-
তুমি, আমি ও গাঁদালপাতা
আমাদের জ্যেঠু বাবা কাকাদের সব ভাইদের নামের শেষে একটা বন্ধু জোড়া ছিল। বিশ্ববন্ধু প্রিয়বন্ধু, নিখিল বন্ধু, প্রাণবন্ধু এই রকম। এই চার ভাইয়ের স্কুলের সহপাঠী রা তাদের এই নাম নিয়ে মজা করে বলতো, “এই নিখিল বিশ্বে প্রাণটা বড়ই প্রিয়। ”
আমার বিয়ে ঠিক হবার পরে আমার শ্বশুরমশায় সুভদ্রাকে বলেছিলেন, “তোমার শ্বশুররা সবাই friends, মা!”
নামের শেষে বন্ধু জোড়া থাকলেও একমাত্র ছোটকাকা (অশোকবন্ধু ) আর সোনাকাকা (সুনীলবন্ধু) – এই দুজনই আমাদের ছোটদের সাথে বন্ধুর মত মিশতেন, সব সময়ে আমাদের সাথে হাসি খুসী মজা ঠাট্টা করতেন।
সোনাকাকা পাটনায় থাকতেন তাই তাঁকে আমরা খুব কাছে পাইনি। কিন্তু মনোহরপুকুরে ছোটকাকা ছিলেন আমাদের খুব কাছের মানুষ।
এই গল্পটা তাঁকে নিয়ে।
একদিন সন্ধ্যায় আমাদের বড় বারান্দায় খোদেচাটা পুরনো গোল টেবিলে কয়েকজন বসে চা খাচ্ছি। ছোটকাকা বললেন, “বুঝলি মান্টু, আমি এবার একটা ফিল্ম তৈরী করবো ঠিক করেছি।”
ফিল্ম? আমরা সবাই তো লাফিয়ে উঠলাম।
ছোটকাকা বললেন “ফিল্মের গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ, সঙ্গীত, পরিচালনা সবটাই আমার। কেবল অভিনয়ের জন্যে একজন নায়ক আর একজন নায়িকা আমার দরকার। বাকি সবটাই আমি দেখবো।”
কিছুদিন আগেই আমাদের সবাই কে নিয়ে ছোটকাকা সত্যজিত রায়ের “কাঞ্চনজঙ্ঘা” দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কিনা কে জানে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম “গল্পটা লিখে ফেলেছো?”
ছোটকাকা বললেন, “না শুরু করিনি এখনো, তবে ছবির নাম ঠিক করে ফেলেছি!”
আমরা সবাই তো উত্তেজিত। কি নাম হবে ছবির?
ছোটকাকা বললেন “তুমি, আমি ও গাঁদাল পাতা।”
এ আবার কি নাম?
জিজ্ঞেস করলে ছোটকাকা আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “এটা হলো আমাদের মত সাধারণ মানুষের জীবনের কথা, বুঝলিনা?”
স্বপ্নময় চক্রবর্ত্তী আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় সংখ্যায় “সাদা কাক” নামে একটি কলাম লিখতেন, তাতে নানা ধরণের চরিত্রের কথা থাকতো। তাতে একটা লেখায় দুই প্রেমিক প্রেমিকার কথা ছিল, তাদের নাম চানু আর মিনু।
স্বপ্নময় লিখছেন কমবয়েসে স্কুলে থাকতেই চানু একজন প্রেমিকা যোগাড় করার ক্যালি দেখিয়েছিল। ওরা দুজন যখন নদীর ধারে গিয়ে বসতো তখন তারা কি বলছে শোনার জন্যে বন্ধুরা পিছনে গিয়ে দাঁড়াতো। ওদের কথাবার্ত্তা শুনে তারা বুঝেছিল যে প্রেম করার জন্যে “জীবন” কথাটা খুব দরকারী।
যেমন নদীর ওপারে একটা আলো জ্বলছে আর নিবছে, চানু বললো, “আলোটা কিন্তু জ্বলেই আছে, নিবছেনা আসলে। আমাদের জীবনটাই ওরম। মনে হয় নিবে গেছে, কিন্তু আসলে নেবেনি!”
কিংবা “ওই দ্যাখো মাঝে মাঝে নদীর জল সরে গেলে কেমন কাদা ভেসে আসছে। আমাদের জীবনটাই ওরম। কখনো জল আর কখনো কাদা!”
অথবা, “ইস এই আমগুলোর মধ্যে বেশ কিছু আম পচা বেরোল, আমাদের জীবনটাই ওরম। কিছু ভালো কিছু পচা।”
চানুর এই সব কথা মিনু মুগ্ধ হয়ে শুনতো, আর এই ভাবেই ওদের মধ্যে প্রেমটা বেশ জমে ওঠে।
হাই থট কথাটাও লোককে ইম্প্রেস করতে বেশ কাজে লাগে।
চারুলতা ছবির শেষ দৃশ্যে মিনু জিজ্ঞেস করেছিল “ওরা দু’জন ফ্রিজ করে গেল কেন গো?” চানু বলেছিল “ওটা হাই থট, বোঝাতে সময় লাগবে, নিরিবিলি পেলে বুঝিয়ে দেবো!”
অশনি সংকেত ছবিতে একটা দুর্ভিক্ষের দৃশ্য ছিল। গ্রামের মানুষ খেতে পাচ্ছেনা। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রজাপতির উড়ে যাওয়া দেখানো হয়েছিল। মিনু জিজ্ঞেস করেছিল,”প্রজাপতি গুলো উড়ছে কেন গো?”
চানু বলেছিল “বুঝলেনা, হাই থট, আমাদের জীবনও ওই প্রজাপতির মতই কেবল উড়তে চায়!”
গোল টেবিলে চা খেতে খেতে ছোটকাকা বললেন, “শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে নায়ক নায়িকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, আর দূর থেকে গাঁদাল পাতার গন্ধ ভেসে আসছে!”
আমি বললাম, “ছবিতে গাঁদাল পাতার গন্ধ বোঝাবে কি করে?”
ছোটকাকা বললেন, “অসুবিধা কি আছে? একটা সংলাপ দিয়ে দেবো নায়কের মুখে। নায়ক উদাস আর করুণ মুখ করে গন্ধ শোঁকার ভান করবে আর বলবে, আঃ গাঁদাল পাতা! উঃ গাঁদাল পাতা! ব্যাস দর্শক বুঝে যাবে।”
আমি বললাম, “তা না হয় হলো, কিন্তু এত জিনিষ থাকতে গাঁদাল পাতা কেন?”
ছোটকাকা অল্প হেসে বললেন, “হাই থট, বুঝলিনা?”
-
এইচ টু ও

ইন্টারভিউ – হ্যান্ডশেক
এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকে একটা চাকরীর ইন্টারভিউ এর সীন ছিল। তাতে এক এক করে অমল বিমল কমল ইন্দ্রজিৎ রা একটা ঘরে ইন্টারভিউ দিতে ঢুকছে। কিন্তু ওদের বের করে দেওয়া হচ্ছে অন্য দরজা দিয়ে।
কেন?
লেখক এর একটা সংলাপ আছে সেখানে সে বলছে আসলে ওদের বেশী প্রশ্ন নেই তো, একই প্রশ্ন সবাইকে করছে, তাই ওরা চায়না যে বাইরে বেরিয়ে এসে কেউ তার প্রশ্নগুলো তার বন্ধুদের বলে দিক।
এই নিয়ে নীচের গল্প টা~
বেঙ্গল কেমিকাল কোম্পানী চীফ কেমিস্ট চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তার উত্তরে হাজার হাজার প্রার্থীর দরখাস্ত এসেছে। যদিও চাকরীর জন্যে কেমিস্ট্রী তে মাস্টার্স ডিগ্রী যথেষ্ট বলা হয়েছে , কিন্তু প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই ডক্টরেট আর অনেকের আবার পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রী!
ইন্টারভিউ এর দিন প্রচন্ড ভীড়, যাকে বলে লোকে লোকারণ্য, অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের “প্রতিদ্বন্দ্বী” ছবির সেই ইন্টারভিউ এর সীনটার মত।
দুই বন্ধু এসেছে ইন্টারভিউ দিতে। তাদের মধ্যে একজন খুব সাজগোজ করে এসেছে, স্যুট টাই, পায়ে চকচকে পালিশ করা জুতো। সে ভেবেছে এখানে যারা এসেছে সবারই তো দরকারী শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, সে ব্যাপারে কেউ কাউকে বেশী টেক্কা দিতে পারবেনা, যদি ভাল সেজেগুজে এলে একটু চোখে পড়া যায়!
বেঙ্গল কেমিকাল কোম্পানীর চীফ কেমিস্ট বলে কথা, সে তো কোম্পানীর একজন বড়সাহেব, তাকে স্যুট টাই না পরলে মানাবে কেন?
একটু সকাল সকালই তার ডাক পড়লো। যাঁরা ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, তাঁরা তার ফিটফাট চেহারা আর সাজগোজ দেখে বেশ চমৎকৃত, তাঁদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার জুতোটা তো খুব ভাল পালিশ করেছো, আয়নার মত চকচক করছে!”
যদিও সে একটু আগে রাস্তার মোড়ে জুতো পালিশওয়ালার কাছে জুতো পালিশ করিয়ে এসেছে, তবু তার মনে হল সে কথা বললে তার কিছু নম্বর কাটা যেতে পারে। এঁরা ভাববেন যে নিজের জুতো নিজে পালিশ করেনা সে কি করে চীফ কেমিস্টের এর দায়িত্ব সামলাবে?
সে একটু রেলা নিয়ে বললো “আমি নিজেই পালিশ করেছি স্যার~”
“কি দিয়ে পালিশ করলে?” জিজ্ঞেস করলেন আর একজন, একটু মজা করেই। এত প্রার্থী কে রুটিন একঘেয়ে প্রশ্ন করতে করতে মাঝে মাঝে একটু অন্যরকম প্রশ্ন করতে ভালই লাগে।
কি দিয়ে?
প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে পরে সামলে নিয়ে ছেলেটি বললো, “চেরী ব্লসম বুটপালিশ দিয়ে স্যার!”
“চেরী ব্লসম, হুম!” বললেন পরীক্ষক, “আচ্ছা, তুমি বুট পালিশের কেমিকাল ফর্মূলা জানো?”
সব্বোনাশ! এটা তো জানা নেই! বেচারা চুপ করে রইলো। সে যে এই ফ্যাসাদে পড়বে কে জানতো?
“বেঙ্গল কেমিকাল কোম্পানী এখন বুট পালিশ তৈরী করেনা ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে তো করতেই পারি আমরা। তাই না? তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ চীফ কেমিস্ট হিসেবে আমরা তো আশা করতে পারি যে তুমি অন্ততঃ আমাদের ভবিষ্যৎ কার্য্যকলাপ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবে। ”
ইন্টারভিউ এর শেষে সে বাইরে বেরিয়ে আসতেই তাকে ছেঁকে ধরলো সবাই। “কি জিজ্ঞেস করছে একটু বলুন না প্লীজ?”

ইন্টারভিউ
কাউকে নিজের বেইজ্জতের কথা না বললেও তার বন্ধু তার মুখ দেখেই বুঝেছে যে কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। সব শুনে বন্ধুটি বলল “আমায় তোর জুতোটা দে তো, আমি তোর জুতো পরে ইন্টারভিউ দেবো।”
“তুই আমার জুতো পরবি? তোর তো দু সাইজ ছোট হবে~”
“দে না, আমি ঠিক পরে নেবো, ভাবিস না!”
তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে, দিন প্রায় শেষ, বন্ধুটির যখন ডাক পড়ল, তখন বাইরে আর মাত্র কয়েকজন প্রার্থী বাকি। ভেতরে পরীক্ষকরাও ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।
দুই সাইজ ছোট জুতো পরে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরে ঢুকে ছেলেটি পরীক্ষক দের সামনে “গুড আফটারনুন স্যার!” বলে দাঁড়িয়ে রইলো, চেয়ারে আর বসেনা।
“কি হলো, বসুন!” পরীক্ষকরা বেশ বিরক্ত।
“আমার জুতো স্যার!”, বিগলিত হেসে নিজের পায়ের জুতোর দিকে ইঙ্গিত করে দেখালো সে।
“কি হয়েছে তোমার জুতোর?” পরীক্ষকরা কিছুটা হতভম্ব, তাঁদের সহ্যের সীমা ক্রমশঃ ছাড়াচ্ছে।
“আমি আমার জুতো নিজেই পালিশ করেছি স্যার!”
“So what?” এবার চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলেন এক পরীক্ষক।
“আমি আমার জুতো জল দিয়ে পালিশ করেছি স্যার!” বললো ছেলেটি।
তার পরে একগাল হেসে, “আর জলের কেমিকাল ফর্মূলা হলো এইচ টু ও স্যার!”
———
বন্ধুটির সেই চাকরীটা শেষ পর্য্যন্ত হয়েছিল কিনা তা জানা নেই।

বাইরে বসে বাকি প্রার্থীদের সম্ভাব্য প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা
-
গ্রীনিচের O2 Mall এর এক রেস্টুরেন্টে

লন্ডনে আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে গ্রীনিচ (Greenwich) জায়গাটা খুব বেশী দূরে নয়। লন্ডনে এলে এখনো দুই একবার গ্রীনিচে যাই, কেননা জায়গাটা বড় সুন্দর, খোলা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, প্রচুর বড় বড় গাছ সেখানে ছড়িয়ে আছে। আর আছে ফুলের বাগান সেখানে ছোট লেকে সাদা হাঁসেরা ভেসে বেড়ায়। তাছাড়া আছে কফি শপ, রেস্টুরেন্ট।
গ্রীনিচ অবশ্যই গ্রীনিচ মীন টাইম এর জন্যে বিখ্যাত, এখান দিয়েই চলে গেছে মেরিডিয়ান লাইন (zero ডিগ্রী longitude )। কিন্তু সেখানে Time keeping আর Astronomy সম্পর্কিত আরও অনেক প্রাচীন এবং বৈজ্ঞানিক আকর্ষণ আছে বিশেষ করে Royal Astronomical Observatory , Naval Museum, Planetarium, Cutty Sark, ইত্যাদি। সেগুলো আছে একটা টিলার ওপরে অনেকটা জায়গা নিয়ে। তার মধ্যে একটা বিশাল চত্বর, সেখানে মেরিডিয়ান লাইন আঁকা আর সেই লাইনের দুই পাশে নানা শহরের নাম (আর তাদের longitude ডিগ্রী – কতটা পূবে আর কতটা পশ্চিমে)।


