Category Archives: নানা চরিত্র

পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ ও বশংবদ কর্ম্মচারী

আমরা তিন বন্ধু – দীপঙ্কর, অমিতাভ আর আমি – আমাদের বৌদের নিয়ে সম্প্রতি উড়িষ্যায় গোপালপুরে সমুদ্রের ধারে তিন দিন ছুটি কাটিয়ে এলাম। আমরা তিনজন হলাম বাল্যবন্ধু, বালীগঞ্জের সেন্ট লরেন্স হাইস্কুলে সেই পঞ্চাশের দশকে নীচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকে আমাদের বন্ধুত্ব।

তিনদিন সমুদ্রের তীরে জলে ভেজা বালিতে পা ডুবিয়ে হেঁটে, ফেনা মাখা ঢেউএর সাথে catch me if you can খেলে, আর জমিয়ে কাঁকড়া আর চিংড়ী মাছ খেয়ে দিনগুলো বেশ হৈ হৈ করে কেটে গেল। এক দিন চিল্কা হ্রদে গিয়ে বোটিং ও হলো।

এবার ফেরার পালা। হোটেল থেকে গাড়ী নিয়ে ভুবনেশ্বর যাচ্ছি। সেখান থেকে আমাদের প্লেন ছাড়ছে বেলা দুটো। দমদম পৌঁছবো বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ। আমি ফোনে আমাদের ড্রাইভার কে বাড়ী থেকে গাড়ীটা নিয়ে দমদমে আসতে বলছি।

“একটু আগে এসে গাড়ীতে তেল আছে কিনা দেখে নিও, টায়ার গুলোতে হাওয়া ভরতে হতে পারে, তিনটের একটু আগে দমদম পৌঁছে যেও”, ইত্যাদি বলে যাচ্ছি আর ভাবছি মোবাইল ফোন যখন ছিলনা, তখন আমরা কি করে বেঁচে ছিলাম!

দীপঙ্কর বসে ছিল পিছনে, সে বললো ইন্দ্রজিৎ এর ড্রাইভার কে এই পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।

কি গল্প?

এক কোম্পানীর মালিক তাঁর এক কর্ম্মচারীকে পাঠাবেন আসানসোলে তাঁর এক খদ্দেরের কাছ থেকে একটা চেক নিয়ে আসতে। ইয়ার এন্ড এসে যাচ্ছে, তাই চেক টা পাওয়া খুব দরকারী।

কর্ম্মচারী ছেলেটি খুব বিশ্বাসী আর বশংবদ।

মালিক তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিচ্ছেন এই ভাবে।

শোনো তুমি সামনের সোমবার ভোরবেলা হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরবে, বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

ব্ল্যাক ডায়মন্ড প্ল্যাটফর্ম আট থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় ছাড়বে, তার মানে তোমায় হাওড়া স্টেশনে পৌনে ছটার আগে পৌঁছে যেতে হবে, বুঝতে পেরেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

তুমি সেদিন ভোর চারটে তে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠবে, উঠে সব কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়বে। তুমি তো ফার্ণ রোডে আলেয়া সিনেমার কাছে থাকো, ওখান থেকে গড়িয়াহাটে হেঁটে যেতে তোমার দুই তিন মিনিট লাগবে, সেখানে গিয়ে তুমি পাঁচ নম্বর বাস ধরবে, ফার্স্ট বাস আসে ভোর পাঁচটায় তাই তার আগেই তোমায় বাস স্টপে পৌঁছে যেতে হবে, দেরী করবেনা, বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার!

আচ্ছা ওই সকালে বাসে তুমি হাওড়া স্টেশনে ছ’টার আগেই পৌঁছে যাবে, সেখানে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে টিকিট রিসার্ভেশন কাউন্টারে লাইন দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড চেয়ার কারে তোমার সীট রিসার্ভ করে টিকিট কিনবে। ঠিক আছে?

হ্যাঁ, স্যার!

এবার আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম্মে গিয়ে ট্রেণে উঠে নিজের সীটে গিয়ে বসবে। আসানসোল স্টেশনে ট্রেণ পৌছবে সকাল ন’টায়। কিন্তু তুমি যে অফিসে যাবে তারা খোলে বেলা দশটায়। তাই তুমি ট্রেণ থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে মিনিট পনেরো চা খেয়ে নিয়ে নিও। ক্লীয়ার?

হ্যাঁ, স্যার!

তারপরে বাইরে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ওদের অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটা ওদের দেখিও। ওরা তোমায় একটা চেক দেবে, সেটা নিয়ে তুমি আবার স্টেশনে ফিরে বিকেল চারটে তে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে এসো।

সোমবার ন’টা নাগাদ মালিকের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। সেই বশংবদ কর্ম্মচারীর ফোন।

এবার তাদের দু’জনের কথাবার্ত্তা এরকম হলো।

কি হলো? কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? ভোরবেলা গড়িয়াহাট থেকে ফার্স্ট বাস পাঁচ নম্বর ধরেছিলে?

হ্যাঁ, স্যার!

বেশ! তারপর? ট্রেণের টিকিট কাটলে? সীট রিসার্ভ করতে পারলে?

হ্যাঁ স্যার!

বেশ বেশ! আসানসোল পৌছে গেছো?

হ্যাঁ স্যার!

তাহলে তো সবই ঠিকঠাকই করেছো। ফোন করছো কেন? কোন প্রবলেম?

হ্যাঁ স্যার একটা প্রবলেম হয়েছে।

মালিক একটু অবাক। কি আবার প্রবলেম হলো।

স্যার এই দোকানে চা পাওয়া যায়না, কেবল কফি। আমি কি কফি খেতে পারি, স্যার?

খান স্যার

স্কুলের ইতিহাস পাঠক্রম নিয়ে আমাদের দেশে এখন অনেক তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা। তাদের মত হলো স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে স্কুল আর কলেজের ছাত্ররা ইতিহাসের বইতে শুধু মুঘল আর অন্যান্য মুসলমান রাজাদের কাহিনী পড়ে।  হিন্দু সাম্রাজ্য এবং হিন্দু রাজাদের কথা দেশের ছাত্রদের  সেরকম ভাবে কিছুই পড়ানো হয়না। উত্তর ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য, দক্ষিণের চোলা বা বিজয়নগর, বাংলার সেন বা পাল বংশ এমন কি শিবাজীর মাড়াঠাদের নিয়ে আমাদের স্কুলের বা কলেজের ইতিহাসের বইতে সেরকম উল্লেখ নেই। সেখানে শুধু মুঘলদের এবং পরে ইংরেজদের ইতিহাস।

হিন্দুত্ববাদী বিক্রম সম্পথ ইতিহাসের এই বিকৃতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি অনেক ইতিহাসবিদ – যেমন রমেশচন্দ্র দত্ত, যদুনাথ সরকার ইত্যাদি – তাঁদের লেখা ইতিহাসের পাঠে হিন্দু রাজত্বের কথা লিখলেও প্রথম দিকের অসাম্প্রদায়িক (Left/Secular)ভারত সরকার ইতিহাসের পাঠ থেকে হিন্দু রাজাদের মোটামুটি বাইরে রেখেছেন। বিক্রম বলছেন তার ফলে প্রাচীন ভারতের অনেক হিন্দু রাজত্বের উজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের ছাত্রদের গোচরে আসছেনা।

তর্কের অন্যদিকে Left secular ইতিহাসবিদ রা – যেমন রোমিলা থাপার, রামচন্দ্র গুহ – প্রতিবাদ করে বলছেন মুসলমান invader দের আসার আগে ভারত নানা ছোটখাটো রাজাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে ছিল। মুঘলরা এবং পরে ইংরেজদের  শাসনের ফলে ভারত এক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, ভারতের হিন্দুদের সাথে তাদের মুসলমান বা ইংরেজ শাসকদের কোন বিবাদ ছিলনা ইত্যাদি।

এর মধ্যে আমি মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদের স্কুলজীবনে ইতিহাসে কি পড়েছিলাম তা মনে করার চেষ্টা করি।                 

আমাদের স্কুলে (সেন্ট লরেন্স, বালীগঞ্জ, কলকাতা) ইতিহাস পড়াতেন খান স্যার । সাধারণ দোহারা চেহারা, পরনে সাদা সার্ট আর ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুটো চোখ। ইতিহাস ছিল তাঁর passion ।

