নতুন পোস্ট

  • পাকিস্তান আর ভারত

    আজকাল সুভদ্রা আর আমি মাঝে মাঝে দিল্লী যাই।  সেখানে আমাদের ছোট মেয়ে বুড়ী থাকে, আমরা মেয়ে জামাই আর নাতি নাতনীদের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে আসি। দিল্লী গেলেই মুকুর সাথে দেখা হয়, আর আমরা নিয়ম করে একদিন কিছুক্ষণ একসাথে কাটাই।

    মুকু আমাকে ওর গাড়ীতে তাদের Army Officers Golf Club এ নিয়ে যায়। সেখানে আমরা দুই ভাই গলফ কোর্সের পাশে একটা খোলা রেস্টুরেন্টে বসে নানা গল্প করে সময় কাটাই।

    আর্মিতে অনেক বছর অফিসার হয়ে কাজ করেছে মুকু, দেশের নানা জায়গায় তার পোস্টিং ছিল। সে হলো যাকে বলে একজন পোড় খাওয়া আর্মি  অফিসার।    

    সাধারণ ভারতীয় আর পাকিস্তানী লোকেদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এই গল্পটা তার কাছ থেকে সম্প্রতি শুনলাম।

    ভারত আর পাকিস্তান শুনলেই মনে হয় সাবজেক্টটা খুব সংবেদনশীল, এই নিয়ে অনেক তর্কাতর্কির অবকাশ আছে। সেই তর্কের মধ্যে চলে আসে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ১৯৬৫ আর ১৯৭১ এর যুদ্ধ, কাশ্মীর, কারগিল, মুম্বাই এর তাজমহল হোটেল। নানা তিক্ততা ও অসূয়া।

    কিন্তু মুকুর এই গল্পটি শুনলে এই দুই দেশের মানুষের সম্পর্কের সম্বন্ধে একটা অন্যরকম ধারণা হয়।  Ground level এ দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক শত্রুতার নয়, সেই সম্পর্ক অনেক সময়ই বরং বন্ধুত্বের।   

    মহম্মদ ইকবাল রহমান (M I Rehman) নামে মুকুর এক সহকর্ম্মী অফিসারের এক আত্মীয়ের বিয়ে হচ্ছে পাকিস্তানের করাচীতে।  অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে Ministry of Foreign Affairs আর  Indian Military Intelligence থেকে সে সেই বিয়েতে যোগ দেবার অনুমতি যোগাড় করেছে।

    সেখান থেকে ফিরে এসে সে মুকু কে করাচীতে তার অভিজ্ঞতার র এই আশ্চর্য্য গল্পটা বলেছিল।    

    সে বললো করাচীতে যতদিন সে ছিল, নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সব জায়গায় তাকে shadow করতো plainclothes এ পাকিস্তানী Security agency ISI এর একজন লোক। যেখানেই সে যায়, সেখানেই কাছাকাছি বসে থাকে অথবা তাকে নজর রেখে ঘুরে বেড়ায় সেই লোকটি।

    ইকবাল এবং সে কেউ কারুর সাথে কথা বলেনা, কিন্তু দুজনেই জানে পরস্পরের উপস্থিতি। ইকবাল জানে ঐ ISI এর লোকটি তার নিজের কাজ করছে, তার ওপরে নজরদারী রাখাই হলো তার কাজ।

    এর মধ্যে বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ, পরের দিন ইকবালের দেশে ফেরার কথা, সে যাবার আগে তার আত্মীয় বন্ধুদের এক রেস্টুরেন্টে খেতে ডেকেছে। সেখানেও ইকবাল দেখলো যথারীতি সেই লোকটি পাশের এক টেবিলে চুপচাপ এক কাপ চা নিয়ে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

    পার্টি শেষ, ইকবাল বিল pay করতে গেল, গিয়ে শোনে তার বিল কেউ একজন already pay করে দিয়েছে। ইকবাল তো অবাক।  এই বিদেশে কে তার বিল অযাচিত ভাবে pay করে দিলো?

    কাউন্টারের  ভদ্রলোক তখন ওই ISI এর স্পাই টির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।  ওই লোকটাই তার বিল pay করেছে!

    তাই শুনে ইকবালের বেশ রাগ হয়ে গেল।

    এতদিন সে এই লোকটাকে সহ্য করে এসেছে, কিন্তু আজ এই শেষ রাতে তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল।  সে সেই লোকটার কাছে গিয়ে বললো, “সেই প্রথম দিন থেকে আপনি আমায় ফলো করছেন, আমি কিছু বলিনি, আজ এখানে আমার শেষ রাত, আমি আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় দের এখানে খাওয়াতে নিয়ে এসেছি, সেখানেও আপনি এসে আমার সামনে বসে আছেন, তাও আমি আপত্তি জানাইনি। কিন্তু আপনি আমার রেস্টুরেন্টের বিল ও মিটিয়ে দেবেন, এটা কি হচ্ছেটা কি?”

    তাই শুনে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ইকবালের দুটো হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খুব বিনীত আন্তরিক ভাবে বললো, “স্যার,  please আমার ওপর রাগ করবেন না। এ ক’দিন আমি আপনাদের কাছে থেকে আপনাদের কথাবার্ত্তা শুনে জেনেছি যে আপনারা সবাই originally হায়দ্রাবাদের । জানেন আমিও হায়দ্রাবাদের ছেলে, ওখানেই আমার জন্ম, ওখানেই আমি বড় হয়েছি। আমার যখন দশ বছর বয়েস, তখন আমার আব্বা আর আম্মা আমায় নিয়ে করাচীতে চলে আসেন। কিন্তু এখনো আমি হায়দ্রাবাদে আমার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা ভুলতে পারিনা। আপনি হায়দ্রাবাদ থেকে এসেছেন, তাই আপনাকে এবং আপনার এখানকার আত্মীয় বন্ধুদের সবাইকে ক’দিন থেকেই আমি খুব আপন ভাবছি। আপনারা হলেন আমার মেহমান, এই দেশে আমার অতিথি। সুতরাং আপনাকে অনুরোধ, আজ আপনাদের আতিথেয়তা আমায় করতে দিন্‌।”

  • মোহাম্মেদ  ইমলাক হুসেন সাহেবের আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন

    কুয়েতে  আমরা  মুরগাবে কর্ণফুলী স্টোর্সে নিয়মিত বাজার করি। তরীতরকারী ছাড়াও সেখানে বাংলাদেশের মাছ পাওয়া যায়। বরফের মাছ ঠিকই, তবু  কুয়েতের সমুদ্রের   fresh মাছের সাথে মাঝে মাঝে দেশের কাতলা মৃগেল আর পাপ্তা পার্শে ও খেতে ইচ্ছে করে। এর মধ্যে মুরগাবে অনেক বাংলাদেশী দোকান ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠলেও আমাদের কাছে কর্ণফুলী স্টোর্সের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।

    এর প্রধান কারণ তাদের Customer relationship management (CRM) অন্য দোকানগুলোর থেকে অনেক ভালো, এবং তার জন্যে  স্বীকৃতি দিতে হবে তাদের মালিক মোহাম্মেদ ইমলাক হুসেন সাহেবকে। ভদ্রলোক দেখতে ছোটখাটো, কথা খুব কম বলেন, কিন্তু তাঁর ভেতরে একটা রাশভারী ব্যক্তিত্ব আছে, যেদিন তিনি কাউন্টারে থাকেন, সেদিন সব কর্ম্মচারী দের বেশ তঠস্থ দেখা যায়, ইমলাক সাহেব  তাদের কাজে কোন গাফিলতি দেখলে কোন চ্যাঁচামেচি করেননা, তাদের দিকে কেবল ঠাণ্ডা চোখে তাকান, ব্যাস তাতেই কাজ হয়…

    কিছু ম্যানেজার আছেন যাঁরা চোখ রাঙান, আবার কিছু আছেন যাঁরা শুধু ঠান্ডা চোখে তাকান। ইমলাক সাহেব এই দ্বিতীয় দলের।  কর্ণফুলী স্টোর্সের এত বাড়বাড়ন্ত তাঁর কর্মকুশলতা আর নেতৃত্বেই হচ্ছে ধরে নেওয়া যায়, ইতিমধ্যে আবু হালিফার দিকেও তাদের একটা দোকান খোলা হয়েছে।

    দোকানের বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ডে দোকানের নামের তলায় বেশ বড় বড় করে তাঁর নাম লেখা –  “প্রোঃ – মোঃ ইমলাক হুসেন।”

    কুয়েতের মত বিদেশে বসে এত বড় একটা দোকান চালানো সোজা কাজ নয়।  বাংলাদেশ থেকে তরীতরকারী মাছ আমদানী করা (Supply chain management, Storage), এখানকার কাস্টমস্‌, পুলিশ, মিউনিসিপ্যালিটি র লোকেদের তোয়াজ করা, কর্ম্মচারীদের কাজ দেখা, competition সত্ত্বেও sales  আর customer   বাড়ানো, এত সব দায়িত্ব প্রায় একা নিজের কাঁধে বইছেন তিনি, তাঁর এই    উদ্যোগী স্বভাবের  তারিফ করতেই হয়।

    আমরা তাঁর দোকানে গেলে বিশেষ করে সুভদ্রাকে দেখলে আমি লক্ষ্য করি ইমলাক সাহেব কেমন যেন  বিহবল  হয়ে যান্‌। যেন কি করবেন ভেবে পান্‌না। নিজে আমাদের জন্যে ডাবের জলের can নিয়ে এসে খাবার জন্যে সাধাসাধি করেন। সুভদ্রা যা চায়, সে মাছই হোক, বা মুড়ি বা জর্দ্দা, তাঁর দোকানে না থাকলে তিনি নিজে ছুটে বাইরে কোন দোকান থেকে   নিয়ে আসেন।

    আর আপত্তি জানালে তাঁর মুখে একটাই কথা, “অসুবিধা নাই”…

    একদিকে কর্ম্মচারীদের সাথে কঠিন আর ঠান্ডা  ব্যবহার, অন্যদিকে  বিনয় বিগলিত, মাথা নীচু, মুখে হাসি, সুভদ্রাকে দেখলেই  ইমলাক সাহেবের ওই পরিবর্ত্তনটা আমি খুব উপভোগ করতাম।  

    শেষের দিকে তাঁর সাথে বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল, নানা রকম ব্যক্তিগত কথা বলতেন। স্ত্রী ও ছেলে কে USA পাঠিয়ে দিয়েছেন,  শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে, এই সব।  ক্রমশঃ তাঁকে বেশ ক্লান্ত, বিপর্য্যস্ত, চিন্তিত মনে হতো।  মাথায় বেশ কিছু পাকা চুল। দেখা হলে আমায় প্রায়ই বলতেন চট্টগ্রাম আসবেন একবার বৌদি কে নিয়ে, আমি সব বন্দোবস্ত করে দেবো, হোটেল, গাড়ী, গাইড। আপনাদের কোন চিন্তা নাই। পতেঙ্গা কক্সবাজার রাঙামাটি সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবো।

    আমার সাথে কথা বলার সময় ইমলাক সাহেব আমাদের দিকের বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, ভুলেও বাঙাল ভাষায় বলতেন না। ভাবী নয়, বৌদি। দিমু নয়, দেবো।

    তো একদিন বাজার করতে গিয়ে সাইন বোর্ডে চোখ পড়লো, দেখলাম সেখানে ইমলাক সাহেবের নাম আর নেই।

    কি হলো? 

