-
আশ্চর্য্য ভ্রমণ – মুর্শিদাবাদ (১২-১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩)

হাজারদুয়ারী প্রাসাদ
প্রথম দিন ১২/১২/২০২৩
১) ট্রেণ যাত্রা
ছোটবেলার স্কুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আজকাল KP mপ্রায়ই কোথাও একসাথে বেড়াতে যাবার কথা ওঠে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে দীপঙ্কর অমিতাভ সুজাতা সুভদ্রা আর আমি একসাথে গোপালপুর বেড়িয়ে আসার পর আমাদের এই যৌথ বেড়ানোর প্রতি আগ্রহ বেশ বেড়ে গেছে। এবার আমরা যাচ্ছি মুর্শিদাবাদ, আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে প্রবীর আর সুপ্রিয়া।
মুর্শিদাবাদে আমাদের কাশিমবাজারের রাজবাড়ীতে দুই রাতের থাকার বন্দোবস্ত করছে অমিতাভ। কাশিমবাজারের আজকের রাজা প্রশান্ত রায়ের ছেলে পল্লব রায় এখন এই রাজবাড়ীটার দেখাশোনা করে। সে অমিতাভর বন্ধু, তারা দু’জনেই Calcutta Club এর সদস্য, এবং আমাদের এই ট্রিপের সব বন্দোবস্তই পল্লব করে দিয়েছে।
মঙ্গলবার ১২ই ডিসেম্বর সকাল ন’টায় আমাদের ট্রেণ হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়বে।
কলকাতা স্টেশন আবার কোথায়?
আমরা কেউ ওই স্টেশন চিনিনা। যাই হোক, আমাদের সকলের ড্রাইভাররা জায়গাটা চেনে। তাই অসুবিধে হয়নি। জায়গাটা হলো উত্তর কলকাতায়, আর জি কর মেডিকাল কলেজ আর হাসপাতালের কাছে। আমাদের বেরোতে একটু দেরী হয়েছে, তবে এই সাত সকালে কলকাতার রাস্তা ফাঁকা। তবু আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন ট্রেণ ছাড়বার বেশী দেরী নেই। দীপঙ্কর, প্রবীর, আর অমিতাভ ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে, আমাদের দেরী দেখে ওরা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল কয়েকবার।
ট্রেণ দাঁড়িয়ে আছে লাইনের ওপারের প্ল্যাটফর্মে, ওভারব্রীজ দিয়ে লাইন ক্রস করার সময় হাতে নেই, আমাদের বুড়ো কুলী আমাদের মাল মাথায় নিয়ে হেঁটে লাইন ক্রস করে আমাদের ট্রেণে উঠিয়ে দিলো। সেই কুলীটির অভিজ্ঞতা আর উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে সেদিন ট্রেণ মিস করিনি।
ট্রেণের চেয়ার কারের টিকিট কেটে রেখেছিলো প্রবীর।
একটু পরেই ট্রেণ ছেড়ে দিলো। মন্থর গতিতে আমরা কলকাতা শহর আর শহরতলীর মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম, কারুর হেঁসেল, কারুর রান্নাঘর, কারুর উঠোন দুই পাশে দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কিছু কোঠাবাড়ী, তার বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে, ছাতে শাড়ি শুকোচ্ছে। দুই একটা পুকুর চোখে পড়ছে সেখানে সকালবেলায় দাঁতন করছে কিছু লোক, তাদের পরণে গামছা, হয়তো এর পরে পুকুরে নেমে স্নান সেরে নিয়ে তারা অফিস যাবার জন্যে তৈরী হবে।
একটা নতুন দিন শুরু হচ্ছে, ঘুম ভাঙ্গছে কলকাতা শহরের।
একটু পরেই অবশ্য শিয়ালদা লাইনে এসে পড়ার পরে চেনা স্টেশন এক এক করে আসতে লাগলো। দমদম জংশন, বরানগর, বেলঘরিয়া, আগরপাড়া। বহুদিন আগে, ১৯৬৬ সালে, আমি তখন খড়্গপুরে থার্ড ইয়ার, গরমের ছুটিতে আমার ট্রেনিং ছিল বেলঘরিয়াতে Texmaco কোম্পানীতে। আগরপাড়াতেও Texmaco র একটা ফ্যাক্টরী ছিল, তাই কাজ থাকলে বেলঘরিয়া থেকে আগরপাড়া ও অনেক বার লাইন ধরে হেঁটে গেছি। ওই স্টেশনগুলো পেরিয়ে যাবার সময় সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি মনে ভেসে আসছিল।
ট্রেণ বেশ ভাল স্পীড নেবার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল কামরায় হকারদের আনাগোনা। তাদের মধ্যে বেশ কিছু ভিখারী, একটি বিকলাঙ্গ শিশু দেখলাম ঘষ্টে ঘষ্টে কামরার এক দিক থেকে অন্য দিকে দুই পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথের লোকটি করুণ চোখে হাত পেতে আছে। জীবিকা অর্জ্জনের জন্যে এই শিশুটিকে ব্যবহার করছে তার পরিবার। এই ধরণের দৃশ্য আমাদের সবার মোটামুটি পরিচিত। আমরা কেউ কেউ ব্যাগ থেকে কিছু খুচরো পয়সা বের করে ওই বাড়িয়ে দেওয়া হাতে গুঁজে দিই। আবার কেউ কেউ উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। জগতের সব দুঃখ কষ্ট অনাচার অবিচার অসাম্য দূর করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
এছাড়া আছে খাবার দাবার, ব্রেকফাস্টের জন্যে চা আর স্যান্ডুইচ বিক্রেতারা। বেশ কয়েকবার আমরা লেবু চা কিনে খেলাম। লেবু চার কাগজের কাপ গুলো এত ছোট যে বার বার না খেলে ঠিক চা খেয়েছি বলে মনেই হয়না।
এটা কি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চায়ের কাপ?
আর হকারদের কথা তো বলে শেষ করাই যাবেনা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ নেই, যা এখানে পাওয়া যাবেনা। অফিস স্টেশনারীর পসরা সাজিয়ে একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার হাতে আছে A4 কাগজ, পেন্সিল, বল পয়েন্ট পেন, ফাইল, স্টেপলার, হোলপাঞ্চ, টর্চ, ব্যাটারী এবং আরো অনেক এরকম অত্যন্ত দরকারী জিনিষ। লোকে পটাপট কিনছে দেখলাম। একজন রংচঙে গামছা বিক্রী করছিল, সুভদ্রা তার কাছ থেকে দুটো লাল নীল বেগুণি রঙের চেক আর স্ট্রাইপ করা গামছা কিনে নিল। ওই গামছা দিয়ে সুন্দর কামিজ কিংবা টপ্ বানানো যাবে।
এরপরে একটি লোক এলো যে পিঠ চুলকানোর সুবিধের জন্যে লম্বা প্লাস্টিকের লাঠি বিক্রী করছে। লাঠিটার শেষটা আঙুলের নখের মত ছুঁচলো, চুলকানোর সুবিধের জন্যে।
বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর মেয়েদের এই নিয়ে কোন অসুবিধে থাকেনা। তখন তাদের বাধ্য বরেরা বললেই তারা বৌদের মাথা পা বা কোমর টেপার জন্যে প্রস্তুত। “শুনছো, পিঠের এই জায়গাটায় একটু চুলকে দাওনা গো”, বললেই তারা হাসিমুখে এসে বৌদের হুকুম তামিল করতো।
কিন্তু বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরে এখন সেই বরেদের আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন হয়ে গেছে। এখন তাদের দেখলে আর চেনাই যায়না।
একজন তো সারাদিন ভুরু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে শেয়ার মার্কেটের ওঠা পড়া দেখে। আর একজন রাত দুটো থেকে রাত চারটে টি ভি চালিয়ে ফুটবল খেলা দেখে যায়। আর তৃতীয় জনের অবস্থা আরো খারাপ, সারাদিন তার ফোন আসে, কে বা কারা যে তাকে এত ফোন করে কে জানে, তার ওপরে সে আবার রাত্রে ল্যাপটপ খুলে কি যে হাবিজাবি লেখা লেখে, তার কোন মাথামুন্ডু নেই।
বৌদের সাথে কথা বলার সময় এখন এদের কারুর নেই।
সখীর হৃদয় কুসুম কোমল/কার অনাদরে আজি ঝরে যায়/
কেন কাছে আসো, কেন মিছে হাসো/ কাছে যে আসিত, সে তো আসিতে না চায়/
সুতরাং, এখন হলো নিজের পিঠ নিজে চুলকোবার দিন। কিন্তু মুস্কিল হলো নিজের পিঠ নিজে চুলকোনো অত সোজা কাজ নয়। ভগবান আমাদের শরীরের ডিজাইন করার সময় পিঠ আর হাতের ভারসাম্যের কথাটা চিন্তা করেননি। ফলে পিঠের অনেক জায়গাই আমাদের হাত পৌঁছয়না। আর পিঠের যে সব জায়গা্য আমাদের হাত পৌঁছয়না সেই সব জায়গাই অবধারিত বেশি চুলকোয়।
সে এক মহা যন্ত্রণা।
সুজাতা সুপ্রিয়া আর সুভদ্রা তিনজনেই প্লাস্টিকের পিঠ চুলকোনোর লাঠি কিনে নিলো।
এই সব যখন চলছে তখন আমাদের ট্রেণ একটার পর একটা স্টেশন ক্রস করে যাচ্ছে। অমিতাভ মাথা নীচু করে চোখ কুঁচকে তার ফোনে স্টেশন এর নাম দেখে যাচ্ছে, বেথুয়াডহরী, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর…
খুব কম স্টেশনেই আমাদের ট্রেণ থামছে। বেলঘরিয়ার পরে রাণাঘাট আর তার পরে কৃষ্ণনগর। প্রত্যেক স্টেশনে মাত্র এক মিনিটের জন্যে ট্রেণ দাঁড়ায়। সামনে বহরমপুর আর তারপর আমাদের স্টেশন মুর্শিদাবাদ। এক মিনিটের মধ্যে নামতে হবে, তাই আমরা আগে থেকেই ওপরের র্যাক থেকে আমাদের ব্যাগ নামিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিয়েছি।
অমিতাভ দুটো Toyota Innova SUV বলে রেখেছিল, সেই দুটো গাড়িতে চড়ে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য কাশিমবাজারের রাজবাড়ী।

২) কাশিমবাজার রাজবাড়ী
স্টেশন থেকে কাশিমবাজারের রাজবাড়ী বেশী দূর নয়। পথে আসতে আসতে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রধান এবং জনবহুল, ব্যস্ত এবং ব্যবসায়িক অঞ্চল লালবাগের রাস্তাঘাটে প্রচুর ভীড় আর রাস্তায় অনেক ঘোড়ায় টানা গাড়ী চোখে পড়ল। বিয়ের পরে সুভদ্রা আর আমি একবার ১৯৭৫ সালে মুর্শিদাবাদে এসেছিলাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে মুর্শিদাবাদে এসে রাস্তার ভীড় আর ঘোড়ায় টানা গাড়ী দেখে সেই পুরনো দিনগুলো আবার মনের মধ্যে ফিরে এলো।
সেবার একদিন একটা সাইকেল রিক্সায় চেপে আমরা অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম, হাজারদুয়ারী, মোতিঝিল এই সব জায়গার নাম এখন আবছা মনে পড়ে, কিন্তু এখন এতদিন পরে স্মৃতি একেবারেই ঝাপসা। আমার ক্যামেরায় অনেক ছবিও তুলেছিলাম সেবার, তার মধ্যে আমার সুন্দরী নতুন বিয়ে করা বৌয়ের নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবিই বেশী ছিল।
এই প্রাচীন শহর অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এই শহরে ছড়িয়ে আছে বহু দর্শনীয় স্থান, যেখানে বাংলার ইতিহাস জানার জন্যে যেতেই হবে। দুঃখের বিষয় বিয়ের পরের সেই দিনগুলোতে অতীতের ইতিহাস আমার জীবনে ততোটা গুরুত্ব পেতোনা, তখন বর্ত্তমানেই মজে ছিলাম। এখন এই বয়েসে এসে ইতিহাস জানার ইচ্ছেটা বেশী।
একসময় সমস্ত বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবী মসনদ থেকে। শুধু মাত্র নবাবরাই নন, বর্ধিষ্ণু এই অঞ্চলে ছিল বহু জমিদার বংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি। পরে সেই ধনী জমিদারদের মধ্যে অনেকে ইংরেজ শাসকদের কাছে রাজা উপাধি পান্। কাশিমবাজার রাজবাড়ি সেই ইতিহাসেরই মূর্ত প্রতীক।
আমরা কাশিমবাজারের রাজবাড়ী পৌঁছে গেলাম মিনিট পনেরোর মধ্যে।
প্রথম দর্শনে সামনে থেকে দেখে ধবধবে সাদা বাড়ীটির ইউরোপীয় (Romanesque) স্থাপত্য আমার চোখে খুব সুন্দর লাগলো। সামনে ত্রিভুজাকার façade, এবং তার তলায় বেশ কিছু স্তম্ভ, আর বাড়ীটির সামনে ঘন সবুজ রং এর ঘাসের গালিচা বাড়ীর সাদা রং এর সাথে একটা অদ্ভুত সুন্দর contrast তৈরী করে বাড়ীটার একটা বনেদী চেহারা দিয়েছে।
১৯৭৪ সালে সুভদ্রার আর আমার বিয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতায় কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে। এলগিন রোড আর হরিশ মুখার্জ্জী রোডের মোড়ে অবস্থিত ওই রাজবাড়ীটি তেও যতদূর মনে পড়ছে ধবধবে সাদা প্রাসাদোপম বাড়ীর সামনে বিশাল সবুজ লন্ ছিল। আমার মাস্তুতো দাদা রতনদা’ বোধহয় ওই রাজবাড়ীতে কাউকে চিনতেন, তিনিই বৌভাতের জন্যে বাড়ীটির বন্দোবস্ত করে দেন্।
যাই হোক্, ভিতরে ঢুকে রিসেপশনে চেক ইন করে দোতলায় যার যার নিজের ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নীচে একতলায় নেমে এলাম আমরা। সেখানে একটা বিশাল ডাইনিং রুম, এক দিকে একটা লম্বা টেবিলে আমাদের জায়গা করা হয়েছে। শেফ ভদ্রলোক আমরা পল্লবের চেনা বলে এসে খুব খাতির করে এসে আমাদের সাথে কথা বলে গেলেন।
লাঞ্চের মেনু পুরো বাড়ীর খাবার, সুক্তো, ডাল, ভাত, পাঁচমিশেলী তরকারী, মাছের ঝোল, মাংস, চাটনি – সব সুস্বাদু বাঙালী রান্না। শেষ পাতে মিষ্টি ছিল লাল দই, আর বহরমপুরের বিখ্যাত মিষ্টি, ছানাবড়া। কাশিমবাজারের রায় পরিবারের এখন একটা মিষ্টির দোকান কলকাতায় খুব নাম করেছে, তার নাম “Sugarr and Spice”,মুর্শিদাবাদের রাজবাড়ীতেও তাদের একটা দোকান আছে সেখান থেকেই আবাসিক দের জন্যে মিষ্টি সরবরাহ করা হয়।
জমিয়ে খেলাম সবাই, বেশ ক্ষিদেও পেয়েছিল। দুই দিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ শহরে যত দেখার জায়গা আছে, সব তো চাক্ষুস করা সম্ভব নয়, এই বয়সে এসে বেশী ছোটাছুটিও আমরা করতে চাইনা। হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে আমরা আজ আর সামনের দুই দিন কোথায় কোথায় যাওয়া যায় আর কি কি দেখা যায়, তার একটা ছক করে ফেললাম।

৩) কাটরা মসজিদ
প্রথমে কাটরা মসজিদ। এখানে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর সমাধি। ঢোকবার মুখেই বেশ কিছু গাইড দাঁড়িয়ে।
সেই গাইড দের মধ্যে একজনের সাথে আমাদের রফা হলো। তার নাম মনোজ তরফদার। তার কাছে শুনলাম যে কাটরা মসজিদ এবং মুর্শিদাবাদের অন্যান্য যত প্রাচীন প্রাসাদ আছে সব সরকারী পুরাতত্ত্ব বিভাগ ASI (Archeological Society of India) দেখাশোনা করে। এই গাইড রাও সবাই ASI দ্বারা লাইসেন্স প্রাপ্ত।
এক হিন্দু পরিবারে ১৬৭০ সালে এক হিন্দু ব্রাম্ভন পরিবারে মুর্শিদকুলী খাঁর জন্ম, তাঁর নাম ছিল সূর্য্য নারায়ণ মিশ্র। ন’বছর বয়েসে, মাথা মুন্ডন করে পৈতে নেওয়া হয়ে গেছে, সংস্কৃত মন্ত্র ছাড়াও রামায়ণ মহাভারত পুরান পড়েন। গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ। সেই সময় পারস্যের এক ধনী ব্যক্তি সফিউদ্দীন ইসলাম তাঁকে দত্তক নেন্, এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। তখন তাঁর নাম হয় কারতলব খান।
সফিউদ্দীন সম্রাট আওরংজেবের কাছের মানুষ ছিলেন। সফির পালিত পুত্র কারতলবের জমি জমা আর কর খাজনা ইত্যাদির হিসেব করার কাজ দেখে খুসী হয়ে সম্রাট আওরংজেব ১৭০০ সালে তাঁকে মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি দিয়ে বাংলার দিওয়ান করে ঢাকায় (তখন জাহাঙ্গীরাবাদ) পাঠান।
ঢাকায় তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবেদার ছিলেন সম্রাটের নাতি আজিম উস শান, যিনি কারতলবের প্রতি আওরংজেবের স্নেহ ভাল চোখে দেখেননি। তাঁদের শত্রুতা চরমে ওঠায়, মুর্শিদকুলী আওরংজেবের অনুমতি নিয়ে ঢাকা থেকে কিছুটা পশ্চিমে মুকসুদাবাদ নামে একটি ছোট শহরে তাঁর দপ্তর সরিয়ে আনেন। ১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি আনুগত্য ও দক্ষতার সাথে দিওয়ান হিসেবে তাঁর কাজ করে গেছেন, নিয়মিত মোগল সম্রাটের কাছে খাজনা পাঠিয়েছেন, এবং নিজের প্রদেশে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন এবং জায়গীরদার প্রথা সংক্রান্ত নানা উদ্ভাবনী কাজ করেছেন।
দিল্লীতে আজিম উস শানের ছেলে ফারুকশিয়ার মোগল সম্রাট হবার পরে তিনি ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলী খান কে বাংলা প্রদেশের সুবেদার করেন, কিন্তু চার বছর পরে মুর্শিদকুলী খাঁ মোগলদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে খাজনা পাঠানো বন্ধ করে ১৭১৭ সালে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হন্। এবং এই মুকসুদাবাদই পরে স্বাধীন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ হয়ে ওঠে।
কাটরা কথাটার মানে হলো সরাই খানা, সেই মধ্যযুগে বিদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এই সরাইখানা তে বিশ্রাম নিতো, সাথে খানা পিনা নাচ গান ও হতো নিশ্চয়।
কাটরা মসজিদ একটা চৌকো জায়গা নিয়ে তৈরী, যার চার কোণে বসানো চারটে উঁচু মিনার। ইঁটের তৈরী লাল রং এর মসজিদ, তার চারিপাশে সবুজ বাগান আর সামনে একটা লম্বা দোতলা বাড়ী, সেটাও লাল ইঁটের তৈরী, তাতে সারি সারি ঘর আর জানলা। এই ঘরগুলো নাকি ছিল ৭০০ জন মাদ্রাসার ছাত্রদের কোরান পড়ার জন্যে। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই মসজিদ ছিল ইসলামী শিক্ষার একটি বড় কেন্দ্র।
চারিদিকে লাল রং আর মাঝখানে সাজানো সবুজ বাগান পরিবেশকে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে সেরকম ভীড় নেই, শুধু আমরা ক’জন, সেই নির্জনতাও খুব উপভোগ করেছিলাম সেদিন। ১৭২৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর তৈরী এই কাটরা মসজিদ আজ দেশের হেরিটেজ প্রপার্টি।
মনোজ আমাদের গল্প করলো যে দিওয়ান হবার পরে মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাট আওরংজেব কে খুসী করার জন্যে নিয়মিত খাজনা পাঠিয়ে দিতেন। একবার তিনি নাকি তাঁর ছেলের হাতে ১০০০ স্বর্ণ মুদ্রা (মোহর) পাঠিয়েছিলেন, সে নাকি তার মধ্যে থেকে একটি মোহর এক গরীব দুঃখী লোক কে দান করে। ভেবেছিল কেউ গুণে দেখবেনা তাই ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
কিছুদিন পরে মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাটের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। তাতে লেখা এক হাজারের জায়গায় একটা মোহর কম পাঠিয়েছো দেখছি, কি ব্যাপার?
ছেলে কে জিজ্ঞেস করে যখন জানলেন সে একটা মোহর একজন গরীব লোককে দয়াপরবশ হয়ে দান করেছে, তিনি নাকি ছেলেকে মেরে তার মৃত ছেলের শিরচ্ছেদ করে তার মাথা ও একটি মোহর সম্রাট কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
যখন আমরা মনোজের এই গল্প অবাক হয়ে শুনছি, আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দীপঙ্কর, খেলোয়াড়ী হাফ প্যান্ট (বার্মুডা) পরে তাকে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে, নীচু গলায় সে আমায় বললো “এর একটা কথাও বিশ্বাস কোরোনা ইন্দ্রজিৎ, সব ডাহা গুল!”
তারপরে মনোজ বললো নবাবের বড় মেয়ে আজিমুন্নিসা বেগমকে তাঁর কোন একটি ব্যাধি নিরাময়ের জন্যে ১০০ টি শিশুর কলিজা খাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁর ব্যাধি নিরাময় হলেও শিশুদের কলিজা খাওয়া নাকি তাঁর নেশা হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে তাকে কলিজা খেকো বেগম ও বলা হয়। মুর্শিদকুলি খাঁ না কি সে জন্যে রেগে গিয়ে নিজের মেয়েকে জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলেন।
আমার পাশ থেকে অবিশ্বাসী দীপঙ্কর আবার বলে উঠলো “ইন্দ্রজিৎ এসব পুরো গ্যাঁজা, বুঝেছো তো?”
মনোজ বলল “না স্যার, সত্যি স্যার, কলিজা খাকী বেগমের সমাধি আর বাচ্চা মসজিদ এখান থেকে কাছে, বলেন তো আমি আপনাদের দেখিয়ে আনতে পারি ওখানে সব লেখা আছে!”
মুর্শিদকুলী খাঁ যতদূর জানা যায়, দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, ১৭২৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্য্যন্ত তাঁর রাজত্বে শান্তি এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় ছিল। কাটরা মসজিদের প্রাঙ্গনে বাগানের এক পাশে একটি ছোট শিবমন্দির দেখলাম। ব্যক্তিগত জীবনেও মুর্শিদকুলী খাঁ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেননা, তাঁর হারেম ছিলনা, এক স্ত্রীর সাথে সারা জীবন কাটিয়েছেন।
জমিজমা সংক্রান্ত আইনের সংস্কারকে মুর্শিদকুলী খাঁর অন্যতম অবদান হিসেবে ধরা হয়। মোগলদের জায়গীর প্রথাকে পালটে তিনি যে জমি আইনের প্রবর্ত্তন করেছিলেন, তাই শেষে জমিদারী প্রথা হিসেবে চালু হয়।
কাটরা মসজিদ থেকে বেরোবার দরজার পাশে নীচে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে, মনোজ দেখালো মাটির তলায় নবাবের সমাধি। ধর্ম্মপ্রাণ নবাবের নাকি ইচ্ছে ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পরে মানুষের যাতায়াতের পায়ের তলায় তাঁর সমাধি থাকবে, যাতে জীবনে যত পাপ তিনি করেছেন, মানুষের পায়ের তলায় কবরে শুয়ে থাকলে সেই পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে।


৪) জাহানকোষা কামান
কাটরা মসজিদের পরে জাহানকোষা কামান। জায়গাটা খুব কাছে । দুই মিনিটে পৌঁছে গেলাম।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে শুধু যুদ্ধ। ক্ষমতা আর আধিপত্যের, লোভ আর হিংসার কাহিনী। আর সেই যুদ্ধে ব্যবহার হয় গুলি বারুদ আর কামান।
কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর বিখ্যাত “পলাশীর যুদ্ধ” কাব্যে লিখেছিলেন,
“আবার, আবার সেই কামান গর্জন!
কাঁপাইয়া ধরাতল, বিদারিয়া রণস্থল,
উঠিল যে ভীম রব, ফাটিল গগন”
আজ কবি কথিত সেই সব কামান অব্যবহার্য হয়ে পড়লেও তাদের আকর্ষণ বিন্দুমাত্রও কমেনি। পশ্চিমবঙ্গের যে দু’টি বিখ্যাত কামানের নাম সর্বজনবিদিত, সেগুলি হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের দলমাদল এবং মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা। প্রথমটি প্রচারের আলোয় অনেকটা বেশি আলোকিত হলেও জাহানকোষার মাহাত্ম্যও কম নয়।জাহানকোষা কামানটি রাখা আছে কাটরা মসজিদ থেকে কাছেই একটি গ্রামে যার নাম তোপখানা। আমাদের গাড়ী দুটো সেই গ্রামের ভিতরে ঢুকে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। গাছপালার মধ্যে ধুলোমাখা সরু রাস্তা, সেই পড়ন্ত বিকেলে কিছু লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে, বাচ্চারা খেলা করছে। কিছুটা দূরে একটা ঘেরা জায়গায় দেখা যাচ্ছে একটি কামান, কিছুটা যেন অনাদৃত, অবহেলিত আর একলা, আশে পাশে তাকে দেখার বা তাকে দেখে মুগ্ধ বা আশ্চর্য্য হবার কেউ নেই। পর্য্যটক বা গাইড ও কেউ নেই। শুধু আমরা ক’জন।
অষ্টধাতু দিয়ে তৈরী বলে কামানে এখনো কোন জং পড়েনি। কামানটির গায়ে খুব সুক্ষ্ম কাজে লেখা আছে ফারসী ভাষায় কোন লিপি। পাশে একটা ASI এর নোটিস বোর্ড সেখানে কামান সংক্রান্ত অনেক তথ্য। যে লোহার চাকাযুক্ত গাড়িতে কামানটি স্থাপিত ছিল তা বহু বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।


৫) মোতিঝিল
ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামছে, আমরা মোতিঝিল প্রাসাদের দিকে রওনা দিলাম।
মোতিঝিল মুর্শিদাবাদ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন পড়ন্ত বিকেল। একটা বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে, সেই গেটে বড় বড় করে “মোতিঝিল” লেখা। গেটের সামনে অনেক দোকান পাট, ভীড়। ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় সাজানো বাগান, আর এক দিকে একটা বেশ বড় ঝিল।
মুর্শিদাবাদে মোতিঝিলে ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ হল পর্য্যটকদের জন্য একটা বড় আকর্ষন।
কে এই ঘসেটি বেগম?
১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁর মৃত্যুর পরে নানা ঘটনাবলীর পরে ১৭৪০ সালে বাংলার নবাব হন্ আলীবর্দ্দী খাঁ। দীর্ঘ ষোল বছর (১৭৬০ সাল পর্য্যন্ত) তিনি বাংলার নবাব ছিলেন।
আলিবর্দ্দীর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের স্বামী আলীবর্দ্দির ভ্রাতুষ্পুত্র নওয়াজেস মহম্মদ ধনী ছিলেন এবং তিনি দানধ্যানে বহু অর্থ অকাতরে বিলোতেন। তাঁরা থাকতেন মুর্শিদাবাদে মোতিঝিল প্রাসাদে। নওয়াজেস তাঁর দান ধ্যান এবং ধার্মিক ব্যবহারের জন্যে ক্রমশ; সাধারণ এবং অভিজাত সবার মধ্যেই অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠছিলেন। নওয়াজেস আলিবর্দ্দীর জীবনদশাতেই অল্প বয়েসে মারা না গেলে হয়তো সিরাজের জায়গায় তিনিই নবাব হতেন। তাহলে বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হতো কিনা কে জানে?
তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে ঘসেটি বেগম উত্তরাধিকার সূত্রে তার স্বামীর কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ধন সম্পদ পান। মোতিঝিল প্রাসাদে গেলে সেই সব ধন রত্ন বিলাস সামগ্রী আজও যত্ন করে সাজানো আছে দেখা যায়।
নবাব আলীবর্দ্দী খানের মৃত্যুর পরে, ঘসেটি বেগম চেষ্টা করছিলেন দ্বিতীয় বোন শাহ বেগমের পুত্র শওকত জঙ্গ কে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত আলিবর্দ্দী খাঁ মৃত্যুর আগে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের ছেলে সিরাজউদ্দৌলা কে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব হিসেবে অভিষিক্ত করেন।
ঘসেটি বেগম তাই নবাব আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীরজাফর, ধনী ব্যবসায় জগৎ শেঠ, এবং উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ দের কাছে পরাজিত হন এবং ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানান।
বিয়ের পরে যখন আমরা এসেছিলাম, মনে আছে এই প্রাসাদের ভিতরে আমরা অনেকটা সময় কাটাই। সেখানে অনেক দর্শনীয় এবং মূল্যবান জিনিষ ছিল, তার মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ে লাল নীল কাঁচের জানলা, যা কিনা বিদেশ থেকে কেনা। তা ছাড়া ঝাড়লন্ঠন ঘর সাজানোর জিনিষ, নানা কারুকার্য্য, চারিদিকে বৈভবের ছড়াছড়ি।
এবার আর হাতে বেশী সময় না থাকায় ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ পর্য্যন্ত আর হাঁটা গেলনা। গেট থেকে প্রাসাদ পর্য্যন্ত একটা ছোট ট্রেনে করে যাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল, কিন্তু সন্ধ্যা নামায় সেটাও বন্ধ। আমরা তাই ঝিলের ধারে একটু হেঁটে বেড়ালাম।

৬) সন্ধ্যার আড্ডা
কাশিমবাজার রাজবাড়ীতে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে একটু বিশ্রাম করে আমরা বসলাম আড্ডায়। দোতলায় আমাদের ঘর গুলো পাশাপাশি, এই সময়ে হোটেল খালি, আমরা ছাড়া এখানে আর কোন অতিথি নেই।
দীপঙ্কর আর অমিতাভর ঘরের পাশে একটা বসবার ঘর আছে লাউঞ্জের মত, সেখানে অনেক চেয়ার পাতা। দীপঙ্করের আনা মহার্ঘ্য হুইস্কি আর জিন যে যার মতো নিয়ে জমিয়ে বসলাম আমরা।
আমাদের মধ্যে দীপঙ্কর সেই কলেজ জীবন থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভক্ত। খুব কম বয়েস থেকেই নানা সঙ্গীত সন্মেলন এর টিকিট কেটে রাত জেগে সে বিখ্যাত নানা শিল্পীর অনুষ্ঠান শুনতো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে তার একটা স্বাভাবিক আর সহজাত ভাল লাগা ছিল। তার ওপরে সে বেশ কিছু বছর ধরে নানা জায়গা থেকে অনেক দুষ্প্রাপ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরনো রেকর্ড আর সি ডির collection করে আসছে। এই সব দুষ্প্রাপ্য গান শুনতে তার বাড়ীতে নানা গুনীজনের আগমন হয়।
হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রাগ রাগিনী ও নানা ঘরানার শিল্পীদের নিয়ে তার অপরিমিত পড়াশোনা আর জ্ঞান। আমাদের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় তার উত্তেজনা দেখে আমরা যারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তেমন বুঝিনা, তারাও বুঝি যে ব্যাপারটা তার কাছে একটা গভীর প্রেমের মত, একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু মুস্কিল হলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে একটা নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে, তার বাইরে যাওয়া নিয়ে দীপঙ্করের প্রবল আপত্তি। এ ব্যাপারে সে কঠোর ভাবে রক্ষণশীল। তাই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তার নানা অভিযোগ, এমন কি সে রবীন্দ্রনাথকেও পছন্দ করেনা, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাবার কথা উঠলে সে অবজ্ঞা করে বলে তোমরা যাও, আমার ওখানে যাবার কোন ইচ্ছে নেই।
এদিকে সুপ্রিয়া আবার রবীন্দ্রনাথের গানে একেবার যাকে বলে নিমজ্জিত। মুম্বাই তে তার বাড়ীতে সে রবীন্দ্রনাথের গান শেখানোর স্কুল খুলেছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও তার যথেষ্ট তালিম আছে। গানের ভাব প্রকাশের জন্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শৃঙ্খলার সামন্য একটু এদিক ওদিক হলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়, এই নিয়ে দীপঙ্করের সাথে তার তর্ক শুরু হয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন রাগাশ্রিত গানে কঠোর রাগের আধার কে মুখ্য করে তোলেননি। গানের কথার চারিপাশে তিনি উন্মুক্ত রেখেছেন সুরের প্রবাহ, রাগের মূল মেজাজ ও লয় বজায় রেখে তিনি কাঠামোগত বন্ধন থেকে তাঁর গানগুলিকে মুক্তি দিয়েছেন।
আমরা বাকিরা এই তর্কে যোগ দিইনা, তবে সাধারণ ভাবে যেহেতু আমরাও সুপ্রিয়ার মত রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালবাসি এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আমাদের তেমন জ্ঞান বা উৎসাহ নেই, তাই আমরা এই তর্কে মনে মনে সুপ্রিয়ার পক্ষেই থাকি।
বেশ কিছুক্ষণ তর্ক চলার পরে শেষে আমরা সুপ্রিয়া কে গান গাইতে অনুরোধ করলাম। সে আমাদের অনুরোধে দুটি গান গাইলো~
“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা”, আর “বাজিল কাহার বীণা”।
বড় ভাল গায় সুপ্রিয়া। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম।
আমার জীবনে “আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা” গানটার একটা বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৪ সালে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সুভদ্রার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্ত্তা চলছে। তো একদিন আমরা বেশ কয়েকজন জানুয়ারী মাসের এক বিকেলে গেছি ওদের সাঁতরাগাছির বাড়ীতে, কনে দেখা আর জামাই দেখা দুটোই একসাথে হবে।
আমার মা’র অনুরোধে সেদিন সুভদ্রা আমাদের ওই গানটা খুব সপ্রতিভ ভাবে গেয়ে শুনিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্য্যায়ের ওই ছোট গানটিতে প্রতিটি ছত্রে ভালবাসার কথা।
আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয়/
বড় উতলা আজ পরাণ আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও?/
অনাত্মীয় অল্পবয়েসী একটি সুন্দরী মেয়ে আমার মত একজন অচেনা ছেলে কে একঘর লোকের সামনে প্রেম নিবেদন করবে তা তো হতে পারেনা। আমি অত নির্বোধ ও ছিলাম না যে তা ভাববো। কিন্তু আমি নিজেকেই কিছুটা অবাক করে দিয়ে সুভদ্রার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে একটি ছোট প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলাম।
গোপন কথাটি রবে না গোপনে/ উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে/
হয়তো আমি সেই অচেনা সুন্দরী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম “হ্যাঁ, আমি খেলায় হার মানতে রাজী, যদি তুমি আমার সাথে খেলতে রাজী থাকো।”
আমরা দু’জনেই রবীন্দ্রনাথের গান ভালবেসে শুনতাম। কবি তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই আমাদের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন।
সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কিন্তু সেই বিকেলটার স্মৃতি আমার মনে এখনো অমলিন। বিশেষ করে এই গানটা যখন যেখানেই শুনি, মনে মনে চলে যাই সেই পঞ্চাশ বছর আগের এক শীতের বিকেলে একটি অচেনা সুন্দরী মেয়ের গান শুনে তাকে ভাল লাগার দিনে।
সুপ্রিয়াকে পরে সেই কথা জানিয়ে ঐ গানটি সেদিন গাইবার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।