যতদূর মনে পড়ে আমাদের ইতিহাসের বইতে বহিরাগত মুসলমান শাসকদেরই প্রাধান্য ছিল বেশী। তবে রাণা প্রতাপ, শিবাজী, চন্দ্রগুপ্ত, অশোক দের কথাও পড়েছি। তবে তাদের মোটামুটি সকলকেই minor player হিসেবে ই দেখানো হতো। চোলা বা বিজয়নগর সাম্রাজ্য সম্বন্ধে তো আমাদের কিছুই পড়ানো হয়েছে বলে মনে পড়েনা।

আর প্রায় প্রত্যেক যুদ্ধেই হিন্দু রাজাদের হার হতো – এখনকার হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের ছাত্র – বিক্রম সম্পথ আর স্বপন দাশগুপ্তদের –  এই আপত্তি খুব একটা ভুল বোধ হয় নয়।  আমাদের বাংলার ইতিহাসেও সেন আর পাল বংশ এবং পরে বারো ভুঁইয়া দেরও দেখানো হয়েছে মুঘল বা ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরাজিত হিসেবে।

হিন্দু রাজাদের পরাক্রম, সাহস আর বিদ্রোহের কথা আমাদের স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে খুব বেশী নেই, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মারাঠাদের কথা, বাঙলায় সশস্ত্র আন্দোলন, সিপাহী বা নৌবিদ্রোহ কেও খুব একটা মাহাত্ম্য দেখানো হয়নি। গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের জন্যেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এই কথাই আমরা জানি।

এখন এই হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সশস্ত্র আন্দোলন এবং প্রাণ বিসর্জ্জন কে আমাদের ইতিহাসে যথাযোগ্য সন্মান জানানো হয়নি। স্বাধীনতার জন্যে ভগত সিং, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মত নেতাদের অবদানের নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে।

আমাদের ছোটবেলায় এই সব বিতর্ক আর বিবাদ ছিলনা।         

খান স্যার বড় ভালো পড়াতেন, আকবর, বীরবল, শিবাজী, আফজল খাঁ রা সবাই তাঁর পড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠতেন। তিনি হলদিবাড়ী বা পানিপতের যুদ্ধের কথা পড়াবার সময় আমরা তলোয়ারের ঝনঝন আওয়াজ, আহত সৈনিকদের আর্তনাদ, ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক যেন কানে শুনতে পেতাম। নিজেকে আমি মাঝে মাঝে নিজেকে সেই যুদ্ধের মধ্যে এক অনামী সৈনিক বলেও ভেবেছি।  


খান স্যারের সবই ভালো ছিল, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ আমরা পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছি কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দুমদাম প্রশ্ন করে বসতেন। একটু অমনোযোগী হলেই আমরা ঠিক ওনার কাছে ধরা পড়ে যেতাম।

তো একবার মনে পড়ে ক্লাসে বারো ভুইঁয়া দের সম্বন্ধে পড়াচ্ছেন খান স্যার। আমি সেদিন তৈরী হয়ে আসিনি, তাই খান স্যারের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না, পাছে আমায় কোন প্রশ্ন করে বসেন। খান স্যার বুঝতে পেরে আমায় বল্লেন “ইন্দ্রজিৎ, তুমি তো ভৌমিক, তাই না? তার মানে তুমি নিশ্চয় কোন বারো ভুঁইয়ার বংশধর। আচ্ছা, তুমি বলো তো…

সব্বোনাশ!

যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই!  

ভৌমিক হয়ে জন্মাবার জন্যে বেশ দুঃখ হয়েছিল সেদিন। ঘোষ বোস মিত্র বা মুখুজ্যে বাঁড়ূজ্যে হলেও এই বিপদে পড়তে হতোনা আমায়।

ডঃ বীরেন বসু

ছোটবেলায় যে কোন কারণেই হোক আমার মাঝে মাঝেই অসুখ হতো।  জ্বর, পেটব্যথা, কাশি, এই সব।  বোধহয় immunity কম ছিল, তাই ।  

অসুখ হলে স্কুলে যেতে হতোনা, সেটা ওই বয়সে ভালোই লাগত অবশ্য, কিন্তু সারাদিন বাড়িতে ঘরে শুয়ে থাকাও বেশ কষ্টকর। ।  মা সকাল দশটায় অফিস চলে যেতেন, তার পর সন্ধ্যায় মা না ফেরা পর্য্যন্ত সারাদিন আমি জ্যেঠিমা আর কাকীমাদের হেফাজতে। মাথা ধুইয়ে দেওয়া, থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখা, ওষুধ খাওয়ানো, এসব তো ছিলই, তাছাড়া সংসারের নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও দিনের মধ্যে মাঝে মাঝেই তাঁরা আমার শয্যার পাশে বসে খানিকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে যেতেন । অসুখের দিনগুলোর স্মৃতির সাথে তাঁদের সেই স্নেহস্পর্শের স্মৃতি অবধারিত  মিশে আছে।

আর মনে পড়ে আমাদের গৃহচিকিৎসক ডঃ বীরেন বসুর কথা।  

আজকাল অসুখ হলে সবাই চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে যায়। কেননা সেখানে স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখানো ছাড়াও অনেক সুবিধে, পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে সেখানে নানা যন্ত্রপাতি আছে, তাছাড়া নার্সরা ও নানা কাজে সাহায্য করে। আজকাল কোন রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে রিসেপশনে রোগী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের ভীড়ের বহর দেখলে ভির্মি খেতে হয়। কিন্তু ভীড় থাকলেও বিশেষ করে শক্ত অসুখ হলে হাসপাতাল যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আর সেরকম শক্ত অসুখ না হলে আমরা আজকাল যাই ডাক্তারদের চেম্বারে। সেখানেও বেশ ভীড়, বহু রোগী। বিশেষ করে কোন নামী ডাক্তার হলে ভীড় আরও বেশী।

এই অভিজ্ঞতা কমবেশী আমাদের সকলের।

আমাদের ছোটবেলায় বাড়ীতে কারুর অসুখ হলে গৃহচিকিৎসক আসার (home visit) যে চল ছিল তা আজকাল প্রায় উঠেই গেছে।                    

আমাদের গৃহচিকিৎসক ছিলেন ডঃ বীরেন  বসু।   

উজ্জ্বলা সিনেমার উল্টোদিকে ওনার চেম্বার ছিল।  তার সাথে ছিল একটা Pharmacy  যার নাম ছিল ক্যালকাটা মেডিকাল হল।  আজ সেই উজ্জ্বলা সিনেমাও নেই, ক্যালকাটা মেডিকাল হলও নেই , সেখানে এখন বীরেন বাবুর ছোট ছেলে শিবাজীর চেম্বার।  শিবাজী এখন কলকাতায় একজন প্রথম সারির Urologist, তার চেম্বারে আমিও দুই একবার গেছি। বেশ রাত পর্য্যন্ত সেখানে বহু রোগীর ভীড়।

বীরেনবাবুর চেম্বার আমাদের বাড়ী থেকে বেশী দূরে না হলেও  আমার মনে পড়ে যে আমাদের ছোটদের অসুখ বিসুখ হলে বীরেনবাবু আমাদের বাড়ীতে এসেই দেখতেন। অসুখ হলে ওনাকে দেখাতে ওনার চেম্বারে কখনো গিয়েছি বলে মনে পড়েনা।

বীরেনবাবু থাকতেনও আমাদের বাড়ীর পিছনেই, ওঁর বাড়ীতে বা চেম্বারে গিয়ে একটা খবর দিলেই উনি  চেম্বার থেকে বাড়ী ফেরার পথে অথবা বাড়ী থেকে চেম্বারে যাবার পথে সময় করে ঠিক একবার আমাদের বাড়ীতে চলে আসতেন।              