Meridian Line গ্রীনিচে একটা hilltop viewing point আছে, যেখানে দাঁড়ালে দূরে নীচে দেখা যায় লন্ডন শহরের স্কাইলাইন, এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া টেম্স্ নদী আর তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া Emirates রোপওয়ে আর তার পাশে O2 Mall এর বিশাল তাঁবুর মত সাদা hemispheric ছাউনী।
টিলার ওপর থেকে নীচে গ্রীনিচ শহরে যাবার রাস্তা আর সিঁড়ি নেমে গেছে। নীচে একটা বড় flea market বসে, তাছাড়া শহর টা বেশ ছবির মত নিরিবিলি আর সুন্দর। সেখানেও মাঝে মাঝে যাওয়া হয়।
গ্রীনিচ একদিনের ফ্যামিলি পিকনিকের পক্ষে আদর্শ জায়গা।






এই গল্পটা অবশ্য গ্রীনিচ বরোতে O2 মল নিয়ে। সেটা Observatory আর Museum থেকে কিছুটা দূরে।
O2 নামে এই দেশে একটা মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্ক কোম্পানী আছে, এই মলটা তাদের নামে তৈরী। সেই মলের তাঁবুর মত hemispheric ছাউনীতে সিঁড়ি বেয়ে অনেক লোক ওপরে চলে যায়, নীচ থেকে তাদের দেখতে বেশ পিঁপড়ের মত লাগে। কম বয়েস হলে আমিও অনায়াসে ওপরে দৌড়ে উঠে যেতাম, কিন্তু এখন বয়েসটা বাদ সাধে।
O2 Mall এ অনেক কোম্পানীর ফ্যাকটরী আউটলেট আছে, যেখানে জামাকাপড় জুতো ইত্যাদি অনেক জিনিষপত্রের দাম অবিশ্বাস্য কম, এবার একদিন আমরা সস্তায় কেনাকাটা করার জন্যে সেখানে গিয়েছিলাম।
O2 mall এ গাড়ীতে গেলে নদী পার হবার জন্যে Blackwell Tunnel আছে, আর টিউবে গেলে জুবিলী লাইনে North Greenwich স্টেশনে নেমে নদীর ওপরে Emirates রোপওয়ে ধরে চলে যাওয়া যায়। রোপওয়ে তে আগে চড়া হয়েছে, এবার তাই নদীর নীচে টানেল পেরিয়ে গাড়ীতেই যাওয়া হলো।
কেনাকাটা সারা হলে মলের ভিতরে একটা ইটালিয়ায়ন রেস্টুরেন্ট – Frankie and Benny’s- এ খেতে ঢুকলাম আমরা। কোভিড এর জন্যে দোকান সব খোলা হলেও মল বেশ ফাঁকা, রেস্টুরেন্টও খালি।
আমাদের ওয়েটার ছেলেটি খুব প্রিয়দর্শন। ফর্সা, একমাথা কালো চুল, একটু গাবদু চেহারা হলেও তার চলাফেরায় বেশ একটা ক্ষিপ্র, চটপটে ভাব আছে। পরনে সাদা সার্টের ওপরে লাল রং এর একটা apron, কোম্পানীর ইউনিফর্ম হবে, ফর্সা রং এর সাথে তা দিব্বি মানিয়েছে। ছেলেটি বেশ হাসিখুসী, কথাবার্ত্তা বেশ ভদ্র, আর ইংরেজী ভাল বললেও তার কথাবার্তায় সেরকম কোন ব্রিটিশ accent নেই, চেহারা দেখে ইউরোপের কোন দেশের বলে মনে হয়। স্পেন বা ইটালী?
যাই হোক, খাবার অর্ডার দিয়ে আমরা নানা গল্প করে যাচ্ছি, ছেলেটি সব খাবার এক এক করে নিয়ে এসে নিখুঁত ভাবে আমাদের টেবিলে পরিবেশন করে গেলো।
তারপর হঠাৎ আমাদের অবাক করে সে বললো, “Please don’t mind my asking, but are you speaking in Bengali?”
অ্যাঁ , বলে কি?
একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে সে ইংরেজীতে বললো, “তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলে তো তাই শুনে মনে হলো~”
তুমি বাংলা জানো? ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করলাম আমি।
এবার সে একগাল হেসে বললো “একটু একটু!”
তারপরে তো অনেক গল্প হলো তার সাথে। ইংরেজীতেই।
সে নাকি কলকাতায় ও গিয়েছে বেশ কয়েকবার তার মামার কাছে। মামা ছিলেন তার মা’র আপন দাদা, বোন আর ভাগ্নে কে তিনি খুব ভালবাসতেন। তিনি ভাল বেহালা বাজাতেন, মুম্বাই থেকে কলকাতায় বেহালা বাজাতে কয়েকবার গিয়ে কলকাতা তাঁর এত ভাল লেগে যায় যে তিনি শেষ পর্য্যন্ত সেখানে থেকে যান। তোমরা হয়তো তাঁর নাম শুনেও থাকতে পারো।
কি নাম ? জিজ্ঞেস করলাম আমরা।
ছেলেটি একটু কুন্ঠিত ভঙ্গী তে বলল, “আমার মামার নাম ভি জি জোগ্! ”
ভি জি জোগের নাম জানবোনা? আমি তো হৈ হৈ করে উঠলাম। ওনার মত এত বড় শিল্পী, পদ্মভূষণ সঙ্গীত নাটক আকাদেমী ইত্যাদি কত খেতাব আর পুরস্কার পেয়েছেন, তার ওপরে কলকাতার সাথে তাঁর গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক তো সবাই জানে। কলকাতা আর বাঙালী কে ভালবাসার সূত্রে তিনি তো আমাদেরও আত্মীয়।
ছেলেটির সাথে তারপর বেশ কিছুক্ষণ আলাপ জমে গেল আমাদের। ওর মা থাকেন পুণাতে। মারা যাবার আগে পর্য্যন্ত বোনের কাছে মামা আসতেন মাঝে মাঝে, মুম্বাই তে কাজে এলেই। ও নিজে কোন গান বাজনা জানেনা, তবে লতা মাসী আর আশা মাসীর গান ওর খুব ভালো লাগে, ওঁরা ওদের পুণার বাড়ীতে প্রায়ই আসতেন ওর ছোটবেলায়।
নদীর ধারে কাছেই গ্রীনিচের এক এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সে একাই থাকে। তবে একা হলেও লন্ডনে তার থাকতে ভালোই লাগছে, কয়েক বছর হলো তার মা আর বাবাও গত হয়েছেন, তাই দেশে ফেরার টান তার আর নেই।
বিল মিটিয়ে ছেলেটিকে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম।।
লন্ডনের সাথে কলকাতার এই আশ্চর্য্য যোগাযোগের জন্যে গ্রীনিচের সেই দুপুরটার কথা অনেকদিন মনে থাকবে।




-
একাকী গায়কের নহে তো গান

অক্টোবর, ২০১৩
মান্না দে সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এখন চারিদিকে তাঁকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ এবং আলোচনা হচ্ছে, এবং সেই আলোচনায় তাঁর সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তুলনা চলে আসছে।
আনন্দবাজারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর স্মৃতিচারণে এই দুজনের তুলনা টেনে এনেছেন দেখলাম। তিনি পারেন, কেননা প্রতিভা ও সাধনার জোরে তিনি ওনাদের সমকক্ষ, এবং আরো বড়ো কথা, ওই দুজনের সাথেই তিনি গান গেয়েছেন। তাঁর মতে “হেমন্ত দা ছিলেন ‘রোমান্টিক সম্রাট’ আর মান্না দা হলেন ‘সুরের সাগর’~”
দুজনেই নিজের নিজের জায়গায় গৌরবের সাথে অধিষ্টিত। তাঁদের মধ্যে তুলনা করা চলেনা।
কিন্তু ব্যাপার টা হচ্ছে আমরা সাধারণ লোকেরা যারা গানের ব্যকরণ বুঝিনা কিন্তু গান শুনতে ভালবাসি, তারা নিজের নিজের মত করে তাদের ব্যক্তিগত ভাল লাগা তৈরী করে নিই। আমাদের মধ্যে কেউ রফি, কেউ কিশোর, কেউ মুকেশ বা তালাতের ভক্ত।
আমি যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এ নিবেদিত প্রাণ। ওনার গান শুনলে আমি এখনো কেমন যেন সন্মোহিত হয়ে পড়ি। ওরকম ভরাট, মিষ্টি, রোমান্টিক গলা ভগবান কি আর কাউকে কোন দিন দেবেন? মনে হয়না। ওই গলা আর হবেনা। ওনার গান শুনলেই প্রাণ টা যেন জুড়িয়ে যায়! শরীরে ক্লান্তি বোধ করলে অথবা মন নিরাশায় ভরে উঠলে আমি ওনার গান চালিয়ে শুনি। অব্যর্থ ওষুধ! কিছুক্ষণ ওনার গলা শোনার পরেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
সেই ছোটবেলা থেকে নিয়ে আজ পর্য্যন্ত আমার জীবনের ফেলে আসা দিনের কথা যখন মনে পড়ে, সেই সব দিনের স্মৃতির সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে।
হয়তো মনোহরপুকুরের বাড়ীর বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে নীচে রাস্তায় লোক চলাচল দেখছি, পাড়ার পূজো প্যান্ডেলের মাইকে বেজে উঠছে তাঁর মায়াবী গলায় গান। হয়তো খড়গপুরে হোস্টেলে এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে নিজের ঘরে পড়ার টেবিলে বসে আছি, এরকম মেঘলা দিনে একা ঘরে বসে মনের মধ্যেও একটা নিঃসঙ্গতার মেঘ জমছে, তখন দূর থেকে সজল বাতাসে ভেসে আসছে হেমন্তর তখনকার সময়ের কোন মন মাতানো গান, শুনতে শুনতে আমার মন ক্রমশঃ ভাল হয়ে উঠছে। অথবা বম্বে তে সারাদিন অফিসের কাজ সেরে সান্টা ক্রুজ স্টেশনের ভীড় কাটিয়ে মাথা নীচু করে নিজের ঘরে ফিরছি, হঠাৎ কাছেই কোথাও রেডিও তে বেজে উঠলো হেমন্তের fluid গলা। “আঃ হেমন্ত”, বলে আমি একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলাম।
আমাদের এই ব্যক্তিগত ভালো লাগা দিয়েই কিন্তু শিল্পীদের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি তৈরী হয়। গ্রামোফোন কোম্পানীর sales record থেকে সেই জনপ্রিয়তার হিসেব মেলে। যেমন শুনেছি এখনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড (CD) সব চেয়ে বেশী বিক্রি হয় দেবব্রত বিশ্বাস এর গান।
প্রতিভা মাপা যায়না, talent এর কোন measure নেই, কিন্তু sale এর বিশ্বস্ত record আছে, তাই দিয়ে কে প্রথম, কে দ্বিতীয় সেই বিচার করা যেতেই পারে।
তবে রেকর্ড বিক্রী ছাড়াও শিল্পীদের জনপ্রিয়তার আর একটা সূক্ষ্ম বিচার ছিল।
আমাদের ছোটবেলায় রেডিওতে বাংলা আধুনিক গানের অনুরোধের আসর শুনতাম রোজ শনিবার আর রবিবার দুপুরে। সেই পঞ্চাশ আর ষাটের দশক কে বলা হতো আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। অনেক গুণী গীতিকার সুরকার আর শিল্পীর উজ্জ্বল সমাবেশ ঘটেছিল এক সাথে, আমরা তাঁদের কাছ থেকে বছরের পর বছর উপহার পেতাম একের পর এক কালজয়ী গান। আজকের দিনেও সেই সব গান তাদের জনপ্রিয়তা হারায়ানি।
সেই অনুরোধের আসরে সব শেষে বাজানো হতো হেমন্ত মুখোপাধায়ের গান, বাংলা আধুনিক গানের জগতে শ্রোতাদের মনে তাঁর জন্যে শ্রেষ্ঠ আসনটি অবিসংবাদিত ভাবে বাঁধা ছিল।
মান্না দে সেই সময় বম্বেতে হিন্দী ফিল্মের গান গেয়ে সুনাম অর্জ্জন করে বাংলা গানের জগতে সবে পা রেখেছেন। অনুরোধের আসরে তাঁর সেই সময়ের গানগুলি বাজানো হতো প্রথম দিকে। কিন্তু ক্রমশঃ কয়েক বছরের মধ্যেই ষাটের দশক থেকেই তাঁর বাংলা গানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে শুরু করে।
বাংলা সিনেমা তেও উত্তমকুমারের গলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানই প্রচলিত ছিল, দুইজনের গলায় বেশ ভাল মিলও ছিল। কিন্তু ক্রমশঃ মান্না দে বাংলা ফিল্মের গানেও জনপ্রিয়তায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে ছাড়িয়ে যান। উত্তমকুমারের সাথে তাঁর গলার মিল তেমন না থাকলেও ক্রম্নশঃ বাংলা সিনেমায় তাঁর লিপেই মান্না দের বহু গান বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করে।
পরের দিকে অনুরোধের আসরে তাঁর আধুনিক গানও সবার শেষে বাজানো হতো।
আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়ীর কাছে বসুশ্রী I Iসিনেমায় প্রতি বাংলা নববর্ষে এক বিশাল সঙ্গীতানুষ্ঠান হতো। বাংলা গানের জগতের সব মহারথীরা সেখানে এসে গান গাইতেন। সেই গান মাইকে বাজতো, আর আমরা অনেকে, যাদের ভিতরে ঢোকার পাস বা টিকিট ছিলনা, বাইরে দাঁড়িয়ে সেই গান শুনতাম।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রতি বছর সব শেষে গান গাইতেন। তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী।
কিন্তু কবে থেকে ঠিক মনে নেই, একদিন দেখলাম বসুশ্রী সিনেমার অনুষ্ঠানে মান্না দে গান গাইতে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরে, সবার শেষে।
অস্বীকার করবোনা, সেদিন আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল।