মোতিঝিল
দ্বিতীয় দিন – ১৩/১২/২০২৩
১) কাঠগোলা
আজকে সকালে সবাই তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে নেমে এলাম। আজ প্রাতরাশে প্রথমে ফলের রস, তার পরে লুচি হালুয়া তরকারী। সাথে টোস্ট ডিম, চা কফি।
শেফ ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির করছেন, লাঞ্চে কি খাবেন, ডিনারে কি খাবেন সব জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন আগে থেকেই। আমরা যখন খেতে বসি তিনি নিজে এসে তত্ত্বাবধান করে যান। রাজবাড়ীতে এই ক’দিন বেশ রাজার হালেই থাকা যাবে মনে হচ্ছে।
আজ আমাদের প্রথম স্টপ হলো কাঠগোলা। এটা এক পুরনো দিনের রাজস্থানী ব্যবসায়ী পরিবারের বাগানবাড়ী। গেট দিয়ে ঢুকে একটি অল্পবয়েসী ছেলেকে আমাদের গাইড হিসেবে পেলাম। তার বিশেষত্ব হলো সে একজন স্বভাব কবি, অধিকাংশ সময়ে সে আমাদের সাথে কবিতায় কথা বলছিল।
মোগল আমলে রাজস্থান থেকে আসা জৈন ব্যবসায়ীদের আনাগোনা এখানে বাড়তে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিচিত নাম অবশ্যই জগৎ শেঠ। নবাব এবং ইংরেজদের দু’ দিকের সাথেই এদের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল, তাদের তাঁরা চড়া শুদে টাকা ধার দিতেন। ব্যবসা করে এদের এত বাড়বাড়ন্ত হয়েছিলে, যে শোনা যায় এঁদের ধন সম্পত্তি নাকি আজকের আদানী আম্বানীর থেকেও অনেক গুণ বেশী ছিল।
কাঠগোলা বাগান বা কাঠগোলা প্রাসাদ তার কালো গোলাপ এর বাগান আর আদিনাথের (জৈনধর্মের আদিপুরুষ) মন্দিরের জন্যে বিখ্যাত। পঞ্চাশ বিঘা জুড়ে এক বিশাল জমির ওপর এই বাগান বিস্তৃত। কালো গোলাপ অবশ্য এখন আর নেই, কিন্তু সেখানে আজ এক বিশাল আমবাগান। কথিত আছে এই কাঠগোলা বাগান আর প্রাসাদ তৈরী করেন লক্ষীপত সিং দুগার। আজ কাঠগোলার এই বাগানটি মুর্শিদাবাদের পর্য্যটকদের জন্যে একটি অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনস্থল। বাগানের চার কোণে চারটি অশ্বারোহীর সাদা মার্বেলের স্ট্যাচু। শোনা গেল তারা হলেন সেই দুগার পরিবারের চার ভাই।
কাঠগোলা নাম কেন? আমাদের গাইডের কাছে শুনলাম দুগার দের নাকি বিশাল কাঠের ব্যবসা ছিল, সেখান থেকেই ওই নাম।
গেট দিয়ে ঢুকে সামনেই একটা বিশাল টলটলে জলের বিশাল পুকুর, কিছু লোক ঘাটে দাঁড়িয়ে জলে খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর জলের মধ্যে অনেক রঙ্গীন মাছ খলবল করে জলে ঢেউ তুলছে। পুকুরের চার দিকে ঘাটের সিঁড়ি জলে নেমে গেছে, বেশ কিছু রাজহাঁস সেখানে ব্যস্ত ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কাঠগোলার দুগার দের সাথে জগৎ শেঠের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। আমাদের গাইড রাস্তার পাশে একটি সুড়ঙ্গ দেখালো, সেখানে সিঁড়ি নেমে গেছে এবং নীচে জল দেখা যায়। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি এই বাড়ীর সাথে জগৎ শেঠের বাড়ীতে মাটির তলা দিয়ে জলপথে যোগাযোগ ছিল। গোপন নথিপত্র সরকারী নজর এড়িয়ে নাকি এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নৌকা করে বা অন্য কোন উপায়ে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হত।
পথচারীদের সেই সুড়ঙ্গের কাছে না আসার জন্যে বলা হত এখানে মেয়েরা স্নান করছে, একটু দূরত্ব রেখে হাঁটুন। আমাদের গাইড কবিতায় বুঝিয়ে বললো – “মেয়েরা হেথায় করিতেছে স্নান, আপনারা দয়া করে দূর দিয়ে যান্!”
আর একটু এগিয়ে গেলে দুগার পরিবারের একটা বিরাট প্রাসাদ, আর পাশে ফুলের বাগান। এখানে নাকি রঙ্গীন মাছগুলো মারা গেলে তাদের যত্ন করে মাটির তলায় কবর দেওয়া হত। আমাদের গাইড বললো – “দ্যাখো মাছেদের কি কদর, মাটির নীচে তাদের কবর!”
প্রাসাদ ছেড়ে এগিয়ে গেলে একটা চাঁপা গাছ, তার গুঁড়ির একটা দিক বেশ কিছুটা ভেঙ্গে ফাঁক হয়ে গেছে, আমাদের কবি গাইড এর ভাষায় “গাছটি চাঁপা, পিছনটা ফাঁপা”।
বাগানের পাশে একটু দূরে দেখলাম একটা ধবধবে সাদা মার্বেলের তৈরী মন্দির। এই হলো সেই কাঠগোলার বিখ্যাত পরশনাথের মন্দির। তার সামনে ফুলের বাগান। গাইডের কাজ শেষ, সে এবার ফিরে যাবে।
সে আমাদের বিদায় জানিয়ে বললো – “সামনে বাগান, আমি যাই, আপনারা আগান!”
২) জগৎ শেঠের বাড়ী – নসীপুর
কাঠগোলার পরে আমাদের গন্তব্য জগৎ শেঠের বাড়ী।
স্কুলে থাকতে ইতিহাস পড়ে আমার ধারণা ছিল যে জগৎ শেঠ একজন ধনী ব্যবসায়ীর নাম। আমি মনে মনে তাঁর চেহারা ও কল্পনা করতাম বিশাল বপু, বিশাল গোঁফ, কিছুটা আমাদের বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের মত।
পরে জানলাম জগৎ শেঠ আসলে একজন বিশেষ কারুর নাম নয়, ওটা একটা পারিবারিক উপাধি। এই উপাধির মানে তারা হল জগতের অর্থাৎ সারা পৃথিবীর মালিক।
এই পরিবারের আদিপুরুষের নাম মাণিক চাঁদ। তিনি ব্যবসার সুত্রে ১৭০০ সালে প্রথম পাটনা থেকে ঢাকা আসেন। মাণিকচাঁদের নিজের সন্তান ছিলনা, ১৭১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পালিত পুত্র ফতেচাঁদ শেঠ পরিবারের ব্যবসার উত্তরাধিকারী হন্ এবং তাঁর সময়ে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। ১৭২৩ সালে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ার ফতেচাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি দেন। এরপর থেকে ফতেচাঁদের পুরো পরিবার জগৎ শেঠ পরিবার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তার সময়েই শেঠ পরিবারের যশ-প্রতিপত্তি চূড়ায় পৌঁছয়।
জগৎ শেঠের বিলাসবহুল বাড়ী এখন একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। বাড়ীর পাশে একটি বড় সাদা রং এর জৈন মন্দির। টিকিট কেটে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।
বাড়ীর ভিতরে ঢুকে মিউজিয়াম, শেঠদের নানা ব্যক্তিগত সংগ্রহ সেখানে রাখা। টাকশালে তৈরী সোনা আর রূপোর মুদ্রা। মুর্শিদাবাদের সিল্ক আর ঢাকাই মসলিন শাড়ী। এছাড়া কিছু প্রাকৃতিক সৃষ্টি, যেমন ফসিল ও উল্কা পাথর। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য অয়েল পেন্টিং দেয়ালে টাঙানো। মূল্যবান আসবাব পত্র, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছাপ মারা লোহার চেয়ার। অস্ত্র শস্ত্র রাখার গুপ্ত ঘর মাটির ২০ ফিট তলায়।
আর মাটির তলায় সেই গুপ্ত সুড়ঙ্গ – যার অন্য দিকটা আমরা একটু আগে দেখে এসেছি কাঠগোলায়।
সব মিলিয়ে জগৎ শেঠের বাড়ীর ভিতরে ঢুকে খুব একটা আহামরি কিছু লাগলোনা আমাদের কাছে। বেশ এলোমেলো ভাবে জিনিষপত্র রাখা, কিছু মরচে পড়া কোম্পানীর আমলের কিছু মরচে পড়া লোহার চেয়ার রাখা আছে ঘরের এক কোণে। দেয়ালে রং ও করা হয়নি বহুদিন। যত বৈভব আশা করেছিলাম, তত কিছু চোখে পড়লোনা।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনকুবের, যার কাছে আজকের আদানী, আমবানী, বিল গেটস, এয়ন মাস্ক, জেফ বেজোস সবাই শিশু, তার বাড়ী দেখে বেশ আশাভঙ্গই হয়েছিল সেদিন আমাদের।
প্রবীর অমিতাভকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, জগুদা’ দের এত টাকা কি করে হলো রে?”
আসলে আমি আর প্রবীর হলাম ইঞ্জিনীয়ার, লোহা লক্কড় যন্ত্রপাতি নিয়ে আমাদের কাজ, ওদিকে অমিতাভ আর দীপঙ্কর হলো ফাইন্যান্সের লোক, টাকা জমানোর ব্যাপারটা ওরা ভাল জানবে।
দীপঙ্কর বললো, “আরে ভাই, টাকা রোজগার করার অনেক ফন্দী ফিকির আছে, সে সব জানতে গেলে আগে টাকা ভালবাসতে হবে, টাকা অন্ত প্রাণ হতে হবে। ক্ষমতাশালী রাজাদের (আজকের দিনে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের) সাথে যোগাযোগ আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী করা হলো সবচেয়ে জরুরী। রাজনৈতিক ক্ষমতা আর ব্যবসা – power and business – এই দুইয়ের সম্পর্কের নাম হলো Crony capitalism, ব্যাপারটা আগেও ছিল, এখনো আছে। জগু দা’রা এই ব্যাপারটা খুব ভাল জানতেন। ”
অমিতাভ তার সাথে যোগ করে বললো, “অবশ্য টাকা থাকলেই জীবনটা সুখের হবে তার কোন মানে নেই। না হলে এই জগৎ শেঠের পরিবারে এত সৈন্য সামন্ত, এত অস্ত্রশস্ত্র কেন দরকার হতো?”
আমি বললাম “ওরা হলো গিয়ে ভাগ্যলক্ষীর বরপুত্র। সেই Abba র গানটা মনে আছে তো? It’s a rich man’s world?”
Money, money, money, must be funny, in the rich man’s world/
Money, money, money, always sunny, in the rich man’s world/





৩) হাজারদুয়ারী
হাজারদুয়ারী মুর্শিদাবাদের অন্যতম দর্শনীয় জায়গা। বাস্তবিক হাজারদুয়ারী আর মুর্শিদাবাদ দুটো কথা প্রায় সমার্থক। আমরা যে ট্রেনে এসেছি তার নাম ও ছিল হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস। সুতরাং মুর্শিদাবাদ এলে হাজারদুয়ারী তো দেখতেই হবে।
জগৎ শেঠের বাড়ীর পরে আমরা গেলাম হাজারদুয়ারী দেখতে। কাছেই, গাড়ীতে মিনিট দশেক লাগলো। যখন পৌঁছলাম তখন বেলা হয়েছে, মাথার ওপরে সূর্য্য, বেশ গরম।
গঙ্গার ধারে একটা বিশাল জায়গা নিয়ে হাজারদুয়ারী প্রাসাদ আর ইমামবাড়া।
গেটের সামনে সরু রাস্তায় ময়লা ছড়ানো, বিক্ষিপ্ত ভীড়, ঘোড়ার গাড়ী। পুরো পরিবেশেই কেমন যেন একটা অবক্ষয় আর অযত্নের মলিন ছাপ। যাই হোক, গেট দিয়ে ঢুকে টিকিট কাটার পরে আমরা একজন গাইডকে নিলাম। সুজাতা আমাদের খরচের হিসাব রাখছে। পরে হিসেব করে ভাগাভাগি করে নেবো আমরা।
একটা গাছের ছায়ায় বসে আমাদের গাইড তার লেকচার শুরু করলো।
১৭৫৬ সালে আলীবর্দ্দী খাঁর মৃত্যুর পরে বাংলার নবাব হন্ তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা।
মাত্র তেইশ বছর বয়েসে সিরাজ যখন বাংলার নবাব হন্ তখন উড়িষ্যা আর বিহারের অনেকটাই আলীবর্দ্দী হারিয়েছেন মারাঠাদের সাথে চুক্তির জন্যে । সিরাজ মুর্শিদকুলী খাঁ বা আলীবর্দ্দী খাঁর মত বিচক্ষণ ছিলেননা, নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতাও তাঁর ছিলনা। কম বয়েস হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, এবং তাঁর অত্যাচারে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর চারিদিকে বহু শত্রু এবং অনেক মসনদ দখল করার দাবীদার জড়ো হয়ে যায়। তার ওপরে ঐতিহাসিকেরা সিরাজকে একজন নির্বোধ, এবং লম্পট মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দীর্ঘদিন রাজত্ব শাসন করার সুযোগ সিরাজ পান্নি। শেষে মাত্র এক বছর রাজত্বের পরে ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে পলাশীর যুদ্ধে প্রধানতঃ তাঁর নিজের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যু হয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নাটকে গানে গল্পে কবিতায় বার বার কিন্তু একজন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে উঠে এসেছে সিরাজের নাম। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সিরাজ ব্রিটিশ বিরোধী এই ভাগ্য বিড়ম্বিত নায়কের প্রতি একটা বড় অংশের বাঙালীর সহানুভূতি রয়েছে।
এই ভাল আর মন্দ দুই দিকের মধ্যে কোনটা ঠিক? সিরাজ কি নায়ক ছিলেন, না খলনায়ক?
গাইড ছেলেটির কাছ থেকে হাজারদুয়ারী এবং তার উলটো দিকে ইমামবাড়া নিয়ে কিছু তথ্য জানা গেল।
এই প্রাসাদে কি সত্যিই এক হাজারটি দরজা আছে? গাইড ছেলেটি বললো প্রাসাদটিতে মাত্র ১০০ টি বাস্তব দরজা রয়েছে আর বাকি ৯০০ টি নাকি নকল। ভাগীরথী নদীর তীরে কিলা নিজামত বা নিজামত কিলা ছিল মুর্শিদাবাদের পুরনো দুর্গের স্থান। এই প্রাসাদের নির্মানের জন্য দুর্গটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। জায়গাটি এখনো কিলা নিজামত নামে পরিচিত।
হাজারদুয়ারী প্রধানতঃ একটি জাদুঘর, সেখানে এ সযত্নে ধরে রাখা আছে স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ের অজস্র নিদর্শন। সেখানে কি কি দর্শনীয় জিনিষ আছে তা গাইড ছেলেটি আমাদের জানিয়ে দিল। একটা ছবি আছে, সামনে খাবারের থালা নিয়ে বসে একটি বিশাল মোটা লোক খাচ্ছে। সেই ছবিটা দেখতে ভুলবেন না, বললো সে।
গাইডের বক্তব্য শেষ হলে তার পাওনা মিটিয়ে আমরা টিকিট কেটে হাজারদুয়ারীর ভেতরে প্রবেশ করলাম।
এই প্রাসাদের মোট তিনটি তলা রয়েছে। আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। তৎকালীন নবাব দের ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র – আলীবর্দ্দী খাঁ এবং সিরাজের তরবারী এমন কি যে ছুরি দিয়ে মহম্মদী বেগ সিরাজ কে খুন করেছিলেন তা পর্য্যন্ত রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। এছাড়া আছে মার্বেল মূর্তি, চীনামাটির বাসন, ধাতব সামগ্রী, দুর্লভ বই, পাণ্ডুলিপি, পুরনো মানচিত্র, ভূমি রাজস্ব রেকর্ড। আছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার রূপোর সিংহাসন আর বিশাল ঝাড়বাতি। আর তিনতলায় আছে নবাব আমলের নানা নিদর্শন। সোনা দিয়ে মোড়া কোরাণ শরীফ, নানা অমূল্য পুঁথিপত্র, অসংখ্য বই, আবুল ফজলের আইনী আকবরীর পান্ডুলিপি, তাছাড়া নানা পুরাকীর্তি এবং আসবাবপত্রের বিশাল সংগ্রহ। দেশ বিদেশ থেকে সংগৃহীত নানা ধরণের ঘড়ি, রাফায়েল, ভ্যান ডাইক এবং অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের অয়েল পেন্টিং, শ্বেত পাথরের মূর্ত্তি, এবং আরও অনেক দর্শনীয় জিনিষ।
এ ছাড়া ৯০ ডিগ্রীতে একটি জোড়া আয়নার রাখা আছে । এই আয়নায় মানুষ তার নিজের মুখ দেখতে পারে না যদিও অন্যরা একই দেখতে পারে। এটি নবাব আক্রমণকারীদের দূরে রাখার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
একটা ফেলে আসা সময়কে ধরে রেখেছে হাজারদুয়ারী।




৪) ইমামবাড়া
হাজারদুয়ারীর ঠিক উল্টো দিকে এক বিশাল লম্বা প্রাসাদ। শুনলাম এটি হল শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ইমামবাড়া তার কাছেই আছে মদিনা মসজিদ। এটি শুধুমাত্র মহরমের সময় দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
ইমামবাড়ার সামনে একটি কামান, যার নাম বাচাওয়ালি টোপ, এটি তৈরি করেছিলেন মুর্শিদকুলী খান। কামানটি মুখ উঁচু করে একটি উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত। এই কামানটি নাকি ভাগীরথীর জলের তলায় ছিল, নদী সরে যাবার পরে এক উদ্ধার করে এখানে রাখা হয়।
ইমামবাড়ার স্থাপত্যও চোখে পড়ার মত, সামনে অসংখ্য স্তম্ভ, আর প্রবেশদ্বার হিসাবে একটি বিশাল গেট, যার নাম দক্ষিণ দরওয়াজা অন্য প্রান্তে যেখানে সিঁড়ি শুরু হয়, সেখানে দুটি ভিক্টোরিয়ান সিংহের মূর্তি রয়েছে। গাইডের মুখে শুনলাম মহরম উৎসবের সময় এখানে মেলা বসে, অনেক লোকজনের ভীড়ে জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে।
হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়ার চারিপাশে একটু ঘুরে বেড়ালাম আমরা। কাছেই দুটো বড় মসজিদ। চারিদিকে পর্য্যটকদের ভীড়, বেশ একটা উৎসবের বা মেলার মত পরিবেশ।
বেশ কিছু ছবি তোলা হলো।



৫) একটি আশ্চর্য্য স্বপ্ন
হাজারদুয়ারী আর ইমামবাড়া দেখার পরে আজ বিকেলে আর কোথাও যাবার নেই, হোটেলে ফিরে আমরা সোজা ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে গেলাম। আবার উপাদেয় সব পদ, শেষ পাতে মিষ্টি দই আর রাজভোগ। শেফ ভদ্রলোক আবার কাছে এসে রাত্রে কি খাবো জিজ্ঞেস করে গেলেন। এদের আতিথেয়তার কোন ত্রুটি নেই। আমরা রায় পরিবারের ছোটবাবু পল্লবের অতিথি। সুতরাং আমাদের দিকে তো নজর একটু বেশী হবেই।
দুপুরে একটু বিশ্রাম নেবার পরে সন্ধ্যায় আবার আড্ডা দেবো এই হলো আমাদের প্ল্যান। তো বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা রাখতেই গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলাম। আসলে রোদের মধ্যে অত হাঁটা, তারপরে জমিয়ে একটা লাঞ্চ। ঘুমের আর দোষ কি?
আর এই দু’দিন গাইডদের মুখে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের নানা আজব আজগুবি উদ্ভট গল্প মাথার মধ্যে গজগজ করছে, ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে আমি ফিরে গেলাম সোজা অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সেই স্বপ্নে আমি মোগল আমলের দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁ, সম্রাট আওরংজেব আমায় ডেকেছেন, আমি তার কাছে খাজনা নিয়ে দেখা করতে গেছি।
স্বপ্নে আমি সম্রাটের সাথে বেশ সুন্দর উর্দ্দু ভাষায় কথা বলে যাচ্ছি, কোন অসুবিধেই হচ্ছেনা, আওরংজেব আমার ওপর মোটের ওপর বেশ সদয় মনে হচ্ছে, বেটা বেটা বলে তিনি আমায় অনেক উপদেশ দিচ্ছেন।
তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পালঙ্কে বসে আছেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব, শণের মত সাদা চুল দাড়ি, শ্যেন দৃষ্টি, সারা মুখে অসংখ্য বলিরেখা। পরণে সাদা ঢোলা আলখাল্লা, পাজামা। গলায় মুক্তোর মালা, হাতের মুঠোয় তসবি। সামনে মেঝেতে জাজিম বিছানো, তার ওপর হাঁটু মুড়ে বসে আছি আমি, কারতলব খান।
আওরংজেব আমায় বললেন তোমায় দেখলে আমার সফির কথা মনে পড়ে। সে আমার আত্মীয় ছিল। সফি তোমায় আমার কাছে নিয়ে এসেছিল । সে যখন আমায় বলল তোমার আগের পরিচয়, তখন প্রথমে আমি একটু নারাজ ছিলাম। কারণ আমি হিন্দুদের তত বিশ্বাস করতামনা।
তুমি জন্মেছো এদেশের আদি ধর্ম্মের পরিবারে, সেই ধর্ম্ম জেনেছো, পড়েছো, এতে কোন কসুর নেই। ঘটনাক্রমে তার পরে দীক্ষিত হয়েছো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ন্ম ইসলামে। পড়েছো কোরান, হাদিস। এটা তোমার জীবনের পরম সৌভাগ্য। তুমি হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষের মন পড়তে পারো। ভাল মন্দ বুঝতে পারো, সবার প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারো।
তুমি হিন্দু ঘরের আউলাদ, এটা তোমার অতিরিক্ত সুবিধা, হিন্দুদের কাছে টানো। তারা সচরাচর বেইমানী করেনা, তাদের লালচ আর সাহস দুইই কম। কিন্তু তোমার মধ্যে আমি কূটনীতির অভাব লক্ষ্য করি।
পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজনীতির চাল দেওয়া, দরকারে দুশমনের গালে চুমু খাওয়া ধূর্ততা, শঠতা, লোক চেনার মত পরিপক্কতা এই সব তোমাকে আয়ত্ত্ব করতে হবে।
বেটা, আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি সবার ওপরে ইনসানিয়াত, মনুষ্যত্ব। সর্ব্বশক্তিমান আল্লা তাদেরই পাশে থাকেন যারা মানুষের পাশে থাকে। আল্লার কাছে দোয়া করি যেন তুমি শেষ দিন পর্য্যন্ত যে ধর্ম্মেরই মানুষ হোক, সাচ্চা ইনসানের পাশে যেন দাঁড়াতে পারো।
আমায় এই সব উপদেশ দিতে দিতে নৃশংস নিষ্ঠুর হিন্দু বিদ্বেষী সম্রাট আওরংজেব হঠাৎ যেন একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে গেলেন, তাঁর গলায় আমি পেলাম অনুতাপের আর আত্মধিক্কারের সুর। এ যেন এক অন্য আওরংজেব!
বেটা,আমি জীবনে যত অপরাধ করেছি, তার শেষ নেই, আমি জানি খোদাতালার কাছে তার ক্ষমা নেই। সেই পাপ এই মুলুক আমার তখত্ সব ধ্বংস করে দেবে। এ থেকে আমার রেহাই নেই বেটা।
কুর্সির লালচে আমি আব্বাজানকে বন্দী করেছি,অত্যাচার করেছি, নিজের ভাইদের একে একে নৃশংস ভাবে খতম করেছি। আমার হাত খুনে লাল হয়ে আছে। তখন আমার একটাই লক্ষ্য, সকলকে সরিয়ে আমিই হবো হিন্দুস্তানের মালিক। আলমগীর আওরংজেব। বাকি সবাই থাকবে আমার পায়ের তলায়। যে যখন আমার বিরোধিতা করেছে, তাকে আমি সরিয়ে দিয়েছি। আল্লার দরবারে এর কোন ক্ষমা নেই।
এদিকে আমি মনে মনে ভাবছি ব্যাপারটা কি, বাদশা একবার বলছেন ধূর্ত্ত হও, শঠ হও, নির্মম হও, আবার অন্যদিকে মানবতার বাণী শোনাচ্ছেন, আবার নিজের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা করছেন। এতো মরণকালে হরিনামের মত শোনাচ্ছে! দেরীতে বোধোদয়?
এই সব ভাবছি, এমন সময় সুভদ্রার ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলাম সন্ধ্যা হয়েছে, হোটেল থেকে ঘরে চা দিতে এসেছে, সাথে বিস্কুট। স্বপ্নের রেশটা কিন্তু রয়েই গেল মনের ভিতরে। ভাবছিলাম কে যে আমাদের মনের নানা চিন্তা আর কল্পনা মিশিয়ে এই সব আশ্চর্য্য বাস্তব স্বপ্ন তৈরী করে্ !
আমি সেই লোকটার নাম দিয়েছি স্বপ্নের জাদুকর।


৬) রাত্রের আড্ডা
আজকের আড্ডার বিষয় হলো কর্পোরেট জগতে প্রেম। দীপঙ্করের কর্পোরেট জগতের হোমরা চোমরা লোক – কানোরিয়া, বাজোরিয়া, গোয়েঙ্কা, বাঙ্গুর, আগরওয়াল দের সাথে খুব মেলামেশা, দহরম মহরম। তার স্টকে তাই তাদের নিয়ে অনেক গল্প। সেই সব গল্প আমাদের সে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে।
দীপঙ্করের সেদিন বলা দুটো গল্প এখনো মনে পড়ে।
প্রথম গল্প – দজ্জাল বৌ
একটা বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তাঁর সেক্রেটারী একটি কমবয়েসী মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছেন। অফিসে অনেক সিনিয়র ম্যানেজার দের দু’জনের এই পারস্পরিক ভাল লাগার ব্যাপারে কিছুটা আন্দাজ আছে, কিন্তু এই নিয়ে কেউ কিছু বলেনা, প্রাপ্তবয়স্ক দুই নারী ও পুরুষ তাদের সম্পর্ক কি ভাবে তৈরী করবে তাতে কার কি বলার আছে? তার ওপর চেয়ারম্যান বলে কথা।
তো একদিন সকালে চেয়রাম্যান ট্যুরে কলকাতার বাইরে গেছেন, তাই তাঁর অফিস প্রায় খালি। সেই সেক্রেটারী মহিলা আর কিছু অন্য মহিলা টাইপিস্ট নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছেন। বস্ নেই তাই কাজ ও নেই, বেশ একটা খুসীর আমেজ অফিসে।
এমন সময় রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ চেয়ারম্যানের স্ত্রীর প্রবেশ। তাঁকে ওই মেয়েরা সবাই চেনে, সবাই সন্মান জানিয়ে তাঁকে গুড মর্ণিং ম্যাডাম বলার আগেই মহিলা গিয়ে সেই সেক্রেটারী মেয়েটির কাছে গিয়ে তার চুল ধরে এক টান। আর এলোপাথাড়ি চড় চাপড় এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি।
তোর এত বড় আস্পর্দ্ধা, আমার বরের সাথে লুকিয়ে প্রেম করছিস, জানিস তোর কি ব্যবস্থা করবো আমি? আমায় তুই চিনিস না্…ইত্যাদি।
সেই সেক্রেটারী মেয়েটি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে সেও সহকর্ম্মীদের সামনে এই অপমান সহ্য করবে কেন, সেও সমান তালে মহিলার ওপরে চড়াও হলো। চেয়ারম্যানের দামী কার্পেটে ঢাকা অফিসে দুই বয়স্ক ভদ্রমহিলার মধ্যে শুরু হয়ে গেল চুলোচুলি।
সৌভাগ্য বশতঃ সেদিন ব্যাঙ্কের আরও দুই একজন উচ্চপদস্থ অফিসার সেদিন সেই অফিসে নিজেদের ঘরে ছিলেন, তাঁরা বাইরে বেরিয়ে এসে কোনমতে দুই মহিলাকে থামান।
দীপঙ্কর ওই ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টর ছিল, সে এই ঘটনার কথা শোনে কোম্পানীর সেক্রেটারীর কাছ থেকে। তিনি নাকি দীপঙ্কর কে বলেছিলেন মিস্টার চ্যাটার্জ্জি, আপনি একটু চেয়ারম্যান সাহেব কে বুঝিয়ে বলুন না।
আমি বললাম তুমি কি বুঝিয়ে বললে?
দীপঙ্কর বলল দূর, আমি কি বোঝাবো? শেষ পর্য্যন্ত ওই দজ্জাল বৌয়ের ভয়ে তিনি নিজে থেকেই সরে এসেছেন
দ্বিতীয় গল্প – কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে
একটি নামকরা এয়ার কন্ডিশনার কোম্পানীর মালিক এক মাড়োয়ারী, শিক্ষিত, সুদর্শন ভদ্রলোক, স্ত্রী আর দুই প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর সুখী পরিবার। এই কোম্পানীটা তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন।
তো এক দিন একটি অল্প বয়েসী মেয়ে তাঁকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিক্রী করতে আসে। কি যে ছিল সেই মেয়েটির মধ্যে কে জানে, ভদ্রলোক তার প্রেমে পড়ে গেলেন। তারপরে এই দু’জনের মধ্যে যে একটা অদ্ভুত,অবিশ্বাস্য, অসমবয়েসী সম্পর্ক তৈরী হল তা কেবল গল্প উপন্যাসেই সম্ভব।
শেষ পর্য্যন্ত ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স করে তাঁর পরিবার কে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির সাথে ঘর বাঁধলেন। তিনি তাঁর সম্পত্তির সিংহভাগ, তাঁর বাড়ী ঘর, এমনকি কোম্পানীর সব শেয়ার তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে উইল করেছিলেন, নিজেও কোম্পানী থেকে সরে এসেছিলেন।
দীপঙ্কর ছিল সেই কোম্পানীর অডিটর। ভদ্রলোকের অনুরোধে দীপঙ্কর তাঁর উইল এবং ডিভোর্সের কাজ কর্ম, সম্পত্তির ভাগ ইত্যাদি সব দেখা শোনা করেছিল।
কর্পোরেট জগতের পুরুষ ও নারীর নিষিদ্ধ সম্পর্কের এই দু’টি গল্প নিয়ে আমাদের অনেক তর্কের অবকাশ ছিল। প্রথম গল্পটি তো অনায়াসে “Me too” আন্দোলনের পর্য্যায়ে পড়বে। সেক্রেটারী মেয়েটির সাথে চেয়ারম্যানের এই সম্পর্ক কোন ভাবেই প্রেম বলে ধরা যায়না। এটা অবশ্যই পুরুষের ক্ষমতার অপব্যবহার। কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটি ঠিক সেই জাতের নয়। এই গল্পেও নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে, কিন্তু নারী পুরুষের গভীর প্রেমই হলো এই গল্পের প্রধান উপজীব্য। একজন পুরুষ একজন নারীকে ভালবেসে তাঁর সামাজিক সন্মান, প্রতিপত্তি, ধন, মান এমন কি নিজের স্ত্রী আর পরিবারকেও ছেড়ে যেতে পারেন?
এসেছো প্রেম, এসেছো আজ, কি মহা সমারোহে…
কিন্তু এর মধ্যেও মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার দেখবে আমার সন্দেহ নেই। তাদের সহানুভূতি থাকবে স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি। তাদের এই ভাবে ছেড়ে চলে যাবার কোন অজুহাতই তারা মেনে নেবেনা। দাম্পত্যে বিষ জমলেও দু’জন কে একসাথে থেকে যেতে হবে? আর ছাড়াছাড়ি হলেই ছেলেদের দোষ!
আমাদের চেনা জানা অনেক গুণী মানুষ বিবাহিত হয়েও নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য নারীর সাথে জীবন কাটিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন রবিশঙ্কর, সমরেশ বসু, সলিল চৌধুরীর মত সর্ব্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষেরা।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই তথাকথিত hegemonic toxic masculinity নিয়ে আমাদের বৌরা একটা আক্রমনাত্মক আলোচনা শুরু করার জন্যে মুখিয়ে ছিল, কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভাল যে তার আগেই নীচ থেকে একজন এসে বললো স্যার খেতে আসুন, ডিনার রেডি।



তৃতীয় এবং শেষ দিন – ১৪/১২/২০২৩
১) রাজবাড়ী ট্যুর
আজ আমাদের এখানে শেষ দিন।
পল্লব আজ সকালে আমাদের জন্যে কাশিমবাজারের রাজবাড়ীর একটা ট্যুরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ব্রেকফাস্টের পরে এক মহিলা আমাদের নিয়ে পুরো রাজবাড়ী ঘুরিয়ে দেখালেন, তার সাথে তিনি কাশিমপুরের রাজপরিবারের এবং রাজবাড়ীর ইতিহাস নিয়ে ও অনেক তথ্য জানালেন আমাদের।
আমরা জানলাম ১৭৪০ খৃস্টাব্দে পেশায় ব্যবসায়ী দীনবন্ধু রায় এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করেন। পরে ব্রিটিশ সরকার এই জমিদার পরিবারকে তাদের প্রজাকল্যাণ, ধর্ম্মনিরপেক্ষতা আর সুশাসনের পুরস্কার হিসেবে রাজা উপাধি দেন। ১৯৯০ এর দশকে পরিবারের উত্তরাধিকারীরা বাড়ির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বাড়ির কিছুটা অংশ নিয়ে অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে পরিবারেরই উদ্যোগে ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য চালু হয়েছে কাশিমবাজার রাজবাড়ী গেস্ট হাউস।
বিশাল জায়গা জুড়ে রাজবাড়ী। প্রথমে আমরা গেলাম বাড়ীর বাইরে চারিদিক টা দেখতে। প্রাসাদের সামনে সুন্দর সবুজ লন আছে, কিন্তু বাড়ীর পিছনে সেই তুলনায় বেশ অযত্নের ছাপ। একটা পুকুর পাশে বাঁধানো ঘাট, কিন্তু জল ময়লা, ব্যবহার করা হয় বলে মনে হলোনা। চারিদিকে ছাতিম, চাঁপা, এবং আরও অনেক বড় বড় গাছ। একটা সিমেন্টের টেনিস কোর্ট ও দেখলাম হইয়তো বহুদিন আগে সাহেবসুবোরা সেখানে খেলতেন, কিন্তু এখন আর কেউ খেলেনা, কোর্টময় ধূলো আর চারিদিকে শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। রাজবাড়ীকে ফাইভ স্টার ডি লুক্স হোটেল করতে গেলে পল্লবদের এখনো অনেক টাকা ঢালতে হবে।
বাড়ীর অন্দরমহলটা কিন্তু সুন্দর, পরিস্কার, সাজানো গোছানো। বৈভবের চিহ্ন চারিদিকে। এক তলার সুদৃশ্য হলঘরে ঝকঝকে পরিস্কার মার্বেলের মেঝে। চারিপাশের দেয়ালে সাজানো নানা মূল্যবান কাঁচের, রুপোর, হাতির দাঁতের তৈরী ঘর সাজাবার সামগ্রী, আর ফ্রেমে বাঁধানো অনেক পুরনো পারিবারিক ছবি। হলঘরে বসার জন্যে দামী এবং আরামদায়ক সোফা, আর মাথার ওপরে বিশাল ঝাড়লন্ঠন। একটা প্রাচীন পাল্কীও রাখা আছে দেখলাম এক জায়গায়, কবে সেটা শেষ ব্যবহার করা হয়েছিল, এবং কি উপলক্ষ্যে, কে জানে?
রাধা গোবিন্দ মন্দির, নাটমন্দির, ভোগের ঘর, দালান ও গর্ভগৃহ দেখে আমরা এগোলাম চন্ডীমণ্ডপের দিকে। এই চন্ডীমণ্ডপেই খুব ধূমধাম করে দূর্গা পূজো হয়, কলকাতা থেকে রায় পরিবারের সবাই আসেন। দূর্গা দালানে অনেক গান বাজনা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
আমাদের রাজবাড়ীর ট্যুর শেষ হলো বেলা দশটা নাগাদ।
সন্ধ্যায় আমাদের ফেরার ট্রেণ, দিনের অনেকটাই বাকি আছে, দুটো গাড়ীও আছে, সাথে, তাই কোথাও ঘুরে এলে কেমন হয়?
মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি দেখার মত অনেক ঐতিহাসিক জায়গা আছে, রয়েছে প্রচুর মন্দির, যার অধিকাংশই বেশ কয়েক শতাব্দী পুরনো। কাশিমবাজারে মোগলদের আমলে ব্রিটিশ আর ডাচরা এখানে নদীর ধারে কুঠি (warehouse) বানিয়ে থাকতো, এখানে তাদের কবরখানা দেখতে অনেকে আসে। । বহু প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্রিটিশ এবং ডাচ ব্যক্তিত্বের শেষ শয়নভূমি এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই।
তাছাড়া আছে ১৭৫০ ক্রিস্টাব্দ নাগাদ স্থাপিত নাটোরের রানী ভবানীর টেরাকোটার মন্দিরগুলি। কিরিটেশ্বড়ী কালী মন্দির, যা কালী পিঠগুলির মধ্যে অন্যতম। খোশবাগে আছে সিরাজউদ্দৌলা এবং তার পরিবারের কবরগুলি।
সময় থাকলে পলাশীতেও হয়তো যাওয়া যেতো্ কিন্তু শুনলাম সেখানে ধূ ধূ করছে ফাঁকা মাঠ, তার মধ্যে একটা জায়গায় লাঠির ওপরে একটা বোর্ড টাঙানো আছে, তাতে লেখা “এই স্থানে ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর যুদ্ধ হইয়াছিল।”
সেই বোর্ড দেখার জন্যে দেড় ঘণ্টা গাড়ী চালিয়ে যাবার কোন মানে হয়না।
আমাদের হাতে সময় নেই তাই এত সব জায়গা দেখে আসা সম্ভব হবেনা। এই বয়সে এত ছোটাছুটিও করা মুস্কিল।
অমিতাভ বললো গাড়ী নিয়ে গঙ্গার ব্রীজ পেরিয়ে আজিমগঞ্জ যাওয়া যেতে পারে, লাঞ্চের মধ্যে ফিরে আসা যাবে। সেখানে নাকি বড়াকোঠি বলে ভাগীরথীর তীরে একটা বড় নিরামিষ হোটেল আছে, খুব দামী, প্রতি রাতে এক ঘরের ভাড়া প্রায় ৩০,০০০ টাকা, সেখানে শুধু খুব বড়লোক মাড়োয়ারীরাই গিয়ে থাকে।
তারপরে আজিমগঞ্জ থেকে ফিরে দুপুরে লাঞ্চের পরে একটু হোটেলে বসে প্যাকিং সেরে বিল মিটিয়ে বিকেলের দিকে স্টেশন চলে যাবো।