বীরেন বাবুর ডাক্তার হিসেবে পাড়ায় খুব নাম ডাক ছিল। তিনি  প্রিয়দর্শন মানুষ ছিলেন,  সুন্দর হেসে কথা বলতেন, চমৎকার  ব্যবহার ছিল। ডাক্তারদের Home visit  করার সময় Bedside manners জানা খুব দরকার, সেই দিক দিয়ে বীরেন বাবু ছিলেন একজন আদর্শ গৃহচিকিৎসক। একদিকে হাসিখুসী অন্যদিকে রাশভারী, বীরেনবাবুর ব্যক্তিত্ব ছিল খুব আকর্ষনীয়। উনি এলেই বাড়ীতে একটা বেশ সোরগোল পড়ে যেতো।

একটা বড় চামড়ার ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকে উনি jযখন আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলতেন “কি গো, আবার কি অসুখ বাধিয়ে বসলে?” তখন মনে হতো ওনাকে দেখেই আমার অসুখ অর্দ্ধেক সেরে গেল।

ডাক্তারী ছাড়াও বীরেন বাবুর একটা সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিচয় ছিল, কংগ্রেসের টিকিটে তিনি ভোটে জিতে আমাদের ওয়ার্ড থেকে কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হয়েছিলেন একবার।  সেটা ছিল ওনার ব্যক্তিত্বের আর একটা দিক। তিনি তাঁর ওয়ার্ডে নানা জনহিতকর সামাজিক কাজের সাথে জড়িত থাকতেন।      

আমাদের ছোটবেলায় Antibiotic এর প্রচলন হয়নি। Mass produced ট্যাবলেট এর ব্যবহারও তখন  সে ভাবে শুরু হয়নি।       সেই সময় ডাক্তারেরা  নানা ওষুধ মিশিয়ে একটা মিক্সচার prescribe করতেন, যা ছিল একজন রোগীর  জন্যেই তৈরী,  ইংরেজীতে যাকে বলে customised and tailored…

বীরেনবাবু তাঁর প্যাডে মিক্সচারের প্রেসক্রিপশন  লিখে দিতেন, আমরা সেই  প্রেসক্রিপশন নিয়ে Pharmacy তে যেতাম। সেখানে কম্পাউন্ডার বাবু সেই প্রেসক্রিপশন এ অনেকক্ষণ ধরে ভুরু কুঁচকে চোখ বোলাতেন, যেন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পড়ছেন। তার পর বলতেন, “আধ ঘন্টা পরে ঘুরে এসো খোকা, তৈরী করতে সময় লাগবে!”

শিবাজীর কাছে গেলে অথবা কালীঘাট পোস্টাপিসের পাশে ওই রাস্তা টা দিয়ে এখনো যখন হেঁটে যাই, তখন সেই ক্যালকাটা মেডিকাল হলে গিয়ে মিক্সচার আনার কথা মনে পড়ে। একটা বোতলে লাল রঙ এর ওষুধ, বোতলের গায়ে কাগজ কেটে ডোজের মাপ দেওয়া থাকতো।

আজকাল আরও অনেক কিছুর সাথে মিক্সচার ব্যাপারটাও উঠে গেছে।

অনুগ্রহ নারায়ন ঠাকুর

পাটনায় রান্নার লোকদের বাবাজী নামে ডাকা হতো, কিন্তু মনোহরপুকুরে রান্নার লোকদের সবাই ডাকতো ঠাকুর নামে।

আমার ছোটবেলায় মনোহরপুকুরে ঠাকুর ছিল একজন বিহারী লোক, তার নাম  অনুগ্রহ নারায়ণ ঝা। তার দেশ বিহারের ছাপরা জেলায়, ছিপছিপে সুদর্শন চেহারা, ফর্সা, বড় বড় চোখ, নাকের নীচে মস্ত গোঁফ আর মাথায় একটা মস্ত টিকি। যখন ছোট ছিলাম তখন সুযোগ পেলে ঠাকুরের টিকি ধরে টান দিয়ে খুব মজা পেতাম।     আমায় খুব ছোট বয়স থেকে দেখার ফলে আমার প্রতি তার একটা বিশেষ স্নেহের ভাব ছিল, তাই টিকি ধরে টান মারলেও সে রাগ করতোনা, প্রশ্রয়ের হাসি হাসতো।

আমাদের পারিবারিক এ্যালবামে ঠাকুরের সাথে মনোহরপুকুরের ছাতে তোলা আমার অনেক ছোটবেলার ছবি এখনো রাখা আছে। পুরনো হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতির মতো সেই ছবি গুলোও এখন বিবর্ণ।

অনুগ্রহ নারায়ণ আমাদের বাড়িতে  বোধ হয় দশ বছরের ও বেশী কাজ করেছিল। ক্রমশঃ ধর্মভীরু আর বিশ্বাসী এই লোকটি আমাদের পরিবারের অংশই হয়ে যায়।

একবার মনে পড়ে ঠাকুর আমাদের সব ভাইবোনদের নিয়ে রাসবিহারী এভিনিউতে জলযোগের লাল দই খাওয়াতে নিয়ে যায়। সেই দোকানে দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটা খুব বড় অয়েল পেন্টিং টাঙ্গানো ছিল, আর সাথে লেখা ছিল “জলযোগের পয়োধি খাইয়া বড় তৃপ্তি পাইলাম!”

পয়োধি মানে কি লাল দই? এই প্রশ্নটা সেই ছোটবেলাতেই মনে আসে। আর মনে পড়ে ঠাকুরের পিছন পিছন এক বিকেলবেলা আমরা ভাই বোনেরা সবাই দল বেঁধে নকুলেশ্বর ভট্টাচার্য্য লেন দিয়ে নতুন পার্ক ছাড়িয়ে বিপিন পাল রোড দিয়ে হেঁটে চলেছি।  

ন’কাকার সাথে কিছু একটা বাদানুবাদ বা তর্কে জড়িয়ে পড়ে একদিনের মধ্যে আমাদের পরিবারের সাথে এতদিনের সম্পর্ক এক কথায় শেষ করে ঠাকুর দেশে ফিরে যায়। তার এই প্রখর আত্মমর্য্যাদাবোধের কথা ভাবলে এখনো বেশ অবাক লাগে।

অনুগ্রহ নারায়ণের ভাইয়ের নাম অনুরোধ নারায়ণ, দাদার জায়গায় সে পরে আমাদের বাড়ীতে কাজ করতে আসে কিছুদিনের জন্যে। সেও বেশ ফর্সা সুপুরুষ লোক ছিল, মাথাভর্ত্তি কালো চুল, হাতে উল্কি, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা, কানে মাকড়ি পরতো, তারও মাথায় টিকি। নিয়ম করে রোজ সন্ধ্যায় সে তুলসীদাসের রামায়ণ পড়তো মনে আছে।

অনুগ্রহ, অনুরোধ, কি সব নাম!

এই সব নাম দেখে মনে হয় ওদের বেশ শিক্ষিত পরিবার ছিল। ওদের আর কোন ভাই ছিল নাকি? কে জানে, থাকলে তাদের নাম নিশ্চয় অনু দিয়ে শুরু – অনুমান,অনুরাগ, অনুনয়, অনুকূল, কিংবা অনুভব এই সব হবে!

আমাদের বাড়ির কাজ ছেড়ে চলে যাবার কয়েক বছরের মধ্যে অনুগ্রহনারায়ণের ক্যান্সার হয়। চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় এসে সে আমাদের বাড়িতে কিছুদিনে জন্যে থেকেছিল। আশ্রয় দেবার সাথে সাথে বাবা কাকারা তার চিকিৎসাতে সাহায্য ও করে থাকবেন।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পথে মনোহরপুকুরে  কুঠুরী র মতো একটা  ছোট ঘর ছিল, আমরা বলতাম ঠাকুরের ঘর, সেই ঘরে মাথা নীচু করে কোন মতে ঢুকে শুয়ে পড়তে হবে, কেননা বসলেও মাথা দেয়ালে ঠেকে যেত।

সেই ঘরে চুপ করে শুয়ে থাকতো অনুগ্রহনারায়ণ ঠাকুর, মারণ রোগ তখন তার শরীরে বাসা বেঁধেছে, তার চেহারা শুকিয়ে প্রায় কঙ্কালের মতো, সারা মুখে ক্লান্তি, হতাশা আর জীবন শেষ হয়ে যাবার যন্ত্রণাবোধ। 