    শুনলাম তিনি  আর নেই, কর্ণফুলী স্টোর্স এর মালিকানা এখন নতুন কারুর হাতে। পুরনো কর্ম্মচারীরা সবাই আগের বলেই মনে হলো। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল ইমলাক সাহেব নাকি ব্যবসার বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

    কর্ম্মচারীদের কথা মতো ইমলাক সাহেব  ভালো লোক ছিলেন, কিন্তু ওনার বৌ আর ছেলে নাকি তাঁর কাছ থেকে  টাকা চেয়ে চেয়ে তাঁকে “এক্কেরে শ্যাষ কইরা দিসিলো।” টাকা নিয়ে পালানো ছাড়া নাকি তাঁর আর কোন উপায় ছিলোনা।

    এক উদ্যোগী সফল ব্যবসাদার ভদ্রলোক থেকে একজন চুরির আসামী  …ইমলাক সাহেবের এও এক আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন!    

  • বীভৎস

    সুভদ্রা, আমি, আমার ভাই খোকন আর তার ছেলে বুবান আমরা চার জনে দেরাদুন থেকে গাড়ী নিয়ে গঙ্গোত্রী যাচ্ছি।

    আমাদের ড্রাইভার এর নাম রামেন্দ্র রাওয়াত, আমাদের গন্তব্য হলো গঙ্গোত্রীর কাছে ধারালী নামে একটা জায়গায়, সেখানে আমাদের হোটেলের নাম হলো Prakriti the Retreat – সেটাই দেখলাম সবচেয়ে ভাল হোটেল সেখানে।

    কাছেই হারশিল নামে একটা শহর আছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে ভাল হোটেল নেই। রামেন্দ্র বললো হারশিল কথাটা এসেছে হরিশিলা থেকে।

    দেরাদুন থেকে ধারালীর দূরত্ব প্রায় ২০০ কিমি। পথে উত্তরকাশীতে থেমে দুপুরের খাওয়া খেতে ঘন্টা খানেক নিয়ে সব মিলিয়ে ধারালীতে হোটেলে পৌঁছতে আমাদের আনুমানিক আট ঘন্টা লাগবে। অর্থাৎ বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছবো।

    রামেন্দ্র বললো আপনাদের হোটেলটা একদম নদীর পাশে। পাহাড়ের ওপরে তখনো যথেষ্ট আলো থাকবে। আপনারা হোটেলে পৌঁছে নদীর ধারে চলে যেতে পারেন।

    রামেন্দ্র উত্তরাখন্ডের লোক, সে হলো গাড়োয়ালী। হিন্দী অবশ্য সে ভালোই বলে। সে মধ্যবয়েসী, হাসিখুসী, বেশ কথা বলে, আমাদের সাথে তার আলাপ জমে গেল অল্পক্ষনের মধ্যেই। জানা গেল সে তার বৌ আর ছেলে মেয়েদের নিয়ে দেরাদুনে থাকে। তবে অনেক বছর ধরে সে নিয়মিত দেরাদুন থেকে চার ধামে গাড়ী চালিয়েছে বলে এই অঞ্চলের রাস্তাঘাটের সাথে সে খুব পরিচিত।

    তার গাড়ী চালানো দেখে বুঝলাম সে বেশ দক্ষ ড্রাইভার। আমাদের গাড়ীটাও (Toyota RAV 4) বেশ বড়ো আর নতুন। বেশী ঝাঁকানী নেই। আমি সামনে রামেন্দ্রর পাশে ক্যামেরা হাতে বসলাম। ওরা তিনজন আরাম করে পা ছড়িয়ে পিছনে। লম্বা পাহাড়ী রাস্তায় এই বড় গাড়ীই ভালো। Comfortable and safe…

    দেরাদুন শহরটা পেরোলেই পাহাড়ী রাস্তা শুরু। এই রাস্তায় আমরা মুসৌরী গেছি অনেকবার। কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে Road sign দেখে বুঝলাম আমরা মুসৌরী্র দিকে না গিয়ে অন্য দিকে বেঁকে গেলাম। রামেন্দ্র বললো ওই রাস্তাটা বাঁ দিকে মুসৌরী আর যমুনোত্রীর দিকে চলে গেছে। আমরা যাচ্ছি ডান দিকে উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রীর দিকে।

    গাড়ী চলছে, জানলার বাইরে দেখছি পাহাড়ের রূপ। ছবি তুলে যাচ্ছি। কথাবার্ত্তাও চলছে টুকটাক।

    রাস্তায় খুব কাজ হচ্ছে দেখছি। রামেন্দ্র বললো মোদীজী উত্তরাখন্ডে তিব্বত বর্ডারের চারিপাশে চওড়া all weather road তৈরী করছেন, যাতে army trucks আর artillery চট করে বর্ডারে পৌঁছে দেওয়া যায়। উত্তরাখন্ডে বি জে পি সম্প্রতি Assembly election এ জিতেছে। তাদের মুখ্যমন্ত্রীর বিশাল ছবি রাস্তার পাশে হোর্ডিং এ চোখে পড়ে।

    বেশ কিছুক্ষণ গাড়ী চালাবার পরে একটা জায়গায় এসে রামেন্দ্র গাড়ী থামালো। চা আর বাথরুম ব্রেক। দোকানের নাম কাজল রেস্টুরেন্ট এন্ড কাফে। রাস্তার ধারে বেশ ছিমছাম দোকান, সেখানে বসার জায়গা আছে, অনেক গুলো টেবিল চেয়ার। আমরা যখন গেলাম তখন দোকানে কোন লোক নেই। আমরা গরম কফি আর বিস্কুট অর্ডার করে বসলাম। ওদের টয়লেটটা খুব পরিস্কার, দেখে বেশ ভাল লাগলো। এই পাহাড়ের দেশের লোকেদের ওপর বেশ একটা শ্রদ্ধা আর সন্মানের ভাব জন্মাচ্ছে আমার মনে। দোকানের মালিক কাউন্টারে বসে আছেন তাঁর সাথে কিছুক্ষণ গল্প জুড়ে দিলাম।

    উত্তরকাশী যাবার পথে এবার নদীর পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে আমাদের রাস্তা। দূরে পাহাড়, পাশে নদী নুড়ি পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে আমরা নদীর এদিকে মাঝে মাঝে ব্রীজ পার হয়ে ওদিকে। রামেন্দ্র আমাদের বলে দিয়েছে এখানে নদীর নাম গঙ্গা নয়। এখানে তার নাম হলো ভাগীরথী। আরও নীচে রুদ্রপ্রয়াগ আর দেবপ্রয়াগে মন্দাকিনী আর অলকনন্দারর সাথে মিশে যাওয়ার পরে তিন সখীর মিলিত নাম হলো গঙ্গা, যা তার পরে হৃষিকেশ আর হরিদ্বারে সমতলে নেমে এসেছে।

    কিছুক্ষণ পরে আমরা ভাগীরথী নদীর ওপরে Tehri dam এর কাছে এসে পৌঁছলাম। এখানে Hydroelectric power generation plant আছে। ২০০৬ সালে এই বাঁধের কাজ শেষ হবার পরে এখান থেকেই এখন উত্তরাখন্ডের প্রায় ৯০% বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। রামেন্দ্র আমাদের একটা Viewing point এর সামনে নিয়ে গেল। খুব দূর থেকে নীচে দেখা যায় বাঁধের reservoir – বিশাল এক নীল হ্রদ।

    রক্তকরবীতে রাজা নিজের সাথে নন্দিনীর তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “সরোবর কি ফেনার নূপুর পরা ঝর্ণার মত নাচতে পারে?” টেহরী বাঁধের বিশাল নীল সরোবর দেখে আমার রাজার সেই কথাটা মনে পড়লো। ফেনার নূপুর পরা উচ্ছল বালিকা ভাগীরথী কে এখানে পায়ে শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

    উত্তরকাশী পৌঁছলাম প্রায় দেড়টা নাগাদ। উত্তরাখন্ডের এই শহরটিকে বেশ ধূলিধূসরিত আর নোংরা মনে হলো । বেশ চওড়া একটা রাস্তা, সেখান দিয়ে একের পর এক বাস আর গাড়ী চলে যাচ্ছে। বেশ কিছু বাসের পিছনে বদ্রীনাথ লেখা আছে দেখলাম। রাস্তার দু’পাশে দোকান, তার মধ্যে রামেন্দ্রর বাছা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করলাম। মেনু দেখে বুঝলাম এখানে প্রধান দু’টো খাবার – staple food – হলো মোমো আর ম্যাগীর স্যুপ। কিসের মাংস দেবে কে জানে এই ভেবে আমরা তিন জন নিরামিষ মোমো অর্ডার করলাম কিন্তু বুবান নিরামিষ ভালবাসেনা। আমরা অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে চিকেন মোমো অর্ডার করলো।

    সেই ২০১৭ সালের পর থেকে কি একটা ওষুধ খাবার পরে তার পেট এখনো একদিনও খারাপ হয়নি জানালো সে। এখানে চিকেন মোমো খেয়েও তার কিছুই হবেনা সে নিশ্চিত।

    বুবান বললো , “আমার পেটটা বীভৎস!”

    বীভৎস?

    বুবান একটু অপ্রস্তুত আর লজ্জিত ভঙ্গীতে বললো, এখানে বীভৎস মানে ব্যাপক, মানে ভাল, দারুণ, দুর্দ্দান্ত!”

    কত বদলে যাচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষা!

    খেয়ে দেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে রাস্তার এক ঠ্যালাওয়ালার কাছ থেকে কিছু ফল – কমলালেবু, আঙ্গুর ইত্যাদি কেনা হলো। তারপরে আর সময় নষ্ট না করে সোজা ধারালীর পথে।

    এবার পাহাড়ী রাস্তায় ক্রমাগত সেকেন্ড গীয়ারে ওঠা। এঁকে বেঁকে আস্তে আস্তে এক পাহাড় থেকে পাশের পাহাড়ে চলে যাচ্ছি, যত ওপরে উঠছি তত যেন বেশ ঠান্ডা লাগছে, আমরা সকলেই গায়ে আর এক গরম জামা পরে নিলাম। কেউ জ্যাকেট, কেউ সোয়েটার, কেউ শাল।

    রাস্তার এক একটা বাঁক ঘুরতেই আশ্চর্য্য সুন্দর সব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পাহাড়ের গায়ে বৃত্তাকারে নেমে গেছে ক্ষেত, দূরে ছোট ছোট গ্রাম দেখা যায়, সেই গ্রামের ছোট ছোট বাড়ীতে বিকেলের সূর্য্যের আলো এসে পড়েছে। মাঝে মাঝেই দূরের পাহাড়ের গা থেকে ধোঁয়া উঠছে দেখা যায়। রামেন্দ্র বললো – Forest fire – বনে আগুন লেগেছে, তাই ধোঁয়া।

    ক্রমশঃ দূরের পাহাড়গুলো কাছে চলে আসতে শুরু করলো, তাদের চূড়ো সব বরফে ঢাকা। সেই বরফের ওপরে অস্তগামী সূর্য্যের লাল আলো এসে পড়েছে।

    জীবনে অনেক হিল স্টেশনে গিয়েছি কিন্তু এত কাছ থেকে বিশাল বরফে ঢাকা পর্ব্বতচুড়ো দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম।

    বুবান বললো, “জ্যেঠু আমরা আর একটু ওপরে উঠলে ওই ঝাউ গাছ গুলোর মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের চুড়োয় বরফের মধ্যে সূর্য্যের লাল আলো এসে পড়ছে, এরকম বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিও। বীভৎস উঠবে। ”

  • পেনাল্টি মিস্‌

    কয়েক বছর আগে  আগে USA র বিরুদ্ধে কোপা সেমিফাইনালে তিরিশ গজ দূর থেকে মেসির ফ্রিকিক এ দুর্দ্ধর্ষ গোল দেখার পর মেসি কে সবাই দেবতা ভেবে আকাশে তুলে নাচছিল।  তার মাত্র কিছুদিন পরে স্প্যানিশ লীগের ম্যাচে বার্সিলোনার হয়ে খেলার সময় পেনাল্টি মিসের পর বেচারার মুখটা দেখে দুঃখই হচ্ছিল। কাল কাগজে তাকে নিয়ে কি লেখা হবে কে জানে।

    আকাশ থেকে সোজা মাটিতে। দেবতা থেকে আবার একজন সাধারণ মানুষ?

