-
কুয়েতে রক্তকরবী – প্রস্তুতি পর্ব্ব

ফাগুলাল আর চন্দ্রা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে কুয়েতের বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক সমিতির প্রযোজনায় আমরা ভারতীয় দূতাবাসের অডিটোরিয়াম এ রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম।
১) রক্তকরবী কেন?
রক্তকরবী নিঃসন্দেহে একটি কঠিন নাটক এবং কুয়েতের দর্শকদের কাছে এই নাটক ভাল লাগবে কিনা এটি একটি বড় প্রশ্ন ছিল আমাদের মনে। এই নাটকটি একটি রূপক, এই নাটকের বিষয়বস্তুর ভিতরে অন্তর্নিহিত আছে সমাজে শ্রেণীবিভাগ, প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দর্শন, গভীর চিন্তা এবং সুস্পষ্ট মতামত। নাটক দেখতে এসে এই সব সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কেই বা ভাবতে চায়?
কিন্ত অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে এটাও ঠিক যে রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজেই অনেকবার বলেছেন রক্তকরবী কোন রূপক নয়, তা হল নন্দিনী নামের একটি মানবীর কাহিনী। নাটকটিতে ভাল লাগার উপাদানও কম নেই। সুন্দর গল্প আছে, নাচ আছে, গান আছে, আছে নারী আর পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ, বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালবাসা, সন্দেহ, শোষন, অত্যাচার, বিদ্রোহ। সবার ওপরে আছে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল ভাষায় লেখা শাণিত সব সংলাপ।
রক্তকরবী নিঃসন্দেহে একটি উচ্চস্তরের বাংলা নাটক। তাই অনেক ভেবেচিন্তে আমরা রক্তকরবী নাটকটিকে বেছে নিলাম।

বিশুপাগল আর ফাগুলাল 
ফাগুলাল আর সর্দ্দার ২) প্রস্তুতি
রক্তকরবী নাটকে অনেক চরিত্র, কুয়েতে চট করে অত অভিনেতা পাওয়া মুস্কিল। দল তৈরী করতে তাই প্রথমে কিছু অসুবিধে হয়েছিল। এমনিতে কুয়েতে বাঙালিদের মধ্যে ভাল অভিনেতা অভিনেত্রী র অভাব নেই, নাটকে অংশ নিতে তারা সবসময়ই উৎসাহী। তাই প্রধান চরিত্র মোটামুটি সব পাওয়া গেলেও, কিছু চরিত্র বাদ দিতে হলো। তাছাড়া বেশ কিছু লম্বা আর কাব্যিক ভাষার সংলাপ – যা কিনা অনেকাংশেই দর্শকের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে – আর তার সাথে কিছু গানও বাদ দিলাম। এর ফলে নাটকটার সময় দুই ঘন্টা থেকে দেড় ঘণ্টায় না মিয়ে আনা গেল।
এ দিকে আর এক মুস্কিল, রঞ্জন আর দু’জন প্রহরীর তো কোন সংলাপই নেই। বিশেষ করে রঞ্জন এর রোলটা কে করতে চাইবে? রাজা দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসার পরে তার মৃতদেহ হয়ে শুধু শুয়ে থাকা কাজ। এই রোলে কাউকে পাওয়া কঠিন। শেষ পর্য্যন্ত শৈবাল রঞ্জন আর প্রথম প্রহরী করতে রাজী হয়েছিল। অনুপম হয়েছিল দ্বিতীয় প্রহরী, তার সুন্দর ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যবান চেহারা, শুকদেব বললো “অনুপমকে প্রহরী হিসেবে যা মানাবে না!” সংলাপহীন ওই দুটো রোলে ওই দু’ জন কিন্তু নিয়ম করে রোজ রিহার্সালে এসেছে। “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে” গানের সাথে গ্রামবাসীদের নাচের সীনে কিছু বাচ্চা ছেলে মেয়েদের দীপা যোগাড় করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল।
অভিনয় ছাড়া স্টেজের পিছনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে, এই ব্যাকস্টেজের কাজ করার জন্যেও কুয়েতে বাঙালীদের মধ্যে গুণী এবং কাজের লোকের অভাব হয়নি কোনদিন। আমাদের মঞ্চের দায়িত্ব নিলো রাজীব আর শৈবাল, আলো অমিতেন্দ্র, আবহ বনানী আর রথীন, পোষাক সুভদ্রা, এবং প্রম্পটিং সুপর্ণা।
দল তৈরী করার পরে মহা উৎসাহে আমরা মহড়া শুরু করে দিলাম। হাতে তিন মাস সময়।
প্রথম কয়েকদিন মহড়ার পরে দুটো জিনিষ পরিস্কার হয়ে গেল।
এক, এত বছর আগে লেখা এই নাটক, তার ওপর রবীন্দ্রনাথের কঠিন সব সংলাপ, নাটকের মূল বক্তব্য ও কেমন যেন একটু অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে, কিন্তু কয়েকটা মহড়া হবার পরে বুঝলাম এই নাটক নিয়ে আমার দলের তরুণ অভিনেতাদের উৎসাহ আমার থেকেও বেশী। তারা সকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজের নিজের চরিত্র আত্মস্থ করে নিলো ।
আর দ্বিতীয় যে জিনিষটা হল সেটা আরও চমৎকার।
প্রথম বার পড়ে সংলাপ গুলো যত কঠিন মনে হয়েছিল, মহড়া করতে করতে সেই সংলাপ গুলো আমাদের কাছে ক্রমশঃ সহজ হয়ে উঠতে লাগলো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে আমাদের মনের ওপর তাঁর সন্মোহনী প্রভাব ফেলতে শুরু করে দিলেন। যতো রিহার্স করছি, ততোই রবীন্দ্রনাথের সংলাপের মাধুর্য্য তার সমস্ত রূপ রস গন্ধ নিয়ে অনিবার্য্য, অবধারিত ভাবে আমাদের মনের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো।

নন্দিনী আর সর্দ্দার ৩) রিহার্সালের মজা
প্রবাসী বাঙালীর জীবনে নাটকের মূল আকর্ষণ আমার মতে এই রিহার্সাল। এই রিহার্সালকে কেন্দ্র করে মাস তিনেক সবাই মিলে জড়ো হওয়া আর এক সাথে আড্ডায় গল্পে হাসিতে কিছুটা সময় কাটানো। যেন নাটকটা হলো একটা উপলক্ষ্য মাত্র, আসল আনন্দ হলো রিহার্সালের সময়টা বাড়ী জুড়ে হৈ হৈ, উত্তেজনা, আড্ডা, আলোচনা, কেউ চা সিঙাড়া খাচ্ছে, কেউ বা আবার হাসি ঠাট্টায় মগ্ন। সমস্বরে সবাই কথা বলছে, নানা আলোচনা, হাসি, গল্প, রসিকতা, কলরব, কলতান।
আর একটা ব্যাপার হচ্ছে সবাই নিজের নিজের অভিনীত চরিত্রদের সাথে মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে, যার জন্যে রিহার্সালের মধ্যে এমন কি বাইরেও মাঝে মাঝে দেখা হলে সবাই সবাই কে নাটকের নামেই ডাকে। ধরা যাক তাপস একদিন রিহার্সালে একটু দেরী করে এসেছে, সে ঘরে ঢুকলেই রব উঠলো, “ওরে, ফাগু এসে গেছে! ফাগুলাল, আজ এত দেরী হলো কেন ভাই?” নাটক হয়ে যাবার পরে একদিন অরুণাভর বাড়িতে সবাই মিলে মাটিতে শতরঞ্চি পেতে ভিডিও দেখা হবে , শর্ব্বরী সেদিন আসতে পারছেনা, দেবাশীষ তাকে বলল “কেন,নাতনি? যে বাসা দিয়েছি সে তো খাসা, সরকারি খরচে সতরঞ্চি পর্যন্ত রাখা গেছে।” কল্যাণ একদিন আমাদের বললো যে ও মোড়ল শুনে পলি নাকি বলেছে ইন্দ্রজিৎ দা’ লোক চেনে বোঝা যাচ্ছে! কেউ কেউ আবার অরুণাভ কে “পাগলভাই” বলেও ডাকছে। রথীন অরুণাভ কে বলছে শুনলাম, “পাগলভাই, সিঙাড়াটা কোন দোকান থেকে এনেছো? দারুণ তো!”
অবশ্য উল্টোটাও হত মাঝে, নাটকের নামের বদলে ভুল করে আসল নাম চলে আসতো। হরেরাম কোলে গোঁসাই সেজে সব সময় দুই হাত তুলে হরি হরি করছে, তার গায়ে গেরুয়া নামাবলী, তার আসল নামের সাথে তার চরিত্রের নামের হুবহু মিল। একদিন দেবাশীষ ভুল করে শর্ব্বরী কে বলে ফেললো, “নাতনি, একটা সুখবর আছে। এদের ভালো কথা শোনাবার জন্যে হরেরাম কোলেকে আনিয়ে রেখেছি।”
রিহার্সালের কথা উঠলে খাওয়া দাওয়ার কথা বলবোনা, তা কি করে হয়?
হরেরামের বাড়ীতে এক শুক্রবার রিহার্সাল। সেদিনের মূল আকর্ষণ ছিল স্বাতীর তৈরী কচুরী আর আলুর দম। পরে স্টেজ রিহার্সালেও একদিন স্বাতী শ’ খানেক মাছের চপ নিয়ে এসেছিল। কুয়েতে রক্তকরবীর নাটকের ইতিহাস যদি কোনদিন লেখা হয় তাহলে সেখানে সেই মাছের চপ এর কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে নিশ্চয়। পলকের মধ্যে শ’খানেক চপ হাওয়া। যাকে বলে Gone with the wind!

হার্মোনিয়াম নিয়ে বনানী 
নন্দিনী ৪) মেগা রিহার্সাল
নাটকের দিন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে, আর দিন পনেরো বাকী।
এতদিন আমরা নাটকটা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে বার বার রিহার্স করেছি, তার অনেক কারণ ছিল।
প্রথমতঃ রোজ সবাই আসতোনা, বিশেষ করে নাচের বাচ্চারা। কারুর কারুর ছোট পার্ট, এরা মাঝে মাঝে না আসতে চাইলে আমি জোর করতাম না। কিছু চরিত্র যেমন প্রথম দ্বিতীয় আর তৃতীয় গ্রামবাসী তো প্রায় শেষ মুহূর্ত্তে পেলাম। ওই তিন জনের সাথে নন্দিনীর “ওগো তোমরা রঞ্জন কে দেখেছো?” সীনটা তো অভিনেতার অভাবে কোনদিন রিহার্স করাই হয়নি। তাছাড়া কোনদিন কারুর শরীর খারাপ, কারুর কাজ পড়ে গেছে, এসব তো থাকেই। তাই অনেক দৃশ্য বাদ দিয়ে নাটকটা ভাগ ভাগ করে আমাদের রিহার্সাল হতো। পার্ট মুখস্থ হাবার জন্যে কিছু কিছু দৃশ্য দরকার মতো বার বার করতাম, যাতে অভিনেতারা দৃশ্যগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
এখন আর আমাদের বেশী সময় হাতে নেই, তাই ঠিক হলো একদিন আমাদের বাড়িতে প্রথম থেকে শেষ পুরো নাটকটা রিহার্স করা হবে, ভাগ ভাগ করে নয়। আমরা এর নাম দিয়েছি মেগা রিহার্সাল। কি ভুলভাল হচ্ছে তাই পরে দেখার জন্যে আজ এই রিহার্সালের ভিডিও রেকর্ডিং হবে, রাজকুমার তার নতুন ভিডিও ক্যামেরা আর স্ট্যান্ড নিয়ে এসেছে। বনানী এসেছে তার হারমোনিয়াম নিয়ে। বাচ্চারা সবাই শাড়ি পরে এসেছে। ফাগুলালকে মাথায় পাগড়ী আর ধুতি সার্টে বেশ authentic লাগছে। ফাগু আর বিশুর পিঠে কাগজে বড় বড় অক্ষরে নাম্বার (৪৭ফ,৬৯ঙ) সাঁটানো। রথীন কোথা থেকে জোগাড় করে রাজার জন্যে তিনটে সবুজ রং এর ব্যাং নিয়ে এসেছে। শুকদেব তার মধ্যে থেকে একটা ব্যাং বেছে নিলো। নাটকে এই ব্যাং এর বয়স তিন হাজার বছর। নাটকে এক জায়গায় ধ্বজার দন্ড ভাঙতে হবে, শুকদেব আগে ভাগে আমাদের রান্নাঘরে গিয়ে একটা লাঠি দেখে এসেছে। ওই দৃশ্যের সময় সংলাপ বলতে বলতে সে চট করে ছুটে রান্নাঘর থেকে গিয়ে লাঠিটা নিয়ে আসবে।
বাড়ী জুড়ে হৈ হৈ, উত্তেজনা, আড্ডা, আলোচনা, কেউ চা সিঙাড়া খাচ্ছে, কেউ হাসি ঠাট্টায় মগ্ন, পরিবেশ বেশ জমে উঠেছে, রাজকুমার তার ভিডিও ক্যামেরা স্ট্যান্ডে বসিয়ে রেডী।
তারাপদ রায়ের একটা কবিতায় ছিল যে বাড়ির সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে, বাক্স প্যাঁটরা হোল্ডল বাঁধা হয়েছে, চারিদিকে খুব ব্যস্ততা, হাঁকাহাঁকি, একজন ট্যাক্সি ডাকতে গেছে, ট্যাক্সি এলেই বেরিয়ে পড়া হবে, তার পর হাওড়া স্টেশন, পুঁ ঝিক ঝিক রেলগাড়ী। ছেলেবেলার সেই উত্তেজনার দিন নিয়ে তাঁর সেই কবিতায় একটা লাইন ছিলঃ
“আমার খুব ভালো লাগে এই সব হাঙ্গামা।”

গোঁসাই 
নন্দিনী ও রঞ্জন (মৃতদেহ) ৫) মেকআপ এর কারিগর
এই হাঙ্গামার মধ্যে যখন রিহার্সাল শুরু করবো ভাবছি, এমন সময়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলেন এক মালয়ালী ভদ্রলোক, তাঁর নাম পল (Paul)। শুকদেব আমার সাথে তাঁর আলাপ করিয়ে দিলো। তিনি সব অভিনেতাদের মেকআপ করাবেন। আজ তিনি এসেছেন মেকআপ নিয়ে আলোচনা করতে।
আগে আমাদের নাটকে সমিতির সদস্যদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ মেকআপ করতেন, ইদানীং এই ব্যাপারটা বাইরের কাউকে দিয়ে করা হয়, তাতে খরচ সামান্য বেশী হলেও ঝামেলা অনেক কম।
পল ভদ্রলোকের গায়ের রং মিশমিশে কালো, লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা, কিন্তু তাঁর মুখে সবসময় একটা অমায়িক মিষ্টি হাসি, ইংরেজী হিন্দী এই দুটো ভাষাই ভাল না জানার জন্যে তাঁর মুখে বেশী কথা নেই, যাই বলা হয়, তিনি ঘাড় নেড়ে বলেন হয়ে যাবে,চিন্তা নেই। বোঝা গেল যে তিনি বেশ করিতকর্ম্মা লোক, মেকআপের ব্যাপারে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা।তিনি আগেও আমাদের নাটকে মেক আপ করিয়েছেন। তবে তাঁকে নিয়ে মুস্কিল হল বাংলা ভাষা না জানার জন্যে তিনি চরিত্রানুগ মেকআপ প্রায়শঃই করতে পারেননা। তাঁকে চরিত্রদের সম্বন্ধে আগে ভাল করে না বোঝালে তিনি যে কি মেকআপ করবেন তা আগে থেকে বলা খুব মুস্কিল।
গতবছর পূজোয় শুকদেব ছোটদের নিয়ে “ভাষণদাদু” নামে একটা নাটক করেছিল।তাতে তার রোল ছিল এক বুড়ো বাঙ্গালী ভদ্রলোকের। মানে একজন দাদু আর কি। শুকদেব বললো, “ইন্দ্রজিৎদা, পল আমার মেকআপ শেষ করার পরে আয়নায় নিজেকে দেখে আমি তো চমকে উঠলাম।এ কি? আমায় তো একজন দুর্দ্ধর্ষ পর্ত্তুগীজ জলদস্যু মনে হচ্ছে!”
তখন আর বেশী সময় নেই নাটক শুরু হবার, সেই অল্প সময়ে অনেক বলে কয়ে বুঝিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে শুকদেবের মেকআপ পুরো বদলে শেষ পর্য্যন্ত সে যখন স্টেজে নামলো তখন তাকে ঠিক সান্তা ক্লজের মত দেখাচ্ছিল। এক মুখ সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে লাল জামা…
তো এই হল পল!
মেগা রিহার্সালের জন্যে সবাই তৈরী, কিন্তু তার আগে পল কে নিয়ে বসানো হলো আমাদের টিভির ঘরে। সেখানে তাকে আমাদের নাটকের চরিত্রগুলোসব এক এক করে বোঝাতে হবে। কার কি রোল, কার কি রকম dress আর মেকআপ হবে এই সব। শুকদেব আর সুভদ্রা কে এই কাজের ভার দিয়ে আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ওরা পলকে এক এক করে নাটকের চরিত্র বোঝাতে লাগলো। মাঝে মাঝে ওদের কথা কানে আসছিল~
শুকদেব বলছে ম্যায় হুঁ রাজা, সমঝে না, মতলব King, emperor…
তারপরে দেবাশীষ কে দেখিয়ে ইয়ে হ্যায় সর্দ্দার,মতলব কিং কা আর্মি কা জেনেরাল, কমান্ডার ইন চীফ…
তাপস আর শর্ব্বরী কে ডাকা হলো। ইনকা নাম হ্যায় ফাগুলাল, ইয়ে এক গ্রামবাসী, মতলব ভিলেজার হ্যায়, আউর ইয়ে হ্যায় উনকি বিবি, চন্দ্রা…ইয়ে দোনো সিধাসাধা গাঁও কা আদমী…সিম্পল, সমঝে না?
তারপর এলো অরুণাভ। ইয়ে হ্যায় বিশু পাগল,মতলব পাগলা সা আদমী হ্যায়, ইধর উধর গানা গা কে ঘুমতা, তারপরে শুকদেব ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “কি ইন্দ্রজিৎ দা, বিশুকে ঠিক বুঝিয়েছি তো?”
আমি সন্মতি জানালাম। কি আর করবো? বিশুপাগলের চরিত্র বোঝানো কি সহজ কাজ? ওর থেকে ভাল তো আমিও বোঝাতে পারতামনা।
কিন্তু কল্যাণ কে ডেকে নিয়ে এসে মোড়ল বোঝাতে গিয়ে শুকদেবের হিন্দীতে কুলোলনা, সে হাল ছেড়ে দিয়ে সুভদ্রাকে বললো, “মোড়ল হিন্দীতে কি হবে বৌদি?”
সুভদ্রা বললো আপ মুখিয়া সমঝতে হ্যায়? মুখিয়া? সরপঞ্চ?
পল তো যথারীতি সবেতেই মাথা নাড়ছে, যেন সব সে পরিস্কার বুঝছে, আর একটা ছোট নোটবুকে কি সব হিজিবিজি লিখে রাখছে, আমাদের impress করার জন্যেই বোধ হয়।
আমি তো পলের ভাবগতিক দেখে ভাবলাম,সব্বোনাশ, শুকদেব এ কাকে ধরে নিয়ে এলো? শেষ পর্য্যন্ত হয়তো দেখবো শো এর দিন রক্তকরবী নাটকে বেশ কিছু পর্ত্তুগীজ জলদস্যু, রঘু ডাকাত আর সান্টা ক্লস মাথায় ফেট্টি বেঁধে স্টেজময় দাপাদাপি করছে।
উঠোনে দাপুটি করে নেচেছিল কাল/
তার পরে কি হইলো জানে শ্যামলাল/
পল চলে যাবার পরে মেগা রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল।