তবে আমার মত হেমন্ত ভক্তদের একটা ব্যাপারে একটু সান্ত্বনা ছিল, তা হলো জনপ্রিয়তার দিক থেকে বম্বের ফিল্মি গানের জগতে এবং বিশেষ করে রাগপ্রধান গানে মান্না দে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও, বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে প্রথম সারির শিল্পী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কবির জন্মশতবার্ষিকীর বছরে বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গানের প্রভূত প্রসার শুরু হয়। শান্তিনিকেতনের পরিধি অতিক্রম করে রবীন্দ্রসঙ্গীত সে বছর থেকে যে সব বরেণ্য গুণী শিল্পীর হাত ধরে সাধারণ বাঙালীর কাছে পৌছে যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম পথিকৃৎ।
তাঁর গাওয়া সেই প্রথম যুগের রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডের গান কি অসম্ভব শ্রুতিমধুর ও জনপ্রিয় হয়েছিলা তা আমার এখনো মনে পড়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বাঙালীর কাছে এত জনপ্রিয় করার পিছনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মূল্যবান অবদান ছিল একথা অস্বীকার করা যাবেনা। সেই শতবার্ষিকীর বছরে HMV শ্যামা গীতিনাট্যের রেকর্ডে বজ্রসেনের গান গেয়েছিলেন তিনি, কণিকা বন্দ্যোপাধায় গেয়েছিলেন শ্যামার গান। আজও শ্যামার সেই রেকর্ডটি আমাদের বয়সী অনেকের কাছেই বার বার শোনা একটি অতি যত্নের সঞ্চয়।
যাই হোক আগেই বলেছি মান্না দে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দু’জনেই ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান এবং গুণী শিল্পী, এঁদের দুজনের মধ্যে কোন তুলনা করা যায়না। তাঁরা দুজনেই নিজের নিজের মত করে অতুলনীয়।
কিন্তু আমাদের মত সাধারণ শ্রোতাদের কাছে এঁদের মধ্যে একজনের প্রতি একটু বিশেষ ব্যক্তিগত ভালবাসা আর পক্ষপাতিত্ব থাকলেও সেটা বোধহয় খুব একটা অন্যায় নয়।


-
মাধবকাকার সঙ্গে কিছুক্ষণ

মাধব কাকা, উত্তরপাড়ায় নিজের ঘরে, অক্টোবর ১৮, ২০১৬ ১
গত মঙ্গলবার (১৮/১০/২০১৬) চৈতী, সুভদ্রা আর আমি উত্তরপাড়া তে গিয়ে মাধবকাকার সাথে দেখা করে এলাম।
মাধবকাকা এখন উত্তরপাড়ায় ছোট ছেলে রঞ্জু, বৌমা জয়া আর নাতি অরিজিৎ (দানু) কে নিয়ে থাকেন। ফোন করে তাঁর সাথে কথা বলা যায়না, কেননা তিনি এখন কানে একেবারেই শোনেন না। তার ছেলে রঞ্জুর সাথে কথা হল, বললাম বিজয়ার পরে দেখা করতে যাবো। চৈতীকে বলাতে সেও এক কথায় আমার আর সুভদ্রার সাথে যেতে রাজী।
চৈতী কে গোলপার্ক থেকে তুলে বেরোতে বেরোতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। আজকাল সাড়ে পাঁচটায় অন্ধকার হয়ে আসে, পার্ক সার্কাস ফ্লাই ওভার দিয়ে দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন নদীর ওপারে লাল টুকটুকে বলের মত সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে। কোনা রোড ধরে সোজা বালীখাল, সেখানে হাইওয়ে থেকে নেমে জি টি রোডে পড়লাম। রঞ্জু ফোনে direction দিয়ে দিয়েছিল।
জি টি রোড আছে আগের মতোই, নোংরা সরু রাস্তা, পথচারীদের ভীড়, দু’পাশে সারি সারি দোকান, গাড়ী বাস ঠ্যালাগাড়ী রিক্সা, নানা যানবাহন, হর্ণের বিকট আওয়াজ। সামনেই কালীপুজো, রাস্তার পাশে বেশ কিছু বাঁশের structure, পূজোর প্যান্ডেল বানানো শুরু হয়ে গেছে, একটা টেম্পো করে বেশ কিছু লোক একটি বেশ বড় কালীপ্রতিমা নিয়ে যাচ্ছে চোখে পড়লো। এখানে সেখানে মাইক থেকে হিন্দী ফিল্মের গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।
এই সবের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আহিরীটোলা খেয়াঘাট, রাস্তার একদম পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। দেখে মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে গেল। ওই নোংরা ঘিঞ্জি রাস্তার পাশেই এক বিশাল বিস্তীর্ণ নদী বয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য সত্যিই অবাক করার মত, সামঞ্জস্য হীন।
খেয়া ঘাট ছাড়িয়ে একটু আগে ভদ্রকালীর সখের বাজারের মোড়। সেখান থেকে রঞ্জু কে ফোন করতে সে বললো, “ওখানেই গাড়ীটা রাখুন, আমি দানুকে পাঠাচ্ছি।” মিনিট দশেক এর মধ্যে সাইকেলে চেপে দানু চলে এল, তাকে follow করে আমরা পৌঁছে গেলাম মাধবকাকার বাড়ীর গলিতে। রামলাল দত্ত লেন। রঞ্জু আমাদের অপেক্ষায় গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে আগে কোনদিন দেখিনি, ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু প্রথম দেখাতেই তাকে মাধবকাকার ছেলে বলে চিনতে পারলাম। দু’জনের মুখের বেশ সাদৃশ্য আছে।
যেতে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা লাগলো। পৌঁছলাম ছ’টার একটু পরে। তখন বেশ অন্ধকার।
একটা gated compound এর ভেতরে মাধবকাকার তিনতলা বাড়ী, ছোটর মধ্যে বেশ ছিমছাম সাজানো গোছানো। মাধবকাকা থাকেন দোতলায়, হাঁটুর ব্যথায় কষ্ট পান, তাই আজকাল আর বেশী চলাফেরা করতে পারেন না। ওপরেই থাকেন, নীচে নামেন না। বেশ সেজেগুজে স্মার্ট একটা টি শার্ট পরে খাটে বসেছিলেন, আমরা গিয়ে প্রণাম করলাম। চেহারাটা বয়সের তুলনায় এখনও বেশrobust আছে, কেবল মুখ আর ঠোঁটের কাছটা যেন একটু ফোলা লাগলো। এমনিতে কথা বেশী বলছিলেন না, সারাক্ষণ চুপ করেই বসে রইলেন। বোধ হয় কানে কিছ শুনতে না পারার জন্যেই।
দোতলায় দুটো ঘর, তার মধ্যে বড় ঘরটিতে মাধবকাকা বিছানায় বসেছিলেন, আমি তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম।
বাড়ীটা ছোট হলেও ঝকঝকে পরিস্কার, মোজেইক এর মেঝে, দেয়ালে নানা পারিবারিক ছবি সাজানো। বোঝাই যায় যে জয়া সুগৃহিণী। মাধবকাকার ঘরে বিছানার ওপর পরিপাটি করে চাদর বিছোনো। খাটের পিছনে দেয়ালে মাধবকাকা আর কাকীমার একটা বড় করে বাঁধানো ছবি টাঙানো আছে। বোধ হয় বিয়ের পরে তোলা। কাকীমার লাল শাড়ী, মাথায় ঘোমটা। সেই ছবিতে মাধবকাকাকে চেনাই যাচ্ছেনা, রোগা, ল্যাংপ্যাঙ্গে এক অচেনা যুবক। অবশ্য একটু খেয়াল করে দেখলে মুখের মিলটা টের পাওয়া যায়।
চৈতী জিজ্ঞেস করলো এটা কি মাধবকাকার ছবি?

জয়ার সাথে আগে আমাদের কোন পরিচয় ছিলনা, কিন্তু সে দেখলাম আমাদের পরিবারের সব খবরই রাখে, মা জ্যেঠিমা কাকীমাদের সবাইকে চেনে। মনোহরপুকুরে গেছেও বলল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জয়া আর রঞ্জু আমাদের আপন করে নিল। যে ঘরে আমরা বসেছিলাম সেই ঘরের সাথে লাগানো কিচেন। “চা খাবেন তো?” বলে জয়া সেখানে গিয়ে খুটখাট শুরু করে দিল। রঞ্জু হঠাৎ কোথায় বেরিয়ে গেল, নিশ্চয় আমাদের জন্যে কিছু কিনতে।
আমরা দানুর সাথে কথা বলে জানলাম সে Globsyn নামে কলকাতার একটা Management Institute থেকে MBA করেTimes of India তে Digital marketing এর কাজ নিয়েছে, কিন্তু সে এই কাজে খুব একটা happy নয়। তার future career নিয়ে অনেক আলোচনা হল, বুঝলাম সে মা আর বাবা কে ছেড়ে কলকাতার বাইরে যেতে প্রস্তুত নয়। বাইরে গেলে বেশী টাকা জমাতে পারবেনা, সে বলল মা আর বাবা তাকে তাঁদের কষ্টার্জ্জিত টাকা খরচ করে MBA পড়িয়েছেন, এখন সেই টাকা তাঁদের ফেরত দেওয়া তার আশু কর্ত্তব্য। কলকাতার বেশ কিছু জায়গায় সে চাকরীর চেষ্টা চালাচ্ছে, তার মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা লেগে যাবে তার আশা। আমরা তাকে আমাদের শুভেচ্ছা জানালাম।
আমরা আসবো বলে অনেক খাবারের আয়োজন করেছে জয়া। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সে আমাদের আলোচনাতে যোগ দিচ্ছে, আর তার কাছ থেকে আমরা অনেক খবর পাচ্ছি। মাধবকাকার ভাইরা আর কেউ বেঁচে নেই, তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেউ আর উত্তরপাড়ায় থাকেনা, তাদের বাড়ী সব ফাঁকা পড়ে আছে। একমাত্র বোন ভক্তি পিসী এখন মেয়ের কাছে নবদ্বীপে থাকেন ইত্যাদি। রঞ্জু কাছেই কো অপেরাটিভ ব্যাঙ্কে কাজ করতো, কিন্তু রাজনৈতিক গুন্ডা দের চাপ অসহ্য হওয়ায় তার blood sugar অত্যধিক বেড়ে যায়। ফলে সে কাজ থেকে voluntary retirement নিয়ে নিয়েছে। এখন দানু দাঁড়িয়ে গেলে তারা দু’জনে নিশ্চিন্ত।
ইতিমধ্যে রঞ্জু দোকান থেকে খাবার কিনে ফিরে এসেছে, জয়া চায়ের সাথে বাড়ীতে বানানো বিস্কুট, গজা প্লেটে করে এগিয়ে দিলো আমাদের। তার পরে একে একে আসতে লাগলো বাড়ীতে বানানো নারকেলের নাড়ু, দোকান থেকে আনা ভেজিটেবল প্যাটিস, নানা রকমের মিষ্টি – সন্দেশ, রসগোল্লা।
সর্ব্বনাশ, এত কে খাবে?
জয়া বললো এর পরে আইসক্রীম আছে !
গল্পে গল্পে ঘন্টা খানেক কেটে গেল। এবার উঠতে হবে।


জয়া আমাদের তিনতলায় তার পূজোর ঘর দেখাতে নিয়ে গেল। পাশেই এক চিলতে ছাত। অন্ধকার, মাথার ওপরে তারাভরা আকাশ, চারিপাশে ঘনবসতি, গায়ে গায়ে লাগানো বাড়ীর ঘন ঠাসবুনোট। কিছু বাড়ী অন্ধকার। কিছু বাড়ীর জানলায় আলো জ্বলছে। জয়া বললো জানেন, আমি রোজ সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ ছাতে এসে বসে থাকি, আমার খুব ভাল লাগে।
ছাত থেকে রাতের শহরের ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ল, মাধবকাকার বিয়েতে মনোহরপুকুর থেকে মা জ্যেঠিমা কাকীমারা সবাই আমাদের ছোটদের নিয়ে বিকেলে এসেছিলেন, রাত্রের ট্রেণ ধরে আমরা ফিরে যাই। তখন এই জায়গাটা কি ফাঁকা ছিল, চারিদিকে খোলা মাঠ, মিঠু, আমি বাবলু আর সমবয়েসী অনেক ছেলে মেয়েরা সেই মাঠে সারা বিকেল খুব ছোটাছুটি করেছিলাম। ওই মাঠেই বিয়ের অনুষ্ঠান আর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল।
এখন আর কোন ফাঁকা জায়গা নেই, চারিদিকে শুধু বাড়ী।
ছাত থেকে নামার সময় সিঁড়ির পাশে দেখলাম দেয়ালে বুক কেস, তার ভেতরে যত্ন করে সাজানো অনেক বই। জয়া বললো আপনার বাবার লেখা পূর্ব্বাচল বইটা আমাদের কাছে আছে। জেনে আমি অবাক হলাম, আর খুসীও।
ফেরার সময় রঞ্জু আর জয়া অনেক করে বললো আবার আসবেন, এবার বেশীক্ষণ থাকলেন না, এর পরের বার সারা দিনের জন্যে আসুন, আমরা সকলে মিলে বেলুড়ের মন্দির দেখে আসবো। তাদের দু’জনের এই আন্তরিক ব্যবহারের মধ্যে কোথাও যেন মাধবকাকার স্বভাব আর ব্যবহারের ছায়া দেখতে পেলাম আমি।
রঞ্জু এসে গলির মোড় পর্য্যন্ত এগিয়ে দিল আমাদের।
ফেরার পথে আমরা বালী (বিবেকানন্দ) ব্রীজ ধরে দক্ষিণেশ্বর হয়ে ফিরলাম। বিবেকানন্দ ব্রীজে রাস্তার কাজ হবার জন্যে অনেকদিন দু’দিকই বন্ধ ছিল, সম্প্রতি ফেরার দিকটা খুলে দেওয়া হয়েছে। ব্রীজের ওপর দিয়ে আসার সময় নীচে কালো নদী, আর নদীর ওপারে দূরে মা ভবতারিণীর সাদা রং এর মন্দির আলোয় ঝলমল করছে, দেখে মনটা অকস্মাৎ খুব প্রশান্ত হয়ে উঠলো।
দক্ষিণেশ্বর থেকে দমদম এয়ারপোর্ট পর্য্যন্ত নতুন রাস্তা হয়েছে, তার পরে রাজারহাট হয়ে বাইপাস, পরমা ফ্লাইওভার। ভেবেছিলাম ফেরাটা তাড়াতাড়ি হবে, কিন্তু পশ্চিম দিক দিয়ে হাওড়া হয়ে যাবার তুলনায় এই উত্তর আর পূব দিক দিয়ে ফেরার দূরত্বটা বোধ হয় একটু বেশী। তাই ভাল রাস্তা হওয়া সত্ত্বেও ফিরতেও দেড় ঘন্টা লেগে গেল। উত্তরপাড়া থেকে রাত সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে গোলপার্ক পৌঁছলাম রাত ন’টার একটু পরে।
সব মিলিয়ে বিকেল সাড়ে চারটে থেকে রাত ন’টা, সাড়ে চার ঘন্টা, দেড় ঘন্টা যেতে, দেড়্ ঘন্টা ফিরতে আর দেড়ঘণ্টা ওদের সাথে। বেশ ভালোই হলো আমাদের trip সব মিলিয়ে।