    সালা হুইমসিকাল পাব্লিক!

    গত বছর (২০২২) কাতারের বিশ্বকাপে অনেক পেনাল্টি মিস দেখলাম । ফুল টাইমের মধ্যে খেলার মীমাংসা না হলে পেনাল্টি শুটআউটে জয় পরাজয় ঠিক হয়, অনেক সময় কোন টীম ১২০ মিনিট ভাল খেলেও পেনাল্টি মিসের জন্যে হেরে গেলে বেশ খারাপ লাগে। কাতারে আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্সের ফাইনালে যা হলো। স্বস্তির কথা সেখানে অবশ্য মেসি বা এমব্যাপে দুজনেই পেনল্টি মিস করেনি।

    কিন্তু ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে ইটালী ব্রাজিলের কাছে হারে। ইটালীর নামী ফরোয়ার্ড বাজিও সেবার পেনাল্টি মিস করে। তার পর মাঠে বেচারার দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নার ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে।

    দেশের হয়ে খেলার সময়  এই সব নামী দামী খেলোয়াড়দের  মনের ওপরে কি ধরণের expectation এর চাপ থাকে তা আমাদের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন।   

    সুতরাং পেনাল্টি মিস হলে অবাক হবার তেমন কিছু নেই। হতেই পারে। মেসি রোনাল্ডো এবং আরও অনেক নামকরা খেলোয়াড় বহু বার পেনাল্টি মিস করেছে, ওই ম্যাচটাতে মেসিরও সেটা  প্রথম পেনাল্টি মিস ছিলনা!

    ২০০৬ সালে জার্মানীর বিশ্বকাপ Quarter Final এ পর্তুগালের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড এর বেকহ্যাম, জেরার্ড আর ল্যাম্পার্ড তিন জনেই পেনাল্টি মিস করে, এবং ইংল্যান্ড হেরে যায়। সেই সময়ে ইংল্যান্ডে Immigrant দের জন্যে Britishness course চালু করা হয়েছিল। যাতে তাদের মধ্যে ব্রিটিশদের মূল্যবোধ চারিত হয় আর তারা ভাল ভাবে ব্রিটিশ সমাজে মিশে যেতে পারে।

    তো তার পরের দিন গার্ডিয়ানে একটা কার্টুন বেরিয়েছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে আলখাল্লা আর পাগড়ী  পরা এক মুখ দাড়িওয়ালা তিন জন লোক এরকম একটা Britishness course এর ক্যাম্প থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে,তাদের একজন রিপোর্টার জিজ্ঞেস করছেঃWhat did you learn today?

    উত্তরে তারা একগাল হেসে  বলছেঃ Today we learnt how to miss penalty kicks…

    ইংল্যান্ডের এই পেনাল্টি মিস করে ম্যাচ হারা এখন একটা রসিকতার পর্য্যায়ে চলে গেছে।  

    আমার বাবা (প্রাণবন্ধু, বাদল) তিরিশের দশকে কলকাতা ময়দানে ফার্স্ট ডিভিসনে ফুটবল খেলতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের হয়ে এলিয়ট শীল্ডে খেলার সময় তিনি এরিয়ানের দুখীরাম মজুমদারের নজরে পড়েন। দুখীরাম তাঁকে এরিয়ানে ডেকে নেন।

    আমার মাসতুতো দাদা (বড়মাসীর ছেলে, রতন দা’) বাবার কাছ থেকে  পাস নিয়ে ময়দানে খেলা দেখতে যেতেন। রতনদা’র কাছে শুনেছি, “উঃ, মেসোমশায়ের দুই পায়ে সে কি দুর্দ্দান্ত  কিক!”

    বাবা গল্প করতেন যে তিনি নাকি এমন কর্ণার কিক করতেন যে বল হামেশাই swerve করে সেকেণ্ড পোস্ট দিয়ে গোলে ঢুকে যেত।  Bend it like Beckham এর মত। তখন অবশ্য বেকহ্যাম এর জন্ম হয়নি। কথাটা হওয়া উচিত ছিল Bend it like Bhowmick!

    তাই যে কোন খেলায় কর্ণার বা পেনাল্টি অবধারিত বাবাই নিতেন।

    একবার কোন এক ম্যাচে বাবা নাকি পেনাল্টি মিস্‌ করেন। বল বারের সামান্য দুই ইঞ্চি ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

    পরের দিন স্টেটসম্যান কাগজে সেই ম্যাচ রিপোর্টের হেডলাইন ছিলঃ

    BHOWMICK MISSES PENALTY KICK!


    পড়লে মনে হবে সেটা যেন পৃথিবীর একটা অন্যতম আশ্চর্য্য ঘটনা~

    এই হেডলাইন টা বাবার খুব গর্ব্বের আর আত্মশ্লাঘার কারণ ছিল বলে আমার মনে হয়, কেননা এই গল্পটা তাঁর মুখে আমি অনেকবার শুনেছি। পেনাল্টি মিস করে যে দুঃখ বাবার হয়েছিল, আমার ধারণা স্টেটসম্যান এর মত বড় এবং নামকরা কাগজে বাবার নামে ওই হেডলাইন সেই দুঃখ ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

  • ছোটবেলার খেলার মাঠের বন্ধুরা

    সকালবেলার কেয়াতলা রোড

    ১) স্বরাজ

     ২০২০ সালের আগস্ট মাস।

    কোভিডের প্রকোপ কিছুটা কমেছে।  আমরা দু’টো ভ্যাক্সিন নিয়েছি, মুখে মাস্ক পরে মাঝে মাঝে বাড়ীর বাইরে বেরোই।  বিদেশ ভ্রমণের বাধানিষেধ কমেছে, লন্ডন থেকে পুপু এসেছে আমাদের দেখতে।

    আমি  আর পুপু রোজ সকালে বাড়ীর কাছে ঢাকুরিয়া লেকে একটু হেঁটে আসি।

    একদিন পুপুর সাথে লেকে হাঁটার পর  কেয়াতলা রোড দিয়ে  বাড়ী ফিরছি।  দক্ষিণ কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালী পাড়া, একদিকে নানা রং এর একতলা দো’তলা বাড়ী, তাদের সামনে এক চিলতে বারান্দা, আর মাঝে মাঝে  বস্তীতে টালির চালের বাড়ী । ওই সকালে রাস্তার ধারে জলের কলের সামনে কিছু মেয়েরা বাসন মাজছে।  কিছু  লোক গামছা পরে ঘটির জল দিয়ে স্নান করছে।  কেউ কেউ নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছে,  এই সবের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম  সামনে উল্টো দিক থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের দিকে হেঁটে আসছেন,  এবং মনে হলো তিনি যেন আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।  

    ইনি কি আমার পরিচিত কেউ?   আমার মতোই হাইট, ভারী চেহারা।  দু’জনেরই মুখে মাস্ক বলে চিনতে পারছিনা।  

    আমাদের কাছে এসে ভদ্রলোক একটু হেসে  বললেন “মাস্ক টা একটু খুলবেন প্লীজ?”

    এই কোভিডের সময় অপরিচিত কারুর কাছ থেকে এই ধরণের অনুরোধ আসলে একটু অস্বস্তি হয়। আমি অবশ্য ভদ্রতা করে মুখ থেকে মাস্ক টা খুলতেই যাচ্ছিলাম, কেননা মনে  হচ্ছিল ভদ্রলোক আমায় চেনেন।

    কিন্তু  পুপু ডাক্তার, সে সোজা বলে দিলো “না বাবা”। ওর মা’র মতোই ও ও বেশ যাকে ইংরেজীতে বলে aggressive…

    ভদ্রলোক এবং আমি দুজনেই একটু অপ্রস্তুত।

    উনি বললেন,  “মান্টু না?”   

    আমি ভাবলাম এই রে, ঠিক যা ভেবেছি। ইনি আমায় চেনেন। একটু বিব্রত হয়ে আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে মানে আমি তো ঠিক…

    ভদ্রলোক বললেন ছোটবেলায় আমরা একসাথে কত খেলাধুলা করেছি। আমার সব মনে আছে, শ্যামল দা’,বাবলু, বাপ্পা, মনা, শঙ্কর, বাবু,  অলক, বিকাশ …

    আমি খুব লজ্জা পেয়ে বললাম আপনার নামটা কি?

    উনি বললেন, “আবার আপনি কেন? আমি হলাম স্বরাজ।  তুমি আমায় চিনতে পারছোনা? কালীঘাট পার্কে আমরা  কত ফুটবল খেলেছি একসাথে. আমার চেহারাটা পালটে গেছে, তাই তুমি চিনতে পারছোনা, কিন্তু তোমায়  দ্যাখো আমি চিনতে পেরে গেলাম, আমার বেশ গর্ব্ববোধ হচ্ছে,…  ”

    স্বরাজ কে আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম, ষাট বছর পরে দেখা,সময়টা তো কম নয়।  আর তার ওপরে স্বরাজের চেহারা একেবারেই পালটে গেছে। আগে ছিল ছিপছিপে লম্বা, এখন চেহারাটা বেশ মুশকো হয়েছে।  কিন্তু যেই বললো কালীঘাট পার্কে ফুটবল খেলেছি এক সাথে, অমনি  এক মূহুর্ত্তের মধ্যে ছবির মত ওকে মনে পড়ে গেল। ওরা থাকতো হাজরা রোডে অন্য পাড়ায়। ওদের ক্লাব ছিল উদয়ন সঙ্ঘ, আর আমাদের ক্লাব ছিল মনোহরপুকুর বৈশাখী সঙ্ঘ। আমাদের দুই ক্লাবের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হতো কালীঘাট পার্কে।

    অসাধারণ বল কন্ট্রোল ছিল স্বরাজের।  তাছাড়া ছিল স্পীড আর দুর্দ্ধর্ষ ড্রিবলিং স্কিল।  এখনো মনে আছে একবার আমার মাথার ওপর দিয়ে বল ট্যাপ করে পাশ কাটিয়ে তীরবেগে আমাদের গোলের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে।

    আমিও ফুটবলটা ভালোই খেলতাম। তাই হয়তো স্বরাজের ও আমার কথা এতদিন পরেও মনে আছে।  ছোটবেলার খেলার মাঠের সেই বন্ধুত্ব কি কোন দিনই ভোলা যায়?  

