নতুন পোস্ট

  • বিয়ের আগে – মা vs বৌ

    ১ – কার রান্না?

    ১৯৭০ সাল, আমি ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানী (মার্কেটিং ডিভিসন) তে Management Trainee  হিসেবে জয়েন করে মুম্বাইতে গেছি।  আমাদের আট জনের ব্যাচে আমরা দুই জন বাঙ্গালী, সুমন্ত্র ঘোষাল, আর আমি। আমরা দু’জন সান্তা ক্রুজ ইস্ট (রেল লাইন এর পূব দিকে) একটা গেস্ট হাউসে একটা বড় ঘর নিয়ে থাকি।

    মুম্বাইতে হেড অফিসে আমাদের তিন মাস ক্লাস রুম ট্রেনিং, তাই রোজ সকাল আটটা নাগাদ স্নান টান সেরে বেরিয়ে আমরা কাছেই একটা ইরাণী রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট (মাসকা বান আর কলা) সেরে লাল রং এর দোতলা বাস (84 Limited) ধরে Worli তে আমাদের অফিসে চলে যাই। তারপরে সারা দিন ক্লাসে নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করে বিকেলে দোতলা বাসে চড়ে মুম্বাই শহর টা ঘুরে ঘুরে  দেখি।  সুমন্ত্র দিল্লীর ছেলে, আমি এসেছি কলকাতা থেকে। মুম্বাই শহরটা আমাদের দু’জনের চোখেই নতুন।

    সারা বিকেল শহরটা ঘুরে বেড়িয়ে দেখে সন্ধ্যায় আবার ট্রেণে বা বাসে চেপে বাড়ী।

    আমাদের ঘরে রান্নার বন্দোবস্ত ছিলনা, থাকলেও আমরা রান্না করতাম কিনা সন্দেহ। রাত্রের খাবারের জন্যে আমরা বোস বাবু বলে এক বাঙালী ভদ্রলোক কে ঠিক করেছিলাম, তিনি রোজ সন্ধ্যাবেলা টিফিন ক্যারিয়ারে করে আমাদের ডিনার দিয়ে যেতেন। মুম্বাইতে ওই ভাবে খাবার সাপ্লাই করার ট্র্যাডিশন বহুদিনের।

    বোসবাবু বাঙালী খাবার পাঠাতেন। ডাল, তরকারী, মাছের ঝোল। আমরা খেতাম আর অনুমান করতাম এই সব ওনার বাড়ীর রান্না। হয়তো ওনার মা বা বৌ এইসব রান্না করেন, এটা হলো ওঁদের family business…

    হয়তো একদিন একটা নিরামিষ তরকারী দারুন খেতে হয়েছে, সুমন্ত্র খেয়ে বলতো, বাঃ এই তরকারীটা দুর্দ্দান্ত লাগছে খেতে, এটা নিশ্চয় বোসবাবুর মা রান্না করেছেন।

    আবার কোন একদিন মাছের ঝোল মুখে বিস্বাদ লাগলে আমি বলতাম কি বিশ্রী হয়েছে খেতে, এই রান্নাটা বোস বাবুর বৌ রেঁধেছে নির্ঘাৎ!

    মা আর বৌ – ২ – কার জন্যে ফিরে যাবো?

    মাস দুয়েক ক্লাসরুম ট্রেনিং এর পরে আমাদের একটা ফিল্ড ট্রিপ হলো আমেদাবাদ আর বরোদা তে।

    সেখানে আমরা আঙ্কলেশ্বর Oil field আর বরোদার কয়ালী refinery দেখে অনেক কিছু জানবো শিখবো। আমাদের ট্রেণ মুম্বাই থেকে সন্ধ্যাবেলা ছাড়লো। আমরা আট জন Management Trainee, আমাদের সাথে আমাদের মেন্টর এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক তিনি বেশ মাই ডিয়ার লোক, ফর্সা, এক মাথা টাক, ছোটখাটো, হাসিখুসী মানুষ, তাঁর মুখ দেখেই তাঁকে বাঙ্গালী বলে চেনা যায়। আমি আর সুমন্ত্র তাঁকে মুকুল দা’ বলে ডাকি।  

    তো এক কম্পার্টমেন্ট এ সকলে মিলে বসে খুব আড্ডা চলছে। আড্ডার সাবজেক্ট হলো Love Marriage না Arranged marriage ? মুকুলদা’ আমাদের মডারেটর। বিয়ে নিয়ে এই অবিবাহিত যুবকদের তর্ক আর কথাবার্ত্তা শুনে তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন মনে হয়।

    কিছুক্ষণ আলোচনা চলার পরে হঠাৎ মুকুল দা’ বললেন আচ্ছা ধরো বিয়ের পরে তোমরা সবাই upward mobile corporate executive হয়েছো, অফিসের কাজে তোমরা খুব ব্যস্ত থাকো, তোমাদের সবার লক্ষ্য কোম্পানীতে তরতর করে ওপরে ওঠা, বাড়ীতে বৌকে বেশী সময় দিতে পারোনা। অফিসের একটা খুব important মিটিং এ তোমাদের ধরো কলকাতা বা দিল্লী থেকে হেড অফিস মুম্বাই তে ডাকা হয়েছে, এই মিটিং টা তোমাদের জন্যে attend করা খু্বই জরুরী, না attend করলে প্রোমোশন আটকে যেতে পারে। ট্রেণে করে মুম্বাই যাচ্ছো এমন সময় মাঝরাস্তায় একটা টেলিগ্রাম পেলে। তাতে লেখা “তোমার বৌ খুব অসুস্থ, হাসপাতালে, এখুনি ফিরে এসো!”

    তোমরা কি করবে? মিটিং ক্যানসেল করে বৌ এর কাছে ফিরে যাবে, না বৌ চুলোয় যাক, চাকরীতে উন্নতি অনেক বেশী দরকারী ভেবে মুম্বাই চলে যাবে?

    যতদূর মনে পড়ছে আমরা প্রায় সবাই বলেছিলাম মুম্বাই চলে যাবো। মুকুলদা’ আমাদের উত্তর শুনে মুচকি হেসেছিলেন।

    সুমন্ত্র পরে একটু ভেবে বলেছিল, “মুকুল দা’ আপনি যদি বৌয়ের বদলে মায়ের অসুখ বলতেন, তাহলে কিন্তু আমরা সকলে ফিরেই যেতাম! আমাদের তো বৌ নেই, তাই আমরা কেবল মা কেই চিনি!”

  • সরস্বতী পূজো এবং একটি মৃত্যু

    আমাদের ছোটবেলায় সেই পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে যখন মনোহরপুকুরের বাড়ীতে আমাদের মধ্যবিত্ত  যৌথপরিবারে  আমরা ভাইবোনেরা বড় হচ্ছি  – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা  সংগ্রামের  নানা  সংঘাত  ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে – সেই সময়ের কথা ভাবলে দেশের  মানুষের  জীবনে শান্তির একটা বাতাবরণ  নেমে আসার কথা মনে পড়ে। সেই শান্তির আবহ আমাদের পারিবারিক জীবনেও তার ছায়া ফেলেছিল।

    মধ্যবিত্ত পরিবার বড় হলেও আমাদের ভাইবোনদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত  করার জন্যে  আমাদের সুশিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে মা বাবাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলনা।  আর বাড়ীর বৌরা – আমাদের মা জ্যেঠীমা কাকীমারা – সর্ব্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন আমাদের পরিবারের এবং বিশেষ করে আমাদের ছোটদের কল্যাণ কামনায়।     

    সেই কল্যাণ কামনা থেকেই আমাদের জন্যে তাঁদের নানা ব্রত, নানা উপোস, নানা পূজো।  নীল ষষ্ঠী, শিবরাত্রি,  অক্ষয় তৃতীয়া…

    মনোহরপকুরের বাড়ীতে  সরস্বতী পূজো আর লক্ষ্মী পূজো দু’টোই হতো বেশ ধূমধাম করে। মা জ্যেঠিমা কাকীমারা সবাই খুব ভক্তি আর নিষ্ঠার সাথে পূজোর আয়োজন করতেন, আমাদের বাড়ীর সামনে টিনের চালের একতলা বাসায় থাকতেন হারু আর কানাই, দুই ভাই। ওঁদের মধ্যে একজন এসে পূজো করতেন।

    যেহেতু সরস্বতী হলেন বিদ্যার দেবী, তাই তাঁর পূজো আমাদের ছোটদের – যারা স্কুলে পড়ি এবং যাদের মা সরস্বতীর আশীর্ব্বাদ একান্ত প্রয়োজন –  তাদেরও পূজো ছিল , পূজোয় খুব মজা করতাম আমরা ভাইবোনেরা।

    আমাদের স্কুলের পাঠ্য বই আর কলম দেবীর সামনে রাখা হতো, “জয় জয় দেবী চরাচর সারে” বলে হাত জোড় করে আমরা সবাই অঞ্জলি দিতাম, বেলপাতায় খাগের কলম দিয়ে “ওঁ সরস্বতৈ নমো নিত্যং” লিখতাম।