মাধবকাকা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আর দুই বছর পরে।
-
তারাপদ দা’

১ – মুখবন্ধ
কবি তারাপদ রায় আমার সম্পর্কে দাদা হতেন। একটু লতায় পাতায় অবশ্য, উনি হলেন বাবার পিসতুতো ভাইয়ের ছেলে।
আমার ঠাকুর্দারা দুই ভাই এবং এক বোন ছিলেন, বাবাদের সেই একমাত্র পিসীর বিয়ে হয় ময়মনসিংহে, দেশভাগের পরে তাঁরা ভারতে আসেননি। পিসেমশায় ডাক্তার ছিলেন, ময়মনসিংহে তাঁর সম্পন্ন পরিবার, কাজে সুনাম আর পসার ভাল ছিল ধরে নেওয়া যায়। সে সব ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে তাঁরা পূর্ব্ব বাংলায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন্। তাঁদের দুই ছেলে পূর্ণ আর সুশীলও এদেশে আসেননি।
পূর্ণ জ্যাঠামশায়ের কোন সন্তান ছিলনা, ষাটের দশকে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীর পক্ষে একা ওদেশে থাকা সম্ভব ছিলনা, তিনি তখন ভারতে চলে আসেন। আমাদের সেই ময়মনসিংহের জ্যেঠিমাকে নিয়ে আমি এখানে আগে লিখেছি, হয়তো তোমাদের কারুর কারুর মনে থাকবে।,
ছোটভাই সুশীল ছিলেন উকিল, তিনি টাঙ্গাইল শহরে ওকালতি করতেন। তবে দেশভাগের সময় তিনি এবং তাঁর স্ত্রী নিজেরা টাঙ্গাইলে থেকে গেলেও তাঁদের দুই ছেলে তারাপদ আর বিজন কে ভারতে কলেজে পড়তে পাঠিয়ে দেন্। স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও সুশীল একাই টাঙ্গাইল শহরে থেকে যান। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
যাই হোক, বাবাদের এই পিসতুতো ভাইদের পরিবারের অনেকেই ভারতে এসে থাকতে শুরু করেন। আমাদের বাঙালদের লতায় পাতায় পারিবারিক সম্পর্ক আর network এর সুবাদে এঁদের সাথে আমাদের পরিচয় ছিল। সেই সূত্রেই তারাপদদা’র সাথে আমার প্রথম আলাপ। তখন আমি স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি, বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ মোটামুটি পড়ে ফেলে ক্রমশঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দিকে ঝুঁকছি।
সেই ষাটের দশকে কল্লোল যুগ তখন অতিক্রান্ত, কৃত্তিবাস কবিগোষ্ঠীর সুনাম ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে।
তারাপদ দা’ সেই কৃত্তিবাস কবিগোষ্ঠীর একজন প্রধান সদস্য ছিলেন, নিঃসন্দেহে সেই সময়ের একজন প্রথম সারির কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। বুদ্ধদেব বসু মারা যাবার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এবং শরৎ মুখোপাধ্যায়ের সাথে তিনিও একজন শববাহক হয়েছিলেন।
তাঁর এই কবিখ্যাতি আমার কৈশোরে তাঁর প্রতি আকর্ষণ জন্মাবার একটি প্রধান কারণ ছিল। তাছাড়া তিনি খুব মজলিসী আর আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন, তাঁর স্টকে অনেক মজার গল্প, আর সেই সব মজার গল্প বলার তাঁর একটা অননুকরণীয় স্টাইল ছিল, যেটা আমার খুব ভাল লাগত। হেঁড়ে গলায় সামান্য বাঙ্গাল উচ্চারণে উনি নানা গল্প করে যেতেন একের পর এক, আর এই সব গল্প বলার সময় তারাপদ দা’ প্রায় প্রতি বাক্যের মধ্যেই একবার “বুঝতে পেরেছো তুমি?” বলতেন। ওটা তাঁর একটা মুদ্রাদোষ ছিল।
পন্ডিতিয়া রোড টা ক্যালকাটা কেমিকালের পরে যেখানে বেঁকে হাজরা রোডের দিকে চলে গেছে ঠিক সেই জায়গায় একটা ছোট ভাড়া বাড়ীর একতলায় থাকতেন তারাপদ দা’, মিনতি বৌদি আর তাঁদের ছেলে তাতাই (কৃত্তিবাস)। আমি থাকতাম মনোহরপুকুর রোডে, ত্রিধারার পাশ দিয়ে শর্টকাট করে চলে যেতাম, খুব বেশী দূর নয়, হেঁটে মিনিট পনেরো লাগতো। ওনার সেই পন্ডিতিয়া রোডের বাড়ীতে প্রায়ই আমি আর সুভদ্রা গিয়ে আড্ডা মেরে আসতাম। নানা গল্প হত। আর তারাপদ দা’র সব গল্পেই বার বার ওই কথাটা ফিরে আসবেই।
ধরা যাক তারাপদ দা’ কে কেউ এক জন একটা Rubic Cube উপহার দিয়েছে। তারাপদ দা’র ছেলে তাতাই সেটা নিয়ে অনায়াসে সব লাল এক দিকে, সব নীল এক দিকে, আর সব হলদে এক দিকে করে দেয়, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেটা তারাপদ দা’ কিছুতেই পারছেন না।
এই ব্যাপার টা বলতে হলে তারাপদ দা’ বলবেন “সবাই শুয়ে পড়লে, বুঝতে পেরেছো তুমি, আমি ওটা নিয়ে অনেক রাত পর্য্যন্ত নাড়াচাড়া করি, কিন্তু কিছুতেই রং গুলো এক জায়গায় আনতে পারিনা, বুঝতে পেরেছো তুমি, অথচ তাতাই কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পেরেছো তুমি, ওই জিনিষটা তে যদি কেউ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়, তাহলে দেখবে শুধু আমারই হাতের ছাপ, বুঝতে পেরেছো তুমি…”
তারাপদ দা’র বসার ঘর রাস্তার ওপরেই, দরজা সব সময় খোলা থাকত। ছোট ঘর, একটা টেবিল, বই পত্রে ঠাসা, কিছু চেয়ার আর একটা সোফা।
সেই সময়ে নিজের খরচে তারাপদ দা একটা লিটল ম্যাগাজিন ছাপাতেন, তার নাম ছিল “কয়েকজন”। সেই ম্যাগাজিনে ওঁর বন্ধুরা – যেমন নবনীতা দেব সেন, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, হিমানীশ গোস্বামী, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ইত্যাদিরা লিখতেন। রাইটার্সে ফাইনান্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন তারাপদ দা, সেই সরকারী কাজ সেরে লেখা যোগাড় করা, প্রেসে যাওয়া, প্রুফ দেখা, কয়েকজনের জন্যে বিজ্ঞাপন আনা, বিজ্ঞাপনের টাকার তাগাদা দেওয়া সব কাজ তাঁকে একাই করতে হতো। তবু ওটা একটা নেশার মতোই ছিল ওঁর কাছে।
পন্ডিতিয়া রোডে তারাপদ দার সাথে কাটানো সেই সন্ধ্যাগুলো এখনো বেশ পরিস্কার মনে পড়ে। সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা হত, বিশেষ করে কবিতা নিয়ে। সেই আলোচনায় সমর সেন, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র দের ঘিরে নানা টক ঝাল মিষ্টি গসিপ উঠে আসত, আর সেই সাথে অবশ্যই আসত তারাপদ দার ওই “বুঝতে পেরেছো তুমি” দিয়ে punctuate করা অজস্র সরস গল্প।
সেই সব গল্প থেকে দুটো গল্প এই সাথে।
২ – Radish with molasses
বাঙ্গালী সংষ্কৃতি এবং সাহিত্য নিয়ে খুব উৎসাহী এক আমেরিকান দম্পতি কলকাতায় এসেছেন। প্রায় এক মাস কলকাতায় থেকে তাঁরা খুব কাছ থেকে বাঙ্গালীদের জীবনের নানা দিক – বাঙ্গালীর পূজো আর্চ্চা, বাঙ্গালীর রান্না, বাঙ্গালীর আড্ডা, বাঙ্গালীর রাজনীতি– এই সব খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছেন। দেশে ফিরে যাবার কিছুদিন আগে তাঁরা দুজনে একদিন কোন এক মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে রাইটার্সে এসে হাজির।
তারাপদ দা’ বিখ্যাত কবি, মন্ত্রী মশাই ওনাদের তারাপদ দা’র কাছে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, “তারাপদ, তুমি তো কালীঘাটে থাকো, এনারা কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে মা কে দর্শন করতে চান, তুমি একটু ওঁদের নিয়ে গিয়ে দর্শন করিয়ে দেবে?”
সেদিন শনিবার, হাফ ছুটি। তারাপদ দা’ তখন থাকেন কালীঘাটে মহিম হালদার স্ট্রীটে, ওঁর বাড়ি থেকে মন্দির কাছেই, হাঁটাপথ। মা’র দর্শন হয়ে গেলে তিনি দুজন কে নিয়ে বাসায় গিয়ে দেখেন মিনতি বৌদি বাড়ি নেই, বাড়ি ফাঁকা। সকালে একটু বৌদির সাথে বাদানুবাদ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে বৌদি বাড়ী ছেড়ে চলে যাবেন এটা তারাপদ দা ভাবেন নি।
সর্ব্বনাশ! এখন এই দুই অতিথির খাওয়ার বন্দোবস্ত কি হবে? বিকেল প্রায় চারটে বাজে, এখন তো আর বাইরেও কোথাও যাওয়া যাবেনা। তার ওপর খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড।
তারাপদ দা’ রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন বৌদি কোন রান্নাই করে রেখে যান নি। শুধু এক কোণে পড়ে আছে কয়েকটা মূলো আর একটু ঝোলা গুড়।
নিরুপায় হয়ে তারাপদ দা ওই বিদেশী অতিথিদের প্লেটে করে কিছু মূলো আর গুড় দিয়ে বললেন এটা খান, এই পদটার নাম Radish with molasses, এটা হলো বাঙ্গালীদের একটা স্পেশাল খাবার। যাকে বলে ডেলিকেসী।
এর পরে অনেকদিন কেটে গেছে।
হঠাৎ একদিন নিউ ইয়র্ক থেকে এয়ার মেলে তারাপদ দা’র নামে এক চিঠি এল। সেই দম্পতি তারাপদ দা’ কে তাঁর সেদিনের আতিথেয়তার জন্যে অজস্র ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠির শেষে লিখেছেন, আপনি জেনে খুশী হবেন যে আমরা নিউ ইয়র্কে একটা রেস্তোরাঁ খুলেছি, আর আমাদের মেনু তে লাউ চিংড়ি, মোচার চপ, আলু পোস্ত, চালতার টক, ইত্যাদি অনেক বাঙ্গালী পদ রেখেছি।
কিন্তু সব চেয়ে বেশী লোকের কি পছন্দ জানেন? আপনার দেওয়া রেসিপি দিয়ে তৈরী Radish with molasses, যা কিনা হু হু করে বিক্রী হচ্ছে!
বুঝতে পেরেছো তুমি?
৩ – গৃহপালিত গন্ডার
সারা পৃথিবীতে কত গৃহপালিত জন্তু আছে তাই নিয়ে ইউনাইটেড নেশনের এক সমীক্ষা হবে। তার ফর্ম ছাপিয়ে পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর নানা শহরে আর গ্রামে।
এই ধরনের সমীক্ষায় সাধারনতঃ Statistical sampling technique ব্যবহার করা হয়, সারা পৃথিবী থেকে তো আর information জোগাড় করা সম্ভব নয়, তাই কিছু selected representative জায়গা থেকে data collection করে তার পর Computer software দিয়ে data extrapolation করে সারা পৃথিবী সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নেওয়া হয়।
তো ইউনাইটেড নেশনের সেই সমীক্ষার ফর্ম এসে পৌঁছলো বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেই গ্রামে ইংরেজী জানা কোন লোক নেই, পোস্টমাস্টার মশাই ক্লাস ফাইভ পর্য্যন্ত পড়েছেন, একমাত্র তিনি কিছুটা ইংরেজী জানেন, এবং তাই নিয়ে তাঁর আবার একটু গোপন অহংকার ও আছে।
এদিকে গ্রামের পাঠশালার মাস্টার মশায়ের এক ভাইপো ঢাকায় স্কুলে পড়ে, তার বয়েস বছর দশ এগারো হবে, সে ছুটিতে কাকার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। সে ভালই ইংরেজি জানে, তাছাড়া সে বেশ উৎসাহী আর কাজের ছেলে, তাই তার উপরেই ভার পড়ল সারা গ্রামে কত গৃহপালিত জন্তু আছে তার একটা হিসেব করে ফর্ম ফিল আপ করার।
ছেলেটি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ক’দিনের মধ্যেই একটা লিস্ট তৈরী করে ফেললো। তার পর ইংরেজী তে ফর্ম ফিল আপ করার পালা।
ছেলেটি গোটা গোটা ইংরেজী হরফে ফর্মে লিখলোঃ
Cow 20, Goat 45, Pig 28, Sheep 32, Rooster 50, Hen 55, Gander 12, Geese 15, Cat 62, Dog 45 ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই ফর্ম শেষ পর্য্যন্ত পৌঁছলো পোস্টমাস্টারের কাছে। তিনি সেই ফর্ম খামে ভরে পাঠিয়ে দেবেন সঠিক জায়গায়।
পোস্টমাস্টার মশায় ফর্ম টা দেখে কৌতূহলী হয়ে ভাবলেন দেখি তো ছোঁড়া কিরকম ইংরেজী লিখেছে। পড়তে পড়তে হঠাৎ গ্যান্ডার এ এসে তাঁর চোখ আটকে গেল।
গ্যান্ডার?
“ছোঁড়া গন্ডারের ইংরেজী লিখেছে গ্যান্ডার! ছি ছি! কিস্যু ইংরেজি শেখেনি বোঝাই যাচ্ছে” মনে মনে এই কথা বলে তিনি ফর্মে গ্যান্ডার -১২ কেটে লাল কালি দিয়ে লিখে দিলেন রাইনোসেরাস – ১২।
নানা দেশ ঘুরে সেই ফর্ম শেষ পর্য্যন্ত পৌঁছলো ইউনাইটেড নেশনের হেড কোয়ার্টারে। সেখানে কারুর চোখে কোন অসঙ্গতি ধরা পড়লোনা, Computer software দিয়ে সেই data extrapolate করে বড় একটা রিপোর্ট তৈরী হলো, সেখানে দেখা গেল সারা পৃথিবীতে গৃহপালিত গন্ডারের সংখ্যা হল দুই লক্ষ ছাব্বিশ হাজার!
বুঝতে পেরেছো তুমি?
-
টালিগঞ্জের জ্যেঠিমা আর বালিকা বধূ
১) টালিগঞ্জের জ্যেঠিমা
এক এক জনের নামের সাথে তাদের সাথে সম্পর্কিত কোন জায়গার নাম যোগ হয়ে যায়, তোমরা কেউ খেয়াল করেছো?
আমাদের ছিলেন পাটনার দাদু, দিল্লীর জ্যেঠু, উত্তরপাড়ার দিদা।
আর ছিলেন ময়মনসিংহের জ্যেঠিমা।
আমাদের ভৌমিক পরিবারের আদি বসবাস ছিল ওপার বাংলায় টাঙ্গাইলের ভাদরা গ্রামে। সেই সময়ে সেই জায়গাটা পড়তো ময়মনসিংহ জেলায় – এখন অবশ্য টাঙ্গাইল জেলা হয়েছে।
যাই হোক দেশভাগের পরে পরিবারের সবাই ভারতে চলে এলেও বাবাদের এক পিসী (আমাদের দাদুদের এক মাত্র বোন) এবং তাঁর স্বামী ওদিকেই থেকে যান্। বাবাদের পিসেমশায় ময়মনসিংহ শহরে ডাক্তারী করতেন, তাঁর পসার ভাল ছিল। ভিটে মাটির টানে তিনি দেশ ছাড়তে রাজী হন্নি।
দেশে ফিরে আসা পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে বাবাদের এই পিসী ও তাঁর দুই ছেলের যোগাযোগ স্তিমিত হয়ে আসে। তবে দেশভাগের আগে পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানে দুই পক্ষেরই আসা যাওয়া ছিল। আমার মা আর বাবার বিয়েতে (১৯৩৯ সালে) পিসীমা তাঁর ছেলেদের এবং বৌমা দের নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন।
তবে দেশভাগের পরে তাঁদের সাথে আমাদের যোগাযোগ ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে আসে।
পিসীমার বড় ছেলে পূর্ণ (রায়) তাঁর বাবার মত ময়মনসিংহ শহরে ডাক্তারী করতেন। আমাদের ময়মনসিংহের জ্যেঠিমা ছিলেন তাঁর স্ত্রী। চট্টগ্রামের বনেদী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল।
বাবার এই পিসতুতো দাদা পূর্ণর সাথে খুব অল্পবয়েসে তাঁর বিয়ে হয়। ওঁদের কোন ছেলেপুলে হয়নি। স্বাধীনতার পরে তাঁরাও ভারতে আসেন নি। পূর্ণ জ্যাঠামশায় ডাক্তার ছিলেন, সম্পত্তি আর জমিজমা ছিল, অতএব ময়মনসিংহে তাঁর প্রতিপত্তি ও পসার দুইই ভাল ছিল ধরে নেওয়া যায়।
১৯৬০ সালে স্বামী পূর্ণ মারা যাবার পর জ্যেঠিমা ওখানে আর একা থাকতে পারেন নি, ততদিনে তাঁর সব আত্মীয় স্বজন ভারতে চলে এসেছে। স্বজনহীন, সহায়হীন একা বিধবা আশ্রয়ের সন্ধানে তখন কলকাতা চলে আসেন। কিন্তু সেখানে কোন আত্মীয় দের কাছে তাঁর আশ্রয় মেলেনি। মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীও তখন ভর্ত্তি।
টালীগঞ্জের চন্ডীতলায় একটা ছোট এক কামরার বাসা ভাড়া করে তিনি এবং তাঁর বিধবা দিদি দুই বোন থাকতেন।
তখন থেকেই ময়মনসিংহের জ্যেঠিমা থেকে তিনি হয়ে যান্ আমাদের টালিগঞ্জের জ্যেঠিমা।
সেই ১৯৬০ সালে তাঁর বয়স পঞ্চাশের নীচেই ছিল, নিজেই হাঁটাচলা বাজার ইত্যাদি করতেন। প্রায়ই বাসে চেপে আমাদের মনোহরপুকুর রোডের বাড়িতে তিনি চলে আসতেন। বোধহয় আমাদের যৌথ পরিবারের কোলাহল আর ব্যস্ততার মধ্যে তিনি তাঁর ফেলে আসা জীবনের হারিয়ে যাওয়া উষ্ণতা কিছুটা খুঁজে পেতেন। তাঁর হাসিখুশী ব্যবহারের জন্যে তিনি আমাদের সকলের খুব প্রিয় ছিলেন। আমার তখন অল্প বয়েস, তবু তাঁর নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের কষ্ট বুঝতে আমার অসুবিধে হত না।
টালিগঞ্জের জ্যেঠিমা যে কমবয়েসে খুব সুন্দরী ছিলেন তাঁকে দেখেই তা বোঝা যেতো। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, টুলটুলে মুখে অজস্র বলিরেখা, মাথায় কিছু রূপোলী চুলের ঝিলিক, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, আর মুখ ভর্ত্তি পানে ঠোঁট লাল, সব মিলিয়ে তাঁর সেই চেহারাটা এখনো পরিস্কার চোখে ভাসে। মুখ টিপে অল্প হেসে অনেক মজার মজার কথা বলতেন জ্যেঠিমা, তাঁর ব্যক্তিত্বে বনেদীয়ানার একটা সুস্পষ্ট ছাপ ছিল। তাঁকে দেখে তাঁর জীবনের নানা বিপন্নতা আর বিষাদ একেবারেই বোঝা যেতোনা।
আমাদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় নিয়ম করে তাঁকে আমি বসুশ্রী সিনেমার সামনে বাসে তুলে দিয়ে আসতাম। চার নম্বর বাস যেত টালিগঞ্জের চন্ডীতলায়। বাসে খুব ভীড় থাকলেও ওনাকে দেখে কন্ডাক্টররা ভালবেসে “আসুন দিদিমা” বলে হাত ধরে টেনে তুলে নিত। আর চন্ডীতলায় ওনার ঘরে মাঝে মাঝে গেলে কি খুশী যে হতেন দুই বোন। পাথরের থালায় বাড়িতে বানানো নারকেলের নাড়ু, অথবা রাঘবসাই খেতে দিতেন, সাথে কাঁসার গেলাসে কুঁজোর ঠান্ডা জল।
২) বালিকা বধূ
ইন্দিরা তে ম্যাটিনি শো তে বালিকা বধূ দেখাচ্ছে । সুভদ্রা আর জ্যেঠিমা সেজেগুজে বেরোচ্ছে সিনেমা দেখতে। টালিগঞ্জের জ্যেঠিমা তখন মনোহরপুকুরে কিছুদিনের জন্যে এসে আছেন, তিনি ঠিক লক্ষ্য করেছেন । এই দুজন কোথায় যায় এই দুপুরবেলায় এত সেজেগুজে?
“তোরা কোথা যাওস?”
দুজনে সিনেমা যাচ্ছে শুনে তিনি “আমারেও নিয়া চল্” বলে ধরে বসলেন, তাঁকে না বলা কঠিন। সুতরাং তিনিও ওদের সাথে চললেন ।
সিনেমা শুরু হলো।
বিয়ের দৃশ্যের পর ফুলশয্যা । বালিকা বধূ তার বরকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলছে, “দ্যাখো দ্যাখো, কি সুন্দর চমচমে জ্যোৎস্না!”
এমন সময় হঠাৎ পাশ থেকে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ ।
কি ব্যাপার? কে কাঁদে?
সুভদ্রা দ্যাখে পাশে টালিগঞ্জের জ্যেঠিমা ঘন ঘন শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছছেন । ক্রমশঃ তাঁর কান্না আর বাঁধ মানলোনা । হু হু করে চোখ দিয়ে জল আর হাপুস নয়নে কান্না ।
পাশ থেকে অনেকে বিরক্ত হয়ে নানা রকম মন্তব্য করতে লাগলো।
সুভদ্রা আর জ্যেঠিমা ভীষণ অপ্রস্তুত।
“আমার ও ঠিক এই বয়সে বিয়া হয়েসিল রে, সেই কথা বড় মনে পড়ত্যাসে!”
এই গল্পটা পরে সুভদ্রা আর জ্যেঠিমার মুখে অনেকবার শুনেছি। আর প্রত্যেক বারই এই নিয়ে খুব হাসাহাসি হয়েছে।
কিন্তু এখন মাঝে মাঝে ভাবি গল্পটা কি আসলে হাসির না দুঃখের?
-
কলকাতায় বর্ষা , জুলাই ২০১৯