    সেই বন্ধুত্ব চিরকালীন।

    তারপরে কিছু মামুলী কথাবার্ত্তার পর আমরা বিদায় নিলাম।  কেউই কাউকে ঠিকানা বা ফোন নাম্বার দিলামনা। 

    ২) কিরণ

    কিরণকে কি কারুর মনে আছে? কিরণ সিনহা।

    ফুটবলটা বেশ ভাল খেলত। উঁচু ক্লাসে উঠে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল বোধহয়। থাকতো বালীগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। কোয়ালিটির পাশে একটা ছোট পার্কে ওকে পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে দেখেছি মাঝে মাঝে।

    আমাদের সেন্ট লরেন্স স্কুলে ছিল বিশাল খেলার মাঠ,  সেই মাঠ ছোট ছোট ভাগ করে লাঞ্চ ব্রেকে আমরা চুটিয়ে ফুটবল খেলতাম। এখনো মনে পড়ে  স্কুলের পিছন দিকে বাঁধাকপির ক্ষেত আর পুকুরের দিকে এক চিলতে মাঠে ক্লাস ফোর ফাইভে খেলতাম আমরা। আর সেই সময় কিরণ ছিল আমাদের স্টার প্লেয়ার। এমনিতে পড়াশোনায় কিরণ তেমন ভাল ছিলনা,  ক্লাসে  মাথা নীচু করে চুপ করেই থাকতো বেশীর ভাগ সময়, খুব লাজুক ছিল কিরণ।

    কিন্তু খেলার মাঠে বল পায়ে তার অন্য রূপ।  ফুটবল মাঠে সে একচ্ছত্র সম্রাট।  

    বেশ কয়েক বছর আগে একবার বালীগঞ্জ ফাঁড়ির উল্টো দিকে পেট্রোল পাম্পের পাশে The Wardrobe নামে একটা লন্ড্রীতে কাপড় কাচাতে নিয়ে গেছি। ঢুকেই দেখি কাউন্টারে আমাদের কিরণ বসে।

    অনেকদিন পর দেখা, কিন্তু আমি চিনলাম সহজেই, চেহারাটা অনেকটা আগের মতোই আছে, বেশ শক্তপোক্ত খেলোয়াড় সুলভ। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা, কপালের সামনে একটু পাতলা হয়েছে, বেশ ভারিক্কী হয়েছে কিরণ, দোকান টা ওরই  franchise  নেওয়া বুঝলাম, কেননা চারপাশের কর্ন্মচারীদের সাথে সে বেশ হুকুমের ভঙ্গী তে কথা বলছিল।

    কিরণ ও আমায় চিনেছে ঠিক। ছোটবেলার ফুটবল মাঠের বন্ধুদের  সহজে ভোলা যায়না।

    “এখনও খেলো নাকি?” কিছুটা লাজুক গলায় কিরণ জিজ্ঞেস করলো আমায়।

    “কোথায় আর?” বললাম আমি।

    তারপর বেশ কিছু খুচরো কথা হলো।

    আমার বিলটা সই করার আগে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে পুরনো বন্ধুকে ২০% ডিসকাউন্ট লিখে দিল কিরণ।

    কি মুস্কিল, এসব আবার কেন, বললাম আমি।

    তার পরে আর কোনদিন কিরণের দোকানে কাপড় কাচাতে নিয়ে যাইনি।

    বন্ধুদের এইরকম ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে ডিসকাউন্ট দিতে গিয়ে ওর দোকানটা শেষে উঠে যাক আর কি?

    কি দরকার?

    ৩) পৃথ্বীশ

    পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে যখন স্কুলে পড়ি, তখন কলকাতার দুই ফুটবল ক্লাব  মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল ছিল দুই  প্রবল পরান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী, আর তাদের সমর্ত্থক দের মধ্যেও ছিল দারুণ রেষারেষি।

    স্কুলে আমাদের নিজেদের মধ্যে খেলার জন্যে দুই ফুটবল টীম করার সময় প্রায়ই মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার দের নিয়ে টীম তৈরি  হতো।  আমি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান কোন দলের সমর্থক ছিলামনা,  কিন্তু আমায় সবসময় ইস্টবেঙ্গলের টীমে খেলতে হতো।  আসলে আমাদের সহপাঠী খেলোয়াড়দের মধ্যে মোহনবাগানের সমর্থক অনেক বেশী থাকতো, তুলনায় ইস্টবেঙ্গলে অনেক কম।  তাই ইস্টবেঙ্গলের টীমে যথেষ্ট প্লেয়ার পাওয়া যেতোনা।  তাই আমায় ইস্টবেঙ্গলের টীমে খেলতে হতো।  সেই সব খেলা অবশ্য এলেবেলে খেলা, তাই কোন একটা দল হলেই হলো।

    কিন্তু  ইস্টবেঙ্গলের দলে বাঁধা খেলোয়াড় ছিল পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশ  চ্যাটার্জ্জী।

    সে ছিল ইস্টবেঙ্গলের পাঁড় সমর্থক। তাকে ইস্টবেঙ্গল কেমন খেলেছে এই প্রশ্ন করা হলে তার তিনটে সম্ভাব্য উত্তর ছিলঃ

    ১) দারুণ খেলেছে

    ২) দুর্দ্দান্ত খেলেছে

    ৩) দুর্দ্ধর্ষ খেলেছে

    ইস্টবেঙ্গল কখনো খারাপ খেলেছে, এ কথা সে ভাবতেই পারতোনা।

    তো একবার কলকাতা লীগের খেলায় (বোধ হয় ১৯৫৭ কি ১৯৫৮ সালে) এরিয়ান ক্লাবের কাছে ইস্টবেঙ্গল ০-৪ হেরে যায়। পরের দিন স্কুলে আমি পৃথ্বীশ কে বললাম “কী রে, কাল তোদের কী হল?”

    পৃথ্বীশ গোমড়া মুখ করে বললো, “অস্বীকার করছি, কাল ইস্টবেঙ্গল ভালো খেলেছে!”

    ঢাকুরিয়া লেক

  • ইন্দোর  হইতে বিদায়, ২০১৭

    সুচরিতা উদয় আর সুভদ্রার সাথে মাসীমণি

    সেপ্টেম্বর, ২০১৪

    কিছুদিন আগে ইন্দোর গিয়েছিলাম, মাসীমণির সাথে দেখা করতে। মাসীমণি আমার ছোটমাসী, মা’দের  পাঁচ বোনের মধ্যে সব চেয়ে ছোট বোন, মেসোমশায় চলে যাবার পরে উনি একাই ইন্দোরে থাকতেন, ওঁদের একমাত্র ছেলে উদয় থাকে কানাডায়।

    ইন্দোরে একটা নামকরা মেয়েদের স্কুলে ডাকসাইটে  প্রিন্সিপাল হিসেবে মাসীমণির খুব নামডাক ছিল, রিপাবলিক ডে তে রাষ্ট্রপতি শংকরদয়াল শর্মার হাত থেকে  তিনি পুরস্কার নিচ্ছেন সেই ছবি এখনো তাঁদের বাইরের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে।

    মাসীমণি বরাবরই   ইংরেজী তে যাকে বলে fiercely independent, কিন্তু ইদানীং তাঁর শরীর আর মন ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে, একা একা থাকা আর সম্ভব হচ্ছেনা। তাই উদয় মা’কে নিজের কাছে কানাডায় নিয়ে যেতে এসেছে। 

    মাসীমণি র সাথে আবার কবে দেখা হবে কে জানে, এই ভেবে সুভদ্রা আর আমি ইন্দোরে গেলাম কয়েকদিনের জন্যে।

    পাকাপাকি কানাডা যাবার আগে  উদয়ের অনেক কাজ। আমি যত টা পারি ওর সাথে সাথে থাকছি।  একদিন দু’জনে মিলে গেলাম ওদের বাড়ির কাছে স্টেট ব্যাঙ্কের একটা ব্রাঞ্চে।   

    ইন্দোর শহরে স্টেট ব্যাঙ্কের এই ব্রাঞ্চ টা খুব একটা ছোট নয়, অনেক লোকজন কাজ করছে, ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমাদের অনেকটা সময় দিলেন, তারপরে সব শুনে আমাদের পাঠালেন Assistant  ম্যানেজারের কাছে। সেই ভদ্রলোকের বৌ আবার মাসীমণির ছাত্রী ছিলেন, তাই তিনি তো উদয়কে দেখে একেবারে বিগলিত, কি করে উদয়কে খাতির করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কেমন আছেন স্যার, ম্যাডাম কেমন আছেন স্যার, ওনাকে নিয়ে কানাডা নিয়ে যাচ্ছেন শুনলাম স্যার, উনি কবে ফিরবেন স্যার, আমি আর আমার বৌ যাবার আগে একবার দেখা করতে আসবো স্যার,  ইত্যাদি তিনি বলেই চললেন, তাঁর কথা আর ফুরোয় না।  তার ওপর কি খাবেন স্যার, বলে  চায়ের বন্দোবস্তও করে ফেললেন চট করে। চা খাওয়ার পর অনেকক্ষন খেজুরে গল্প হলো আমাদের, তার পরে তিনি আমাদের পাঠালেন এক মহিলার কাছে, আর যতক্ষণ না সেখানে আমাদের কাজ শেষ হয়, বেশ কয়েকবার এসে খোঁজ করে গেলেন, কি সব ঠিক আছে তো স্যার! সেই মহিলারও দেখলাম মাসীমণির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, বার বার বলছিলেন ম্যাডাম কানাডা চলে যাবেন জেনে কি খারাপ যে লাগছে।

    আমি তো এই সব দেখে যাকে বলে থ~

    আমি তো কলকাতার স্টেট ব্যাঙ্ক দেখে অভ্যস্ত। সেখানে এই আন্তরিকতা কোথায়?  চেক বই ফুরিয়ে গেলে সেখানে কাউন্টারে গিয়ে নতুন চেক বই চাইতেও ভয় করে। এমন ভাবে তাকাবে যেন ভীষন অপরাধ করে ফেলেছি। “এত তাড়াতাড়ি চেক বই কেন ফুরিয়ে যায় মশাই? কাল আসুন, আজ আমার সময় নেই। ” কিংবা “যিনি নতুন চেক বই ইস্যু করেন তিনি এক সপ্তাহ ছুটিতে আছেন। দশ দিন পরে আসুন।”

    উদয়ের  পাশে বসে এই সব দেখে আমার মনে হচ্ছিল, এ কি রে, আমি কি ব্যাঙ্কে কোন কাজ নিয়ে এসেছি না কোন আত্মীয় কিংবা বন্ধুর বাড়ীতে দেখা করতে এসেছি?

    কাজ হয়ে গেলে সবাই কে হাত নেড়ে  বিদায় জানিয়ে দরজার বাইরে গিয়ে দেখি ইউনিফর্ম পরা একজন সিপাই একটা বিশাল ভারী গাদা বন্দুক নিয়ে ব্যাজার মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

    আমি  উদয় কে বললাম দ্যাখ্‌ এই লোকটার বন্দুকটা, মনে হচ্ছে এটা শেষ বার সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। এটা দিয়ে আজ কি আর গুলি চলে?

    আমার কথা শুনে  উদয়  সেই দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করে বসলো, “আচ্ছা ভাই তোমার এই বন্দুকটা  কি কোন কাজে লাগে, না স্রেফ লোক কে ভয় দেখাবার জন্যে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো?”