    সরস্বতী পূজোর আগে কুল খাওয়া মানা ছিল, খেলে দেবী পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবেন এরকম একটা ধারণা আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা অনেকেই অবশ্য সেটা মানতাম না, মা সরস্বতী তাঁকে আগে না খাইয়ে নিজেরা কুল খেয়ে নিয়েছে বলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শাস্তি দিয়ে ফেল করিয়ে দেবেন, এত নিষ্ঠুর তিনি নন্‌।

    গুরুজনদের না জানিয়ে মাঝে মাঝে পূজোর আগেই কুল খেয়েছি এ কথা এতদিন পরে এখন স্বীকার করতে বাধা নেই। মা’রা বাড়ীতে নানা মিষ্টি – তিলের নাড়ু নারকোলের নাড়ু, গজা মালপোয়া ইত্যাদি তৈরী করতেন, কিন্তু যে মিষ্টির কথা সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে তা হলো কদমা। আদ্যোপান্ত চিনি দিয়ে তৈরী ওই গোল মিষ্টিটা আর কোন পূজোতে খেয়েছি বলে মনে পড়েনা।

    কদমা হলো সরস্বতী পূজোর মিষ্টি।

    আর যেটা মনে পড়ে তা হলো আমরা ভাইবোনেরা নানা রং এর কাগজ কেটে গদের আঠা দিয়ে অনেক লম্বা লম্বা শিকল বানিয়ে সেগুলো বারান্দার দেয়ালে আটকে দিতাম। সারা বারান্দা ঝলমলে সুন্দর হয়ে সেজে উঠতো, বেশ একটা উৎসবের মেজাজ নেমে আসতো আমাদের সকলের মনে।

    এতগুলো বছর কেটে গেছে, তবু এখনো প্রতি বছর সরস্বতী পূজো এলেই সেই শিকল বানানোর কাজে আমাদের ভাইবোনদের উৎসাহ আর উত্তেজনার কথা মনে পড়ে।

    আর মনে পড়ে ঠাকুর কিনতে যাবার কথা।

    একবার ১৯৬০ সালে, আমার তখন ক্লাস নাইন, সরস্বতী পূজোর দুই দিন আগে মেসোমশায় (রঞ্জুর বাবা, ভগবতী মাসীর -স্বামী) রাত প্রায় দশটা নাগাদ সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। উনি অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ছিলনা। কিন্তু অত রাতে মারা যাওয়াতে একটু logistical অসুবিধে হয়েছিল।

    মাসী ছিলেন মা’র ঠিক ওপরের বোন, ভগবতী নাম থেকে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ভাগু। সবার কাছে তিনি ছিলেন ভাগুদি। আর ওই দুই বোন ছিলেন ভীষন কাছের মানুষ, বিয়ের পর থেকেই দু’জনে কলকাতায় থাকার জন্যে অন্য দুই ছোট বোনদের তুলনায় তাঁদের দু’জনের মধ্যে একটা একটা অদ্ভুত bonding তৈরী হয়েছিল। আর আমি আর রঞ্জু দু’জনে ছিলাম দুই বোনের এক মাত্র সন্তান। ছোটবেলায় মা আমায় নিয়ে মাঝে মাঝেই রবিবার বা কোন ছুটির দিন সকালে মাসীর বাড়ী (এন্টালী ক্রিস্টোফার রোডে সি আই টি বিলডিংএ সরকারী আবাসন) চলে যেতেন। ৩৩ নম্বর বাসে মাসীর বাড়ী যাওয়া হতো। হাজরা মোড়ে উঠতাম। আর পার্ক সার্কাস ছাড়িয়ে পদ্মপুকুর স্টপে নেমে কিছুটা হাঁটতে হতো।

    মাসীর বাড়ীতেই লাঞ্চ খেতাম। আর সারা দিন আমি আর রঞ্জু এক সাথে । কখনো পাড়ায় ক্রিকেট, কখনো বাড়ীতে ক্যারম, কখনো রেডিও তে অনুরোধের আসর। আবার মাসী আর মা’র নানা কাজেও আমাদের দুই মাণিকজোড় ছুটোছুটি করতাম। ট্যাক্সি ডেকে দেওয়া, চিঠি পোস্ট করা, ট্রেণের টিকিট কাটা, বাজার করে নিয়ে আসা, এই সব নানা কাজ দু’জনে মিলে করতে বেশ লাগতো।

    রঞ্জু আর আমি দুই ভাই  ক্রমশঃ অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে যাই।

    মেসোমশায় খুব চুপচাপ মানুষ ছিলেন,  নিজের ঘর থেকে বেরোতেন না, শেষের দিকে অসুখে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন।  

    বাবার মৃত্যুর সময় রঞ্জু তখন নরেন্দ্রপুরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে, তার বয়স মাত্র তেরো বছর। মাসী অত রাতে মেসোমশায়ের সেক্রেটারী রামুয়াকে পাঠালেন মেসোমশায়ের গাড়ী নিয়ে  রঞ্জুকে আনতে। মাসী  রামুয়াকে  বলে দিয়েছিলেন রঞ্জুকে তুলে ফেরার পথে আমাদের বাড়ী থেকে মা’কে তুলে নিতে। মাসীর আর আমাদের দুজনের বাড়ীতেই ফোন ছিলনা, তাই আগে খবর দেওয়া সম্ভব ছিলনা।

    রামুয়া যখন আমাদের বাড়ীর দরজায় কড়া নাড়লো, তখন রাত প্রায় দু’টো।

    কড়ার শব্দ শুনে বাড়ীর বড়রা সবাই ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছেন, আমারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মা খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

    গাড়ীতে তখন ছোট্ট রঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে।

    পরের দিন আমার স্কুলে সাইন্সের পরীক্ষা ছিল মনে আছে। Weekly test..আর তার পরের দিন বাড়ীতে সরস্বতী পূজো।

    স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পরে ভালকাকা আমায় আর বাবলুকে নিয়ে  গোপালনগরে সরস্বতী ঠাকুর কিনতে গিয়েছিলেন। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, আলো জ্বলে উঠেছিল চারিদিকে, বিশাল একটা প্রাঙ্গনে অনেক ঠাকুর সাজানো, কেনা বেচা চলছে, বেশ ভীড়, তার মধ্যেই ভালকাকার সাথে আমাদের কোন এক দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। মনে হলো মেসোমশায়কে তিনি চিনতেন।

    ভালকাকা তাঁকে বলেছিলেন, “খবর টা শুনেছেন নাকি? ননীবাবু কাল রাত্রে মারা গেছেন। স্ট্রোক হয়েছিল। ”

    তারপরে দু’জনের মধ্যে মেসোমশায় কে নিয়ে কিছু শোকপ্রকাশ এবং কিছু আলোচনা হয়েছিল। মৃত্যু যে আমাদের জীবনে একটি সামাজিক ঘটনা, লোকের মুখে মুখে যে এই ভাবে মানুষের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, সেদিন সরস্বতী ঠাকুর কিনতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি তা জানতে পারি।

    পারিবারিক গন্ডীর মধ্যে ১৯৬০ সালে  সেই ছিল আমার জীবনে পরিবারে্র এত কাছের একজন  মানুষের মৃত্যুর প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।  মনে আছে সরস্বতী পুজোর আনন্দ সেবছর অনেকটাই মুছে দিয়েছিল সেই মৃত্যু সংবাদ। 

    এখন এতদিন পরে জীবন সায়াহ্নে পোঁছে আমার কাছের কত লোক এক এক করে চলে গেলেন। মৃত্যু এখন আর আমার কাছে অপরিচিত নয়।

    আমাদের আগের প্রজন্মের কেউই আর এখন আমাদের কাছে নেই। মৃত্যু এসে হানা দিয়েছে আমাদের প্রজন্মেও। শঙ্কর আর তাপার পরে সম্প্রতি মিঠুও চলে গেল আমাদের ছেড়ে।

    এখন সরস্বতী পূজো এলেই আমাদের ছোটবেলার মনোহরপুকুরে সেই গমগমে সরস্বতী পুজোর পরিবেশের কথা মনে পড়লে মনটা এখন বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

    বসন্তপঞ্চমী,  জানুয়ারী,  ২০২৩

  • শেওড়াফুলি স্টেশন আর মান্না দে

    সত্তরের দশকে IBM Sales এর কাজে আমায় নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো।  

    কলকাতার কাছাকাছি কোথাও যেতে হলে নিজের গাড়ী নিয়েই যেতাম, কিন্তু কলকাতার বাইরে কোথাও গেলে লোকাল ট্রেণ ধরে যেতেই আমার ভাল লাগতো।

    সেই সব লোকাল ট্রেণে ভীড় আর চাপাচাপির মধ্যে কোনমতে জায়গা করে মাথার ওপরে হাতল ধরে  ট্রেণের চাকার ঝাঁকানীর শব্দ শুনে, আর দুলুনী তে দুলতে দুলতে চারিপাশের মানুষজন কে দেখে বেশ সময় কেটে যেত মনে পড়ে। 