কলকাতায় এখন বর্ষা। আষাঢ় মাস, তাই এখন এখানে রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা চলছে।
সারা আকাশ উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে, হঠাৎ নিঃশব্দে নিঃসাড়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো, আর একটু পর থেকেই শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। প্রথমে টিপটিপ, তারপরে ঝিরঝির, শেষে ঝমঝম। কিছুক্ষণ “বজ্র বিদ্যুৎসহ তুমুল বৃষ্টি, তার পরেই আবার ঝকঝকে রোদ।
একটা সময় ছিল যখন বর্ষা মানেই আমার কাছে ছিল বিভীষিকা। প্যান্ট গুটিয়ে জল কাদা পেরিয়ে কাজে গিয়েছি, কতবার রাস্তার জলের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চালাতে গিয়ে গাড়ীর ডিস্ট্রিবিউটর এ জল ঢুকে গাড়ী বন্ধ হয়ে গেছে, লোক ডেকে গাড়ী ঠেলতে হয়েছে। বৃষ্টি বা মেঘলা আকাশ উপভোগ করার অবকাশ তখন আমার ছিলোনা। বর্ষা মানেই তখন ভোগান্তি।
কিন্তু এখন আমার অবসর জীবন, এখন কাজে বেরোবার কোন তাড়া নেই, কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এখন আমার এমন কোন কাজ নেই যা কিনা দুই বা তিন দিন ফেলে রাখা যায়না। আমার হাতে এখন অনেক সময় আর যা খুসী করার অবাধ স্বাধীনতা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঘলা আকাশ দেখলেই বেশ মন ভালো হয়ে যায়, বাড়ী থেকে আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করেনা। চা খেতে খেতে আরাম করে খবরের কাগজ পড়ি, এফ এম চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান শুনি।
অবসরের পরে বর্ষাকাল এর মজাই আলাদা।

আমি যে অঞ্চলে থাকি, ঢাকুরিয়া লেকের কাছে, সেখানে সাদার্ণ এভিনিউর দু’দিকে অনেক বড় বড় গাছ, বট অশ্বথ, ছাতিম, জারুল, নিম, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, শিমূল আরও সব কত নাম না জানা গাছ। বছরের অন্য সময়ে জায়গাটা বেশ ময়লা লাগে, কেমন যেন যত্নের অভাব, রাস্তায় জঞ্জাল আর শুকনো পাতা পড়ে থাকে, গাছের পাতা ধুলোয় বিবর্ণ, মলিন।কিন্তু এখন এই বর্ষায় সমস্ত পরিবেশটা এখন বেশ মায়াবী সবুজ আর পরিস্কার, বৃষ্টির জলে ধোয়া গাছের পাতা চকচকে সতেজ, সজীব, ঝলমলে ~
তো এর মধ্যে একদিন গাড়ীতে সাদার্ণ এভিনিউ দিয়ে যাচ্ছি, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে, এই সময় এফ এম এ রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান হচ্ছে নাকি? দেখি তো, ভেবে গাড়ীর রেডিও টা চালালাম।
দূর, কোথায় রবীন্দ্রনাথ, এফ এম এর ফাজিল ছেলেটা বর্ষা আর বৃষ্টি নিয়ে নানা রকম বাজে ইয়ার্কি মেরে যাচ্ছে।
একটু পরে সে যে গান টা বাজালো, সেটা বর্ষার গান বলা যাবে কিনা জানিনা।
——–
ইলিশ টা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো/এখন আর কেউ আটকাতে পারবেনা/
সরষে বাটাটা এবার তুমি শুরু করে দিতে পারো/
মা’কে বলে দাও রান্না চাপাতে শিগগির/
ইলিশ টা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি/
আর মাত্র ঘন্টা খানেক ব্যাস/
স্টারটিং এই খাবো দুটো মাছ ভাজা/ তার পরে ভাপা পাতুরী/
চুপ করে কেন বেলা, কিছু বলছোনা/
এটা কি টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান টু নাইন?
দুচ্ছাই, এটা কি…
————–
এখন তো আর নিজে গাড়ী চালাইনা, পিছনের সীটে আরাম করে বসে গান শুনতে শুনতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি বৃষ্টিভেজা রাস্তাঘাট, যান বাহন, সিনেমার পোস্টার বড় বড় হোর্ডিং আর রাস্তার দু’পাশে সবুজ গাছপালার ফাঁক দিয়ে মেঘলা আকাশ। আর এই সব দেখতে দেখতে ভাবছি এখন আর আমায় এই শহর ছেড়ে আর কোথাও নির্ব্বাসনে যেতে হবেনা, আর ভাবতেই বেশ মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।
আগে কুয়েতে থাকতে ছুটিতে কলকাতায় কিছুদিন কাটিয়ে যেতাম, আর প্রত্যেকবার ছুটি শেষ হয়ে যাবার আগে কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে ভেবে মন বেশ খারাপ হয়ে থাকতো। কুয়েতে যাবার পরেও বেশ কিছুদিন লাগতো আবার ওখানকার “সুখী” জীবনে অভ্যস্ত হতে।
“সাদা কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহর” টা কে কেন যে এত ভাল লাগে! আর বর্ষা এলে সেই ভাল লাগাটা যেন আরও একটু বেশী!

-
মধ্যবিত্তের উইম্বলডন, ২০১৯

আমার বাবা আমায় স্কুলে থাকতে কলকাতায় সাউথ ক্লাবে BLTA (Bengla Lawn tennis Association) এর টেনিস কোচিং ক্লাসে ভর্ত্তি করে দিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের খেলা শেখাতেন নরেশ কুমার আর আখতার আলি। পাশের কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে দেখতাম জয়দীপ মুখার্জ্জি আর প্রেমজিৎ লালকে। সেই ১৯৬০ সালে তারা ভারতের দুই জন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন।
টেনিস এর প্রতি আমার মনে আকর্ষণ আর ভালবাসা জন্মায় সেই সময় থেকেই। বাবা নিজে খুব ভাল টেনিস খেলতেন সাউথ ক্লাবে মেম্বার ছিলেন, ওখানকার অনেকের সাথেই ওঁর ভাল আলাপ ছিল। সুমন্ত মিশ্র, অধীপ মুখার্জ্জী, হরিগোপাল দাশগুপ্ত দের সাথে প্রায়ই ক্লাবে বসে গল্প আর হাসি ঠাট্টা করতেন। তাছাড়া কাস্টমস ক্লাবে প্রতি রবিবার গিয়ে ওখানকার সবুজ লনে বন্ধুদের সাথে টেনিস খেলতেন। আমি কিছুটা টেনিস খেলতে শেখার পরে আমায় নিয়েও খেলেছেন।
আমাদের স্কুল জীবনে তো টিভি ছিলনা, BBC রেডিও ও পেতাম না। টেনিস এর খবর কাগজ পড়েই follow করতাম। রড লেভার, কেন রোজওয়াল, রয় ইমারসন, আমাদের রমানাথন কৃষ্ণণ। কে জিতলো কে হারলো সব খবর ছিল আমার নখদর্পণে।
এক বন্ধুর বাড়ীতে কালার টিভি তে প্রথম উইম্বল্ডন ফাইনাল দেখি সত্তরের দশকে। ম্যাকেনরো আর বর্গ। সেই সবুজ ঘাস, সেই সাদা পোষাকের খেলোয়াড়রা, সেই পরিবেশ, দেখে একেবারে মজে গিয়েছিলাম। তারপরে কত বছর কেটে গেছে, টি ভি তে উইম্বল্ডন ম্যাচ দেখা পারলে miss করিনি কখনো।
এতবার লন্ডন গেছি, কিন্তু উইম্বলডনের All England Lawn Tennis Club (AELTC) Ground এ কোনদিন খেলা দেখতে যাওয়া হয়নি।
এবছর আমার সেই আক্ষেপটা মিটলো।
আমার মেয়ে লটারীর টিকিট পেয়েছিল, সেন্টার কোর্টে দ্বিতীয় দিন। সেদিন সেখানে খেললো এঞ্জেলিকা কার্ব্বার, রজার ফেডারার আর সেরেনা উইলিয়ামস। একটার সময় খেলা শুরু, হিসেব করে দেখা গেল বাড়ী থেকে ক্লাবে পৌঁছতে ঘন্টা খানেক লাগবে।

বেলা দশটা নাগাদ ধীরেসুস্থে বেরোলাম। বাড়ীর কাছে Central line টিউব স্টেশন South Woodford, সেখান থেকে Stratford গিয়ে লাইন চেঞ্জ করে জুবিলী লাইন ধরে ওয়াটারলু স্টেশন। তারপর overland ট্রেণ ধরে উইম্বলডন। এখানে ঘড়ির কাঁটা ধরে ট্রেণ চলে, অতএব গন্তব্যে পৌঁছতে লাগলো ঠিক পঞ্চাশ মিনিট। সুন্দর আবহাওয়া এখন, বাইশ ডিগ্রী সেলশিয়াস। নীল আকাশ, সোনালী রোদ।
স্টেশনের বাইরে চারিদিকে অনেক বুথ, সেখানে ব্যাজ পরা volunteer রা সাহায্য করার জন্যে প্রস্তুত, তাদের কারুর হাতে tournament schedule, কারুর হাতে map, আর সবার মুখে হাসি।
স্টেশন থেকে All England Lawn Tennis Club (AELTC) Ground পর্য্যন্ত হেঁটে যেতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে, সামনেই ট্যাক্সির জন্যে লম্বা লাইন, সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। গাড়ীতে পাঁচজনের সীট, আড়াই পাউন্ড এক এক জনের। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম।
স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে গাড়ীর জানলা দিয়ে উইম্বলডন শহর টা কে বেশ বর্ধিষ্ণু বলে মনে হলো। রাস্তার পাশে সাজানো গোছানো দোকানপাট, বুটিক, সেলন, রেস্টুরেন্ট।, কালো ট্যাক্সি আর লাল দোতলা বাস চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। Tournament চলছে বলেই বোধ হয় রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড় ।
প্রথম দর্শনে উইম্বলডন শহর কে বেশ ভালোই লাগলো।
Club ground এ বারোটার মধ্যে পোঁছে গেলাম। ক্লাবের অনেক গুলো গেট। আমাদের গেট নাম্বার ১৩। অন্য এক গেটের সামনে দেখি বিরাট লাইন। সেটা হলো যাদের টিকিট নেই তাদের জন্যে। সকাল সকাল গেলে টিকিট পাওয়া যায় ছোট ছোট কোর্টের। একশো পাউন্ডের এর কাছাকাছি দাম। তাছাড়া পঁচিশ পাউন্ডে শুধু ভেতরে ঢোকার টিকিট ও আছে। Henman Hill এর সবুজ ঘাসে বসে বড় স্ক্রীনে ভাল খেলা দেখার সাথে সাথে family আর বন্ধুবান্ধব কে নিয়ে একটা পিকনিক ও হয়ে যায়।
আর বেলা যত এগোয় তত যারা খেলা দেখে চলে যায় তাদের টিকিট তারা ক্লাব কে দিয়ে যেতে পারে। সেই used ticket এর জন্যেও আলাদা কাউন্টার আছে। তার দাম পাঁচ পাউন্ড।
Security check এর পরে তেরো নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে জনসমুদ্র।
এত লোক?
সব কোর্ট মিলিয়ে শুনেছি এখানকার capacity বড় জোর চল্লিশ হাজার, Wembley বা আমাদের Eden Gardens এর তুলনায় কিছুই না। এদের মধ্যে একটা বড় অংশের কোর্টে যাবার টিকিট নেই, তারা এসেছে সেখানকার উৎসবের পরিবেশটা উপভোগ করতে। প্রত্যেকে খুব সাজগোজ করে এসেছে, ছেলেদের মাথায় ফেল্টের হ্যাট, হাতে চুরুট, মেয়েদের চোখে বাহারী সানগ্লাস।
ভীড়ের আর একটা কারণ ক্লাবের ভিতরে হাঁটার রাস্তা বেশী চওড়া নয় , কোর্ট গুলো অনেক জায়গা নিয়ে নিয়েছে।



আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে জায়গাটার সাথে পরিচিত হলাম। বিশাল সেন্টার কোর্ট, তার সামনে ফ্রেড পেরীর স্ট্যাচু। আমার মতো যারা টেনিস খেলেছে বা টেনিস খেলাটা কে ভালোবাসে, তাদের কাছে উইম্বলডন হলো একটি তীর্থক্ষেত্র। তাদের কাছে এই জায়গার aura ই আলাদা। বেশ বিহবল বোধ করছিলাম মনে মনে।
সামনেই শ্যাম্পেন, Pimms, Strawberry and cream, Pizza ইত্যাদির স্টল, সেখানে লম্বা লাইন। আমরা সেন্টার কোর্টের গেট সন্ধান করে জেনে নিয়ে কিছু ছবি তুলে লাইনে দাঁড়িয়ে স্যান্ডউইচ আর শ্যাম্পেন কিনে এক জায়গায় বসে খেয়ে নিলাম।
একটা বাজতে আর পনেরো মিনিট বাকি। এবার সীটে গিয়ে বসার সময় হয়েছে।
সেন্টার কোর্টের একদম ওপরে আমাদের সীট। গেট ৫১১। পাঁচ তলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে দম বেরিয়ে গেল। বেশ সরু প্যাসেজ আর তুমুল ভীড়। ব্যাজ পরা Volunteer আর Security র লোকেরা চারিদিকে দাঁড়িয়ে।
৫১১ তে পোঁছে গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো নীচে বহু নীচে সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা কোর্ট, আর দর্শকে ঠাসা কোর্টের চারিদিক। ছাদ এর Cover খোলা, তাই রোদ এসে ভরিয়ে দিয়েছে সবুজ ঘাসের কোর্ট আর গ্যালারী।
অত ওপর থেকে বেশ লাগছিলো। Bird’s eye view যাকে বলে।



খেলা শুরু হলো কাঁটায় কাঁটায় একটায়, গত বছরের চ্যাম্পিয়ন Angelique Kerber আর Tatjana Maria নামে একজন অচেনা মেয়ের, দু’জনেই জার্মান। টি ভি তে যেরকম দেখি সবই একরকম, কেবল খুব ওপর থেকে দেখা বলে অন্যরকম লাগছে।
চারিদিক তাকিয়ে দেখছি এমন সময় হঠাৎ হাততালির শব্দ!
কি ব্যাপার?
দেখি দুজন প্লেয়ার মাঠে ঢুকছে, দর্শকরা প্রথা অনুযায়ী তাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। তারপরে টস আর কিছুক্ষণ প্র্যাকটিস। আম্পায়ার “টাইম” বলার পরে ম্যাচ শুরু।
সারা জীবন এতগুলো বছর High Definition large screen colour TV তে টেনিস খেলা দেখেছি। সেখানে ক্যামেরার গুণে বাড়ীতে বসেই মনে হয় যেন কোর্ট সাইডে বসে খেলা দেখছি। সেই যেরকম সাঊথ ক্লাবের কাঠের গ্যালারীতে বসে সামনা সামনি জয়দীপ প্রেমজিত এর প্র্যাক্টিস ম্যাচ বা বা ডেভিস কাপে রয় ইমারসন রমানাথন কৃষ্ণন এর খেলা দেখতাম।
সেই অভিজ্ঞতার সাথে এত ওপর থেকে খেলা দেখার মধ্যে অনেক তফাত। তার ওপর আমাদের বাইনোকুলার ও নেই। থাকলেও কত সুবিধে হতো কে জানে।
কিন্তু আমি নিজেকে বোঝালাম আমি তো খেলা দেখতে আসিনি, আমি এসেছি এখানকার পরিবেশ দেখতে, Wimbledon Centre Court এ যে একদিন এসে খেলা দেখেছি এটাই কি যথেষ্ট নয়? আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিছু আশা আকাঙ্খা থাকে, যা পূর্ণ না হলে মনের ভিতরে কেমন যেন একটা খেদ থেকে যায়।
এখন এতদিন পরে আমি এখানে। আজ যদি খেলা টা ভাল ভাবে নাও দেখতে পারি, এখানকার এই পরিবেশটা চুটিয়ে উপভোগ করে নিই।
ফার্স্ট রাউন্ডের খেলা তো একপেশে one sided হবে জানাই কথা, সেদিন কার্বার আর সেরেনা দু’জনেই সহজে স্ট্রেট সেটে জিতলো। রজার কিছুটা অবাক করে ফার্স্ট সেটটা হেরে পরের তিন সেটে উড়িয়ে দিলো তার প্রথম রাউন্ডের প্রতিযোগীকে।
রজার ফেডারার কে এখন ঘাসের কোর্টের সর্ব্বকালের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ টেনিস খেলোয়াড় বলা হয়, তার খেলা উইম্বলডন সেণ্টার কোর্টে বসে দেখছি ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। চার সেট খেলার জন্যে রজারের শিল্পসুষমা ভরা খেলার অনেক নিদর্শন দেখলাম।




খেলার মাঝে মাঝে খেলোয়াড় দের বিশ্রামের সময় দর্শকরা উঠে চলাফেরা করতে পারে, কিন্তু খেলা চলার সময় gallery তে কোন movement চলবেনা। বাইরে করিডরে যাবার দরজা আটকে দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে, ঢোকা বেরনো দুটোই বারণ।আমি একবার বাথরুমে যাবো বলে বাইরে বেরিয়ে আটকে গেলাম, দুটো গেম খেলা শেষ হবার পরে প্রহরীরা ভেতরে ঢুকতে দিলো। আমার সাথে অবশ্য বাইরে বহু লোক ছিল, সবাই ভিতরে ঢুকবে।
প্রতি খেলার পরে মিনিট পনেরো ব্রেক, তার মধ্যে বাইরে বেরিয়ে করিডর দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে toilet আর refreshment shop। দুই জায়গাতেই বিশাল লম্বা লাইন। রজারের খেলা শুরু হবার আগে আমরা Elderberry drink আর উইম্বলডনের বিখ্যাত Strawberry and cream কিনে নিয়ে এলাম। এবছর শুনেছিলাম উইম্বলডনে স্ট্রবেরী বেশী আমদানী হয়নি, যাও বা পাওয়া গেছে তাও তেমন সুবিধের নয়। আমাদের তো একেবারেই ভাল লাগলোনা। জঘন্য টক। তবু হাসিমুখেই খেলাম।
ফেডারার এর পরে সেদিনের শেষ ম্যাচ ছিল সেরেনার। সে প্রথম সেটটা জেতার পরে আমি সুভদ্রা আর পুপু কে বললাম তোমরা খেলা দ্যাখো, আমি একটু বাইরে বেরিয়ে জায়গাটা ঘুরে দেখে আসি।
টিকিটের সাথে Ticket holder’s guide নামে একটা booklet এসেছে, তাতে সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লেখা, সেখানে সব কোর্টের ম্যাপ আঁকা আছে, সেই ম্যাপ দেখে দেখে ভীড়ের মধ্যে গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। সব মিলিয়ে আঠেরোটা কোর্ট, তার মধ্যে সেন্টার কোর্ট আর এক নম্বর কোর্টের ছাদ আছে, তাদের মাঝখানে চৌদ্দ থেকে সতেরো নম্বর কোর্ট সেখানে সাধারণ কাঠের গ্যালারী। আমাদের সাউথ ক্লাবের মতই। সব কোর্টেই খেলা চলছে, তবে বাইরে থেকে খেলা দেখার উপায় নেই। ঘাসে বল বাউন্স করার অবিরাম শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। সব গ্যালারী ই লোকে ভর্ত্তি।

সতেরো নম্বর কোর্টের পরে হেনম্যান হিল, একটা সিঁড়ি উঠে গেছে তার পাশ দিয়ে। হেনম্যান হিলের সামনে বড় টিভিতে নাদালের খেলা দেখানো হচ্ছে, আর অন্য দিকে সিঁড়ির ওপাশে উঁচু আঠেরো নম্বর কোর্ট।সেই কোর্ট covered না হলেও অনেক উঁচু তে। এবং তার capacity ও বেশী।
হেনম্যান হিলে লোক গিজগিজ করছে, ঘাসের ওপরে বসে সবাই সামনে টিভিতে নাদালের খেলা দেখছে, একটা মেলার মত পরিবেশ। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। সবাই খুব সেজে গুজে এসেছে, বিশেষ করে মহিলাদের বেশভূষা দেখলে তাদের খুব upmarket বলে বোঝা যায়, উইম্বলডন হলো একটা বনেদী দের গার্ডেন পার্টি। আমি গরীব মধ্যবিত্ত সেখানে খানিকটা হলেও বেমানান।




সুভদ্রা আর পুপু বেরিয়ে আসার পর তিন জনে মিলে Souvenir shopping সেরে গিয়ে একটা open air cafe তে গিয়ে কফি নিয়ে বসলাম। তখন খেলা সব প্রায় শেষ, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তবু এত ভীড়, কফি শপে বসবার জায়গা পেতেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল।
উইম্বল্ডনে খুব সবুজ রং এর আধিক্য, green environment নিয়ে AELTC অনেক কাজও করছে। কোর্ট গুলো তো সবই চোখ জোড়ানো সবুজ ঘাসের, তাছাড়া হেনম্যান হিল এও যেন ঘাসের গালিচা পাতা। গ্যালারীর স্ট্যান্ড সব গাঢ় সবুজ আর সেন্টার কোর্ট বিল্ডিং এর দেয়ালেও চারিদিকে সবুজ রং।এর আগে নাকি ঘাস দিয়েই দেয়াল ঢাকা থাকতো, কিন্তু গরমে ঘাস শুকিয়ে যায় তাই এখন artificial grass..আমার চোখে অবশ্য বেশ underwhelming লাগলো।


গেট থেকে যখন বেরোলাম তখন সন্ধ্যা নামছে। স্টেশনে যাবার ট্যাক্সি পাবার জন্যে বিশাল লম্বা লাইন। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে আলাপ হয়ে গেল একটি ভারতীয় পরিবারের সাথে, স্বামী স্ত্রী, তারা আমেরিকা থেকে এসেছে। তবে টেনিসের থেকে ক্রিকেটেই তাদের উৎসাহ বেশী। এখন ইংল্যান্ডে Limited Over ক্রিকেটের World Cup এর খেলা চলছে। তারা ক্রিকেটের ভক্ত, একটা সেমি ফাইনালের টিকিট পেয়েছে। ভারত এবার জিতবে world cup জিতবে নিশ্চয়। কি বলেন?
উইম্বলডনে টেনিস খেলা দেখতে এসে ক্রিকেট নিয়ে ওই দু’জনের সাথে আলোচনা করলাম ট্যাক্সি না আসা পর্য্যন্ত। এই ক্রিকেট পাগলদের পাল্লায় পড়ে শেষটা একটু anti climax এর মত হয়ে গেল।
সেবছর লর্ডসে পঞ্চাশ ওভার One day ক্রিকেট ফাইনাল আর উইম্বলডনে পুরুষদের টেনিস ফাইনাল এই দুটো ম্যাচ এক দিনে প্রায় এক সাথে খেলা হয়েছিল। এবং দুটোই রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। ইংল্যান্ড ক্রিকেটে হারিয়েছিল নিউজিল্যান্ডকে আর টেনিসে নোভাকের কাছে পাঁচ সেটের ম্যাচে হেরে গিয়েছিল রজার। দুটো ম্যাচেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল, শেষে দুটোই টাই ব্রেক পর্য্যন্ত গড়ায়। আমি বাড়ীতে বসে টিভি চ্যানেল ঘন ঘন পালটে সেই দুটো খেলাই দেখেছি সেদিন।
তবে সত্যি বলতে কি উইম্বলডনে ওই পাঁচ তলার ওপর থেকে খেলা দেখার থেকে বাড়ীতে আরাম করে টিভির সামনে বসে খেলা দেখার কোন তুলনাই হয়না। প্রথমতঃ সেখানে কোর্টের সামনের সীটে বসে খেলা দেখার টিকিটের দাম আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভাগ্যে লটারীর শিকে ছিঁড়লে যা বুঝলাম ওই ওপর থেকেই খেলা দেখতে হবে। আর বাড়ীতে বসে টিভিতে High resolution ক্যামেরার সৌজন্যে আমি ওই সামনে বসে থাকা গ্যালারীর দর্শকদের থেকেও অনেক বেশী কাছ থেকে খেলা দেখছি বলে মনে হয়। খেলোয়াড়দের যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে, তাদের মুখের অভিব্যক্তি – ব্যর্থতার গ্লানি কিংবা সাফল্যের আনন্দ – স্পিনে বল কেমন ঘুরছে, ঘাসে বল পড়লে ধূলো উড়ছে, এই সব পরিস্কার দেখতে পাই।
আমি আর উইম্বলডন যাচ্ছিনা। একবার গিয়ে দেখে নিলাম, ব্যাস, আমার বাকেট লিস্টে টিক্ পড়ে গেছে। ওই বিখ্যাত স্ট্রবেরী আর ক্রীম খাবার কোন ইচ্ছেও আমার আর নেই। বডড টক!
আমার জন্য নিজের ঘর আর টিভি ই ভালো।

-
কুয়েতে পাগলা ঘোড়া

১ – নাটক
২০০৯ সালের ২৭ শে নভেম্বর (শুক্রবার) সন্ধ্যায় কুয়েতের সালমিয়ার ইন্ডিয়ান স্কুলের স্টেজে আমরা বাদল সরকারের “পাগলা ঘোড়া” নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম। ষাট সত্তরের দশকে কলকাতায় এই নাটকটি সাফল্যের সাথে প্রথম মঞ্চস্থ করেন বহুরূপী। তারপর এতগুলো বছরে নাটকটি বহু ভাষায় অনুদিত হয়ে পৃথিবীর বহু জায়গায় আজও অভিনীত হয়ে চলেছে।
পাগলা ঘোড়া নাটকের ভিতরে চারটে গল্প। প্রত্যেকটি গল্পের মূল বিষয় হলো পুরুষ আর নারীর সম্পর্ক নিয়ে। প্রতি গল্পেই মেয়েদের ভালবাসা হলো নিঃস্বর্ত্ব আত্মসমর্পন, আর পুরুষদের প্রেম মানেই হলো একতরফা অধিকারবোধ আর প্রত্যাখ্যান।
যদিও বাদল বাবু এই নাটক কে ভালবাসার নাটক বলেছেন, কিন্তু মনে করা হয় নাটকটি আমাদের দেশে একদিকে patriarchal সমাজ, আর অন্যদিকে মেয়েদের lack of empowerment নিয়ে লেখা।
এই নাটকের পটভূমিকা হল গ্রামের প্রান্তে একটি শ্মশান। সেখানে এক রাতে চারজন পুরুষ এসেছে একটি মেয়ের মৃতদেহ দাহ করতে। সেই শ্মশানবন্ধুরা হলো কার্ত্তিক কম্পাউন্ডার, পোস্টমাস্টার শশী, কন্ট্রাকটর সাতকড়ি (সাতু) আর এদের থেকে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়েসী তরুণ স্কুলশিক্ষক হিমাদ্রি। বাইরে চিতা জ্বলছে, আর ঘরের ভিতরে সময় কাটাবার জন্যে একটা তক্তাপোষে বসে তাস খেলছে ওই চার জন, সাথে সাতুর আনা বিলায়েতী হুইস্কি।
হঠাৎই ওই চারজনের মধ্যে এসে হাজির হয় আর একজন। যে মেয়েটির দেহ পুড়ছে বাইরের চিতায়, এ হলো সেই মেয়েটির অশরীরী আত্মা। ওই চার জন তাকে দেখতে পায়না, কিন্তু সে তাদের আশেপাশে ঘোরে, তাদের সাথে কথা বলে। রাত বাড়ে, চার জনের নেশা ক্রমশঃ জমে ওঠে। আর অদৃশ্য সেই মেয়েটি কেমন করে যেন একটা অদ্ভুত প্রভাব ফেলতে শুরু করে তাদের মনের ওপরে। মেয়েটি বার বার তাদের জীবনের ভালোবাসার গল্প বলতে উৎসাহিত আর অনুপ্রাণিত করতে থাকে।
“বলো না তোমার গল্পটা? খুব মিষ্টি গল্প! আমার খুব ভালো লাগে।”
তারপরে গ্রামের শ্মশানের সেই গা ছমছম করা অন্ধকার রাতে, এক এক করে বেরিয়ে আসে তাদের চার জনের জীবনের চারটি ভালোবাসার গল্প। প্রেম আর অপ্রেম, নিবেদন আর প্রত্যাখ্যান, আকুলতা আর যন্ত্রণা, পাওয়া আর পেয়ে হারানোর সেই চারটে গল্প নাটকের মধ্যে ফ্ল্যাশ ব্যাক এর মধ্যে দিয়ে দর্শকদের সামনে ফুটে ওঠে।




২) মঞ্চ, আলো, আবহ আর পোষাক
পাগলা ঘোড়া নাটকের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মঞ্চ।
প্রথমতঃ সেখানে শ্মশানের পরিবেশ ফোটাতে হবে। তারপর আরও নানা ঝামেলা। অশরীরি আত্মা, চার চারটে আলাদা গল্প। শশীর সাথে মালতী, হিমাদ্রির সাথে মিলি, সাতুর সাথে লক্ষ্মী, আর কার্ত্তিকের সাথে ওই মেয়েটা যে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গুগল করে দেখা গেল বহুরূপীর পাগলা ঘোড়া নাটকে খালেদ চৌধুরীর স্টেজ একেবারে authentic শ্মশান ! বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরী একচালা ঘর, দেয়ালে চাটাই আর মাদুর, টিমটিম করে লন্ঠনের আলো জ্বলছে। বাইরে একটা ফাঁকা জায়গা, এক পাশে গাছের তলায় একটা বেদী আর অন্য দিকে জ্বলন্ত চিতা।
আবার USA র New Jersey তে অমল পালেকারের সাম্প্রতিক নাটকে স্টেজ হলো modern আর abstract, তাকে শ্মশান বলে বোঝার জো নেই। একটা ভাঙা চোরা লাল ইঁট বের করা দেয়াল, আর ঝকঝকে বিশাল স্টেজ জুড়ে চারটে নানা লেভেলের rectangular platform, এক একটা লেভেলে এক জনের flash back সীন, আর প্রত্যেক সীন আলাদা করে বোঝাবার জন্যে আলাদা রং এর আলো।
বাস্তব না বিমূর্ত? আমরা বাস্তবের দিকেই ঝুঁকলাম।