রাজা আর নন্দিনী ৬) মহড়া
সুভদ্রা আর সুপর্ণা দুই দিকে বসে প্রম্পট করার জন্যে তৈরী, বনানী হারমোনিয়াম নিয়ে এক দিকে বসে, রথীন তার যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তুত। প্রত্যেকের সামনে খোলা বই। রাজকুমারের চোখ তার ভিডিও ক্যামেরা্র ভিউফাইন্ডারে।
প্রথম থেকে শেষ কোন interruption ছাড়া রিহার্স করার অনেকগুলো সুবিধে আছে। নাটকটা করতে কতক্ষণ সময় লাগছে তার একটা ভাল ধারণা পাওয়া যায়। তারপরে নাটকটি এক দৃশ্য থেকে পরের দৃশ্যে কত seamlessly এগিয়ে যাচ্ছে সেটা জানা যায়, প্রত্যেক অভিনেতা তার পরের entry নিয়ে আগে থেকেই তৈরী হয়ে থাকতে পারে।
পুরো নাটকটা কেমন gel করছে, সেটা ভাগ ভাগ করে করলে ঠিক বোঝা যায়না। Sum of parts make more than a whole বলে ইংরেজীতে একটা কথা আছে। আমাদের ক্ষেত্রে সব পার্ট জোড়া লাগিয়ে নাটকের একটা চমৎকার সামগ্রিক রূপ আমার চোখে ফুটে উঠলো। বুঝতে পারলাম সবাই নাটকটা এবং নিজের নিজের রোল নিয়ে কতোটা সিরিয়াস এবং তৈরী।
বেশ তরতর করে এগিয়ে চলেছে আমাদের নাটকের নৌকা।এখন আমরা স্টেজ রিহার্সালের জন্যে তৈরী।
মেগা রিহার্সাল শেষ হলে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডার পালা। সমস্বরে সবাই কথা বলছে, নানা আলোচনা, হাসি, গল্প, রসিকতা, ক্যালব্যাল, আমাদের বাড়ীর হলঘর গমগম করতে লাগলো।
আমার খুব ভাল লাগে এই সব হাঙ্গামা!

রাজা, চন্দ্রা আর ফাগুলাল -
লিসবনের খাস্তা গজা

Jeronimos Monastery, Lisbon ১) এ আবার কি অসভ্যতা
মার্চ ৩১, ২০১৮ – শনিবার
আমাদের আজকের ট্যুর প্যাকেজে সকালে half day লিসবন সিটি ট্যূর।
হোটেলে সকাল ন’টায় বাস আসবে। আমরা সবাই রেডি হয়ে লাউঞ্জে এসে সোফায় বসে আছি।
এমন সময় হোটেলের বাইরে একটা বড় বাস এসে দাঁড়ালো, এবং একটু পরে একটি সুদর্শন যুবক আমাদের সামনে এসে বললো You are the group of Prodosh Mitra? My name is Nunu and I shall be your guide today…
নুনু?
এ আবার কি অসভ্য নাম?
অবশ্য পর্তুগীজ ভাষায় অসভ্য নয় নিশ্চয়, নাহলে ওরকম গর্ব্ব আর আনন্দের সাথে কেউ বলে আমার নাম নুনু? পরে জেনেছিলাম কথাটার মানে হলো petite ছোটখাটো, আদরের।
অসভ্য কথা শুনলেই মেয়েদের খুব হাসি পায়, আমাদের বৌদের মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবেই একটা চাপা হাসির গুঞ্জন উঠলো। আমরা ছেলেরা অবশ্য অসভ্য কথাকে হাসির ভাবিনা, তবু আমরাও একটু চোখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। ছেলেটির জন্যে একটু সহানুভূতিও অনুভব করলাম, বেচারা জানেওনা কি বিশ্রী একটা নাম তার গায়ে আটকে আছে চিরজীবনের মতো।
নুনু ছেলেটি কিন্তু খুব স্মার্ট, সুন্দর কথা বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে তার বেশ ভাল আলাপ হয়ে গেল।
কিন্তু মুস্কিল হলো বাসে সে বসে আছে একেবারে সামনে, তার সাথে কথা বলতে গেলে বা তাকে কোন প্রশ্ন করতে গেলে তাকে নাম ধরে ডাকতে হবে।
সুমিতা সিদ্ধার্থ কে বলল তুমি ওকে নাম ধরে ডাকেবেনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে বলবে Excuse me?
নাম ধরে ডাকতে হবে তাই আমরা কেউ ই নুনুকে কোন প্রশ্ন করছিনা। কিছুক্ষণ বকবক করে নুনু ড্রাইভারের পাশের সীটে সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে।
এদিকে বাসে একদম পিছনে বসে আছি আমি আর প্রদোষ। বাসে এ সি চলছেনা, বেশ গরম। তুতু বসে আছে একদম সামনে, প্রদোষ তুতু কে বললো এই নুনু কে বলো তো এ সি টা চালাতে।
তুতু পিছন দিকে প্রদোষ কে একটা বিশ্রী দৃষ্টি দিয়ে বললো, না আমি বলতে পারবোনা, তুমি বলো।
প্রদোষ আর কি করে, সে কয়েকবার মিন মিন করে খুব নীচু গলায় মিস্টার নুনু, মিস্টার নুনু বলে ডাকলো, কিন্তু অত আস্তে বললে নুনু শুনবে কি করে? তখন মরিয়া হয়ে লজ্জা শরম বিসর্জ্জন দিয়ে প্রদোষ বেশ জোরে ডেকে উঠলো – মিস্টার নুনু !
এবার কথাটা নুনুর কানে গেছে, সে মুখ ফিরিয়ে বললো, ইয়েস?
প্রদোষ বলল Please will you turn the air conditioning on?
Sure, বললো নুনু।
কিছুক্ষন পরে আবার এক মুস্কিল। মাইক্রোফোন থেকে একটা খসখস আওয়াজ হচ্ছে, কানে লাগছে।
প্রদোষ এবার তার সংকোচ ছাড়িয়ে উঠেছে। তার গলায় এখন বেশ জোর।
আমি ওর পাশে বসে ছিলাম, আমি বললাম মিস্টার বলার কি দরকার, বাচ্চা ছেলে, ওকে নাম ধরেই ডাকোনা।
বজ্রগম্ভীর স্বরে প্রদোষ ডেকে উঠলো এই নুনু, নুনু!
সামনে বসে ছিল তুতু, সে পিছন ফিরে প্রদোষ কে বলল “এসব কি অসভ্যতা হচ্ছে?”
কিন্তু প্রদোষ কে থামানো যাচ্ছেনা, সে ওই খসখস আওয়াজ আর সহ্য করতে পারছেনা।
সে আবার পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো “নুনু, এই নুনু! আওয়াজ টা বন্ধ কর্ মাইরী…”

Tagos River and 25th April Bridge, Lisbon 
Our group at Belem, Lisbon 
Discovery monument, Lisbon 
Belem Tower, Lisbon ২ ভাস্কো ডা গামা
বাসে করে সারা শহর ঘুরতে ঘুরতে নুনু আমাদের লিসবনের ইতিহাস বর্ণনা করতে লাগলো। পাহাড় দিয়ে ঘেরা টাগোস নদীর মোহনার কাছে গড়ে ওঠা লিসবন হলো ইউরোপে এথেন্সের পরে প্রাচীনতম রাজধানী শহর এবং তার অনুপম সৌন্দর্য্যের জন্যে তার পৃথিবীজোড়া খ্যাতি।
বাসে যেতে যেতে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম এই মার্চ্চ মাসের সকালে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় ঢাকা বুলেভার্ড, বেশ কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে, কিছু লোক পথের পাশে বেঞ্চিতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। রং বেরং এর ফুলের সমারোহ চারিদিকে, পরিস্কার চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তার ফুটপাথে নানারকম সুন্দর ডিজাইন দিয়ে আঁকা টাইল দিয়ে ঢাকা, রাস্তার পাশে অনেক বাড়ীর দেয়ালে ছবি আর ফ্রেস্কো আঁকা। অনেক গোলচক্কর চারিদিকে, প্রায় প্রত্যেক গোলচক্করেই বিশাল বিশাল সুদৃশ্য স্ট্যাচু। যেন কোন এক মহান শিল্পীর সৃষ্টি এই শহর।
বড় বড় ছাদখোলা লাল দোতলা বাস ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় সরু neighbourhood এর ভেতর দিয়ে ট্রাম চলে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় আমরা মধ্যযুগে ঢুকে পড়েছি।
ইউরোপের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে Iberian peninsula তে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে এই ছোট্ট রাজ্য পর্ত্তুগাল প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সুদূর ১১৪০ সালে, তারপরে সেখানকার রাজা রাজড়ারা নানা যুদ্ধ বিগ্রহ করে তাদের রাজ্য দক্ষিণে আরো বাড়িয়ে নেয়, যার মধ্যে ছিল বন্দর শহর লিসবন। ১৩৮৫ সালে লিসবন পর্তুগালের রাজধানী হয়। কিন্তু পর্ত্তুগাল বিখ্যাত হয় পনেরো আর ষোল শতাব্দীতে, যখন তাদের নৌসেনা এবং আবিস্কারকরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তাদের উপনিবেশ তৈরী করতে শুরু করে।
ওই সময়টা ছিল পর্ত্তুগালের স্বর্ণযুগ, এখন যাকে বলা হয় Age of Discovery – তখন পর্তুগাল হয়ে ওঠে পৃথিবীর এক দুর্দ্ধর্ষ ঔপনিবেশিক শক্তি। লিসবনের টাগোস নদীর মোহনার তীরে Belem District এর সব iconic ঐতিহাসিক landmark ওই সময়ই তৈরী হয়। তাদের মধ্যে আছে World Heritage site Belem Tower, Discovery Monument আর Jeronimos Monastery, যা আজ আমরা দেখবো।
নুনু আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল একটা Viewing point এ – যার নাম স্থানীয় ভাষায় Meraduro – সেখানে অনেক ওপর থেকে নীচে দেখা যায় ছবির মত সুন্দর ছড়ানো শহর, বাগান, ঘরবাড়ী, রাস্তা।
আমাদের পরবর্ত্তী গন্তব্য হলো বিখ্যাত Jeronimos Monastery, যার ভিতরে আছে বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ নাবিক আবিস্কারক (explorer) ভাস্কো ডা গামার কবর। ছোটবেলায় ইতিহাসের বইতে ১৪৯২ সালে ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে Cape of good hope পেরিয়ে তাঁর ভারতবর্ষের গোয়া তে পৌঁছবার কাহিনী পড়েছি।
Jeronimos Monastery র বিশাল imposing স্থাপত্য চোখে পড়ার মত। ভাস্কো ডা গামা ভারত থেকে Spice trade শুরু করেন, এবং সেই ব্যবসা থেকে যে বিশাল অর্থ উপার্জ্জন হয়, তা অনেকটাই খরচ করে Jeronimos Monastery তৈরী হয় – ভাস্কো ডা গামার সফল ভারত অভিযান এর memorial হিসেবে। এই বিশাল উপাসনা গৃহতে পর্তুগালের রাজা রাজড়াদের সাথে ভাস্কো ডা গামাকেও সন্মানের সাথে সমাধিত করা হয়।
ভাস্কো ডা গামা গোয়াতে পর্তুগীজ সরকারের ভাইসরয় হয়েছিলেন, শোনা যায় ভারতেই তাঁর মৃত্যু হয়, এবং কোচিতে প্রথমে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। পরে পর্তুগীজ সরকার তাঁর দেহ লিসবনে স্থানান্তরিত করেন, যদিও কোচিতে St Francis Church এও তাঁর একটা সমাধিস্থল (Memorial) এখনো আছে।
Jeronimos Monastery র সামনে দর্শনার্থীদের বিশাল লম্বা লাইন। নুনু আমাদের বলল, “তোমরা লাইনে দাঁড়িওনা, কেননা Monastery র হলে ঢোকার জন্যে কোন টিকিট লাগেনা, ওই হলো দোতলায় মিউজিয়ামে যাবার লাইন। তোমরা হলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে পাশে এখানকার একটা বিখ্যাত Pasties এর দোকান আছে, সেখানে গিয়ে কফি নিয়ে একটু বসতে পারো। ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে বাসে ফিরে এসো কিন্তু।”
Monastery র হলঘরে ঢুকে দেখি সেখানে অনেক লোক, একটা মৃদু গুঞ্জন চারিদিকে। দেয়ালে বড় বড় Oil Painting টাঙানো, রঙীন কাঁচের ওপর ছবি আঁকা জানলা। খুঁজে খুঁজে ভাস্কো ডা গামার শায়িত মর্মর মূর্ত্তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পনেরো শো খ্রীষ্টাব্দের শেষে Age of discovery র সময় তিনি ছিলেন পর্তুগালের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, এক অন্যতম নায়ক। এখানে ভাস্কো ডা গামার মর্মর মূর্ত্তি দেখে ধারণা হয় তিনি ছোটখাটো লোক ছিলেন, মুখ চোখ তীক্ষ্ণ, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। দুই হাত ওপরে নমস্কারের ভঙ্গীতে তুলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন।
সেদিন Jeronimos Monastery তে ওই হলঘরে ভাস্কো ডা গামার শায়িত মর্মর মূর্ত্তির সামনে চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই স্কুল জীবনের দিন গুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম। মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল অন্ধকার রাত্রে ঝড়ের উত্তাল সমুদ্র, জাহাজ ডুবির ভয়, নাবিকদের কোলাহল, আর এই সব ছাপিয়ে ভাস্কো ডা গামার সাহস, আত্মবিশ্বাস আর নেতৃত্ব দেবার অপরিসীম ক্ষমতা।
মূর্ত্তির তলায় দুর্বোধ্য পর্তুগীজ ভাষায় কি সব লেখা আছে দেখলাম।
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব পর্তুগালে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল… বা ওই ধরণের কিছু নাকি?
কি জানি, হবেও বা।

Vasco Da Gama – in Jerominos Monastery ৩ – লিসবনের গজা
Jeronimos Monastery থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে সারি সারি দোকান, একটু হেঁটেই পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত গজার দোকান, নুনু আমাদের যার কথা বলেছিল। বাইরে বিশাল সাইনবোর্ড Belem Pasties, আর রেস্টুরেন্টের ভেতরে বিশাল ভীড়। ঢুকে কোনমতে একটা টেবিল পাওয়া গেল। ইউনিফর্ম পরা ওয়েটাররা ট্রে হাতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে রেস্টুরেন্টটা বেশ নামী।
যাই হোক কফি আর গজা অর্ডার দিয়ে বসে আছি তো আছিই। এদিকে নুনু বলে দিয়েছে দুই ঘন্টার মধ্যে ফিরতে, তাই বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি আমরা। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের ওয়েটারের নাম ফার্নান্ডো। আমি বার দুয়েক গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছি আর কত দেরী ভাই, সে আমাদের কোন পাত্তা না দিয়ে ট্রে হাতে ব্যস্ত ভাবে দূরে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।
মহা মুস্কিল তো? এই লিসবনের গজা খাওয়া আমাদের কপালে নেই মনে হচ্ছে।
যাই হোক একটু পরে আবার ব্যস্তসমস্ত ভাবে ঘুরে বেড়ানো ফার্নান্ডো কে গিয়ে যেই “এত দেরী হচ্ছে কেন ভাই” জিজ্ঞেস করেছি, মনে হলো আগুণে যেন ঘি পড়লো। ছোটখাটো বেশ সুঠাম চেহারার ছেলেটি হঠাৎ হেড অফিসের বড়বাবুর মত তেলেবেগুণে জ্বলে উঠে তার হাতের ট্রে টা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো~
Will you take my place?
ফার্ণান্ডো কে হঠাৎ ওই ভাবে ফেটে পড়তে দেখে আমার সেদিন খুব দুঃখ হয়েছিল। নানা কারণে আমাদের অনেকের মনেই জমতে থাকে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ। কাজের চাপ, নানাবিধ অসন্মান, গ্লাণি, সম্পর্কের টানাপোড়েন। হয়তো তার ভিতরে নিশ্চয় ক্রমশঃ জমে উঠছিল অনেক অস্থিরতা, অসহায়তা, তা আমার সামান্য একটা কথায় মুহুর্ত্তের মধ্যে ফুঁসে বেরিয়ে আসে।
পরক্ষনেই অবশ্য সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল, আমিও হেসে তার কাঁধে হাত রেখে দুঃখপ্রকাশ করেছিলাম।
কিন্তু ঘটনাটা আমি আজও ভুলতে পারিনা। Abba র সেই বিখ্যাত Fernando গান টা শুনলে আমার এখনো লিসবনের সেই ফার্নান্ডো ছেলেটিকে মনে পড়ে। গানের সেই ফার্নান্ডো ছিল তার দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক যুবক সৈনিক, এখন তার বয়স হয়েছে, তার মাথায় এখন পাকা চুল। তবু এই পরিণত বয়সে এসেও সে তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ভোলেনি, সেই বারুদের গন্ধ, বোমার আওয়াজ সে এখনো ভুলতে পারেনা।
There was something in the air that night/
The stars were bright, Fernando/
They were shining there for you and me/For liberty, Fernando
আমাদের এই ওয়েটার ফার্ণান্ডো ছেলেটিও সৈনিক। তবে সে হলো জীবনযুদ্ধের সৈনিক।
জানিনা সে কেমন আছে।
একটু পরেই আমাদের টেবিলে কফি আর রসে ভাজা খাস্তা গজা দিয়ে গেল সে।
তবে বলতে দ্বিধা নেই, সেই গজা খেয়ে আমার বেশ খারাপ লেগেছিল, খুবই আশাহত হয়েছিলাম আমি। ছোটবেলায় আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীতে মা আর জ্যেঠিমার তৈরী খাস্তা গজার সাথে এর কোন তুলনাই হয়না।
ছোটবেলার সেই গজার স্বাদ এখনো আমার জিভে লেগে আছে।
মা আর জ্যেঠিমা যদি লিসবনে এসে একটা গজার দোকান খুলতেন…