সেই সিঁড়ির ঘরের পাশ দিয়ে ওঠা নামা করার সময় আমার চোখাচোখি হতো তার সাথে, আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান কিন্তু পরিচিত একটা হাসি হাসতো ঠাকুর, তার সেই হাসিটা এখনো মনে পড়ে।  

সীতাদিদি

 ১

সীতা মনোহরপুকুরে কাজে এসেছিল চৈতীর বিয়ের এক মাস পর। মা কে জিজ্ঞেস করে জানলাম। তার মানে চল্লিশ বছর হয়ে গেল।

ক্যানিং লাইনে লক্ষ্মীকান্তপুরে সীতাদের গ্রাম। সেই ১৯৭২ সালে দুই মেয়ে কে নিয়ে সীতার জীবন সেখানে বেশ কষ্টের ছিল, কেননা তার বরের কোন কাজ বা উপার্জ্জন ছিলনা। ওর এক গ্রাম সম্পর্কে বোন অমলা মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীতে ঠিকে কাজ করত, সেই সীতা কে আমাদের বাড়ীতে প্রথম নিয়ে আসে।

অমলা কে মনে আছে, সে “র” বলতে পারতোনা। বোধহয় ওদের গ্রামে কেউই “র” বলেনা, সীতাও না। তাই তার নাম রমলা না অমলা এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সে বলতো, “না না অমলা নয় গো, আমি অমলা~”

তো এই অমলা একদিন সীতাকে গিয়ে বললো, “তোকে আর ঘরে বইসে থাকতি হবেনাকো। আমার সাথে চল্‌ দিনি, বওমাকে (বড়মা, মানে জ্যেঠিমা, মনোহরপুকুরের সর্ব্বময়ী কর্ত্রী) বইলে একেচি। ওই বাড়িতে তোর  কাজ হইয়ে যাবে।”

সেই যে সীতা এল আমাদের বাড়ীতে কাজের লোক হয়ে, কবে যে সে ধীরে ধীরে পরিবারের একজন হয়ে গেল, আমরা জানতে পারলামনা।

১৯৭৬ সালে সীতার বড় মেয়ে খুব অল্পবয়েসে দুর্ঘটনায় মারা যায়। পুপুরাণী র জন্মের পর (১৯৭৭) আমরা ১৯৮০ সালে Ironside Road এ shift করার আগে তিন চার বছর মনোহরপুকুরে ছিলাম। সেই সময় ছোট্ট পুপুকে প্রায় নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসত সীতা, আগলে রাখত সব সময়। বিকেল বেলা হলে “চল্‌ সীতাদিদি, দুধ আনতে যাই” বলে পাড়ায় এক গোয়ালার কাছে সীতাদিদির হাত ধরে দুধ আনতে যেত পুপু, কিংবা সন্ধ্যায় “চল্‌ সীতাদিদি, উটি বেলতে যাই” বলে ছাদে রান্নাঘরে গিয়ে আটা আর বেলনা নিয়ে খেলা করতো। পুপু তখন সবাই কেই “তুই” বলে ডাকতো, তাই সীতাদিদিও “তুই”।

বেশ ছিল সেই দিনগুলো।

পুপুর প্রতি সীতার বাৎসল্য আর স্নেহের ভাব টা এখনও খুব গভীর। পুপু এলেই সে তার কাছে এসে গায়ে মাথায় হাত বোলায়, “আয় সোনামণি, তোর চুল টা বেঁইধে দিই” বলে একটা চিরুণী নিয়ে তার পাশে এসে বসে। 

জ্যেঠুকে বড়বাবা বলে ডাকতো সীতা। তাঁর জীবনের শেষের কয়েকটা বছরে প্রাণ দিয়ে তাঁকে সেবা করেছে সে। জ্যেঠুর মৃত্যুর পর মনোহরপুকুরের বাড়ী বিক্রী হয়ে গেলে সীতা মার কাছে Ironside Road এ চলে আসে। এখন মার দেখাশোনার ভার তার হাতেই।

আত্মীয়স্বজন কেউ  Ironside Road এর বাড়ীতে এলে সীতার খুব আনন্দ হয়।   তাদের সবার আদর আপ্যায়ন করার ভার মা তার ওপরেই ছেড়ে দেন আজকাল। সে আমাদের বিশাল পরিবারের সবাই কে চেনে, নিজের লোকের মতোই সবার খোঁজখবর নেয়। আমি তো সীতার আতিথ্যের বহর দেখে বেশ অস্বস্তি তে পড়ে যাই মাঝে মাঝে। দরজা দিয়ে ঢুকেছি কি ঢুকিনি, সীতা শুরু করে দেয়। দাদাবাবু, চা করি? সিঙ্গাড়া নিয়ে আসব? নিমকি খাবে? কাল বানিয়েছি তোমার জন্যে। একটা রসগোল্লা দিই?

মাকে নিয়ে অসুস্থ ছোটকাকা বা মৃত্যুশয্যায় শায়িত জ্যেঠিমার সাথে দেখা করতে গেলে অবধারিত সীতাকে ও নিয়ে যেতে যাবে আমাদের সাথে। না নিয়ে গেলে তার মন খারাপ হয়। এতদিন থেকে দেখেছে তাদের, এক সাথে এতদিন থেকেছে, তাই এখন তাদের শেষ দেখা দেখতে সে যাবেনা তা কি করে হয়?

সীতার বয়েস এখন ষাট ছাড়িয়েছে। চল্লিশ বছর ধরে বাড়ীর কাজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে সে। এখন এই বয়েসে বেশী পরিশ্রম করার সামর্থ্য তার আর নেই। তার ওপরে বেশ কয়েক বছর তার diabetes হয়েছে, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। চোখেও কম দেখছে। সীতা কি এবার তার গ্রামে ফিরে গিয়ে ছোট মেয়ে, জামাই আর নাতি দের সাথে জীবনের বাকি দিনগুলো শান্তি তে কাটাবে? তার মাইনে টা আমি তাকে pension হিসেবেই দেবো বলে রেখেছি। চল্লিশ বছর নিষ্ঠা আর সততার সাথে কাজ করার পর এটুকু তো তার rightful due!

কিন্তু মুশকিল হলো সীতা আর তার গ্রামে ফিরতে চায়না। সেখানে পাকা বাড়ি নেই, বাড়িতে ঠান্ডা জল নেই, বোধহয় আলো পাখাও নেই। এতগুলো বছর শহরে কাটিয়ে তার অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। তাছাড়া যখন তার আরও বয়েস বাড়বে, শরীর আরও খারাপ হবে,  তখন গ্রামে চিকিৎসা হবে কিনা, তার মেয়ে জামাই আর নাতিরা তাকে ভালোবাসে খুব, ফোন করে প্রায়ই, কিন্তু ওদের কাছে ফিরে গেলে  তার প্রতি তাদের ব্যবহার কেমন হবে সে বিষয় ও তার সন্দেহ আছে।

তাছাড়া সে এখন আমাদের পরিবারের অংশ বলেই নিজেকে ভাবে, আমাদের ছেড়ে সে থাকবেই বা কি করে? আমরাই কি তাকে চলে যেতে বলতে পারবো কোন দিন?


————————-

পরিশিষ্ট

২০১৪ সাল থেকে সীতার আর কাজ করারা ক্ষমতা ছিলনা। ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হবার পরে তার শরীর ক্রমশঃ দুর্ব্বল হতে থাকে, চোখেও সে ভাল দেখতে পেতোনা। তখন তার মেয়ে সন্ধ্যা আর জামাই শ্রীমন্ত তাকে তাদের গ্রামে নিয়ে চলে যায়। আমি সীতাকে তার চিকিৎসার জন্যে নিয়মিত পেনশন এর টাকা পাঠাতাম। সীতার জামাই শ্রীমন্ত আমাদের বাড়ীতে এসে টাকা নিয়ে যেত, এবং প্রত্যেকবার আমাদের জন্যে তাদের বাগানের তরকারী আর পুকুরের মাছ দিয়ে যেতো।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর ২৫ শে সীতার মৃত্যু হয়। সন্ধ্যা আর শ্রীমন্ত খুব নিয়ম মেনে তার পারলৌকিক কাজ করেছিল।

সীতার পরলোকগত আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

প্রতিমা

সুভদ্রা একদিন আমায় Ironside এ নামিয়ে Forum এ কেনাকাটা করতে চলে গেছে, আমি বাড়ীতে ল্যাপটপে বসে কাজ করছি, এমন সময় হঠাৎ দরজায় বেল। এই ভর দুপুরে আবার কে এল?