নাটকে নয়টা ফ্ল্যাশব্যাক সীন, যেখানে ওই চারজনের অতীত জীবন ফুটে উঠবে। সুতরাং মঞ্চকে দুই ভাগে ভাগ করে একদিকে দেখাতে হবে একটা ঘরে চারজন তাস খেলছে, আর অন্য দিকে দেখাতে হবে ফ্ল্যাশ ব্যাক সীনগুলো। নাটক মাঝে মাঝেই দর্শকদের নিয়ে যাবে বর্ত্তমান থেকে অতীতে। আর সেই time travel বোঝাতে আমাদের ব্যবহার করতে হবে আলো আর আবহ।
মঞ্চ তৈরীর ভার যার ওপর তার নাম হলো পার্থসারথি বর্দ্ধন। সে আবহের ও দায়িত্বে। আর আলোর ভার নিয়েছে অমিতেন্দ্র বাগচী।
বর্ত্তমান থেকে অতীতে যাবার মূহুর্ত্তে এবং অতীত থেকে বর্ত্তমানে ফিরে আসার মূহুর্ত্তে দর্শকদের বোঝানোর জন্যে আমরা বিশেষ একটা ভূতুড়ে আবহসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলাম। আর স্টেজের যে দিকে অভিনয় চলছে, সেদিকটা আলোকিত করে তখন অন্যদিকে কিছুটা অন্ধকার করে রাখতে হবে। ফ্ল্যাশব্যাক সীনে অভিনয় চলার সময় অন্যদিকে তক্তাপোষে বসা অল্প আলোয় দেখা যাবে তাস খেলোয়াড়রা freeze করে গেছে, তারা হাত পা নাড়াচ্ছেনা, কথা বলছেনা, তারা একেবারে স্ট্যাচুর মত নিশ্চুপ।
বাদল সরকারের অনেক নাটকে আঙ্গিকের এই ধরণের অভিনবত্ব দেখা যায়। ষাটের দশকে তাঁর নাটকগুলো জনপ্রিয় হবার পিছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল।
নাটকে চারটি মেয়ে। আমাদের নাটকে দীপা একাই চারটে রোল করছে। সুতরাং তাকে আলাদা করে দর্শকদের কাছে পৌছনোর জন্যে আমরা পোষাক আর অন্য প্রপ্ ব্যবহার করেছিলাম। যে মেয়েটি র অশরীরি আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সাথে মালতীর তফাত বোঝাতে মালতীর গায়ে একটা শাল। আর মিলি অল্পবয়েসী বড়লোকের মেয়ে, তার পায়ে হিল তোলা জুতো, চলায় একটা ছন্দ, কথা বলার ভঙ্গীতে একটা মাদকতা। লক্ষীকে করে দিলাম কাঠ বাঙাল। তার সংলাপ গুলো সব বাঙাল ভাষায় লেখা হলো।
বাদল বাবু তো আঙ্গিক তৈরী করেই খালাস, এদিকে সেই সব আঙ্গিক নাটকে প্রয়োগ করতে গেলে অনেক হ্যাপা পোয়াতে হয়।




৩ – আমাদের মঞ্চ নির্মাণ
বহুরূপীর design follow করে পার্থ আমাদের স্টেজ কে দুই ভাগে ভাগ করেছে, এক দিকে ঘর যেখানে চৌকি আর তক্তাপোষের ওপরে বসে চারজন তাস খেলবে, আর অন্যদিকে ফাঁকা একটু জায়গা আর একটা বেদী আর চাতাল যার মাঝখানে একটা গাছ, সেখানে flash back সীন গুলো হবে। ঘরের তিন দিকে কোন দেয়াল নেই, পিছনে একটা প্লাস্টার ওঠা স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আর দু’দিকে শুধু দুটো জানলা আর একটা দরজার ফ্রেম। একটা নীচু মত দেয়ালও পিছনে (half wall) রাখা হলো, সেখানে চার জন মাঝে মাঝে গিয়ে বসবে।
তো শো এর দিন (শুক্রবার) সকাল দশটা নাগাদ ইন্ডিয়ান স্কুলে গিয়ে দেখি পার্থ তার সাকরেদদের নিয়ে কাজে লেগে গেছে। কাজের সরঞ্জাম সব পার্থ যোগাড় করে নিয়ে এসেছে। থার্ম্মোকোল, পেন্ট, ব্রাশ, কাঁচি, ছুরি, দড়ি, তার, সুতো, আঠা, পেরেক, হাতুড়ি ইত্যাদি আরও যা যা কিছু দরকার। এছাড়া নানা রকম prop যেমন মা কালীর ছবি, গামছা, লন্ঠন চিতা জ্বালাবার জন্যে Electronic fire এই সব।
স্টেজটা চোখের সামনে আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে লাগলো।
কুয়েতের রাস্তায় এখন অনেক ঝাঁকড়া গাছ, সেই গাছের বেশ কিছু ডাল কেটে এনেছে পার্থ। একটা গাছ বসবে স্টেজে চাতালের বেদীর মাঝখানে, আর বাকি ডালগুলো কেটে ছুলে চিতার কাঠ বানানো হবে। পার্থ কাঠগুলো কে একটার পর একটা layer করে সাজিয়ে স্টেজের সামনে রেখে দিয়ে তার ওপরে Electronic fire জ্বালিয়ে দিলেই বেশ চিতা বলে মনে হবে।
পার্থ বেদীতে একটা leafy গাছের ডাল দাঁড় করিয়ে ডালটা যাতে বেঁকে পড়ে না যায় সে জন্যে তিন দিকে তিনটে তার দিয়ে বেদীর নীচে কাঠের baton এর সাথে বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ডাল টাকে এবার বেশ গাছ গাছ মনে হচ্ছে।
ঘরের পিছনে দেয়ালটা পার্থ থার্ম্মোকোল দিয়ে তৈরী করলো, তার মধ্যে কিছু জায়গায় প্লাস্টার খোলা লাল ইঁট আঁকা। স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল বোঝাতে কিছু জায়গায় ভিজে বোঝাতে নীল রং বুলিয়ে দেওয়া হলো। জানলা দরজার ফ্রেম গুলো stable আর strong করার জন্যে পার্থ সেগুলো নীচে কাঠের platform এর সাথে শক্ত করে তার দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
বিকেল পাঁচটার আগেই স্টেজ ready হয়ে গেল। বহুরূপীর মত authentic শ্মশান তৈরী করতে না পারলেও আমাদের শ্মশান মোটের ওপর বিশ্বাসযোগ্য।
সব শেষে কিছু খুচরো কাজ ছিল, যেমন দেয়ালে কিছু পেরেক ঠুকে মা কালীর ছবি, বাংলা ক্যালেন্ডার এই সব লাগানো। গামছা আর এক ঘটা গঙ্গাজল লাগবে লাস্ট সীনে। গামছা টাঙাবার জন্যে একটা দড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হলো পিছনে। লন্ঠনটা দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো নিয়ে আমার মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল, আমার ইচ্ছে ছিল ওটাকে half wall এর ওপরে রাখতে। আমি পার্থ কে বললাম “দেখো, লন্ঠন টা পেরেকে ঝোলালে, পড়ে যাবে না তো?”
পার্থ বললো, “আরে না না”…



৩ – কি হতে পারতো, কিন্তু হয়নি
বাদল সরকারের এই নাটক কে জনপ্রিয় করার পিছনে বহুরূপী আর শম্ভু মিত্রের অবদান অনস্বীকার্য্য, তাই নাটকের শুরুতেই আমরা বি সি এসের তরফে আমাদের এই নাটককে শম্ভু মিত্রের স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করলাম।
তারপর নাটক তো শুরু হয়ে গেল।
অমিতেন্দ্র আলোর সরঞ্জাম নিয়ে দরকার মত আলো জ্বালাচ্ছে নেবাচ্ছে, আর আমার অন্য পাশে পার্থ, তার কাজ হল ঠিক সময়ে Audio clip গুলো play করা। শ্মশানের রাত বোঝাতে ঝিঁঝিঁ পোকা আর শেয়াল কুকুরের ডাক, দূরে রেলগাড়ীর হুইসিল, এই সব ক্লিপ সে যোগাড় করে সি ডি তে রেকর্ড করে নিয়ে এসেছে। আমি বসে আছি ওদের দুজনের মাঝখানে।
সেদিন আমি খুব নার্ভাস ছিলাম, প্রথম থেকে tense হয়ে বসে ছিলাম সারাক্ষণ আর প্রতি মূহুর্ত্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কোন একটা ভুল হলো।
কতরকম ভুল হতে পারে আমাদের amateur নাটকে!
সেদিন সকাল থেকে সারা দিন পার্থর সাথে থেকে চোখের সামনে একটু একটু করে স্টেজ তৈরী হতে দেখেছি। বাইরে চাতালের গাছটা জানি পার্থ পাতলা তিনটে তার দিয়ে শক্ত করে বেদীর নীচে কাঠের ব্যাটন পুঁতে তার সাথে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু কি জানি সেই সুতো খুলে গাছটা দুম করে মেয়েটার মাথার ওপরে পড়বেনা তো? বলা যায়না।
দুপুরে পার্থ মাঝে মাঝে দেয়ালে পেরেক ঠোকার সময়ে লাল ইঁটের থার্মোকোল খুলে পড়ছিল। মাত্র কয়েক ঘন্টায় এখন glue কি শুকিয়েছে, না সেগুলো এখনো আলগা আছে? হঠাৎ দেয়ালে কারুর হাত লাগলে খুলে পড়লে তো হয়েছে আর কি! দর্শকরা কি ভাববে যে পুরনো বাড়ী, তাই দেয়াল ভেঙে পড়ছে?
তার ওপরে আরও কত চিন্তা!
প্রথম সীনে সেই অশরীরি মেয়েটির হাসির সীনে দেয়ালের পিছনে মেয়েটাকে উঁচুতে তোলার জন্যে একটা চেয়ার আর তার ওপরে দাঁড়াবার জন্যে একটা টুল রাখা আছে। সেখানে উঠতে বা নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে সে পা ভাঙলেই তো কেলেঙ্কারী।
সাতু যখন খুব ভাবপ্রবণ হয়ে জানলার ফ্রেমে হাত দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় তার সংলাপ বলছে আমি দেখছি জানলার ফ্রেমটা ভূমিকম্পের মত দুলছে। এই রে, এখন জানলা শুদ্ধ সাতু উলটে পড়বে না কি? চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, ওরে সাতু সাবধান, জানলা তে হাত দিস্না, জানলা শুদ্ধ উলটে পড়বি!
কিন্তু thankfully এসব কিছুই হলোনা।
বরং কিছু কিছু জায়গায় দেখলাম ওরা বেশ নিজেরাই উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু মুস্কিল আসান করে দিলো। বিলায়েতী হুইস্কির বদলে আমরা বোতলে ভরে লাল চা নিয়ে এসেছিলাম। বোতল দেখে যাতে বোঝা না যায় জনি ওয়াকার বা অন্য কোন চেনা ব্র্যান্ড। খবরের কাগজে নাটকের ছবি বেরোবে, সেখানে জনি ওয়াকারের বোতল দেখলে তো নির্ঘাত জেল এবং দেশ থেকে বহিস্কার। সাদামাটা কাঁচের বোতল জোগাড় করা হয়েছিল নাটকের জন্যে। তো যাই হোক, একটা সীনে কারুর হাতে লেগে কিছুটা চা গ্লাস থেকে চলকে তক্তপোষে পড়ে যায়। হিমাদ্রী দেখলাম smartly উঠে গামছা দিয়ে জায়গাটা মুছে পরিস্কার করে দিলো।
নাটকের মধ্যে মাঝে মাঝেই হুইস্কির গেলাস refill করতে হচ্ছে, কিন্তু মুস্কিল হল দু’ঘন্টা ধরে কত আর ঠান্ডা চা খাওয়া যায়? তাই গেলাস আর কারুর ফুরোচ্ছেনা। এক সীনে সাতু “দিন শশী বাবু, আপনার গেলাসটা ভরে দিই” বলতে গিয়ে দেখে গেলাসটা already ভরা। সে চমৎকার সংলাপটা বদলে বললো “শশীবাবু আপনার গেলাস তো ভরাই আছে মশাই, খান্, খান্…”
এদিকে আমি সামনে বসে চমকে উঠলাম। “ভরাই আছে?” ওরকম কোন সংলাপ তো ছিলোনা নাটকে?



তো যাই হোক, লন্ঠনটা শেষ পর্য্যন্ত পড়ে ভাঙেনি ঠিকই, কিন্তু পড়ে গেলেও আমার মনে হয় ওরা পাঁচ জন ঠিক সামলে নিতো।
ধরা যাক হঠাৎ লন্ঠনটা দুম করে পড়ে ঝনঝন শব্দ করে চৌচির হয়ে ভেঙে গেল আর সেই কাঁচ ভাঙার আওয়াজ Floor mike গুলো capture আর amplify করে সারা হলে ছড়িয়ে দিলো।
তখন?
আমি জানি তাহলে নাটকের সংলাপগুলো একটু পালটে যেতো।
অনেকটা এই রকম~
———————————–
শশী (কিছুটা দার্শনিক ভঙ্গী তে গম্ভীর গলায়) – হুম্ম্ম্, লন্ঠনটা ভাঙলো তাহলে?
হিমাদ্রি (বিরক্ত হয়ে) – তা আর ভাঙবেনা শশী দা’? এত করে বললাম ওটা হাফ ওয়ালের ওপরে রাখুন। আপনি কথা শুনলেন না। দেখি এখন কাঁচ গুলো কুড়াই গিয়ে…
শশী (ওঠার নাম না করে, গ্যাঁট হয়ে বসে থেকে) – না না, তুমি কেন ? আমি, আমি দেখছি…
সাতু (জড়িত কন্ঠে) – আপনারা তো বেশ মুস্কিলে ফেললেন দেখছি – এখন আমি একটা ঝাঁটা পাই কোথায়…
কার্ত্তিক (হাত দুটো বাড়িয়ে নাটকীয় সুরে) – আরে ঝাঁটা দিয়ে কি হবে? আমার গামছাটা নিয়ে নাও না, ওটা তো লাস্ট সীনে কাজে লাগছেনা। দেখো হিমাদ্রি সাবধানে কুড়িও, কাঁচ যেন পায়ে না ফোটে…
মেয়েটা (কান্না কান্না গলায়) – এই তোমরা কি সারারাত শুধু ঝাঁট দিয়ে যাবে নাকি? তোমাদের গল্প গুলো বলবেনা? এদিকে আমি যে পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম…
সাতু (আরও জড়িত গলায়) – নাঃ আপনারা দেখছি আমাদের নাটকটার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিলেন মশাই।


নাঃ বারোটা কিছু বাজেনি, মোটের ওপরে নাটক টা ভালোয় ভালোয় উতরেই গেছে শেষ পর্য্যন্ত।
বি সি এসে র পক্ষ থেকে আমরা বাদল বাবু কে তাঁর সন্মানী চেক পাঠিয়েছি্লাম অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (কার্ত্তিক কম্পাউন্ডার) এর হাত দিয়ে, তিনি আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন অভিজিৎ এর হাতে। এই সাথে তার দুটো ছবি।
বাকি ছবি আমাদের কাস্ট পার্টির আর সবশেষে স্থানীয় খবরের কাগজ কুয়েত টাইমসে রিভিউ। সেখানে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, বলা বাহুল্য আমাদেরই লেখা।