    উদয়ের এই প্রশ্ন শুনে লোকটি খুব hurt হয়েছিল মনে আছে।

    “কেয়া বাত করতেঁ হ্যায় সাহাব?”, খুবই ক্ষুণ্ণ হয়ে সে বলেছিল মনে আছে।   

    তার কাছ থেকে জানা গেল যে অল্প কিছুদিন আগে এই বন্দুক দিয়ে গুলি ছুঁড়ে সে এক ব্যাঙ্ক ডাকাতি থামিয়ে সরকারের কাছ থেকে ইনাম পেয়েছে। তাছাড়া self-defence এর অজুহাতে তার নাকি মানুষ মারার লাইসেন্স ও আছে, কোন ব্যাঙ্ক ডাকাত কে মেরে ফেললেও তার কোন শাস্তি হবেনা।

  • আমের বদলে স্ট্যাম্প

    মামা বাড়ীর বাগানে রঞ্জু ভাস্বর আর চার বোন

    আমার চার মামাতো ভাই বোন, ঝুমুদি, রুমি, ভাস্বর আর মিনি। এছাড়া ছিলাম আমি আর আমার মেজমাসীর ছেলে রঞ্জু। আমরা সবাই পিঠোপিঠি ভাই বোন বলে একসাথে হলে খুব হৈ হৈ করতাম। আর হৈ হৈ করার জন্যে আসানসোলে মামার কোর্ট রোডের  বিশাল বাগানবাড়ীটা ছিল যাকে ইংরেজীতে বলে আইডিয়াল। স্কুলে পড়ার সময় মাস দুয়েক গরমের ছুটির  সময় মা আর মাসীর সাথে আমি আর রঞ্জু আসানসোলে মামা বাড়ীতে কিছুদিন কাটিয়ে আসতাম।  

    ভাস্বরের সাথে এখন দেখা হলে ছোটবেলার এই সব ছুটির দিনগুলোর গল্প হয়। সেই সব দিনের নানা ছোটখাটো মজার ঘটনার কথা ভাস্বরের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল। আর ভাস্বরের গল্প বলার একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। প্রথমতঃ সেই সব ছোটবেলার গল্প সবই হাসি আর মজার। আর দ্বিতীয়তঃ গল্প বলার সময় কোন সেই সব মজার জায়গায় এলে ভাস্বর প্রাণ খুলে গলা কাঁপিয়ে হা হা হো হো করে হাসে, সেই হাসি দেখে তখন যে গল্প শুনছে তার ও হাসি পেয়ে যাবেই। তৃতীয়তঃ ভাস্বরের গলা কাঁপানো হাসিটা আবার ললিত বা বেহাগ রাগের খেয়ালের মত, যা কিনা আলাপ থেকে ঝালার মত ধীরে ধীরে ক্রমশঃ নীচু থেকে উঁচুতে স্পীড বাড়িয়ে উঠতে থাকে এবং গলার সাথে সাথে ভাস্বরের সারা শরীর ও কেঁপে কেঁপে ওঠে।  আর চতুর্থতঃ ভাস্বর এই সব গল্প বলার মধ্যে মাঝে মাঝেই সে “মান্টু দা’, একবার চিন্তা করে দেখো অবস্থাটা”, কিংবা “মান্টুদা’ দৃশ্যটা একবার কল্পনা করো” বলে  শ্রোতাকে (এ ক্ষেত্রে আমাকে) একেবারে গল্পের পরিবেশে নিয়ে যায়, যেন আমি পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ছবির মত দেখতে পাই।

    সব মিলিয়ে ভাস্বরের মুখে কোন গল্প শোনা একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা।      

    এই গল্পটা ভাস্বরের মুখে সম্প্রতি শুনলাম। এই গল্পে মূল চরিত্র হলো ভাস্বর আর রঞ্জু। আর পার্শ্বচরিত্রে মামা আর মামীমা।

    গরমের ছুটিতে রঞ্জুকে মাসী আসানসোলে মামার বাড়ীতে রেখে এসেছেন। ভাস্বর আর রঞ্জু ছুটির দিনগুলো কোর্ট রোডের বাড়ীর বিশাল বাগানে হুটোপাটি ছুটোছুটি আর দৌরাত্ম্য করে বেড়াচ্ছে।

    ওদের দু’জনের আবার দেশ বিদেশের স্ট্যাম্প জমানোর অভ্যেস, সেই সব স্ট্যাম্প আদান প্রদান হয় দু’জনের মধ্যে।  রঞ্জুর কাছে একটা ইউরোপের কোন এক দেশের রং বেরং এর সুন্দর ছবি আঁকা একটা বড় স্ট্যাম্প আছে। ভাস্বরের ওই স্ট্যাম্পের ওপর খুব লোভ। কিন্তু রঞ্জু কিছুতেই সেই স্ট্যাম্প তাকে দিতে রাজী হচ্ছেনা।

    একদিন সকালে দুই ভাই বাড়ীর বাগানে একটা বিশাল ডালপালাওয়ালা আমগাছে চড়ে গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করছে, এমন সময় রঞ্জু হঠাৎ দ্যাখে টুকটুকে লাল একটা পাকা আম সরু একটা ডালের ওপর ঝুলছে। সেই সরু ডালে গিয়ে রঞ্জুর পক্ষে ওই আম পাড়া সম্ভব নয়, কিন্তু ভাস্বরের শরীর হাল্কা আর নমনীয়, সে অনায়াসে ওই আমটা পেড়ে আনতে পারে।

    রঞ্জু ভাস্বর কে বললো, “তুই যদি আমায় ওই আমটা পেড়ে এনে দিস, তাহলে ওই স্ট্যাম্পটা আমি তোকে দেবো।”

    আমি ভাস্বর কে বললাম, “এতো সেই নাকের বদলে নরুণ পাবার গল্প হয়ে গেল!”

    ভাস্বর তার শরীর আর গলা কাঁপানো হাসিটা হেসে বললো, “ঠিক বলেছো মান্টুদা’, আমের বদলে স্ট্যাম্প পেলাম, টাক ডুমা ডুম ডুম!”

    ছোটবেলায় এই ধরণের barter বা দেয়া নেয়া বেশ স্বাভাবিক ছিল।

    তো ভাস্বর সেই সরু ডাল বেয়ে প্রায় আমের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, হাত বাড়িয়ে আমটা পাড়তে যাবে, এমন সময় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে ডালটা আচমকা দুলে উঠলো, আর ভাস্বর টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে যেতে কোনমতে দুই হাতে ডালটা ধরে ঝুলে রইলো।

    এদিকে তাই দেখে রঞ্জু তো প্রাণপনে চ্যাঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। বাড়ীতে অনেক কাজের লোক, কিন্তু কেউ রঞ্জুর চ্যাঁচানী শুনতে পাচ্ছেনা, তাই বেশ কিছুক্ষন ভাস্বর ডাল ধরে ঝুলে আছে, এদিকে হাওয়া দিচ্ছে বেশ জোরে, ডালটাও দুলছে, আর কতক্ষন ভাস্বর ঝুলে থাকতে পারবে বলা কঠিন।

    গাছের তলায় কিছু লোহার রড আর ইঁটের টুকরো জড়ো করা ছিল, সেই জন্যে ভাস্বর মাটিতে পড়লে বেশ চোট পাবে, হাত পা ভেঙেও যেতে পারে।

    এই রকম সময় রঞ্জুর আর্ত্তনাদ কানে আসায় কিছু একটা হয়েছে ভেবে মামা আর মামীমা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো দু’জনে কেমন যেন চিত্রার্পিত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, কাজের লোকদের ডাকছেন না, গাছের তলায় গিয়ে ভাস্বর কে উদ্ধার করার ও কোন চেষ্টা করার লক্ষণ দেখাচ্ছেন না।

    ভাস্বর তার ললিত রাগে গলা কাঁপানো হাসি হেসে বললো “মান্টুদা’ দৃশ্যটা একবার কল্পনা করো…”

    আমি দৃশ্যটা কল্পনায় পরিস্কার দেখলাম। একেবারে ছবির মতো। অল্প হাওয়ায় গাছের ডাল দুলছে,  এবং সেই ডাল ধরে ভাস্বর ঝুলছে। আর ওদিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মামা আর মামীমা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের মুখে কোন কথা নেই।

    হঠাৎ মামীমা মামাকে বলে উঠলেন, “গাড়ীটা গ্যারেজ থেকে বের করো~”

    মামীমার এই কথা শুনে মামা বেশ অবাক হয়ে গেছেন, তিনি বললেন, “গাড়ী? গাড়ী বের করবো কেন?”

    মামীমা বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, “কি আশ্চর্য্য, তোমার ছেলে তো এখুনি গাছ থেকে পড়ে হাত পা কিছু একটা ভাঙবে, তখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবেনা?”

    খুব উচ্চস্বরে বেহাগ রাগে তার শরীর কাঁপানো হাসি হেসে ভাস্বর বললো, “চিন্তা করে দ্যাখো মান্টুদা, কিরকম মা বাবা, ছেলে গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে, কোথায় এসে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, তা না…”  

    গল্পের শেষে অবশ্য কিছু কাজের লোক এসে ভাস্বরকে ডাল থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। তার হাত পা কিছুই ভাঙ্গেনি, গাড়ীও বের করতে হয়নি। হাসপাতালেও যেতে হয়নি।

    সব ভাল যার শেষ ভালো। তবে ওই স্ট্যাম্পটা ভাস্বরের কপালে ছিলোনা। 

    ভাস্বরের বৌ মালা একদিন কথায় কথায় আমায় বলেছিল, “জানেন মান্টুদা’, ও না মাঝে মাঝে একা ঘরে বসে এই সব পুরনো দিনের কথা ভেবে নিজের মনেই হাসে। আমার বেশ ভয় করে। আমি ওকে বলি “ওগো, তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছো”, কিন্তু ও আমার কোন কথা কানেই নেয়না, বলে “এসব তুমি বুঝবেনা…”

  • চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা

    মন্দারমণি সমুদ্র সৈকতে সুর্য্যাস্ত

    এপ্রিল, ২০১৭

    ১ মন্দারমণি

    কিছুদিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সাথে মন্দারমণি গিয়েছিলাম। 

    একটা সময় ছিল যখন কলকাতার কাছে সমুদ্র সৈকত হিসেবে সবচেয়ে বেশী নামডাক ছিল দীঘার। কিন্তু আজ দীঘা আর আগের মত নেই, এখন সেখানে বড্ড ভীড় আর নোংরা ঘিঞ্জি পরিবেশ। সেই তুলনায়  মন্দারমণি বেশ নিরিবিলি, pristine, চমৎকার চওড়া বীচ্‌, বেশী ভীড় নেই।

    আমরা উঠেছিলাম সমুদ্রের ধারে Sun City Hotel এ। 

    মন্দারমণি যাবার আগে শুনেছিলাম যে ওখানে High tide এর জন্যে যথেষ্ট জায়গা না রেখে হোটেল গুলো তৈরী হওয়ায় জোয়ারের সময়ে সমুদ্রের জল প্রায় হোটেলের মধ্যে ঢুকে আসে। 

    তো আমরা প্রথম দিন পৌঁছে যখন বিকেলে বীচে গিয়ে পোঁছলাম, তখন ভাঁটা। সমুদ্র অনেকটাই দূরে। বিশাল বীচ, শক্ত বালি, সেই বালির ওপরে অনায়াসে গাড়ী চালানো যায়। দেখলাম হোটেলের গা ঘেঁসে পাথরের বাঁধ, বুঝলাম জল যাতে হোটেলের ভিতরে না ঢোকে তাই ওই ব্যবস্থা। 


    আমরা হোটেলের বাইরে একটা দোকানে ডাব অর্ডার করতে তারা খাতির করে আমাদের প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসতে দিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, সমুদ্রের তীরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আড্ডা মারার মজাই আলাদা। নানা রকম মজা হাসি আর পি এন পি সি হচ্ছে। এদিকে আড্ডা মারতে মারতে কখন যে নিঃশব্দে সমুদ্রের ঢেউ আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। দোকানের বাচ্চা ছেলেটা হঠাৎ বলে উঠলো উঠুন উঠুন… 


    চেয়ারগুলো সব সরাবার আগেই ঢেউ এসে আমাদের প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়ে গেল।

    ২ ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রজিৎ!! চটি চটি!!