 দরজা খুলে দেখি প্রতিমা।  

প্রতিমা আমাদের ফ্ল্যাটে দিনের বেলা ঠিকে কাজ করে। তাছাড়া রাত্রে সে মা’র ঘরে শুয়ে ঘুমোয়, দরকার পড়লে  উঠে মা’কে বাথরুমে নিয়ে যায়।   

সকালে আজ আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি, প্রতিমা সকালে এসে ঘর ঝাড়াঝুড়ি করে দিয়ে গেছে, কিন্তু ঘর মোছার আর সময় পায়নি। আমায় বাড়ীতে দেখে একগাল হেসে প্রতিমা বললো, “আমি দেখতে এলাম তোমরা বাড়ীতে আছো কিনা। ঘরটা মুছে দিয়ে যাই?”

অবাক হয়ে গেলাম। কি কাজের মেয়ে বাবা? এরকম দায়িত্ববোধ দেখা যায়না।

জবা আমাদের বাড়ীতে চব্বিশ ঘন্টার লোক, সে বললো, “প্রতিমাদি কাজ ছাড়া থাকতে পারেনা। শীতলা মন্দিরের কাছে যে বাড়ীতে ও কাজ করে, তারা মাসে মাত্র এক হাজার টাকা দেয় আর কতো কাজ করিয়ে নেয়। রোজ সকালে বাজার করা থেকে শুরু করে রোগী দেখা, ঘর ঝাড়পোঁছ সব হাসিমুখে করে।”

মা র কাছে রোজ রাত্রে এসে শোয় প্রতিমা, কিন্তু শুয়েও যেন তার ঘুম আসেনা। জবা ওকে বলে, “প্রতিমাদি’ তুই সারারাত এই বারান্দায় হেঁটে বেড়া, তোকে আর ঘুমোতে হবেনা।”

প্রতিমা রোজ পাঁচ ছয়টা বাড়িতে কাজ করে রাত্রে মা’র কাছে গিয়ে শোয়, রাত্রে দরকার মতো উঠে মা’কে বাথরুমে নিয়ে যায়। সকালে মা কে ভাল করে তেল মালিশ করে স্নান করিয়ে তার পরে গড়িয়াহাটে বাজার করে শীতলা মন্দিরের কাছে এক বাড়িতে কাজ করতে যায়।

রাত্রে মা’র কাছে থাকে বলে তার গ্রামের বাড়িতেও নিয়মিত যাওয়া হয়না। মাসে দুমাসে একবার কি দুবার যায় কেবল, ছেলেকে টাকা দিতে।

প্রতিমা এত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটে, তবু তার মুখে সবসময় হাসি। ওর শরীরে কি কোন ক্লান্তি নেই? কিছুদিন আগে তার মুখে একটা ঘা হয়েছিল অপারেশন করার পর মুখটা অল্প বেঁকে আছে, ক্যান্সার নয়তো?

না না, তা কি করে হয়? ক্যান্সার হলে কি আর এই খাটুনী সে খাটতে পারতো?

প্রতিমার বড় ছেলে সারদা চিট ফান্ডের এজেন্ট ছিল। সেই চিট ফান্ড ডুবে গেছে, চিটফান্ডের মালিক সুদীপ্ত সেন এখন জেলে। যাদের কাছ থেকে প্রতিমার ছেলে  টাকা নিয়েছিল, তারা এখন তার কাছ থেকে সেই টাকা ফেরৎ চাইছে। প্রায় পাঁচ লাখ টাকা সে কোথা থেকে ফেরৎ দেবে?

সারদার এরকম অনেক এজেন্ট টাকা ফেরৎ দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে শোনা যায়।

প্রতিমা তার ছেলেকে বলেছে তুই ভয় পাসনা, আমি রোজগার করে তোকে পাঁচ লাখ টাকা এনে দেবো।

অন্ধ ধোপা

মনোহরপুকুরে আমাদের ছোটবেলায় একজন ধোপা বাড়ী তে কাপড় নিয়ে আসত, তার একটা চোখ অন্ধ, সব সময় বোঁজা থাকতো – তাকে কি কারুর মনে আছে?

ছোটখাটো মানুষটি, কাঁধে একটা বিশাল ভারী কাপড়ের বস্তা নিয়ে সে সামান্য কুঁজো হয়ে আমাদের পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত।

আমাদের বাড়ীতে কাপড় দিতে আর নিতে সে আসতো সন্ধ্যাবেলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে   আলোর নীচে বারান্দায় এসে কাঁধ থেকে কাপড়জামার স্তূপ নামিয়ে সে উবু হয়ে বসতো। মা জ্যেঠিমা কাকীমা রা সবাই এসে নিজের নিজের কাপড় জামার হিসেব মিলিয়ে নিতেন।

ভালোকাকীমা র কাজ ছিল একটা মোটা ধোপার খাতায় সব হিসেব লিখে রাখা।

মাঝে মাঝেই হিসেব মিলতোনা।

তখন ওই ধোপা বেচারা  মা কাকীমাদের কাছে solid বকুনি খেতো। কাপড় কম হলে তো বটেই, এমন কি কাপড় কয়েকটা বেশী এসে গেলেও মা রা মনের সুখে তাকে বকতেন আর সে মুখ বুঁজে বকুনী খেয়ে যেত। “হাঁ মাইজী, নেহী মাইজী” ছাড়া তার মুখে কোন কথাও শুনিনি কোনদিন।

বাবুরাম সাপুড়ের সেই বিখ্যাত সাপের মতোই নিরীহ নির্ব্বিবাদী লোক ছিল আমাদের সেই অন্ধ ধোপা।

 ২

একবার ছোটকাকীমা দুই দিন পরে দানাপুর যাবেন, তাঁর একটা শাড়ী ধোপার কাছে পড়ে আছে, সেই শাড়ি টা তার এতদিনে দিয়ে যাবার কথা, কিন্তু সে আসেনি, আমার ওপর ভার পড়ল ধোপার বাড়ী গিয়ে সেই শাড়ী নিয়ে আসার।

খুঁজে খুঁজে এক পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে পৌঁছলাম ধোপার আস্তানায়। জায়গাটা হলো দেওদার স্ট্রীট। হাজরা রোড আর বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের মাঝামাঝি,  ডোভার রোড দিয়ে  ঢুকতে হয়।  

একটা অন্ধকার সরু গলি র দুই পাশে ঘন বস্তী, অন্ধকার হয়ে আসছে, রাস্তায় ম্লান আলো।  বাচ্চারা খেলছে, তাদের কলরব, সব মিলিয়ে একটা নোংরা, ময়লা পরিবেশ, এখানে আমাদের কাপড় কাচা হয়?

বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডের ওই upmarket locality র একদম পাশে ধোপাদের ওই বস্তী দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম মনে পড়ে।

শেষ পর্য্যন্ত সেই অন্ধ ধোপার ঘর খুঁজে পেয়েছিলাম। সে আমায় দেখে খুব লজ্জিত হয়েছিল, যতদূর মনে পড়ছে শরীর খারাপ বলে সে আসতে পারেনি আমাদের বাড়ি। ছোটকাকীমার শাড়ীটা আমায় সেদিন দিয়েছিল কিনা, অথবা পরের দিন দিয়ে এসেছিল কিনা তা আর এখন মনে পড়েনা।

কিন্তু সেই অন্ধ ধোপা কে ভুলিনি। তার নিজের থেকেও ভারী কাপড়ের বিশাল বস্তা নিয়ে ছোটখাটো মানুষটার অল্প কুঁজো হয়ে পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আমাদের বাড়ীর বারান্দায় মা কাকিমাদের সামনে উবু হয়ে বসে তার চুপ করে বকুনি খাওয়া, নোংরা বস্তীর মধ্যে তার অন্ধকার ছোট ঘরে হঠাৎ আমায় দেখে অপ্রস্তুত হওয়া, এই সব এখনো ছবির মতো মনের মধ্যে রয়ে গেছে। 

