোটাই প্রতি শুক্রবার আমাদের সাপ্তাহিক পরীক্ষা দিতে হতো। ফলে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া সম্ভব ছিলনা।

    পড়াশোনা ছাড়াও, খেলাধূলাতেও আমাদের স্কুলের নাম ছিল। প্রথমেই বলতে হয় আমাদের স্কুলের সেই বিশাল সবুজ মাঠের কথা। কলকাতা শহরের বুকে ওই রকম বড় মাঠ আর কোন স্কুলে ছিল বলে আমার জানা নেই। ওই মাঠ ছিল আমাদের স্কুলের একটা বড় গর্ব্বের জায়গা। সেই মাঠে কত যে ফুটবল হকি ক্রিকেট খেলেছি আমরা! কলকাতার অন্য ক্রিশ্চিয়ান স্কুল যেমন সেন্ট পল্‌স্‌, সেন্ট জেভিয়ার্স্‌ ইত্যাদি তাদের ফুটবল টীম নিয়ে এসে আমাদের সাথে টূর্ণামেন্ট খেলতো।

    পড়াশোনা ও খেলাধূলায় আমাদের স্কুলের এই সাফল্যের পিছনে আমাদের শিক্ষকদের অবদান একটা প্রধান কারণ ছিল, আমাদের আলাপে পুরনো দিনের কথার মধ্যে তাই অনেকটাই আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের কথা চলে আসে।   

    কম বয়েসে নীচু ক্লাসে ছিলেন পুলিন স্যার, পাঞ্জা স্যার, খান স্যার, চৌধুরী স্যার, মন্ডল স্যার।

    পুলিন স্যারের ব্যায়াম পুষ্ট চেহারাটা বেশ মনে পড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের ড্রিল (Physical Education) টিচার। সপ্তাহে একদিন শেষ পিরিয়ডে মাঠে আমাদের ড্রিল হত, তাতে স্যার আমাদের নানা রকম ব্যায়াম আর কসরত শেখাতেন। আর কেউ কিছু না পারলে তার মাথায় হাল্কা করে একটা গাঁট্টা মারতেন।  “পুলিন স্যারের গাঁট্টা, পয়সায় আটটা” নামে একটা ছড়া বেশ প্রচলিত ছিল তখন।

    বছরে একদিন স্কুলের বিশাল সবুজ মাঠে Sports day হতো, আমাদের পরিবারের অনেকে আমাদের দৌড় ঝাঁপ এবং অন্যান্য কসরত দেখতে আসতেন। সেদিন দর্শকদের  সামনে  আমরা অনেক জিমন্যাস্টিক খেলা দেখাতাম। তার মধ্যে একটা আগুনের রিং এর মধ্যে দিয়ে ডিগবাজী দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যাওয়া খেলাও ছিল, পুলিন স্যার সেটা আমাদের দিয়ে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রচুর প্র্যাকটিস করাতেন।    

    ড্রয়িং শেখাতেন পাঞ্জা স্যার। ধুতি পাঞ্জাবী পরা রোগা পাতলা চেহারা, দুটো চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি, সব সময় খুব মজার মজার কথা বলতেন। খাইবার পাস আর বেলুচিস্থান নিয়ে তাঁর বিখ্যাত একটা গল্প ছিল।  এক বিয়েবাড়ীতে এক নিমন্ত্রিত বরযাত্রী ভদ্রলোক খাবার ডাক পড়ায় তাড়াহুড়ো তে ভুল করে বাথরুমের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। একটি ফাজিল ছেলে তাকে ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে খাবার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে বলে “এদিকে নয় স্যার, ওদিকে যান। এদিকটা হলো বেলুচিস্থান। ওদিকটা খাইবার পাস।”

    ক্লাস ফাইভে ভূগোল পড়ানোর সময় মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পাঞ্জা স্যার আমাদের বলেছিলেন “তোমরা বাড়িতে গিয়ে যখন মা’কে বলো, ‘মা, ভাত দাও’, তখন আর কিছু দিতে বলোনা কেননা ডাল তরকারী মাছ ওই সব খাবার ভাতের সাথেই আসে তোমরা জানো। ওদেশের ছেলেরা তাদের মা’দের কি বলে জানো?” আমরা কৌতূহলী হয়ে বলতাম, “কি বলে স্যার?” উনি হেসে বলতেন ওরা বলে “মা, খেজুর দাও!”

    ঘটনাচক্রে আমি এখন এই মরুভূমির দেশেই থাকি। পাঞ্জা স্যারের ওই কথাটা এখনো ভুলিনি। খেজুর খাবার সময় ওঁর ওই কথাটা মনে পড়বেই। হাসি আর মজা করে বলা কথা এরকম মনে গেঁথে যায়।

    খান স্যার আমাদের ইতিহাস পড়াতেন।  সাধারণ দোহারা চেহারা, পরনে সাদা সার্ট আর ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুটো চোখ। ইতিহাস ছিল তাঁর passion । খান স্যার বড় ভালো পড়াতেন, আকবর, বীরবল, শিবাজী, আফজল খাঁ রা সবাই তাঁর পড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠতেন। তিনি হলদিবাড়ী বা পানিপতের যুদ্ধের কথা পড়াবার সময় আমরা তলোয়ারের ঝনঝন আওয়াজ, আহত সৈনিকদের আর্তনাদ, ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক যেন কানে শুনতে পেতাম। নিজেকে আমি মাঝে মাঝে নিজেকে সেই যুদ্ধের মধ্যে এক অনামী সৈনিক বলেও ভেবেছি। 
    খান স্যারের সবই ভালো ছিল, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ আমরা পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছি কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দুমদাম প্রশ্ন করে বসতেন। একটু অমনোযোগী হলেই আমরা ঠিক ওনার কাছে ধরা পড়ে যেতাম।
    তো একবার মনে পড়ে ক্লাসে বারো ভুইঁয়া দের সম্বন্ধে পড়াচ্ছেন খান স্যার। আমি সেদিন তৈরী হয়ে আসিনি, তাই খান স্যারের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না, পাছে আমায় কোন প্রশ্ন করে বসেন। খান স্যার বুঝতে পেরে আমায় বললেন, “ইন্দ্রজিৎ, তুমি তো ভৌমিক, তাই না? তার মানে তুমি নিশ্চয় কোন বারো ভুঁইয়ার বংশধর। আচ্ছা, তুমি বলো তো…”

    সব্বোনাশ!

    যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই! 

    ভৌমিক হয়ে জন্মাবার জন্যে বেশ দুঃখ হয়েছিল সেদিন। ঘোষ বোস মিত্র বা মুখুজ্যে বাঁড়ূজ্যে হলেও এই বিপদে পড়তে হতোনা আমায়।

    উঁচু ক্লাসে ওঠার পরে নতুন বিষয় নিয়ে পড়াতে এলেন নতুন শিক্ষকেরা।  মিত্র স্যার পড়াতেন ফিজিক্স, সুহাস স্যার কেমিস্ট্রী আর ভট্টাচার্য্য স্যার অঙ্ক।  বাংলা পড়াতেন অমল সান্যাল স্যার, ইংরেজী ফাদার ভেটিকাড। আমরা খুব ভাগ্যবান ছিলাম শিক্ষক হিসেবে এঁদের পেয়ে।

    নিউটনের Laws of motion পড়ানো হচ্ছে, তৃতীয় Law – “Every action has an equal and opposite reaction” শিখে সবাই সবার পিঠে আচমকা কিল বসিয়ে দিচ্ছি। “কি রে আমায় মারলি কেন?” বললে উত্তর আসছে “আরে তোর পিঠও তো আমার হাতে সমান ভাবে মেরেছে!”

    আর ছিল ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি ল্যাব।    

    ফিজিক্স ল্যাবে পেন্ডূলাম ব্যবহার করে acceleration due to gravity (g) বের করতে হতো, উত্তরটা তো জানা 981cm/square second তাই কিছুটা কারিকুরি করে ৯৮১ তে পৌঁছে যাওয়া কঠিন ছিলোনা।  তবে লেন্সের focal length কিংবা কেমিসট্রী ল্যাবে সল্ট বের করা অত সহজ ছিলনা। কপার সালফেটের রং সবুজ, তাই সেটাই সব চেয়ে সহজে ধরে ফেলতাম।  

    অন্যান্য বিষয়ের সাথে Moral Science নামে একটা সাবজেক্ট পড়ানো হতো আমাদের তাতে খ্রীশ্চান (রোমান ক্যাথলিক) ধর্মের নানা বাণী আর বাইবেল (Old and new Testaments, Gospels) থেকে নানা গল্প পড়াতেন আমাদের বিদেশী সাহেব শিক্ষকেরা, যাদের Father নামে ডাকা হতো। এঁদের  বেশীর ভাগই আসতেন ইউরোপ থেকে, এবং স্কুলের একটা বাড়ীতেই তাঁদের থাকার আর খাওয়ার বন্দোবস্ত হতো।  এঁদের মধ্যে কিছু ভারতীয় ফাদারও ছিলেন, যেমন ফাদার পিন্টো, ফাদার ডি’সুজা, ফাদার ডি সিলভা, ইত্যাদি। এঁদের সবার পোষাক ছিল সাদা আলখাল্লা।

    যীশু খ্রীষ্টের জীবন গুলে খেতে হয়েছে সেই সময়। Old Testament এর অনেক গল্প মনে আছে এখনো।  Return of the Prodigal son, The Good Samaritan ইত্যাদি এই সব  গল্প এখনো মনে পড়ে।

    আর মনে পড়ে আমাদের কিছু সহপাঠীদের কথা যারা আবাসিক (বোর্ডার)  ছিল। তাদের জন্যে স্কুলে আলাদা থাকা খাওয়ার জায়গা ছিল। প্রধানতঃ গ্রামের দু;স্থ প্রান্তিক পরিবারের ছেলেদের ক্রীশ্চান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে তাদের স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেওয়াই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এদের বেশীর ভাগ ছেলের ক্রীশ্চান নাম ছিল, আর পদবী ছিল গোম্‌স্‌।

    আমাদের এই আবাসিক সহপাঠীরা পড়াশোনায় তেমন ভাল না হলেও অনেকেই খেলা ধূলায় খুব ভাল ছিল।  ক্লাস শেষ হলে বিকেলে তারা অনেকেই আমাদের সাথে ফুটবল খেলতো। তার পর সন্ধ্যার ঘ্ন্টা বাজলেই তারা তাদের হোস্টেলে ফিরে যেত। ক্রীশ্চান ধর্মের কঠোর অনুশাসনের মধ্যে তাদের রাখা হতো বলেই এখন মনে হয়। অল্প বয়েসে মা বাবা আর পরিবারের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া আর অন্য ধর্ম্মে ধর্মান্তরিত হওয়া তাদের মনে কি প্রভাব ফেলেছিল তা জানিনা, তবে তারা কমবেশী সবাই চুপচাপ মাথা নীচু করেই থাকতো। খেলার মাঠে অবশ্য তাদের অন্য রূপ।

    একবার অঘোর শীল্ডের ফাইনাল খেলা হচ্ছে ঢাকুরিয়া লেকে, ন্যাশনাল হাই স্কুলের বিরুদ্ধে ৩-০ গোলে আমরা জিতেছিলাম, সেন্টার ফরোয়ার্ড  সাইমন গোম্‌স্‌ একাই তিন গোল করে হ্যাটট্রিক করেছিল। আমি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে খেলা দেখেছিলাম।  কি যে আনন্দ হয়েছিল! আর রাইট আউটে দারুণ খেলেছিল ক্ল্যারেন্স রডরিগ্‌স্‌ (ডাক নাম বাচ্চা), ক্ষিপ্র গতিতে বল নিয়ে ডান দিক থেকে তার উঠে আসা এখনও পরিস্কার চোখে ভাসে।

    আমাদের ক্লাসে বোর্ডার সহপাঠীদের মধ্যে গ্যাব্রিয়েল গোম্‌স্‌, সুনীল গোম্‌স্‌ আর ক্লিফোর্ড রডরিগ্‌স্‌ এর চেহারা গুলো এখনো ভুলিনি।  কোথায়  কেমন আছে আমাদের এই সহপাঠীরা এখন, তা কেই বা জানে?

    তাছাড়া মনে পড়ে আমাদের বেশ কিছু সহপাঠীদের, যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের জন্যে।  তারাও ফিরে এলো আমাদের সেদিনের স্মৃতিচারণে। তাদের মধ্যে আছে হিতেন চক্রবর্ত্তী, বিনোদ কোহলী, নারায়ণ কৃষ্ণান, আর ললিত মোহন নন্দা। 

    ২০২৩ সাল

    পঞ্চাশ আর ষাটের  দশক

    সেদিন স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সাথে স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে,  পঞ্চাশের দশক যেন হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া যেন একটা অদৃশ্য জানলা খুলে মনের ভেতরে ঢুকে এলো।

    আজকাল মাঝে মাঝে বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় স্কুল বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে দেখি, বড় বড় জানলা, বিরাট বাড়ী, ভিতরে ক্লাস হচ্ছে, বাইরে সেই অর্জুন গাছগুলো পাতা ছড়িয়ে এখনো দাঁড়িয়ে। বহুদিন আগে আমি আর আমার এই সহপাঠীরা ওই ক্লাসরুমে বেঞ্চিতে বসতাম, বাইরে জানলা দিয়ে তাকালে অর্জুন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যেত Army Camp এর স্কাইলাইন, স্যাররা পড়াতেন, ক্লাসে কোন আওয়াজ নেই, শুধু ফ্যান চলার শব্দ। আর টিফিনের ঘন্টা বাজলেই শুরু হতো ছুটোছুটি আর হুটোপাটি, কান ঝালাপালা করা আওয়াজ।

    ক্লাস টু থেকে শুরু করে থ্রী ফোর, ফাইভ…। একটা করে বছর যায়, আমরা বড় হতে থাকি।  প্রমোশন পেয়ে নতুন ক্লাসে উঠি, বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসের বুক লিস্ট নিয়ে দোকান থেকে বই কিনে নিয়ে আসি।  নতুন বইয়ের একটা আলাদা গন্ধ আছে, সেই সব নতুন বই পেয়ে সে কি উত্তেজনা আমাদের। কত নতুন কিছু শিখবো আমরা সামনের বছরে।

    আমরা ভাল করে সেই বইদের মলাট দিয়ে ঢাকি।  ভিতরে প্রথম পাতায় নিজেদের নাম লিখি। কেউ কেউ আবার ঠিকানাও লেখে।  সেই ঠিকানা শুধু কলকাতা বা ভারতবর্ষের নয়। আমাদের কল্পনায় আমরা হলাম বিশ্বনাগরিক, মহাবিশ্বে আমাদের বাসস্থান।

    Indrajit Bhowmick, Class 5, St Lawrence High School, 27,Ballygunje Circular Road, Kolkata 19, West Bengal, India, Asia, World, Solar System, Milky way, Universe – অনেকটা এই রকম।

    বারোটা থেকে একটা এক ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেকের কিছুটা আগে থেকেই চিলরা আকাশে ভীড় করতো। ওদের sense of timing দেখে বেশ অবাক হতাম। আমার হাত থেকে বেশ কয়েকবার টিফিন কিছু বোঝার আগেই সোঁ করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চিল। কলকাতার আকাশ থেকে চিল এখন উধাও। তারা আর বোধ হয় আর টিফিন টাইমে স্কুলের আকাশে ভীড় করেনা।

    আর এক ঘন্টা লাঞ্চ ব্রেকে প্রখর গ্রীষ্মেও মাঠে নেমে ফুটবল পেটাতাম আমরা, তার পর ঘেমে চুপচুপে হয়ে ভিজে ক্লাসে গিয়ে ক্লাসে বসতাম, ফ্যানের হাওয়ায় জামা শুকিয়ে যেত, এখন ভাবলে বেশ আশ্চর্য্য লাগে।

    আর মনে পড়ে সকালে একা একা স্কুলে আসা আর বিকেলে স্কুল ছুটি হলে বন্ধুদের সাথে বাড়ী ফেরার কথা। তখন রিচি রোডের গেটটাই ব্যবহার করতাম আমরা। আমাদের স্কুল শুরু হতো সকাল দশটা চল্লিশে, তখন একা একাই হেঁটে আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ী থেকে ল্যান্সডাউন  রোডে শিশুমঙ্গল হাসপাতাল ছাড়িয়ে হাজরা রোড ধরে ম্যাডক্স স্কোয়ার এর পাশ দিয়ে রিচি রোড ধরতাম। বিকেলে স্কুল ছুটি হতো বিকেল তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিটে – বাড়ী ফেরার পথে সাথে কোন না কোন বন্ধু থাকতো।

    কেমন ছিল আমাদের সেই  পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের কলকাতা?  

    বিকেলে হোসপাইপ দিয়ে জল দিয়ে রাস্তা ধুতো কর্পোরেশনের লোকেরা। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে আর দেয়ালে হোর্ডিং এ উত্তম সুচিত্রা রাজ কাপুর নার্গিস দিলীপ কুমার বৈজয়ন্তীমালা, দেব আনন্দ্‌ মধুবালাদের ছবি দিয়ে পোস্টার লাগানো থাকতো। মাইকে ভেসে আসতো তখনকার সময়ের জনপ্রিয় ফিল্মী হিন্দী আর বাংলা গান। রাস্তা দিয়ে  রাজহাঁসের মত রাজকীয় চালে চলে যেতো ডাউস ঢাউস ঢাউস বিদেশী গাড়ী – শেভ্রোলে স্টুডিবেকার, প্লাইমাউথ, ডজ্‌, ইমপালা, অস্টিন, হিলম্যান, আর সাথে আমাদের দেশী গাড়ী – ল্যান্ডমাস্টার, ফিয়াট, স্ট্যান্ডার্ড হেরল্ড।  আর ছিল লাল রং এর 2, 2B 8B আর দশ নম্বর দোতলা বাস।  টুং টুং করে ঘন্টা বাজিয়ে পাশ দিয়ে যেতো হাতে টানা রিক্সা।

    স্কুল ছুটির পরে বাড়ী ফেরার সময় বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কত কথাই না হতো আমাদের। ফিল্ম, সাহিত্য, সিনেমা খেলাধূলা নিয়ে। ষাটের দশকে আমাদের বয়ঃসন্ধির বয়েস, রাস্তা ঘাটে সুন্দরী মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকাই, দেশ পত্রিকায় বড়দের উপন্যাস পড়ার অভ্যাস শুরু হয়েছে।  দেশে ধারাবাহিক বেরোচ্ছে অচিন্ত্য সেনগুপ্তর প্রথম কদম ফুল কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সূর্য্যসাক্ষী। সেই সব প্রেমের উপন্যাস নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের উত্তেজিত আলোচনা চলে।

    তাছাড়া আছে ময়দানে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের  লীগ আর আই এফ এ শীল্ডের খেলা, আর ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হল গিলক্রিষ্টের ফাস্ট বোলিং। রেডিওতে কমলদা’ অজয় বসু পিয়ারসন সুরিটার কমেন্টারী, শনি রবিবার দুপুরে অনুরোধের আসর, আর শুক্রবার রাত ন’টায় নাটক।

    প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার আমাদের সাপ্তাহিক পরীক্ষা থাকতো, এবং সেই পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে আগের দিন অর্থাৎ বৃহষ্পতিবার থাকতো আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি।  রবিবার নিয়ে আমাদের সপ্তাহে দুই দিন ছুটি ছিল। আর শুক্রবার পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে রাত্রে  রেডিওর সামনে বসে রাত ন’টার নাটক শুনতে কি যে ভাল লাগতো।       

    স্কুল থেকে বছরের প্রথমে আমাদের সবাইকে একটা বাৎসরিক ক্যালেন্ডার দেওয়া হতো, তাতে থাকতো বারো মাসের নানা ছুটি্র দিন এবং অন্যান্য নানা খবর। জেসুইট সাহেবরা স্কুল চালাতেন, তাই অনেক ক্রীশ্চান উৎসবের ছুটিও থাকতো – Good Friday, Easter  ছাড়াও  Ignatious Loyola’s birthday, St Patrick’s day ইত্যাদি।  এছাড়া গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি,  বড়দিনের ছুটি। 

    কি অনবদ্য ছিল আমাদের সেই শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো, যা আমরা বন্ধুদের সাথে কাটিয়েছি একসাথে, গভীর অন্তরঙ্গতায় কাটানো সেই দিনগুলোর নানা স্মৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে আমাদের।

    এই বন্ধুত্ব চিরদিনের।

     

    ২০২৪ সাল

       যখন ভাঙ্গলো মিলনমেলা

    আড্ডা হাসি ঠাট্টা স্মৃতি চারণে দীপঙ্করের বড় হলঘর গমগম করছে। প্রচুর ছবিও তোলা হচ্ছে এদিক ওদিক।

    দেরী হয়ে যাচ্ছে, এবার ডিনার শুরু করা যাক, বলল প্রবীর। ততক্ষণে বেশ কয়েক বার আমার গ্লাস ভরে দিয়ে গেছে দীপঙ্কর, মাথাটা বেশ টলমল করছে, পুরনো বন্ধুদের সাথে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চারিপাশ টা বেশ রঙ্গীন লাগছে, মন বেশ হাল্কা, যাকে বলে উড়ুউড়ু।

    ডিনার এর আয়োজন খুব পরিপাটি, নিখুঁত মেনু।  প্রবীরের কেটারার (গুঁই কেটারার্স) এর লোকেরা (তারা সবাই আবার ইউনিফর্ম পরা) দীপঙ্করের ডাইনিং টেবিলে তাদের খাবারদাবার সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে, পাশের ঘরে মেয়েদের বসার বন্দোবস্ত। সব পদই খুব সুস্বাদু, মুখরোচক। শেষপাতে মিস্টি। রাবড়ী আর সন্দেশ। বেশ জমে গেল। 

    খাবার পালা শেষ হতেই যাবার পালা শুরু। প্রায় এগারোটা বাজে, বেশ রাত হয়েছে, এক এক করে সবাই উঠতে শুরু করলো। আমরা কয়েকজন যারা রইলাম তারা দীপঙ্করের বারান্দায় গিয়ে আবার কিছু গ্রুপ ফটো তুললাম, সবাই সবার কাঁধে হাত রেখে। কেউ সামনে বসে কেউ পিছনে দাঁড়িয়ে।

    বাইরে রাত গভীর হচ্ছে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো গল্প করে নিলাম আমরা ক’জন। আবার কবে দেখা হবে, আদৌ হবে কিনা, তা না জেনে।

    আবার সামনের বছর দেখা হবে কি? কে জানে? বন্ধুদের সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় সেই প্রশ্নটা মনে এলো। নাকি আমরা আবার যে যার নিজের বৃত্তে ফিরে যাবো, আমাদের মধ্যে আবার ফিরে আসবে সেই আগেকার দূরত্ব?

    না,না তা কি করে হয়? আজকের এই ইন্টারনেট, ইমেল আর ফেসবুকের যুগে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ এত সহজ হয়ে উঠেছে, এখন একবার পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে আর কি হারানো সম্ভব? আশা করব আমরা এবার থেকে প্রতি বছর একসাথে জড়ো হব, আমাদের সেই বাৎসরিক মিলন উৎসবে এবার যারা আসতে পারেনি, তারাও যোগ দেবে। ক্রমশঃ সেই সব হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের এক এক করে আমরা আমাদের মধ্যে ফিরে পাবো। 

    সেই আশা নিয়ে আমাদের আজকের এই প্রথম সভা শেষ হলো।

    ২০২৫ সাল

     ) পুনশ্চ

    ২০২৫ সালে এই লেখা যখন লিখছি, তখন সেই ২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সাল বারো বছর জানুয়ারীর প্রথমে দীপঙ্করের বাড়ীতে আমাদের বন্ধুদের এই বার্ষিক রিইউনিয়ন প্রতি বছর নিয়মিত হয়ে এসেছে।

    ২০১৪ সালের পর থেকে নতুন অনেকে পরের বছর গুলোতে আমাদের অনেক প্রবাসী সহপাঠী তাদের সুবিধা মতো এই পুনর্মিলন সভায় যোগ দিয়েছে।  তাদের মধ্যে আছে হায়দ্রাবাদ থেকে চৈতন্যময় (গাঙ্গুলী), সিঙ্গাপুর থেকে দেবব্রত (ব্যানার্জ্জী), USA থেকে  সুভাষ (চন্দ্র বোস) আর কিশোর (আচার্য্য), কুয়েত থেকে সিদ্ধার্থ (ভট্টাচার্য্য), কলকাতা থেকে জয়ন্ত দে।   

    কিন্তু এই বারো বছরে আমরা হারিয়েছি আরো বেশ কিছু সহপাঠীকে। ২০১৪ সালেই চলে গেছে অজয় নাথ রায় আর রবীন নাগ। তার পরে এক এক করে চলে গেছে সুভাষ মাধব বোস, প্রদীপ সোম, প্রদীপ মিত্র আর বিপ্লব রায়।

    ভগবানের কাছে তাদের সবার আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।

    ২০২৫ সাল

  •   নামটা  যেন কি? ইস্‌ মনে পড়ছেনা, এই বল্‌না…

    গত শনিবার ১৪/৬/২৫ আমাদের বাড়ীতে ভাই বোনদের আড্ডা বসেছিল। খোকন, মিঠু,ঝুনকু, ভান্টুলি,ঝুন্টু আর কৌশিকী আর আমরা দু’জন। সব মিলিয়ে আমরা আট জন। যখন কাজ করতাম তখন শনি আর রবিবার ছিল ছুটির দিন। কিন্তু এখন কাজ থেকে অবসর নেবার পরে তো রোজই ছুটি,যে কোন একদিন বসলেই হয়।  তবু কেন জানিনা শনি আর রবিবারের ছুটির আমেজ টা আজও মন থেকে মুছে যায়নি।

    এই দুই দিনের মধ্যে শনিবারটা ছুটি হিসেবে রবিবারের থেকেও ভাল কেননা যখন কাজ করতাম তখন রবিবার কেটে গেলে সন্ধ্যা থেকে পরের দিন আবার কাজে যেতে হবে ভেবে মন খারাপ হয়ে থাকতো শনিবার সন্ধ্যায় মন খারাপ হতোনা, পরের দিনটাও তো ছুটি।   কুয়েতে প্রথম গিয়ে শুনি শুক্রবার ওদের জুম্মাবার, সেদিনই ওদের সপ্তাহান্তের ছুটি। রবিবার কাজ করতে যেতে কি যে খারাপ লাগতো। যাক, জীবনের সেই চ্যাপ্টার এখন শেষ।

    সবাই বেলা বারোটার মধ্যে কথামতো চলে এলো। আমি আর খোকন সিঙ্গল মল্ট্‌ নিয়ে বসলাম, বাকিরা সবাই পেপসি আর কোক। সুভদ্রা সাথে চিপ্‌স্‌ আর কাঠবাদাম (Almonds) প্লেটে সাজিয়ে এনে দিলো।

    আড্ডা ক্রমশঃ জমে উঠলো।

    খোকন মিঠুর সাথে আমরা কিছুদিন আগে অমৃতসর ডালহাউসী আর ধর্মশালা ঘুরে এসেছি। আমরা দিল্লী হয়ে গেছি, খোকনরা গেছে কলকাতা থেকে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সাথে অপারেশন সিঁদুরের যুদ্ধ শেষ হয়েছে, অমৃতসর শহরটা পাকিস্তান বর্ডারের খুব কাছে, কিছুদিন আগে ওখানে বোমা পড়েছে, ব্ল্যাক আউটও ছিল। ওয়াগা আতারী বর্ডার বন্ধ। এই সময়ে ওই জায়গায় যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?

    দিল্লীতে মুকুর সাথে কথা হলো। অমৃতসরের কাছে গুরদাসপুরে মুকু অনেকদিন পোস্টেড ছিল। ওই জায়গাটা তার খুব পরিচিত। তার মত হলো এখন ওইসব জায়গায় না যাওয়াই ভালো। কিন্তু টিকিট কাটা হয়ে গেছে, গাড়ী হোটেল ইত্যাদি সব কিছু বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, তা ছাড়া যুদ্ধ তো শেষ। Cease Fire declare করা হয়েছে,এখন পিছিয়ে আসা মুস্কিল।

    আমার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে মুকু খোকন কে ফোন করেছিল। খোকন আমাদের সেই ফোন কল টা অভিনয় করে দেখালো। সে বেশ ভাল অভিনয় করে। তার গলার modulation ও দারুণ, কানের কাছে হাত রেখে অনেকটা যেন টেলিফোনে কথা বলছে সেই ভাবে মুকুর গলাটা যথাসম্ভব গম্ভীর আর ভারী (মুকু দা’ কথা বলে কর্ণেল সাহেবের মতো বেশ আদেশের ভঙ্গীতে) করে আর নিজের গলাটা কিছুটা নরম আর মিনমিনে করে সে তাদের কথোপকথন হুবহু বলে গেল।    

    মুকুঃ হ্যালো, খোকন?

    খোকনঃ মুকুদা’, বলো?

    মুকুঃ মান্টুর কাছে শুনলাম তোরা নাকি অমৃতসর যাচ্ছিস?

    খোকন (আমতা আমতা করে) – হ্যাঁ, সেরকমই তো ঠিক আছে।

    মুকুঃ না না এখন যাস, না। আমি মান্টুকেও বলেছি।

    খোকনের স্টকে মুকুর সাথে এইরকম অনেক টেলিফোন কথোপকথন রয়েছে।  খোকন সেই গুলো ও আমাদের শোনালো।

    প্রথম টা জন্মদিন নিয়েঃ

    মুকুঃ হ্যালো, খোকন?

    খোকনঃ মুকুদা’ , বলো?

    মুকুঃ  Happy birthday!

    খোকন (আমতা আমতা করে) – আজ তো আমার জন্মদিন নয়?

    মুকুঃ (খুব অবাক হয়ে) সে কি? তাহলে আজ কা’র জন্মদিন?

    আর এটা হলো বাড়ীর ঠিকানা নিয়েঃ

    মুকুঃ হ্যালো, খোকন?

    খোকনঃ মুকুদা’ আমি দিল্লী এসেছি। তোমার সাথে দেখা করতে আসবো।

    মুকুঃ  চলে আয়!

    খোকন (আমতা আমতা করে) –  তোমার বাড়ীর ঠিকানা টা দেবে?

    মুকুঃ ঠিকানা? দাঁড়া দিচ্ছি।

    বেশ কিছুক্ষণ পর~

    মুকুঃ খোকন, খুঁজে পাচ্ছিনা রে।

    খোকন – কি খুঁজে পাচ্ছোনা?

    মুকুঃ আমার চশমাটা! কোথায় যে রাখলাম!

    এই গল্পটা শুনে ভান্টুলী অবাক হয়ে বললো মুকুদা’  U 18 এর ঠিকানা  ভুলে গেছে? আমার তো এখনো U 18 এর ফোন নাম্বারও মনে আছে।

    ন’কাকা কাকীমা অনেক দিন দিল্লীতে জ্যেঠুর বাড়ীতে গ্যারেজের ওপরে একটা ঘর নিয়ে থাকতেন। ভান্টূলি বললো রাস্তার উল্টোদিকে বিপুমামার বাড়ী ছিল V 16  Green Park Extension । বিপুমামা  মুম্বাই তে  ফিল্ম  প্রোডিউসার ছিলেন, মাঝে মাঝে ওনার বাড়ীতে  বলিউডের ফিল্ম স্টার রা এসে থাকতো।  ওই বাড়ীতে ফোন ছিলনা, ফোন করার দরকার পড়লে তাদের বলা ছিল U 18 এ গিয়ে ফোন করতে।

    একবার নাকি বিখ্যাত ফিল্মস্টার জিতেন্দ্র ফোন করতে এসেছিলেন। জ্যেঠু  তখন বাড়ীতে খালি গায়ে জাঙ্গিয়া পরে মুগুর ভাঁজছেন। বাড়ীতে ছিল শিখা তার তখনো বিয়ে হয়নি, সে তো সামনা সামনি জিতেন্দ্র কে দেখে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। জিতেন্দ্র যখন বললো আমি কি একটা ফোন করতে পারি, শিখা ছূটে নাকি জ্যেঠুকে বলেছিল বাবা বাবা জিতেন্দ্র এসেছে ফোন করতে…

    জ্যেঠু নাকি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন জিতেন্দ্রটা আবার কে?

    শিখা নাকি জ্যেঠুকে এক ধমক  দিয়ে  বলেছিল,তুমি জিতেন্দ্রর নাম শোনোনি? আশ্চর্য্য! যাও তাড়াতাড়ি পাজামা পাঞ্জাবি পরে এসো।

    সেখান থেকে জিতেন্দ্র  কে নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু হয়ে গেল। জিতেন্দ্রর প্রথম ছবিটা যেন কি? কারুর ঠিক মনে পড়ছেনা।

    সুভদ্রা বললো জীনে কি রাহ!

    কৌশিকীর পুরনো ছবি তে বেশ ভাল ফান্ডা – সে বললো  না না, ওর প্রথম ছবি হলো ফর্জ্‌।

    আজকাল আমাদের কিছু মনে থাকেনা, স্মৃতি ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, এখন আমাদের গুগলই ভরসা। ঝুনকু ফোন খুলে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ দেখে বললো, হ্যাঁ ফর্জ ই ওর প্রথম ছবি।

    সুভদ্রার ও হিন্দী সিনেমার ফাণ্ডা বেশ ভাল। সে বললো ইস্‌, ফর্জের গান গুলো কি দারুণ, – মস্ত বাহারো কা ম্যায় হুঁ আশিক – আহা – ঝুন্টু তোর মনে আছে আমরা কিরকম হিন্দী ছবি দেখেছি এক সময়। তুই টিকিট কেটে আনতি।

    সুভদ্রা এখনো হিন্দী গান বেশ ভালই গায়, সে দুই হাত ছড়িয়ে নাচের ভঙ্গীতে গেয়ে উঠলোঃ সারা জাঁহা হ্যায় মেরে লিয়ে ~

    আমাদের সকলের যে বয়েস হচ্ছে, তা এখন আমাদের কথাবার্ত্তা থেকেই  বোঝা যায়। কিছুদিন আগেও আমাদের এই আড্ডায় খুব হাসি ঠাট্টা হতো, আমরা বেড়াতে যাবার কথা বলতাম। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীরা আমাদের আলোচনায় আসতো। এবার দেখলাম  আমরা বেশীর ভাগ সময়ে কথা বলছি আমাদের নিজেদের নিয়ে। আমরা বুঝতে পারছি যে আমাদের জীবনে ক্রমশঃ একটা ছায়া নেমে আসছে। ভাই বোনেরা অনেকেই বিদায় নিয়েছে, আমরা যারা আছি, তারাও একটা বাধ্যতামূলক একা হয়ে যাওয়া আর পরাধীনতার দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধছে, আমরা হয়তো জানিওনা। আমরা কেউ কেউ যারা কানে কম শুনছি তাদের সাথে বেশ জোরে বা কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। খোকন বললো সে কিছুদিন আগে স্নেহদিয়া নামে রাজারহাটে একটা Old age home এ গিয়ে কথা বলে খোঁজখবর করে এসেছে।

    এই নিয়ে কিছুদিন আগে প্রচেত গুপ্ত রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন, তার নাম “এ বড় সুখের সময় নয়!”

    সব চেয়ে বেশী যেটা বোঝা যাচ্ছে সেটা হল আমাদের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্ব্বল হয়ে যাচ্ছে। Dementia বা Alzheimers এখনও হয়নি কারুরই, কিন্তু কোন জায়গা বা কোন সিনেমা বা কারুর নাম  বলতে গেলে কোথাও আটকে যাই, প্রানপণ চেষ্টা করেও কোন নাম  কিছুতেই মনে করতে পারিনা। মাথার ভিতরে memory cell গুলো কোন অদৃশ্য পোকা কুরে কুরে খেয়ে চলেছে।

    বিশেষ করে নাম ভুলে যাওয়া টাই সব চেয়ে বেশী। ঝুন্টু বললো ও নাকি Proper noun মনে রাখতে পারেনা। 

    বহুদিন আগে, তখন কুয়েতে উইকেন্ডে বন্ধুদের বাড়ীতে আড্ডা বসত। সেই রকম কোন এক আড্ডায় একবার আমাদের এক বন্ধু সিদ্ধার্থ সাহেব বিবি গোলাম সিনেমাটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারছিলোনা। তার সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা এখনো মনে পড়ে। যাতে আমাদের কারুর মনে পড়ে সেই জন্যে আমাদের নানা clue দিয়ে যাচ্ছিল।   আরে বিমল মিত্রের লেখা বিখ্যাত  উপন্যাস।  আরে সেই যে এক জমিদারের সুন্দরী বৌ সুমিত্রা দেবী একা একা মদ খেতে শুরু করলো! আরে উত্তম কুমার ও ছিলো একটা ছোট রোলে! মনে পড়ছেনা?   

    আমি লেখালেখি করি। লিখতে গিয়ে প্রায়ই কোন একটা বিশেষ শব্দ ব্যবহার করতে চাই, সেই শব্দটা আমার জানা, কিন্তু কিছুতেই সেই শব্দটা মনে পড়েনা।  মাথার ভিতরে কোন এক অতল অন্ধকার জায়গায় সে লুকিয়ে থাকে, সেখান থেকে তাকে অনেক চেষ্টা করেও বের করে আনতে পারিনা। গভীর জলের তলায় যেন ডুবে থাকা মণি মুক্তোর মতই লাগে তাদের, ডুবুরী লাগিয়েও যাদের খুঁজে পাওয়া সোজা কাজ নয়। তখন খুব অসহায় লাগে।

    আমি ঝুন্টু কে বললাম আমার তো Common noun ও মনে আসেনা রে।

    শরীর আমাদের এই সব ছোট ছোট সাবধানবাণী শোনাচ্ছে – যাকে বলে early signal – বিদায়ের সময় আগত ভাই সব! প্রস্তুতি শুরু করো।

    ঝুন্টু কৌশিকী কে বললো, “আমরা মান্টুদা’ কে আজ কি একটা ্জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম না?” কৌশিকী বলল, “সত্যি, একদম মনে পড়ছেনা।“

    আরো অনেক কিছুই এরকম মনে থাকেনা।

    যাই হোক, জিতেন্দ্র থেকে আমরা চলে গেলেম নায়িকাদের দিকে। ফর্জে জিতেন্দ্রর নায়িকা কে ছিল? কারুর মনে নেই। সাধনা, নূতন, রেহানা সুলতানা?

    আমাদের গুগল বিশেষজ্ঞ ঝুনকু আবার ভুরু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ববিতা”…

    ববিতা নামে যে একজন নায়িকা ছিল তা আমরা ভুলেই গেছি।

    আমি বললাম ওফ, সেই সময়ের সিনেমায় নায়ক আর নায়িকারা কি নাচানাচি আর ছোটাছুটিই না করত, মাঠে ঘাটে ,রাস্তা ঘাটে পাহাড়ে গাছের মধ্যে যেখানে হোক, ধেই ধেই করে নেচে প্রেম নিবেদন।

    তারাপদদা’র কবিতায় একটা লাইন ছিল~

    ভালবাসাবাসি ছাড়া আর কোন কাজ নেই সোমত্থ যুবক যুবতীর।

    আমাদের কমবয়েসে শাম্মী কাপুর আর  জিতেন্দ্র এই দু’জন ছিল নাচানাচি তে ওস্তাদ।

    কে বেশী সুন্দরী ছিল,নূতন না সাধনা?

    এই নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ দেখা  গেল। সাধনা কে নিয়ে আমি আমার জীবনের একটা গল্প বললাম।

    মার্চ্চ, ১৯৬৩। হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার প্রথম দিন। বাবা একটা গাড়ী বলেছেন আমায় পরীক্ষার সেন্টারে নামিয়ে দেবে। আমি মনোহরপুকুরের বাড়ীর  ছোট বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। গাড়ীটা আসতে এত দেরী করছে কেন? গত তিন মাস খুব খেটেছি, কিন্তু এখন যেন কিছুই মনে পড়ছেনা, বেশ নার্ভাস লাগছে, ভয়ে বুক দুরদুর করছে।  কি প্রশ্ন আসতে পারে তাই নিয়ে ভেবে যাচ্ছি।

    হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে একদল ছেলে যাচ্ছে, তারা নিজেদের মধ্যে বেশ চেঁচিয়ে কথা বলতে বলতে  শুনে বুঝলাম তারাও হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, কাছেই কোন স্কুলে তাদের সীট পড়েছে। তাদের সকলেরি হাসি মুখ, চিন্তার লেশমাত্র আছে বলে মনে হলোনা। একজন শুনলাম বলছে “saলা, আমি তো saধনার মুখ টা মনে করে যা খুসী লিখে আসবো মাইরী।“

    সাধনা খুব একটা তেমন সুন্দরী না হলেও তখন খুব জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু সুভদ্রার ভাল লাগতো নূতন কে।

    সেই রাজকাপুর আর নূতনের সিনেমাটা যেন কি? দারুন সব গান ছিল মুকেশ আর লতার…

    আমি বললাম “আনাড়ী?”

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে সুভদ্রা গেয়ে উঠলো , “ও চাঁদ খিলা,ও তারে হসে, ও রাত অজব মতওয়ারী হ্যায় – সমঝনে ওয়ালে সমঝ গয়ে হ্যায় – না সমঝে ও আনাড়ী হ্যায়”। হিন্দী গানে সুভদ্রা এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী যাকে বলে second to none..

    এই সব গল্প হতে হতে বেলা দু’টো বেজে গেছে , এবার লাঞ্চ। 

    আজকের মেনু হলো খাঁটি বাড়ীর খাবার।  ভাত, ডাল, লাউচিংড়ী, ধোকার ডালনা,  পার্শে মাছ ভাজা,  রুই মাছের ঝোল, কাঁচা আমের চাটনি।  শেষপাতে  মিষ্টি, কৌশিকী এনেছে লাল দই, আর মিঠু এনেছে রাজভোগ আর হিমসাগর আম।

    খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে আবার আড্ডা, সেই আড্ডায় এলো অনেক পুরনো দিনের মনোহরপকুরের বাড়ীর পারিবারিক স্মৃতি। আমাদের পিতামহ ব্রজবন্ধু ভৌমিকের লেখা তাঁর বাবা দীনবন্ধু ভৌমিকের সংক্ষিপ্ত জীবনী “পিতৃতর্পন” নিয়ে আলোচনা হলো। আমি বললাম আমাদের ভৌমিক পরিবারের ইতিহাস এবং বংশ তালিকা নিয়ে আমার একটা বই লেখার পরিকল্পনার কথা। সকলে খুব উৎসাহ দিলো আমায়। কিন্তু শুধু মুখের উৎসাহ দিলে তো হবেনা। আমায় তথ্য দিতে হবে। আমি এটা খসড়া করে সবাইকে পাঠাবো বললাম, কোন তথ্য না থাকলে বা তাতে কোন ভুলচুক হলে যেন সবাই যার যার মত করে সেগুলো আমায় সংশোধন করে দেয়।

    এদিকে কলকাতায় খুব বাঁদরের উৎপাত শুরু হয়েছে। অনেক জায়গাতেই খবর পাচ্ছি কলকাতায় বাঁদরদের উপদ্রব বাড়ছে। ঝুনকু বললো ওদের পাটুলীর বাড়ীতে নাকি একটা বাঁদর ছানা এসে বাড়ীর ভিতর থেকে কিছু খাবার নিয়ে ছাদে গিয়ে বসে খাচ্ছিল। খবর পেয়ে ঝুনকু নাকি ছাদে গিয়ে বাঁদর ছানা টাকে বাংলায় তুমুল বকেছে। “আর এক বার যদি এরকম বাঁদরামি করিস  তাহলে ঠাসঠাস করে দুই গালে দুই চড় খাবি।“

    ঝুন্টু বললো কি আশ্চর্য্য, বাঁদররা তো বাঁদরামি ই করবে।

    ঝুনকু বললো না রে, আমার বকুনী খেয়ে বাঁদরবাচ্চা টা ঠিক মানুষের বাচ্চার মত ভয় পেয়ে মুখ লুকিয়ে ফেললো।

    খোকন বললো সাবধান ওদের বেশী কাছে যাস্‌না। বাচ্চাটার মা এসে “আমার ছেলে কে কেন বকছো বলে তোকেই দুটো ঠাস ঠাস করে কষিয়ে দুটো চড় মেরে দেবে।‘  

    বাঁদর দের নিয়ে একটা বিখ্যাত জোক আছে, সেটা অনেকেই জানে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বার বার শুনেও সবাই হো হো করে হাসে।  যেন এই প্রথম শুনলো।

    ———–

    চিড়িয়াখানায় খাঁচার ভিতর থেকে একটি বাঁদর এক ভদ্রলোকের চশমা কেড়ে নেয়।

    কি করে এটা সম্ভব হলো?

    আসলে হয়েছে কি, খাঁচার সামনে একটা নোটিস টাঙ্গানো ছিল। ভদ্রলোক কৌতূহলী হয়ে খাঁচার খুব কাছে গিয়ে ঝুঁকে নোটিসটা পড়তে গিয়েছিলেন, তাতেই এই বিপত্তি।

    নোটিসে লেখা ছিল “সাবধান!! বাঁদরেরা চশমা কাড়িয়া লয়!”

    এই গল্পটা শুনে একটি মেয়ে নাকি একটুও না হেসে বলেছিল “সত্যি বাঁদরগুলো যা অসভ্য!”

    ———–

    এবার ও খুব একচোট হাসাহাসি হলো।

    বিকেলে কফির সাথে সুভদ্রার তৈরী Banana ব্রেড।

    দিনটা বেশ কাটলো।

  •  আশ্চর্য্য ভ্রমণ – গোপালপুর (২২ – ২৬ আগস্ট, ২০২২)

    পূর্ব্বকথা

    আমরা স্কুলের তিন বন্ধু অমিতাভ, দীপঙ্কর আর আমি গোপালপুর বেড়াতে যাচ্ছি। 

    অনেক আলোচনার পরে গোপালপুর যাওয়া ঠিক হয়েছে।। কাছেই পুরী আর দীঘা আছে, কিন্তু দুটোই চেনা এবং বড্ড ভীড়। গোপালপুরে ওবেরয় দের পাম বীচ রিসর্ট হোটেলটা বেশ upmarket, এখন অবশ্য মেফেয়ার নামে একটা চেন সেটা কিনে নিয়ে renovate করে অনেক বাড়িয়েছে, সেখানে সমুদ্রতট ও শুনেছি খুব চওড়া আর পরিস্কার আর ভীড়ও কম।

    আমি কখনো সেখানে যাইনি, কিন্তু ছোটবেলায় সুভদ্রা মা বাবার সাথে গেছে একবার। আমরা দু’জনেই গোপালপুরে যেতে রাজী। অমিতাভ সুজাতারা বিয়ের পরে ১৯৭২ সালে সেখানে হানিমুন করতে গিয়েছিল। সেখানে অনেক বছর পরে গিয়ে আর একবার সেই পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরে পাবার জন্যে তারাও যেতে রাজী। আর দীপঙ্কর সেখানে একসময় Institute of Chartered Accountant (East India Chapter) এর সেক্রেটারী পোস্টের ইলেকশনে জেতার জন্যে উড়িষ্যা চষে খেয়েছে, জায়গাটা তাই এখনো তার হাতের পাতার মত চেনা। সেও রাজী।

    ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে নির্জ্জন এক সমুদ্রের বেলাতটে কিছুদিন একসাথে কাটানোটাই আসল উদ্দেশ্য। আমাদের তিনজনের অনেকদিনের বন্ধুত্ব, আমরা তিন জনেই সারা পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু একসাথে আমাদের বেড়ানো এই প্রথম।   

    গোপালপুরে হাওড়া থেকে ট্রেণে করে বেরহমপুর স্টেশনে ভোরবেলা নেমে গাড়ী করে হোটেলে যাওয়া যায়। সেখান থেকে গোপালপুর বেশী দূর নয়। কম বয়েসে দীপঙ্কর আর অমিতাভ ট্রেণেই গোপালপুর গেছে, হোটেল থেকে স্টেশনে গাড়ীও পাঠিয়ে দেবে বললে। তবে এই বয়সে ট্রেণের থেকে প্লেনে যাওয়া টাই আমাদের কাছে বেশী সুবিধের মনে হলো। আজকাল প্লেনের টিকিট আর ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস স্লীপারের ভাড়া প্রায় একই। তাই খরচও তেমন কিছু বেশী নয়। দমদম থেকে সকালের প্লেনে ভুবনেশ্বর পৌঁছে সেখান থেকে বড় একটা গাড়ী ভাড়া করে গোপালপুরে হোটেলে পৌঁছনোটাই শেষ পর্য্যন্ত ঠিক হলো।

    ভুবনেশ্বর থেকে গোপালপুর ১৭০ কিলোমিটার, গাড়ীতে যেতে প্রায় চার ঘন্টা লাগবে, সেটাই একমাত্র downside। রাস্তা (ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৬) অবশ্য খুব ভাল, দীপঙ্কর জানালো।

    ঠিক হলো আমরা বেরোব ২২শে আগস্ট, ফিরবো ২৬শে আগস্ট, ২০২২। হোটেলে চার রাতের রিসার্ভেশন করলো অমিতাভ। দীপঙ্কর কাটলো প্লেনের টিকিট। সুভদ্রা ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট থেকে গোপালপুর মেফেয়ার পাম বীচ হোটেল পর্য্যন্ত যাবার গাড়ীর বন্দোবস্ত করে ফেললো।

    আজকাল এসব কাজ করা যায় বাড়ীতে বসে একটা মোবাইল ফোন থেকে। টেকনোলজী কা কেয়া খেল্‌ হ্যায়!    

    প্রথম দিন ২২শে আগস্ট, ২০২২

    ১) আমাদের যাত্রা হলো শুরু  

    ২২/৮/২২ সকালে দমদম এয়ারপোর্টে চেক ইন করে পাঁচজনে গিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসে গল্প করছি। দীপঙ্কর খোঁজ নিয়ে এসে জানালো যে আমাদের প্লেন এখনো এসে পৌঁছয়নি। তাই প্লেন ছাড়ার এখনো বেশ দেরী। আমি আর অমিতাভ এর মধ্যে একটু কফি খেয়ে এলাম। কোথাও বেড়াতে যাবার আগে এই সময়টা আমার বেশ লাগে, সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে একটা অষ্পষ্ট ভাল লাগা, উত্তেজনা।

    ইতিমধ্যে দীপঙ্করের বাড়ী থেকে একটা ফোন এলো। দীপঙ্কর দেখলাম ফোনটা পেয়ে বেশ একটু রেগে গিয়ে বলছে, “কি? কেক আর ফুল রেখে গেছে? কে? কি নাম?” তার একটু পরে শুনলাম বলছে, “ঠিক আছে কেকটা তোমরা খেয়ে নাও আর ফুলগুলো সব ফেলে দাও~”

    বাড়ীর কাজের লোকের ফোন, যা বোঝা গেল। কেউ একজন দীপঙ্করকে কেক আর ফুল পাঠিয়েছে। কিন্তু এতে রেগে যাবার কি আছে? সুজাতা বললো “বুঝলেনা, এক নাছোড়বান্দা মহিলা…”

    আমি বললাম “তা তো বুঝলাম, কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে আজ দীপঙ্করের জন্মদিন নাকি? তাহলে তো হোটেলে গিয়ে সেলিব্রেট করতে হবে!”

    দীপঙ্কর সজোরে প্রতিবাদ করে বললো “আরে ভাই, না না, আজ আমার জন্মদিন নয়।” দীপঙ্করের প্রায় সব কথাই “আরে ভাই” দিয়ে শুরু হয়। 

    অমিতাভ বললো “কাল দীপঙ্করের জন্মদিন, আমরা হোটেলে কাল সেলিব্রেট করবো!”

    বেশ বেশ, বেড়ানো এবং জন্মদিন – একসাথে দুই মজা।

    মাত্র দেড় ঘন্টার প্লেন জার্নি ভালোই হলো, কিছু বোঝার আগেই নির্ঝঞ্ঝাটে সময় মত ভুবনেশ্বর পৌঁছে গেলাম। দীপঙ্করের সেক্রেটারী খাবারের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, স্যান্ডুইচ আর Mango juice, তা ছাড়াও আমাদের সাথে কিছু কেক বিস্কুট ইত্যাদি ছিল। সেগুলোর ও সদব্যবহার হলো।

    গাড়ী এসে গেল ফোন করতেই। মালপত্র তুলে বেরিয়ে পড়লাম।

    ভুবনেশ্বর শহরটা বেশ লাগছিল গাড়ীর জানলার বাইরে, ছিমছাম সবুজ, low skyline, পরিস্কার চওড়া রাস্তা ঘাট, আর একবার শহরের বাইরে আসার পরে রাস্তার দুই পাশে একের পর এক স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়, বেশীর ভাগই বেসরকারী মনে হলো। দীপঙ্কর বললো উড়িষ্যা হলো দেশের মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে। দেশের নানা প্রদেশ থেকে ছেলে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে।

    গাড়ীর ভেতরে যেতে যেতে নানা গল্প হচ্ছে, বেশীর ভাগ গল্প দীপঙ্করের। সে কম বয়সে এখানে এসে Institute of Chartered Accountants এর সেক্রেটারী হবার ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পেন করতে এসে প্রায় সব নামকরা Chartered Accountancy firm এর পার্টনার দের সাথে দেখা করেছিল, পরে সে নির্ব্বাচনে জিতে ICA Eastern Chapter এর সেক্রেটারী হবার পরে সেই যোগাযোগ আরো গাঢ় হয়, এবং এদের অনেকের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়। তার নিজের ব্যবসার জন্যেও এই যোগাযোগ এবং বন্ধুত্ব খুব জরুরী।

    এই সব কারণে উড়িষ্যার এই দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের সাথে তার পরিচয় খুব গভীর।          

    এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অডিটর যিনি কিনা উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের ব্যক্তিগত কাজ দেখেন, তিনি হলেন দীপঙ্করের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি নাকি প্রতি বছর তাকে নিজের বাগানের প্রচুর আম পাঠান। গাড়ীতে যেতে যেতে দীপঙ্কর সেই ভদ্রলোককে ফোন করে জানিয়ে রাখলো সে গোপালপুর যাচ্ছে এবং রাত্রে হোটেল থেকে ফোন করে কথা বলবে।

    এরকম জনসংযোগ না থাকলে ব্যবসা বাড়ানো যায়না। দীপঙ্করের চার্টার্ড একাউন্টেসী ফার্মের ব্যবসা হু হু করে বেড়ে চলেছে।   

    কিছুদূর পরে একটা ছোট জনপদ পড়লো রাস্তার দুই পাশে অনেক ভীড় জটলা, কিছু দোকান। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা “কুনা কাফে।” 

    সুভদ্রা বললো কি অদ্ভুত নাম, কুনা কাফে।

    দীপঙ্কর খুব গম্ভীর মুখ করে বলল “কুনা কাফে মানে কি জানো তো? এই কাফে টা হলো ঘরকুনো লোকেদের বাড়ীর বাইরে একমাত্র কফি খাবার জায়গা।”

    সুজাতা একটু হেসে প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতে বললো, “দীপঙ্করের যত সব বাজে কথা!”

    এই রকম ভাবে দীপঙ্করের গল্প আর অনর্গল ফাজলামি ভরা কথা শুনতে শুনতে আমরা যখন গোপালপুর পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে।

    মেফেয়ার পাম বীচ হোটেলটা বেশ ঝাঁ চকচকে। ঢুকেই বিশাল লাউঞ্জ। এই পাঁচতারা হোটেলটা প্রথমে ওবেরয়দের ছিল। দেশের মধ্যে Premier Deluxe luxury resort হিসেবে গোপালপুরের ওবেরয় পাম বীচ হোটেলের খুব সুনাম ছিল। মেফেয়ার গ্রুপ তাদের কাছ থেকে প্রপার্টিটা কিনে নিয়ে এখন অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে শুনেছি। তাছাড়া আগে একতলা ছিল, এখন দোতলা হয়েছে। 

    যাই হোক, হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে আমাদের ঘরের চাবি আর মালপত্র ঘরে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করে ঘরে যাবার পথে দীপঙ্কর রিসেপশনের ছেলেটাকে একটু হেসে বলে গেল, “আমাদের ভালো ভাবে দেখাশোনা কোরো কিন্তু, নাহলে দিলীপের কাছে খবর চলে যাবে!”

    দিলীপ রায় হলো মেফেয়ারের মালিক, আর দীপঙ্করের বন্ধু।

    ২ আড্ডা আর ডিনার   

    হোটেলটা 5 Star Deluxe, তাই বেশ সাজানো গোছানো ঝকঝকে। দামী কার্পেটে ঢাকা মেঝে। আমাদের তিনটে ঘর দোতলায়। আমাদের আর অমিতাভদের ঘর পাশাপাশি, দীপঙ্করের ঘর সামান্য একটু দূরে। বেশ বড় ঘর, উঁচু সিলিং। ঘরের পাশে একটা লম্বা ব্যালকনি, সেখানে চেয়ার টেবিল সাজানো, বড় কাঁচের জানলা দিয়ে দূরে সমুদ্র দেখা যায়, কিন্তু এখন অন্ধকার, কাল সকালে সেখানে চা নিয়ে বসে গল্প করা যাবে। দীপঙ্করের ঘরে ব্যালকনি নেই। ওর বুকিং একজনের জন্যে, তাই বোধ হ্য় ব্যালকনি ছাড়া ঘর। 

    মালপত্র রেখে হাত পা মুখ ধুয়ে আমরা দীপঙ্করের ঘরে গিয়ে বসলাম। ডিনারে যাবার আগে দীপঙ্করের আনা দামী হুইস্কির সাথে একটু আড্ডা হোক। সাথে অনেক চানাচুর আর বাদাম ও আনা হয়েছে।

    দীপঙ্কর তিনটে খুব নামী দামী, স্কচ হুইস্কির বোতল এনেছে, যদিও আমি কোনটারই নাম শুনিনি, কিন্তু গলায় ঢেলেই বুঝতে পারছি এর জাত আলাদা, এই তরলে গলা জ্বলেনা, একটা ঝিমঝিমে নেশা হয়। অভ্যাস মত সাথে কচর মচর করে হুইস্কির সাথে চানাচুর আর বাদাম খাচ্ছি হঠাৎ দীপঙ্কর বললো, “ইন্দ্রজিৎ, এই মালের সাথে কোন কিছু খাওয়ার নিয়ম নেই ভাই, শুধু না গলায় ঢাললে এর স্বাদ বুঝবেনা।”

    সুভদ্রা বলল “দ্যাখোনা ইন্দ্রজিৎ তো সাথে বিস্কুট না থাকলে চা খায়না। যেন বিস্কুট খাবার জন্যেই ও চা খায় মনে হয়। আর যে কোন ড্রিঙ্কের সাথে ওকে বাদাম চিপস বা মাছের চপ দিতেই হবে।” আমার নামে কিছু বলার সুযোগ পেলে সুভদ্রা ছাড়েনা।

    চানাচুর আর বাদাম বাদ দিয়ে শুধু দীপঙ্করের দামী হুইস্কি খেতে কিন্তু বেশ ভাল লাগলো, অস্বীকার করবোনা।

    আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। এর মধ্যে দীপঙ্করের সেই বন্ধু ফোন করে খবরাখবর নিলেন। আমাদের বেড়াবার কি প্ল্যান ওনাকে জানালে উনি সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। বালুগাঁও এর মাছের বাজার অথবা চিল্কা হ্রদে নৌকাবিহার, কাছাকাছি সব দর্শনীয় স্থানেই তাঁর অনেক চেনশোনা। চিল্কায় পান্থনিবাস হোটেলে আমাদের লাঞ্চের ব্যাপারটাও উনি দেখে দেবেন বললেন। দীপঙ্কর ওনাকে কাল ফোন করে আমাদের বেড়াবার প্ল্যান জানাবে ঠিক হলো।

    শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে দীপঙ্করের গভীর জ্ঞান, তাই আমাদের আলোচনায় রাগ রাগিনী খেয়াল ধ্রুপদ কিংবদন্তী শিল্পী আর তাঁদের ঘরানা এসে গেল। বিসমিল্লা খান কিরকম অল্প বয়সে বেনারসে কাকা অসুস্থ হলে অষ্টপ্রহর বাঁশী বাজিয়েছিলেন, আল্লারাখা রবিশঙ্কর কে এক ফাংশনে কানে কানে বলেছিলেন “বেটা আউর শাদী মত্‌ কর্‌”, কোন এক দুঃস্থ কিশোর খুঁজে খুঁজে অনেক দূরের কোন শহরে গিয়ে শেষ পর্য্যন্ত তার গুরুকে খুঁজে পেয়ে পরে এক বিখ্যাত শিল্পী হয়েছিলেন, এই সব অনেক গল্প আমরা শুনলাম দীপঙ্করের কাছে।

    রাগ রাগিনী নিয়েও দীপঙ্করের পান্ডিত্য অসাধারণ, তার কাছে কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিশাল কালেকশন তার বাড়ীতে প্রায়ই সঙ্গীতের আসর বসে, সেই আসরে কলকাতার অনেক সঙ্গীত রসিক ও বোদ্ধারা এসে মাঝে মাঝে যোগ দেন।

    দীপঙ্করের কাছ থেকে জানলাম ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুণ), মরুৎ (বাতাস) আর ব্যোম (আকাশ) এই পাঁচ টি প্রাকৃতিক element নিয়ে মহাদেব পাঁচটি রাগ তৈরী করার পরে পার্ব্বতী চেয়েছিলেন পাঁচটি একসাথে মিশিয়ে একটি রাগ যেন মহাদেব তৈরী করেন। মহাদেব নাকি পার্ব্বতীকে বলেছিলেন এই কাজটা তুমি করো পারু।

    আমি দীপঙ্কর কে বললাম মহাদেব পার্ব্বতী কে পারু বলে ডাকতেন নাকি? দীপঙ্কর বলল “হ্যাঁ, সেজন্যেই তো শরৎচন্দ্র দেবদাস কে দিয়ে পার্ব্বতীকে ওই নামে ডাকিয়েছেন।” 

    অমিতাভ বললো, “তো পারু কি রাগ কোন তৈরী করেছিলেন?”

    দীপঙ্কর বলল “মালকোষ!”

    সুভদ্রা্র ও রাগ রাগিণী নিয়ে কিছু ফান্ডা আছে, সে বললো পন্ডিত যশরাজ একবার দূর্গা পূজোয় কুয়েতে এসে রাগ দূর্গা শুনিয়েছিলেন, এত ভাল লেগেছিল, এখনো ভুলিনি।

    দীপঙ্কর সুভদ্রাকে উড়িয়ে দিয়ে বললো “যশরাজ? দূর, ওই লোকটার তো পোটাটো ডিফেক্ট~”

    সুজাতা সুভদ্রার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বললো “গান গাইবার সাথে পোটাটো ডিফেক্ট এর কি সম্পর্ক?”

    সুভদ্রা আমার নামে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে বললো “ইন্দ্রজিৎ এর ও খুব পোটাটো ডিফেক্ট জানো তো, ওর পিছনে মেয়েদের লম্বা লাইন…”

    সুজাতা বললো, “তাই নাকি ইন্দ্রজিৎ? এটা তো জানতামনা।”

    আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “সব গুণী লোকেদেরই পোটাটো ডিফেক্ট থাকে, যেমন রবীন্দ্রনাথ, পন্ডিত যশরাজ, আমি…”

    এই সব কথা হচ্ছে এমন সময় রেস্টুরেন্ট থেকে ফোন এলো, স্যার আপনাদের ডিনার রেডি, চলে আসুন।

    বিশাল বড় আলো ঝলমলে সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্ট। দরজার বাইরে সাদা দেয়ালে টাঙানো ইন্দিরা গান্ধী, জে আর ডি টাটা, এবং আরও নানা রথী মহারথীর ছবি, তাঁরা সবাই এই হোটেলে অতিথি হয়ে এসে থেকে গেছেন। উঁচু সিলিং, ঝকঝকে মার্বেলের মেঝে, ভারী দরজা, চারিদিকে বৈভবের ছাপ। ওবেরয় সাহেবের উত্তরাধিকার, বোঝা যায়। আমাদের দেশের হোটেলের ব্যবসায় তিনি এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ ছিলেন।

    একটি মেয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে একটা বড় টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালো। তার নাম লোপামুদ্রা। মেয়েটি হাসিখুসী, ছোটখাটো গোলগাল চেহারা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা তার কাজ হলো সবার দেখাশোনা করা, সে হলো হোস্টেস। আমাদের সাথে তার বেশ আলাপ হয়ে গেল।

    আমরা লোপামুদ্রা কে বললাম কাল আমাদের বন্ধুর জন্মদিন, আমরা একটা স্পেশাল কেক চাই, আর তাছাড়া তোমাদের এখানে একটা ছানাপোড়া বলে একটা মিষ্টি আছে, সেটা কাল আমাদের খাওয়াতে পারবে?

    লোপামুদ্রা তখন ওদের শেফ কে নিয়ে সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। কাল দীপঙ্করের জন্মদিন পালন করা হবে একটা স্পেশাল ডিনার দিয়ে, তার মেনুও আমরা ঠিক করে দিলাম, সাথে কেক, ছানাপোড়া সব ওরা বন্দোবস্ত করবে। শেফ আমাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন তিনি নিজে কেক আর ছানাপোড়া তৈরীর দায়িত্ব নেবেন।  

    কেক এ দীপঙ্করের নাম লেখা হবে, আমি সেই নামের বানান লোপামুদ্রাকে একটা কাগজে লিখে দিলাম।           

    ৩ ) দ্বিতীয় দিন – ২৩/৮/২২

    দীপঙ্করের জন্মদিন আজ, সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাকে সবাই অভিনন্দন জানালাম। ব্রেকফাস্টের পর সেরে সবাই মিলে সমুদ্রের ধারে   হোটেলের পিছনে একটা বড় বাগান, চারদিকে দেয়ালে ঘেরা, এক কোণে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট, পাশে কিছু টেবিল চেয়ার পাতা। শুনলাম প্রতিদিন বিকেলে সেখানে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া যায়, সাথে সিঙাড়া, ঝালমুড়ি। On the house..তা ছাড়া সাথে একটা গানের অনুষ্ঠান ও নাকি রোজ বিকেলে

    হোটেলের বাইরে সমুদ্র, সেখানে যেতে গেলে একটা গেট দিয়ে যেতে হবে, সেখানে একজন লোক একটা খাতা খুলে বসে আছে, নাম ধাম রুম নম্বর ইত্যাদি লিখতে হবে, হোটেলের অতিথিরা বাইরে গেলে তাদের একটা রেকর্ড রাখা, হোটেলে ফেরার সময় আবার সেই খাতায় সই করতে হবে। কেউ যাতে হারিয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা। মানে হয়তো সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আর ফিরলোনা, হতেও তো পারে?

    এই হোটেলের নিজের কোন সৈকত আছে বলে kiমনে হলোনা। নিজের নুলিয়াও নেই। তবে কয়েকজন নুলিয়া এসে আলাপ করলো। তারা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। অনেক করে বলা সত্ত্বেও আমরা টায়ার নিয়ে সমুদ্রে নামবোনা, তাই তারা বেশ আশাহত। নিজের মনেই তারা সমুদ্রের জলে নেমে কাঁকড়া ধরতে চলে গেল।

    আমরা তিন জনেই আজ হাফ প্যান্ট পরে এসেছি। কমবয়েসে সমুদ্র অনেকবার দেখা, নুলিয়ার হাত ধরে সমুদ্রে ঢেউয়ের মোকাবিলাও করেছি অনেক। এই বয়সে এখন আর জলে নামার ইচ্ছে নেই। এখন শুধু সমুদ্রের শোভা দেখা আর নরম ভেজা বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটা।    

    একটা বিশাল ছাতা হোটেল থেকে দিয়ে গেছে, তার তলায় অনেক গুলো চেয়ার। আমরা সেখানে বসে বালিতে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম। তারপরে খালি পায়ে বালির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেলাম। হোটেল ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে একটা খুব পুরনো লাইটহাউস। লাল সাদা রং এর এই লাইটহাউসটি গোপালপুরের একটি দর্শনীয় স্থাপত্য, নানা জায়গায় এর ছবি দেখেছি। 

    তবে এক সময় এই লাইটহাউসটি জাহাজের নাবিকদের কাজে লাগলেও, আজ তার চারিদিকে ভাঙ্গাচোরা কিছু বাড়ী, অবক্ষয়ের চিহ্ন চারিদিকে। এত দামী একটা 5 star luxury resort এর ঠিক পাশে এই রকম একটা বিশ্রী পরিবেশ দেখে বেশ অবাকই লাগে। ওবেরয় রা অনায়াসে এখানে একটা চমৎকার বাগান বানিয়ে দিতে পারতেন। তার বদলে এখানে ভাঙাচোরা আর পোড়ো বাড়ী, ধুলো ময়লা ভরা রাস্তাঘাট, এত দামী একটা হোটেলের পাশে মোটেই মানানসই নয়। 

    অনেকটা হেঁটে ফিরে এসে দীপঙ্কর আর আমি গিয়ে সমুদ্রের ধারে বসলাম। ঢেউ এসে পায়ের কাছে ভেঙে আবার ফিরে যাচ্ছে, আমরা গল্প করে যাচ্ছি। দূরে পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ উঠছে একের পর এক, কিন্তু আমরা নিরাপদ দূরত্বে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। কূলে ঢেউ এসে ভেঙে আমাদের পা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু বড় ঢেউ বুক পর্য্যন্ত এসে ফিরে যাচ্ছে। 

    আমাদের দু’জনের বাড়ী কাছাকাছি ছিল বলে  স্কুলে পড়তে দীপঙ্কর আর আমি একসাথে নানা গল্প  করতে করতে হেঁটে বাড়ী ফিরতাম, তখন থেকেই দীপঙ্করের  খুব সাহিত্যে নেশা।  আমিও বইয়ের পোকা ছিলা, কিন্তু আমি পড়তাম বাংলা গল্প উপন্যাস, দীপঙ্করের নেশা ছিল ইংরেজী ভাষায় নানা দেশের লেখকদের লেখা non-fiction – নানা বিষয় নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। আমাদের দু’জনেরি বই পড়ার ব্যাপারে  সেই অভ্যেস এখনো আছে। দীপঙ্কর আমায় আমাকে তার প্রিয় লেখক এবং তাদের কিছু অসাধারণ বই সম্বন্ধে বলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কিছু বই সে আমায় পড়াবেই।  পরে সে একটা কাগজে তার প্রিয় কিছু লেখক ও তাদের কয়েকটা বইয়ের নাম ও লিখে দিয়েছিল।  ওর ধারণা শুধু fiction পড়া, তাও আবার বাংলায়, মোটেই কাজের কথা নয়।   

    গল্প করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ গর্জ্জন করে এসে আমাদের মাথায় নাকে মুখে একরাশ নোনা জল ঢেলে দিয়ে গেল।

    ভাবটা যেন, “কি রে, কিরকম দিলাম?”

    সমুদ্রে এসে জলে একটু না ভিজলে কি করে হবে? কিন্তু মুস্কিল হলো সারা গায়ে মাথায় চুলে একরাশ বালি। ঘরে ফিরে স্নান করার সময় অনেকক্ষন লাগলো শরীর থেকে সব বালি সরাতে। প্যান্টের পকেটও ভারী, কেননা বালিতে ভর্ত্তি। 

    দুপুরে সুভদ্রা আর আমি হোটেলের বাইরে একটু হেঁটে একটা বাজারের মধ্যে স্বস্তি নামে একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম। উড়িষ্যায় দুটো হোটেলের বেশ নাম। এক হলো এই স্বস্তি আর একটা হলো পান্থনিবাস। স্বস্তি হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোক খুব আলাপী আর মিশুকে, তিনি আমাদের বললেন কাল আপনাদের বন্ধুদের নিয়ে আসুন না, আমি আপনাদের খয়রা মাছ খাওয়াবো।

    খয়রা? সেটা আবার কি মাছ?   

    এদিকে আজ দীপঙ্কর অমিতাভ আর সুজাতা খেয়েছে পান্থনিবাসে। সেটাও হোটেলের বাইরে বাজারের মধ্যে। হাঁটাপথের দূরত্বে। কাল আমরা সবাই স্বস্তিতে যাবো ঠিক হলো খয়রা মাছ খেতে। লাঞ্চের পর একটু রেস্ট নিয়ে সূর্য্যাস্ত দেখতে বাইরে গিয়ে হোটেলের বাইরে ওই চায়ের দোকানে চা আর ঝালমুড়ি নিয়ে বসে আড্ডা হলো। কাল ঠিক হলো একটা গাড়ী নিয়ে আমরা একটু চিল্কা ঘুরে আসবো।

    আজ রাত্রে আবার কালকের মত দীপঙ্করের ঘরে বিশুদ্ধ বিলিতি মাল সহকারে আড্ডা। আজ রাগ রাগিনী নয়, আজ ছেলেবেলার স্কুলের গল্প। দীপঙ্কর আর অমিতাভ দুজনেই হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিল।   দীপঙ্কর চ্যাটার্জ্জি নামে আর একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছিল, আমাদের সাথে একই সালে সে বেচারা হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দেয়, কিন্তু আমাদের দীপঙ্করের মত অত ভালো রেজাল্ট তার হয়নি।

    অনেক পরে দুই দীপঙ্করের দেখা এবং আলাপ হয়, এখন দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব। আলাপ হবার পর একদিন দ্বিতীয় দীপঙ্কর হেসে আমাদের দীপঙ্কর কে নাকি বলেছিলেন, “আপনার জন্যে মশাই ছোটবেলায় আমায় বাবার কাছে খুব মার খেতে হয়েছে!”

    “আমার জন্যে?” দীপঙ্কর তো অবাক, “আমি আবার কি করলাম?”

    দ্বিতীয় দীপঙ্কর বললেন, “আরে মশাই আপনি তো হায়ার সেকেন্ডারীতে সেকেন্ড হলেন, তার পর আপনার নাম খবরের কাগজে দেখে আমাদের যত আত্মীয়স্বজন, বাবার বন্ধুরা সবাই বাবাকে ফোন করে আর বলে “কি খুসী হয়েছি, আমাদের দীপু সেকেন্ড হয়েছে, কি গর্ব্ব হচ্ছে, কি আনন্দ…”

    “আর প্রত্যেক বার ফোন নামিয়ে রেখে আমায় বাবার এক চড়। সেদিন অন্ততঃপক্ষে চল্লিশ পঞ্চাশটা চড় খেতে হয়েছিল মশাই আপনার জন্যে।”

    হায়ার সেকেন্ডারী তে ভাল রেজাল্ট না হলে কি হবে, এই দ্বিতীয় দীপঙ্কর খুব সফল ব্যবসায়ী। তাঁর বাবার একটা চা বাগান ছিল আসামে, বাবার সেই ব্যবসা বাড়িয়ে আসামে ও ডুয়ার্সে তিনি এখন অন্ততঃ কুড়িটা চা বাগানের মালিক। দীপঙ্কর মাঝে মাঝেই গিয়ে বন্ধুর চা বাগানের গেস্ট হাউসে কিছুদিন কাটিয়ে আসে।ব্যবসার কাজে দুজনে এক সাথে পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরেও এসেছে বেশ কয়েক বার।

    কাল চিল্কা যাবার জন্যে হোটেল থেকে একটা গাড়ীর বন্দোবস্ত করা হলো। আর দীপঙ্কর তার বন্ধু কে ফোন করে বলতেই তিনি সেখানকার পান্থনিবাসের ম্যানেজার কে আমাদের ওখানে দুপুরের খাওয়ার কথা বলে দেবেন বললেন। 

    আড্ডার মধ্যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার ডাক এলো। আজ দীপঙ্করের জন্মদিন বলে সে একটা লাল জামা পরে বেশ সাজগোজ করে এসেছে। আমাদের টেবিলটা এক কোনে সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। শেফ এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বিশাল কেক নিয়ে এলো।

    এদিকে হয়েছে কি, রেস্টুরেন্টের অন্য কোণে আর একটা টেবিলে একটা বেশ বড় গ্রুপ বসে আছে, সেখানেও একজনের আজ জন্মদিন। দূর থেকে আমরা দেখলাম হোটেল এর ওয়েটাররা একটা বড় কেক নিয়ে এসে সেই টেবিলের সামনে খুব হ্যাপি বার্থডে বলে গান গাইছে। যে মেয়েটির আজ জন্মদিন, সে হাসিমুখে অনেকগুলো মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভালো। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী আর হাসিখুসী, রঙ্গীন টপ আর স্কার্টে তাকে বেশ মানিয়েছে, তার দুই ছোট ছেলে মেয়েও তাদের মা’কে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করছে দেখলাম। তাছাড়া টেবিলের অন্য পুরুষ ও মহিলারা সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

    ইতিমধ্যে আমাদের টেবিলেও গান গাইতে গাইতে চলে এলো ওয়েটাররা, তাদের মধ্যে আছে হোটেলের শেফ আর জমকালো শাড়ী পরে চোখে গোল চশমা আমাদের লোপামুদ্রা।

    দীপঙ্করের কেক কাটা হয়ে গেছে এমন সময় ওই টেবিল থেকে জন্মদিনের মহিলা এবং তার বর আমাদের টেবিলে এসে দীপঙ্কর কে শুভেচ্ছা জানাতে এলো। দীপঙ্করকেও পালটা শুভেচ্ছা জানাতে হবে, সে মেয়েটিকে হেসে বলল- “Two birthdays today, 75 and 25!”

    মহিলার বর পাশ থেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে তার বর কে হাত তুলে থামিয়ে দীপঙ্করকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে গেল। তার মুখে জ্বলজ্বল করছিল একগাল হাসি। কোন পুরুষ, তা সে যতই বুড়ো হোক, তাকে দেখে পঁচিশ বছর বয়েস বললে তার তো খুসী হবারই কথা!

    তারপরে তো আমাদের খাওয়া দাওয়া বেশ জমে গেল। পোলাও, মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারী, আর সবশেষে শেফের নিজের তৈরী ছানাপোড়া। 

    ঘরে ফেরার পথে আমি দীপঙ্কর কে বললাম “ওই ভদ্রমহিলার বয়েস তোমার পঁচিশ মনে হলো?” দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, সুন্দরী মেয়েদের বয়েস কখনো পঁচিশের থেকে বেশী হয় নাকি?”

    তৃতীয় দিন – ২৪/৮/২২

    ৪)  অলিভ রিডলি কচ্ছপ

    আজ আমাদের চিল্কা হ্রদ যাবার দিন।

    এখানে আসার আগে আমি গোপালপুর আর চিল্কা সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করে এসেছিলাম, এখানে কি কি দেখার জায়গা আছে ইত্যাদি। পর্য্যটক দের জন্যে চিল্কা হ্রদ অবশ্যই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। তার নানা কারণ আছে। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম কূলে ১১০০ স্কোয়ার কিমি বিস্তৃত এই চিল্কা হলো আমাদের দেশের সব চেয়ে বড় হ্রদ। সমুদ্রের সাথে এই হ্রদের যোগ থাকায় জোয়ারের সময় এই হ্রদে লোনা জল এসে যায়। কিন্তু বেশ কিছু নদী চিল্কায় এসে মেশায় একে fresh water লেকও বলা হয়। এই হ্রদে ইরাবতী শুশুক ছাড়া নানা জলচর প্রাণী বাস করে।

    চিল্কার তীরে অনেক মাছের বাজার তাই, প্রধানতঃ এই তীর চিংড়ি আর কাঁকড়া কেনাবেচার জন্যে বিখ্যাত। শীতকালে এই হ্রদে অনেক পরিযায়ী পাখী চলে আসে। গুগল এ গিয়ে অনেক গোলাপী ফ্লামিঙ্গোর ছবি দেখলাম। এরা আসে উত্তরে সাইবেরিয়া বৈকাল হ্রদ এবং অন্যান্য নানা পাহাড়ী জায়গা থেকে।

    আর একটা বিশেষ ব্যাপারের জন্যে চিল্কা বিখ্যাত। অলিভ রিডলি নামে এক জাতীয় সামুদ্রিক কাছিমরা দলে দলে ওড়িশার সমুদ্রকূলে এসে ডিম পাড়ে –এদের জল্পাই রং এর খোলসের সূত্রেই তাদের এই নাম। আকারে তারা ছোট, এবং তাদের ফ্লিপারের মত পা থাকে যা ডাঙায় বসবাসকারী কাছিম দের থেকে আলাদা। উড়িষ্যা ও ভারতের অন্য কিছু রাজ্যের উপকূলে তারা দলে দলে প্রজননের জন্যে আসে। এর নাম হলো মাস নেস্টিং যার প্রধান ঠিকানা হলো ওড়িশার কেন্দ্রপাড়া জেলার অন্তর্গত গহিরমাথা অঞ্চল।কিন্তু সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ, কেননা সেটি ভারত সরকারের সুরক্ষিত এলাকা।

    কিন্তু গঞ্জাম ডিস্ট্রিক্টে রম্ভার কাছে রুশিকুল্য নদীর মোহনাও মাস নেস্টিং এর আর এক ঠিকানা, এবং পর্য্যটকদের কাছে তা এক প্রধান আকর্ষণ। জায়গাটা গোপালপুর থেকে খুব কাছে, কিন্তু আমরা আগস্টে এসেছি, মাস নেস্টিং এর সময়টা মোটামুটি হলো ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চের মাঝামাঝি। সুতরাং আমাদের দেখা কপালে নেই।

    ডিসেম্বর মাসে ওড়িশা উপকূলে সমুদ্রের পরিস্কার জলে পুরুষ ও স্ত্রী কাছিমরা একত্রিত হয় মেটিং এর জন্যে। এর পর পুরুষ কাছিমরা ফিরে যায় তাদের বিচরণ স্থানে। স্ত্রী কাছিমরা অপেক্ষা করে, সঠিক আবহাওয়া আর উপযুক্ত পটভূমি পেলে তবেই এরা দলে দলে ডিম পাড়ার জন্যে পারে উঠে আসে। সে এক অদ্ভুত, অভিন্‌ব, অভাবনীয় দৃশ্য। প্রতিটি ঢেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসে একরাশ প্রাণ!

    সাধারণতঃ এই সমারোহ চলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। আসে কয়েক লক্ষ অলিভ রিডলি। যারা এখানে জন্মগ্রহণ করে তারাই নাকি ফিরে আসে আবার জননী হয়ে। শোনা গেল সে এক আশ্চর্য্য অভিনব প্রাকৃতিক লীলা। প্রতিটি কাছিম সেই বিস্তীর্ণ বালুতটে ঢেউয়ের নাগালের বাইরে জায়গা খুঁজে নিয়ে গর্ত্ত খুঁড়তে শুরু করে দেয়। তারপরে তাদের ডিম সেই গর্ত্তে রেখে প্রাণপন শক্তি দিয়ে সেই গর্ত্ত বালি দিয়ে ঢেকে ধরিত্রী মায়ের সুরক্ষায় তাদের জমা করে তারা আবার ফিরে যায় জলে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে জলে ফিরতে প্রায় এক ঘন্টা বা তারও বেশী লেগে যায়।

    এই কাহিনীর দ্বিতীয় ভাগ এখন থেকে দেড় মাস পরে রচিত হবে, মে মাসে। তখন বালির গরমে ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরোবে, এবং নিজেরাই শুধুমাত্র প্রকৃতির দুর্বোধ সঙ্কেত চিনে নিয়ে নির্ভুল পথে পাড়ি দেবে দূর সাগরে নিজেদের ডেরায়। ততদিন পর্য্যন্ত সরকারের বন দফতর আর নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকেরা অক্লান্ত ভাবে সামলে ডিমগুলো সামলে রাখবে পশুপাখী আর মানুষের হাত থেকে। 

    গোপালপুরে এসে রম্ভায় গিয়ে সেখানে মাস নেস্টিং দেখা না হওয়ায় আমাদের মন একটু খারাপ।

    দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই ইউটিউবে ভিডিও তে দেখে নিও। কষ্ট করে রাত জেগে সমুদ্রের তীরে গিয়ে বসে থাকার বয়েস কি আমাদের আর আছে?”

    ৫)   চিল্কায় নৌকাবিহার    

    গঞ্জাম জেলার বারকুল আর খোরদা জেলার রম্ভা নামে চিল্কার তীরে দুটি জায়গা থেকে পর্য্যটকরা হ্রদে বোটিং করে। দীপঙ্করের বন্ধু আমাদের বলেছেন বারকুলে যেতে, সেটা রম্ভার তুলনায় গোপালপুর থেকে কাছে এবং সেখানকার পান্থনিবাসে তিনি আমাদের লাঞ্চের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ম্যানেজারের নাম মিস্টার কর্‌। কর্‌ পদবীটা বাঙালীদেরও হয়, কিন্তু ইনি উড়িষ্যার লোক।

    তাই আমরা বারকুলেই যাচ্ছি।               

    চিল্কায় অনেক দ্বীপ। এই সব দ্বীপে নৌকা নিয়ে পর্য্যটকরা যায়, আমরা তো ঠিক সে অর্থে পর্য্যটক নই। তবু দীপঙ্করের বন্ধু বলে দিয়েছেন, বারকুলে লাঞ্চ সেরে আমরা যেন একটা নৌকা ভাড়া করে কালিজায়ি নামে একটা দ্বীপে গিয়ে সেখানে এক কালীমন্দিরে পূজো দিয়ে আসি। কালিজায়ির মা কালী খুব জাগ্রত।

    এ ছাড়া তিনি বলে দিয়েছেন যে বারকুল পৌঁছবার আগে টামপারা নামে একটা লেক পড়বে, সেই জায়গাটাও দেখার মত। আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ কাটাতে পারি।

    তো আমরা ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম। আজও বড় গাড়ী। রাস্তাও বেশ ভাল, কোন ঝাঁকানি নেই। গোপালপুর থেকে টামপারা এক ঘণ্টার মত পথ। পথে ছত্রপুর নামে একটা শহর পড়লো।

    টামপারা (fresh water) লেকটা দেখলাম বেশ বড় (৭৫০ acre – অর্থাৎ প্রায় পাঁচ স্কোয়ার কিমি এর বিস্তার)। রুশিকুল্য নদীর মোহনাও এখান থেকে বেশী দূরে নয়। সেই হ্রদের ধারে একটা চমৎকার বাগানের সামনে এসে আমাদের গাড়ী থামলো। আকাশে সেদিন মেঘ, পাশের হ্রদ থেকে ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে, এই আগস্ট মাসেও তেমন গরম নেই, বাগানের গাছগাছালির মধ্যে একটি বাঁধানো রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। বেশ কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটা কফি শপে গিয়ে বসলাম।

    কফি শপের ঠিক উল্টো দিকে হ্রদের ধারে একটা ছোট্ট হোটেল, বাইরে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা টাম্পারা গেস্ট হাউস, ছত্রপুর। 

    দীপঙ্কর বললো, “আমার গার্লফ্রেন্ডরা যখন আমার সাথে এখানে আসে তখন আমরা এই গেস্ট হাউসে এসে উঠি, আর একটা ঘর নিই যাতে জানলা খুললেই সামনে হ্রদ দেখা যায়!”

    সুজাতা বললো “এই আবার দীপঙ্করের ঢপ্‌ শুরু হলো!”

    সুভদ্রা বললো “যাও যাও তোমার ক্যালি আমাদের খুব জানা আছে! গার্লফ্রেন্ড না ছাই!”

    দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, তোমরা বিশ্বাস না করলে আমি কি করতে পারি, পূর্ণিমার রাতে লেকের জল চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করে, আমার বান্ধবীরা কেউ ওই Lake facing room ছাড়া থাকবেনা! ”

    টামপারা থেকে বারকুল কাছেই। সেখানে পান্থনিবাস হোটেলে গিয়ে দেখি সেখানকার ম্যানেজার কর্‌ সাহেব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। হোটেলে অনেক গেস্ট, বেশ ভীড়, তাই তিনি তাদের নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত। আমাদের জন্যে তিনি একটা হোটেলের ঘর খুলে দিলেন, আমরা সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিতে নিতে তিনি আমাদের জন্যে রেস্টুরেন্টে টেবিলের আর খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন।

    লাঞ্চ ভালোই হলো। কর্‌ সাহেব ভালোই বন্দোবস্ত করেছেন। চিংড়ী মাছ আর কাঁকড়ার ঝোল খেলাম ভাত দিয়ে। তা ছাড়া ভাত ডাল আর তরকারী। শেষ পাতে মিষ্টি দই।

    লাঞ্চের পর কাছেই হ্রদের ধারে সারি সারি নৌকা বাঁধা আছে সেখানে একটা কাউন্টারে এক ঘণ্টা বোটিং এর টিকিট কিনে আমরা একটা নৌকায় উঠে পড়লাম। ওঠার আগে আমাদের প্রত্যেককে একটা লাইফ জ্যাকেট পরতে হলো।  

    আমাদের নৌকাটা একটা মটরবোট, ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। মাঝি একটা স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বোটটা চালাচ্ছে, আমরা বোটের দুই পাশে বসে জলের ঢেউএর দোলায় অল্প অল্প দুলছি, অভিজ্ঞতাটা মন্দ নয়। তীরের কাছাকাছি দিয়ে আমাদের বোট চলছে, সেদিকে তাকালে তীরের গাছপালা ঘরবাড়ী পাহাড় সব চোখে পড়ছে, আর অন্যদিকে অকূল জল। ঠিক সমুদ্রের মতোই। যতদূর তাকাই শুধু জল আর জল। কোন ডলফিন চোখে না পড়লেও অনেক পাখী আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর জলের মধ্যে কিছু কচ্ছপ চোখে পড়লো, তারা চার পা চালিয়ে বেশ আরাম করে হাই স্পীডে জলের মধ্যে সাঁতার কেটে ভেসে যাচ্ছে। মাটিতে তারা আস্তে আস্তে এগোয়, কিন্তু জলের মধ্যে তারা বেশ স্বচ্ছন্দ।  মিনিট পনেরোর মধ্যে কালিজায়ী দ্বীপে পৌঁছে গেলাম আমরা। সুজাতা আর সুভদ্রা মন্দিরে গেল পূজো দিতে, আমাদের ছেলেদের মনে অত ভক্তি নেই, সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য এই প্রিন্সিপল ফলো করে আমরা তিন জন একটা জলের মধ্যে রাবারের তৈরী একটা ভাসমান র‍্যাম্পের ওপর দিয়ে উঠে কিছুদূর গিয়ে চিল্কার সীমাহীন জলের শোভা দেখলাম।   

    এদিকে আকাশে তখন কালো মেঘ জড়ো হচ্ছে, ঝড় উঠবে নাকি? এখন ভালোয় ভালোয় ফিরে গেলে হয়।

    আবার সবাই বোটে এসে বসলাম, মিনিট পাঁচেক যাবার পরে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া শুরু হলো। আকাশের মেঘ আর বাষ্প নেমে এসেছে অনেক নীচে, তীরের পাহাড় বাড়ী গাছপালা সবই ঝাপসা দেখাচ্ছে আর তীব্র হাওয়ায় জলে বেশ ধেউ উঠছে। আমি সেই ঝাপসা পাহাড় আর জলের ঢেউয়ের কিছু ছবি তুলে নিলাম।

    আমাদের ছোটবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি জনপ্রিয় গানের (শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি) শেষের দিকে এই লাইন গুলো ছিল।

    জমছে কালো মেঘ, অন্ধকার ঘনায়/

    তাই দেখে মাঝি আকাশে তাকায়/

    রুদ্র ঝড়ে উঠবে নড়ে স্তব্ধ প্রকৃতি/

    আমাদের মাঝি লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছেনা তার কোন ভাবান্তর হচ্ছে, এই ধরণের ঝড় বৃষ্টি তার অনেক দেখা আছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমরা সবাই চুপ, কার মনে কি চলছে বলা মুস্কিল, তবে আমি ভাবছি ঝড় আর বৃষ্টি যেন আমাদের নিরাপদে কূলে পৌঁছে যাওয়া পর্য্যন্ত একটু অপেক্ষা করে।

    শেষ পর্য্যন্ত তাই হলো অবশ্য। এর প্রধান কারণ আমার মনে হয় মা কালীর আশীর্ব্বাদ। সুজাতা আর সুভদ্রা ভাগ্যিস তাঁর মন্দিরে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এসেছে। তা না করলে কি হতো বলা মুস্কিল।

    যাই হোক, পারে পৌঁছবার পরে মাঝি বোট নোঙ্গর করে ছুটলো আমাদের জন্যে ছাতা আনতে। আমরা সেই ছাতার তলায় মাথা বাঁচিয়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ছুটে গিয়ে কাছেই একটি ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের ড্রাইভার সেখানে গাড়ী নিয়ে চলে এলো, আমরা গাড়িতে উঠে স্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম।

    বারকুল থেকে বৃষ্টির মধ্যে হোটেলে ফেরার কথাটা অনেকদিন মনে থাকবে। সামনের সীটে বসে আমি দেখছিলাম বৃষ্টি তে ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, চারিদিক ঝাপসা, উইন্ডশীল্ডে ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টিকে সামলাতে ঝপাঝপ শব্দ করে দুটো ওয়াইপার উঠছে আর নামছে। যে রাস্তায় সকালে এসেছিলাম, এখন সে রাস্তা আর চেনার উপায় নেই। জীবনে এরকম বেশ কিছু মূহুর্ত্ত আর অভিজ্ঞতা আসে যা চট করে ভোলা যায়না। আমাদের চিল্কা যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সেই রকম।

    ড্রাইভার ছেলেটি বলতেই হবে ওই দুর্য্যোগের মধ্যে খুব সুন্দর গাড়ী চালিয়েছিল সেদিন। 

    ৬) চতুর্থ দিন – ২৫/৮/২২      

    আজ গোপালপুরে আমাদের শেষদিন। আজকের সকালটা আরাম করে সমুদ্র তীরে রোদ বাঁচিয়ে ছাতার তলায় বসে গল্প করে কেটে গেল। নরম ভেজা বালিতে জলে পা ডুবিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে।

    সুভদ্রা আর আমি একটু হোটেলের সুইমিং পুলে নামলাম। পুলে আর কেউ নেই শুধু আমরা দু’জন। ট্রাঙ্ক এর বদলে একটা শর্ট পরে এসেছি আমি, যেটা পরে সমুদ্রর তীরেও হাঁটা যায় আবার পুলেও নামা যায়।        

    ঘর থেকে বেরোবার আগে যে মানিব্যাগটা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছি, পুলে নামার আগে তা খেয়ালই ছিলনা। জলে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে দু’তিনটে ল্যাপ নেবার পরে সুভদ্রার সাথে জলের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গল্প করছি, হঠাৎ মনে হলো পকেটটা এত ভারী লাগছে কেন?

    পিছু কেন ভারী ঠেকে ভাবে কোচোয়ান…

    চকিতে বুঝলাম কেন। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ব্যাগটা বের করে বুঝলাম যা কেলো হবার তা হয়ে গেছে। টাকার নোট সব ভিজে। ডেবিট ক্রেডিট কার্ডের কিছু হবেনা। কিন্তু নোট গুলো শুকোনো একটা বড় কাজ এখন।

    ঘরে ফিরে নোট গুলো ব্যাগ থেকে বের করে বিছানায় শুকোতে দিলাম। ব্যাগটাও সপসপে ভিজে। 

    রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্তবুড়ীর দিদিশ্বাশুড়ীর তিন বোনের কথা লিখেছিলেন, আমার অবস্থা অনেকটা তাঁদের মত।

    কোন দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে, নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে/

    টাকাকড়ি গুলো হাওয়া খাবে বলে রেখে দেয় খোলা জানলায়/

    আমি অবশ্য টাকার নোট গুলো জানলায় রাখিনি, বিছানায় রেখে ফুল স্পীডে ফান চালিয়ে তাদের হাওয়া খাইয়েছিলাম।

    দুপুরে আজ সবাই মিলে স্বস্তি হোটেলে লাঞ্চে গেলাম। কালকের সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির করে বড় একটা গোল টেবিলে বসালেন। খয়রা মাছটা দেখলাম অনেকটা তেলাপিয়ার মত। খুব সুস্বাদু রান্না, বেশ ভাল লাগলো খেতে। শেষ পাতে ছানাপোড়া। 

    কাল আমরা কলকাতা ফিরছি, সাথে বাড়ীর জন্যে কিছু ছানাপোড়া নিয়ে গেলে কেমন হয়?

    ম্যানেজার ভদ্রলোক কে আমাদের জন্যে কিছু ছানাপোড়া প্যাক করে দিতে বললাম। তিনি বললেন, “কাল ভুবনেশ্বর যাবার পথে ল্যাংলেশ্বর নামে একটা ছোট শহর পড়বে। ওই শহরে কোন এক ভালো দোকান থেকে আপনারা ছানাপোড়া কিনে নেবেন, কেননা ওখানকার ছানাপোড়াই হল বিখ্যাত, কাছাকাছির মধ্যে সব চেয়ে নাম করা।” 

    লাঞ্চের পরে আবার একটু বিশ্রাম সেরে আমরা সমুদ্রের ধারে চা আর ঝালমুড়ি নিয়ে বসে গেলাম। নানা আলোচনার মধ্যে ফেনার মুকুট পরা সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্লান্তিহীন আসা যাওয়া দেখতে দেখতে পশ্চিমের আকাশ কমলা আর লাল রং এ ভরিয়ে সুর্য্যাস্ত হল, তারপর নেমে এলো অন্ধকার।

    ৭) পঞ্চম দিন – ২৬/৮/২৩ – ফেরা

    কাল ফ্লাইটের চেক ইন আর বোর্ডিং পাস হোটেল থেকে লোপামুদ্রা করিয়ে রেখেছে।

    আজ ব্রেকফাস্ট এর পর সকাল সকাল হোটেল থেকে চেক আউট করে মালপত্র গাড়ীতে তুলে বেরিয়ে পড়লাম। ভুবনেশ্বর পর্য্যন্ত চার ঘন্টার লম্বা রাস্তা।

    পথে ল্যাংলেশ্বর জায়গাটা পড়ল। ড্রাইভার আমাদের একটা মশহুর ছানাপোড়া দোকানের সামনে এসে গাড়ী থামালো। আমরা যে যার দরকার মত কেউ এক কেজি কেউ দুই কেজি ছানাপোড়া কিনে নিলাম।

    সুজাতা বলল, ল্যাংলেশ্বর! কি নাম বাবা…

    দীপঙ্কর বলল “আরে ভাই, এই নামটা কি করে হলো জানো? এর একটা হিস্ট্রি আছে। একবার বহু বছর আগে ঈশ্বর নামে একটি লোক এই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, সে ছিল ছানাপোড়া তৈরী করার একজন বিখ্যাত কারিগর। দেশজুড়ে তার সুনাম। এখানকার কিছু লোক তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, তার ফলে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়, সে আর কোথাও যেতে পারেনা। এখানেই সে ছানাপোড়া তৈরীর কারখানা খোলে এবং ক্রমে ক্রমে এই জায়গাটা ছানাপোড়ার জন্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হয়েছে ল্যাংলেশ্বর।”

    সুভদ্রা বলল ভ্যাট্‌, দীপঙ্করের যত হাবিজাবি গল্প।

    আমাদের প্লেন ছাড়ছে বেলা দুটো। দমদম পৌঁছবো বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। আমি ফোনে আমাদের ড্রাইভার কে বাড়ী থেকে গাড়ীটা নিয়ে দমদমে আসতে বলছি।

    “একটু আগে এসে গাড়ীতে তেল আছে কিনা দেখে নিও, টায়ার গুলোতে হাওয়া ভরতে হতে পারে, তিনটের একটু আগে দমদম পৌঁছে যেও”, ইত্যাদি বলে যাচ্ছি আর ভাবছি মোবাইল ফোন যখন ছিলনা, তখন আমরা কি করে বেঁচে ছিলাম!

    দীপঙ্কর বসে ছিল পিছনে, সে বললো ইন্দ্রজিৎ এর ড্রাইভার কে এই পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।

    কি গল্প?

    এক কোম্পানীর মালিক তাঁর এক কর্ম্মচারীকে পাঠাবেন আসানসোলে তাঁর এক খদ্দেরের কাছ থেকে একটা চেক নিয়ে আসতে। ইয়ার এন্ড এসে যাচ্ছে, তাই চেক টা পাওয়া খুব দরকারী।

    কর্ম্মচারী ছেলেটি খুব বিশ্বাসী আর বশংবদ।

    মালিক তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিচ্ছেন এই ভাবে।

    শোনো তুমি সামনের সোমবার ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবে, বুঝেছো?

    হ্যাঁ, স্যার!

    ব্ল্যাক ডায়মন্ড প্ল্যাটফর্ম আট থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় ছাড়বে, তার মানে তোমায় হাওড়া স্টেশনে পৌনে ছটার আগে পৌঁছে যেতে হবে, বুঝতে পেরেছো?

    হ্যাঁ, স্যার!

    তুমি সেদিন ভোর চারটে তে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠবে, উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়বে। তুমি তো ফার্ণ রোডে আলেয়া সিনেমার কাছে থাকো, ওখান থেকে গড়িয়াহাটে হেঁটে যেতে তোমার দুই তিন মিনিট লাগবে, সেখানে গিয়ে তুমি পাঁচ নম্বর বাস ধরবে, ফার্স্ট বাস আসে ভোর পাঁচটায় তাই তার আগেই তোমায় বাস স্টপে পৌঁছে যেতে হবে, দেরী করবেনা, বুঝেছো?

    হ্যাঁ, স্যার!

    আচ্ছা ওই সকালে বাসে তুমি হাওড়া স্টেশনে ছ’টার আগেই পৌঁছে যাবে, সেখানে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে টিকিট রিসার্ভেশন কাউন্টারে লাইন দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড চেয়ার কারে তোমার সীট রিসার্ভ করে টিকিট কিনবে। ঠিক আছে?

    হ্যাঁ, স্যার! এবার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে ট্রেণে উঠে নিজের সীটে গিয়ে বসবে। আসানসোল স্টেশনে ট্রেণ পৌছবে সকাল ন’টায়। কিন্তু তুমি যে অফিসে যাবে তারা খোলে বেলা দশটায়। তাই তুমি ট্রেণ থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে মিনিট পনেরো চা খেয়ে নিয়ে নিও। ক্লীয়ার?

    হ্যাঁ, স্যার!

    তারপরে বাইরে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ওদের অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটা ওদের দেখিও। ওরা তোমায় এক টা চেক দেবে, সেটা নিয়ে তুমি আবার স্টেশনে ফিরে বিকেল চারটে তে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে এসো।

    সোমবার ন’টা নাগাদ মালিকের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। সেই বশংবদ কর্ম্মচারীর ফোন।

    এবার তাদের দু’জনের কথাবার্ত্তা এরকম হলো।

    কি হলো? কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? ভোরবেলা গড়িয়াহাট থেকে ফার্স্ট বাস পাঁচ নম্বর ধরেছিলে?

    হ্যাঁ, স্যার!

    বেশ! তারপর? ট্রেণের টিকিট কাটলে? সীট রিসার্ভ করতে পারলে?

    হ্যাঁ স্যার!

    বেশ বেশ! আসানসোল পৌছে গেছো?

    হ্যাঁ স্যার!

    তাহলে তো সবই ঠিকঠাকই করেছো। ফোন করছো কেন? কোন প্রবলেম?

    হ্যাঁ স্যার একটা প্রবলেম হয়েছে।

    মালিক একটু অবাক। কি আবার প্রবলেম হলো।

    স্যার এই দোকানে চা পাওয়া যায়না, কেবল কফি। আমি কি কফি খেতে পারি, স্যার?

  • এ আবার কি অসভ্যতা

    মার্চ ৩১, ২০১৮। কাল আমরা বন্ধুরা মাদ্রিদ থেকে লিসবনে এসে পৌঁছে হলিডে ইন হোটেলে উঠেছি।

    আজ সকালে আমাদের half day লিসবন সিটি ট্যূর।   

    হোটেলে সকাল ন’টায় বাস আসবে। আমরা সবাই রেডি হয়ে লাউঞ্জে এসে সোফায় বসে আছি।        

    এমন সময় হোটেলের বাইরে একটা বড় বাস এসে দাঁড়ালো, এবং একটু পরে একটি সুদর্শন যুবক আমাদের সামনে এসে বললো You are the group of Prodosh Mitra? My name is Nunu and I shall be your guide today…

    নুনু?

    এ আবার কি অসভ্য নাম?

    অবশ্য পর্তুগীজ ভাষায় অসভ্য নয় নিশ্চয়, নাহলে ওরকম গর্ব্ব আর আনন্দের সাথে কেউ বলে আমার নাম নুনু? পরে জেনেছিলাম কথাটার মানে হলো petite ছোটখাটো, আদরের।

    অসভ্য কথা শুনলেই মেয়েদের খুব হাসি পায়, আমাদের বৌদের মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবেই একটা চাপা হাসির  গুঞ্জন উঠলো। আমরা ছেলেরা অবশ্য অসভ্য কথাকে হাসির ভাবিনা, তবু আমরাও একটু চোখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। ছেলেটির জন্যে একটু সহানুভূতিও অনুভব করলাম, বেচারা জানেওনা কি বিশ্রী একটা নাম তার গায়ে আটকে আছে চিরজীবনের মতো।   

    নুনু ছেলেটি কিন্তু খুব স্মার্ট, সুন্দর কথা বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে তার বেশ ভাল আলাপ হয়ে গেল।

    কিন্তু মুস্কিল হলো বাসে সে বসে আছে একেবারে সামনে, তার সাথে কথা বলতে গেলে বা তাকে কোন প্রশ্ন করতে গেলে তাকে নাম ধরে ডাকতে হবে।

    সুমিতা সিদ্ধার্থ কে বলল তুমি ওকে নাম ধরে ডাকেবেনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে বলবে Excuse me?

    নাম ধরে ডাকতে হবে তাই আমরা কেউ ই নুনুকে কোন প্রশ্ন করছিনা। কিছুক্ষণ বকবক করে নুনু ড্রাইভারের পাশের সীটে সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে।

    এদিকে বাসে একদম পিছনে বসে আছি আমি আর প্রদোষ। বাসে এ সি চলছেনা, বেশ গরম। তুতু বসে আছে একদম সামনে, প্রদোষ তুতু কে বললো এই নুনু কে বলো তো এ সি টা চালাতে।

    তুতু পিছন দিকে প্রদোষ কে একটা বিশ্রী দৃষ্টি দিয়ে বললো, না আমি বলতে পারবোনা, তুমি বলো।

    প্রদোষ আর কি করে, সে কয়েকবার মিন মিন করে খুব নীচু গলায় মিস্টার নুনু, মিস্টার নুনু বলে ডাকলো, কিন্তু অত আস্তে বললে নুনু শুনবে কি করে? তখন মরিয়া হয়ে লজ্জা শরম বিসর্জ্জন দিয়ে প্রদোষ বেশ জোরে ডেকে উঠলো – মিস্টার নুনু !

    এবার কথাটা নুনুর কানে গেছে, সে মুখ ফিরিয়ে বললো, ইয়েস?

    প্রদোষ বলল Please will you turn the air conditioning on?

    Sure, বললো নুনু।

    কিছুক্ষন পরে আবার এক মুস্কিল। মাইক্রোফোন থেকে একটা খসখস আওয়াজ হচ্ছে, কানে লাগছে।

    প্রদোষ এবার তার সংকোচ ছাড়িয়ে উঠেছে। তার গলায় এখন বেশ জোর।

    আমি ওর পাশে বসে ছিলাম, আমি বললাম মিস্টার বলার কি দরকার, বাচ্চা ছেলে, ওকে নাম ধরেই ডাকোনা।

    বজ্রগম্ভীর স্বরে প্রদোষ ডেকে উঠলো এই নুনু, নুনু!

    সামনে বসে ছিল তুতু, সে পিছন ফিরে প্রদোষ কে বলল “এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে?” 

    কিন্তু প্রদোষ কে থামানো যাচ্ছেনা, সে ওই খসখস আওয়াজ আর সহ্য করতে পারছেনা।

    সে আবার পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “নুনু, এই নুনু! আওয়াজ টা বন্ধ কর্‌ মাইরী…”

  • আরশোলা ভাজা, টিকটিকির চাটনী

    মার্চ, ২০১৭। আমরা কুয়েতের বন্ধুরা ভিয়েতনাম আর কাম্বোডিয়া বেড়াতে এসেছি।

    আমাদের ট্রিপ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গত সাত দিন ভিয়েতনামে হানয় আর হ্যালং বে তে ঘুরে আর কাম্বোডিয়াতে সীম রীপ (আঙ্কোর ভাট মন্দির) দেখে এখন আমরা বাসে চেপে চলেছি কাম্বোডিয়ার রাজধানী Phnom Penh এর দিকে। সেখানে আমাদের প্ল্যান হলো Khmer Rouge এর বন্দীদের  যেখানে রেখে অত্যাচার করা হতো, সেই বিখ্যাত Tuol Sleng prison দেখা। তারপরে মেকং নদীতে নৌকাভ্রমণ।  

    পরের দিন দেশে ফেরা।

    সীম রীপ থেকে Phnom Penh  ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা। বিকেলের আলো থাকতে পৌঁছতে হবে তাই আমরা সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট খেয়ে মালপত্র বাসে তুলে নিয়ে  বেরিয়ে পড়েছি। পথে কোথাও একটা ব্রেক নিয়ে কিছু খেয়ে নেবো।

    মার্চ মাসে তেমন গরম পড়েনি তখনো, আমরা বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি কাম্বোডিয়ার গ্রামের দৃশ্যপট। আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের সাথে মতোই অনেকটা। আজ দিনটা বেশ সুন্দর, নীল আকাশ, নরম রোদ, চারিদিকে সবুজের মেলা। বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত, চারিদিকে তাল আর নারকেল গাছের সারি। মাঝে মাঝে কিছু জনপদ পেরিয়ে যাচ্ছি। কিছু কৃষক কে মাঠে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে, তাদের মাথায় সাদা ত্রিভুজ টোকা। গ্রামের বাড়ীগুলোর  ডিজাইন একটু অন্যরকম, আমাদের চোখে বেশ নতুন লাগলো। আর তাদের মধ্যে পাকাবাড়ীর বদলে বাঁশের তৈরী বাড়ীই বেশী।

    মাঝপথে আমাদের ড্রাইভার একটা জায়গায় এসে বাস থামালো। দেখলাম এখানে একটা বেশ বড় বাজার বসেছে। তরী তরকারী ফলমূল এই সব সাজিয়ে নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দরদাম করে কেনাকাটা করছে বহু লোক। আজ রবিবার, ছুটির দিন, তাই বোধ হয় ভীড় এক্টূ বেশী।  আমরা একটা চায়ের দোকান খুঁজে চা খাচ্ছি, এমন হঠাৎ সমবেত মেয়েলী গলায় একটা আর্ত আওয়াজ পেলাম।

    “ও মাগো! দেখে যাও শিগগিরি!”

    আমাদের বৌরা যথারীতি দোকান গুলোতে ঘুরে দেখতে গেছে কেনার মত কিছু স্যুভেনির সেখানেপাওয়া যায় কিনা দেখতে। সেখানে গিয়ে  ঢালাও করে যা বিক্রী হচ্ছে তা’ দেখে তাদের এই সমবেত আর্ত্তনাদ।

    আমরা ছেলেরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে আমরাও তাজ্জব।

    এক এক টা দোকানে পর্য্যাপ্ত পরিমাণে পাহাড়ের মত উঁচু ঢিপ করে রাখা আছে কালো কালো নানা ধরণের পতঙ্গ ভাজা। তাদের মধ্যে আরশোলা আছে, আরো কি কি আছে কে জানে, উচ্চিংড়ে, ফড়িং, locust ইত্যাদি  জাতীয় সব  প্রাণী। কাঁচের শিশিতে তেলের মধ্যে চার পা ছড়িয়ে উল্টো হয়ে ভাসছে  টিকটিকি। আচার নাকি? হতেও পারে।

    আমার মনে আছে রাজগীর থেকে পাটনা ফেরার পথে একটা দোকানে মৌরলা মাছ ভাজা পাওয়া যেত। আমরা প্লেট ভর্ত্তি করে নিয়ে মনের সুখে খেয়েছি।  আর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে  Carniviore নামে একটা বেশ নামী রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে মেনু তে বীফ, পর্ক, চিকেন, হরিণ ইত্যাদি ছাড়াও  অন্যান্য নানা বন্য জন্তুর মাংস – তার মধ্যে আছে জলহস্তী, গণ্ডার, হাতি, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়েনা ইত্যাদি। আমাদের বন্ধুদের  মধ্যে কেউ কেউ উৎসাহ নিয়ে সে সব অর্ডার করেছিল, আমি অবশ্য risk নিইনি।

    কিন্তু এখানে এই সব কেঁচো সুঁওপোকা ব্যাং টিকটিকি এমন কি সাপ দেখে এই সব কেউ ভালবেসে খায় ভেবে বেশ বমি পাচ্ছিল আমাদের সবার।  

    আরও অবাক করার মত ব্যাপার হলো সেই সব অখাদ্য ভালবেসে কিনছে যে খদ্দেররা, তাদের মধ্যে আছে বেশ কিছু সুন্দরী কমবয়েসী মেয়েরাও। তাদের বেশভূষা দেখলে মনে হয় তারা বেশ সম্পন্ন পরিবারের উচ্চশিক্ষিত মহিলা, তাদের অনেকের হাতে ফ্যাশানী হ্যান্ডব্যাগ, চোখে রোদচশমা।

    আজ রবিবার, সন্ধ্যায় বন্ধুবান্ধব এর সাথে বসে পার্টিতে হুইস্কির সাথে জমিয়ে আরশোলা আর উচ্চিংড়ে ভাজা, পরে ডিনারে ডালভাতের সাথে ব্যাঙএর চপ, সাপের ডালনা, আর টিকটিকির আচার?

    ওয়াক!  

    মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস এই সব দেশে আমি জন্মাইনি।