লিসবনে গজার দোকান 

Subhadra and I at the Discovery monument, Belem, Lisbon
-
ইন্দ্রজিৎ নাম হলো, ইন্দ্রে নাহি জিতে

১) আমার জন্ম
তিন বছর আগে মা’র প্রথম সন্তান কাশীতে চিকিৎসার গাফিলতিতে মারা যায়। তাই আমার জন্মের সময় বাবা আর কোন রিস্ক নেন্নি, তিনি মা’কে কাশীতে দিদিমার কাছে না পাঠিয়ে কলকাতায় আমাদের মনোহরপুকু্রের বাড়ীতে রেখেছিলেন, এবং তখনকার সময়ের একজন নামকরা ডাক্তার ডঃ স্বদেশ বোস মা’কে দেখেছিলেন।
সেই মনোহরপুকুরের বাড়ীতেই ১৯৪৬ সালে দোলপূর্ণিমার দিন ১৭ই মার্চ (রবিবার) বিকেলে আমি জন্ম নিই।
আমার জন্মের সময় মা’র নিজের শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছিলেননা, তাঁরা তখন দুজনেই মারা গেছেন, পাটনা থেকে তাঁর খুড়শ্বাশুড়ী – বাবাদের কাকীমা, আমাদের পাটনার দিদা – আর মা’র আপন দিদি ভগবতী – সবার ভাগুদি – এসে ছিলেন মা’র পাশে।
বাবার ডায়েরী লেখার অভ্যেস ছিল, তাঁর একটা ছোট ডায়েরীতে ১৭/৩/৪৬ তারিখের পাতায় আমার জন্ম নিয়ে লেখা ছিল “Khoka born to Saraswati at 3.15pm”!
আমি নাকি জন্মাবার পরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদিনি। সেটা ডাক্তার স্বদেশ বোসের কাছে একটা বিপদের কারণ ছিল, কেননা শিশু জন্মাবার পরে না কাঁদলে তার ফুসফুসে বাতাস না যাবার ফলে তার মৃত্যু হবার সম্ভাবনা। তিনি নাকি ক্রমাগত আমায় উলটে ধরে আমার পিছনে অনবরত চাপড় মেরেছিলেন। বেশ কয়েকবার সেই চাপড় খেয়ে শেষ পর্য্যন্ত আমি কেঁদে উঠি। এবং তার পরে আমার কান্না থামেনি, আমি নাকি সারা রাত কেঁদেছিলাম।
কিন্তু আমার কান্না আমার মা’র জন্যে ছিল খুব আনন্দের কারণ। অবশেষে তিনি মা হয়েছেন। সেই মাতৃত্বের আনন্দের সাথে কোন আনন্দেরই বোধহয় কোন তুলনা হয়না।
স্বদেশ বাবু নাকি সেদিন পরে কোন এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে বলেছিলেন, “আজ একটা difficult case ছিল। বাচ্চাটা প্রায় যায় যায় অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু যায়নি, বেঁচে গেছে।”
আমি এই পৃথিবীতে আমার প্রথম রাতের কান্নার কথা ভাবি মাঝে মাঝে। আমার জীবনের কান্নার কোটা সেদিনই অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে, এটাই যা সুখবর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে পৃথিবীর বুকে একটা শান্তির বাতাবরণ নেমে আসে। ওই সময় (১৯৪৬-১৯৬৪) সারা পৃথিবীতে জন্মের হার হঠাৎ বেড়ে যায়, শুধু ১৯৪৬ সালেই প্রায় ৭৫ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়। যুদ্ধ পরবর্ত্তী এই Population explosion কে baby boom বলা হয়, এবং সেই অনুযায়ী আমাদের এই প্রজন্মের নাম হলো Baby boomers!
এই লেখা লিখবার সময় (২০২১ সালে) আমাদের প্রজন্মের সবার পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় হয়ে এসেছে, আমাদের Baby boomer দের বয়স এখন পঁচাত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে প্রজন্ম হিসেবে আমরা আগের প্রজন্মের লোকেদের থেকে বেশী শিক্ষিত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কর্ত্তব্যপরায়ণ, দায়িত্বশীল, কর্মঠ আর পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ।
যুদ্ধ পরবর্ত্তী শান্তির পৃথিবীতে যখন জীবনের নানা ক্ষেত্রে একটা বিশাল পরিবর্ত্তনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল, সেই সময় জন্মাবার জন্যে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান বলেই মনে হয়।
২) The great Calcutta killing – আগস্ট ১৬, ১৯৪৬
আমার জন্মের আগে থেকেই ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের সাথে দুটো রাজনৈতিক দলের – কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ – দেশের স্বাধীনতা এবং দেশভাগ নিয়ে আলোচনা চলছে। মুসলিম লীগ ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমান দের জন্যে আলাদা দেশ চায়। কিন্তু আলোচনায় কোন ফল হচ্ছেনা।
মুসলিম লীগের নেতা মহম্মদ জিন্না সাহেব ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবিত প্ল্যান নাকচ করে ১৬ই আগস্ট Direct Action Day হবে ঘোষনা করলেন।
বাংলায় তখন মুসলীম লীগের সরকার, মুখ্যমন্ত্রী হুসেন শহীদ সুরাবর্দ্দী। ঠিক হলো কলকাতায় মনুমেন্টের পাশে ময়দানে মুসলমানদের বিক্ষোভ সভা হবে।
আবহাওয়া ক্রমশঃ উত্তপ্ত হচ্ছে, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হবে ধরে নিয়ে অনেকেই কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার এক মাস বয়েসে – এপ্রিল ১৯৪৬ – পাটনার দিদা মা আর আমাকে নিয়ে পাটনায় নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। একমাস পরে মে মাসে বাবা এসে আমাদের কলকাতা নিয়ে এলেন, কিন্তু তখন কলকাতার অবস্থা ক্রমশঃ খারাপের দিকে এগোচ্ছে। অনেকেই আর কলকাতায় থাকতে সাহস পাচ্ছেনা।
বাবা তখন আমায় আর মা’কে নিয়ে দিদিমার কাছে কাশীতে রেখে এসেছিলেন।
তার কিছুদিন পরে ১৬ ই আগস্টে Direct Action day তে মনুমেন্টের ওই বিক্ষোভ সভার পরে সারা শহরে দাঙ্গা আর মারামারি খুনোখুনি শুরু হয়েছিল। পরে শোনা যায় যে মুসলমান গুন্ডারা আগে থেকেই হিন্দুদের মারার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল।
প্রথমে মার খেয়ে কিছুদিন পর থেকে হিন্দুরাও নৃশংস ভাবে মুসলমান দের হত্যা করতে শুরু করে।
মাসী (মা’র ভাগুদি’) আর মেসোমশায় তখন থাকতেন মৌলালীর কাছে তাঁদের সার্পেন্টাইন লেনের বাড়ীতে। সেই জায়গাটা মুসলমান পাড়া, তাই বাবা পুলিসের গাড়ী নিয়ে সেখানে গিয়ে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে আনেন।
৩) আমার মুখে ভাত আর নামকরণ
দাঙ্গা শেষ হবার পরে বাবা মা’কে আর আমাকে কাশী থেকে কলকাতা নিয়ে এলেন। আমার মুখে ভাত অনুষ্ঠান হলো মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীতে। অনেকে এসেছিলেন, বাবার বন্ধুরা – বাণীবাবু, ভাষিবাবু, বীরেনদা’ । তাছাড়া অনেক আত্মীয়স্বজন, পাটনা থেকেও অনেকে।
মামা আমায় ভাত খাইয়েছিলেন।
সেই অনুষ্ঠানে আমার নামকরণ হয়েছিল। সেটা একটা বেশ মজার গল্প।
বাবার ডায়েরীতে এই নিয়ে লেখা আছে~
——————
মান্টুর অন্নপ্রাশনের সময় ওর নাম রাখার কথা হওয়াতে আমার শান্তিনিকেতনের বন্ধু ক্ষিতীশ রায় (বাণী) প্রস্তাব করলো যে লটারী করা হোক্।
ছোট ছোট কাগজের টুকরোতে যার যেরকম ইচ্ছে নাম লেখা ঠিক হলো। দু’টো করে নাম প্রত্যেকে লিখবে ঠিক হলো। কাগজগুলো মুড়ে একটা বাটিতে রেখে মান্টুর সামনে রাখা হলো। ছোট ছোট হাতে মান্টু খপ্ করে তার মধ্যে থেকে একটা কাগজ তুলে নিলো।
সেটাই অঞ্জুর রাখা নাম – “ইন্দ্রজিৎ”~
অঞ্জু (অঞ্জনা) হল আমার জ্যাঠতুতো দিদি (দিদিভাই) – তখন তার আট বছর বয়েস।
———————-
মা গল্প করতেন যে সবার নাম লেখা কাগজ যখন বাটিতে রাখা হয়ে গেছে, তখন দিদিভাই নাকি ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে “আমিও একটা নাম দেবো” বলে ছুটতে ছুটতে নেমে আসে।তাই দিদিভাইয়ের দেওয়া কাগজটা বোধ হয় সবচেয়ে পরে আসায় সবচেয়ে ওপরে ছিল। তাই সেটাই আমি তুলে নিই। কিংবা এমনও হতে পারে আমি হয়তো ওই নামটা তুলিনি, কিন্তু মা’র হয়তো ওই নামটাই ভাল লেগেছিল? সে যাই হোক্, ইন্দ্রজিৎ নামটাই আমার সাথে সারা জীবনের মত সেঁটে গেল। আমার অন্য কোন নামের কথা আর ভাবতেই পারিনা।
এই নিয়ে বাবা একটা ছোট্ট কবিতাও লিখেছিলেন।
———
নামযশ যত কিছু/ ওঠে লটারীতে/ইন্দ্রজিৎ হলো নাম/ইন্দ্রে নাহি জিতে/
———
-
যাও এবারের মত তোমায় ছেড়ে দিলাম ~

২৮শে মার্চ, ২০১৮।
আজ আমাদের ভিয়েতনামে শেষ দিন। এখান থেকে আমরা যাচ্ছি কাম্বোডিয়ার সীম রীপে আঙ্কোর ওয়াট মন্দির দেখতে।
সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে হানয় এয়ারপোর্টে যাবার পথে দুই জায়গায় আমাদের গাইড টুয়ান আমাদের নিয়ে যাবে, প্রথমে হো চি মিনের mausoleum, যেখানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত, তার পরে সেখান থেকে কাছেই Single pillar pagoda, এই দুটো জায়গা দেখার পরে আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে কাম্বোডিয়ার সীম রীপের ফ্লাইট ধরবো।
হো চি মিনের Mausolem শহরের একটা কেন্দ্রস্থলে, সেখানে চারিদিকে নানা সরকারী অফিস বিল্ডিং, পার্লামেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের বাড়ী ইত্যাদি।মিলিটারীর ছড়াছড়ি চারিদিকে। বিশাল প্রাঙ্গন সামনে, অনেকটা হেঁটে ভেতরে ঢুকতে হলো, বেশ ভীড়, লম্বা লাইন। রাইফেল হাতে মিলিটারী গার্ড রা দরজায় দাঁড়িয়ে, sunglass পরা চলবেনা, মাথায় টুপি পরা থাকলে মৃত নেতা কে সন্মান জানানোর জন্যে তা খুলে ঢুকতে হবে। এই সব নিয়ম মেনে সবাই লাইন দিয়ে ঢুকছে, সারা জায়গাটা অত লোক থাকতেও বেশ নিস্তব্ধ।
ছোট একটা ঘরে কাঁচের বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছেন হো চি মিন। ওইটুকু দেশের ওরকম একজন দুর্দ্ধর্ষ নেতা, USA র মত এক প্রবল প্রতিপক্ষ কে যুদ্ধে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। জানি তিনি মৃত তবু তাঁর এই ঘুমন্ত মুখের মধ্যেও একটা কঠিন ভাব, মনে হচ্ছে বেশ জীবন্ত তিনি, এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন, একটু আওয়াজ হলেই হয়তো ঘুম ভেঙে উঠে বসবেন। তাঁকে এত কাছ থেকে দেখে গায়ে বেশ কাঁটা দিচ্ছিল।
আমরা লাইন করে কাঁচের বাক্স প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে এলাম।
সেখান থেকে কাছেই One pillar pagoda সেখানে টুয়ানের সাথে আমরা হেঁটে পৌঁছে গেলাম। এখানে চারিদিকে জলের moat এর মধ্যে থেকে উঠে এসেছে একটি column এর ওপরে তৈরী নারী বুদ্ধের (female Buddha) মন্দির, আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দর্শন করে এলাম।

হানয় এয়ারপোর্টে দেবযানীর পাসপোর্ট দেখে চেক ইন কাউন্টারের লোকটি বলল আপনার পাসপোর্টে তো দেখছি দুটো ফাঁকা পাতা নেই। নিয়ম হলো দুটো ফাঁকা পাতা না থাকলে তো আপনাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া যাবেনা।
এ আবার কি নিয়ম?
প্রদোষ আর দেবযানী হলো কানাডার নাগরিক, তাদের মেয়েরা থাকে আমেরিকায়, কাজে এবং বেড়াতে তারা সারা পৃথিবীতে অনবরত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ভূপর্য্যটক আখ্যা দেওয়া যায়। তাদের পাসপোর্টের পাতা খুব তাড়াতাড়ি স্ট্যাম্পে র ছাপে ভরে ওঠে, সুতরাং দেবযানীর পাসপোর্টে দুটো ফাঁকা পাতা না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
দেবযানী বেশ বলিয়ে কইয়ে মেয়ে, তার ওপরে সে আবার খুব সুন্দরী , হানয় এয়ারপোর্টের কাউন্টারের লোকটিকে সে সহজেই বশ করে প্লেনে উঠে পড়লো।
কিন্তু তার পরে কাম্বোডিয়ার সীম রীপ এয়ারপোর্টে পৌঁছে তো এক বিরাট ঝামেলা। আমাদের সবার visa on arrival stamped হয়ে গেল , এদিকে প্রদোষ বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু দেবযানীর পাসপোর্টে পাশাপাশি দুটো ফাঁকা পাতা না থাকায় তাকে কিছুতেই এয়ারপোর্টের Immigration officer রা বাইরে বেরোতে দিচ্ছেনা। আমরা দেখছি ম্লান মুখে দেবযানী দু’জন অফিসারের সাথে একবার এদিক আর একবার ওদিকে যাচ্ছে, বুঝলাম ওকে জেরা করা হচ্ছে কেন সে এই পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে? কি তার উদ্দেশ্য? সে কি নিয়ম জানেনা?
ওদিকে বাইরে আমরা সবাই অধীর অপেক্ষায়। প্রদোষের মুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ।
শেষ পর্য্যন্ত দেবযানীকে অবশ্য ছেড়ে দিলো একজন senior officer, কিন্তু পরে তার মুখে সেই harrowing অভিজ্ঞতার গল্প শুনে মনে হয়েছে যে এক সময় সত্যিই তার মনে হয়েছিল যে তাকে কাম্বোডিয়া ঢুকতে দেওয়া হবেনা, তাকে ফিরে যেতে হবে।
বেশ কিছু দিন পরে দেবযানী বেশ মজা করে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল আমাদের।
তার গল্পে দু’জন চরিত্র, একজন মিনমিনে রোগা পাতলা জুনিয়র assistant, আর একজন মোটাসোটা বেঁটেখাটো হাট্টা গাঁট্টা সিনিয়র অফিসার।
গল্পটা এই রকম –
———————
মিনমিনে বললো ম্যাঁও ফ্যাঁও ক্যাঁও চ্যাঁও…
আমি দেবযানীকে বললাম তার মানে কি?
দেবযানী বললো ও বললো, “দেখুন না স্যার এই মেয়েটি নিশ্চয় আমাদের দেশে স্পাই করতে এসেছে এ কে ঢুকতে দেওয়া যায়না স্যার…”
হাট্টা গাঁট্টা গম্ভীর হয়ে বললো “হাঃ কাঃ ফাঃ মাঃ !”
আমি বললাম তার মানে?
দেবযানী এই সব কথার মানে সব বুঝতে পারছে, সে বললো লোকটা আমায় জিজ্ঞেস করছে আমি এই নিয়ম টা জানি কি না? আমি তো অনেক করে বুঝিয়ে বললাম না স্যার বিশ্বাস করুন আমি এই সব নিয়ম জানিনা, আমি স্পাই নই স্যার, আমি আর আমার বর আপনাদের এই সুন্দর দেশ ঘুরে দেখতে এসেছি, আমরা ট্যূরিস্ট…
মিনমিনে মিনমিন করে বললো কুঁচু মুঁচু ফুঁচু হুঁচু…
আমি বললাম তার মানে? সে বললো বুঝলেনা ও বললো, “স্যার এর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না , এই মেয়েটা কে ঢুকতে দিলে দেশের একটা বড় বিপদ হয়ে যাবে।”
এই রকম কিছুক্ষণ চলার পরে হাট্টা গাঁট্টার বোধ হয় একটু মায়া হলো। সে বললো “ফঃ হঃ ফঃ খঃ!
দেবযানী বললো তার মানে হচ্ছে “ঠিক আছে যাও এবারের মত তোমায় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু আর যেন কোনদিন এরকম ভুল না হয়!”
——————————–
দেবযানীর এই গল্পটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকের একটা প্যারোডি ছিল তাতে এক বাঙাল জমিদার সব চেয়ে বেশী চাঁদা দিয়েছেন বলে পাড়ার নাটকে আলেকজান্ডারের রোল টা তাঁকে দিতেই হয়েছে, আর তিনিও তাঁর মত করে নাটকের সব সংলাপ বলে যাচ্ছেন সইত্য সেলুকস কি বিচিত্তির এই দ্যাশ ইত্যাদি…
তো এক সময়ে স্টেজে চন্দ্রগুপ্ত কে নিয়ে সেনাপতি Antigones এর প্রবেশ।
জমিদার – অ্যা্ন্টি গনশা, এডা কেডা?
সেনাপতি – মহারাজ এই যুবক একজন গুপ্তচর, আমাদের শিবিরের বাইরে সন্দেহজনক ভাবে আনাগোনা করছিল, তাই তাকে আপনার সামনে ধরে নিয়ে এসেছি।
জমিদার – গুইপ্তচর? এ রে বন্দী কর্~
চন্দ্রগুপ্ত – আমায় বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না সম্রাট!
জমিদার – ও তুমি দ্যাখতেসি বীর! হঃ, ব্যাটাকে ছাইড়্যা দে…
দেবযানীর গল্পে ওই হাট্টা গাঁট্টা অফিসার হলেন আলেকজেন্ডার, আর দেবযানী হলো female বুদ্ধর মতো female চন্দ্রগুপ্ত !







-
টাঙ্গাইলে জ্যাঠামশায়ের সাথে কিছুক্ষণ (১৯৮১ )

আমার প্রপিতামহ স্বর্গীয় দীনবন্ধু ভৌমিকের এক মেয়ের (বাবাদের পিসীর) ময়মনসিংহে বিয়ে হয়। তিনি, এবং তাঁদের দুই ছেলে দেশভাগের পরে ভারতে আসেন নি, দু’জনেই ভিটে মাটির টানে পূর্ব্ব বাংলায় রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের বড় ছেলে (পূর্ণ রায়) ছিলেন ডাক্তার, তিনি ও তাঁর স্ত্রী ষোড়শী নিঃসন্তান ছিলেন।
আর তাঁদের ছোট ছেলে (সুশীল রায়) ছিলেন উকিল, তিনি টাঙ্গাইল কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। তাঁর দুই ছেলে তারাপদ (কবি তারাপদ রায়) আর বিজন দুজনেই কর্ম্মসূত্রে কলকাতায় চলে এলেও তিনি আসেন নি, স্ত্রী মারা যাবার পরে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি টাঙ্গাইলেই নিজের ভিটেয় থেকে যান।
তারাপদ দা’র বাবা সম্পর্কে ছিলেন আমার বাবা কাকাদের পিসতুতো দাদা, আমার সুশীল জ্যাঠামশায়।
ভাদরা যেতে না পারলেও ১৯৮১ সালে আমি একবার টাঙ্গাইলে গিয়ে সুশীল জ্যাঠামশায়ের সাথে দেখা করে এসেছিলাম। সেই ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে বেশ hostile পরিবেশে তিনি শুধুমাত্র ভিটে মাটির টানে জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ একা একজন প্রৌঢ়া বিধবা কাজের মহিলার উপর নির্ভর করে থেকে গিয়েছিলেন। জ্যাঠামশায়ের বাংলাদশে থেকে যাবার অভিজ্ঞতা অবশ্য বিয়োগান্ত হয়নি। টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ীতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।তাঁর সাথে টাঙ্গাইল শহরে গিয়ে দেখা করা নিয়ে নীচের এই লেখাটি।
———-
আমার বাবার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে প্রাক স্বাধীনতা যুগের পূর্ব্ববঙ্গের নানা শহরে, তাঁর মুখে সেই সব জায়গার নানা গল্প শুনেছি, পূর্ব্বাচল নামে তাঁর স্মৃতিকথায় ও সেইসব জায়গার সুন্দর বর্ণনা আছে।
ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, রাজসাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম…
বাবার লেখা পড়তাম আর ভাবতাম এই সব জায়গায় কি কোনদিন আমার যাওয়া হবে?
১৯৮১ সালে বাংলাদেশে যাবার সেই সু্যোগ এসে গেল। বাঙাল পরিবারে জন্ম, তাই বাংলাদেশ আসার সু্যোগ পেয়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম মনে পড়ে। ওই দেশটার সাথে আমার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন রক্তের মধ্যে মিশে আছে।
International Centre for Diarrhoeal Disease Research (ICDDR) বাংলাদেশে কলেরা আর আমাশা এই দুই রোগ আর মহামারী নিয়ে রিসার্চ করছে, তারা IBM system ব্যবহার করে বাংলাদেশে র নানা গ্রামে আর শহরে জন্ম মৃত্যু সংক্রান্ত sample demographic database তৈরী করবে। সেই কাজে সাহায্য করার জন্যে IBM India থেকে একটা assignment পেয়ে আমি তাদের সাথে বছর খানেক বাংলাদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।কাজের সূত্রে সেই এক বছর বাংলাদেশের নানা শহর দেখা হয়েছিল, অনেক লোকের সাথে আলাপ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। ঢাকায় যখন বেশ কয়েকবার যাতায়াত এবং বেশ কিছু দিন থাকা হয়ে গেছে, তখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের গ্রাম ভাদরা গ্রাম টা ঢাকা থেকে খুব একটা দূর নয়, একবার সেখানে ঘুরে এলে বেশ হয়।
কিন্তু আমি তো জায়গাটা কোথায় জানিনা, কেই বা আমায় সেখানে নিয়ে যাবে, আর সেখানে গেলেই বা নিজের পরিচয় কি দেবো, সেখানে আমার অভ্যর্থনা কেমন হবে এই সব ভেবে সেখানে যাবার আশা পরিত্যাগ করেছি।
তার পরে এক দিন মনে হলো ভাদরা না হোক, অন্ততঃ টাঙ্গাইল গিয়ে জ্যাঠামশায়ের সাথে একবার দেখা করে আসি, উনি একা একা কেমন আছেন দেখে আসি, আর তিনি হয়তো আমায় ভাদরা যাবার ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারেন। ভাদরা গ্রাম শুনেছি টাঙ্গাইল থেকে খুব একটা দূরেও নয়।
দেশভাগের সময় টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ছিল। এই ১৯৮১ সালে এখন টাঙ্গাইল একটি জেলা।
তারাপদ দা’র কাছ থেকে direction নিয়ে এসেছিলাম। এক রবিবার দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম।


ঢাকার বাইদুল মুকারাম মসজিদের কাছে বাস স্ট্যান্ড, সেখানে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে, সেই সব বাসের গায়ে বড় বড় করে বাংলায় লেখা আরবী ভাষায় কোরানের বাণী, “বিসমিল্লা রাহমানুর রাহিম”, “লা ইলা ইল্লাল্লাহ” ইত্যাদি।
রবিবার দুপুরে মাগরেব এর নমাজ সবে শেষ হয়েছে, রাস্তায় চারিদিকে লুঙ্গী পরা মাথায় টুপি দাড়িওয়ালা ধর্ম্মপ্রাণ মুসলমান লোকেদের ভীড়। সেই ভীড়ের মধ্যে আমি বিধর্ম্মী হিসেবে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত, সবাই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছে, এদের ধর্ম্মে নাকি বলে বিধর্ম্মী কে মারলে বেহেস্তে যাবার রাস্তা সুগম হয়। আমায় দেখে এই সব ধর্ম্মপ্রাণ লোকেদের মনে নিজেদের বেহেস্তে যাবার পথ সুগম করার ইচ্ছে জাগছে কিনা কে জানে?
গা টা বেশ ছমছম করছে, মনের ভেতরে বেশ একটা শিরশিরানি ভয় টের পাচ্ছিলাম।
কাজটা কি ঠিক করছি?
ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল খুব দূর নয়, বাসে দুই ঘন্টার পথ।
টাঙ্গাইলের বাস খুঁজে উঠে বসে পড়লাম। ছুটির দিন দুপুর, বাস ফাঁকাই পেলাম। পিচের রাস্তা তেমন চওড়া না হলেও বেশ মসৃণ, শহর ছাড়িয়ে একটু পরেই দু’দিকে চোখে পড়ল অবারিত প্রান্তর, দিকচক্রবাল পর্য্যন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে কিছু I গ্রাম আর জনপদ আসে, সেখানে বাড়ীর দেয়ালে নানা ধরণের লিখন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী”, কিংবা “কাদের সিদ্দিকির হুলিয়া, নিতে হবে তুলিয়া” ইত্যাদি।
বট, অশ্বথ, ছাতিম, তেঁতুল, আম জাম, কাঁঠাল, আরও কত নাম না জানা গাছের ডাল পালা দুই পাশ থেকে এসে রাস্তার ওপরে ঝুঁকে পড়ে ছায়া ফেলে। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে পথের ধারে কলাবাগান, কিছু ছোট পুকুর, ছোট বাড়ী, অসংখ্য নারকেল গাছ।
বেলা তিনটে নাগাদ টাঙ্গাইল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে রিক্সা নিলাম। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম। রিক্সাওয়ালা একেবারে অবিকল তারাপদ দা’র মত করে কথা বলছে, এক সুর, এক উচ্চারণ, এক কথা বলার ভঙ্গী। একেই বোধ হয় বলে স্থানমাহাত্ম্য।
টাঙ্গাইল শহরে সবাই ওই ভাবেই কথা বলে নাকি?
তারাপদ দা’র direction থাকায় জ্যাঠামশায়ের বাড়ী বাস স্ট্যান্ড থেকে কাছেই, খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলোনা। রাস্তার ওপরেই একতলা ছোট বাড়ী। রাস্তার উল্টো দিকে একটা বিরাট পুকুর। বাড়ীর সামনে বারান্দায় আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে (বোধ হয় মার্চ্চ মাস, তখনও অল্প শীত) জ্যাঠামশায় আরামকেদারায় বসে রোদ পোয়াচ্ছেন, এই দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। আমায় দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলেন। বাবা আর দাদুর নাম বলতেই চিনতে পেরে উঠে আমায় জড়িয়ে ধরলেন।
ছোটখাটো চেহারা, চোখে ঘষা কাঁচের চশমা, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, তবু মনের জোর আর সাহস সাঙ্ঘাতিক, দুই ছেলে পাশে নেই, স্ত্রীও গত হয়েছেন, বয়স হয়েছে, তবু একা একা এক বয়স্কা কাজের মহিলার ওপরে নির্ভর করে তিনি টাঙ্গাইলে থেকে গেছেন।
বান্ধবহীন স্বজনহীন জীবনে অপ্রত্যাশিত ভাবে জ্যাঠামশায় আমায় পেয়ে খুব খুসী হয়েছিলেন বুঝেছিলাম, অচেনা হলেও আমি তো ঘরের লোক, হাজার হলেও রক্তের সম্পর্ক। আমার কাছ থেকে পরিবারের কে কোথায় আছেন সব খবরাখবর নিলেন। মামা রা দুজনেই (ব্রজবন্ধু, জগদবন্ধু) চলে গেছেন সে কথা জানেন, আমার বাবাও যে অল্পবয়েসে গত হয়েছেন সে খবরও পেয়েছেন জানালেন।
তারাপদ দা’র সাথে আমার যোগাযোগ আছে জেনে খুসী হলেন।
সেই বিধবা কাজের মহিলাও আমায় দেখে খুব খুসী। হাসিমুখে ঝকঝকে কাঁসার রেকাবী আর গেলাসে যত্ন করে আমায় বাড়ীর তৈরী নাড়ু, নিমকি সন্দেশ আর ঠান্ডা জল এনে দিলেন, ভেতরে শোবার ঘরে খাটের ওপর বসে নানা গল্প করতে করতে খেলাম।
ঘন্টা দুয়েক ওঁদের সাথে বেশ কেটে গেল।


ভাদরা যাবার কথা তুললাম। কিন্তু বুঝলাম জ্যাঠামশায় এর ইচ্ছে নয় আমি ভাদরা যাই। ভাদরা যাবার ব্যাপারে উনি খুব একটা উৎসাহ দিলেন না। প্রথমতঃ গ্রামটা নাকি অগম্য, রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। আলপথ ধরে হেঁটে বা সাইকেলে চেপে যেতে হয়। আর বর্ষা কালে নৌকায়। তাছাড়া সেখানে আমাদের আর কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, আমায় দেখে ওখানকার স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে unfavourable (adverse, hostile) reaction হবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।
বাংলাদেশে এখন গ্রাম অত অগম্য এই যুক্তি আমি ঠিক মেনে নিতে না পারলেও তাঁর সাথে তর্ক করিনি। নিশ্চয় অন্য কোন কারণ ছিল, যা তিনি আমায় বলতে চান নি, যার জন্যে তিনি আমায় ভাদরা যেতে উৎসাহ দেন্নি, হয়তো ওখানে গেলে সত্যিই আমার কোন বিপদ হবার সম্ভাবনা ছিল।
অন্ধকার হবার আগেই উঠলাম। তারপরে রিক্সা নিয়ে আবার বাসস্ট্যাণ্ড।
বারণ করা সত্ত্বেও জ্যাঠামশায় আমার সাথে বাস স্ট্যাণ্ড পর্য্যন্ত এসে পৌঁছে দিলেন। এখনও তিনি ওকালতি করেন বুঝলাম, কালো একটা কোট চাপিয়ে নিলেন বেরোবার আগে। বাস স্ট্যান্ডে অনেক পরিচিত লোক তাঁকে “চাচা কেমন আসেন?” বলে হেসে সালাম জানাচ্ছিলেন। তিনি তাদের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন, বললেন আমার ভাইপো। কলকাতা থেকে দেখা করতে এসেছে। বাসস্ট্যাণ্ড এর কাছে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল, আমায় আঙুল তুলে দেখালেন, ছোটবেলায় তারাপদ দা’ ওই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ওনার কবিতায় ওই স্কুলের উল্লেখ আছে, মনে পড়ে গেল।
তারপরে বাসে উঠে পড়লাম, জানলা দিয়ে দেখলাম জ্যাঠামশায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন, ঝলঝলে ট্রাউজার্স, গায়ে কালো কোট, তাঁকে দেখে বেশ দুঃখী, অসহায় আর একলা মনে হচ্ছিল, ইংরেজীতে যাকে বলে sad lonely and lost~
জ্যাঠামশায়ের ওই বাস স্ট্যান্ডে আমায় বিদায় জানানোর দৃশ্য টা আমার এখনও পরিস্কার মনে পড়ে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমায় আপন করে নিয়েছিলেন।
তার দুই এক বছরের মধ্যে টাঙ্গাইলেই তাঁর জীবনাবসান হয়।
বাসে আসতে আসতে ভাবছিলাম কি হতো যদি শ্যামাপ্রসাদ না পারতেন, যদি কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গ পাকিস্তানে চলে যেতো?
১৯৪২ সালে ব্রজবন্ধু মারা গেছেন, আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীতে তখন তাঁর ছেলেরা অর্থাৎ আমাদের বাবা কাকারা থাকেন। তাঁরা কি পাকিস্তানে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কলকাতার বাড়ী বিক্রী করে বিহারে পাটনা বা রাঁচীতে বাস তুলে নিয়ে যেতেন?
বলা মুস্কিল।
পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশের) নাগরিক হলে আজ আমাদের কি অবস্থা হতো? আমরা কি “নিজভূমে পরবাসী” হয়ে মাথা নীচু করে থাকতাম?
বাসের ঝাঁকানীর মধ্যে এই সব ভাবতে ভাবতে চলেছি।
জানলার বাইরে তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।


-
এ আমার, এ আমার, এ আমার

মা ও ছেলে নভেম্বর, ২০১৭
মা’র ৯৪ বছর বয়েস হল, ক্রমশঃ আরো ক্ষীন আর দুর্ব্বল হচ্ছেন। সারাদিন বাড়ীতে বন্দী, লাঠি ধরে আস্তে আস্তে হাঁটেন। ভাই বোন সমবয়েসী খেলার সাথী এক এক করে সবাই চলে গেছেন, এখন তাঁরও ওপারে যাবার অপেক্ষা।
আমি মা’র একমাত্র সন্তান তাই তাঁর স্নেহের সিংহভাগ আমিই পেয়ে এসেছি। অবশ্য সেই স্নেহের উল্টোদিকে ছিল কঠোর শাসন আর পরের দিকে গভীর দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ, যার ভারও আমায় সারা জীবন একাই বইতে হয়েছে।
১৯৬৩ সালে খড়গপুরে হোস্টেলে যাবার সময়ে (আমার সেই প্রথম বাড়ী ছেড়ে একা থাকা)হাওড়া স্টেশনে আমায় তুলে দিতে এসেছিলেন মা আর বাবা। ট্রেণ ছেড়ে দেবার পরে অনেকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়েছিলাম। দু’দিন পরে বাবার লেখা পোস্টকার্ড পেলাম। হাওড়া স্টেশনের পোস্ট অফিস থেকে সে দিন আমায় ট্রেণে তুলে দিয়েই লিখে পোস্ট করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন তোমাকে ছেড়ে তোমার মা খুব কাঁদছেন, তুমি ঠিকঠাক পৌঁছলে কিনা জানার জন্যে আমরা খুব উদ্বিগ্ন থাকবো, তাই এই চিঠি পেয়েই উত্তর দিও।
এবছর পূজা সংখ্যা দেশে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস “ঘটনাক্রমে” র এক জায়গায় বৃদ্ধা মা মোহিনী এবং তাঁর প্রৌঢ় এবং অসুস্থ ছেলে সুকুমার কে নিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
—————–
মোহিনী আর আগের মত চটপটে নন্, নানা ব্যথা বেদনা অস্থি সন্ধিতে বিকলতা, লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। তাই তাঁর ছেলে সুকুমার যখন শেষ দুপুরে নার্সিং হোম থেকে ফিরলেন, তখন তিনি তেমন উদ্বেলিত হতে পারলেন না। তবে তাঁর মুখে এক অপরূপ হাসি ছিল। সুকুমার যখন তাঁর বিছানার পাশে পা ঝুলিয়ে বসলেন তখন মোহিনীর রোগা হাত সুকুমারের পিঠে বিচরণ করছে। কি খুঁজছে সেখানে কে জানে? কে জানে মায়ের হাত সন্তানের শরীরে বার বার নিজেকেই খুঁজে পায় কিনা। হয়তো হাত ও বিড়বিড় করে। এ আমার এ আমার এ আমার।
——————–
গল্পের মোহিনীর মত আমার মা ও এক কালে খুব চটপটে ছিলেন, সারা জীবন এ জি বেঙ্গলে চাকরী করেছেন, রোজ সকালে নিয়ম করে ভীড় বাসে চড়ে ডালহাউসী স্কোয়ারে অফিস গিয়েছেন, সন্ধ্যাবেলা রোজ ফিরেছেন ট্রামে। তাছাড়া বিশাল যৌথ পরিবারের অনেক দায়িত্ব সামলেছেন, নিকট এবং দূর সম্পর্কের দুঃস্থ আত্মীয়দের যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। দেশের প্রায় সব তীর্থস্থানে গিয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি এক আশ্চর্য্য সফল, ব্যস্ত এবং কর্ম্মবহুল জীবন কাটিয়েছেন।
ছোটবেলায় আমি মা’র সাথে দূরপাল্লার ট্রেণে করে অনেক ঘুরেছি। কখনও দিল্লী, কখনও পাটনা, কখনও কাশী। সেই সব ভীড় ট্রেণে unreserved কামরায় হুড়োহুড়ি করে আমার হাত ধরে মা কি করে যে ঢুকে জায়গা করে নিতেন, ভাবলে বেশ অবাক লাগে।
কিন্তু সেই মা এখন সারাদিন আমাদের পূর্ণ দাস রোডের বাড়ীর বারান্দায় জানলার সামনে একটা চেয়ারে একা চুপ করে বসে থাকেন। কথা বলার লোক নেই, বলার মত কোন কথাও নেই। কিছুদিন আগেও খবরের কাগজ আর দেশ পত্রিকা খুঁটিয়ে পড়তেন, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে কেবল গীতা নিয়ে পাতা উল্টোন্।
এখন আমি রোজ একবার মা’র কাছে বিকেলে যাই, মা’র পাশে বসে একসাথে চা খাই। পুরনো দিনের নানা কথা হয়। গল্পের মোহিনী র মতো মা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোন।
কোন কাজে আটকে গেলে আজ যেতে পারছিনা বলার জন্যে মা’কে ফোন করি, কিন্তু আমার ফোন পেয়ে কিছু বলার আগে মা নিজেই জিজ্ঞেস করেন, “কি রে আজ আসতে পারবিনা? আজ কি হলো, শরীর ঠিক আছে তো?”
এই উদ্বেগ অবশ্য আমার বেশ ভালোই লাগে। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি।
একবার মনে আছে মা’কে নিয়ে এক ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বাইরে হলে ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। পাশাপাশি বসার জায়গা নেই, তাই মা’র থেকে J একটু দূরে বসেছি। আমার পাশের লোকটি উঠে গেলে একটু জায়গা হতেই মা, ছোটখাটো মানুষটি, ক্ষিপ্র ভঙ্গীতে তীর বেগে কেউ আসার আগেই চলে এসে আমার পাশে বসে পড়লেন।
ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু এখনো ভুলতে পারিনা।

মা আর বাবা – বিয়ের পরে 
মা ও আমি মাঝে মাঝে আমি আমার গাড়ীতে মা’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কোনদিন মাসতুতো বোন গার্গীর বাড়ী বাঁশদ্রোণী। কোনদিন মামাতো বোন মিনির বাড়ী কসবায়। এরকম আরো অনেক আত্মীয়স্বজন আর কাছের লোকের কাছে চলে যাই, খানিকক্ষন সময় কাটিয়ে আসি। মা বেশী কথা না বললেও তাঁর ভাল লাগে বুঝতে পারি। যাদের বাড়ীতে যাই তারাও খুব খুসী হয় মা’কে পেলে।
আমাদের যৌথ পরিবারে মা লতায় পাতায় সবার সাথে গভীর সম্পর্ক রাখতেন। এ ব্যাপারে তাঁর একটা স্বাভাবিক তৎপরতা ছিল।
কিছুদিন আগে মা’কে বললাম চলো তোমাকে তোমার অফিস দেখিয়ে আনি। এক সময়ে যেখানে তুমি রোজ যেতে।
মা রাজী।
প্রথম স্টপ মনোহরপুকুর। আমাদের বাড়ি আর নেই, বিক্রী হয়ে গেছে, সেখানে এখন নতুন বাড়ি, তার তলায় গিয়ে গাড়ীটা পার্ক করে কিছুক্ষণ থাকলাম। মা চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন বাড়ীটার দিকে। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি এখানে কাটিয়েছেন।
সেখান থেকে কালীঘাটে মায়ের মন্দির। মহিম হালদার স্ট্রীট দিয়ে কালীমন্দির যাবার পথে একটা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির পড়তো সেখানে মা আর জ্যেঠিমা শিবের মাথায় জল দিতেন।বছরে অন্ততঃ তিন দিন আমি আর মা এক সাথে কালীবাড়ী যেতাম। আমার জন্মদিনে ভোরবেলা, শিবরাত্রির দিন বিকেলে আর কালীপূজোর দিন রাত্রে।
কালীঘাট থানার পরে মন্দিরের রাস্তায় ঢুকে ডান দিক বন্ধ, পুলিশ গাড়ী ঢুকতে দেবেনা, দূর থেকেই মা দুই হাত জুড়ে প্রণাম করে নিলেন। মা খুব শিবের ভক্ত ছিলেন, প্রায় সব সময় তাঁর গলায় “প্রণমামি শিবং শিব কল্পতরুং” গানের সুর শুনে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম।
তার পরে সেখান থেকে আশুতোষ মুখার্জ্জী রোড, হাজরা মোড়, পুর্ণ সিনেমা, জগুবাবুর বাজার, এলগিন রোড, লছমী বাবু কা সোনা চাঁদী কি দুকান। মা’কে বললাম কি, এই সব জায়গা চিনতে পারছো? তোমার তো চেনা রাস্তা, রোজ দু’বেলা বাসে করে এই রুটে যাতায়াত করতে।
মা ঘোলাটে চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে বললেন “কতো গাড়ী, কি ভীড়!”
সবই মা’র চোখে নতুন লাগছে মনে হলো।
তারপর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হয়ে রেড রোড দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন মা দেখলাম বাইরের সবুজ দেখে খুব খুসী। তার পরে ইডেন গার্ডেন আকাশবাণী ভবন হয়ে রাজভবনের সামনে মা’র পুরনো অফিস। সেখান থেকে আউটরাম ঘাটে গঙ্গা। মা আবার হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।
এই সব জায়গা এক সময় কত পরিচিত ছিল তাঁর!
বাড়ী যখন ফিরছি তখন অন্ধকার নেমে আসছে।

বাড়ীর দূর্গাপূজোতে মা আর আমি ———————-
নভেম্বর, ২০২৩
এখন এই ২০২৩ সালে যখন মা আর আমাদের মধ্যে নেই, আমি মাঝে মাঝে বাড়ীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি। নীচে পূর্ণ দাস রোডে আর কেয়াতলা রোডে লোকজন, ব্যস্ততা, গাছে পাখী এসে বসছে, কাঠবিড়ালী তরতর করে গাছের ডাল দিয়ে চলে যাচ্ছে, চারিদিকে প্রাণের খেলা।
মনে হয় সবই আছে আগের মত, শুধু মা ই আর নেই।
কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানে এক ভদ্রমহিলা বলছিলেন, এখন থেকে একশো বছর পরে, ধরো ২১২৩ সালে, যখন আমরা কেউ বেঁচে থাকবোনা, তখন আমাদের এই যে এখন এত বাড়ী গাড়ী টাকা পয়সা, এই সব কোথায় থাকবে? আমাদের কষ্টার্জ্জিত টাকায় তৈরী বাড়ীতে থাকবে অচেনা লোকেরা, আমাদের এত সাধের দামী গাড়ী স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে পড়ে থাকবে। আমাদের মৃত্যুর পর বড় জোর কয়েক দশক আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের মনে রাখবে, আমাদের ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবে, কিন্তু তারপর? আমরা কি আমাদের ঠাকুর্দ্দার ঠাকুর্দ্দার নাম কেউ জানি, বা জানতে চাই?
তাহলে মোদ্দা কথাটা কি দাঁড়ালো?
ভিডিওর মহিলা বলছেন, সবসময় ভাবো কত ক্ষণস্থায়ী আমাদের জীবন, তাই “এ আমার এ আমার এ আমার” বলে কোন কিছুকেই একান্ত নিজের বলে আঁকড়ে থেকে মনকে ভারাক্রান্ত কোরোনা।
গীতায় ও ভগবান শ্রী কৃষ্ণ আমাদের সেই নিরাসক্তি আর নির্লিপ্তি সাধনা করার উপদেশ দিয়ে গেছেন।
মা’র মৃত্যু এখন অন্য আর একটি কারণে আমার জন্যে অনেক সহনীয় হয়ে এসেছে।
২০১৯ সালে মা চলে যাবার পরের বছরেই (২০২০ সালে) আমাদের জীবনে কোভিডের অতিমারীর আবির্ভাব হয়।
কোভিডের আগে অনেক বছর ধরে আমাদের মনে সার্থক জীবন আর ভাল মৃত্যু সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী হয়েছে। আগে সেই চলে যাওয়া ছিল এক সার্থক জীবনের সুখী পরিণতি। দীর্ঘ জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে সব দায়িত্ব পালন করে পরিণত বয়সে আত্মীয় পরিজনদের সবাইকে পাশে রেখে সেই চলে যাওয়ার সার্থকতা এতদিন ছিল সামাজিক পরিপূর্ণতায়।
আমার মা যখন পরিণত বয়সে মারা যান, তখন শ্মশান ঘাটে গিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আমার সব ভাই বোনেরা গিয়েছিল। তাঁর শ্রাদ্ধবাসরেও অনেকে এসেছিলেন, স্মৃতিচারণ করেছিলেন। আমাদের ধারণায় এই ছিল গ্রহণযোগ্য মৃত্যু।
কিন্তু ২০২০ সালের এই করোনা ভাইরাস এসে ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু নিয়ে আমাদের ধারণা যেন আমূল পালটে দিয়ে গেল।
মৃত্যুর কি নতুন রূপ দেখলাম আমরা?
আনন্দবাজারে সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত লিখেছেন – “আমরা দেখলাম করোনা আক্রান্ত কে বাড়ী ফিরতে দেওয়া হচ্ছেনা, চিকিৎসক কে পাড়া ছাড়া করা হচ্ছে, মুমূর্ষূ কে এম্বুল্যান্স থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আক্রান্ত কে তো বটেই, তার পরিবার কেও একঘরে করা হচ্ছে, ফুটপাথে পড়া রোগীর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেনা। সেই সঙ্গে আতঙ্ক, গুজব, কুসংস্কার। সংক্রমণের আশঙ্কায় আত্মীয় স্বজন কে মৃতদেহের কাছে যেতে দেওয়া হয়না। হাসপাতাল থেকেই সোজা কোভিড আক্রান্ত দের জন্যে আলাদা শ্মশানে দাহ করার জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ”
যাঁরা দেখাশোনা করেন, সেই নার্স ও ডাক্তাররা স্পেসস্যুটের মত পোষাক পরে থাকেন, যাতে তাঁরা আক্রান্ত না হন্। তাঁদের হাতে দস্তানা, চোখে ভারী গগলস্, যাতে বীজানু না ঢোকে। ফলে মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে রোগীর সাথে কোন মানুষের শারীরিক যোগাযোগ নেই। এমন কি ডাক্তার বা নার্সের চোখে কোন সহানুভূতির ছায়া অথবা তাঁরা যে কোন মানুষের সঙ্গের স্বাদ পাবেন, তারও উপায় নেই।
আপনজনের মৃত্যু এমনিতেই অসহনীয় দুঃখের, কিন্তু করোনার আবহে করোনাভাইরাস এমন একটা অসামাজিক চেহারা দিল মৃত্যুকে, যার জন্যে আমরা মানসিক ভাবে এখনো তৈরী নই। হয়তো কোন দিন হবোনা।
আমার মা এই কোভিড অতিমারীর আগে চলে গেছেন এই কথা ভেবে মনের মধ্যে একটা স্বস্তি অনুভব করি।


-
ভুলভুলাইয়া

ধাবার সামনে দীপা, সুভদ্রা আর সুব্রত ২০১৬ সালের মে মাসে আমরা কুয়েত থেকে পাকাপাকি দেশে ফিরে এসেছি। কোন কাজ নেই, এই সময় দু’তিন দিনের জন্যে কলকাতার কাছে কোথাও বেড়াতে গেলে বেশ হয়।
হুগলি জেলায় ইটাচুণার রাজবাড়ী কথা বেশ কিছুদিন শুনছি। চেনাশোনা অনেকেই সেখানে গিয়ে থেকে এসেছে, তাদের কাছ থেকে খবর পেয়েই আমরা দুজনে এক উইকেন্ডে সেখানে গাড়ী ভাড়া এক রাতের জন্যে ঘুরে আসবো ভেবেছিলাম। দীপা গরমের ছুটিতে ছেলের সাথে কলকাতায় আছে, সে একদিন এসেছিল দেখা করতে, আমরা ইটাচূনা রাজবাড়ী যেতে চাই শুনে সে নেচে উঠলো, “চলো সুভদ্রা দি’, আমরা একসাথে যাই।”
সুব্রত ঈদের ছুটিতে কুয়েত থেকে কলকাতায় আসছে, ওরা ইটাচূনা যায়নি, ঠিক হল আমরা চারজন একসাথে যাবো।
ইটাচূণা আবার কি নাম?
অবশ্য গ্রামের নামের কোন মানে থাকতে হবে তার কি মানে আছে?
জলপাইগুড়ি তে ডুয়ার্সের একটা চা বাগানে একবার কাজে গিয়েছিলাম, অপূর্ব্ব সুন্দর জায়গা, চা বাগানের মধ্যে সারি সারি লম্বা লম্বা shade tree, দূরে নীল পাহাড়, কিন্তু জায়গাটার নাম ঘাটিয়া…
আমার ভালকাকীমার বাপের বাড়ী ছিল পুর্ব্ব বাংলার রংপুরের কাছে একটা গ্রামে, তার নাম গাইবান্ধা। কেন? ওখানে কি গরুদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় নাকি?
গ্রামের নামের কোন মাথামুন্ডু হয় না, যা ইচ্ছে একটা হলেই হলো।
ইটাচূণা নামটা অবশ্য বেশ ভাল, তার ওপরে আবার রাজবাড়ী। গ্রামে আবার রাজা কোথা থেকে এল? জমিদার বা খুব বড়লোক হলে সবাই রাজামশায় বলে ডাকে। সেরকমই কিছু হবে। ওই গ্রামের এক ভদ্রলোক শোনা যায় সাহেবদের আমলে ইট আর চূনের ব্যবসা করে লালে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। সাহেবরা তাঁকে ভালবেসে অনেক জমি আর রাজা উপাধি দিয়ে থাকবেন, সেই থেকেই ইটাচূণা রাজবাড়ী।
সুভদ্রা ইন্টারনেট থেকে ফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোন করে দুটো ঘর বুক করে ফেলেছে। ঘরের নাম ঠাকুমার ঘর আর বড়বৌদির ঘর। বেশ নাম তো ? বনেদী রাজবাড়ীর অন্তঃপুরের একটা গন্ধ পাওয়া যায় ওই নামগুলোতে। ওই ঘরে আমরা থাকবো ভাবতে বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছিল।
সুভদ্রা যদি ঠাকুমা হয়, আমি কি তাহলে ঠাকুর্দ্দা? কিংবা সুভদ্রা বড়বৌদি, আমি বড়দা’?
মন্দ কি?
ইন্টারনেটের কল্যাণে আজকাল সব কিছুই ঘরে বসেই করা যায়, ইটাচূণা রাজবাড়ীর ওয়েবসাইটে গিয়ে আমি পরের দিন এক রাতের জন্যে পেমেন্ট ও করে দিলাম। দীপারা একটা বড় গাড়ীর বন্দোবস্ত করেছে।
বুধবার ৬ই জুলাই সকালে বেরোব, আগের দিন রাজবাড়ীর marketing office থেকে ফোন এলো। hiসকালে আর রাত্রে কি খাবেন? মেনু হল মাছ, মাংস, চিকেন আর ডিম।
বেশ ভাল ব্যবস্থা তো? Very well organized…
আমি আর সুভদ্রা মাছ, দীপা আর সুব্রত ডিম অর্ডার করলাম।
ছয় তারিখ কথামতো ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় গাড়ী নিয়ে দীপা আর সুব্রত আমাদের আইরনসাইড রোডের বাড়ীতে হাজির। আমরাও তৈরী হয়ে ছিলাম।
বড় গাড়ী। টয়োটা ইনোভা, পিছনে বুটে আমাদের মালপত্র রেখে আমরা যে যার মত বসে গেলাম। আমি ক্যামেরা হাতে সামনে, ড্রাইভারের পাশে। ড্রাইভারের নাম বাপী। বাপীর ছোটখাটো চেহারা, সে অল্প কথার মানুষ, আমায় একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল দরকার পড়লে ডাকবেন, আমি এই দেশের সব জায়গায় গাড়ী চালিয়েছি। সব রাস্তা আমার চেনা।
কাল ইন্টারনেট থেকে আমি ম্যাপ ডাউনলোড করেছি, কিন্তু তার আর দরকার হবেনা, ইটাচূণা রাজবাড়ির রাস্তা বাপীর চেনা, সে এখানে আগে এসেছে।
রাস্তায় খাবার জন্যে আমরা গতকাল হলদিরাম থেকে কিছু নোনতা স্ন্যাক কিনেছি, আজ দীপা আর সুব্রত বেকবাগানে মিঠাই থেকে সিঙাড়া আর কড়াপাকের সন্দেশ কিনে নিলো গাড়ী থামিয়ে।
পার্ক সার্কাস ব্রীজ ছাড়িয়ে সেকেন্ড হুগলী ব্রীজ, সেটা ছাড়াতেই দেখা গেল নীল রং দিয়ে সাজানো নবান্ন বিল্ডিং। তারপরে কোনা রোড চলে এলো, ক্রমশঃ লোকালয় ছাড়িয়ে যাচ্ছি আমরা, দু’পাশের দৃশ্যপট landscape দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সুভদ্রাদের রামরাজাতলার বাড়ীর রাস্তা পেরিয়ে গেলাম, শহর থেকে শহরতলী, রাস্তার পাশে বাড়ী আর দোকান বাজারের চেহারা পালটে যাচ্ছে।




শহরতলী ছাড়িয়ে ক্রমশঃ চওড়া দূর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে আমাদের গাড়ী যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ গাড়ীতে আছি, এবার একটা rest room break নিলে হয়না?
বাপীকে বলতেই সে পথে একটা Rest area তে নিয়ে এসে গাড়ী থামালো। এই সব জায়গা সব তার হাতের পাতার মত চেনা।
বিরাট একটা খোলা জায়গা, মাঝখানে HP petrol station, দূরে HP নামে একটা ধাবা।
ধাবার দরজায় এক বিশাল চেহারার ভদ্রলোক হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন।
এই এক শুরু হয়েছে দেখছি আজকাল এই দুই হাত জোড় করে নমস্কার। কোন মলে গেলে সিকিউরিটি গার্ডরা আমাদের body check করার আগে নমস্কার করবেই। কেন রে বাপু? আমরা তো টেররিস্ট হতে পারি। আমাদের পেটে বোমা গোঁজা কিংবা পকেটে ছুরি কিংবা রিভলভার থাকতে পারেনা? ভাল করে আমাদের চেক কর্ তা না যেন আমরা রামচন্দ্র আর তারা ভক্ত হনুমান।
“অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ” কথাটা পালটে এখন বলা উচিত “অতি ভক্তি গার্ডের লক্ষণ।”
দোকান ফাঁকা, কিছু চেয়ার আর সোফা এদিক ওদিক বসানো। কাউন্টারে আর এক হুমদো মত ভদ্রলোক বসে আছেন।
প্রথম হুমদো হাত জোড় করে নমস্কার করে আমাদের বললেন “আসুন, আসুন!”
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কফি পাওয়া যাবে?”
অবশ্যই পাওয়া যাবে জানালেন তিনি। কফির অর্ডার দিয়ে দিলাম আমরা। সুভদ্রা আর দীপা বাথরুমে যাবে। কিন্তু ধাবায় বাথরুম নেই। দোকানের একটি ছেলে ওদের দূরে বাথরুম দেখাতে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে সুব্রত কাউন্টারের দ্বিতীয় হুমদো ভদ্রলোক কে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে শুরু করেছে।
এই দোকানটা কি HPর ? না, ওঁরা ফ্রাঞ্চাইজ নিয়েছেন।
মালিক কে? ওই যিনি দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন।
তাহলে আপনি? আমি কর্ম্মচারী।
আজ তো ঈদের ছুটি, দোকানে ভীড় নেই কেন? কি করে বলবো? পরে বিকেলের দিকে ভীড় হবে আশা করছি।
আপনাদের এখানে কি ঘর পাওয়া যায়? না।
ক’জন লোক কাজ করে? দশজন।
আমি বুঝতে পারছিলাম সুব্রত র এই grilling ভদ্রলোকের পছন্দ হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পরে ওনার একটা ফোন এল, তিনি সুব্রতর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেন।
কফি আর আসেনা, ওদিকে সুভদ্রা আর দীপাও ফিরছেনা। আমি আর সুব্রত দু’জনে বসে আড্ডা মারছি। আমাদের আজকের সাবজেক্ট পৃথিবীতে তেলের দাম কেন কমে যাচ্ছে? সুব্রত তেল কোম্পানীতে কাজ করে, আমিও একসময় Indian Oil এ কাজ করেছি। তাই ভারতের তেল নিয়ে কথা উঠলো, আমরা কত তেল import করি, ইত্যাদি। সেখান থেকে কথায় কথায় ভারতবর্ষের Refinery র কথা উঠলো। আমি সুব্রত কে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা আম্বানীদের গুজরাটে একটা Refinery আছে না? কোথায় যেন?
এই রে!
সুব্রতর কিছুতেই মনে পড়ছেনা জায়গাটার নাম। আমারও না। কিছু জানা জিনিষের নাম ভুলে গেলে বড্ড অস্বস্তি হয়, না মনে পড়া পর্য্যন্ত অস্থির লাগে।
ওই কাউন্টারের ভদ্রলোক কি জানেন ? ওনাকে সুব্রত জিজ্ঞেস করবে নাকি? কিন্তু ভদ্রলোক সেই যে ফোন কানে নিয়ে বসে আছেন, কার সাথে এত লম্বা কথা বলছেন কে জানে। কিংবা হয়তো কারুর সাথে কথা বলছেন না আদৌ, সুব্রতর প্রশ্নবাণ আবার শুরু হবে এই ভয়ে ফোনে কথা বলার অভিনয় করছেন।
ভুলে যাওয়া নিয়ে এই রকম একটা গল্প আছে। এক ভুলো লোকের বাড়ীতে তার বন্ধু এসেছে, সে তার বন্ধুকে বলছে জানিস, কাল আমরা একটা রেস্টুরেন্টে খেলাম। সে যে কি অপূর্ব্ব খাবার~
বন্ধু জিজ্ঞেস করল কোন রেস্টুরেন্ট? কি নাম?
এই রে, নাম তো মনে পড়ছেনা। একটা ফুলের নাম কর্, যা প্রেমিকরা প্রেমিকাদের দেয়।
বন্ধু বললো, কার্নেশন?
আরে না না।
তাহলে কি প্যানসি?
না না, যে ফুলের গাছে কাঁটা থাকে।
ও Rose?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলে ভুলো লোকটি তার বৌ কে ডেকে বললো, এই Rose, কাল আমরা যে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম তার নামটা যেন কি?
তার মানে রেস্টুরেন্টের নাম তো ভুলেছেই, তার ওপর নিজের বৌয়ের নামও মনে নেই!
সুব্রতর অবশ্য অত খারাপ অবস্থা নয়, সে বৌয়ের নাম ভোলেনি।
একটু পরে দীপা আর সুভদ্রা ফিরতেই সুব্রতর দীপাকে প্রথম প্রশ্ন – অমুক দা কোথায় থাকেন যেন?
দীপা একটুও সময় না নিয়ে promptly বললো জামনগরে!
সুব্রতর মুখটা তাই শুনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে সে বললো ~
ইন্দ্রজিৎ দা’, জামনগর!




-
দুই অর্জ্জুনের সাথে একদিন

১) প্রথম অর্জ্জুন – দীপু ঘোষ
বিখ্যাত ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় দীপু ঘোষের সাথে কলেজের বন্ধু তপন রায়ের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রে বেশ কয়েক বছর আগে আমার ইমেলে যোগাযোগ হয়। তখন তিনি আর তাঁর স্ত্রী শ্যামলী বৌদি আইসল্যান্ডে থাকতেন। সেই দেশে তিনি অনেক বছর আগে ব্যাডমিন্টন কোচ হয়ে গিয়েছিলেন, এবং সেই দেশের সরকারের আনুকুল্যে তিনি সেখানেই থেকে যান। সম্প্রতি তাঁরা আইসল্যান্ড ছেড়ে সিঙ্গাপুরে তাঁদের একমাত্র ছেলের কাছে এসে আছেন।
তিনি আমাদের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড়, তপন তাঁকে দীপুদা’ বলে ডাকে, তাই তিনি আমারও দীপুদা’ হয়ে গেলেন চট করে। ২০২১ সালে প্রথম আলাপের সময় দীপুদা’ আর শ্যামলী বৌদি আইসল্যান্ডে রামকৃষ্ণ মিশনের নানা কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাঁর ইমেলের বেশীর ভাগই ঠাকুর রামকৃষ্ণ আর স্বামী বিবেকানন্দের নানা বাণী এবং রামকৃষ্ণ চরিতামৃত থেকে উদ্ধৃতি থাকে, সেই সব মেল থেকে তাঁকে একজন ধার্ম্মিক এবং আধ্যাত্মিক লোক বলে মনে হয়, ব্যাডমিন্টন খেলার সাথে তাঁর এখন আর কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়না।
আমাদের ছোটবেলায় – ষাটের দশকে – আমাদের দেশে নন্দু নাটেকার, সুরেশ গোয়েল, দীনেশ খান্নার মতো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও দীপুদা’ পর পর ছয়বার ব্যাডমিন্টন জাতীয় প্রতি্যোগিতার ফাইনালে উঠেছিলেন, তার থেকে বোঝা যায় কত উঁচুদরের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। অবশ্য তার মধ্যে তিনি মাত্র একবার (১৯৬৯) জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন্, বাকি পাঁচবার সেই সময়ের অন্য বিখ্যাত খেলোয়াড়দের কাছে ফাইনালে হেরে যান।
সেই একবার তাঁর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়াও একটা গল্প।
দীপুদা’ South Eastern Railway তে চাকরী করতেন, একদিন গার্ডেনরীচে প্র্যাকটিস করতে যাবার সময় একটি ট্রাক তাঁর স্কুটার কে ধাক্কা মারায় তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় সাতমাস রেল হাসপাতালে ভর্ত্তি ছিলেন। তাঁর ডাক্তাররা তিনি আবার ফিরে এসে খেলতে পারবেন এই আশা দিতে পারেননি, কিন্তু তাঁদের অবাক করে তিনি ফিরে এসে ১৯৬৯ সালে সেমি ফাইনালে দীনেশ খান্না আর ফাইনালে সুরেশ গোয়েল কে হারিয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন্।
আমি তখন স্কুলে পড়ি, ইডেন ইন্ডোর স্টেডিয়াম এ National Badminton championship এর খেলা হচ্ছিল, বাবার সাথে আমি সেখানে সেমি ফাইনাল আর ফাইনালে দীপুদা’র খেলা দেখি। সেমি ফাইনালে দীপুদা’ ত্রিলোক নাথ শেঠ কে হারিয়ে ফাইনালে শেষে নন্দু নাটেকারের কাছে হেরে যান্। ফাইনাল খেলাটা হয়েছিল সমানে সমানে – যে কেউ জিততে পারতেন, নন্দু শেষ পর্য্যন্ত জিতলেও দীপুদা’কে হারানো তাঁর পক্ষে সোজা হয়নি।
সেই বয়সে ওই দু’জনের মধ্যে দীপু ঘোষ কেই আমার বেশী ভাল লেগেছিল মানে পড়ে, উনি হেরে যাওয়াতে আমার যে মন খারাপ হয়েছিল সেটাও পরিস্কার মনে পড়ে। উনি বাঙালী ছিলেন বলেই হয়তো আমার দিক থেকে একটু পক্ষপাতিত্ব ছিল।।তাছাড়া ওই ছোটখাটো ছিপছিপে তরুণটি অসাধারণ খেলেছিলেন সেদিন, সারা কোর্ট জুড়ে তাঁর আধিপত্য, তাঁর ওভারহেড স্ম্যাশ, নিখুঁত ড্রপ শট, নেট প্লে, এই সব দেখে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, নন্দু নাটেকারের মত দুর্দ্ধর্ষ খেলোয়াড়ও ওনার কাছে বেশ বিপর্য্যস্ত হয়েছিলেন সেদিন।
ভাই রমেন ঘোষের সাথে ডাবলস খেলে দীপুদা’ ১৯৬৩-৭০ এই সময়ের মধ্যে প্রতি বছর জাতীয় ফাইনালে ওঠেন, এবং পাঁচ বার ডাবলস্ চ্যাম্পিয়ন হন্। এটা বোধ হয় একটা জাতীয় রেকর্ড।
দেশের হয়ে Thomas Cup এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও দীপুদা’ তাঁর খেলোয়াড় জীবনে অনেক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, দেশের জন্যে তাঁর এই অবদানের জন্যে ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে অর্জ্জুন পুরস্কার প্রদান করেন।
গত বছর ২০২২ সালে দীপুদা’ আমাদের লিখলেন তিনি আর বৌদি সিঙ্গাপুর থেকে পূজোয় মাস খানেকের জন্যে কলকাতা আসছেন। অনেক বছর পরে এখানে আসা, অনেক কাজ, অনেকের সাথে দেখাশোনা, এন্টালীর ফ্ল্যাটটা ময়লা হয়ে পড়ে আছে ওটা পরিস্কার করতে হবে, এই সব – কিন্তু তার মধ্যে সময় করে একদিন দেখা করা গেলে তাঁদের খুব ভাল লাগবে।
সুভদ্রাদের হাওড়ার রামরাজাতলার বাড়ীতে দুর্গা পূজো হয়। সপ্তমীর দিন সেখানে দুপুরে সব জ্ঞাতিদের নিমন্ত্রণ থাকে, আমি দীপুদা’ কে সেদিন সেখানে বাড়ীর পূজোতে আসতে অনুরোধ করলাম, এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। আমি তাঁর কাছে অচেনা মানুষ, আমার শ্বশুরবাড়ীতে অত লোক সেদিন আসবে, তারাও সবাই তাঁর অচেনা, কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো দীপুদার সে ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।বরং বাড়ীর পূজো কাছ থেকে দেখার সু্যোগ করে দেবার জন্যে তিনি বার বার তাঁর কৃতজ্ঞতা আর আনন্দের কথা আমায় বলে যাচ্ছেন।

কলকাতায় ওঁরা এসে কিছুদিনের জন্যে উঠলেন গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্ট হাউসে, আমাদের পূর্ণ দাস রোডের বাড়ী থেকে খুব কাছে। কথা হলো সপ্তমীর দিন সকালে ওঁরা সেখান থেকে চেক আউট করবেন, আমি আমার গাড়ীতে ওদের তুলে সাঁতরাগাছি নিয়ে যাবো, ওঁদের মালপত্র – দুটো স্যুটকেস – থাকবে আমার গাড়ীর বুটে, বিকেল বেলা বাড়ী ফেরার পথে আমরা ওঁদের এন্টালীর ফ্ল্যাটে নামিয়ে দিয়ে যাবো।
কথামতো সপ্তমীর সকালে গোলপার্কে সুভদ্রা আর আমি দীপুদা’ আর শ্যামলী বৌদিকে আমাদের গাড়ীতে তুলে নিলাম। প্রথম দর্শনে দীপুদা’কে আরো ছোটখাটো লাগলো, তবে আশির ওপরে বয়েস হলেও সোজা হয়ে হাঁটেন, মুখে একটা স্মিত হাসি, হাত বাড়িয়ে এসে আমার হাত ধরলেন, আমি যেন কতদিনের চেনা।
হাওড়ায় পৌঁছতে আজকাল সেকেন্ড হাওড়া ব্রীজ আর কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরলে আধঘন্টা লাগে, রাস্তায় দীপুদা’ আর বৌদির সাথে আমাদের একটা প্রাথমিক আলাপ হয়ে গেল। দীপুদা’র কাছ থেকে তাঁর ব্যাডমিন্টন খেলার জীবনের অনেক গল্প জানার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেখছিলাম তিনি খেলা এবং তাঁর অতীতের খেলোয়াড় জীবন নিয়ে কোন আলোচনাতেই যেতে চান্না, একটু হেসে এড়িয়ে যান্। আমাদের আলাপ হলো মামুলী আটপৌরে কথা দিয়ে।
কলকাতায় এতবছর পরে এসে ওঁরা দুজনেই খুব উত্তেজিত। শ্যামলী বৌদি নবমীর দিন একটা বাসে করে পুরনো বাড়ীর পূজা পরিক্রমা ট্যুর বুক করেছেন। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা ভাল ব্যাডমিন্টন খেলতেন, সেই সূত্রে ওঁদের সাথে দীপুদা’ দের অন্তরঙ্গ আলাপ ছিল, সম্প্রতি সৌমিত্র গত হয়েছেন, তাই এবার আর তাঁদের সাথে আগের মত আড্ডা দিতে যাওয়া হবেনা, তবে দীপার সাথে একবার তো দেখা করতে যাবেনই। ভাই রমেন উনি আসাতে তাঁর বাড়ীতে আত্মীয়স্বজনের সাথে একদিন একসাথে কাটাবার আয়োজন করেছেন। এই সব কথা।
রামজাতলায় সুভদ্রাদের দুর্গাবাড়ীর পূজোর দালানে সেদিন আত্মীয়স্বজন আর জ্ঞাতিদের বেশ ভীড়, তার মধ্যে দীপুদা’ আর বৌদির সহজেই মিশে গেলেন, তাঁদের মধ্যে কোন জড়তা নেই। সুভদ্রার দাদারা দীপুদা’র পরিচয় পেয়ে অনেকেই তাঁকে ঘিরে ধরলেন, তাঁর খেলার প্রশ্ংসায় সবাই পঞ্চমুখ, “আপনি একবার আমাদের বাণী নিকেতন ক্লাবে খেলতে এসেছিলেন, আমরা আপনার খেলা দেখেছি” ইত্যাদি অনেক প্রশস্তি শুনে দীপুদা’র মুখে শুধু সেই স্মিত হাসি, কোন কথা নেই, যেন সেই হাসিটুকু দিয়ে তিনি তাঁদের প্রশংসার জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।

মনে মনে আমি সেদিনের সেই ক্ষিপ্র তরুণ খেলোয়াড়টির সাথে আজকের দীপুদা’ কে মেলানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারছিলামনা। আজকের দীপুদা’ একজন অন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। তিনি এখন শান্ত ধীর স্থির আর অমায়িক, আদ্যোপান্ত বিনয়ী ও ভদ্রলোক, স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত তাঁর জীবন।
খুব ভক্তিভরে পূজো দেখলেন দু’জনে, পুষ্পাঞ্জলি দিলেন, শান্তিজল মাথায় নিলেন, আর বার বার আমাদের এই বাড়ীর পূজো দেখার সু্যোগ করে দেবার জন্যে ধন্যবাদ জানালেন।
সারা সকাল আমি তাঁদের সঙ্গ দিলাম সেদিন, পূজোর দালানে সুভদ্রার আত্মীয়স্বজনের ভীড়ের মধ্যে এক কোণে চেয়ার টেনে বসে আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। কথায় কথায় জানলাম শ্যামলী বৌদির বাপের বাড়ী হাওড়ায় শিবপুরে সুতরাং হাওড়ার এই সব অঞ্চল তাঁর খুব চেনা। বাড়ীর পূজো দেখার সু্যোগ করে দেবার জন্যে দীপুদা’ বার বার তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলেন, তাঁর মত এক প্রবাদপ্রতিম দিকপাল খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এরকম বিনয়ী আর আন্তরিক ব্যবহার পেয়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম, অবশ্য এটাও ঠিক যে আইসল্যান্ড থেকে পাঠানো তাঁর ইমেল থেকে তাঁর এই চারিত্রিক বিনয়ের কিছুটা আন্দাজ আমার ছিল।
ইতিমধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে দেউড়িতে একটু জল কাদা জমেছে, আমরাও একটু পরে বেরোব বলে কাছেই দাঁড়িয়ে আছি, সুভদ্রার এক বৃদ্ধা আত্মীয়া ভাল করে হাঁটতে পারেননা, তাঁকে ধরে ধরে গাড়ীতে তোলা হচ্ছে, দীপুদা’ হঠাৎ দেখি সামনে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধার জন্যে গাড়ীর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। দৃশ্যটা এখনো ভুলতে পারিনি। বৌদি বললেন, “দীপুর এটা একটা স্বভাব, কোথাও কারুর বিপদ দেখলে ও সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে যায়।”

২) দ্বিতীয় অর্জ্জুন – অরুণ ঘোষ
ষাটের দশকের প্রখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় অরুণ ঘোষ হাওড়ার ব্যাতড়ে থাকেন, দীপুদা’ আর তিনি দু’জনে একসাথে South Eastern Railway তে একসময় কাজ করেছেন, তখন দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। দীপুদা’ খুব সঙ্কোচের সাথে আমায় বললেন “অনেকদিন অরুণদা’র সাথে দেখা নেই, এখন বয়েস হয়েছে, শুনেছিলাম ওঁর শরীর ভাল যাচ্ছেনা। এত কাছে যখন এলাম, ফেরার পথে কিছুক্ষণের জন্যে কি একবার ওনার বাড়ীতে গিয়ে দেখা করা যায়?”
“অবশ্যই যায়”, আমি বললাম, “কিন্তু অরুণদা’ কোথায় থাকেন সেটা কি করে জানা যাবে?”
শ্যামলী বৌদি বললেন “ব্যাতড়ে আমার এক মামা থাকে, আমরা সমবয়েসী, আমি ওকে ফোন করেছিলাম, ও অরুণদা’র বাড়ীটা চেনে।” ঠিক হলো খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমরা বেরিয়ে পড়বো, ব্যাতড়ে বৌদি তাঁর মামার সাথে কথা বলে নিলেন, তিনি আমাদের জন্যে পথে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবেন।
অরুণ ঘোষ ছিলেন বাংলার ফুটবলে এক প্রবাদপ্রতিম স্টপার। ষাটের দশকে কলকাতার ময়দানে কখনো ইস্টবেঙ্গল কখনো মোহনবাগান কখনো বি এন আর এর হয়ে খেলে মাঝমাঠে রাজত্ব করে গেছেন অরুণ। আমি তাঁকে অনেকবার খেলতে দেখেছি, তাঁর সেই লম্বা চওড়া চেহারা সুঠাম স্বাস্থ্যবান চেহারাটা এখনো চোখের সামনে ভাসে। রক্ষণে তিনি থাকলে তাঁকে ভেদ করে যাওয়া ফরোয়ার্ডদের পক্ষে সহজ কাজ ছিলনা।
১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিক, ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমস্, ১৯৬৪ সালে মাড়ডেকা এবং AFC Cup এ ইত্যাদি নানা প্রতিযোগিতায় তিনি ভারতীয় দলে থেকে দেশের হয়ে অনেক পদক জিতেছেন। পরে কিছুদিনের জন্যে তিনি ভারতীয় দলের কোচ ও ছিলেন।
তাছাড়া বংলাও তাঁর অধিনায়কত্বে সন্তোষ ট্রফি জিতেছে বেশ কয়েকবার।
১৯৬৭ সালে অসাধারণ ফুটবলার হিসেবে ভারত সরকার তাঁকে অর্জুন পুরস্কার প্রদান করেন।
যাই হোক, শেষ পর্য্যন্ত ব্যাতড়ে গিয়ে বৌদির মামার দেখা পাওয়া গেল, তিনি আমাদের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁকে আমরা গাড়ীতে তুলে নিলাম। দেখলাম বৌদি আর তাঁর মামা নিজেদের মধ্যে তুই তুই করে কথা বলছেন, ওঁরা দু’জন ছেলেবেলার বন্ধু।
সপ্তমীর দুপুর, জায়গাটা নির্জন, কাছাকাছি কোন বারোয়ারী পূজো নেই, তাই এই জায়গাটা ভীড় আর ঢাকের আওয়াজ নেই। একটা গলির ভিতর দু’দিকে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ী, ঢুকে একটু এগিয়েই একটা তিন তলা বাড়ীতে দোতলার একটা ফ্ল্যাটে অরুণদা’ থাকেন। বৌদির মামাকে অনুসরণ করে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় বেল বাজালাম। একটি কমবয়েসী মেয়ে দরজা খুলে দীপুদা’ আর শ্যামলী বৌদিকে চিনতে পেরে আপ্যায়ণ করে আমাদের ভিতরে ডেকে নিলো।
পরে আলাপ হয়ে জেনেছিলাম সে অরুণদা’র বড় মেয়ে। তার মুখের সাথে অরুণদা’র মুখের অদ্ভুত সাদৃশ্য – সে কথা বলতে মেয়েটি হেসে বলেছিল, “হ্যাঁ, জানি, সবাই তাই বলে।”
দরজা দিয়ে ঢুকেই ছোট একটা বসার ঘর, সেখানে একটা সোফায় দেখি এক ভদ্রলোক লম্বা পা ছড়িয়ে বসে আছেন, তাঁকে দেখে অতীতের অরুণদা’ বলে চেনা যায়, আগের সেই সুস্বাস্থ্য আর নেই, তবু শরীরের কাঠামোটা এখনো মজবুত, দীপুদা’ তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে গিয়ে “অরুণদা’ কত দিন পরে দেখা হলো”, বলে জড়িয়ে ধরলেন।

আমরা না জানিয়ে হঠাৎ এসেছি, কিন্তু তাতে দরজা খুলে দেওয়া মেয়েটির মুখে কোন বিরূপতা নেই, বরং দীপুদা’ আর বৌদিকে এরকম ভাবে হঠাৎ পেয়ে তাকে বেশ খুসীই মনে হচ্ছে।
পুরনো বন্ধুর সাথে অনেক বছর পরে দেখা হয়ে দীপুদা’ ছেলেমানুষের মত খুসী হয়েছিলেন, তাঁকে দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল, দুই বন্ধু ওঁদের পুরনো জীবনের অনেক ঘটনার স্মৃতিরোমন্থন করলেন। গার্ডেনরীচ থেকে নৌকা করে নদী পার হয়ে দু’জনে হাওড়া আসতেন, সেই গল্পও হলো। অরুণদা’র মেয়ের কাছে যখন তিনি শুনলেন অরুণদা’র জন্ম ১৯৪১ সালে, তিনি খুব অবাক হয়ে কিছুটা অনুশোচনার ভঙ্গীতে বলেছিলেন,“১৯৪১?সে কি? তাহলে তো আমি অরুণদা’র থেকে দুই বছরের বড় হলাম। অরুণদা’, দ্যাখো বয়েসে বড় হয়েও এতগুলো বছর আমি তোমায় দাদা বলে ডেকে এসেছি!”
যে সোফায় অরুণদা’ পা এলিয়ে বসেছিলেন, সেই সোফার পিছনে দেয়ালে টাঙানো তাঁর খেলোয়াড় জীবনের অনেক ছবি মন দিয়ে দেখলাম। তার মধ্যে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অর্জ্জুন পুরস্কার নেবার ছবিও ছিল।
আমি ষাটের দশকে কলকাতার ময়দানে অরুণদা’ র খেলা অনেক দেখেছি। চমৎকার সুঠাম স্বাস্থ্য ছিল অরুণদা’র, প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের ঢেউয়ের মত আক্রমণের বিরুদ্ধে শালপ্রাংশুর মতো তিনি ঢাল হয়ে দাঁড়াতেন, তাঁর ট্যাকলিং, পাসিং, শুটিং এর কথা এখনো পরিস্কার মনে পড়ে।
নিজের নিজের খেলায় এঁরা দুজনেই যৌবনে অসাধারণ দক্ষতা আর পারদর্শিতার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তার ওপরেও তাঁদের যা ছিল, তা হলো ইস্পাতকঠিন হার না মানা মানসিকতা, জেতার অদম্য ইচ্ছা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, এবং প্রখর আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে শুধু ভাল খেললেই হয়না, তার সাথে চাই জেতার ক্ষিদে। এই দু’জনের মধ্যে যা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।
অরুণদা’র বাড়ী থেকে বেরিয়ে, বৌদির মামা কে কাছেই তাঁর বাড়ীতে নামিয়ে পার্ক সার্কাসের কাছে দীপুদা’ আর শ্যামলী বৌদি কে তাঁদের এণ্টালীর ফ্ল্যাট বাড়ীতে নামিয়ে আমরা বাড়ী ফিরলাম।
দেশের মধ্যে এক সময়ের শ্রেষ্ঠতম এই দুই খেলোয়াড়ের সান্নিধ্য পেয়ে সেদিন নিজেকে খুব ভাগ্যবান আর ধন্য মনে হয়েছিল। গত বছরের (২০২২) পূজোর সপ্তমীর দিনটা তাই আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।

-
কলকাতার পূজো, ২০১৮

বাগবাজার সার্ব্বজনীন ১ – একাল সেকাল
ত্রিশ বছর পর কাজ থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে দূর্গা পূজোর দিনগুলো এখন কলকাতায় কাটাচ্ছি। চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ শুনছি আর মন চলে যাচ্ছে সেই পঞ্চাশ ষাট আর সত্তরের দশকের আমার কম বয়েসের পূজোর দিনগুলোতে।
পবিত্র সরকারের লেখা সনৎ সিংহের গাওয়া একটা জনপ্রিয় গান মনে পড়ে। সেই গানে পাঠশালায় ছেলেমেয়েরা নামতা মুখস্থ করছে, কিন্তু তাদের মন পড়ে আছে চন্ডীতলায়, সেখানে কুমোর ঠাকুর গড়ার কাজে ব্যস্ত, পূজোর আর বেশী দেরী নেই, তাদের খুব ইচ্ছে করছে এক ছুটে চলে যায় সেখানে। হয়তো মায়ের চোখ আঁকা হচ্ছে এখন, কিংবা মোষের পেট ফেটে অসুর হয়তো বেরিয়ে এসেছে এতক্ষণে। পবিত্র সেই গানে চমৎকার ধরেছেন ছোটদের মনের ওই অস্থিরতা, পূজো আসার আগে থেকেই মনের মধ্যে আমিও কমবয়সে ঠিক ওইরকম একটা উত্তেজনার ভাব টের পেতাম।
কাছে এলো পূজোর ছুটি, রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপাফুলের রং। কবি বলেছেন।
একটা বয়স ছিল যখন সেই রং লাগতো আমার মনেও।
নিয়ম করে প্রতি বছর মহালয়ার দিন রাত থাকতে উঠে সব ভাইবোনদের সাথে অন্ধকারে রেডিওর সামনে বসে কত আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে মহিষাসুর মর্দ্দিনী অনুষ্ঠান শুনতাম তখন। পূজোর আগে কোথাও বাঁশ দিয়ে প্যান্ডেলের কাঠামো তৈরী হচ্ছে দেখলে মন কেমন একটা অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠত। দেব সাহিত্য কুটীরের শারদীয়া পত্রিকা বাড়ীতে এলে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। টেনিদা’ আর তার দলবল, কিংবা হর্ষবর্ধন গোবর্ধন দুই ভাইয়ের মজার যত সব কান্ডকারখানা! পূজোর জলসায় পূজোর গান গাইতে আসতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। “পূজোয় চাই নতুন জুতো” নামে বাটা একটা ক্যাম্পেন করতো পূজোর সময়। আমরা পূজোয় পেতাম নতুন জুতো আর জামাকাপড়…
এখন আর মহালয়ার ভোরে ঘুম ভাঙেনা। এখন সি ডি চালিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুনি। পূজোর আগে এক গাদা বাঁশ রাস্তায় স্তূপ হয়ে পড়ে আছে কিংবা রাস্তা বন্ধ করে প্যান্ডেল হচ্ছে দেখলে আজকাল বেশ বিরক্তই লাগে। টেনিদা’ আর হর্ষবর্ধন গোবর্ধন নিরুদ্দেশে চলে গেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্ররা আর নেই। এখনো রমরম করে চলে পূজোর বাজার, কেনাকাটা। ফুটপাথে অসংখ্য হকারের স্টল, ভীড় ঠেলে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, ভাল লাগেনা।
আজও পূজোর বেশ কিছু দিন আগে থেকে শহরের প্রায় সব রাস্তার দুই পাশ বড় বড় হোর্ডিং এ ঢাকা থাকে। তবে সেই সব হোর্ডিং গুলোতে খেয়াল করলে দেখা যায় অর্ধেকের ওপর বিজ্ঞাপন পান পরাগ আর পানমসালার।
এই সব কোম্পানী মৃত্যু বেচে এত লাভ করছে ? ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
কমবয়েসে আমরা ভীড়ের মধ্যে গা ভাসিয়ে ঘুরে ঘুরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিমা দেখে বেড়াতাম। পা ব্যথা কি বস্তু জানাই ছিলনা। এখন আগের মত ভীড়ের মধ্যে গা ভাসিয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার সামর্থ্য এবং উৎসাহ কোনটাই নেই। এখন বাড়ীতে আরাম করে বসে ইন্টারনেট কিংবা টিভি তেই সব ঠাকুর বেশ ভাল ভাবেই দেখা যায়। তা ছাড়া আছে ফেসবুক, এবং নানাবিধ Mobile App…
আগে বারোয়ারী পূজোর খরচ উঠতো বাড়ী বাড়ী চাঁদা তুলে। এখন কর্পোরেট স্পনসরশীপ আর তোলাবাজীর টাকা থেকে কোটি কোটি টাকা খাটে এক একটা পূজোয়। এখন পূজো হলো big business…
এ বছর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে থীম ছিল মহাভারত, সেখানে দেখলাম অর্জ্জুন আর শ্রীকৃষ্ণের এক বিশাল রূপোর রথ, যার দাম নাকি কুড়ি কোটি টাকা। এত টাকা এরা কোথায় পায় কে জানে? এদিকে দেশে লোকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। ওই রথ আর অনাবশ্যক, অবিশ্বাস্য অপচয় দেখে শামশুর রহমানের কবিতার সেই লাইনটা মনে পড়ে যায়।
“এক অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে চলেছে স্বদেশ~”
সময় বদলেছে, আমি নিজেও বয়সের সাথে সাথে অনেক পালটে গেছি, আমার সেই সবুজ চশমাটা হারিয়ে গেছে। এখন আর আমার মনে চাঁপাফুলের রং লাগেনা।
But, wait….
একটা জিনিষ আছে যা এখনও আনন্দে মন মাতায়, তা হলো ওই ঢাকের আওয়াজ। সনৎ সিংহের সেই গানের কথায় সেটা এখনও আগের মতোই “মিষ্টি মধুর”‘~
“তা ধিনা তাকতা ধিনা, তাক গুড় গুড়, কুরুড় কুরুড় তাক… ”



সমাজসেবী সঙ্ঘ হিন্দুস্তান পার্ক সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার
২ – পূজো না উৎসব?
সাবেকী না থীম? পূজো না উৎসব? এই নিয়ে এখন কলকাতায় serious তরজা চলছে।
এখন হলো থীম পূজোর যুগ। সার্ব্বজনীন পূজো মানে এখন শুধু প্রতিমা নয়, প্যান্ডেলসজ্জা, আলো এই সব নিয়ে একটা সর্ব্বাঙ্গীন প্যাকেজ। অবশ্য কিছু পুজো যেমন একডালিয়া, বাগবাজার, কলেজ স্কোয়ার এখনও তাদের সাবেকী পূজোর পরিবেশ বজায় রেখেছে। তাদের বক্তব্য হলো পূজো তে ভক্তিভরে মায়ের আরাধনাই হলো আসল, বাকি যা তা হলো বর্জ্জনীয় আড়ম্বর।
ওদিকে যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লী, সমাজসেবী, নাকতলা, বেহালা সুরুচি সঙ্ঘ, ত্রিধারা অকালবোধন, মুদিয়ালী, কসবা বোসপুকুর, এবং অন্য অনেক নামী দামী পুজোতেই এখন থীম। সেখানে কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের সাবেকী সনাতন প্রতিমার জায়গা এখন অধিকার করে নিয়েছেন আর্ট কলেজের স্বনামধন্য শিল্পীরা – ভবতোষ সুতার, সনাতন দিন্দা এবং অন্যান্যরা। তাঁদের তৈরী মায়ের প্রতিমার নান্দনিক সৌন্দর্য্য দর্শক কে মুগ্ধ করে ঠিকই, কিন্তু সাবেকীদের মতে সেই মুগ্ধতার মধ্যে কোথায় যেন মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসা ও ভক্তিবোধের কিছুটা অভাব থেকেই যায়। কিন্তু থীমের প্রবক্তাদের মত হলো থীম হচ্ছে উৎসবের অঙ্গ। থীমই হাজার হাজার মানুষ কে পূজোর দিকে টানে, থীমের মধ্যেই আছে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার প্রধান উপাদান।
এবছর আমি আর সুভদ্রা চতুর্থী আর পঞ্চমীর দিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এক দিন দক্ষিণ আর এক দিন উত্তর কলকাতা। পূজো শুরু হতে তখনও দুই দিন বাকী, তবু চতুর্থী থেকেই রাস্তায় মানুষের ঢল।
সমাজসেবী সঙ্ঘের এবারের পূজোর থীম অন্ধদের নিয়ে, সেখানে প্যান্ডেলে সব কিছু ব্রেলে লেখা। রামরাজাতলায় সুভদ্রাদের দূর্গাবাড়ীর পিছনে ইছাপুর জগাছার বিখ্যাত শিবাজী সঙ্ঘের পুজো। সেখানে এবছর থীম হলো আমাদের জীবনে টেকনোলজীর অভিশাপ। প্যান্ডেল জুড়ে মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপের ছবি। ছেলেমেয়েরা সবাই মাথা নীচু করে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। বিবেকানন্দ রোডের লোহাপট্টি চালতাবাগানে থীম এবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিশাল ছবি, তাঁর কবিতা লেখা চারিদিকে, মাইকে তাঁর গান বাজছে। কত পরিকল্পনা, যত্ন আর কত লোকের পরিশ্রম লুকিয়ে আছে এই সব থীম তৈরীর পিছনে তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
আগে কলেজ স্কোয়ারে ঠাকুর দেখে পাশেই প্যারামাউন্টে মালাই সরবৎ খাওয়া আমাদের নিয়ম ছিল। কিন্তু এবার চতুর্থীর বিকেলেই দোকানের দরজায় ভীড় উপছে পড়ছে। প্যারামাউন্টে সরবৎ না খেতে পাওয়ার দুঃখ কিছুটা অন্ততঃ ভোলা গেল বিবেকানন্দ রোডের চালতাবাগানে। সেখানে রাস্তার পাশে দোকানে গরম গরম সিঙ্গাড়া আর অমৃতি বিক্রী হচ্ছে… খেতে একেবারে অমৃত!
সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে ফেরার সময় মহম্মদ আলি পার্কের বিরাট পূজো। দেখি বাঁশ দিয়ে তৈরী বেড়ার মধ্যে দিয়ে পিলপিল করে হাজার হাজার লোক ঢুকছে, প্রায় মাইল খানেক লম্বা লাইন। আমি সুভদ্রাকে বললাম, “কি যাবে নাকি?”
সুভদ্রার প্রশ্নসূচক উত্তর খুব সংক্ষিপ্ত। সে ভুরু কুঁচকে বললো, “পাগল?”