সুন্দর বাবু

আমাদের ছোটবেলায় পঞ্চাশের দশকে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ছোটদের গোয়েন্দা উপন্যাস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। জন্মদিনে আমরা এই সব বই (“যখের ধন”, “আবার যখের ধন”, “নীল পত্রের রক্ত লেখা”) উপহার পেতাম, আর গোগ্রাসে গিলতাম।

সেই সব উপাদেয় গল্পে  মোটাসোটা পুলিশ অফিসার সুন্দরবাবুকে তোমাদের মধ্যে যারা আমার সমবয়েসী তাদের মনে আছে  নিশ্চয়।  সেই পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু কে হেমেন্দ্রকুমার বেশ একটা কমিক (হাসির) চরিত্র করেই উপস্থিত করেছেন তাঁর গল্পে। তিনি জয়ন্ত আর মাণিকের বাড়ী তে এসে ডিমের “মামলেট” খেতেন আর কথায় কথায় “হুম” বলতেন। 

এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি আর এই সব বই পড়ে? বোধহয় না।

আমার এই লেখাটি অবশ্য অন্য একজন সুন্দরবাবুকে নিয়ে।

কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছিলাম JEE Entrance Application form এর সাথে ছবি তে অনেকে নানা ভঙ্গী তে তোলা নিজের সেলফি পাঠিয়েছে, সবাই নানা ড্রেসে। চকরা বকরা সার্ট , মাথায় টুপি, চোখে সান গ্লাস। কেউ হাসছে কেউ নাচছে, কারুর মুখে সিগারেট…

তাদের এই সব ছবি দেখে কর্তাব্যক্তিরা যাকে বলে থ।

এসব কি হচ্ছে টা কি? 

আমরা তো college application এর পাসপোর্ট সাইজের ছবি স্টুডিও থেকে  তুলিয়ে পাঠাতাম। সেই ছবি তে সাধারণতঃ আমাদের শুধু গম্ভীর গোমড়া মুখ। কদাচিৎ এক চিলতে হাসি।

দিন কাল কত পালটে গেল, ভাবা যায়না।

আমাদের ছোটবেলায়  বাড়ীর কাছে হাজরা  রোড আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোডের মোড়ের দক্ষিণ পূর্ব্ব কোণে একটা বিরাট বাড়ির দোতলায় একটা স্টুডিও ছিল, তার নাম সুন্দর স্টুডিও।  সেই স্টুডিও তে আমরা ছোটবেলায় এবং বড় হয়ে ফটোও তুলতে গেছি অনেকবার। ছোটবেলায় পারিবারিক অনেক ফটো সেই স্টুডিও তে তোলা হয়েছে, তার পরে কলেজ ভর্তি বা চাকরীর application এর জন্যে পাসপোর্ট ফটো দরকার হলে ওখানেই গিয়েছি।

হাজরা মোড়ে মানুষের ভীড় ট্রাম বাস গাড়ীর ব্যস্ততার মধ্যে ওই বিশাল বাড়ীটার কথা বেশ মনে  পড়ে।  বাড়ীর তলায় ফুটপাথে  জুতো পালিশওয়ালারা সারি সারি বসে থাকতো।  আর টাইপরাইটার মেশিন নিয়ে বসে খুব মন দিয়ে বেশ কিছু মাঝবয়েসী চশমা পরা লোক ভুরু কুঁচকে কাগজ দেখে দেখে ঠকাঠক শব্দ করে টাইপ করতো।  আর ছিল অনেক খবরের কাগজ আর পত্রপত্রিকার স্টল, সেখান থেকে প্রায়ই সাপ্তাহিক  দেশ পত্রিকা কিনেছি।  তাছাড়া ছিল একটা সরবতের দোকান।  গরমকালে সেখানে ঠান্ডা বরফ মেশানো লেবু সরবত স্ট্র দিয়ে চোঁ চোঁ করে খেয়ে তেষ্টা মিটিয়েছি অনেক।   

বাড়ীটার ওপরে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজীতে SUNDAR STUDIO লেখা বিশাল হোর্ডিং, অনেক দূর থেকে চোখে পড়ত।

 ষাটের দশকে যখন প্রথম নিজের ক্যামেরা দিয়ে ফটো তোলা শুরু করি, তখন ফিল্ম ডেভেলপ আর প্রিন্ট করাতেও আমি সেখানে প্রায়ই যেতাম। কাছাকাছি সেই সময় আর কোন স্টুডিও ছিলনা।

সরু অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে দোতলায় উঠে স্টুডিওর দরজা। ঢুকেই একটা ঘর, সেখানে স্টুডিওর মালিক এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের অফিস। ঘরটা বেশ সুন্দর সাজানো, customer  দের বসবার জন্যে সোফা, দেয়ালে এক সুন্দরী লাস্যময়ী যুবতীর অনেক হাস্যমুখী ছবি টাঙানো।

উচ্চারণে একটু টান থাকলেও ভদ্রলোক বাংলাটা মোটামুটি ভালই বলতে পারতেন। তাঁর বেশভূষা দেখলে তাকে বেশ সৌখীন লোক বলেই মনে হতো। ছোটখাটো কিন্তু বেশ ফিটফাট চেহারা, ব্যাকব্রাশ করা চুল, পরিস্কার ইস্ত্রী করা জামাকাপড়, গলায় একটা রঙ্গীন স্কার্ফ, পালিশ করা চকচকে জুতো। ফটো তোলা থেকে শুরু করে ল্যাবের কাজ সব তিনি একাই করতেন মনে হয়, তাঁর কোন assistant কে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

স্টুডিওর ওই ঘরটার আর একটা দরজা ছিল বাড়ির ভেতরে যাওয়ার। সেখানে একটা পর্দা টাঙ্গানো থাকত। মাঝে মাঝে সেই পর্দা সরিয়ে এক মোটাসোটা মহিলা  ভেতরে ঢুকে ভদ্রলোকের সাথে বেশ ঝগড়ার বা আদেশের ভঙ্গিতে কথা বলতেন মনে আছে। তাঁর সাথে পায়ে পায়ে একটা গোলগাল বাচ্চা ছেলেও আসত। সেও মার সাথে বাবার দিকে বেশ একটা বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকাতো, যেন মার সাথে সেও বাবা কে কিছুটা বকুনী দিতে পারলে খুসী হয়।

মা আর ছেলে কে দোকানে customer দের সামনে দেখলে ভদ্রলোক স্পষ্টতঃই বেশ অপ্রস্তুত হতেন। নীচু গলায় বার বার হিন্দী তে বলতেন, ঠিক আছে, ভেতরে যাও, আমি আসছি। কিন্তু ভদ্রমহিলা তাঁর কথা শেষ না করে যেতেন না।

একবার আমি আর আমার ভাই খোকন ওই দোকানে বসে আছি, এমন সময় সেই ভদ্রমহিলার প্রবেশ। খোকন আমায় ফিসফিস করে বললো সুন্দরবাবুর বৌ, বুঝলি?

সুন্দরবাবু? সে আবার কে?  আমি একটু ব্যোমকেই গেলাম।

তার পর বুঝলাম ও হরি, খোকন স্টুডিওর নাম থেকে ওই পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের নাম দিয়েছে সুন্দরবাবু। 

দেয়ালে টাঙানো ছবির ওই সুন্দরী লাস্যময়ী যুবতী ইনিই নাকি?  মুখের মিল আছে সন্দেহ নেই। খোকনের observation  যথারীতি অব্যর্থ এবং নির্ভুল! 

এক সময় এই ছবির মেয়েটির প্রেমে পড়ে একে বিয়ে করেছিলেন সুন্দরবাবু, এখন এত বছর পরে সে মেয়েটি হারিয়ে গেছে, সে প্রেমও বোধ হয় আর নেই, এখন শুধু গঞ্জনা আর কথা কাটাকাটি।

তার পর বহুদিন কেটে গেছে।

যতদূর মনে পড়ে আশির দশকের প্রথম দিকে বাজারে Colour film আসার পর সুন্দরবাবুর ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। ততো দিনে তাঁর ছেলে বেশ বড়ো আর লায়েক হয়ে গেছে। শেষের দিকে গেলে মাঝে মাঝে সেই ছেলেকেই বাবার জায়গায় কাউন্টারে বসতে দেখতাম। তার পর কালের নিয়ম মেনেই সে দোকান উঠে গেছে।

এখন এই  Digital Photography র যুগে এসে মাঝে মাঝে যখন  album খুলে সেই পুরনো Black and white ফটো গুলো দেখি, তখন সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে, আর সুন্দরবাবুর গলায় রঙ্গীন স্কার্ফ ফিটফাট চেহারা আর বাইরের লোকের সামনে বৌয়ের গঞ্জনা খেয়ে অপ্রস্তুত মুখটাও ভুলতে পারিনা।

—————

সাথের দুটো ছবি সুন্দর স্টুডিও তে তোলা।

প্রথম টা মা’র সাথে আমি –   ছেলেকে বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে মা নিয়ে গেছেন ছবি তোলাতে।  তখনকার দিনে এই ধরণের ছবি তোলার চল ছিল।  এখন তো আর স্টুডিওতে যাবার দরকার পড়েনা।  বাড়ীতেই মা বাবারা তাঁদের শিশুদের ইচ্ছেমতো ছবি তুলে নিতে পারেন। 

দ্বিতীয় ছবিতে দুই জ্যাঠতুতো দিদির সাথে আমি।  লক্ষ্য করলে দেখবে তিনজনে তিন দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হয় আমাদের সামনে আমাদের তিন মা আমাদের direction দিচ্ছেন,  সোজা হয়ে বসো, হাসো, সামনের দিকে তাকাও, ইত্যাদি।     

সুন্দরবাবু বেশ ভালো  ছবি তুলতেন, স্বীকার করতেই হবে।

নয় নম্বর

আমাদের বাড়ীটা ছিল মনোহরপুকুর রোডের  ঠিক ওপরে, সেখানে দোতলায় উত্তর দিকে রাস্তার দিকে মুখ করা একটা ছোট বারান্দা ছিল, সেখানে  দাঁড়ালে নীচে রাস্তায় একটা চলমান জীবন চোখে পড়তো।  সেই বারান্দাকে আমরা উত্তরের বারান্দা বলতাম। 

বিশেষ করে বর্ষা কালে তুমুল বৃষ্টি হলে বাড়ী থেকে বেরোতে পারতামনা, আর আমাদের বাড়ীর ঠিক সামনে চট করে জল জমে যেতো। বর্ষা ভেজা সেই বিকেলগুলো আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জমা জলের মধ্যে ছাতা মাথায় হাঁটু পর্য্যন্ত কাপড় তুলে লোকজনের যাতায়াত আর ঘন্টি বাজানো হাতে টানা রিক্সা দেখতাম।

পূজোর পরে কাছাকাছি পাড়ার যত বিসর্জ্জনের ঠাকুর ট্রাকে করে আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে চলে যেতো, সেই সব আলো ঝলমলে ট্রাকের আগে আর পিছনে বহু লোক নাচতে নাচতে যেতো। তাদের সাথে থাকতো প্রচন্ড আওয়াজের প্যাঁ পোঁ ব্যান্ড পার্টি। খুব আস্তে আস্তে অনেকক্ষণ ধরে যেত তারা, আমাদের বারন্দায় বাড়ীর সকলে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একের পর এক ঠাকুর যেতো, দূর থেকে তাদের প্যাঁ পোঁ আওয়াজ পেলেই  ভাই বোনদের মধ্যে কেউ আমাদের সবাই কে ডাকতো “ঠাকুর আসছে ঠাকুর আসছে…” আর তাই শুনে আমরা সব কাজ ফেলে হুড়মুড় করে ছুটে উত্তরের বারান্দায় চলে যেতাম।

আর মনে পড়ে দিবারাত্র সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতার কথা।

আমাদের ছোটবেলায় পাড়ার ক্লাব সাথী সংঘের পরিচালনায়  দিবারাত্র সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা হতো । কে সব চেয়ে বেশী দিন অবিরাম সাইকেল চালাতে পারে। যে সব থেকে বেশী দিন সাইকেল এর ওপর থাকবে তার জন্যে বোধ হয় পাঁচশো টাকা  পুরস্কার ছিল। পাঁচশো টাকা সেই সময় অনেক টাকা। 

সেই সাইকেল চালানোর রুট টা সাথী সঙ্ঘ থেকে শুরু হয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়ে সতীশ মুখার্জ্জী রোড, রাসবিহারী এভিনিউ, লেক মার্কেট হয়ে দেশপ্রিয় পার্ক দিয়ে ল্যান্সডাউন ধরে আবার সাথী সঙ্ঘের পাশ দিয়ে মনোহরপুকুর রোড ধরত।

প্রথম চব্বিশ ঘন্টা সবাই বেশ চটপট তাড়াতাড়ি সাইকেল চালাত, তাদের তখন প্রচুর এনার্জি।  কিন্তু আটচল্লিশ ঘন্টা হয়ে গেলে ক্রমশঃ সবাইকে বেশ ক্লান্ত আর নির্জীব দেখাত, বাড়ির সামনে দিয়ে তারা যাবার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা বেশ উৎসাহের সাথে তাদের দেখতাম।

প্রত্যেকের জামায় কাগজে একটা করে নাম্বার লাগানো থাকতো। নয় নম্বর যার, সেই লোকটা ছিল আমার ফেভারিট। মধ্যবয়েসী, কিছুটা ভারী চেহারা, গায়ের রং কালো, কেন জানিনা আমার ইচ্ছে ছিল সেই জিতুক।

তিন চার দিন এর পর থেকে অনেকেই আর পারতোনা, যে দুই তিন জন তখনো ধুঁকতে ধুঁকতে কোনমতে সাইকেল চালাত, তাদের জামায় এক টাকা দু’ টাকার বেশ কিছু নোট পিন দিয়ে আটকানো থাকত। কারুর কারুর জামায় পাঁচ দশ টাকাও শেষের দিকে আটকানো দেখেছি।  তাদের সাথে একদল লোক হাতে জলের বোতল নিয়ে পাশে পাশে হেঁটে যেতো, সাইকেলে বসেই তারা এক হাতে বোতল ধরে ঢকঢক করে জল খেত।

রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসা পর্য্যন্ত আমি ওদের কথা ভাবতাম। ওরা কি রাতেও সাইকেল চালাচ্ছে? ওদের কি ঘুম পায়না? খাওয়া, বাথরুম যাওয়া এই সব কখন কি করে করে ওরা? ক্লাবের লোকেরা কি ওদের পিছন পিছন ঘুরে ঘুরে দেখে ওরা সাইকেল চালাচ্ছে না সাইকেল থেকে নেমে বিশ্রাম নিচ্ছে? 

নয় নম্বর সেবার জিততে পারেনি, সে দ্বিতীয় হয়েছিল। আট নম্বর তাকে হারিয়ে প্রথম হয়েছিল মনে আছে। আট নম্বর ছেলেটার বয়স কম, পেটানো চেহারা, তার চোখে মুখে প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাস। তাকে হারানো নয় নম্বরের মতো একজন মাঝ বয়েসী লোকের কম্মো নয়। তবু নয় নম্বর দ্বিতীয় হলেও সে আমার হিরো ই থেকে গিয়েছিল কোন কারণে। 

ওদের দুজনকে মালা পরিয়ে কাঁধে চাপিয়ে হৈ হৈ করে খুব ঘোরানো হয়েছিল মনে পড়ে।

বেশ কিছুদিন পরে আমি মা’র সাথে কোথায় যেন যাচ্ছি, হঠাৎ মনোহরপুকুর ল্যান্সডাউনের মোড়ে  রাস্তায় সেই নয় নম্বর ভদ্রলোক এর সাথে দেখা। তার পরনে তখন সাধারণ পাজামা পাঞ্জাবী,  চটি পরে এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে তিনি হাঁটছেন।

আমি তাকে চিনতে পেরে উত্তেজিত হয়ে মা’কে বলতে যাচ্ছিলাম, “মা  দ্যাখো, দ্যাখো – নয় নম্বর!”

কিন্তু ভেবে দেখলাম না বলাই ভালো।

সেই দশ বারো বছর বয়েসে আমি তখন মা’র আঁচলের তলা থেকে ক্রমশঃ আস্তে আস্তে  বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে আসছি। স্কুলে যাই, পাড়ায় বন্ধুদের সাথে গলিতে  মাঠে পার্কে ক্রিকেট ফুটবল খেলি।  পাড়ার পূজোয় ভলন্টিয়ারের ব্যাজ পরে ঘুরে বেড়াই, এই সব আর কি। তখন থেকেই ক্রমশঃ বুঝতে পারছি যে মা’র ভাল লাগা আর আমার ভাল লাগার হামেশাই মিল হচ্ছেনা। দু’জনের জগত যেন কেমন আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

আমার জগতে গ্যারী সোবার্স, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,  চূণী গোস্বামী আর  মা’র জগতে সত্যনারায়ণ, নীলষষ্ঠী আর শিবরাত্রির উপোস, কোষাকুষি, গঙ্গাজল, ফুল বেলপাতা, সিন্নী আর পায়েস।

সাইকেল প্রতিযোগিতা সম্বন্ধে মা কোন খবর রাখেননা,  কে জিতলো কে হারল তা জানবার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ও মা’র নেই।

নয় নম্বর শুনে  তাঁর মনে হতে পারে ছেলে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছে, ব্যাপার কি? মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি?  তারপর জোর করে আমায় চেপ্পে ধরে কোন মাথার ডাক্তারকে দেখাতে নিয়ে যাবেন হয়তো,  সেই বয়সে শরীরে সামান্য  জ্বরজারি হলেই ডাক্তার দেখানো বাধ্যতামূলক ছিল আমার জন্যে। 

এই সব ভেবে তাই চুপ করেই রইলাম।

আমার পাশ দিয়ে সেই নয় নম্বর সাইকেল চালক ভদ্রলোক তাঁর বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে চলে গেলেন।  আমি সতৃষ্ণ নয়নে আমার সেই ট্র্যাজিক হিরোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।  হিরোসুলভ চেহারা তাঁর একেবারেই নয়,  বরং উল্টোটাই।  গায়ের রং মিশমিশে কালো, তার ওপরে বেশ মেদবহুল শরীর, সামান্য ভুঁড়ি।  কিন্তু কি করে যে তাঁর প্রতি আমার মনে এক আশ্চর্য্য ভাল লাগা তৈরী হয়েছিল তা এখনো ভাবলে অবাক লাগে।

আরও আশ্চর্য্য এই যে এতগুলো বছর কেটে গেলেও সেই নয় নম্বরের স্মৃতি আমার মনে এখনো অমলিন।

হরিকুমার বাবু  

মনোহরপুকুর রোডে আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাড়ী থেকে কিছুদূরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হরিকুমার বাবু।তখন হরিকুমার বাবু পাড়ায় মোটামুটি চেনা মুখ। এদিকে ওদিকে পূজো বা পাড়ার অন্য নানা বারোয়ারী অনুষ্ঠানে মাতব্বরি করতে দেখা যেত তাঁকে, যদিও কারুর কাছ থেকেই তেমন পাত্তা পেতেন না।

একটু অসংলগ্ন কথাবার্ত্তা বলতেন, মাঝে মাঝে টলতে টলতে হাঁটতেন, চোখ দুটো প্রায়ই লাল হয়ে থাকতো। নেশা করতেন হয়তো। রাইটার্সে বোধহয় একটা পিয়ন বা বেয়ারার কাজ করতেন।    

পাড়ায় পাগলাটে বলে তাঁর দুর্নাম ছিল। তবে নিজের মত থাকতেন, কারুর সাথে কোন দুর্ভাব বা ঝগড়াঝাঁটি ছিলনা। সবাই যতটা পারে তাঁকে এড়িয়েই চলতো।

এই হরিকুমার বাবু আমাদের বাড়ীতে মাঝে মাঝেই আসতেন।

মার মুখে শুনেছি ওনার পরিবার ছিল পাটনায়, আমাদের পরিবারের  পাটনার শাখার সাথে ওনার পরিবারের সেখানে এক জ্ঞাতি সম্পর্ক তৈরী হয়। যেখান থেকে ভাগ্যের ফেরে যুদ্ধের সময় কলকাতায় এসে তিনি মনোহরপুকুরে আমাদের বাড়ীতে উঠেছিলেন। পরে পাশেই একটা ছোট ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করেন।

আমাদের ছোটবেলায় ওনাকে একটু দুঃখী একলা মানুষ বলে মনে হতো আমার। পরে বড় হয়ে বুঝেছি, উনি ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বহীন, হেরে যাওয়া মানুষ। সবার উপহাস, অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র।  

চালচুলো হীন, আপাতদৃষ্টিতে এই একাকী অসহায় মানুষটির জন্যে আমার মনে কোথাও একটা সমবেদনা আর সহানুভূতি অনুভব করতাম মনে পড়ে। কারুর ভালবাসা পেলে হয়তো তাঁর জীবনটা পালটে যেতো। কিন্তু তাঁর জীবনে ভালবাসা নিয়ে কেউ আসেনি।     

এই পৃথিবীতে এই ধরণের হতভাগ্য লোক অনেক আছে, আমাদের হরিকুমার বাবু ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।   

সারা জীবন একলা কাটিয়ে গিয়েছিলেন হরিকুমার বাবু, তাঁর মৃত্যুও হয় সকলের অজান্তে, নিভৃতে। অনেক দিন থেকে তাঁর ঘর বন্ধ ছিল। ভেতর থেকে মৃতদেহের দুর্গন্ধ পেয়ে পাড়ার লোকেরা পুলিশ ডেকে তাঁর দরজা ভেঙে ঢুকে তাঁর মৃতদেহ  উদ্ধার করে তাঁর সৎকার করে।

গোড়ালী পর্য্যন্ত নেমে আসা ঢলঢলে প্যান্ট, ময়লা বুশসার্ট আর ছেঁড়া চটি পরে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা আসতেন হরিকুমার বাবু। চোখ দুটো অল্প লাল, কথা একটু জড়ানো, হাঁটার ভঙ্গি টাও কেমন যেন একটু টলমলে।

তিনি যে এসেছেন তা কেউ গ্রাহ্যই করতোনা, কেউ বসতে বলতনা তাঁকে, কেউ কথাও বলতোনা তাঁর সাথে। তিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে কি বলতেন কেউ শুনতো না

জ্যেঠিমা কে কিছুটা কুণ্ঠিত ভঙ্গী তে বলতেন “বৌদি, একটু চা হবে?”

তার পর বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা একা চা খেয়ে কাপ টা টেবিলে রেখে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যেতেন, দেখে ওনার জন্যে বেশ মায়াই হতো।

বাংলা দেশের কোন গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে হরিকুমার বাবুর নামে পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত সুধা নামে একটি মেয়ে। সেই চিঠি ওনার জন্যে রেখে দেওয়া হতো বারান্দায় Book case এর ওপর। খোলা পড়ে থাকা গোটা গোটা মেয়েলী অক্ষরে লেখা সেই পোস্টকার্ডের চিঠিতে কৌতূহলবশতঃ আমরা অনেকেই চোখ বোলাতাম, অস্বীকার করবোনা। 

“শ্রীচরণেষু  হরিকাকা” দিয়ে শুরু, আর “ইতি প্রণতা সুধা” দিয়ে শেষ, সেই চিঠি গুলো জুড়ে থাকতো অনেক দুঃখের কথা। হয়তো কাকার কাছে নিজেদের অবস্থার কথা জানানো র মধ্যে কিছু সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল সুধার। চিঠির মধ্যে কিছুটা হলেও একটা আর্তি আর প্রার্থনার সুর ধরা পড়তো, আমার মনে পড়ে।       

হরিকুমার বাবু আমাদের বাড়ী এলে তাঁকে সেই চিঠি দেওয়া হতো। তিনি মন দিয়ে সেই চিঠি পড়তেন। তার পর কেমন যেন উদাস হয়ে যেতেন। চুপ করে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন বেশ কিছুক্ষণ। কি ভাবতেন কে জানে? 

মনোহরপুকুরের বাড়িতে কাটানো সেই সব ছেলেবেলার দিনগুলোর স্মৃতির মধ্যে হরিকুমার বাবু তাঁর জায়গা করে নিয়েছেন।