    ডেলি প্যাসেঞ্জারদের এক একটা গ্রুপ থাকতো। রোজ দেখা হবার ফলে তাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তাদের আড্ডা, হাসিঠাট্টা আর রসিকতা আমরা বাকি যাত্রীরাও বেশ উপভোগ করি।  আবার কিছু যাত্রীর হলো তাসের নেশা, একটা চাদর পেতে তারা টোয়েন্টি নাইন (ষোল আছি সতেরো আছি) কিংবা ব্রীজ (ওয়ান স্পেড টু হার্ট )শুরু করে দেয়।  এই চলন্ত ট্রেণে বসে তাস খেলায় তাদের মনোযোগ আর মগ্নতা দেখলে মনে হবে তারা বিশ্বসংসার ভুলতে বসেছে।        

    আর থাকতো ফেরীওয়ালারা। অল্পবয়েসী কিশোর থেকে যুবক, মধ্যবয়েসী, এবং অনেক প্রৌঢ় মানুষ নানা ধরণের জিনিষ বিক্রী করার জন্যে এক কম্পার্টমেন্ট থেকে আর এক কম্পার্টমেন্টে ঘুরে বেড়াতেন।  কেউ কলম, কেউ লেবু লজেন্স, কেউ ঝালমুড়ি। বিক্রী তেমন কিছু হতো বলে মনে হয়না, তবু তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতেন।  সকাল থেকে রাত পর্য্যন্ত এক ট্রেন থেকে আর এক ট্রেন, জীবিকা উপার্জ্জনের বাধ্যবাধকতার তাগিদে তাদের সেই ক্লান্তি হীন, বিরামহীন ছুটে চলা দেখে মনের মধ্যে একটা বিষাদ অনুভব করতাম।

    আর থাকতো গানওয়ালারা।

    নানা ধরণের গান – ভক্তিগীতি, বাংলা আধুনিক, হিন্দী ফিল্মের গান – গেয়ে যাত্রীদের মনোরঞ্জন করে তারা তাদের পয়সার কৌটো ঝনঝন শব্দে এগিয়ে দিতো।  কিন্তু প্রায় সব যাত্রীই মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকতো, গান শুনে ভিক্ষা দেবার মত পকেটে রেস্ত তাদের কারুরই নেই। মানসিকতাও নেই হয়তো।

    ষাটের দশকের শেষে তখন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দেশে ধারাবাহিক “পারাপার” লিখছেন,  সেই উপন্যাসে মাঝে মাঝেই ভীড়ের ট্রেণের কথা উঠে আসে। গাদাগাদি ভীড়ের মধ্যে কোনমতে গাড়ীর পাদানিতে পা আর সারা শরীর বাইরে রেখে  ঝুলে থাকা একটি মানুষ জানেওনা তার দিকে উলটো দিক থেকে ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটে আসছে প্রাণঘাতী টেলিগ্রাফের পোস্ট।  

    শীর্ষেন্দু লিখেছিলেন – “অন্ধকারে ছুটে যায় জন্মান্ধ মানুষ। ”  

    সেইরকম একটি জন্মান্ধ কিশোরকে দেখেছিলাম একদিন ট্রেণে।  নিষ্পাপ সুকুমার মুখ, দুটো চোখ বোঁজা, বোঝাই যায় যে তার পৃথিবী অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু তার রিনরিনে মিষ্টি গলায় বেশ সুর আছে, দুই হাতে দুটো ইঁটের চাকতি কে খঞ্জনির মতো টকাটক করে বাজিয়ে তাল রেখে সে  সেই সময়ের শ্যমল মিত্রের একটি জনপ্রিয় গান গেয়েছিল।  

    কে জানে, কে জানে ?/

    কবে  আবার দেখবো পৃথিবীটাকে/

    এই ফুল, এই আলো আর হাসিটিকে/

    তার কাছের লোকেরা তাকে দিয়ে এই অল্প বয়েসে ট্রেণে ট্রেণে ঘুরে গান গেয়ে উপার্জ্জন করতে পাঠিয়েছে ভেবে সেদিনা আমার  মন বেশ খারাপ হয়েছিল, তার ছোট হাত দুটো ধরে আমি কিছু টাকা গুঁজে দিয়েছিলাম। 

    সেই ফুটফুটে কিশোরটিকে এখনো ভুলতে পারিনি।

    আর একটি বিকেলের কথা মনে পড়ে।

    বৈদ্যবাটীতে একটা জুট মিলে কাজ সেরে বিকেলের ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরছি।

    অফিস ফেরত লোকেদের  ভীড়ে ঠাসা কামরা, কোনমতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। শেওড়াফুলি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই দেখলাম আমাদের কামরার সামনে প্ল্যাটফর্মে একটা জটলা, আর কার একজনের গলায় গান ভেসে আসছে।

    মান্না দের “সেই তো আবার কাছে এলে”~

    আহা, বেশ সুন্দর গাইছে তো ছেলেটা? মিষ্টি গলা, গায়কীটাও পরিণত।

    কৌতূহল হলো, বাইরে তাকিয়ে জটলার মধ্যে দেখি একটি যুবক দাঁড়িয়ে, দেখে একটু অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়, পরনে সার্ট আর পাজামা, মুখে অনেকদিনের না কামানো দাড়ি, চুল উস্কোখুস্কো, আত্মমগ্ন হয়ে আপন মনে গান গেয়ে যাচ্ছে। আর তার চারিপাশে শ্রোতার দল মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে চুপ করে তার গান শুনছে।

    ছেলেটি কি পাগল? অথবা ব্যর্থ প্রেমিক? সন্ধ্যাবেলা শেওড়াফুলি স্টেশনের ব্যস্ত ভীড় আর কোলাহল কে সে তার আশ্চর্য্য গানের যাদু দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য।

    সে পরের গান ধরলো। “আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি~”

    আবার মান্না দে?

    ট্রেন থেকে নেমে পড়ে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। একের পর এক মান্না দে’র গান গেয়ে গেল ছেলেটি, যেন সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে, পরিপার্শ্বের কোন খেয়াল নেই। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার গান শুনে গেলাম।

    তারপর দুটো ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিলাম সেদিন।

    পরে ওই লাইনে ছেলেটিকে আর দেখিনি কোনদিন। কিন্তু তার পর থেকে মান্না দে’র কোন গান শুনলেই শেওড়াফুলি স্টেশনের সেই বিকেল আর সেই ছেলেটার কথা আমার মনে পড়ে যায়।

  • ভাই বোনদের সাথে কিছুক্ষন

    উর্ম্মি আর উদয়ন অনেক বছর পরে কলকাতায় এসেছে। পাটুলীতে ঝুনকুর ঝকঝকে নতুন বাড়ীতে আমরা ভাইবোনেরা সবাই একটা সন্ধ্যা ওদের সাথে কাটালাম।

    রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এক সূত্রে বাঁধা আছে সহস্র জীবন। আমরা ভাইবোনেরা যে সুতোয় বাঁধা আছি তা হলো আমাদের মনোহরপুকুরের বাড়ীতে একসাথে কাটানো বাল্য আর কৈশোরের প্রায় পনেরো কুড়ি বছরের দিনগুলোর স্মৃতি।

    এই বাঁধন এতগুলো বছরেও আলগা হয়নি।  

    উর্ম্মিরা বলেছিল বিকেল পাঁচটার মধ্যে চলে আসতে, তো আমরা চলে এলাম। সুভদ্রা আর আমি। মিঠু, খোক্‌ন, টুপসি, ওর ছেলে, আর বুবান। ভান্টুলি আর শ্রেয়া। কৌশিকী, ঝুন্টু, আর ঋদ্ধি। তা ছাড়া উর্ম্মি, উদয়ন আর ঝুনকু। সব মিলিয়ে টুপসির বাচ্চাটাকে নিয়ে আমরা পনেরো জন।  

    তারপর শুধু হাসি আর আড্ডা, যাকে বলে নরক গুলজার।

    মনোহরপুকুরের দিন গুলো নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ হলো। সেই সবাই মিলে ছাতের বারান্দায় মাদুরে বসে কাঁসার থালায় খাওয়ার কথা কি ভোলা যায়? সেই অন্নপূর্ণা বাবু, মাখনবাবু, সুন্দর স্টূডিওর পাঞ্জাবী ভদ্রলোক যার নাম খোকন দিয়েছে সুন্দরবাবু, পাশের পাঁচুবাবুর বাড়ীর তলায় মুচি, বসন্ত নাপিত। কত সব চেনা মানুষ। তাদের নিয়ে কত কথা। কত গল্প। শেষ আর হয়না।