২) আজিমগঞ্জ
দু’টো গাড়ী নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আজিমগঞ্জের দিকে। সামনের গাড়ীতে ড্রাইভারের পাশে সামনে আমি, পিছনে দীপঙ্কর প্রবীর আর অমিতাভ, পিছনের গাড়ীতে মেয়েরা।
মুর্শিদাবাদ আর বহরমপুর পাশাপাশি শহর। বহরমপুর এখন মুর্শিদাবাদ জেলার প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার, প্রধানতঃ কাঁসা আর পেতলের বাসনের জন্যে জায়গাটা বিখ্যাত, তা ছাড়া শোলা, সিল্ক, হাতির দাঁত ইত্যাদি নিয়েও এখানে অনেক কুটির শিল্পের দোকান দেখা যায়, রাস্তায় বেশ ভীড়, দুই পাশে প্রচুর দোকানপাট। তাছাড়া অবশ্যই আছে এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি ছানাবড়ার দোকান।
একটু পরেই এসে গেল ভাগীরথীর ওপরে ব্রীজ। এবং তার পরেই দীপঙ্করের ফোন বেজে উঠলো, ক্রিং ক্রিং!
বাইরে বেড়াতে এলেও দীপঙ্কর তার অফিসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, মাঝে মাঝেই তার কাছে নানা কাজের ফোন আসে, এবং সে তার কর্ম্মচারীদের নানা রকম নির্দেশ দিয়ে আবার আমাদের আড্ডায় ফিরে আসে।
আজ তাকে ফোন করছে তার সেক্রেটারী। আমরা শুনেছি মেয়েটি খুব কাজের, দীপঙ্কর তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অফিসের বাইরে থাকলে তার সাথে ফোনে কথা বলতে দীপঙ্করের বেশ ভালোই লাগে।
যাই হোক, ওদিক থেকে মেয়েটি কি বলছে শোনা না গেলেও দীপঙ্করের কথা শুনে বুঝলাম যে হায়দ্রাবাদে কিছুদিন পরে তাকে একটা কোম্পানীর বোর্ড মিটিং এ যেতে হবে, তাঁর সাথে কলকাতা থেকে যাবেন আর এক ভদ্রলোক। মিটিংটা বিকেলে হবার কথা কিন্তু দীপঙ্করের অন্য একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় সে মিটিংটা পরের দিন সকালে করতে চায়। কিন্তু এই বদল করাটা সোজা কাজ নয়।
প্রথমতঃ সেই কোম্পানী কে রাজী করাতে হবে, তারপর তারা রাজী হলে ওই অন্য ভদ্রলোক কে জানাতে হবে, তিনি রাজী হলে দু’জনের এয়ার টিকিট আর একটা রাত থাকার জন্যে হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে। ইত্যাদি।
এক বার ভাল করে বুঝিয়ে বললে এই সেক্রেটারী মেয়েটি এক এক করে গুছিয়ে এই সমস্ত কাজ করে ফেলতে পারে। কিন্তু দীপঙ্কর ফোনে তাকে কাজগুলো দিচ্ছে এক এক করে, মেয়েটি একটা কাজ শেষ করে ফোনে জানাচ্ছে, দীপঙ্কর তখন তাকে ফোনে পরের কাজটা বিশদ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ক্রিং ক্রিং… “কি কোম্পানী রাজী হলো? তাহলে এবার মিস্টার ভটচাজ্জি কে ফোন করে জানাও”।
ক্রিং ক্রিং…“মিস্টার ভটচাজ্জি রাজী? বেশ! এবার তুমি আমাদের বিজনেস ক্লাসে দুটো রিটার্ণ এয়ার টিকিটের বন্দোবস্ত করে ফেলো! পরের দিন সন্ধ্যায় ফিরবো! ”
ক্রিং ক্রিং…
এই ভাবে পাঁচ দশ মিনিট অন্তর অন্তর দীপঙ্করের ফোন আসতেই লাগলো। এক দিকের বাক্যালাপ শুনে বেশ সময়টা কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমরা আজিমগঞ্জ রেল স্টেশন পৌঁছে গেছি। স্টেশনের পরে একটা সরু রাস্তা তাতে বিস্তর যানবাহন চলাচল করছে। আমাদের বড় Innova SUV কোনমতে সেই রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে।
কিন্তু কোথায় বড়াকোঠি?
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জায়গাটা পাওয়া গেল। বাইরে থেকে দেখে বড়াকোঠির মাহাত্ম্য টের পাওয়া মুস্কিল। সাধারণ একাট বাড়ী, সামনে কোন বড় গেট নেই, বাগান নেই, শুধু একটা ছোট খোলা দরজা। গাড়ী পার্ক করার জন্যে একটা খোলা মাঠ সামনে, সেখানে গাড়ি রেখে আমরা সেই বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হোটেলে কোন ঘর খালি নেই, আমাদের ভিতরে ঢুকে দেখার আবেদন মঞ্জুর হলোনা। বড়াকোঠি আসা আমাদের বিফল ই হলো।
অবশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবেনা। বড়াকোঠি একেবারে নদীর ধারে, সেখানে অতিথিদের সকালের ব্রেকফাস্ট আর বিকেলের চা খাবার জন্যে অনেক টেবিল আর চেয়ার সাজানো আছে, সেখানে এই দুপুরে কেউ নেই, আমরা গিয়ে সেখান থেকে নদীর শোভা দেখলাম বসে বসে।
সেই গভীর স্রোতহীন শান্ত নদীর নীরবে বয়ে যাওয়া বড় সুন্দর দৃশ্য। নদীর জলে আকাশের ছায়া পড়েছে, দুই পারের ঘাটে অনেক মানুষ জনের জটলা, কিছু দোকান পাট, আর নদী পারাপার করছে অনেক নৌকা। কেউ মাল বোঝাই, কিছু নৌকায় অনেক মানুষ এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে।
যেন আবহমান কাল থেকে বয়ে যাচ্ছে এই নদী। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সে। আজিমগঞ্জে বড়াকোঠির পাশে ভাগীরথীর পারে বসে নদীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শহরের দিকে তাকিয়ে আমার মন চলে গেল সেই সব পুরনো দিনে।
আমি মনে মনে চলে গেলাম সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদাবাদে। মোগল সাম্রাজ্য ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে, মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার স্বাধীন নবাব, ইংরেজরা ক্রমশঃ মোগলদের সরিয়ে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করছে। ইংরেজদের কাছে বেঙ্গল প্রভিন্স হলো সোনার দেশ। মুর্শিদাবাদ ও তার নিকটবর্ত্তী শহর ও গঞ্জ থেকে তারা কিনে আনে আফিম, তামাক, নীল, সোরা, পাট, তুলো, রেশম থেকে খাদ্যশস্য মশলা ও নানাবিধ জিনিষ। সেই মালপত্র রাখা হয় নদীতীরবর্ত্তী কাশিমবাজার কুঠির গুদামঘরে।
ওদিকে হুগলী নদীর কাছে তিনটি গ্রাম ইজারা নিয়ে ইংরেজরা গড়ে তুলেছে এক নতুন শহর, তার নাম ক্যালকাটা। উদীয়মান সেই শহরে এসে বসতি স্থাপন করছে নানা জাতির ভাগ্যান্বেষী মানুষজন।
কাশিমবাজার এবং দেশের অন্যান্য শহর থেকে এই সব মজুত মাল যথেষ্ট পরিমাণ হলে তাদের ছোট বড় নানা নৌকায় নিয়ে যাওয়া হয় সেই নতুন শহর ক্যালকাটায়। তারপরে সেই সব মাল বোঝাই করা হয় জাহাজঘাটায় নোঙ্গর করে থাকা বিশাল বিশাল বাণিজ্যপোতে। তারা পাল তুলে রওনা হয়ে যায় সাত সমুদ্র পেরিয়ে ইংল্যান্ডের দিকে।
একসময় যিনি ছিলেন স্রেফ দেওয়ান কারতলব খান, সেই তিনিই এখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা সুবার দন্ড মুন্ডের কর্তা নবাব মুর্শিদকুলী খান। তাঁর কর্ম্মক্ষেত্র ছিল ছোট এক জনপদ মুকসুদাবাদ, এক পীরের নামে। সেই শহর এখন সুবা বাংলার রাজধানী – মুর্শিদাবাদ, তাঁর নামাঙ্কিত।
মুর্শিদকুলী খানের স্বপ্ন দিয়ে সাজানো এই শহর। নদীর পাড় দিয়ে পরের পর কেয়ারী করা ফুলের বাগিচা। ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলে আছে নানা জাতের জলযা্ন, ডিঙ্গি নৌকা থেকে বড় বড় বর্ণময় ময়ূরপঙ্খী, মকরমুখী সাগরদাঁড়ি বজরা । শহর জুড়ে অসংখ্য অট্টালিকা, মসজিদ, সুউচ্চ মিনার, গম্বুজ, আছে ত্রিশূল চিহ্নিত শিব মন্দিরও। আলোয় আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে।
গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা, কাবেরী যমুনা ওই/
বহিয়া চলেছে আগের মত, কইরে আগের মানুষ কই?/
আগের মানুষ নেই, সেই আগের বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী আলো ঝলমল মুর্শিদাবাদও কি আর আছে?
আজ সে ধূলিধূসরিত এক মলিন শহর, তার সারা গায়ে আজ অবক্ষয় আর দারিদ্র্যের চিহ্ন।




৩) ফেরা
আজমগঞ্জ থেকে কাশিমবাজারে ফিরে লাঞ্চ সেরে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে স্টেশনের দিকে এগোলাম। লালবাগের ব্যস্ত রাস্তায় তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে।
বিদায়, মুর্শিদাবাদ!

-
কোলাঘাটে রূপনারায়ণের তীরে শীতের দুপুর – জানুয়ারী, ২০২১

ষাটের দশকে আমাদের ছোটবেলায় শঙ্করীপ্রসাদ বসু ক্রিকেট খেলার বর্ণময় ইতিহাস নিয়ে “ইডেনে শীতের দুপুর” নামে একটা বই লিখেছিলেন। তোমাদের মধ্যে যারা আমার সমবয়সী এবং ক্রিকেট নিয়ে তখন যাদের উৎসাহ ছিল তাদের সেই বইটির কথা মনে আছে নিশ্চয়। এই লেখাটির নাম সেই বই থেকে ধার করা।
কুয়েতের বন্ধুদের সাথে সেই আশির দশক থেকে বন্ধত্ব। সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত এর ভেতর দিয়ে আমদের একসাথে পথচলা। এখন সবাই কাজ থেকে অবসর নিয়ে কুয়েত থেকে ফিরে এসেছি। আমাদের মধ্যে যারা কলকাতায় এসে থিতু হয়েছি তারা মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে আড্ডা জমাই। বা একসাথে কলকাতার কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে চলে যাই।
এই লেখাটা আমাদের বন্ধুদের কোলাঘাট বেড়ানো নিয়ে।
——————————————–


কাজ থেকে অবসর নেবার পরে এখন আমাদের জীবন বেশ আনন্দের, রোজই ছুটি, যখন যেখানে খুসী চলে যাই, উইকএন্ডের সন্ধ্যায় আবার কাল সকালে কাজে যেতে হবে বলে মন খারাপ হয়না। এখন সপ্তাহের প্রতিদিনই উইকএন্ড। কিন্তু কোভিডের অতিমারীতে ২০২০ সালটা প্রায় পুরোটাই বাড়ীতে বন্দী হয়ে কেটেছে।
২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে – তখন কোভিডের প্রকোপ কিছুটা কমেছে, ভ্যাক্সিন আসার কথা শোনা যাচ্ছে – আমরা কুয়েতের বন্ধুরা দুচ্ছাই আর পারা যাচ্ছেনা বলে দু’দিনের জন্যে কলকাতা থেকে বাস ভাড়া করে কোলাঘাট ঘুরে এলাম।
কলকাতা থেকে কোলাঘাট ঘন্টা দুয়েকের পথ, বেশ চওড়া পরিস্কার রাস্তা। সকাল সকাল বেরিয়ে বেলা বারোটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের হোটেলের নাম সোনার বাংলা। রূপনারায়ণ নদীর ধারে। সুন্দর বাগান, সেখানে এই জানুয়ারীর শীতে ফুলের মেলা। আর সোনালী রোদ। আমাদের সবার গায়ে গরম জামা, মনের ভিতরে উষ্ণতা ।


বেলা একটা নাগাদ পোঁছে ইলিশ মাছের নানা পদ দিয়ে তৈরী উপাদেয় লাঞ্চ সেরে বাগানে চেয়ার টেনে গোল হয়ে বসে আমাদের আড্ডা শুরু হলো।
সারা দুপুর আর সন্ধ্যা পর্য্যন্ত চললো আমাদের অন্তহীন আড্ডা। অনেক দিন পরে একসাথে হয়েছি আমরা – তাই আমাদের গল্প আর ফুরোতে চায়না। এক এক জন এক একটা গল্প বলে আর বাকি আমরা সবাই হো হো করে হাসিতে লুটিয়ে পড়ি।
গল্পে গল্পে কি করে যে সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারলামনা। রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের টেবিলে চা দিয়ে গেল। ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামলো। নদীর ওপারে সুর্য্যাস্ত হলো, কুয়াশার স্তর নেমে এলো নদীর জলের ওপর। বেশ মায়াবী দৃশ্য।
আমাদের আড্ডায় অনেক মজার মজার গল্প বললো সবাই। সব গল্পই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা।
সেদিনের কিছু গল্প এই সাথে।


১ – সুভদ্রার গল্প – পুলি পিঠে
কুয়েতে সুভদ্রা ALICO তে লাইফ ইন্সুরেন্স বিক্রী করতো আর তার খদ্দেরদের কাছে যাবার জন্যে সে তার সাধের বিশাল Mitsubishi Pajero (SUV) গাড়ী চড়ে সারা কুয়েত শহর চষে বেড়াতো।
তার গাড়ীর গ্যারেজ ছিলো Sharq এ Fisheries বিল্ডিং এর উল্টোদিকে। গাড়ীতে কোন গন্ডগোল হলে সে নিজেই সেখানে গাড়ী নিয়ে চলে যেতো। সেই গ্যারেজের মেকানিকরা সবাই ভারতীয়। তাদের যে লীডার তার নাম মওলা, সে অন্ধ্রের লোক। ভাঙা ভাঙা হিন্দী তে কথা বলে।
তো একবার সুভদ্রার গাড়ীর ফ্যান বেল্ট ছিঁড়ে খুলে গেছে। আমি সুভদ্রা কে বললাম পুলি থেকে বেল্টটা খুলে গেছে, মওলা কে বললেই ও বুঝে যাবে।
সুভদ্রা ফ্যান বেল্ট কথাটা ভুলে গেছে, তার শুধু মনে আছে পুলি।
সে গ্যারেজে গিয়ে মওলা কে বললো “দেখো তো পিঠে মে কুছ হুয়া…”
পিঠে?
মওলা তো অবাক!
“পিঠে কেয়া হ্যায় ম্যাডাম?”
তারপর গাড়ীর বনেট খুলে অবশ্য মওলা বুঝে যায় প্রবলেমটা কি।
গল্পটা শুনে সিদ্ধার্থ বললো তুমি ওকে বললেনা কেন “পাটিসাপটা কো জরা দেখনা, উসমে কুছ গড়বড় হুয়া হোগা…”

২ – সিদ্ধার্থর গল্প
আমার বন্ধু সিদ্ধার্থর মেজমাসীর একটা অদ্ভুত প্রবণতা ছিল, luck ও বলা যায়, তাঁর সাথে celebrity দের পথে ঘাটে দেখা হয়ে যেত। এবং তাদের সাথে দেখা হলেই চেনা নেই শোনা নেই তবু মেজমাসী খুব smartly তাদের সাথে গিয়ে আলাপ জুড়ে দিতে পারতেন। এবং আলাপ করে বাড়ি এসেই তিনি তাঁর বোনদের সবাই কে ফোন করে বলতেন কার সাথে দেখা হল, তিনি কাকে কি বললেন, তারা কি বললো ইত্যাদি।
একবার নিউ মার্কেটে মাধবী মুখার্জ্জীর সাথে মেজমাসীর দেখা। মেজমাসী বললেন এ কী মাধবী, তোমার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ নাকি? মাধবী একটু সংকোচের সাথে বললেন আমি তো মাসীমা আপনাকে ঠিক…
মেজমাসী বললেন আমায় চিনতে পারছোনা তো? কি করে চিনবে? তুমি তো আমায় কোনদিন দ্যাখোইনি।
এই নিয়ে মাসীমা মানে সিদ্ধার্থর মা’র একটা inferiority complex ছিল, কেননা তাঁর সাথে কোনদিন কোন celebrity র দেখা হয়না।
তো একবার মাসীমা ছেলের কাছে কুয়েতে বেড়াতে এসেছেন। মাস তিনেক থাকার পরে সিদ্ধার্থ তাঁকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। দুবাই তে Stop over, সেখানে সিদ্ধার্থ দ্যাখে মৃণাল সেন লাউঞ্জে একটু দূরে বসে আছেন। মাসীমাও দেখেছেন।
সিদ্ধার্থ মাসীমাকে বলল মা আমি একটু বাথরুমে যাচ্ছি, তুমি কিন্তু একদম ওনার সাথে গিয়ে কথা বলবেনা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে সিদ্ধার্থ দ্যাখে যা ভয় পেয়েছিল তাই, মাসীমা মৃণাল বাবুর পাশে বসে দিব্বি আলাপ করে যাচ্ছেন। সিদ্ধার্থ কাছে আসতে মাসীমা বললেন এই হল আমার ছেলে, কুয়েতে থাকে। মৃণাল বাবু বেশ গপ্পে লোক, তিনি বললেন আমিও কুয়েতে গিয়েছিলাম একবার বেশ কিছুদিন আগে…
দমদম থেকে যাদবপুরে বাড়িতে ঢুকেই মাসীমার ফোন মেজমাসীকে।
মেজদি, জানিস আজ কার সাথে দেখা হলো?
ঋত্বিক ঘটক!

৩ – টিঙ্কুর গল্প
টিঙ্কু আর দেবাশীষ কলকাতায় ফিরে আসার পর, তাদের ড্রাইভার সুভাষ ওদের প্রায় বাড়ীর লোক হয়ে গেছে। গাড়ী চালানো ছাড়া সে ওদের বাজার দোকান ইত্যাদি অনেক কাজ হাসিমুখে করে দেয়। সে একাধারে বিশ্বাসী আর করিতকর্ম্মা ছেলে।
তো একদিন টিঙ্কু সুভাষ কে বললো, “আমার জন্যে বারোটা বারোটা করে দুই গোছা চব্বিশটা রজনীগন্ধা নিয়ে আসিস তো। কাটতে হবেনা, আমি কেটে নেবো।”
কিছুক্ষণ পরে সুভাষ রজনীগন্ধা নিয়ে এসে হাজির। টিঙ্কু বলল, “নিয়ে এসেছিস, ঠিক আছে ফ্রিজে রেখে দে।”
বিকেলে টিঙ্কু ফ্রিজ খুলে কোথাও ফুল না দেখে সুভাষ কে বললো, “কি রে রজনীগন্ধা কোথায় রাখলি? ফ্রিজে তো দেখছিনা?”
“কেন, ওখানেই তো আছে”, বলে সুভাষ দুই তাড়া রজনীগন্ধা পান মসালার প্যাকেট নিয়ে এসে টিঙ্কু কে দিলো!
টিঙ্কুর তো তাই দেখে চক্ষু চড়কগাছ!
টিঙ্কুর বকুনী খেয়ে সুভাষ বলেছিল, “তাই দোকানের লোকটা বলছিল এগুলো তো এক প্যাকেটে দশটা করে থাকে, বারোটা তো হবেনা, দুটো আলাদা নিয়ে যান!”
সত্যি পান মসালার নাম রজনীগন্ধা হলে সুভাষ কি করবে?
কিন্তু টিঙ্কুরই বা কি দোষ?

৪) কোলাঘাট থেকে ফেরার পথে কোভিডের টেস্ট
পরের দিন কোলাঘাট থেকে কলকাতা ফেরার পথে এক জায়গায় গাড়ী দাঁড় করিয়ে রাস্তার পাশে একটা হোটেলে আমরা লাঞ্চ খেতে ঢুকলাম। প্রসূণ বললো, “তোমরা যাও আমি একটু টয়লেট হয়ে আসছি।”
একটু পরে ফিরে প্রসূণ ফিরে এলো, তার মুখের ওপর একটা রুমাল। সে বললো “আমার কোভিড হয়নি। ”
আমরা বললাম, “কি করে জানলে?”
প্রসূণ বললো “বাথরুমে একটা কোভিড টেস্ট দিয়ে এলাম। সব গন্ধই নাকে পেয়েছি। নিশ্চিন্ত।“



-
বিজয়পদ সর্দ্দারের গ্রামের বাড়ীতে একদিন

১ – ওরা থাকে ওধারে
জয়পদ আর বিজয়পদ এই দু’জন যমজ ভাই ছিল identical twins – দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিং এর কাছে কোন এক অখ্যাত প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আমাদের পরিবারে কাজের লোক হিসেবে যখন তারা আসে তখন তাদের অল্প বয়েস। দু’জনে একেবারে এক রকম দেখতে, দু’জনেরি গায়ের রং কুচকুচে কালো, কথাবার্ত্তাও দু’জনে গ্রামের ভাষায় একই ভাবে বলে। দু’জনেই স্বাস্থ্যবান আর কর্মঠ, বাড়ীর কাজে তারা দু’জন – প্রথমে বিজয় ও সে কাজ ছেড়ে দেবার পরে জয় – বহাল হয়ে গেল সহজেই। ওরা আমারই বয়সী ছিল, হয়তো আমার থেকে সামান্য বড়োও হতে পারে।
আমাদের বাড়ীতে ছোটবেলা থেকেই সংসারে ঠিকে এবং দিন রাতের লোকেদের কাজ করতে দেখেছি। আমরা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করে কত কিছু জানবো শিখবো, আর জয় বিজয় আমাদের সমবয়সী হলেও ওরা বাড়ীতে ফাইফরমাস খাটবে, আমাদের সাথে ওদের এই পার্থক্য, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আমাদের চোখে পড়েনি।
গ্রাম আর শহর, শিক্ষিত আর অশিক্ষিত, ভদ্রলোক আর অন্ত্যজ – আমাদের সমাজের মধ্যে এই যে একটা পরিস্কার শ্রেণীবিভাজনরেখা রয়েছে, সমাজের নিয়ম হিসেবেই আমরা তা মেনে নিয়েছি। হয়তো ওই প্রান্তিক খেটে খাওয়া সমাজের নীচের তলার মানুষেরাও সেই নিয়ম মেনে নিয়েছিল।
এটা এখন ভাবলে বেশ খারাপ লাগে।
তবে এটাও ঠিক যে ছোটবেলায় আমাদের ভাই বোনদের মনে ওই কাজের লোকদের প্রতি কোন নাক উঁচু মনোভাব ছিলনা। আমাদের বাড়ীর পরিবেশে কাজের লোকেরা থাকতো বাড়ীর লোকের মতোই। আর যেহেতু ওই দুই ভাইয়ের চমৎকার হাসিখুসী স্বভাব ছিল তাই অল্পদিনের মধ্যেই ওরা আমাদের বাড়ীর লোকের মত হয়ে যায়।
ইদানীং আমাদের দেশে খুব ধীরে হলেও ক্রমশঃ সমাজের নীচের স্তরের প্রান্তিক মানুষদের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর প্রযুক্তি পৌঁছে যাচ্ছে। এখন দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে পাকা বাড়ী, শৌচালয়, জল বিদ্যুৎ ইন্টারনেট মোবাইল ফোন ইত্যাদি সবই সহজলভ্য। একদা পিছিয়ে পড়া গ্রামের দলিত আদিবাসী লোকেরাও তাদের জীবনকে একটু একটু করে নতুন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাবার সু্যোগ পাচ্ছে।
সম্প্রতি বিজয়ের গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে তার পরিবারের সাথে একটা দিন কাটাবার সুযোগ হয়েছিল। সেইদিন বিজয় কে দেখে দেশের সেই সামাজিক পরিবর্ত্তনের একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। যা ছিল একসাথে কৌতূহলোদ্দীপক এবং আনন্দদায়ক।
এই লেখাটা সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে।


২ মান্টুদা, মুখ থেইকে মাক্সোটা খুইলে ফেলো
জয়পদ আর বিজয়পদ দুই ভাই আমাদের বাড়ীর কাজ ছেড়ে দেবার পর ওদের সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিলনা। তবে ছোটমা অনেক চেষ্টা করে নানা জায়গায় তদবির করে বিজয় কে স্টেট ব্যাঙ্ক আর জয় কে FCI তে চাকরী করে দিয়েছিলেন। সরকারী চাকরী পেয়ে তাদের দুজনের জীবনেই অনেক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল, অনেক দিন কাজ করার পরে ভাল পেনশন ইত্যাদি পেয়ে তাদের গ্রামের জীবনযাত্রা আমূল পালটে যায়।
সেই জন্যে ছোটমা’র প্রতি দুই ভাইয়ের মনে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল, তাই আমাদের বাড়ীতে কাজের লোক না হলেও আমাদের পরিবারের সাথে এই দুই ভাইয়ের একটা যোগাযোগ থেকেই যায়। আমাদের নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে ওরা আসতো, না বলতেই নিজে থেকে নানা কাজ করে দিত। তাদের গ্রামের বাড়ী থেকে তরীতরকারী ফলমূল ইত্যাদি এনে দিতো।
তারপরে তো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে প্রধানতঃ খোকনের কাছ থেকে শুনতাম বিজয় এখন একজন সম্পন্ন গৃহস্থ, স্ত্রী ছেলে পুত্রবধূ নিয়ে বারুইপুরের কাছে এক গ্রামে তার বিরাট সংসার। তার আমন্ত্রণে ওদের গ্রামের বাড়ীতে ওরা মাঝে মাঝে যায়, আর গেলে বিজয় আর তার পরিবার তাদের নিয়ে কি করবে ভেবে পায়না, তাদের আদর যত্ন আর আতিথেয়তা পেয়ে খোকনরা আপ্লুত। ছোটমা বেশ কয়েক বার ওদের বাড়ীতে অতিথি হিসেবেও থেকে এসেছেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে লকডাউন এর প্রভাব যখন একটু কমেছে, শীত তখনো বিদায় নেয়নি, আমরা ভাই বোনেরা ভাবছি কোথাও সবাই মিলে একসাথে বেড়িয়ে আসবো, তখন খোকন একদিন বললো বিজয় বার বার বলছে ওদের বাড়ী আসতে, ওদের গ্রামটা দেখে আসবি নাকি?
আসবো তো বটেই, এরকম লোভনীয় প্রস্তাব কেউ ছাড়ে নাকি? আমরা এক কথায় রাজী। টুবলি কলকাতা এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে, সেও আমাদের সাথে যোগ দিতে চায়।
বুধবার ফেব্রুয়ারীর ষোল তারিখ যাওয়া ঠিক হলো।
কথামতো সেদিন সকাল দশটা নাগাদ একটা বড় Mahindra Scorpio SUV গাড়ী নিয়ে আমরা রওনা হলাম। পথে গড়িয়া থেকে খোকন মিঠু আর টুবলিকে তুলে নেওয়া হলো। টুবলি সল্ট লেকে ওদের বাড়ী থেকে Uber নিয়ে গড়িয়া চলে এসেছে।
গড়িয়া থেকে বাইপাস ধরে নরেন্দ্রপুর সোনারপুর ছাড়িয়ে আমরা বারুইপুরের দিকে এগোলাম। কলকাতা শহরের এই দক্ষিণ প্রান্তে বাইপাসের ধারে কত উঁচু উঁচু বাড়ী আর Housing complex ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে, দেখে অবাক হতে হয়।
বারুইপুর শহরটা বেশ বড়, শহরের প্রধান রাস্তার দুই দিকে দোকান, জমজমাট ভীড়। ছোটকাকা কাজ থেকে অবসর নেবার পরে এখানে একটা জমি কিনে বাড়ী করে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। টুবলির তাই জায়গাটা চেনা। “বিয়ের পরে কলকাতা থেকে মা বাবার কাছে আসলে ট্রেণ থেকে নেমে এই স্টেশন রোড থেকে রিক্সা নিয়ে আমি বাড়ী যেতাম”, কিছুটা স্মৃতিমেদুর হয়ে বললো সে।
বারুইপুর থেকে বিজয়দের গ্রাম আরো প্রায় মিনিট পনেরোর রাস্তা, বিজয় বলে দিয়েছিল বন্ধন ব্যাঙ্ক এর পরে একটা রাস্তা ডান দিকে গ্রামের ভিতরে চলে গেছে, সেখানে পৌঁছে ওকে একটা ফোন করতে।
শহর কলকাতা ক্রমশঃ তার থাবা বাড়াচ্ছে কলকাতার উপকণ্ঠে।
বন্ধন ব্যাঙ্ক চোখে পড়তেই বিজয়ের নির্দ্দেশ অনুযায়ী আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে তার গ্রামের সরু রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। আর ঢুকেই পল্লীগ্রামের পরিবেশ চোখে পড়লো। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, চারিদিকে প্রচুর গাছ পালা, তার মাঝে কিছু মাটির আর পাকা বাড়ী। সরু কিন্তু পাকা সিমেন্টের রাস্তা, আমাদের গাড়ীটা পুরো রাস্তা জুড়ে যাচ্ছে, উল্টো দিক থেকে কোন গাড়ী এলে কি হবে কে জানে, তার ওপরে মাঝে মাঝে রাস্তার একেবারে পাশে পুকুর, একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ীশুদ্ধ জলে।
ঝুনকু আর খোকন এখানে বেশ কয়েকবার এসেছে, তাই জায়গাটার সাথে তারা পরিচিত। তাছাড়া বিজয় তার বাড়ী থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্যে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক দিন পরে তাকে দেখলাম। বেশ রোগা হয়ে গেছে বিজয়, একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দেখলাম, খোকনের প্রশ্নের উত্তরে বলল কোমরে ব্যথা, ডাক্তার দেখিয়েছে। আমায় অনেকদিন পরে দেখছে বিজয় কিন্তু তার ব্যবহারে তা বোঝার জো নেই। আন্তরিক ভাবে সে আমার হাত ধরে আমায় তার বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেল।
“এখেনে কেউ মাক্স পরেনা মান্টুদা, মুখ থেইকে মাক্স টা খুইলে ফেলো”, বেশ ভারিক্কী চালেই আমায় বললো বিজয়।
তার কথায় একটা অধিকারবোধ আর শাসনের ভাব ছিল যেটা খুব উপভোগ করেছিলাম সেদিন। এত বছর পরে দেখা, আমি তো তার কাছে বলতে গেলে একজন অজানা অচেনা লোক। কিন্তু কত সহজে সে আমায় আত্মীয়ের মতো আপন করে নিলো একেবারে প্রথম থেকেই, তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি তার ব্যবহারে কোন জড়তা ছিলনা।


৩ – বিজয়ের গ্রাম, বাড়ী আর সংসার
আগে মাটির বাড়ীতে থাকতো বিজয়রা, এখন বিজয় তার নিজের পাকা বাড়ী বানিয়েছে, উঠোনের দেয়ালে তার বাবা আর তার নাম বেশ স্টাইল করে সিমেন্ট দিয়ে লেখা।
স্বর্গীয় ঋতুরাম সর্দ্দার – বিজয়পদ সর্দ্দার
উঠোনের এক দিকে রান্নাঘর, সেখানে একটি অল্পবয়েসী মেয়ে আমাদের দেখে লাজুক হাসলো। বিজয় আলাপ করিয়ে দিয়ে বললো, “সকাল থেকে বৌমা তোমাদের জন্যে রান্না করতি লেগেছে”। বৌটির গায়ে গায়ে ঘুরছে তার দুই ছেলেমেয়ে, বিজয়ের নাতি অঙ্কিত আর নাতনী অদ্বিতীয়া। তারাও তাদের মা’র মত বেশ চুপচাপ। বিজয়ের বৌ প্রভা বাড়ী নেই, শুনলাম সে গেছে তাদের পুকুর ঘাটে, বাড়ীর পাশেই রাস্তার ওপারে বিজয়দের নিজের পুকুর।
আমি সুভদ্রা আর টুবলি এই প্রথম বিজয়ের বাড়ী এসেছি, সে আমাদের বাড়ীটা ঘুরিয়ে দেখালো। প্রচ্ছন্ন গর্ব মেশানো বিনয়ের সাথে সে আমাদের জানালো যে তার বাড়ীতে টি ভি, এ সি, ওয়াই ফাই, ব্রড ব্যান্ড ইন্টারনেট, বেশ কিছু মোবাইল ফোন – এ সমস্ত কিছুই আছে। আর আছে আধুনিক বাথরুম সেখানে কমোডের ও ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ আমাদের শহুরে বাড়ীতে যা কিছু আছে সবই আছে তার এই গ্রামের বাড়ীতেও। দিদি আর বৌদিদের তাই কোন অসুবিধেই হবেনা এখানে।
দোতলা বাড়ী, তিনতলায় ছাত। দোতলায় দুটো শোবার ঘর, আর আছে একটা খোলা ছাদ, সেখানে পরে ঘর উঠবে হয়তো। বিজয় আর অঙ্কিত দু’জনে মিলে সেই ছাতে আমাদের বসার জন্যে কিছু চেয়ার এনে দিলো।
তিন তলার ছাতে ওঠার পথে পূজোর ঘর। সেটা ছাড়িয়ে ওপরের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রথমেই দেখলাম সারা ছাতে শুকোনোর জন্যে ছড়ানো আছে প্রচুর ধান। সন্তর্পনে সেই ধান কাটিয়ে পাঁচিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। নীচে তাকিয়ে দেখি চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে পল্লীগ্রাম তার যাবতীয় সৌন্দর্য্য নিয়ে। যতদূর চোখ যায় শুধু অবারিত সবুজ ধানক্ষেত। কচি ধানের চারার তলায় জমে আছে জল, আর রোদ পড়ে সেই জল চিকচিক করছে।
আমার শহুরে চোখে এই দৃশ্য খুব মায়াবী লাগলো, আর অবধারিত ভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে পড়ে গেল।
ওপারেতে দেখি আঁকা/ তরুছায়া মসী মাখা/ গ্রামখানি মেঘে ঢাকা/প্রভাতবেলা/
বিজয় বললো “ওই যে ক্ষেতটা দেখতিছো, ওটা সবটাই আমার। প্রায় কুড়ি বিঘা জমি।”
“কে চাষ করে, তুমি লোক রেখেছো?”
বিজয় বলল, “চাষ করার জন্যি লোক আছে, আমি নিজেও কাজে লাগি।” এই বয়সেও বিজয় খুব কর্মঠ।
আমরা ভাইবোনেরা কিছুক্ষন দোতলার ছাতে চেয়ারে বসে গল্প করলাম, বিজয় আমাদের জন্যে ডাবের জল নিয়ে এলো। তারপর খোকন আর আমি বিজয়ের সাথে গেলাম গ্রামটা একটু ঘুরে দেখতে। গ্রামের নাম চয়নী মাঝেরহাট। ঘুরে ঘুরে এঁকে বেঁকে সরু সিমেন্টের রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে পুকুর, সেখানে ঘাটে বেশ কিছু লোক গা ডুবিয়ে স্নান করছে, আর কোথাও ঘাটের সিঁড়িতে বসে কাজে ব্যস্ত কিছু মেয়ে। আমাদের মত অচেনা শহুরে মানুষদের দেখে তারা মাথায় ঘোমটা দিলো।
সত্যেন দত্তের সেই পালকীর গানের লাইনগুলো মনে এলো তাদের দেখে।
কার বহুড়ী বাসন মাজে, পুকুর ঘাটে ব্যস্ত কাজে/ হুন হুনা/
এঁটো হাতে হাতের পোঁছায়, গায়ে মাথার কাপড় গোছায়/হুন হুনা, হুনহুনা/
পথে জয়পদর বাড়ী পড়লো। জয় হলো বিজয়ের যমজ ভাই। ওরা Identical twins, কম বয়েসে ওদের অবিকল এক চেহারা ছিল। পাশাপাশি রাখলে কে যে কে চেনা প্রায় অসম্ভব ছিল। এখন অবশ্য চেহারা অনেক আলাদা হয়ে গেছে দু’জনের। বিজয় কাজ ছেড়ে দেবার পরে তার দুই ভাই জয়পদ আর চিন্তামণি আমাদের বাড়ীতে কাজ করেছে কিছুদিন।
দেখা গেল জয়পদ বাড়ী নেই, পুকুরে স্নান করতে গেছে। তো বিজয় আমাদের নিয়ে চলে গেল সেই পুকুরঘাটে। জয় আর চিন্তামণি দুজনেই আমাদের দেখে খুব খুসী। পুকুর ধারে রাস্তার ওপরেই অনেক কথা হলো তিন ভাইয়ের সাথে। মনোহরপুকুরের বাড়ীর সেই পুরনো দিনগুলো নিয়েই স্মৃতিরোমন্থন হলো। বিশেষ করে তাদের মনে আছে মেজমা আর সেজমার (জ্যেঠিমা আর আমার মা) কথা। জ্যেঠিমা সম্বন্ধে বিজয়ের সহাস্য মন্তব্য – “বড়মা খুব ভালবাসতো আমাদের, কিন্তু মাঝে মাঝে বড় গরম হই যেতো” শুনে বাকি দুই ভাইও হেসে তাদের সোৎসাহী সমর্থন জানালো।
তিন ভাই এর সাথে আমি আর খোকন ওই পুকুর পাড়ে গ্রুপ ফটো তুললাম।
তার পরে বাড়ী ফেরার পথে তার নিজের পুকুর দেখাতে নিয়ে গেল বিজয়, সেখানে বিজয়ের বৌ প্রভা তখন তার কাজ সেরে বেশ কিছু বাসন হাতে বাড়ী ফিরছে। আমাদের দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তার বৌমার মতোই শান্ত স্মিত হেসে সে নীরবে অভ্যর্থনা জানালো আমাদের।
গ্রাম দেখা শেষ করে আমরা বাড়ী ফিরলাম। ইতিমধ্যে বিজয়ের ছেলে বিশ্বজিৎ তার কাজ থেকে ফিরে এসেছে, বাড়ীর কাছেই বড় রাস্তার ওপর সে একটা বাড়ী কিনে সেটা বন্ধন ব্যাঙ্ক কে একটা দিক ভাড়া দিয়েছে, তা ছাড়াও তার একটা বিয়েবাড়ী ভাড়া আর কেটারিং এর ব্যবসা আছে, আর সেই বাড়ীর একতলায় বিল্ডিং মেটিরিয়াল এর দোকান। বেশ করিতকর্ম্মা আর উদ্যমী ছেলে বিশ্বজিৎ। এত অল্প বয়সে এতগুলো ব্যবসা করার মত মূলধন সে পেলো কোথায় এই প্রশ্ন অবশ্য করিনি। ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে সেই টাকা খাটিয়ে বাড়িয়েছে ধরে নিতে হবে, তাছাড়া বিজয়ও তার পেনশনের টাকা থেকে ছেলে কে সাহায্য করেছে নিশ্চয়।
বড় কথা হলো সে টাকাটা নষ্ট করেনি, ঠিকঠাক কাজে লাগিয়েছে।
“বড় রাস্তার পাশে জমিটা কত দিয়ে কিনলে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“কত আর? পঞ্চাশ লাখ মতো হবে! জলা জমি বলে একটু সস্তায় পেলাম!” বিশ্বজিৎএর কথায় তার বাবার মত কোন গ্রামীন টান নেই।
“আর বাড়ীটা তৈরী করতে কত পড়লো?”
খানিকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বিশ্বজিৎ বললো, “এখনো পর্য্যন্ত তো দুই কোটি টাকা মতো লেগেছে, কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি।”
বলে কি?
আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীটা তো মনে হচ্ছে বিজয়ই কিনে নিতে পারতো~
বিজয় বললো “মান্টুদা’, তোমরা এবার এসে খেতি বোসো, আর দেরী কইরোনা, খাবার ঠান্ডা হই যাবে। ”
তাকিয়ে দেখি উঠোনের মাঝখানে বেশ কিছু টেবিল চেয়ার পাতা। বিয়ের নেমন্তন্নের পার্টির মতো ধবধবে পরিস্কার সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিশ্বজিৎএর কেটারিং এর ব্যবসা আছে, ওই বন্দোবস্ত করেছে।
আমরা গিয়ে যে যার মত বসে পড়লাম, বেশ ক্ষিদেও পেয়েছিলো। আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার শিউমঙ্গলও এসে বসলো আমাদের সাথে।



৪ – বিজয় আর মার্লন ব্র্যান্ডো
সেই ভোরবেলা থেকে বিজয়ের বৌমা আমাদের জন্যে রান্না করেছে শুনেছিলাম, এবার সে নিজেই আমাদের পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বড় নম্র আর শান্ত মেয়েটি, একা একা এত কাজ সে হাসিমুখে করছে, তার মাথায় ঘোমটা, মুখে কোন কথা নেই, তাকে দেখে আমাদের খুব ভাল লাগলো। বিজয়ের কাছে শুনেছি সে বড় ঘরের মেয়ে। তার তিন ভাই এর কাছ থেকে সে তার বাবার সম্পত্তির কোন ভাগ চায়নি, তাই ভাইয়েরা ভালবেসে তাকে প্রায়ই এটা সেটা উপহার দিয়ে যায়। বিজয় তার ছেলের বিয়েতে তার বড়লোক বেয়াই এর কাছ থেকে কোন যৌতুক ও নেয়নি, তাই দুই পরিবারের মধ্যে খুব সুসম্পর্ক।
আমাদের সাথে বিজয় আর তার নাতি নাতনীও খেতে বসেছে, তারাও তাদের মা’র মতোই খুব চুপচাপ আর শান্ত। বিজয়ের বৌ প্রভা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখাশোনা করতে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে তাদের আতিথেয়তা বড় আন্তরিক।
এলাহী মেনু।
সেদ্ধ চালের ভাত, শুনলাম সেই চাল বিজয়ের নিজের ক্ষেতের। বিশ্বজিৎ এর ব্যবসায় যারা কাজ করে, সেখানে তাদের দুপুরের খাবারের চালও যায় এখান থেকে। তার পরে মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, সাথে বেগুণী, আর বাটা মাছ ভাজা। চাল এসেছে বিজয়ের ক্ষেত থেকে, বাটা মাছ বিজয়ের পুকুরের। তার পর এক এক করে গলদা চিংড়ীর মালাইকারী, রুই মাছের কালিয়া আর পাঁঠার মাংস। শেষ পাতে টোম্যাটো আর আমসত্ত্বের চাটনি আর মিষ্টি।
বিজয় কিছু বাকি রাখেনি।
প্রত্যেকটি পদ অত্যন্ত সুস্বাদু লাগলো আমাদের । আমরা প্রত্যেকেই সাধারণ ভাবে আমাদের খাবারে একটি বিশেষ স্বাদে অভ্যস্ত থাকি, আমাদের জিভে সেই স্বাদের একটা ভাল লাগা আগে থেকেই তৈরী হয়ে থাকে। সেই তৈরী স্বাদের থেকে খাবারের রসায়নে একটু এদিক ওদিক হলেই আমরা টের পাই। হয়তো ভাত ভাল সেদ্ধ হয়নি, কিংবা নুন মশলা আমাদের মনোমত নয়, আমরা টের পাবোই।
কিন্তু বিজয়ের বউমার প্রত্যেকটি রান্না একেবারে আমাদের palette এর সাথে যাকে বলে perfect fit…
সে যে একজন পাকা রাঁধুনী তা বুঝতে দেরী হলোনা, হুস হাস করে চেটে পুটে খেলাম সবাই।
খাবার পরে লম্বা গেলাসে করে ডাবের জল নিয়ে এলো বিজয়। তার নিজের জমিরই গাছ, সম্ভবতঃ। ডাব নিজেই কেটে গেলাসে ভরেছে সে।
সারা দুপুর বিজয়দের চাতালে বসে নানা গল্প হলো আমাদের।
মাসে ইলেক্ট্রিক বিল কত হয়? হাজার চারেক টাকা।
লোড শেডিং হয় কিনা। না, আজকাল আর হয়না।
মশারী ব্যবহার করতে হয় রাতে? হ্যাঁ।
চুরি চামারী ডাকাতি? গরু নাকি অনেক চুরি হয়ে গেছে এই গ্রাম থেকে। বাংলা দেশে পাচার হয়ে যায় তারা। এখন তাই সবার শুধু ছোট ছোট “হেলে” গরু। গ্রামে হিন্দুদের বাস, তাই গরুর মাংস এখানে খাওয়ার চল নেই।
রাজনীতির লোকেদের টাকা পয়সা খাওয়াতে হয়? তা তো হয় অবশ্যই। তবে টাকা দিলে তাদের দিয়ে কাজও হয়। এই তো গ্রামে পাকা রাস্তা হয়েছে।
এই সব নানা প্রসঙ্গ চলে এলো আমাদের আলোচনায়।
কথাবার্ত্তা বেশী বলেনা বিজয়, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বে আর ব্যবহারে পরিবারের ওপরে তার যে একটা অনায়াস আধিপত্য আছে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়না। এমন নয় যে তাকে সবাই ভয় পায়, বা তাকে দেখে তঠস্থ হয়ে থাকে। বরং তার মুখে সবসময়ই লেগে থাকে এক চিলতে হাসি যার থেকে তার আত্মবিশ্বাসের একটা সুস্পষ্ট আন্দাজ পাওয়া যায়।
নাতি নাতনীরা এত চুপচাপ কেন? তোমরা ওদের বেশী বকঝকা করোনা তো – সুভদ্রার এই প্রশ্নের ঊত্তরে বিজয়পদ তার সহজ হাসি হেসে বলেছিল “একটু আধটু শাসন না করলি চলবি কি করে?” এক এক জন মানুষ থাকে যাদের ব্যক্তিত্ব আশেপাশের লোকেদের কাছ থেকে ভয় আর সমীহ আদায় করে নেয়। বিজয় ডন নয়, তবু তার গ্রামের লোকজন আর সংসারের কাছের মানুষদের কাছে তার প্রভাব আর প্রতিপত্তি আমার নজর এড়ায়নি। আজকের স্বল্পবাক আত্মবিশ্বাসী বিজয় কে দেখে আমার গডফাদার ছবিতে ডন কর্লিয়নের ভূমিকায় মার্লন ব্র্যান্ডোর দুর্দ্দান্ত অভিনয়ের কথা মনে পড়ছিল। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ঘটনাবহুল জীবনের শেষে পৌঁছে এক শান্ত সৌম্য পরিতৃপ্ত ডন বসে আছেন তাঁর বাগানে, তাকিয়ে দেখছেন তাঁর নাতি নাতনীরা বাগানে ছুটোছুটি করে খেলা করছে। সে এমন এক মায়াবী দৃশ্য, অভিনয়ের গুণে যা মনে থেকে যায় অনেকদিন।


৫) বিদায়ের পালা
আলো কমে আসছে, আমাদের ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো।
বাড়ী থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে ওঠার পথে দেখি বিজয়ের বাড়ীর বাগানে শিম গাছে রাশি রাশি শিম ঝুলছে। বিজয় আমাদের জন্যে তার বাগানের গাছ থেকে বেশ কিছু শিম আর শীষ পালং তুলে আমাদের জন্যে থলিতে ভরে দিলো।
বড় রাস্তা পর্য্যন্ত আমাদের গাড়ীতে করে এলো বিজয়। তার ছেলের দোকান আর অফিস রাস্তার ওপরে, বন্ধন ব্যাঙ্কের বিরাট সাইনবোর্ড। দোতলায় বন্ধন ব্যাঙ্ক, একতলায় বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাড়া দেবার জন্যে একটা আলাদা জায়গা করা হয়েছে, আর পাশে একটা বিল্ডিং মেটিরিয়ালের শোরুম।
ব্যবসার দুটো সাইনবোর্ড টাঙানো আছে চোখে পড়লো। প্রভা বিল্ডার্স আর অদ্বিতীয়া কেটারিং। মা আর মেয়ের নামে তার কোম্পানীর নাম রেখেছে বিশ্বজিৎ।
বিশ্বজিৎ আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখালো। তার আর বিজয়ের মুখে একটা সাফল্য আর তৃপ্তির হাসি লক্ষ্য করে বেশ ভাল লাগলো।
গাড়ীতে ফিরতে ফিরতে বিজয়ের একটা কথা বার বার মনে পড়ছিল।
“মান্টুদা, আমার যা কিছু হয়েছে, সব তোমাদের আশীর্ব্বাদে”, বার বার বলেছিল সে। তার সেই কথার মধ্যে ছিল বিশুদ্ধ আন্তরিকতা। আর তার সেই কথা শুনে আমার বেশ লজ্জাই করেছিল সেদিন। সেই আশীর্ব্বাদ তো সে পেয়েছে তার ভাগ্যদেবতার কাছ থেকে।
বাকিটা তার একান্ত নিজের সুকৃতি, তার সততা, নিষ্ঠা আর কর্ম্মক্ষমতা।
বিজয়দের সাথে তাদের গ্রামে কাটানো সেই দিনটির কথা আর তাদের আতিথেয়তার কথা অনেকদিন মনে থাকবে।
ভগবান তাদের মঙ্গল করুন।





-
মুকু আর সোনুর সাথে দিল্লীতে কিছুক্ষণ

১
সোমবার, ৩০/৯/২০২৪
সুভদ্রা আর আমি দিল্লীতে এসেছি বুড়ীর কাছে দিন দশেকের জন্যে।
দিল্লীতে এলে মুকুর সাথে একবার দেখা হবেই। সাধারণতঃ ও আমায় ওদের Army Officers Club এ নিয়ে যায়, সেখানে খানাপিনা আর আড্ডা হয়। এবার আমরা সোনুকেও ডেকে নিলাম।
কথামতো সকালে সোনু চলে এলো আমায় তুলতে। দিল্লীর সব রাস্তাঘাট ওর মোটামুটি চেনা। যদিও এখন অনেকদিন গুরগাঁও তে থাকার জন্যে দিল্লী তার কাছে কিছুটা অপরিচিত, তার একটা প্রধান কারণ হলো দিল্লী শহরটাও এতগুলো বছরে অনেকটাই পালটে গেছে।
আমিও এক সময় দিল্লীতে প্রায়ই আসতাম। ন’কাকা দেরাদুন থেকে দিল্লীতে এসে প্রথমে রামকৃষ্ণপুরম ও পরে নৌরজী নগরে থাকতেন। জ্যেঠুর U18 গ্রীন পার্ক এক্সটেন্সনের বাড়ীতে ও কতবার গেছি। তখন বাসে স্কুটারে বা ভটভটিয়াতে সফদরজং হাসপাতালের পাশে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নেমে ইউসুফসরাই এর গলি দিয়ে সোজা চলে যেতাম। এখন ওই সব জায়গা একেবারেই অচেনা মনে হয়। দিল্লী আর আমার চেনা সেই আগের দিল্লী নেই।
বুড়ীরা আগে থাকতো নিজামুদ্দীন ইস্টে, এখন তারা পঞ্চশীল পার্কে চলে এসেছে। S Block এ ওদের বাড়ী। সোনুকে ঠিকানা দিয়ে রেখেছিলাম। পঞ্চশীল পার্কের ওই জায়গাটা অনেকটা খাঁচার মত,সেখানে ঢোকার আর বেরোবার জন্যে আবার তিনটে গেট। এক নম্বর গেট মাসের ১-১০ তারিখ খোলা, দুই নম্বর গেট খোলা মাসের ১১-২০ তারিখ, আর ২১ থেকে ৩০ তারিখ তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢোকা বেরোনো। সেদিন ছিল ৩০ তারিখ, তাই তিন নম্বর গেটের এই মাসে সেটাই শেষ দিন।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কমনে আসে যায়…
সোনুর আসতে একটু দেরী হলো। সে বললো আমি তো পঞ্চশীল পার্কের বি ব্লক দিয়ে ঢুকলাম, জানি সোজা রাস্তা। ওমা, কিছুদূর গিয়ে দেখি গেট বন্ধ তালা ঝুলছে। কি আর করি আবার বেরিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হলো।
খাঁচা থেকে বেরোতে গিয়ে আবার এক ঝামেলা। গেটে তালা লাগানো।
যারা বাইরে থাকে তারা এসব জানবে কি করে?সোনু বেচারা কে দোষ দেওয়া যায়না।
এই তারিখ নিয়ে একটা মজার গল্প আছে।
——————–
এক ভদ্রলোক বর্দ্ধমান থেকে ট্রেণে ব্যান্ডেল যাচ্ছেন, সেখন থেকে তিনি কর্ড লাইনের লোকাল ধরবেন, সেটা ছাড়ে বেলা দুটোয়। তাঁর হাতে ঘড়ি নেই, সহযাত্রী এক ভদ্রলোকের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি দেখছেন দুটো প্রায় বাজে, তার মানে ব্যাণ্ডেল এর ওই ট্রেণ তাঁর মিস হয়ে যাবে। মরিয়া হয়ে তিনি সেই সহযাত্রীকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার ঘড়িতে ক’টা বাজে দাদা? আমার একটা দুটোর ট্রেণ ধরতে হবে ব্যান্ডেল থেকে…”
তিনি উত্তরে জিজ্ঞেস করলেন আজ কত তারিখ?
তারিখ? ভদ্রলোক তো অবাক! সময়ের সাথে তারিখের কি সম্পর্ক?
“আজ তো কুড়ি তারিখ” তিনি বললেন।
“আমার ঘড়িটা দিনে দুই মিনিট করে ফাস্ট হয়ে যায় বুঝলেন, আমি মাসে একবার করে ঠিক করে নিই। আজ যদি কুড়ি তারিখ হয়, তার মানে আমার ঘড়ি এখন চল্লিশ মিনিট ফাস্ট, তার মানে দু’টো বাজতে এখনো অনেক দেরী। ব্যাণ্ডেলে ট্রেণ আপনি পেয়ে যাবেন চিন্তা নেই।“
তাই শুনে ভদ্রলোক একটা স্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।
—————–
যাই হোক অনেক দিন পরে সোনুর সাথে দেখা, আমরা গাড়ীতেই যেতে যেতে গল্প শুরু করে দিলাম। সম্প্রতি তনুজ আর সুদীপ্তার ছেলে হয়েছে, পাটনার দিকে আমাদের বংশের পঞ্চম প্রজন্মের প্রথম সন্তান। পাটনার দাদু জগদবন্ধুকে প্রথম প্রজন্ম ধরলে সোনাকাকা দ্বিতীয়, সোনু তৃতীয়, অনুজ হলো চতুর্থ প্রজন্ম।
আমাদের বাবা কাকারা যৌথ পরিবারে এক সাথে বড় হয়েছিলেন, আমাদের ভাই বোনেরাও মোটামুটি তাই। সেই জন্যে আমাদের মধ্যে এখনো যথেষ্ট আলাপ পরিচয় বন্ধুত্ব আর যোগাযোগ আছে, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেটা আশা করা যায়না। এই নবজাতক সোনুর নাতি যখন বড় হবে তখন আমাদের প্রজন্মের কেউ থাকবোনা, এবং আমাদের এখনকার পারিবারিক সম্পর্কগুলোও অনেকটা আলগা হয়ে আসবে। আবার নানা নতুন সম্পর্কের সূচনা হবে।
সেটাই স্বাভাবিক।
সোনু বললো সুদীপ্তার মা এখন কিছুদিন ওদের কাছে আছেন, বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্যে। বাচ্চার এখন এক মাস বয়েস। সোনু ফোনে ছবি দেখালো, খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে তাকে।
এই সব গল্প করতে করতে সোনু বেশ কয়েকবার ভুল রাস্তা ধরেছে। আর বার বার কপাল চাপড়ে বলছে, “আরে আমি কি করছি? এর পরের ডান দিকের এক্সিট টা নিতে হতো। আবার কিছুটা ঘুরতে হবে।“
সোনু আবার ওদের বাঙালী পূজোর কমিটির এক চাঁই। এবছর পূজো তে ওরা পরশুরামের “ভূষন্ডির মাঠে” নাটক করবে। বিখ্যাত মজার নাটক। তাতে সোনুর একটা ছোট রোল আছে। পুরোদমে নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে।
এ ছাড়া পূজোর নানা কাজ। বেশ কিছু ফোন এলো গাড়ীতেই। কেউ জানতে চাইছে দাদা পুলিশের ক্লিয়ারেনসটা কবে পাওয়া যাবে, কেউ বলছে দাদা নাটকের প্রপ গুলো কে দেখছে,? সোনু গাড়ী চালাতে চালাতে এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আবার ভুল করে এক জায়গায় বাঁ দিকে না গিয়ে সোজা চলে গেল। “ও হো, এটা আমি কি করলাম”, কপাল চাপড়ে বললো সোনু, “দ্যাখো বাঁ দিকে না ঢুকে সোজা ইউসুফসরাই চলে এসেছি।“
আমি জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম এটা ইয়ুসুফসরাই নাকি? সেই পুরনো দিনের ইয়ুসুফসরাই বলে চেনাই যাচ্ছেনা। ওই গলির ভিতের একটা হনুমানের মন্দির ছিল না?
যাই হোক, আবার ইউ টার্ণ।
এর মধ্যে দুই বার মুকুর ফোন এসেছে। কি রে তোদের কি হলো?
শেষ পর্য্যন্ত ইউ ১৮এ তো পৌঁছলাম। বাড়ীর পাশে অনেক নতুন বাড়ী উঠেছে, জায়গাটা আর চেনা যায়না। পাশে একটা বড় মাঠ ছিল আগে, সেখানে একটা কবরস্থান ছিল, সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে ন’কাকা দের নওরোজী নগরের বাড়ীতে যাবার একটা সর্টকাট ছিল। হাতে সময় থাকলে আমরা হেঁটে চলে যেতাম। “কমল” নামে একটা সিনেমা হল ও ছিল কাছেই। সোনু বলল সেটা আর নেই। ভেঙে শপিং মল করা হয়েছে নাকি।
মুকু বাড়ীর বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। ওর গাড়ীতেই বেরোলাম আমরা।

২
মুকু আমাদের নিয়ে গেল ওদের Dhaulakia Officers’ club এ – রাস্তাটা ওর ভালোই চেনা, কেননা সেখানে সে অরুণা বৌদি আর মনিকাকে নিয়ে প্রায়ই যায়। সাধারণতঃ ওখানে ওরা বিকেলে পুলে সাঁতার কেটে সন্ধ্যায় কিছু খেয়ে বাড়ী ফিরে আসে।
সোনুর তুলনায় দেখলাম মুকু দিল্লীর রাস্তাঘাট অনেক ভাল চেনে। বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখালো তাকে, দুই এক বার আমাদের “দ্যাখ্, একটা অন্য রাস্তা দিয়ে তোদের নিয়ে যাচ্ছি” বলে সে দুম্ করে একটা no entry দিয়ে একটা মিলিটারী টাউনশিপে ঢুকে পড়লো।
সোনু মুকুকে মাঝে মাঝে “কর্ণেল সাহাব” বলে ডাকে, সে বললো পুলিস আমাদের কর্ণেল সাহাব কে কিছু বলবেনা।
যাই হোক ওই টাউনশিপের মধ্যে দিয়ে আমরা মুকুদের ক্লাবে পিছন দিক দিয়ে একটা এন্ট্রি নিলাম। গেটে যারা পাহারা দিচ্ছিল, তারা সবাই দেখলাম মুকুকে ভালই চেনে। জায়গাটা বেশ সুন্দর, প্রচুর গাছপালা। সোমবার সকাল, ভীড় ও তেমন নেই।
আমরা একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসলাম। মুকু আমাদের দু’জনের জন্যে বীয়ার অর্ডার দিল, সোনু চাইলো জিন আর সোডা। সাথে আলু ভাজা আর ফ্রাইড চিকেন।
আমাদের গল্প শুরু হলো। নানা ধরনের গল্প। তবে প্রধানতঃ পুরনো দিনের পারিবারিক স্মৃতি।
এদিকে রেস্তোঁরার টিভি তে ক্রিকেট দেখাচ্ছে, বাংলাদেশের সাথে আমাদের টেস্ট ম্যাচ। আমি আজকাল ক্রিকেটের কোন খবর রাখিনা, কিন্তু সোনুর খুব উৎসাহ। সে নিজে কমবয়সে ভাল ক্রিকেট খেলতো – পেস বোলার ছিল। কিন্তু জোরে বল করতে গিয়ে তার মাস্ল্ এ স্ট্রেন হওয়ায় পরে সে স্পিনে চলে যায়।
“তখন তো আমাদের ভাল Physio আর কোচ ছিলনা”, দুঃখ করে বললো সে।
বাংলাদেশের সাথে এই টেস্ট ম্যাচে প্রথম তিন দিন বৃষ্টি হওয়াতে আজ চতুর্থ দিন প্রথম খেলা। মীমাংসা হবার কোন চান্স নেই, ড্র হবেই। যাই হোক, বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হবার পরে আমাদের রবীন্দ্র জাডেজা ৩০০০ রান আর তিনশোটা উইকেট পেয়েছে জানা গেল। এই সব দেখতে দেখতে মুকু তার এক CO (Commanding Officer) র কথা বললো, তিনি নাকি সব কথার মধ্যে ক্রিকেটের ভাষায় কথা বলতেন। যেমন – “That was a googly”, “I played him with a straight bat” কিংবা, “I sent him to the boundary” – এইরকম আর কি।
তো একদিন মুকু সেই CO ভদ্রলোকের সামনে বসে আছে, একজন আর্দ্দালী এসে বললো “স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন, নাম বলছেন না, কিন্তু দেখা করা খুব নাকি আর্জেন্ট।“ CO ভদ্রলোক তাকে বললেন “LBW”!
মুকু তো অবাক! তার মানে কি?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, “বুঝলেনা তো?” ওর মানে হচ্ছে “Let the bugger wait!”
আমাদের ছোটবেলায় জহর রায়ের একটা হাসির গল্প ছিল – ইডেন গার্ডেনে ম্যাচ দেখতে গিয়ে একজন দর্শক নাকি গ্যালারীতে মাল খেয়ে out হয়ে গিয়ে টলমল করে হাঁটছিলেন, জহর রায় তাঁকে LBW out বলেছিলেন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য তার মানে ছিল “Loaded belly with wine!”
মুকুর আর একটা গল্প আমার বাবা (তার সেজকাকা) কে নিয়ে। একবার,মুকু তখন খুব ছোট, ব্যাঙ্গালোরের কাছে জালাহালি নামে একটা জায়গায় জ্যেঠু পোস্টেড।
“গাড়ী করে সবাই মিলে কোথাও যাওয়া হচ্ছে, গাড়ীর সামনে সেজকাকা, পাশে বাবা গাড়ী চালাচ্ছেন। পিছনে মা আর আমরা তিন ভাই বোন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, একটা গাছে দেখলাম একটা বোর্ড টাঙানো, তাতে লেখা আছে “Block Development Officer”।আমি সেজকাকাকে জিজ্ঞেস করলাম “What does a Block Development officer do?” এক মূহুর্ত্ত দেরী না করে সেজকাকা হেসে বললেন “কি আবার? He blocks development!”
আমি হেসে বললাম “এটা তো বাবা একটা ওভারবাউন্ডারী হাঁকালেন!”
মুকু খবর দিলো ঝর্ণা দি মারা গেছেন কয়েক দিন আগে। তোমরা যারা ঝর্ণা দি’কে চেনোনা, তাদের জানাই যে তিনি মুকুদের বদুমামার স্ত্রী ছিলেন। মুকুর মামাদের মধ্যে বদুমামা আর নিতুমামা দুই ভাই সব চেয়ে ছোট ছিলেন, নিতু মামা বিয়ে করেননি, বদু মামার বিয়ে হয়েছিল আমাদের উষাপিসীর মেয়ে ঝর্ণাদি’র সাথে,ওঁদের দু’জনের কোন সন্তান ছিলনা। বামুনপাড়ায় শেষের দিকে যখন ওঁদের সাথে দেখা করতে যেতাম, তখন বদু মামা আর নিতু মামা চলে গেছেন, সেই বিশাল বাড়ীতে শুধু থাকতেন ঝর্ণা দি আর রাদুমামার স্ত্রী। দুজনেই শয্যাশায়ী। তাদের দেখা শোনা করতো বড়মামার মেয়ে কেয়া – সেও বিয়ে করেনি।
রাদুমামীমা আর ঝর্ণাদি দু’জনেই চলে যাবার ফলে এখন কেয়া একা হয়ে গেল। বড়মামার ছেলে ঢুন্ডি কাছেই থাকে। তার ছেলের বিয়েতে মুকুরা সামনের নভেম্বরে কলকাতায় আসবে, তখন ওরা সবাই মিলে বাড়ীটা নিয়ে কি করবে তার সিদ্ধান্ত নেবে।
মনোহরপুকুরের বাড়ীটার মত বামুনপাড়ার বাড়ীটাও হয়তো হাতবদল হবে, সেখানে নতুন একটা বিশাল বাড়ী তৈরী হবে। ওই বাড়ীটার সাথে আমার ও অনেক স্মৃতি জড়িত, বাড়ীর সামনে একটা গলি, তার শেষে একটা গেট আর গেট দিয়ে ঢুকে এক চিলতে জমি। সেই জমিতে আমার কম বয়সে নিতু মামা বদুমামারা কালীপূজোয় বাড়ীতে তৈরী বসন তুবড়ী জ্বালাতো, তার ফুলকি উঠে যেতো তিন তলার ছাদ ছাড়িয়ে অনেক ওপরে।
মনোহরপকুরের বাড়ীর মত ওই বাড়ীতেও এক সময় খুব হৈ হুল্লোড় হয়েছে।
সোনুদের গুরগাঁওতে সম্প্রতি হরিয়ানার Assembly election হয়ে গেল। এবং জম্মু কাশ্মীরেও পরে পরেই। সোনু রাজনীতির অনেক খবর রাখে, সে বললো হরিয়ানায় এবার কংগ্রেস জিতবে। কাশ্মীরেও NC কংগ্রেস জোটের জেতার সম্ভাবনা। বি জে পির সময়টা গত লোকসভার পর থেকে ভাল যাচ্ছেনা। মোদী ম্যাজিক ভ্যানিশ। ভালোই, মাঝে মাঝে সরকার পালটানো দরকার। কেউই অপরিহার্য্য নয়।
এর মধ্যে দ্বিতীয় রাউন্ড বিয়ার আর জিন এসে গেছে। আমাদের ছোটবেলায় বাবা কাকারা বাড়িতে কোনদিন ড্রিঙ্ক করেননি। ব্যাপার টা সেই যুগে ভদ্রসমাজে ভাল চোখে দেখা হতোনা।
সোনু গল্প করলো, একবার অনেক দিন আগে, সোনা কাকা তখন সিমলার কাছে চেল নামে একটা জায়গায় পোস্টেড। শীতকাল, প্রচন্ড ঠান্ডা, চারিদিকে বরফ পড়ছে, বাড়ীর ভিতরে সোনাকাকার কিছু সহকর্ম্মী Army officer এসেছেন, সবাই মিলে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে গা গরম করার জন্যে ব্র্যান্ডি আর হুইস্কী পান চলছে, এমন সময় হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে কাঁপা কাঁপা মেয়েলী গলায় কে যেন”সোঁনাকাঁকু,সোঁনাকাঁকু” বলে ডেকে উঠলো। ডাকটা সোনু বেশ সুন্দর নকল করে শোনালো আমাদের সেদিন, সে অভিনয়টা বেশ ভালই করে বুঝলাম।
এই ভর সন্ধ্যে বেলা যাদের নাম করতে নেই, সেই সব অশরীরী আত্মারা কেউ নাকি? “বাবার একটু ভূতের ভয় ছিল বেশ কয়েকবার ওই খনখনে কাঁপা কাঁপা গলায় ”সোঁনাকাঁকু,সোঁনাকাঁকু”ডাক শোনার পরে বাবা আমায় বললো, “সোনু যা তো দরজা টা একটু ফাঁক করে দ্যাখ্ তো কে আমায় ডাকছে?”
যাই হোক, দরজা খুলে দেখা গেল, শিখা আর শঙ্কর। কিছুদিন আগে ওদের বিয়ে হয়েছে, বোধহয় হানিমুন করতেই ওদের সিমলায় আসা। কিন্তু এই বরফ পড়ায় ওরা কিছুটা বিপদে পড়ে গেছে।
ওরা দুজন সোনাকাকীমার দেওয়া শুকনো জামাকাপড় পরে নেবার পরে সবাই মিলে গল্প করছে, সোনাকাকা সোনু কে বললেন “নতুন জামাই কে তো আমি হুইস্কি অফার করতে পারিনা, তুই বরং ওদের দু’জনকে এই Glenfiddich এর নতুন বোতলটা দিয়ে আয়। আমাদের বুড়োদের সাথে তোরা ছোটরাও একটু গা গরম করে নে।“
সোনাকাকা এরকমই দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন।
শঙ্কর নাকি কিছুতেই নতুন শ্বশুরের সামনে হুইস্কি খাবেনা, তার নাকি ভীষন লজ্জা করবে…সোনু এবার শঙ্করের সেই লজ্জিত ভঙ্গীর পার্ট টাও নিখুঁত অভিনয় করে দেখালো আমাদের।
শেষ পর্য্যন্ত সেদিন ওরা নাকি বোতলটা প্রায় শেষ করে দিয়েছিল।

৩
বেলা প্রায় দু’টো বাজে, আমাদের ড্রিঙ্ক শেষ, মুকু আমাদের পাশে একটা সাজানো গোছানো রেস্তোঁরা তে লাঞ্চে নিয়ে গেল। সেখানে তিন জনে বসে খেতে খেতে মুকু বললো “কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় আমরা সাঁতার কেটে এখানে খেতে বসেছি, এমন সময় হঠাৎ চৈতীর ছেলে সুমন – ও অন্য একটা টেবিলে কারুর সাথে খাচ্ছিল – আমাদের কাছে এসে বলল “মুকুমামা আমায় চিনতে পারছো?”
“চিনতে পারবোনা কেন? কবে দিল্লী এসেছিস? বাড়ীতে আয় একদিন!” ওকে বলেছিল মুকু। আমাদের বারেন্দ্র দের যৌথ পরিবারের লতায় পাতায় এই সব কিছুটা দূরের সম্পর্কের মধ্যেও কিরকম গভীর আত্মীয়তার টান থেকে যায়!
সুমন কাজে মাঝে মাঝে অল্প দিনের জন্যে দিল্লী আসে, এবার হঠাৎ মুকুমামার সাথে দেখা হয়ে যাওয়াতে সে খুব খুসী।
সোনু বললো “সুমনের মত ভাল ছেলে চট করে দেখা যায়না, he is a gem…”
বেশ কয়েকবছর আগে মঙ্গল আর রুণার বড় ছেলে মটরবাইক কিনে একাই সেই নতুন বাইকে চেপে ব্যাঙ্গালোর থেকে তিরুপতি যাচ্ছিল। পথে একটা ট্রাকের ধাক্কায় সে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে শেষ পর্য্যন্ত মারা যায়। মঙ্গল আর রুমা খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানিপত্ থেকে দিল্লী আসে। সোনুর ছেলে তনুজ তখন ব্যাঙ্গালোরে, তার কাছ থেকে খবর পেয়ে সুমন – তখন সে কোন এক এয়ারলাইনে কাজ করতো – Spicejet কিংবা Go Air ঠিক মনে নেই – তাদের সাথে কথা বলে দু’জন passenger কে offload করে ওদের ব্যাঙ্গালোর নিয়ে আসে, এবং শুধু তাই নয়, সেই এয়ারলাইনের গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট থেকে মঙ্গল আর রুণা কে প্রথমে accident site ও পরে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্তও করে।
প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন সম্ভাবনাময় তরুণ সন্তানের এরকম অকাল্মৃত্যু মঙ্গল আর রুণার মনে কতটা আঘাত হেনেছিল তা সহজেই কল্পনা করা যায়। পাঞ্জাবের পানিপত্ শহরে চলে যাবার পরে ওরা এমনিতেই পরিবারের বাকি সবার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল,এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পরে এখন তারা আরও অনেক বেশী চুপচাপ হয়ে গেছে।
তবে মুকু আর সোনু দু’জনেই বললো মঙ্গল আর রুণা পানিপতে এখন তাদের নিজেদের হার্ট এর হাসপাতাল খুলেছে, এবং সেই হাসপাতাল নাকি খুব ভাল চলছে সেখানে। মুকু ওকে পাটনায় নিজেদের বাড়ীতে ক্লিনিক খোলার কথা বলেছিল, কিন্তু কোন কারণে সে আর পাটনায় আসতে চায়না।
ছোটবেলায় যখন পাটনায় যেতাম, ভাইদের মধ্যে রাঙাকাকাই তখন একমাত্র পাটনায় থাকতেন, তাই কৃষ্ণা শুক্লা বন্টু মঙ্গল এদের সাথেই বাগানে খুব হুটোপাটি করেছি তখন। রাঙাকাকার তিন মেয়ের পরে এক ছেলে হওয়াতে মঙ্গল দাদু আর দিদার খুব ফেভারিট নাতি ছিল মনে পড়ে। তার আদরের শেষ ছিলনা। ভোজপুরী ভাষায় তাকে সবাই ডাকতো “মঙ্গলওয়া”।
এখন সে সবার কাছ থেকে দূরে থাকে স্বেচ্ছা নির্ব্বাসনে।
পাটনার অন্যান্য ভাই বোনেদেরও খবরাখবর নিলাম, বিশেষ করে যাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বহুদিন। বড় জ্যেঠুর ছেলে মেয়েরা – দীপা গুণু খোকন যেমন। সবাই নিজের নিজের মত ভাল আছে জেনে ভাল লাগলো। বড়জ্যেঠুর ছোট ছেলে আমাদের সব চেয়ে ছোট ভাই লাল্টুর সাথে অবশ্য সম্প্রতি আমার দেখা হয়েছে, মাঝে মাঝে সে আমায় ফোন ও করে আজকাল। লাল্টুর সাথে মনোহরপকুরের ঝুন্টু ভান্টুলী আর টুবলির বেশ ভাল যোগাযোগ আছে, এবং সে দূরে ব্যাঙ্গালোরে থাকলেও আমাদের অনেকেরই বেশ ভাল খোঁজ রাখে।
আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ তো কাউকে চিনবেনা। সম্পর্কে ভাই বোন হলেও তারা পরস্পরের কাছে অচেনা অজানাই থেকে যাবে। সেটাই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে ভাবনার কোন কারণ নেই।
খাওয়া শেষ, এবার বাড়ী ফেরার পালা।
সোনুর তুলনায় মুকু দেখলাম দিল্লীর রাস্তাঘাট অনেক ভাল চেনে। সে নানা রাস্তা আর ওভারব্রীজের ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে গেল। তার homing instinct এর প্রশংসা করতেই হয়। বহুদিন ধরে দিল্লীতে গাড়ী চালাচ্ছে সে।
প্রানী জগতে নানা জীব জন্তুর এরকম অসাধারণ homing instinct দেখা যায়। Monarch butterfly রা মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে বহুদূর গন্তব্যে পৌঁছে যায়। Olive Ridley কচ্ছপেরা প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা নির্দিষ্ট সমুদ্র উপকূলে এসে ডিম পেড়ে বালি দিয়ে ঢেকে সমুদ্রে ফিরে চলে যায়। আর সেই ডিম ফেটে যে বাচ্চারা জন্মায় তারা সমুদ্রে ফিরে যায়, কিন্তু এক বছর পরে ঠিক সময়ে নিজেদের ডিম পাড়তে আবার তারা তাদের জন্মস্থানে ফিরে আসে।
আমাদের গৃহপালিত বেড়ালদের ও নাকি নিজের জায়গায় চিনে ফিরে আসার একটা আশ্চর্য্য ক্ষমতা আছে। এই নিয়ে শিবরাম চক্রবর্ত্তির একটা বিখ্যাত গল্প আছে, যারা পড়োনি তাদের জন্যে এখানে লিখে রাখি।
————-
শিবরাম এর বাড়ীতে একটা বেড়াল আছে, তিনি সেটাকে মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে ফেলে রেখে আসেন, কিন্তু সে দুই তিন দিনের মধ্যেই আবার তার কাছে ফিরে আসে।
একবার তিনি বেড়ালটাকে একটা বস্তার মধ্যে বন্দী করে ট্রেণে করে অনেক দূরে গিয়ে একটা জায়গায় ফেলে দিয়ে আসেন। কিন্তু মুস্কিল হলো এবার তিনি নিজেই রাস্তা গুলিয়ে ফেলে আর নিজের বাড়ী ফিরতে পারছেন না। অগত্যা শেষ পর্য্যন্ত সেই বেড়াল টাকে follow করেই তিনি নিজের বাড়ী ফিরেছিলেন।
কিন্তু বেড়াল তো আর সোজা পথে বাড়ী ফেরেনা। তারা গেরস্থের বাড়ীর দেয়াল টপকায়, বাড়ীর দেয়ালে জলের পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠে, এক বাড়ীর ছাদ থেকে পাশের বাড়ীর ছাদে লাফ দিয়ে চলে যায়।
শিবরাম যখন বাড়ী ফিরলেন, তখন তাঁর জামাকাপড়ে ধুলো ময়লার কালো দাগ, হাতে কালশিরে পড়েছে, পাঞ্জাবীর হাতা ছিঁড়ে গেছে, হাঁটু ছড়ে রক্ত বেরোচ্ছে, চুল এলোমেলো, তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর মাথার ওপর দিয়ে একটা ঝড় চলে গেছে।
তাঁর প্রতিবেশীরা তো তাঁকে দেখে অবাক। এ কি চেহারা হয়েছে আপনার?
শিবরাম একটু কাষ্ঠহাসি হেসে তাদের বলেছিলেন, “আর বলবেননা, বেড়াল কে অনুসরণ করে বাড়ী ফেরা যে কি কঠিন কাজ, কি বলবো?”
—————-
মুকু সেই বেড়ালটার মতোই বেশ সাবলীল ভঙ্গী তে পঞ্চশীল পার্কে আমাদের নিয়ে এলো। আমি বললাম, “আজ কিন্তু ৩০ তারিখ, মনে রাখিস তিন নম্বর গেট।“ কুছ পরোয়া নেই ভঙ্গীতে মুকু ঠিক তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে পড়লো।
আমায় নামিয়ে ওরা দু’জন ওপরে উঠে সুভদ্রা আর বুড়ী সৌগত আর ওদের বাচ্চা দের সাথে দেখা করে এলো। সুভদ্রা বললো “তোমরা আমাদের বৌদের না নিয়ে নিজেরা গিয়ে গল্প করে আসো কেন?কি এত গল্প তোমাদের যা আমাদের বলা যায়না?”
সোনু বললো,”বৌদি, আজ আমরা যে সময়ের কথা বললাম, সেই সময়ে তো তোমরা কেউ ছিলেনা, তাই ওইসব গল্প শুনে তোমাদের ভীষণ বোরিং লাগতো।“
ভেবে দেখলে কথাটা কিন্তু ঠিকই বলেছে সোনু। সারাদিন তিন জনে মিলে কত বোরিং কথা বলে হাসাহাসি করলাম আমরা। আমাদের সাথে মঙ্গলটা থাকলে আরো ভাল হতো, ওর কাছ থেকে আরও এইরকম বেশ কিছু বোরিং গল্প শোনা যেতো।
কিন্তু তা আর হবার নয়। মঙ্গলের সাথে দেখা করতে গেলে আমাদের পানিপত্ যেতে হবে।

নালন্দা ট্রিপ, ১৯৮৯, সামনে মঙ্গল বসে , পাশে বুড়ী -
কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ

১) মুখবন্ধ
ডিসেম্বর ৭, ২০০৭।
সেই দিন কুয়েতে সালমিয়ার ভারতীয় স্কুলের অডিটোরিয়ামে বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক সমিতি (বি সি এস) এর উদ্যোগে আমরা বাদল সরকারের বিখ্যাত নাটক “এবং ইন্দ্রজিৎ” সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ করেছিলাম।
সেই বছর সমিতির সভাপতি তাপস (বসু) যখন আমায় নাটক পরিচালনার ভার দিলে্ন, তখন আমি এই নাটকটিকেই বেছে নিয়েছিলাম। তার প্রধান কারণ অবশ্যই এই যে প্রায় চল্লিশ বছর আগে (১৯৬৫) লেখা এই নাটকটি কে এখনো বাংলায় লেখা সর্ব্বকালের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক নাটকের প্রথম পাঁচটি মধ্যে একটি বলে ধরা হয়।
বাদল সরকারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি তিনি লেখেন প্রবাস জীবনে, নাইজেরিয়ায় থাকতে ১৯৬৩ সালে। আর নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৫ সালে কলকাতায়।
বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক – দুই দিক থেকেই নাটকটি নিঃসন্দেহে বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি দিকচিহ্ন হিসেবে নিজের পরিচিতি আদায় করে নিয়েছে। এই নাটকটি ইংরেজী এবং নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং সারা দেশে এটি এখনো নিয়মিত অভিনীত হয়ে থাকে। নাটকটি নিয়ে অনেক্ লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে, এবং শুনেছি কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের এম এ ক্লাসের পাঠ্যতালিকায়তেও এই নাটক টি স্থান পেয়েছে।
নাটকটি পছন্দ করার আর একটি কারণ ছিল এই যে ১৯৬৬ সালে – তখন কলেজে পড়ি এবং নাটক দেখায় তখন দারুন নেশা – কলকাতায় রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্ত অঙ্গন প্রেক্ষাগৃহে এক সন্ধ্যায় শৌভনিক গোষ্ঠীর প্রযোজনায় ওই নাটকটি দেখে আমি মুগ্ধ আর অভিভূত হয়েছিলাম, সেই ভাল লাগা আর মুগ্ধতা কুয়েতের বাঙালী বন্ধুদের মনে পৌঁছে দিতে আমার গভীর আগ্রহ ছিল।
অবশ্য মনে একটু দুশ্চিন্তাও যে ছিলনা তা বলবোনা। নাটকটি বেশ কঠিন এবং দুর্ব্বোধ্য, তাই আগে থেকে একটু তৈরী হয়ে না এলে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে নাটকটি সাধারণ দর্শকদের ভাল না লাগারই সম্ভাবনাই বেশী। সাধারণত; কুয়েতে আমরা প্রতি বছর আমাদের দর্শকদের বিনোদন হিসেবে একটি হালকা হাসির নাটকই পরিবেশন করতাম।
এই নাটকে সেরকম কোন গল্প নেই, কোন হাসি গান বা মজার দৃশ্য বা সংলাপ নেই। এখানে নেই কোন নাটকীয় সংঘাত, অথবা কোন নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স। এই নাটক হলো মধ্যবিত্ত মানুষের সাধারণ জীবনের কথা, নীরবে বয়ে চলা নিস্তরঙ্গ নদীর মত সেই জীবন, এবং তারই টুকরো টুকরো ছবি।
তবু কেন জানিনা আমাদের দর্শকদের শিল্পবোধের ওপর আমার আস্থা ছিল। আমার মনে হয়েছিল, যে নাটকটি তে নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের যে যান্ত্রিক এবং নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা গতানুগতিক দিকটা ফুটে উঠেছে, তার সাথে গড়পড়তা কুয়েতের সব বাঙালী দর্শকই কমবেশী পরিচিত। এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটিতে আমাদের সকলের জীবনের কথাই বলা হয়েছে। তাই এই নাটকের সাথে আমরা আমাদের জীবনের মিল খুঁজে পাবো।
আমি জানতাম এবং ইন্দ্রজিৎ কুয়েতের দর্শকের ভাল লাগবে, এবং শেষ পর্য্যন্ত তাই হয়েওছিল।
নাটকটি যে আমাদের দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলবে তা আমি বুঝি নাটকের মহড়ার সময়ে। একমাত্র নুপূর (রায়চৌধুরী – মাসীমা) ছাড়া এই নাটকে যারা অভিনয় করেছিল তারা সকলেই বয়সে তরুণ। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই নাটকটি যখন লেখা হয় তখন এদের কারুর জন্ম হয়নি। প্রথম দিকে চল্লিশ বছর আগে লেখা নাটকটির আজকের যুগে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমার মনে কিছুটা সংশয় ছিল তা ঠিক। কিন্তু চার মাস মহড়া দেবার সময় লক্ষ্য করলাম বয়সে তরুণ এই ছেলেমেয়েদের নাটকটির প্রতি আকর্ষন ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ওদের উৎসাহ একটা সময়ে এসে আমার উৎসাহ কেও অতিক্রম করে গেছে।
তবু সাবধানের মার নেই ভেবে আমি নাটকটি মঞ্চস্থ হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বি সি এসের website এ নাটকটির বিষয় বস্তু নিয়ে অনেক লেখালেখি ও আলোচনা করেছিলাম। যাতে সেই সব লেখা পড়ে আমাদের সমিতির সভ্যরা নাটক দেখতে আসার আগে কিছুটা মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে আসে।
ইংরেজীতে একটা কথা আছে – “Fools dare where angels fear to tread” – আমিও সেরকম কিছুটা দুঃসাহসী হয়ে কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল, কেননা আমাদের দর্শকরা নাটকটি মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেছিলেন, এবং নাটকের শেষে তাঁরা আমাদের প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

২) অমল, বিমল, কমল, ইন্দ্রজিৎ আর মানসী
নাটকটিতে মূল চরিত্র সাতটি। তাদের মধ্যে দু’জন – লেখক আর মাসীমা – হলেন রক্তমাংসের মানুষ, অর্থাৎ জীবন্ত চরিত্র। বাকি পাঁচ জন – অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ আর মানসী – এরা সবাই বাস করে লেখকের কল্পনায়। এই পাঁচ জন কাল্পনিক চরিত্র কে নিয়ে লেখক একটি নাটক লিখতে চান। এই ব্যাপারটা না জানা থাকলে নাটকের মধ্যে অনেক জায়গাতেই এই চার জনের সাথে লেখকের ব্যবহার আর সংলাপ দর্শকের কাছে দুর্ব্বোধ্য মনে হতে পারে। নাটকটি শুরু হবার আগে তাই পরিচালক হিসেবে মাইক হাতে আমি মিনিট পাঁচেক ধরে দর্শকদের নাটকটি র মূল আখ্যান আর আঙ্গিক নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলাম।
BCS Website এ বিশদে নাটক টি নিয়ে লেখা আর নাটকের আগে এই বক্তৃতাটা বেশ কাজে দিয়েছিল বলেই আমার ধারণা।
এই নাটকের প্রধান চরিত্র একজন উদীয়মান তরুণ লেখক, যিনি আধুনিক বাঙালী মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের জীবন কে উপজীব্য করে নিয়ে একটি নাটক লিখতে চান্। সেই নাটকে উঠে আসবে তাদের জীবনচক্রের নানা দিক।
এই আধুনিক নাগরিক সমাজ নিয়ে নাটকের শুরুতে লেখক দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছেন~
“ ১৯৬১ সালের আদমশুমারির হিসাবে কলকাতার বর্তমান লোকসংখ্যা ২৯,২৭,২৮৯। এর শতকরা প্রায় আড়াই ভাগ গ্র্যাজুয়েট বা আরো উচ্চশিক্ষিত। বিভিন্ন নামে এঁদের পরিচিতি। এঁরা মধ্যবিত্ত, যদিও এঁদের মধ্যে বিত্তের তারতম্য যথেষ্ট। এঁরা বুদ্ধিজীবী যদিও বুদ্ধি জীবিকা হলে অনেকেই অনাহারে মরতো। এঁরা শিক্ষিত, যদি ডিগ্রিকে শিক্ষা বলে ধরে নেওয়া চলে। এঁরা ভদ্রলোক, ছোটলোকদের থেকে নিজেদের পার্থক্যটা বোঝেন বলে। এঁরা অমল বিমল কমল। এবং ইন্দ্রজিৎ।”
অমল, বিমল, কমল, এবং ইন্দ্রজিৎ, নাটকের এই চার জন চরিত্রের সাথে দর্শকদের আলাপ হবে যখন এরা কলেজে পড়ে। এদের সাথে আছে মানসী, সে ইন্দ্রজিৎ এর প্রেমিকা।
কলেজের ক্লাসের কিছু দৃশ্যতে এরা চারজন ছাত্র, তারা স্টেজে যন্ত্রের মত চলাফেরা করে যন্ত্রের মত শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। ক্লাসের পরে বসে নানা বিষয় নিয়ে তাদের প্রাণখোলা আড্ডা।


কলেজে শিক্ষক ও ছাত্র

কলেজের পর প্রাণখোলা আড্ডা
লেখক দেখিয়েছেন যে আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ, হয়তো চেষ্টা করলে আমরাও উল্লেখযোগ্য হতে পারতাম, কিন্তু আমরা চেষ্টা করিনি, মিশে গেছি জনারণ্যে। আমাদের মতই সাধারণ হলো অমল, বিমল আর কমল। এই সাধারণ মানুষেরা সমাজের নানা নিয়ম মেনে নিয়ে একটা যান্ত্রিক জীবনে বাঁধা পড়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এদের নিয়ে নাটক লেখা যায়না।
কিন্তু এদের থেকে আলাদা একজন আছে, সে ‘ইন্দ্রজিৎ’। সে আমাদের মত সাধারণ অমল-কমল-বিমল বা নির্মল নয়, সে ইন্দ্রজিৎ। আর আলাদা বলেই ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে নাটক লেখা হয়।
দর্শক-পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে কেন এই নাটক। কেন ইন্দ্রজিৎ নাটকের নামভূমিকায়? কি ভাবে ইন্দ্রজিৎ তার বন্ধুদের থেকে আলাদা?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো ইন্দ্রজিৎ আলাদা তার চিন্তাভাবনায়। সে অন্য তিনজনের মত অবলীলায় সব কিছু মেনে নিতে পারে না। এই যেমন সে তার প্রেমিকা মানসীকে বলে, “যে নিয়মে সাত বছরের ছেলেকে জুতো পালিশ করতে হয়, সে নিয়মটাকে আমি মানতে পারি না”।
কলেজের সেই প্রাণখোলা আড্ডার পরে একদিন সবাই চলে গেলে ইন্দ্রজিৎ একা বসে থাকে। বন্ধুদের সাথে রোজ সেই একই বিষয় নিয়ে একই কথা বলতে তার ভাল লাগেনা। এমন সময় লেখক তার কাছে আসে।
লেখকঃ কি রে এখানে একা বসে কি ভাবছিস? তোর স্যাঙাৎরা সবাই কোথায়? অমল বিমল কমল?
ইন্দ্রজিৎঃ ওরা একটু আগে চলে গেল।
লেখকঃ কি নিয়ে গ্যাঁজালি?
ইন্দ্রজিৎঃ (কিছুটা বিরক্ত) ওই তো সেই একই বিষয় – ক্রিকেট, রাজনীতি, সিনেমা, ফিসিক্স আর সাহিত্য। আর ভাল লাগেনা এই সব। ইচ্ছে হয় কোথাও বেরিয়ে পড়ি! কোন নাম না জানা জায়গায়…
লেখকঃ বাঃ, চল্ তাহলে, আমিও যাবো তোর সাথে। তোর পকেটে কত টাকা আছে?
ইন্দ্রজিৎঃ (মানিব্যাগে টাকা গুণে) – আড়াই টাকা।
লেখকঃ আমারও ওই রকম। চল্ একটা বাস ধরে হাওড়া স্টেশন চলে যাই, তারপরে যে ট্রেণটা প্রথমে পাবো, সেটা ধরে এই টাকায় যত দূর যাওয়া যায়, চলে যাই।
যাওয়া অবশ্য শেষ পর্য্যন্ত হয়না।
লেখক ইন্দ্রজিৎ কে বাদামের ঠোঙা এগিয়ে দিয়ে বলে, “নে, বাদাম খা!”

নে, বাদাম খা
৩) নাটকের বিষয়বস্তু
এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু হলো অমল বিমল কমলের মত আজকের সাধারণ নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষ এক অসার অর্থহীন যান্ত্রিক এবং নানা সামাজিক নিয়মের নাগপাশে বাঁধা জীবনে আটকে পড়ে আছে। ইন্দ্রজিৎ এর মত কিছু মানুষ এই নিয়মের গন্ডী থেকে বেরিয়ে পড়তে চায়। তারা হল বিদ্রোহী। ইংরেজীতে যাকে বলে non- compliant, uncompromising… নাটকের এই বিদ্রোহী চরিত্র ইন্দ্রজিৎ আসলে লেখক নিজেই, নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ইন্দ্রজিৎ এর সংলাপে তাঁর নিজের ভাবনা চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ইন্দ্রজিৎ লেখকেরই দ্বৈত সত্তা, তার অল্টার ইগো।
লেখক ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে যে নাটক লেখার চেষ্টা করছেন সেখানে তিনি আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের চক্র বোঝাতে গিয়ে বলছেন “স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ আর পরীক্ষা। পরীক্ষা আর পাস। তারপর দুনিয়া”। লেখক চরিত্রের ভেতর দিয়ে বাদল সরকার খুব সহজে জীবনের একটা ছক এঁকেছেন, যেই ছকে আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষেরা সবাই কম-বেশি ঘুরপাক খাচ্ছি।
ঘুরছি, ঘুরছি আর ঘুরছি…
লেখকের সংলাপে বার বার ওই কথা টা ঘুরে ফিরে আসে।
সেই ঘোরা বোঝাবার জন্যে আমরা স্টেজের পিছনের কালো ব্যাকড্রপে একটা মোটিফ এঁকে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম, তাতে আঁকা ছিল একটা চাকার ছবি আর সেই চাকার মধ্যে বাঁধা পড়ে আছে কিছু মানুষ।

ঘুরছি, ঘুরছি আর ঘুরছি
৪) অভিনব আঙ্গিক
বাদল সরকার এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকে এমন কিছু নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন, যা আর কোন মৌলিক বাংলা নাটকে এর আগে দেখা যায়নি।
প্রথমতঃ, এই নাটকে স্টেজ বলতে কেবল লেখকের চেয়ার, টেবিল, আর একটা টেবিল ল্যাম্প, এ ছাড়া অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎ এর বসার জন্যে চারটে কাঠের cube, সেগুলো দরকার মত তারাই এখান থেকে ওখানে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আর বাগানে ইন্দ্রজিৎ আর মানসীর পাশাপাশি বসে কথা বলার জন্যে একটা বেঞ্চ।
ব্যাস বাকি যত কিছু প্রপ্ দরকার সব অদৃশ্য, দর্শক কে কল্পনা করে নিতে হবে।
চাকরীর ইন্টারভিউ দেবার সীনে এক এক করে অমল বিমল কমল ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে, বাকিরা বাইরে বসে। ইন্টারভিউ যারা নিচ্ছেন তাঁরা অদৃশ্য, যে ইন্টারভিউ দিচ্ছে সে কেবল হাত পা নেড়ে মূকাভিনয় করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। শেষে অদৃশ্য তিনজন প্রশ্নকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে হেসে সে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে পরের জন ঢুকছে। বাইরে অপেক্ষমান অন্যরা তাদের নিজেদের সংলাপ বলে যাচ্ছে।
লেখক এর একটা সংলাপ আছে সেখানে সে বলছে আসলে ওদের বেশী প্রশ্ন নেই তো, একই প্রশ্ন সবাইকে করছে, তাই ওরা চায়না যে বাইরে বেরিয়ে এসে কেউ তার প্রশ্নগুলো তার বন্ধুদের বলে দিক।


চাকরীর ইন্টারভিউ
চাকরী পাবার পরে অফিসের সীনে, সেখানে অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎ কাজ করে। চার জন পাশাপাশি বসে। তাদের সামনে অদৃশ্য টেবিলে রাখা অদৃশ্য ফাইল ,কাগজ, টাইপরাইটার। তারা কথা বলতে বলতে হাত চালিয়ে ফাইলে চোখ বোলাচ্ছে, অদৃশ্য পাতা ওল্টাচ্ছে, অদৃশ্য টাইপরাইটারে অদৃশ্য কাগজ লাগিয়ে দুই আঙুল ব্যবহার করে বাতাসে টাইপ করছে।

এছাড়া আছে একই অভিনেতার বিভিন্ন রোলের মধ্যে অনায়াস বিচরণ।
যেমন অফিসের দৃশ্যে লেখক হয়ে যান্ অফিসের বেয়ারা “হরিশ”! সেখানে তার কাজ হলো বাবুদের ফাই ফরমাস খাটা, দরকার মতো চা, সিগারে্ট, ফাইল এই সব এনে দেওয়া। অমল বিমল কমল আর ইন্দ্রজিৎরা তাকে নানা সুরে “হরিশ ! হরিশ!!” বলে ডাকলেই সে তাদের কাছে “বলুন স্যার” বলে গিয়ে হাজির হয়। হরিশের জন্যে কোন আলাদা অভিনেতা নেই, লেখক দর্শকদের সামনেই কাঁধে একটা কাপড় নিয়ে হরিশ হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে সেই হরিশ আবার অফিসের ম্যানেজার হয়ে গিয়ে সেক্রেটারী মিস মালহোত্রা কে ডেকে চিঠি dictate করে। তখন তার কাঁধে আর টেবিল পরিস্কার করার কাপড় নেই, তার চালচলনে তখন রাশভারী ব্যক্তিত্ব। অমল বিমল কমলরা তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে “গুড মর্ণিং স্যার” বলে।
এদিকে মানসী দিব্বি মিস মালহোত্রা হয়ে গিয়ে অদৃশ্য খাতায় অদৃশ্য পেন দিয়ে ডিক্টেশন লেখে।
এই সব অভিনব নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করার জন্যেও এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে সমানভাবে আদৃত হয়।


অফিসের দৃশ্য – কখনো হরিশ, কখনো ম্যানেজার
৫) নাটকের শুরু
এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের শুরুটা বেশ মজার।
রাসবিহারী মোড়ের কাছে মুক্ত অঙ্গন মঞ্চে এই নাটকটা প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালে। প্রথম সীনে পর্দ্দা খোলার পরে যখন লেখক স্টেজে দর্শকদের সাথে কথা বলছে তখন হঠাৎ সামনের সারির দর্শক আসন থেকে একটা গুঞ্জন শুরু হলো। দু’জন দর্শকের মধ্যে সীট নিয়ে বাদানুবাদ। একদিকে স্টেজে লেখক তার সংলাপ বলছে, অন্যদিকে হলে সেই জায়গাটাতে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে, একটা জটলার মত, আর গুঞ্জন ক্রমশঃ কোলাহলের দিকে এগোচ্ছে।
ব্যাপার টা কি?
এমন সময়ে ওই জটলার দিকে লেখকের চোখ পড়বে, এবং সে তার সংলাপ বন্ধ করে ওই কোলাহলরত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলবে, “এই যে শুনছেন, ও মশাই! আপনারা একবার একটু ওপরে উঠে আসবেন?”
তারপর “আমাদের বলছেন?” বলে চার মূর্ত্তি অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ এক এক করে স্টেজে উঠে তাদের নাম বলবে।
কি নাম আপনার? অমল কুমার বোস।
আপনার? বিমল কুমার ঘোষ। ইত্যাদি।
আমার ভাই খোকন গল্প করে যে তার এক বন্ধু সব্যসাচী নাকি একবার নাটক দেখতে গিয়ে ওই ঝগড়ার সময়ে অমল বিমলদের পিছনেই বসেছিল। ওদের ঝগড়া দেখে সে বুঝতে পারেনি যে ওই ঝগড়াটা আসলে নাটকেরই একটা অংশ, সে ওদের কাছে গিয়ে ঝগড়া থামাতে যায়। তার পরে লেখক যখন ওদের স্টেজে ডাকছে, তখন লেখক তাকেও ডাকছে এই ভেবে সে ওদের সাথে আর একটু হলেই স্টেজে উঠে “আমার নাম সব্যসাচী সেন” বলে একটা কেলো করতে যাচ্ছিল, নাটকের কিছু লোক তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে আনে।
এই সীট নিয়ে ঝগড়ার কথা অবশ্য নাটকে লেখা নেই। এটা কিছুটা ইম্প্রোভাইস করা। আমরাও এই ভাবে আমাদের নাটক শুরু করি।
এই দৃশ্য টা রোজ রীতিমতো রিহার্সাল হতো। অবশ্য আমাদের নাটকের ভিডিও তে ঝগড়াটা ওঠেনি। আমি আমাদের ভিডিওগ্রাফার ভিক্টর কে বলেছিলাম ঝগড়াটা তুলতে কিন্তু ওই জায়গাটা অন্ধকার ছিল, তাই বোধহয় তোলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওই সময়ে হলে একটা অস্পস্ট চ্যাঁচামেচির আওয়াজ ভিডিওতে উঠেছে, এবং দেখা যাচ্ছে সামনের সারিতে বসে আমাদের সত্য (চক্রবর্ত্তী) বেশ বিরক্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কি যেন বলছে। ঝগড়া থামাতে বলছে ধরে নেওয়া যায়।
তার মানে আমাদের অভিনয় বেশ বিশ্বাস্য হয়েছিল!



নাটকের শুরু
৬) মাসীমা
মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারে স্নেহময়ী মাসীমা জ্যেঠিমা কাকীমা পিসীমা কেউ না কেউ একজন থাকবেনই। এই নাটকেও একটি মাসীমার চরিত্র আছে, যিনি মাঝে মাঝেই লেখকের কাছে এসে “ওরে ভাত যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কখন থেকে ডাকছি, খেতে আয় বাবা!” বলে অনুরোধ উপরোধ করেন।
কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়না।
লেখকের মনে নানা চিন্তা। আমি কে? আমি কি? আমি কেন? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
মাসীমা এসব কি কেন কোথায় প্রশ্নের মানে বোঝেন না। তিনি বলেন “কি যে ছাই হাবি জাবি ভাবিস তুই, বুঝিনা বাবা!”
লেখক মাসীমাকে একটু খ্যাপাবার জন্যে কবিতা করে বলে~
“কেন তুমি তরকারী বঁটি দিয়ে কুটবে, কেন তুমি ডালে দেবে আটখানা লংকাই?
সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই।
কেন তুমি ঘড়ি ধরে অফিসেতে ছুটবে, তেল দিতে কেন বাছো অন্যের চরকাই?
সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই। ”
নিয়মের গন্ডীতে বাঁধা আমাদের নাগরিক জীবন কে বোঝাতে বাদলবাবু এই “সব্বাই করে বলে” লাইনটি ব্যবহার করেছিলেন, যা এক সময় লোকের মুখে মুখে ঘুরতো।

সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই – লেখক ও মাসীমা
৭) প্রেম
স্কুলের পরে কলেজ, এবং কলেজে পড়ার সময় প্রেম।
আমাদের প্রায় প্রত্যেকের জীবনচক্রে এ এক অনিবার্য্য ঘটনা, নাটকে জীবনের ওই সময়টা ছুঁয়ে গেছেন নাট্যকার।
অমল বিমল কমল আর লেখক চার জন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় নানা বয়সের নানা ধরণের মেয়েরা, তারা সতৃষ্ণ নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথমে দেখা যায় সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ে হাতে বই খাতা নিয়ে কলেজে হেঁটে যাচ্ছে। তার একটু পরে দেখা গেল এক আধুনিকাকে, তার হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস, চলার ভঙ্গীতে লাস্য।
এবং আরও একটু পরে তার আশ্চর্য্য হয়ে দেখলো একটি মেয়ের সাথে কথা হেসে হেসে অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে কথা বলতে বলতে তাদের দিকে একবার ও না তাকিয়ে চলে গেল তাদের বন্ধু ইন্দ্রজিৎ~
“ডুবে ডুবে কিরকম জল খাচ্ছে দেখেছিস – আমাদের সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিলোনা।” দু;খ করে বললো অমল বিমল কমল।


কিন্তু ইন্দ্রজিৎ এর সাথে এই মেয়েটি কে?
জানা গেল এই মেয়েটির নাম মানসী, এবং সে ইন্দ্রজিৎ এর এক দূর সম্পর্কের বোন হয়। তারা পার্কের বেঞ্চে গিয়ে পাশাপাশি বসে, কথা বলে, আর দর্শকদের কল্পনা করে নিতে হয়, তাদের মাথার ওপরে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ধরেছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে আকাশে চাঁদ ওঠে, ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলো জ্বলে ওঠে।
ইন্দ্রজিৎ ও মানসীর প্রেম শেষ পর্য্যন্ত নাটকে পরিণতি লাভ করেনি। ইন্দ্রজিৎ চেয়েছিল মানসীকে বিয়ে করতে। কিন্তু মানসী রাজী হয়নি। এখানেও সেই সমাজের নিয়মের প্রশ্ন উঠে এসেছে। মানসীর মনে সংশয় ছিল যে দূর সম্পর্কের বোন কে বিয়ে করলে তাদের বিয়ে পরিবারের মান্যতা হয়তো পাবেনা।
অনেকদিন মানসী বা ইন্দ্রজিৎ কেউই বিয়ে করেনি। দেখা করেছে, কথা বলেছে। ইন্দ্রজিৎ বারবার বলেছে বিয়ের কথা কিন্তু মানসী রাজি নয়।


ইন্দ্রজিৎ ও মানসী
৮) বিবাহ
লেখক যে জীবন চক্রের ছক এঁকেছেন তাতে কলেজ পাসের পর দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় টিকতে হলে একটা চাকরি দরকার, রুটি-রুজির নিশ্চিত ব্যবস্থা দরকার। ইন্দ্রজিৎ ও তাঁর বন্ধুরা সেজন্য চাকরির খোঁজ করে, ইন্টারভিউ দেয়। তারপরে এক সময় তারা চাকরীও পায়। এবং স্বাবলম্বী হবার পরে তারা জগতের নিয়ম মেনে বিয়েও করে।
এই ভাবেই নাটকে জীবনের একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যায় তারা।
বিয়ের প্রথমে বর আর বৌ, মধ্যবয়েসে স্বামী আর স্ত্রী আর শেষ বয়েসে গিয়ে কর্ত্তা আর গিন্নী… নাটকে জীবনের তিন বয়সের দাম্পত্যের দৃশ্য দেখিয়েছেন নাট্যকার।
সদ্য বিয়ে হয়েছে অমলের, সদ্যবিবাহিত বলে তারা এখন বর আর বৌ। বৌকে একা পেয়ে অমল তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে লজ্জা পেয়ে বৌ “কি করছো? কেউ দেখে ফেলবে!” বলে একটু দূরে সরে যায়।
বিমলের বিয়ে কয়েক বছর হলো হয়েছে, তারা এখন স্বামী আর স্ত্রী। এক দৃশ্যে সকালে বিমল খবরের কাগজ পড়ছে, তার স্ত্রী তার সামনে চায়ের কাপ রেখে বলে “আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরো, দিদি জামাইবাবুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে!”
কমলের এখন বেশ বয়েস, সে আর তার স্ত্রী এখন কর্ত্তা আর গিন্নী। তাদের ছেলের অসুখ, অফিস ফেরত তার ওষুধ কিনে আনার কথা ছিল, কিন্তু সে ভুলে গেছে, তাই তাকে গিন্নীর গঞ্জনা শুনতে হয়।
আমাদের সকলের দাম্পত্য জীবনের এই সব অতি পরিচিত দৃশ্য!




বিয়ের পরে বর বৌ, স্বামী স্ত্রী, ও কর্ত্তা গিন্নী
৯) দুনিয়া
এই ভাবেই দিন কাটে। অমল বিমল কমল যুবক থেকে মধ্যবয়েসী এবং তারপর প্রৌঢ় হতে থাকে।
জীবনচক্রে ধীরে ধীরে আটকে যায় সবাই।
ঘুরে ফিরে অমল-কমল-বিমলের সাথে দেখা হয় লেখকের। এরা সবাই চাকরি-বাকরি, ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। যদিও কেউই তেমন সুখী নয়।
অমল লেখককে বলে, “এই এ-বি-সি-ডি কোম্পানিতে ঢুকে ভবিষ্যৎটা ঝরঝরে হয়ে গেল। সিনিয়র অ্যাসিসটেন্টের পোস্টে ছ’বছরের এক্সপেরিয়েন্স, জানো? আর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার করে নিয়ে এল, বাইরে থেকে এক মাদ্রাজিকে!”
বিমল জমি কেনা বেচা আর বাড়ী তৈরী করার প্রোমোটার হয়েছে। তার হাতে অনেক বাড়ী আর জমি। লেখক কিনতে চাইলে খুব কম দামে সে ভাল জমি বা বাড়ীর সন্ধান দিতে পারে। তাছাড়া তার মনে অনেক নতুন লাভজনক ব্যবসার স্কীম আছে, লেখকের যদি উৎসাহ থাকে…
ওদিকে কমল তার চাকরীর বাঁধা মাইনের বাইরেও কিছু উপার্জ্জনের আশায় ইন্সিওরেন্স বিক্রী করে। সে লেখক কে বলে “একটা ইন্সিওরেন্স পলিসি করিয়ে নিতে ভুলোনা কিন্তু!”
এই ভাবেই আমাদের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তদের বর্ণহীন, স্বাদহীন, যান্ত্রিক, গতানুগতিক নাগরিক জীবন এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে এগিয়ে যায়। অমল রিটায়ার করে, অমলের ছেলে অমল চাকরী পায়। বিমল অসুখে পড়ে, বিমলের ছেলে বিমল চাকরী পায়। কমল মারা যায়, কমলের ছেলে কমল…
১০) ইন্দ্রজিৎ কি নির্মল ?
কিন্তু নাটকের মুখ্য চরিত্র ইন্দ্রজিৎ কোথায়? ওদের মতই সেও কি চাকরি করছে? বিয়ে করেছে?
জানা গেল ইন্দ্রজিৎ একটা কোর্স করতে লন্ডন চলে যায়। সেখান থেকে সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে। ত।রপর এক সময় দেশে ফিরে আসে ইন্দ্রজিৎ। বিয়ে করে অন্য এক মানসী কে। লেখকের সাথে একদিন দেখা হয় তার। অনেকদিন পর দেখা তাই লেখক অনেক কথাই জানতে চাইছে ইন্দ্রজিতের কাছে, কেমন আছে? কি করছে? কিন্তু লেখক যতোটা শুনতে চায় ইন্দ্রজিতের বলার মতো ততোটা নেই।
আমাদের জীবনের দৈনন্দিনতা আর প্রাত্যহিকতার গ্লানি, রোজ রোজ একই বিষয়ের ফিরে ফিরে আসা, একই রুটিনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, অস্তিত্বের ভার, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মধ্যে মধ্যে নিহিত থাকে এক ধরণের অবসাদ আর ক্লান্তি। তার সাথে থাকে আমাদের হাজারো না পাওয়া, বাধাবিপত্তি, অসুখবিসুখ, ব্যর্থতা, বিপর্য্যয়।
ইন্দ্রজিৎ বলে, “দুনিয়াতে বলবার মত ঘটনা প্রায়ই ঘটে না”।
আমি সকালে বাজার করি। আমার বৌ রান্না করে।
আমি খেয়ে দেয়ে অফিসে যাই। আমার বৌ বাড়ীর কাজ করে।
আমি অফিস থেকে ফিরি। আমার বৌ আমার জন্যে চা নিয়ে আসে।
সুমন গুণের সাম্প্রতিক এই কবিতাটিতে এক সাধারণ নারীর জীবনের এইরকম বর্ণহীন, স্বাদহীন, গন্ধহীন একটি দিনের কথা লেখা আছে।
—————
লালন – সুমন গুণ
বাড়ীতে দুপুরে তুমি একা থাকো, একমাত্র ছেলে সকাল দশটায় যায় কাজে/
তারপর তোমার আর খুব কিছু করার থাকেনা, ভোরে উঠে চা করে ঘর মুছে/
ভাতের সাথে একটা দুটো তরকারী বানিয়ে নাও/
ছেলে যাবার পরে দিন খুব বড় হয়ে যায়/
গ্রিল টেনে দিয়ে তুমি ঘরে আসো, চেয়ার এলিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকো/
বেশীক্ষন দাঁড়াতে পারোনা, বিছানায় শুয়ে নাও, ঘুম পায়, দরজা খোলা থাকে/
এক সময় ঘুম ভেঙে উঠে, স্নান সেরে, ছাদে যাও/
দুপুরের স্তব্ধ রোদে মেলে দাও শাড়ি, গামছা, ছেলের পাজামা/
আস্তে আস্তে নেমে এসে বারান্দায় সামান্য দাঁড়াও/
দুপুরে কখনো অল্প ঘুম আসে, বিকেলের আগে ঘুম ভাঙে/
তবু কিছুক্ষন বিছানায় চোখ বুজে থাকো/
নৈহাটি লোকাল এসে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়/
গ্রিলের আওয়াজে তুমি বারান্দায় এলে গ্রিল খুলে/
ক্লান্ত, জীর্ণ, অপত্যকালীন সন্ধ্যা ঘরে উঠে আসে/
——————
ইন্দ্রজিৎ তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, কারণ সে ভেবেছিল সে বাকিদের থেকে আলাদা। কিন্তু আজ তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে সে ইন্দ্রজিৎ নয়, সে অমল-কমল-বিমলের মতই সাধারণ আরেকজন। সে নির্মল। এখন বাকি জীবনটা ঘর-সংসার, চাকরি-বাকরি করে কাটিয়ে দিতে চায় সে।
কিন্তু ইন্দ্রজিৎ তো নির্মল হতে পারবেনা, সে তো সাধারণ হতে পারবে না। কারণ হিসেবে লেখক বলেন, “কিন্তু তোমার যে কিছু নেই। প্রমোশন নেই, বাড়ি করা নেই, ব্যবসার স্কিম নেই, কী করে নির্মল হবে তুমি?”
তাহলে কি ইন্দ্রজিৎ আলাদা হতে পারলো? ইন্দ্রজিৎ কে নিয়ে নাটক লেখা কি সার্থক হলো?
লেখক নাটকের শেষ টানেন, “আমাদের অতীত-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে গেছে। আমরা জেনে গেছি পেছনে যা ছিল, সামনেও তাই।”
মোটিফের কাগজে তাই ওই চাকার পাশে একটা দূরান্তে চলে যাওয়া এক জোড়া রেল লাইন ও এঁকে দিই আমরা।
পিছনেও যা, সামনেও তাই। মনে হয় দুই লাইন হয়তো কোথাও এক জায়গায় গিয়ে মিশেছে, কিন্তু তা নয়। কোনদিনই ওরা এক হবেনা।
গ্রীক পুরাণের হতভাগ্য সিসিফাস সারা জীবন একাট ভারী লোহার বল ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের ওপরে তুলতেই সেটা আবার গড়িয়ে নীচে নেমে যেতো। বাদল সরকার নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষদের সেই সিসিফাসের সাথে তুলনা করেছেন।


That’s all ladies and gentlemen
১১) আমাদের দল
কুয়েতের বি সি এসে নাটকে উৎসাহী যুবকের কোন অভাব নেই। বরং তারা সংখ্যায় এত বেশী যে সবাইকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়াই মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে। এবং ইন্দ্রজিৎ এর ক্ষেত্রে যেহেতু মাত্র সাতটি চরিত্র তাই অনেককেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাদ দিতে হয়েছিল।
লেখক করেছিল শুকদেব (চট্টোপাধ্যায়), ইন্দ্রজিৎ – শুভঙ্কর (রায়), অমল – অজিত (চ্যাটার্জ্জী), বিমল – দেবাঞ্জন (ভট্টাচার্য্য), কমল – তাপস (ভট্টাচার্য্য), মাসীমা – নুপূর (রায় চৌধুরী) আর মানসী – দীপা (গুপ্ত)।
মহড়া হয়েছিল প্রায় তিন মাস ধরে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার বাড়ীতেই হতো। মনে আছে আমাদের সবার মাসীমা নুপূর রোজ রিহার্সালে বাড়ীতে তৈরী নারকেলের নাড়ু বানিয়ে নিয়ে আসতো। নিমেষে তা উধাও হয়ে যেতো অবশ্যই।
প্রবাসী জীবনে নাটকের থেকেও বেশী উপভোগ্য হত মহড়া উপলক্ষ্যে সবার একজোট হওয়া। হৈ হৈ আড্ডা এর ওর পিছনে লাগা এসব তো ছিলই। কিন্তু সব চেয়ে ভাল লাগতো নাটকটির পিছনে এই দলের সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে।
পার্থসারথী (বর্দ্ধন) স্টেজ আর আবহের দায়িত্বে ছিল। স্টেজে অবশ্য বিশেষ কাজ কিছু ছিলনা। কেবল ওই পিছনে কালো কাগজের ওপর একটা চাকা আর রেল লাইনের মোটিফ এঁকে সাঁটিয়ে দিতে বলেছিলাম ওকে। আবহে সে ব্যবহার করেছিল পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত। Bach, Beethoven এবং অন্যান্য দিকপালদের Cello Violin ইত্যাদি। অভিনেতাদের সংলাপ ধরার জন্যে মেঝেতে রাখা ফ্লোর মাইক ব্যবহার করেছিলাম।
অমিতেন্দ্র (বাগচী) ছিল আলোর দায়িত্বে। এই নাটকে আলোর কোন কেরামতি ছিলনা। দু’ তিনতে ফ্লাড লাইটেই কাজ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তার তেমন কোন অসুবিধে হয়নি।
মনে পড়ে যে নাটক শুরু হবার এক ঘন্টা তখনো বাকি, আমি হলে পৌঁছে দেখি সেই মোটিফের কাগজটা পিছনের ব্যাকড্রপে সাঁটানো হয়নি, পার্থকেও দেখা যাচ্ছেনা। কোথায় গেল? এদিকে একটু পর থেকে দর্শকরা আসতে শুরু করবে।
পার্থ অবশ্য খুবই দায়িত্ববান ছেলে। বি সি এসের অনেক নাটকের কাজ সে একাই সামলেছে। তো একটু পরেই সে তার কাগজটা নিয়ে এসে পিছনে সাঁটিয়ে দিলো।
দিয়ে আমায় বললো, “কি ইন্দ্রজিৎ দা’, ঠিক আছে তো?”
দেখলাম তার আঁকার size আর proportion আমি যেরকম চেয়েছিলাম, একদম তাই হয়েছে। হলের একদম পিছন থেকেও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
আমি পার্থকে বললাম, “পারফেক্ট!”
কুয়েতের তিনটে ইংরেজী কাগজেই আমাদের নাটকের রিভিউ ছাপা হয়েছিলা। তার সব গুলোতেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।

আমাদের দলের অভিনেতা দের সাথে সুভদ্রা আর আমি (নাটকের আগে)

কাস্ট পার্টি তে উপহার পেয়ে উৎফুল্ল পরিচালক
১২) পরিশিষ্ট – বাদলবাবু
কুয়েতে এবং ইন্দ্রজিৎ মঞ্চস্থ করার আগে নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক হিসেবে বি সি এসের হয়ে আমি নাট্যকার বাদলবাবুকে নাটকটি কুয়েতে করার অনুমতি চাইবার জন্যে কলকাতায় ফোন করেছিলাম। তিনি আমার ফোন পেয়ে খুসী হয়েছিলেন, এবং অবশ্যই আমাদের কুয়েতে তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করার অনুমতি ও দিয়েছিলেন।
সাফল্যের সাথে নাটকটি কুয়েতে মঞ্চস্থ হবার পরে আমরা তাঁকে বি সি এসের পক্ষ থেকে সন্মানী হিসেবে একটি চেক পাঠাই। লেখকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল শুকদেব (চট্টোপাধ্যায়) , সে নিজে হাতে গিয়ে বাদলবাবুকে সেই চেক দিয়ে আসে। সেই চেকের সাথে একটা ইংরজীতে লেখা প্রাপ্তির (Receipt) চিঠিও ছিল, তাতে সই করে আমাদের পাঠাবার জন্যে।
সেই ইংরেজী প্রাপ্তির চিঠি সই করার সাথে সাথে বাদলবাবু বাংলায় নিজে হাতে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লিখে আমাদের পাঠিয়েছিলেন।
বাদলবাবু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, আমরা তাঁর পরলোকগত আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি

-
বিজয়া দশমী
তোমাদের মধ্যে যাদের আমার কাছাকাছি বয়েস, তাদের মনে থাকতে পারে আমাদের ছোটবেলায় বিজয়া দশমী এলে পূজো শেষ হয়ে গেল ভেবে মনটা বেশ খারাপ হত ঠিকই, কিন্তু একই সাথে বিজয়ায় অনেক আত্মীয়স্বজন বাড়ীতে দেখা করতে আসতেন এবং তাঁদের জন্যে মা জ্যেঠিমা কাকীমারা অনেক খাবার তৈরি করে রাখতেন। আর আমরা ছোটরা সেই সব খাবারের ভাগ পেতাম।
কিন্তু বিজয়ার প্রধান downside ছিল দু’টো।
এক হলো গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা। আজকাল এই নিয়মটা কি উঠে গেছে? বোধ হয় না।
এখন আমি নিজে একজন গুরুজন হয়ে গেছি, কেউ আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে আমার একটু অস্বস্তি হয়। কিছুদিন আগে গায়ত্রীমাসীর নাতি ঋদ্ধির (মুনিয়া আর দেবাশীষের ছেলে) বিয়েতে গিয়েছিলাম, সেখানে ছোটরা অনেকে ছিল। ঋদ্ধি আর তার নববধূ শীতল তো বটেই্, তা ছাড়া গার্গীর ছেলে শুভ আর তার বৌ সোহিনী, উদয়ের মেয়ে রমিতা, রঞ্জুর মেয়ে তু্তুন, আর তার স্বামী রোহন। এরকম আরো অনেকে সবাই আমায় আর সুভদ্রাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, আমি বাধা দিতে গেলে তারা আমার কথা শোনেনি।
বড়দের শ্রদ্ধা জানানোর এই পুরনো প্রথা আজকের তরুণ ছেলে মেয়েরাও চালু রেখেছে দেখে আমার ভাল লেগেছে।
মনোহরপুকুরে আমাদের ও তখন এই রকম পাইকারী হারে গুরুজন দের প্রণাম করার প্রথা ছিল। আমাদের বাড়ী তখন গুরুজনে একেবার টইটম্বুর ভর্ত্তি, তার ওপর আবার যাঁরা দেখা করতে আসতেন তাঁদেরও প্রণাম করা নিয়ম ছিল। নো ছাড়ান ছুড়ন…
——–
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তাঁর বরযাত্রী বই তে এক জায়গায় লিখছেন, গণশা বলিল, “পরশু মাসীর বাড়ী গেছলাম। মা মাসী ডেকে ডেকে তেইশজন কে পায়ে হাত দিয়ে পেরনাম করালে, তার মধ্যে তিন জন ফাউ। সেখানে অত গুরুজন আছে জানলে ওদিক মাড়াতামনা। কোমরের ফিক ব্যাথাটা এসা আউড়ে উঠেছে!”
ত্রিলোচন প্রশ্ন করিল, “ফাউ মানে?”
“তিনটে তাদের মধ্যে কাজের লোক ছিল, ঘাড় তুলে তাকাবার তো আর ফুরসত ছিলনা!”
————
বিজয়াতে ছেলেদের মধ্যে কোলাকুলির চল অবশ্য এখনো আছে। এখানে ছোট বড়র কোন প্রভেদ নেই, ছোটরাও গুরুজনদের সাথে কোলাকুলি করতে পারে্।
এই নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম।
———–
একবার বিজয়ার পর ভীড় বাসে দুই বন্ধুর দেখা, কিন্তু তাদের মাঝখানে অনেক সহযাত্রী, তাদের শরীরের মধ্যে কয়েক স্কোয়ার ইঞ্চি ফাঁক, সেই ফাঁক দিয়ে তারা পরস্পর কে হেসে শুভ বিজয়া জানাচ্ছে।
কিন্তু এই ভীড় বাসে দূর থেকে নমস্কার বা কোলাকুলি করা অসম্ভব। একে তো দূরত্ব, তার ওপরে দুই হাত দিয়ে ওপরে বাসের হ্যান্ডেল ধরা। নমস্কার যে করবেন তারও উপায় নেই, হ্যান্ডেল থেকে হাত ছাড়লেই উল্টে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা।
দু’জনে তাই যতটা সম্ভব তাদের হাত দুটো ওপরে রেখেই দুই কাঁধ সামনে পিছনে একটু আন্দোলিত করলেন, কোলাকুলি বোঝাতে।
বোঝো কান্ড।
————
দ্বিতীয় downside ছিল বিজয়ার চিঠি লেখা। উঃ, এখন ভাবলে মনে হয় সে ছিল এক বিভীষিকা।
আর যে সব গুরুজনরা বাইরে থাকতেন – তাঁদের সংখ্যাও কিছু কম নয় – তাঁদের নিয়ম করে চিঠিতে বিজয়ার প্রণাম জানাতে হতো। সে আর এক যন্ত্রণা। আজ যেরকম গ্রুপ মেলে বা Whatsapp এ একবার লিখেই সবাইকে একসাথে সবাই কে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তখন তো আর তা ছিলনা। তখন প্রতিটি চিঠি আলাদা আলাদা লিখতে হতো, আর তাও শুধু ন্য়, একটা পোস্টকার্ডে বা ইনল্যান্ডে বেশ কয়েকজন প্রণাম আশীর্ব্বাদ ইত্যাদি জানাচ্ছেন, লেখার জায়গা ক্রমশঃ কমে আসছে, কিন্তু তার মধ্যেই কোনমতে জায়গা করে নিয়ে কখনো মার্জিনে কিছুটা, শেষে কিছুটা, এই ভাবে ভেঙে ভেঙে লিখতে হতো, মাঝে মাঝে নাম ঠিকানার জায়গাতেও প্রণাম জানিয়েছি, প্রায়ই অক্ষর গুলো এত ছোট হয়ে যেত আর হাতের লেখা এত বিশ্রী, যে কেউ সেই লেখা পড়তে পারতো কিনা বলা মুস্কিল।
কেবল একটাই যা সান্ত্বনা ছিল, যে পড়তে না পারলেও কোন অসুবিধে ছিলানা, কেননা কি লেখা আছে তা তো সবারই জানা।
“তুমি আমার বিজয়ার প্রণাম নিও, ছোটদের ভালবাসা জানিও।” ব্যাস, এই তো?
এই একই বাক্য আমাদের সারা দিন ধরে শ’ খানেক চিঠিতে রোবোটের মত লিখে যেতে হতো।
এটা একটা শাস্তি নয়?
বিজয়া দশমী এলেই সেই মিষ্টি খাবার আনন্দের পাশাপাশি ওই শাস্তির কথাটাও এখনো মনে পড়ে।
-
নট্ কাশি খুকখুক

১) স্মৃতির শহর – কাশী
আমার জন্ম ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে। আমার যখন চার মাস বয়েস তখন জুলাই মাসে কলকাতায় The great Calcutta Killing এর দাঙ্গা হয় , তার আগে বাবা আমায় আর মা’কে কাশীতে দিদার কাছে রেখে দিয়ে আসেন।
আমার দিদা তখন তাঁর বাবার (মা’র দাদু) সাথে কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে রাণামহল নামে একটা বাড়ীতে থাকতেন।
সুতরাং জন্মের পর থেকেই বলতে গেলে কাশীর সাথে আমার পরিচয়।
তার পরে শৈশবে এবং কৈশোরে আমি মা’র সাথে অনেকবার দিদার কাছে কাশীতে গেছি। কাশী তাই আমার কাছে এক স্মৃতির শহর। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৫ সালে পূজোর ছুটিতে, তখন আমার খড়্গপুরে থার্ড ইয়ার , বাবা সেই বছরই জুলাই মাসে মারা গেছেন, শেষ কাশী গিয়েছিলাম।
তার পরে পরেই দিদা’র শরীর খারাপ হতে শুরু করে, মা মাসীরা আর মামা ওনাকে আর কাশীতে একা থাকতে না দিয়ে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন।
প্রথমে কিছুদিন মামার কাছে আসানসোলে থাকার পরে দিদা কে কলকাতায় চিকিৎসার সুবিধের জন্যে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে তিনি এন্টালীতে খ্রীস্টোফার রোডে মাসীর বাড়ীতে থাকতেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে ৭৮ বছর বয়েসে দিদা আমাদের ছেড়ে চলে যান্।
আমার সেই বাল্য আর কৈশোরের কাশীর স্মৃতি প্রায় সবটাই দিদাকে ঘিরে।


দাদু – উপেন্দ্র নারায়ণ বাগচী দিদা – নির্মলা দেবী
২) আমাদের দিদা
দিদা (নির্মলা দেবী) অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছিলেন, নদীয়া জমশেরপুরের সম্পন্ন এবং সুখ্যাত বাগচী পরিবারের বৌ হলেও স্বামী মারা যাবার পরে তিনি শ্বশুরবাড়ীতে পাঁচ ছেলেমেয়েদের নিয়ে আশ্রিতা হয়ে থাকতে চান্নি।
দিদার স্বামী (আমাদের দাদু – উপেন্দ্রনারায়ণ বাগচী) খুব অল্প বয়েসে মারা যান, বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে সবে, মা মাসীরা তখন স্কুলে পড়েন, মামা সবে কলেজে ভর্ত্তি হয়েছেন। দিদার নিজের আর্থিক সামর্থ্য বেশী না থাকলেও সেই সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাবা ও দুই ভাই।
আমার দিদা প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারী ছিলেন, তাঁর চরিত্রের নানা দিক ছিল।
তার মধ্যে প্রধান ছিল তাঁর আধ্যাত্মিক দিকটি, কঠোর এবং রক্ষণশীল ধার্মিক অনুশাসনের মধ্যে তিনি তাঁর সন্তানদের মানুষ করেছিলেন। তিনি আনন্দময়ী মা’র একজন প্রধান শিষ্যা ছিলেন, তাঁর খুব কাছে থাকার জন্যে ছেলে মেয়েদের সবার বিয়ে এবং নিজের নিজের সংসার হবার পরে তিনি কাশীতে একা এসে থাকতে শুরু করেন।
দ্বিতীয় দিকটি ছিল তাঁর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। অল্প বয়েসে রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হবার ফলে তিনি প্রথাগত শিক্ষা তেমন ভাবে না পেলেও, রবীন্দ্রনাথের লেখার সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল। তাঁর নানা কবিতা তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল, বিশেষ করে কবির ঈশ্বর প্রেমের কবিতা এবং যেখানে তিনি মানুষের আত্মার উন্নতির জন্যে আবেদন করেছেন সেই সব কবিতা তাঁর প্রিয় ছিল।
“তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি”, “অন্যায় যে করে আর অন্য্যায় যে সহে”, “কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের তরে দীর্ঘশ্বাস” ইত্যাদি কবিতা তিনি বই না দেখে মন থেকে ঝরঝর করে আবৃত্তি করতেন। আমরা ছোটবেলায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর সেই আবৃত্তি শুনেছি।
দিদা নিজেও অনেক কবিতা লিখে গেছেন, তাছাড়া তাঁর লেখা ছোটদের রামায়ণ মহাভারতের গল্প আমার মা বই হিসেবে ছাপিয়েছিলেন। সেই লেখার আঙ্গিকটা সে যুগে বেশ নতুন ছিল। এক দিদিমা যেন তাঁর নাতি নাতনীদের গল্প বলছেন, তারা নানা প্রশ্ন করছে এবং তিনি হাসিমুখে তাঁদের সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। সেই প্রশ্নোত্তর এর মধ্যে দিয়ে রামায়ণ মহাভারত এর গল্প গুলো জানা হয়ে যাচ্ছে তাদের।
আর তৃতীয় দিক টি ছিল দিদার স্নেহময়ী স্বভাব। বিশেষ করে আমরা তাঁর নাতি নাতনীরা তাঁর তাঁর অকুন্ঠ স্নেহ আর ভালবাসা পেয়েছি।
আমার চিঠি লেখার অভ্যাস অনেক ছোটবেলা থেকে। দিদা কাশী থেকে আমায় মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন। আমিও উত্তর দিতাম। দিদার লেখা কিছু চিঠি আমার কাছে এখনো জমানো আছে। শুরু করতেন “পরমকল্যাণবরেষু স্নেহের মান্টু্ভাই” দিয়ে। চমৎকার ঝরঝরে লেখা। তাছাড়া সুন্দর হাতের লেখা, একটু ও কাটাকুটি নেই। এখনো মাঝে মাঝে পড়তে বেশ লাগে। দিদার স্নেহের পরশ লেগে আছে সেই সব চিঠিতে।


২) শৈশবের কাশী
আমার হাতে খড়ি হয়েছি্লো কাশীতে। রামকৃষ্ণ মঠ থেকে এক সন্ন্যাসী বাড়ীতে এসে আমায় স্লেটে অ আ ক খ লেখা শিখিয়েছিলেন। আমার সেই সব চটপট লিখে ফেলা দেখে তাঁর নাকি তাক লেগে গিয়েছিল। আমার অক্ষরজ্ঞান দেখে ঐ সন্ন্যাসী ভদ্রলোক নাকি আমার খুব প্রশংসা করেছিলেন। এদিকে আমার মা যে বেশ কয়েকদিন ধরেই স্লেট কিনে এনে আমায় অ আ ক খ লেখা প্র্যাকটিস করিয়েছেন, তা তো আর তিনি জানেন না। সুতরাং সেই সন্ন্যাসীর প্রশংসা আমার মা’র ই প্রাপ্য ছিল।
আমার ছোটবেলার কাশীর আর একটা গল্প মা খুব বলতেন, এটা ছিল ওঁর খুব প্রিয় একটা গল্প।
তখন আমি খুব ছোট চার বা পাঁচ বছর বয়েস হবে। এই ঘটনা টা আমার স্মৃতিতে নেই, মা’র কাছেই শোনা।
মা র কাশীতে অর্শের অপারেশন হয়েছে, তিনি হাসপাতালে আছেন বেশ কিছুদিন। বাবা এসেছেন দিল্লী থেকে মা’র পাশে থাকতে। রোজ বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে বাবা চলে যান মা’কে দেখতে হাসপাতালে। এদিকে আমায় নিয়ে দিদা আর গায়ত্রী মাসী রোজ বিকেলে চলে যান্ আনন্দময়ী মা’র কাছে। কাশীতে তিনি থাকেন দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে নদীর ধারে কোন এক রাজার বিশাল বাড়ীতে। ত্রোজ বিকেলে তাঁর সভা বসে সেই বাড়ীর এক বিরাট হলঘরে।
স্মৃতি খুব ঝাপসা হলেও তাঁকে আমার কিছুটা মনে পড়ে। আমি গায়ত্রীমাসীর সাথে বসতাম বিশাল – মেঝে থেকে সিলিং পর্য্যন্ত – কাঁচের জানলার পাশে। সামনে একটা ছোট মঞ্চের ওপর আনন্দময়ী মা এসে বসতেন, প্রিয় শিষ্যা হিসেবে দিদা বসতেন তাঁর পাশেই মঞ্চের ওপরে।
আনন্দময়ী মা’কে দেখে মনে হতো তাঁর ভিতরে একটা জ্যোতি ফুটে বেরোচ্ছে। অসাধারণ দিব্য রূপ ছিল তাঁর এবং এমন একটা ব্যক্তিত্ব যা চারিপাশের সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। খুব আস্তে কথা বলতেন, নরম গলায়। আমি তো কিছু বুঝতাম না, কিন্তু মনে আছে অত বড় হলে সবাই চুপ করে তাঁর কথা শুনতো। কোন শব্দ বা আওয়াজ হতোনা।
আমি জানলার বাইরে নীচে নদী আর ঘাটের লোকজনের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতাম। মন পড়ে থাকতো মা’র কাছে।
তো একদিন বিকেলে বাবা যাচ্ছেন হাসপাতালে মা’র কাছে, আমি নাকি তাঁর সাথে যাবো বলে জেদ করে বলেছিলাম ,”আজ আর আনন্দময়ী মা নয়, আজ আমার মা।”
এটা ছিল আমায় নিয়ে মা’র অন্যতম প্রিয় আর গর্ব্বের গল্প।
৩) কৈশোরের কাশী
একটু বড় হবার পরে মা আমাকে নিয়ে প্রতি বছর গরমের বা পূজোর ছুটিতে কাশীতে গিয়ে দিদার কাছে চলে যেতেন। এক দেড় মাস কাটিয়ে আসতাম। মাসীরাও আসতেন। দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে রাণা মহল নামে একটা বাড়ীতে দোতলায় দিদা থাকতেন।
ট্রেণে কাশী যাবার একটা প্রধান স্মৃতি ছিল বেনারস স্টেশনের ঠিক আগে গঙ্গার ওপরে লম্বা ব্রীজ। সেই ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেণ যাবার সময়, ট্রেণের ভিতর থেকে একটা সমবেত কন্ঠে “জয় গঙ্গা মাইকি জয়” রব উঠতো। তাছাড়া কামরার প্রায় সবাই তাদের গঙ্গা মাই কে প্রণামী হিসেব নদীর জলে coin ছুঁড়তো, এবং সেগুলো ব্রীজের গার্ডার এ লেগে ঝনঝন একটা শব্দ হতো, সেই শব্দ এখনো কানে বাজে।
ট্রেণের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম বহু দূরে কাশীর গঙ্গার তীরের উঁচু বাড়ীগুলো, আর পাশ দিয়ে জলে নেমে যাওয়া ঘাটের সিঁড়ি। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে ভোলা প্রায় অসম্ভব। সত্যজিৎ রায় তাঁর “অপরাজিত” সিনেমায় কাশীর অনেক দৃশ্যের মধ্যে ব্রীজের ওপর ট্রেণ থেকে দেখা ওই দৃশ্য টা ব্যবহার করেছেন।
রাণামহলের বাড়ীতে আমার সমবয়েসী মাসতুতো ভাই রঞ্জু আর আমি অনেক হুটোপাটি করেছি এক সময়। ওই বাড়ীতে একটা বড় ছাত ছিল, ওই ছাত থেকে নদী আর নদীর চর দেখা যেত। আর দেখা যেত দূরে কুয়াশায় ঢাকা রেল ব্রীজ, ট্রেণ গেলে একটা গুমগুম শব্দও কানে আসতো। সেই রেল ব্রীজের ওপর দিয়ে গুম গুম আওয়াজ করে ট্রেণ চলে যেতো,যতক্ষন দেখা যায়, আমরা তাকিয়ে থাকতাম।
কাশীতে খুব ঘুড়ি ওড়ানোর চল ছিল, কাটা ঘুড়ি দুলতে দুলতে নদীর জলে গিয়ে পড়ছে এই দৃশ্যটা দেখতে আমার খুব ভাল লাগতো। একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে দুলতে দুলতে ভেসে জলে গিয়ে পড়ছে, এই দৃশ্য যে কতোটা মনোমুগ্ধকর হতে পারে তা বর্ণনা করা যাবেনা।
আর ছিল বাঁদরের উৎপাত। কিছু কিছু বাঁদর বেশ ভয়ঙ্কর ছিল, আমার এখনো মনে পড়ে যে একবার শিবুমামা (মা’র বড় মামা দিদার ভাই শ্রী মঙ্গল আচার্য্যর বড় ছেলে) কাশীতে এসেছেন। রঞ্জ আর আমি ওনার সাথে একদিন বাড়ীর ছাতে গল্প করছি এমন সময় একটা গোদা বাঁদর হঠাৎ কোন কারণে রেগে গিয়ে আমাদের দু’জনকে তাড়া করে এলো। শিবু মামা আমাকে আর রঞ্জুকে ওই দুর্দ্ধর্ষ বাঁদরের সামনে ফেলে প্রাণপনে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে দৌড়ে নেমে বাড়ীর ভিতরে চলে গেলেন। পরে শিবুমামা কে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের ফেলে পালালে কেন?
শিবুমামা বললেন, দুর্ ফেলে পালাবো কেন, আসলে বাঁদরটা তো আমাকেই…আর আমি তো তোদের থেকে অনেক বেশী জোরে দৌড়োই, দেখলি তো?”
একটা সময় রঞ্জু আর আমি দু’জনে দশাশ্বমেধ আর চৌষট্টি ঘাটের চারিপাশের রাস্তা ঘাট গলি সব চষে বেড়িয়েছি। দশাশ্বমেধের গলির মুখে বেশ কয়েকটা মিষ্টির দোকান ছিল, তার মধ্যে প্রথম দোকানে একটা ফর্সা গোলগাল কমবয়েসী হাসিখুসী লোক বসতো। কেন জানিনা এতদিন পরেও লোকটার চেহারা আমার মনে রয়ে গেছে। মিষ্টি কিনতে আমরা দু’জন ওই দোকানে প্রায় রোজই যেতাম। সারি সারি রং বেরং এর মিষ্টি রাখা থাকতো, সেই মন্ডা মিঠাইদের মধ্যে আমার প্রিয় ছিল রসগোল্লা, পান্তুয়া, ক্ষীরকদম্ব আর চমচম।
আর দশাশ্বমেধের গলি আটকে বসে থাকা বিশাল কিছু ষাঁড়ের কথা এখনো মনে পড়ে। বেশ সাবধানে তাদের পাশ কাটিয়ে আমরা যেতাম। কেউ ওদের বিরক্ত করার সাহস পেতামনা। শিবের শহরে ষাঁড়দের অবাধ গতিবিধি।
সেই সব দিনের কথা ভাবলে দিদার কথা খুব মনে পড়ে। তাঁর ফর্সা লম্বা চেহারা মাথায় কদমছাঁট চুল, পরণে সাদা থান, কেরোসিনের স্টোভের সামনে বসে রান্না করছেন, তাঁর এই ছবিটাই চোখে ভাসে, আর তার সাথে মনের মধ্যে ভেসে আসে কেরোসিনের গন্ধ। একটাও দাঁত নেই, তাই তাঁর গাল দুটো তোবড়ানো, কথা বলার সময় দিদার জিভটা বার বার গালের মধ্যে বোধ হয় দাঁত খুঁজে ঘুরে বেড়াতো। মা আর মাসীর সাথে গল্প করার সময় তাঁর মুখের মধ্যে জিভের ওই অবিশ্রান্ত ঘোরাফেরার জন্যে তাঁর ঠোঁটে একটা অদ্ভুত ওঠানামা হতো, যার জন্যে বেশ শিশুসুলভ ত ত করে কথা বলতেন তিনি, সেকথাও মনে পড়ে।
যৌবনে যিনি অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন, বার্দ্ধক্যে তাঁর চেহারার এই পরিবর্ত্তন হলো প্রকৃতির নিয়ম, এর থেকে কারুর রেহাই নেই।


৪) প্রফুল্ল দিদা
আর মনে আছে প্রফুল্ল দিদার কথা।
দিদার মত তিনিও আনন্দময়ী মা’র শিষ্যা ছিলেন। দিদাকে “দিদি” বলে ডাকতেন, দিদাও তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। মা’ মাসীরা ওনাকে প্রফুল্লমাসী বলে ডাকতেন।
আমাদের ছোটবেলায় পঞ্চাশের দশকে প্রফুল্লদিদার তখন বেশী বয়স নয়, মা’দের থেকে সামান্যই বড় হবেন। ছোটখাটো, ইংরেজী তে যাকে বলে petite, ফর্সা, ফুটফুটে সুন্দরী, আর মুখে সবসময় হাসি।
তাঁর পরণে সাদা থান, মাথায় ঘোমটা দিতেন, দিদার জন্যে মাঝে মাঝেই দরকার মতো বাজার করে আনতেন। আর রোদের মধ্যে হেঁটে আসার জন্যে তাঁর মাথায় ঘোমটা থাকতো, আর ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে থাকতো।
প্রফুল্লদিদা ছিলেন বালবিধবা। মা মাসীদের কাছে শুনেছিলাম স্বামী মারা যাবার পর প্রফুল্ল দিদারও বাপের বাড়ী বা শ্বশুর বাড়ীতে জায়গা হয়নি, খুব অল্প বয়েসে সেই আত্মীয়রা তাঁকে টিকিট কেটে ট্রেণে উঠিয়ে কাশী পাঠিয়ে দেয়।
যে সব বাঙালী বিধবাদের তাদের পরিবারে থাকার জায়গা হতোনা, তাদের মধ্যে অনেকেই তখন কাশী তে চলে আসতেন। এই সব বিধবাদের মধ্যে যারা অল্পবয়েসী এবং সুন্দরী ছিলেন কাশীতে এসে তাঁদের অনেকেরই এখানকার পুরুষদের কামনার শিকার হওয়া থেকে বাঁচার উপায় ছিলনা।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর মহাস্থবির জাতক বইতে (প্রথম খন্ডে) এই হতভাগিনী বাঙালী বিধবাদের কথা লিখে গেছেন। অনেক পরে পরিণত বয়সে সেই বই পড়ার সময় অবধারিত ভাবে আমার প্রফুল্লদিদা’র কথা মনে পড়েছিল।
প্রফুল্ল দিদা’র সেই হাসিখুশী সুন্দর চেহারাটা এখনো আমি ভুলতে পারিনা। তখন তো মেয়েদের প্রতি আলাদা আকর্ষন অনুভব করার বয়েস আমার নয়, তবু তাঁর প্রতি একটা অষ্পষ্ট ভাল লাগা মনের মধ্যে তৈরী হয়েছিল সেটা এখনো মনে পড়ে।
একাকিনী কাশীতে এসে প্রফুল্ল দিদার জীবন কেমন ছিল, তাঁর পরিবার থেকে তিনি কোন অর্থসাহায্য পেতেন কিনা, কামার্ত পুরুষদের কু’নজর তাঁর ওপর পড়েছিল কিনা এসব কিছুই আমার জানা নেই। তবে ধরে নিতে পারি যে তাদের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে প্রফুল্ল দিদা আনন্দময়ী মা’র কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
দিদার মত তিনিও তাঁর মাথাও সন্ন্যাসিনীদের মত ন্যাড়া রাখতেন। বাড়ীর বাইরে বেরোলে তাঁর মাথায় ঘোমটা থাকতো কিন্তু বাড়ীর ভিতরে তিনি ঘোমটা খুলে থাকতেন। মাথায় চুল না থাকলেও তাঁর স্বাভাবিক হাসিখুসী স্বভাবের জন্যে আমার চোখে তাঁর সৌন্দর্য্য একটুও ক্ষুণ্ণ হয়নি।
আমার মা দিদাকে নিয়মিত মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাতেন, সেই সাথে তিনি প্রফুল্ল দিদাকেও টাকা পাঠাতেন। সেই মানি অর্ডার এর receipt ফিরে আসতো , সেখানে প্রফুল্লদিদার হাতের লেখায় মুক্তোর মত গোটা গোটা মেয়েলী অক্ষরে লেখা থাকতো “দশ টাকা পাইলাম।”


৫) মেয়ে, অতএব দোষী
আমার ভাবতে অবাক লাগে উনবিংশ শতাব্দীর আলোকপ্রাপ্ত, নবজাগরণে উদ্ভাসিত বাংলায় এই অসহায় বাঙালী বালবিধবাদের ঠাঁই হয়নি।
বাঙালী বিধবাদের কাশীতে নির্ব্বাসন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও তাঁর সাথে যাঁরা বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা তৎকালীন “আদ্যোপান্ত পাঁকে ডোবা” হিন্দু বাঙালী সমাজের কতোটা বিরুদ্ধতার সন্মুখীন হয়েছিলেন, তা এই সব লেখা পড়লে বোঝা যায়।
যেমন তাঁর ‘পিঞ্জরে বসিয়া’ বইতে কল্যাণী দত্ত তাঁর মেজপিসিমা শিবকালীর ছোট জা’ ইন্দুমতীর কথা লিখেছেন। তিনি বিধবা হবার পরে তাঁর ভাশুর চাইতেন না তিনি শ্বশুরবাড়ি থাকুন। সবাই একজোট হয়ে কাশী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তাঁর জন্য মাসোহারা ঠিক হল একশো টাকা। ছ’মাস যেতে না যেতেই মাসোহারা কমতে থাকে। বড় ঘর ছেড়ে এক টাকার ভাড়ার বাড়িতে ঠাঁই হল। চব্বিশ ঘণ্টা তসরের কাপড় পরে, কমণ্ডলু হাতে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে ঘোরা সেই ইন্দুমতী কাশীর ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে মরলেন শেষকালে। কল্যাণী দত্ত লিখছেন, “আট ভাশুরপো মিলে পিসিমাকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। শেষে পাগল হয়ে ঠাঁই হয় মিশনের সেবাশ্রমে। পিসিমার খবর পেয়ে এক দিন কাশী গিয়ে দেখলেন, সম্পূর্ণ বিবসনা নগ্ন উন্মাদ ইন্দুমতী ‘মুখপোড়া ভগবানকে গালমন্দ করছেন।”
দেশ থেকে পাঠানো মাসোহারা কমে এলে অনেকে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করত, কেউ বা আত্মঘাতী হত। নিমাই ভট্টাচার্যর ‘গোধুলিয়া’ তে গল্পের নায়ক প্রদীপ কাশীতে বিধবা পিসির বাড়িতে থাকার সময় মণিপিসি, সুধাপিসি, সারদাপিসির কথা শুনতে গিয়ে জানল, দু’পাঁচ-দশ টাকা মানি অর্ডারে কোনও রকমে এই বিধবারা বেঁচে আছেন। বিধবারা অনেক কাল ধরে এ ভাবেই বাবা বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণার ভরসায় দিন গুজরান করতেন।
কিন্তু কাশীতে কেন?
কেননা কাশী মানেই মুক্তি, এ কথা চাউর হয়েছে অনেক কাল। ‘মহাস্থবির জাতক’-এ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী লিখেছিলেন, “প্রতি সকালে বিধবা বঙ্গবালারা গঙ্গাতীরে কপালে হাত ঠেকিয়ে কী চান? তাঁরা তো কাশী এসেইছিলেন মরবেন বলে। কারণ এখানে মরলে আর জন্মাতে হয় না, ওই নরকের জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে আর জন্মাতে চান না। তার জন্যও কাশীবাস। আসলে কাশী যেন এক কালে বাঙালির শেষ আশ্রয়।”
গালিব থেকে রামপ্রসাদ— সবাই একই বার্তা দিচ্ছেন। গালিব তো এ কথাও লিখেছিলেন, যে বান্দা কাশীতে দেহত্যাগ করে, বিশ্বাসীরা মানে, মোক্ষলাভও হয় তাঁর, আত্মা মুক্তি পায় দেহ থেকে, জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে ছুটি মেলে কাশী-মহিমায়। এই আকর্ষণেই তো আবহমান কাল ধরে বাঙালির কাশীযাত্রা আর কাশীবাস।
কিন্তু মুক্তি পাওয়া ছাড়াও বাঙ্গালী বিধবাদের কাশীতে পাঠিয়ে দেওয়ার অন্য একটা বিশেষ কারণ ছিল।
সেই কারণ ছিল পাপের বিদায়।
এই হতভাগিনী নারীদের মধ্যে অনেকেই কাছের আত্মীয় পুরুষদের কামের শিকার হয়ে গর্ভবতী হলে রক্ষনশীল হিন্দু সমাজে তাদেরই পাপী বলে ধরা হতো। এবং সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে তাঁদের কাশী পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
দুর্গাচরণ রায় তাঁর ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ বইতে লিখেছেন, “দেবতারা এক দিন ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলেন কাশীতে। দেখলেন, কয়েকটা বাচ্চা বাবার কথা জিজ্ঞেস করছে, মা-কে। পরিচয় জানতে চাইলে ইন্দ্রদেব বরুণদেবকে উত্তর দিচ্ছেন, “এদের এই অবস্থার কারণ— এরা বিয়ের দু’-এক বছরের মধ্যেই বিধবা হয়। বঙ্গদেশে যে হেতু তখনও বিধবাবিবাহ চালু হয়নি, তাই এরা স্বামী-সহবাসের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে সংযম-শিক্ষার অভাবে রিপুদমনে অসমর্থতা হেতু পরপুরুষ সহবাসে গর্ভবতী হয়। এদের মা-বাবা লোক সমাজের ভয়ে এবং ভ্রূণহত্যা মহাপাপ মনে করে তীর্থযাত্রার নামে তাদের বারাণসী তীর্থে বনবাস দিয়া গিয়াছেন। কারও বাড়ি থেকে কখন কখনও কিছু খরচ আসে, অনেকের তাও জোটে না। আস্তে আস্তে এই কাশী সব ‘পাপীদের’ আখড়াতে পরিণত হতে লাগল।”
প্রায়শ্চিত্ত করবেন কোথায়? জায়গা একটাই— কাশী। এ শহরে গঙ্গায় স্নান করে বিশ্বনাথ দর্শন করলেই সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ।
বিধবাদের এই আসার হিড়িক দেখে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ ইন্দ্রদেব তো বরুণদেব কে বলেই বসলেন, “কাশীতেই তুলসীদাসের আশ্রম এবং রামানন্দের মঠ ছিল। আর এখন সেই কাশী কিনা বাঙ্গালী বালবিধবাদিগের আন্দামান।”
আস্তে আস্তে এ ভাবেই যেন কাশী ‘খারাপ মেয়েদের’ও আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করল। রেল হওয়ার পরে কাশীবাসী বাঙালি বিধবাদের সংখ্যা অনেকটা বেড়েছিল। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে পৌঁছোনো সব বয়সের পরিবার-পরিত্যক্ত বাঙালি হিন্দু বিধবাদের আশ্রয় দিল কাশী।
নারী নরকের দ্বার – বাঙ্গালী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই কথাটি সমধিক প্রচলিত।
কিন্তু প্রফুল্লদিদার সাথে যখন এ ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা তো উনবিংশ শতাব্দী নয়। সেটা বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। দেশ স্বাধীন হবার পরেও তখন বছর দশেক কেটে গেছে।
আজ এই লেখা লেখার সময় মেয়েদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে সন্দেহ নেই, বিশেষ করে শহরের মেয়েরা এখন বেশীর ভাগই শিক্ষিতা এবং স্বাবলম্বী। কিন্তু এখনো যৌন আক্রমণ বা যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলে সাধারনতঃ মেয়েদের দিকেই আঙুল তোলা হয়। সব দোষ মেয়েদের। কেন রাতে একা গিয়েছিলে, কেন ওই পোষাক পরেছিলে? ইত্যাদি।
এখনো আগের মতোই আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক রয়ে গেছে। প্রফুল্ল দিদারা এখনো সেই সমাজে পুরুষদের হাতে অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছেন।
এই নিয়ে কবি রণজিৎ দাশের “পুরুষ” কবিতার একটা অংশ নীচে দিলাম।
———————–
মনে রেখো, এ জীবন অশুভের, অদৃশ্য হিংসার/
মনে রেখো, এ জীবন আকাশের, শুভকামনার/
মনে রেখো, তোমার জীবনে আছে অন্ততঃ একজন/
অতন্দ্র প্রহরী – এক শুভাকাঙ্খী নারী/
যে তোমার মঙ্গলকামনায় মন্দিরে গিয়ে পূজো দেয়/
ফিরে এসে প্রসাদী ফুল তোমার মাথায় ছোঁয়ায়/
পরিবর্তে, তুমি কি নিজে কখনো, মন্দিরে নয়/
তোমার মানমন্দিরে গিয়ে, দূরবীনে চোখ রেখে, রাত্রির আকাশে/
অনন্ত শোভাময় নক্ষত্রলোকের কাছে প্রার্থনা করেছো/
এই নারীর মঙ্গলকামনায়?/
অন্ততঃ একবার এই পুরুষ জীবনে এই প্রার্থনার সৌন্দর্য্যটুকু অর্জন করো/
রাত্রির নক্ষত্রলোক জেগে আছে তোমারই আশায়/


৬ ) বাবা
বাবা মাঝে মাঝে দিল্লী থেকে এসে আমাদের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে যেতেন। তাঁকে স্টেশন থেকে তুলতে আমি আর মা যেতাম। বাবাকে নিয়ে স্টেশন থেকে বাড়ী যাবার পথে কাশীর রাস্তা ঘাট, দোকানপাট আর সাইনবোর্ড, সাইকেল রিক্সা, ঘোড়ায় টানা গাড়ী, পথচারীদের ভীড়, ল্যাম্প পোস্টে সিনেমার পোস্টারে রাজ কাপুর দেব আনন্দ নার্গিস আর মধুবালার ছবি – এই সব চোখে পড়তো।
ভারতবর্ষের প্রায় সব শহরের রাস্তাঘাটের ওই একই চেহারা।
বাবা কাশীতে এলে আমাদের দিনগুলো বড় ভাল কাটতো।
কয়েক দিন অনেকে মিলে বেড়ানো হত, নদীতে নৌকা চড়া হতো।
নদী থেকে তীরের লাল রং এর বাড়ী গুলো আর ঘাটের সিঁড়ি দেখতাম, ওপরে খোলা আকাশ, মাঝির দাঁড়ের আওয়াজে জলে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আসছে, আমি চলন্ত নৌকা থেকে জলে হাত নামিয়ে দিয়ে দেখছি কেমন ঠাণ্ডা। মণিকর্ণিকা বা হরিশচন্দ্র ঘাট এলে মা বলতেন জানো তো এখানে চিতার আগুণ কখনো নেবেনা। কাশীতে অনেক মরণন্মুখ মানুষ মারা যেতে আসেন, এই দুই ঘাটে দাহ করলে আর পুনর্জন্ম হয়না।
সারনাথের বৌদ্ধ স্তুপ আর মন্দির কাশী থেকে কাছেই, সেখানেও গিয়েছি মা বাবার সাথে।
ভোরবেলা মা আর বাবার সাথে সাইকল রিক্সায় চেপে বিশ্বনাথের মন্দিরে যাবার কথা মনে পড়ে। ভোরবেলা স্নান সেরে গরদ পরে মা পুজো দিতে যেতেন। অল্প দিনের জন্যে বাবাকে কাছে পেয়ে তিনি সে খুসী সেটা তাঁকে দেখেই বোঝা যেতো। স্বামী আর একমাত্র সন্তান কে নিয়ে তিনি যাচ্ছেন তাঁর প্রিয় দেবতা বিশ্বনাথের দর্শন করে তাঁর আশীর্ব্বাদ চাইতে। ভোরবেলা মন্দিরে যাবার পথে রিক্সায় মা’র ওই ঝলমলে সুখী চেহারাটা এখনো আমার চোখে ভাসে।
মা শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, যতদিন পেরেছেন শিবরাত্রি তে নির্জলা উপোস করেছেন। আর প্রায় সর্বক্ষন গুনগুন করে শিবস্তোত্র গাইতেন, যার মাধ্যে তাঁর গলায় “প্রণমামি শিবং শিব কল্পতরুং” কলি টা এখনো কানে বাজে।
বাড়ীর ছাদে বাবা আমায় পড়াতে বসতেন, হোমওয়ার্ক দেখে নিতেন। সতরঞ্চি পেতে আমরা বসতাম মনে পড়ে।
একদিন বাবার সাথে ইংরেজী ট্র্যানস্লেশন করছি। “সে ঘাসের উপর শুইয়া আছে” র ইংরেজী কি হবে? এখনো মনে আছে বাবা আমায় “He lay sprawling on the grass” বলার পরে বলেছিলেন, “মান্টু, তুমি কি sprawl কথাটা পেয়েছো আগে?”
তারপর থেকে আমি জীবনে যতবার ওই কথাটা কোথাও পড়েছি বা লিখেছি, কাশীর বাড়ীর ছাদে বাবার সাথে ইংরেজী পড়ার সকালটা আমার পরিস্কার মনে পড়ে গেছে। ছবির মতোন।
আর এক দিন বাবার সাথে ইংরেজী গ্রামারে Preposition শেখাতে গিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “Pull up মানে কি বলো তো?”
পুল্ আপ? এ তো সোজা প্রশ্ন।
আমি আমার সীমিত ইংরেজী ভাষার জ্ঞান নিয়ে বেশ বিজ্ঞের মত বলেছিলাম “পুল্ আপ মানে হলো টেনে তোলা।”
বাবা বলেছিলেন, “না, এটা একটা idiomatic use তার মানে বকুনী বা ধমক দেওয়া। যেমন The teacher pulled up his student for making a mistake.”
বাবা আর একটা কথা খুব বলতেন। যে সব নতুন শব্দ শিখছো সেগুলো নিজের লেখায় যতোটা পারো ব্যবহার করো। তাহলে শব্দ গুলো আর কোন দিন ভুলবেনা।
আর মনে আছে খুব গরম বলে মাঝে মাঝে আমি মা আর বাবার সাথে রাত্রে ছাদে খাটিয়া পেতে শুতাম। ঘুম আসার আগে পর্য্যন্ত মাথার ওপর তারাভরা আকাশে বাবা আমায় সপ্তর্ষি মন্ডল ধ্রুবতারা আর কালপুরুষ চেনাতেন। রাতের আকাশে তারারা কি পরিস্কার ঝিলমিল করে জ্বলতো তখন, আজকের মত ধুলো আর কুয়াশার আস্তরনে ঢাকা পড়ে থাকতোনা। বিশ্বনাথের গলির মোড়ে অনেক বেনারসী শাড়ীর দোকান ছিল, আমার মনে পড়ে একবার ছোড়দাদুর (দিদার ছোট ভাই দূর্গাপ্রসন্ন আচার্য্য, মা’র ছোটমামা) বড় মেয়ে রমা মাসীর বিয়ের বেনারসী কেনার ভার পড়েছিল মা’র ওপর। অনেক দোকান ঘুরে অনেক বাছাবাছি করে মা একটা বেশ দামী লাল বেনারসী পছন্দ করেছিলেন। মিষ্টি দেখতে একটি ছোট্ট মেয়ে আমারই বয়েসী– সম্ভবতঃ দোকানদারের মেয়ে – বিনুনী করে পরিপাটি চুল বাঁধা, একটা লাল ডুরে শাড়ি পরে এক পাশে বসে মা’র শাড়ী বাছা দেখতো, তাকেও ভুলিনি।


৭) ইমাদি’
দশাশ্বমেধ থেকে কাছেই গোধূলিয়াতে থাকতেন ইমাদি’ ও তাঁর স্বামী ডাক্তার সুশীল চৌধুরী। ইমাদি’ হলেন মা’দের হাজদি’র (হাজারী) বড় মেয়ে। তাঁর সংসারে বাড়ীভর্ত্তি লোকজন, সম্পন্ন যৌথ পরিবা্র।
ইমাদি’রা কাশীতে অনেক দিন আছেন, তাঁর স্বামী সুশীল বাবু খুব হাসিখুসী আলাপী লোক, চট করে সবার সাথে জমিয়ে নিতে পারেন, আর খুব উঁচু পর্দ্দায় কথা বলতে ভালবাসেন। তুলনায় ইমাদি’ তাঁর ঠিক উল্টো। ছোটখাটো মানুষ, কাটা কাটা সুন্দর মুখ, গায়ের রং একটু ময়লা, কিন্তু তাঁর চেহারায় একটা লালিত্য ছিল। এমনিতে তিনি খুব নরম, আস্তে আস্তে কথা বলেন। কিন্তু কম কথা বললেও তিনি যে সংসারের কত্রী সেটা তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে বোঝা যায়।
বেশ কয়েকবার আমরা ইমাদি’র বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি। ওঁদের বাড়ীটা তিনতলা, বেশ বড়ো, ছাদে একটা বিশাল টবের গাছের বাগান। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, আর বাঁদরদের উৎপাত থেকে জন্যে খোলা জায়গাটা লোহার জাল দিয়ে ঢাকা। ইমাদি’ অনেক আয়োজন করতেন, আর নিজে খাবার পরিবেশন করতেন। ছাদেই বাগানের পাশে মাদুর পেতে খাওয়া হতো। আমার মনে আছে এত বেশী খাবার আমি খেতে পারতামনা, কিন্তু ইমাদি’ তাঁর মিষ্টি গলায় এমন ভাবে আমায় আরো খেতে বলতেন, যে আমি না বলতে পারতামনা।


৮) পরিশিষ্ট
তারপরে তো অনেক দিন কেটে গেছে।
যে সব মানুষদের কথা এই স্মৃতিচারণে উল্লেখ করলাম, তাঁরা কেউই আর আমাদের সাথে নেই। দিদা চলে গেছেন, বাবা আর মা আর নেই, আমার খেলার সাথী রঞ্জুও বিদায় নিয়েছে।
কাশী অবশ্য এখনো আছে, এবং কাশীর গঙ্গা এখনো আগের মতই বয়ে যাচ্ছে।
ভূপেন হাজারিকা যা নিয়ে তাঁর বহুল প্রচারিত বিখ্যাত এই গান গেয়েছিলেন~
বিস্তীর্ণ দু’পারে, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও/
নিস্তব্ধে নীরবে গঙ্গা, ও গঙ্গা, তুমি বইছ কেন?/
সাথে সাথে এখনো রয়ে গেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ওপর নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতা।
আর রয়ে গেছে আমার মনের ভিতরে কোথাও ছবির মত লুকিয়ে রাখা এই ছোটবেলার কাশীর নানা স্মৃতি যার কথা এখানে লিখে রাখলাম। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অলস ভঙ্গী তে দুলতে দুলতে ঘুড়ি আকাশ থেকে নেমে আসে নদীর জলে। ছাতে উঠলে দেখা যায় দূরে নদীর ওপর ব্রীজে গুম গুম আওয়াজ করে ট্রেণ চলে যায়। দশাশ্বমেধ এর গলি আটকে শুয়ে থাকে বিশাল ষাঁড়, আমি আর রঞ্জু সাবধানে তার পাশ কাটিয়ে চলে যাই। গাছে গাছে কিচিরমিচির করে এক পাল বাঁদর। মিষ্টির দোকানে থরে থরে সাজানো থাকে চমচম, পান্তুয়া। বিশ্বনাথের গলির মোড়ে বেনারসী শাড়ীর দোকানে মা শাড়ী পছন্দ করেন, আর একটি মিষ্টি মেয়ে চুপ করে পাশে বসে থাকে।
এই সব ছবি আমার মনের মধ্যে একটা কোলাজ হয়ে জমে আছে এখনও।
সেই ১৯৬৫ সালের পর থেকে আর কাশী আসা হয়নি। বাবা বিশ্বনাথ না ডাকলে নাকি কাশী যাওয়া যায়না। সেই ডাকের অপেক্ষায় এতদিন বসে থেকে এবার এই ২০২৪ সালে শেষ পর্য্যন্ত ডাক এলো। মা আর আমার শ্বাশুড়ীর মৃত্যুর পরে তাঁদের আত্মাকে পিন্ডদান করতে আমরা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কাশী ঘুরে এলাম।
কিন্তু সে এক অন্য গল্প।
৯) উপসংহার
এই লেখার নাম দিয়েছি “নট্ কাশি খুকখুক”।
এই বাক্যবন্ধ টি সত্যজিৎ রায়ের ষাটের দশকের ছবি “মহাপুরুষ” থেকে নেওয়া। সংলাপটি ছিল কৌতুকাভিনেতা হরিধন মুখোপাধ্যায়ের মুখে। যাকে বলছেন তিনি যাতে কাশী শহর আর খুকখুকে কাশি এই দুটি গুলিয়ে না ফেলেন তাই তাঁর এই প্রাঞ্জল ব্যাখা।
আর এই পোস্টের রঙীন ছবি গুলি আমাদের এপ্রিল মাসে কাশী বেড়ানোর সময়ে তোলা।

-
রঞ্জু ও নকশালবাড়ী আন্দোলন

ছোটবেলায় রঞ্জু
১) সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজ রোপন
রঞ্জু আর আমি ছিলাম পিঠোপিঠি ভাই। আপন ভাই না, আমরা ছিলাম মাসতুতো ভাই, কিন্তু আপন এর থেকেও বেশী আপন। যাকে বলে অভিন্নহৃদয়, মাণিকজোড়, হরিহরাত্মা।
মা’রা ছিলেন পাঁচ বোন। এদের মধ্যে মা (সরস্বতী) আর মাসী (ভগবতী) কলকাতায় থাকতেন। গায়ত্রী মাসী থাকতেন পাটনায় আর ছোটমাসী (পার্ব্বতী) থাকতেন মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে, পরে ভোপালে।
কলকাতায় থাকার দরুণ মা আর মাসীর মধ্যে একটা গভীর ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাসী যেহেতু মা’র থেকে প্রায় আট বছরের বড়, মা’র প্রতি তাঁর একটা স্নেহের ভাব ও ছিল। মা’ও তাঁর ভাগু দি’কে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন।
দুই বোন ই তাদের প্রথম সন্তান কে হারিয়ে পরের সন্তান কে আঁকড়ে ধরেছিলেন। মাসী রঞ্জুকে, মা আমাকে। আমরা দু’জনেই আমাদের মা’দের একমাত্র সন্তান। তাছাড়া তাঁরা দুজনেই তাঁদের স্বামীদের (মেসোমশায় ১৯৬১, বাবা ১৯৬৫) কয়েক বছরের মধ্যে বিধবা হন্। দুই বোনের ভিতরে bonding এটাও একটা বড় কারণ ছিল।
মাসীরা থাকতেন এন্টালীতে ক্রীস্টোফার রোডে CIT Buildings এ। একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতি রবিবার মা আর আমি ৩৩ নম্বর বাসে চেপে হাজরা মোড় থেকে পদ্মপুকুর স্টপে নেমে কাছেই হাঁটাপথে মাসীর বাড়ীতে এসে সারাদিন কাটাতাম। ওখানেই খাওয়া হতো। তারপর সারা দুপুর আর বিকেল মা’রা দুই বোন বিছানায় বসে গল্প করতেন,আমি আর রঞ্জু বাইরে ওর বন্ধুদের সাথে খেলতাম, অথবা দু’জনে বাড়ীতে বসে একসাথে কোন বই পড়তাম, অথবা ক্যারম খেলতাম।
এই ভাবেই আমাদের ছোটবেলায় দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা তৈরী হয়। মা আর মাসীর মধ্যে যে ভালবাসা ছিল সেটাই মনে হয় আমাদের দু’জনের এক অপর কে ভাল লাগা এবং ভালাবাসার কারণ।
স্কুলের পালা শেষ করে আমরা কলেজে ভর্ত্তি হলাম ১৯৬৩ সালে। আমি গেলাম খড়্গপুরে। রঞ্জু ভর্ত্তি হলো কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের কাছে ওয়েলেসলি স্ট্রীটে মৌলানা আবদুল কালাম কলেজে।
কলেজে যাবার পর থেকে আমাদের পথ ক্রমশঃ আলাদা হতে শুরু করলো। দু’জনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা না কমলেও জীবনের নানা বাধ্যবাধকতা কে মেনে নিয়ে আমরা ক্রমশঃ এক অপরের থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগলাম।
এই সময় থেকে রঞ্জু বাম রাজনীতির দিকে ক্রমশঃ আকৃষ্ট হতে থাকে। বাড়ী ছেড়ে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে গিয়ে থাকার পর থেকেই তার মার্ক্সিস্ট আদর্শে হাতে খড়ি। অনেক পোড় খাওয়া বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত radical ছাত্র তখন প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াশোনা করে, এবং তাদের সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে মেশার ফলে রঞ্জু ক্রমশঃ বাম আদর্শের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।
আমি যখন খড়্গপুর থেকে ছুটিছাটাতে কলকাতায় আসতাম তখন থেকেই আমি তার এই পরিবর্ত্তনটা লক্ষ্য করি। তার মুখে তখন শুধু দ্বন্দ্বমূলক সমাজবাদের (Dialectical Materialism) কথা, আমায় বেশ কিছু Marx আর Engels বইও সে তখন দিয়েছিল পড়তে। খুব উৎসাহ নিয়ে সে আমায় মার্ক্সীয় তত্ত্ব বোঝাতো। সেই সব কঠিন তত্ত্ব আমার মাথায় না ঢুকলেও আমি হুঁ হাঁ করে শুনে যেতাম। ওর উৎসাহে জল ঢালতে ইচ্ছে করতোনা।
ব্যাপারটা যে কোন দিকে গড়াবে তখন আমি আন্দাজ করতে পারিনি।
তবে এটা বুঝেছিলাম যে রঞ্জুর মনের মধ্যে সমাজের অসাম্য একটা বিপুল এবং গভীর প্রভাব ফেলছে। তার ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বন্ধুরাই তার মাথায় এই সব চিন্তা রোপন করছে কিনা তা তখন জানতামনা।
তবে আমাদের আলোচনার মধ্যে প্রায়ই এই সামাজিক বৈষম্য নিয়ে তার রাগ আর অসহিষ্ণুতা আমি দেখতে পেতাম। এই যে একজন গরীব লোক রিক্সা টানছে, আর একজন দামী গাড়ী চড়ছে, এই যে একজন শীতের রাত রাস্তায় শুয়ে কাটায় আর একজন শোয় দুগ্ধফেননিভ শয্যায় তার বিলাসবহুল প্রাসাদে, কেন এরকম হবে? ফুটপাতে শীতের রাতে ঠান্ডায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকে, পথের শিশু রা খেতে না পেয়ে কাঁদে, এই সব দৃশ্য রঞ্জুর মনে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করতো।
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে তার সহানুভূতি আর তার এই প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী স্বভাবটি রঞ্জু পেয়েছিল তাঁর বাবা – আমার মেসোমশায়ের কাছ থেকে। মেসোমশায় তাঁর যৌবনে ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, এমন কি তিনি অনুশীলন সমিতির ও সভ্য ছিলেন শুনেছি। বেশ কয়েক বছর ব্রিটিশ আমলে তিনি জেলেও ছিলেন, এবং জেল থেকেই তিনি ইংরেজি আর ফিলসফিতে কৃতিত্বের সাথে MA পরীক্ষায় পাশ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে মানুষের ওপরে মানুষের অন্যায় এবং অত্যাচার হয়ে এসেছে, এবং একই সাথে সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ করে এসেছে আরও একদল প্রতিবাদী মানুষ।
সবাই প্রতিবাদ করেনা, অনেকে এই সব অত্যাচার মাথা নীচু করে মেনে নেয়। কিন্তু রঞ্জু সেই দলে ছিলনা।
কবি বলেছেন~ “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা দোঁহে যেন তৃণ সম দহে।”
রঞ্জু অন্যায় সহ্য করেনি। সে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছিল।


যৌবনে রঞ্জু
২) বাংলায় ভূমি সংস্কার আন্দোলন
আমাদের দেশে কৃষকদের ওপর অত্যাচারের দীর্ঘ ইতিহাস। সেই মোগল দের সময় থেকেই জমিদার এবং মুসলমান শাসকদের কাছে খাজনা দিতে গিয়ে গরীব চাষীদের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে। এর ওপরে ছিল ভূমিহীন চাষী দের করুণ অবস্থা। তারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে অন্যের জমিতে ফসল ফলাতো। এক ভূমিহীন bonded labour কে নিয়ে প্রেমচন্দের সেই বিখ্যাত গল্প সদগতি নিয়ে সত্যজিৎ রায় একটা সিনেমা তৈরী করেছিলেন।
মোগলদের পরে এলো ব্রিটিশরা। তাদের শাসন ছিল আরও ভয়ঙ্কর। উনবিংশ শতাব্দীতে নীলচাষীদের ওপর তাদের অত্যাচার এবং নীলবিদ্রোহ নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ উপন্যাস সমাজে খুব সাড়া ফেলেছিল।
দেশ স্বাধীন হবার ঠিক আগে ১৯৪৬-৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলনের কথাও আমরা ভুলিনি। না ভোলার প্রধান কারণ ছিল গ্রামে ও শহরে সেই আন্দোলনের পক্ষে জনসাধারণের অসাধারণ সমর্থন পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে ও গণসঙ্গীতে তার প্রভাব পড়ে। কিছুদিন আগে আমরা তেভাগা আন্দোলনের ওপর মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প অবলম্বনে “হারানের নাতজামাই” নাটকটি দেখলাম। তেভাগাও কৃষকদের জমির অধিকার ও উৎপন্ন ফসলের দুই তৃতীয়াংশ অধিকার পাবার আন্দোলন ছিল।
তেভাগা আন্দোলন নিয়ে রচিত সলিল চৌধুরীর কালজয়ী গান এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে।
হেই সামালো হেই সামালো/
হেই সামালো ধান হো, কাস্তে টা দাও শান হো/
ধান কবুল আর মান কবুল/
আর দেবোনা আর দেবোনা/ রক্তে রাঙা ধান মোদের প্রাণ হো/
তারপরে তো ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো। পরাধীনতার হাত থেকে উদ্ধার পাবার পরে কুড়ি বছর পর তখন কেটে গেছে। পাঞ্জাব আর হরিয়ানায় সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছে, সেখানে সবাই ধনী কৃষক, তাদের বিশাল বিশাল জমি, তাছাড়া সরকারের প্রচুর অনুদান, ক্যানালে সেচের জল, বিদ্যুৎ এর পয়সা আর ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়না, ভালো বীজ দেওয়া হয়, তাদের ফসল সরকার ন্যায্য দামে (MSP – Minimum Sales price) কিনে নেয়। প্রত্যেকের দামী গাড়ী, ট্র্যাক্টর।
আমাদের বাংলায় অবশ্য এসব কিছুই হয়নি। আমাদের অসুবিধে ছিল অনেক কৃষক এবং সবার ছোট ছোট জমি। অনেক ভূমিহীন চাষী আর তার ওপরে আছে জমিদার আর জোতদার (যারা ধনী আর ক্ষমতাশালী কৃষক) দের অত্যাচার।
ষাটের দশকের শেষে (১৯৬৭) যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সেই সরকার এর দুই নেতা মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোনার ও বিনয় চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের কাজ শুরু করেন।
তাঁরা বড় জমির মালিকদের হাতে থাকা ভূমি সিলিং আইনের অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত জমি এবং বেনামি জমি রাষ্ট্রের কাছে অর্পণ করেছিলেন। এইভাবে অর্পিত ভাল কৃষি জমি পরবর্তীকালে ২৪ লক্ষ ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকের মধ্যে জমি বিতরণ করা হয়।
এ ছাড়াও তাঁরা অপারেশন বর্গা শুরু করেছিলেন, যার মধ্যে দিয়ে ধনী কৃষক রা তাদের জমির কিছু অংশ বর্গাদার দের নিজের খরচে চাষ করার জন্যে দেন এবং বিনিময়ে উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ বর্গাদারের কাছ থেকে পান্। যুক্তফ্রন্ট সরকারের এই উদ্বৃত্ত ভূমি বন্টন আর অপারেশন বর্গা বাংলায় অসাধারণ সাফল্য লাভ করে।
কিন্তু ইতিমধ্যে ষাটের দশকের শেষের দিকে (১৯৬৯ সালে) চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয় নকশাল আন্দোলন এবং এক ঝাঁক মেধাবী এবং বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত যুবক সেই নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ী থেকে প্রধানতঃ এই কৃষি আন্দোলন এর উৎপত্তি। গ্রামের গরীব কৃষক দের ওপর ধনী জোতদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদ থেকেই সেই আন্দোলনের শুরু।
রঞ্জু এই নকশাল আন্দোলনে সামিল হয়।
এর পরেই শুরু হয়ে যায় যুক্তফ্রন্টের কম্যুনিস্ট শাসকদের সাথে নকশালদের বিরোধ। দুই দলই কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী, এবং দুই দলেরই লক্ষ্য জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কৃষকদের ওপর জোতদার আর ধনী কৃষক দের অন্যায় অত্যাচার দূরীকরণ, জমিহীন দের জমি বন্টন, ফসলের সুসংহত ভাগ ইত্যাদি। যুক্তফ্রন্টের প্রধান দল সি পি এম – কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট) যারা তখন সরকারে। আর নকশাল দের নেতা চারু মজুমদার আর কানু সান্যালরা তাদের পার্টির নাম দিলেন কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) – সি পি এম এল। অর্থাৎ তাঁরা হলেন সি পি এম এর থেকেও বেশী জনদরদী। এবং তাঁদের আন্দোলন হলো চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর অনুগামী। আর সেই আন্দোলন হলো সশস্ত্র, হিংসাত্মক।
একজন বাম, আর একজন অতি বাম।
এই দুই দলে অনেক আলোচনা হলো কিন্তু একসাথে এগোবার কোন সূত্র পাওয়া গেলনা।

আসানসোলে মামাবাড়ীর বাগানে রঞ্জু আর ভাস্বর – সাথে বোনেরা
৩) নকশালবাড়ী আন্দোলন
নকশাল আন্দোলনের নেতাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজের দুই শ্রেণীর অর্থাৎ এক দিকে ধনী কৃষক ও জোতদার এবং অন্যদিকে দরিদ্র এবং ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে একটা সাম্যের পরিবেশ তৈরী করা যেখানে কোন শ্রেণী বৈষম্য থাকবেনা।
কিন্তু প্রথম থেকেই নকশাল আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। গ্রামে গ্রামে জোতদারদের ঘর বাড়ী তে আগুণ লাগিয়ে দেওয়া, তাদের ক্ষেতের ফসল কেটে নেওয়া, এবং শেষে ধনী জমিদার এবং বড় কৃষকদের নৃশংস ভাবে খুন করা শুরু হয়। তারপরে ক্রমশঃ সেই অনিয়ন্ত্রিত অরাজকতা গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
চারু মজুমদার নকশালদের এই হত্যালীলার নাম দিয়েছিলেন “শ্রেণী শত্রু খতম।”
কলকাতার রাস্তা ঘাটে দেয়ালে তখন লেনিন আর মাও সে তুং এর ছবি তে ছয়লাপ। আর হাজার হাজার পোস্টারে লেখা “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান!” “সত্তরের দশক মুক্তির দশক” ইত্যাদি। কে বা কারা তাদের এই সব কাজের জন্যে টাকা জোগাতো জানিনা।
কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের পথে গিয়ে নকশালবাড়ী আন্দোলন রাষ্ট্রের রোষের মুখে পড়ল। নকশালদের এই আইনের শাসন কে তোয়াক্কা না করা আন্দোলন কে তারা মানবে কেন? তারা সেই আন্দোলন কে রাষ্ট্রবিরোধী ঘোষণা করে পুলিশ দিয়ে তাদের দমন করতে শুরু করলো। এর ফলে নকশালরা রাস্তা ঘাটে পুলিশ দেখলেই তাদের নির্ব্বিচারে মারতে শুরু করে। এর ফল হয় আরো মারাত্মক।
এবার পুলিশও নির্ম্মম হতে শুরু করে, তারা একতরফা মার খাবে কেন? ধরপাকড় শুরু হলো, জেলে নিয়ে গিয়ে বহু তরুণ বিদ্রোহীর ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলো। Encounter এর নাম দিয়ে অনেক বন্দী যুবক কে ছেড়ে দিয়ে তাদের পিছন থেকে পুলিশ গুলি করে মারে।
আমাদের মাসতুতো দাদা রতন দা’ তখন লালবাজারে পুলিশের সার্জেন্ট। তাঁকে কাজে রাস্তা ঘাটে ডিউটি করতে হয়। বেচারা রতন দা’র অবস্থা তখন বেশ খারাপ। রাস্তায় বেরোলে তিনি সব সময় পকেটে পিস্তলে হাত রেখে ঘোরেন। কিন্তু কেউ পিছন থেকে এসে ছুরি মারলে পিস্তলে কোন কাজ হবেনা। তাই রতনদা’ বাইরে বেরোলে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকেন।
রতনদা’ আমাদের বড়মাসীর ছেলে, তিনি আমাদের ছোটমাসী পার্ব্বতীর বয়সী। সুতরাং আমার আর রঞ্জুর থেকে তিনি বয়সে অনেকটাই বড়। আমাকে আর রঞ্জুকে তিনি খুবই স্নেহ করেন, সুতরাং তাঁর পক্ষে রঞ্জুকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার তো কোন প্রশ্নই নেই।
সেই দিনগুলোতে রতন দা’ পড়ে গিয়েছিলেন এক উভয়সঙ্কটে।
এই সময় ১৯৬৯ সালে আমি Indian Oil Corporation এ কাজে join করে প্রথমে মুম্বাই ও পরে উত্তর প্রদেশের নানা শহরে কাজ নিয়ে চলে যাই। শুনেছি সেই সময় রঞ্জু পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো, পালা করে করে চেনা শোনাদের বাড়ীতে রাত কাটাতো। মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীতেও সে বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছে।
একবার নাকি মাঝ রাতে আমাদের বাড়ীতেও রঞ্জুকে খুঁজতে এসেছিল পুলিশ।
রঞ্জু ধরা পড়লে পুলিশের হাতে তার কি অবস্থা হবে সেই ভেবে রঞ্জুর জন্যে মাসী আর মা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন।
নকশাল আন্দোলন এর উদ্দেশ্য যে ঠিক কি ছিল, তা বোঝা মুস্কিল। বিশাল দেশের একটা ছোট প্রদেশে কিছু লোক মেরে আর ক্ষেতে বাড়ীতে আগুণ লাগিয়ে কি বিপ্লব তারা আনবে ভেবেছিল আমি জানিনা। রঞ্জুর মত অনেক শিক্ষিত বুদ্ধিমান এবং আদর্শবাদী যুবক কোন বিপ্লবের আশায় চারু মজুমদারের এই মারণ যজ্ঞে যোগ দিয়েছিল তাই বা কে জানে। ওরা কি ভারতবর্ষে ফরাসী বা রুশ বিপ্লবের মত কিছু করবে আশা করেছিল?
রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সাফল্য লাভ করার জন্যে যে বিশাল জন আন্দোলন দরকার, নকশাল আন্দোলন ততটা জনসমর্থন পায়নি। শেষের দিকে বরং গ্রামে কিছুটা সমর্থন থাকলেও শহরে তারা অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬/৪৭ সালের তেভাগা কৃষক আন্দোলনের সময় বাংলা সাহিত্য নাটক সঙ্গীতে যেরকম সাড়া জেগেছিল, নকশাল আন্দোলনে সেরকম কোন উন্মাদনা চোখে পড়েনি। ওই আন্দোলন নিয়ে যে লেখালেখি হয়েছে, সবই তাত্ত্বিক মতাদর্শের কচকচি। পন্ডিতি ফলানো ছাড়া যার আর কোন উদ্দেশ্য ছিলনা। মাও সে তুং এর পথই নাকি তাদের পথ। সেই পথেই নাকি মুক্তি। মাও তাঁর দেশের অধ্যাপক, ডাক্তার, শিক্ষক, শিল্পী সবাই কে গ্রামে ক্ষেতের কাজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কি লাভ হয়েছিলো তাতে ?
মাওয়ের সময় থেকেই চীনে এক (কম্যুনিস্ট) পার্টির শাসন, অর্থাৎ সেখানে গণতন্ত্র কোনদিনই ছিলনা,আজও নেই। আজ সেখানে পুঁজিবাদ রমরম করে চলছে সেখানে অনেক ধনী বিলিওনেয়ার। কিন্তু সেখানে আজও গণতন্ত্র নেই।
আমাদের ভারতবর্ষ হলো গণতান্ত্রিক দেশ এবং আমাদের সংবিধানে তা পরিস্কার বলা আছে। নকশালরা কি আশা করেছিল যে তারা ভারতবর্ষে গণতন্ত্র মুছে দিয়ে এক পার্টির স্বৈরতন্ত্র আনবে?
জানিনা।
তবে এটা জানা যে বহু তত্ত্বের কচকচি দিয়েও এই আশা পূরণ করা প্রথম থেকেই অসম্ভব ছিল।
এই আন্দোলনে সামিল হয়ে রঞ্জু তার ব্যক্তিগত জীবনে তার আদর্শের জন্যে অনেক আত্মত্যাগ করেছে। নিজের কথা ভাবেনি। দেশের কথা ভেবেছে, গরীব মানুষদের জীবনে পরিবর্ত্তন আনার কথা ভেবেছে। নিজের চাকরী যায় যাক, নিয়মিত কাজে কামাই করে গেছে রঞ্জু। মাসীর কথাও ভাবেনি সে। পালিয়ে পালিয়ে লুকিয়ে কোথায় না থেকেছে সে তখন। কখনো কলকাতায় কোন বস্তীতে কখনো কোন গ্রামে কোন চাষীর বাড়ীতে।
তার তখন পাখীর চোখ বিপ্লব। কিন্তু সে যে একটা বিরাট মগজধোলাই এর চক্রান্তের শিকার হয়েছে, সেটা সে শেষ পর্য্যন্ত বুঝতে পেরেছিল কিনা আমি জানিনা।

রতনদা’, মাসী, মাসীমণি আর মা
৪ ) রঞ্জুর পুলিশের হাতে ধরা পড়া
শেষ পর্য্যন্ত ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার ধরা পড়েন। কাছাকাছি সময়ে রঞ্জু কেও পুলিশ ধরে হাজতে নিয়ে যায়। আমি তখন IBM এ কাজ নিয়ে দিল্লীতে ট্রেণিং এ।
মা আর মাসী খবর পেয়ে পাগলের মত লালবাজারে রঞ্জুকে দেখতে বার বার ছুটে যান্। রতনদা’ মা আর মাসীকে লালবাজারে পুলিশ কমিশনার এর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যান্। তা ছাড়া রতনদা’ হাজতে রঞ্জুর জন্যে মা আর মাসীর আনা খাবার ও পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করেছিলেন বলে শুনেছি।
অচিস্মান ঘটক নামে একজন পুলিশের বড়কর্ত্তা – বোধ হয় ডি এস পি ছিলেন – মা’দের যমশেরপুরের এক জ্যাঠতুতো দিদির (রাঙাজ্যাঠা – শ্রী দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচীর মেয়ে ঊষারাণী দি’) ছেলে ছিলেন। মা আর মাসী তাঁর হাজরা রোডের বাড়ীতে গিয়ে তাঁকে রঞ্জুর ওপর হাজতে যেন কোন শারীরিক অত্যাচার না করা হয় তা’র জন্যে অনুরোধ করেছিলেন।
এ ছাড়া যিনি রঞ্জুর সবচেয়ে বড় পরিত্রাতা হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আমাদের মনোহরপুকুরের বড় জামাই, শ্রী রমাবিলাস গোস্বামী – আমাদের সকলের জামাইবাবু। রঞ্জু কে তিনি খুব ভাল চিনতেন, কেননা রঞ্জু প্রায় মনোহরপুকুরের বাড়ীর ছেলের মতোই হয়ে গিয়েছিল।
জামাইবাবু তখন ছিলেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের জজসাহেব। পুলিশের অনেক বড় ছোট কর্ত্তার সাথে তাঁর দহরম মহরম ছিল। বিশেষ করে পুলিশের এক কুখ্যাত অফিসার – রণদেব (রুণু) গুহ নিয়োগী – কয়েদীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করার জন্যে যাঁর দুর্নাম ছিল – তাঁর সাথে জামাইবাবুর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল।
জামাইবাবুর জন্যেই রঞ্জুর ওপরে পুলিশ কোন অত্যাচার করেনি।
তার আরো একটা কারণ ছিল এই যে পুলিশ জেনেছিল যে রঞ্জু নিজে ওদের দলের কোন উঁচু নেতা ছিলনা, এবং কোন খুনোখুনির ঘটনায় ও সে জড়িত ছিলনা।
সে ছিল শুধুমাত্র একজন আদর্শবাদী যুবক, নকশাল আন্দোলনের প্রতি যার মতাদর্শের মিল ছিল, এবং সে ছিল পার্টির এক নীচুতলার কর্ম্মী, সে তার পার্টির জন্যে ছোটখাটো কাজ করতো, কোন নৃশংস হত্যাকান্ড বা অন্য কোন সেই জাতীয় অপরাধের সাথে তার কোন যোগ ছিলনা।
যাই হোক, এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। পুলিশের হাত থেকে অল্পদিনের মধ্যেই রঞ্জু ছাড়া পেয়ে আবার তার পুরনো জীবনে ফিরে আসে।

বিয়ের পরে দেবযানী আর রঞ্জু

সুভদ্রা আর আমি আইরনসাইড রোডের বাড়ীতে রঞ্জু গার্গী আর দেবযানীর সাথে

আইরনসাইড রোডের বাড়ীতে মা আর মাসীর সাথে আমি আর রঞ্জু
৫ ) আবার সে এসেছে ফিরিয়া
WBCS পরীক্ষা দিয়ে সে Sales Tax এর অফিসার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বহুদিন কাজে না যাওয়ায় তার মাইনে আটকে তাকে শো কজ করা হয়েছিল, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই কাজ সে ফিরে পায়, এবং অফিসার হিসেবে তার কাজে সুনাম হয়। পরে সে Sales Tax Officers’ Association এর সেক্রেটারীও হয়েছিল। একবার কোন কারণে ওর সাথে দেখা করতে বেলেঘাটাতে ওদের অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানে তার প্রতিপত্তি দেখে খুব ভাল লেগেছিল। বহু লোক ওর সাথে দেখা করে ওর কাছ থেকে নানা আদেশ ও পরামর্শ নিচ্ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল যে ওখানে তার যথেষ্ট সন্মান, খোদ কমিশনার সাহেবও ওর কাজে খুব সন্তুষ্ট।
আবার সে আমাদের সাথে হেসে খেলে দিন কাটায়। আমরা ভাইবোনেরা একসাথে কলকাতার কাছে বেড়াতে যাই, রঞ্জু আমাদের মধ্যে থাকে মধ্যমণি হয়ে। কখনো ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, কখনো ব্যান্ডেল কখনো মায়াপুর, কখনো বোটানিকাল গার্ডেন্স।
মনোহরপকুরে সবাই মিলে তাস আর ক্যারম খেলা জমে ওঠে।
কিছু পরে আমাদের দু’জনেরই বিয়ে আর সন্তান হয়, আমরা নিজের নিজের সংসারে প্রবেশ করি। নিজেদের আলাদা বৃত্ত তৈরী করে নিই। নানা ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরী হতে থাকে।
তারপর ঘটনাচক্রে জীবিকার তাগিদে আমি বিদেশ চলে যাই।

মায়াপুরে রঞ্জু আর দেবযানীর সাথে সুভদ্রা আমি আর খোকন

পিকনিকে প্যাডল বোটে রঞ্জু
রঞ্জু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু আমাদের মনে নানা স্মৃতির মধ্যে সে এখনো উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে। তার দুষ্টুমি ভরা হাসি আর সব সময় সবার পিছনে লাগার কথা এখনো মনে পড়ে।
সুভদ্রা গল্প করে যে একবার অনেকে মিলে দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হয়েছে। মন্দিরে দর্শন সেরে ফেরার সময় সুভদ্রা দেখে তার একটা চটি নেই। কোথায় গেল? অনেক খোঁজা খুঁজি করে যখন কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছেনা, হঠাৎ সুভদ্রার খেয়াল হলো এটা নিশ্চয় রঞ্জুর কাজ।
“এই রঞ্জু, কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার চটি?”
রঞ্জু “আমি কি জানি” বলে তার দুষ্টু হাসিটা হেসে শেষ পর্য্যন্ত বের করে দিয়েছিল সুভদ্রার চটি।
এই বার্ধক্যে পৌঁছে রঞ্জু কে খুব মনে পড়ে। আর তাকে মনে পড়লে অবধারিত মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের “হতভাগ্যের গান” কবিতার এই লাইন গুলো।
আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি/
আমরা দুখের বক্র মুখের চক্র দেখে ভয় না করি/
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য, বাজিয়ে যাবো জয়বাদ্য/
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীল আকাশ/
হাস্যমুখে অদৃষ্টের করবো মোরা পরিহাস/
ভগবানের কাছে রঞ্জুর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।
-
সামতাবেড় – শরৎকুঠি

সামতাবেড়ে শরৎচন্দ্রের বাসভবনের সামনে বাগানে তাঁর আবক্ষ মর্ম্মর মূর্ত্তি
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বন্ধুদের সাথে এক রাত্রের জন্যে কোলাঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ছিলাম রূপনারায়ণ নদীর ধারে সোনার বাংলা হোটেলে।
মনে আছে ১৯৬৩ সালে কলেজে ভর্ত্তি হবার ইন্টার byভিউ দিতে বাবার সাথে ট্রেণে খড়্গপুর গিয়েছিলাম। বম্বে এক্সপ্রেস, কোন স্টেশনে থামছিলনা, ট্রেণে বেশ ভীড় ছিল, আমাদের 2nd class unreserved কম্পার্টমেন্ট, সেখানে কোনমতে আমরা বসার জায়গা পেয়েছিলাম। হঠাৎ ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেণ চলার একটা গুমগুম আওয়াজ পেয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক ঘোলাটে মাটির রং এর নদীর ওপর দিয়ে আমাদের ট্রেণ চলেছে।
বাবা বললেন এ হলো রূপনারায়ণ নদী।
তখন ভরা বর্ষা, দুই কূল ছাপানো রূপনারায়ণ, সেই আমার প্রথম দেখা।
তারপরে তো পাঁচ বছরে এই ব্রীজের ওপর দিয়ে কতবার গেছি এসেছি। আমাদের খড়্গপুরে থাকতে থাকতেই সেখানে একটি দ্বিতীয় রেল আর রোড ব্রিজ তৈরী হয়েছে। কোলাঘাটের ঈলিশ আর পরের স্টেশন মেচেদা সিঙ্গাড়ার জন্যে বিখ্যাত ছিল। কলেজ জীবনে ঈলিশ কিনতে না পারলেও মেচেদায় চায়ের সাথে সিঙ্গাড়া খেয়েছি প্রচুর।
কোলাঘাটে আমাদের হোটেলটা ওই ব্রীজের পাশেই, নদীর ধারে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে মন চলে যাচ্ছিল সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোতে।


কোলাঘাটে রূপনারায়ণের তীরে ও হোটেলের বাগানে
শুনেছিলাম কোলাঘাটের আগের স্টেশন দেউলটির কাছে সামতাবেড় নামে একটা গ্রামে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা বাড়ী আছে। সেখানে এক সময় উনি থাকতেন। হোটেলে খোঁজখবর করে শুনলাম সামতাবেড় গ্রামটা আমাদের কলকাতা ফেরার পথেই পড়বে, দেউলটি পোঁছে মেন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে যেতে হবে, পথে সাইনবোর্ড আছে, আর কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তারা বলে দেবে।
সবাই মিলে ঠিক করলাম পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে চেক আউট করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কলকাতা ফেরার পথে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখে নেবো। শরৎবাবুর লেখার সাথে আমরা সকলেই কমবেশী পরিচিত। স্কুলে থাকতে ওনার অভাগীর স্বর্গ আর মহেশ এই দুটো গল্প তো আমাদের পাঠ্যই ছিল। তাছাড়াও শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম খন্ড পড়ার ফলে ইন্দ্রনাথ, ছিনাথ বহুরূপী, নতুনদা’, শাহজী আর অন্নদা দিদির সাথে আমাদের বেহ ভাল পরিচয় ছিল। বিন্দুর ছেলে রামের সুমতি নিষ্কৃতি ইত্যাদিও আমরা স্কুলে থাকতেই পড়েছি।
পরে বয়স বাড়লে শরৎচন্দ্রের লেখা আর তেমন পড়া হয়নি। সাম্প্রতিক লেখকেরা – যেমন স্কুলের উঁচু ক্লাসে তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণরা – আমায় গ্রাস করে নিয়েছিলেন। তারপর আমার কলেজ জীবনে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন জোয়ার এলো। রমাপদ চৌধুরী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘো্ষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল কর, আশাপূর্ণা দেবীরা এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। তার পরে এলেন সুনীল শীর্ষেন্দুরা।
এর মধ্যে আমি চলে গেলাম কুয়েতে।
সুতরাং একটা লম্বা সময় আমার শরৎচন্দ্রের কোন বই পড়ার সুযোগ হয়নি।
কুয়েত থেকে ২০১৬ সালে পাকাপাকি ফেরার পরে দেখলাম বাড়ীর আলমারীতে বেশ কিছু বই মা কিনে রেখেছেন। তার মধ্যে আছে শরৎ সমগ্র, বঙ্কিম সমগ্র, শরদিন্দু ওমনিবাস, রাজশেখর সমগ্র, সত্যজিৎ ১০০, ইত্যাদি। দেখে খুব খুসী হলাম, অবসরের পরে কোন কাজ নেই, এখন সারাদিনই বলতে গেলে বাড়ীতে, আর হাতের কাছে এত ভালো ভালো বই ! সময় কাটাতে আর কোন অসুবিধেই হবেনা।
প্রথমেই ধরলাম শরৎচন্দ্র সমগ্র।
এক এক করে সেই বই থেকে তাঁর সব উপন্যাস পড়ে ফেললাম। দেনা পাওনা, পন্ডিত মশায়, দত্তা, চরিত্রহীন, পুরো শ্রীকান্ত (চার খন্ড), বিরাজ বৌ, কত কি যে আগে পড়া হয়নি। শরৎচন্দ্রে প্রায় ডুবে রইলাম মাস দুয়েক।
পড়ে একটা জিনিষ বুঝতে পারলাম যে কেন সারা ভারতবর্ষে তাঁর সময়ে জনপ্রিয়তাতে শরৎচন্দ্রের কাছাকাছি কোন সাহিত্যিক ছিলেন না। তাঁর সব লেখা ভারতের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, এবং এখনও বাংলায় তো বটেই, শোনা যায় সারা ভারতে তাঁর লেখার কাটতি সব চেয়ে বেশী।
তাঁর সব উপন্যাসই নারীকেন্দ্রিক। পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তাঁর দরদ বেশী ছিল। আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তাঁর করুণা ছিল আরও বেশী। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন।
রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে এক জায়গায় নিখিলেশ তার স্ত্রী বিমলা কে জিজ্ঞেস করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা তার কেমন লাগে। উত্তরে বিমলা বলেছিলেন বঙ্কিম তাঁর অত্যন্ত প্রিয় লেখক, কেবল তাঁর নায়িকারা এত বেশী সুন্দরী বলে তাঁর খুব ঈর্ষা হয়।
সত্যিই তাই। বঙ্কিমের নায়িকারা সবাই দারুণ সুন্দরী। এবং তাঁর প্রায় সব উপন্যাসই (কিছু বাদ দিলে) মিলনাত্মক। এমন কি জন্মান্ধ ফুলওয়ালী রজনী ও শেষ পর্য্যন্ত দৃষ্টি ফিরে পায় এবং স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকে।
শরৎচন্দ্রের নায়িকারাও অনেকেই বেশ সুন্দরী ঠিকই, কিন্তু তাদের ভাল লাগে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা আর ব্যক্তিত্বর জন্যে। তাদের নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ ভালবাসা, অকুন্ঠ স্নেহ এবং সাংসারিক কাজে তাদের কর্ত্তব্যপরায়ণতার কোন তুলনাই চলেনা।
আর একটা ব্যাপার হল যে তাঁর অনেক উপন্যাসই বিয়োগান্ত। উপন্যাসের শেষে পন্ডিত মশায়ের কুসুম, চরিত্রহীন এর কিরণময়ী , বিরাজ বৌ এর বিরাজের করুণ পরিণতি দেখে পাঠকের মন খারাপ হবেই।
শ্রীকান্ত চতুর্থ পর্বে দেখি সে কোন কাজই করেনা, সারাদিন বাড়ীতে নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছে, কিন্তু তাও রাজলক্ষী তার সেবায় সব সময় ব্যস্ত। এই লুচি ভেজে আনছে, এই শরীর খারাপ বলে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে , কিংবা মাথায় জলপট্টি লাগাচ্ছে, এমন কি টাকা পয়সাও তুলে দিচ্ছে তার হাত খরচের জন্যে। অথচ শ্রীকান্ত নির্লিপ্ত, উদাসীন।
কি রে বাবা?
ওদিকে দেবদাস কে দ্যাখো। সে সারাদিন মাল খেয়ে চূর হয়ে থাকে, কি যে তার সমস্যা ভগবান জানেন। কিন্তু দুই সুন্দরী নায়িকা তার মন পাবার জন্যে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে।
এ আবার কি?
কিন্তু কি করা যাবে? শরৎচন্দ্রের নায়িকারা সবাই ওই রকমই। তারা দুঃখ পাবে, কষ্ট পাবে, শেষে ভিখিরি হয়ে পথে বসবে, তবু তারা শেষ পর্য্যন্ত তাদের সেবা আর ভালবাসার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবেনা। তারা হলো যাকে বলে আদর্শ নারী, সংকল্প থেকে তাদের টলানো অসম্ভব, সে যতোই না কেন বিপদ তাদের সামনে আসুকে।I
এই সব বাদ দিলে তাঁর সব বইতে সহজ করে বলা সাধারণ মানুষের গল্প আছে, বিশেষ করে গ্রামীন সমাজের নানা কথা উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর চরিত্ররা সবাই আমাদের চারিপাশের চেনা মানুষ – কেউ শঠ, কুটিল, স্বার্থান্বেষী আবার কেউ উদারমনস্ক, দয়ালূ, আদর্শবাদী। তাদের আমরা সহজেই চিনে নিতে পারি।




সামতাবেড়ের রাস্তায় সাইনবোর্ড আর শরৎ কুঠির গেটে মার্ব্বেল ফলকে ওনার লেখা
যাই হোক্, আমরা তো বেরিয়ে পড়লাম।
দেউলটি কোলাঘাট থেকে খুব বেশী দূরে নয়। সেখানে পৌঁছে রাস্তার পাশে একটা দোকানে খোঁজ করতেই তারা আমাদের রাস্তা বাতলে দিলো। বড় রাস্তা ছেড়ে আমরা গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। কিছুটা দূর এগোনোর পরে কিছু সাইনবোর্ড চোখে পড়লো।
একটা জায়গায় এসে রাস্তা খুবই সরু হয়ে গেছে, তাই আমাদের বাস আর এগোতে পারলোনা। আমরা বাস থেকে নেমে সাইনবোর্ড দেখে দেখে বাড়ীর গেটে পোঁছে গেলাম। গেটের পাশে বাইরে দেয়ালে বাঁধানো বোর্ড তাতে লেখা “বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বসত বাড়ী।” আর তার পাশে মার্ব্বেল ফলকে “মহেশ” থেকে একটি ছোট উদ্ধৃতি।
গেট দিয়ে ঢুকে সোজা পথ সামনে একটি লাল রং এর টালি দিয়ে ঢাকা একটি দোতলা বাড়ীর দিকে চলে গেছে। বাড়ীটি সুন্দর। গ্রাম্য পরিবেশ , চারিদিকে গাছগাছালি, সবুজে ঢাকা। বাড়ীর সামনে একটা পুকুর আর পুকুরঘাট ও চোখে পড়ল। সামনে কিছু কার্ত্তিক ঠাকুরের মাটির মূর্ত্তি।


বাড়ীর গেটের সামনে পুকুর, আর গেট থেকে তোলা বাড়ীর সামনে আমাদের গ্রুপ ফটো
এক বয়স্ক ভদ্রলোক নীচে দাওয়ায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন, আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। জানা গেল ওনার নাম দুলাল চন্দ্র লালা। সবাই এখানে ওনাকে লালাবাবু নামেই চেনে। উনি অনেকদিন থেকে এই বাড়ীতে আছেন, এখন তিনি এই বাড়ীর কেয়ারটেকার। শরৎচন্দ্রের পরিবারের অনুমতি নিয়ে তিনি এই বাড়ীর দেখভাল করেন, এবং আমাদের মত যাঁরা এখানে আসেন তাঁদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান।
শরৎ স্মৃতিরক্ষা কমিটি নামে একটি সরকারী সংস্থা এই বাড়ীটির রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে।
লালাবাবু আমাদের জানালেন যে এই বাড়ীটির নাম “শরৎ কুটির।”
শরৎচন্দ্র সামতাবেড় গ্রামে নদীর কাছে ১৯১৯ সালে জমি কিনে বাড়ী তৈরী করতে শুরু করেন। ১৯২৩ সালে বাড়ী তৈরী হবার পরে তিনি এখানে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হিরন্ময়ী দেবীর সাথে ১৯৩৪ সাল পর্য্যন্ত অর্থাৎ বারো বছর ছিলেন।
শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় শেষ দিকে কলকাতার বালীগঞ্জে অশ্বিনী দত্ত রোডে ১৯৩৪ সালে একটি বাড়ি তৈরি করিয়ে সেখানে গিয়ে থাকতে শুরু করেন।
আরও চার বছর পরে ১৯৩৮ সালে শরৎচন্দ্রের জীবনাবসান হয়।
শরৎচন্দ্রের জন্ম হয় হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে, সেখানে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে। পরে তাঁর কৈশোর কেটেছে বিহারের ভাগলপুরে তাঁর মামাবাড়ীতে। সেখানেও গ্রাম্য পরিবেশই ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। পরিণত বয়সে তিনি কয়েক বছর কাজ নিয়ে বর্ম্মার (এখন মিয়ানমার) রেঙ্গুন শহরে কাটিয়েছেন। তাঁর নানা লেখায় (শ্রীকান্ত – তৃতীয় পর্ব্ব – অভয়ার সাথে, পথের দাবী) সেই শহরের বর্ণনা আমরা পাই। বর্মাতে তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানের মৃত্যুর পরে তিনি দেশে ফিরে হাওড়ায় বাজেশিবপুরে দশ এগারো বছর কাটিয়ে তারপরে সামতাবেড়ে এসে থাকতে শুরু করেন।
কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিমি দূরে এই গ্রামে তিনি কেন বাড়ী তৈরী করে থাকতে এসেছিলেন তা পরিস্কার জানা নেই। তবে বাল্য আর কৈশোরে গ্রামে থাকার জন্যে গ্রাম্য জীবনের প্রতি তাঁর একটা টান হয়তো ছিল। তা ছাড়া সামতাবেড়ে লেখার জন্যে একটা শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ ও হয়তো তিনি চেয়েছিলেন। আর ছিল কাছেই রূপনারায়ণ নদীর আকর্ষণ।
লালা বাবু আমাদের বললেন শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ে থাকার সময় অল্প কয়েকটি মাত্র গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন। তাদের মধ্যে তিনি কেবল পথের দাবী আর বিপ্রদাস বই দুটির কথা বলেন। পথের দাবী ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হবার পরে সেই উপন্যাসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নায়ক সব্যসাচীর বিদ্রোহ কে শরৎচন্দ্র যে ভাষায় প্রশংসা করেছিলেন (“মুক্তিপথের অগ্রদূত”) তা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকের কাছে রাজদ্রোহ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯২৭ সালে বইটি বাজেয়াপ্ত হয়।

বাড়ীর একতলার দেয়ালে ফলক
লালাবাবু আমাদের এক তলার ঘর গুলো সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। ভিতরে ঢোকা যাবেনা, বাইরে জানলার গরাদের ভিতর থেকে আমরা দেখলাম তাঁর লেখার টেবিল, তার শোবার ঘর, সেখানে খাটে পরিস্কার সাদা চাদর পাতা, সাথে মাথার বালিশ আর পাশবালিশ।আরও একটা ঘর দেখলাম, লালা বাবু বললেন এই ঘর ছিল তাঁর হোমিওপ্যাথীর রোগীদের দেখার চেম্বার, সেখানে শরৎবাবু গ্রামের লোকেদের হোমিওপ্যাথীর চিকিৎসা করতেন।
শরৎচন্দ্র হাওড়া শহর ছেড়ে সামতাবেড়ে যখন থেকে বাস করতে থাকেন, তখন থেকে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র লোকদের অসুখে চিকিৎসা করা তাঁর একটা কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগী দেখে তিনি শুধু ওষুধই দাতব্য করতেন না, অনেকের পথ্যও কিনে দিতেন। হাওড়া শহরে থাকার সময় সেখানেও তিনি এই-রকম করতেন। শরৎচন্দ্র সামতাবেড় অঞ্চলের বহু দুঃস্থ পরিবারকে বিশেষ করে অনাথ বিধবাদের মাসিক অর্থসাহায্য করতেন।
এছাড়া তিনি আরো একটা ঘর দেখিয়ে বললেন যে সেই সময় শরৎচন্দ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সাথে অনুশীলন সমিতির গোপনে যোগাযোগ ছিল, এ বাড়ীর একটি ঘরে মাঝে মাঝে তাঁদের মিটিং আর আলোচনা হত।
লালাবাবু জানালেন সামতাবেড়ের এই শরৎকুঠি তৈরী করতে সে যুগে খরচ হয়েছিল মোট ১৭,০০০ টাকা। Burmese design এ তৈরী এই বাড়ীটি তাঁর বর্ম্মায় বাস করার স্মৃতির প্রেরণা হিসেবে ধরা হয়। এই বাড়ীর আসবাবপত্র সব বার্মা টিকের তৈরী।
এই বাড়ীতে শরৎচন্দ্রের নানা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিষ এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে। তাঁর হুকা, তাঁর লেখার টেবিল, তাঁর বইয়ের আলমারী আর একটা ছোট লাইব্রেরী, জাপানী দেয়াল ঘড়ি সব কিছুই লালা বাবু আমাদের দেখালেন।
শুনলাম এই শরৎ কুঠি এখন একটি সরকার ঘোষিত ঐতিহ্যের (heritage site) স্মৃতিসৌধ।




শরৎচন্দ্রের ঘরে রক্ষিত তাঁর নিত্য ব্যবহৃত লেখার টেবিল, ঘড়ি, বিছানা ও আসবাবপত্র
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দোতলায় ও উঠলাম আমরা। সেখানে চারিপাশে টানা বারান্দা, লাল পাথরের মেঝে। বারান্দার পাশে বেশ কিছু শোবার ঘর। বারান্দা থেকে নীচে শ্যামল সবুজ প্রকৃতির ছবি তোলা হল, আর নিজেদের কিছু গ্রুপ ফটো।
নীচে ফুলের বাগানে শরৎচন্দ্রের একটা মার্বেলের Bust রাখা আছে, আমরা সকলে তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ ফটো তুললাম।
বিদায় নেবার আগে লালাবাবুকে সন্মানী হিসেবে কিছু টাকা দিয়ে এবং আমাদের সব কিছু ভাল ভাবে দেখাবার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
ফেরার পথে বাসে যেতে যেতে শরৎচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ীটি দেখার সুযোগ পেয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়েছিল।


-
রঞ্জু আর অলিম্পিক
১
অলিম্পিক এলেই আমার রঞ্জুর কথা মনে পড়ে।
রঞ্জু আমার মেজমাসীর ছেলে, ছোটবেলা থেকেই আমরা ছিলাম যাকে বলে অভিন্নহৃদয়, হরিহরাত্মা। মা আর আমার মেজমাসী পিঠোপিঠি বোন ছিলেন, মাসী মা’র থেকে প্রায় আট বছরের বড় হলেও তাঁদের দুই বোনের মধ্যে দুর্দ্দান্ত bonding ছিল, মা আমায় নিয়ে ছুটির দিনে প্রায়ই হাজরা মোড় থেকে তেত্রিশ নম্বর বাসে চেপে এন্টালী তে মাসীর বাড়ীতে চলে যেতেন। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে মা আর মাসী দু’জনে বিছানায় মুখোমুখি বসে গল্প করতেন, আমি আর রঞ্জু বাড়ীতে কিংবা বাড়ীর বাইরে সারা দুপুর বিকেল খেলা করে বেড়াতাম। রঞ্জু ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত, সেই তুলনায় আমি শান্ত আর চুপচাপ ছিলাম, আমাদের দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব হবার সেটাও একটা কারণ হতে পারে।
এই ২০২৪ সালে এখন প্যারিসে অলিম্পিক চলছে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে চৌষট্টি বছর আগে ১৯৬০ সালের টোকিও অলিম্পিকের কথা। তখনই আমাদের প্রথম অলিম্পিক নিয়ে উৎসাহ শুরু হয়। আমরা সব পুরনো এবং সমসাময়িক অলিম্পিক hero দের সম্পর্কে পড়াশোনা করে নানা তথ্য আহরণ করতে শুরু করে দিলাম। এমিল জ্যাটোপেক, পাভো নুরমি, জেসি ওয়েন্স, বব্ বিমন, আবেবে বিকিলা, কিপজোগ কিনো, সারজি বুবকা, এদের সবার কীর্ত্তিকলাপ জানার জন্যে আমরা মাঝে মাঝে থিয়েটার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে চলে যেতাম। সেখানে World Sports পত্রিকার পাতায় পাতায় এইসব কিংবদন্তীদের নিয়ে অনেক খবর।
আসলে আমাদের ওই বয়সে মনের জানলা গুলো ক্রমশঃ খুলছে, তাই অলিম্পিকের আদর্শ, সারা পৃথিবীর দেশের athlete আর sportsman মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা সেই ১৯৬০ সালে আমাদের মনকে খুব উদ্বুদ্ধ আর অনুপ্রাণিত করেছিল মনে পড়ে। আমরা নিজেদের মধ্যে প্রায় “অলিম্পিক অলিম্পিক” খেলেছি, কখনো আমি জাপান, রঞ্জু চীন, কিংবা আমি East Germany, রঞ্জু Russia , অথবা আমি USA, রঞ্জু England ! রঞ্জুদের বাড়ীর একতলার সিঁড়িতে রবারের বল kick করে ওপরে পাঠিয়ে বলটা ক’বার drop করে নীচে নামলো, কিংবা দৌড়ে ওপরের তিন নম্বর ফ্ল্যাটের দরজা ছুঁয়ে কে আগে নেমে আসতে পারে এই সব হিসেব করে পয়েন্ট count করে আমরা নিজেদের সোনা রূপো ব্রোঞ্জ মেডেল দিতাম। ওই দেশগুলোর হয়ে আমরা অনেক মেডেল জিতেছি সেই সময়!
খেলাধূলার ব্যাপারে ক্রমশঃ রঞ্জুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা বাড়তে থাকে, খেলাধূলা সংক্রান্ত যাবতীয় খবর – Sports statistics – সমস্ত অলিম্পিক আর world রেকর্ড, বিশেষ করে track and field event এর, তাছাড়া দেশের এবং বিদেশের ক্রিকেট টেনিস আর ফুটবল এর কত খবর যে সে রাখতো ভাবলে বেশ অবাক লাগে। তখন তো আর এখনকার মত Google search বা Wikipedia ছিলনা, যে কোন Sports related information পেতে গেলে রঞ্জুই ছিল আমাদের প্রধান source…
২
শঙ্করীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ক্রিকেট নিয়ে দুটি বই লিখেছিলেন, “ইডেনে শীতের দুপুর” আর “বল পড়ে ব্যাট নড়ে”। এই দুটো বই ক্রিকেট এর ইতিহাস নিয়ে নানা ঘটনা আর তথ্যে সমৃদ্ধ ছিল, বিশেষ করে আদি যুগের ক্রিকেট, W G Grace থেকে Don Bradman পর্য্যন্ত ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বিশেষ করে বডিলাইন সিরিজ নিয়ে সেখানে অনেক লেখা ছিল। রঞ্জুর কাছে ওই বই দুটো ছিল, মাসীর বাড়ীতে খেয়ে দেয়ে উঠে সারা দুপুর প্রায়ই রঞ্জু ওই বই থেকে আমায় পড়ে শোনাতো। পড়তে পড়তে রঞ্জু উত্তেজিত হয়ে উঠতো, মনে হত ও যেন সেই সব দিনে গিয়ে ফিরে গেছে, তার চোখের সামনে খেলা হচ্ছে আর সে তার live ধারা বিবরণী দিচ্ছে। শঙ্করীপ্রসাদের লেখার গুণে আর রঞ্জুর সেই উত্তেজিত ভঙ্গী তে পড়া দুই এ মিলিয়ে সেই দুপুর গুলো দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠতো আমার কাছে।
সব চেয়ে বেশী মনে পড়ে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টাই টেস্টের কথা। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ব্রিসবেন এ খেলাটা হয়েছিল ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে। শঙ্করীপ্রসাদ তাঁর বই তে সেই টেস্ট ম্যাচ নিয়ে পুরো একটা chapter লিখেছিলেন, যার মধ্যে টানটান রোমাঞ্চে ভরা বিখ্যাত শেষ ওভার নিয়েই বেশ কয়েক পাতা লেখা হয়েছিল। সেই chapter টা রঞ্জু যে কতবার পড়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। পড়তে পড়তে তার ওই শেষ ওভারটা পুরোটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, পরের দিকে বই দরকার হত না, রঞ্জু গড় গড় করে তার ওই উত্তেজিত গলায় verbatim বলে যেত, আর আমরা যারা শুনতাম তারা রঞ্জুর সাথে সাথে উত্তেজিত আর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতাম।
রঞ্জু পড়ছে, তার গলা কাঁপছে উত্তেজনায়, চার নম্বর বল, মেকিফ যা থাকে কপালে বলে ধুমধাড়াক্কা ব্যাট চালালো। যাকে বলে তাড়ু। দুই রান হয়ে গেছে, দুই দলের এখন সমান সমান রান, এখন জেতার জন্যে আর এক রান দরকার। কিন্তু তৃতীয় রান নিতে গিয়ে কনরাড হান্টের অব্যর্থ থ্রো সোজা আলেক্সান্ডার এর হাতে। মেকিফ রান আউট।
রান সমান সমান। জিততে এক রান, হাতে দুই বল, এক উইকেট। সারা মাঠে তুমুল উত্তেজনা। কি হয়, কি হয়!
লাস্ট ব্যাটসম্যান লিন্ডসে ক্লাইন। এসেই সে সাত নম্বর বলে রান নেবার জন্যে ব্যাট হাঁকড়ালো। ব্যাটে বলে হলেও রান নেওয়া যায়না, বল গেছে সলোমনের হাতে। তা সত্ত্বেও রান নেবার জন্যে মরিয়া হয়ে আম্পায়ারের দিক থেকে মেকিফ ছুটলো উইকেট ছেড়ে, আর প্রায় বারো মিটার দূর থেকে সলোমনের থ্রো মেকিফের উইকেট ছিটকে দিল।
ম্যাচ টাই।
সারা বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাসে সেই প্রথম টাই ম্যাচ!
১৯৬০ সালের সেই ঐতিহাসিক প্রথম টাই টেস্টের পরে টেস্ট, লিমিটেড ওভার আর টি টোয়েন্টি ম্যাচে নেকবার টাই হয়েছে, কিন্তু প্রথম বারের মত সেই উর্ধশ্বাস উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ বোধ হয় আর কোন ম্যাচে হয়নি।
এখন তো ইউটিউব গুগল এই সব থেকে সেই ম্যাচটা চাইলেই দেখা যায়, সেই ম্যাচ নিয়ে বহু আলোচনা analysis ইত্যাদি সব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় তো সেসব ছিলনা, আমাদের ছিলেন শঙ্করীপ্রসাদ, আর ছিল রঞ্জু।
শঙ্করীপ্রসাদের লেখনীর গুণে আর রঞ্জুর অননুকরণীয় পড়ার সুবাদে মাসীর বাড়ীতে কাটানো সেই দুপুরগুলো আমার কাছে এখনও স্মরনীয় হয়ে আছে।
৩
রঞ্জু আর আমি খুব একসাথে কলকাতার রাস্তায় হেঁটেছি এক সময়। গল্প করতে করতে কতবার আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ী থেকে পার্ক সার্কাস হয়ে এন্টালীর সুন্দরীমোহন এভিনিউর কাছে ক্রিস্টোফার রোডে সি আই টি বিল্ডিং এ মাসীর বাড়ী (দুই নম্বর ব্রীজের পাশে) হেঁটে গেছি, উত্তর কলকাতা ভাল চিনিনা বলে দু’জনে শিয়ালদা’ থেকে শ্যামবাজার চষে বেড়িয়েছি।
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটার সময়ে আমাদের অনেক গল্প হত। রঞ্জু তার জীবনের নানা গল্প করতো, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ার সময় হোস্টেলের বন্ধুদের গল্প, মিশনের মহারাজদের গল্প, আর সবচেয়ে বেশী করতো খেলাধূলার জগতে তার নিজের ব্যক্তিগত নানা উজ্জ্বল সাফল্যের গল্প। আমি শুনতাম।
একবার ময়দানে ঘেরামাঠে ফুটবল ম্যাচ দেখে দু’জনে ফিরছি। ইস্টবেঙ্গল পুলিশ কে ২-০ হারিয়েছে, তাই রঞ্জু খুব খুসী। এস এন ব্যানার্জ্জী রোডে অনাদির দোকানে মোগলাই পরোটা খেয়ে আমরা ধর্ম্মতলা স্ট্রীট ধরে মৌলালীর দিকে হাঁটছি। অফিস পাড়ায়, ডালহাউসী এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে সন্ধ্যা নামছে, কর্ম্মক্লান্ত দিনের শেষে সবাই ঘরে ফিরছে, বাসে বাদুড়ঝোলা লোক, রাস্তায় জনস্রোত।
সেই ক্রমশঃ নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারে ভীড়ের রাস্তায় আমরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটছি। রঞ্জু শুরু করলো নরেন্দ্রপুরে স্কুলের Sports এর গল্প। Middle Distance (৫০০০ মিটার) এর final, রঞ্জুর প্রধান opponent যে ছেলেটি সে হলো স্কুলের চ্যাম্পিয়ন দৌড়বাজ, তাকে গত কয়েকবছর কেউ হারাতে পারেনি, তার যেমন দম, তেমনই স্পীড। রঞ্জু মনে মনে ঠিক করেছে তাকে এবার হারাতেই হবে।
প্রত্যেক খেলাতেই জেতার জন্যে একটা mental preparation দরকার, যাকে বলে game plan বা strategy, middle বা long distance run এর strategy হল কিভাবে প্রথম থেকে শেষ পর্য্যন্ত দম ধরে রেখে দৌড়বে, প্রথম থেকেই pace set করে এগিয়ে যাবে না Mo Farahর মত প্রথমে দম conserve করে পিছিয়ে থাকবে, শেষ রাউন্ডে গিয়ে accelerate করে এগিয়ে যাবে।
রঞ্জু ঠিক করেছে সে Mo Farah র strategy adopt করে প্রথমে পিছনে থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে স্পীড বাড়িয়ে এগোবে।
রেস শুরু হয়ে গেছে, আমরা হাঁটছি। মাঠটা বারো পাক দিতে হবে। শুরুর দুই রাউন্ড পরে রঞ্জু একদম শেষে, প্রধান প্রতিপক্ষ ছেলেটি একদম আগে এগিয়ে গেছে, মাঝখানে এক ঝাঁক ছেলে। রঞ্জু হাঁটতে হাঁটতে তার স্বভাবোচিত উত্তেজিত গলায় রেসের minute to minute পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে যাচ্ছে।
ওয়েলিংটন স্কোয়ার যখন পৌঁছলাম তখন বেশ অন্ধকার, রাস্তার আলো সব জ্বলে উঠেছে, ঢং ঢং করে ঘন্টি বাজিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রাম। বাদুড়ঝোলা প্রাইভেট বাসের কন্ডাকটর রা “মৌলালী, শিয়ালদা’, বৌবাজার” বলে ডাক দিচ্ছে।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নামে/ ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে নেয় চিল/
পৃথিবীর সব আলো নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন/তখন গল্পের তরে জ্বোনাকীর রঙে ঝিলমিল/
সব পাখী ঘরে ফেরে, সব নদী…
ধর্ম্মতলা থেকে তালতলা হয়ে আমরা এস এন ব্যানার্জ্জী রোডে পড়ে ভেতরের গলি দিয়ে মৌলালীর দিকে এগোচ্ছি। এইসব রাস্তা অলি গলি রঞ্জুর সব চেনা।
এদিকে ছয় পাক ঘোরা হয়ে গেছে, রঞ্জু এখন স্পীড বাড়াতে শুরু করেছে, সে এখন মাঝামাঝি, লীডার ছেলেটি তবুও অনেকটা সামনে।
আমরা যখন মৌলালী পৌছলাম তখন দশ পাক ঘোরা হয়ে গেছে, আর দুটো পাক বাকী, রঞ্জু এই বার accelerate করতে শুরু করলো। সার্কুলার রোড পেরিয়ে ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা, আনন্দ পালিতের পার্কে যখন পৌঁছলাম, তখন একেবারে শেষ রাউণ্ড।
রঞ্জুর গলায় উর্দ্ধশ্বাস উত্তেজনা ফুটে বেরোচ্ছে, লীডারের সাথে তার gap ক্রমশঃ কমে আসছে, তারা এখন প্রায় সমান সমান। কিন্তু আরো কয়েকজন রঞ্জুর পিছনে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, রঞ্জু মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখছে। এদের মধ্যে কেউ তাকে ছাড়িয়ে যাবে নাকি? তাহলে তো সর্ব্বনাশ। পক্ষীরাজের মত হাওয়ায় ভর দিয়ে ছুটে চলেছে রঞ্জু, সেই সত্যেন দত্তের রানারের মতঃ
রঞ্জু সবেগে হরিণের মত ধায়…
আনন্দ পালিত পার্কে পোঁছে আমি রঞ্জুকে বললাম চল্ পার্কে একটু বসে চীনেবাদাম খাই, পা ব্যথা করছে।
রেসে শেষ পর্য্যন্ত কি হয়েছিল তা আর মনে নেই, কিন্তু সেই পার্কে দু’জনে পাশাপাশি বসে চীনেবাদাম খাওয়াটা বেশ মনে আছে।
৪
আর একবার, তখন আমরা কলেজে পড়ি, আমি খড়গপুরে, রঞ্জু কলকাতায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজে। একদিন বিকেলে দু’জনে পার্ক সার্কাস ময়দানে হাঁটছি। রঞ্জু শুরু করল তার কলেজের ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার ফাইনাল এর গল্প। ফাইনালে রঞ্জুর প্রতিপক্ষ কলেজের ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন। সে state level এ খেলে, ব্যাডমিন্টনে তার দুর্দ্দান্ত stamina আর skill, তাকে হারানো প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু রঞ্জুর ডিকশনারী তে অসম্ভব বলে কোন শব্দ নেই। সে জানে যে কোন খেলায় জিততে গেলে যেটা সবচেয়ে বেশী দরকার তা হলো জেতার অদম্য ইচ্ছে, একটা লড়াকু মনোভাব, ইংরেজী তে যাকে বলে mental fortitude, আমি জিততে পারি এই আত্মবিশ্বাস। আর যেটা দরকার তা হলো court coverage, anticipation – opponent এর strategy বুঝে মনে মনে একটা game plan তৈরী করা এবং খেলার সময় সেই game plan কাজ না করলে Plan B কিংবা Plan C আগে থেকে তৈরী করে রাখা। যে কোন খেলাই ultimately একটা mind game, তাই ওই ছেলেটির মত stamina আর skill রঞ্জুর হয়তো নেই, কিন্তু mind game জেতার জন্যে তার আছে মগজাস্ত্র।
খেলা শুরু হয়ে গেছে, আমরা হাঁটছি, রঞ্জু শট বাই শট ধারাবিবরণী শুরু করে দিয়েছে। “ও একটা দারুণ overhead smash করলো, আমি কোনমতে তুলে দিলাম, আমি একটা ব্যাকহ্যান্ড ড্রপ শট মারলাম একেবারে নেট ঘেঁষে”, ইত্যাদি।
তিন রাউন্ড হাঁটার পর প্রথম গেমটা শেষ হলো। রঞ্জু হেরে গেল ১৫-২১। কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুরা খুব উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে, রঞ্জু যে ওই চ্যাম্পিয়ন ছেলেটিকে এরকম fight দেবে তারা আশাই করেনি।
দ্বিতীয় গেম শুরু হলো।
প্রথম থেকেই এই গেমে রঞ্জু দুর্দ্ধর্ষ খেলছে, অপোনেন্টের smash আর drop shot সে দুর্দ্দান্ত anticipate করে ঠিক জায়গায় পোঁছে গিয়ে return করে দিচ্ছে, রঞ্জু নিজেই জানেনা কি করে সে এত ভাল খেলছে, প্রমথ চৌধুরীর মন্ত্রশক্তি গল্পের মত তাকে মনে হয় কোন অদৃশ্য শক্তি ঘাড় ধরে খেলাচ্ছে। তার প্রতিপক্ষ কিছুটা ব্যাকফুটে, তার আত্মবিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও কমছে, এদিকে রঞ্জু একটা করে পয়েন্ট পাচ্ছে আর দর্শকদের মধ্যে রঞ্জুর বন্ধুরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে।
দ্বিতীয় গেমটা রঞ্জু শেষ পর্য্যন্ত যখন জিতলো তখন আমাদের পার্ক সার্কাস ময়দানের বিশাল মাঠে আরো তিন রাউন্ড হাঁটা হয়ে গেছে। আমি রঞ্জুকে বললাম চল্ এবার বাড়ী ফেরা যাক, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বাকিটা বাড়ী যেতে যেতে যেতে শুনবো।
বাড়ী ফিরতে ফিরতে তৃতীয় গেম শুরু হল। সে এক হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ, লম্বা লম্বা rally, কেউ কাউকে ছাড়বেনা। ১০-১০, ১২-১২, ১৫-১৫, ১৮-১৮… কোর্টে যেন আগুণ লেগে গেছে~ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা সবাই রঞ্জুর জন্যে গলা ফাটাচ্ছে।
Dangerous smashes, delectable flicks, deadly drop shots…
বাড়ী পর্য্যন্ত যখন এসেছি, তখন ২০-২০। একেবারে চূড়ান্ত সাসপেন্স।
রঞ্জু বলল মান্টুদা, চলো আর একটু এগিয়ে যাই।
সেদিন ম্যাচ এর রেজাল্ট কি হয়েছিল আমার আর মনে নেই, কেবল এটুকু মনে আছে যে মৌলালীতে গিয়ে ম্যাচ শেষ হয়েছিল।
আজ রঞ্জু আর নেই। আমি কাজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতা ফিরে এসেছি।
মনে হয় রঞ্জূটা আজ থাকলে বেশ হত, দু’জনে মিলে আবার আগের মত কলকাতার রাস্তায়, ঢাকুরিয়া লেকে কিংবা পার্ক সার্কাস ময়দানে গল্প করতে করতে হাঁটতাম।
ছোটবেলার মত এখন আবার হাতে অফুরন্ত সময়।
খেলার জগতে ওর সাথে আলোচনা করার মত আরও কত ঘটনা ঘটে গেছে ও চলে যাবার পর। ২০১০ সালের Soccer World Cup এ Ghanar বিরুদ্ধে Uruguyar Suarez এর হাত দিয়ে অবধারিত গোল বাঁচানো, শ্রীলঙ্কার মুরলী কে New Zealand এর Wicket keeper captain ব্রেন্ডন ম্যাকালাম এর unsporting রান আউট, ২০০৯ সালের Andy Roddick আর Roger Federer এর অবিশ্বাস্য লম্বা Wimbledon Final…
তাছাড়া ইউসেন বোল্ট কিংবা মাইকেল ফেল্পস কে নিয়ে আলোচনা করেই রঞ্জুর সাথে পুরো একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় তা আর সম্ভব নয়।
অলিম্পিক এলেই খুব রঞ্জুর কথা মনে পড়ে।