    দ্বিতীয় দিন বিকেলে আবার সমুদ্রের তীরে গেছি। একটু পরে সূর্য্যাস্ত হবে, সময়টা বড় মায়াবী। আমরা আমাদের চটি গুলো জল থেকে বেশ কিছুটা দূরে যাকে বলে নিরাপদ দূরত্বে রেখে খালি পায়ে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে হাঁটছি। আর জলের মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবে যাওয়া সূর্য্য কে ধরবার জন্যে ক্যামেরা তাক করে আছি।

    সামনে পূর্ণিমা, জোয়ারের জল যে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে তা খেয়াল নেই। ক্যামেরার aperture, light metering আর shutter speed এই সব নিয়ে আমি মগ্ন। 


    হঠাৎ ধ্রুবর গলায় আর্ত চিৎকার কানে এলো। 


    ইন্দ্রজিৎ, ইন্দ্রজিৎ!! চটি চটি!!


    তাকিয়ে দেখি আমাদের চটি জলে ভেসে যাচ্ছে। 


    সব্বোনাশ! 


    সূর্য্যাস্তের ছবি তোলা চুলোয় গেল, চটি বাঁচাতে পাঁই পাঁই করে ছুটলাম।

    ৩ চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। 

    আমাদের হোটেলের বাইরে বীচের ওপরে বেশ কিছু makeshift ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট, বাঁশের খুঁটির  ওপরে তেরপল দিয়ে ঢাকা ছাউনী। তলায় বেশ কিছু টেবিল চেয়ার পাতা, সেখানে লোকেরা বসে খাচ্ছে। বাঁশের খুঁটিতে A4 সাইজের মেনুকার্ড ঝুলছে, তাতে নানা ধরণের খাবার এর লিস্ট। ইলিশ মাছ আর চিংড়ীমাছ ভাজা, কাঁকড়া, চিকেন। তাছাড়া তড়কা ডাল, রুটি, ভাত, তরকারী, যা চাই। হোটেলের তুলনায় বেশ সস্তাও।

    আমরা ঠিক করলাম সন্ধ্যায় এখানে এসে খাবো।

    কিন্তু বিকেল থেকে জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করলো। সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে আমাদের চক্ষুস্থির। কোথায় দোকান?

    চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। 

    ৪ দীঘা

    মন্দারমণি তে সারাদিন তেমন কিছু করার নেই, একদিন আমরা দীঘা আর শঙ্করপুর ঘুরে এলাম।

    ১৯৬৩-৬৮ খড়্গপুরে থাকার সময় অনেকবার দীঘা গেছি বন্ধুদের সাথে। ষোলো সতেরো বছর বয়েস তখন, বাড়ীর গন্ডী থেকে বের হয়ে হোস্টেলে স্বাধীন জীবন, নতুন পাওয়া বন্ধুরা, আর ক্লাসে যাওয়া আর ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে প্রত্যেকের একটা করে সাইকেল।

    জীবনে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?

    বাঙালীর প্রিয় পুরী কে ছাড়িয়ে সমুদ্র সৈকত হিসেবে দীঘা তখন ক্রমশঃ তার জনপ্রিয়তা  অর্জ্জন করতে শুরু করেছে। বাংলা ছোটগল্পে উপন্যাসে আধুনিক গানে দীঘা তার জায়গা করে নিয়েছে। পিন্টূ ভটাচার্য্যের “চলোনা দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়া ছায়ায়” গান তখন সুপারহিট। 

    আমাদের ফার্স্ট আর সেকেন্ড ইয়ারে বছরে অন্ততঃ দুই তিন বার লং উইকেন্ড পেলেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে দীঘা তে গিয়ে দুই দিন কাটিয়ে আসতাম। খড়্গপুর থেকে দীঘা বেশ দূর (আশি মাইল), তখন সেই লাইনে সোজা বাস বা ট্রেণ রুট ছিলনা। আমরা খড়্গপুর স্টেশন থেকে বাসের মাথায় সাইকেল চাপিয়ে কাঁথি চলে যেতাম। কাঁথি থেকে দীঘা ত্রিশ মাইল মত। সাইকেলে চার ঘন্টা মত লাগতো।

    রাত দুটো নাগাদ কাঁথি পৌঁছে আমরা দশ বারোজন বন্ধু পাশাপাশি অন্ধকার রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলা দীঘা পৌঁছতাম। মাথার ওপর রাতের তারাভরা আকাশ, দুইপাশে অন্ধকার চরাচর, মাঝে মাঝে দুই একটি ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ গ্রাম চলে যায়, এসবের মধ্যে গল্প করতে করতে গান গাইতে গাইতে সাইকেলে চেপে আমরা চলেছি। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে, একটু পরেই সূর্য্যোদয় হবে। তার আগেই আমরা সোজা সমুদ্রের তীরে পৌঁছে যেতাম।

    প্রথম যৌবনের অনন্য অপূর্ব্ব অভিজ্ঞতার সাথে দীঘার স্মৃতি আমার মনে অবধারিত জড়িয়ে আছে।

    তখন কি নির্জ্জন আর পরিস্কার ছিল দীঘা! সমুদ্রের ধারে বে কাফে নামে একটা রেস্তোরাঁ ছিল, তার দোতলার বারান্দায় চা খেতে খেতে সামনে অকূল সমুদ্রে সূর্য্যাস্ত দেখে মোহিত হবার স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনি। ঝাউবনের ছায়ায়  চাদর পেতে বন্ধুদের সাথে হাসি গান আর আড্ডাও ভোলার নয়। সৈকতাবাস নামে একটা সস্তা কিন্তু পরিস্কার সরকারী হোটেল ছিল  সেখানে এক বা দুই রাত কাটিয়ে আবার সাইকেলে চেপে খড়্গপুরে হোস্টেলে ফিরে যেতাম।

    সেই দীঘা আর নেই। ষাট বছরে অনেক পরিবর্ত্তন হয়েছে। এখন রাস্তাঘাট দোকান পাট অনেক বাড়ী চারিদিকে। অনেক পর্য্যটকের ভীড়। সমুদ্র সৈকতে থিকথিক করছে ভীড়, গাড়ী পার্ক করার জায়গা পেতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ফেরার পথে শঙ্করপুর সমুদ্রসৈকত অবশ্য জনবহুল নয়।  

    পথে অনেক চিংড়ী মাছ আর কাঁকড়ার আড়ত চোখে পড়লো। কলকাতা ফেরার পথে একটা এইরকম একটা আড়তে নেমে সবাই বাড়ীর জন্যে কেজি দুই মাছ কিনে নিলাম।      

  • পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ ও বশংবদ কর্ম্মচারী

    আমরা তিন বন্ধু – দীপঙ্কর, অমিতাভ আর আমি – আমাদের বৌদের নিয়ে সম্প্রতি উড়িষ্যায় গোপালপুরে সমুদ্রের ধারে তিন দিন ছুটি কাটিয়ে এলাম। আমরা তিনজন হলাম বাল্যবন্ধু, বালীগঞ্জের সেন্ট লরেন্স হাইস্কুলে সেই পঞ্চাশের দশকে নীচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকে আমাদের বন্ধুত্ব।

    তিনদিন সমুদ্রের তীরে জলে ভেজা বালিতে পা ডুবিয়ে হেঁটে, ফেনা মাখা ঢেউএর সাথে catch me if you can খেলে, আর জমিয়ে কাঁকড়া আর চিংড়ী মাছ খেয়ে দিনগুলো বেশ হৈ হৈ করে কেটে গেল। এক দিন চিল্কা হ্রদে গিয়ে বোটিং ও হলো।

    এবার ফেরার পালা। হোটেল থেকে গাড়ী নিয়ে ভুবনেশ্বর যাচ্ছি। সেখান থেকে আমাদের প্লেন ছাড়ছে বেলা দুটো। দমদম পৌঁছবো বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। আমি ফোনে আমাদের ড্রাইভার কে বাড়ী থেকে গাড়ীটা নিয়ে দমদমে আসতে বলছি।

    “একটু আগে এসে গাড়ীতে তেল আছে কিনা দেখে নিও, টায়ার গুলোতে হাওয়া ভরতে হতে পারে, তিনটের একটু আগে দমদম পৌঁছে যেও”, ইত্যাদি বলে যাচ্ছি আর ভাবছি মোবাইল ফোন যখন ছিলনা, তখন আমরা কি করে বেঁচে ছিলাম!

    দীপঙ্কর বসে ছিল পিছনে, সে বললো ইন্দ্রজিৎ এর ড্রাইভার কে এই পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।

    কি গল্প?

    এক কোম্পানীর মালিক তাঁর এক কর্ম্মচারীকে পাঠাবেন আসানসোলে তাঁর এক খদ্দেরের কাছ থেকে একটা চেক নিয়ে আসতে। ইয়ার এন্ড এসে যাচ্ছে, তাই চেক টা পাওয়া খুব দরকারী।

    কর্ম্মচারী ছেলেটি খুব বিশ্বাসী আর বশংবদ।

    মালিক তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিচ্ছেন এই ভাবে।

    শোনো তুমি সামনের সোমবার ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবে, বুঝেছো?

    হ্যাঁ, স্যার!

    ব্ল্যাক ডায়মন্ড প্ল্যাটফর্ম আট থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় ছাড়বে, তার মানে তোমায় হাওড়া স্টেশনে পৌনে ছটার আগে পৌঁছে যেতে হবে, বুঝতে পেরেছো?

    হ্যাঁ, স্যার!

    তুমি সেদিন ভোর চারটে তে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠবে, উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়বে। তুমি তো ফার্ণ রোডে আলেয়া সিনেমার কাছে থাকো, ওখান থেকে গড়িয়াহাটে হেঁটে যেতে তোমার দুই তিন মিনিট লাগবে, সেখানে গিয়ে তুমি পাঁচ নম্বর বাস ধরবে, ফার্স্ট বাস আসে ভোর পাঁচটায় তাই তার আগেই তোমায় বাস স্টপে পৌঁছে যেতে হবে, দেরী করবেনা, বুঝেছো?

    হ্যাঁ, স্যার!

    আচ্ছা ওই সকালে বাসে তুমি হাওড়া স্টেশনে ছ’টার আগেই পৌঁছে যাবে, সেখানে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে টিকিট রিসার্ভেশন কাউন্টারে লাইন দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড চেয়ার কারে তোমার সীট রিসার্ভ করে টিকিট কিনবে। ঠিক আছে?

    হ্যাঁ, স্যার!

    এবার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে ট্রেণে উঠে নিজের সীটে গিয়ে বসবে। আসানসোল স্টেশনে ট্রেণ পৌছবে সকাল ন’টায়। কিন্তু তুমি যে অফিসে যাবে তারা খোলে বেলা দশটায়। তাই তুমি ট্রেণ থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে মিনিট পনেরো চা খেয়ে নিয়ে নিও। ক্লীয়ার?

    হ্যাঁ, স্যার!