    হরিকুমার বাবু থাকতেন মঞ্জুশ্রীর গলির পরে মোহন বিশুদের বাড়ীর তলায়। উর্ম্মি বললো মোহনের বৌর ওপরে মাঝে মাঝে কোন দেবী এসে ভর করতেন, আর ভর হলেই নাকি সেই বৌ ঠাস ঠাস করে তার শ্বাশুড়ীকে গালে চড় মারতো। এমন কি মোহনকেও সে এমন চড় মেরেছে যে সে নাকি বৌয়ের ভর হলেই নীচে রকে গিয়ে বসে থাকতো। বাপ্পা বলেছে ভরটর সব বাজে, আসলে শ্বাশুড়ী আর বরের ওপর রাগ মেটানোর ওটা একটা উপলক্ষ্য।   

    আমরা একবার সবাই মিলে ট্রেণে ডায়মন্ড হারবার গিয়েছিলাম, উদয়নও ছিল আমাদের সাথে, মনে আছে? বৃষ্টিভেজা দিন ছিল, উদয়ন উদাত্ত গলায় অনেক কবিতা আবৃত্তি করেছিল নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। মনে আছে? আর একবার আমরা উর্ম্মির দুই যমজ মেয়েকে দেখে ফেরার সময় দেশপ্রিয় পার্কের সামনে ফুটপাথে একটা গ্রুপ ফটো তুলেছিলাম, মনে আছে? দিদিভাই ও ছিল সেবার আমাদের সাথে।

    সবার সব পরিস্কার মনে আছে।   

    ট্রেণের কথা উঠতে খোকন বলল মাঝে মাঝে আমি কাজ থেকে বাড়ী ফেরার সময় শিয়লাদা থেকে ট্রেণ ধরে গড়িয়া আসতাম। সে কি ভীড়। কে যে কাকে ধরে ঝুলছে বোঝার উপায় নেই। এক ভদ্রলোক হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন আরে আরে আমার ধুতি! কিন্তু কিছু বোঝার আগেই তাঁর ধুতি অন্য কারুর হাতে চলে গেছে।

    খোকনের এই সব মজার মজার কথা শুনে সব চেয়ে বেশী হাসছে উর্ম্মি আর ঝুনকু।

    “হি হি হা হা, আমার ধুতি… হো হো হা হা”!

    ঝুন্টুর কৌতূহল একটু বেশী । সে বললো, “তলায় কিছু ছিল তো?”

    ভান্টুলি বললো “না থাকলেও কিছু দেখা যেতোনা। ওপরে পাঞ্জাবী ছিল নিশ্চয়, তাতে সব ঢাকা পড়ে যাবে…”

    ঝুনকু বললো, “যাঃ, কি সব অসভ্যতা হচ্ছে…”

    ভান্টুলির স্টকেও ট্রেণের গল্প। এটা ফুলকাকাকে নিয়ে।   

    একবার ফুলকাকা ট্রেণে করে কোথাও যাচ্ছেন, রাত হয়েছে। কামরায় তিন জন তাস খেলছে, তারা ফুলকাকাকে বললো “তিন পাত্তি খেলবেন?” ফুলকাকা তাস খেলেন না তিনি তাঁর ব্যাগ মাথার নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন সেই খেলোয়াড়রা কেউ নেই, তাঁর ব্যাগটাও উধাও।

    খোকন বললো, “ভাগ্যিস মাথাটাও নিয়ে যায়নি…”

    ঝুনকু আর উর্ম্মি যথারীতি হেসে লুটিয়ে পড়লো।          

    “হি হি হা হা, মাথাটাও নিয়ে যায়নি হো হো হা হা”!

    আমি বললাম কি হচ্ছে কি? কারুর ধুতি, কারুর ব্যাগ হারিয়ে যাচ্ছে, এ তো দুঃখের গল্প! এত হাসছিস কেন তোরা?

    জ্যেঠিমার বোন শেফালী মাসীর বর মেসোমশায়ের ডাকনাম ছিল খোকা। মাঝে মাঝে শেফালী মাসীর কোন কাজে – কিছু দিতে বা নিতে – উনি কাজ থেকে পুলিশের ড্রেস পরে মনোহরপুকুরে আসতেন, আর এলেই জ্যেঠিমা “ওরে খোকা বাবু এসেছে” বলে একটা হাঁক পাড়তেন।

    মেসোমশায় ছিলেন কলকাতার কোন এক থানার ওসি। লম্বা চওড়া চেহারা, পরণে পুলিশের ইউনিফর্ম, তার ওপরে গমগমে গলা। রসিক লোক ছিলেন, নিজের রসিকতাতে নিজেই যখন হাসতেন তখন আমাদের বাড়ীর কড়িবরগা সব কেঁপে উঠতো।

    এদিকে আমাদের বাড়ীর সামনে এক মুদীর দোকান ছিল, সেখানে আমরা চাল ডাল তেল ইত্যাদি কিনতে যেতাম। যে লোকটা সেই দোকান চালাতো তাকে সবাই খোকা নামে চিনতো। মুদীর দোকানের নাম হয়ে গিয়েছিল খোকার দোকান। মা কাকীমারা মাঝে মাঝে আমাদের বলতো, “খোকার দোকান থেকে আড়াইশো গ্রাম মুড়ি নিয়ে আয় তো~ ”

    ঝুন্টূ বললো “একদিন মেজমা শুনি পিছনের গলিতে কে পেচ্ছাপ করছিল তাকে ধমক দিয়ে বলছে খোকাকে বলবো একদিন পুলিশের ড্রেস পরে এসে তোমায় ধরতে। মজাটা বুঝবে সেদিন। আমি ভাবলাম     My God, মুদীর দোকানের ওই মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা ছেঁড়া গেঞ্জী পরা লোকটার এত ক্ষমতা?”      

    আসলে দুজনের নামই খোকা, তাই ঝুন্টুর গুলিয়ে গেছে। খোকন গম্ভীর ভাবে বলল “A case of mistaken identity”..

    ঝুন্টু বললো “তার পর থেকে আমি খোকার দোকানে গেলে লোকটাকে খুব সন্মান করে কথা বলতাম…”

    তাই শুনে ঝুনকু আর উর্ম্মি আবার হেসে গড়াগড়ি।

    “হি হি হা হা, সন্মান করে কথা বলতাম, হো হো হা হা”!

    আমাদের বাড়ীর পাশে ডক্টর মৃণাল দত্তের চেম্বার, সেখানে এক কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক ইঞ্জেকশন দিতে আসতেন, তার নাম ভালোকাকীমা দিয়েছিলেন ফুটুবাবু। উর্ম্মি বলল একবার নাকি রাস্তায় ভালোকাকার সাথে আচমকা ফুটূবাবুর দেখা হয়। এখন ভালকাকা ছিলেন পাড়ার একজন সন্মানীয় লোক, সবাই দেখা হলেই খুব খাতির করে তাঁকে শ্যামলদা’ বলে ডাকে, তিনি নাকি ফুটুবাবুকে দেখে কিছুটা patronizing ভঙ্গীতে হাসি মুখে যেন অনেক দিনে চেনা এই ভাবে “ভাল আছো ফুটু?” বলেছিলেন।

    খোকন বললো “ওনার নাম যে ফুটু উনি কি সেটা জানতেন নাকি?”

    আমি বললাম “মনে হচ্ছে উনি ভেবেছিলেন কে না কে ফুটু, আমায় শ্যামলদা’ ফুটু ভাবছে – a case of mistaken identity”..

    উর্ম্মি আর ঝুনকুর হাসি আর থামেই না।

    “হি হি হা হা, ভাল আছো ফুটু, হো হো হা হা”!

    উদয়ন ও বেশ ভাল গল্প বলতে পারে। সে শুরু করলো হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার পরে তার স্কুলের   বন্ধুদের সাথে জম্বুদ্বীপে বেড়াতে যাবার লোমহর্ষক গল্প। রামায়ণের জম্বু দ্বীপ নয়, এ হলো সুন্দরবনের জম্বুদ্বীপ, সাগর দ্বীপের কাছে। শীতের দিন ফ্রেজারগঞ্জ থেকে নৌকায় সাত বন্ধু – তারা আবার সবাই হিন্দু স্কুলের মেধাবী ছাত্র – বিকেলে গিয়ে পৌছল সেই দ্বীপে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, সারাদিন খাওয়া হয়নি, এদিকে নির্জন জনমানবশুন্য দ্বীপ, থাকা খাওয়ার জায়গা নেই, ওদিকে নৌকা নিয়ে মাঝিও কেটে পড়েছে, এখন উপায়?

    হঠাৎ তারা শোনে অন্ধকারে কোথাও রেডিও তে লতা মঙ্গেশকারের গান বাজছে। কেউ কোথাও নেই, গানটা বাজাচ্ছে কে? ভূতুড়ে ব্যাপার। তারপর তো সেই রেডিওর খোঁজে গিয়ে কিছু জেলের দেখা পাওয়া গেল, তারা তাদের ভালবেসে অনেক রাতে রান্না সেরে মাছের ঝোল ভাত খাওয়ালো আর পরের দিন ছোট নৌকায় করে ওদের আবার ফ্রেজারগঞ্জে পৌঁছে দিল।

    এই নৌকা মাছ ধরার নয়। ছোট এবং নীচু, মাছ নিয়ে যাবার নৌকা, সেখানে সাত জন বসাতে নৌকার অর্ধেক জলের তলায়। জায়গাটা নদীর মোহনা, চারিদিকে অকূল সমুদ্র, ছোট নৌকায় করে জল ছেঁচে ছেঁচে ফ্রেজারগঞ্জে পৌঁছবার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা উদয়ন এতগুলো বছর পরেও এখনো ভোলেনি। তার সাথে সাথে সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের ঢেউ এ অস্তগামী সূর্য্যের লাল আলো পড়ার দৃশ্যটা এখনো উদয়নের মনে পড়ে। সে এক অদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য।

    উদয়ন বেশ ভাল গল্প বলে, কিন্তু সব চেয়ে জমিয়ে গল্প বলে আমাদের খোকন। খোকনের গল্প বলার একটা অননুকরণীয় ভঙ্গী আছে, সেটা হলো কোন গল্প বলার সাথে সাথে তার দুটি হাত কে সে নানা ভাবে ঘুরিয়ে ব্যবহার করে। 

    শম্ভু মিত্র ম্যাগসেসে পুরস্কার নিতে ম্যানিলা যাচ্ছেন, তাঁকে এয়ারপোর্টে দেখাশোনা করার ভার পড়েছে খোকনের ওপর। সে তখন দমদমে পোস্টেড। খোকন কিছুদিন আগে রাজা অয়দিপাউস নাটকে শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখে মুগ্ধ। সেই মানুষটাকে অভাবিত ভাবে এত কাছে পেয়ে তাই স্বভাবতঃই সে দারুণ অভিভূত।

    খোকন হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বালে যাচ্ছে “আমি তো ওনাকে অনেক কিছু বলে যাচ্ছি, আপনি আমাদের বাঙালীদের গর্ব, আপনি এত বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন আপনার এই সন্মান আমাদেরও সন্মান, ইত্যাদি প্রভৃতি। আর উনি শুধু গম্ভীর মুখে হুঁ হুঁ করে যাচ্ছেন।”

    তারপর যেই না বলেছি “আমি একাডেমীতে গত সপ্তাহে আপনাদের বহুরূপীর রাজা অয়দিপাউস নাটকটা দেখেছি, আমার খুব ভাল লেগেছে”, ওমনি ভদ্রলোক যেন হঠাৎ জেগে উঠলেন, আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “তুমি দেখেছ? হলে কোথায় বসেছিলে বলো তো?”

    যেই আমি বলেছি সামনের পাঁচ নম্বর রো তে বাঁদিকে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমায় বললেন “আচ্ছা অমুক সীনে আমি যখন হাতটা ঘুরিয়ে (খোকন এই জায়গাটা হাত ঘুরিয়ে দেখালো উনি কেমন করে দেখাচ্ছেন)কপালের কাছে নিয়ে আসছি, তখন তোমাদের সীট থেকে আমার মুখটা কি দেখা যাচ্ছিলো?”

    খোকন বললো “আমি ভাবলাম এই রে সেরেছে, এর পরে আমায় নাটকের সমঝদার ভেবে আবার কি প্রশ্ন করবেন কে জানে, তাড়াতাড়ি এক জন কে ডেকে বললাম ভাই এনাকে লাউঞ্জে পৌঁছে দিয়ে এসো।”

    এই রকম নানা গল্প করতে করতে রাত প্রায় ন’টা বেজে গেল।

    ইতিমধ্যে কেটারার এসে বড় বড় কড়ায় করে খাবার দিয়ে গেছে। মেনু হলো মিষ্টি পোলাও, ফুলকপির রোস্ট, মাংস, চাটনি আর ক্ষীরকদম্ব।

    শেষ পর্য্যন্ত যখন বেরোলাম তখন রাত দশটা বেজে গেছে।

    প্রায় পাঁচ ঘন্টা কি করে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।

  • অপত্য স্নেহ

    মুকুদের Army Officers Golf Club এ চারিদিকে অবারিত আদিগন্ত সবুজ  গলফ কোর্স । খোলা আকাশের নীচে ক্লাবের outdoor restaurant, চারিপাশে অনেক গাছপালা, তাদের পাতার মাঝখান দিয়ে ঝিলিমিলি রোদ্দুর, মরশুমী ফুলের বাগান। সেই রেস্টুরেন্টের  নিরিবিলি কোণ বেছে নিয়ে একটা টেবিলে আমরা দুজনে বীয়ার নিয়ে মুখোমুখি বসে আড্ডা মারি। শীতের সকাল, নরম সোনালী রোদ, পরিবেশটা খুব সুন্দর, আমি আমার মনের মধ্যে বেশ একটা ফুরফুরে আনন্দের ভাব টের পাই। 

    মুকুদের ক্লাবের চারিদিকে সাদা উর্দ্দি পরা মাথায় পাগড়ী পরা অধস্তন কর্ম্মচারীরা কাজ করছে, কেউ রিসেপশন কাউন্টারে, কেউ রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, কেউ আবার মালী। Army তে rank ব্যাপারটা খুব important, তাই Army officer দের তুলনায় এই সব কর্ম্মচারীরা একটু নীচের তলার লোক।

    উত্তর ভারতে হিন্দী belt এর প্রদেশ গুলোতে “বেটা” কথাটা নিজের ছেলেমেয়েদের অথবা ছোটদের ভালবেসে বলা হয়।

    হাঁ বেটা, নেহী বেটা, উধর যাও বেটা, ইধর আও বেটা ইত্যাদি।

    আমি দেখলাম মুকু অক্লেশে এই সব উর্দ্দী পরা মাঝবয়েসী এমন কি বেশ বুড়ো ওয়েটারদেরও  আদর করে “বেটা” বলে সম্বোধন করছে, এবং তার কাছ থেকে এই  পুত্রসদৃশ স্নেহের ব্যবহার পেয়ে তাদেরও কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। অফিসারদের কাছ থেকে এই অপত্যস্নেহ পাওয়া তাদের কাছে নতুন কিছু নয়, এতে তারা বেশ অভ্যস্ত বলেই মনে হয়।

    এই নিয়ে মুকুর একটা গল্প আছে।

    —————-

    মুকুর মেয়ে মণিকা Institute of Mass Communication এ admission পেয়েছে, এখানে admission পাওয়া সোজা নয়, খুব কম লোকেই পায়।  মুকু তার সাথে ব্যাঙ্কে গেছে admission fee pay করতে। সেখানে গিয়ে দেখে বিশাল লম্বা লাইন। অন্ততঃ ঘন্টা দুয়েক লেগে যাবে লাইনের সামনে পৌঁছতে।

    মুকু মণিকা কে বলল, “থাক্‌ তোর আর এখানে ভর্ত্তি হতে হবেনা, তুই বরং বরোদাতে গিয়ে Art History নিয়ে MA পড়তে যা, সেখানে এরকম লাইন দেবার ব্যাপার নেই, আমি টাকাটা ব্যাঙ্ক ট্র্যান্সফার করে দেবো।”

    এই সব কথা হচ্ছে, এমন সময় একটি উর্দ্দি পরা ব্যাঙ্কের দারোয়ান এসে মুকু কে বললো “সাব্‌, আমায় চেক লিখে দিন্‌, আমি আপনার টাকা জমা দিয়ে রিসিট এনে দিচ্ছি”।

    আমি মুকু কে বললাম, “কে লোকটা?”

    মুকু বললো, “শোন্‌ না! আমি তো চেক লিখে দিলাম, ভাবলাম  account payee cheque, কি আর করবে? দেখাই যাক না”।

    মিনিট দশেক পরে লোকটা এসে মুকুকে টাকার রিসিট দিয়ে একটু দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললো, “আপ মেরেকো পহচানা নেহী, সাব্‌?”

    মুকু অফিসার সুলভ পুত্রস্নেহে বিগলিত হয়ে লোকটাকে বললো “নেহী বেটা, ম্যায় পহচানা নেহি, কৌন হ্যায় তুম্‌?”

    লোকটা বললো, “ম্যায় ভরতপুর মে আপকা আর্দালী থা”, তার পর মণিকাকে দেখিয়ে, “বেবী কো ম্যায় হী সাইকেল চালানা সিখায়া…”

    ————–

    বীয়ার নিয়ে দুজনে আরাম করে বসে গল্প করছি, এই সময় এই সুন্দর বাগান কে ব্যাকগ্রাউন্ড করে আমাদের একটা ছবি তোলা যায়না?

    আমি মুকু কে বললাম কাউকে একটু বল্‌ না আমাদের একটা ছবি তুলে দেবে।

    দূর থেকে একজন বেশ প্রৌঢ় ওয়েটার আসছিল, তার মাথা ভরা পাকা চুল, সাথে আবার বেশ বাহারী সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

    সব্বোনাশ, মুকু কি এই বুড়ো লোকটাকেও “বেটা” বলে ডাকবে নাকি?

    যা ভেবেছি তাই।  

    মুকু ওই ফ্রেঞ্চকাট লোকটাকে ডেকে বললো, “বেটা, ইধার আও!”

    লোকটা কাছে এসে বশংবদের মত এসে দাঁড়িয়ে বললো, “জী সাব্‌!”

    মুকু তাকে স্নেহমিশ্রিত স্বরে বললো, “হমারে এক ফোটো খিঁচ দো বেটা…”

  • কোয়েলিয়া গান থামা এবার

    আজকাল সুভদ্রা আর আমি মাঝে মাঝে দিল্লী যাই।  সেখানে আমাদের ছোট মেয়ে বুড়ী থাকে, আমরা মেয়ে জামাই আর নাতি নাতনীদের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে আসি। দিল্লী গেলেই মুকুর সাথে দেখা হয়, আর আমরা নিয়ম করে একদিন কিছুক্ষণ একসাথে কাটাই।

    মুকু আমাকে ওর গাড়ীতে তাদের Army Officers Golf Club এ নিয়ে যায়। রাস্তায় গাড়ী চালাতে চালাতে মুকু অনর্গল কথা বলে যায়। তার অনেক গল্প। আর সেই কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মুকু মাঝে মাঝে বেশ কিছু গানের দুই এক কলি নিজের মনেই গেয়ে ওঠে।

    মুকু সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে সে একজন সঙ্গীতরসিক, এমন কি ভাল বাংলায় তাকে সঙ্গীতপিপাসু ও বলা যায়। একটু সুযোগ পেলেই সে কিছু গান গুণগুণ করে গাইবেই। আর একটা আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো যে জীবনটা প্রায় সবটাই বাংলার বাইরে কাটালেও তার প্রিয় গান গুলো সবই বাংলা গান। স্কুলের উঁচু ক্লাসে (ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেন ১৯৬০-৬৩) পড়ার সময়ে সে তিন বছর কলকাতায় ছিল। সেটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। সেই সময়ের বহু বাংলা গান মুকুর এখনো বেশ মনে আছে, গত বছর সে গাড়ী চালাতে চালাতে স্টিয়ারিং এ তবলা বাজাতে বাজাতে গাইছিল মান্না দে’র আমি যামিনী তুমি শশী হে…

    এবার তার গলায় শুনলাম দুই ভাই সিনেমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত সুপারহিট গান “তারে বলে দিও সে যেন আসেনা আমার দ্বারে”…ওই গানের একটা interlude আছে গানের মাঝখানে বিশ্বজিৎ (রাধাকান্ত নন্দী) হঠাৎ তবলা বাজানো বন্ধ করবে আর উত্তমকুমার (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) বলবে “কি রে থামলি কেন, বাজা?”

    ট্র্যাফিক জ্যামে গাড়ী আটকে গেলে বা ট্র্যাফিক লাইটে গাড়ী থামলেই মুকু আনমনে গান থামিয়ে বলে উঠছে, “কি রে থামলি কেন, বাজা?”

    এই গান গাওয়া নিয়ে মুকুর একটি গল্প আছে, এর থেকে তার self mocking  আর self deprecating persona সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যাবে।

    ————-

    একবার বহুদিন আগে পঞ্চাশের দশকে (মুকুর বয়েস তখন সাত কি আট বছর) জ্যেঠুরা তখন পান্ডারা রোডে থাকেন, সবাই মিলে টাঙ্গা চড়ে বিপু মামার বাড়ীতে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ীতে জ্যেঠিমা (মুকুর মেজমা) ও আছেন।

    মুকুর সব গল্প শুনলেই সেগুলো মনের মধ্যে একটা ছবির মত ফুটে ওঠে। ওর গল্প বলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক দক্ষতা আছে।

    আমি শুনছিলাম আর মনে মনে কল্পনা করে নিচ্ছিলাম সেই সময়কার পান্ডারা রোড, নির্জ্জন, গাছের ছায়ায় ঢাকা, তার মধ্যে টাঙ্গা চলছে, ঘোড়ার খুরের খট্‌খট্‌ আর গাড়োয়ানের জিভ দিয়ে তোলা টক্‌টক্‌ আওয়াজ শোনা যায়, তার সাথে মাঝে মাঝে স্পীড বাড়ানোর জন্যে ঘোড়ার পিঠে আলতো করে মারা চাবুকের সপ্‌সপ্‌ শব্দ।

    ছোটবেলায় এক সময়ে কত টাঙ্গায় চড়েছি, দিল্লী পাটনা লক্ষ্ণৌ কাশী এই সব শহরে। এখন আর কোথাও টাঙ্গা চলেনা, তার জায়গায় এখন অটো আর রিক্সা।

    যাই হোক, টাঙ্গায় যেতে যেতে মুকু – সে সেই অল্পবয়েস থেকেই সঙ্গীতপিপাসু –    জ্যেঠিমা কে বললো, “মেজমা তুমি একটা গান গাও না!”

    জ্যেঠিমা বললেন, “আমি তো গান গাইতে পারিনা মুকু, বরং তুই একটা গান গা’ না”।

    এখন মুকু হচ্ছে এমন একজন ছেলে যাকে গান গাইতে বলার দরকার হয়না, সে এমনিতেই নিজের উৎসাহেই গান গেয়ে যায়। সুতরাং বলা বাহুল্য জ্যেঠিমা বলার সাথে সাথে সে একটা গান গাইতে শুরু করে দিলো।

    “কি গান গাইলি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    কিছু দিন আগে শুমার কাছ থেকে শুনে এই গানের সুরটা তার খুব ভালো লেগেছে। সে গাইতে শুরু করে দিলো “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো…”

    মুকু আমায় বললো , “আমি বেশ ভালোই গান টা শুরু করেছিলাম, বুঝলি, কিন্তু দুই লাইন গাইবার পরেই আমার মাথায় এক বিরাট চাঁটি ”…

    চাঁটি? আমি বললাম “সে কি রে, কে মারলো?”

    মুকু বললো, “কে আবার? বাবা…”

    মুকুর পাশে বসেছিলেন জ্যেঠু, তিনি নাকি মুকুর মাথায় এক চাঁটি মেরে বলেছিলেন, “এই ভর দুপুরে চাঁদের আলো! যত্ত সব ইয়ার্কি, হুঁঃ! তোকে আর গান গাইতে হবেনা, ঢের হয়েছে, থামা তোর গান। ”

    ———————

  • মুকু, আমি ও কুতব মিনার

    ১৯৫৩ সাল, আমার সাত বছর বয়েস, মা’র সাথে বাবার কাছে দিল্লীতে গিয়েছি। সেই প্রথম আমার দিল্লী যাওয়া।


    নিখিল জ্যেঠু (আমরা বলতাম দিল্লীর জ্যেঠু) তখন দিল্লীতে পোস্টেড, সফদরজং এনক্লেভে ওঁর বিরাট বাগানওয়ালা বিশাল কোয়ার্টার, সেখানে গিয়ে প্রথম মুকুর সাথে আমার দেখা।


    মুকু সেই ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত আর দামাল, সব সময় দুদ্দাড় করে ছুটে বেড়াচ্ছে, সেই তুলনায় আমি শান্ত, লাজুক আর ভীতু, বিশেষ করে নতুন জায়গায় নতুন লোকজনেদের সাথে একেবারেই মিশতে পারিনা, ফলে ওনাদের বাড়ী গেলে শুমা আর জ্যেঠু আমায় অনেক আদর করা সত্ত্বেও আমি মা’র আঁচলের পিছনে লুকিয়ে থাকি।


    তার ওপরে মুকুদের বাড়িতে একটা বিরাট অ্যালশেসিয়ান কুকুর আছে, তার নাম তোজো, তাকে  আমি ভীষণ ভয় পাই। সব মিলিয়ে মুকুদের বাড়িতে যেতে আমার মোটেই ভাল লাগেনা।
    যাই হোক, এক ছুটির দিন সবাই মিলে কুতব মিনার যাওয়া হবে, জ্যেঠুর গাড়ীতে পিছনের সীটে বসে আছি মুকু আর শিখার সাথে, শিখা তখন ছোট্ট মেয়ে, চার কি পাঁচ বছর বয়েস, পুটপুট করে দুই ভাই বোনে ইংরেজীতে কি যে কথা বলে যাচ্ছে, আমার মাথায় কিছুই ছাই ঢুকছেনা, আমি চুপ করে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি।


    Feeling quite left out and ignored যাকে বলে!


    কিছুক্ষণ পরে মুকু আর শিখা হঠাৎ “কুতব মিনার কুতব মিনার” বলে চ্যাঁচাতে শুরু করলো।
    ব্যাপারটা কি ?


    আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গাঢ় লাল রং এর বেশ উঁচু একটা টাওয়ার, তলাটা মোটা, খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা দেয়াল, লম্বা হয়ে ছোট হতে হতে ওপরে উঠে গেছে, মাঝে মাঝে কিছু গোল বারান্দা, তাতে বেশ কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে নীচ থেকে দেখা যায়।


    এটাই কুতব মিনার নাকি ?


    লোক গুলো ওই ওপরের বারান্দায় উঠল কেমন করে ? হাঁচোড় পাঁচোড় করে ওই খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা দেয়াল বেয়ে নাকি ?


    সব্বোনাশ! আমার দ্বারা ও কাজ জীবনেও হবেনা।


    জ্যেঠু বললেন, “কে কে কুতব মিনারে চড়বে, হাত তোলো।” মুকু তো সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে ready, ওদিকে ছোট্ট শিখাও দেখি হাসিমুখে হাত তুলে বসে আছে।


    আমি তো অবাক, এ কি রে ? এইটুকু মেয়ে, সে কিনা ওই লম্বা টাওয়ারের গা বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠবে? সাহস তো কম নয় ? জ্যেঠু আর শুমার ও তো তাই নিয়ে কোন চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছেনা!
    আমি মনে মনে কল্পনা করলাম দুরন্ত মুকু হাঁই পাঁই করে লাফিয়ে লাফিয়ে ওই দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে, আর তার পিছন পিছন হামাগুড়ি দিয়ে শিখা…


    আমি আর হাত তুলছিনা, চুপ করে বসে আছি! তোমরা যত ইচ্ছে ওঠো বাবা, আমি ওতে নেই । শুমা বললেন “মান্টুবাবুর কি হলো ? তুমি কুতব মিনারে চড়বেনা ?”


    আমি চুপ।


    কিন্তু পরে সামনে গিয়ে দেখি ও হরি, ভেতরে তো দিব্বি ওপরে ওঠার সিঁড়ি!


    তখন আর আমায় পায় কে ? মুকুর সাথে আমিও দুদ্দাড় করে ওপরে উঠে গেলাম। তখন ভেতরটা বেশ অন্ধকার, সরু, ঘুলঘুলি দিয়ে অল্প আলো আসছে, উত্তাল স্রোতের মত ওই একই সিঁড়ি দিয়ে লোক উঠছে আর নামছে তার মধ্যে দিয়েই আমরা দুজন প্রায় দৌড়ে উঠছি, এ যেন বেশ একটা মজার খেলা! তখন তো আর এখনকার মতো হাঁটু কনকন আর কোমর টনটন নেই, শরীরের কলকব্জা সব brand new, ফুসফুসে অফুরন্ত দম!


    একেবারে ওপরের বারান্দায় উঠে গিয়েছিলাম আমরা দু’জনে। সেখান থেকে নীচটা খুব সুন্দর দেখায়, সাজানো বাগান, প্রচুর ফুল ফুটে আছে।

    আর দূরে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় দিল্লী শহরের ঘরবাড়ী, আর দিকচক্রবালে সবুজ বনানী।


    সেই বিকেল টা এখনো খুব মনে পড়ে।


    মুকুর সাথে সেই দিন থেকে আমার ভাব।

  • স্মোকিং কিলস্‌

    আমাদের বন্ধু দের কিছু মুদ্রাদোষ আছে, যেমন প্রদোষ অবাক হলে বলে  “গুড গড্‌” আর ধ্রুব কোন কারণে অস্বস্তিতে পড়লে বলেন “কি বলবো মাইরী”!

    তো একবার প্রদোষ আর তুতু কলকাতায় এসেছে, ওদের সাউথ সিটি র বাড়ীতে আমরা কয়েকজন ড্রইং রুমে বসে আড্ডা মারছি। সাথে প্রদোষের সিঙ্গল মল্ট্‌। সামনে টি ভি খোলা, তাতে একটা ইংরেজী ছবি চলছে, সাইলেন্ট মোডে। বেশ ঝিংচ্যাক ছবি মনে হয়, গল্পের মধ্যে মাঝে মাঝে টি ভি তে চোখ চলে যাচ্ছে, দেখছি হ্যারিসন ফোর্ড খুব গুলি গোলা চালাচ্ছেন, তাছাড়া বেশ কিছু car chase এর দৃশ্য।

    কয়েক রাউন্ড মাল খাবার পর সকলের চোখ বেশ ঢুলুঢুলু। হঠাৎ সুভদ্রা বললো, “এই, টি ভিতে কি সিনেমা চলছে?”

    স্ক্রীনের বাঁ দিকে ওপরে খুব ছোট অক্ষরে বোধ হয় সিনেমার নাম লেখা আছে, দূর থেকে পড়া যাচ্ছেনা। সুভদ্রার কথা শুনে ধ্রুব টলমলে পায়ে উঠে টি ভির কাছে চলে গেলেন। তারপরে আবার টলমলে পায়ে ফিরে এসে যুদ্ধজয়ের খবর জানানোর ভঙ্গীতে বললেন ছবির নাম হলো “স্মোকিং কিলস্‌”।

     “স্মোকিং কিলস্‌”?

    আমরা সবাই ধ্রুবর কথা শুনে হো হো করে হাসলাম। কিছুটা আউট হয়ে যাওয়ায় হাসিটা বোধ হয় একটু বেশীই হলো।

    প্রদোষ বললো গুড গড ধ্রুব, আপনি কি  আউট  হয়ে গেছেন?

    ধ্রুব ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটু অপ্রস্তুত। তিনি একটু হেসে বললেন “কি বলবো মাইরী…”

  • খান স্যার

    স্কুলের ইতিহাস পাঠক্রম নিয়ে আমাদের দেশে এখন অনেক তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা। তাদের মত হলো স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে স্কুল আর কলেজের ছাত্ররা ইতিহাসের বইতে শুধু মুঘল আর অন্যান্য মুসলমান রাজাদের কাহিনী পড়ে।  হিন্দু সাম্রাজ্য এবং হিন্দু রাজাদের কথা দেশের ছাত্রদের  সেরকম ভাবে কিছুই পড়ানো হয়না। উত্তর ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য, দক্ষিণের চোলা বা বিজয়নগর, বাংলার সেন বা পাল বংশ এমন কি শিবাজীর মাড়াঠাদের নিয়ে আমাদের স্কুলের বা কলেজের ইতিহাসের বইতে সেরকম উল্লেখ নেই। সেখানে শুধু মুঘলদের এবং পরে ইংরেজদের ইতিহাস।

    হিন্দুত্ববাদী বিক্রম সম্পথ ইতিহাসের এই বিকৃতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি অনেক ইতিহাসবিদ – যেমন রমেশচন্দ্র দত্ত, যদুনাথ সরকার ইত্যাদি – তাঁদের লেখা ইতিহাসের পাঠে হিন্দু রাজত্বের কথা লিখলেও প্রথম দিকের অসাম্প্রদায়িক (Left/Secular)ভারত সরকার ইতিহাসের পাঠ থেকে হিন্দু রাজাদের মোটামুটি বাইরে রেখেছেন। বিক্রম বলছেন তার ফলে প্রাচীন ভারতের অনেক হিন্দু রাজত্বের উজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের ছাত্রদের গোচরে আসছেনা।

    তর্কের অন্যদিকে Left secular ইতিহাসবিদ রা – যেমন রোমিলা থাপার, রামচন্দ্র গুহ – প্রতিবাদ করে বলছেন মুসলমান invader দের আসার আগে ভারত নানা ছোটখাটো রাজাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে ছিল। মুঘলরা এবং পরে ইংরেজদের  শাসনের ফলে ভারত এক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, ভারতের হিন্দুদের সাথে তাদের মুসলমান বা ইংরেজ শাসকদের কোন বিবাদ ছিলনা ইত্যাদি।

    এর মধ্যে আমি মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদের স্কুলজীবনে ইতিহাসে কি পড়েছিলাম তা মনে করার চেষ্টা করি।                 

    আমাদের স্কুলে (সেন্ট লরেন্স, বালীগঞ্জ, কলকাতা) ইতিহাস পড়াতেন খান স্যার । সাধারণ দোহারা চেহারা, পরনে সাদা সার্ট আর ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুটো চোখ। ইতিহাস ছিল তাঁর passion ।

    যতদূর মনে পড়ে আমাদের ইতিহাসের বইতে বহিরাগত মুসলমান শাসকদেরই প্রাধান্য ছিল বেশী। তবে রাণা প্রতাপ, শিবাজী, চন্দ্রগুপ্ত, অশোক দের কথাও পড়েছি। তবে তাদের মোটামুটি সকলকেই minor player হিসেবে ই দেখানো হতো। চোলা বা বিজয়নগর সাম্রাজ্য সম্বন্ধে তো আমাদের কিছুই পড়ানো হয়েছে বলে মনে পড়েনা।

    আর প্রায় প্রত্যেক যুদ্ধেই হিন্দু রাজাদের হার হতো – এখনকার হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের ছাত্র – বিক্রম সম্পথ আর স্বপন দাশগুপ্তদের –  এই আপত্তি খুব একটা ভুল বোধ হয় নয়।  আমাদের বাংলার ইতিহাসেও সেন আর পাল বংশ এবং পরে বারো ভুঁইয়া দেরও দেখানো হয়েছে মুঘল বা ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরাজিত হিসেবে।

    হিন্দু রাজাদের পরাক্রম, সাহস আর বিদ্রোহের কথা আমাদের স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে খুব বেশী নেই, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মারাঠাদের কথা, বাঙলায় সশস্ত্র আন্দোলন, সিপাহী বা নৌবিদ্রোহ কেও খুব একটা মাহাত্ম্য দেখানো হয়নি। গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের জন্যেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এই কথাই আমরা জানি।

    এখন এই হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সশস্ত্র আন্দোলন এবং প্রাণ বিসর্জ্জন কে আমাদের ইতিহাসে যথাযোগ্য সন্মান জানানো হয়নি। স্বাধীনতার জন্যে ভগত সিং, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মত নেতাদের অবদানের নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে।

    আমাদের ছোটবেলায় এই সব বিতর্ক আর বিবাদ ছিলনা।         

    খান স্যার বড় ভালো পড়াতেন, আকবর, বীরবল, শিবাজী, আফজল খাঁ রা সবাই তাঁর পড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠতেন। তিনি হলদিবাড়ী বা পানিপতের যুদ্ধের কথা পড়াবার সময় আমরা তলোয়ারের ঝনঝন আওয়াজ, আহত সৈনিকদের আর্তনাদ, ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক যেন কানে শুনতে পেতাম। নিজেকে আমি মাঝে মাঝে নিজেকে সেই যুদ্ধের মধ্যে এক অনামী সৈনিক বলেও ভেবেছি।  


    খান স্যারের সবই ভালো ছিল, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ আমরা পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছি কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দুমদাম প্রশ্ন করে বসতেন। একটু অমনোযোগী হলেই আমরা ঠিক ওনার কাছে ধরা পড়ে যেতাম।

    তো একবার মনে পড়ে ক্লাসে বারো ভুইঁয়া দের সম্বন্ধে পড়াচ্ছেন খান স্যার। আমি সেদিন তৈরী হয়ে আসিনি, তাই খান স্যারের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না, পাছে আমায় কোন প্রশ্ন করে বসেন। খান স্যার বুঝতে পেরে আমায় বল্লেন “ইন্দ্রজিৎ, তুমি তো ভৌমিক, তাই না? তার মানে তুমি নিশ্চয় কোন বারো ভুঁইয়ার বংশধর। আচ্ছা, তুমি বলো তো…

    সব্বোনাশ!

    যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই!  

    ভৌমিক হয়ে জন্মাবার জন্যে বেশ দুঃখ হয়েছিল সেদিন। ঘোষ বোস মিত্র বা মুখুজ্যে বাঁড়ূজ্যে হলেও এই বিপদে পড়তে হতোনা আমায়।

  • মামা, কাটবো?

    মনোহরপুকুর, বোধহয় ১৯৫৭ সাল।

    দিদিভাই আমাদের ছোটদের নিয়ে বাড়ির বড়ো বারান্দায় একটা সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে। উপলক্ষ্যটা ঠিক মনে নেই। রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকী  কিংবা বসন্ত উৎসব হবে হয়তো।

    প্ল্যান হলো দিদিভাই ব্যাকস্টেজ থেকে রবীন্দ্রনাথের “পূজারিণী”  কবিতাটা আবৃত্তি করবে আর তার  সাথে আমরা স্টেজে কবিতাটার একটা নাট্যরূপ অভিনয় করব। এর সাথে থাকবে কিছু গান, আবৃত্তি, আর আবহসঙ্গীত।

    আমাদের সকলের তো খুব উৎসাহ। রোজ বিকেলে ছাতে গান আর নাটকের রিহার্সাল চলে। “ওরে ভাই ফাগুণ লেগেছে বনে বনে” গানটা দিদিভাই এর কাছ থেকে আমরা শিখে নিয়েছি।

    নাটকে চারজন চরিত্র।

    আমি হলাম “নৃপতি বিম্বিসার”, প্রথম সীনে – “নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইল পদনখকণা তার”- আমি বুদ্ধের মূর্ত্তির সামনে গিয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে যাব।  

    বাবলু হলো বিম্বিসারের ছেলে অজাতশত্রু, সে আবার বুদ্ধকে দু চক্ষে দেখতে পারেনা। সে রাজা হয়ে বুদ্ধের পূজা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, তার রাজত্বে শুধু মারামারি, কাটাকাটি, হিংসা। বাবলুর প্রথম সীন হলো হাতে একটা রাংতার তৈরী তলোয়ার মাথার ওপর বাঁইবাঁই করে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ স্টেজে নাচবে। সাথে বাজনা।

    এছাড়া দুজন মেয়ে। এক হলো রাজমহিষী, যার কাজ হলো শুধু সাজগোজ করা, ওই পার্টটা করেছিল সামনের বাড়ীর অপুমাসী র মেয়ে টুটু।  আর একজন “শ্রীমতী নামে সে দাসী” সেটা করেছিল দিদিভাইয়ের বন্ধু গৌরীদির বোন বাসন্তী। ওরা আমাদের পাড়াতেই থাকতো। দাসী শ্রীমতী কে রাজমহিষী অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে বুদ্ধদেবের পূজো করবেই। শেষ সীনে সে যখন পূজো করছে তখন অজাতশত্রু এসে তার গলা কেটে তাকে মারবে।

    মোটামুটি এই হলো নাটক।

    বাবলু কে পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছে যে তলোয়ার দিয়ে গলা কাটার timing  টা ভীষন important, ও শ্রীমতীর গলার কাছে তলোয়ার নামানোর সঙ্গে সঙ্গে ঝ্যাং করে একটা বাজনা বাজবে আর স্টেজ অন্ধকার হয়ে যাবে। বাবলু তাই ওই সীন টা নিয়ে বেশ চিন্তিত।

     ২

    নাটকের দিন বারান্দায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসার জায়গাতে স্টেজ বানানো হয়েছে। জ্যেঠিমার ঘর হলো গ্রীনরুম। সেখানে আমাদের সব সাজগোজ করিয়ে দিয়েছে দিদিভাই। চায়ের ঘরটা হলো উইংস। সেখানে ভালোকাকীমার ভাই শ্যামলমামা দাঁড়িয়ে। তিনি হলেন ব্যাকস্টেজ ম্যানেজার।

    স্টেজের সামনে বারান্দায় চাদর পাতা, একটু একটু করে সেখানে বেশ ভীড় জমে গেল। অনেকে এসেছে। তাদের মধ্যে আত্মীয়রা আছেন, আর পাড়ার ও অনেকে নিমন্ত্রিত।

    প্রথম আর্টিস্ট পলা । সে হলো ভজা জ্যেঠুর ভাই পূজা জ্যেঠুর মেয়ে। তখন পলার কতোই বা বয়েস? বারো কি তেরো হবে। লাল রং এর ডুরে শাড়ি, আঁট করে চুল বাঁধা, চোখ নাচিয়ে হাত ঘুরিয়ে বেশ গিন্নীর মতো পলা “হাইস্যো না কো বাবুরা, বুড়া আমায় মারিসে” বলে একটা কবিতা সুন্দর ঝরঝর করে আবৃত্তি করল। She was a big hit, প্রচুর হাততালি পড়ল দর্শকদের কাছ থেকে।

    তারপর আমাদের কোরাসে “ওরে ভাই ফাগুণ লেগেছে বনে বনে” গান। সেটাও মোটামুটি ভালোই উতরে গেল।

    তারপর শুরু হলো নাটক। সেটাও ভালোই এগোচ্ছিল, কিন্তু বাবলুর লাস্ট সীনে গিয়ে একটু কেলো হয়ে গেল। দোষ অবশ্য বাবলু কে দেওয়া যায়না। আগেই বলেছি ওই গলা কাটার timing টা নিয়ে ওর বেশ চিন্তা ছিল। যদি তলোয়ার নামানোর সময় ঝ্যাং করে বাজনাটা না বাজে, যদি স্টেজ অন্ধকার না হয়?

    বাবলু তাই রাংতার তরোয়াল মাথার ওপর ধরে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। ওদিকে শ্যামলমামাও (যার কাজ হলো ঝ্যাং বাজনা টা বাজানো আর স্টেজে আলো নেবানো), বসে আছেন বাবলুর তরোয়াল নামানোর অপেক্ষায়।

    বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর বাবলু উইংসে দাঁড়ানো শ্যামলমামা কে জিজ্ঞেস করেছিল, “মামা, কাটবো?”

    প্রশ্নটা বেশ উঁচু গলায় জোরেই করতে হয়েছিল বাবলুকে, কেননা উইংস টা ছিল স্টেজের মাঝখান থেকে বেশ দূরেই। ফলে ওর ওই কথাটা হল শুদ্ধ সবাই শুনে ফেলে।

    তার পর থেকে বহুদিন বাবলুকে “মামা কাটবো?” বলে খ্যাপানো হয়েছে।

    মনোহরপুকুরের বাড়ীর ইতিহাস যদি কোনদিন লেখা হয় তাহলে এই গল্পটা তার মধ্যে স্থান পাবে নিশ্চয়।