চালতাবাগান হিন্দুস্তান পার্ক শিবাজী সঙ্ঘ, জগাছা, হাওড়া



কলেজ স্কোয়ার ত্রিধারা চালতাবাগান
৩ – বাড়ীর পূজো
আমার শ্বশুরবাড়ীতে, হাওড়ার রামরাজাতলায় ১৯৬০ সালে নিজেদের বাড়ীতে দূর্গা পূজো শুরু করেছিলেন সুভদ্রার জ্যাঠা কাকা বাবারা। সেই পূজোর প্রায় ষাট বছর হতে চললো। বাবা কাকারা এখন আর কেউ নেই, এখন পূজোর দায়িত্ব নিয়েছে পরের প্রজন্ম, বাড়ীর ছেলে মেয়ে বৌরা। দেশে ফিরে আসার পর থেকে সুভদ্রা এখন পূজোর অনেক দায়িত্ব সামলায়। পূজোর দিনগুলো আমাদের সেখানেই কাটে।
বাড়ীর পূজোতে ওই সাবেকী vs উৎসবের conflict টা নেই। এখানে নিষ্ঠা আর ভক্তির সাথে পূজো হয়, এবং একই সাথে পারিবারিক আনন্দ উৎসবেরও একটা চমৎকার জমজমাট পরিবেশ তৈরী হয়। ইংরেজীতে যাকে বলে best of both worlds…
রামরাজাতলায় সুভদ্রাদের লতায় পাতায় ছড়ানো ছিটোনো তিন চার পুরুষের বিশাল যৌথ পরিবার। এবং এই বিশাল পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্প্রীতি এখনও অটুট, মাঝেই মাঝেই নানা অনুষ্ঠানে অনেকে একসাথে জড়ো হয়। স্বাভাবিক ভাবেই তাই পূজোতেও রোজ এই extended family র অনেকে নিমন্ত্রিত হয়ে সুভদ্রাদের বাড়ীতে আসেন। পূজোতে অংশ নেবার পরে সবাই মিলে পূজোর দালানে বসে গল্প, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া হয়। সমবেত হাসি ঠাট্টার কলতানে ঠাকুরদালান মুখরিত হয়ে ওঠে।
বাড়ীর মেয়েরা সবাই মিলে পূজোর কাজের ভার নেয়। ভোরবেলা উঠে ভোগ রান্না করা, শাঁখ বাজানো, প্রদীপ হাতে ঘুরে ঘুরে সবাই কে হোমের শিখার তাপ দেওয়া, প্রসাদ বিতরণ এই সব কাজ ভাগাভাগি করাতে বেশ একটা মজা আছে। সুভদ্রাদের কুলদেবতা হলেন নারায়ণ, পূজোর দালানে যে হাড়িকাঠ আছে সেখানে পাঁঠার বদলে চালকুমড়ো বলি হয়, সেটাও বেশ একটা দেখার মত জিনিষ।
সকাল থেকেই পূজোর আয়োজন শুরু হয়ে যায়। প্রথমে পূজো, তারপরে এক এক করে হাড়িকাঠে চালকুমড়ো বলি, পুষ্পাঞ্জলি, হোম। শেষে শান্তির জল। অষ্টমী আর নবমীর মাঝে সময় মেনে হয় সন্ধিপূজো। সেই পূজোতে সবাই মিলে রামচন্দ্রের একশো আট গোলাপী পদ্মফুল মা’র পায়ে অর্পণ করে প্রদীপ জ্বালানো হয়। পদ্মফুল বাজার থেকে আসে আধফোটা অবস্থায়। সেই ফুল হাত দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে তারপর ধীরেসুস্থে সাবধানে একটা একটা করে পাপড়ি ফোটানোর কাজটা বেশ সময়সাপেক্ষ। বাড়ীর মেয়েদের ওপরেই থাকে সেই কাজের ভার।
আর রোজ সন্ধ্যায় হয় ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে আরতি। তখন বাড়ীশুদ্ধ সবাই পূজোর দালানে এসে জড়ো হয়। কাঁসরঘন্টার আওয়াজ আর ধুনোর ধোঁয়ায় আর গন্ধে কিছুক্ষনের জন্যে সেখানে একটা মোহময় অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মা’ যেন ধীরে ধীরে সবার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠেন।
দুপুরে রোজ জমিয়ে খাওয়া হয়। আজকাল তো আর মাটিতে বসে কলাপাতা শালপাতা মাটির ভাঁড় নেই। এখন চেয়ার টেবিলে বসে কাগজের প্লেট আর গ্লাস। তবু সেই “ওরে এদিকে একটু শুক্তো”, অথবা “জগন্নাথ, চিংড়ী মাছটা এদিকে আর এক রাউন্ড পাঠা”, কিংবা “ভাই, আমায় একটু দই এর মাথা প্লীজ্” এসব তো আর কোন দিন পুরনো হবেনা, এসব হলো চিরকালীন।
আর আমার কাছে যেটা সব চেয়ে লোভনীয় ছিল তা হলো বাড়ীর তৈরী নানারকম মিষ্টি – নারকোলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, গজা, মোয়া। কত বছর বাড়ীর তৈরী গজা খাইনি, এ জিনিষ কি ছাড়া যায়? প্রসাদের থালা নিয়ে অনেকেই আমার কাছে আসছে, আমি সেখান থেকে বেশ কয়েকবার গজা তুলে নিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর সুভদ্রার কাছে ধমক খেলাম। “সকাল থেকে কতবার গজা খেয়েছো আজ?”
সত্যি, এই বয়সে এত মিষ্টি খাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
কিন্তু কি করবো, এতগুলো বছর দেশের বাইরে ছিলাম, আমার জীবনের গজা খাওয়ার কোটা তো কমপ্লিট হতে এখনো অনেক দেরী?
আমি সুভদ্রা কে বললাম, “না না, মা’র নাম করে খেলে কিছু হয়না।”









৪ – কেন চেয়ে আছো গো মা
এ বছর আমাদের গোল পার্কের যে ফ্ল্যাটে আমার মা আর শ্বাশুড়ী থাকেন সেই building complex এর পূজোর ঠাকুর ভাসান দেখতে বিজয়া দশমীর দিন বিকেলে আমি কয়েকজন আবাসিকদের সাথে গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলাম। আমরা যখন ইডেন গার্ডেন এর পিছনে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় চারটে, জায়গাটা বেশ গমগম করছে লোকের ভীড়ে। এক একটা ট্রাকে করে প্রতিমা আসছে, আর আসতে না আসতেই এক দল ছেলে মাথায় গামছা আর ফেট্টি বেঁধে সেখানে চলে আসছে। তাদের রেট বাঁধা, সামান্য দরাদরি হচ্ছে ব্যাস্, তারপর তারা কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে হৈ হৈ করে চলে যাচ্ছে নদীতে।
আমাদের প্রতিমাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকজন ছেলে কাঁধে চাপিয়ে নদীতে নিয়ে গেল।
ঘাটের ওপরে বাঁধানো দেয়াল, সেখানে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। পড়ন্ত বিকেলে রোদের তেজ কমে আসছে, সামনে মন্থর ঘোলাটে নদী নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে, আর সেই নদীর জলে এক এক করে প্রতিমা বিসর্জ্জন হচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখছে সবাই। মন খারাপ করা দৃশ্য। মেয়েদের সবার পরণে লাল পাড় সাদা শাড়ী, সারা মুখে গালে কপালে সিঁদূর মাখামাখি। সবাই তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। ওদিকে একের পর এক ট্রাক আসছে, তাদের ঘিরে উন্মাদের মত নেচে চলেছে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। ঢাকীরা সাথে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। বেশ frenetic scene, বিশেষ করে কাঁধে প্রতিমা নিয়ে যখন হৈ হৈ করে হাই স্পীডে ছেলেগুলো ভীড়ের মধ্যে চলে আসছে, তখন একটু অন্যমনস্ক হয়ে তাদের সামনে পড়ে গেলে বিশ্রী দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
আমরা দেয়ালের পাশে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। দূরে দেখা যাচ্ছে এক দিকে হাওড়া ব্রীজ, আর অন্য দিকে বিদ্যাসাগর সেতু, শেষ বিকেলের মায়াবী কুয়াশায় তারা কিছুটা ঢাকা। নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক প্রতিমা, কিছু লোক জলে নেমে ঘড়া বা বোতলে গঙ্গাজল ভরে নিচ্ছে, ওই নোংরা polluted জল আমাদের অনেকের কাছেই খুব পবিত্র।
যতোটা বিশৃঙ্খলা আশঙ্কা করে গিয়েছিলাম, তার তুলনায় সব ব্যাপারটা বেশ সুসংবদ্ধ ভাবেই হলো।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কাজ মিটিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম।
সেদিন পরে দুই মা’র সাথে বিজয়ার সন্ধ্যেটা কাটিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে রাত ন’টা নাগাদ গাড়ীতে করে বালীগঞ্জ পোস্ট অফিসের কাছে আমাদের আয়রনসাইড রোডের ফ্ল্যাটে ফিরছি। গড়িয়াহাট মোড়ে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। গাড়ীর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ফুটপাথে বহুলোক দাঁড়িয়ে, আর রাস্তার ওপর কাগজ পেতে হাজার হাজার লোক বসে আছে। তারা প্রতিমা বিসর্জ্জন দেখবে, তাই আগে থেকে জায়গা নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে না ঘুরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক প্রতিমা দেখার এই একমাত্র সুযোগ। একের পর এক ট্রাকে প্রতিমা আসছে, তাদের ভিতরে আলোর মালায় সাজানো ঝলমলে প্রতিমা। সামনে প্যাঁ পোঁ করে ব্যান্ড পার্টি কুচকাওয়াজ করে হাঁটছে, আর তাদের পিছনে নাচানাচি করছে বহু ছেলেমেয়ে। ট্রাকের পিছনে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়া গাড়ী বাস আর নানা যানবাহনের বিশাল লাইন।
গাড়ীতে বসে পূজোর গত কয়েকদিনের নানা স্মৃতি নানা ছবি মনে ভেসে আসছিল। বিশেষ করে মনে পড়ছিল একটু আগে পড়ন্ত বিকেলে গঙ্গার ঘাটে ছেলেদের কাঁধে বিসর্জ্জন যাবার পথে মায়ের প্রতিমার আয়ত চোখ দুটো। যেন আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আছেন।
কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখপানে…
এই গান রবীন্দ্রনাথ পঁচিশ বছর বয়েসে লিখেছিলেন, উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালীদের সম্বন্ধে। সেই সময় শোনা যায় বাংলায় নবজাগরণ এসেছিল, তবু তাঁর এই গানে বাঙ্গালীদের সম্বন্ধে তাঁর দুঃখ আর লজ্জা বেশ পরিস্কার বোঝা যায়।
এরা চাহেনা তোমারে, চাহেনা যে, আপন মায়েরে নাহি জানে/
এরা তোমায় কিছু দেবেনা, দেবেনা, মিথ্যা কহে শুধু কত কি ভাণে/
আজ যদি কবি বেঁচে থাকতেন, তাহলে উৎসবকে উপলক্ষ্য করে আজ যে মাতামাতি আর উচ্ছৃঙ্খলতা চলছে আমাদের দেশে, এই অর্থের অপচয় (unproductive expenditure) , হুজুগ আর হুল্লোড়, রাস্তায় অবিশ্রান্ত জনস্রোত, ট্র্যাফিক আটকে দিয়ে রাস্তায় উদ্দাম নাচানাচি, এই সব দেখে উনি আজকের আমাদের বাঙালীদের সম্বন্ধে কি ভাবতেন?
তবে কবির গানে মা অবশ্য দেশমাতৃকা, মা দূর্গা নন্। তবু মা’ই তো?
বিজয়া দশমীর রাতে রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে আটকে গিয়ে গাড়ীতে বসে এই সব ভাবছিলাম।
আজকের দিনটা হলো মন খারাপের দিন।







-
ফেলে এসেছি ঘরবাড়ী মোরা
আগস্ট মাস এলেই ১৯৯০ সালের সেই ইরাকের কুয়েত আক্রমণের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
সেই সময়ে আমরা বেশ কয়েকজন বাঙালী কুয়েতে আটকে পড়ি। মাস খানেক পরে ১৯৯০র সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমরা প্রায় সবাই কুয়েত ছেড়ে দেশে আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে গিয়েছিলাম।
এখন এত দিন পরে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবলে মনের মধ্যে সেই সময়ের নানা স্মৃতি ভেসে আসে। সে ছিল আমাদের জন্যে এক অস্থির সময়, অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কার কালো মেঘ আমদের সকলের জীবনে ঘনিয়ে এসেছিল।
আমাদের প্রায় সবার বৌ আর ছেলেমেয়েরা স্কুল ছুটি হবার কারণে দেশে চলে গেছে, এটা একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের ও অনেকের দেশে যাবার টিকিট কাটা ছিল, কিন্তু এখন এয়ারপোর্ট বন্ধ এখন আমরা এ দেশে বন্দী। কবে দেশে ফেরা যাবে জানিনা। আমাদের সবার মনের ভিতরে এই অনিশ্চয়তা আর বিষাদের ভাবটা আমরা লুকিয়ে রাখি। এই স্থায়ী চাকরী, এই সুখের জীবন ছেড়ে সব কিছু ফেলে দিয়ে এই মধ্যবয়সে আবার নতুন করে কোথাও শুরু করতে হবে?
এদিকে কুয়েতের রাস্তায় বন্দুক হাতে ইরাকী সৈন্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, জায়গায় জায়গায় কুয়েতীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, মাঝে মাঝেই গুলি বোমার আওয়াজ কানে আসে। কুয়েতের রাস্তায় ইরাকী ট্যাঙ্ক চলছে, আকাশে জেট প্লেনের আওয়াজ শোনা যায়। যুদ্ধ শুরু হলে সাদ্দাম হুসেন কি কুয়েতে কেমিকাল গ্যাস এর মিসাইল ছুঁড়বে?
আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি।
এই দুর্দিনেও কিন্তু আমাদের বন্ধুদের আড্ডার শেষ নেই। মাঝে মাঝেই কারুর না কারুর বাড়ীতে আমরা একসাথে বসি, নানা ব্যাপারে আলোচনা হয়।
এত বিপদের মধ্যেও আমাদের সত্য (নারায়ণ, চক্রবর্ত্তী) বিন্দাস। তার মুখে সবসময় এক হাজার ওয়াটের হাসি। তার হাতে এখন অঢেল সময়, তাই বাড়ীতে একা একা সময় কাটাতে সে এখন মজার মজার parody গান তৈরী করে। আর আমাদের আড্ডায় সত্য থাকলে সেই সব গান খুব দরদ দিয়ে সে গেয়ে শোনায় আমাদের।
সত্যর দুটি গানের কথা এখনো মনে আছে। দুটো গানই কুয়েতের আমীর শেখ জাবের এর গলায়।
প্রথম গানে তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধু ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন কে বলছেন,
“কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া/
এসেছো কি তুমি ওগো তব পথ ভুলিয়া?/”
দ্বিতীয় গানে দুশ্চিন্তায় তাঁর রাত্রে ঘুম আসছেনা, তিনি নিজের মনেই গাইছেন~
“জাগরণে যায় বিভাবরী, আঁখি হতে ঘুম নিলো হরি/
সাদ্দাম নিলো হরি। কি যে করি, কি যে করি ই ই ই ই ?/
অত্যন্ত আবেগের সাথে চোখ বুঁজে দুই হাত নেড়ে সত্য যখন তার এই সব গান একের পর এক গেয়ে যায়, আমরা সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ি।
শেষ পর্য্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা জর্ডানের ভিসা জোগাড় করে কুয়েত থেকে বাগদাদ হয়ে আম্মানে এসে পৌঁছেছি। এয়ার ইন্ডিয়া কুয়েতের সব ভারতীয়দের সেখান থেকে ভারতে নিয়ে যাবে। এই মহানিষ্ক্রমণের কথা গিনেস বুকে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
আম্মান এয়ারপোর্টের ভেতরেই আমরা বন্ধুরা সবাই মাটিতে বসে আড্ডা আর হাসি গল্পে মশগুল হয়ে সময় কাটালাম সারা রাত। এই গত দেড় মাসের অনিশ্চয়তা আর উৎকন্ঠার হাত থেকে এখন আমরা মুক্তি পেয়েছি।
দেশে ফেরার পরে আমরা কি করবো? সত্য বললো আমরা বন্ধুরা একটা বড় চাদর নিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবো, আমাদের সামনে একটা বড় পোস্টারে লেখা থাকবে “কুয়েত প্রত্যাগত দুর্গত মানুষদের সাহায্য করুন ” বা ওই ধরনের কিছু। সামনে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে থাকবেন অরবিন্দ, তাঁর রোগা পাতলা চেহারায় তাঁকে বন্যাবিদ্ধ্বস্ত বা দুর্ভিক্ষনিপীড়িতদের মত দুঃখী মানুষ বলে সহজেই মানিয়ে যাবে। তিনি প্যাঁপোঁ করে হারমোনিয়াম বাজাবেন আর তাঁর পিছনে খঞ্জনী বাজিয়ে আমরা গান গাইবো। আর রাস্তার পাশে বাড়ীর বারান্দা থেকে লোকেরা কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখবে আর কেউ কেউ আমাদের চাদরের ওপরে ছুঁড়ে দেবে কলাটা মূলোটা, আর সাথে কিছু সিকি আর আধুলিও।
“ফেঁলে এঁসেছি ঘঁরবাঁড়ী মোঁরা – ফেঁলে এঁসেছি সঁবকিছু – প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ”, আম্মান এয়ারপোর্টের ব্যস্ত পরিবেশে মাঝরাতে এক কোণে আমাদের আড্ডায় বেশ দরদ দিয়ে খোলা গলায় গান গাইছে সত্য, হারমোনিয়াম এর আওয়াজ শুদ্ধ।
এই ছবিটা ওই দিনগুলোর কথা ভাবলেই মনে পড়ে।
এদিকে প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় আসছে একটা করে Air India র প্লেন, আর ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় দের নিয়ে মুম্বাই চলে যাচ্ছে তারা। সারা রাত ধরে Air India র কর্ম্মকর্ত্তারা evacuee দের চেক ইন করতে আর বোর্ডিং পাস দিতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন।
আমরা সবাই ভোরের দিকে আমাদের বোর্ডিং পাস পেলাম। সেই মুম্বাই যাত্রার জন্যে আমাদের কোন টাকা পয়সা দিতে হয়নি, কেবল পাসপোর্টে একটা স্ট্যাম্প মারা হয়েছিল। পরে অবশ্য আমরা সেই দেনা মিটিয়ে দিয়েছিলাম।
মঙ্গলবার ১৮/৯/৯০ তারিখে আম্মান থেকে আমাদের প্লেন ছাড়লো দুপুর দুটোয়। মনে আছে নিজের সীটে বসে একটা খুব তৃপ্তি আর আনন্দের দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়েছিলাম। প্লেন আকাশে ওড়ার পরে air hostess মেয়েটি দুই হাত জোড় করে মিষ্টি হেসে বলেছিল Welcome home! সে কথাটা কোনদিন ভুলবোনা। জীবনের অনেক অবিস্মরনীয় মুহূর্ত্তের মধ্যে সেটি ছিল একটি অন্যতম মুহূর্ত্ত।