    তারপরে বাইরে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ওদের অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটা ওদের দেখিও। ওরা তোমায় একটা চেক দেবে, সেটা নিয়ে তুমি আবার স্টেশনে ফিরে বিকেল চারটে তে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে এসো।

    সোমবার ন’টা নাগাদ মালিকের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। সেই বশংবদ কর্ম্মচারীর ফোন।

    এবার তাদের দু’জনের কথাবার্ত্তা এরকম হলো।

    কি হলো? কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? ভোরবেলা গড়িয়াহাট থেকে ফার্স্ট বাস পাঁচ নম্বর ধরেছিলে?

    হ্যাঁ, স্যার!

    বেশ! তারপর? ট্রেণের টিকিট কাটলে? সীট রিসার্ভ করতে পারলে?

    হ্যাঁ স্যার!

    বেশ বেশ! আসানসোল পৌছে গেছো?

    হ্যাঁ স্যার!

    তাহলে তো সবই ঠিকঠাকই করেছো। ফোন করছো কেন? কোন প্রবলেম?

    হ্যাঁ স্যার একটা প্রবলেম হয়েছে।

    মালিক একটু অবাক। কি আবার প্রবলেম হলো।

    স্যার এই দোকানে চা পাওয়া যায়না, কেবল কফি। আমি কি কফি খেতে পারি, স্যার?

  • মামাবাড়ী ভারী মজা

    আমার মামা (ধ্রুবনারায়ণ বাগচী) ছিলেন একজন বর্ণময় চরিত্র।

    দীর্ঘদেহী, ছয় ফিটের ওপর লম্বা, ঘষা কাঁচের হাই পাওয়ারের চশমার ভিতরে চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, উঁচু গলায় কথা বলেন, নানা বিষয়ে বিশেষ করে ইঞ্জিনীয়ারিং সংক্রান্ত যে কোন ব্যাপারে প্রগাঢ় জ্ঞান, অঙ্কে দুর্দ্দান্ত মাথা, আমাদের ভাই বোনদের প্রতি স্নেহপরায়ণ, মামা ছিলেন আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় একজন কাছের মানুষ।

    মা’রা পাঁচ বোন, এক ভাই। ফলে আমাদের মাসতুতো ভাইবোনদের একমাত্র একজনই মামা। কৃতী ছাত্র ছিলেন, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে শেষ জীবনে Directorate General of Mines Safety (DGMS) তে Joint Director হয়েছিলেন, যেমন উঁচু পদ সেরকম কঠিন দায়িত্ব। কয়লা খনির মালিক রা তাদের শ্রমিক দের কাজের পরিবেশে, বিশেষ করে Underground mine গুলোতে, সব রকম সাবধানতা অবলম্বন করছে কিনা তা দেখার জন্যে প্রায় প্রতিদিন সকালে মামা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তাঁর কাজের পরিধি ছিল রাণীগঞ্জ, আসানসোল, সীতারামপুর আর ধানবাদের কয়লাখনি অঞ্চলে।

    আমি মামার সাথে বেশ কয়েকবার খনি পরিদর্শনে গিয়েছি।

    আমাদের ছোটবেলায় মামা থাকতেন আসানসোলে কোর্ট রোডে পাঁচিল ঘেরা এক বিশাল বাংলোতে। জি টি রোডের ওপরে বি এন আর ব্রীজের পাশে যে রাস্তাটা  ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট হয়ে বার্ণপুর রোডে গিয়ে পড়েছে, সেই রাস্তায় একটু এগিয়ে গেলে ডান দিকে হলুদ রং এর করবী ফুলের ঝাড় দিয়ে ঘেরা একটা কাঠের গেট। সেই গেট দিয়ে একটা লাল কাঁকরের রাস্তা এঁকেবেঁকে বাড়ীর সামনে চলে এসেছে। সাহেবী আমলের বাংলো, ঘাসের জমি থেকে তিন চার step সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসতে হয়। বাড়ীর সামনে sloping টালির ছাদ দিয়ে ঢাকা লম্বা টানা বারান্দা। বাংলোতে অনেকগুলো ঘর, বড় বড় সেগুন কাঠের জানলা দরজা, সব ঘরে উঁচু সীলিং,  সেখান থেকে লম্বা রড দিয়ে ঝোলানো সিলিং ফ্যান, গরমকালে সেগুলো চালালে ঘটাং ঘটাং আওয়াজ হয়।

    বাড়ীর চারিদিকে অন্ততঃ বিঘা দুয়েক জমি, সেই জমিতে মালীদের কেয়ারী করা ফুলের বাগান, আর প্রচুর গাছপালা। ওই বাড়ী ঘিরে আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি।    

    নরাণাং মাতুলং ক্রমঃ বলে একটা কথা আছে, মানে ছেলেরা সাধারণতঃ তাদের মামাদের মত হয়, আমি অনেকদিন ভেবেছি বড় হলে মামার মত এরকম একটা বিশাল বাড়ী আমারও হবে নিশ্চয়। কিন্তু ওই কথাটা আমার ওপরে খাটেনি, দুঃখের বিষয়।    

    আমার চার মামাতো ভাই বোন, ঝুমুদি, রুমি, ভাস্বর আর মিনি। এছাড়া ছিলাম আমি আর আমার মেজমসাসীর ছেলে রঞ্জু। রঞ্জু আমার থেকে বয়সে অল্প ছোট, ভাস্বর আবার রঞ্জুর থেকেও সামান্য ছোট, কিন্তু আমরা সবাই পিঠোপিঠি ভাই বোন বলে একসাথে হলে খুব হৈ হৈ করতাম। আর হৈ হৈ করার জন্যে কোর্ট রোডের ওই বাড়ীটা ছিল যাকে ইংরেজীতে বলে আইডিয়াল।

    আসানসোল কলকাতা থেকে বেশী দূরে নয় তাই ছুটিছাটাতে প্রায়ই আসানসোলে মামার বাড়ী যাওয়া হতো। আরও অনেক আত্মীয় স্বজন আসতেন, বিশেষ করে গরমের ছুটিতে ওই বাড়ীটা আড্ডা, হাসি, ঠাট্টা, আর গল্পতে সরগরম হয়ে থাকতো সব সময়। মামার একটা চমৎকার আকর্ষনীয় (হাসিখুসী, মজলিসী আড্ডাবাজ আর হুল্লোড়ে) ব্যক্তিত্ব ছিল, তাই হয়তো ছুটিছাটায়  তাঁর বাড়ীতে নানা আত্মীয়স্বজনের ভীড় লেগেই থাকতো।  তাছাড়া মামা আর মামীমা খুব অতিথিবৎসল ছিলেন, বাড়ীতে অনেক লোক থাকলেও তাঁদের আতিথ্যে কোন ত্রুটি থাকতোনা।  

    গরমের ছুটিতে রোজ সকালে আমরা ছোটরা বাড়ীর বাগানে রাবারের কিংবা ক্যাম্বিসের বল দিয়ে পিট্টু আর কিং কিং খেলতাম, আর আম গাছে চড়ে কাঁচা আম পেড়ে খেতাম। বিকেলে ঘাসের জমিতে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হত।

    আর ওই টালির ছাদ দিয়ে ঢাকা টানা বারান্দা ছিল আমাদের ক্যারম খেলার জায়গা। 

    ছুটির দিন গুলো ওই বাংলো তে কি করে যে কেটে যেত বোঝাই যেতনা। 

    এমনিতে মামা খুব jovial মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর পছন্দমতো কিছু না হলে তিনি বেশ রেগে যেতেন। বেশ হাসি ঠাট্টা করছেন, হঠাৎ দুম করে রাগ হয়ে গেলে তিনি একদম অন্য মানুষ। মামা একদিকে তিনি যেমন হাসিখুসী, আড্ডাবাজ, গপ্পে ছিলেন, অন্যদিকে আমরা ছোটরা তাঁকে বেশ সমীহ আর সন্মান করতাম, ভয়ও পেতাম, কখন কিছু অপছন্দ হলেই রেগে যাবেন কে জানে?

    একবার ব্রীজ খেলার সময় তাঁর পার্টনার মনোরঞ্জন মল্লিক নামে এক ভদ্রলোক বিড করতে কিংবা লীড দিতে মারাত্মক একটা ভুল করেছিলেন, সেই ভুলের জন্যে তাঁদের গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফস্কে যায়। মল্লিকবাবু আসানসোল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের জাজ, সন্মানীয় লোক, মামার থেকে বয়সেও বড়, কিন্তু তাঁর ওই ভুল দেখে মামা দুম করে রেগে গিয়ে মল্লিক বাবুকে বলেছিলেন আপনার মত গাধার সাথে ব্রীজ খেলার কোন মানেই হয়না।

    গাধা বলেছিলেন না বোকাপাঁঠা বলেছিলেন ঠিক জানিনা, অন্য কিছুও বলে থাকতে পারেন, কিন্তু যাই বলে থাকুন মল্লিক বাবুর সেটা ভাল লাগেনি, সবার সামনে অপমানিত হয়ে তাঁর মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। তার পর থেকে তিনি আর কোন দিন মামার সাথে ব্রীজ খেলতে আসেন নি।  

    মামার রাগ আর মেজাজের এই রকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তার মধ্যে থেকে নীচের দুটি ঘটনার কথা লেখা যেতে পারে, এই দুটি ঘটনা থেকে মামাকে জানা সহজ হবে।

    আসানসোল শহরে এক রবিবার মামা সপরিবারে গাড়ী নিয়ে বাজার করতে এসেছেন, ভীড়ের মধ্যে হাঁটার সময়  তিনি খেয়াল করলেন তাঁর পকেটমার হচ্ছে, একটি যুবক তাঁর মানিব্যাগটা নিয়ে ভীড় কেটে এঁকেবেঁকে তীর বেগে পালিয়ে যাচ্ছে। মামা সব ফেলে তাকে ধাওয়া করে শেষ পর্য্যন্ত ধরে ফেলে মানিব্যাগ ফেরত নিয়ে এসেছিলেন। এর থেকে মামার উপস্থিত বুদ্ধি, সজাগ মন, সাহস, এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। আসানসোলের মত গুন্ডা অধ্যুষিত জায়গায় বাজারের ভীড়ের মধ্যে জল কাদা ঠেঙিয়ে হাই স্পীডে দৌড়িয়ে চোর ধরা সহজ কাজ  নয়। বুকের পাটা লাগে। আর মামার তখন মধ্যবয়েস, শরীর আর স্বাস্থ্য ও তেমন মজবুত নয়। পুরোটাই মনের জোর।

    আর একবার দিদা বেনারস থেকে আসছেন, মামা গেছেন আসানসোল স্টেশনে তাঁকে receive করতে। ট্রেণ লেট, কিন্তু কত লেট, কখন আসবে, তার কোন announcement হচ্ছেনা, কেবল বার বার মাইকে বলা হচ্ছে “যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে টিকিট কাটার সময় দয়া করে দরকার মতো খুচরো পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করুন!”

    বেশ কয়েকবার ওই এক announcement শোনার পরে মামার মেজাজ গেল বিগড়ে, তিনি সটান স্টেশন মাস্টারের ঘরে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে তাঁকে দিলেন এক ধমক।

    ট্রেণ এর টাইমিং  নিয়ে কোন খবর নেই, বার বার শুধু খুচরো নিয়ে আসুন, খুচরো নিয়ে আসুন, এটা কি ধরণের ইয়ার্কি হচ্ছে মশাই?

    মামার বকুনী খাবার পরে আবার ঠিক ঠাক announcement শুরু হল। অমুক নম্বর ট্রেণ তমুক নম্বর প্ল্যাটফর্মে তসুক সময়ে আসছে..

    আমার মাসতুতো ভাই রঞ্জু ছোটবেলা থেকেই বেশ দুরন্ত, ও যখন নরেন্দ্রপুরে রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের হোস্টেলে থেকে ক্লাস নাইনে পড়ে, তখন মেসোমশায় মারা যান (১৯৬০)।  স্কুলের ছুটি হলে হোস্টেল থেকে বাড়ী  ফিরলে মাসী তাঁর দুরন্ত ছেলেকে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। রঞ্জু কে শাসন করার ক্ষমতা মাসীর ছিলনা, কেননা তিনি খুব নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মামার শাসনে থাকলে ছেলে ভাল থাকবে, বখে যাবেনা বা হাতের বাইরে চলে যাবেনা।   

    রঞ্জু তাই মামার বাড়ীতে আমার থেকে অনেক বেশী থেকেছে, মামা আর মামীমাও রঞ্জু কে নিজের ছেলের মতই ভালবাসতেন, মামাতো ভাই বোনেদের সাথে রঞ্জূ পরিবারের একজনই হয়ে গিয়েছিল।

    মামাবাড়ী ভারী মজা, কিল চড় নাই বলে একটা কথা আছে, সেটা রঞ্জুর কাছে কতোটা ঠিক ছিল বলা মুস্কিল। কেননা পড়াশুনা, বিশেষ করে অঙ্ক ঠিক করতে না পারলে মামার প্রচন্ড মেজাজ গরম হয়ে যেত, বকুনী তো খেতে হতোই, কিল চড় ও যে মাঝে মাঝে খেতোনা, তাও জোর করে বলা যায়না। বিশেষ করে বুদ্ধির অঙ্ক ছিল মামার ফেভারিট, বুদ্ধির অঙ্ক আর নানা ধরণের ধাঁধা দিয়ে মামা আমাদের প্রায়ই বেশ বোকা বানাতেন। আর পড়াশোনার ব্যাপারে মামা ছিলেন firm and uncompromising, a very strict taskmaster.. 

    ফলে মামার রাগ আর মেজাজের সাথে সব চেয়ে বেশী পরিচয় ছিল ভাস্বর আর রঞ্জুর। তারা দুজন মামাকে যমের মত ভয় পেতো।

    ১৯৬৩ সালে হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার পরে লম্বা ছুটি তে মাসী  as usual রঞ্জুকে মামার কাছে আসানসোলে পাঠিয়ে দেন। সামনে রঞ্জুর বি ই কলেজের Admission test, তার জন্যে  application form fill up করা হয়েছে,  সেটা পোস্ট অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হবে।

    মামা রঞ্জু আর ভাস্বরকে টাকা দিয়ে পোস্ট অফিসে পাঠালেন।   

    সেদিন আবার দিদা বিকেলে কলকাতায় যাচ্ছেন, প্যাকিং ইত্যাদি নিয়ে মামা বেশ ব্যস্ত ছিলেন, দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে তাঁর মনে পড়ল রেজিস্ট্রি করার কথা, তিনি রঞ্জু আর ভাস্বর কে জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে তোরা application form  রেজিস্ট্রি  করে এলি?”

    দুজনেই মাথা নেড়ে বলল হ্যাঁ!

    মামা বললেন “Receipt টা দেখি”।

    Receipt? Receipt আবার কি?  Receipt তো নেই!  দুজনে তো অবাক।

    তারপরে মামার হিমশীতল চাহনি দেখে অবশ্য দু’জনেই বুঝলো কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে, তারা একটা কেলো করেছে নিশ্চয়!

    পোস্ট অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রি করতে কত টাকার স্ট্যাম্প লাগবে জেনে স্ট্যাম্প কিনে আর লাগিয়ে তারা খামটা পোস্ট বক্সে ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে এসেছে, আগে তো কোনদিন তারা রেজিস্ট্রি করেনি, জানবে কি করে যে কাউন্টারে জমা দিয়ে Receipt নিতে হয়।

    তারপরে শুরু হল মামার বকুনী। সমুদ্রের ঢেউএর মত সেই বকুনী আর ধমক তাদের ওপরে আছড়ে পড়লো বেশ কিছুক্ষণ।

    তার পরে মামা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গেলেন পোস্ট অফিসে। সেখানে তিনি শুনলেন যে সেদিনের মেল স্টেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে sorting এর জন্যে। সেখান থেকে মামা ছুটলেন স্টেশনে। সেই স্টেশন মাস্টার ভদ্রলোক যিনি কিছুদিন আগে মামার কাছে বকুনী খেয়েছেন, তিনি মামাকে দেখে অনেক খাতির করে তাঁর লোকদের পাঠিয়ে রঞ্জুর application form  টা আনাবার বন্দোবস্ত করলেন।

    সেদিন বিকেলে দিদাকে নিয়ে স্টেশন যাবার সময়ে মামা রঞ্জু আর ভাস্বর কে বললেন তোরাও আমার সাথে চল্‌। স্টেশন মাস্টার তোদের দেখতে চেয়েছেন। আজ বাদে কাল কলেজে ভর্ত্তী হবে আর এখন ও চিঠি রেজিস্ট্রি করতে জানেনা? একবার ওদের নিয়ে আসবেন তো, দেখবো।

    এই গল্পটা বলার সময় ভাস্বর বলে জানো মান্টুদা’, স্টেশন মাস্টার ভদ্রলোক কিন্তু মোটেই আমাদের দেখতে চান নি। ওটা পুরোপুরি বাবার বানানো। আমাদের যাতে আরও খারাপ লাগে তার ব্যবস্থা করা। উনি তো আমাদের দেখে খুব ভালোমানুষের মত বলেছিলেন, “না না ধ্রুব বাবু, কি যে বলেন, ছোট ছেলে, এরা কোন দিন আগে চিঠি রেজিস্ট্রি করেনি। ভুল তো হতেই পারে।”

    তার পরে ওদের দুজন কে গাড়ীতে গিয়ে বসতে বলে মামা দিদা কে প্লাটফর্মে see off করতে চলে গেলেন।

    রঞ্জু আর ভাস্বর দুই ভাই মুখ চূণ করে গাড়ীতে গিয়ে বসে আছে, এমন সময় রঞ্জু হঠাৎ দেখে গাড়ির পিছনের সীটে একটা লম্বা বাঁশের লাঠি পড়ে আছে। এই লাঠিটা কার? দিদার লাঠি নাকি? মামা ভুল করে গাড়ীতে ফেলে গেছেন নির্ঘাত।

    রঞ্জু ভাস্বর কে বললো যা, এটা মামাকে তাড়াতাড়ি গিয়ে দিয়ে আয়। ট্রেণ এখুনি ছেড়ে দেবে।

    রঞ্জু বোধহয় ভেবেছিল লাঠিটা দিয়ে এলে মামা খুসী হবেন, সারাদিন রেজিস্ট্রী চিঠি নিয়ে এই ঝামেলা হবার পর অন্ততঃ কিছুটা কৃতিত্ব তো এখন তাঁর কাছে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের দুজনেরই বকুনী খেয়ে মাথা এমন গুলিয়ে গেছে যে তারা চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে, বুদ্ধিশুদ্ধি যা ছিল, সব লোপ পেয়েছে।

    ওই লম্বা ভারী বাঁশের লাঠি যে দিদার হতেই পারেনা সেটা ওদের মাথায়ই আসেনি। আর তাছাড়া ভাস্বরের তো জানা উচিত যে ওই লাঠিটা মামার, খনি পরিদর্শনে যাবার সময় রোজ সকালে তিনি ওই লাঠিটা নিয়ে বেরোন।

    ভাস্বর উৎসাহের সাথে দৌড়তে দৌড়তে মামাকে লাঠিটা দিতে গেল। প্ল্যাটফর্মে মামার কাছাকাছি যেতেই ভাস্বর দেখলো মামা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখ দিয়ে আগুণ ঠিকরে বেরোচ্ছে। তাঁর সেই আগুণে দৃষ্টি থেকে ভাস্বর বুঝে নিল মামা বলছেন, “তবে রে, দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা, আজ তোর পিঠেই এই লাঠিটা ভাঙবো!”

    নিমেষের মধ্যে ভাস্বর বুঝে নিলো সর্ব্বনাশ, আবার একটা ভুল হয়ে গেছে। লাঠিটা দিদার নয়, তার বাবার। সঙ্গে সঙ্গে ফুল স্পীডে ব্যাক।

    গাড়ীতে ফিরে ভাস্বর রঞ্জু কে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো “লাঠিটা বাবার।”

    রঞ্জু আর নেই, সে বেশ কয়েক বছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ও যখন ছিল তখন আমরা দু’জন আর ভাস্বর একসাথে হলেই সেই কোর্ট রোডের বাড়ীতে কাটানো দিনগুলোর গল্প হত, নানা ঘটনার মধ্যে এই রেজিস্ট্রী আর লাঠির গল্পটা উঠে আসতোই।

    রঞ্জুর গল্প বলার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, আর ওর হাসিটা ছিল খুব সংক্রামক, ও যখন এই সব গল্পগুলো ওর নিজস্ব অননুকরণীয় ভঙ্গীঁতে বলত, আমরা তিনজন হো হো করে হাসতাম। এখন রঞ্জু আর নেই, ভাস্বরের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়, আমরা পুরো্নো দিনের গল্প করি, আর এই   গল্পটা বলার সময় ভাস্বরও খুব হাসে।   

    ভাস্বরের বৌ মালা একটু বিরক্ত হয়ে বলে এ আবার কি? বাবার কাছে বোকামী করে বকুনী খেয়েছো তো তাতে এত হাসার কি আছে?

    ভাস্বর একটু উদাস মুখ করে বলে সে তুমি বুঝবেনা !

    সত্যি, এই গল্প গুলো করার সময় আমাদের এত হাসি পায় কেন?  

    নিজেদের ভুল বোকামী ইত্যাদি (bloopers and blunders) – আমি কি বোকা ছিলাম হি হি হি, কিংবা আমি মামার কাছে কি solid বকুনী খেলাম হা হা হা – নিয়ে নিজেরাই মজা করা বা হাসাহাসি করা হল ইংরেজীতে যাকে বলে Self-deprecating humour, যা কিনা রসিকতার একটা উচ্চ স্তর। ভাস্বরের হাসি বোধ হয় সেভাবে ব্যাখা করা যায়।

    ওই গল্পটা বলার সময় ভাস্বরের হাসার আরও একটা কারণ হয়ত এই যে ছোটবেলায় কোর্ট রোডের বাংলো তে কাটানো সেই হাসি আর আনন্দের (carefree) দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে মনে মনে সেই দিনগুলোতে ফিরে যায়। ভাস্বর আমায় বলল জানো মান্টুদা’, ছোটবেলায় আমি বাবাকে খুব ভয় পেতাম,  কিন্তু এখন মনে হয় বাবার ওই শাসন আর বকুনীর মধ্যে একটা বিশেষ ভালবাসার আর স্নেহের স্পর্শ ছিলো।

    সেই দিনগুলোর স্মৃতির মধ্যে একদিকে যেমন মিশে আছে আমাদের ছেলেমানুষী দুষ্টুমি, দুষ্কর্ম্ম, আর বোকামী,  ঠিক তেমনই অন্যদিকে আছে গুরুজনদের শাসন, ধমক আর বকুনী। এই দুই মিলিয়েই দিন গুলো বড় সুন্দর ছিল।

    তাই এই স্মৃতিচারণ করার সময় ভাস্বর যে কেন এত প্রাণ খুলে হাসে, তা বোঝা কঠিন নয়।

    কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই।